মানুষ হিশেবে আমার অপরাধসমূহ – উপন্যাস – হুমায়ুন আজাদ
উৎসর্গ – ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম
প্রথম প্রকাশ – ফাল্গুন ১৪০২ : ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬
ওই ঘটনার আমি অংশ হই আকস্মিকভাবে, আমার তাতে থাকার কথা ছিলো না। আমি, সাধারণত, কোনো কিছুতে থাকতে চাই না; দূরে থাকতে চাই সব কিছু থেকে–দূরে থাকতে পারলে খুব নির্মল একটা শান্তি পাই; কিন্তু আমি কেমন করে যেনো জড়িয়ে পড়ি, জড়িয়ে পড়ার পর আমারও মনে হতে থাকে যেনো আমি সুপরিকল্পিতভাবেই ওই সবে থাকতে চেয়েছিলাম। দেলোয়ার আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো, অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ;–অনেক বছর খুব কাছাকাছি ছিলাম আমরা, এতো কাছাকাছি যে দুজনকে সব সময় একই সাথে দেখা যেতো; কিন্তু ওই ঘটনার কয়েক বছর আগে থেকে আমরা বেশ দূরে সরে গিয়েছিলাম। দূরে সরে যাওয়াটা বিদ্বেষ বা বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য ঘটে নি–(আমরা সব সময়ই পরস্পরকে ভাবতাম, কোনো পরিচিতের সাথে দেখা হলেই আমি দেলোয়ারের আর দেলোয়ার আমার কথা বলতো); ঘটেছিলো আমরা ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছিলাম বলে। নিজের পেশায়, ব্যবসায়, অত্যন্ত সফল হয়েছিলো দেলোয়ার; তিরিশ বছর বয়সেই যা সে উপার্জন করেছিলো, আমি তা আজো করার স্বপ্নও দেখি না। ওই বছর দেলোয়ার বিয়ে করে। বিয়ের মঞ্চে দেলোয়ারের বউকে দেখে আমি একটু কেঁপে উঠি, সামান্য একটু কাঁপন;–আমার চোখ তার বউয়ের চিবুকের ওপর গিয়ে পড়েছিলো, একটি কাঁধের ওপর গিয়ে পড়েছিলো; তা আমাকে কম্পিত করে, কিছুটা ঈর্ষারও জন্ম দেয়; এবং আমি ভয় পাই। এটা অবশ্য নতুন নয়; অন্য কয়েকটি বিয়ের আসরেও আমার এমন হয়েছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে রূপসী বউ দেখে আর নিজের কথা ভেবে কে না কাঁপন আর ঈর্ষা বোধ করে; আর অসুন্দর বউ দেখে কে না সুখ পায়। আমার কাঁপন আর ঈর্ষা ছিলো অল্প সময়ের জন্যে;–তা অচিরেই কেটে যায়; দু-তিন দিনের মধ্যেই আমি ভুলে যাই যে আমার বন্ধু দেলোয়ারের বউ অত্যন্ত রূপসী। কিন্তু ভয়টা আমার সঙ্গে থেকে যায়; আমি যে দেলোয়ারের বউর চিবুক আর কাঁধের ওপর চোখ ফেলেছি; এতে আমার ভয় লাগতে থাকে, অপরাধ বোধ হ’তে থাকে;–অনেক বছর আমি কোনো নারীর শরীরের ওপর এমনভাবে চোখ ফেলি নি।
বিয়ের পর আরো দু-তিনটি অনুষ্ঠানে আমি আমন্ত্রিত হই; এবং আমি যাই নি এমন নয় যে ওই দিনগুলোতে আমার আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজ, বা আরো আনন্দয়ক উৎসবে নিমন্ত্রণ ছিলো। আমি যাই নি;–কেনো যাই নি, আমি নিজেও বুঝি নি। আমার কি ভয় হচ্ছিলো যে গেলে আমার চোখ আবার দেলোয়ারের বউর চিবুক বা কাঁধের ওপর গিয়ে পড়বে? বা পড়বে আরো ভয়ঙ্কর কোনো জায়গায়;–নতুন বিয়ের পর বউদের ভয়ঙ্কর জায়গাগুলো থেকে মাঝেমাঝেই কাতান বেনারসি জর্জেট খসে পড়ে, খসে পড়লেই তাদের আরো সুন্দর দেখায়–এবং আমি আবার কাঁপন আর ঈর্ষা বোধ করবো? না কি বউ ব্যাপারটিই ভীত করতে আমাকে বউ ব্যাপারটি মনে হলেই আমার অন্যদের কথা মনে হতো; কখনো নিজেকে মনে পড়তো না; বউ এবং নিজেকে জড়িয়ে আমি কিছু ভাবতে পারতাম না। আমি দেলোয়ারের ওই অনুষ্ঠানগুলোতে যাই নি; না যাওয়ার জন্যে আমার মনে ক্ষীণ অপরাধবোধ জন্ম নেয়। দেলোয়ারের সাথে আমার তো দেখা হবেই, দু-এক দিনের মধ্যে না হোক দু-এক মাসের মধ্যে হবেই; তখন আমি কী জবাব দেবো? তখন থেকে দেলোয়ার আর তার বউ ডলির কথা আমার সব সময় মনে পড়তে থাকে; মনে হতে থাকে এই বুঝি দেলোয়ার আমার বাসায় বা মানুষ হিশেবে আমার অপরাধসমূহ অফিসে আসছে; এই বুঝি টেলিফোন করছে; এবং আমি ভয় পাই। একরাতে আমি ডলিকে স্বপ্নে দেখি। স্বপ্নে আমি ডলির চিবুক বা কাঁধ দেখি না; পেছন দিক থেকে তার দীর্ঘ গ্রীবা আর প্রশস্ত পিঠ দেখি, এবং ঘুম থেকে জেগে উঠি। বন্ধুর নতুন বউকে স্বপ্নে দেখা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না; তারপর সারারাত আমি আর ঘুমোতে পারি না।
এক ছুটির দিন, ভোরবেলা, যখন আমি ঘুম থেকে জেগে গড়াচ্ছি, চা খাচ্ছি, গড়াচ্ছি, সিগারেট টানছি, আমার ভালো লাগছে, পুরোনো প্লেবয়ের পাতা উল্টোচ্ছি, চা খাচ্ছি, আমার ভালো লাগছে না কিন্তু ভালো লাগছে, বেলা দশটা বেজে যাচ্ছে, অনেক কিছু আমার মনে পড়ছে এবং অনেক কিছু আমার মনে পড়ছে না, তখন দেলোয়ার তার বউকে নিয়ে আমাদের ফ্ল্যাটে উপস্থিত হয়। একরাশ সুগন্ধ ঝড়ের বেগে আমার দরোজা দিয়ে ঢুকছিলো; তাতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম দেলোয়ার তার বউকে নিয়ে এসেছে। দেলোয়ার যে একদিন আসবে, তাতে আমি নিশ্চিত ছিলাম। কেনো নিশ্চিত ছিলাম? আমি কি কোনো অলৌকিক পরিকল্পনা অনুমোদন করিয়ে নিয়েছিলাম কোনোখানে, যা অনুসারে দেলোয়ারকে আমাদের ফ্ল্যাটে আসতেই হতো? ও-ধরনের কিছু আমি করি নি, করার শক্তি আমার নেই; কিন্তু আমি জানতাম দেলোয়ার তার বউকে নিয়ে একদিন আসবেই। সুন্দর দামি জিনিশ, আমার মনে হতো, কেউ কখনো একলা উপভোগ করে সম্পূর্ণ তৃপ্তি পায় না; আর দেলোয়ার তো আমাকে ছাড়া কিছুই উপভোগ করে সুখ পেতো না। দেলোয়ার তার রূপসী বউকে নিশ্চয়ই উপভোগ করছে; কিন্তু আমার মনে হতো আমাকে বাদ দিয়ে তার উপভোগ কখনো সম্পূর্ণ হবে না; তার উপভোগকে পরিপূর্ণ করে তোলার জন্যে একদিন বউকে নিয়ে আমার কাছে আসতেই হবে; এবং দেলোয়ার এসে উপস্থিত হয়। আমি তার বউর দিকে তাকাতে পারি না। বিয়ের পর বউদের মাংস আর চামড়ায় অদ্ভুত রঙ লাগে; তারা ঢলঢল করতে থাকে–এটা আমার ছেলেবেলায় দেখা, পরে আর আমি কোনো নতুন বউর দিকে ভালো করে তাকাতে পারি নি; দেলোয়ারের বউর চামড়ায়, আমি দেখতে পাই, সোনার হাল্কা প্রলেপ লেগেছে; তার কোমল আদুরে চর্বি চামড়া ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। দেলোয়ারের বউর চামড়ার ভেতর দিয়ে একটি শ্রাবণের নদী বইছে। কারো পক্ষে ওই সৌন্দর্য একলা উপভোগ করা সম্ভব নয়। দেলোয়ার নিশ্চয়ই ওই সৌন্দর্য উপভোগের সময় নীরবে চিৎকার করে ওঠে; নিজেকে মহাশূন্যে-খসে-পড়া পালক বলে মনে করে; ওই সৌন্দর্য উপভোগের সময় বারবার মরে যেতে যেতে বেঁচে ওঠে, কিন্তু কখনো সম্পূর্ণরূপে উপভোগ করতে পারে না।
দেলোয়ার তার বউকে নিয়ে সরাসরি আমার ঘরে ঢোকে। এই প্রথম কোনো নারী ঢোকে আমার ঘরে;–আমার ছোটো বোনটি আর মা সব সময়ই আমার ঘরে ঢোকে, একবার একটি সহপাঠিনীও এসেছিলো; কিন্তু আমার মনে হয় এই প্রথম কোনো নারী আমার ঘরে ঢুকলো। আমার ঘরটি বদলে যায়, সিলিংয়ের এককোণে মাকড়সার জালটি সোনার তন্তুমালার মতো ঝলমল করে ওঠে। আমি লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করি, কিন্তু পেরে উঠি না; দেলোয়ারের বউ তাতে খিলখিল করে হেসে ওঠে। ওই হাসি শুনে আমার মনে হয় আমি অজস্র অপরাধ করে ফেলেছি, তবে সেগুলো ক্ষমার অযোগ্য নয়; অন্যরা না হলেও ডলি সেগুলো অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়ে সুখ পাচ্ছে। ডলি ক্ষমা করে দিলেও আমি অজস্র অপরাধের ভার বোধ করতে থাকি। আমার ভেতরে একটি পুরোনো অপবিত্রতার বোধও জেগে ওঠে। তারা দুজনেই আমাকে নির্দেশ দেয় তাড়াতাড়ি উঠতে, এবং তাদের সাথে যেতে। আমি কোনো প্রশ্ন করি না–প্রশ্ন করলেই আমার অপরাধ বাড়বে মনে হয়; উঠে আমি নিজেকে তৈরি করে নিই, এবং তাদের সাথে বেরিয়ে পড়ি। আমি গাড়ির পেছনের সিটে বসতে চাই, ডলি বসতে দেয় না; সে-ই উঠে পেছনের সিটে বসে; সম্ভবত একটি পুরুষকে পেছনের সিটে বসিয়ে নিজে একটি পুরুষের পাশে বসতে তার দ্বিধা হয়। আমি সামনের সিটে বসি; দেলোয়ার গাড়ি চালাতে শুরু করে।
গাড়িতে উঠে আমি জানতে পারি তারা আমাকে গ্রামে নিয়ে যাচ্ছে। বিয়ের পর দেলোয়ার এই প্রথম যাচ্ছে ডলিদের গ্রামের বাড়ি; অন্যরা সবাই চলে গেছে, এর মাঝে দেলোয়ার আর ডলিও হয়তো গিয়ে পৌঁছোতো; কিন্তু বাসা থেকে বেরিয়ে আমার কথা মনে পড়ে দেলোয়ারের। আমাকে চমকে দেয়ার জন্যে তারা ঠিক করে আমাকেও সাথে নিয়ে যাবে; আমি রাজি না হলেও তারা শুনবে না। আমি টের পাই গাড়িটা পুরোপুরি সুগন্ধে ভরে আছে। পেছনের সিট থেকে কোমল মাংসের সাথে মিশে একাকার হয়ে যাওয়া সুগন্ধ এসে আমার নাকে লাগতে থাকে। বেশি সুগন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে; কিন্তু আমি খুব আনন্দে রয়েছি এমনভাবে বসে থাকি। এক সময় আমার মনে হয় গাড়ি সুগন্ধে নয়, মাংসের গন্ধে ভরে উঠছে, সোনালি মাংসের ভেতর থেকে গন্ধ উঠে আসছে; তখন গাড়ি থেকে লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়তে আমার ইচ্ছে হয়। দেলোয়ার গাড়ি চালাচ্ছে, আর অনবরত কথা বলছে, আর ডলি অনবরত হেসে চলছে; ডলির হাসির শব্দও আমার কাছে মাংসে গঠিত বলে মনে হয়। ডলির দিকে পেছন ফিরে একবারও আমি তাকাই নি, কিন্তু তার হাসি শুনে আমি বুঝতে পারি সম্ভব হলে সে গাড়ি ভ’রে মাংস ছড়িয়ে দিতো; তাল তাল মাংসের গোলাপ ফুটিয়ে তুলতে গাড়ি জুড়ে। ডলি এখন পুরোপুরি মাংস। আমি ভয়ঙ্কর মাংসের গন্ধ পেতে থাকি; নারায়ণগঞ্জ নামের একটি শহরের কথা আমার মনে পড়ে; ইচ্ছে হয় দেলোয়ারকে গাড়ি থামাতে বলি, বাইরে গিয়ে অনেকক্ষণ নিশ্বাস নিই; কিন্তু দেলোয়ারকে আমি গাড়ি থামাতে বলতে পারি না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ফেরিঘাটে পৌঁছি। শহরের সব লোক সম্ভবত বাস ট্রাক বেবি জিপ গাড়ি করে শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে; হয়তো শহরে তাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে, বা শহরে মড়ক লেগেছে, বা আজই শহর ভ’রে প্লেগ দেখা দেবে, এমন ভিড় ফেরিঘাটে; তবে দেলোয়ার চমৎকার গাড়ি চালাতে জানে-সে একটির পর একটি গাড়ি পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। এক সময় তাকেও থামতে হয়। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, বারবার নেমে পড়ার প্রচণ্ড চাপ বোধ করছিলাম; কিন্তু নেমে পড়া ঠিক হবে কি না আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। দুটি জিনিশ কঠোর পীড়া দিচ্ছিলো আমাকে;–মাংসমেশানো সুগন্ধে আমার দম আটকে আসছিলো, আর গাড়িতে বসে ফেরিতে ওঠার ভয় পেয়ে বসছিলো আমাকে। আমি তা প্রকাশ করতে পারছিলাম না। আমি কী করে প্রকাশ করি যে বন্ধুর নতুন বউর শরীর থেকে যে-সুগন্ধ বেরোচ্ছে, তাতে আমি কাঁচা মাংসের গন্ধ পাচ্ছি; তাতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে? আর আমি কী করে বলি যে গাড়িতে বসে ফেরিতে উঠতে আমার ভয় হচ্ছে? আমাদের সামনের পেছনের বাসগুলোর লোকদের তো ভয় হচ্ছে না। দেলোয়ার আর তার বউর তো ভয় হচ্ছে না। আমার একা কেনো ভয় হবে? আমার একার ভয় হওয়া ন্যায়সঙ্গত নয় বলে আমার মনে হচ্ছিলো। তবে আমার ভয় করছিলো; তাতেই হয়তো আমি বেশি করে তীব্র মাংসের গন্ধ পাচ্ছিলাম। গাড়িতে বসে পানি দেখলে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে চায়; আমি দেখতে পাই বাক্সের ভেতরে বন্দী করে কারা যেনো আমাকে পানিতে ফেলে দিয়েছে; আমি বেরোতে পারছি না। আমার এই অনুভূতি হতে থাকে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে।
আমি হঠাৎ দরোজা খুলে বাইরে একটি পা রাখি।
তুমি বাইরে বেরোতে চাও? দেলোয়ার জিজ্ঞেস করে।
আমি কোনো উত্তর দিই না; তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
ডলি, তুমিও বেরোও, দেলোয়ার পেছনের দিকে তাকিয়ে বলে, ফেরিতে ওঠার সময় গাড়িতে থাকা ঠিক না।
আমি নিশ্চিত ছিলাম ডলি বেরোতে চাইবে না, দেলোয়ারের সাথেই থাকতে, চাইবে;–আমি তা-ই চাচ্ছিলাম। কিন্তু ডলি দরোজা খুলে বেরোনোর উদ্যোগ নিলে আমি অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করি; আমি বন্দী হয়ে পড়ছি বলে আমার মনে হয়। ডলির সাথে এখনো আমার সরাসরি কোনো কথাই হয় নি; সে গাড়ি থেকে বেরোলে আমার কি তার সাথে কথা বলতে হবে না? আমি কি তাকে পেছনে রেখে পোন্টুনের দিকে একা হাঁটতে পারবো? একা হেঁটে যাওয়া কি ঠিক হবে? তার সাথে আমি কী কথা বলবো? আমি এগিয়ে গিয়ে কথা বললে সে কি কিছু মনে করবে না? দেলোয়ার কি গাড়ি থেকে তাকিয়ে লক্ষ্য করবে না আমি ডলির সাথে কীভাবে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছি? তার কি তখন একটু কেমন লাগবে না? নিজেকে আমার অস্বাভাবিক মনে হতে থাকে; একবার সামনের দিকে বেশ বড়ো করে পা ফেলি, ঠিক কোথায় পা ফেলবো বুঝে উঠতে পারি না; একটু থেমে যাই, এবং পেছনের দিকে তাকাই। ওদিকে সামনে গাড়ি চলতে শুরু করেছে, ফেরিতে ওঠা শুরু হয়ে গেছে, দেলোয়ার বেশ দ্রুত গাড়ি এগিয়ে নিচ্ছে। আমাদেরও–ডলির এবং আমার, তাড়াতাড়ি ফেরিতে গিয়ে উঠতে হবে। আমি একবার ডলির দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াই; ডলিও একবার আমার দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ায়।
গাড়িগুলো ফেরিতে উঠছে যেনো নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে; অসংখ্য লেমিং ছুটছে কে কার আগে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে; বা শিশুরা ছুটছে কোনো মজার পুরস্কার পাবে বলে। দেলোয়ার গাড়ি নিয়ে সবার আগে ফেরিতে উঠে গেছে; ডলি আর আমি পিছিয়ে পড়েছি; একটা ট্রাকের জন্যে তার গাড়িটা দেখতে পাচ্ছি না। আমরা দ্রুত ফেরির একপাশ দিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকি; আমি একবার দেলোয়ারের গাড়িটা দেখি; কিন্তু পরমুহূর্তেই তার গাড়িটা আর দেখতে পাই না। ফেরির সামনের দিকের লোকগুলো একবার খুব জোরে চিৎকার করে ওঠে; এবং একটা ট্রাক ভয়ঙ্কর শব্দ করে ব্রেক কষে। আমি সামনের দিকে তাকিয়ে শূন্য নদী দেখি; ডলি আমার দিকে অন্ধ হয়ে তাকায়।
আমি যে খুব জোরে চিৎকার করে উঠতে পারি না, তাতে আমার বিস্ময় লাগে না; কিন্তু ডলিও যে চিৎকার করে ওঠে না, তাতে আমি অপরাধ বোধ করতে থাকি। ডলির খুব জোরে চিৎকার করে ওঠা উচিত–আমার মনে হতে থাকে; তার নদীতে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করা উচিত-আমার মনে হতে থাকে; কিন্তু সে তা কিছুই করে না। তাতে আমার ভেতরে বেশি করে অপরাধবোধ জমতে থাকে। কেউ কেউ দেলোয়ারের গাড়ির জন্যে, দেলোয়ারের জন্যে, পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে; তবে ওসব পণ্ডশ্রম;–দেলোয়ার যদি নিজে না উঠে আসে, তাহলে কেউ দেলোয়ারকে উঠিয়ে আনতে পারবে না; যখন পারবে তখন দেলোয়ার আর দেলোয়ার থাকবে না। লোকজন ঘিরে ধরেছে আমাদের, যে নদীতে পড়ে গেছে তার সাথে আমার কী সম্পর্ক, বিশেষ করে ডলির কী সম্পর্ক জানার জন্যে ব্যগ্র হয়ে পড়েছে; কিন্তু আমরা কিছু বলছি না, বলতে পারছি না। কয়েকটি দারোগাপুলিশ এসে পড়েছে; বড়ো দারোগাটি আমাদের সম্পর্ক না জেনে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না মনে হচ্ছে। সমস্ত সম্পর্ক জানার পরই সে ঠিক করতে পারবে দেলোয়ারের গাড়ি পানির ভেতর থেকে কীভাবে উদ্ধার করা হবে, বা উদ্ধার করা হবে কি না। আমি তাকে জানাই গাড়ি নিয়ে যে ডুবে গেছে, সে আমার বন্ধু; তার নাম মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন; আর যে-মহিলাটি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, সে দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী; তাদের নতুন বিয়ে হয়েছে। দারোগা আর চারপাশের লোকগুলো আমার আর ডলির দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। তাদের অদ্ভুত চোখ দেখে আমার মনে হয় আমার গাড়ির ভেতরে থাকা উচিত ছিলো; গাড়ির সাথে তলিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো; এমন মনে হওয়ার সাথে সাথে আমার ভেতরে অপরাধবোধটি আরো ঘন হয়ে উঠতে থাকে। গাড়ির ভেতরে ওই মাংসমেশানো গন্ধ যদি না পেতাম, আর পানি দেখে আমার যদি ভয় না লাগতো, অর্থাৎ আমি যদি সম্পূর্ণ সুস্থ হতাম ওই বাসের ভেতরে বসে থাকা লোকগুলোর মতো, এবং সাহসী হতাম, তাহলে এখন এই বড়ো দারোগা আর পাঁচটি পুলিশ আর চারপাশের লোকগুলো আমাদের দিকে এমন অদ্ভুতভাবে তাকাতে পারতো না। আমি না হয় গাড়ি থেকে নেমে এসেছিলাম, কিন্তু ডলি নামলো কেনো? তার তো থাকার কথা ছিলো দেলোয়ারের সাথে। মাংসল কোনো গন্ধ নিশ্চয়ই তার নিশ্বাস বন্ধ করে নি; তবে সেও কি আমার মতো কোনো ভয়ে পীড়িত বোধ করেছিলো? তাহলে সে কি দেলোয়ারকে সম্পূর্ণ ভালোবাসে না? সে কি পানি দেখে ভয় পেয়েছিলো?–কেনো ভয় পাবে? লোহার সিন্দুকে ভরে তাকে কেউ পানিতে ফেলে দিয়েছে, এমন শ্বাসরুদ্ধকর বোধ তার হয়েছিলো?–কেনো স্বাসরুদ্ধকর বোধ হবে? সে কি সিন্দুকে দেলোয়ারকে দেখতে পায় নি? দেলোয়ার যদি সে-সিন্দুকে থাকে, তার শ্বাস কেনো আটকে আসবে? সে কি দেলোয়ারকে সম্পূর্ণ ভালোবাসে না? স্ত্রী হওয়ার সাথে সাথেই কি ভেতর থেকে ভালোবাসা জন্ম নেয় না? তাদের শরীর যেমন মিলিত হয়েছে, আমি ধরে নিচ্ছি, এক শরীর থেকে মধু যেমন ঢুকেছে আরেক শরীরে, তেমনভাবে এক শরীর থেকে আরেক শরীরে কি তাদের আত্মা আর প্রেম ঢোকে নি? ডলির বাইরে বেরিয়ে পড়াটা আমি সমর্থন করতে পারি না; এবং চারপাশে তাকিয়ে দেখি চারপাশের চোখ আমাদের, ডলির এবং আমার, বাইরে বেরোনো সমর্থন করতে পারছে না।
বড়ো দারোগা আমাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি বাইরে বেরিয়েছিলেন কেনো?
প্রশ্ন শোনার সাথে সাথেই আমি বুঝতে পারি আমি অপরাধ করেছি। দারোগারা শুধু প্রশ্ন করে না; তাদের প্রশ্নের ভেতরে অপরাধীর অপরাধ সম্পর্কে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত থাকে; আমি বড়ো দারোগার প্রশ্নের মধ্যে ওই নিশ্চিত সিদ্ধান্তটি শুনতে পাই। আমার মনে হয় আমি অপরাধ করেছি কি না তা আমি ভালোভাবে বুঝতে পারছি না; বুঝতে পারছে বড়ো দারোগা; তার পোশাক, গোঁফ, হাতের লাঠি জানিয়ে দিচ্ছে অপরের ব্যাপার, বিশেষ করে অপরাধের ব্যাপার, বোঝার অধিকার তার ওপর অর্পণ করা হয়েছে। আমি অপরাধ করেছি কি না তা বোঝার শক্তি বা অধিকার আমার নেই, তা বুঝতে পারে ওই বড়ো দারোগা; এবং তার কথা শুনে, তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারি আমি অপরাধ করেছি।
আমি বলি, গাড়ির ভেতরে সুগন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।
আমার কথা শুনে চারপাশ ডলির দিকে তাকায়, এবং ডলি তাকায় আমার দিকে।
দারোগা বলে, সুগন্ধে কারো দম বন্ধ হয়ে আসে না।
আমিও বড়ো দারোগাকে সমর্থন করি; আর কেউ যদি আমাকে বলতো সুগন্ধে তার দম বন্ধ হয়ে আসে, তাহলে আমিও বলতাম সুগন্ধে কারো দম বন্ধ হয়ে আসে না। কিন্তু সত্যিই সুগন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো; বিশেষ করে মাংসমেশানো সুগন্ধে; এবং আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, তাতে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকে।
তবু আমি বলি, আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
দারোগা আমার দিকে প্রভুর মতো তাকায়; আমার মনে হতে থাকে এখন সে যে-কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারে; এবং সে যে-সিদ্ধান্তই দেবে, তা-ই ঠিক সিদ্ধান্ত। আমি তার সিদ্ধান্ত মেনে নেবো, কেননা তাতে কোনো ভুল হতে পারে না।
দারোগা বলে, আপনি সুস্থ নন।
আমি চারপাশের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি সবাই বড়ো দারোগার সাথে একমত; এমন কি ডলির মুখও বলছে আমি সুস্থ নই।
বড়ো দারোগা আমার সম্পর্কে সব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে; ডলির সম্পর্কে তার এখনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নি। ডলির সম্পর্কেও তার সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার।
বড়ো দারোগা ডলিকেও জিজ্ঞেস করে, আপনি বাইরে বেরিয়েছিলেন কেনো?
ডলি বলে, গাড়িতে আমার ভয় করছিলো।
বড়ো দারোগা জিজ্ঞেস করে, কেনো ভয় করছিলো?
ডলি বলে, মরে যাওয়ার ভয় করছিলো।
বড়ো দারোগা জিজ্ঞেস করে, আপনাদের না নতুন বিবাহ হয়েছিলো?
ডলি বলে, হ্যাঁ।
বড়ো দারোগা বলে, তাহলে কেনো ভয় করলো?
ডলি কোনো উত্তর দেয় না; সে একবার নদীর দিকে তাকানোর চেষ্টা করে। বড়ো দারোগা ডলি আর আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। তার চোখ দেখে মনে হয় নতুন বিয়ে হলে স্বামীর সাথে গাড়ি করে ফেরিতে উঠতে ভয় পাওয়া আইনসম্মত নয়, নীতিসম্মত নয়।
বড়ো দারোগা জিজ্ঞেস করে, আপনি কি জানতেন দুর্ঘটনা ঘটবে?
ডলি বলে, না।
বড়ো দারোগা বলে, তাহলে আপনি ভয় পাচ্ছিলেন কেনো?
ডলি বলে, জানি না; কিন্তু আমার ভয় করছিলো।
ডলির থেকে যা জানার বড়ো দারোগার জানা হয়ে গেছে; সে এবার আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনাদের মধ্যে কে আগে নেমেছিলেন?
আমি বলি, আমি।
বড়ো দারোগা জিজ্ঞেস করে, আপনাদের কি আগে থেকে পরিচয় ছিলো?
আমি কিছু বলার আগে ডলি উত্তর দেয়, না।
বড় দারোগা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না কেনো?
আমি বলি, দিতে দেরি হয়ে গেছে।
বড়ো দারোগা বলে, এতো দেরি স্বাভাবিক নয়।
দেলোয়ার ভেসে ওঠে নি; সবাই সম্ভবত অপেক্ষা করছিলো দেলোয়ার ভেসে উঠে সকলের কৌতূহল মেটাবে; বিশেষ করে দারোগা আর পুলিশরা সরকারি দায়িত্ব হিশেবেই দেলোয়ারের লাশটির ভেসে ওঠার প্রত্যাশা করছিলো। পারলে তারা লাশটিকে ভেসে ওঠার আদেশ দিতো। তাহলে সরকারের অপচয় বাঁচতো; কিন্তু দেলোয়ার তাদের প্রত্যাশা পূরণ করে নি। দারোগার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি দেলোয়ারের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম; মনে করতে পারছিলাম না আমি কেনো ফেরির ওপর দাঁড়িয়ে আছি, আমার সামনে কেনো দারোগা আর পুলিশ, আর কেনোই বা একটি নারী আমার পাশে। দেলোয়ার ভেসে ওঠে নি; তাই ফেরিটি এখন ছাড়বে; বড়ো দারোগা আমাদের কাছে জানতে চায় কোথায় খবর দিতে হবে। কোথায় খবর দিতে হবে, আমি জানি না; ডলি জানে। আমি ডলির দিকে তাকাই; ডলি তাদের গ্রামের ঠিকানা বড়ো দারোগাকে লিখে দেয়। বড়ো দারোগার সাথে ডলি আর আমি পোন্টুনে ফিরে আসি; ফেরিটি ছেড়ে দেয়। ডলির দিকে তাকিয়ে আমি অপরাধ বোধ করতে থাকি। ডলিকে অদ্ভুত দেখাতে থাকে; মনে হয় ডলি এখন কাঁদতো, কিন্তু কাঁদতে পারছে না; বড়ো দারোগা বা এই নদী বা আমার সামনে সে নিজের বা দেলোয়ারের জন্যে কাঁদতে পারবে না।
দেলোয়ারের গাড়িটি উঠোনোর জন্যে একটি উদ্ধারকারী জাহাজকে খবর পাঠানো হয়েছে। পাঠানো হয়েছে? আমি জানি না; আমার মনে হয় খবর পাঠানোই নিয়ম, নিশ্চয়ই পাঠানো হয়েছে। কোনো জাহাজ এসে পৌঁছে নি। আমার কোনো তাড়া নেই; ডলিরও কোনো তাড়া নেই-সে পোন্টেনের এককোণে গিয়ে এমনভাবে বসেছে যে বোঝা যাচ্ছে তারও কোনো তাড়া নেই; খুব শিগগির সে কোনো তাড়া বোধ করবে না। কোনো জাহাজ আসে নি; তবে পুলিশরা খুবই দক্ষ-দলে দলে ডলিদের বাড়ি থেকে লোকজন এসে পৌঁচোচ্ছে; আমি অবশ্য তাদের কাউকেই চিনি না। তারা আসার পরই আমি প্রথম শোকের চাপ বোধ করতে শুরু করি;–তারা চিৎকার আর অশ্রুতে চারপাশ মুখর ও ভারাক্রান্ত করে আসতে থাকে; আমি ওই চিৎকার শুনে হঠাৎ এক প্রচণ্ড অভাব বোধ করি। আমার মনে হতে থাকে দেলোয়ার নেই, দেলোয়ারকে আমি আর কখনো দেখবো না; পরিচিত কারো সাথে দেখা হলেই দেলোয়ার আর আমার কথা বলবে না, আমিও তার কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যাবো। ডলিদের বাড়ির লোকজন আমাকে চেনে না বলেই আমার কাছে কেউ আসছে না; সবাই ডলিকে ঘিরে ধরছে, ডলি কোনো কথা বলছে না। একবার আমার মনে হয় আমি খুব দূরে গিয়ে দাঁড়াই, কিন্তু দূরে যেতে পারি না; বরং ভিড় ঠেলে একটু একটু করে ডলির বেশ কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াই। মেয়েরা ডলিকে জড়িয়ে ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে কাঁদার চেষ্টা করছে, বা ডলিকে কাঁদাতে চাচ্ছে; কিন্তু ডলি কাঁদছে না। আমি দেখতে পাই ডলি চোখ দিয়ে কী যেনো খুঁজছে; এক সময় তার চোখ এসে আমার চোখের ওপর পড়ে; ডলি হঠাৎ ডুকরে কেঁদে ওঠে।
আমি অন্য দিকে তাকাই; আর তখনই দেখি দেলোয়ারের বাবা, মা, একটি বোন, আর একটি ভাই জড়াজড়ি করে কেঁদে কেঁদে ফেরি থেকে নামছে। আমি তাদের দিকে এগিয়ে যাই, দেলোয়ারের বাবাকে জড়িয়ে না হলেও ধরার চেষ্টা করি। তাকে আমি ঠিকমতো ধরতে পারি না; আমার মনে হয় তিনিই আমাকে ধরতে দিচ্ছেন না; আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন না। তারা হঠাৎ দাঁড়িয়ে যান; ডলির দিকে আর এগোন না। দেলোয়ারের মা একবার নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে চান, কিন্তু পারেন না; তাঁকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে দেলোয়ারের ভাইটি ও বোনটি। দেলোয়ারের বাবা লাফিয়ে পড়তে চাচ্ছেন না; সম্ভবত পুরুষ হওয়ার অসুবিধা এই যে সব কাজ তাদের মানায় না; শেষ সিদ্ধান্ত তারা সহজে নিতে পারে না। আমি সবার মুখের দিকে তাকাতে থাকি, সেখানে আমি কিছুই খুঁজি না; শুধুই তাকাই; অনেকের মুখেই আমি বেদনা দেখতে পাই; ডলির মুখের দিকে তাকাতেই আমি বেদনার বদলে অপরাধবোধ দেখতে পাই। ডলি কি কষ্টের বদলে অপরাধে ভুগছে? সে যে দেলোয়ারের সাথে গাড়িতে থাকে নি, এটা কি তার কাছে অপরাধ মনে হচ্ছে? সে কি মনে করছে দেলোয়ারের সাথে গাড়িতে থেকে পানিতে ডুবে গেলেই সে ঠিক কাজটি করতো; এবং ঠিক কাজটি করে নি বলে নিজেকে অপরাধী মনে করছে? ডলির মুখে যদি আমি অপরাধের ছাপ দেখতে পাই, তাহলে সবাই আমার মুখে কী দেখছে? আমার মুখ নিশ্চয়ই বেদনায় নীল হয়ে যায় নি; আমি কোনো বেদনা বোধ করছি না, অভাব বোধ করছি দেলোয়ারের; ওই অভাবটা আমার বুকের ভেতরে, মুখে তার কোনো চিহ্ন নেই। আমি যে বেঁচে আছি, এটা অপরাধের মতো মনে হতে চাচ্ছে এখন; ডলির মুখ দেখার পরই এ-বোধটি আমার তীব্র হয়ে উঠছে। আমি কোনো অপরাধ করেছি। আমার তো এখানে থাকারই কথা নয়; এখনো আমি হয়তো পুরোনো প্লেবয়ের পাতা উল্টোতাম, চা খেতাম, সিগারেট টানতাম; দেলোয়ারই তো এখানে আমাকে নিয়ে এসেছে; এবং সে আমাকে অপরাধবোধের মুখে ছুঁড়ে দিয়ে নিজে চিরনিরপরাধের মতো চলে গেছে। কিন্তু আমি কি কোনো অপরাধ করি নি?
দেলোয়ারের বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?
আমি বলি, আমি দেলোয়ারের সাথে যাচ্ছিলাম।
তিনি বলেন, তুমি যাবে বলে তো জানতাম না।
আমি বলি, ওরা আমাকে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসে।
তিনি এবার জানতে চান, তুমি গাড়ি থেকে নেমেছিলে কেনো?
আমি বুকে একটা আঘাত বোধ করি। আমি তাঁকে বলতে পারি না যে গাড়িতে মাংসমেশানো সুগন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, তাই আমি গাড়ি থেকে নেমেছিলাম। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই তিনি দেলোয়ারের সাথে আমাকেও নদীর গর্ভে দেখতে চাচ্ছেন; আমি সেখানে নেই বলে কষ্ট পাচ্ছেন। তার চোখ দেখে আমি অপরাধ বোধ করি; ইচ্ছে হয় দেলোয়ারের সাথে ডুবে যাই, আর লাশ হয়ে দেলোয়ারকে জড়িয়ে ধরে ভেসে উঠি।
আমি তাকে বলি, গাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।
তিনি বলেন, তাই তুমি বেঁচে আছে।
একটু থেমে জিজ্ঞেস করেন, ডলি কি তোমার সাথেই গাড়ি থেকে নেমেছিলো?
আমি বলি, না।
তিনি জিজ্ঞেস করেন, ডলি কখন নামে?
আমি বলি, আমি নামার একটু পরে।
তিনি জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি ডলিকে আগে থেকেই চিনতে?
আমি প্রায় হ্যাঁ বলে ফেলেছিলাম; কিন্তু বলার একটু আগে আমার মনে পড়ে ডলিকে আমি আগে থেকে চিনতাম না, এখনো চিনি না।
আমি বলি, না।
তিনি বলেন, তাহলে তোমরা দুজন গাড়ি থেকে নেমেছিলে কেনো?
আমি কোনো উত্তর দিই না; দেলোয়ারের বাবা যেনো আমার উত্তর পেয়ে গেছেন এমনভাবে নিচ দিকে ও চারদিকে তাকান; আমার মুখের দিকে আর তাকান না; যেখানে লোকজন ডলিকে ঘিরে আছে, সেদিকে হাঁটতে থাকেন। আমি অন্য কোনো দিকে যেতে পারি না; মনে হয় দেলোয়ারের বাবা আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, আমি তাঁর হাত থেকে ছুটতে চেষ্ট করছি, কিন্তু ছুটতে পারছি না, এমনভাবে তাঁর পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকি। দূর থেকে আরেকবার আমি ডলির মুখ দেখি; তাতে আমি কষ্ট দেখতে পাই না; একধরনের গোপন শান্তি দেখতে পাই, ওই শান্তির ওপর একটা হাল্কা অপরাধের ছায়া দেখতে পাই। আমার মুখেও কি অন্যরা অমন কোনো গোপন শান্তি দেখতে পাচ্ছে? তার ওপর দেখতে পাচ্ছে লঘু অপরাধের ছায়া? আমি মাংসমেশানো গন্ধটা আবার পেতে থাকি, তবে এবার আমার দম বন্ধ হয়ে আসে না; আমি গন্ধটা প্রাণপণে বুকের ভেতর নেয়ার জন্যে একটি দীর্ঘ নিশ্বাস নিই; সুগন্ধে আমার বুক ভরে ওঠে। তারপরই দেলোয়ারের অভাব আবার বোধ করি। গাড়ি থেকে নেমে যাওয়া আমার ঠিক হয় নি, গাড়িতে থাকলেই ভালো হতো বলে মনে হয়। আমার মুখে, আমি নিজেই টের পাই, অপরাধের ছাপটি বেশ ঘন হয়েই লেগেছে; এখন সবাই নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছে। আমিও আমার মুখটি চারদিকে দেখতে পাচ্ছি, অপরাধবোধের একটি কালো প্রলেপ লেগে আছে আমার মুখটিতে।
দেলোয়ারের মা ডলিকে জিজ্ঞেস করছেন, বউ, তুমি গাড়ি থেকে নেমেছিলে কেনো?
ডলি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে; তিনি আবার ওই প্রশ্ন করেন। ডলি কোনো উত্তর দেয় না; দেলোয়ারের মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ডলি কী যেনো পড়ার চেষ্টা করে।
ডলি অনেকক্ষণ ধরে পড়ে,–ডলি যেভাবে তাকায় তাতে পড়ার কথাই আমার মনে হয়; পড়া শেষ হলে চুপ করে থেকে শেষে ডলি বলে, আমার ভয় করছিলো।
তিনি বলেন, স্বামীর সাথে থাকতে মেয়েলোকের কী ভয়?
‘স্বামী’ শব্দটি শুনে আমার যেনো কেমন লাগে, ডলিকে আমার নোংরা মনে হয়।
ডলি বলে, মনে হচ্ছিলো আমি মরে যাবো।
তিনি বলেন, স্বামীর সাথে মরতে পারাও তো মেয়েলোকের ভাগ্য; তোমার সেই ভাগ্যও হলো না।
ডলি নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
তিনি জিজ্ঞেস করেন, আনিসের সাথে তোমার আগে থেকে জানাশোনা ছিলো?
ডলি প্রথম আনিস নামটি মনে করতে পারে না বলে আমার মনে হয়; পরে আমার দিকে তাকিয়ে নামটি তার মনে পড়ে। সে অনেকক্ষণ দেলোয়ারের মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর মুখ ফিরিয়ে নেয়।
ডলি বলে, হ্যাঁ; ছিলো।
ডলির কথা শুনে আমি চমকে উঠি।
দেলোয়ারের মা জিজ্ঞেস করেন, তাই তোমরা গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছিলে?
ডলি বলে, না।
তিনি বলেন, তাহলে নামলে কেনো?
দেলোয়ারের মা এবার আমার দিকে এগিয়ে আসেন; এবং জিজ্ঞেস করেন, বউর সাথে তোমার আগে থেকেই পরিচয় ছিলো?
আমি ডলির দিকে একবার তাকাই; তখন আমার দেলোয়ারের কথা আর মনে পড়ে; ডলি আমার দিকে তাকিয়ে নদীর দিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।
আমি বলি, হ্যাঁ; পরিচয় ছিলো।
তিনি বলেন, তাই তোমরা গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছিলো?
আমি বলি, হ্যাঁ।
তিনি বলেন, এজন্যেই দেলোয়ার খুব জোরে গাড়ি চালিয়েছিলো?
আমি বলি, ফেরিতে ওঠার সময় সবাই জোরে গাড়ি চালায়।
তিনি বলেন, দেলোয়ার অন্যদের মতো না; আমার দেলোয়াররে আমি চিনি।
আমি পোন্টুনের অন্য দিকে হাঁটতে শুরু করি। দেলোয়ারের ভাই ও বোনটিকে দেখে আমি গোপনে ভয় পাই; ভাইটি আমার ওপর লাফিয়ে পড়তে পারে-বেশ চমৎকার পেশি ছেলেটির। লাফিয়ে পড়তে পারে ডলির ওপরও; এটা ডলির বাবা, ভাইবোন, আর ডলির অন্যরা টের পেয়ে গেছে মনে হচ্ছে; তারা বেশ নিবিড়ভাবে ডলিকে ঘিরে আছে। তারা ডলিকে কোনো প্রশ্ন করছে না। তাদের চোখেমুখে আমি একধরনের শান্তি আর উদ্বেগ দেখতে পাই। ডলির ছোটো বোনটি ডলিকে জড়িয়ে ধরে আছে;–কেউ ডলিকে ছিনিয়ে নিয়ে পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে, এমন একটা উদ্বেগ তার দু-বাহু দিয়ে বয়ে চলছে। তার মুখেও একটা শান্তির ছাপ লেগে আছে। একবার আমার মনে হয় শুধু আমারই কেউ নেই, আমাকে নিবিড়ভাবে ঘিরে রাখার মতো কেউ নেই। দেলোয়ারের গাড়ি খোঁজার জন্যে ডুবুরিরা পানিতে নেমেছে; তাদের ডুব দেখতে আমার ভালো লাগছে। আমি দেলোয়ারের মুখটি মনে করার চেষ্টা করি; কিন্তু তার মুখ মনে করতে পারি না; বারবার ডলির মুখটি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দেলোয়ার দেখতে কেমন ছিলো? তার কি গোঁফ ছিল? চুল চমৎকারভাবে কাটা ছিলো? কপালে একটা ছোট্ট দাগ ছিলো? আমি কেনো কিছুই মনে করতে পারছি না।
ডুবুরিরা দেলোয়ারের গাড়ি খুঁজে পাচ্ছে না; স্রোতের টানে গাড়ি আর দেলোয়ার তাদের সমস্ত সীমার বাইরে চলে গেছে; আর পাওয়া যাবে না। শুনে আমার অদ্ভুত ধরনের ভালো লাগে। কিন্তু কেনো? দেলোয়ারের লাশ আমার দেখতে হবে না বলে? দেলোয়ারের লাশের কাছে আমার জবাবদিহি করতে হবে না বলে? দেলোয়ারের লাশ যদি আমার হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে, আনিস, তুমি গাড়ি থেকে নেমেছিলে কেনো, আমি কী জবাব দেবো? আমি কি তাকে বলতে পারবো মাংসমেশানো গন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো? আমার ভালো লাগছে তার লাশ আর পাওয়া যাবে না। আমি যেনো তার লাশ গুম করে ফেলতে চাই; যেনো আমি আমার প্রিয় বন্ধুকে খুন করেছি, লাশটি গুম করে ফেলতে পারলে আমি বেঁচে যাই, এমন মনে হতে থাকে; আমি প্রার্থনা করতে থাকি যেনো কোনো ডুবুরি কোনো দিন দেলোয়ারের লাশ খুঁজে না পায়। পরমুহূর্তে মনে হয় আমি কখনো প্রার্থনা করি নি; প্রার্থনায় আমার বিশ্বাস নেই; প্রার্থনা আমার কাছে হাস্যকর। আমার করুণা হয় নিজের জন্যে। অমনি আমি দেখতে পাই শুয়ে শুয়ে আমি পুরোনো প্লেবয় পড়ছি, চা খাচ্ছি, সিগারেট টানছি; আমি কোনো নদীতে নেই, গাড়িতে নেই, মাংসমেশানো সুগন্ধে নেই।
দেলোয়ার এখন একটি শূন্য, আমার মনে হতে থাকে, দেলোয়ার কখনো ছিলো না। মরে গেলে সবাই শূন্যে পরিণত হয়। যে মরে যায়, তার কাছে সে শূন্য হয়ে যায়; সে জানে না, সে ছিলো; অন্যরাই শুধু জানে সে ছিলো। আমি জানি দেলোয়ার ছিলো; দেলোয়ার জানে না সে ছিলো। ডলি জানে দেলোয়ার ছিলো; কিন্তু আজ আর দেলোয়ার জানে না ডলি ছিলো, আর সে ছিলো, আর সুগন্ধ ছিলো, আর মাংস ছিলো। শূন্য হয়ে যাওয়া খুব কষ্টের ব্যাপার; তবে যে শূন্য হয়ে যায় তার কোনো কষ্ট থাকে না। কষ্ট অন্যদের। আমি কষ্ট পাচ্ছি, দেলোয়ারের জন্যে কষ্ট পাচ্ছি; এবং আমার ভেতর থেকে একটি ঘটনা জেগে উঠছে। ঘটনাটি জেগে উঠতেই আরো কষ্ট পাই, আমার শরীর ভেঙে আসে; আমি অন্ধকার দেখতে পাই। আমার সামনে নদী, অত্যন্ত সুন্দর নদী, যাতে আমার বারবার লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে কিন্তু আমি লাফিয়ে পড়ছি না, যাতে দেলোয়ার ডুবে গেছে, আর উঠে আসবে না, ওই নদীই আমার ভেতরে ঘটনাটি জাগিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু নদীর সাথে ঘটনাটির কোনো সম্পর্ক নেই। নদী ঘটনাটি জানে না; এখন আমি ছাড়া আর কেউ জানে না; দেলোয়ার যেহেতু এখন শূন্য, তাই সেও জানে না। ঘটনাটি আমার ভেতর জেগে উঠছে; অনেক দিন ভেতরে তলিয়ে ছিলো, কিন্তু কখনো সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যায় নি, জেগে উঠেছে মাঝেমাঝেই; এবং এখন চর হয়ে দেখা দিচ্ছে। সলিমুল্লাহ হল, সন্ধ্যা, অন্ধকার জেগে উঠছে আমার ভেতরে। আমরা দুজনই তখন কষ্টে ছিলাম-সুন্দর মধুর বিষাক্ত কষ্টের সময় ছিলো সেটা আমাদের। নদী কেনো আমার ভেতরে ওই সন্ধ্যা জাগিয়ে তুলছে? দেলোয়ার শূন্য হয়ে গেছে, সে আর কখনো আমার জীবনে এতোটা জীবিত থাকবে না, তার সাথে আজই আমার শেষ সম্পর্ক, তাই কি ঘটনাটি শেষবারের মতো জেগে উঠছে আমার ভেতরে? সন্ধ্যার অন্ধকারে দেলোয়ার আর আমি সলিমুল্লাহ হলের গাছের অন্ধকারে হাঁটছি, দেলোয়ার একটি প্রস্তাব দিচ্ছে;–আমার মনে হচ্ছে দেলোয়ার এখনই আমাকে প্রস্তাব দিচ্ছে, আর আমি তাতে সাড়া দিচ্ছি।
চল্, দেলোয়ার বলে; তারপর ক্রিয়াটি সংশোধন করে বলে, চলো, এক জায়গা থেকে ঘুরে আসি।
তার ‘চল’ আর ‘চলো’ শুনে আমি একটু বিব্রত হই, যেনো আমি কোনো অপরাধ করেছি, এমন মনে হয়। এটা ঘটে আসছে অনেক বছর ধরেই। দেলোয়ার আমাকে মাঝেমাঝেই ‘তুই’ বলে ফেলে, বন্ধুদের ‘তুই’ বলাই দেলোয়ারের অভ্যাস; তার অন্য বন্ধুরাও তাকে ‘তুই’ বলে; কিন্তু আমি তাকে কখনো তুই বলি নি; তাই আমাকে ‘তুই’ বলতে গিয়ে সে আজো থেমে যায়, অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে বলে ‘তুমি’। তার সাথে দেখা হলেই কথা শুরু করতে গিয়ে আমি অপরাধবোধে ভুগি; আমার মনে হয় দেলোয়ার মনে মনে ‘তুই’ বলতে চাচ্ছে, এবং চাচ্ছে আমিও তাকে ‘তুই’ বলি; কিন্তু আমি যেহেতু ‘তুমি’ বলবো, তাই সে তার কথার জগতটিকে আমার জন্যে পাল্টে নিচ্ছে। আমি দেলোয়ারকে তুই বলতে পারি নি, কাউকেই পারি নি, এতে সব সময়ই আমার মনে হয়েছে আমি অপরাধ করছি।
কোথায়? আমি জানতে চাই।
নারায়ণগঞ্জে।
কেনো?
তুমি কিছু না মনে করলে বলতে পারি।
বলো, কিছু মনে করবো না।
দেলোয়ার ব্রোথেলে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়; আমি সাথে সাথে রাজি হয়ে যাই। এতে তাড়াতাড়ি রাজি হই যে আমার মনে হয় দেলোয়ার প্রস্তাব না দিলে আমিই প্রস্তাবটি দিতাম। অনেক বছর ধরে রক্তে একটি বিরক্তিকর ক্ষুধা চেপে রেখে রেখে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি; আমি আর ক্লান্তির মধ্যে থাকতে চাই না; মনে হয় দেলোয়ার আমাকে উদ্ধার করছে। আমার ভয় হতে থাকে দেলোয়ার যদি তার প্রস্তাব ফিরিয়ে নেয়, তাহলে আমাকে একলাই নারায়ণগঞ্জে যেতে হবে। কিন্তু আমি চিনি না। আমি আর বিরক্তি সহ্য করতে পারছি না।
নারায়ণগঞ্জ কেনো, ঢাকায়ই তো আছে? তবু আমি জানতে চাই।
ঢাকার থেকে নারায়ণগঞ্জই ভালো, দেলোয়ার বলে, ঢাকায় আমাদের কেউ দেখে ফেলতে পারে।
দেখে ফেললে কী হবে? আমি বলি।
মানসম্মান থাকবে না। দেলোয়ার বলে।
দেলোয়ারের কথা শুনে মানসম্মানের কথা আমার মনে পড়ে। মানসম্মানের কথা কি আমি কখনো ভাবি নি? সব সময়ই তো আমি মানসম্মানের কথা ভেবেছি, কিন্তু আজ আমার মনে পড়লো না কেনো? সত্যিই, যে-মেয়েটিকে দেখলে আমি কেঁপে উঠি,–কেনো যে কাঁপি আমি জানি না; যে-মেয়েটির সাথে তার দুলাভাই আর মামা মাঝেমাঝেই দেখা করতে আসে–আমি বুঝতে পারি না দুলাভাই আর মামারা কেনো এতো স্নেহ পোষণ করেন; মামার সাথে আর দুলাভাইয়ের সাথে মাঝেমাঝেই যে বেবিতে চেপে কোথায় চলে যায়–মামা আর দুলাভাইয়ের সাথে তার কেনো কোথায় যেতে হয়?–সে যদি জেনে ফেলে আমি ব্রোথেলে গিয়েছিলাম, তাহলে আমার মানসম্মান থাকবে না। ওই মেয়েটিকেই মনে পড়ে আমার; কেনো যে মানসম্মানের প্রসঙ্গে শুধু মেয়েটিকেই মনে পড়ে আমি বুঝতে পারি না।
দেলোয়ার বলে, সব কিছু গোপন করতে জানতে হয়।
আমি বলি, হ্যাঁ।
দেলোয়ার বলে, যারা গোপন করতে পারে তারাই সৎ মানুষ–চরিত্রবান।
আমি বলি, আমি মাঝেমাঝে কিছু কিছু গোপন করি।
দেলোয়ার জানতে চায়, যেমন?
আমি বলি, আমি একবার বাবার পকেট থেকে দশ টাকা চুরি করেছিলাম।
দেলোয়ার জানতে চায়, তারপর?
বাড়িতে একটা ঝড় বয়ে গিয়েছিলো, আমি বলি, তবে সবাই আমাকে ভালো জানতো, তাই আমাকে কেউ সন্দেহ করে নি; কিন্তু বাড়ির সবাইকে সন্দেহ করা হয়েছিলো।
দেলোয়ার বলে, তুমি কি সত্যটি এই প্রথম প্রকাশ করলে?
আমি বলি, হ্যাঁ।
দেলোয়ার বলে, সৎ মানুষ হিশেবে তুমি একদিন প্রসিদ্ধ হবে।
আমি বলি, কিন্তু চেপে রাখতে আমার খুব কষ্ট হয়েছে। তোমাকে বলতে পেরে কষ্টটা কমলো।
দেলোয়ার বলে, সৎ মানুষদের অনেক কষ্ট, অনেক সত্য তাদের চেপে রাখতে হয়।
সৎ মানুষদের কথা ভেবে আমার খুব কষ্ট হয়। আমার আর সৎ মানুষ হতে ইচ্ছে করে না। আমার ইচ্ছে করে ব্রোথেল থেকে ফিরেই সবাইকে জানিয়ে দেবো আমি ব্রোথেলে গিয়েছিলাম। তারপরই আমার ভয় হয়; দেখতে পাই জানিয়ে দেয়ার সাথে সাথেই আমি আর কোথাও নেই। চারপাশে সৎ মানুষেরা ভিড় করে আসছে; তারা আমার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলছে, মোহাম্মদ আনিসুর রহমান অসৎ, চরিত্রহীন; সে এখানে থাকতে পারে না। কিন্তু আমাকে এখানে থাকতে হবে।
দেলোয়ার একটি বেবি ঠিক করে; আমরা ভিক্টোরিয়া পার্কে গিয়ে ট্যাক্সিতে উঠি। এখানে যে ট্যাক্সি পাওয়া যায়, আসার সাথে সাথেই যে ড্রাইভাররা টানাটানি করে ট্যাক্সিতে তোলে, আমার জানা ছিলো না। আমার চমৎকার লাগতে থাকে, এবং ভয় করতে থাকে। নারায়ণগঞ্জে গিয়ে নামার সাথে সাথে দেলোয়ার একটি রিক্সা নেয়। দেলোয়ার যে রিক্সাটিকে কোথায় যেতে বলে আমি বুঝতে পারি না; আমার ভয় লাগতে থাকে এবং আমার চমৎকার লাগতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আমদের রিক্সা একটি অন্ধকার গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে; এবং আরো একটি অন্ধকার গলির মুখে এসে থামে। আমি দেলোয়ারের পাশে পাশে হেঁটে গলিতে ঢুকি, তার পেছনে হাঁটতে চাই না; পেছনে হাঁটতে আমার ভালো লাগে না। পেছনে হাঁটলে দেলোয়ার আমাকে কাপুরুষ মনে করতে পারে, বলতে পারে আমি ব্রোথেলে আসার উপযুক্ত হই নি; কিন্তু আমি সম্পূর্ণ উপযুক্ত। হেঁটে যেতে যেতে একটি মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে, কিছুতেই ছাড়তে চায় না। এই প্রথম কোনো মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে; তার মুখটি আমার ভালো লাগে।
তুমি ওর ঘরে ঢোকো, দেলোয়ার বলে, আমি সামনে যাই।
আচ্ছা। আমি বলি।
মেয়েটি আমাকে টেনে তার ঘরে ঢুকোয়।
আমার বেশ ভালোই লাগছিলো, যদিও মেয়েটি আমার পকেটে হাত দিয়ে আরো পাঁচটি টাকা নিয়ে নিয়েছিলো; এবং কিছুতেই ব্লাউজ খোলে নি, যদিও আমি বারবার খুলতে বলছিলাম; যদিও মেয়েটি আমাকে তাড়াতাড়ি করতে বলছিলো, কিন্তু আমি তাড়াতাড়ির উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারছিলাম না; এবং যদিও আমি ভালোভাবে পারি নি, আমি বাইরে পড়ে গিয়েছিলাম; তবু ভালো লাগার অনুভূতিটি আমার অনেকক্ষণ ছিলো। আমি একটি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি বলে সুখ লাগছিলো; আমার শরীর থেকে বিরক্তি অনেকটা কেটে গিয়েছিলো। কথা ছিলো গলির মোড়ের দোকানটির সামনে আমরা আবার মিলিত হবো। আমি গলির মোড়ের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে সিগারেট টানতে থাকি, একটি পুলিশ এসে টাকা চাইলে তাকে আমি পাঁচটি টাকা দিই, কিন্তু সে দশ টাকা চায়; আমি বেশ ভয় পাই, এবং তিন চারটি সিগারেট টেনে শেষ করে ফেলি; এক সময় দেলোয়ারকে আসতে দেখে খুশি হয়ে উঠি।
হাঁটতে হাঁটতে দেলোয়ার আমাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার কেমন লাগলো?
আমি বলি, খুব ভালো।
দেলোয়ার বলে, তুমি করেছো?
আমি বলি, হ্যাঁ।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, তোমার কেমন লাগলো?
দেলোয়ার বলে, আমি তো করি নি।
আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি।
দেলোয়ার বলে, আমি দেখতে এসেছিলাম, করতে আসি নি।
আমি চুপ করে থাকি।
দেলোয়ার বলে, তুমি আর ভার্জিন নও, তোমার চরিত্র নষ্ট হয়ে গেলো।
আমি ভেঙে প’ড়ে যেতে চাই।
আমি একবার দেলোয়ারকে জিজ্ঞেস করি, তুমি সত্যিই করো নি?
দেলোয়ার বলে, আমি তোমার মতো না।
পা ফেলতে আমার কষ্ট হতে থাকে; আমার মনে হতে থাকে দেলোয়ার সৎ, তার চরিত্র ভালো, সে ব্রোথেলে এলেও এখানকার মেয়েগুলোর সাথে কিছু করে না, তার কৌমার্য নষ্ট হয় নি; আমি সৎ মানুষ নই, আমার চরিত্র ভালো নয়, আমি একটি পতিতা মেয়ের সাথে করেছি; আমার চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে; আমি আর আমার চরিত্র ফিরে পাবো না; আমি আর আমার কৌমার্য ফিরে পাবো না। কৌমার্য হচ্ছে পবিত্রতা, আমি কোথায় যেনো পড়েছিলাম; আমি আর পবিত্র নই। নিজেকে আমার ঘেন্না লাগতে থাকে; বমি বমি লাগতে থাকে; চারপাশের দিকে আমি তাকাতে পারি না; মনে হতে থাকে সবাই বুঝতে পারছে আমি চরিত্রহীন; আমি ব্রোথেলে এসেছি, একটি পতিতা মেয়ের সাথে করেছি। ইচ্ছে হয় হলে ফিরে ব্লেড দিয়ে আমার অঙ্গটিকে কেটে ফেলতে। তাহলে আমি আবার পবিত্র হয়ে উঠতে পারবো। বসে পড়ে আমার গলগল করে বমি করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু আমি বসি না; বরং উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি।
মেয়েটি চমৎকার ছিলো, আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলি, আমার আবার যেতে ইচ্ছে করছে।
দেলোয়ার কোনো কথা বলে না।
তুমি খুব পবিত্র, আমি বলি। ভেঙে পড়তে পড়তে আমি হাঁটতে থাকি।
দেলোয়ার একটি রিক্সা ঠিক করে, আমরা একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকি। সে মোগলাই পারোটা আনতে বলে, দুটো করে মোগলাই পরোটা। আমি অর্ধেকও খেতে পারি না, দেলোয়ার তার দুটো শেষ করে; আমার থেকে একটি নিয়ে খেতে থাকে। আমি দেলোয়ারের মুখের দিকে বারবার তাকাই, তার মুখটিকে আমার পবিত্র মনে হয়; মনে মনে আমি আমার মুখ দেখার চেষ্টা করি। আমার মুখ দেখে আমার ঘেন্না লাগে; আমি দেখি আমার মুখটি বিকৃত হয়ে গেছে, চরিত্রহীনদের মুখ যেমন বিকৃত হয় আমার মুখ তেমন বিকৃত হয়ে গেছে। চরিত্রহীনদের মুখ কেমন? আমার মুখ যেমন? আমি আমার মুখ আর চরিত্রহীনদের মুখ দেখে দেখে ঘেন্নায় কুঁকড়ে উঠি। অনেক দিন পর আমার আত্মার কথা মনে পড়ে, মনে হয় আমার আত্মা অপবিত্র হয়ে গেছে।
দেলোয়ার বলে, তোমার চরিত্র নষ্ট হয়ে গেলো।
আমি তার দিকে অপরাধীর মতো তাকাই।
আমি বলি, আমি অপরাধ করেছি।
দেলোয়ার বলে, তুমি ভার্জিন নও, বিয়ে করে তুমি সুখ পাবে না।
আমি বলি, আমার সুখী হওয়ার খুব ইচ্ছে ছিলো।
দেলোয়ার হাসতে থাকে।
আমি বলি, আমি বিয়ে করবো না।
দেলোয়ার বলে, তুমি এতো খারাপ হবে আমি ভাবতে পারি নি।
নিজেকে আমার খুব খারাপ মনে হয়। আমার আর ভালোদের সাথে মেশা ঠিক হবে না। যে-মেয়েটিকে দেখে আমি কেঁপে উঠি, যাকে আমার খুব ভালো মনে হয়, তার দিকে আমি আর তাকাবো না। সে তার মামার সাথে বেবিতে যাক, তার দুলাভাইয়ের সাথে বেবিতে যাক, আমি আর কষ্ট পাবো না। দেলোয়ারের পাশে নিজেকে আমার অপবিত্র মনে হয়; আমি আর আমার পবিত্রতা ফিরে পাবো না বলে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হয়। একটি জিনিশ আছে, কোথায় যেনো আমি পড়েছিলাম, হারিয়ে গেলে আর ফিরে পাওয়া যায় না। আমি তা হারিয়ে ফেলেছি; আর ফিরে পাবো না।
দেলোয়ারকে দেখলেই, তারপর, আমার মনে অপরাধবোধ জেগে উঠতো। আমি তার দিকে এমনভাবে তাকাতাম যেনো আমি পবিত্র কিছু দেখছি। পবিত্র কোনো কিছু আমি বেশি দেখি নি; পবিত্র জায়গায় আমি কখনো যাই নি; দেলোয়ারই ছিলো আমার কাছে পবিত্রতা। আমি অনেক কিছু ছোঁয়াই ছেড়ে দিয়েছিলাম;–ফুল, আমার কাছে পবিত্র মনে হতো; তাই আমি আর কোনো ফুল ছুঁই নি; আমার ভয় হতো ছুঁলেই পবিত্র ফুলটি অপবিত্র হয়ে যাবে। বই ছুঁতে আমার খুব কষ্ট হতো; কিন্তু বই আমার প্রিয়, বই ছাড়া বাঁচা আমার পক্ষে কষ্টকর; বই আমি না ছুঁয়ে পারি নি;–তবে বারবার বইয়ের কাছে আমি ক্ষমা চেয়েছি। দেলোয়ারের যে-বোনটি, বিলকিস, যশোরে থাকে, যার দুটি তিনটি বাচ্চা, সে আমাকে একদিন খুব বিপদে ফেলে দিয়েছিলো; খুব অপরাধের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলো, খুব বেদনার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলো। আমি যদি অপবিত্র না হতাম, তাহলে ওই বেদনা আমার হতো না; ওই অপরাধবোধ আমার হতো না। দেলোয়ারের খোঁজে এক বিকেলে আমি তাদের বাসায় যাই; গিয়ে দেখি কেউ নেই; শুধু বিলকিস রয়েছে। বিলকিস আমাকে দেখে চৈত্রের গোলাপের মতো ফুটে উঠতে আর ছড়িয়ে পড়তে থাকে; আর আমি অপরাধবোধে কাতর হয়ে পড়ি। বিলকিস দেখতে শ্যামলা, কিন্তু ওর মুখভরা সৌন্দর্য ও আমার মতো একটি অপবিত্র মানুষের জন্যে এমনভাবে ফুটছে দেখে আমার কষ্ট হয়।
বিলকিস আমাকে কিছুতেই ফিরে আসতে দেয় না; বাসায় আমাকে ঢুকতেই হয়, আমি বসার ঘরে বসি। বিলকিস চমৎকার চা বানাতে পারতো; তার বানানো চা খেয়েই সারাজীবন বেঁচে থাকা সম্ভব বলে কখনো কখনো আমার মনে হতো। বিলকিস আমার জন্যে চা বানিয়ে আনে, সোনালি চা দেখে আমার ভয় লাগতে থাকে; যদি ওই চা আমার ছোঁয়ায় নোংরা হয়ে যায়?
বিলকিস বলে, আনিসভাই, চা খান।
আমি বলি, এই খাচ্ছি।
বিলকিস বেরিয়ে যায়, আমি এক চুমুকে চা শেষ করে ফেলি; বারবার পেয়ালা ছুঁতে আমার সাহস হয় না। দেখি বিলকিস একটি লাল টকটকে গোলাপ হাতে ঢুকছে, দেখে আমি আবার ভয় পাই। বিলকিস আমার দিকে গোলাপটি বাড়িয়ে আমার মুখের দিকে গোলাপের মতো ফুটে থাকে। শ্যামলা গোলাপের মতো বিলকিসের মুখ, তার হাতে লালগোলাপ;–আমি আমার সামনে দুটি গোলাপ দেখতে পাই, দুটি গোলাপের কাছে অপরাধী বোধ করি।
বিলকিস অদ্ভুতভাবে ফুটতে ফুটতে বলে, নিন।
আমি বলি, না, বিলকিস।
বিলকিস বলে, কেনো?
আমি বলি, আমি ছুঁলে গোলাপটি অপবিত্র হয়ে যাবে।
বিলকিস আমার দিকে বিস্মিত হয়ে থাকায়।
আবার বলে, কেনো?
আমি বলি, আমি অপবিত্র।
বিলকিস বলে, তাতে কিছু যায় আসে না আনিস ভাই।
আমি আবার বলি, বিলকিস, আমি অপবিত্র।
বিলকিস কেঁদে ফেলে, তাতে কিছু যায় আসে না আনিস ভাই, আমার কাছে আপনি পবিত্র।
বিলকিস নিশ্চয়ই সত্য বলছে, আমার এমন বিশ্বাস হতে চায়; তবু আমি বিলকিসের হাত থেকে গোলাপ নিতে পারি না; আমার ভয় হতে থাকে আমি ছুঁলেই গোলাপের পাপড়ি থেকে পুঁজ ঝরতে থাকবে।
আমি বলি, বিলকিস, আমি ছুঁলে গোলাপটি পুঁজে ভরে উঠবে, পাপড়ি থেকে পুঁজ ঝরতে থাকবে।
বিলকিস কাঁপতে থাকে।
বিলকিস গোলাপটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমার পাশে বসে; তার শ্যামল মুখটি আমার মুখের কাছে তুলে ধরে, এবং বলে, তাহলে একবার আমাকে ছূঁন, আনিস ভাই; একবার আমাকে ছূঁন।
আমি বলি, তাহলে তোমার শরীর থেকে পুঁজ ঝরতে থাকবে, বিলকিস।
বিলকিস ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।