বিমলেন্দু
ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে দেখলাম, অত্যন্ত গম্ভীর এবং নিবিষ্ট চোখ মুখে তাপস, অবিনাশ আর হেমকান্তি, সামনে তাস ছড়ানো। তিন জনে বসে আছে অথচ চার জনের তাস ভাগ করা। যেন চতুর্থ লোকের প্রতীক্ষায় ছিল, আমাকে দেখেই বলে উঠল, আয়, তাস তোল।
আমি তাস খেলতে জানি না।
শিখে নিবি, বসে পড়, অবিনাশ বলল।
না, ওসব আমার ভাল লাগে না।
ও! অবিনাশ চোখ না তুলেই বলল। ওদের খেলা থামল না। অবিনাশ বলল, ফাইভ নো ট্রামপস্। চার জনের তাস বিছিয়েও যে তিন জনে ব্রিজ খেলা যায় আমি জানতাম না। এখন আমাকে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে হবে, অত্যন্ত বিরক্তিকর আমি উঠে গিয়ে রেডিয়োর চাবি ঘোরালাম, যুদ্ধের বোমা বর্ষণের মতো আওয়াজ ও মাঝে দ্রুত মিলিয়ে যাওয়া গানের লাইন। আঃ, বিরক্ত করিস না, তাপস বলল, দে, একটা সিগারেট দে! আমি উঠে পাশের ঘরে গেলাম। মায়া দাঁত দিয়ে কালো ফিতে চেপে ধরে চুল বাঁধছে আয়নার সামনে। ফর্সা গালে ফিতেটা শায়া ও ব্লাউজ পরা, ভাঁজ করা শাড়িটা হাঁটুর উপর। আমাকে দেখে চমকে উঠল না, লজ্জা পেয়ে শাড়িটা তাড়াতাড়ি তুলে বুকে জড়াল না, ঠাণ্ডা চোখে আমার দিকে চেয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
দিদি কোথায়, মায়া?
বাথরুমে।
তোমার কাছে একটা খালি খাম আছে? একটি চিঠি পোস্ট করব।
না নেই। আপনি পাশের ঘরে বসুন। মায়া তখনও আমার চোখের দিকে চেয়ে ছিল, অত্যন্ত হিম সেই চেয়ে থাকা।
বাড়িতে আর কেউ নেই বুঝি? পিসিমা?
না। আপনি পাশের ঘরে বসুন। দিদি যাচ্ছে।
মায়া, তুমি আমাকে একটা রুমাল দেবে বলেছিলে।
মায়া ঘুরে দ্রুত চলে গেল ড্রেসিং টেবিলের সামনে, ড্রয়ার খুলে একটা ফর্সা ও সোনালি কাজ করা রুমাল এনে বলল, এই নিন, পাশের ঘরে বসুন।
আর কেউ আমাকে দেখেনি, তবু বুঝতে পারলাম, কী বোকা ও নির্লজ্জের মতো আমি রুমালটা চেয়েছিলাম। আর একটু দাঁড়াবার জন্য। কিন্তু মায়ার সঙ্গে আমি কিছুতেই কথা বলতেই পারি না, ভয় পাই। এক দিন ঘুমন্ত অবস্থায় মায়াকে ভাল করে দেখব, মনে মনে ভাবলাম।
ও-ঘরে কী কারণে ওরা চেঁচিয়ে উঠতেই মনে হল, তাস খেলা শেষ হয়েছে। ফিরে এলাম। অবিনাশ পয়সা গুনছে। হেমকান্তি ওর লম্বা মুখ তুলে আমাকে কিছু যেন বলতে চাইল। পরক্ষণেই আবার মুখ নিচু করল সতরঞ্চির দিকে। ওর স্বভাবই এই। মুখ দিয়ে ক’টা ওর কথা বের হয়, আঙুলে গোনা যায়। কোন কথাটা কীভাবে বলবে, ও হয়তো ভেবে পায় না। আমি বললাম, আজ কীসের মিটিং রে? হঠাৎ ফোন করে আসতে বললি কেন?
আজ মাংস খাব। পয়সা নেই। অবিনাশ বলল, তুই তো ইয়া লাশ আছিস, তোর ঊরু থেকে সের খানেক মাংস দেনা, মশলা দিয়ে রাঁধি। মানুষের মাংস কেমন খেতে একটু চেখে দেখি।
যদি খেতেই হয়, তবে আমার কেন, কোনও সুন্দরী মেয়ের মাংস খা না।
দুর ব্লকহেড! ওদের মাংস খেতে হয় চেটে চেটে কিংবা চুষে চুষে। চিবিয়ে গিলে ফেললে তো একেবারেই ফুরিয়ে গেল।
মায়া ও ছায়াদি দুই বোন ঘরে এল। ছায়াদিসদ্য স্নান করে এসেছে। ওর চুল, চোখের পাতা, চিবুক, ভুরু এখনও ভিজে। বলল, চা খাবে? তোমরা যে আজ আসবে তা আগে জানাবে তো?
কেন, তাহলে কি চায়ের বদলে মদ খাওয়াতিস? তাপস বলল।
ধেৎ! তা নয়, মায়া যে দু’খানা সিনেমার টিকিট কেটে এনেছে।
তা মায়া যাক না অন্য কারুকে সঙ্গে নিয়ে, তুমি থাকো।
কে যাবে ওর সঙ্গে? তোমরা যাবে কেউ?
কেন, এত বয়স হল, কারুর সঙ্গে প্রেম-ট্রেম করে না?
করে, আমার সঙ্গে। অবিনাশ গম্ভীর গলায় জানাল।
আমার ভীষণ মাথা ধরেছে, আপনারা কোনও ওষুধ –? হঠাৎ হেমকান্তি বলে উঠল, বড় যন্ত্রণা করে, রোজ সন্ধে হলেই –।
অ্যাসপ্রো আছে, এনে দেব?
না, ওতে কমে না। অন্য কোনও…আপনারা.. ওষুধ।
আমি জানি, হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে তাপস বলল, নেচার ট্রিটমেন্ট। কিন্তু একটু শক্ত, পারবেন?
না, ও পারবে না, আমি জানালাম। তাপসের চোখে বদমাইসি।
কেন পারবে না? শুনুন, আপনি উঠে দাঁড়ান, ডান হাত দিয়ে বাঁ-কান ও বাঁ-হাত দিয়ে ডান কান ধরে ভাল করে ঈশ্বরকে প্রণাম করুন, তারপর মাথাটা জোর করে ঘুরিয়ে নিজের ঘাড়ে ফুঁ দিন, পারবেন তো? তারপর একটা বেগুনি রঙের পাখির কথা ভেবে উলটো মুখ করে সিঁড়ি গুণে গুণে নেমে যান, শেষ ধাপটায় একবার বসুন, আর ঘাড়ে ফুঁ দিন। এবার রাস্তার পানের দোকান থেকে দু’টো পান কিনে নিজে একটা খেয়ে বাকিটা প্রথম যে-মেয়ে ভিখারি দেখবেন, তাকে দান করুন। নির্ঘাৎ সেরে যাবে, সারতে বাধ্য।
মায়া ফুলে ফুলে হাসছিল। হেমকান্তি নিচু দিকে মুখ রেখেই বলল, ওঃ, আচ্ছা? এমন ভাবে বলল, যেন অব্যর্থ বলে বিশ্বাস করেছে, কিন্তু আজ নয় কাল পরীক্ষা করে দেখবে।
যাঃ, কেন ওকে বিরক্ত করছিস তাপস? সত্যি, মাথা ধরলে ভারি কষ্ট হয়, ছায়াদি বলল, আপনি বরং মায়ার সঙ্গে সিনেমায় যান না। সেরে যেতে পারে।
হেমকান্তি কোনও উত্তর দিল না। ওর লম্বা মুখখানা এমন ভাবে তুলে ধরল, যেন ওকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও ভাল হত এর বদলে।
না, এক জন অসুস্থ লোককে কষ্ট দেওয়ার কোনও মানে হয় না, মায়া জানাল।
আমি যাব? আমি নিজেই ব্যগ্র গলায় বললাম।
হ্যাঁ, আপনি আর দিদি যান। মায়া সেই ঠাণ্ডা চোখ আমার দিকে তুলেছে।
তার চেয়ে এক কাজ করা যাক না। অবিনাশ বলল, আমাদের সকলের নামগুলো নিয়ে লটারি হোক। যাব নাম উঠবে সেই যাবে।
এই সময় বেশ জুতোর শব্দ করে পরীক্ষিৎ ঢুকল। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। অনিমেষদের ওখানে বেড়াতে গিয়েও নাকি নদীতে পড়ে গিয়েছিল ব্রিজ থেকে। পরীক্ষিতের চোখ অসম্ভব লাল। অবিনাশ টুকরো টুকরো কাগজে আমাদের নামগুলো লিখে গুলি পাকাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করল, তোর নাম দেব? তুই যাবি পরীক্ষিৎ, মায়ার সঙ্গে সিনেমায়?
হোয়াই নট? কী ছবি? বাংলা?
হ্যাঁ, ছায়াদি বলল।
খারাপ নয়। বই খারাপ হলেও মায়াও তো থাকবেই পাশে।
অবিনাশ কাগজের গুলিগুলো হাতে ঝেঁকে ছড়িয়ে দিল সতরঞ্চিতে। বলল, তুমি তোলো মায়া।
আমি না, দিদি তুলুক।
না, দিদি কেন? তুমিই বেছে নাও না, কে যাবে তোমার সঙ্গে, অনেকটা স্বয়ম্বর সভার স্বাদ পাওয়া। যাবে। জানি তো আমাকেই বেছে নেবে, সেটা মুখ ফুটে বলতে অত লজ্জা কীসের?
কক্ষনো না, মায়া হাসতে হাসতে এগিয়ে এল। আমার ইচ্ছে পরীক্ষিৎদার সঙ্গে যাওযার। দেখবেন, ওর নামই উঠবে। মায়া তুলতে যাচ্ছিল, অবিনাশ ওর হাতখানা চেপে ধরে বলল, কিন্তু শোনো মায়া, যার নাম উঠবে তার সঙ্গেই কিন্তু যেতে হবে, এমনকী হেমকান্তির নাম উঠলেও।
আমি? অসহায় চোখে হেমকান্তি।
মা একটা কাগজের গুলি তুলে একা একা দেখে বলল, পরীক্ষিৎদার নাম। ঠোঁট কামড়ে হাসি চাপছে।
দেখি দেখি, বলে তাড়াতাড়ি করে ছায়াদি আর আমি কাগজটা দেখলাম। না, অবিনাশের –
জানতাম! অবিনাশ হেসে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে মোজা পরতে শুরু করে দেয়। মায়া হাসতে হাসতে বলল, ওঃ কী গরজ। কী হ্যাংলা আপনি বাবা।
পরীক্ষিৎ একটা লম্বা চুরুট ধরিয়েছে। মুচকি হেসে অবিনাশের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই চললি, তোর সঙ্গে যে কয়েকটা কথা ছিল। ফিরছিস তো এখানেই?
ফিরতে পাবি, কিন্তু যদি মায়া দেবী শো’র পর আমার সঙ্গে ময়দানে ঘুরতে কিংবা রেস্টুরেন্টে বসতে রাজি হন। তবে দেবি হবে।
খবরদাব মায়া, কোথাও যাবি না, মায়ার অভিভাবিকা বলে।
মায়া বলল, আপনি কিন্তু হলের মধ্যে বসে ইয়ার্কি করতে পারবেন না। নিজে সাহিত্যিক বলে, ইচ্ছে করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মন্তব্য করবেন, ও-সব অহঙ্কার চলবেনা।
পাগল হয়েছ, অবিনাশ বলল, তোমার কাছে আমি অহঙ্কার করব। সুন্দরীর পাশে আবার সাহিত্যিকের কোনও মূল্য আছে নাকি। বিমলেন্দু, দশটা টাকা দে তো?
আমার কাছে নেই।
নেই কী! খবরের কাগজে লিখে তো খুব টাকা পিটছিস। কিছু ছাড়।
না বে, সঙ্গে কিছু নেই।
নেই? যাঃ শালা, শ্মশানের পাশে গিয়ে ব্যবসা কর।
এই নে। পরীক্ষিৎ চুরুটটা দাঁতে চেপে পকেট থেকে চামড়ার ব্যাগ বার করল। দুটো দশ টাকার নোট এগিয়ে গিয়ে বলল, আসবার সময় একটা পাঁইট আনিস।
তুই তো যথেষ্ট মেরে এসেছিস। আবার কেন?
বাড়ি নিয়ে যাব। রাত্তিরে দরকার।
অবিনাশ মায়ার বাহু ছুঁয়ে বলল, চলো যাই। ছায়া, এদের একটু সামলে টামলে রেখো। ওঃ, একটা কথা বলিনি, অবিনাশ আবার ঘুরে দাঁড়াল, তারপর না-হাসার ভঙ্গি করে বলল, কাগজের গোল্লাগুলো খুলে দেখ, সবগুলোতেই আমার নাম লেখা। মায়া যেটা তুলত, সেটাই আমার। গুড নাইট, বয়েজ।
আমাদের সকলের হাসি থামলে তাপস বলল, হারামজাদা!
আমি খুব অপমানিত বোধ করছিলাম। মায়ার জন্য নয়। মায়ার সঙ্গে যাবার আন্তরিক ইচ্ছে হয়েছিল আমার, সে-জন্য। মায়ার সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করিনি, বরং ওকে সাহায্য করেছি। অনেক, পরীক্ষার সময়। আসলে মায়া আমাকে ঘৃণা করে ছায়াদির জন্য। ছায়াদি এমন ভাব দেখায়, যেন আমাকে কত ভালবাসে। বেচারির এ পর্যন্ত বিয়ে তো হলই না, প্রেমিকও নেই। এতটা বয়স পর্যন্ত কুমারী। ছায়াদি যদি অনুরোধ করে, তুবে অনায়াসেই ওকে বিয়ে করতে পারি আমি। শ্বেতি মোটই ছোঁয়াচে রোগনয়, তাছাড়া মেয়েটা বড় শান্ত, অনেকটা মায়ের মতো, আমার বড় শান্তি লাগে ছায়াদির কাছে। শুধু ওর ওই ন্যাকা পদ্যগুলো লেখার অভ্যেস ছাড়া দরকার। মায়া আমাকে ভুল ভেবেছে, আসলে যে, অবিনাশের সঙ্গে ওর এত মাখামাখি, ওই অবিনাশটাই লম্পট, বিবেকহীন, বদমাশ। ও-ই মজা লুটে পালাবে। মায়াকে নিয়ে ও শেষ পর্যন্ত কী করবে, কী জানি! ভাবতেও ভয় হয়। মায়ার ও-রকম ঝরনার জলে ধোওয়া শরীর। লেখার জন্য জীবনটা কলুষিত করতেই হবে? তাপস-পরীক্ষিৎ-অবিনাশদের তাই ধারণা। ওদের কারুর অসুখ হলে কপালের ওপর কে ঠাণ্ডা হাত রাখবে জানি না।
আমাদের বাড়ির ছাদে কয়েকটা সুন্দর গোলাপ ফুলের চারা টবে বসানো। এক দিন চা খেতে খেতে গাজিপুরের লালগোলাপটা দেখাচ্ছিলাম ওদের। অনেক চেষ্টার পর একটা গাছে সে-দিন প্রথম ফুল ফুটেছে। হয়তো আমার গলায় একটু বেশি উচ্ছ্বাস লেগেছিল, পরীক্ষিৎহঠাৎ সেই টবটা আছড়ে ভেঙে দিল। আধুনিকতা সম্বন্ধে এ-রকম ছেলেমানুষি ধারণা ওদের! জানে না, একশো বছর আগে ফুলকে অবহেলা করে এখন আবার ফুলের স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। অবিনাশটা আবার ফুল খায়। গোলাপ, রজনীগন্ধা, সূর্যমুখী –যেখানে যে ফুল দেখে –লোকের বাড়ির ফুলদানিতে বা উপহারে, বাগানে, ও অমনি ছুটে যায়, ফুল আমি বড্ড ভালবাসি বলে পাপড়িগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে চিবিয়ে খায়। আমি একদিন সরল ভাবে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুই ফুল খাস কেন রে? দ্যাটস দা আনলি ওয়ে অভ অ্যাপ্রিসিয়েসান! কথাটা খুব গর্বের সঙ্গে বলে, যেন ভবিষ্যকাল ওর এই বাণীটি মনে রাখবে।
পরীক্ষিৎ বিশাল কাঁধের হাড় দুটো উঁচু করে চেয়ারে উঠে বসল। ছায়া, চা খাওয়াচ্ছ না কেন? যাও, চা-খাবার টাবার নিয়ে এসো। ছায়াদি বেরিয়ে যেতেই তাপসের দিকে ফিরে বলল, তোদের একটা কথা আছে, ভুলে যাবার আগেই বলি। দিন কয়েক ও-পাড়ার দিকে যাসনি কিন্তু।
কেন?
পরশু একটা খুন হয়ে গেছে ও-পাড়ায়। পুলিশে ছেয়ে গেছে। দিন কয়েক—
তুই ওদিকে গিয়েছিলি কেন? তোর হঠাৎ একা..।
অবিনাশকে খুঁজতে খুঁজতে। তারপর কী রুক্ষু ঝঞ্জাট। এক মক্কেল পুলিশ তো আমাকে ধরে ফেলে আর কী! আমি দৌড়ে গিয়ে লক্ষ্মীর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। সে-বুড়িটা তো আমাকে দেখেই আঁতকে উঠেছে। আমি বললাম, চেঁচিও না মা লক্ষ্মী, চোর-ডাকাত নই, পুলিশের হামলা কমলেই বেরিয়ে যাব। ও সেই ক্যানকেনে গলায় বলল, আজ এখানে এসেছ কেন মরতে?
তাপস জিজ্ঞেস করল, কোন বাড়িতে খুন হয়েছে?
প্রসন্নর বাড়িতে। লক্ষ্মীর কাছে সব শুনলাম। প্রসন্নর বাড়ির তিন তলায় মল্লিকার ঘরের ঠিক পাশের ঘরটা অন্ধকার থাকত, তোর মনে আছে? ও-ঘরে হাসিনা বলে একটা মেয়ের কাছে আসত গোলক গুণ্ডা। সে নাকি মাস্তান, ও-পাড়ার সবাই তাকে চেনে। প্রসন্ন বাড়িওয়ালা এক দিন বলল, তুমি আর এসোনা বাবা, তোমার ভয়ে আমার বাড়িতে লোক আসেনা। চোপ শুয়ার! বলে গোলক তাকে ধমকে দিয়েছে। তখন প্রসন্ন হাসিনাকে বলল, তুই ওকে ঢুকতে দিবি না ঘরে। হাসিনা বলল, ওমরদকে আমার সাধ্য কী, না বলি। জোর করে ঢুকরে। তাছাড়া টাকা-পয়সা ঠিক দিচ্ছে, এ বাড়িতে ও আসছে-যাচ্ছে ভদ্রলোকের মতো। রুপিয়াও জায়দা দিচ্ছে। কোনওদিন তো এখানে হাকরেনি। করেনি, করতে কতক্ষণ। প্রসন্ন হেঁকেছে, তারপর দিয়েছে হাসিনার ঘরের আলোর লাইন কেটে। গোলক তাতেও কোনও আপত্তিকরেনি। রোজ আসবার সময় মোমবাতি কিনে আনত। কাল মল্লিকার ঘরে সন্ধেবেলা তিনটে বাবু এসেছিল। তারা আর এক জন চেয়েছে। হাসিনা, তখন বাথরুম থেকে খালি গায় বেরুচ্ছিল, তাকে দেখেই বাবুদের পছন্দ। কিন্তু হাসিনা রাজিনয়, ওটা গোলকের আসবার দিন। তখন বাড়িওয়ালা জোর করে দুটো লোককে ঢুকিয়ে দিল ওর ঘরে। খানিকক্ষণ বাদে গোলক হাজির হতেই লেগে গেল।
পরীক্ষিৎ চুরুট ধরাবার জন্য দেশলাই জ্বালাতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, গোলক ধরা পড়ল? মাথা খারাপ! দুটো লোক আর একটা মেয়েকে ছুরি মেরে সে হাওয়া। আমাকে লক্ষ্মী বলল, গোলকের কিন্তু দোষ নেই বাপু, যাই বলল। তার যা ব্যাভার ছিল, বাবুদের মাথায় হাগে। কেন তাকে ঘাটানো! সে তো নিজেকে বাঁচাবার জন্যই দুটোকে ছুরি চালিয়েছে। দেখলাম, গোলকের ওপর ওদের খুব ভক্তি। ওদের হিরো। আমি প্রসন্নর বাড়ি খুন শুনেই ভয় পেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম কাছাকাছি। তাতেই তো পুলিশের হাতে পড়ছিলাম প্রায়! লোক দুটোর চেহারার ডেসক্রিপশন শুনেই বুঝতে পারলাম অবিনাশ নয়, তাছাড়া অবিনাশ খুন হবার ছেলেই নয়।
আর মেয়েটা কে?
মল্লিকা! পরীক্ষিৎ অন্য মনস্ক গলায় বলল।
কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে রইলাম। মল্লিকার নাম শুনে ওরা বিষণ্ণ হয়ে গেছে মনে হয়। আমিও মল্লিকাকে চিনতাম। একদিন ওদের সঙ্গে গিয়েছিলাম। ওরা জোর করে টেনে নিয়ে গিয়েছিল আমাকে।
স্যাঁতসেঁতে সিঁড়ি দিয়ে তিন তলায় উঠে আলো ঝলমল পর পর ঘর। মল্লিকা মেয়েটার ঘর ছিল চমৎকার সাজানো-গোছানো। রেডিয়োত ইংরিজি সুর বাজছিল। মা কালি আর সিগারেট কোম্পানির ক্যালেন্ডারে ন্যাংটো মেয়ের ছবি পাশাপাশি দেয়ালে এবং অশ্বারূঢ় শিবাজি। এ ছাড়া কয়েকটি নকল টিকটিকি, আরশোলা, কাকড়াবিছে এখানে-সেখানে ঝুলছে। বিরাট ভাসে এক ঝাড় লাল গোলাপ, অমন সাটিনের মতো ঝলমলে লাল গোলাপ আগে কখনও দেখিনি। মেয়েটা একেবারে পাগলাটে ধরনের ফর্সা, টান করে চুল বাঁধা, অল্প নেশার ঘোরে দুলছিল। বলেছিল, তোমরা আবার কেন এসেছ? মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে প্রাইভেট কথা বলবে, একদম দেখতে পারি না। ওই লোকটা আবার বই লেখে। তাপসের দিকে আঙুল দেখিয়ে, ওসব লেখক-টেখক আমার সয় না, মাইরি। অবিনাশ ততক্ষণে ওর বিছানায় টান টান শুয়ে পড়ে হুকুম করেছে, রেডিয়োটা বন্ধ করে দে মল্লিকা, পাখাটা খোল না। তারপর বলেছে, এই নে সিগারেট খাবি? ভাল সিগারেট আছে আজ। তাপসের সঙ্গে কী নিয়ে যেন কথা কাটাকাটি হল মেয়েটার। তাপস বলল, নাও, টাকা নাও, একটা বোতল আনাও। দু’টোক গিললেই মেজাজ শরিফ হয়ে যাবে।
না। আজ ভাগো। আমার শরীর ভাল নয়।
তাতে কী হয়েছে, না হয় একটু গল্প-গুজবই করব আজ।
না, হবে না। বেরোও বলছি। মেয়েটা খুবই রেগে গেছে কী জানি।
আচ্ছা বাবা, তোমার টাকা অ্যাডভান্স দিচ্ছি।
টাকা দেখাচ্ছ মল্লিকা মিত্তিরকে? কত টাকা, দেখি।
তাপস কুড়িটা টাকা এগিয়ে দিল। হাসতে হাসতে মেয়েটা গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে ঘুরে টলে গিয়ে দেয়াল ধরে সামলাতে সামলাতে কাশতে লাগল।
আচ্ছা, আর পাঁচ টাকা বেশি নাও।
পাঁচ টাকা, আবার পাঁচ টাকা! সরু গলায় বিশ্রীভাবে হেসে উঠল মল্লিকা।
তাপস চটে উঠল এবার। তোমার ওই রূপের জন্য আবার কত চাও?
কী! মল্লিকা বাঘিনীর মত ফুঁসে ওঠে তাপসের দিকে। ঘন নিশ্বাসে ওর বুক ফুলে ফুলে উঠছে। আস্তে আস্তে বলল, রূপের দাম? রূপ কি কিস্মৎ পাঁচ ঘা জুতি! যাবার সময় পাঁচ ঘা জুতো মেরে যেও বলে দশ টাকার নোট দু’খানা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলল। আমি চুপ করে এই নাটক দেখছিলাম। অবিনাশ উঠে বলল, কী ঝঞ্ঝাট করছ মাইরি। দাও, এক গ্লাস জল দাও।
জল! মল্লিকা ছুটে গিয়ে খাটের তলা থেকে কাচের কুঁজোটা টেনে বের করল, তারপর হঠাৎ দুম করে কুঁজোটা ফেলে দিল মাটিতে। অবিনাশ আর কোনও কথাবার্তা না বলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল যাই, মাসির আজ মান হয়েছে! আমরা বেরিয়ে আসার সময় মল্লিকা বলল, দেখো, যেন কা 1 পা কাটে না কাঁচে। আমার ঘরে রক্ত-ফক্ত চলবে না।
আমি বললাম, খবরটা শুনলে অবিনাশ খুবই দুঃখ পাবে। অবিনাশের ওপর মেয়েটার সত্যিই টান ছিল।
না, পাবে না। তাপস বলল।
সত্যিই পাবে না। পরীক্ষিৎ বলে, ওই হারামজাদার বুকের মধ্যে দয়া মায়া কিছুই নেই। ওর আত্মাই নেই বোধহয়।
অবিনাশও তোর সম্বন্ধে এই কথা বলে। আমি বললাম।
যা যা! আমার বুকে ভালবাসা আছে, তাই আমি কবিতা লিখি। অবিনাশ যা লিখেছে, ওগুলো আবার লেখা নাকি? ওর দ্বারা কিছু হবে না।
তোদের ভালবাসা কী-রকম জানিস। একটা পিঁপড়ে মরলে তোদের প্রাণ কাঁদে, কিন্তু বাড়িতে তোর মা খেতে পেল কিনা সে-সম্বন্ধে গ্রাহ্য নেই!
তাপস আমাকে বলল, শালা, তোর কথার মধ্যে বক্তৃতার ঢঙ এসে যায় কেন রে?
আমি চুপ করে গেলাম। পরীক্ষিৎ উদাস ভাবে বলল, ছেলেবেলায় মা মারা গেছে। মায়ের মুখটাও আমার ভাল করে মনে পড়ে না।
ছায়াদি ট্রেতে করে গরম নিমকি ভাজা আর চা নিয়ে এল। এতক্ষণ লাগে তোমার চা বানাতে? পরীক্ষিৎ চমকে উঠল। তাপস বলল, তোর কবিতাগুলো কখন শোনাবি?
চা খাওয়ার পর না হয় ।
না, চা খেতে খেতেই শোনা যাক।
ছায়াদি নির্লজ্জের মতো বাঁধানো খাতাখানা এনে সতরঞ্চির এক পাশে বসল।
খারাপ লাগলে স্পষ্ট করে বলবে কিন্তু, হেমকান্তিবাবু, আপনার কি খুবই শরীর খারাপ লাগছে?
না, হেমকান্তি মুখ গুঁজে বসে ছিল। এবার মাথা তুলল।
ছায়াদি পাতার পর পাতা পড়ে যেতে লাগল। আমি একদম মনোযোগ দিলাম না সে-দিকে। সব ছন্দ-মিল দেওয়া ট্র্যাশ। পরীক্ষিৎ, তাপসও নিশ্চিত শুনছে না। অন্য কিছু ভাবছে। ছায়াদির কী যে এই দুর্বলতা। বাশি বাশি লিখে চলেছে এই সব, ছাপাও হয় নানা জায়গায়, তবু তরুণ সাহিত্যিকদের শোনাবার কী লোভ। মাঝে মাঝে ওদের পিসিমা বাড়ি থাকে না, বা মনে হয় ছায়াদিই ওঁকে কোথাও পাঠিয়ে দেয়। তখন এ বাড়িতে দলেবলে আড্ডা। পিসিমা ভারি ঠাণ্ডা মানুষটি, কাঁচা বেলের ভেবে মতো গায়ের রঙ, সব সময়েই হাসিমুখ। এক দিন শেখর এসে বমি করেছিল, পিসিমা নিজে হাতে পরিষ্কার করেছিলেন। আমাদের বাড়িতে মা-পিসিমারা এ সব করার কথা কখনও ভাবতে পারেন? তা নয়, পিসিমা এদের অভিভাবিকা তো নয়, গলগ্রহ। বুদ্ধিমতী মহিলার মতো তাই মানিয়ে নিচ্ছেন। আমাদের পক্ষে অবশ্য ভালই, চমৎকার আড্ডার জায়গা। তাছাড়া দুটি মেয়ে উপস্থিত থাকলে জমজমাট হয়। একমাত্র মুশকিল, মাঝে মাঝে ছায়াদির লেখা নিয়ে আলোচনা করতে হয়। তবে মেয়েদের স্তুতি করাটা ঠিক মিথ্যে নয়, চর্চা রাখা ভাল। দুপুরে তাপস যখন ফোন করল তখনই বুঝতে পারলাম, কপালে আজ কিছু বাজে পদ্য শোনার দুঃখ আছে। মেয়ের লেখা কবিতা –এ যেন গোল বোতলে চৌকো কর্ক মাইরি, অবিনাশ বলে। অনেকটা ঠিকই বলে। ও ধড়িবাজ ছেলে, কী চমৎকার কেটে পড়ল মায়াকে নিয়ে। মায়াকে আমি অনেক দিন থেকে চিনি। কিশোরী অবস্থা থেকে আস্তে আস্তে ওকে বড় হয়ে উঠতে দেখলাম। ওই ওই সুকুমার, স্বর্গীয় শরীর, অবিনাশ কবে নষ্ট করে দেবে, কে জানে।
আমি বাথরুমে গিয়েছিলাম, দেখলাম ছায়াদিও বেরিয়ে এসেছে। বলল, একটা কথা আছে তোমার সঙ্গে।
বলো।
এখানে দাঁড়িয়ে বলব না, চলো ওপরের ঘরে যাই।
ওপরের ঘরের দরজা ঠেলে খোলার আগেই বলল, না থাক, চলো ছাদে যাই। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। অনেকগুলো টবে সাদা ফুলগুলো ফুটে উঠেছে। তিন চার রকমের গন্ধ আমার নাকে লাগছে। ছোট একটা ঘর আছে ছাদে। চারদিকে চমৎকার নির্জন। ছায়াদিকে কী-রকম রহস্যময় দেখাচ্ছে। আমাকে কী বলতে চায়। আমাকে দিয়ে কোনও কাজ করাবার মতলব নাকি? আমি এতক্ষণে ওকে নিশ্চয়ই একটা চুমু খেয়ে খুশি করতাম, কিন্তু মায়ার ব্যবহারে মনটা কী-রকম বিষিয়ে আছে। আমাকে ওর ভাল লাগতে না পারে, কিন্তু আমাকে দেখে ওর ব্রেসিযার-পরা বুকে শাড়িটা অন্তত জড়িয়ে নিতে পারত।
চলো, এই কাঠের সিঁড়িটা দিয়ে চিলেছাদে উঠবে? হু-হু করে হাওয়া ধাক্কা মারবে।
কী ব্যাপার, মনে হচ্ছে তোমার কথাটা বলার জন্য যেন পৃথিবীর সব চেয়ে উঁচু জায়গা দরকার?
হ্যাঁ, সে-কথা স্বর্গে দাঁড়িয়ে বলা উচিত।
আশা করি তুমি এখন বলবে না, তুমি আমাকে ভালবাসো?
ছায়াদি থতমত খেয়ে আমার চোখে চোখ রাখল। তারপর খাদে গলার স্বর নামিয়ে বলল, তুমিও বুঝি প্রাণপণে হৃদয়হীন আধুনিক হবার চেষ্টা করছ বিমলেন্দু?
না, তা নয়, তুমি বলার আগে আমি বলতে চাই। পৃথিবীর দিন এসে গেলেও একটি মেয়েকে আমি ভালবাসি, একথা বলায় কোনও আধুনিকতা নেই। ছায়াদি, তুমি আমার কাছে কী চাও?
আমি তোমার কাছে অমৃত চাই।
আমার কাছে অমৃত নেই। সামান্য ভালবাসা আছে।
না, ইয়ার্কি নয় বিমলেন্দু, আমি সত্যি তোমাকে কিছু জানাতে চাই।
আমি ইয়ার্কি করছিনা, আমি প্রাণ থেকে বলছি।
ওকথা থাক। আমি অনেককে জানি, কিন্তু তোমাকেই আমার সব চেয়ে আপন লোক মনে হয়। কারুকে না বলে আমি আর পারছি না বিমলেন্দু, আমি আর বেশি দিন বাঁচবনা।
সে তো আমরা কেউ-ই আর বেশি দিন বাঁচবনা। মানুষ জাতটাই ধ্বংস হয়ে যাবে।
না, সেকথা নয়, অসুখ। আমার লিউকোমিয়া হয়েছে।
লিউকোর্ডামা? ও আবার একটা অসুখ নাকি?
লুইকোডার্মা নয়, লিউকোমিয়া। এ অসুখ হলে মানুষ বাঁচে না। রক্তের শ্বেত কণিকাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। যাকে বলে ব্লাড ক্যানসার। এর কোনও চিকিৎসা নেই। চলো, তোমাকে ডাক্তারের রিপোর্ট দেখাচ্ছি। ডাক্তার বলেছে, আমি আর বড় জোর বছর খানেক।
ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে কেন হঠাৎ?
হঠাৎ নয়, আজ ছমাস ধরে যাচ্ছি। তুমি যে-দিন আমার শ্বেতির দাগধরা ঠোঁটে আদর করলে, সেদিনই মনে হল শ্বেতি দাগটা না সারিয়ে দিলে আমরা চলবে না। কারণ তোমার ঠোঁটে সেদিনই একটা চাপা অহঙ্কার দেখতে পেয়েছিলাম। অহঙ্কার এই জন্য যে, তোমার মন এত বড়, তুমি ওসব দাগ-টাগ ঘেন্না করো না, এটা দেখাতে পারলে। কেন, তোমাদের কাছে আমি এ-রকম ছোট হয়ে থাকব? জন্ম থেকে আমার শ্বেতি, তোমার নেই কেন?
তোমার ভুল ধারণা।
আমার সারা শরীর শির শির করে, জ্বালা করে। তাই ডাক্তারের কাছে—
আজ থাক, এই সন্ধেবেলা ওসব কথা আমার ভাল লাগে না। চলো নিচে যাই।
না, তোমাকে শুনতেই হবে। আমি আর সময় পাব না।
কী ছেলেমানুষি করছ, চলো নিচে।
না, বিমল, শোনো।
না, নিচে চল। নিচে। আমার বড় অস্বস্তি লাগছে। আমার তেষ্টা পেয়েছে।
ছায়াদি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি এগিয়ে ওকে স্পর্শ করলাম। ওর সারা শরীরে যেন কোনও স্পন্দন নেই। আমি হাত ধরে নিচে নিয়ে এলাম। যেন ওর পায়ের তলায় চাকা লাগানো, সমস্ত শরীরটা অস্থিহীন, বাসনা বা প্রতিরোধ নেই, নেমে এল নিচে।
.
রাত্তির সাড়ে দশটার মধ্যেও অবিনাশ ফিরল না মায়াকে নিয়ে। এর মধ্যে আবার গন্ধ শুঁকে শুঁকে হাজির হয়েছে শেখর আর অম্লান। হইহই ও চিৎকারে কান পাতা যায়নি এতক্ষণ। শেখর কাচের গ্লাস ভেঙেছে, অম্লান হাতের তাস ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে জানালা দিয়ে, তাস অদৃশ্য করার ম্যাজিক দেখাবার ভান করে। এখন কী চেহারা হয়েছে ঘরটার। অসংখ্য পোড়া সিগারেটের, চুরুটের ছাই, কাপ উলটে চা পড়েছে বিছানা ও চাদরে, শ’খানেক দেশলাইয়ের কাঠি, তাপসের কানে একটা মরা প্রজাপতি। ওটার উপর যতবার আমার চোখ পড়েছে আমি চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছি। প্রজাপতি নয়, হয়তো মথ, যেগুলো রাত্রে ওড়ে। হলুদও কালোয় মেশানোদুই ডানা মেলে ওটা পড়ে আছে। একটু আগেহঠাৎ উড়তে উড়তে ঘরে এসেছিল। সারা ঘরটা যখন পাক দিচ্ছিল অন্ধের মতো, তখন আমাদের সকলের চোখগুলি ছিল ওর পিছনে। আবার কাকে দল থেকে খসাতে এসেছেরে ওটা! পরীক্ষিৎ বলেছিল, কার হলুদ খামে ঝাঁপিয়ে পড়বে মানিক।
বেশ সুন্দর দেখতে রে পোকাটাকে, যা ছায়ার কপালে গিয়ে বোস। ওর যে বয়স পেরিয়ে গেল।
এই তাপস, আমি তোর চেয়ে বয়সে ছোট জানিস, ছায়াদি চেঁচিয়ে উঠল। হেমকান্তি একদৃষ্টিতে ওকে দেখছিল। মাথা ধরার জন্যই কিনা, ওর দু’চোখ অসম্ভব লাল, দুই বিস্ফারিত চক্ষুতে প্রজাপতি দেখছিল হেমকান্তি। হঠাৎ ওটা ঝপ করে উড়ে বসল তাপসের গায়ে। এ কী রে, এ কী, উঃ বলে আরশোলা গায়ে বসলে কোনও কোনও মেয়ের ভঙ্গির মতো ছটফট করে উঠল তাপস। একঝটকায় ওটাকে গা থেকে ফেলে দিল। সেইটুকুই যথেষ্ট ছিল, প্রজাপতিটা স্থির হয়ে পড়ে রইল।
এ কী, মেরে ফেললি নাকি? পরীক্ষিৎ আলতো ভাবে ওর হাতের চেটোয় তুলে নিল, তারপর নিজের দৃষ্টি যেন ওর শরীরে মধ্যে ঢুকিয়ে দেখে বলল, না, শেষ হয়ে গেছে। ওটাকে ফেলে দিয়ে আবার অন্য কথাবার্তা বলতে লাগল। তারপর থেকে আমরা ওটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। খানিকক্ষণ বাদে চুরুট ধরাবার সময় অন্য মনস্ক ভাবে পরীক্ষিৎ দেশলাইয়ের কাঠিটা ছুঁড়ে দিতেই সেটা গিয়ে পড়ল ওর ছড়ানো ডানায়, দপ দপ করে জ্বলতে ও কাঁপতে লাগল আগুনের ছোট্ট শিখা, ধোঁয়া উঠতে লাগল সেখান থেকে। ওরা কেউ লক্ষ্য করেনি। আমি খুব চুপিচুপি যেন কেউ দেখতে না পায়– যেন কোনও খুব অন্যায় করতে যাচ্ছি, এইভাবে কাঠিটা আস্তে তুলে অন্য জায়গায় ফেলে দিয়েছিলাম।
নাঃ, ভাল লাগছে না, বাড়ি যাই। পরীক্ষিৎ বলল। ওর শরীর যথেষ্ট খারাপ দেখায়, তবু কী করে ঘুরে বেড়ায়, কে জানে! মাথা ফাটিয়েছে ব্রিজ থেকে নদীতে পড়ে গিয়ে, তারপর কেউ আবার বেঁচে ওঠে, একথা কখনও শুনিনি। ও বলেই বেঁচেছে।
শুধু তাই নয়, ব্রিজ থেকে নদীতে পড়ে যাওয়াও পরীক্ষিতের পক্ষেই সম্ভব। কী জানি ইচ্ছে করেই ঝাঁপ দিয়েছে কিনা, হয়তো প্রাণে বেশি কবিত্ব এসেছিল।
আমারও আর বসতে ইচ্ছে করছিল না। ছায়াদিকে বললাম, আজ যাই, কাল-পরশু তুমি আমার ওখানে আসবে একবার! আমিই যেতাম, কিন্তু তোমাদের অফিসের ওই ব্যানার্জি বড় বিশ্রীভাবে তাকায়।
তোমাকে যেতে হবে না। আমিই যাব।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে কাচের আলমারি খোঁজাখুঁজি করে দু’খানা পেপারব্যাক গোয়েন্দা উপন্যাস বেছে নিলাম।
এগুলো এখন কেউ পড়ছে নাকি? জিজ্ঞেস করলাম। ঘাড় নেড়ে ছায়াদি ‘না’ জানাল।
পরশু দিনের মধ্যে আমাকে ভাষাতত্ত্ব নিয়ে একটা লিখতে হবে, তার আগে এ-রকম কিছু হালকা বই না পড়লে আমার কিছুতেই মন বসে না।
তাপস, তুই এখন যাবি?
না, একটু অবিনাশের জন্য বসে যাই।
আপনি যাবেন নাকি পরীক্ষিৎবাবু?
অবিনাশের সঙ্গে আমার দরকার আছে। তাছাড়া টাকাটা নিয়ে গেল।
দেয়ালে পারিবারিক গ্রুপ ফটোগ্রাফের মধ্যে ফ্ৰকপরা মায়াকে দেখতে পেলাম। হঠাৎ মনে হল ওরা কী আজ সারা রাত এখানে বেলেন্না করবে?
ছায়াদি বোধহয় আপত্তি করবে না। কিন্তু মায়া থাকতে দেবে না কারুকে। মায়া এসব ব্যাপারে খুব কঠিন, হয়তো তার কারণ মায়ার কবিতা লেখার রোগ নেই।
আমি যাব, দাঁড়ান। হেমকান্তি উঠে দাঁড়াল। যেন ওর বিষম দরকার, এখুনি না গেলে চলবে না। অথচ আমি জানি, আমাদের মধ্যে যে-কোনও এক জন যদি যাবার কথা না বলত, তবে হেমকান্তি এখানেই অনন্তকাল বসে থাকত।
আরেকটু বসে যা বিমলেন্দু, আমি যাব। শেখর বলল।
তুই তো অন্য দিকে। আমি যাই।
বোস না, তোকে এগিয়ে দেব এখন।
কত দূর এগিয়ে দিবি?
নরক পর্যন্ত।
ওদের ফেলেই আমি আর হেমকান্তি বেরিয়ে এলাম। বাইরে বিষম ঠাণ্ডা। মোড়ের দোকান থেকে সিগারেট কিনলাম। আপনার মাথা ধরা কমেছে?
হেমকান্তি ওর সুন্দর, বিষণ্ণ মুখ আমার দিকে তুলে বলল, না। হেমকান্তির মতো রূপবান যুবা আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে তো নেই-ই, দেখেছিও খুব কম। আমার চেয়েও প্রায় আধ হাত লম্বা, চৈতন্যদেবের মতো গায়ের রঙ, ছিপছিপে শরীর, কপালের ওপর জোড়া ভুরু। অথচ মেয়েরা হেমকান্তিকে পছন্দ করে না। অবিনাশের চেহারা গুণ্ডার মতো, একমাথা চুল, চাপা নাক, তবুঅবিনাশ ললনাপ্রিয়। হেমকান্তির কী অসুখ আমি জানি না, সব সময় চুপ করে থাকে, কথা বলতে চায় না, অথচ বন্ধুবান্ধবদের সংসর্গ ভালবাসে। যে-কোনও আড্ডায় আসা চাই, শেষ পর্যন্ত চুপ করে থাকবে, না জিজ্ঞেস করলে একটাও মন্তব্য করে না। চরম উত্তেজনা, বিষম তর্কাতর্কির মধ্যেও হেমকান্তি নিঃশব্দ। এমন যখন ওর স্বভাব তখন ও একা থাকলেই পারে, কিন্তু কে বলবে, চাকরি-বাকরি করে না, তবু বাড়ির অবস্থা বোধহয় অসচ্ছল নয়। বাড়ির লোকেরা ওর এই অদ্ভুত জীবন কী করে সহ্য করে বুঝি না! ওর এই রকম নম্রভাবে চুপ করে থাকা আমারও বিরক্তিকর লাগে।
সব চেয়ে মজা হয় মেয়েদের সঙ্গে। যখন মেয়েরা থাকে, স্বভাবতই রূপবান হেমকান্তির দিকে তাদের বেশি কৌতূহল। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও মেয়ের দিকে তাকায়নি, কথা বলেনি, প্রশ্ন করলে এক অক্ষরে উত্তর দিয়েছে। মেয়েরা এখন ওকে নিয়ে প্রকাশ্যেই হাসাহাসি করে। মায়া ওকে একদম সহ্য করতে পারে না। হেমকান্তি সম্বন্ধে গভীর বিতৃষ্ণা মায়ার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে, আমি দেখেছি।
অনেকক্ষণ পাশাপাশি চুপ করে হাঁটবার পর হেমকান্তি আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি…বাড়ি ফিরবেন?
হ্যাঁ, আমি বললাম, কেন, আপনি ফিরবেন না!
ঠিক ইচ্ছে…আমার মায়ের খুব…অসুখ। হেমকান্তি দাঁড়িয়ে পড়ল।
তার মানে? অসুখ বলেই ফিরবেন না? কী-রকম অসুখ?
খুবই…বলা যায় ।
আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম হেমকান্তির অবস্থা। সকলে বিষম ব্যস্ত, উৎকণ্ঠা, ডাক্তার আসা যাওয়া করছে। হেমকান্তি চুপ করে সারা দিন বসে আছে নিজের ঘরে, অথবা সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে সকলের ব্যস্ততা দেখছে। তার নিজের কিছুই করার নেই, কেউ তাকে ডাক্তার ডাকতে বলবে না, ওষুধের দোকানে পাঠাবে না। জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসেও ওর মা যদি একবার আকুল ভাবে ডেকে ওঠেন, হেম, কোথায়, হেমকে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে, হেম –তখনও হেমকান্তি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভাববে সাড়া দেবে কি না, জোরে কথা বলতে হবে না ফিসফিসিয়ে, মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াব না হাঁটু মুড়ে বসব, কপালে হাত রাখবনা কাঁদপ পা ছুঁয়ে, এ-সব বিপুল সমস্যার বদলে বাড়ির বাইরে থাকাই ভাল –হেমকান্তি ভাবে নিশ্চিত। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। অনেক পোষা কুকুরের মুখের দিকে মাঝে মাঝে তাকালে যেমন মনে হয়, মানুষের ভাষায় কথা বলার জন্য বেদনা জেগে উঠছে তাদের মধ্যে, হেমকান্তির মুখেও সেই বেদনা। যেন ও মানুষদের ভাষা জানে না।
আমি হেমকান্তিকে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, কী বলছেন? খুব বেশি অসুখ নাকি? এতক্ষণ কিছু হয়ে যায়নি তো?
জানি না।
আমার বিষম ভয় হল। হেমকান্তি বোধহয় মায়ের মৃত্যুর সময়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। এতক্ষণ কিছুই জানায়নি।
শিগগির চলুন বাড়ি। আমি যাচ্ছি আপনার সঙ্গে।
কয়েক পা এগিয়েই হেমকান্তি আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, না, আপনি…মানে..আমি একাই যাই। এ-সব জিনিস দু’জনে ভাগ করে নেওয়া যায় না।
হেমকান্তির বাম বাহু জোর করে চেপে আমি ছুটে চললাম। কাছেই সাদার্ন রোডের মুখটায় বাড়ি।
বাড়ির সদর দরজা হাট করে খোলা। সদরের সামনে খোলা জায়গাটায় চড়া পাওয়ারের আলো। রাস্তায় বিপুল জ্যোৎস্না আজ। সুতরাং কাছের ইলেকট্রিকের আলো আর জ্যোৎস্না এক জায়গায় মিশেছে। আমি তৎক্ষণাৎ সেই মিশ্রিত আলোর মধ্যে মৃত্যুর গন্ধ পেলাম। কোথাও কোনও শব্দ নেই। ভেতরে ঢুকে সিঁড়িতে পা দিলাম দুজনে। এ বিষয়ে আমার অনুভূতি একেবারে নির্ভুল। আমি জানি, হেমকান্তির মা আর বেঁচে নেই। এই নিস্তব্ধতা, সিঁড়ি কিংবা দেয়াল–এর যে-কোনও একটা দেখলেই এই মুহূর্তে মৃত্যুর কথা বুঝতে পারা যায়। যে-বাড়িতে মৃত্যু হয়, সে-বাড়িরই দরজা সে-রাত্রে হাট করে খোলা থাকে, আমি দেখেছি। কেন? চোর-ডাকাতের কথা তখন মনে থাকে না কারুর? কেন? মৃত্যুর থেকে আর বড় চুরি হয় না এই ভেবে? যাই হোক, মৃত্যুর বাড়িতে কখনও চুরি হয়েছে আমি শুনিনি। সে-বাড়ির দরজার একটা পাল্লা ভেজানো পর্যন্ত থাকে না। দুটো দরজাই সম্পূর্ণ খোলা থাকে, আমি বার বার লক্ষ্য করেছি। হঠাৎ আমার মনে পড়ল, আমার বাড়িতে ভাত ঢাকা দিয়ে মা আমার জন্য জেগে বসে আছে। আমি কেন এত দেরি করছি। আর কোনও দিন দেরি করব না। কিন্তু এখন তো হেমকান্তিকে ফেলে চলে যাওয়া যায় না।
দোতলার বারান্দায় উঠতেই দেখা গেল তিন জন দামি পোশাক-পরা ভদ্রলোক দ্রুত বেরিয়ে আসছেন একটা ঘর থেকে। হেমকান্তিকে দেখেই তারা থমকে দাঁড়ালেন।
এ কী, তুমি শ্মশানে যাওনি? সারা কলকাতা খোঁজা হচ্ছে তোমাকে!
তাঁদের কথার মধ্যে ভর্ৎসনার সুর ছিল না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমার বুক মুচড়ে উঠল। হেমকান্তি মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল।
চলো, আমাদের গাড়ি আছে, শ্মশানে যেতে হয়, জুতো খোলা! সেই তিন জনের মধ্যে এক জন খুব নরম গলায় বললেন।
মামাবাবু, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি শ্মশান দেখতে পারি না।
সেই ভদ্রলোক কাছে এসে হেমকান্তিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, তারপর বুকের মধ্যে অনেকখানি হাওয়া টেনে নিয়ে হু-হু করা গলায় বললেন, তোকে আমি কী আর বলব হেম, চল, যেতে হয়। যে গেল সেছিল আমার দিদি, তোর মা। তোকে সান্ত্বনা দিতে পারব না আমি। চল, হিন্দুধর্মের নিয়মগুলো মেনে দেখ, দুঃখ-কষ্ট আপনি কমে যাবে।
আমি হেমকান্তির মুখের দিকে ভাল করে খুঁজে খুঁজে দেখলাম। সাদা পাথরের মূর্তির মতো স্পন্দনহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কী জানি কী-রকম দুঃখ-কষ্ট ওর চোখে-মুখে যার কোনও চিহ্ন ফোটে না। হঠাৎ হেমকান্তিকে আমার অত্যন্ত নির্লজ্জ রকমের বিলাসী পুরুষ বলে মনে হল।