সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পরেছে শুভ।
ঘি রংয়ের চমৎকার কাজ করা। সকালবেলা সেভ করে, গোসল করেছে, চুলে শ্যাম্পু করেছে। ফ্যানের হাওয়ায় সেই চুল এখন ফুরফুর করে উড়ছে। বেশ পুরুষালি একটা পারফিউমের গন্ধ আসছে শরীর থেকে। সব মিলিয়ে বেশ ভাল লাগছে শুভকে। কিন্তু চোখেমুখে গোপন একটা উৎকণ্ঠা যেন ছায়া ফেলেছে।
নাহিদ আছে সঙ্গে। ক্যামেরায় রিল ভরছিল। শুভ হঠাৎ করে বলল, কত টাকা লাগতে পারে?
বন্ধুর দিকে তাকাল না নাহিদ। নিজের কাজ করতে করতে বলল, কোন ব্যাপারে কত টাকা লাগার কথা বলছিস?
গলা নিচু করে শুভ বলল, তুই বুঝতে পারিসনি? বিয়ে করতে কত টাকা লাগবে?
রিল ভরা শেষ করে শুভর দিকে তাকাল নাহিদ। কী করে বলব? এই ধরনের বিয়েতে আমি কখনও এটেন্ড করিনি।
আমিও তো করিনি।
কিন্তু খোঁজখবর নেয়া উচিত ছিল।
তা কিছুটা নিয়েছি। বেশি টাকার কাবিন হলে নাকি ফি বেড়ে যায়। ভাবছি খুব কম টাকার কাবিন করব। আজকাল নাকি মাত্র এক টাকার কাবিন করে কেউ কেউ।
যার যা ইচ্ছে করুক। তুই এখন এসব নিয়ে ভাবছিস কেন? বুঝতে পারিসনি কেন ভাবছি?
না।
টাকা পয়সা তেমন নেই আমার কাছে। তিনচার জায়গা থেকে অতিকষ্টে হাজার পাঁচেক টাকা জোগাড় করেছি। পুরোটাই ধার। এতে না হলে মার্ডার হয়ে যাব। সেতুর সামনে প্রেস্টিজ থাকবে না।
নাহিদ যেন একটু বিরক্ত হল। ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে বলল, এভাবে টাকা পয়সা ধার করতে যাওয়া ঠিক হয়নি।
শুভ অসহায় গলায় বলল, তাহলে কীভাবে করব? সেতুকে বলব বিয়ের টাকা নিয়ে এস, আমার কাছে টাকা নেই।
না তা আমি বলিনি। তুই আসলে ভুলে গেছিস যে আমি তোর সঙ্গে আছি।
শুভর কাঁধে হাত দিল নাহিদ। আমি সঙ্গে থাকলে কোনও ব্যাপারেই তুই কখনও ভাববি না। আমার কাছে টাকা আছে, টাকা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।
এ কথায় গভীর আবেগে বুক ভরে গেল শুভর। চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। তুই যখন এভাবে কথা বলিস, ক্রাইসিসের সময় আমার পাশে দাঁড়াস, ভরসা দিস, আমি ঠিক বুঝতে পারি না তখন আমার কী করা উচিত! কী বলা উচিত তোকে!
নাহিদ মৃদু হাসল। কিছু বলার দরকার নেই।
আসলে আমি কিছু বলতে পারি না। আমার শুধু কান্না পায়।
অন্যদিকে মুখ ঘোরাল শুভ। এখনও পাচ্ছে।
আবার শুভর কাঁধে হাত দিল নাহিদ। এত ইমোশনাল হওয়ার কিছু নেই। চল।
মাকে ভাবীকে একটু সালাম করে আসব? এতবড় একটা কাজ করতে যাচ্ছি!
না যাওয়াই ভাল। ঝামেলা হতে পারে। পাঞ্জাবি টাঞ্জাবি পরে হঠাৎ করে মুরব্বিদেরকে সালাম করছিস, খালাম্মা নানা রকমের প্রশ্ন করতে পারেন।
ঠিকই বলেছিস। চল।
.
শুভর বুকে, গলার কাছে হাত বুলাতে বুলাতে সেতু বলল, কাজি অফিসে নাহিদ ভাই যখন তোমার আমার ছবি তুলছিল, আমার যে কী ভাল লাগছিল!
শুভ কথা বলল না।
বিয়ে শেষ করে খানিক আগে দোলনদের বাড়িতে ফিরেছে ওরা। কাজি অফিস থেকে বেরিয়েই চলে গিয়েছিল নাহিদ। উত্তরায় কী যেন কাজ আছে। নতুন বউ নিয়ে তারপর স্কুটারে চড়ে দোলনদের বাড়ি এসেছে শুভ। সঙ্গে অবশ্য দোলনও ছিল। বাড়ি এসেই দোলন চলে গেছে তার রুমে। সেতু শুভকে রেখে গেছে ড্রয়িংরুমে। সেই রুমের লম্বা সোফায় সেতুর কোলে মাথা দিয়ে এখন শুয়ে আছে শুভ।
কিন্তু আনমনা হয়ে আছে কেন? সেতু কথা বলল সে কোনও সাড়াই দিল না।
সেতু বলল, কী ভাবছ তুমি?
শুভ বলল, কিছু না।
তাহলে আনমনা হয়ে আছ কেন?
এভাবে বিয়ে করে ফেললাম, কেমন যেন লাগছে।
কথাটা শুনে মন খারাপ হলো সেতুর। তুমি শুধু তোমার দিকটা ভাবছ!
না শুধু আমার দিকটা ভাবব কেন? তোমার দিকটাও ভাবছি।
কথা বলতে বলতে উঠে বসল শুভ। আমি জানি আমার চে তোমার সমস্যা হবে অনেক বেশি, অনেক কিছু ফেস করতে হবে তোমাকে।
তারপরও সামলানো যে কী কঠিন হবে, আমি ছাড়া কেউ তা বুঝতে পারবে না।
তোমার ভাইরা খুব দুঃখ পাবেন। আমার মা ভাই এবং বোনটিও দুঃখ পাবে। খুশি হবেন শুধু ভাবী।
সেতুর একটা হাত ধরল শুভ। আমাদের ফ্যামিলির দুঃখ পাওয়ার কারণ কিন্তু তুমি না। তোমাকে সবাই খুব পছন্দ করবে, গোপনে বিয়ে করাটা পছন্দ করবে না।
সেতু ম্লান হাসল। তা কেউ করেও না। ছেলেমেয়ে কিংবা ভাইবোনের সুন্দর, স্বাভাবিক বিয়েই পছন্দ করে সবাই।
এজন্য প্রেম করাটাই ঠিক না। আর করলেও দুপক্ষ যাতে মেনে নেয় সেভাবে করা উচিত।
একথায় বিরক্ত হল সেতু। তোমার এই ধরনের কথা শুনলে আমার খুব রাগ হয়। এতকিছু ভেবে প্রেম করতে পারে কেউ? নাকি সব বুঝে শুনে অংক কষে প্রেম করে লোকে!
তারপর উদাস এবং দুঃখি হল। জানি সামনে অনেক সমস্যা, এই সুন্দর সময়টা সেই সমস্যার কথা ভেবে নষ্ট করছি আমরা। অথচ বিয়ের দিনটা সবচে আনন্দের দিন প্রেমিক প্রেমিকার।
কথা বলতে বলতে গলা ধরে এল সেতুর। চোখ ভরে এল জলে। মনে হয় তোমার জন্য অনেক কাঁদতে হবে আমাকে।
সঙ্গে সঙ্গে শুভ কী রকম বদলে গেল। গভীর মমতায় দুহাতে তুলে ধরল সেতুর মুখখানি। এভাবে বলো না। আমি তোমাকে কখনও কাঁদতে দেব না, কখনও দুঃখ দেব না। তুমি যা বলবে তাই শুনব। তোমার জন্য দরকার হলে জীবন দিয়ে দেব।
চোখ মুছে সেতু বলল, না তা তুমি করবে না। যাকে পাওয়ার জন্য সমগ্র পৃথিবীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি আমি, বেঁচে থাকতে তাকে আমি কখনও হারাব না।
সেতুর কথা শুনে এত ভাল লাগল শুভর, পাগলের মতো কাছে টানল সেতুকে, দুহাতে চেপে ধরল বুকে।
শুভর বুকে মুখ রেখে খানিক স্থির হয়ে রইল সেতু। তারপর মুখ তুলে শুভর গলার কাছে চুমু খেতে খেতে বলল, আদর কর, আমাকে তুমি খুব আদর কর। যত পার আদর আমাকে তুমি কর।
.
আজ সকাল থেকে মালা খুব ব্যস্ত।
সে একটু আয়েশি ধরনের মেয়ে। স্বামীকে চিঠি লেখা এবং স্বামীর ফোন পেলে পাগলের মতো ছুটে গিয়ে ফোন ধরা ছাড়া অন্য যে কোনও কাজে অপরিসীম আলস্য তার।
আজ সেই আলস্য একদমই দেখা যাচ্ছে না।
সাড়ে আটটা নটার আগে মালা কখনও ঘুম থেকে ওঠে না। আজ উঠেছে পৌনে সাতটার দিকে। উঠেই ছুটোছুটি শুরু করেছে।
এই বাড়িতে সবার আগে ঘুম ভাঙে মায়ের। ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে। ঘুম ভাঙার পর এক মিনিটও বিছানায় থাকেন না তিনি। উঠে অজু করে নামাজ পড়েন। তারপর সংসারের কাজ শুরু করেন। শরীরে আলস্য বলে কিছুই যেন নেই তাঁর। তাঁকে কেউ কখনও বসে থাকতে দেখে না। সারাক্ষণই এটা করছেন, ওটা করছেন। মায়ের জন্য বাধা কাজের বুয়া রাখা যায় না বাড়িতে। একজন ছুটা বুয়া আছে। সকালবেলা এসে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে সে। তারপর চলে যায়। মধ্যবয়সী বুয়াটির কাজ হচ্ছে সব রকমের ধোয়া মোছা এবং মশলা বাটা। মেশিনে গুঁড়ো করা মশলা একেবারেই পছন্দ করেন না মা। গুড়ো মশলায় রান্না করা তরকারি মুখে দিতে পারেন না।
আর বুয়াদের হাতের রান্না?
প্রশ্নই ওঠে না। মরে গেলেও ওসব রান্না মুখে দেবেন না তিনি।
সারাক্ষণ কাজের মধ্যে আছেন বলেই বোধহয় এখনও ভাল আছেন তিনি। শরীরে মেদ জমেনি, অসুখ বিসুখে ধরেনি। বয়স হল চৌষট্টি, পয়ষট্টি। এগারো বছর আগে বিধবা হয়েছেন, তবু যেন কোনও রকমের মালিন্য স্পর্শ করেনি তাঁকে। গায়ের রং টকটকে ফর্সা, তীক্ষ্ণ নাক, বয়সের তুলনায় সামান্যই পেকেছে চুল, চোখে চশমা আছে কিন্তু বয়সের তুলনায় পাওয়ার তেমন নয় চশমার। মুখটা রাগি ধরনের, এই রাগি মুখ নিয়ে এখনও বেশ সুন্দর তিনি। কম বয়সে তিনি যে বেশ রূপবতি ছিলেন বোঝা যায়।
আজ অত সকালে মালাকে উঠতে দেখে, ব্যস্ত হতে দেখে যা বোঝার বুঝে গেছেন তিনি কিন্তু ওই নিয়ে কোনও কথা বলেননি।
বললেন এখন।
ডাইনিং টেবিলে অনেকগুলো প্লেট গ্লাস, কাপ পিরিচ পেয়ালা জগ। মালা নিজ হাতে গরম পানি দিয়ে ভাল করে ধুয়েছে। এখন মা মেয়ে দুজনে মিলে সেগুলো গুছিয়ে রাখছে। কাজটা করতে করতে থমথমে গলায় মা বললেন, তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজনের এভাবে আসার দরকারটা কী?
শ্বশুরবাড়ি শব্দটা শুনলেই লাজুক একটা ভঙ্গি করে মালা। সেই ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে বলল, আমাকে নাকি অনেকদিন দেখে না। বলল, দেখতে আসবে।
শুনে মা বেশ রাগলেন। এতই যখন আল্লাদ, তোকে তাদের বাড়িতে নিয়ে রাখে না কেন? ছেলে বিদেশে আছে তো কী হয়েছে?
মালা গাল ফুলাল। সব সময় এমন করে বলো না মা, ভাল লাগে না।
উচিত কথা কারওই ভাল লাগে না। এতগুলো মানুষ আসবে তাদের পেছনে একটা খরচা আছে না! টাকাটা আসে কোত্থেকে?
যত খরচ হয়, হিসেব করে টাকাটা আমার কাছ থেকে নিয়ে নিও।
চুপ কর, বড় কথা বলবি না।
এ সময় শুভ এসে বাড়ি ঢুকল। কোথায় ছিল কে জানে। মুখটা বিষণ্ণ হয়ে আছে, চোখে উদাসীনতা। কোনওদিকে না তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে, মা শুভর দিকে তাকালেন। আজ আর বাড়ি থেকে বেরুবি না। গেস্ট আসবে।
চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকাল শুভ। কোনও কথা বলল না, নিজের রুমের দিকে চলে গেল। শুভর এই আচরণে মা যেন খুবই বিরক্ত হলেন। নিজেকে নিজে বলার মতো করে বললেন, পাগলা গারদের মধ্যে আছি। একেকটা হয়েছে একেক রকম।
.
অফিস থেকে সরাসরি বাড়ির কিচেনে আজকের আগে কখনও আসেনি শাহিন।
সুরমা ব্যস্ত রান্নাবান্না নিয়ে। গরমে ঘামে একসা অবস্থা তার। বোধহয় এই কারণেই স্বামীর এভাবে রান্নাঘরে আসাটা খুব একটা গুরুত্ব দিল না সে।
কিন্তু স্ত্রীর কাহিল অবস্থাটা গুরুত্ব দিল শাহিন। চিন্তিত গলায় বলল, রান্নাবান্না করতে পারে এমন একটা কাজের বুয়া রাখা দরকার।
কথাটা শুনে সুরমা যেন অবাক হল। কেন, বুয়া তো আছেই।
শাহিনও অবাক হল। কোথায় বুয়া?
এই যে!
নিজেকে দেখাল সুরমা।
শাহিন লজ্জা পেল। এভাবে বলল না। আমাকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ? সংসারে একেকজন মানুষ একেকরকম হয়। আমার মা একটু অন্যরকম, একটু মেজাজি…!
শাহিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই হাসল সুরমা। এত কাতর হওয়ার কিছু নেই। আমি এভাবেই বলেছি। তুমি এখান থেকে যাও। মা দেখলে বিপদ হবে।
কীসের বিপদ?
বলবেন, অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসে, কিচেনে দাঁড়িয়ে বউর সঙ্গে গল্প করছে।
কিন্তু আমি তো এসেছি মালার শ্বশুরবাড়ি থেকে গেস্ট আসবে বলে! রান্নাবান্না কী হচ্ছে সেসবের খোঁজখবর নিচ্ছি। ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি।
কিচেন থেকে বেরিয়ে শুভর রুমে এল শাহিন। কী করছিস?
সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে শুয়েছিল শুভ। শাহিনকে দেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে বসল। ভাইয়া, তুমি আমার রুমে?
শাহিন হাসল। এমনভাবে বললি, যেন জীবনে কোনওদিন তোর রুমে আসিনি?
তবে এসে খুব ভাল করেছ। তোমার সঙ্গে জরুরী আলাপ আছে।
শুভর পড়ার চেয়ারটায় বসল শাহিন। আমাকে দেখে আলাপের কথা মনে হল?
আরে না! অনেকদিন ধরেই ভাবছি আলাপটা করব।
করিসনি কেন?
সময় পাইনি।
শাহিন ঠাট্টার সুরে বলল, হ্যাঁ তুই তো খুবই ব্যস্ত। আপন বড়ভাই জ্বরে বেহুশ হয়ে থাকে, এক বাড়িতে থেকেও তুই তাকে দেখতে যাওয়ার সময় পাস না।
শুভ লজ্জা পেল। এটা সত্যি আমার খুব অন্যায় হয়েছে।
তারপর বিছানায় বসেই ডানদিককার কান শাহিনের দিকে এগিয়ে দিল। তুমি আমার কানটা মুচড়ে দাও ভাইয়া।
শুভর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিল শাহিন। আরে যাহ পাগলা!
তারপর বলল, কিন্তু কী নিয়ে ব্যস্ত তুই?
ব্যস্ত মানে নানা রকমের ঝামেলা যাচ্ছে আর কী! যেটা তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চাইলাম ভাইয়া, আমাকে একটা চাকরি বাকরির ব্যবস্থা করে দাও। চাকরির খুব দরকার।
তীক্ষ্ণচোখে শুভর মুখের দিকে তাকাল শাহিন। তোর তো এখনও রেজাল্ট বেরয়নি, এখুনি কীসের চাকরি!
একপলক শাহিনের দিকে তাকিয়ে কথা ঘোরাল শুভ। বেকার ছেলে মা একদম দেখতে পারে না। প্রায়ই কথা শোনায়। তাছাড়া নিজের একটা হাত খরচের ব্যাপার। আছে। তোমাদের কাছ থেকে কত নেব?
শাহিন উদাস গলায় বলল, ঠিক আছে, দেখি।
এই বিষয়টা রাতেরবেলা সুরমাকে বলল শাহিন।
মালার শ্বশুরবাড়ির লোকজন চলে যাওয়ার পর, সবকিছু গোছগাছ করে, রাত এগারোটার দিকে নিজের রুমের ড্রেসিংটেবিলে বসেছে সুরমা। ঘুমোবার আগে অনেকক্ষণ ধরে মাথা আঁচড়াবার অভ্যেস তার। এখন সেই কাজটা করছে। বিছানায়। আধশোয়া হয়েছিল শাহিন। শুভর কথা মাত্র বলতে যাবে তার আগেই সুরমা বলল, মালার শ্বশুরবাড়ির লোকজনগুলো যেন কেমন?
শুনে শুভর প্রসঙ্গ ভুলে গেল শাহিন। মানে?
আমাদের বাড়িতে এসে মালাকে নিয়ে আদিখ্যেতার সীমা পরিসীমা নেই, কিন্তু একবারও বলল না তুমি গিয়ে আমাদের বাড়িতে কদিন থেকে এসো। ছেলে বিদেশে থাকলে ছেলের বউকে বাড়িতে নিয়ে রাখে না লোকে, নাকি সবসময় বাপের বাড়িতেই ফেলে রাখে!
এসব নিয়ে ভেব না। মালার শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের ব্যাপারে আমার তেমন কোনও আগ্রহ নেই। ওর বরটা ভাল তাতেই আমি খুশি।
তারপর শুভর কথা মনে পড়ল শাহিনের। বিছানায় উঠে বসল সে। শোন, অন্য একটা বিষয়ে কথা বলি। শুভর ব্যাপারটা কী?
সুরমা চমকাল। কেন, কী হয়েছে?
খুবই চিন্তিত মনে হল। চাকরি বাকরি করতে চাইছে।
তাই নাকি! হঠাৎ এমন সুমতি?
সুমতি না অন্যকিছু সেটাই ভাবছি।
অন্যকিছু মানে?
এই মানেটাই বের করতে চাইছি। আচ্ছা, শুভর কি কোনও মেয়ের সঙ্গে ভাবটাব আছে? ব্যাপারটা এমন নয়তো যে সেই মেয়েটি বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে করতে হবে এজন্য চাকরি বাকরি দরকার।
ভেতরে ভেতরে ব্ৰিত হল সুরমা কিন্তু শাহিনকে বুঝতে দিল না কিছুই। মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে নির্বিকার গলায় বলল, আমি কী করে বলব?
তোমার কাছে সে কিছু লুকায় না।
কিন্তু এসব কখনও বলেনি।
জানার একটু চেষ্টা করো তো?
পরদিন সকালেই জানার চেষ্টাটা করল সুরমা।
এককাপ চা হাতে শুভর রুমে এসে ঢুকল সে। শুভ বেরুচ্ছিল সেতুর সঙ্গে দেখা করতে। সুরমাকে দেখে নয়, তার হাতে চায়ের কাপ দেখে উৎফুল্ল হল। কাপটা নিয়ে ফুরুক করে চুমুক দিয়ে বলল, তোমার নামের মধ্যে ‘মা’ শব্দটা আছে, সুরমা, তোমাকে আমার মা বলেই ডাকা উচিত। তুমি আমার জন্য যা কর, যেভাবে ফিল কর আমাকে, মা ছাড়া এভাবে কেউ কাউকে ফিল করে না।
মুখের সুন্দর একটা ভঙ্গি করে সুরমা বলল, হঠাৎ এমন আল্লাদের কারণ কী? মানে এত আল্লাদী কথা কেন বলছিস?
এই যে তুমি আমার জন্য চা নিয়ে এলে এজন্য। তুমি ছাড়া কারোরই বোঝার কথা নয় যে এই মুহূর্তে আমার এককাপ চায়ের দরকার।
সেতুর বোঝার কথা।
শুভ একটু থতমত খেল। হ্যাঁ সেও হয়তো বুঝবে।
তারপর উদাস হল।
ব্যাপারটা খেয়াল করে সুরমা বলল, সেতুর কথা বলতেই যেন চিন্তিত হয়ে গেলি?
নিজেকে সামলাল শুভ। না মানে, ভাবী, আমি আসলে ভেতরে ভেতরে খুবই অস্থির হয়ে আছি। এমন একটা ব্যাপার, কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। কিন্তু ব্যাপারটা। কারও সঙ্গে শেয়ার করা উচিত।
কী হয়েছে?
তোমাকে আগেই বলা উচিত ছিল। কেন যে বলা হয়নি!
এত ভনিতা করছিস কেন? বলতে হলে এখনও বলা যায়।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলের ওপর রাখল শুভ। মাথা নিচু করে বলল, সেতুর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
শুনে আপাদমস্তক কেঁপে উঠল সুরমা। কী?
আমাদের কোনও উপায় ছিল না।
দুহাতে সুরমার একটা হাত ধরল শুভ। তোমাকে না বললে অন্যায় হতো। ভাবী, আপাতত তুমি ছাড়া কথাটা যেন আর কেউ না জানে!
শুভর চোখের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় সুরমা বলল, এটা কি ঠিক হল?
আমি এভাবে চাইনি। সেতুর কারণে বাধ্য হয়েছি।
কিন্তু সামলাবি কীভাবে?
জানি না। তবে তিনটি ভরসা আছে আমার। তুমি নাহিদ আর সেতু।
.
সব শুনে সেতু বলল, তুমি অন্তত একজনকে বলে ফেলেছ, আমি তো পারছি না।
অবাক হয়ে সেতুর মুখের দিকে তাকাল শুভ। এখনও কাউকে বলনি?
না। ভয় করছে, খুব ভয় করছে। বলার সঙ্গে সঙ্গে যে কী হবে বাড়িতে কিছুই বুঝতে পারছি না। ভাই ভাবীরা কে কীভাবে রিয়্যাক্ট করবে, তাদের রিয়্যাকসানে আমি কী করব কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।
কিন্তু জানানো দরকার। এনগেজম্যান্টের ডেট এসে গেল, এখনও যদি না জানাও পরে কিন্তু অন্য ধরনের কেলেংকারি হয়ে যাবে।
আর একটা ব্যাপারেও খুব ভয় পাচ্ছি।
কী?
জানাজানি হওয়ার পর যদি বাড়ি থেকে বেরুনো বন্ধ হয়ে যায়, মানে বাড়ি থেকে যদি আমাকে আর বেরুতে না দেয়, তোমার সঙ্গে যদি দেখা করতে না পারি!
হ্যাঁ, এমনও হতে পারে। তবে এখন যে কোনও পরিস্থিতি ফেস করার জন্য রেডি থাকতে হবে।
কিন্তু আমার খুব ভয় করছে।
সেতুকে বুকের কাছে টেনে আনল শুভ। ভয় পাবে না, একদম ভয় পাবে না। আমি আছি। এখন তুমি আমার বউ, বিয়ে করা বউ। আমি বেঁচে থাকতে আমার কাছ থেকে কেউ তোমাকে সরিয়ে রাখতে পারবে না। তোমার জন্য পৃথিবীর যে কোনও দেয়াল আমি ভেঙে ফেলব।
শুভর গলার কাছে আদুরে ভঙ্গিতে মুখ ঘষে সেতু বলল, তুমি এভাবে বললে খুব ভাল লাগে আমার, খুব সাহস পাই আমি।
শুভ কোনও কথা বলল না। আনমনা হয়ে গেল।
শুভর বুক থেকে মুখ তুলে সেতু বলল, কী হয়েছে? আমার সামনে বসে কার কথা ভাবছ তুমি?
শুভ ম্লান হাসল। তোমার কথা।
আমার কথা ভাববে যখন আমি তোমার সামনে না থাকব তখন, যখন সামনে থাকব তখন তুমি শুধু আমাকে দেখবে, আমার সঙ্গে কথা বলবে আর আমাকে আদর করবে।
সেতুর কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল শুভ। আসলে আমার মনটা খারাপ।
কেন গো?
তোমার জন্য।
কী করেছি আমি?
আমাকে বিয়ে করে খুব বড় ভুল করেছ। আমি এক হতদরিদ্র যুবক, সুখ শান্তি প্রাচুর্য কিছুই তোমাকে আমি দিতে পারব না।
শুভর একগালে হাত বুলিয়ে দিল সেতু আর একগালে চুমু খেল। কীসে আমার সুখ, কীসে আমার শান্তি তা তুমি জান না। কোনও প্রাচুর্য তোমার কাছে আমি চাই না, আমি শুধু একটা জিনিস চাই তোমার কাছে, বল, সারাজীবন ধরে সেই জিনিসটা আমাকে তুমি দেবে?
সাধ্য থাকলে অবশ্যই দেব।
সাধ্য তোমার আছে।
তাহলে বল, বল কী চাও তুমি?
ভালবাসা চাই, সারাজীবন ধরে আমি শুধু তোমার ভালবাসা চাই।
সেতুকে আরও নিবিড় করে আঁকড়ে ধরল শুভ। তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ভালবাসা ছাড়া তোমাকে দেয়ার মতো আর কিছু নেই আমার। সারাজীবন ধরে আমার সবটুকু ভালবাসা আমি শুধু তোমাকেই দেব।
তারপর একটু থেমে বলল, এই, তুমি আমার সঙ্গে একটা জায়গায় যাবে?
সেতু ঘোরলাগা গলায় বলল, তোমার সঙ্গে যে কোনও জায়গায় যেতে রাজি আমি, এমনকি দোযখেও।
দোযখে তোমাকে আমি নেব কেন?
তাহলে কোথায় নেবে?
কক্সবাজার।
হঠাৎ কক্সবাজার কেন?
হানিমুনে। আমরা নবদম্পতি, হানিমুনে যাব না?
ওরকম হানিমুন কি আমাদের কখনও হবে?
কেন হবে না?
যেভাবে বিয়ে হল, আমার ভাইরা এ বিয়ে মেনে নেবে কি না…
সেতুকে থামিয়ে দিল শুভ। থাক, এসব এখন আর বলো না, মন খারাপ হয়ে যাবে। তারচে’ অন্যকথা বল।
শুভর বুকে আঙুল বোলাতে বোলাতে সেতু বলল, আমার এক সময় স্বপ্ন ছিল আমি হানিমুনে যাব কাশ্মিরে। শ্রীনগরের ডাললেকে সিকারায় থাকব অনেকগুলো দিন।
সিকারা মানে?
এক ধরনের নৌকো। নবদম্পতি কিংবা প্রেমিক প্রেমিকারা থাকে।
শুভ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সাধ্য থাকলে এক্ষুণি তোমাকে আমি সেখানে নিয়ে যেতাম।
তারপর একেবারেই অন্যমানুষ হয়ে গেল শুভ। চটপটে গলায় বলল, চল, শ্রীনগরে নিয়ে যাই তোমাকে, এক্ষুণি নিয়ে যাই। ডাললেকের সিকারায় বসে একজন ধরে রাখি আরেকজনের হাত, একজন তাকিয়ে থাকি আরেকজনের চোখে মুখে কোনও কথা থাকবে না আমাদের, সব কথা হবে চুমোয় চুমোয়, নিঃশব্দে।
সেতু হাসল। কিন্তু তুমি আমাকে নেবে কীভাবে?
শুভ একমুহূর্তও দেরি করল না। বলল, কল্পনায়, কল্পনায় নিয়ে যাব। আমার বুকে মুখ রেখে চোখ বুজে তুমি কল্পনা কর, দেখবে দোলনদের ড্রয়িংরুমটাই ডালকের ভাসমান সিকারা হয়ে গেছে। ভালবাসা থাকলে সব হয়।
.
মামুন বাড়ি ফিরল সন্ধের পর।
অফিস থেকে ফিরে সে সাধারণত ড্রেসিংরুমে ঢোকে। বাইরের পোশাক বদলে বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে তারপর আসে বেডরুমে।
আজ ড্রেসিংরুমে ঢুকল না। বেডরুমে শিলা আছে, তার সামনে দাঁড়িয়ে টাই আলগা করতে করতে বলল, এনগেজম্যান্টের অনুষ্ঠান শেরাটনে করব। স্বপনকে। পাঠিয়েছি বুকড করতে।
শিলা বলল, এটা কিন্তু একটা বাড়তি খরচ। এসব না করে একবারে বিয়ে দিলেই পারতে। সোনারগাঁওয়ে অনুষ্ঠান করতে আর নয়ত সেনাকুঞ্জে।
খরচ নিয়ে তুমি ভাবছ কেন? আমাদের একমাত্র বোন।
একমাত্র বোন বলে অকারণে সব করতে হবে নাকি?
কোন ফাঁকে দক্ষিণের দেয়ালের সঙ্গে লাগানো সুন্দর এবং অতি আরামদায়ক চেয়ারটায় বসে পড়েছে মামুন। শিলার কথা শুনে একটু নড়েচড়ে উঠল। আক্রমণের গন্ধ পাচ্ছি। তুমি কি কোনও কারণে রেগে আছ? ঝগড়া লাগাবে নাকি?
শিলা কঠিন গলায় বলল, যদি লাগাই?
না না, লাগিয়ো না। আমি আগেই সারেন্ডার করছি। আমি তোমাকে খুবই ভয় পাই। সেদিনের পর থেকে মারাত্মক রকমের সাবধানতা অবলম্বন করে আছি, যাতে কোনওভাবেই বিগড়ে যাওয়ার চান্স না পাও তুমি। ইয়ে, গহনা বানাবে বলেছিলে, কালই যাও, অর্ডার দিয়ে এস।
অর্ডার দেয়া হয়ে গেছে। দুএকদিনের মধ্যেই নিয়ে আসব। টাকাটা দিয়ে দিও।
কত, কত টাকা? ক্যাশ না চেক?
বিলটা আমার কাছে আছে। একলাখ বাহাত্তোর হাজার। তবে ক্যাশ টাকা নিয়ে আমি মুভ করব না। চারদিকে যা ছিনতাই ফিনতাই হচ্ছে!
খুবই সরল মুখ করে মামুন বলল, ফিনতাইটা কী?
মামুনের মুখভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল শিলা। ফাজলামো করো না।
মামুন বিগলিত হল। করার আর দরকার হবে না। এই যে তুমি একবার হাসলে, মামার কাজ শেষ। শোন, আমাদের প্রপার্টির এক অংশ সেতুরও। সব মিলে দুআড়াই কোটি টাকা সে পাবে। দরকার হলে ওর টাকা থেকে ওর বিয়ের খরচা করব।
গ্রীবা বাঁকিয়ে মামুনের দিকে তাকাল শিলা। কথাটা কি তুমি আমাকে খুশি করার জন্য বললে?
মামুন বিব্রত হল। না, তা কেন বলব!
ভাবতে পার, আমি তোমার স্ত্রী, বোনের বিয়েতে তোমার টাকা থেকে বিশাল একটা এমাউন্ট খরচা হয়ে যাবে ভেবে রেগে আছি আমি কিংবা রেগে যেতে পারি এজন্য আমাকে ম্যানেজ করছ এ ধরনের কথা বলে! যদি এরকম ভেবে থাক, ভাবনাটা তোমার ঠিক না। এভারেজ বাঙালি বউদের মতো লোভি মহিলা আমি নই। যা বললে তা কক্ষনো করবে না। তোমাদের কি কোনও অভাব আছে নাকি যে সেতুর প্রাপ্য থেকে ওর বিয়ের খরচা করবে? তোমাদের দুভাইয়ের দায়িত্ব হচ্ছে ছোটবোনকে ভাল পাত্রে বিয়ে দেয়া। বাপ না থাকলে বড়ভাই বাবার মতো। মেয়ে বিয়ে দিয়ে বাবা কখনও বলে না যে তোর প্রাপ্য থেকে তোকে বিয়ে দিলাম।
শিলার কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেল মামুন। চেয়ার ছেড়ে উঠে এল সে, শিলার সামনে দাঁড়াল। খুব ভাল লাগল তোমার কথা শুনে। তুমি যাতে এই কথাগুলোই বল, শোনার জন্য চালাকি করে সেতুর প্রাপ্য টাকার প্রসঙ্গটা তুলোম। সত্যিকার অর্থে কখনও আমি তা করব না। স্বপনকেও করতে দেব না। আমাদের টাকায়ই বিয়ে দেব সেতুকে। তারপর ও যখন ওর প্রাপ্য চাইবে হিসেব করে পাই টু পাই ওরটা ওকে দিয়ে দেব।
তারপর স্ত্রীর কাঁধে হাত দিল মামুন। তুমি একটু নিচু হও।
শিলা অবাক হল। কেন?
দেখছ না সঙ্গে জলচৌকিটা নেই।
স্বামীর হাত সরিয়ে ছিটকে গেল শিলা। এই, খবরদার! ফাজলামো করো না।
মামুন হো হো করে হাসতে লাগল।
.
রেখা টিভি দেখছে।
বেডরুমে ঢুকে রেখার দিকে না তাকিয়ে টিভির দিকে তাকাল স্বপন। টিভিটা অফ
রিমোট টিপে টিভি অফ করল রেখা। ভাইয়া কী বললেন?
খুশি হলেন। চট করে শেরাটন ম্যানেজ করে ফেলব, ভাবেননি।
মন খারাপ করা ভঙ্গিতে বিছানায় শুয়ে পড়ল স্বপন।
ব্যাপারটা খেয়াল করে রেখা বলল, তোমাকে কী রকম যেন দেখাচ্ছে। মন খারাপ?
স্বপন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেতুর এনগেজম্যান্টের দিন ঘনিয়ে আসছে আর মন খারাপ হচ্ছে আমার।
ছোটবোনের বিয়ের সময় এমনই লাগে। বিশেষ করে মা বাবা না থাকলে। আমার বিয়ের দিন দেখনি ভাইয়ারা কী রকম কান্নাকাটি করল!
বোন যখন বাড়ি থেকে চলে যায় তখন কান্না পাবেই। আমার তো এখনই পাচ্ছে।
রেখা আচমকা বলল, একটু কাঁদ না!
স্বপন অবাক হল। কী?
তোমাকে আমি কখনও কাঁদতে দেখিনি। নিজের স্বামীকে কাঁদতে দেখলে কেমন লাগে, এই অভিজ্ঞতাটা থাকা দরকার।
স্বপন হাসল। ফাজলামো করো না।
রেখাও হাসল। তোমার মন ভাল করার জন্য করলাম।
তা আমি বুঝেছি।
তবে অভিজ্ঞতাটা আমার সত্যি থাকা দরকার।
সেতুর বিয়ের দিন হয়ে যাবে।
স্বপন এবং রেখা যখন এসব কথা বলছে তখন বাবলুর রুমে এসে ঢুকেছে মুন্নি। সোফায় শুয়ে সকালবেলার কাগজ রাতেরবেলা পড়ছে বাবলু আর তার রুমের মেঝেতে বসে পাঁচ সাতটা পুতুল নিয়ে মগ্ন হয়ে খেলছে টুপলু।
বিন্দুমাত্র ভনিতা না করে মুন্নি বলল, গেটধরা বোঝ, ভাইয়া?
খবরের কাগজের আড়াল থেকে মুখ বের করল বাবলু। না তো! গেটরা কী?
বিয়ের দিন যখন বর আসে তখন বাড়ির ছেলেমেয়েরা গেট আগলে দাঁড়ায়। বরপক্ষ টাকা না দিলে ঢুকতে দেয়া হয় না, এটাকে বলে গেটধরা।
বুঝেছি, এখন যা, আমি খেলার খবর পড়ছি।
পুতুলকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে টুপলু বলল, আমিও ব্যস্ত। খেলছি।
কিন্তু মুন্নি দমল না। বলল, একেকজন দশহাজার টাকা করে পাব।
বাবলু উৎসাহি হল। কীভাবে?
ফুপির বিয়ের দিন আমরা তিনজনে মিলে গেট ধরব। পঞ্চাশ হাজার টাকা চাইব। যা চাইব তাতো আর দেবে না, কমাবার চেষ্টা করবে। তবে তিরিশ হাজারের কমে কিছুতেই আমরা ছাড়ব না। ওই তিরিশ হাজার তিনজনে ভাগ করব। একেকজনের ভাগে দশহাজার করে।
ভেরিগুড। আমি আছি তোর সঙ্গে। গেট ধরব।
টুপলু বলল, আমিও ধরব কিন্তু টাকা নেব না। টাকা নিলে আম্মু আমাকে বকবে। আমার ভাগের টাকাটাও তোমরা দুজনে নিয়ে নিও।
মুন্নি খুশি হয়ে বলল, তাহলে আমাদের ভাগে পনের হাজার করে পড়বে।
.
তুই কি ঢাকায় নাকি?
নাহিদ বিষণ্ণ গলায় বলল, ছিলাম না, বর্ষাকে নিয়ে কাল এসেছি। বাবা মাও এসেছেন। আজ ওকে একজন ডাক্তার দেখাব তারপর কাল সবাই মিলে আবার ফিরে যাব।
কোথায় উঠেছিস তোরা?
মাঝারি ধরনের একটা হোটেলে।
শুভ অবাক হল। হোটেলে উঠেছিস কেন?
নাহিদ আবার বিষণ্ণ হল। তাহলে কোথায় উঠব! তুই তো জানিসই ঢাকায় আমাদের কোনও আত্মীয়স্বজন নেই।
আত্মীয়স্বজন না থাক, আমি তো আছি, আমাকে জানালি না কেন?
জানালে কী হত?
আমাদের বাড়িতে ওঠার ব্যবস্থা করতাম।
এতগুলো মানুষ নিয়ে একটা বাড়িতে এসে ওঠা যায় না।
বুক পকেট থেকে ছবির খাম বের করল নাহিদ। তোদের বিয়ের ছবিগুলো।
ছবির কথা শুনে যতটা আগ্রহি হওয়ার কথা শুভর তার কিছুই হল না। খামটা সে খুললও না। বিছানার ওপর ফেলে রেখে বলল, কোন হোটেলে উঠেছিস বল, আমি গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা করে আসব।
দরকার নেই। আমরা কখন কোথায় থাকব বলতে পারছি না। তবে কিছুদিনের মধ্যেই আমি আবার ঢাকায় আসব। এসে তোর সঙ্গে দেখা করব।
নাহিদ চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে ছবিগুলো দেখল শুভ। প্রত্যেকটি ছবির দুটো করে প্রিন্ট। বেশ বুদ্ধি করেই দুসেট ছবি করিয়েছে নাহিদ। একটা সেট শুভর কাছে থাকবে আরেকটা সেতুর কাছে।
সেতুর সেটটা তো তাহলে আজই পৌঁছে দিতে হয়। এক্ষুণি যেতে হয় দোলনদের বাড়ি।
এই ভেবে তক্ষুনি বাড়ি থেকে বেরুল শুভ। দোলনদের বাড়ি পৌঁছবার আগে টকটকে লাল, তরতাজা কতগুলো গোলাপ কিনল। ফুলগুলো ব্যান্ড দিয়ে সুন্দর করে বেঁধে দিল দোকানের একজন কর্মচারি। ছবির সঙ্গে এই ফুল পেলে মুগ্ধ হয়ে যাবে সেতু। সেতুর মুগ্ধতার চে মূল্যবান আর কিছুই নেই শুভর কাছে।
কিন্তু ফুল দেখে দোলন একটু ভুল বুঝল। আমার জন্য ফুল এনেছেন?
শুভ হাসল। না।
তাই তো বলি, আপনার তো এত উদার হওয়ার কথা না।
বউর বান্ধবীর সঙ্গে উদার হওয়ার কোনও দরকার আমার নেই। আমি এলাম তোমাকে একটু জ্বালাতে।
ওসব বলে আর লাভ কী! দুজনে মিলে তো অনেকদিন ধরেই জ্বালাচ্ছেন।
এভাবে বললে সারাজীবন জ্বালাব।
না বললেও যে জ্বালাবেন, জানি। অসুবিধা নেই, কী করতে হবে বলুন।
এই খামে আমাদের বিয়ের ছবিগুলো আছে, ছবির সঙ্গে এই ফুল, এসব ওকে একটু পৌঁছে দেবে।
ছবির খাম এবং ফুল হাতে নিল দোলন। ঠিক আছে, এক্ষুনি যাচ্ছি। আর কিছু বলতে হবে?
হ্যাঁ।
কী?
বলবে, আমি ওকে খুব ভালবাসি।
দোলন মিষ্টি করে হাসল। আপনি খুব রোমান্টিক।
কিন্তু দোলনের হাতে ফুল দেখে সেতু খুব অবাক। চোখ ছানাবড়া করে বলল, তুই হঠাৎ ফুল নিয়ে!
দোলন উজ্জ্বল গলায় বলল, বান্ধবীর এনগেজম্যান্ট হচ্ছে, খালি হাতে তার সঙ্গে দেখা করতে আসি কী করে?
সেতু গম্ভীর হল। আমি টেনশানে মরছি আর তুই ফাজলামো করছিস?
টেনশান করে লাভ নেই। আমি চলে যাওয়ার পর পরই বাড়িতে আজ জানিয়ে দিবি।
ফুলগুলো সেতুর হাতে দিয়ে ব্যাগ থেকে ছবির খামটা বের করল দোলন, সেতুর হাতে দিল। তোদের বিয়ের ছবি। কেউ যদি তোর কথা বিশ্বেস না করে তাহলে ছবি দেখিয়ে দিবি। ছবির সঙ্গে ফুলগুলোও তোর বর পাঠিয়েছে, বলেছে, সে তোকে খুব। ভালবাসে।
ভালবাসা শব্দটা শুনে মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল সেতুর।
তারপরও ভাবীদের কাউকে বিয়ের কথাটা জানাতে পারল না সেতু। সারাটা দুপুর ছটফট করল। বিয়ের ছবিগুলো দেখতে দেখতে নানারকমভাবে ভাবল কেমন করে কথাটা ভাবীদেরকে বলা যায়। কোন ভাবিকে বলবে, শিলা না রেখাকে!
রেখা একটু নরম ধরনের। রেখাকে বলতে সুবিধে হবে ভেবে বিকেলের মুখে মুখে রেখার বেডরুমের সামনে এসে দাঁড়াল সেতু। যেমন করেই হোক আজকেই জানাতে হবে। এনগেজমেন্টের চারদিন বাকি। আজ না জানালে অন্য ধরনের সমস্যা হবে। পাত্রপক্ষকে মানা করার ব্যাপার আছে। একেবারেই শেষ সময়ে জানালে কিংবা এনগেজম্যান্টের দিন জানালে সিনেমার মতো ব্যাপার হবে। স্বাভাবিক অবস্থার চে বেশি বিব্রত হবে ভাইয়ারা, স্বাভাবিক অবস্থার চে বেশি রাগবে সেতুর ওপর।
কিন্তু রেখার বেডরুমের কাছে এসেও ভেতরে ঢুকতে পারল না সেতু, নিজের অজান্তেই যেন বসে পড়ল রেখার রুমের সঙ্গের বারান্দায় ফেলে রাখা বেতের চেয়ারগুলোর একটায়। বসে আনমনা হয়ে রইল। বিয়ের তিন চারটে ছবি হাতে ধরা, মূল খাম রেখে অন্য একটা খামে ভরে ছবি কটি নিয়ে এসেছে। একবার ভেবেছিল সবগুলো ছবিই, মানে পুরো খামটা দোলন যেভাবে দিয়ে গেছে ঠিক সেভাবেই দিয়ে আসবে ভাবীদের একজনকে। তারপর ভেবেছে, যদি ছবিগুলো আর ফেরত না পায়! যদি ছিঁড়েটিরে ফেলে দেয় ভাইয়ারা! তারপর যদি শুভর সঙ্গে যোগাযোগের সব পথ বন্ধ করে দেয়, তাহলে একা ঘরে হাজার ইচ্ছে হলেও তো বিয়ের ছবিগুলো দেখতে পাবে না সে!
তুমি এভাবে এখানে বসে আছ?
সেতু চমকে তাকাল। কখন রেখা এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে! সেতুকে এভাবে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হল। সেতু তার দিকে তাকাতে মুখে দুঃশ্চিন্তার ছায়াটাও দেখতে পেল। বলল, কী হয়েছে?
সেতু বিষণ্ণ গলায় বলল, কিছু না।
তোমাকে কী রকম যেন দেখাচ্ছে! শরীর খারাপ, নাকি কিছু ভাবছ?
এই সুযোগটা ইচ্ছে করলেই নিতে পারে সেতু! রেখার কথার রেশ ধরে গড়গড় করে বলে যেতে পারে সব কথা। হাতের খামটা এগিয়ে দিতে পারে রেখার দিকে।
কিন্তু এসবের কিছুই করল না সে। আগের মতোই বিষণ্ণ গলায় বলল, শরীরও খারাপ না, কিছু ভাবছিও না, এমনিতেই বসে আছি।
সঙ্গে সঙ্গে সেতুর মুখোমুখি চেয়ারে বসল রেখা। চা খাবে?
একথায় বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই কিন্তু সেতু খুব বিরক্ত হল। রুক্ষ্ম গলায় বলল, এ সময় চা খাব কেন? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি বাইরের লোক, তোমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি!
রেখা থতমত খেল। ফ্যাল ফ্যাল করে সেতুর মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বলল, আমি আবারও বলছি, কী হয়েছে তোমার?
গলা আগের চেয়েও রুক্ষ্ম হল সেতুর। আমিও আবার বলছি, কিছুই হয়নি আমার।
কদিন পর এত ভালপাত্রের সঙ্গে যে মেয়ের এনগেজম্যান্ট তার মনমেজাজ এ সময় এত তিরিক্ষি হওয়ার কথা নয়।
তাহলে কেমন হওয়ার কথা?
এ সময় সে থাকবে গভীর আনন্দে। মজা করবে, হাসবে।
নাচবে না? ভারতনাট্যম কিংবা কথক?
উঠে হন হন করে নিজের রুমের দিকে চলে গেল সেতু।
রেখা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সেতুর এই ধরনের আচরণ কখনও দেখেনি সে।
.
মামুন অফিসে চলে যাওয়ার পর সুন্দর একটা শাড়ি পরল শিলা।
ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে সাজগোজ করতে লাগল। এক্ষুনি বাড়ি থেকে বেরুবে সে। গহনা আনতে যাবে। এক লাখ বাহাত্তোর হাজার টাকার চেক দিয়ে গেছে মামুন।
জুয়েলারিওয়ালারা এডভান্স ছাড়া অর্ডার নেয় না, শুধু এই বাড়িরটা নেয়। ক্যাটালগ দেখে অর্ডার দিয়ে এলেই হয়। গহনা আনার দিন পুরো পেমেন্ট।
কাল বিকেলে টেলিফোনে খবর নিয়েছে শিলা। গহনা রেডি। আজ আনতে যাবে, এজন্য বেশ আনন্দে আছে সে। গুনগুন করে গানও গাইছিল। সেতুকে দেখে থামল।
হাতের খামটা নাড়তে নাড়তে সেতু বলল, তুমি কি বেরুচ্ছ ভাবি?
শিলা হাসল। হ্যাঁ।
কোথায় যাচ্ছ?
মার্কেটে। ননদের বিয়ে, কত কেনাকাটা করতে হয়! এখন যাচ্ছি গয়না আনতে।
তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
বল।
ভাইয়াদেরকে জানিয়ে দাও, বিয়েটা হবে না।
কথাটা যেন বুঝতে পারল না শিলা। থতমত খেয়ে ড্রেসিংটেবিলের আয়না থেকে মুখ ফেরাল। কী?
গলা একটুও কাঁপল না সেতুর, একটুও নার্ভাস হল না সে, একেবারেই নির্বিকার গলায় বলল, আমার বিয়ে হয়ে গেছে। শুভ নামের একজনের সঙ্গে বহুদিনের এফেয়ার আমার। তাকে আমি বিয়ে করেছি। এই খামে আমাদের বিয়ের ছবি আছে।
খামটা শিলার হাতে দিয়ে যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে নিজের রুমের দিকে চলে গেল সেতু।
এদিকে শিলার তখন সেন্সলেস হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। খামটা ধরে মৃতের মতো দাঁড়িয়ে রইল সে। মার্কেটে যাওয়ার কথা ভুলে গেল, গহনার কথা ভুলে গেল। তারপর একসময় পাগলের মতো ছুটে এল রেখার রুমে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, শুনেছ, শুনেছ কী কাণ্ড হয়েছে?
সব শুনে ধপ করে নিজের বিছানায় বসে পড়ল রেখা। বল কী! সর্বনাশ হয়ে গেছে তো!
আমি কল্পনাই করতে পারিনি। ছবি না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। এই যে ছবি, তুমিও দেখ।
ছবি দেখতে দেখতে চোখ প্রায় ঠিকরে বেরুল রেখার। ও যে ভেতরে ভেতরে এমন, মুখ দেখে একদম বোঝা যায় না। কাল বিকেলে এই খামটা ওর হাতে আমি দেখেছি। বোধহয় তখন থেকেই এসব বলার প্রিপারেশান নিচ্ছিল। আমার সঙ্গে বাজে ব্যবহারও করেছে।
রেখার কথা যেন শুনতেই পেল না শিলা। বলল, আমার যখন বিয়ে হয় তখন ওর দুআড়াই বছর বয়স। দুই ভাইয়ের সঙ্গেই বয়সের বিরাট ব্যবধান। যে বয়সে সন্তান হওয়ার কথা কল্পনা করে না লোকে সেই বয়সে কেমন করে যেন কনসিপ করেছিলেন। আমার শাশুড়ি। এই বাড়িতে এসে আমি যখন ওকে কোলে নিতাম কিংবা মামুন যখন কোলে নিত মনে হতো ও আমাদেরই সন্তান। কোথাও বেড়াতে গেলে ওকে আমরা সঙ্গে নিতাম না, কারণ কেউ বিশ্বাস করত না যে ও আমার ননদ। তারপর আমার চোখের সামনে বড় হল। প্রথমে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল ওকে। তিন বছর পড়ার পর শ্বশুর বললেন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লে যখন সেভেন এইটে উঠবে তখনই বখে যাবে মেয়ে। স্কুল বদলাও। আমি এবং মামুন অনেক বোঝালাম। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লে ছেলেমেয়েরা বখে যায় এসব কথা কে বলেছে! যারা বখার তারা যে কোনও পরিস্থিতিতেই বখতে পারে। তিনি কোনও কথাই শুনলেন না। স্কুল বদলে বাংলা মিডিয়ামে ভর্তি করা হল ওকে। দুটো বছর নষ্ট হল। বয়স অনুযায়ী ওর তো এখন অনার্স কমপ্লিট হওয়ার কথা।
একটু থামল শিলা। তবে বখে সেতু কখনও যায়নি। আমার চোখের সামনে বড় হল। কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হল, খারাপ কিছু ওর মধ্যে কখনও আমি দেখিনি। সেই মেয়ে গোপনে গোপনে এমন কাজ করল! কথা নেই বার্তা নেই আচমকা পুরো ফ্যামিলির মাথায় বাড়ি মেরে বসল!
রেখা অধৈর্যের গলায় বলল, কিন্তু এখন কী হবে? তিনদিন পর এনগেজম্যান্ট, সব রেডি!
আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না, কিছু ভাবতে পারছি না আমি।
একথা শোনার পর সেতুর ভাইদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে। টুপলুর বাবা এমনিতে খুব ভাল, কিন্তু ভীষণ বদরাগি, কী যেন কী করে বসে!
মামুন সাহেবও কম রাগি নয়। দেখে বোঝা যায় না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুব রাগি। এসব শোনার পর তার মাথার ঠিক থাকবে না। সেতু তার জান, তারপরও কিছুতেই এসব সে মেনে নেবে না।
আমার কথা হচ্ছে এতবড় একটা ব্যাপার এতদিন ও কীভাবে চেপে রাখল?
উত্তেজনায় রেখার গলা আরও রুক্ষ্ম এবং কর্কশ হয়ে গেছ। শিলার লক্ষ্মীট্যারা চোখটা গেছে ভাল রকমের ট্যারা হয়ে। সেই চোখ ঘুরিয়ে সে বলল, তুমি না বলেছিলে প্রেম এবং ক্যান্সার চেপে রাখা যায় না, সেতু তো ঠিকই চেপে রেখেছিল!
কোথায় আর চেপে রাখল! বলে তো দিলই! কথা হচ্ছে, প্রেম এবং ক্যান্সার কোনও না কোনও সময় বেরিয়ে আসবেই। বহুদিন চেপে রাখার পর সেতুরটা যেমন বেরিয়ে এল। সব বলে দিল সে।
এই বলাটা আরও কিছুদিন আগে বললে আমাদের খুব উপকার হতো।
কিন্তু এখন কী হবে?
শিলা রেগে গেল। তীক্ষ্ম গলায় বলল, বার বার এক কথা বলো না। কী হবে তার আমি কী জানি?
শিলার একটা হাত ধরল রেখা। কাতর গলায় বলল, রাগ করো না ভাবী। আমার খুব ভয় করছে।
শিলা নরম হল। ভয় আমারও করছে। সংসারে বিরাট ঝামেলা লেগে যাবে। চল, ওর সঙ্গে কথা বলে দেখি।
রেখা উঠল। চল।
ওরা দুজন তারপর সেতুর রুমে এসে ঢুকল।
চিন্তিত মুখে হাতপা গুটিয়ে নিজের বিছানায় বসে আছে সেতু। শিলা এবং রেখাকে দেখে চোখ তুলে তাকাল। তারপর ওরা কিছু বলার আগে নিজেই বেশ অপরাধী গলায় বলল, আমার আর কিছু বলার নেই। যদি কাবিননামা দেখতে চাও, দেখাব।
চাপা ক্রোধের গলায় শিলা বলল, কিন্তু এটা তুমি কেন করলে? তোমার যদি কারও সঙ্গে এফেয়ার থাকে প্রথমে আমাদের দুজনকে তুমি তা বলবে, আমরা তোমার। ভাইদেরকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করব। না পারলে তুমি তোমার ডিসিসান নেবে। এরকমই নিয়ম। তুমি কোনও নিয়মের ধার ধারলে না? আগেই বিয়ে করে ফেললে? তাও এমন সময় যখন অন্য জায়গায় তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এ তুমি কি করলে? এসব জানার পর তোমার ভাইরা কী দুঃখটা পাবে, তুমি ভেবেছ? যে ভাইয়েরা এত ভালবাসে তোমাকে, তুমি যাদের জান, তাদেরকে একরম দুঃখ দেয়ার আগে তুমি একটু ভাবলে না?
রেখা বলল, আমি মনে করি দুঃখের চে’ অপমানটা তাঁদের বেশি। যেখানে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে সেই লোকগুলোকে তারা এখন কী বলবে? কীভাবে মুখ দেখাবে তাদেরকে! কীভাবে সব ম্যানেজ করবে! সবকিছু জানাজানি হলে লোকে আমাদেরকে বলবে কী?
দাঁতে দাঁত চেপে শিলা বলল, আমার নিজের মেয়ে হলে থাপড়ে তোমার দাঁতগুলো আমি ভেঙে ফেলতাম। তারপর,তারপর ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম। তোমার মতো মেয়ের মুখ আমি জীবনে দেখতাম না।
রাগি ভঙ্গিতে চলে যাওয়ার জন্য পা বড়িয়েছে শিলা, থাবা দিয়ে তার একটা হাত ধরল সেতু। চোখের জলে গাল ভেসে যাচ্ছে তার। কাঁদতে কাঁদতে বলল, অন্যায় আমি করে ফেলেছি, নিশ্চয় অনেক বড় অন্যায় আমি করে ফেলেছি। আমার ওপর যদি খুব রাগ হয় তোমার, আমাকে তুমি গালাগাল করো, যত ইচ্ছা গালাগাল করো, দরকার হলে মারো, তারপরও ভাইয়াকে তুমি ম্যানেজ করো।
ঝটকা মেরে সেতুর হাত ছাড়িয়ে দিল শিলা। আমি পারব না। ম্যানেজ করা তো দূরের কথা, তোমাকে নিয়ে তার সঙ্গে আমি কোনও কথাই বলব না। তুমি একটা বাজে মেয়ে।
প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল শিলা। তার পিছু পিছু গেল রেখা।
চোখের জলে ভাসতে ভাসতে সেতু তখন ভাবছে এখন সে কি করবে! কেমন করে ম্যানেজ করবে ভাবীদেরকে।
যে কোনও অসহায় মুহূর্তে সেতুর যা হয়, শেষ পর্যন্ত শুভকে ডাকতে লাগল সে। মনে মনে কথা বলতে লাগল শুভর সঙ্গে। শুভ, তুমি বলে দাও আমি এখন কী করব।
আশ্চর্য ব্যাপার, শুভই যেন পথটা তাকে বাতলে দিল। কিছুক্ষণ পর নিজের অজান্তেই যেন রেখার রুমে এসে ঢুকল সে।
চিন্তিত ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে আছে রেখা। সেতুকে দেখে মোটেই অবাক হল না, বিরক্ত হল। কপালে কুঁচকে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।
অপমানটা গায়ে মাখল না সেতু। বলল, তোমরা দুজনেই যদি আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে আমি কার কাছে যাব? তোমরা ছাড়া আমার আর আছে কে?
নরম করে বলতে চাওয়ার পরও গলাটা রেখার নরম হল না। কর্কশ গলায় বলল, আমাদের জায়গায় তুমি হলে কী করতে?
তোমাদের কোনও প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না। তবে সবদিক ভেবেই কাজটা আমি করেছি। এছাড়া আমার কোনও উপায় ছিল না। আমি চাই তোমরা দুজন আমার পাশে দাঁড়াও, আমাকে হেলপ কর।
একথায় রেখা কেমন ব্ৰিত হল। আমি কীভাবে তোমাকে হেলপ করব? না না আমার কিছু করার নেই।
আছে। তুমি ছোটভাইকে বোঝাও।
সে আমার কথা শুনবে না। প্রচন্ড রেগে যাবে, তার রাগ সামলাবার ক্ষমতা আমার নেই। তারচে’ তুমি বরং ভাবির কাছে যাও। ভাইয়া যদি সব মেনে নেন তাহলে কারও কিছু বলার থাকবে না।
কিন্তু শিলা বলল, আমার রুমে আসা তোমার ঠিক হয়নি, যা বলার আমি তোমাকে বলে দিয়েছি।
শিলার সঙ্গে সেতুর সম্পর্কটা মা মেয়ের মতো। রেখার কথা তেমন গায়ে লাগে না তার, কিন্তু শিলা রাগ করে কিছু বললে সঙ্গে সঙ্গে কান্না পায়।
এখনও পেল। কাঁদ কাঁদ গলায় বলল, তুমি যে আমার সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার করবে এ আমি কখনও ভাবীনি।
শিলা শুয়েছিল, উঠে বসল। তুমি নিজে যা করেছ তারচে খারাপ আর কিছু হতে পারে! আমার খারাপ ব্যবহারটা দেখছ, নিজেরটা দেখছ না?
ভাঙাচোরা, কাতর গলায় সেতু বলল, আগের কথাটাই তোমাকে আবার বলি, ভাইয়াকে তুমি ম্যানেজ কর। তোমার কথা ভাইয়া ফেলবে না। আমাকে তুমি বাঁচাও ভাবী, প্লিজ, আমাকে তুমি বাঁচাও।
শিলা কঠিন গলায় বলল, এককথা আমি দুবার বলি না। এতবড় কাজটাই যখন করে ফেলতে পেরেছ, তখন ভাইদের সামনেও দাঁড়াতে পারবে। তুমি নিজেই তাদের সামনে দাঁড়াও, তাদেরকে ম্যানেজ কর। আমি পারব না।
বিছানা থেকে নেমে দ্রুত হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল শিলা। তারপরও সেতু খানিক দাঁড়িয়ে রইল। চোখের জলে দুগাল ভাসছিল তার।