অধ্যায় ৮০ – অমাবস্যা ও পুনর্জাগরণ
খ্রিস্টপূর্ব ৩৩ সাল থেকে খ্রিস্টাব্দ ৭৫ সালের মাঝে চীনে হান-রাজবংশকে সাময়িকভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়। কারণ হিসেবে দেখানো হয় অশনি সংকেতকে। পরে আবার তারা ফিরেও আসে।
পূর্বাঞ্চলে হান রাজবংশের তত্ত্বাবধানে চীন বেশ ভালোই এগিয়ে যাচ্ছিল।
৩৩ সালে অক্টাভিয়ান যখন তার ক্ষমতা সুসংহত করছেন, তখন হান সম্রাট ইউয়ানদির মৃত্যু হল। তিনি তার বাবা জুয়ানদির কাছ থেকে ক্ষমতা পেয়েছিলেন। এবার তার জায়গায় সম্রাট হলেন তার ছেলে চেংদি।
১৮ বছর বয়সি চেংদির সঙ্গে জ্যেষ্ঠ অভিভাবক ও রিজেন্ট হিসেবে থাকলেন তার মা চেং-চুন। তার উপদেশ মেনে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ সব পদে নিয়োগ দিলেন ওয়াং গোত্রের আত্মীয়দের। হান সরকারের উচ্চপদগুলোতে এই ওয়াং গোত্রের সদস্যদের ছড়াছড়ি দেখা গেল।
দুই দশক শাসনের পর খ্রিস্টপূর্ব ৭ সালে মারা গেলেন চেংদি। তার নিজের সন্তান ছিল না। ভাইপো আইতি তার স্থলাভিষিক্ত হলেন। এরপর রহস্যময় কারণে হান শাসকদের শাসনামল ছোট হতে লাগল। আইতির পর সম্রাট হলে তার চাচাতো ভাই পিং। তিনিও ৬ খ্রিস্টাব্দে মারা গেলেন। তারও কোনো সন্তান ছিল না।
রাজ-মাতা চেং-চুন তখনো জীবিত ছিলেন। তার জীবদ্দশায় তিনি চারজন সম্রাট দেখেছেন। এবার তিনি হানদের দূরসম্পর্কের চাচাতো ভাই রুজিকে সিংহাসনে বসালেন। তিনি জুয়ানদির বংশধর ছিলেন। রুজির রিজেন্ট হিসেবে তিনি তার নিজের ভাইপো ওয়াং মাংকে নিয়োগ দিলেন। তিনি ছিলেন একজন সম্মানিত ও শিক্ষিত মানুষ, যিনি বেশ কয়েক বছর ধরে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। তিনি ‘জায়গামতো ও সময়মতো ঘুস দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন বলে আমাদের জানান ইতিহাসবিদ বান গু।
অনেকে ওয়াং-এর নিয়োগে আপত্তি জানালেন। তার বিরুদ্ধে আগের অন্তত একজন রাজাকে বিষপ্রয়োগের অভিযোগ এল। কিন্তু ওয়াং মাং নিশ্চয়তা দিলেন, রাজার বয়স আরেকটু বাড়লেই তিনি তার হাতে সিংহাসন ছেড়ে দেবেন।
৩ বছরের মাথায় তিনি রাজধানীর মানুষকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হলেন যে হান-রাজারা দেশের জন্য অশুভ। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সম্রাটের অভাবে দেশের দুর্বৃত্তায়ন, হত্যা ও সবধরনের অপরাধ বাড়ছে। ওয়াং মাং-এর পক্ষে বিভিন্ন স্বৰ্গীয় চিহ্ন দেখা গেল। কুয়ার নিচে একটি সাদা পাথর পাওয়া গেল, যেখানে লেখা, “ওয়াং মাংকে বলো, তাকে সম্রাট হতে হবে!”।
হঠাৎ তিনি ঘোষণা দিলেন, হান রাজবংশের অবসান ঘটেছে এবং তিনিই এখন সম্রাট।
এভাবেই আপাতত সমাপ্ত হল হান রাজবংশের ১৯৭ বছরের শাসনামল।
প্রায় ১৫ বছর ওয়াং মাং-এর জিন রাজবংশ—নতুন রাজবংশ (৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) হান রাজবংশকে অমাবস্যার দিকে ঠেলে দিল।
ওয়াং মাং হান রাজবংশের আমলে করা সব সংস্কার পরিত্যাগ করার চেষ্টা করলেন। অভিজাত পরিবারগুলোকে ক্ষমতাবান করলেন। দেশের মানুষ এই আকাশ-পাতাল পরিবর্তনে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল।
ওয়াং মাং-এর শাসনামলেও দুর্ভাগ্য নেমে এল। খরা ও দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ল রাজধানী শহরে। সঙ্গে এল বন্যা। ১১ সালে হোয়াংহো নদের বাঁধ ভেঙে পড়ল এবং হাজারো মানুষ ডুবে মরলেন। যেসব অশুভ লক্ষণের দিকে ইঙ্গিত করে হানদের দূর করেছিলেন ওয়াং মাং, সেগুলোই তাকে তাড়া করে বেড়াল।
ওয়াং মাং যতদিনে শাস্তি পেলেন (সিংহাসন হারিয়ে), ততদিনে সাম্রাজ্যের অর্ধেক মানুষ মারা পড়েছে।
রাজনৈতিক পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাঝে চীনের প্রথম গোপন সম্প্রদায় গঠিত হয়। তাদের নাম ছিল রেড আইব্রো (লাল ভুরু)। তারা ওয়াং মাং-এর প্রচলন করা আইনগুলো বাস্তবায়ন করতে আসা সেনাদের বিরুদ্ধে লড়তে লাগলেন। তারা তাদের কপাল লাল রঙে রাঙাতেন, যাতে যুদ্ধের সময় তারা নিজেদের মিত্রদের খুঁজে পেতে পারেন।
২৩ খ্রিস্টাব্দে ওয়াং মাং ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। রেখে গেলেন হান পরিবারের অসংখ্য সদস্যকে, যাদের কারও সিংহাসনের ওপর স্পষ্ট দাবি ছিল না। দুই বছর তারা নিজেরা যুদ্ধ করল। অবশেষে লিউ জিউ নামে এক ব্যক্তি সবার সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হলেন। তার অপর নাম ছিল গুয়াং উদি। তিনি ওয়াং মাং-এর করা ক্ষতিগুলো পরিপূরণের চেষ্টা করলেন। তবে হানের আগের নীতিতে পুরোপুরি ফিরলেন না তিনি।
৩২ বছরে অসংখ্য ইতিবাচক সংস্কার করার পর তিনি তার সন্তান মিংদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন।
২৯ বছর বয়সে ক্ষমতাগ্রহণ করলেন মিংদি। তিনি উত্তরাঞ্চলে তার সেনাপতি পান চাওকে পাঠালেন শিওংনুদের হুমকির মোকাবিলা করতে।
পান চাও শুধু শিওংনুদের পরাজিত করেই থামলেন না, তিনি পশ্চিমের তারিম বেসিনও দখল করলেন। এই অঞ্চল দখলের ফলে পশ্চিমের সঙ্গে যোগাযোগ আরও সহজ হল।
মাংদি একসময় স্বপ্নে এক সোনালি দেবতা দেখলেন। এই দেবতা সম্মান চাইলেন। তার উপদেষ্টারা তাকে জানলেন, তিনি স্বপ্নে বুদ্ধকে দেখেছেন। ভারতীয়দের কাছে বুদ্ধের কথা শুনেছেন তারা। সে আমলে চীনে ভারত থেকে অসংখ্য বণিক ও ধর্মপ্রচারক আসতেন।
বুদ্ধের বিষয়ে আরও জানতে ভারতে দূত পাঠালেন মিংদি। ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্মে আগ্রহী হয়ে উঠলেন তিনি।