অধ্যায় ৮৩ – সিংহাসনে শিশুরা
৮৮ থেকে ১৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চীনে বেশ কয়েক দফায় ‘শিশুরা’ হান উপাধি পেল। প্রাসাদের খোজারা ক্ষমতাবান হল ও হলুদ পাগড়িদের ক্ষমতা বাড়ল।
৮৮ সাল নাগাদ মিংদির ছেলে ঝাংদির শাসনামলের শেষ বছরে এসে হান রাজবংশ আবারও তাদের পুরনো ঐতিহ্যের বেশিরভাগ অংশ ফিরে পেয়েছে। পার্থিয়ান সীমান্ত পর্যন্ত পশ্চিমা ভূখণ্ড দখল করা হয়েছে এবং সিল্ক রোড ধরে বাণিজ্যের ফলে সাম্রাজ্যে এসেছে বিশেষ উন্নয়ন।
ঝাংদির প্রয়াণের পর তার উত্তরাধিকারী হলেন নয় বছর বয়সি হেদি, কিন্তু সেটাকে হান সাম্রাজ্যের আগেরবারের শাসনামলের মতো দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হল না।
১০৫ সালে হেদি ২০ বছর বয়সে মারা যান। তার কোনো স্ত্রীর গর্ভে তার কোনো বৈধ সন্তান ছিল না। শুধু প্রাসাদের এক দাসীর গর্ভে তিন মাস বয়সি পুত্রসন্তান ছিল। এক বছর বয়স হবার আগেই শিশু শাংদি মারা গেল।
হেদির ভাইপো আন্দি ১২ বছর বয়সে ১০৬ সালে সিংহাসনে বসলেন।
১৪৬ সাল পর্যন্ত নাবালক শাসকদের সিংহাসনে বসাতে লাগল চীনের উচ্চাভিলাষী অভিজাত পরিবারগুলো। ১২৫ সালে আন্দির ছেলে শুনদি ১০ বছর বয়সে রাজা হলেন। তার ছেলে চংদি ১ বছর বয়সে রাজা হয়ে ৩ পুরো হওয়ার আগেই মারা গেল।
পরের রাজা হল তার চাচাতো ভাই; ৭ বছর বয়সি ঝিদি, যাকে পরের বছর বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা হল। এবার রাজা হল অপর এক চাচাতো ভাই—হুয়ানদি (১৪)।
এই বছরগুলোতে চাচা-মামা, চাচাতো-মামাতো-খালাতো ভাই, চাচি, মামি, যে যেভাবে পেরেছে রাজ্য শাসন করেছে। হুয়ানদির কার্যক্রম নির্ধারণ করে দিতেন তার স্ত্রীর বড়ভাই—উচ্চাভিলাষী লিয়াং জি।
হুয়ানদি ক্ষমতার বলয় থেকে বঞ্চিত থেকে প্রাসাদের অভ্যন্তরে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হলেন। তিনি তার স্ত্রীর শয্যাসঙ্গী হতে অস্বীকার করতেন। বরং প্রাসাদের খোজাদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
পাঁচ খোজা প্রাসাদের রক্ষীদের নিয়ে লিয়াং জির বাড়ি ঘিরে ফেলল। তাদের হাতে ধরা না দিয়ে আত্মহত্যা করলেন লিয়াং। তার পরিবারের বাকি সদস্যরা নিহত হলেন।
কিন্তু হুয়ানদির ক্ষমতায় ফিরে আসাতে অনেক দেরি হয়ে গেল। একের পর এক অযোগ্য ও দুর্নীতিপ্রবণ রাজপ্রতিনিধির (নাবালক/অপ্রাপ্তবয়স্ক রাজাদের প্রতিনিধি) শাসনে সার্বিকভাবে চীনের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। গুয়াং উদির চালু করা প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থায় হিতে বিপরীত হয়। যোগ্য রাজার অভাবে বিভিন্ন প্রদেশের শাসনভার যোগ্য শাসকদের হাতে চলে যায়।
এই যোগ্য মানুষগুলো উচ্চাভিলাষীও ছিলেন। যারা কর দিতে পারতেন না, তারা তাদের জমি কেড়ে নিয়ে আবার সেগুলো মূল মালিকের কাছে ইজারা দিতেন।
এভাবে নতুন এক শ্রেণির জমিদার পরিবারের উদ্ভব ঘটে। প্রাচীন আমলের অভিজাত পরিবার না হলেও তারা বেশ শক্তিশালী ছিলেন।
হুয়াংদি এসব সমস্যা সমাধানের তেমন কোনো সুযোগ পাননি। ১৬৮ সালে হান সাম্রাজ্যের সব সমস্যা ও সিংহাসনটি তার ১২ বছরের ছেলে লিংদির জন্য রেখে তিনি মারা গেলেন।
হুয়ানদির তৃতীয় স্ত্রী দৌ-র সন্তান ছিলেন লিংদি। তিনি তার সন্তানের রিজেন্ট হিসেবে রাজ্য শাসন করেন।
দৌর জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল প্রাসাদের খোজারা, যারা আগের তুলনায় অনেক বেশি সম্পদ ও ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন।
তার এক উপদেষ্টা চেন ফান রাজ্যের সব খোজাকে নিশ্চিহ্ন করার সুপারিশ করেন।
টেন রেগুলার অ্যাটেনডেন্টস নামে খোজা-সংগঠনের সদস্যরা এই খবর পেয়ে প্রাসাদে ছুটে এল। তারা তরুণ লিংদিকে জানালেন, তারা তাকে তার মায়ের প্রভাব থেকে মুক্তি দিতে এসেছেন।
চার বছর অন্তরিন থাকার পর ১৭২ সালে মারা যান তিনি। টেন রেগুলার অ্যাটেন্ডেন্টস-এর নেতা কাও জি তাকে হত্যা করেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। লিংদি এই সংগঠনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
হান চীনের প্রকৃত কোনো নেতা ছিল না। অর্থনৈতিক দুর্দশার সঙ্গে যোগ হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ১৭২ সালে অসুস্থতা, বন্যা ও পঙ্গপালের হামলা এবং ১৭৭ সালে যাযাবরদের বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভিযানে দেশের অবস্থা করুণ হয়ে পড়ে। ১৭৯ সালে মহামারি সারাদেশে অসংখ্য মানুষকে প্রভাবিত করে।
আবারও দেশে সহিংসতা দেখা দেয়। এবার ইয়েলো টারবান বা হলুদ পাগড়ি শামে নতুন একদল স্বাধীনতাকামী যোদ্ধার আবির্ভাব হয়।
১৮২ সালে হলুদ পাগড়ি সংগঠনের তিন লাখ ৫০ হাজার অনুসারী ছিলেন, যাদের প্রায় সবাই দরিদ্র, ভূমিহীন, রাগান্বিত ও মরিয়া অবস্থায় ছিলেন। ১৮৪ সাল নাগাদ তারা বিদ্রোহ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন।