অধ্যায় ৮৫ – সাম্রাজ্যের রক্ষাকর্তা
২২২ থেকে ৩১২ সালের মাঝে পারস্যের কাছে পার্থিয়ার পতন হল। ডিওক্লেশিয়ান আর কনস্ট্যানটিন রোমান সাম্রাজ্যকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেন।
২২২ সালে এলাগাবালুসকে হত্যার পর একই বছর পার্থিয়ার রাজা পঞ্চম আরতাবানাস তার প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে সেসিফনের দখল ফিরিয়ে নিলেন।
কিন্তু মাত্র দুই বছর তিনি রাজধানীর দখল বজায় রাখতে পারেন। পারস্যের তরুণ রাজা আরদাশির প্রাচীন মেদিয়ান ও পারসিয়ান শহরগুলোকে মিত্র হিসেবে পেলেন।
২২৪ সালে তিনি ও তার বাহিনী হরমিজদাগান সমতলভূমিতে পার্থিয়ানদের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন।
এই যুদ্ধে পঞ্চম আরতাবানাস নিহত হলেন এবং পার্থিয়ান সাম্রাজ্যের পতন হল। আরদাশির তার রাজধানীকে সেসিফনে নিয়ে গেলেন এবং নিজেকে পারস্যের প্রাচীন প্রক্রিয়ায় প্রথম আরদাশির নাম নিলেন। তিনি তার নিজ রাজবংশের নাম দিলেন সাসানিয়ান।
যাযাবরদের নানা যুদ্ধে পরাজিত করার মাধ্যমে পার্থিয়ান সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। তিনি এই ব্যবস্থা বদলে পারস্যের আগের আমলের সাতরাপির ধারণায় ফিরে যান। তিনি প্রতিটি প্রদেশে তার নিজের সাসানিয়ান গোত্র থেকে সদস্যদের সামরিক গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন—তাদের উপাধি ছিল ‘শাহ’।
রোমানরা একের পর এক অথর্ব রাজার শাসনে জর্জরিত হচ্ছিল। পারস্যের পুনর্জাগরণে তারা ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। ২৪১ সাল পর্যন্ত পারস্যের রাজা প্রথম আরদাশির রাজত্ব করেন। তারপর তিনি তার সন্তান শাপুরের কাছে একটি সুসংহত রাজত্ব হস্তান্তর করেন।
প্রথম শাপুর দেবতা আহুরামাজদার আশীর্বাদ নিয়ে রাজত্ব শুরু করেন। শাপুর ও আরদাশির উভয়ই জরথুস্ত্রীয় বা পারসিক ধর্ম পালন করতেন। প্রথম দারিয়াসের আমলে এই ধর্মের প্রচলন করে জরথুস্ত্র।
শাপুরের সশস্ত্র সংগ্রাম ও সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তু ছিল রোম। তিনি মেসোপটেমিয়ায় রোমান গ্যারিসন দখল করেন এবং সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা করেন।
তবে প্রথম দফায় শাপুরের সেনাবাহিনী সিরিয়ার লেজিওনদের হাতে পরাজিত হয়। পারস্য পিছাতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই যুদ্ধে রোম বড় ক্ষতির শিকার হয়। অপরদিকে, উত্তরদিক থেকে নতুন শত্রুর মুখোমুখি হয় রোম।
দ্বিতীয় শতাব্দীর কোনো এক সময় উত্তরাঞ্চলীয় উপদ্বীপের বাসিন্দারা (এখন যে অঞ্চলকে স্ক্যান্ডিনেভিয়া বলা হয়) নৌকায় করে প্রণালি পার হয়ে ইউরোপের উপকূলে এসে পৌঁছান। ষষ্ঠ শতাব্দীর লেখক জরডানেস পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বোঝার জন্য আমাদের সেরা উৎস। তিনি বলেন, ‘স্ক্যান্ডজা নামে একটি বিশাল দ্বীপ রয়েছে। এখান থেকে এক জাতি উঠে আসে, যারা মৌমাছির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে ইউরোপে এসে পৌঁছায়।’
রোমানরা এই নবাগতদের ‘গথ’ বলে সম্বোধন করলেও জরডানেস বেশ কয়েকটি গোত্রের নাম উল্লেখ করেন, যেমন ক্রেরেফেনি, ফিনাথি, ফিনস, দানি ও গ্রানি এবং আরও বেশ কয়েকটি। তিনি জানান, এরা ছিলেন অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও সহনশীল। ‘তারা অন্য যেকোনো জাতির চেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে পারে’।
ইউরোপে তারা জার্মানির গোত্রগুলোকে পরাজিত করে দানিউবে এসে পৌঁছায়। এরপর পূর্বদিকে স্কাইথিয়ানদের পুরনো ভূখণ্ডের দিকে আগাতে থাকে। জরডানেস এরপর তাদেরকে দুই ভাগে ভাগ করেন। ‘পশ্চিম দেহের গথ’ বা ভিসিগথ এবং পূর্বের অংশ’ বা অসট্রোগথ। ভিসিগথরা দানিউবের কাছে অবস্থিত রোম ভূখণ্ডের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছিল। আর অস্ট্রোগথরা থ্রেস ও মেসিডোনিয়ার প্রাচীন ভূখণ্ডে দলে দলে হাজির হচ্ছিল।
২৪৯ সাল নাগাদ উত্তরের আগ্রাসনের হুমকি বাস্তবে রূপান্তরিত হয়। তৎকালীন সম্রাট ফিলিপ ছিলেন অযোগ্য। তিনি গথদের নজরানা দিয়ে সন্তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সময়মতো অর্থ পরিশোধ করতে পারেননি। ফলে ভিসিগথরা দানিউব পেরিয়ে এসে শহরতলিতে লুটপাট চালায়। দানিউবের কাছে মোতায়েন করা রোমান বাহিনী অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে তাদের সেনাপতি ডেসিয়াসকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেয়। তাদের কিছু সদস্য গথদের সঙ্গেও যোগ দিয়েছিল।
দুই বছর সম্রাট ছিলেন ডেসিয়াস। রোমে যেয়ে নিজের নতুন ক্ষমতার বৈধতা নিয়ে আসার পর ২৫১ সালে দানিউবের কাছেই তার মৃত্যু হয়। তিনিই ছিলেন প্রথম রোমান সম্রাট, যিনি বাইরে থেকে আসা কোনো হুমকির মোকাবিলা করতে যেয়ে নিহত হলেন। বাকি সব সম্রাট তাদের নিজেদের দেশের মানুষের হাতেই প্রাণ হারিয়েছিলেন।
২৫২ সালে প্রথম শাপুর সিরিয়ার সীমান্তে হামলা চালায়। সেসময় রোমান সেনাবাহিনী পূর্বের সীমান্তে পারস্য ও উত্তর সীমান্তে গথদের হামলা ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছিল।
পূর্ব সীমান্তে প্রথম শাপুর সিরিয়া দখল করেন নেন। ২৫৩ সালে তিনি পূর্বের গৌরবময় শহর অ্যান্টিওক দখল করেন এবং সেখানে লুটপাট চালান।
একই বছরে ভ্যালেরিয়ানের হাত ধরে রোম আবারও এক বলিষ্ঠ সম্রাট পেল। ৬০ বছর বয়সি ভ্যালেরিয়ান একজন কনসাল ও সাবেক সেনাপতি। তার বয়স ৬০ হলেও তিনি রোমানদের ভাগ্য ফেরাতে পারবেন বলেই ভাবছিলেন সংশ্লিষ্টরা। তিনি তার সন্তান গ্যালিনিয়াসকে পশ্চিমের বাহিনীর নেতৃত্ব দিলেন। গ্যালেনিয়াস রাইনের কাছ থেকে হানাদারদের পরাজিত করতে লাগলেন আর ভ্যালেরিয়ান পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধ জিততে লাগলেন।
২৬০ সালে মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে ভ্যালেরিয়ানের সেনাবাহিনীর ক্ষমতা খর্ব হল। এ সময় এদেসা থেকে পারস্যের হামলা এল। তিনি পিছু হটলেন এবং আলোচনায় বসতে চাইলেন।
প্রথম শাপুর এক শর্তে রাজি হলেন—ভ্যালেরিয়ানকে ছোট এক সেনাদল নিয়ে তার সঙ্গে সশরীরে দেখা করতে হবে। শাপুর ভ্যালেরিয়ানের রক্ষীদের হত্যা করে তাকে আটক করলেন।
দীর্ঘসময় ধরে পারস্যের রাজার হাতে বন্দি থাকলেন রোমান সম্রাট ভ্যালেরিয়ান। হঠাৎ করেই রোম প্রবল পরাক্রমশালী সাম্রাজ্য থেকে এক এলোমেলো, নেতৃত্বহীন অঞ্চলে পর্যবসিত হল। সম্রাট উপস্থিত না থাকায় প্রদেশগুলো বিদ্রোহ করতে লাগল। রোমান সেনাবাহিনী এই বিদ্রোহ দমনের মতো পরিস্থিতিতে ছিল না। উত্তর থেকে আরও আগ্রাসন আসছিল। জার্মানিক আলেমানি গোত্র ইতালিতে হামলা চালাচ্ছিল। ফ্রাঙ্করা (এরা এসেছে জার্মানিকদের থেকে) আইবেরীয় উপদ্বীপে রোমান প্রদেশগুলোতে লুটপাট চালাচ্ছিল আর গলরা আলাদা হয়ে নিজেদেরকে পৃথক জাতি হিসেব ঘোষণা দিয়েছিল।
ভ্যালেরিয়ান তখনো আটক ছিলেন, আবার একইসঙ্গে সম্রাটও ছিলেন। তার ছেলে গ্যালেনিয়াস ভারপ্রাপ্ত সম্রাট হিসেবে কাজ চালাচ্ছিলেন। তিনি দক্ষ সেনাপতি হলেও এই পর্যায়ের সমস্যার সমাধান করা তার একার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
তিনি সবসময় একদল বিশ্বস্ত সেনাকে সঙ্গে নিয়ে চলাফেরা করতেন, খাবার খাওয়ার সময় সতর্ক থাকতেন, যাতে তাকে কেউ বিষ খাওয়াতে না পারে। তা সত্ত্বেও, ২৬৮ সালে তারই এক তথাকথিত বিশ্বস্ত সেনা তাকে হত্যা করেন।
এরই মাঝে একসময় তার পিতা ভ্যালেরিয়ানও বন্দি অবস্থায় মারা যান।
শাপুর তার মরদেহকে ‘শিরোপার’ মতো করে দেখলেন। লাকতানশিয়াস জানান, ‘তার মরদেহ থেকে চামড়া তুলে নেওয়া হয়। তারপর তাকে সিঁদুরে রঙে রাঙিয়ে বর্বরদের দেবতার উদ্দেশে নিবেদিত মন্দিরে স্থাপন করা হয়। এর মাধ্যমে আজীবন যেন সবাই দেখতে পারে, কীভাবে রোমানদের পরাভূত করা হয়েছিল।’
২৬৮ সালে গ্যালিনিয়াসের হত্যাকাণ্ডের পর রোম সাম্রাজ্য কোনোমতে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। ২৭১ সাল নাগাদ এই উপদ্বীপের মধ্যবর্তী অঞ্চলে পৌঁছে যায় আগ্রাসী যাযাবররা। তৎকালীন সম্রাট অরেলিয়ান ছিলেন একজন দক্ষ যোদ্ধা। চতুর্থ শতকের ইতিহাসবিদ ইউক্রোপিয়াস তাকে ‘একজন নির্দয় সেনা’ হিসেবে অভিহিত করেন।
তিনি বেশ কয়েকটি সুপরিকল্পিত সামরিক অভিযানে রোমে গৌরব ফিরিয়ে আনার পথে বেশ এগিয়ে যান। এতে অরেলিয়ান জনপ্রিয় না হলেও সমীহ আদায় করে নেন। ইউক্রোপিয়াস জানান, ‘তিনি জনপ্রিয় না হলেও সেসময় তার মতো একজন শাসকের প্রয়োজন ছিল। তিনি ছিলেন একজন সংস্কারপন্থী। সামরিক শৃঙ্খলা তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’
তবে সেনাবাহিনীর উন্নয়নে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। অরেলিয়ান পুরো শহরজুড়ে একটি প্রাচীর নির্মাণে উদ্যত হলেন। প্রায় ৩০০ বছর ধরে রোমে কোনো প্রাচীর ছিল না। এতদিন নাগরিকরা গর্ব করে বলতেন, রোমের সেনারাই রোমের প্রতিরক্ষা। আগের মতো সেনাবাহিনীর ওপর ভরসা রাখতে পারছিলেন না কোনো শাসকই। অরেলিয়ান নিজেও শাসনামলের পাঁচ বছরের মাথায় একটি সরকারি সড়কে নিহত হন—প্রিটোরিয়ান গার্ডের এক সদস্য তাকে দিনদুপুরে হত্যা করেন।
সিনেট সম্রাটের হাতে সর্বময় ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল, আর সম্রাট তার শক্তিমত্তার জন্য সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু রোমের বাহিনী এত জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে মোতায়েন করা ছিল যে সেখানে কোনো ধরনের স্থিতিশীলতা আশা করা যেত না। অরেলিয়ানের প্রয়াণের পরের নয় বছরে আরও ছয় ব্যক্তি সম্রাট হলেন, এবং তাদের সবাইকে হত্যা করা হল।
এই তালিকার চতুর্থ ব্যক্তির নাম ছিল কারুস। বলা হয়, টাইগ্রিসের তীরে ক্যাম্পিং করার সময় তিনি বজ্রাঘাতে নিহত হয়েছেন। অপরদিকে, যখন তিনি ‘বজ্রের আঘাত’ পান, তখন সেই শিবিরে তার সেনাপতি ও দেহরক্ষী ডিওক্লেশিয়ানও উপস্থিত ছিলেন। এরপর কারুসের ছেলে নুমেরিয়ান সম্রাট হলেন। তিনিও সেনাবাহিনীর সঙ্গে যাত্রার পথিমধ্যে রহস্যজনকভাবে নিহত হন। তার চোখে সমস্যা দেখা দেওয়ায় তিনি সূর্যের আলো থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হন। তাকে একটি পালকিতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সেখানেই তার মৃত্যু হয় এবং কেউ বিষয়টি বুঝতে পারেননি। ইউক্রোপিয়াস বলেন, ‘মরদেহের পচা গন্ধে তার মৃত্যু সম্পর্কে জানা যায়। সেনা-সদস্যরা পালকির পর্দা সরিয়ে দেখতে পান, কয়েকদিন আগেই সম্রাটের মৃত্যু হয়েছে।’
এখানে মরদেহের গন্ধের চেয়েও প্রকট হয়ে ওঠে ষড়যন্ত্রের গন্ধ। খুব শিগগির এর দায়ী ব্যক্তিকেও খুঁজে বের করা হয়।
সেনাবাহিনী যখন নতুন নেতা নির্বাচনের জন্য আলোচনা করছিল, তখন ডিওক্লেশিয়ান বলে উঠেন, তিনি জানেন কে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। তিনি দাবি করেন, নুমেরিয়ানের শ্বশুর ও প্রিটোরিয়ান গার্ডের নেতা এর জন্য দায়ী। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে, অন্য সেনাদের সামনেই তাকে হত্যা করেন। সেনাবাহিনী পরে আর তার এই অভিযোগ (ও নিজের দেওয়া শাস্তি) নিয়ে তদন্তের প্রয়োজন অনুভব করেনি।
কারুসের অপর সন্তানকে তার বাবার বন্ধুরা সম্রাট হিসেবে নির্বাচন করল। এবার আসল রূপ দেখালেন ডিওক্লেশিয়ান। তিনি তার নিজের সমর্থকদের নিয়ে নতুন সম্রাটকে যুদ্ধে পরাজিত ও হত্যা করলেন।
এবার ডিওক্লেশিয়ানের হাতে এল রোমের সর্বময় কর্তৃত্ব। তার পূর্বসূরিদের মতো তিনিও খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের আদেশ দিলেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, নির্দয় আচরণ, অতিরিক্ত কর আদায়, ধর্ষণ ও প্রায় সবধরনের অপরাধের অভিযোগ ছিল। লাকতানশিয়াস অভিযোগ আনেন, ‘তিনি রোমের সর্বনাশ করেন’।
‘তিনি সরকারে আরও তিন ব্যক্তিকে অনুপ্রবেশ করান। ফলে, সমগ্র সাম্রাজ্য চার ভাগে ভাগ হয় এবং এই চার নেতা আগের যেকোনো সম্রাটের চেয়ে সম্মিলিতভাবে অনেক বড় এক সেনাবাহিনী বজায় রাখতে শুরু করেন’, যোগ করেন তিনি।
তবে আদতে ক্ষমতার এই বিকেন্দ্রীকরণেই সাম্রাজ্য রক্ষা পায়। ডিওক্লেশিয়ান উচ্চাভিলাষী ছিলেন, কিন্তু তিনি রোম সাম্রাজ্যের সব সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজছিলেন। এই সমাধান তিনি পান ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে।
ক্ষমতায় বসার পরের বছর ডিওক্লেশিয়ান তার ডানহাত হিসেবে সামরিক কর্মকর্তা ম্যাক্সিমিয়ানকে নির্বাচন করেন। তিনি তাকে ‘অগাস্টাস’ উপাধি ও সহ- শাসকের সম্মান দেন। তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে-রোম সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল এর বিশাল আকার। একা একজন মানুষের পক্ষে সবগুলো প্রদেশের ওপর নজর রাখা সম্ভব নয়, যদি-না তিনি স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র কায়েম করেন। এবং এ-ধরনের একনায়কদের কপালে অবধারিত ছিল অপঘাতে মৃত্যু
এমনকি, জনপ্রিয় স্বৈরশাসকরাও গল থেকে শুরু করে ইউফ্রেতিস পর্যন্ত সমগ্ৰ অঞ্চলের সেনাদের কাছে জনপ্রিয় হতে পারতেন না; তারা মূলত তাদের কাছে আছেন এমন এক ব্যক্তিকেই নেতা হিসেবে পছন্দ করতেন। ডিওক্লেশিয়ান সাম্রাজ্যকে দুই ভাগে ভাগ করে দিলেন, যাতে উভয় সম্রাট তার বাহিনীর কাছে থাকতে পারেন।
সেনাবাহিনীর ক্ষমতায় ডিওক্লেশিয়ান উদ্বিগ্ন ছিলেন। ২৯৩ সালে তিনি আরক একটি পদক্ষেপ নেন। তিনি দুইজন জুনিয়র ‘সম্রাট’ নিয়োগ দেন। এই কর্মকর্তারা ‘সিজার’ উপাধি পান (সাধারণত সম্রাটরা তাদের উত্তরাধিকারীদের এই খেতাব দিতেন)।
নতুন দুই সিজার কনস্ট্যানটিয়াস ও গ্যালারিয়াস ছিলেন সম্রাটদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। গ্যালেরিয়াস ও কনস্ট্যানটিয়াস যথাক্রমে ডিওক্লেশিয়ান ও ম্যাক্সিমিয়ানের মেয়েদের বিয়ে করেন। তারা তাদের আগের স্ত্রীদের ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
৩০৫ সালে ডিওক্লেশিয়ান এক নজিরবিহীন পদক্ষেপ নেন। তিনি অবসরগ্রহণ করেন। এটা এমন এক কাজ ছিল যা এর আগে কোনো সম্রাট করেননি। তিনি ম্যাক্সিমিয়ানকেও উদ্বুদ্ধ করেন। পরবর্তীতে দুই সম্রাট একইসঙ্গে সাম্রাজ্যের নিজ অংশে বসে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সিজারদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ডিওক্লেশিয়ানের বয়স বাড়ছিল। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত সিংহাসন ধরে না থেকে তিনি চেয়েছিলেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ার অংশ হতে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ম্যাক্সিমিয়ান তাকে অনুসরণ করেন।
এই অনুষ্ঠানে তারা সম্রাটের পোশাক খুলে বেসামরিক পোশাক পরেন।
এই ব্যবস্থা অল্প সময়ের জন্য বেশ কার্যকর থাকল। কনস্ট্যানটিয়াস গল, ইতালি ও আফ্রিকার সম্রাট হলেন। গ্যালেরিয়াস পূর্বাঞ্চলের সম্রাট হলেন। তাদের সহকারী হলেন আরও দুই নতুন সিজার। তবে এক বছর পর, ৩০৬ সালে কনস্ট্যানটিয়াসের মৃত্যু হলে আবার দৃশ্যপটে সেনাবাহিনী ফিরে আসে। তারা দাবি করে, কনস্ট্যানটিয়াসের আগের ঘরের সন্তান তরুণ কনস্ট্যানটিনকে সম্রাট বানাতে হবে। যার ফলে আবারও রোমে বাবা থেকে ছেলেরে কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাচীন প্রক্রিয়া ফিরে এল। সন্তান যেমন মানুষই হোক, বাবার পরিচয়ের কারণে তার হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার এই প্রবণতা মানবজাতির মাঝে সেই সুমেরে ইটানার আমল থেকেই বিরাজ করছিল, এবং তিন হাজার বছর পরেও তা টিকে রইল।
ঠিক এ-বিষয়টি এড়াতে চেয়েছিলেন ডিওক্লেশিয়ান। অপরদিকে, পূর্বের সম্রাট গ্যালেরিয়াস দাবি করলেন, আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী কনস্ট্যানটিয়াসের নির্বাচন করা সিজার সেভেরাসকে পশ্চিম রোমের সম্রাট বানানো হোক। এবার সেই গিলগামেশের আমলের ক্ষমতার লোভও ফিরে এল। ম্যাক্সিমিয়ান কখনোই অবসর নিতে চাননি। তিনি দুর্ভাগা সেভেরাসের বিরুদ্ধে লড়লেন এবং কনস্ট্যানটিনের সহায়তায় তাকে পরাজিত করলেন।
আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অস্থিতিশীল অবস্থায় চলে গেল রোম সাম্রাজ্য। শুধু গ্যালেরিয়াসই ছিলেন বৈধ শাসক। সেভেরাস নিহত হয়েছেন এবং ম্যাক্সিমিয়ানের অবসরে থাকার কথা। এ পরিস্থিতিতে কনস্ট্যানটিন ম্যাক্সিমিয়ানের ক্ষমতায় ফিরে আসার উদ্যোগে সমর্থন দেন। তিনি একইসঙ্গে তার মেয়েকেও বিয়ে করেন। ম্যাক্সিমিয়ানের ছেলে ম্যাক্সেনশিয়াস দেখলেন, তার বাবা সম্রাট হলে পরবর্তীতে উত্তরাধিকারসূত্রে তিনিও সম্রাট হবেন—যদি তার দুলাভাই কনস্ট্যানটিন ঝামেলা না করেন।
এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে একের পর এক যুদ্ধ হতে থাকে এবং তা পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে। রোমের সাধারণ জনগণের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার ছিল না। ৩১২ সাল নাগাদ বাকি সব সংঘাত শেষে এক চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল রোম। উত্তরে কনস্ট্যানটিনের বাহিনী ম্যাক্সেনশিয়াসের বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা চালতে প্রস্তুত হচ্ছিল। দুই বছর আগে ম্যাক্সিমিয়ান লজ্জায় আত্মহত্যা করেন—তার নিজের ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার ব্যর্থতায় ম্যাক্সেনশিয়াসের নিয়ন্ত্রণে ছিল রোম।
অক্টোবরে কনস্ট্যানটিন তার বাহিনী নিয়ে রোমের দিকে আগালেন। কনস্ট্যানটিন তার এই হামলার পেছনে যুক্তি দেন এভাবে, ‘রোমান সাম্রাজ্যের রাজকীয় শহরটি এক স্বৈরাচারীর অত্যাচারের ভারে ভারাক্রান্ত।’ ইতিহাসবিদ ইউসেবিয়াস বলেন, ‘রোমের এই দুর্দশা সহ্য করতে পারছিলেন না কনস্ট্যানটিন। তিনি রোমকে এই স্বৈরাচারীর হাত থেকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত হন।
তবে আগের আমলের মতো, ‘স্বাধীনতা এনে দেওয়ার আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। রোমানদের রাজধানী শহর এর আগেও অনেক ধরনের স্বাধীনতাকামী দেখেছে, এবং প্রত্যেকেই তাদের লক্ষ্য অর্জনের পর সাধারণ জনগণকে তাদের দাস বানিয়েছেন। কনস্ট্যানটিনের আরও বড় কোনো অনুঘটক প্রয়োজন ছিল।
কনস্ট্যানটিন ভাবলেন, রোমের কোনো দেবতাকে তার পৃষ্ঠপোষক বানাবেন। এ-ধরনের কৌশল পারস্যে প্রথম শাপুরের জন্য কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল। তবে এর চেয়েও ভালো কৌশল খুঁজে পেলেন তিনি। এ ঘটনাকে অনেকে বানোয়াট বলতে চাইলেও ইউসেবিয়াস একে সত্য বলেই দাবি করেন।
কনস্ট্যানটিন এক স্বপ্নদৃশ্যের কথা জানান। নিজের চোখে তিনি স্বর্গ থেকে আসা একখণ্ড আলো দেখেন, যা দেখতে ছিল ক্রুশের মতো। এটা সূর্যের ওপর আবির্ভূত হয় এবং এতে লেখা ছিল : ‘এর মাধ্যমে দখল করো। এই দৃশ্য দেখে কনস্ট্যানটিন অবাক হয়ে যান। সারাদিন চিন্তা করে কূল পান না, এর অর্থ কী! এরপর রাতে তিনি বিষয়টি বুঝে উঠতে পারেন। খ্রিস্টধর্মের ঈশ্বর তার সামনে উপস্থিত হয়ে নির্দেশ দিয়েছেন, এই পবিত্র ক্রুশ চিহ্ন ব্যবহার করে শত্রুর হাত থেকে রোমকে মুক্ত করতে হবে।
অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মে এ-ধরনের অলৌকিক বিষয়গুলোকে নিরুৎসাহিত করা হলেও কনস্ট্যানটিন এতে উদ্বুদ্ধ হন। তিনি যিশুখ্রিস্টের নামের প্রথম দুই অক্ষর, চি ও রো-কে তার শিরস্ত্রাণে খোদাই করে নেন।
তিবার নদীর অপরপারে ভায়া ফ্লামিনায় মিলভিয়ান সেতুর সামনে কনস্ট্যানটিনের বাহিনীর মোকাবিলা করেন ম্যাক্সেনশিয়াস। শহরে যেতে কনস্ট্যানটিনকে এই সেতু পার হতে হোত।
ম্যাক্সেনশিয়াসের সেনাবাহিনী কনস্ট্যানটিনের বাহিনীর চেয়ে আকারে বড় ছিল। তবে ইউসেবিয়াস জানান, শহরের ভেতরে দুর্ভিক্ষ চলছিল। ফলে সেনারা দুর্বল ছিলেন। কনস্ট্যানটিনের হামলায় তারা তিবার নদীর দিকে ফিরে যেতে বাধ্য হন।
ম্যাক্সেনশিয়াসের বড় বাহিনীকে জায়গা দেওয়ার জন্য মিলভিয়ান সেতু যথেষ্ট ছিল না। তাই পলায়নরত সেনারা এর পাশে একটি পন্টুন সেতু নির্মাণের চেষ্টা চালান। কিন্তু সেনার চাপে নৌকাগুলো ডুবে যেতে থাকে। অসংখ্য সেনা ডুবে মারা যান। ম্যাক্সেনশিয়াসের সেনাদের পরনে ছিল প্রথাগত ভারী রোমান বর্ম, তাই তারা খুব সহজেই তিবার নদীতে ডুবে যাচ্ছিলেন। তাদের মাঝে ম্যাক্সেনশিয়াসও ছিলেন।
ম্যাক্সেনশিয়াসের চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে লিখতে যেয়ে ইসরায়েলিদের কথা উল্লেখ করেন ইউসেবিয়াস। তাদেরকে ধাওয়া করতে আসা মিশরীয়রা লোহিত সাগরে ডুবে মরার পর ইসরায়েলিরা বলেন, ‘বিজয়ীদের এখন এটাই বলা উচিত : আসুন আমরা ঈশ্বরের উদ্দেশে স্তুতিবাক্য উচ্চারণ করি, কারণ তিনি ঘোড়া ও রথ, উভয়কেই সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছেন।’ এই গান এমন এক জাতির মানুষ গেয়েছিল, যাদের ধর্মবিশ্বাসই জাতি হিসেবে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের পরিচায়ক। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের মাঝে এ-ধরনের চিন্তাধারা কখনোই ছিল না। তবে কনস্ট্যানটিন খ্রিস্টধর্মকে ভবিষ্যতে রোমান জাতিকে ধরে রাখার ও নিজেদের পরিচয় খুঁজে পাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে দেখেন।
কনস্ট্যানটিনের অধীনে রোমান সাম্রাজ্য তার চারপাশে সীমানা আঁকতে বাধ্য হল। তারা প্রথমে মিত্রদের শোষণ ও দখল করল, তারপর শুরুতে এক সম্রাটের কাছে ও পরবর্তীতে সম্রাটের আধিপত্যের ধারণার কাছে আত্মসমর্পণের দাবি জানাল। দিনে দিনে এই সাম্রাজ্যের দীনতা সবার সামনে প্রকাশ পাচ্ছিল। অপরদিকে, খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা বেশ কয়েকটি রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্যদিয়ে গেছে এবং সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
খ্রিস্টধর্ম এমন একটি কাজ করে দেখিয়েছে, যা রোম কখনোই পারেনি। এই মতবাদ ইহুদিদের একটি ছোট গোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত হয়ে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এটা ছিল এমন এক পরিচয়, যা একইসঙ্গে ইহুদি, থ্রেসিয়ান, জেনটাইল, গ্রিক, সিরীয় ও রোমানদের একই ছাতার নিচে নিয়ে এসেছিল।
মিলভিয়ান সেতুর যুদ্ধে খ্রিস্টধর্মের ঈশ্বরই ছিলেন কনস্ট্যানটিনের একমাত্র মিত্র। এর মাধ্যমে তিনি রোম সাম্রাজ্যকে নতুন পথে পরিচালিত করেন। যুগ যুগ ধরে সোনার হরিণ হয়ে থাকা সেই ‘রোমানত্ব’ খুঁজে পাওয়ার অর্থহীন অভিযান পরিত্যাগ করেন তিনি। বিপরীতে, তিনি খ্রিস্টধর্মকে আঁকড়ে ধরেন। এরপর যতবারই যুদ্ধে গেছেন, তিনি খ্রিস্টধর্মের ধ্বজাধারী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি এই ধ্যানধারণার ওপর বাজি রেখে তার জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেন।
এভাবেই রোম সাম্রাজ্যের পতন হল। তবে প্রকৃতপক্ষে পতন নয়, এ ছিল রূপান্তর। কাগজে-কলমে প্রজাতান্ত্রিক, কিন্তু আদতে সাম্রাজ্যবাদী শাসনব্যবস্থা থেকে সরে যেয়ে প্রাচীন রোমের সূর্য অস্ত গেল।
মানব-ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি এভাবেই এল এবং তার হাত ধরে তিন হাজার বছরের ইতিহাসের যবনিকাপাত হল।
***