৮. এক দুপুরে অফিসে ফোন

বেলা এক দুপুরে অফিসে ফোন করে; সে খুব রেগে আছে, বলে, দাদা, মা আর আমি যে বেঁচে আছি, ঢাকায়ই আছি, তা বোধ হয় তোমার মনে নেই।

আমি বলি, খুব মনে আছে।

বেলা বলে, এক বছরেরও বেশি হলে তুমি আমাদের দেখতে আসো নি, হয়তো এখন আমাদের চিনতেও পারবে না।

আমি বলি, একশো বছর পরে দেখলেও তোমাদের দুজনকে চিনতে পারবো।

বেলা বলে, চিনতে পারবে, তবে আমরা তোমার কী হই, তা মনে করতে পারবে না।

আমি বলি, তাও পারবো।

বেলা বলে, আমি তোমার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই, আজই, খুব দরকার।

আমি বলি, তারচেয়ে এখনই দরকারটা কী বলে ফেল।

বেলা বলে, দাদা, আমি তোমার ছোটো বোন, একমাত্র বোন, আমার দরকারের কথাটা কি আমি তোমার বাসায় এসে বলতে পারি না?

এমন সময় লাইনটা কেটে যায়, একের পর এক জরুরি ফোন আসতে থাকে; বেলা নিশ্চয়ই ফোন করে চলছে, আমি জরুরি ফোনে কথা বলতে বলতে বেলার কথা ভাবি, বেলা নিশ্চয়ই রেগে উঠছে, কিন্তু একের পর এক ফোন আসতে থাকে।

বেলা আধঘণ্টা পর আবার লাইন পায়, পেয়েই রেগে ওঠে, দাদা, লাইনটা কেটে গেলো, তুমিই তো আমাকে একটু ফোন করতে পারতে; তোমার লাইন পাওয়া যা কষ্ট, আর হাজারটা পরিচয় দিতে হয়।

আমি বলি, তোকে তো এজন্যেই বলেছিলাম আমলা হ, না হয়ে তুই বউ হওয়ার জন্যে পাগল হয়ে গেলি।

বেলা বলে, বুঝেছি তুমি আমাকে বাসায় যেতে বলবে না, তাই ফোনেই বলছি; কাশেমকে চট্টগ্রামে বদলি করে দিয়েছে, ওকে ঢাকায় রাখার একটু ব্যবস্থা করতে হবে। বেলা আরো যোগ করে, কাশেমকে তোমার মনে আছে কি না জানি না, কাশেম তোমার ছোটো বোনের স্বামী।

আমি বলি, ওর ঢাকায় থাকার কী দরকার?

বেলা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, এ তুমি কী বলছো, দাদা? কাশেম চট্টগ্রামে গেলে আমাকেও যেতে হবে, খোকাকে সেখানে ভর্তি করাতে হবে; আমি ঢাকা ছেড়ে যেতে পারবো না।

আমি বলি, চট্টগ্রামে তো মানুষেরাই থাকে।

বেলা বলে, আমি চট্টগ্রাম যেতে পারবো না, দাদা; তুমি একটু বলে দিলেই ওকে আর বদলি করবে না।

আমি বলি, আগে ক-বার বলেছি।

বেলা বলে, মাত্র দুবার, দাদা।

আমি বলি, আর বলতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না রে বেলা।

বেলা চিৎকার করে কাঁদে, দাদা, তুমি আমাদের ভালোবাসো না।

কাশেমকে বদলি করে দেয়া হয়েছে, ফেরাতে হবে; কিন্তু আমিই তো চাই আমাকে কোথাও বদলি করে দেয়া হোক, শহর ছেড়ে চলে যাই। আমাকে বদলি করে ঢাকার বাইরে পাঠানোর জায়গা নেই, পাঠালে দেশের বাইরে পাঠাতে হবে; আমি তা চাই না। ঢাকার বাইরে, বিলের ধারে বা নদীর পারে, হিজল বট নারকেল বনের ভেতরে কোনো উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক করে আমাকে বদলি করে দিলে কেমন হয়? আমাকে কি ওই পদে বদলি করা সম্ভব? সংস্থাপনের জালালউদ্দিন মিয়ার সাথে একবার আলাপ করে দেখবো? জালালউদ্দিন চাইলেই তো হতে পারে। জালালউদ্দিন কি আমার জন্যে এটা চাইতে পারে না? আমি কি দরখাস্ত লিখবো যে হুজুরের নিকট আমার এই আবেদন যে আমাকে বিলের ধারে বা নদীর পারে কোন একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক করিয়া বদলি করার আজ্ঞা হোক? বগুড়ায় সেই প্রধান শিক্ষককে আমি দেখেছিলাম, যার চুলের মসৃণতা দেখে আমার মনে হয়েছিলো তাঁর মতো সুখী যদি আমি হতে পারতাম, আমার আজো ইচ্ছে হয় তাঁর মতে, অবিকল তাঁর মতে, প্রধান শিক্ষক হতে। প্রধান শিক্ষকেরা কি সব সময় ইংরেজি আর্টিক্যল আর প্রিপজিশনের কথা ভাবেন? আমাদের প্রধান শিক্ষকও সব সময় ইংরেজি আর্টিক্যল আর প্রিপজিশনের কথা বলতেন, বগুড়ার প্রধান শিক্ষকও বারবার ইংরেজি আর্টিক্যল আর প্রিপজিশনের কথা বলছিলেন, আমার তাই হ’তে ইচ্ছে করছে; কিন্তু জালালউদ্দিন কি আমাকে বদলি করবে?

আমার বদলি হ’তে ইচ্ছে করছে, কিন্তু জালালউদ্দিন মিয়াকে আমি বলতে পারি না আমাকে বিলের ধারে বা নদীর পারে কোনো বিদ্যালয়ে বদলি করে দাও, জালালউদ্দিন মিয়া তা পারবে না, আমার পক্ষেও তাকে একথা বলা সম্ভব নয়; তবে দশ দিনের জন্যে আমাকে নিউ ইয়র্ক যেতে হচ্ছে, যদিও যেতে আমার ইচ্ছে করছে না। আমার ইচ্ছে করছে বিলের ধারে নদীর পারে যেতে; সেখানে কেউ আমাকে যেতে বলবে না, সেখানে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ নেই। আমার ভয় হয় বিমান পশ্চিমের দিকে উড়লেই হয়তো ডলির কথা মনে পড়বে, ডলিকে আট দশ ঘণ্টা ধরে ভাবতে হবে, ভাবতে আমার ইচ্ছে করছে না। আমার কি একটা দায়িত্ব পড়ে যাবে না হিথ্রোতে নেমে ডলিকে ফোন করা? তারপর ডলির ওখানে গিয়ে অন্তত একদিন থাকা? ফেরার পথে তার ওখানে গিয়ে ওঠা? এমন কি তাকে নিয়ে ঢাকায় ফেরা? হিথ্রো থেকে ফোন করার অর্থই কি হবে না যে আমি ডলিকে আনতে গেছি? এসবের কোনোটিই আমার ইচ্ছে করছে না। বিমানে উঠে আমি একটি বই পড়তে শুরু করি, বইটি পড়া যখন শেষ করি তখন বিমান হিথ্রোতে নামছে; নামার সময় আমি একটু ভয় পাই, আর তখন ডলিকে আমার মনে পড়ে। হিথ্রোতে নেমে আমি ডলিকে টেলিফোন করি না, এক ঘণ্টার মধ্যেই আরেকটি বিমানে নিউ ইয়র্কের দিকে উড়তে থাকি; এবং ফেরার সময়ও আমি হিথ্রোতে নেমে ডলিকে ফোন করি না, তার কথা আমার মনেই পড়ে না; শুধু বিমানটি যখন ভূমধ্য না আড্রিয়াটিকের এক কোণে এসে একবার লাফিয়ে ওঠে, তখন ডলিকে আমার মনে পড়ে। আবার বিমান মসৃণভাবে চলতে শুরু করলে ডলিকে আমি ভুলে যাই। আমার মনে পড়তে থাকে কোথাও আমার বদলি হওয়া দরকার, ঢাকা আর নিউ ইয়র্ক কোনোটিতেই আমার থাকতে ইচ্ছে করছে না, নারকেলগাছের নিচে টিনের ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে। অমন বাড়িতে আমি কখনো থাকি নি; নারকেলগাছের ছায়ায় আমার ঘুমোতে ইচ্ছে করছে। ঢাকায় নেমে আমি কি আরো একটি প্লেন ধরবো? প্লেন আমাকে কোথায় পৌঁছে দেবে? টিনের ঘরের দরোজায়? না, বিমানে করে টিনের ঘরের দরোজায় যাওয়া যায় না; হেঁটে যেতে হয়। আমি কি ঢাকায় নেমে হাঁটতে শুরু করবো? হেঁটে হেঁটে কোথায় যাবো? এর চেয়ে ভালো হয় বিমানটি কোথাও না নামলে; বিমানটি কি বছরের পর বছর আকাশে উড়তে পারে না? না, পারে না; বিমানটিকে নামতেই হবে; আর বিমানটি যা পারে, তা হচ্ছে ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে। আমি বিমানের সাথে চুরমার হয়ে যেতে চাই না; আমি নামতে চাই, কিন্তু নেমে কোথাও যেতে আমার ইচ্ছে করে না।

বেঁচে থাকতে আমার কেমন লাগছে? নিরর্থক? অর্থপূর্ণ? বিবর্ণ? চাঞ্চল্যকর? সফল? ব্যর্থ? সুখকর দুঃখভারাক্রান্ত? মধুময়? বিষাক্ত? কোনোটিই না। বেঁচে থাকতে আমার খারাপ লাগছে না; এমন মনে হচ্ছে না যে পৃথিবীটাকে বিদায় জানাই, কোনো নাইটিংগেলের লোকোত্তর গান শুনেও মনে হবে না মৃত্যুই এখন, যে-কোনো সময়ের থেকে, বেশি বরণীয়; আবার মরে যাওয়ার ভয়ে ভেতরটা হাহাকারও করছে না। ভেতরে আমি কোনো কান্না শুনি না। নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে মনে কি হচ্ছে জীবনকে আমি আর বইতে পারছি না? না; এমন মনে হচ্ছে না। জীবনকে কি খুব চাঞ্চল্যকর মনে হচ্ছে? তাও নয়। আমার কি জীবনটাকে আবার শুরু থেকে শুরু করতে ইচ্ছে করছে, মনে কি হচ্ছে যে সুযোগ পেলে ভুলগুলোকে সুন্দরভাবে সংশোধন করে নিতাম? তাও মনে হচ্ছে না। কোনো ভুলকেই সুন্দর করতে আমার ইচ্ছে করছে না, ভুলগুলোকে আমি ভুলই রেখে যেতে চাই। নারী থেকে দূরে থেকে কেমন আছি? কারো সাথেই জড়িয়ে থাকতে আমার ইচ্ছে করছে না। কোনো নারী দিনরাত আমার সাথে আছে, আমার ঘরে আছে, আমার সাথে খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছ, বাইরে যাচ্ছে, আমি ভাবতে পারছি না; কিন্তু কোনো নারীর সাথে যদি একবেলা, গভীরভাবে নিবিড়ভাবে কোমলভাবে প্রচণ্ডভাবে, কাটাতে পারতাম, খারাপ লাগতো না হয়তো। কিন্তু তাও আমি পারছি না। মিসেস হামিদউল্লাহর মুখটি আমার ভালো লাগে, আমি ডাকলে তিনি রাজি হবেন বলেই মনে হয়, এবং এক সন্ধ্যায় তাঁকে আমি ডাকি-খেতে ডাকি। খাওয়ার পর আমরা শোয়ার ঘরে গিয়ে বসি। আমি একটু পান করার প্রস্তাব দিলে তিনি আনন্দিত হন, তাঁর আনন্দটা দেখে আমি সুখ পাই। আমরা দুটি সুন্দর আসনে পাশাপাশি বসে, পান করতে থাকি; তার মুখটি আমার আরো ভালো লাগতে থাকে, তিনি একবার আমার হাতের ওপর হাত রাখেন, আমি তার হাত ধরে অনেকক্ষণ দেখি, আদর করি, আমার একটু কর্কশই লাগে; কিন্তু আমি আমার অনুভূতিটা প্রকাশ করি না; পান করতে করতে আমি তার মুখটি বাঁ-হাত দিয়ে ছুঁই, বারবার ছুঁই, তিনি তার মুখটি আমার কাঁধের ওপর রাখেন। আমি তার চুলে একবার মুখ রেখে ঘ্রাণ নিই; তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আমি তার ব্লাউজ আর অন্তর্বাস খুলি, এবং খোলা হলেই দুটি লম্বা তরল ঢোলা স্তন নাভি পর্যন্ত ঝুলে পড়ে। দেখে আমি ভয় পাই, আমার ঘেন্না লাগে, আমি হাত সরিয়ে আনি। তাকে আর ছুঁতে ইচ্ছে করে না; মনে হতে থাকে ছুঁলে আমার শরীর ভ’রে ঘা দগদগ ক’রে উঠবে, এখনই আমি কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হবো।

আমি বলি, আমি খুব দুঃখিত, এখনই আমার একটি মিটিং আছে।

আমি উঠে দাঁড়াই; মিসেস হামিদউল্লাহ খুব অসহায় বিব্রত বোধ করেন; স্তন দুটি গুটানোর চেষ্টা করে বারবার বিফল হতে থাকেন; আমার দিকে খুব করুণভাবে তাকান। আমি তাঁর স্তন দুটি ধরে গুটোতে সাহায্য করি; তিনি ও-দুটিকে বেঁধে ফেলে মাথা নিচু করে বসে থাকেন। আমি ড্রাইভারকে ডাকি। মিসেস হামিদউল্লাহ আমার দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে যান।

আমি আবার বলি, আমি খুব দুঃখিত।

মিসেস হামিদউল্লাহ কোনো কথা বলেন না। আমি বাথরুমে গিয়ে বারবার হাত ধুই। আমি সম্পূর্ণ নিষ্কাম হয়ে উঠি; যেনো আমি কখনো কামবোধ করি নি, ভবিষ্যতে কখনো করবো না।

মিসেস হামিদউল্লাহর কাছে আমি মনে মনে ক্ষমা চাইতে থাকি, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে থাকি;–তিনি অপমান করতে পারতেন আমাকে, গালে একটা শক্ত চড় কষিয়ে দিতে পারতেন, মুখে একদলা থুতু ছিটিয়ে দিতে পারতেন; বলতে পারতেন–আমার দু-দুটি স্বামী ছিলো, তারা আমার ভেতরে পাঁচটা ছেলেমেয়ে পয়দা করেছে, আমি কিশোরী নই যে তুমি একটা বুড়ো হাবড়া মুঠোর ভেতর দুটি কমলালেবু পাবে। কমলালেবুর কাল আমাদের সেই কবেই কেটে গেছে। আমি ক্ষমা চাইতে থাকি, এবং আবার বাথরুমে ঢুকি, ঝরনা খুলে দিই, দেয়ালে পানি ছিটোতে থাকি; মনে হয় মা, দরোজা ঠেলে বাথরুমে ঢুকে পড়বে, দু-হাত দিয়ে শিশ্ন ঢেকে আমি একবার বসে পড়ি। বসতে আমার কষ্ট হয়, বুঝতে পারি আমার উদর সেই আগের মতো নেই, ইচ্ছে করলেই আমি আর আগের মতো বসতে পারি না, উঠতেও পারি না। অনেক দিন ধরে আমি আমার শরীরটিকে ভালো করে দেখি নি; আয়নায় তাকিয়ে দেখি আমার গলকম্বল দেখা দিয়েছে, মাড়িতে হাত দিতেই তিন দাঁতের ডেনচারটি আঙুলের সাথে উঠে আসতে চায়। ঝুলে পড়া উদরটি আমাকে বেশ বিব্রত করে, পেশি টেনে সেটিকে আমি ঠিক করতে চাই, সেটি অনেকটা ভেতরে প্রবেশ করে, কিন্তু পেশির টান ছাড়তেই আবার ঝুলে পড়ে। মিসেস হামিদউল্লাহ যদি দেখতেন? তিনি খিলখিল করে হেসে উঠতেন না? লোমগুলো এমন শাদা হয়ে গেছে? মিসেস হামিদউল্লাহ যদি দেখতেন? আমি আমার দিকে তাকাতে সাহস করি না, হো হো করে হেসে উঠতে থাকি। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি, দাঁড়াতে পারি না। আমি অনেক বছর সোজা দাঁড়াই না? আমার মেরুদণ্ড নিচের দিকে এমনভাবে বেঁকে গেছে? কখন বাঁকলো? কীভাবে বাঁকলো? কেনো আমি টের পাই নি? আমি নগ্ন বাথরুম থেকে বেরোই, বেরিয়েই আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। এ-আয়নাটিতে পায়ের পাতা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এটা গলকম্বল? আমি গলার নিচের চামড়া নাড়তে থাকি, টেনে টানটান করি, ছেড়ে দিলেই চামড়া শিথিল হয়ে পড়ে। আমি দৌড়ে পাশের ঘরে যাই, আয়নার সামনে দাঁড়াই। এ-আয়নাটিতে আমাকে আরো বিকট লাগে, ধুলো জমে আছে ভেবে আমি আয়নাটি মুছতে থাকি, আমার গলার চামড়া ঝুলছে দেখে আমি ভয় পাই; আবার দৌড়ে পাশের ঘরে যাই। এ-ঘরের আয়নাটিতে আমার উদরটিকে ঠেলে বেরিয়ে আসা একটি পাথরের মতো দেখায়। আমি দুহাত দিয়ে উদর চেপে ধরে আমার ঘরে ফিরে আসি। আমি নগ্ন বসে পান করতে থাকি, এমন সময় টেলিফোন বেজে ওঠে।

ডলি বলে, শুনলাম তুমি লন্ডন হয়ে নিউ ইয়র্ক গেছো আর ফিরেছো, অথচ আমার কোনো খবর নাও নি?

আমি বলি, আপনি কে বলছেন?

ডলি বলে, তুমি কি মাতাল হয়ে আছো যে আমার গলা চিনতে পারছো না?

আমি বলি, হ্যাঁ, আমি একটু পান করছি, আপনি কে বলছেন?

ডলি বলে, আমি তোমার স্ত্রী, যদি তুমি তা মনে করো।

আমি বলি, না, জেনারেলের কাছে আমি আর কাউকে ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দিতে পারবো না, তার সঙ্গে আমার আর সম্পর্ক ভালো নেই।

ডলি বলে, আমি জানি তুমি জেনারেলের পিম্প, কিন্তু আমি তা চাই না; আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই।

আমি বলি, বলুন।

ডলি বলে, প্রথমে চিনে নাও যে আমি ডলি বলছি, আমি তোমার স্ত্রী।

আমি বলি, ওহ, ডলি, আমি চিনতে পারি নি।

ডলি বলে, তোমার কী হয়েছে? তোমাকে তো এমন কখনো দেখি নি।

আমি বলি, মিসেস হামিদউল্লাহকে একটু খেতে ডেকেছিলাম।

ডলি বলে, তোমার ডাকে বুড়ীরা ছাড়া আর কে আসবে, কিন্তু এতো মাতলামি করছো কেনো?

আমি বলি, না তো, আমি স্বাভাবিক আছি, খুবই স্বাভাবিক।

ডলি বলে, শুনলাম তুমি নিউ ইয়র্ক গিয়েছিলে, কিন্তু আমি যে লন্ডনে পড়ে আছি, তা কি তোমার মনে নেই?

আমি বলি, হ্যাঁ, মনে ছিলো, কিন্তু ফোন করতে ইচ্ছে করে নি।

ডলি বলে, শুধু ফোন? আমার সাথে তোমার দেখা করা উচিৎ ছিলো না? আমি বলি, দেখা করতে ইচ্ছে করে নি।

ডলি বলে, কিন্তু মনে রেখো তোমাকে আমি ছাড়ছি না, তোমাকে আমি ছাড়বো।

আমি বলি, ছাড়াছাড়ির কথা আমি কিছুই ভাবছি না, কিন্তু সত্যিই তোমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করে নি।

ডলি বলে, তোমার সাথে দেখা করতে আমারও ইচ্ছে করে না, কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়ছি না।

আমি বলি, তোমাকে আমি ছাড়তে বলি নি।

ডলি বলে, মিসেস হামিদউল্লাহকে নিয়েই তুমি থাকো, আগামীকাল আমি হাসান জায়গিরদারের সঙ্গে সিসিলি যাচ্ছি।

আমি বলি, একটু সাবধানে থেকো, মাফিয়ার সাথে ওর সম্পর্ক আছে বলে শুনেছি, তোমাকে ভূমধ্যসাগরে ফেলেও আসতে পারে।

ডলি বলে, তোমার থেকে মাফিয়া আর ভূমধ্যসাগরও আমার কাছে ভালো।

আমি বলি, তাহলে আমাকে আর কেনো কষ্ট করে টেলিফোন করলে?

ডলি বলে, জানিয়ে রাখলাম, যাতে তুমি জ্বলো।

আমি বলি, অনেক দিন ধরে আমি জ্বলি না, যদি একটু জ্বালাতে পারো কৃতজ্ঞ থাকবো।

ডলি বলে, তুমি জায়গিরদারের থেকেও পাষণ্ড।

আমি বলি, জায়গিরদারের সাথে তোমার সম্পর্ক কি খুবই ঘনিষ্ঠ?

ডলি বলে, ঘনিষ্ঠতার তুমি কী বোঝো, আর তোমাকে আমার ব্যক্তিগত কথা কেননা বলতে যাবো?

আমি বলি, আমার ভুল হয়ে গেছে, তোমার ব্যক্তিগত কথা জানতে চাওয়া আমার ঠিক হয় নি।

ডলি বলে, যদি বলি এখন আমি জায়গিরদারের সাথে শুয়ে আছি, তাহলে কি। তোমার জ্বালা লাগবে? আমি জানি তোমার সেই শক্তিও নেই।

আমি বলি, পান করার সময় আমি কোনো জ্বালা বোধ করি না; তখন কাউকে আমার খারাপ লাগে না, সবাইকে ভালো লাগে, সব দৃশ্য সুন্দর মনে হয়।

ডলি বলে, জায়গিরদারের সঙ্গে আমি শুয়ে আছি এটাও কি তোমার সুন্দর লাগবে? তুমি পাষণ্ড, তাই এ-দৃশ্যও তোমার সুন্দর লাগতে পারে।

ডলি ফোন রেখে দেয়।

আমি কোনো শূন্যতা বোধ করি না; জায়গিরদারের সাথে ডলি শুয়ে আছে, এ-দৃশ্যও দেখি না; ডলি নামের কেউ আছে, ছিলো, থাকবে, এ-নামের কেউ এইমাত্র ফোন। করেছিলো, তাও আমার মনে থাকে না। একের পর এক টেলিফোন বাজতে থাকে; টেলিফোনের শব্দ আমার মধুর মনে হয়, ওগুলো ধরে যে সাড়া দিতে হয়, তা আমার মনে হয় না; ওগুলো যে আমারই ঘরে বেজে চলছে, তাও মনে হয় না; হয়তো কোনো নক্ষত্রে, কোনো অরণ্যে পত্রপল্লবের ভেতরে বাজছে; কোনো নদীর ভেতরে, মেঘ বা পাখির বাসায় বাজছে, এমন মনে হয়। আমার কাজের লোকটি, কী যেনো তার নাম, এক সময় আসে; আমি তাকে ভেতরে ঢুকতে বলি; সে ভেতরে ঢুকে আমাকে দেখে বিব্রত হয়; ঢুকবে কি ঢুকবে না করতে থাকে, আমি তাকে ঢুকতে বলি, সে ভেতরে ঢুকলে তাকে পাশের চেয়ারে বসতে বলি। সে দাঁড়িয়েই থাকে, তাতে আমি খুব বিস্মিত হই; আবার তাকে আমি বসতে বলি, কিন্তু সে বসে না।

আমি বলি, আপনি বসুন।

লোকটি বলি, না, স্যার; না, স্যার, বসতে অইব না।

আমি বলি, আমার পাশে বসতে কি আপনার ঘেন্না লাগছে? আপনি কি আর্য ব্রাহ্মণ? আমি কি শূদ্র?

লোকটি আমার কথা বুঝতে পারে না।

সে বলে, স্যার, একটা লুঙ্গি আইন্যা দেই?

আমি বলি, আপনার কী নাম?

লোকটি বলে, আমার নাম দীন মুহাম্মদ, স্যার।

আমি বলি, আপনি কী চান?

লোকটি বলে, আমি কিছু চাই না, স্যার, থালবাসনগুলি নিতে আইছি।

আমি বলি, আপনি বসুন।

লোকটি দাঁড়িয়ে থাকে। আমার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে দেখে আমার খারাপ লাগে।

লোকটি বলে, একটা লুঙ্গি আইন্যা দেই, স্যার?

আমি বলি, লুঙ্গির কী দরকার, এই তো আমি বেশ আছি।

লোকটি বলে, আপনে ভাল নাই, স্যার।

আমি বলি, আপনি আমাকে স্যার বলবেন না; শুনতে শুনতে আমার ঘেন্না ধরে গেছে। স্যার শুনলে মনে হয় কেউ আমাকে শালা বলে ডাকছে; আমি কারো স্যার নই, আমি কারো শালা নই।

লোকটির সঙ্গে আমার সারারাত কথা বলতে ইচ্ছে করে। লোকটি কি বলবে? লোকটির মুখের দিকে আমি আগে কখনো তাকাই নি; সুন্দর দাড়ি রেখেছে লোকটি,-আগে কি লোকটির দাড়ি ছিলো? মনে পড়ে না, তবে বেশ দাড়ি রেখেছে, দাড়ির বেশি ঝোঁপ নেই, বেশ হাল্কা পাতলা; মাথায় একটি টুপিও আছে, মুখটি ছোটো, গালে একটি ছোটো কাটা দাগ আছে বলে আমার মনে হয় তার লুঙ্গিটা গোড়ালির অনেক ওপরে ওঠানো। দক্ষিণের মসজিদটায় হয়তো নিয়মিত যায়, লোকটিকে বেশ লাগছে আমার।

আমি বলি, আপনি কি বিয়ে করেছেন?

লোকটি বলে, জি, স্যার; পরথম স্ত্রীর মিরতুর পর তিন বছর আগে আবার বিবাহ করছি।

আমি বলি, আপনার স্ত্রী কার সাথে ঘুমায়?

লোকটি বলে, নাউজুবিল্লা, আমার ইস্তিরি আর কার লগে ঘুমাইব, আমার লগেই ঘুমায়।

আমি বলি, কিন্তু আপনি তো এখানেই থাকেন, আপনার স্ত্রী কোথায় থাকে?

লোকটি বলে, দিনাজপুরের বীরগঞ্জের রহমতপুরে।

আমি বলি, সেখানে সে কার সঙ্গে ঘুমোয় আপনি জানেন?

লোকটি বলে, আল্লা জানে, স্যার।

আমি বলি, আল্লা জানলেই চলবে, আপনার জানতে হবে না?

লোকটি বলে, হের আরও চাইরখানা বিয়া অইছিল, স্যার, হের লগে আর কে ঘুমাইতে চাইব?

আমি হাসতে থাকি।

লোকটি বলে, আমি একটা কথা কইতে চাইছিলাম, স্যার, সাহস অয় নাই।

আমি বলি, বলুন।

লোকটি বলে, আমার আগের ঘরে একটা মাইয়া আছিল, স্যার, টেনে পড়ে।

আমি বলি, ঠিক আছে, বইপত্র লাগলে আমি কিনে দেবো।

লোকটি বলে, আমার মাইয়াটা খুব ভাল, স্যার, ফাস্ট অইছে ক্যালাশে, কিন্তু মাইয়াটার একটা অসুখ হইছে।

আমি বলি, দীন মুহাম্মদ সাহেব, কারো অসুখের কথা শুনতে আমার ইচ্ছে করে না, কোনো সুখের কথা থাকলে বলুন।

লোকটি বলে, গরিবগো কোন সুখের কথা নাই, স্যার।  

আমি বলি, তাহলে আপনি যান, গরিবদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

লোকটি ভয় পেয়ে বেরিয়ে যায়। লোকটি তো ভয় নাও পেতে পারতো, কিছু কথা শুনিয়ে দিতে পারতো আমাকে, সিনেমায় যেমন গরিবরা কথা শুনিয়ে দেয়; আমি ওর এমন কী করতে পারতাম? ওকে বরখাস্ত করতে পারতাম না। লোকটি হয়তো ভাবে ওকে আমি বরখাস্ত করতে পারি, কিন্তু আসলে আমি পারি না। তবে লোকটি যে ভয় পেয়েছে দেখতে আমার ভালো লাগে। মানুষ ভয় পেয়ে কীভাবে বেরোয় আমি তা দেখতে থাকি, ভয় পেয়ে বেরোনোর দৃশ্য দেখতে আমার ভালো লাগে; আমার ইচ্ছে করে লোকটির মতো ভয় পেয়ে প্রত্যেক ঘর থেকে বেরোতে। দেখতে পাই আমি আমার কেরানিদের ঘরে গেছি, তারা আমার দিকে তাকাচ্ছে না, আমি স্যার, স্যার করে তাদের ডাকছি, কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছে না, শেষে একজন আমার দিকে তাকিয়ে বলছে, পরে আইসেন, এখন সময় নাই; তার কথা শুনে আমি ভয় পাই, ভয় পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি, বেরোনোর সময় আমি ভুল জায়গায় পা ফেলি, পা থেকে আমার স্যান্ডল খুলে পড়ে যায়। এখন আমি যদি নিচে দীন মুহাম্মদের ঘরে যাই, ঘরে গিয়ে বলি, আমি ভালো নেই, আর দীন মুহাম্মদ বলে কারো ভালো না থাকার কথা শুনতে তার ভালো লাগে না, সে যদি আমাকে ঘর থেকে চলে যেতে বলে, তাহলে কি আমি ভয় পাবো, ভয়ে ভয়ে তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসবো? আমার ভয় পেতে ইচ্ছে করে, আমার ভয় পাওয়ার সুখ পেতে ইচ্ছে করে; আমার দীন মুহাম্মদ হ’তে ইচ্ছে করে।

আমি কি একটু বেশি পান করেছি? আগে কখনো এতোটা পান করি নি পান করলেই ভেতর থেকে এভাবে ঠেলে বেরিয়ে আসতে হবে? ভেতরে একটা প্রচণ্ড আলোড়ন চলছে, মনে হচ্ছে ভেতরের সব কিছু ঠেলে বেরিয়ে আসছে; কিন্তু আমি বেরোতে দেবো না বলে ঠিক করি, তবে চাপ তীব্র হয়ে উঠতে থাকে। প্রচণ্ডভাবে বমি আসছে ভেতর থেকে; আমি কি বাথরুমে গিয়ে সিং ধরে বমি করতে শুরু করবো? কতো বছর আমাকে সিংক ধরে গো গো গলগল করে বমি করতে হবে? আজ রাতে যদি বমি শেষ না হয়? যদি আগামীকাল, পরশু, আর পরের রাত ও দিনগুলো, দুপুর ও মধ্যরাতগুলো, মাসগুলো, বছরগুলো ধরে আমার ভেতর থেকে বমি উৎসারিত হতে থাকে? আমি বাথরুমে যাই না; টলতে টলতে বিছানায় গিয়ে শুই, অমনি ভেতর থেকে বমির ধারা বেরিয়ে আসতে থাকে। গলগল করে বেরোনো বমিতে বালিশ ঢেকে যায়, বিছানা প্লাবিত হয়ে যায়; আমি দেখতে থাকি আমার বমিতে শহরের সমস্ত পথ প্রাবিত হয়ে যাচ্ছে, সব যানবাহন ভাঙা বাস আর পতাকাশোভিত মার্সিডিজ, রিকশা আর ঠেলাগাড়ি-ডুবে যাচ্ছে; সচিবালয় আর শহর ডুবে যাচ্ছে, ছোট্ট একটি দেশ ডুবে যাচ্ছে, পাখির ডাক আর বাঁশির সুর আর ঘাসফুল আর কবিতার পংক্তিগুলো ডুবে যাচ্ছে, একটির পর একটি মহাদেশ ডুবে যাচ্ছে। আমি বমির নিচে হারিয়ে যেতে থাকি।

কাজির, স্বরাষ্ট্রের হাজি কাজি আহমদ সালেকিনের, সাথে দেখা হলেই ধর্মের পুণ্যকথা শুনতে হচ্ছে আজকাল, পুণ্যকথায় ও সব কিছু প্লাবিত করে দেবে মনে হচ্ছে; ওর না কি মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে, আগে জানলে অর্থনীতি পড়তো না, সিভিল সার্ভিস অফ পাকিস্তানে যোগ দিতো না, ইসলামিয়াত পড়তো, আর কোন একটি বাদশার কথা যেনো ও বলে, সেটির নাম আমি মনে রাখতে পারি না, যেমন দীন মুহাম্মদের নাম মনে রাখতে পারি না, যদিও সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার সময় অজস্র বাজে বিদ্যার সাথে ওই নামটিও মুখস্থ করেছিলাম, ও তার মতো আলকুরআন নকল করে জীবিকা নির্বাহ করতো (বইটির নাম আমি প্রথম বুঝতে পারি নি, এর উচ্চারণ আর বানান যে বদলে গেছে আমার জানা ছিলো না, বাঙলা ভাষা আর আমার স্বরতন্ত্রির কষ্ট হয় বলে আমি ছেলেবেলায় যা বলতাম সেই কোরান বলেই শান্তি পাই), তাতেই ও শান্তি পেতো। আলকুরআন নকল করে জীবিকা নির্বাহ করা কাজি আজো শুরু করে নি, শিগগির শুরু করবে, অবসর নেয়ার পর কোনো অসরকারি সংস্থা খুলে শুধু আলকুরআন নকল করবে হয়তো, এখন বছর বছর হাজি হচ্ছে, ডান দিক থেকে পেঁচিয়ে আসা অক্ষরগুলো শিখছে, অক্ষরের ফাঁকে ফাঁকে বেহেশত আর হুরি দেখছে, টুপি নিয়ে খুব দৌড়োচ্ছ, টুপিদৌড়ে কাজি ফার্স্ট হচ্ছে, আর মাজারটাজার দেখলেই নেমে দোয়া পড়ছে। দোয়াটোয়া পড়তে আমি জানি না, আমাকে দোয়ার বই কয়েকটি ও দিয়েছে, আমি খুলে দেখি নি, না কি খুলে দেখে ভয় পেয়েছি, না কি খুলে দেখে হেসে উঠেছি। একটি মাজারে কাজি বছরে চারবার করে যাচ্ছে, কাজির বুক সুখে ভরে উঠছে; আমি তাকে তার আইনশৃঙ্খলারক্ষীদের একটু ধর্মটর্ম শেখাতে বলি, তাদের ধর্ষণ করতে একটু নিষেধ করতে বলি (অবশ্য মনে মনে আমি তাদের ঈর্ষা করি, তারা যখন তখন শক্ত হয় কীভাবে? তাদের কি বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়?); কাজি সেদিকে কান দেয় না; যেনো তার আইনশৃঙ্খলারক্ষীরা ধার্মিক হয়ে উঠলে, ধর্ষণ কমিয়ে দিলে, তার পুণ্য কমে যাবে, বেহেশত মানুষে গিজগিজ করবে, কাজি তা পছন্দ করে না; সে একাই বেহেশতে থাকতে চায়। কাজির শেষ বউ মাঝেমাঝেই আমাকে টেলিফোন করছেন, কাজি তার ওপর যে ধর্মাত্যাচার করছে, তা কমানোর জন্যে চাপ দিতে অনুরোধ করছেন। আমি বুঝে উঠতে পারছি না কী অত্যাচার করতে পারে কাজি, যাকে ধর্মত্যাচার বলা যায়? কাজির সাথে কয়েকদিন আগে ওর বাসায় যেতে হয় আমাকে, গিয়েই ব্যাপারটি বোঝা সহজ হয়ে ওঠে আমার পক্ষে। কাজির বউ বোরখা পরেই ড্রয়িংরুমে আসেন, এসে আমাকে খাঁটি একটি আসোলামুআলাইকুম দেন, আমি ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে যাই।

মিসেস কাজি বলেন, আনিছ ভাই, যখন ড্রাইবারের বউ আছিলাম, তখনও এমন জ্বালা সইহ্য করতে হইতো না।

কাজি বলে, হালিমা বেগম, পরপুরুষের সামনে আপনার আসা ঠিক হয় নি।

মিসেস কাজি বলেন, আমার মন চায় আমি আবার রহিম ড্রাইবারের বউ হইয়া যাই, সেকরেটারির ইস্তিরি থাকতে আমার আর ইচ্ছা করে না।

আমি জিজ্ঞেস করি, ভাবী, আপনার অসুবিধা কী?

হালিমা চিৎকার করে ওঠেন, দ্যাখছেন না, বাইরতেও আমার এই বোরকা পইর‍্যা থাকতে অয়, আর ভিতরে পরতে অয় হিরোইনগো ড্রেস।

হালিমা বেগমকে আগে আমি দেখি নি, এখনো দেখতে পাচ্ছি না; তিনি বোরখার ভেতরেই আছেন, কিন্তু ওই ঝলমলে কালো বস্ত্রটির ভেতর যে-ঢেউ খেলছে, ঢেউ যেভাবে উঠছে আর ভাঙছে, তাতে তাকে আমার দেখা হয়ে যায়। আমি অনেকটা উত্তেজিতই বোধ করি-অনেকদিন পর বোধ করি এই আবেগটি, মনে হয় আমি হয়তো কাজির আইনশৃঙ্খলার একজন হয়ে উঠবো। নিজেকে আমি দমন করি, দমন ক’রে, শান্তি পাই না। আমি ভয় পেতে থাকি হালিমা বেগম কোনো নাটকীয় কাণ্ড করে বসবেন, আমি তাতে করতালি দিয়ে উঠবো। হালিমা বেগম অনেকটা তাই করেন; তিনি বোরখাঁটি খুলে ছুঁড়ে মারেন, কালো বাদুড়ের মতো উড়ে গিয়ে সেটি কাজির মুখ ঢেকে ফেলে; কাজি বেরাখা চেপে ধরে বসে থাকে, আমি চোখের সামনে দেখতে পাই ঝলমলে টলটলে জ্বলজ্বলে হালিমা বেগমকে। হালিমা বেগমের শরীরটি তাজা ও তন্বী, বোরখার ভেতর থেকে বেরিয়ে শ্যামল জমাট বিদ্যুতের মতো সেটি ঝলসে ওঠে আমার চোখের সামনে, আমি চারপাশে শুধু তার দেহ দেখতে পাই। হালিমা বেগম খুবই হ্রস্ব ব্লাউজ পরেছেন, বক্ষবন্ধনির থেকেও হ্রস্ব, শাড়ি পরেছেন নাভির অনেক নিচে; তার শরীরটিকে স্তব্ধ বিদ্যুৎপুঞ্জ মনে হয়। আমার ইচ্ছে করে আবার একবার উত্তেজিত বোধ করতে, আমি নিজেকে সংযত করি। হালিমা বেগম একবার আমার দিকে হেঁটে আসতে থাকেন, আবার আমার দিক থেকে বিপরীত দিকে যেতে থাকেন; আবার আরেক দিকে হাঁটতে থাকেন; আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি। হালিমা বেগমের এমন কোনো অঙ্গ নেই, যা দোলে না, দোলায় না।

হালিমা বেগম বলেন, আনিছ ভাই, আপনে আমার শরীলটা দ্যাকতে পাইতেছেন ত?

আমি বলি, দেখতে পাচ্ছি, ভাবী।

হালিমা বেগম বলেন, দেইক্যা কি আপনার মনে হয় এই শরীল দিনরাইত কালা বোরকায় ঢাইক্যা রাখনের মতন?

আমি বলি, না, ভাবী।

হালিমা বেগম বলেন, আমি কি বুড়ী পেত্নী যে বোরকায় নিজেরে ঢাইক্যা রাখুম?

আমি বলি, আপনাকে পরী বলাই ভালো।

হালিমা বেগম বলেন, দ্যাকেন, রহিম ড্রাইবর সেকরেটারির গাড়ি চালাইতো, আমি তারে ছাইরা আইছি, অহন সেকরেটারি আমারে কয় সব সোম বোরকা পরবা আর ভিতরে হিরোইনের ড্রেস পরবা; বিছনায় কিছু পারে না, আমারে খালি দোয়াকলমা শিকায়, নিজে জায়নমজেই পইর‍্যা থাকে, আমার লিগাও ভেলভেটের জায়নমজ কিনছে।

আমি বলি, জায়নামাজ খুব ভালো জায়গা, ভাবী।

হালিমা বেগম বলেন, জায়নমজে পইর‍্যা থাকনের বয়স আমার হয় নাই, সেকরেটারি যুদি জায়নমজে পইরা থাকতে চায় তাইলে আল্লারে পাইব, আমারে পাইব না, আমি কইয়া দিলাম।

আমি বলি, আপনিও কাজির সাথে বেহেশতে যেতে পারবেন, ভাবী।

হালিমা বেগম বলেন, ভেস্তে যাইয়া আমার কাম নাই, আমি খাডের ওপরই ভেস্ত পাইতে চাই, রহিম ড্রাইবার আমারে ভাঙা চকির উপরই ভেস্ত দিতো, আর সেকরেটারি আমারে দোয়া শিকায়।

আমি বলি, দোয়াকলমা শেখানোই এখন আমাদের কাজ, ভাবী, সবাইকে আমরা বেহেশত দিতে চাই, এটা আমাদের সরকারি দায়িত্ব। আমরা সবাইকে ভাত দিতে পারবো না আমরা জানি, কিন্তু বেহেশত দিতে পারবো, ইনশাল্লা। তাই আমরা ট্রাক ভরে জনগণের কাছে দোয়াদরুদ পৌঁছে দিচ্ছি আজকাল।

হালিমা বেগম বলেন, আনিছ ভাই, আপনের সামনে সেকরেটারিরে কইয়া দিলাম এমুন করলে আমি সেকরেটারির মাইঝ্যা পোলার লগে ভাইগ্যা যামু, সেকরেটারি আফিসে গ্যালেই মাইঝ্যা পোলা আমার লগে দ্যাকা করতে আহে, আম্মাগো বইল্যা জরাইয়া ধরে, আর ছারতে চায় না।

কাজি চিৎকার করে ওঠে, আমার ছেলের কথা আপনি বলবেন না হালিমা বেগম, আপনার পায়ে পড়ি। আমার ছেলেকে আমি আমেরিকা পাঠিয়ে দেবো।

হালিমা বেগম বলেন, পোলাটা আমারে আধাঘণ্টা জরাইয়া ধইর‍্যা রাকে, তারপর কাঁপতে কাঁপতে পইরা যায়, পোলাটা আমারে যতুক্ষুন ধইর‍্যা রাকে ততুক্ষুনই আমি শান্তি পাই। আমি চাইলে হেই আমারে আমেরিকা লইয়া যাইব।

কাজি বলে, হালিমা বেগম, আপনার ওপর শয়তান আছর করেছে, আপনাকে আমার পীরের মাজারে নিয়ে যেতে হবে, আপনি শয়তানের হাত থেকে মুক্তি পাবেন।

হালিমা বেগম বলেন, শয়তানেরে আমি হাজার দোয়া করি, শয়তানের আছর য্যান আমার উপর সব সোম থাকে, কিন্তু তোমার মত সেকরেটারির লগে আমি থাকতে পারুম না।

কাজি দোয়া পড়তে থাকে, আর কাঁদতে থাকে; কাজি কাঁদতে থাকে, আর দোয়া পড়তে থাকে।

হালিমা বেগম বলেন, এই বোরকা আমি ফেইল্যা দিলাম, আইজ থিকা তুমি নিজে ফিন্দো, নাইলে তোমার মারে ফিন্দাইও।

কাজি বলে, আপনি এমন কথা কীভাবে বলেন, হালিমা বেগম, আপনার কি দোজখের ভয় নেই?

হালিমা বেগম বলেন, তোমার লগে থাকনের থিকা দোজগে থাকতেও বেশি শান্তি পামু আমি। রহিম ড্রাইবরের লগে আমি ভেস্তে আছিলাম, সেই ভেস্তরে পায় ঠেইল্লা আমি দোজগ বাইচ্ছা নিছি, হায় আল্লা।

কাজি বেশি সময় নেয় না, তার দক্ষতা অসীম, দুটি মন্ত্রণালয় দেখছে সে;–সাত দিনের মধ্যে কাজি তার পীরের শহরে আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কে একটি প্রায়-আন্তর্জাতিক সেমিনার, একটি অ্যাকাডেমির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও একটি কুচকাওয়াজের আয়োজন করে ফেলে। কাজির দক্ষতা দেখে আমি বিস্মিত হই না, সে যে দক্ষ সিভিল সার্ভিস অফ পাকিস্তান, যা আমি ভুলে গিয়েছিলাম, তা আমার মনে পড়ে। কাজি ঠিক করে ফেলেছে আমাকেও যেতে হবে, আমার পক্ষে না করাও সম্ভব নয়, আর আমি না করতেও চাই না। বেশ উৎসব আর আনন্দ হবে; আইনশৃঙ্খলা জানা যাবে, ভিত্তিপ্রস্তর, কুচকায়াজ, আর মাজার দেখা যাবে; কোনো অলৌকিক উপকারও হয়ে যেতে পারে।

কাজি আমাকে ফোন করে, তোমাকে যেতে হবে, পীরবাবার মাজারটা জিয়ারত করে আসতে পারবে, আর হালিমা বেগম তোমার কথা শুনবেন মনে হয়, তাকে তুমি যাওয়ার জন্যে একটু রাজি করাবে।

আমি বলি, ভাবীকে দিয়ে একটা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করালে কেমন হয়?

কাজি বলে, তা করতে পারতাম যদি হালিমা বেগম ঠিকমতো বাঙলা বা ইংরেজি বলতে পারতেন।

আমি বলি, এখন তা কে-ইবা পারে, তুমি ভাবীকে দিয়ে একটা পাথরটাথর বসানোর ব্যবস্থা করো, আমি তাকে রাজি করাবো।

কাজি বলে, জেনারেল হালিমা বেগমকে দেখুক আমি চাই না, আমার ভয় হয়, হালিমা বেগম সেক্রেটারির থেকে জেনারেল বেশি পছন্দ করে।

পীরবাবার পুণ্যনগরে গিয়েই কাজি মাজার জিয়ারতের ব্যবস্থা করে, সেটাই প্রথম কাজ, চারদিকে সাড়া পড়ে যায়; জেনারেল মাজারটাজার পেলেই পাগল হয়ে ওঠে, না পেলে রাতারাতি একটা তৈরি করে ফেলতে চায়; তাকে বোঝাতে কোনো কষ্ট হয় না কাজির, বরং সে-ই কাজিকে বোঝাতে থাকে; আমিও অর্ধেক রাজি হই, আমলা হওয়ার পর কোনো বিশ্বাস রাখা বা কিছু অবিশ্বাস করা আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়; বিশ্বাস আমার কাছে যা, অবিশ্বাসও আমার কাছে তা-ই; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে হালিমা বেগম সিভিল সার্ভিস অফ পাকিস্তান নন, মনে হয় তিনি কিছু কিছু বিশ্বাস করেন আর অবিশ্বাসও করেন অনেক কিছু; সে-অধিকার তাঁর আছে; তাকে আমাদের সাথে যেতে রাজি করাতে আমার বেশ কষ্ট হয়, রাজি করাতে পেরে আমি কাজিকে একই সাথে স্বস্তি আর অস্বস্তিতে ফেলে দিই, নিজে একটু সুখ বোধ করি; কিন্তু হালিমা বেগমকে মাজার জিয়ারত করতে রাজি করাতে পারি না।

হালিমা বেগম বলেন, উই গুলিন পুরুষপোলাগো কাম, মাজারে আমার কাম নাই; ড্রাইবর একবার আমারে লইয়া আইছিল, আমারে উপরে উটতেও দেয় নাই, আমি আর উইগুলিনে নাই।

হালিমা বেগম হাসতে থাকেন, বলেন, ড্রাইবর ত আমারে মাজারে লইয়া আইছিল, তার কী লাব হইল? পীর আমারে ত তার লিগা ধইর‍্যা রাকতে পারল না? সেকরেটারি ত আমারে ভাগাইয়া নিজের বিছনায় উঠাইল।

আমি বলি, ভাবী, তবে আপনি মাজারের নিচে না গেলে কাজির একটু বিপদ হতে পারে, জেনারেল অসন্তুষ্ট হতে পারে, জেনারেল সেকরেটারিদের স্ত্রীদের দেখতে পছন্দ করেন।

হালিমা বেগম বলেন, জেনারেল যুদি আবার আমারে পছন্দ কইর‍্যা ফ্যালে।

আমি কোনো কথা বলি না; আমি জানি জেনারেল হালিমা বেগমকে পছন্দ করবে।

হালিমা বেগম হাসেন, মনে হয় বছরখানেক ধরে হাসেন, এবং বলেন, আনিছ ভাই, আপনেরা হইলেন পুরুষপোলা, বড় বড় চাকরি করেন আপনেরা, এই দ্যাশটা চালান। আপনেরা, আপনাগো ডরে দ্যাশটা কাঁপতে থাকে, কিন্তু আমি ভাইব্যা পাই না আপনেরা যে ক্যান পীর আর মাজার লইয়া পাগল হন। পীর আর মাজারে আমার কাম নাই।

আমি তাঁকে রাজি করাতে পারি না; আমরা যখন মাজার নিয়ে মেতে উঠি তিনি তখন রেস্টহাউজে বসে ভিসিআর দেখতে থাকেন; আমি যখন মাজারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকি, তখন আমি হালিমা বেগমকে দেখতে থাকি; তার হাসি শুনতে থাকি।

অ্যাকাডেমির মর্মরভিত্তিপ্রস্তর যখন স্থাপন করছিলো জেনারেল হালিমা বেগমের পাশে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, দাঁড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। আমার সারাজীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলোর একগুচ্ছ আমি তখন যাপন করি।

হালিমা বেগম বলেন, আনিছ ভাই, কন ত এই পাথর বসাইয়া কী লাভ?

আমি বলি, এখানে একটি বড় দালান উঠবে, অ্যাকাডেমি হবে।

হালিমা বেগম বলেন, তাইলে দালানটা বানাইয়া ফ্যালাইলেই ত পারত, পাথর বসানের কী দরকার?

আমি বলি, দালান বানাতে সময় লাগে, পাথর বসাতে সময় লাগে না; আর দালান নাও উঠতে পারে।

হালিমা বেগম বলেন, আপনেরা তাইলে সব জায়গায়ই ফাঁকি দ্যান, আনিছ ভাই? বিছনায়ও ফাঁকি দ্যান, পাত্থর বসাইয়াও ফাঁকি দ্যান?

অ্যাকাডেমির মঙ্গল কামনা করে মঙ্গলময়ের কাছে মোনাজাত হচ্ছে, এটা আমরা নিষ্ঠার সাথে করে আসছি, মোনাজাত ছাড়া কিছু আমরা করি না, কিন্তু তিনি শুনছেন না বলেই সন্দেহ হচ্ছে, চারদিকে তার শোনার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না; আমি (এবং আরো অনেকে) ঠিক মোনাজাত করতেও জানি না, অনেক আগে শিখেছিলাম, দরকার নেই দেখে ভুলে গেছি; তবে সিনেমাহল, হোটেল, পানশালা, প্রমোদশালা, সেতু, কারখানা, মাদ্রাসা উদ্বোধন করতে গিয়ে কয়েক শো বার আমি দু-হাত উঠিয়ে ঠোঁট নেড়েছি; আজো আমি হাত উঠোই, হাত দুটি অভ্যাসবশত ওপরের দিকে বাঁকা হয়ে উঠে যায়, ঠোঁটও নড়ে অভ্যাসবশত; কিন্তু হালিমা বেগম হাত তুলছেন না, ঠোঁট দুটি নাড়ছেন না। তিনি কি এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কর্ম ছাড়া ওই দুটি ব্যবহার করেন না? হালিমা বেগম হাত তুলছেন না দেখে আমি ভয় পাই; ভিক্ষা করতে কেউ অস্বীকার করতে পারে এ-দৃশ্য আমাকে ভীত করে তোলে; যদি কোনো বজ্র আকাশ ফেড়ে এখনই তাঁর মাথায় নেমে আসে, নেমে আসারই কথা, অবশ্যই নেমে আসবে, তা আমার মাথায়ও পড়বে, আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি; আমার ইচ্ছে করে দৌড়ে কোনো পাহাড়ের দিকে ছুটে যাই, আমি যেতে পারি না। বজ্রটা কোন দিক থেকে আসতে পারে? আকাশের দিকে একবার অন্যমনস্কভাবে তাকাই; আমি সিভিল সার্ভিস অফ পাকিস্তান, আমাকে সাবধান থাকতেই হবে, আমার মাথায় কোনো বজ্রপাত হতে দেয়া হবে না। অন্যদের মাথায় হতে পারে, সিভিল সার্ভিস অফ পাকিস্তানের মাথায় নয়। বজ্রপাত হচ্ছে না দেখে আমি কম্পন বোধ করি, কাঁপতে থাকি, হতাশ বোধ করি। আমি একটি বজ্র চাই, ভীষণ বজ্রপাত চাই, যাতে আমি নিজেও ছাই হয়ে যেতে পারি; কোনো বজ্রপাত হয় না দেখে আমি কাঁপতে থাকি। হালিমা বেগম কেনো হাত তুলবেন না? তিনি কি বজ্রপাতের ভয় করেন না? তিনি কি বজ্রপাতের সংবাদ রাখেন না? বজ্রের কাল কি শেষ হয়ে গেছে? মনে হয় আমারই ভুল হয়েছে; তিনি এখনই আমাদের শাস্তি দেবেন না; একদিন দেবেন। সেদিন বুঝতে পারবেন হালিমা বেগম। তার পাশে দাঁড়িয়ে কি আমারও বুঝতে হবে?

মোনাজাতের পর আমি হালিমা বেগমের খিলখিল হাসি শুনতে পাই। হাসিটার রঙ আমি দেখতে পাই–টকটকে লাল হাসি; হাসিটা তিনি আমাকেই শোনাতে আর দেখাতে চাচ্ছেন; কাজি অনেক দূরে আছে, তার কানে আর চোখে হাসিটা পৌঁছোবে না; হালিমা বেগম তা চান না।

খিলখিল করতে করতে হালিমা বেগম জিজ্ঞেস করেন, আনিছ ভাই, হাত উড়াইয়া ঠোঁট লড়াইয়া আপনারা কি কইলেন আল্লারে?

আমি বলি, আল্লাকে কিছু বলতে হয় না, তিনি এভাবেই সব কিছু জানেন।

হালিমা বেগম বলেন, দ্যাশের পুলিশগুলিন যেইভাবে মাইয়ালোক পাইলেই নিজেগো বিবি ভাইব্যা যা-তা করতাছে, আল্লারে সেই কথা কন নাই?

আমি বলি, কাজি হয়তো বলেছে।

হালিমা বেগম বলেন, কাজির কথা আমিই শুনি না, আল্লা কি শুনবো?

আমি বলি, আল্লা পরম করুণাময়, তিনি সবার কথা শোনেন।

জেনারেল হেলিকপ্টারে উড়ে চলে যায়। আমি ঢাকার উদ্দেশে রওনা করছি, হঠাৎ কাজির গাড়ি এসে আমার গাড়ির পাশে থামে। কাজি সমস্যায় পড়েছে, সে আবার পীরের মাজার জিয়ারত করতে চায়, কিন্তু হালিমা বেগম মাজারে যেতে চাচ্ছেন না; তাঁর আর পীরের পুণ্যনগরে থাকতে ইচ্ছে করছে না; তাঁর ভয় হচ্ছে কাজি তাঁকে গাড়িতে বসিয়ে মাজার জিয়ারত করতে করতে রাত করে ফেলবে। হালিমা বেগম চাচ্ছেন তাড়াতাড়ি ঢাকা ফিরে যেতে, কাজির মেজো ছেলেটির জন্যে হয়তো তাঁর সৎমাতৃহৃদয় কাঁদছে; তিনি চাচ্ছেন আমার সাথে ঢাকা ফিরতে, তাঁর সওয়াবের দরকার নেই। কাজিও আমাকে অনুরোধ করে হালিমা বেগমকে আমার সাথে নিয়ে যেতে, যাতে কাজি প্রাণভরে জিয়ারত করতে পারে। আমরা ঢাকা চলে আসি, মাজারের পাশ দিয়ে আসার সময় হালিমা বেগম খিলখিল হাসতে থাকেন; তার হাসিতে আমি কোমল স্নিগ্ধ উত্তেজনা বোধ করি, আমার ভালো লাগে, আমি সেটাকে বাড়তে দিই না, গোপন করে রাখি, নিজের শরীরে স্তব্ধ করে রাখি, এবং মনে করতে থাকি যা গোপন তা-ই নিষ্পাপ। হালিমা বেগমকে আমি নিষ্পাপভাবে কাজির বাসায় পৌঁছে দিই।

রাত বারোটার দিকে টেলিফোন বেজে ওঠে; পুণ্যনগরের ডিসি কথা বলছে।

ডিসি বলে, স্যার, আমি আবদুর রহমান মিয়া বলছি, স্যার।

আমি বলি, বলুন।

সে বলে, একটা দুঃসংবাদ আছে স্যার, কাজি স্যারের গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, স্যার।

আমি জানতে চাই, কোথায়?

সে বলে, পীরের মাজার থেকে মাইলখানেক দূরে, স্যার, একটা ট্রাকের সাথে মুখোমুখি কলিশন হয়, স্যার।

আমি জানতে চাই, কাজি এখন কেমন আছে?

সে বলে, কিছুক্ষণ আগে হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন, স্যার।

আমার বলতে ইচ্ছে করে, ইন্তেকালের অর্থ কী আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলুন, কিন্তু আমি বলি, আচ্ছা।

সে বলে, কাজি স্যারের স্ত্রী আপনার সাথে গেছেন, স্যার।

বলতেই লাইনটা কেটে যায়। আবদুর রহমান মিয়া কি ইচ্ছে করেই লাইনটি কেটে দিলো? সে কি মনে করছে কাজির স্ত্রী এখন আমার সাথেই আছে?

আবার ফোন বাজে, আবদুর রহমান মিয়া বলে, আমি খুব দুঃখিত, স্যার, লাইনটা কেটে গিয়েছিলো, স্যার, কাজি স্যারের স্ত্রীকে সংবাদটা জানাতে আমি ভয় পাচ্ছি, স্যার, তিনি হয়তো ভেঙে পড়বেন, স্যার।

আমি বলি, আচ্ছা, আমি জানাবো।

এ-মধ্যরাতে কাজির অ্যাক্সিডেন্ট আর ইন্তেকালের সংবাদ পেলে কি খুশি হবেন হালিমা বেগম? তার ঘুমের থেকে এই সংবাদ কি বেশি মূল্যবান? তিনি কি মধ্যরাতে টেলিফোন ধরেন? আমি টেলিফোন করবো তাকে? কীভাবে আমি তাকে সংবাদটি দেবো? এর আগে কখনো আমি কাউকে মৃত্যুর সংবাদ দিয়েছি? কারো মৃত্যুর সংবাদ শুনলে কোন দোয়াটি যেনো পড়তে হয়? আমি কি সেটা পড়েছি? কোনটা পড়তে হয়, কোনটা? এমন সময় আবার টেলিফোন বেজে ওঠে। ডিসি কি আবার ফোন করলো? এবার কি সে বলবে কাজি বেঁচে উঠেছে? আমলাতান্ত্রিক ভুলবশতই সে আগের সংবাদটি দিয়েছিলো? এখন সে ক্ষমা চাচ্ছে।

টেলিফোন ধরতেই শুনতে পাই, আমি ডলি বলছি।

আমি বলি, অনেক দিন পর ফোন করলে?

ডলি বলে, আজকাল কি নিজের বাসায় ঘুমোও না? মিস্ট্রেসের বাসায়ই ঘুমোচ্ছা, না কি?

আমি বলি, মিস্ট্রেস থাকলে তার বাসায়ই ঘুমোতাম, কিন্তু আমি অতো ভাগ্যবান নই, আজো কোনো মিস্ট্রেস পাই নি।

ডলি বলে, তাহলে পাওয়ার চেষ্টা করছো?

আমি বলি, আমি তোমার জন্যে আর আমার জন্যে দুঃখ পাই, ডলি।

ডলি বলে, কেনো দুঃখ পাও?

আমি বলি, তোমাকে আমি একটি ক্ষ্যাপা নারীতে পরিণত করেছি বলে। শক্তি থাকলে তোমাকে আমি সেই ছোট্ট বালিকাটি করে দিতাম, যে মধুর ছিলো, মিষ্টি ছিলো।

ডলি বলে, তোমার এসব বাজে কথা শোনার সাধ নেই আমার। আমি জানতে চাই দু-রাত ধরে কোন মিস্ট্রেসের বাড়ি ঘুমোচ্ছা?

আমি বলি, আমি যেখানেই ঘুমোই তোমার কিছু আসে যায় না, যেমন তুমি যেখানেই ঘুমোও আমার কিছু আসে যায় না।

ডলি বলে, এই ক-মাস তুমি কারো সাথে ঘুমোও নি, দেবতাটি হয়ে আছো, এটা কি তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে বলো?

আমি বলি, তোমাকে আমি কিছুই বিশ্বাস করতে বলি না।

ডলি বলে, তোমার গলার আওয়াজ শুনেই আমি বুঝতে পারছি আজ সন্ধ্যায়ই তুমি কোনো মেয়েলোকের সাথে শুয়েছে।

আমি বলি, ডলি, তুমি ভালো নেই।

ডলি বলে, তুমি আমার জীবনটা নষ্ট করেছে, তোমাকে আমি ছাড়ছি না।

ডলি ফোন রেখে দেয়।

আমার একটি চমৎকার অভ্যাস হয়েছে, চমৎকার বলেই আমার মনে হচ্ছে; বালিশের নিচে আমি একটি হুইস্কি বা ব্র্যান্ডির বোতল রেখে দিই, যখন ইচ্ছে করে ছিপি খুলে এক চুমুক খাই, খেতে খেতে ছিপিটা বন্ধ করি, বন্ধ করতে করতে আরেক চুমুক খেতে ইচ্ছে করে, আস্তে আস্তে ছিপি খুলি, আরেক চুমুক খাই। জিভের নিচে কখনো একটু মিষ্টি স্বাদ লেগে থাকে, কখনো টক স্বাদ, অনেকক্ষণ ধরে জিভ এদিক সেদিক নেড়ে ওই স্বাদটা আমি চুষে নিই। গ্লাশে ঢেলে খেতে আমার ইচ্ছে করে না। গ্লাশে ঢাললে স্থির হয়ে বসে দায়িত্ব পালনের মতো খেতে হয়, মনে হয় কোনো ফাইল নিয়ে বসেছি, এখনি দরোজা ঠেলে বা ফোন বাজিয়ে কোনো তদবির ঢুকবে; এবং মনে হয় আমি মাতাল, একটু পরেই রাস্তায় নেমে জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলতে থাকবো, যাকে পাবো তার পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাইবো, ঝরঝর করে কাঁদবো। ছিপি খুলে চুমুক দেয়ার অভ্যাস যে আমার চিরকাল থাকবে, তা মনে হয় না; কেনোইবা আমি একটি অভ্যাস সব সময়ের জন্যে বয়ে চলবো? ওই অভ্যাসের সঙ্গে আমার কোনো চুক্তি হয় নি; আমি কোনো চুক্তিতে বাঁধা পড়তে চাই না। আজ অফিস থেকে ফিরে, খাওয়ার আগে, কয়েকবারই বোতলের ছিপি খুলেছি; এটার স্বাদ একটু মিষ্টি, আমার বারবার ছিপি খুলতে ইচ্ছে করছে। লোকটির কী যেনো নাম?–দীন মুহাম্মদ?–সে এসে দরোজায় শব্দ করছে, আমি তাকে ঢুকতে বলি। সরাসরি বোতল উল্টে খাচ্ছি দেখে সে অবাক হয়, একটি গ্লাশ এনে আমার সামনে রাখে।

আমি বলি, তোমার কী যেনো নাম?

লোকটি বলে, আমার নাম দীন মুহাম্মদ, স্যার।

আমি বলি, তোমাকে গ্লাশ আনতে কে বলেছে?

লোকটি ভয় পায়, তার ভয় পাওয়া দেখে আমার খারাপ লাগে।

আমি বলি, আমার বিশেষ সেবা করা আমি পছন্দ করি না। আমি যা করতে বলি না আমার জন্যে তা করবে না।

লোকটি গ্লাশ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমি খাবার দিতে বলি। আমি খেতে বসি, দীন মুহাম্মদ দূরে দাঁড়িয়ে থাকে।

আমি ডাকি, দীন মুহাম্মদ।

লোকটি কাছে এসে বলে, জি, স্যার।

আমি বলি, এই ভাত মাছ মাংস ডাল শজি কে বেঁধেছে?

লোকটি বলে, আমিই রানছি, স্যার।

আমি বলি, রান্নার সময় তুমি এগুলোতে থুতু ছিটিয়ে দাও নি তো?

লোকটি ভয় পেয়ে কেঁপে ওঠে; বলে, নাউজুবিল্লা, কী যে কন স্যার, আমি গরিব মানুষ, আমি ইবলিশ না।

আমি বলি, আমাকে মেরে ফেলতে তোমার ইচ্ছে করে না?

লোকটি আবার নাউজুবিল্লা বলে চিৎকার করে ওঠে।

আমি খেতে থাকি, খেতে আমার ভালো লাগে;–এ-বয়সে কি আমার খেতে ভালো লাগা উচিত? দীন মুহাম্মদ যদি খাবারে থুতুও ছিটিয়ে থাকে, তাহলেও বলতে হবে তার থুতু সুস্বাদু। লোকটি কি আমার খাবারে থুতু ছিটিয়ে দিতে পারে না? থুতু ছিটোনোর সাহস হবে লোকটির? লোকটি কি আমাকে ঘেন্না করতে পারে না? আমাকে ঘেন্না করার সাহস হবে লোকটির? দুপুরে ঘুমিয়ে থাকার সময় লোকটি আমাকে দু-ভাগ করে ফেলতে পারে না? ঘুমোনোর সময় সাবধান হতে হবে, দরোজা বন্ধ করে ঘুমোতে হবে। খেতে আমার ভালো লাগছে। আবার প্রশ্নটি আমার মনে জাগছে;–এ-বয়সে কি খেতে আমার ভালো লাগা উচিত? সব কিছু মেনে খাওয়া উচিত নয়? খাসির মাংসের টুকরোটায় চর্বিটুকু জ্বলজ্বল করছে। আমার কি চর্বিটুকু খাওয়া উচিত? আমি চর্বির টুকরোটিকে মুখে তুলে দিই, ঝনাৎ করে তীব্র একটা স্বাদ আমার রক্তে ছড়িয়ে পড়ে।

আমি আরেকটি চর্বির টুকরো খুঁজতে থাকি, চামচ দিয়ে নাড়তেই একটি টুকরো জ্বলজ্বল করে ওঠে। চামচ দিয়ে টুকরোটি আমি নাড়তে থাকি, অনেকক্ষণ ধরে নাড়ি, নাড়তে আমার ভালো লাগে; আমার আর টুকরোটি খেতে ইচ্ছে করে না।

আমি বলি, দীন মুহাম্মদ, তোমার আগের ঘরের মেয়ের অবস্থা কী?

দীন মুহাম্মদ চমকে ওঠে, আমার মাইয়ার কতা আপনের মনে আছে, স্যার?

আমি বলি, হ্যাঁ, মনে আছে।

দীন মুহাম্মদ বলে, আমার মাইয়াডার ডাইন চোখে একটা পর্দা পড়ছে, স্যার।

আমি বলি, তুমি তো গরিব মানুষ?

দীন মুহাম্মদ বলে, জি, স্যার, অইত্যান্ত গরিব।

আমি বলি, গরিব মানুষের মেয়ের একটি চোখে চলে না?

দীন মুহাম্মদ বলে, স্যার, আমার মাইয়াটা বড় ভাল, ফাস্ট হইছে, স্যার।

আমি বলি, এখন কী করবে?

দীন মুহাম্মদ বলে, হাসপাতালে খবর নিছি, স্যার, দশ হাজার টাকা লাগবো; আমার অতো ট্যাকা নাই।

আমি বলি, আজ কী বার?

দীন মুহাম্মদ বলে, শুক্রবার, স্যার।

আমি বলি, আজই যাও, সোমবার সরাসরি মেয়েটিকে নিয়ে ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করে দেবে। আমার কথা বললেই চলবে।

আমি ক্রিসেন্ট হাসপাতালের গভর্নিংবডির চেয়ারম্যান, অথচ আজো কাউকে হাসপাতালে ভর্তি করাই নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *