“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?”
ভাষা আন্দোলন চলছিল তখন সারা দেশে। সেটা রুখতেই সরকারের এক নির্দেশে স্কুলঘর দখল করেছিল পুলিশ বাহিনী।
যতদূর মনে পড়ে মাসখানেক অবস্থান নিয়েছিলেন এই বাহিনীর মানুষগুলো। আমার তো খুবই মন খারাপ হয়েছিল তখন— বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা সাক্ষাতের অভাবে। তাছাড়া ওই যে স্কুলের মজাটা অনুপস্থিত।
ছুটির সময় তো বাড়ির শাসনরীতি অন্যরকম ছিল। সকাল ন’টার আগে বেরুনো যেত না। ঘণ্টাখানেক পরই ফিরে আসা জরুরি। দুপুরে কোনোভাবেই বাইরে নয়। আসরের আজানের পর খেলতে যাও, মাগরিবের আজান ছিল ফাইনাল হুইসেল। যেখানেই থাকো, দৌড় বাড়ির দিকে।
পুলিশরাও তো মানুষ! ওদের অনেকের সাথেই ভাব জন্মেছিল তখন— তাদের হয়তো নিজেদের সন্তানদের কথাই মনে পড়তো আমাদের দেখে। ওদের কখনো দুশমন মনে হয়নি আমার— সেই বয়সে। বরং খুবই অনুপ্রাণীত হতাম-ওরা যখন পোশাক পরে রাইফেল নিয়ে চলতো।
কিন্তু এই পুলিশেরই ভয়ঙ্কর রূপ দেখেছিলাম ১৯৬৬তে। সারা দেশে তখন শিক্ষা নীতি নিয়ে চলেছে তুমুল আন্দোলন। বুয়েটের ছাত্ররাও ফুঁসে উঠলো। আমরা বিরাট বড় প্রসেশন নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে চলছিলাম আমতলার দিকে। হঠাৎই শহীদ মিনারের সামনে পুলিশ আমাদের চারদিক থেকে ঘেরাও করে বেধড়ক পিটিয়েছিল। মার না খেলেও মেডিকেলের দেয়াল পার হতে গিয়ে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছিলাম ভীষণ।
হ্যাঁ, বলছিলাম সেই ১৯৫২ সনের কথা। সেই সময়কার একটি ঘটনা মনে পড়ছে। একদিন সকালে বাইরে থেকে বাসায় ফিরেই দেখি আমার নানিজান কাঁদছেন, আম্মারও একই দশা।
নানিজান তখন মুর্শিদাবাদ থেকে চট্টগ্রামে এসেছিলেন আমার বড় বোনের বিয়ে উপলক্ষে। কান্নাকাটির কারণ জানলাম একটু পরেই-পুলিশের গুলিতে ঢাকায় আমার এক ভাই মারা গেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন তখন। আমার সম্পর্কের সেই ভাইটির নাম গদাই। অবশ্য ডাকনাম। আসল নাম কখনো জানা হয়নি।
একটি দিন বাড়ির অবস্থা খুব গুমোট ছিল। আব্বাকেও দেখলাম খুব মন খারাপ। রান্নাবাড়া-খাওয়া দাওয়াতেও এই গুমোট ভাবের প্রভাব পড়লো।
কিন্তু একদিন পর বাড়ির আবহাওয়া পুরোপুরি বদলে গেল যাদুর পরশের মত। ব্যাপার কী? না, গতকালকের সংবাদটি ছিল ভুল!
আসলে পুলিশের গুলিতে মুর্শিদাবাদের যে ছেলেটি মারা গেছে সে গদাইভাই নয়। মুর্শিদাবাদেরই বরকত। সে বাবলার বাসিন্দা। আমাদের আত্মীয় কেউ নয়।
এ খবরে সবাই বেঁচেছিলেন হাঁফ ছেড়ে। কিন্তু আব্বাকে দেখেছিলাম খুবই উত্তেজিত ঘটনায়। ঘটনাক্রমে এই শহীদ বরকতের ছোটভাই-এর সঙ্গেই পরে বিয়ে হয় আমার আপন ফুপাতো বোনের। ওরা ভরতপুর নিবাসী ছিল।
আর গদাইভাই? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টর্স করে সি.এস.পি হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে পোস্টিং নিয়ে পাড়ি দেন করাচিতে। দেশ স্বাধীন হলে ওদিকেই দেন অপশন— ওখানেই ইন্তেকাল করেন এক সময়। আর কিছু আমি অন্তত জানি না তাঁর সম্পর্কে। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় ক্লাসে আমরা ছাত্র মাত্র তিনজন। আমি, হালিমুর রহমান মিন্টু আর শাহজাদী। নিয়মমাফিক বৃত্তি পরীক্ষার টেস্ট দিতে হলো। তিনজনই দিলাম। এই অগা ছাত্রই কেমন করে যেন পরীক্ষায় পাসও করলো। সুতরাং বৃত্তির ফাইনালও দিতে হলো। সেকেন্ড স্যার আব্দুল কাদের কত যত্ন করে কোচিং ক্লাস করিয়ে নিজেই নিয়ে টিয়ে গেলেন পরীক্ষা দিতে। ফলাফল-শূন্য!
তবে লাভ হলো একটা, বার্ষিক পরীক্ষা দিতে হয়নি। মিন্টু আর শাহজাদী দিল ফাইনাল পরীক্ষা— প্রথম হওয়ার পুরস্কার পেয়েছিল মিন্টু। সেদিন কী তার ভাব! আর হবে নাই বা কেন, ফাস্ট বলে কথা!
একদিন শেষ হলো টাইগারপাস কিন্ডারগারটেন স্কুলের পালা। এবার যেতে হবে হাইস্কুলে। আমার অপশন ছিল দুটো— পাহাড়তলী রেলওয়ে হাইস্কুল অথবা চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল। আব্বার ভোট ছিল রেলওয়ের দিকে কারণ— নিজেদের প্রতিষ্ঠান। আর হেডমাস্টার শ্রদ্ধেয় লতিফ স্যার ছিলেন বন্ধুমানুষ আব্বার।
আমার কিন্তু ঝোঁক কলেজিয়েট। কারণ পাড়ায় কিছু সিনিয়র ওই স্কুলে পড়ে। সিনিয়র বলতে বেশ সিনিয়র, নবম-দশম শ্রেণির ছাত্র। তাদের দেখতাম মিলিটারি ড্রেস পরে মাঝে মাঝে স্কুলে যেত। ওটাই ছিল আমার লোভ। কলেজিয়েটে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা চালু ছিল J.C.C (Junior Cadet Corps)
আব্বাকে আমার ইচ্ছাটা জানাতেই— উত্তর এল-
দেখ, ওদের কাউকে বলে ভর্তি হতে পার কিনা।
আগেই বলেছি ভর্তি-টর্তির ব্যাপারে এক ধরনের দূরত্ব বজায় রাখতেন আব্বা। ভাগ্যিস তখন পেরেন্টস ডে-র কথা শুনিনি আমরা ওইসব স্কুলে। তা না হলে যে কতবার একমাত্র পুত্রের দারুণ সব রেজাল্টের জন্যে স্কুলে যেতে হতো আব্বাকে!