সপ্তম পর্ব – দ্য গ্রেট ওয়াল
৪৯. ঈশ্বরের জন্য
বিল টি থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে তাদের ছোট্ট গ্রানাইট ল্যান্ডিং প্যাডে জড়ো করতে করতে ক্রিস ফ্লয়েড মাথার উপর জ্বলতে থাকা পাহাড়টাকে ট্যারা চোখে একবার দেখে নেয়। এভারেস্টের চেয়ে বড় একটা, মাত্র একটা ডায়মন্ড! এই ছড়ানো ছিটানো টুকরাগুলি নিশ্চই লাখ ভাগের এক ভাগ নয়, বিলিয়ন ভাগের এক ভাগই হবে…
অন্যদিকে, তারাও নিশ্চই পুরোটার তুলনায় এতোটুকুই হবে।
এমিতে হীরের দাম সব সময় উৎপাদক আর বিক্রেতারা চড়িয়ে রাখে আকাশের গায়ে। যদি এই সময় এমন একটা হীরা-পর্বত বাজারে নামে, তাও আবার জেম ডায়মন্ড-নিশ্চই হীরা-ব্যবসা পাতালে ধসে পড়বে… কোনো সন্দেহ নেই।
এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কেন তাদের ইউরোপা অভিযানে এতোগুলো দল খাবলাখাবলি করেছে এতোদিন! এ্যাদ্দিন রাজনৈতিক আর আর্থিক পার্টিগুলোর নাক গলানোর কোনো শেষ ছিল না।
নিজের তত্ত্ব প্রমাণ করার পর আবার ভ্যান ডার বার্গ চিরাচরিত নিরামিশাষী বিজ্ঞানী হয়ে গেল। এখন আর তার গবেষণায় কোনো বাধা দু চোখে দেখতে পারবে না।
শাটল থেকে অনেক কষ্টে একটা পোর্টেবল ড্রিল নামিয়ে এনে মিটারখানেক এলাকা ছিদ্র করল তারা। কাজটা করতে ভ্যান ডার বার্গ বেশ বেগ পেয়েছিল। কারণ এবার আর ক্রিস ফ্লয়েড তেমন কোনো সহায়তা করতে রাজি ছিল না। কিন্তু কাহাতক অন্যের কষ্ট দেখা যায়-সেও হাত লাগালো একটু পরে। তারপর আবার জিনিসটা সযত্নে তুলে রাখল শাটলের ভিতরে।
ফ্লয়েড বেশ কিছু কাজে প্রাধান্য পেলেও দেখা যাচ্ছে মরার প্রাধান্যের কারণে কঠিন কাজগুলো আগ বাড়িয়ে নিজেকেই করতে হয়। একটা সিসমোগ্রাফ ঠিক করার এবং টিভিটা ট্রাইপডে বসানোর আগে সে চারদিকে ছড়ানো বহুমূল্য রত্নগুলোর কয়েকটা বগলদাবা করে নিল।
একেবারে যদি নাও হয়, সাবধানে কম ক্ষতিকর কয়েকটা টুকরো নিতে নিতে বলল, জিনিসগুলোকে ভাল স্যুভেনির হিসেবে রাখা যাবে।
যদি রোজির বন্ধুরা এগুলো পাওয়ার কারণে মেরে না ফেলে আমাদের।
তীক্ষ্ণ চোখে ভ্যান ডার বার্গ তার সতীর্থের দিকে চেয়ে থাকে। তার মনে একটা চিন্তাই ঝড় তুলছে, ক্রিস কতোটা জানে… কতোটা জানে বাকীরা?
এখন রহস্য খুলে যাওয়াতে বলতে আর কোনো দ্বিধা নেই। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে স্টক এক্সচেঞ্জের কম্পিউটারগুলো পাগলা ঘোড়ার মতো দৌড়ে বেড়াবে।
বেজন্মা কুত্তা! সাথে সাথে গাল দিল ফ্লয়েড, ঘৃণার চেয়ে উৎসাহ বেশি ঝরে পড়ছে তার কণ্ঠে, তো, এ-ই তোমার মেসেজের সারাংশ?
“একজন বিজ্ঞানী আর্থিক বাজারে লাভবান হতে পারবে না এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে কোন্ কালে? তাই পৃথিবীতে আমার বন্ধুর কাছে খবরটা দিয়ে দিলাম, ব্যস। কিন্তু বিশ্বাস কর আমার কথা, এই কাজেই আমি বেশি আনন্দ পাইযেমনটা আর সব বিজ্ঞানবিদের ক্ষেত্রে হওয়া উচিৎ। রেঞ্জটা দিবে, প্লিজ?
জিউস স্টেশন বসানোর আগে তিন তিনবার তাদের পা কেঁপে গেল মহা ভূকম্পনে। প্রথমে পায়ের নিচে একটু মৃদু আন্দোলন, তারপর সবকিছু কাঁপা শুরু করে-সবশেষে অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়ে একটা লম্বা গর্জন ভেসে আসে। কোনো নির্দিষ্ট দিক থেকে নয়, বরং সবদিক থেকে।
এমনকি মাঝেমধ্যে শব্দটা আকাশ থেকেও হয়! কী অবাক ব্যাপার! ফ্লয়েড ভেবে কোনো ব্যাখ্যা পায় না। এম্নিতে তার বিশ্বাস নেই যে এখানকার পাতলা আবহাওয়ায় বাতাসে ভাসিয়ে কোনো কথা বলা সম্ভব। সেখানে কিনা হুঙ্কার!
ভ্যান ডার বার্গ সারাক্ষণ তাকে বোঝাচ্ছে, এগুলো এখনো তেমন ক্ষতিকর পর্যায়ে যায়নি। কিন্তু একটা শিক্ষা পেয়েছে ফ্লয়েড। কখনো সে এক্সপার্টদের কথায় বেশি ভরসা করে না। সত্যি, সে বিল টির শক এবজর্ভিং সিস্টেমকে দেখল টালমাটাল হয়ে সামলে নিচ্ছে পরিস্থিতি। খেয়া নৌকাটাকে যেন আকাশে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছিল। তারপরও সামলে নিচ্ছে কী করে কে জানে!
মনে হচ্ছে হয়ে এল! অবশেষে বলল বৈজ্ঞানিক, অবশেষে। এবং সাথে সাথেই ফ্লয়েড স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল জোরে।
সব চ্যানেল থেকে গ্যানিমিড এখন অপার তথ্য পাচ্ছে। এই ব্যাটারিগুলো হাজার বছর ধরে টিকে যাবার কথা, লুসিফারও সব সময় সোলার প্যানেলকে আলো দেবে, বাকীটা আল্লা মালুম।
গিয়ার যদি সপ্তা খানেকের বেশি টিকে যায় তো আমি অত্যাশ্চর্যান্বিত হব। বাজি ধরতে রাজি আছি, ল্যান্ড করার পরও পর্বতটা অবস্থান বদলেছে; আমাদের উপর পড়ে যাবার আগে চলো ভালোয় ভালোয় ভাগি।
আমার দুঃখ আরো বেশি, ক্রিস। হাসছে ভ্যান ডার বার্গ, তোমার জেটের আঁচে এই সব কষ্ট বানচাল হয়ে যাবে।
তাতে কীবা এসে যায়? আপনা পরাণ বাঁচাতে পারছি তো! ব্যস। তার উপর এত আবর্জনা উগরে দিয়েছি যে এখন উড়াল দিতে বড়জোর আগের অর্ধেক শক্তি লাগবে। অবশ্য তুমি যদি আরো কয়েক বিলিয়ন… নাকি ট্রিলিয়ন? তুলতে চাও…
হিংসুটে কেন তুমি এত? কিন্তু পৃথিবীতে নিয়ে কী লাভ হবে কে জানে! প্রথমেই জাদুঘরগুলো কেড়ে নিবে বেশিরভাগ, তারপর কটা বাঁচবে আর তা দিয়ে কী করা যাবে এখনি বলতে পারব না।
গ্যালাক্সির সাথে কথা আদানপ্রদানের কারণে কন্ট্রোল প্যানেলে ফ্লয়েডের হাত উড়ে বেড়াচ্ছে।
মিশনের প্রথম ধাপ শেষ। বিল টি উড়তে প্রস্তুত। আগের কথামতোই ফ্লাইট প্ল্যান ঠিক করা থাকল।
ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাসের জবাব শুনে তারা মোটেও অবাক হয়নি।
নিশ্চিত ভো, সামনে যেতে চাচ্ছেন? মনে রাখবেন, আপনাদের হাতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। আমি শুধু সাপোর্ট দিব।
ইয়েস স্যার, আমরা দুজনেই মহাখুশি। বোঝাই যাচ্ছে বাকী ক্রুদের মানসিক অবস্থা কেমন। আর বৈজ্ঞানিক লাভ যে কী হবে সেটা পরে বলব, এখন দুজনেই আমরা উত্তেজিত।
একটু সবুর করুন, আমরা কিন্তু এখনো মাউন্ট জিউসের উপর আপনার রিপোর্ট পাবার অপেক্ষায় আছি।
একবার ফ্লয়েড চোখ বুলিয়ে নিল ভ্যান ডার বার্গের মুখের উপর, কাঁধ ঝাঁকিয়ে তুলে নিল মাইক্রোফোন।
এখনি বলে দিলে, ক্যাপ্টেন, আপনি আমাদের স্রেফ পাগল ভাববেন। ব্যস। প্রমাণসহ ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই তো আসছি, ধৈর্যটা ধরা যায় না?
হুম! আদেশ করে শুধু শুধু আপনাদের মনোযোগ নষ্ট করার কোনো মানে হয়, কী বলেন? যাই হোক-গুড লাক। বিশেষত স্বত্বাধিকারীর পক্ষ থেকেও শুভেচছা-তিনি খুশি হয়েছেন জিয়াংয়ের কাছে যাবার কথা শুনে না। লরেন্স অনুমতি দেবেই, ফ্লয়েড নিজের মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়ে। বলল, লুসিটা কে, বলতো একটু, রালফ ভায়া…
আমিও ঠিক চিনি না। আসলে নামটা বের করেছি কম্পিউটার সার্চ করে। ভাবলাম, সবাই সাথে সাথে লুসিফারের সাথে তালগোল পাকিয়ে ফেলবে, সেইসাথে আমরাও সন্দেহের বাইরে থাকব, এই আর কী! এম্নিতেও, সেটাতো এখানে আছেই, লুসি ইজ হেয়ার…
“আমি তাদের নাম শোনার কোনো আশা দেখিনি। হাজার হলেও, শত বছর আগে একটা বিখ্যাত গাইয়ের দল ছিল, নাম হল বিটলস। কিম্ভূত নাম। জিগগেস করো না কেন এমন ছন্নছাড়া নামের জন্ম হল। তাদের একটা মজার গান আছে, লুসি ইন দ্য স্কাই উইথ ডায়মন্ডস। অদ্ভুত, না? যেন তারা ঠিক ঠিক জানতো…
.
গ্যানিমিডের রাডার অনুসারে, জিয়াংয়ের ভাঙা অংশ পড়ে আছে মাউন্ট জিউসের তিনশো কিলোমিটার পশ্চিমে। আঁধার রাজ্যের কাছাকাছি কোথাও। পেছনে তাপহীন জগৎ। জায়গাটা পুরো ঠাণ্ডা হলেও একেবারে অন্ধকার নয়। অর্ধেক সময় সেখানে ভাল প্রতাপ নিয়ে দূরের সূর্য জেগে থাকে। এমনকি ইউরোপার সেই লম্বা সৌর দিনের পরও তাপমাত্রা শূন্যের অনেক অনেক নিচে থাকে সবসময়।
তরল পানি শুধু লুসিফারের দিকে মুখ করা দিকেই পাওয়া যায়। ইউরোপার অন্যদিকে শুধু বরফ, তাই এই গোধূলী এলাকা সারা বছর তীব্র ঝড়ে কাবু হয়ে থাকে।
সেখানে, সেই আলো আঁধারির মিলনমেলায় বৃষ্টি আর তুষাররা ঝগড়া করে মরে দিনমান।
পঞ্চাশ বছর আগে এখানেই কোথাও কিংবদন্তীর জিয়াং ক্র্যাশ করেছিল। কিন্তু সেই কোথাওটা হাজার কিলোমিটার সরে গেছে। শিপটা নিশ্চই গ্যালাক্সির মতো ভেসে গিয়ে ঠেকেছে বরফের রাজ্যের পাশে। এই শত্রুসুলভ শীতল-আঁধার প্রান্তে এসে ভিড়েছে অনিবার্যভাবেই।
এ দুনিয়াটার কেন্দ্রীয় সাগরের দ্বিতীয় ঠোঁটের পাশে আসার সাথে সাথে বিল টি রাডারে প্রতিধ্বনি টের পেল। এতো বড় জিনিসের তুলনায় প্রতিধ্বনি একেবারে
ক্ষীণ। মেঘ ভেঙে নামার সাথে সাথেই বুঝতে পারল কেন এমন লেগেছিল।
বৃহস্পতির কোনো উপগ্রহে আসা মনুষ্যবাহী প্রথম স্পেসশিপ জিয়াং এর ধ্বংসাবশেষ একটা ছোট, গোলাকার হ্রদে আটকে আছে। হ্রদটা অবশ্যই কৃত্রিম। সাগরের সাথে একটা ছোট নালা দিয়ে যুক্ত। সাগর থেকে তিন কিলোমিটারও হবে না দূরত্ব। শুধু কঙ্কালটাই টিকে আছে। তাও পুরোটা নেই। অনেক কিছুই চেঁছে পুছে সাফ করা।
কিন্তু করলটা কে? নিজেকেই প্রশ্ন করে ভ্যান ডার বার্গ।
এখানে জীবনের কোনো চিহ্ন নেই। জায়গাটা যেন অনেক বছর ধরেই পরিত্যক্ত। বোঝাই যাচ্ছে কিছু একটা শিপটাকে এখানে রেখে ব্যবচ্ছেদ করেছে একেবারে চিকিৎসকদের মতো।
ল্যান্ড করা একেবারে নিরাপদ। বলল ফ্লয়েড, তারপর অপেক্ষা করল ভ্যান ডার বার্গের কাঙ্ক্ষিত সায় আসার আশায়। বিজ্ঞানী সবকিছু ভিডিও করছে, মাথা নাড়ল সামান্য, অন্যমনস্কভাবে।
বিল টি বিনাশ্রমে ছোট্ট পুলটার পাশে ল্যান্ড করে। আর তারা আনমনা চোখে মানুষের কীর্তির স্মৃতি সৌধ দেখে শীতল, কালো জলের এপাড় থেকে। ধ্বংসাবশেষটার কাছে যাবার কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না-তাতে তেমন চিন্তি ত মনে হল না ছোট্ট যানটার দু কুকে।
নেমে ক্যামেরায় দৃশ্যগুলো ধরে নিল। তারপর গ্যালাক্সি থেকে ভেসে আসা উল্লাসধ্বনিতে চমকে উঠল দারুণভাবে।
কী চমৎকার করে বানিয়েছে শিপটাকে! এখন ধাতব গড়ন ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না, তবু বোঝা যায় বেশ। তারপর, ধাতু-কাগজ-প্লাস্টিকে বানানো লিপি আর ফুল পাঠিয়ে দিল শিপের উদ্দেশ্যে। লেখাগুলো রোমান অক্ষরে উল্কীর্ণ; আধুনিক সভ্যতার প্রথমদিকে যে ভাষা দুনিয়াকে এক করেছিল-সে ভাষায়।
বিল টির দিকে ফিরতে ফিরতে ফ্লয়েড আনমনে বলল, দেখেছ নাকি, বাস্তবে সেখানে কোনো ধাতুই ছিল না। কাঁচ, প্লাস্টিক আর সিন্থেটিকের আখড়া।
তাহলে রিব আর সাপোর্টিং গার্ডারগুলো?
যৌগ, ঠিক ধাতব নয়। বেশিরভাগই কার্বন আর বোরন। এখানকার কেউ নিশ্চই খুব ধাতুখেকো। তার উপর ধাতু দেখেই বুঝতে পারে, পারে চিনতে, ইন্টারেস্টিং …।
ভেরি, ভাবল ভ্যান ডার বার্গ। যে দুনিয়ায় আগুনের জন্ম হয়নি সেখানে ধাতু আর এ্যালয় গড়ার প্রশ্নই ওঠে না। ধাতুর দাম অবশ্যই… হীরার মতো হবার কথা। সেখানে কী করে ধাতুখেকো থাকতে পারে…।
বেসে রিপোর্ট করার পর সেকেন্ড অফিসার চ্যাঙের সম্ভাষণেভরা ফিরতি খবর পেয়ে দারুণ উৎসাহিত হয়ে উঠল তারা। ফ্লয়েড বিল টি কে হাজার মিটার উঠিয়ে নিয়ে পশ্চিমমুখো যাত্রা করল।
“লাস্ট ল্যাপ। সে বলল, গেমের এ পর্যায়ে উপরে উঠলে কোনো পয়েন্ট নেই। মিনিট দশেকের মধ্যেই চলে যাব সেখানে। কিন্তু ভুলেও ল্যান্ড করছি না। গ্রেট ওয়ালটা আমরা যা মনে করেছি তা হয়ে থাকলে না যাওয়াটাই অনেক ভাল। চড়ুইয়ের মতো ফুড়ৎ করে একটু উড়ে যাব উপর দিয়ে, তারপর সোজা বাসায়। মরার ক্যামেরাগুলো রেডি করে রাখ। এটা মাউন্ট জিউসের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
তারপর, নিজেকে শুনিয়ে বাকীটা বলল, মনে মনে, দ্রুত দেখা যাবে দাদা কী ভাবছিল… বেশিদূরে নয়, মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে। দেখা হলে গল্পের কোনো অভাব হবে না। আর এক হপ্তাও নেই, যদি সব ঠিকঠাক চলে তো।
৫০. উন্মুক্ত নগরী
কী ভয়ঙ্কর স্থানরে বাবা! ভাবল ক্রিস ফ্লয়েড। চলমান হিমবাহ, তুষারের ঘূর্ণি, ভূমির চকিত দেখা পাওয়া আর… এই তুলনায় স্বর্গ তো এক আস্ত বেহেস্ত। নাতিশীতোষ্ণ চমৎকার আবহাওয়া সেখানে।
জানে, এরচে অনেক খারাপ হাল রাতের প্রান্তে। আর মাত্র কয়েকশো কিলোমিটার দূরেই সত্যিকার দোযখ মুখ ব্যাদান করে তাকিয়ে থাকে সারা রাত। রাত আর ফুরায় না।
অবাক চোখে তারা দেখল, লক্ষ্যে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে পরিবেশ কেমন শান্ত হয়ে এসেছে। হারিয়ে গেছে মেঘের কুয়াশা, আর ঠিক সামনেই ভেসে উঠেছে কালো একটা বিশাল দেয়াল। প্রায় এক কিলোমিটার উঁচু; বিল টির উড়াল পথে সরাসরি দাঁড়িয়ে আছে, বুক চিতিয়ে।
জিনিসটা এত্তো বড় যে নিজেই একটা পরিবেশ আর আবহাওয়া গড়ে নিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্যে। চারপাশে বাতাস গুমরে মরছে শান্ত সুরে, ঠিক পাদদেশে একটা শান্ত, নিরাবেগ পরিবেশ। দেখে সাথে সাথেই বোঝা যায় যে এই কালো মনোলিথটা দূরের সূর্যের মলিন আলোয় নেয়ে গেলেও এটাই বৃহস্পতিকে একেবারে গিলে খেয়েছিল। পায়ের কাছে তূপ তূপ করে রাখা তুষার। দেখে কেন যেন পৃথিবীর মৌচাকের কথা মনে পড়ে যায়। কেন একথা মনে হয় কে জানে!
এক ধাপ এগিয়ে আছে ভ্যান ডার বার্গ, চিন্তার দিক দিয়ে।
ইগলু। বরফ-গম্বুজ। বলল সে সোৎসাহে, কতদূরের দুই পৃথিবীতে একই সমস্যা-একই সমাধান। আশপাশে পাথর ছাড়া কোনো গৃহায়ণ উপকরণ নেই, আর পাথর দিয়ে কাজ করে বাসা বাঁধা মুখের কথা না। বরফ নিয়ে বানানোর কাজে লো গ্র্যাভিটি নিশ্চই সাহায্য করেছে। কোনো কোনো ডোম তো বেশ বড়। কে জানে কারা বাস করে সেখানে…– ইউরোপা-দুনিয়ার এ প্রান্তে, এই ছোট্ট মহানগরীর অলি-গলিতে কোনো ব্যস্ত তার লক্ষণ নেই। আরো কাছে এসে তারা দেখতে পায় আদৌ পথ-রাজপথের কোনো অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না।
আচ্ছা! এ হল ভেনিস নগরী। বরফ-সৃষ্ট-জল-শহর। বলল ফ্লয়েড তুষ্টির সাথে, একটা ব্যাখ্যা পেয়ে গেলেই মানুষ হাঁপ ছেড়ে বাঁচে, এখানে রাস্তা বলতে খাল, বাসা বলতে ইগলু।
ঠিক ভেনিস না। ভেনিস আর গ্রিনল্যান্ডের শংকর। প্রাণীগুলো উভচর। মুখ খুলল ভ্যান ডার বার্গ, এমন পরিবেশ আশা করাই উচিত ছিল। গেল কোথায় জীবগুলো?
আমরা ওদের ভয় পাইয়ে দিইনি তো? বিল টির ভিতর থেকে বাইরের দিকটা বেশি শব্দ করে।
মুহূর্তের জন্য ভ্যান ডার বার্গ ভিডিও করা আর রিপোর্ট করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, গ্যালাক্সির সাথে কথা চালাচালির এক পর্যায়ে বলল: এক আধটু যোগাযোগ না করে এ জায়গা ছেড়ে যাই কী করে? আপনাদের কথাই সত্যি হল-এটা মাউন্ট জিউস থেকে অনেক অনেক বড়।
অনেক অনেক ভয়ংকরও হতে পারে কিন্তু।
অগ্রসর প্রযুক্তির কোনো চিহ্নই নেই আশপাশে। কারেকশন-সামনে, সেদিকে একটা বিংশ শতাব্দীর রাডারের মতো কী যেন দেখা যাচ্ছে! আরেকটু কাছে যেতে পারবে, ক্রিসি?
তারপর গুলি খেয়ে মরি? না-বাবা, থ্যাঙ্কস। দূর থেকেই সালাম। তার উপর আমাদের হোভার টাইম ফুরানোর পথে। আর মাত্র মিনিট দশেক। যদি আবার তুমি বাড়ি ফিরতে চাও, তাহলে। না চাইলে আরো অনেক্ষণ ভেসে থাকা যাবে।
অন্তত একবার ল্যান্ড করে আশপাশটায় চোখ বুলাতে পারব তো? সামনে নাঙা পাথরের একটা টিবি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোন্ চুলায় লুকালো সবাই!
ভয়ে ঠ্যাঙ কাঁপছে নিশ্চই, আমার মতো। নীরস ফ্লয়েড একমনে বলে যাচ্ছে, ইউরোপান হবু-সভ্যদের আস্তানা দেখেও তার মনে যেন বিন্দুমাত্র আন্দোলন জাগেনি, নতুন কোনো আবিষ্কারের নেশা কী করে একজন স্পেস অফিসার পাবে? সে থাকবে গাণিতিক হিসাব নিয়ে। ন মিনিট বাকী। বসতির একপাশ থেকে আরেকপাশে একবার উড়ে যেতে পারি, ব্যস। যতটা পার ক্যামেরাবন্দী করে নাও। হু-গ্যাল্যাক্সি-আমরার ওকে-এখন একটু বিজি, এই আর কী!-একটু পর কল করছি–
এইমাত্র বুঝলাম, সেটা মোটেও রাডার ডিশ নয়। একই ধারার ইন্টারেস্টিং কিছু একটা হবে নিশ্চই। জিনিসটা সোজা লুসিফারের দিকে তাক করা-সোলার ফার্নেস! এটা সোলার ফার্নেস!
দেখেই অনেক কিছু বোঝা যাচ্ছে, এমন এক জায়গায় তারা বাস করে যেখানে আগুন ধরানো যাবে না। যেখানে সূর্য কখনো নড়ে না। এবং দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে অন্য পথ বের করতে অসুবিধা কই?
আট মিনিট। আফসোস, সবাই ঘরের দুয়ার দিয়েছে। খোল খোল দ্বার, রাখিও না আর বাহিরে আমারে ভাসায়ে…।
কিংবা ফিরে গেছে পানিতে। চারপাশের খোলা জায়গার ঠিক মাঝখানে বড় বিল্ডিংটা দেখেছ? বাজি ধরবে? এটাই টাউন হল।
অন্য সবগুলো থেকে বড়সড় একটা গড়নের দিকে তার আঙুল তাক করা। ডিজাইনটা পুরো ভিন্ন। খাড়া সিলিন্ডারের একটা সংগ্রহ বলা চলে। সভ্য দুনিয়ার অর্গান পাইপের মতো। তার উপর এটা আর সব ইগলুর মতো পুরো সাদা নয়, বরং গায় গায় নানা রঙের ফোঁটা ছড়ানো।
ইউরোপান শিল্প! যেন কেঁদে ফেলবে ভ্যান ডার বার্গ, এটা কোনো ধরনের দেয়াল-অঙ্কন। কাছে। আরো আরো কাছে! অবশ্যই রেকর্ড নিতে হবে!
অবশ্যই, ফ্লয়েড সাথে সাথে আরো নেমে গেল। আরো আরো। সে যেন তার আগে বলা সব কথা বেমালুম ভুলে গেছে, যেন তার সেই সময়জ্ঞান এখন আর নেই।
তারপর, হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে ভ্যান ডার বার্গ উপলব্ধি করল যে তারা ল্যান্ড করছে।
সাথে সাথে বিজ্ঞানী তার চোখ জোর করে তুলে নিল দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকা স্থাপত্যটা থেকে, তাকালো তার পাইলটের দিকে।
এখনো বিল টির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তারই হাতে, তারপরও, ফ্লয়েড যেন মোহাবিষ্ট হয়ে গেছে; নামতে থাকা আকাশ খেয়াটার সামনের বরাবর ভূমির দিকে তার দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ।
ক্রিস! ক্রিস, কী হল?
জবাব নেই কোনো।
কী করছ তুমি! দোহাই খোদার, জান? কী করছ তুমি!
অবশ্যই জানি। তাকে কি দেখনি নাকি?
কাকে দেখব?
ঐ লোকটাকে? সবচে বড় সিলিন্ডারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে যে! সে তো কোনো ব্রিদিং গিয়ার পরেনি।
ভোন্ট বি এন ইডিয়ট, ক্রিসি: কেউ নেই, কেউ নেই সেখানে…
তিনি মুখ তুলে তাকাচ্ছেন। তাকাচ্ছেন আমাদের দিকে। নড়ছেন তিনি-যতটুকু মনে হয় চিনতে-ও মাই গড!
কেউ নেই, কেউ নেই সেখানে! পুল আপ!
ফ্লয়েড তাকে পুরোপুরি অবহেলা করল।
তারপর, নামার ঠিক আগ মুহূর্তে বন্ধ করে দিল ইঞ্জিন, যেমনটা করার কথা। যখন নেমে এল বিল টি কে নিয়ে, সে এক্কেবারে শান্ত আর পেশাদার এক পাইলট।
খুবই শান্তভাবে সে ইনস্ট্রমেন্ট রিডিং দেখল, অন করল সেফটি সুইচগুলো।
সব কাজ সুচারুভাবে শেষ করে আরেকবার কি সে অবজার্ভেশন উইন্ডো দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল? হয়তো। তার মুখে তখন একটু বিভ্রান্ত শান্তির ছোঁয়া।
ভ্যান ডার বার্গ যদ্র দেখল, তাতে কারো দিকে না তাকিয়েই ক্রিস বলল একটা কথা।
হ্যালো, দাদু।
৫১. ভূত
সবচে ভয়াল দুঃস্বপ্নেও ভ্যান ডার বার্গ কখনো কল্পনা করেনি একটা একরত্তি স্পেস ক্যাপসুল নিয়ে আটকে পড়বে কোনো দস্যু এলাকায়; অচেনা ভুবনে; সাথি শুধু সদ্য পাগল হওয়া এক লোক!
ভরসার কথা একটাই, ক্রিস ফ্লয়েডের আচরণে কোনো ক্ষতিকর দিক দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এখানে নামিয়ে আনার চেয়ে ক্ষতিকর আর কী হতে পারে! ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নেও অবশ্য মানুষ কল্যাণের কথা ভাবে। সাহসী বৈজ্ঞানিক লোকটাও তাই আশা করছে ক্রিস যে কোনো সময় আবার উড়াল দেয়ার চেষ্টা করতে পারে… যেতে পারে গ্যালাক্সির দিকে…
এখনো সে চেয়ে আছে শন্যের দিকে। আর তার ঠোঁট নিরবে কথা বলেই যাচ্ছে কার সাথে যেন।
এখনো অচেনা বসতিতে প্রাণের কোনো স্পন্দন নেই। দেখে মনে হতেই পারে শতাব্দী আগেও এখানে কোনো প্রাণী ছিল না। আশপাশের তুষার-প্রলেপ অনেকটা সরে গেছে বিল টির জেটের ধাক্কায়। ছোট্ট চত্বরটায় এখনো বরফের গুড়া লেপ্টে আছে। এ যেন কোনো বই থেকে ছিঁড়ে নেয়া পাতা। কিছু লেখা আঁকাজোকা আছে, আর কিছু হায়ারোগ্লিফিক-এর কোনোটা সে পড়তে পারে, কোনোটা যেন দুর্বোধ্য, দুয়ে।
কোন ভারি জিনিস যেন এ পধ ধরে টেনে হিঁচড়ে আনা হয়েছে, নয়তো সেটা নিজের ক্ষমতায়ই এসেছে এখানে, এ পথ ধরে। একটা ইগলুর ভিতরে স্পষ্ট চলে গেছে চাকার দাগ। অনেক দূরে একটা কন্টেইনার দেখা যাচ্ছে, বোধ হয় ইউরোপানরা মানুষের মতোই কেয়ারলেস হয়ে যায় কখনো কখনো…
প্রাণ যে আছে তা আর বলতে হয় না। বরং অনুভূতিটাই অসহ্য। হাজার চোখ যে দেখছে তাকে এই অনুভূতিটা স্পষ্ট টের পায় ভ্যান ডার বার্গ। শুধু এটা ভেবেই কোনো কূল কিনারা পায় না সে, সেই চোখগুলোর পেছনে লুকানো মস্তিষ্কে বন্ধুত্ব লুকিয়ে আছে, নাকি নির্জলা ঘৃণা!
কিংবা, কে জানে, তারা হয়তো অপেক্ষা করছে অনাহুত অতিথির বিদায়ক্ষণের জন্য। মানুষের দল চলে যাবে, তারা-ইউরোপানরা আবার তাদের সেই গোপন কাজে নেমে যাবে, পূর্ণ করবে নিজেদের বিরান-নগরীর ছেড়ে যাওয়া ঘরগুলোকে। আবার ব্যস্ত হবে নগর-চত্বর।
তারা দুজন আদৌ অনাহুত তো? নাকি রবাহুত? হতেও পারে, ফ্লয়েডকে দেখে তেমি মনে হয়, হতে পারে, তারাই ডেকে এনেছে….
তারপর, আবার ক্রিস ফ্লয়েড কথা বলল শূন্যতার উদ্দেশ্যে।
বিদায়, দাদু। শান্ত স্বরে সে বলে যায়, কেমন যেন বিষণ্ণ মন নিয়ে। ফিরে তাকায় ভ্যান ডার বার্গের দিকে। তারপর চিরাচরিত সরল কণ্ঠে বলে, যাবার সময় হয়েছে, আমাদের যাবার সময় হয়েছে, তিনি বললেন আমাদের। ভেব না পাগল টাগল হয়ে গেছি।
তার কথায় সায় না দেয়াটাই সবচে বুদ্ধিমানের কাজ, ভাবল ভ্যান ডার বার্গ। কিন্তু এখনো মন খারাপ করার মতো কিছু ব্যাপার আছে এখানে।
ফ্লয়েড বিল টির ডিসপ্লের লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করছে। বোঝার মতো স্পষ্ট সুরে বলছে, ব্যাপারটার জন্য… স্যরি, ভ্যান। আশার চেয়ে বেশি ফুয়েল খরচ হয়ে গেল যে ল্যান্ডিংয়ের কাজে!
এবং, সাথে সাথে বজ্রপাত হল ভ্যান ডার বার্গের মাথায়। বলে কী! মিশন প্রোফাইল বদলে নিতে হবে।
এই পথটাই, ভাবল ভ্যান ডার বার্গ, কথা বলার সঠিক পন্থা এমন মানুষের সাথে, এবং আমরা গ্যালাক্সিতে ফিরে যেতে পারছি না। বলেই কথার উপর নিয়ন্ত্রণ হারালো বিজ্ঞানী, এমন পরিবেশে খুবই স্বাভাবিক, ঘোল ঢালি তোর দাদার মাথায়… কিন্তু শেষ কথাটা আটকে গেল গলার কাছে, কী বলতে নিয়েছিলাম আমি! কাকে! এবং, আবার নিজেকে ফিরে পেয়ে, কথাটা কণ্ঠনালী থেকেই গিলে নিয়ে বলল, তো, আমরা এবার কী করব?
ফ্লয়েড এখনো পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছে, আরো আরো নাম্বার প্রবেশ করাচ্ছে। কম্পিউটারে।
এখানে তো আর থাকতে পারব না…
কেন না, আদর্শ দৌহিত্র! কেন নয়! ভাবল ভ্যান ডার বার্গ। মরতে হয় এখানেই মরব। বাকী সময়টা যতটুকু সম্ভব কাজে লাগাব না কেন? বিজ্ঞান কিছু পাবে, মানবজাতি কিছু পাবে।
কিন্তু কথা শেষ হয়নি ফ্লয়েডের,–তো, আমরা এমন কোথাও থাকব যেখান থেকে ইউনিভার্সের শাটল সহজেই তুলে নিতে পারবে আমাদের।
ভ্যান ডার বার্গ বড় করে একটা মানসিক শ্বাস নিল। স্বস্তির শ্বাস। কী গাধা আমি! ব্যাপারটা মাথায় এল না কেন? আর চারদিনও নেই। ইউনিভার্স চলে আসছে ইউরোপায়। এম্নিতে বিল টি কে টেনেটুনে বিলাসবহুল বলা গেলেও এর মধ্যে জীবন ধারণের সব উপকরণই পাওয়া যাবে।
এই বিচিত্র আবহাওয়া থেকে সরে গিয়ে একটা সমতল, উষ্ণ পরিবেশে নামতে হবে। গ্যালাক্সির কাছাকাছি। আমি শিওর না তাতে খুব বেশি লাভ হবে কিনা। কিন্তু ঝামেলা হবার কথা নয়। পাঁচশো কিলোমিটার পেরুনোর রসদ আমাদের আছে ঠিকই, কিন্তু সাগর পেরুনোর ঝুঁকি না নেয়াই ভাল।
মুহূর্তের জন্য ভ্যান ডার বার্গ জিউস পর্বতের কথা ভাবল। যাওয়া যায় কোনোমতে। কিন্তু সিসমিক সমস্যাটা নিয়ম করে বাড়ছেই। আইও যত এগিয়ে আসছে লুসিফারের রেখায়, তততা বাড়ছে। কে জানে এখনো জিউসের কাছে সেই যন্ত্রপাতি কাজ করছে কিনা! এই সমস্যা থেকে উতরে যেতে পারলে সাথে সাথে সেটা নিয়ে ভাববে, ঠিক করে রাখল ভ্যান ডার বার্গ।
উপকূল ধরে নিরক্ষীয় এলাকায় উড়ে যাব। কোনো স্পেস শাটল ল্যান্ডিংয়ের জন্য সবচে ভাল জায়গা-এ পরিস্থিতিতে। রাডার ম্যাপে এমন কয়েকটা স্থান দেখা যাচ্ছে।
জানি। মাসাদা তেউ।
এবং সেই সাথে শুনিয়ে রাখল নিজের কানকে, ভ্যান ডার বার্গ, কখনো অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারের সুযোগ হাতছাড়া করো না।
তাহলে? মাসাদা প্লাতেউ এখন গন্তব্য। গুডবাই, ভেনিস। গুডবাই, দাদু…
* * *
ব্রেকিং রকেটগুলোর গর্জন থেমে আসতেই ক্রিস ফ্লয়েড শেষবারের মতো ফায়ারিং সার্কিটগুলো নিরাপদ করে। খুলে নেয় সিটবেল্ট। তারপর বিল টির স্বল্প জায়গায় হাত পা যথা সম্ভব ছড়িয়ে দেয় পাইলট।
খুব একটা খারাপ এলাকা নয় এই ইউরোপা, কী বল? উৎফুল্ল কণ্ঠ জুনিয়র ফ্লয়েডের, এখন, শাটলের রেশন যতটা দাবী করে ততটা খারাপ কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য আমাদের হাতে পাক্কা চার-পাঁচটা দিন পড়ে আছে। তো, কী নিয়ে কথা শুরু করতে চাচ্ছ তুমি, ভ্যান ভায়া?
৫২. অন্য দ্য কাউচ
মনস্তত্ত্ব পড়লে কী ভাল কাজই না হত! ভাবছে ভ্যান ডার বার্গ; তাহলে তার মনোভূমি চষে বেড়াতে পারতাম। এখনতো ব্যাটাকে পুরো সজ্ঞান লাগছে-কিন্তু কেন এখনো ব্যাপারটাকে অস্বীকার করছে না? সাধারণত মানুষ অস্বাভাবিক কিছু করে বসলে পরে অস্বীকার করে, সে কেন করছে না?
গ্র্যাভিটির ছ ভাগের এক ভাগে যে কোনো আসনই আরামদায়ক হবার কথা। তারপরও আয়েশী ভঙ্গীতে বসে আছে ফ্লয়েড, মাথার পেছনে হাত নিয়ে। হঠাৎ ভ্যান ডার বার্গের মনে পড়ে গেল আগের দিনের ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ববিদ্যার রোগীরা এভাবেই বসে থাকত; বিদ্যাটা এখনো একেবারে ফেলনা হয়ে যায়নি।
অন্য ব্যাপারে কথা শুরু করল সে। এ নিয়ে কথা না বলাই ভাল। তার ধারণা যত তাড়াতাড়ি ফ্লয়েড এই কিম্ভূত কথাটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলবে ততো তাড়াতাড়ি সে মানসিকভাবে সেরে উঠবে।
কিন্তু অন্যদিকটাকে সে মন থেকে সরিয়ে দেয়নি। এমনও হতে পারে, কোনো বড় কারণ মনে ঘাপটি মেরে ছিল না থাকলে এমন সিরিয়াস সময়ে এমন অতিকল্পনা আসা অসম্ভব।
অবাক ব্যাপার, এতোক্ষণে ফ্লয়েড তার সাথে একমত হয়ে গেছে। স্বস্তির সাথে খেয়াল করছে সে, সেই সাথে নিজের চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছে ফ্লয়েড পরিবারের শেষ সদস্য।
আমার ক্রুর মানসিক রেটিং এক্কেবারে এ ওয়ান প্লাস। সে বলল, তার মানে সে আমার কাজে মনোযোগ দিতে দিবে। আসলে আমিও তোমার মতোই ধাঁধায় পড়ে গেছি। কিন্তু, বিশ্বাস কর আর নাই কর, দেখেছিলাম দাদুকে। তিনি আমার সাথে কথাও বলেছেন। কক্ষনো আমি ভূতে বিশ্বাস করিনি-কে করে রে ভাই?-আত্মার কথা যদি বলি, এর একটাই অর্থ হতে পারে। তিনি মৃত। তাকে যদি আরেকটু ভালভাবে জানতে পারতাম! যাক, দেখা হওয়ার আশায় আছি… এখনো কী যেন একটা কথা মনে পড়ছে না…
তাই সাথে সাথে প্রশ্ন তুলল ভ্যান ডার বার্গ, বলতো, ঠিক কী কী বললেন তোমাকে?
একটু অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে ক্রিস বলল, আমি কিন্তু সেই ক্ষণজন্মা স্মৃতিধরদের একজন নই। কাঁটায় কাঁটায় সব কথা বলি কী করে? অর্থবহভাবে তাকাল ভ্যান ডার বার্গের চেহারায়।
স্ট্রেঞ্জ! এখন পিছনে তাকিয়ে বুঝতে পারছি আমরা ঠিক শব্দ ব্যবহার করে কথা বলিনি।
আরো খারাপ খবর: শঙ্কিত ভ্যান ডার বার্গ ভাবল। টেলিপ্যাথির সাথে মরণের পর দেখা হওয়ার সংযোগ! সোনায় সোহাগা। তারপরও ইতস্তত করে বলল:
যাক। তাও, তোমাদের সেই… কথোপকথনের একটা সারমর্ম শুনিয়ে দাও। তুমি কিন্তু এখনো বলনি যে কি মনে নেই।
ঠিক। তিনি অনেকটা আবার তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম। খুব খুশি লাগছে। আশা করি সব ঠিকমতো চলবে। ইউনিভার্স তাড়াতাড়ি তুলে নেবে তোমাদের। গোছের কিছু একটা বলেছিলেন আর কী!
চিরাচরিত আত্মার কথোপকথন। ভ্যান ডার বার্গ ভাবছে। তারা জিন্দেগীতেও কোনো কাজের কথা বলে না। শ্রোতার আশা আর ভয়ের প্রতিফলন হয় তাদের কথাতে। শূন্য খবর প্রতিধ্বনিত হয় অবচেতন…
বলে যাও।
তারপর প্রশ্ন করলাম, কোথায় গেল সবাই, কেন জায়গাটা এমন বিরান হয়ে আছে?
হাসলেন তিনি, তারপর এমন এক জবাব দিলেন যা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি এখনো।
জানতাম তোমরা কোনো ক্ষতি করতে আসনি। আসতে দেখেই ওয়ার্নিং দেয়া ছাড়া আর কিছু করার সময় ছিল না হাতে। সেই সব
তারপর এখানে এমন এক শব্দ ব্যবহার করলেন যা বোঝা দুষ্কর। অনেকটা যেন, পানির ভিতরে চলে গেল। দরকার হলে খুব দ্রুত চলতে পারে তারা। তোমাদের ফেরার সময় না হলে ওরা কিন্তু বেরুবে না। তাছাড়া বাতাস বিষটাকে উড়িয়ে নিয়েছে… এর মানে কী আল্লা মালুম। আমরা ছড়িয়েছিলাম সুন্দর, পরিষ্কার বাষ্প। সেই একই জিনিসে তাদের আবহাওয়া গঠিত। বিষ এল কোত্থেকে!
যাক! ভাবল ভ্যান ডার বার্গ, এমন কোনো মাথার কিরে কেউ দেয়নি যে কোনো অতিকল্পনাকে যুক্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। সম্ভবত বিষ ব্যাপারটা ক্রিসের মনের কোনো গভীরে লুকিয়ে ছিল। যা তার অত্যন্ত শক্তিশালী মানসিক গঠন সত্ত্বেও সময়মতো বেরুতে পেরেছে। ব্যাপারটা রোজির লাশ উগড়ে দেয়ার ঘটনা দেখার পরও হতে পারে। ব্যাপার যাই হোক না কেন, তাতে আমার কোনো ভয় নেই। এবং সেটাই দশ কথার এক কথা। পয়জন! হ্যাঁ গ্যানিমিডে দেখেছিলাম, বিল টির জেট দিয়ে শুধু পানির বাষ্প বা এর গাঠনিক আত্মীয়রাই বের হতে পারে। যাই বেরুক না কেন…
আরে, এক মিনিট। এক্সহস্ট থেকে বেরুনোর সময় কত গরম থাকে.বাপটা? কোথায় যেন পড়লাম…?
ক্রিস, রিয়্যাক্টরে পানিটা ঢোকার পর সবটাই কি বাষ্প হয়ে আসে?
আর কী করবে? ও, যদি সত্যি সত্যি গরম করে ফেলি তো দশ থেকে পনের পার্সেন্ট গ্যাস হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনে বিভক্ত হয়ে যাবে।
অক্সিজেন! হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গেল ভ্যান ডার বার্গের মেরুদণ্ড-যদিও শাটলের তাপমাত্রা যথেষ্ট গরম। ক্রিসের কাজের পরিধি ভিন্ন; সেখানে অক্সিজেনের অন্য মাত্রার কথা জানার কথা নয় বা সে কথা জেনে মনে পুষে রাখার কথা নয় যে পরে
অবচেতন মন তার সেই অক্সিজেনকে বিষ হিসাবে অভিহিত করবে।
ক্রিস, তুমি কি জান যে প্রাথমিক পৃথিবীতে এবং প্রাথমিক পৃথিবীর মতো গঠনে অন্য সব গ্রহে অক্সিজেন প্রাণীদেহে প্রাণঘাতী হিসেবে কাজ করবে?
মশকরা বাদ দাও, ভ্যান।
রসিকতা করছি না আমি। সেই প্রাচীন বৈশিষ্ট্য এখনো আমাদের শরীরে রয়ে গেছে।
তার মানে আমরা অক্সিজেনে মারা যাব! দারুণ বলেছ কিন্তু।
হু। মারা যাব, যদি ঘনত্ব, চাপ, বা অন্যান্য গ্যাসের তুলনায় হার বেশি হয়। এই তিনটাই যে হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, বরং তিনটার যে কোনো একটা হলেই হল।
ও! তাইতো, আমাদের ডাইভিং কোর্সে ব্যাপারটা শিখিয়েছিল।
তোমার-দাদু-সত্যি কথাই বলছিল! ঠিক যেন আমরা নগরীটার উপর কার্বন মনোক্সাইড ছড়িয়েছি। অবশ্য ততটা খারাপ নয়, কারণ অক্সিজেন তাড়াতাড়ি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
তার মানে এখন আমার কথা বিশ্বাস হল? কাঙালের কথা বাসি হলে ফলে।
আমি কখনো বলিনি যে অবিশ্বাস করছি।
তুমি যদি বলতে তাহলে পাগল হিসেবে গণ্য হতে আমার কাছে।
এবার টান টান ভাবটা একটু ঢিলেঢালা হয়ে গেল। হাসল দুজনেই। প্রাণ খুলে।
তার পরনে কী ছিল কখনোই কিন্তু বলনি।
আদিকালের ড্রেসিং গাউন। ছেলেবেলায় যেমন জিনিস পরতে দেখতাম। খুব আরামদায়ক মনে হয়েছিল।
আর কোনো বিস্তারিত ব্যাপার?
কথাটা যখন তুললেই, বলে ফেলি। দেখতে অনেক তরুণ লাগছিল তাঁকে। শেষবার দেখেছিলাম যেমন, তারচে অনেক বেশি চুল মাথায়। তো, আমার মনে হয় না–কী বলব, লোকটাকে ঠিক সত্যিকার বলে মনে হয়নি। যেন কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজ। যেন কোনো কৃত্রিম হলোগ্রাম।
মনোলিথ!
“ঠিক তাই। এ কথাই ভাবছিলাম। মনে আছে, কীভাবে ডেভ বোম্যান ডিসকভারিতে দাদুর সামনে হাজির হয়েছিল? সম্ভবত এবার তার পালা। কিন্তু কেন? তিনি তো আমাকে কোনো ওয়ার্নিং দেননি। বলতে গেলে, কোনো খবরও পাঠাননি। শুধু যেন বিদায় দিয়ে আমার জন্য শুভ কামনা করলেন…
কয়েকটা অপ্রস্তুত মুহূর্তের জন্য ফ্লয়েড কেমন নিথর হয়ে গেল। কী বলল সে? নিজের অজান্তে কী বলল? কিন্তু আন্দাজে ঘাবড়ে যাবার পাত্র নয় ক্রিস। ফিরল ফ্লয়েড, ভ্যান ডার বার্গের দিকে। হাসল একটু ফ্যাকাশে হাসি।
চিন্তাটাকে আর প্রশ্রয় দেয়া যায় না। কিন্তু কেন যেন ভাল লাগছে না তার। একটুও ভাল লাগছে না।
বেশি বকবক করে ফেললাম, না? এবার তোমার পালা। এখানে, সালফার আর বরফ দিয়ে গড়া বিশ্বে একটা মিলিয়ন-মিলিয়ন টন হীরা কী করছে? কারণটা ভাল হলেই ভাল।
কারণটা ভালোয় ভালোয় ভাল। বলল ড. রালফ ভ্যান ডার বার্গ।
৫৩. হৃদয়ের টুকরো
কাহিনী শুরু করল ভ্যান ডার বার্গ।
আমি তখন ফ্ল্যাগস্টাফে কাজ করছি। সে সময় একটা রদ্দি মার্কা পুরনো দিনের মহাকাশবিদ্যার বই পেলাম; তাতে লেখা, সৌর জগতে য আছে, আছে বৃহস্পতি, আর সেই সাথে আছে অনেক টুকরো।
তাই বলে সে বইটা কিন্তু পৃথিবীকে অস্বীকার করেনি। করেছে, বল? শনি, ইউরেনাস, নেপচুন-এই তিন বিশাল গ্যাস-দানবকে একেবারে অস্বীকার করে বসল। অথচ সেগুলো বৃহস্পতির অর্ধেক।
তর, ধান ভানতে শিবের গীত না গাওয়াই উচিত। অবশ্য এখানে কথাটা প্রযোজ্য, কিন্তু তোমার ধৈর্যচ্যুতির রিস্ক নিতে চাচ্ছি না। শুরু করা যাক ইউরোপা থেকেই, তুমিতো জান-ইউরোপা এক কালে বরফের টুকরা ছিল। তারপর লুসিফার তাকে গরম করতে শুরু করে। বাকীটাও তোমার জানা-অনেক অনেক পানি উবে গেল, বাসা বাঁধল অপর প্রান্তে।
দু হাজার পনেরতে শুরু হল আমাদের ব্যাপক খোঁজ-খবর। দেখতে পেলাম, পানি গলছে। কিন্তু কোনো ভূমি জাগছে না। সে সময় থেকে আটত্রিশ সাল পর্যন্ত পুরো চাঁদটায় মাত্র একটাই উঁচু স্থান ছিল। আর সবখানের মতো এখানেও সে ঘাপটি মেরে বসে ছিল অনাদিকাল থেকে। আর, এখন আমরা জানি সেটা কী।
“অবশ্যই জানি। পৃথিবীর চাঁদের টাইকো জ্বালামুখের পাথরের নিচে, বৃহস্পতির অর্বিটে আলো, আঁধারীতে এবং সবশেষে এই উপগ্রহটার বরফের ভিতর লুকিয়ে থাকার অভ্যাস তাদের অনেক আগে থেকেই। তারপরও, নিজের চোখে দেখেও মনোলিথটাকে ঠিক দেয়াল বলে মনে হচ্ছে না। এখনো আমার চোখে মনোলিথ বলতেই দাঁড়িয়ে থাকা কোনো স্তম্ভ কিংবা অর্বিটে চক্কর দিতে থাকা কোনো গুপ্ত পথ।
“আমার মনে হয় আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির ত্রুটির কোনো অভাব নেই। দেখ, আমরা শিখেছি এটা যে কোনো ক্ষতি করে বসতে পারে। আমরা যা চিন্তা করতে পারি, কল্পনার চোখে যা দেখতে পারি তার সবই সে পারে এমনকি যা কল্পনা করতে পারি না তাও ঐ কালো জিনিসগুলো নির্দ্বিধায় করতে জানে।
“যাক, ইউরোপায় সাইত্রিশ সালে কী এক গণ্ডগোল যেন লেগে গেল-এক পরীক্ষার পর আরেক পরীক্ষায় যেতে না যেতেই দশ কিলোমিটার বড় মাউন্ট জিউসের দেখা পেলাম আমরা। না, বলা নেই, কওয়া নেই।
“প্রথমত, এতো বড় অগ্নিগিরির কথা ভাবতেও আক্কেল গুড়ুম হওয়ার কথা। সেগুলো মাত্র কয়েক সপ্তায় জন্মাতে পারে না। তার উপর ইউরোপা আইওর মতো এতো অ্যাকটিভ নয়।
আমার হিসেবে, অনেক সক্রিয়। যতটুকু অ্যাকটিভ তাই অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিতে কাফি। এরচে বেশি কী চাও? শেষ কম্পনটা টের পাওনি?
রসিকতায় কান দেয়ার সময় কোথায়? একজন বিজ্ঞানী তার গত ক বছরের গবেষণার খবর বলার সুযোগ পেয়েছে, আর কী চাই?
“তাছাড়া, এটা আগ্নেয়গিরি হয়ে থাকলে, যদিও আমরা জানি-এখন আর সে প্রশ্ন নেই। জানি-এটা হীরা। কিন্তু তখন যেসব যুক্তি-পাল্টা যুক্তি উঠেছিল তার আলোকে বলছি, আগ্নেয়গিরি হয়ে থাকলে আকাশে অনেক অনেক গ্যাস ছড়িয়ে দিত। তাছাড়া একটা পাহাড়ের জন্মকথা নিয়ে কাঁহাতক খোঁচাখুঁচি করা যায়? আমাদের নিজস্ব প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আর উদ্ভট থিওরী যাতে না আসে সে চেষ্টাও করা হল। নিরুৎসাহিত করা হল সবাইকে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বাস্তবের চেয়ে উদ্ভট আর কিছু নেই…
“আমি প্রথম সন্দেহ করি ফিফটি সেভেনে। কিন্তু আমলে নিইনি। পরের দু বছর এমি এমি কেটে গেল। কাজের চাপেই নাভিশ্বাস ওঠার দশা, তার উপর পাহাড় পর্যবেক্ষণের ভূত ঘাড়ে থাকতে পারে বেশিক্ষণ, বল?
“কিন্তু তারপর, প্রমাণগুলো আরো বেশি করে ভেসে উঠল চোখের সামনে। ঠেকানোর তেমন কোনো উপায় থাকল না।
“জিউস পর্বতকে হীরার টুকরো ধরে নেয়ার আগে চাই ব্যাখ্যা। কাঠখোট্টা ব্যাখ্যা না পেলে আমার মনই মানবে না আর অন্যকে মানানো তো দূরের কথা। অন্যদিকে, একজন ভাল বিজ্ঞানীর কাছে বাস্তবের কোনো দাম নেই যদি যথাযথ প্রমাণ না থাকে। কিন্তু প্রমাণ না থাকলেও চলে, থাকতে হবে অপ্রমাণিত একটা ব্যাপার, যা বিজ্ঞানের জন্মকাল থেকে সবকিছুর উপর ছড়ি ঘুরিয়ে এসেছে-তত্ত্ব। আর জানোই তো, আমি নিজেকে ভাল বিজ্ঞানী বলে মানি।
“সাধারণত তত্ত্বগুলো বাস্তব হয় না। এমনকি সত্যের ধার ঘেঁষেও যায় না। কিন্তু এর ফলে চিন্তার একটা পথ বেরিয়ে যায়, যা আসল ব্যাপারটাকে এক-আধটু ব্যাখ্যা করতে পারে। না পারলেও ক্ষতি নেই। তত্ত্ব বা থিওরীটা থাকতেই হবে।
“আর যে কথা তুমি বললে, দেখেও যা তোমার মনের খটকা দূর না করে সেটা আমি আন্দাজ করেছিলাম অনেক দূর থেকে কীভাবে আমার মনে তুষ্টি আসবে? মিলিয়ন মিলিয়ন টন একটা হীরা সালফার আর বরফের রাজত্বে কী করছে? এখন জবাবটা একেবারে সহজ হলেও আমি কী গাধার গাধা, বছর কয়েক আগে কেন সেগুলো মাথায় এল না? এলে অনেক ঝামেলা থেকে বাঁচা যেত, আর অন্তত একটা জীবন যেত বেঁচে।
সে চিন্তাম্বিত মনে থামল। তারপর ধুম করে বলে বসল ফ্লয়েডকে :
কেউ কি তোমাকে ড, পল ক্রুগারের কথা বলেছিল?
নাতো, হঠাৎ কেন বলতে যাবে? আমি অবশ্য তার কথা শুনেছি, অবশ্যই।
“এই হঠাৎ মনে হল আর কী! এতো ঘোলাটে ব্যাপার ঘটছে চারপাশে যে বুঝে ওঠা কঠিন…
“যাই হোক, ব্যাপারটা এখন আর গোপনীয় নয়। বছর দুয়েক আগে আমি একটা অত্যন্ত গোপনীয় মেসেজ পাঠিয়েছিলাম পলের কাছে-ওহ, বলতে ভুলে গেছি, তিনি আমার চাচা। আমি একটা দাবী জানিয়েছি সেই সাথে, হয় আমার কথাটা প্রমাণ করুন, নয়তো বাতিল করুন, তাও প্রমাণের সাথে।
“তিনি বেশি সময় নেননি। হয় তার আঙুলের ডগায় কোনো বাগড়া ছিল নয়তো তার পার্সোনাল নেটওয়ার্কে নজরদারি করছিল কেউ, তোমাদের কেউ হবে। তবে যে-ই করে থাক না কেন, কাজটায় দারুণ ফল পেয়ে গেছে তারা।
“দুদিনের মধ্যেই তিনি সায়েন্টিফিক পেপারের একটা আশি বছরের পুরনো কপি পেলেন-নামটা যেন কী… ও, ন্যাচার। জিনিসটা তখনো পেপারব্যাকে ছাপা হত। সেই পত্রিকাই সব খুলে দিল। কী বলছি, বুঝলে, প্রায় সব।
“লেখক তখনকার ইউনাইটেড স্টেটস অব-বুঝতেই পারছ, সাউদার্ন আফ্রিকার তখনো জন্ম হয়নি; আমেরিকায়, সবচে নামী ল্যাবের একটায় কাজ করতেন। সেখানে রাতদিন পারমাণবিক বোমা নিয়ে গবেষণা চলত, সেই সাথে তৈরি করাতেও কোনো দোষ ছিল না। তাই তারা তাপ আর চাপের ব্যাপারে বেশকিছু জানেন, যা ভাল ভাল বিজ্ঞানীরাও জানে না….
“জানি না ড, রস-তার নাম-পারমাণবিক বোমার প্রজেক্টের সাথে যুক্ত ছিলেন কিনা। জানা সম্ভবও নয়। এটুকু জানি, তিনি বড় গ্রহগুলোর একেবারে গভীরের অবস্থা নিয়ে সারাক্ষণ ভাবতেন। তাঁর উনিশো চুরাশি… স্যরি, উনিশো একাশি সালের পেপারটায় বেশ ইন্টারেস্টিং কিছু ব্যাপারের অবতারণা করেন…
“এক পৃষ্ঠার চেয়েও ছোট প্রবন্ধে বলেন, গ্যাস জায়ান্টগুলোতে মিথেন, সি এইচ ফোর রূপে প্রচুর কার্বন জমে আছে। সমস্ত ভরের তুলনায় প্রায় সতের পার্সেন্ট। হিসাব করে দেখিয়েছেন যে মূল অংশের তাপমাত্রা খুব বেশি। আর চাপ? মিলিয়ন মিলিয়ন অ্যাটমোসফিয়ার। এ অবস্থায় সেখানে কার্বন আলাদা হয়ে যাবে। এবং, কার্বনটাই আরো নেমে যাবে কেন্দ্রের দিকে। কেন? কারণ কার্বনের ভর বেশি, তাই আকর্ষণ বেশি। তারপর? সহজেই অনুমান করা যায়, ক্রিস্টালাইজড হয়ে যাবে। তত্ত্বটা কিন্তু দারুণ। মনেতো হয় না তিনি কখনো স্বপ্নেও ভেবেছিলেন যে এ থিওরি কখনো খতিয়ে দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে…
“তো, এই হল কাহিনীর প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্ব প্রচারিত হবে কফি ব্রেকের পর। কী বল?
এইতো, নাও। আর মনে হচ্ছে আমি দ্বিতীয় পর্ব বুঝে গেছি। এর সাথে বৃহস্পতি
অভিযানের কোনো না কোনো সম্বন্ধ আছে, কী বল? জুপিটার এক্সপ্লোশন?
নট এক্সপ্লোশন, ইমপ্লোশন। বৃহস্পতি নিজের ভিতরেই ভেঙে পড়েছিল। তারপর ছড়িয়ে পড়ে বাইরে। অন্য অর্থে, ব্যাপারটা পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মতো। শুধু একটা দিকে পার্থক্য, বৃহস্পতির নতুন আকৃতিটা খুবই সুস্থির, ছোট্ট সূর্য।
“এখন, এক্সপ্লোশন বা বাইরে ছড়ানোর বিস্ফোরণ নয়, বরং ইমপ্লোশন বা ভিতরদিকে গুটানোটা বেশ জটিল। কিন্তু তখন কী হবে ভেবে দেখ তো। উলট পালট হয়ে যাবে না? ভিতরের দিক বাইরে, বাইরের দিক ভিতরে চলে আসবে।
ব্যাপারটা যাই হয়ে থাক না কেন, পৃথিবীর যে কোনো পর্বতের চেয়ে বড় আকৃতির একটা টুকরা মূল কোর থেকে ছিটকে অর্বিটে চলে এসেছিল।
“জিনিসটা বেরিয়ে গিয়ে মূলত একটা গোলকধাঁধায় পড়ে। এতে উপগ্রহের হাজারটা টানাপোড়েনে পড়ে অবশেষে অনেক দিন পর ইউরোপায় তার কুল ফিরে পায়। কিন্তু পতন গতি অনেক অনেক বেশি হয়নি। কেন হয়নি? কারণ এখানে ইউরোপার আকর্ষণে শুধু জিউস পর্বত ছুটে আসেনি। দু বই বেশ বড়, তাই একজন আরেকজনের কাছে গেছে। ইউরোপার অর্বিট খুব একটা নড়েনি, জিউস এসেছে বেশি। ফলে পতনগতিটা হয়েছে একদম কম। সেকেন্ডে মাত্র দু কিলোমিটার।
“যাই হোক, জাহান্নামে যাক ইউরোপা। কথা বলছিলাম জিউস পর্বত নিয়ে। মাঝে মধ্যেই দুঃস্বপ্ন দেখি, জিনিসটা আমাদের দিকেও আসতে পারত। সেক্ষেত্রে পৃথিবীর সাথে জিউসের ভরের পার্থক্য হত অনেক বেশি, পৃথিবী তার জায়গা ছেড়ে নড়ত না, জিউসকেই ছুটে আসতে হত, গতির কথা বা বাকীটা গ্যাভিটিশনাল ফিল্ড।
“তার পরও, যত কম ধাক্কাই হোক না কেন, পরিবেশ আর আবহাওয়ার উপর বিরাট আঘাত আসার কথা, তাই না? আমাদের ইউরোপান বন্ধুরা কী ক্ষতির মুখে পড়েছিল কে জানে! এবং, ফলে সে নিশ্চই এক নাগাড়ে অনেকগুলো সিসমিক অস্থিরতার জন্ম দেয়। শুধু চাবিটা ঘুরিয়ে দিয়েছিল জিউস, অস্থির করে দিয়েছিল ইউরোপার দাঁড়িপাল্লা । সেই জের, এত বছর পর এখনো চলছে এবং কন্দিন চলবে কে জানে!
“আর… অন্য কথা পাড়ছে ফ্লয়েড, রাজনৈতিক ব্যাপারে কী মত? আমি এখন তাদের কারো কাজকে দাম দিতে শুরু করেছি মনে মনে। এ নিয়ে ইউ এস এস এ নিশ্চই যার পর নাই দুঃখিত।
অন্য সবার সাথে।
আর কেউ কি সিরিয়াসলি ভেবেছে যে এই হীরার কাছেধারে ঘেঁষতে পারবে?
“কাজটা এতো কাঁচাভাবে করা হয়নি। বলল সে, শাটলের পিছনে তাকিয়ে, ইন্ডাস্ট্রির উপর মানসিক চাপটাই অসীম হয়ে দাঁড়াবে; বদলে যাবে পৃথিবীর অর্থনীতি, থমকে যাবে অনেক দিনের জন্য, বাস্তবে বাজারে হীরা নামলে কী হবে সেই কথাটাতো ছেড়েই দিলাম। তাই এত পক্ষ-বিপক্ষ-প্রতিপক্ষ পাগল হয়ে গেছে সত্যিটা জানার জন্য।
এখন, তারাতো সব জানে। কী হবে পরবর্তীকালে?
হাজার শুকরিয়া আল্লাহর দরবারে, সমস্যাটা আমার নয়। আমার একটাই পরিতৃপ্তি, গ্যানিমিডের সায়েন্স বেসগুলোর জন্য বেশ মোটা অংকের টাকা বরাদ্দ করানো গেল।
তারপর, একটু লজ্জিত মনে মনে নিজের কথাটাও যোগ করল, আমার জন্যও।
৫৪. তোমার কি রথ পৌঁছুবে না মোর দুয়ারে…
যা দেখেই তোর মনে হয়ে থাক না কেন, আমি মরে গেছি, যেন কেঁদেই ফেলবে হেউড ফ্লয়েড, কত বছর ধরে আমার শরীরটা ভাল নেই!
অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ক্রিস স্পিকার গ্রিলের দিকে। নেচে উঠছে তার মনটা। কেউ একজন-কিছু একটা-তার সাথে কী নিষ্ঠুর ঠাট্টাই না করেছিল তখন! ভিজে উঠছে চোখ, এতোক্ষণে। কেন এমনটা করল?
পাঁচ কোটি কিলোমিটার দূরে, প্রতি সেকেন্ডে কয়েকশ কিলোমিটার এগিয়ে আসতে থেকে হেউড ফ্লয়েডও যেন কেমন আবেগিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখনো তার কণ্ঠে ঝরে পড়ছে আনন্দ। ক্রিস এখনো ভাল আছে, বেশ ভাল।
ও, তোর জন্য আরো কিছু সুসংবাদ আছে। সবার আগে শাটল তোদের তুলে নিবে। অবশ্য গ্যালাক্সিতে জরুরী কিছু মেডিক্যাল রসদও ছুঁড়ে দিবে। তারপরই তোদের কাছে। পরের অর্বিটেই উঠে আসবি। আরো পাঁচ চক্কর শেষ করে ইউনিভার্স নিচে নামবে। বন্ধুদের স্বাগত জানানোর জন্য উঠে থাকবি, কী বলিস?
আর কী… বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। শুধু পুরনো দিনের ক্ষতিটুকু পুষিয়ে নিতে চাই। তোর জবাবের আশায় থাকছি… দাঁড়া, দেখে নিই, তিন মিনিট…।
বিল টির বুকে এক মুহূর্ত কোনো শব্দ ছিল না। ভ্যান ডার বার্গ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বন্ধুর দিকে তাকাবে না। ফ্লয়েড মাইক্রোফোনটা অন করে ধীরলয়ে বলল, দাদু-হোয়াট এ ওয়ান্ডারফুল সারপ্রাইজ-আমার শক এখনো কাটেনি। কিন্তু আমি জানি, তোমার সাথে এখানে-ইউরোপাতেই দেখা হয়েছিল আমার। আমি জানি, তুমি আমাকে বিদায় জানিয়েছিলে। আমি এ ব্যাপারে ঠিক ততটাই নিশ্চিত যতটা তোমার সাথে এ মুহূর্তে কথা বলার ব্যাপারে…
যাক, এ নিয়ে পরে তর্কের টেবিল মাতানো যাবে। কিন্তু ভুলে যেও না কীভাবে ডেভ বোম্যান ডিসকভারির বুকে তোমার সাথে কথা বলেছিল। হয়তো এটাও তেমন কোনো ঘটনা…
এখন আমরা এখানে বসে বসে শুধু প্রহর গুনব। চিন্তা নেই, আরামেই আছি। শুধু নিয়মিত ভূকম্পনটা চলে গেলেই বরং অস্বস্তি হবে। কিন্তু, বললাম না? চিন্তা করোনা। দেখা হবার আগ পর্যন্ত, আমার সমস্ত ভালবাসা তোমাকে ঘিরে রাখবে।
তার ঠিক মনে নেই শেষ কবে সে দাদুর জন্য এই শব্দটা ব্যবহার করেছিল। প্রথমদিনের পর শাটল হয়ে গেল গন্ধমাদন পর্বত। ঘ্রাণ ছুটল একটু একটু করে। দ্বিতীয় দিনে, ঠিক বলতে পারবে না, তবু মনে হয় খাবারের সেই আগের স্বাদটা আর নেই। তারপর ঘুমানো কষ্টকর হয়ে উঠল, শুরু হল নাক ডাকা।
তৃতীয় দিনে, গ্যালাক্সি, ইউনিভার্স, এমনকি পৃথিবী থেকে অবিরত আসতে থাকা মেসেজের ভিড় ঠেলে জায়গা করে নিল বিরক্তি। এদিকে নোংরা গল্পের ঝুলিও এক্কেবারে উদোম হয়ে গেছে। বাকী নেই কিছু।
কিন্তু এটাই ছিল শেষ দিন।
তারপর, লেডি জেসমিন তার হারানো সন্তানের খোঁজে নেমে পড়ল নিচে।
৫৫.ম্যাগমা
বস, অ্যাপার্টমেন্টের মাস্টার কমসেট বলল, আপনি ঘুমানোর সময় গ্যানিমিডের ঐ স্পেশাল অনুষ্ঠানটায় ঢুকেছিলাম। দেখবেন নাকি এখন?
হু। বললেন ড. ক্রুগার, গতি দশ গুণ করে দাও। নো সাউন্ড।
অখাদ্য টাইপের প্রচুর বকবকানি থাকবে প্রথমদিকে, তিনি জানেন। কিছু বাদ পড়ে গেলে ক্ষতি নেই, পরে দেখে নেয়া যাবে। আসল খবর যত তাড়াতাড়ি পাওয়া যায় ততই মঙ্গল।
শুরুর লেখাজোকা চলে গেল হুড়মুড় করে। তারপর মনিটরে ভেসে উঠল বিরক্তিকর ভিক্টর উইলিসের চেহারা। বেচারা গ্যানিমিডের কোনো এক জায়গায় পাগলের মতো শূন্যে হাত ছুঁড়ছে, স্বাভাবিক গতিতে দেখলে ব্যাপারটাকে তেমন মনে হত না। আর সব কর্মঠ বিজ্ঞানীর মতো ড, পল ক্রুগারও উইলিসের দিকে রক্তচক্ষু মেলে তাকালেন। এবং সবার মতোই মনে মনে স্বীকার করলেন যে ব্যাটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ বেশ ভালভাবেই করছে অনেক বছর ধরে।
এলোমেলোভাবে উইলিস হারিয়ে গেল, তারপর একটু কম বিরক্তিকর বিষয় ভেসে উঠল স্ক্রিনে। জিউস পর্বত।
জিনিসটা আর যে কোনো স্বাভাবিক পর্বতের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়; ইউরোপার শেষ ট্রান্সমিশনের পর সেটা কতো দেবে গেছে দেখে অত্যন্ত অবাক হলেন তিনি।
রিয়েল টাইম। আদেশ করলেন সাথে সাথে, সাউন্ড।
…দিনে প্রায় একশ মিটার। নামার সময় পর্বতের উপরের দিকটা প্রায় পনের ডিগ্রি সরে গেছে। এখন টেকটোনিক সক্রিয়তা ভয়ংকর-উপচে পড়া লাভায় ভিত্তিভূমি ভরে উঠেছে। আমার সাথে আছেন ড, ভ্যান ডার বার্গ। ভ্যান, আপনি কী মনে করেন?
আমার ভাস্তের হাল এখনো ভাল, ভাবলেন ড. পল ক্রুগার। অন্তত সে যে ঝড় থেকে উঠে এসেছে আর যে ঝড়ে পড়তে যাচ্ছে সে তুলনায় বেশ শক্তই তো দেখা যায়…
জিনিসটা নেমে যাচ্ছে আরো। আবিষ্কারের পর থেকে আজো জিউস পর্বত ডুবছেই। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে গতিটা অত্যন্ত বেশি। প্রতিদিনই আপনি পরিবর্তন দেখতে পাবেন।
পুরোপুরি মিলিয়ে যেতে আর কতদিন লাগবে বলে মনে করেন?
আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না যে এটা ডুববেই…।
তারপর হঠাৎ পাহাড়ের অন্য দৃশ্য চলে এল। ক্যামেরার বাইরে ভিক্টর উইলিসের কথা শোনা যাচ্ছে।
মাত্র দু দিন আগে এই কথাটা বলেছিলেন ড, ভ্যান ডার বার্গ। কোনো মন্তব্য, ভ্যান?
ইয়ে… মানে… দেখে মনে হচ্ছে হিসেবে ভুল করেছিলাম। এখনো নেমে যাচ্ছে পাহাড়টা-বেশ অবিশ্বাস্যভাবেই। মাত্র আধ কিলোমিটার বাকী! আমি আর কোনো মন্তব্য করব না আগ বাড়িয়ে…
জ্ঞানীর মতো কথা বলেছেন, ভ্যান-যাই হোক। ঘটনাটা মাত্র গতকালের। তো, এখন থেকে আপনাদের আমি নিয়মিত দেখিয়ে যাব ঘটনাচিত্র-যে পর্যন্ত ক্যামেরাটা না হারিয়ে যায়…
ড. পল ক্রুগার সামনে ঝুঁকে এলেন, সেই খেলার সমাপ্তি দেখার জন্য যেটায় দূর থেকে নিজেও গুরুত্বপূর্ণ কলকাঠি নেড়েছিলেন।
তার চোখের সামনেই, ডুবে যাচ্ছে দেবরাজের পর্বত। চোখের সামনে ডুবে যাচ্ছে। চারপাশ থেকে উথলে উঠছে গলিত সালফার, চোখ ধাঁধিয়ে চলে যাচ্ছে আরো আরো উপরে। মুগ্ধ করা নীলের খেলা চলছে চারদিকে। ঠিক যেন কোনো রাজকীয় জাহাজ ডুবে যাচ্ছে ঝড়-ঝঞ্ঝায় অস্থির সমুদ্রের বুকে। চারদিকে যেন সেইন্ট এলমোর আগুন।
অদ্যাবধি আবিস্কৃত সবচে দামী সম্পদ ডুবে যাচ্ছে, উইলিস আফসোসের সুরে পাদ্রীসুলভ কণ্ঠ করে বলল, দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা চূড়ান্ত মুহূর্তটাকে আর দেখাতে পারলাম না। কেন? এখনি দেখতে পাবেন আপনারা।
আবার অ্যাকশনটাকে রিয়েল টাইমে নিয়ে এলেন ড. গার। মাত্র কয়েকশ মিটার বাকী। আশপাশের তোলপাড় যেন ক্লান্ত হয়ে উঠেছে।
তারপর হঠাৎ করেই ক্যামেরার দৃশ্য হেলে পড়ল একদিকে। ক্যামেরার পাগুলো এততদিন যুদ্ধ করে ক্ষান্ত দিল। একবার মনে হয়েছিল যে পর্বতটা আবার জেগে উঠছে, কিন্তু দৃশ্যটা ক্যামেরার কারসাজি। পড়ার সময়, ব্যাটা উল্টোপাল্টা দৃশ্য দেখালো, যেমন সবাই দেখাতে চায়। ইউরোপার শেষ দৃশ্যটা একটু নাটকীয়। গলা সালফারের একটা ঢেউ গ্রাস করল ক্যামেরাকে।
হারিয়ে গেল চিরতরে। আরো দরদ ঝরে পড়ছে উইলিসের কণ্ঠে, গলকন্ডা আর কিম্বার্লি সারা জীবনে যতটুকু সম্পদ উৎপাদন করেছে তারচে অসীম গুণ বেশি সম্পদ মিশে গেল ধুলায়, কী আফসোসের কথা!
যেন সে জানে না এই সম্পদ পেলে উল্টো পৃথিবীর অর্থনীতির পাশাখেলার ছক যেত উল্টে। পাল্টে যেত সম্পদের হিসাব। হীরক সম্পর্কিত সবকিছুর দাম নেমে যেত পানির পর্যায়ে। ফলে ডুবত সেসব কোম্পানি, ভাসত উল্টোগুলো। ডুবে যেত পুরো আফ্রিকা। পৃথিবী পড়ত ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখে, শুরু হত আর্থিক স্যাবোটাজ । এবং হয়তো শুরু হয়ে যেত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
স্টুপিড! ইডিয়ট! সমানে বকে চলেছেন ড. ক্রুগার। ব্যাটার কি ন্যূনতম কমনসেন্স নেই! ও, সেতো মাথামোটা উপস্থাপক, সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো বোঝার সেন্স থাকার কথাও নয়। তাও কি বোঝে না যে…।
ন্যাচার এ আরেকটা চিঠি পাঠানোর সময় হল। এবার আর এতো বড় রহস্য লুকিয়ে রাখা যায় না। উত্তেজনায় কাঁপছেন তিনি। খুলে গেছে। বন্ধ দুয়ার খুলে গেছে। অনন্তের পথে চলার হল শুরু। বৃহস্পতি-বিস্ফোরণ শুধু ইউরোপানদের স্বার্থে হয়নি। মানবজাতির স্বার্থও এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মানব সভ্যতার যুগ ছিল অনেক। প্রত্যেকটাকেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়েছে। প্রস্তর যুগ, তাম্র যুগ, লৌহ যুগ… মহাকাশ যুগ এবং…।
এবং তারা, তারা কি সেই দুয়ারটাই খুলে দিল মানুষের সামনে, জোর করে…
৫৬. ভড়কে দেয়া তত্ত্ব
হতে: প্রফেসর পল ক্রুগার, এফ আর এস, ইত্যাদি।
প্রতি: সম্পাদক, ন্যাচার ডাটা ব্যাঙ্ক (পাবলিক অ্যাক্সেস)
বিষয় : জিউস পর্বত ও বৃহস্পতীয় হীরাগুলো
আজ এ কথাটা সর্বজনবিদিত যে, ইউরোপার জিউস পর্বত নামে যে গড়নটাকে আমরা চিনতাম সেটা আদপে বৃহস্পতির একটা অংশ।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লরেন্স লিভেনমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে তকালে কর্মরত মারভিন রস সর্বপ্রথম গ্যাস জায়ান্ট গ্রহগুলোর ভিতরে হীরা থাকার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন তার ক্লাসিক পেপার, ইউরেনাস ও নেপচুনে বরফের স্তর-মহাকাশে ডায়মন্ড? এ (ভলিউম ২৯২, নং ৫৮২২, পি পি ৪৩৫-৬, ত্রিশ জুলাই, ১৯৮১) অবাক ব্যাপার, রস তার লেখাটায় বৃহস্পতি নিয়ে তার সমাপ্তি টানেননি।
মাউন্ট জিউসের ডুবে যাওয়া যেমন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে তেম্নি জন্ম দিচ্ছে হাজার গুজবের। এসবের বেশিরভাগই একেবারে ভিত্তিহীন। কারণটা নিচে দেয়া হল।
বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না আমরা। পরবর্তী যোগাযোগে ব্যাখ্যা করা হবে। আমি মনে করছি বৃহস্পতির হীরা-কোরটা অন্তত 10^28 গ্রাম ছিল। এটার মাউন্ট জিউসের চেয়ে দশ বিলিয়ন গুণ বড় হবার কথা।
এই গড়নের প্রায় পুরোটাই আপাতদৃষ্টিতে তথাকথিত কৃত্রিম সূর্য লুসিফারের গায়ে হারিয়ে গেছে বলে ধরা হয়। কথা বিশ্বাস করা শক্ত যে মাউন্ট জিউসই একমাত্র বেরিয়ে আসা খণ্ড।
ধরে নেয়া যায়, অনেক অনেক খণ্ড বেরিয়ে এসেছিল। স্বভাবতই বেশিরভাগ আবার ফিরে যাবে লুসিফারের গায়ে। কিন্তু কিছু না কিছু যে অর্বিটে ছড়িয়ে পড়েছিল তারই প্রমাণ এই পর্বতটা। এবং অবশ্যই, সেখানেই সেসবের খণ্ড এখনো মাথা কুটে মরছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত।
বস্তুজগতের তত্ত্ব দেখায় যে সেগুলো আবার ফিরে আসবে তার আগের জায়গায়। একেবারে কাঁটায় কাঁটায় দেখানো সম্ভব নয়, অবশ্যই, হিসেব কষে দেখানো যাবে না। কিন্তু আমি জানি মাউন্ট জিউসের অন্তত দশ লক্ষ গুণ বেশি ভরের সমপরিমাণ বস্তু এখনো মহাকাশে লুসিফারের পাকচক্রে ঘুরে মরছে।
একটা ছোট্ট টুকরার পতন দেখা গেছে, তাও আবার একেবারে হঠাৎ করে, ইউরোপার বুকে। তাই, আসলেই, এর কোনো দাম নেই। নেই বিন্দুমাত্র মূল্য।
আমি অতি দ্রুত একটা রাডার বসানোর প্রস্তাব করছি লুসিফারীয় এলাকাতে শুধু এই বস্তুগুলো খুঁজে বের করার জন্য।
সেই বিরাশি সন থেকেই মানুষ অতি পাতলা হীরা বানাতে পারলেও এখনো শক্ত ভারী খণ্ড গড়তে পারেনি। মেগাটনের হিসাব-মাত্রায় এই জিনিস পাওয়া গেলে শিল্প কারখানার পথে নতুন যুগের উদয় হবে। এমনকি সৃষ্টি হবে নতুন ধরনের শিল্প ও প্রযুক্তি।
প্রায় এক শতাব্দী আগে, আইজ্যাক লিখিদ, এট এল এ এমন একটা কথা বলা হয়েছিল যে সাধারণ চিন্তা-চেতনার জগৎ দুমড়েমুচড়ে দেয় (দেখুন: সায়েন্স, ১৫১, পিপি ৬৮২-৩, ১৯৬৬)। তার মতে, হীরা হল তথাকথিত স্পেস এলিভেটর এর একমাত্র সম্ভাব্য উপাদান। কারণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন যে এই বই সবচে শক্ত এবং এর গাঠনিকতা থেকে তাই যেকোনো গাঠনিকতায় যাওয়া সম্ভব, নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করে, অবশ্যই। এর ফলে পৃথিবী থেকে দূরের কোনো নক্ষত্রের দূরত্ব সামান্য হয়ে যাবে; নদী আর নদীর পাড়ের মতো। নেয়া যাবে জিনিসপত্র অনেক অনেক দূরে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ব্যাপারটা সমর্থন করি, প্রমাণ ছাড়া পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না।
এ এক তত্ত্ব মাত্র। কাঁচা হীরা হাতে পেলে এমন হাজার হাজার তত্ত্ব উপচে পড়বে। তার দু একটা লেগেও যেতে পারে আরো এমন সব কাজে, যার কথা এখন অতিকল্পনা বলে মনে হয়।
এখন যে অযুত হীরক-পর্বত বৃহস্পতীয় অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেসবের দু একটাকে যদি আনা যায় তাহলে একদিন মানুষের কাছে কার্বনের ক্রিস্টালাইন আকৃতি নিয়ে বর্তমানের মাতামাতি একদম অসভ্যতা বলে মনে হবে।
আর, শুধু লেখাটা সঠিক সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে একটা কথা বলে রাখতে চাই। প্রকৃতিতে কার্বন মোটেও দুষ্প্রাপ্য নয়, শুধু গ্যাস জায়ান্ট আর ভূ-গর্ভ-ই এর জনক নয়। আরো একটা উৎস থেকে পাওয়া যেতে পারে অপার হীরক…।
শুধু বলার জন্য বলা আর কী, গ্যাস জায়ান্টের কোরে যাবার চেয়েও হাজারগুণ অসম্ভব সেসব তুলে আনা। নিউট্রন নক্ষত্রের গর্ভে লুকিয়ে থাকতে পারে আরো কোটি গুণ বেশি ভরের হীরা।
সবচে কাছের পরিচিত নিউট্রন স্টারটি পনের আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। আর তার উপরিতলের আকর্ষণ ক্ষমতা পৃথিবীর উপরিতল থেকে সত্তর হাজার মিলিয়ন গুণ বেশি। এমন উৎস থেকে হীরা তুলে আনা মুখের কথা নয়।
মনে হচ্ছে হীরা চিরকালই অধরা আর দামী রয়ে যাবে।
কিন্তু কে কোকালে ভেবেছিল যে একদিন আমরা বৃহস্পতির হৃদয় ছুঁতে পারব?
৫৭. গ্যানিমিডে মধ্যবিরতি
আহারে আদ্যিকালের কলোনিস্টরা! আফসোস করল মাইকেলোভিচ, সারা জীবন, যারা কলোনি বানায় তারা হাড়ভাঙা খাটনি দিয়ে যায় আর বাকীরা পরের প্রজন্মে এসে পায়ের উপর পা তুলে খায়। যাক, আসল কথা হল… দেখতো দেখি কাণ্ড! পুরো গ্যানিমিডে একটাও কনসার্ট হল নেই! না থাক, আমার সিন্থেসাইজার একাই একশো। সকল বাদ্যের সর্বপ্রকার সুর লহরী ইহাতে পুলকিত হইয়া উঠিবেক। কিন্তু আসল সারিন্দা সারিন্দাই, যেমন পা দানি বলতে যে কোনো জায়গায় পা-দানিকেই বোঝাবে।
তার কথা স্থানীয় সুর-রসিকদের মনে বেশ দাগ কেটেছে বলে মনে হল। এমনকি স্থানীয় নিয়মিত অনুষ্ঠান মর্নিং মেড় এ তীর্যক কথাও উঠল এ নিয়ে।
এখানে সাময়িকভাবে উপস্থিত হয়ে সম্মানিত অতিথিবৃন্দ শুধু আমাদেরকেই সম্মানিত করেননি, বরং দু ভুবনের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক মহান সাময়িক জোয়ার এনেছেন…
খোঁচাটা আসলে সরাসরি উইলিস, মাইকেলোভিচ আর ম্যাগি মবালার দিকে ভোলা হয়েছে। ম্যাগি বেঁচেবর্তে যেত, কিন্তু অতীতের দিকে আলোকপাত করার কাজে তার কোনো জুড়ি নেই। সে বৃহস্পতি বা জুপিটাররূপী দেবরাজ জিউসের সাথে আইও, ইউরোপা, গ্যানিমিড আর ক্যালিস্টোর অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্কের কথা টেনে এনেছে আবার সবার সামনে। নিক্ষ২৮ উইরোপার সামনে সাদা ষাঁড়ের অনিন্দ্য মূর্তি ধরে আসাটাই যথেষ্ট খারাপ কাজ হয়েছে জিউসের; আর আইও এবং ক্যালিস্টোকেও তাই সব সময় দেব-মহিষী হেরার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে হত তাঁকে। কিন্তু দেব-রাণী ছেড়ে কথা বলার পাত্রী ছিলেন না। আকাশ পাতাল ফুড়ে তাদের খুঁজতেন। এসবে লোকজন তেমন ক্ষেপেনি বরং শুনে মজাই পেয়েছে, কিন্তু স্থানীয়রা এরপর তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে পরের কথাটা শুনতে পেয়ে। মিথোলজিক্যাল বিখ্যাত চরিত্র গ্যানিমিডের জেন্ডার ছিল ব্যতিক্রমী।
তাদের প্রতি সুবিচার করতে নিজের বিবেকের কাছেই সাংস্কৃতিক দূতেরা বেশ অপরাধী হয়েছিল। সবাই না, কেউ কেউ। হঠাৎ যখন জানতে পারল যে তাদের এখানে থাকতে হবে, তাও আবার দু দশদিন নয়, কয়েক মাস-দুঃখটা মূলত তখনি মনের কোণে দানা বাঁধে। একে তো এখানে বিনোদন আর আবহের বিস্তৃতি নেই, তার উপর বিখ্যাতরা ছোট্ট পরিসরে বেশিদিন থাকতে পারে না এবং সর্বোপরি, এখানকার পরিবেশ তাদের কেউ কেউ নিজেদের শখের বশেই বিষাক্ত করে তুলেছে নিজেদের জন্য।
তারপর, তারা সবাই চারপাশের সবার জন্য যথাসম্ভব কল্যাণকর কাজ করার সিদ্ধান্ত নিল সর্বান্তকরণে। অবশ্য সবার ইচ্ছা বা সময় নেই উপকৃত হবার। তারা সৌর জগতের অগ্রসর প্রযুক্তির এই সম্মুখ সমরের রণক্ষেত্রে নিজেদের কাজে নাক মুখ ডুবিয়েই নাকি কুল পায় না।
উল্টোটা সব সময় যার ক্ষেত্রে ঘটে এবারও তার ক্ষেত্রেই ঘটল। ইভা মারলিন এখানে শুধু মানিয়েই নেয়নি, বরং উপভোগ করছে পুরো ব্যাপারটাকে। পৃথিবীতে তার ভুবন দোলানো জয়জয়কার থাকলেও এই এখানে, মেড়রা তার নাম খুব কমই শুনেছে। সে খোলামেলা চলাচল করতে পারে! পাবলিক করিডোর, সেন্ট্রালের প্রেশার ডোমগুলোতে, সে চলতে পারে বিনা বাধায়। লোকজন ফিরে তাকায় না, ফিসফাস করে না নিজেদের মধ্যে। অবশ্যই, তাকে দেখে সবাই চিনতে পারছে, কিন্তু ইভা মারলিন হিসেবে নয়, বরং পৃথিবী থেকে আসা মানুষগুলোর একজন হিসেবে।
আর, যেখানেই যাক না কেন, মিশে যাওয়ার মানুষটা-কাজে জোর করে ঢুকে যাবার মানুষটা-গ্রিনবার্গ ঠিকই মিশে গেল গ্যানিমিডের মাটির সাথে। এরই মধ্যে অন্তত আধ-ডজন বিজ্ঞান সংস্থার মূল বোর্ডে সে একজন অস্থায়ী উপদেষ্টা অথবা সদস্য অথবা সচিব। প্রশাসন আর প্রযুক্তির জগতে তার দোর্দণ্ড প্রতাপ। তার কাজে গ্যানিমিড এতোই খুশি যে ছাড়ার নাম করছে না বরং না-ও যেতে দেয়া হতে পারে টাইপের হুমকি দিচ্ছে জোরেসোরে।
হেউড ফ্লয়েড ঠাণ্ডা মাথায় তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে তার শিপমেটদের কাণ্ড কারখানা; তবু, সেতো আর সমাজছাড়া নয়, এক আধটু অংশগ্রহণও খারাপ না। তার মূল সমস্যা ক্রিসের সাথে যোগাযোগ স্থাপন। মনের গভীরে প্রবেশ করতে চাচ্ছে সে। দেখতে চাচ্ছে দৌহিত্রের অন্তস্থল; ভবিষ্যতের পরিকল্পনা পাকা করে দিতে চাচ্ছে।
এখন, ইউনিভার্স শত টনেরও কম প্রোপ্যাল্যান্ট নিয়ে এখানে নামাতে হাতে সময়ের কোনো অভাব নেই এবং তাই কাজও গজিয়ে উঠছে আপনাআপনি।
উদ্ধারকর্তাদের প্রতি উদ্ধারকৃতদের কৃতজ্ঞতা দু দলকে এক করে দিয়েছে নিমেষে। ঝালাই-ঘষা মাজা আর ফুয়েলিংসহ সব কাজ শেষ হয়ে গেলে তারা এক দল হিসেবেই উপস্থিত হবে পৃথিবীর অর্বিটে।
উল্লাসে ফেটে পড়েছে ক্রুরা এক খবর পেয়ে। স্যার লরেন্স বলেছে, কদিনের মধ্যেই অত্যাধুনিক… না, সর্বাধুনিক শিপের জন্ম হচ্ছে, গ্যালাক্সি টু। শিপের কন্ট্রাক্ট দিতে পারছে না সুং কোম্পানি বিভিন্ন আইনী জটিলতার কারণে। লয়েডস এর সাথে একটা বোঝাপড়ায় আসার জন্য তার আইনবিদেরা উঠেপড়ে লেগেছে। কোম্পানিটা এখন নতুন কথা বলে হরদম, তাদের মতে, মহাকাশ ছিনতাইয়ের মতো কোনো ঘটনা তাদের চুক্তিপত্রের আওতায় পড়ে না। লয়েডস এর বীমা এক্তিয়ারে এমন কোনো ব্যাপার মহাকাশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
ঘটনার জন্য কাউকে দায়ী করা হয়নি। এই ঝামেলায় না যেতে চাচ্ছে সুং কর্পোরেশন না লয়েডস। যে দল বছরের পর বছর ধরে পরিকল্পনা করে এত নিখুঁতভাবে গ্যালাক্সিকে হাইজ্যাক করতে পারে তাদের বিপরীতে অবস্থান নেয়া
বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ইউনাইটেড স্টেটস অব সাউদার্ন আফ্রিকা জোর গলায় প্রতিবাদ জানিয়েছে। বরং অফিসিয়ালি যে কোনো সংস্থার যে কোনো তদন্ত মাথা পেতে নিতে রাজি। ডার বান্ডও যথারীতি হল্লা করে মরছে, দোষ চাপাচ্ছে শাকার উপর।
ড. ক্রুগারকে এম্নিতে কোনো হুমকি দেয়া হয়েছে কিনা তা এখনো তিনি দেখেননি। শুধু হাজার হাজার ই-মেইল দেখেই তিনি তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছেন। সবগুলোই ন্যাকা কথায় ঠাসা, বিশ্বাসঘাতক, কৃতঘ্ন… ইত্যাদি ইত্যাদি।
লেখাগুলোর বেশিরভাগই আফ্রিকান ভাষায় হলেও অনেক অনেক চিঠির বানানে ভুল, ফ্রেজের কোনো আগামাথা নেই, ব্যাকরণতো বাদ। দেখেই বোঝা যায় বেচারাদের বোধশক্তি নিম্নস্তরের, নয়তো কোনো অপপ্রচারে মাথা গেছে ঘুরে।
তাই তিনি সাথে সাথেই চিঠিগুলো পাঠিয়ে দিলেন অ্যাস্ট্রোপোলে। ইন্টারপোলের এই নবরূপ সেগুলো নিল ঠিকই, ধন্যবাদও দিল অনেক, কিন্তু যা তিনি আশা করেছিলেন তা আর হল না। কোনো মন্তব্য করল না তারা।
যে দু বহির্বিশ্বের আগন্তুকের সাথে সেকেন্ড অফিসার ফ্লয়েড আর চ্যাঙ কথাবার্তা বলেছিল এবং অবশ্যই, মুখোমুখি হয়েছিল সে দুজনের। তাই, সে গল্প শুনতে তাদের প্রায়ই দাওয়াত করা হয় গ্যানিমিডের বড় বড় জায়গায়। সেখানে তারা খাবার পর এবং এমনকি খাবার সময়টাতেও হাজার প্রশ্নে জর্জরিত হয়। ভদ্র প্রশ্ন, অবশ্যই-এমন প্রশ্ন যা দেখে ঠিক প্রশ্ন বলে মনে হবে না। বোঝাই যায় বিভিন্ন সংস্থা শাকার অস্তিত্বের ভিত নড়িয়ে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
ভ্যান ডার বার্গ, যে খুব সূক্ষ্মভাবে এই পুরো ব্যাপারটার সাথে জড়িয়ে গিয়ে সময় মতো আর্থিক ও বৈজ্ঞানিক দিক থেকে দারুণ লাভবান হয়ে গা বাঁচিয়ে সটকে পড়েছে সে এবার দাও মারার নতুন ক্ষেত্র গড়ার চেষ্টায় মত্ত। পৃথিবীর ইউনিভার্সিটি আর ল্যাবগুলো থেকে, সায়েন্টিফিক অর্গানাইজেশনগুলো থেকে অনেক অনেক অফার আসছে সারাক্ষণ। কিন্তু নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস, সেসব গ্রহণের কোনো সুযোগ আর নেই। সে এতোদিন এক ষষ্ঠাংশ গ্রাভিটিতে বসবাস করেছে যে এখন আর, মেডিক্যাল রিপোর্ট অনুযায়ী, কোনো ফেরা নেই।
এখনো চাঁদে একটা সুযোগ আছে, আর হেউড ফ্লয়েড পাস্তুরের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করাতে সেখানেও চান্স নেয়া যায়।
আমরা এখানে একটা স্পেস ইউনিভার্সিটি গড়ার ধান্ধায় আছি। বলল সে, যেন বাইরের দুনিয়ার মানুষেরা, যারা এক জি সহ্য করতে পারে না তারা এগিয়ে আসতে পারে। রিয়েল টাইম পড়াশোনা করতে পারে পৃথিবীর মানুষের সাথে। লেকচার হল, কনফারেন্স রুম, ল্যাব সবই থাকবে। কোনো কোনোটা থাকবে শুধু কম্পিউটারের ভিতরে। কিন্তু দেখে বোঝার কোনো উপায় থাকবে না। আর, মনের অস্থিরতা কমানের জন্য আপনি হরদম ভিডিও শপিংয়ের জন্য পৃথিবীতে যেতে পারবেন।
অবাক হয়ে দেখল ফ্লয়েড, তার শুধু একটা নতুন দৌহিত্রের জন্ম হয়নি, বরং একজন ভাস্তেও জুটে গেছে। ফ্লয়েড, ভ্যান ডার বার্গ আর ক্রিস একে অন্যকে খুব ভালভাবেই বুঝতে পারে, শেয়ার করে অন্যজনের অনুভূতি। তার উপর তাদের এই একাত্মবোধের পিছনে বিরান নগরীতে, মনোলিথের সামনে যে বিপদে তারা তিনজন একত্র হয়েছিল সে ব্যাপারটা বিরাট অবদান রাখছে।
ক্রিসের আজো কোনো সন্দেহ নেই, আমি তোমাকে দেখেছিলাম। শুনেছিলাম তোমার কথা এখন যেমন শুনছি তেমি। কিন্তু ঠোঁট নড়েনি কখনো। আর কথা যে মাথায় বেজেছে তাতো শুনেছ। সবচে বড় কথা, ব্যাপারটা যেন একেবারে আটপৌরে। এমন যেন অহরহ ঘটে। একটু যেন দুঃখ মিশে ছিল। ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। এর সাথে বাস্তব অভিজ্ঞতা মিলবে না।
আমরা কিন্তু ডিসকভারির বুকে আপনার সেই দুনিয়া কাঁপানো ডেভ বোম্যান মোলাকাতটার সাথে এ ব্যাপারটাকে গুলিয়ে না ফেলে পারিনি। বলল ভ্যান ডার বার্গ।
ইউরোপার অনেক দূরে থাকতেই আমি তার সাথে রেডিও যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেছি। একেবারে ছেলেখেলার মতো মনে হলেও এ ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না আমার সামনে। আমি শিওর ছিলাম ও সেখানেই কোথাও ঘোরাফেরা করছে।
তারপর তুমি কোনো প্রাপ্তিস্বীকার পাওনি, দাদু?
একটু ইতস্তত করছে ফ্লয়েড। স্মৃতিটা খুব তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেলেও হঠাৎ সে রাতের সেই মিনি মনোলিথটার কথা মনে পড়ে গেল।
কিছুই হয়নি তখন। শুধু একটা ছোট্ট একশিলাস্তম্ভ হাজির হয়েছিল তার সামনে। আর কেন, কে জানে, তখন থেকেই সে মনে মনে নিশ্চিত হয়ে গেছে দেখা হবে। দেখা হবেই ক্রিসের সাথে।
না। ধীরে ধীরে বলল অশীতিপর বিখ্যাত মহাকাশবিদ, আমি কোনো জবাব পাইনি কখনো।
হাজার হলেও, ব্যাপারটা স্বপ্ন হতেই পারে। আর স্বপ্নে মানুষ তাই দেখে যা তার অবচেতন মন চায়।