পরীক্ষিৎ
সাত মাইল রাস্তা হেঁটে এলাম এই রাত্রে। লাস্ট বাস চলে গিয়েছিল, পকেটে পয়সা ছিল না। ফিরে এসেই লিখতে ইচ্ছে হল। একটা কথাও হারাতে ইচ্ছে করে না। এতক্ষণ যা যা মনে পড়ল, সবই টুকে রাখতে চাই। নইলে হারিয়ে যাবে। অতিকষ্টে শেখরকে কাটানো গেছে। গড়িয়াহাটার মোড়ের আগে আর কিছুতে যেতে চায় না। সাহিত্য আন্দোলন, কবিতার ফর্ম এইসব নিয়ে বকবক শুরু করেছে, রাতদুপুর..অশ্লীল…ফলানো। তারপর বলে যে আমার বাড়িতে আসবে। আমি গেলাম
ওর বাড়িতে থাকতে, তার বদলে ও চায় আমার বাড়ি। এক দিন ওর বাড়ি আমি থেকেছি, এক দিন আমার বাড়িতে ও থাকরেই। এ কি কমুনিজম নাকি? আমি ওর বাড়ি থাকব বেশ করব। আমি ওর বাড়িতে থাকি, ধন্য হয়ে যায়, পরে জীবনীতে লিখবে কিন্তু– । আমার বাড়িতে জায়গা নেই।
আজ ভবকেষ্ট মিত্তিরের কাগজের অফিসে গিয়েছিলাম, শুনলাম আমার নাটকটা এ-মাস থেকে ধরবে না, আগে শেখরের উপন্যাস। শুনে গা জ্বলে গেল। শেখরের কি টাকার অভাব : ওর কী দরকার উপন্যাস লেখার তাছাড়া যখন শুনেছে আমি ওখানে লেখা দেব। একশোটা টাকা পেলে আমার কত কাজে লাগত। ভবকেষ্টর চ্যালা রামকেষ্ট আবার বলে, আপনি বিমলেন্দুবাবুর উপন্যাস একটা জোগাড় করে দিতে পারেন? যেন বিমলেন্দু একটা বিরাট কেষ্ট-বিচ্ছু। ট্র্যাস লেখে! রাগে আমার মুখে থুতু এসে গিয়েছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল থুতু লোকটার মুখে মাখিয়ে দিই। তার বদলে হাসি এনে বললাম, ঠিক আছে, আমি এনে দেব, আপনাদের আর যেতে হবে না ওর কাছে। বিমলেন্দুকে এক দিন কথায় কথায় বলে দিলেই হবে যে, ভবকেষ্ট তোর খুব নিন্দে করছিল, তোর কাছের মেঘ গল্পটা কাফকা থেকে টোকা। হারামজাদা, শুয়োরের বাচ্চারা ফোকটে নাম কিনছে। শিল্পের জন্য সর্বস্ব পর করলাম আমি, আর ওরা মজা লুটল। আমি দিন-রাত মানিনি, ভয়-ভাবনা মায়া-মমতা মানিনি, জীবনটাকে ছুঁড়ে দিয়েছি শূন্যে। আর ছাপার অযোগ্যরা রাত্রে বাড়ি ফেরা ঠিক রেখে, পরের দিনের গাড়িভাড়া বাঁচিয়ে, মা-বোনের কাছে মান ঠিক রেখে, থানা-পুলিশ সামলে শিল্পী সেজেছে। শালারা আমার সঙ্গে ঘুরে– ।
নাঃ, বড় বেশি রাগ এসে যাচ্ছে। আজ নেশাটা পুরো হয়নি, আর হাফ নেশা হলেই শরীরে বিষম রাগ এসে যায়, ইচ্ছে হয় সব অশ্লীলকে ডুবিয়ে ছাড়ি। ওদের নিয়ম, সাবধানের বারোটা বাজাই। সে-দিন অবিনাশ হঠাৎ ছুটে রাস্তা পার হতে গেল। দু’দিক থেকে দুটো গাড়ি, প্রচণ্ড ব্রেক কষার শব্দ। আমি মনে মনে চোখ বুজে খুশি হলাম। নিশ্চয়ই ওটা গেছে। ঈশ্বর, তুমি ধন্যবাদাহঁ, ওর একটা কিছু শাস্তি পাওনা ছিল, প্রাণে যেন না মরে, হাত-পা খোঁড়া হয়ে যাক। ভিড় ঠেলে গেলাম, হা হরি, একটা নিরীহ কুকুর চাপা পড়েছে, অবিনাশ অক্ষত। কুকুরটার জন্য এমন আন্তরিক দুঃখ হল আমার যে, অবিনাশকে চাপা দিতে পারেনি বলে গাড়ির ড্রাইভারের নাকে ঘুষি মারলাম। বেঁচে থাকার আশ্চর্য ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে ওটা। তবে ওকে আমি শিক্ষা দিয়ে দেব। বুঝিয়ে দেব শিল্পের সঙ্গে শত্রুতা কী সাংঘাতিক জিনিস। অনিমেষের সঙ্গেও। সুযোগ পাচ্ছি না।
সে-দিন হাসপাতালে গিয়েছিলাম। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তাপস, শেখর, অম্লান, বিশ্বদেব, অনিমেষ, ছায়া, মায়া, কায়া সব। অবিনাশের চোখ জ্বল জ্বল করছিল। পেচ্ছাপখানার পাশে এসে ওকে বললাম, কী রে, কার মুখ দেখতে এসেছিস? জবাব দিল না। এক পাটি দাঁতের ওপর আর এক পাটি দাঁত ঘষে গেল, চোয়াল নড়া দেখে বুঝলাম। আবার বললাম, অমন ছটফট করছিস কেন? উত্তর নেই। কাঁধে হাত দিয়ে বললাম, অবিনাশ –। অত্যন্ত বিনীত গলায় বলল, পরীক্ষিৎ, তুই এখন অন্য কারুর সঙ্গে কথা বল। কোনও কারণে রাগ হলে আমি চুপ করে থাকতে চাই। আমি চেয়েছিলাম ওকে রাগিয়ে দিতে। রেগে গেলেই ও দু’একটা বোকামি করে, নইলে এমনিতে ভয়ানক সাহেনশা ছেলে। মুখখানা টকটক করছে অনিমেষের। অনিমেষ এক পাশেদাঁড়িয়ে নখ খুঁটছিল, নার্স এসে বলল, কংগ্রাচুলেশন। আপনার ছেলে হয়েছে।
ছেলে। অনিমেষের চেয়ে বেশি চেঁচিয়ে উঠল শেখর আর ছায়া। যেন বাপের জন্মে কোনও ছেলে হওয়ার কথা শোনেনি। অনিমেষ সামনে এসে বলল, ওরা ভাল আছে তো? দু’জনেই –।
দুজন না, তিন জন! নার্সটা মুচকি হাসল। বেশ গোলগাল চেহারা, লেবুর মতো দুটো গাল, তবু মনে হল পেছনে প্যাড বেঁধেছে। নইলে অতটা উঁচু আর শেপলি। ইচ্ছে হল, একটা টোকা মেরে– ।
তিন জন? তার মানে?
হ্যাঁ, তিন জন। সারা মুখে নীলকালি মাখার মতো হাসল নার্স। এবার লক্ষ্য করলাম, ওর বেশ গোঁফ আছে। একটু না, বেশনীলের চেকনাই। পা দুটো যখন অত সাদা, তখন নিশ্চয়ই পায়ের নোম কামায়, সেই সময় কি গোঁফও চেঁছে নেয় নাকি মাঝে মাঝে? অধিকাংশ মহিলা সাহিত্যিকই গোঁফ কামায় শুনেছি। নিজে যাচাই করে দেখিনি অবশ্য।
তিন জন কে? অনিমেষ কেবিনের দিকে যেতে গেল। নার্স মিষ্টি হেসে বলল, ঠিক যেন কোনও অশ্লীল কথা শেখাচ্ছে, আপনার যমজ হয়েছে। খুব ভাল ওয়েট, সাড়ে পাঁচ পাউন্ড করে, সবাই ভাল আছে। আসুন আমার সঙ্গে, বেশি কথা বলবেন না। আমাদের সব্বাইকে মিষ্টি খাওয়াতে হবে কিন্তু।
যমজ? শুনে আমরা সবাই সশব্দেবিস্মিত হয়ে গেলাম। সত্যিকারের যমজ? বহু দিন বাদে একটা খাঁটি আশ্চর্য ঘটনা শুনলাম। আমাদের চেনাশুনো কারুর কখনও যমজ সন্তান হয়েছে শুনিনি। স্কুলে আমাদের ক্লাসে প্রশান্ত আর সুশান্ত নামে দুই ভাই পড়ত। অনিমেষ একেবারে অভিভূত হয়ে পড়েছে। মুখখানা ফ্যাকাশে। নার্সের হাতটা খপ করে চেপে ধরে বলল, আপনি ঠিক বলছেন, আমারই? কেবিন নাম্বার থ্রি? কখন?
নার্সটি যেন ভারি মজা পেয়েছে। কচি খুকির মতো চোখ ঘুরিয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ আপনারই, আপনার স্ত্রী নাম গায়ত্রী তো? আপনাদের আগে বলা হয়নি, প্রথম বেবি হবার ঠিক এগারো মিনিট পরেই আরেকটি। কী ভাগ্য আপনার! দুটিই ছেলে, মেয়ে নয়।
অনিমেষ তখনও নার্সের হাত ধরে আছে, জিজ্ঞেস করল, দু’জনেই –।
হ্যাঁ, বলছি তো দুটিই ছেলে।
না, তা নয়, দু’জনেই –।
হ্যাঁ হ্যাঁ, দুজনেই বেঁচে আছে। খুবনর্মাল ডেলিভারি।
অবিনাশ জিজ্ঞেস করল, আর ছেলে দুটির মা কেমন আছে? গায়ত্রী?
খুব ভাল। জ্ঞান ফিরে এসেছে। গিয়ে দেখুন না, হাসছে! অবিনাশ অনিমেষের কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কংগ্রাচুলসোন! করিডর দিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে বলল, তোমরা খবর শুনেছ? যমজ হয়েছে।
শিশুর মুখ দেখে কিছুই বোঝা যায় না, দুটো রক্ত-মাংসের পুতুল। ওদের চোখ, নাক, কান ও লিঙ্গ আছে, হাসি ও কান্না আছে, পেশির শক্তিতে হাত ও পা ছুঁড়তে পারে। দুঃখ আছে, অর্থাৎ খিদে পেলে বা পিঁপড়েয় কামড়ালে কাঁদতে জানে। সুখবোধও আছে, অর্থাৎ মায়ের বুক পাওয়া। শুধু নেই স্বাত। ওরা আলাদা নয়। দুটোকেই আমার এ-রকম মনে হয়েছিল, হয়তো যমজ বলে ওরা এক রকম দেখতেই হবে। কিন্তু ওরা অন্য শিশুর চেয়েও আলাদা নয়, বস্তুত দুনিয়ার সমস্ত সদ্যোজাত বাচ্চাই আমার কাছে এক। ওরা একই রকম ভাবে চেয়ে থাকে। চৈতন্যের কোন প্রদেশ থেকে আসে ওরা, কী সরল ও দূরভেদ্য চেয়ে থাকা। কোথাকার এক বেঁচে থাকার প্রবল দাবি নিয়ে এসেছে, দু’জনের বুকের ওপর আড়াআড়ি রাখা গায়ত্রীর হাত, দুটো মায়ার পিণ্ড। ওঃ, বিপুল প্রতীক্ষা ও ধৈর্য নিয়ে আসতে হয় পৃথিবীতে। কত কী শিখতে হবে–হাঁটাচলা, শব্দব্রহ্ম থেকে বাক্যবন্ধ, খাবার চুরি, স্বর ও ব্যঞ্জন, পোশাক পরা, আগুনে হাত দিলে হাত পোড়ে এই অভিমানী জ্ঞান, ঘুড়ি বা লাট্টু, ছোঁক হোক, ফ্রক ও হাফপ্যান্টের নিচের রহস্য, নিজেকে লুকোবার জন্য শুন্যতাবোধ, রক্তের ডাক ও কর্মবন্ধন, তারপর আরেক জনকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে এই রকম আর একটা মাংসের পুতুল তৈরি করা। পরা-বিদ্যা বুঝি বলে একেই। অথবা চক্র দিয়ে আরম্ভ কী যেন একটা সংস্কৃত শ্লোক, পরে দেখে নেব। অথবা সুক্ষ্মতা বুঝি এই। নাঃ, জীবচক্র জিনিসটা আমার পছন্দ হয় না। আমার পৃথিবীতে আমি কোনও উত্তরাধিকারী রেখে যাব না।
আমি নবজাতকদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে গায়ত্রীর ক্লান্ত খুশি ছুঁয়ে অনিমেষকে দেখলাম। যেন ওর ঈশ্বরদর্শন হয়েছে, এমন মুখ। খুব ইচ্ছে হল ওকে একটা ধাক্কা দিই। ওকে বলি, অনিমেষ –। মানুষের অতটা খুশি আমার সহ্য হয় না। না হয় যমজ ছেলেইহয়েছে। এমন কী দৃশ্য আছে পৃথিবীতে যা মানুষকে সত্যিকারের খুশি করতে পারবে? চোখ না বুজলে মুখ জাগে না। আমি বলতে চাইছিলাম, অনিমেষ, চোখ বুজে নিজের মুখ দ্যাখ। ওই সন্তান তোর কেউ নয়।
বন্ধুবান্ধব-ফান্ধব আমার মোটই ভাল লাগে না। অর্থাৎ আমার কোনও বন্ধু নেই। যে আমাকে খাওয়াবে সে আমার বন্ধু। যে আমাকে রাত্রে থাকতে দেবে সে আমার বন্ধু। কোনও কাগজের জন্য যদি কেউ লেখা চেয়ে টাকা দেয়, বা যখন তখন সিগারেট পাওয়া যাবে বা ট্রামে-বাসে ভাড়া দেবে তাহলে বন্ধু বলা যায়। আর কিছু আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। এক-একটা আছে, ভিখিরির মতো বসে থাকে আর সাহিত্য-ফাহিত্য নিয়ে কথা বলতে চায়। আমিও তো ভিখিরি। ভিখির সঙ্গে ভিখিরির বন্ধুত্ব করে কী লাভ! মোটেই পছন্দ করি না। অনেকে আবার বন্ধুত্ব করে ধার শোধ চায়, যেমন আজ শেখর। কিন্তু সব চেয়ে বড় বদমাশ অবিনাশ, কারণ ও আর আমার বন্ধুত্ব চায় না। ওর কথা ভাবলেই গা জ্বলে যায়।
অতক্ষণ অন্ধকার দিয়ে হেঁটে এলাম, ওঃ কী অন্ধকার, হেঁটে এলাম না সাঁতরে এলাম। শরীর ডুবে গেল, গা-হাত-পা দেখা যায় না। চোখে-নাকে-অন্ধকার ঢুকে যাচ্ছিল, খানিকটা অন্ধকার হড়াৎ করে খেয়ে ফেললাম ভুলে। কিছুক্ষণ পরে দাঁড়িয়ে এক জায়গায় বমি করার মতো অন্ধকার বার করে দিলাম পেট থেকে, নাক ঝেড়ে সিকনির মতো অন্ধকার পরিষ্কার করলাম। তা-ও শালারা যেতে চায় না। খানিকটা বাদে রাস্তা ভুল হয়ে গেল। কাদার মতো থকথকে অন্ধকার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘেন্নায় শরীর গুলোচ্ছিল।
এক দিন কল্যাণের সঙ্গে এমন ঘোর অমাবস্যায় হেঁটেছিলাম, বহরমপুরে। কল্যাণ একটা চুরুট খাচ্ছিল। মাঝে মাঝে সেই চুরুটের ম্লান লাল আলো। সেদিন আর কী হয়েছিল মনে নেই, শুধুমনে পড়ে আমাদের বহুক্ষণ পাশাপাশি অন্ধকারে হাঁটা। ও, সেদিন আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছিল। আহা, এত দিন মনে পড়েনি কেন? আমরা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার পাড়ে চলে এলাম গির্জার পাশ দিয়ে। আমরা দুজনে কোনও কথা বলিনি, এমন ভাবেহাঁটছিলাম যেন বহুক্ষণ আরও ওই রকম ভাবে হাঁটতে থাকব। কিছুক্ষণ আগে কল্যাণ গান গাইছিল চেঁচিয়ে, জোরালো ও সুরেলা গলা ওর অমন সিড়িঙ্গে চেহারায়। গান অসম্ভব ভাল লাগছিল, সেই সঙ্গে বিরক্ত হয়েছিলামও। কারণ, ও গান গাইছিল আপন মনে, আমাকে গানের সঙ্গী করেনি। তারপর হঠাৎ চুপ করে উকট ভাবে গম্ভীর হয়ে গেল। নদীর পাড়ে এসেও আমরা হাঁটা থামাইনি। মনে হল আমরা নদীর ওপর দিয়েও হেঁটে যাব। ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে জলের কাছে এলাম, আমার দেখতে ইচ্ছে হল কল্যাণ কী করে। ও আস্তে আস্তে জলে নেমে যাচ্ছে, আমি দেখতে লাগলাম, প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলল, যখন বুক জলে, তখন ফিস ফিস করে আমি ডাকলাম, কল্যাণ! কল্যাণ পিছন ফিরে তাকিয়েই সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এল, এসেও কোনও কথা বলল না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ বলল, শ্যামা কথাটার মানে কী রে? কালো? তন্বী শ্যামা শিখরীদশনা…কালিদাসের নায়িকা কি কালো ছিল?
আমি বললাম, না। শ্যামা মানে যে-স্ত্রীলোকের শরীর শীতকালে গরম এবং গ্রীষ্মকালে ঠাণ্ডা থাকে। হঠাৎ—।
কিছুনা, ও বলল। আবার খানিকক্ষণ চুপ। পরে বলল, ও-পারে একটা লোক দেখতে পাচ্ছিস?
না।
ওই যে দ্যাখ, লাল আলোর একটা ছিটে। হ্যারিকেন হাতে মাঠের মধ্য দিয়ে লোকটা হাঁটছে। আমার কী মনে হল জানিস, আমিই এই নদীটা পেরিয়ে গিয়ে ও-পারে মাঠে হাঁটছি। তোকে বললাম, একটু দাঁড়া। কীরকম যেন স্বপ্নের মতো এক মুহূর্তে দেখতে পেলাম।
ও-পারে তো কবরখানা, তোর ওখানে রাতে যেতে ইচ্ছে করছে?
না। শুধু নদীর ওপারে যে-কোনও জায়গায়।
হঠাৎ আমার মনে হল, কল্যাণ কি রাতদুপুরে আমাকে একা পেয়ে কবিত্বে টেক্কা দিচ্ছে? ওর কথায় খানিকটা যেন সত্যিই গভীরতর সুর। বললাম, কী করে পার হবি? আমার তো মনে হচ্ছে এটা অন্ধকার, কাদায় থিক থিকনরকের নদীর মতো বিশ্রী।
কল্যাণ আমরা দিকে গূঢ় সন্দেহের চোখে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, যাঃ, এ তো গঙ্গা। পুণ্যসলিলা।
কিন্তু যাই হোক, তোর কি মনে হয় না এটা একটা অদ্ভুত জীবন্ত জিনিস যা কোনও দিন পার হওয়া যাবে না? (কল্যাণ কোনও দিন পারবে এ-রকম কথা বলতে? )
আমি ঠিক পার হতে চাই না। আমি ডুবে থাকতে চাই।
কীসে ডুবে থাকতে? নদীতে?
হ্যাঁ, সব নদীতে নয়, এখন, এইমাত্র মনে হচ্ছে। আমার ইচ্ছে হচ্ছে ডুবে মরি। মরব? তুই সাক্ষী থাকবি?
থাকব। তার আগে তোর নীল স্যুটটা আমাকে দিয়ে যা। তোর ওটা আমার খুব পছন্দ মাইরি।
তুই জানিস না, পরীক্ষিৎ– কল্যাণ কোট খুলতে খুলতে বলল, শরীরে বড় মৃত্যুভয় ঢুকেছে আমার। মনে হচ্ছে বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। খুবই লজ্জা লাগে কিছুই হল না, জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা লেখা লেখা খেলা করে কাটালাম। যখন চুল পাকরে, দ ত থাকরে না, চোখের ছানি কাটাতে হবে, তখন হয়তো লেখার জন্য কিছু টাকাকড়ি পাব, খবরের কাগজের লোকে যাকে বলে সম্মান দক্ষিণা। তোর লজ্জা করে না? এই কি জীবন নাকি? এর চেয়ে নিজের হাতে—তুই দাঁড়া, পরীক্ষিৎ আমি যাই।
কোথায়?
জলে। নদীর বিছানায় ঘুমোই। কোনও ক্ষোভ থাকবে না।
আমিও তাই ভেবেছিলাম। সেই জন্যই তো আমিও গিয়েছিলাম আত্মহত্যা করতে।
কবে? তুই আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলি? তোর মতো—।
কেন, জব্বলপুরে? ব্রিজ থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়েছিলাম, তোর মনে নেই?
তুই লাফিয়েছিলি? তুই তো হঠাৎ পড়ে গেলি।
নাঃ। এক মুহূর্তে আমার মৃত্যু খেলে গিয়েছিল, হার্ট ক্রেনের মতো। নিচে নদীতে অন্ধকার স্রোত দেখে হঠাৎ মনে হয়েছিল, যাই’ বলে সাড়া দিই। স্রোত, আমিও তোমার সঙ্গে যাব। মাঝখান থেকে অবিনাশ এসে– ।
দেখলাম কল্যাণ পেছন ফিরে উঠতে শুরু করেছে, আমার পুরো কথা না শুনে। সিঁড়ির ওপর গিয়ে মূর্তিটার নিচে দাঁড়াল। বিশাল মর্মর মূর্তিটা যেন মূর্তিটা, কোনও তুলনা মনে আসছেনা, শুধু মূর্তিটাই চোখে ভাসছে, বিশেষত ওই অন্ধকারে তলোয়ারের উপর হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়ানো। মনে পড়ছে মূর্তিটার নিচে কল্যাণকে কী সাধারণ ও অকিঞ্চিৎকর লেগেছিল। ভেবেছিলাম, মানুষ কি একটা মূর্তির চেয়ে নগণ্য বা কম জীবন্ত? পরে ভাবনাটা সংশোধন করে নিয়েছি। মানুষ না, শুধু কল্যাণ। ওই বাস্টার্ড। ওকে আমি দু’চক্ষে দেখতে পারি না। খালি বড় বড় কথা।
.
শনিবার, ২৯ এপ্রিল।
কাল সারা রাত মাথায় ব্যথা হয়েছে। মাথার যন্ত্রণা কিংবা মাথাধরা নয়। মাথার পিছনে চার ইঞ্চি জায়গা জুড়ে সমতল ধরনের ব্যথা। শুয়েছিলাম, হঠাৎ মাঝ রাত্রে মনে হল ভূমিকম্প হচ্ছে, খাট ও ঝোলানো আলোটা দুলছে। শুনতে পেলাম দূর থেকে শত শত শাঁখের আওয়াজ। প্রবল ভয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মেঝেতে পা রাখতে পারছিলাম না, মা মা বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। মা যে বাড়িতে নেই মনে পড়েনি, শুধু মনে হয়েছে মাকে ডেকে বাইরে কোনও খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে বাঁচতে হবে। বাড়ির সামনে খোলা জায়গা নেই, পুরো গলিটা পেরিয়ে রাস্তার ওপরে ঘুঁটে দেবার মাঠ, গলিটা পেরুবকী করে? মা মা বলে ডেকে দেয়াল ধরে ধরে পাশের ঘরে এলাম। দিদি ওর বাচ্চাদের নিয়ে সুখে ঘুমোচ্ছ, এখনও টের পায়নি। দিদিকে ডাকতে গিয়েও মনে হল, থাক না, ওরা নিশ্চিন্তে ঘুমোক, দেয়াল চাপার পড়ে মরে তোমরুক, বিধবা হয়ে দিদি বেশিদিন বেঁচেকী করবে? পরক্ষণেই মনে পড়ল, একবার আমার ডান হাত ভেঙে যেতে দিদি আমাকে অনেক দিন নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছে, তৎক্ষণাৎ দিদিকে ডেকে বাঁচাবার কথা মনে হল। সেই সময় শিয়রের কাছে জানলাটা খোলা, ছায়া দুলছে না, আলো দুলছে না। বুঝতে পারলাম, দিদির ঘরে ভূমিকম্প নেই। থেমে গেছে, না ভূমিকম্প আরম্ভই হয়নি? আমি স্বপ্নেভয় পেয়েছিলাম? নাকি পৃথিবীতে এইমাত্র কয়েক সেকেন্ডের একটা বিষম ভূমিকম্প হয়ে গেল যা শুধু একা আমার শরীর কাঁপিয়েছে! আবার মাথার যন্ত্রণা শুরু হল।
সেই সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, রাত দুটো কি সাড়ে তিনটে, বাবাকে দেখতে পেলাম।
কোর্ট থেকে ফেরার সময় যে-রকম পোশাক পরতেন, ঠিক সেই পোশাকে, কালো সিল্কের কোট, কালো টাই, ধবধরে সাদা স্টিকলার ও জামার হাতা। চোখে প্যাশান। জিজ্ঞেস করলাম, বাবা আপনি হঠাৎ? কী মনে করে?
তোমাদের দেখতে এলাম। তাছাড়া আমার নস্যির কৌটোটা ফেলে গিয়েছিলাম। বাবা খুব ধীর ও পরিষ্কার গলায় বললেন।
আপনাকে আবার দেখব, আশাই করিনি, আপনি তো-।
তুমি কেমন আছ পরীক্ষিৎ, একটু রোগা হয়ে গেছ।
কিন্তু আপনার চেহারা একই রকম আছে। কী করে ফিরলেন?
আমার সোনার হাতঘড়িটা বিক্রি করে দিয়েছ শুনলাম।
আপনি কী করে ফিরলেন? মরে যাবার সাত বছর পরে–
ঘড়িটা আমার খুব প্রিয় ছিল, আমার বাবা ওটা দিয়েছিলেন আমাকে। তিনি বলেছিলেন, এই ঘড়ি তোমাকে দিলাম। এটা কখনও বন্ধ হয় না। এটা তুমি তোমার সন্তানকে দিও। কিন্তু সেই সময়কে তুমি রাখলে না, পরীক্ষিৎ।
মৃত্যুর পরও কি ফিরে আসা যায়? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
আমার মেডেলগুলো সব অশ্বিনীর কাছে বন্ধক দিয়েছ। ওগুলো কী ছাড়াবে?
ছাড়াতাম। কিন্তু স্যাকরা বেচে দিয়েছে বলল।
মিথ্যা কথা বোলা না আর এখন। আসলে তোমার–
আপনি মৃত্যুর কথা বলুন।
ছাড়াবার মোটেই ইচ্ছে ছিল না। তুমি নিজে লেখাপড়া করলে না। এমন কিছু করতে পারবে না যাতে ও-রকম মেডেল পাবে। সেই জন্য তোমার বাবার মেডেল তোমার সহ্য হচ্ছিল না। কিন্তু তোমার মা ওগুলো খুব ভালবাসতেন। তাকে এখনও বলোনি—
সাত বছর আগে আপনাকে আমি পুড়িয়ে এসেছি শ্মশানে। সেদিন খুব বৃষ্টি ছিল। আনাকে বয়ে নিয়ে যেতে অনেক লোক এসেছিল, কিন্তু আমার এমন কাঁধে ব্যথা হয়েছিল যে এক সপ্তাহ ব্যথা ছিল। আপনি জানেন না, জেনে রাখুন, আপনার প্রিয় বন্ধু সতীশবাবু শ্মশানে যাননি। বুলিমাসির বর আপনার টাকা ফেরত দেননি। কিন্তু আপনি কী করে মৃত্যুর পর আবার ফিরলেন, সেই কথা বলুন।
আমার ফটোর কাচটা ফেটে গেছে। ওটাকে সারিয়ে অন্য কোথাও রাখাই তোমার উচিত।
মৃত্যুর দেশ থেকে যদি ফিরে আসা যায়, তবে আমি আপনার সঙ্গে যাব। ফিরে এসে আমি সেই অ্যাডভেঞ্চারের কথা লিখলে পৃথিবীতে হই-হই পড়ে যাবে।
ওরকম জানলার পাশে মাথা দিয়ে শুয়ো না। ওতে বুকে সর্দি বসে যায়।
আপনি মৃত্যুর কথা বলুন! মরার পর আপনি একটুও বদলাননি তো? কেমন করে– ।
আমার বড় শীত করে রে খোকন, আমাকে একটা কম্বল দিতে পারিস?
না। আমাদের আর একটা একস্ট্রা কম্বল নেই। আপনারটা দিদির ছেলে গায়ে দিচ্ছে।
কিন্তু আমার যে বড় শীত করে। চিতায় যাবার পর আর আগুন দেখিনি। আমার প্রথম বার বাৎসরিক কাজটাও করিসনি!
তখন জামাইবাবুর অসুখ ছিল। ভেবেছিলাম, জামাইবাবুর শ্রাদ্ধ আর আপনার বাৎসরিক এক সঙ্গে করব।
মরার আগের দিন তোকে—।
আপনি মরার পরের– ।
একটা কথা– ।
কথা।
বলতে চেয়েছিলাম। তুই আসিসনি, আমার– ।
বলুন, আমি তাই শুনতে চাই।
আমার ওখানে বড় শীত করে পরীক্ষিৎ। তোর কথা ভেবেও আমার শীত করে।