বারান্দায় মামুনকে দেখে এগিয়ে এল স্বপন। ভাইয়া, তুমি কি লইয়ারের সঙ্গে কথা বলেছ? পেপারস রেডি করেছ?
মামুন গম্ভীর গলায় বললেন, না।
কেন?
লজ্জা করছে।
লজ্জা করছে মানে? কীসের লজ্জা?
ড্রয়িংরুমে চল। বলছি।
ড্রয়িংরুমে এসে মুখোমুখি বসল দুভাই।
মামুন বলল, ল ইয়ারও তো পরিচিত মানুষ!
কথাটা বুঝতে পারল না স্বপন। বলল, তাতে কী হয়েছে?
আমাদের ফ্যামিলির এমন একটা কেলেঙ্কারির কথা সে জেনে যাবে।
শুনে বিরক্ত হল স্বপন। খুবই ছেলেমানুষি কথা বললে ভাইয়া।
কী রকম?
সমস্যাটা এমন, এটা মিটাতে হলে কাউকে না কাউকে ব্যাপারটা বলতেই হবে। কিছু কিছু মানুষ এটা জানবেই।
তা ঠিক।
তাছাড়া এই ধরনের কাণ্ড অনেক ফ্যামিলিতেই হয়। সেতুর বয়স কম। সে একটা ভুল করে ফেলেছে। এটা খুব বড় কোনও লজ্জার ব্যাপার নয়। লজ্জার ব্যাপার হবে যদি ব্যাপারটা আমরা মেনে নিই। সেই ছোকরার কাছে যদি সেতুকে….
কিন্তু সেতুকে ম্যানেজ করবি কী করে? সে তো কোনও কথা শুনছে না।
যেমন করেই হোক, ওকে বাধ্য করতে হবে। রেখা এবং ভাবী কথা বলেছে। এখন আমি বলব।
স্বপন সেতুর সঙ্গে কথা বলবে শুনে মামুন কেমন ভয় পেয়ে গেল। না না, তোর বলার দরকার নেই।
কেন?
তুই রগচটা ধরনের। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলে ওর গায়ে হাত টাত তুলে ফেলতে পারিস।
স্বপন হাসল। না, তা তুলব না। যত রাগই হোক, নিজেকে কন্ট্রোল করব।
সেতুর রুমে এসে সত্যি সত্যি নিজেকে খুবই সংযত রাখল স্বপন। সে এসে সেতুর মুখোমুখি দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে সেতু বলল, তুমি কেন এসেছ?
তুই জানিস কেন এসেছি।
কিন্তু যা বলার ভাবীদেরকে আমি বলে দিয়েছি।
কী বলেছিস?
ওসব নিয়ে তোমার সঙ্গে আমি আর কথা বলতে চাই না।
সেতুর চোখের দিকে তাকিয়ে অসহায় গলায় স্বপন বলল, তুই এমন হয়ে গেলি কী করে? আমরা দুটো ভাই কত কষ্টে, কত আগলে আগলে তোকে বড় করেছি। জীবনে কখনও তোর সঙ্গে ঝগড়া করিনি, তোকে একটা ধমক দিইনি। তুই হচ্ছিস আমাদের জান, নয়নের মণি। সেই তুই কোথাকার কার জন্য আমাদের সবাইকে এভাবে সাফার করাচ্ছিস। এই ফ্যামিলির জন্য, আমাদের কারও জন্য কি তোর একটুও টান নেই? একটুও মায়া নেই আমাদের কারও জন্য?
এবার সেতুও তাকাল স্বপনের চোখের দিকে। কথাটা যদি উল্টো করে আমি তোমাদেরকে বলি?
বল শুনি।
আমি তোমাদের একমাত্র বোন। আমার পছন্দে আমি আমার জীবনের সবচে বড় সিদ্ধান্তটা নিয়েছি। যার সঙ্গে নিজের জীবন জড়িয়েছি, তোমাদের বিবেচনায় সে যেমনই। হোক, আমার বিবেচনায় সে ই আমার জন্য প্রকৃত মানুষ। আমার কথা ভেবে, আমার সুখ শান্তির কথা ভেবে, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে তোমরা মেনে নিলেই পার! তা করছ না কেন?
করছি না তোর কথা ভেবেই। তোকে সন্তানের চে’ বেশি ভালবাসি বলে।
তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না।
তোর বয়স কম। এই বয়সে আবেগতাড়িত হয়ে চলে মানুষ। কিন্তু জীবন অনেক বড়। কাঁচা আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। যাকে নিয়ে সমগ্র জীবন কাটাতে চাস তুই, আমরা মনে করি জীবনটা তার সঙ্গে সুখে আনন্দে কাটাতে তুই পারবি না।
কেন? তার অসুবিধা কী?
তুই জানিস অসুবিধাগুলো কী?
টাকা, স্ট্যাটাস এসব বোঝাতে চাইছ তো?
হ্যাঁ।
কিন্তু আমার কাছে এসব একেবারেই মূল্যহীন।
কেন?
একজন মানুষকে সুখে আনন্দে জীবন কাটাতে হলে দরকার তার জীবনসঙ্গীর একটি সুন্দর মন আর গভীর ভালবাসা। আমাদের দুজনেরই তা আছে। আমাদের আর কিছু লাগবে না।
লাগবে, অবশ্যই আরও অনেক কিছু লাগবে। বোঝালেও এখন তুই তা বুঝতে চাইবি না।
সেতু কাতর গলায় বলল, ভাইয়া, সবকিছু বুঝেই কাজটা আমি করেছি। এভাবে বিয়ে হোক শুভ চায়নি। সে আমাকে অনেক বুঝিয়েছে। আমি বুঝতে চাইনি। কারণ আমি জানতাম এভাবে না হলে ওকে আমি কোনওদিন পাব না।
তারপর কেমন ভেঙে পড়ল সেতু। ওর কাছ থেকে আমাকে সরাবার একটিই পথ আছে ভাইয়া। আমাকে তোমরা মেরে ফেল।
সেতুর ভেঙে পড়া একদমই পাত্তা দিল না স্বপন। নিঃশব্দে উঠে ড্রয়িংরুমে চলে এল। এভাবে হবে না ভাইয়া।
সোফায় বসা মামুন নড়েচড়ে উঠল। তাহলে কীভাবে হবে?
অন্য কোনও একটা পথ বের করতে হবে।
কী পথ?
সেতুকে আমরা কেউ কিছুই আর বলব না। বাড়িতে যেভাবে সে আছে সেভাবেই থাকবে। তবে চোখ রাখতে হবে কিছুতেই যেন বাড়ি থেকে বেরুতে না পারে।
বুঝলাম কিন্তু আসল কাজটা হবে কীভাবে?
ছোকরাটাকে প্রেসারে ফেলতে হবে। বা তার চেয়েও বেশি কিছু।
মানে?
শীতল, গম্ভীর গলায় স্বপন বলল, ওকে মেরে ফেলতে চাই।
মামুন একেবারে আঁতকে উঠলেন। কী বলছিস তুই?
ঠিকই বলছি।
না না।
এছাড়া কোনও উপায় নেই ভাইয়া।
তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? একটা মানুষ খুন করে ফেলবি?
আমি নিজে করব না।
তাহলে?
একজন প্রফেসনাল মার্ডারার ঠিক করব। দুচার লাখ টাকার বিনিময়ে কাজটা সে করে দেবে। এমনভাবে করবে, কেউ কিছু বুঝতেই পারবে না।
মামুন ভয়ার্ত গলায় বলল, না না, এসব করা ঠিক হবে না।
স্বপন বলল, তুমি আমাকে বাধা দিও না ভাইয়া। তুমি চুপচাপ থাক। দেখ কী সুন্দরভাবে ব্যাপারটা আমি ম্যানেজ করি। সাপ মারা এবং লাঠি না ভাঙার কাজটা আমি খুব ভাল জানি।
স্বপন আর দাঁড়াল না।
.
লালু খুবই কায়দার সানগ্লাস পরতে পছন্দ করে।
সানগ্লাস পরে মোটর সাইকেল চালাবার সময় সে যতটা না মাস্তান তার চেয়েও বড় মাস্তান মনে হয়। পেছনে দিলুকে সে রাখেই। লালুর সর্বক্ষণের চামচা দিলু। লালুর সঙ্গে দিলুর নামেরও খুব মিল। খুঁজে পেতে চামচাটা লালু ভালই যোগাড় করেছিল।
সেই চামচা নিয়ে লালু এখন মোটর সাইকেল চালাচ্ছে। মাঝারি ধরনের স্পিডে মোটর সাইকেল চালাবার অভ্যেস তার। ফলে ঠিক সময়ের মিনিট দশেক পরে মামুন স্বপনের অফিসের সামনে এসে পৌঁছাল সে। মোটর সাইকেল লক করে অফিসে ঢুকল এই বিল্ডিংয়ের মালিকের ভঙ্গিতে। স্বপনের রুমে ঢুকল মহাভাব ধরে।
স্বপন রুমেই ছিল, লালুকে দেখে উৎফুল্ল হল। এস লালু, এস।
লালু কোনও কথা বলল না, স্বপনের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসল। দিলু দাঁড়িয়ে রইল তার পিঠের কাছে।
কোনও ভণিতা না করে স্বপন বলল, আমার একটা কাজ করে দিতে হবে লালু।
লালু নির্বিকার গলায় বলল, জানি।
শুনে চমকে উঠল স্বপন। কী করে জানো?
কাজ ছাড়া আপনাদের মতো লোকরা আমাদেরকে ডাকে না।
ও তাই বল।
কাজের সাইজ কেমন? হাঁড়ি না বোতল?
কথাটা বুঝতে পারল না স্বপন। বলল, মানে?
বড় না ছোট? কী ধরনের কাজ?
একটু সময় নিয়ে বলতে হবে।
তারপর দিলুর দিকে তাকাল, তোমার সঙ্গে কে?
জিনিসটার নাম দিলু। আমার চামচ।
চামচ মানে?
স্বপনকে একটা ধমক দিল লালু। ধুৎ মিয়া! আপনে তো আমার ল্যাংগুয়েজই বোঝেন না। খালি মানে মানে করেন। চামচ মানে হচ্ছে চামচা। লেজুড়, ট্যান্ডল। অর্থাৎ আমি যা বলব সেই কাজই করবে।
স্বপন আশ্বস্ত হল, বুঝেছি।
বোঝেন নাই। জিনিসটা দেখতে যোবার মতন। অর্থ হচ্ছে দিলু কথায় একদমই বিশ্বাস করে না। কাজ, শুধু কাজে বিশ্বাস করে। কথা বলার আগেই মার্ডার করে দেয়। খুবই চিকন হারামি জিনিস।
দিলুর গুণপনা শুনে স্বপন একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। এরকম লোকই আমার দরকার। ব্যাপারটা তাহলে খুলে বলি তোমাদেরকে। তবে একেবারেই সিক্রেট ব্যাপার। তোমরা দুজন ছাড়া কাকপক্ষীটিও যেন টের না পায়।
কাকপক্ষী শব্দটা বুঝল না লালু। চিন্তিত চোখে স্বপনের দিকে তাকাল। কাকপক্ষী জিনিসটা কী?
কাক, কাক।
বুঝেছি, কাউয়া।
তারপর একটু থেমে বলল, তবে কথা শুরুর আগে দুই প্যাকেট বেনসন আনান। চা আমি আজকাল খাই না। দুই বোতল ঠাণ্ডা আনান। আর কিছু ক্যাশ মাল টেবিলের ওপর রাখেন। তারপর বলেন মার্ডারটা কবে করতে হবে?
এবারও স্বপন খুব অবাক হল। মার্ডার করতে হবে বুঝলে কী করে?
কথার সাইজে বোঝা যায়।
ঠিক তখুনি ট্রেতে করে তিন কাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে স্বপনের রুমের সামনে এসেছে পিয়ন আলী। বন্ধ দরজা ঠেলে মাত্র ঢুকবে, ভেতর থেকে লালুর গলা শুনতে পেল। যাকে মার্ডার করতে হবে তার নাম কী?
মার্ডার শব্দটা শুনে পাথর হয়ে গেল আলী। ভেতরে না ঢুকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল সে। ভেতরের সব কথা শুনতে লাগল।
স্বপন বলল, ছোকরাটির নাম শুভ।
থাকে কোথায়?
সব তোমাকে চিনিয়ে দেব।
ঠিক আছে, এখন ঠাণ্ডা আর বেনসন আনান।
স্বপন বেল বাজাল, সেই শব্দে দরজার সামনে দাঁড়ান আলী চমকে উঠল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। স্বপন অবাক হল, বেল বাজাবার সঙ্গে সঙ্গে তুই ঢুকলি কী করে? কোথায় ছিলি?
চট করেই ব্যাপারটা মনে করল আলী। লালু এবং দিলুকে দেখিয়ে হাসিমুখে বলল, স্যারদের দেখলাম আপনার রুমে ঢুকতে, দেখেই চা বিস্কুট নিয়ে আসছিলাম। আপনার রুমের দরজায় মাত্র এসেছি, বেলটা বাজল।
শীতল চোখে আলীর দিকে তাকাল লালু। তোমার মাথায় ঘিলুটা একটু বেশি।
জ্বি?
বেশি ঘিলু থাকা ভাল না। হিঙ্গুল চেন, হিঙ্গুল? সর্দি হলে মানুষের নাক দিয়ে পড়ে। যাদের মাথায় ঘিলু বেশি তাদের মাথায় ভাল করে একটা কিল দিলে ঘিলুটা হিঙ্গুলের মত নাক দিয়ে বেরিয়ে আসে। আমার এখন ইচ্ছে করছে তোমার মাথায় একটা কিল দিই?
কেন স্যার?
চা বিস্কুট নিয়ে আসার আগে তোমার বোঝা উচিত ছিল এই মাল সবাই খায় না।
তারপর ধমকের সুরে বলল, যাও ঠাণ্ডা নিয়া আস। আর দুই প্যাকেট বেনসন।
সঙ্গে সঙ্গে স্বপন বলল, হ্যাঁ, এজন্যই তোকে ডেকেছিলাম, যা, তাড়াতাড়ি যা।
হাতে ধরা চা বিস্কুটের ট্রে নিয়েই বেরিয়ে যাচ্ছিল আলী, স্বপন বলল, আমার চাটা দিয়ে যা। আমি চা ই খাব।
বিনীত ভঙ্গিতে স্বপনের সামনে এককাপ চা নামিয়ে রাখল আলী।
.
হোটেল লবিতে আলীকে বসে থাকতে দেখে খুবই অবাক হল নাহিদ। কী রে আলী, তুই এলি কোত্থেকে?
আলী উঠে দাঁড়াল। আপনার খোঁজে এসেছি।
কী করে জানলি আমি এই হোটেলে থাকি?
কার কাছে যেন শুনেছিলাম ঢাকায় এলে এই হোটেলেই থাকেন আপনি।
ঠিকই শুনেছিস।
কিন্তু আজ আছেন কি না জানতাম না। আন্দাজের ওপর এলাম।
বা, বা।
দুজনে মুখোমুখি বসল।
নাহিদ বলল, খবর কী বল। চাকুরি বাকরি করছিস না?
জ্বি করছি।
আগেরটাই?
জ্বি।
আজ অফিসে যাসনি?
না।
কেন?
ছুটি নিয়েছি।
তীক্ষ্ণচোখে আলীর দিকে তাকাল নাহিদ। তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ না কি?
না শরীর ঠিকই আছে।
তাহলে?
টেনশনে ছিলাম।
কীসের টেনশন?
আপনাকে পাই কি না? না পেলে কীভাবে কী করব ওসব ভেবে চেহারাটা খারাপ হয়ে গেছে। তাছাড়া আমার ধারণাটা ঠিক কি না, যার নাম শুনেছি সে আপনার বন্ধুই কি না তাও বুঝতে পারছিলাম না।
আলীর কথা বুঝতে পারল না নাহিদ। বলল, কী হয়েছে?
আপনার একজন বন্ধু আছে না শুভ নামে?
হ্যাঁ, খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কী হয়েছে শুভর?
আপনি বলতে পারবেন কি না জানি না, আমার অফিসের দুই মালিক মামুন সাহেব, স্বপন সাহেব….
আলীর কথা শেষ হওয়ার আগেই উত্তেজিত হল নাহিদ। হ্যাঁ, হ্যাঁ শুভর সঙ্গে ওরা রিলেটেড।
এবার আলীও উত্তেজিত হল। তাহলে ঠিক ধারণাই করেছি আমি। ঠিক জায়গাতেই এসেছি।
কী হয়েছে বল আমাকে।
আপনার বন্ধুর জন্য খুব খারাপ একটা খবর আছে। কিন্তু এরকম খোলামেলা জায়গায় বসে ওসব কথা আমি বলতে চাই না।
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল নাহিদ। তাহলে আমার রুমে চল।
চলুন।
ওরা দুজন সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
.
নাহিদের কথা শুনে লাফিয়ে উঠল শুভ, কী? মেরে ফেলবে আমাকে? মাস্তান লাগিয়েছে আমার পেছনে?
নাহিদ বেশ নার্ভাস। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, তাই তো শুনলাম। তিনদিন হল ঢাকায় এসেছি। আজ বিকেলের ট্রেনে চলে যাওয়ার কথা। এসব শুনে আর যেতে পারলাম না।
কিন্তু তুই শুনলি কার কাছে?
শুভর বিছানায় বসল নাহিদ। এও এক অদ্ভুত যোগাযোগ। সেতুর ভাইদের অফিসে আমার একটা পরিচিত ছেলে পিয়নের কাজ করে। এক সময় ছেলেটাকে আমি একটু সাহায্য করেছিলাম। সে জানে তুই আমার বন্ধু। সেতুর ছোট ভাইর রুমে চা দিতে ঢুকে তোর নাম এবং মার্ডার শব্দ দুটো সে শুনে ফেলেছে। ব্যাপারটা পুরোপুরি বোঝেনি। কিছু একটা অনুমান করে আমার হোটেলে এসেছে, আমাকে বলেছে। এইটুকু শুনেই যা বোঝার বুঝে গেছি আমি।
শুভ গম্ভীর গলায় বলল, ওরা আমাকে খুবই আন্ডারএস্টিমেট করেছে।
মানে?
বাড়ি এসে ডিভোর্সের জন্য ধমক দিয়ে গেছে। এখন লাগিয়েছে মাস্তান। ভেবেছে মাস্তান ফাস্তানদের কথা শুনে ভয়ে সেতুকে আমি ছেড়ে দেব। কোন মাস্তান লেগেছে আমার পেছনে, তাদেরকে আমি একটু দেখতে চাই।
মাথা গরম করিস না। এই ধরনের পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে হয়।
মাথা বোধহয় আমি আর ঠাণ্ডা রাখতে পারব না।
কেন?
সীমাহীন বাড়াবাড়ি করছে ওরা। সেতুকে বাড়িতে আটকে রেখেছে। নিশ্চয় খুব মেন্টাল প্রেসারে রেখেছে ওকে। তার ওপর আমার পেছনে লাগিয়েছে মাস্তান। আমি ওদেরকে ছাড়ব না, আমি ওদেরকে দেখে নেব।
কী কাজে শুভর রুমের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন মা, শুভর উত্তেজিত গলা শুনে কী রকম সন্দেহ হল তার। আড়াল থেকে শুভর শেষ দিককার কথা কিছুটা শুনে ফেললেন, শুনে সুরমাকে খুঁজতে ডাইনিং স্পেসের দিকে চলে এলেন। নিজের রুমের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল সুরমা। মা ডাকলেন, বউমা, শোন।
সুরমা এসে তার সামনে দাঁড়াল, জ্বি মা।
মা ভয়ার্ত গলায় বললেন, আমার খুব ভয় করছে বউমা, খুব টেনশন হচ্ছে।
সুরমা অবাক হল। কেন? হঠাৎ কী হল আপনার?
শুভর পেছনে কারা নাকি মাস্তান লাগিয়ে দিয়েছে।
শুনে সুরমাও ভয় পেল। কী?
হ্যাঁ।
কে বলল আপনাকে?
আমি নিজ কানে শুনেছি। শুনেই আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে। নিশ্চয় শুভ কোথাও কিছু একটা ঝামেলা করেছে। কিছুদিন ধরে ওকে বেশ চিন্তিত দেখি। সেদিন কারা যেন ওর কাছে এসেছিল।
সুরমা চিন্তিত গলায় বলল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কারা মাস্তান লাগাবে শুভর পেছনে? কী করেছে ও?
আমি জিজ্ঞেস করলে কোনও কথাই ও আমাকে বলবে না। তুমি ওর সঙ্গে কথা বল বউমা, সব জেনে আমাকে জানাও। আমি তারপর শাহিনের সঙ্গে কথা বলি।
মাকে সাহস দিয়ে সুরমা বলল, আপনি এত টেনশন করবেন না। আমি শুভর সঙ্গে কথা বলব।
শুভর সঙ্গে সুরমা কথা বলল, রাতেরবেলায়।
শুভ বলল, ভেবেছিলাম চুপচাপ থাকব। আস্তেধীরে ব্যাপারটা ঠিক হয়ে আসবে। কিন্তু ওরা আমাকে চুপচাপ থাকতে দিচ্ছে না। আমিও দেখব কোন মাস্তান কী করে আমার।
সুরমা বলল, সেতুর ভাইরা এই ধরনের কাজ করবে এ আমি ভাবতেই পারছি না।
কাজটা ওর ছোট ভাই করেছে। সে নিজেও মাস্তান টাইপের।
এসব তোর আগেই ভাবা উচিত ছিল।
শুভ অবাক হল। কী বলছ ভাবী? ঠিকই বলছি।
না ঠিক বলছ না। কার ভাই মাস্তান, কার কত টাকা আছে ওসব ভেবে কেউ কারও সঙ্গে প্রেম করে? ভালবাসার সাথে এসব বিষয়ের কী সম্পর্ক?
কিন্তু এখন সামলাবি কী করে?
দেখি।
মাস্তানরা তোর যদি কোনও ক্ষতি করে?
কী ক্ষতি করবে?
আজকাল কত রকমের কাণ্ড হয়।
কিছু হবে না। কেউ কিছুই করতে পারবে না আমার। সেতু আমার বিয়ে করা বউ। আইন আমার পক্ষে, দরকার হলে আইনের সাহায্য নেব আমি।
এদিকে বাড়িতেও তো সমস্যা আছে, মা এখনও ব্যাপারটা জানেনই না। তাঁকে ম্যানেজ করাও তো কম ঝামেলার কাজ না।
শুভ নির্বিকার গলায় বলল, নিজেদের বাড়ি নিয়ে এখন আমি আর ভাবছিই না। ওসব তুমি বুঝবে।
সুরমা চিন্তিত চোখে শুভর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
.
সন্ধের পর কখনও কখনও চুপচাপ শুয়ে থাকতে খুব পছন্দ করে শাহিন। টিভি দেখে না, দিনের পুরনো খবরের কাগজ পড়ে না, এমন কি কিছু ভাবেও না।
আজও তেমন করে শুয়ে ছিল।
একসময় সুরমা এসে দাঁড়াল তার সামনে। সেতুর ভাইরা যে মাস্তান লাগিয়ে দিয়েছে শুভর পেছনে সে কথা বলল। শুনে ফ্যালফ্যাল করে স্ত্রীর মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে রইল শাহিন। তারপর উত্তেজিত ভঙ্গিতে বিছানায় উঠে বসল। বল কী?
সুরমা বলল, হ্যাঁ। সব মিলে বেশ বড় রকমের ঝামেলা লেগে গেছে।
তাইতো দেখছি।
শুভর বিয়ের কথা যেদিন তোমাকে বললাম, তোমার উচিত ছিল সেদিনই কথাটা মাকে জানিয়ে দেয়া এবং তাকে ম্যানেজ করা।
আমি ভাবলাম এত তাড়াহুড়োর কী আছে! সময় যাক, আস্তেধীরে মাকে বলব।
এখন তো দুটো দিক সামলাতে হবে। একদিকে মাস্তান, আরেকদিকে তোমার মা।
মাকে নিয়ে আমি ভাবছি না। যত রাগীই হোন, শুভ তো তার ছেলে।
তবু তুমি আগে তাঁকেই ম্যানেজ কর। তারপর পুলিশে জানাও।
পুলিশে?
হ্যাঁ। দুটো ম্যাচিউর ছেলেমেয়ে নিজেদের পছন্দে বিয়ে করেছে, এটা আইনসম্মত। আইন আমাদেরকে সাহায্য করবে।
কিন্তু টাকার জোরে ওদের সঙ্গে আমরা পারব না।
সুরমা একটু বিরক্ত হল, এসব চিন্তা পরে করা যাবে। আগে মাকে ম্যানেজ কর। তিনি খুব টেনশনে আছেন।
সামান্য সময় কী ভাবল শাহিন, তারপর উঠল। চল।
সুরমা অবাক হল। কোথায়?
মার রুমে।
মায়ের রুমে মালাও ছিল। শাহিন কথা শুরু করল মালার দিকে তাকিয়ে। তুই কিছু শুনেছিস?
মা বলল, কী?
শুভর ব্যাপারে।
মালা একটা ঢোক গিলল।
সুরমা বলল, আমি জানি তুমি শুনেছ। বলে ফেল। এখন আর না বলে উপায় নেই।
মা সুরমার দিকে তাকালেন। কী হয়েছে?
সুরমা নয় শাহিন বলল, আমাদের উচিত ছিল আগেই তোমাকে জানানো। কিন্তু তোমার ভয়ে…
এত ভণিতার দরকার নেই। কী হয়েছে পরিষ্কার করে বল।
শুভ বিয়ে করেছে।
কথাটা যেন বুঝতে পারলেন না মা। থতমত খেলেন। কী? কী বললি? শুভ বিয়ে করেছে?
হ্যাঁ।
আমার ছেলে লুকিয়ে বিয়ে করেছে? আমার ছেলে?
মালা বলল, মেয়েটা খুব সুন্দর মা।
মালাকে প্রচণ্ড ধমক দিলেন মা। চুপ কর, সুন্দর অসুন্দর দিয়ে আমি কী করব? লোকে শুনলে বলবে কী? আমাদের মান-সম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিল সে!
সুরমা বলল, এতে মান-সম্মান নষ্টের কী হল? এরকম বিয়ে আজকাল অনেক হয়।
খরচোখে সুরমার দিকে তাকালেন মা। তুমি কথা বলবে না। আমার সামনে একদম কথা বলবে না তুমি। অতিরিক্ত লাই দিয়ে ছেলেটির মাথা তুমি নষ্ট করেছ।
শাহিন বলল, ওর সঙ্গে অযথা রাগ করছ তুমি। ও কি শুভকে বিয়ে করার কথা শিখিয়ে দিয়েছে?
কিন্তু আমার কাছে এসব কথা তোরা লুকিয়ে গেছিস কেন? বাড়ির সবাই জানে, আমি কেন জানি না?
মালা বলল, কথা বললেই যেমন করে ওঠ তুমি, কে যাবে তোমার সঙ্গে কথা বলতে!
মালার কথায় আরও রাগলেন মা, খুঁচিয়ে কথা বলবি না আমার সঙ্গে। আমার মেজাজ খুব খারাপ।
শাহিন শান্ত গলায় বলল, মেজাজ খারাপ করো না মা। বিয়ে করে শুভ না হয় অন্যায় করেছে কিন্তু এখন যে সে বড় রকমের একটা বিপদে পড়েছে তার কী করবে?
শুনে মা একেবারে নিভে গেলেন। কীসের বিপদ?
শুভর পেছনে ওরা মাস্তান লাগিয়ে দিয়েছে। শুভকে মেরে ফেলতে চাইছে।
শাহিনের কথা শুনে নিজের অজান্তেই যেন উঠে দাঁড়ালেন মা। দিশেহারা গলায় বললেন, সর্বনাশ! কোথায়, আমার ছেলে কোথায়?
আর কোনও দিকে তাকালেন না মা। পাগলের মতো শুভর রুমে এসে ঢুকলেন।
চিন্তিত ভঙ্গিতে বিছানায় বসেছিল শুভ। মা এসে অদূরে দাঁড়ালেন। এক পলক মাকে দেখেই চোখ নামিয়ে নিল শুভ।
অপলক চোখে শুভকে খানিক দেখলেন মা। তারপর আস্তেধীরে হেঁটে শুভর সামনে এসে দাঁড়ালেন। শুভর মাথায় হাত দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে শিশুর ভঙ্গিতে দুহাতে মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরল শুভ, মায়ের কোলের কাছে মুখ রেখে হুহু করে কেঁদে ফেলল। আমাকে তুমি মাফ করে দাও মা, আমাকে তুমি মাফ করে দাও।
কোন ফাঁকে যেন শুভর মাথাটা জড়িয়ে ধরেছেন মা। ছেলের কান্নায় তারও চোখ ফেটে কান্না এল।
শুভর রুমে মা এবং ছেলে দুজনেই যখন কাঁদছে ঠিক তখুনি লালুর মোটর সাইকেল এসে থামল এই বাড়ির সামনে। লাইটপোস্টের তলায় মোটর সাইকেল দাঁড় করাল লালু। সঙ্গে সঙ্গে দিলু নামল পেছন থেকে, কিন্তু মোটর সাইকেলের স্টার্ট বন্ধ করার পরও লালু নামল না। সিটে বসেই শুভদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল।
নিজের রুমের জানালা থেকে এই দৃশ্যটি দেখে ফেলল মালা। লোক দুটো যে মাস্তান বুঝে ফেলল। তাদের বাড়ির দিকেই যে তাকিয়ে আছে, বুঝে ফেলল, তারপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।
এদিকে নিজেকে একসময় সামলেছে শুভ। শুকনো গলায় মাকে বলছে, মাস্তানদেরকে আমি ভয় পাচ্ছি না মা। ওরা আমার কিছুই করতে পারবে না। আমি ভয়। পাচ্ছিলাম তোমাকে। এমনিতেই তুমি আমাকে দেখতে পার না, তার ওপর এমন একটা কাজ করে ফেললাম।
চোখের জল সামলে মা বললেন, তোকে আমি দেখতে পারি না, একথা কে বলেছে? আমার মেজাজটা একটু খিটখিটে, এজন্য তুই ভাবিস তোকে আমি কম আদর করি। আসলে ছোট সন্তানের জন্য মায়ের টান থাকে সবচাইতে বেশি, আর বাড়ির সবাই যে কথা জেনে যাবে আমি কেন সে কথা জানব না!
এ সময় হাঁপাতে হাঁপাতে মালা ঢুকল। মা, শুভ, আমাদের বাড়ির সামনে মোটর সাইকেল নিয়ে দুজন মাস্তান দাঁড়িয়ে আছে।
শুনে চমকে উঠলেন মা। সর্বনাশ!
শুভ উঠে দাঁড়ায়, ওরা যে মাস্তান তুই বুঝলি কী করে? চেহারা দেখে বোঝা যায়। আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে! চল তো দেখি।
সঙ্গে সঙ্গে শুভর হাত ধরলেন মা। না, তুই যেতে পারবি না। আমি তোকে ওদের সামনে যেতে দেব না।
শুভ অবাক হল। তোমরা এত ভয় পাচ্ছ কেন? আমি একটু দেখি কোন মাস্তানরা আমার পেছনে লেগেছে।
না না দেখতে হবে না। যদি দেখতে হয় মালার রুমের জানালা থেকে দেখ।
কিন্তু শুভ মালার রুমে আসার আগেই লালু দিলু চলে গেছে।
রাস্তায় কাউকে না দেখে মালার দিকে তাকাল শুভ। বাইরে কোথায় কোন মাস্তান দেখলি আপা? রাস্তায় তো কেউ নেই।
মালা তার জানালা দিয়ে উঁকি দিল। ছিল। রাস্তার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন নেই।
মা বললেন, মালাকে বোধহয় দেখে ফেলেছিল। এজন্য চলে গেছে।
শুভ হাসল। তোমরা সবাই এত বেশি নার্ভাস হয়েছ, কী বলব! আমি একটু বেরুই। চারপাশটা ঘুরে দেখে আসি।
না, একদম না। আজ রাতে বাড়ি থেকে তুই বেরুতেই পারবি না। চল শাহিনের সঙ্গে কথা বলি। ওর সঙ্গে পরামর্শ করে, যা করার করব।
শুভর সঙ্গে মা কোনও রাগারাগি করেনি দেখে সুরমা এবং শাহিন দুজনেই বেশ উৎফুল্ল। কিন্তু বাড়ির সামনে মাস্তান এসেছিল শুনে দুজনেই চিন্তিত হল।
মা বললেন, আমার খুব নার্ভাস লাগছে।
শাহিন বলল, তা তো লাগারই কথা। কীভাবে ব্যাপারটা সামাল দেব বুঝতে পারছি না।
সুরমা বলল, তুমি কি সেতুর ভাইদের সঙ্গে কথা বলবে?
মনে হয় না এই ধরনের পরিস্থিতিতে ওরা আমার সঙ্গে কথা বলবে। অযথা অপমান। হওয়ার দরকার আছে?
মা বললেন, তাহলে কী করবি?
ওয়েট করতে চাই। যতদিন যাবে ব্যাপারটা তত স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
এদিকে মাস্তানরা যদি শুভর কোনও ক্ষতি করে?
ভাবছি থানায় একটা জিডি করে রাখব।
.
মালা তার বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে স্বামীকে চিঠি লিখছে, সামনে সেতুর সেই ছবিটা।
ছবিটার দিকে একবার তাকাচ্ছে তারপর আবার লিখছে।
এসময় শুভ এসে দাঁড়াল এই রুমের সামনে। আপা, আসব?
মালা উঠে বসল। আয়।
শুভ ভেতরে ঢুকল। বিছানায় সেতুর ছবি দেখে অবাক হল। এই ছবি দিয়ে কী করছিস?
মালা হাসল। ছবির দিকে তাকিয়ে সেতুর বর্ণনা লিখছিলাম।
বুঝতে পারলাম না। কীসের বর্ণনা?
তোর দুলাভাইকে চিঠি লিখছি। তোর আর সেতুর পুরো ঘটনা লিখে দিয়েছি। সেতু দেখতে কেমন চিঠিতে ওই বর্ণনাই লিখেছি।
আমার এদিকে জান বেরুচ্ছে আর তুই…
ভাইকে সান্ত্বনা দিল মালা। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই এত ভেঙে পড়িস না তো!
একটু থেমে অনুরোধের গলায় মালা বলল, শুভ, সেতুর এই ছবিটা আমি নিই?
কেন?
তোর দুলাভাইকে পাঠাব।
শুভ হাসল। বর্ণনা তো লিখেই দিয়েছিস, ছবি পাঠাবার আর দরকার কী?
বর্ণনা পড়ে হয়ত বুঝতে পারবে না আমার ছোটভাইর বউটি কী পরিমাণ সুন্দর।
তারপর অনুনয়ের গলায় বলল, ছবিটা নেব?
নে। ওর আরও ছবি আমার কাছে আছে।
মালা একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। খুব খুশি হলাম।
শুভ কথা বলল না। দরজার দিকে পা বাড়াল।
মালা ডাকল। শোন।
শুভ ঘুরে দাঁড়াল। কী?
আমার সামনে এসে একটু বস।
শুভ নিঃশব্দে মালার সামনে এসে বসল।
মন খারাপ করা সন্তানকে যেভাবে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করেন মা ঠিক সেইভাবে শুভর মাথায় পিঠে হাত বুলাতে লাগল মালা, মায়াবি গলায় বলল, তুই আমার চে’ খুব বেশি ছোট না। তবু ছেলেবেলায় মা তোকে বকলে, তুই যখন খুব মন খারাপ করতি, আমি তোকে কোলে নিতাম। তুই বেশ ভারি ছিলি। তোকে কোলে নিয়ে বেশি দূর হাঁটতে পারতাম না আমি। তবু নিতাম। আমি কোলে নিলেই মনটা তোর ভাল হয়ে যেত। আজ সেসব দিনের মতো তোকে কোলে নিতে ইচ্ছে করছে। আমি কোলে নিলে যদি তোর মনটা ভাল হয়।
মালার কথা শুনে চোখ ছলছল করে উঠল শুভর। এভাবে বলিস না আপা, এভাবে বলিস না। আমার খুব কান্না পাচ্ছে।
ততোক্ষণে সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলেছে শুভ। চোখ মুছতে মুছতে তারপর দ্রুত বেরিয়ে গেল সে।
ভাইর জন্য অনেকক্ষণ পর্যন্ত মনটা খারাপ হয়ে রইল মালার।
.
লালু চায়নিজ রেস্টুরেন্টে ঢুকেছে এবং একটা টেবিলে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে দেখে দিলু বলল, এখানে এলি কেন?
লালু নির্বিকার গলায় বলল, গান গাইতে!
তারপর সত্যি সত্যি গান গাইতে লাগল। চাল সাইয়া সাইয়া সাইয়া সাইয়া, চাল সাইয়া সাইয়া সাইয়া…
লালুর মুখোমুখি বসে দিলু বলল, তোর কায়দা কানুন আমি বুঝতেই পারি না।
গরুদের পক্ষে সব কিছু বোঝা সম্ভব না।
তারপরই ছোট্ট একখানা ধমক দিল। এই ব্যাটা রেস্টুরেন্টে লোকে কী করতে আসে?
দিলু সঙ্গে সঙ্গে বলল, খেতে।
আমিও সেই কাজেই আসছি। এখন দাপটের একখানা খাওয়া দেব। আমি রসিয়ে রসিয়ে খাব আর তুই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবি।
আবার সেই গান ধরল লালু। চাল সাইয়া সাইয়া…
একজন ওয়েটার এসে দাঁড়াল এই টেবিলের সামনে। অর্ডার দেবেন স্যার?
লালু নির্বিকার গলায় বলল, না।
জ্বি?
কোনও অর্ডার দেব না। তোমার যা মনে হয় নিয়ে আস।
ওয়েটার হাসল, সত্যি স্যার?
একদম সত্যি। যাও।
লোকটি সত্যি সত্যি চলে গেল।
দিলু গাল ফুলিয়ে বলল, তুই কিন্তু আমাকে খুব ইনসাল্ট করেছিস।
লালু অবাক হল। তাই নাকি?
হ্যাঁ।
তোর কথার ধরনে করেছি।
কী বলেছি আমি?
এত ভাল একটা রেস্টুরেন্টে খেতে এলাম, ঢুকে তুই জিজ্ঞেস করলি, এখানে এলি কেন? তোর সেই কথায় আমি মাইন্ড করেছি। এজন্যই গরু বললাম। ঠিক আছে এখন আর কোনও মাইন্ড নাই। ঠিক আছে?
দিলু খুশি হল। ঠিক আছে।
শোন, স্বপন সাহেব খুবই ভাল মোয়াক্কেল। কাজটা করে ফেলতে পারলে মালের কোনও অভাব হবে না।
তাহলে করছিস না কেন? এইসব মার্ডার তো আমাদের জন্য তেলপানি। বাড়ি চিনি, ছেমড়াটারেও চিনি। মার্ডারে অসুবিধা কী?
কোনও অসুবিধা নাই।
তবে?
কাজটা যখন হাতে নিয়েছি, করতে তো হবেই। করলে এক সঙ্গে মালও অনেক, কিন্তু কাজটা আমি ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে করতে চাই। কাজ যত ঝুলবে খুচরা ইনকাম ততো বাড়বে। দুই চারদিন পর পর স্বপন সাহেবের কাছে যাব, পাঁচ দশ হাজার নিয়ে আসব। মূল কনটাক্টের সঙ্গে এই টাকার কোনও সম্বন্ধ নাই। পলিসিটা বুঝেছিস?
দিলু বিগলিত গলায় বলল, একদম ক্লিয়ার। খুবই ভাল পলিসি।
সঙ্গে সঙ্গে লালু আবার গান ধরল। চাল সাইয়া সাইয়া সাইয়া…।
.
তুই যাসনি?
নাহিদ গম্ভীর গলায় বলল, তোর এই ধরনের পরিস্থিতি জেনে কী করে যাই।
শুভ বেশ বিরক্ত হল। আমার মা ভাইবোন ভাবী কারও সঙ্গে তোর কোনও ব্যবধান নেই। তোরা সবাই একই রকমের ভীতু।
কোনও কোনও পরিস্থিতিতে মানুষ ভীতু হতে বাধ্য হয়। দুচারজন মাস্তান তো আমিও চিনি, তোর বন্ধু বান্ধবের সার্কেল খুব ছোট নয়। ইচ্ছে করলেই সেতুর ভাইদের ভাড়াটিয়া মাস্তানদের দেখে নিতে পারি আমরা। কিন্তু এখন ওসব করা ঠিক হবে না।
কেন ঠিক হবে না?
সেতু যদি ঠিক থাকে, দুদিন আগে পরে ওর ভাইরা ব্যাপারটা মেনে নিতে বাধ্য হবেন। তখন এইসব অপকর্মের জন্য লজ্জা পেতে হবে।
লজ্জা আমি একা পাব কেন? ওরাও তো পাবে! আমার সবচে’ বড় ভয় ছিল আমার মা, মা সব মেনে নিয়েছেন। এখন আমার কোনও ভয় নেই। তার চে’ এক কাজ করি…
কী?
সরাসরি সেতুদের বাড়ি চলে যাই। সেতুকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি।
সেতু যদি এভাবে না আসে?
শুভ একটু থতমত খেল। তোর মনে হয় আসবে না?
নাহিদ চিন্তিত গলায় বলল, নাও আসতে পারে। আমার ধারণা ইচ্ছে করে সময় নিচ্ছে সেতু। ভাইদের রাগ কমে এলে সবাইকে ম্যানেজ করে তোর সংসারে আসবে সে। বেশির ভাগ মেয়ে কিন্তু তাই করে।
শুভ অস্থির গলায় বলল, তাহলে আমাকে তুই কী করতে বলিস?
তুই একটা কাজ কর, আমার সঙ্গে আমাদের গ্রামের বাড়িতে চল।
কী বললি?
আগে কথাটা শোন। যতদিন এদিককার পরিস্থিতি ঠিক না হয় ততদিন আমাদের ওখানে থাকলি। ঠিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এলি?
শুভ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, যেতে পারি কিন্তু তোদের বাড়ির কাউকে এসব কথা বলতে পারবি না।
নাহিদ হাসল। বলব না।
কিন্তু যাওয়ার আগে একটা কাজ করে যেতে চাই।
কী?
গভীর রাতে সেতুদের বাড়ির সামনে গিয়ে বিশাল করে ওদের দেয়ালে লিখে দিয়ে যাই, শুভ + সেতু।
নাহিদ হাসল। তুই একেবারে পাগল হয়ে গেছিস।
.
সব শুনে শাহিন বলল, আমি মনে করি এটাই সবচে ভাল সিদ্ধান্ত।
রাতেরবেলা শুভদের ড্রয়িংরুমে একত্রিত হয়েছে সবাই। মা শাহিন সুরমা মালা শুভ . এবং নাহিদ। সেই যে এসেছে নাহিদ, এখনও ফিরে যায়নি।
কথা শুরু করেছিল নাহিদই। তার কথার রেশ ধরেই কথা বলল শাহিন। তারপর মায়ের দিকে তাকাল। তুমি কী বল মা?
মা গম্ভীর গলায় বললেন, তোরা যা ভাল বুঝিস তাই কর।
সুরমা বলল, শুভ চলেই যাক।
মালা চিন্তিত গলায় বলল, এদিকে সেতুর যদি কোনও অসুবিধা হয়?
নাহিদ বলল, তা মনে হয় হবে না। শুভকে বাড়িতে রেখে আমি মাঝে মাঝে এসে খবর নেব।
শুভ কোনও কথা বলছিল না। মুখটা পাথরের মতো হয়ে আছে তার।
তারপর থেকে একটা রাত গেছে, একটা প্রায় পুরোদিন, মুখের ভাবটা বদলায়নি শুভর। ট্রেনে সারাক্ষণই চুপচাপ ছিল। নাহিদ টুকটাক কথা বলার চেষ্টা করেছে, সেসব কথার হু হ্যাঁ না ছাড়া তেমন কোনও জবাব দেয়নি।
নাহিদদের বাড়িতে পৌঁছেও চুপচাপই আছে শুভ।
যে ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছে তাকে সেই ঘরে খাটের এককোণে উদাস হয়ে বসে আছে এখন। পাশে ব্যাগটা। নাহিদ গেছে তার মা বাবার সঙ্গে দেখা করতে।
এসময় বর্ষা এসে দাঁড়াল দরজার সামনে।
বর্ষাকে দেখে গত চব্বিশ ঘণ্টায় এই প্রথম পুরো একটা বাক্য বলল শুভ। কেমন আছ, বর্ষা?
বর্ষা কথা বলল না। অপলক চোখে শুভর দিকে তাকিয়ে রইল।
শুভ বলল, তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ?
বর্ষা কথা বলল না, মাথা দোলাল।
এবার একটু উফুল্ল হল শুভ। কী মনে করে বলল, তোমার কথা ভেবে তোমাদের এখানে চলে এলাম।
বর্ষা উদাস গলায় বলল, কেন?
শুভ একটু থতমত খেল। না মানে নাহিদ, আমি আমরা সবাই থাকলে তোমার মনটা হয়তো ভাল থাকবে।
তারপর একটু থেমে বলল, অনেকদিন থাকব তোমাদের এখানে।
একথায় মুখটা কেমন উজ্জ্বল হল বর্ষার। সত্যি?
সত্যি।
ধীর, শান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে বর্ষা তারপর শুভর সামনে এসে দাঁড়াল। সত্যি আপনি অনেকদিন থাকবেন আমাদের এখানে?
শুভ হাসল। তোমার সঙ্গে আমি মিথ্যে বলছি না। সত্যি অনেকদিন থাকব তোমাদের এখানে।
সঙ্গে সঙ্গে ডানহাতটা শুভর দিকে বাড়িয়ে দিল বর্ষা। শুভর চোখের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য রকমের সরল গলায় বলল, আমাকে ছুঁয়ে বলুন।
শুভ একটু থতমত খেল। একটু দ্বিধাও হল তার।
বর্ষার হাতটা ধরল শুভ।