চতুর্থ পর্ব – পানির গর্তে
৩২. ধনুকভাঙা পণ
সর্বশেষ খবর হল, বলছে ক্যাপ্টেন স্মিথ, তার নতুন যাত্রীদের প্রতি, গ্যালাক্সি ভাসছে এবং তার অবস্থাও বেশ ভাল। একজন ক্রু মেম্বার মারা গেছে, মহিলা স্টুয়ার্ড। বাকী সবার অবস্থা ভাল, নিরাপদেই আছে সবাই।
শিপের সব সিস্টেম ঠিকমতো কাজ করছে । দু চার জায়গায় ছিদ্র থাকলেও সময় মতো সামলে নিয়েছে তারা। ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস বলেছেন আপাতত কোনো বিশেষ বিপদ নেই। কিন্তু বিশেষ বাতাসটা ভূমি থেকে আরো দূরে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, দিবাভাগের কেন্দ্রের দিকে। দিনের অংশে আশপাশের হাজারখানেক কিলোমিটারের বাতাস সারাক্ষণ সেদিকেই যায়, কারণ সেখান থেকে বাষ্পের সাথে সাথে বাতাসও গরম হয়ে উপরে ওঠে সব সময় লুসিফারের তাপে সিদ্ধ হয়ে । কিন্তু প্রব্লেমটা মেজর নয়। দেখে বোঝা যাচ্ছে বড়বড় বেশকিছু দ্বীপের মধ্যে কোনো কোনোটায় তারা গিয়ে ঠেকতে পারবে।
বর্তমানে তারা সবচে কাছের ভূ-ভাগ থেকে নব্বই কিলোমিটার দূরে। বেশকিছু বড় সামুদ্রিক প্রাণীর দেখা পাওয়া যায় সেখানে। সেগুলো কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
এখন কোনো উটকো ঝামেলায় না পড়লে আরো মাস কয়েক টেনেটুনে চলতে পারবে। খাবারের সঙ্কটটাই প্রধান এবং শক্ত রেশনিং চলছে। কিন্তু ক্যাপ্টেন ল্যাপাসের মতে মনোবল এখনো অটুট আছে সবার।
“এখন, আমরা এমন এক জায়গাতেই যাচ্ছি। রওনা হয়ে পৃথিবী থেকে জ্বালানী নিতে হবে। তারপর অর্বিটে পৌঁছতে পৌঁছতে ৮৫ দিন লেগে যেতে পারে। আর বর্তমানে একমাত্র ইউনিভার্সই সেখান থেকে যথেষ্ট পে লোড নিয়ে আবার ওটার ক্ষমতা রাখে। গ্যানিমিডের শাটলগুলো বড়জোর সাপ্লাই ফেলতে পারে, তাও পাবার ঠিক ঠিকানা নেই। এবং এ কাজ করতে গিয়ে ধসে পড়ার ভয়ও থাকে।
“আই অ্যাম স্যরি, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন, কিন্তু আমাদের যাত্রা একটু কেটেহেঁটে ছোট করতে হচ্ছে। কিন্তু আপনারা নিশ্চই একমত হবেন যে ওয়াদামতো আমরা আপনাদের সব দেখিয়েছি, এবং এ নিয়েও আমি নিশ্চিত যে নতুন মিশনের ব্যাপারেও আপনাদের কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। যদিও, মুক্ত মনে বলতে গেলে, সফলতার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। এখনকার মতো এটুকুই বলতে চেয়েছিলাম। ড. ফ্লয়েড, আপনার সাথে একটু কথা বলা যাবে?
সবাই চিন্তিত মনে ভেসে বেরিয়ে যাবার সময় ক্যাপ্টেন একটা ক্লিপবোর্ড হাতে তুলে নিল। এ যুগেও মাঝেমধ্যে কাগজের টুকরাতে ডাটা প্রিন্ট করা হয়, কিন্তু খুব কম। এখানেও একটা কিন্তু থেকে যায়, এ মাল্টিফ্যাক্স পেপার এক বিশেষ জিনিস। ওয়েস্ট পেপার বক্সের ওজন কমানোর জন্য এক কাগজেই হাজারবার প্রিন্ট নেয়া হয়।
হেউড সে বলল, কারণ আনুষ্ঠানিক ভদ্রতার সময় শেষ হয়ে গেছে, দেখতেই পাচ্ছেন, এতো এতো তথ্য আসছে যে সার্কিট পুড়ে যাবার দশা। আর চারধারে এতোকিছু ঘটছে যে মাথায় চট করে কিছু ঢোকে না।
ক্রিসের কোনো খবর, ডিটো?
“না। কিন্তু গ্যানিমিড আপনার খবর প্রচার করেছে। এর মধ্যে তার মেসেজটা পাবার কথা, এমিতেও প্রাইভেট মেসেজের উপর আমাদের পাঠানো খবরগুলোর প্রাধান্য আছে, তার উপর আপনার নাম নিশ্চই জাদুমন্ত্রের মতো কাজ করবে, অন্তত করার কথা।
“থ্যাঙ্কস, কাপ্তান। কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?
আসলে, না-আমি আপনাকে সাথে সাথেই জানাব।
এই শেষবার তারা নিকট বন্ধুর মতো পরস্পরের সাথে কথা বলছে, আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। তারপরই ড, হেউড ফ্লয়েড হয়ে যাবে, ঐ পাগলা বুড়োটা… আর শুরু হবে ক্ষণস্থায়ী, ইউনিভার্সের বুকে বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহে পুরোধা হবে ক্যাপ্টেন স্বয়ং।
.
আইডিয়াটা আসলে হেউড ফ্লয়েডের নিজস্ব নয়; সে শুধু আশা করেছিল যেন…
সেকেন্ড অফিসার রয় জলসন নেভিগেশন অফিসারদের মধ্যে তারকায় পরিণত হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। এর আগে ফ্লয়েড তার সাথে খুব একটা কথাবার্তা বলেনি, মুখচেনা লোকটাকে বড়জোর শুভ সকাল জানানো হত। তাই ফ্লয়েডের কেবিনে অন্যরকম নক শুনে বেশ অবাক হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
অ্যাস্ট্রোগেটর (মহাকাশ নেভিগেটর) হাতে একগাদা চার্ট নিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছিল; এম্নিতেও ফ্লয়েড তার উপস্থিতি টের পায়নি। তার উপর শিপের আবহাওয়া গেছে। বদলে। তবু এভাবে আসার অন্য কোনো কারণ অবশ্যই আছে।
ড, ফ্লয়েড, সে হড়বড় করে কথা শুরু করল, যেমন করে নতুন সেলসম্যান তার লাইসেন্সদাতার কাছ থেকে লাইসেন্স পাবে নাকি পাবে না তা জানার আগে কথা বলে, সেভাবে, আমি আপনার পরামর্শ চাই-এবং একটু সহায়তা।
অবশ্যই! কিন্তু কী করতে পারি আমি আপনার জন্য?
জলসন চার্টটা মেলে ধরল সামনে। চার্টে লুসিফার অর্বিটের ভিতরে সব গ্রহের অবস্থান দেখাচ্ছে।
লিওনভ আর ডিসকভারিকে জুড়ে দিয়ে বৃহস্পতি জগৎ ধসে পড়ার আগে টেনে নেয়ার যে পদ্ধতি আপনি নিয়েছিলেন, সেটাই আমাকে আইডিয়াটা দিয়েছে।
ধারণাটা আমার নয়, ওয়াল্টার কার্নোর মাথা থেকে বেরিয়েছিল।
ও-আমি এ কথা জানতাম না। অবশ্যই, এখানে গতি বাড়ানোর জন্য আমাদের হাতে অন্য কোনো শিপ নেই, কিন্তু অন্য কোনো ব্যাপার আছে। আরো বড় ফ্যাক্টর।
কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে ফ্লয়েড প্রশ্ন তুলল।
কেন কষ্ট করে পৃথিবী পর্যন্ত যাব? যেখানে দুশ মিটার দূরে ওল্ড ফেইথফুল আমাদের জ্বালানী বুকে নিয়ে বসে আছে! তিন মাসের জায়গায় হপ্তা তিনেক লাগবে, বড়জোর। তারপর সোজা ইউরোপার বুকে নামব আমরা।
চিন্তাটা এতো অবাক করা যে ফ্লয়েড কয়েক মুহূর্তের জন্য শ্বাস নিতে ভুলে গেল। সাথে সাথেই চোখের সামনে আধ ডজন অভিযোগ ভেসে উঠল, কিন্তু কোনোটাই খুব বেশি ভয়ংকর নয়।
ক্যাপ্টেন কী ভাবছে এ নিয়ে?
তাকে বলিনি। আপনার কাছ থেকে এই সাহায্যটাই চাই। আগে হিসাবনিকাশ শেষ করে তারপর বলব। সে পাত্তাই দেবে না-অবশ্যই। আমি হলেও তাই করতাম…।
ছোট্ট কেবিন অনেক অনেকক্ষণ ধরে চুপ থাকার পর ফ্লয়েড বলল, ধীরলয়ে, কেন কাজটা সম্ভব না তা বলার ফুরসত দিন আমাকে। তারপর আপনি জানাবেন আমার কোথায় কোথায় ভুল হল।
.
সেকেন্ড অফিসার জলসন তার ক্যাপ্টেনকে হাড়ে হাড়ে চেনে। সে জিন্দেগীতেও এমন কথায় কান দেবে না..
তার জেদটা একটু পুরনো তালের। তোমার কথা ঠিক আছে, কিন্তু মানা সম্ভব না.. এখানে প্রযোজ্য নয় (এবং, তোমার মাথায় এই আইডিয়া আসার কথা নয়) গোছের।
ও-এটা তত্ত্বেই সম্ভব, বাস্তবে না। বাস্তববাদী হও, ছেলে। দেখ, কীভাবে ওগুলো ট্যাঙ্কে ভরবে?
ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে আগেই কথা হয়েছে আমার। জ্বালামুখের পঞ্চাশ মিটারের মধ্যে শিপ নিয়ে যাওয়া তেমন বিপজ্জনক নয়। তারপর একটা লাইন টেনে নিব ওল্ড ফেইথফুলের দিকে। আপনিতো জানেন, সেটা যথেষ্ট ভাল আচরণ করে।
কিন্তু প্রায় শূন্য বায়ুচাপে আমাদের পাম্প কাজ করবে না।
তাদের কোনো দরকার নেই। উষ্ণ প্রসবণটার নিজস্ব গতিই যা করার করবে। প্রতি সেকেন্ডে শত কিলোমিটারের চেয়েও বেশি স্পিড দিতে পারবে তখন।
সেটা শুধু ক্রিস্টাল বরফ আর বাস্প দিবে, তরল পানি নয়।
শিপে ঢুকতে ঢুকতে জুড়িয়ে যাবে সেগুলো।
“তুমি আসলেই এ নিয়ে ভেবেছ, তাই না? ক্যাপ্টেন ফুঁসছে কিন্তু বুঝতে দিতে চাচ্ছে না, এবং তা বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু আমি শুধু ব্যাপারটা বিশ্বাস করি না। ব্যস। পানি কি যথেষ্ট খুঁটি? সেখানে কার্বনের গুঁড়া ভর্তি। তা নিয়ে কী করবে?
ফ্লয়েড না হেসে পারল না। ক্যাপ্টেন স্মিথ যেন গুলি করার পাঁয়তারা কষছে…
বড়গুলোকে হেঁকে তোলা সহজ। আর রিয়্যাকশনে ছোটগুলো কোনো প্রভাবই ফেলবে না। হাইড্রোজেন আইসোটোপের হার পৃথিবীর চেয়ে বেশি মনে হচ্ছে। ফলে আরো বেশি থ্রাস্ট পাওয়া সম্ভব।
আপনার কলিগরা আইডিয়াটা নিয়ে কী ভাবছে? এখন সোজা লুসিফারের দিকে তেড়ে গেলে তাদের বাড়ি ফিরতে আরো বেশ কমাস লেগে যাবে…
আমি তাদের সাথে কোনো কথা বলিনি। কিন্তু এতো জীবন ঝুঁকিতে থাকার সময় এটা কোনো ব্যাপার নাকি? আমরা গ্যালাক্সিতে পৌঁছতে পারি সত্ত্বর দিন আগেই। সেভেন্টি ডেজ! একবার চিন্তা করুন, এই সময়ে ইউরোপায় কী না হয়ে যেতে পারে!
আমার সময়জ্ঞান যথেষ্ট টনটনা আছে এখনো। হাত নাড়ল ক্যাপ্টেন, ব্যাপারটা আমাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমরাও এতো লম্বা যাত্রা করতে চাই না।
এখন ফ্লয়েড ভাবল, আমার ভাবনা সেও জেনে যেতে পারে, তারচে একটু কৌশলী হওয়া ভাল…
মাত্র বাড়তি দু সপ্তা! ভাবতে অবাক লাগছে, আমাদের মানসিকতা এতো সংকীর্ণ হয়ে গেল কীভাবে! আপনি আমাদের অত্যন্ত ভালভাবে খাওয়াচ্ছেন। আমাদের কেউ কি হপ্তা দুয়েকের জন্য খাবার চুলচেরা করে খেতে রাজি আছে?
ক্যাপ্টেন কোনোমতে একটা বরফ-জমাট হাসি যোগাড় করল মুখ জুড়ে।
কথাটা উইলিস আর মাইকেলোভিচকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। কিন্তু আমার ধারণা পুরো আইডিয়াটাই উদ্ভট।
যাই হোক, অন্তত মালিকপক্ষের হাতে ছেড়ে দিন ব্যাপারটা। আমি স্যার লরেন্সের সাথে কথা বলতে চাই।
আমি আপনাকে বাঁধা দিতে পারিনা। অবশ্যই। ক্যাপ্টেন স্মিথ এমন এক সুরে বলল, যেন পারলে সে বেশ খুশিই হয়, কিন্তু আমি ঠিকই জানি তিনি কী বলবেন।
ক্যাপ্টেন স্মিথের কথা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল।
.
স্যার লরেন্স ত্রিশ বছর ধরে বাজি জিতে জিতেও খুশি নয়, বর্তমান বিশ্ববাজারে তার অবস্থান যথেষ্ট নয় যেন। বাজি সে সবখানেই ধরে। হং হং রেসকোর্সে তাই তার নিয়মিত যাতায়াত। কিন্তু মানুষের সাধারণ মানবিকতার কারণে সরকার রেসকোর্সটা বন্ধ করে দিয়েছে। কী নিষ্ঠুর খেলা! যখন খেলাটা খেলার উপায় ছিল তখন টাকা ছিল না, আর বর্তমানে বিশ্বের সবচে ধনী লোকটার এ খেলা খেলার ইচ্ছা থাকলেও কোনো উপায় বাকী নেই। অন্য পথে বাজি জিতে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপনের উপায় আছে এখনো।
আর তারচে ভাল কেই বা জানে, তার পুরো ক্যারিয়ারটাই এক জুয়া। সে সব সময় নিষ্ঠুর হাতে বিরূপ পরিবেশকে নিজের মতো গড়ে নিয়েছে, নিয়েছে লাখো ঝুঁকি এবং সবশেষে, সবচে দক্ষ লোকগুলোকে সবচে দামী উপদেশের জন্য সবচে বেশি মূল্য দিয়েছে। সে তারপরই কাজ করত, এবং তাদের কথা ভুল হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়ার সাথে সাথে আরো নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া হতো; তার পরও, পুরো জীবনটাই এক জুয়া।
এখন, হেউড ফ্লয়েডের কাছ থেকে পাওয়া মেমোরেন্ডাম পড়তে পড়তে, হঠাৎ যৌবনের সেই ঘোড়াগুলোর শেষচক্র পূর্ণ করার কথা মনে পড়ে যায়। কী উত্তেজনা, কী উত্তেজনা চারদিকে! এটাও এক জুয়া, সম্ভবত তার জীবন এবং ক্যারিয়ারের শেষ এবং সবচে বড় বাজি, যদিও সে কখনো তার বোর্ড অফ ডিরেক্টরসকে কোনো আদেশ দিতে ভয় পায় না…
বিল, তোমার কী মনে হয়?
তার ছেলে (স্থির এবং ভরসা করা যায় তার উপর। কিন্তু সেই ঝলক নেই-ঝলকটা অবশ্য প্রয়োজন পড়বে না আরো কয়েক প্রজন্মের মধ্যে) প্রত্যাশিত জবাবই দিল ।
থিওরিটা কাগজে কলমে ভাল। এদিকে আমরা এরই মধ্যে একটা শিপ হারিয়ে বসেছি। অন্যটাকেও গাড্ডায় ঠেলে দেয়া কি ঠিক হবে?
শিপটা বৃহস্পতিতেমানে লুসিফারে যাচ্ছে।
হ্যাঁ, কিন্তু পৃথিবীর অর্বিটে একটা পূর্ণ চেক-আউটের পর। আর আপনি কি ভাবতেও পারেন কত ঝুঁকি নেয়া হবে একাজে? সে সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙে সেকেন্ডে হাজার কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাবে। এবং ফিরে আসবে। এজন্য আর যাই হোক, যত্ন দরকার।
এরচে অভদ্রভাবে তার পক্ষে বাবাকে কিছু বলা সম্ভব নয়।
বেশ শান্ত সুরেই স্যার লরেন্স জবাব দেয়, একটা পরীক্ষা করলে দোষ কী? অবশ্য ক্যাপ্টেন স্মিথ দাঁত-নখ দিয়ে যুদ্ধ করছে। সম্ভবত পদত্যাগ করবে। যাই হোক, লয়েডস এর সাথে কথাবার্তা সেরে ফেল। আমরা গ্যালাক্সি দাবী করতেই পারি।
সে বলতে পারতো, অন্য শিপটাকেও সেদিকে ছুঁড়ে দিচ্ছি, আর্থিক দিক দিয়ে হিসাব করলে লাভই হবার কথা।
ক্যাপ্টেন স্মিথের ব্যাপারে সে বেশ দুঃখিত। অন্যদিকে ল্যাপ্লাস পচছে ইউরোপায়। আর কে আছে এখন পৃথিবীতে এতো দক্ষ?
৩৩. গর্তের শেষ
কলেজ ছাড়ার পর সবচে বিশ্রী কাজ এটা, কিন্তু এ ছাড়া আর কী করার আছে আমাদের?
উম্মা ঝাড়ল চিফ ইঞ্জিনিয়ার।
পঞ্চাশ মিটার লম্বা পাইপলাইনের ভিতর দিয়ে এখন ওল্ড ফেইথফুলের বাষ্প আর বরফকণার সাথে কার্বনের সূক্ষ্ম আকৃতি এগিয়ে যাবে। সূর্য ওঠার সাথে সাথে উষ্ণ প্রসবণটার ভিতরে চঞ্চলতা বেড়ে যাবে অনেকখানি।
অবজার্ভেশন লাউঞ্জ থেকে দেখতে দেখতে হেউড ফ্লয়েড ভাবল, চব্বিশটা ঘন্টা কাটতে না কাটতেই এতোকিছু হয়ে গেল কীভাবে! প্রথমেই শিপের সবাই দু ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল, একদল ক্যাপ্টেনের পক্ষে, অন্যদল ফ্লয়েডের। এম্নিতে কোনো
প্রকাশ্য বিতর্ক হয়নি, এমনকি শীতল হলেও সৌজন্যমূলক কথাবার্তাও চলেছে, সামনে পড়ে গেলে। কিন্তু আড়ালে আবডালে কেউ কেউ তাকে সুইসাইড ফ্লয়েড নামেও ডেকেছে। হাজার হলেও, জীবনভর যে সম্মান নিয়ে চলেছে সে, সেটার সাথে মানাচ্ছে না ব্যাপারটা।
এখনো কেউ ফ্লয়েড-জলসন চলনের কোনো ভুল খুঁজে পায়নি। (নামটাও অন্যায়: সে হাজারবার বলেছে যে সমস্ত ক্রেডিট জলসনের; কিন্তু কে শোনে কার কথা! তারপর সহাস্যে মাইকেলসন বলল, তুমি কি দোষের ভাগ নিজের কাঁধে নিতে চাও না?)
বিশ মিনিটের মধ্যে প্রথম টেস্ট হয়ে যাবার কথা ওল্ড ফেইথফুলে সকাল হবার সাথে সাথেই। আর সাথে সাথেই যদি ক্যাপ্টেন স্মিথের কথামতো কাদামাটির বদলে বিশুদ্ধ পানিতে ট্যাঙ্ক ভরে উঠতে শুরু করে তাহলেই ইউরোপা যাবার পথ বেরিয়ে যাচ্ছে না।
সমস্যাটা ছোট হলেও চিন্তা করতে হবে। অতিথিদের ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে। তারা সবাই মাটির সেরা সন্তান, দুসপ্তাহের মধ্যে বাড়ি ফেরার কথা ছিল, সেখানে তাদেরকে সৌর জগতের একদিক থেকে আরেকদিকে, প্রায় অর্ধেক এলাকা ঘুরিয়ে একটা নিষিদ্ধ অঞ্চলে নিয়ে গিয়ে (যেখানে উদ্ধার পাওয়াও এক প্রশ্ন) আবার ফিরিয়ে আনতে হবে উদ্ধারপ্রাপ্ত লোকদের সাথে খাবার এবং সুবিধা শেয়ার করিয়ে। তাদের বয়সটাও বিবেচ্য।
উইলিস বেশ বিরক্ত হয়েছে, তার সব শিডিউল এলোমেলো হয়ে যাবে। সে উড়ে বেড়াতে বেড়াতে আইনের আশ্রয়ে যাবার কথা বলছিল বেশ গরম সুরে, কিন্তু কেউ দাম দেয়নি।
টগবগ করে ফুটছে গ্রিনবার্গ। অনেক বছর পর, আবার সে সত্যিকার স্পেস অভিযানে নামতে পারবে। অন্যদিকে মাইকেলোভিচ তার বেশিরভাগ সময় নষ্ট করে গেছে সাউন্ডপ্রুফ অফিসে বসে বসে কম্পোজ করার কাজে, সেও বেশ উৎফুল্প। তার বিশ্বাস, এই পরিবর্তনটা জীবনে নূতন গতি এনে দেবে, সৃষ্টিশীলতা আসবে আবার ফিরে।
ম্যাগি পুরোপুরি দার্শনিকতায় ভরপুর: যদি কাজটা অনেক জীবন বাঁচায়, তো উইলিসের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বাকীটা শেষ করে সে, কী করে কোনো মানুষ এর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে?
ইভা মারলিনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যভাবে এসেছে। ফ্লয়েড সময় নিয়ে সবকিছু বুঝিয়েছে তাকে, তারপর আবিষ্কার করেছে যে সেও পরিস্থিতি বুঝতে পারে বেশ সহজেই। অবাক হয়ে সে লক্ষ্য করে অন্যরা যে প্রশ্ন তোলেনি তাই ইভার মনে উঁকি দিয়েছে সবার আগে, যদি ইউরোপানরা আমাদের ল্যান্ড করতে দিতে না চায়? যদি
তারা উদ্ধার করতে দিতে না চায় তখন?
ফ্লয়েড এখনো তাকে ঠিক রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে মেনে নিতে পারছে না। সে দুর্বোধ্য জগত থেকে কখন বেরিয়ে আসবে কে জানে! তার অন্যরকম থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।
বিশ্বাস কর, আমি এ নিয়ে কাজ করছি এখনো, ইভা।
তার কথা সত্যি। সে কখনো ইভা মারলিনের সাথে মিথ্যা কথা বলতে পারবে না।
.
উষ্ণ প্রসবণ থেকে বাস্পের প্রথম ছোঁয়া বেরিয়ে আসে একটু একটু করে, তারপর একেবারে হঠাৎ উপরের সবটুকু আকাশের সারা বাঁধা এড়িয়ে তীরবেগে উঠে যেতে থাকে উপরদিকেই।
আবারও ওল্ড ফেইথফুলের মুখ খুলে গেছে। আকাশের দিকে তুষারশুভ্র এক স্তম্ভ উঠে গেছে বিনা বাঁধায়। যে কারো পার্থিব দৃষ্টি আশা করবে প্রসবণটার উপরপ্রান্ত ব্যাঙের ছাতার মতো বেঁকে গিয়ে ফিরে আসবে মাটিতে, কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি। খুব কমই ছড়াচ্ছে আশপাশে, এবং উঠতে উঠতে মিশে যাচ্ছে এর বাড়তে থাকা বিশাল বাষ্প-খামের সাথে। ফ্লয়েড দেখল পাইপলাইনটা ঋকি খাচ্ছে, ভিতরে তরল।
দশ মিনিট পর ব্রিজের উপর একটা যুদ্ধসভা বসল। ক্যাপ্টেন স্মিথ সামান্য মাথা নুইয়ে ফ্লয়েডের উপস্থিতি স্বীকার করল। তার সারিন্দাই সব কথা বলল, একটু অপ্রস্তুত হয়ে।
যাই হোক, কাজ করছে চমৎকার। বিশঘণ্টা এ হারে পানি ভরলেই আমাদের সবটা পূর্ণ হয়ে যাবে। বাইরে গিয়ে পাইপটা একটু শক্ত করে নিতে হবে, এই যা।
ময়লার কী হবে? প্রশ্ন তুলল কেউ একজন।
ফাস্ট অফিসারের হাতে একটা স্বচ্ছ স্কুইজ বা ধরা, সেটায় স্বচ্ছ পানি ভরা।
কয়েক মাইক্রন পর্যন্ত যা ছিল সবই ছেকে নিয়েছে ফিল্টারগুলো। নিরাপত্তার খাতিরে আমরা কাজটা একাধিকবার করব। এক ট্যাঙ্ক থেকে আরেকটায় পানি নিয়ে গেলে ফিল্টারিংয়ের কাজ আরো সূক্ষ্মভাবে হয়। মঙ্গল ছেড়ে যাবার আগে কোনো সুইমিং পুল নয়।
এতোক্ষণে একটু হাসির আওয়াজ উঠল আশপাশ থেকে। ফলে ক্যাপ্টেনও সহজ হয়ে এল একটু। হাসিটা দরকার ছিল খুব।
হ্যালির পানিতে কোনো সমস্যা নেই তা বোঝার জন্য একটু সময়ের জন্য ইঞ্জিন চালানো হবে। যদি বিন্দুমাত্র সমস্যা দেখা দেয় তো নির্দ্বিধায় চাঁদে ফিরে গিয়ে সহজ সরল এ্যারিস্টার্কাসের পানিই ব্যবহার করব।
এখানেও সেই পার্টি নিরবতা জেঁকে বসেছে, যখন সবাই আশা করে অন্য কেউ কথা বলবে।
আর না পেরে ক্যাপ্টেন স্মিথ অস্বস্তিকর পরিবেশটা ভেঙে দিল।
আপনারা সবাই জানেন আমি পুরো আইডিয়াটার উপর খুব নাখোশ। এমনকি তারপর হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। সবাই জানে যে সে এই নাখোশির প্রমাণ– স্বরূপ স্যার লরেন্সের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছিল।
কিন্তু গত কয়েক ঘণ্টায় যেন কয়েক রাত কেটে গেল। মালিকপক্ষ রাজি, যদি
কোনো মৌলিক সমস্যা না থাকে। আর সবচে অবাক ব্যাপার, ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল শুধু অনুমোদন দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বরং অনুরোধ করেছে যেন কাজটা আমরা করি । এমনকি যে কোনো মূল্যে কাজটা করার কথাও আছে সেখানে। হ্যাঁ, আমার মতো আপনাদের অনুমানের ক্ষমতাও সমান….
কিন্তু এখনো আমার একটা দুঃখ রয়ে গেল।
সে একটু তাকায় পানির বাটার দিকে। সেটা এখন হেউড ফ্লয়েডের হাতে ধরা। সে জিনিসটাকে আলোর দিকে ঝাঁকাচ্ছিল।
আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার, কোনো মরার কেমিস্ট নই। দেখতে তো বেশ পরিষ্কার- কিন্তু যদি ওটা কোনো বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায় লাইনিংয়ের জন্য?
ফ্লয়েড বোঝে না কেন লোকটা এমন আচরণ করে যা তার সাথে মিলছে না। মিলছে না তার চরিত্রের সাথে । হয়তো হাজার তর্কে সে ক্লান্ত হয়ে রণেভঙ্গ দিয়ে কাজে ফিরতে চাচ্ছে। নয়তো তার মন-মস্তিষ্কে বসে গেছে যে ক্যাপ্টেনের অবশ্যই আচার-আচরণে, মেরুদণ্ডে বেশ শক্তপোক্ত হওয়া উচিত।
সাথে সাথেই সে হ্যালির পানি থেকে খানিকটা, প্রায় বিশ সিসি তুলে নিয়ে গলায় ঢেলে দিল।
সবার বিস্মিত চোখের সামনে বলল, এই আপনার জবাব, ক্যাপ্টেন।
.
এটা আমার জীবনে দেখা সবচে বোকামিপূর্ণ প্রদর্শনী। আধঘণ্টা পর ডাক্তার বলল, আপনি কি জানেন না যে এই পানিতে সায়ানাইড, সায়ানোজেন আর কী কী আল্লা মালুম টাইপের যৌগ থাকার কথা?
অবশ্যই আমি জানি, বিস্তৃত হল ফ্রয়েডের হাসি, জানি বলেই খেয়েছি। লাখ লাখ ভাগে একভাগ সায়ানাইড ধরনের কম্পাউন্ড আছে সেখানে। কেমিক্যাল অ্যানালাইসিসটা আগেই দেখে বসে আছি। তবে একটা চমক আমি পেয়েছি।
কী চমক? আরো বেশি বিস্তৃত হল এবার বৃদ্ধ সেলিব্রিটির মুখের হাসি, একবার পানিটা পৃথিবীতে নিয়ে যান না; তারপর হ্যালির পানি মানুষ একনামে কিনবে।
৩৪. কার ওয়াশ
এবার যাবার কথা দেয়ার পর পরই পুরো ইউনিভার্সের চেহারা বদলে গেল পুরোপুরি। আর কেউ কথা তোলেনি তারপর। এরচে খারাপ পরিস্থিতি যাতে না হয় সে আশাই সবার। সাধ্যমতো কাজ করছে পুরো স্পেসশিপ। পরের দু হ্যালি দিবস (পৃথিবীতে শত ঘণ্টা কেটে যাবে এটুকু সময়ে।) অনেকেই ইচ্ছামতো ঘুমিয়ে নিল।
প্রথমবার, সারাদিন বেশ সাবধানে ওল্ড ফেইথফুলের পানি সংগ্রহ করা হলেও পরে আর কোনো সন্দেহ থাকেনি। হাজার টনের চেয়েও বেশি পানি তোলা হয়েছে শিপের গায়ে। বাকীটা ভরার জন্য পরদিনই যথেষ্ট।
ফ্লয়েড যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে ক্যাপ্টেনকে। বেচারা দেখা হলেই হাজারটা ফ্যাকড়া তোলার ধান্ধা করে। নতুন অর্বিট নিয়েও কথা তুলতে পারে। যাক, বাঁচা গেল, অর্বিটটা তাদের তৈরি নয়, বরং পৃথিবী থেকেই নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রশংসা জুটছে দেদার। এবং প্রত্যাশিত সময়ের চেয়েও কম লাগবে কাজ শেষ হতে। প্রাথমিকভাবে জলসন যে সময় এবং কক্ষপথ দেখিয়েছিল তারচে সুন্দর, সহজ এবং নিরাপদ ব্যবস্থার অনুমতি দিয়েছে পৃথিবীর কন্ট্রোল। সবাই ব্যাপারটায় দারুণ খুশি।
আচ্ছা, ঠিক আছে, সবাই না। প্রায় সবাই।
পথিবীতে, দ্রুত ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা হ্যান্ডস অব হ্যালি সোসাইটি পৃথিবীজুড়ে মাতম তুলল, এর সদস্যরা (সব মিলিয়ে মাত্র ২৩৬ জন, কিন্তু তারা জানে কীভাবে নিজেদের ঢোল নিজেদের দিয়ে পেটাতে হয়।) চিরে ফেলল আকাশ, না, এই প্রাকৃতিক জিনিসটা থেকে আর যাই হোক, ভর ছিনিয়ে নেয়া যাবে না। এমন বিজ্ঞান থাকার চেয়ে না থাকা ভাল। হ্যালি সৌর জগতের মুক্তা, এর এমন ক্ষতি সহনীয় নয়। হয়তো এ ভরটা একদিন হ্যালি ছড়িয়ে দিত কালো মহাকাশে, তাই বলে তার ধ্বংস ত্বরান্বিত করার কোনো অধিকার কারো নেই।
একটা অ্যাটিচ্যুড কন্ট্রোল থ্রাস্টার দিয়ে অতি সাবধানে ক্যাপ্টেন স্মিথ পরীক্ষাটা চালালো। এটা নষ্ট হয়ে গেলে এ ছাড়াও আপাতত শিপের চলবে। আর পৃথিবী থেকে আনা ফিরে যাবার মতো পানি তো আছেই। জেটের আচার ব্যবহার অতি ভদ্র, যেন কিছুই হয়নি, যেন চাঁদের কোনো খনি থেকে পানি তুলে ভরা হয়েছে এর ভিতরে।
এবার সে আসল থ্রাস্ট ড্রাইভটাকে পরীক্ষার ময়দানে তীর-ধনুকে সাজিয়ে পাঠালো। ক্ষতি যদি হয়েই যায়, চলাচল বন্ধ হবে না। এটাই আসল গতি দেয়, ঠিক, কিন্তু চারপাশের চার অ্যাটিচ্যুড কন্ট্রোল জেটই দিক ঠিক করে। এটা নষ্ট হলে চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে না, গতিটা শুধু আশিভাগ কমে যাবে।
এখানেও তাবৎ ইঞ্জিন বহাল তবিয়তে থাকল। এবং সবাই ভাল ব্যবহার করা শুরু করল হেউড ফ্লয়েডের সাথে, এমনকি সেকেন্ড অফিসার জলসন আর মানুষের চক্ষুশূল নয়।
তারপর, পরের ঘণ্টাগুলোয় অভিযানের পরিকল্পনা চলল। আর কিছুক্ষণ, তারপরই ওল্ড ফেইথফুল হারিয়ে যাবে মানুষের চোখের সামনে থেকে। পরের অভিযানে এটা থাকে না থাকে আল্লা মালুম। কে জানে, ভাবল ফ্লয়েড, হয়তো ১৯১০ সালের ছবিগুলোতেও এই প্রসবণটাকে দেখা যাবে।)।
আগেকার দিনের মতো কোনো কাউন্ট ডাউনের ঝক্কি ঝামেলা নেই। সব ঠিকঠাক চলছে বোঝার সাথে সাথেই ক্যাপ্টেন মাত্র পাঁচ টনের ধাক্কা দিয়ে শিপকে ভদ্রভাবে ধূমকেতু থেকে তুলে দিল।
ত্বরণ স্বাভাবিক হলেও প্রযুক্তিটা মানুষকে বিবশ করে রাখে। এই বাইরে থেকে না দেখতে পাওয়া জেটগুলো অসাধারণ। উচ্চ আয়োনিত হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন বেরিয়ে যায় নরকের তাপ গায়ে নিয়ে। শত শত কিলোমিটার দূরে সরে গিয়ে আস্তে আস্তে তাপ থিতিয়ে আসে, তারপর রাসায়নিকভাবে যুক্ত হওয়ার মতো ঠাণ্ডা হয়। তারও অনেক অনেক পরে তাপমাত্রা পরিবেশের সাথে মানিয়ে যায়। এবং সেই জ্বলন্ত পরমাণু বা আয়নগুলোকে দেখা যায় না কারণ দেখার মতো বর্ণালী নেই সে আলোতে।
কিন্তু এখন ইউনিভার্স এমন এক আলো পেছনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে যেদিকে তাকানো যায় না তখন মানুষ অবাক না হয়ে কি আর পারে! যেন আগুনের এক কঠিন স্তম্ভ। যেখানে এটা পাথরকে স্পর্শ করছে সেখানেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে প্রস্তরগাত্র! চলে যাবার আগে মহাজাগতিক স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে ইউনিভার্স, হ্যালির ধূমকেতুর বুকে।
সবাই স্তম্ভিত। ফ্লয়েড অপ্রতিরোধ্য ব্যাখ্যার আশায় বসে আছে। উইলিসকে বোঝানো হচ্ছে যে এমনটা মাঝেমধ্যেই ঘটতে পারে।
কার্বন। সে কোনো কথাই মানবে না, কার্বনের হার বেশি। তাই এমনভাবে জ্বলছে। মোমের আলোর মতোই, শুধু একটু বেশি গরম।
এই, সামান্য আর কী! যোগ করে ফ্লয়েড।
“আমরা জ্বলে পুড়ে মরতে যাচ্ছি না-তুমি যদি কথাটাকে ক্ষমা করো-(ঠিক কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না যেন ফ্লয়েড)- পিওর ওয়াটার-অনেক সাবধানে ফিল্টারিং করার পরও হাজারটা মাইক্রনিক গুড়ো রয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কলয়েডিয় কার্বন থেকেই যায়। সাথে এমন কিছু যৌগ থাকে যা শুধু ডিস্টিল্ড ওয়াটারেই থাকে না।
কাজ হয়েছে দুর্দান্ত, কিন্তু আমি একটু হতাশ হলাম। বলছে গ্রিনবার্গ, এই তেজস্ক্রিয়তা কি ইঞ্জিন আর শিপের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না?
দারুণ প্রশ্ন-এবং বেশ চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে দিল চারপাশে। ফ্লয়েড আশা করেছিল উইলিসই জবাব দেবে কিন্তু চতুরতার সাথে সে বলটা তার দিকেই ফিরিয়ে দিল।
জবাবটা ড, ফ্লয়েড দিলেই ভাল হয়। হাজার হলেও আইডিয়াটা তার।
জলসনের, প্লিজ। তোলা পয়েন্টটা বেশ শক্ত, বলতেই হয়। ফুল গ্রাস্টে চলার সময় সমস্ত পুচ্ছটা হাজার কিলোমিটার দূরে থাকবে। এ নিয়ে চিন্তার কিছুতে দেখছি না।
শিপ এখন নিউক্লিয়াসের কিলোমিটার দুয়েক দূরে ভেসে আছে। নিচের-অথবা দূরের সেই উষ্ণপ্রস্রবণ এর উঠে এসে সামান্য প্রশস্ত হয়ে যায় দেখে তার লেক জেনেভার কথা মনে পড়ে যায় হঠাৎ। সে পঞ্চাশ বছর ধরে সেগুলো দেখছে না। কে জানে এখনো আছে কিনা সেখানে।
ক্যাপ্টেন স্মিথ এখনো পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে, সামান্য প্রাস্টে ডান-বাম করে দেখছে কোনো সমস্যা আছে কিনা। একবার এক্স আরেকবার ওয়াই অক্ষ ধরে এগুচ্ছে। আর কোনো সমস্যা না দেখা দেয়ায় কথা বলে উঠল এবার সে।
মিশন টাইম জিরো এখন থেকে দশ মিনিট দূরে। ০.১ জি থাকবে প্রথম পঞ্চাশ ঘণ্টা, তারপর ঘোরার আগ পর্যন্ত ২।
কথাটা হজম করার সুযোগ দিল সে সবাইকে। এর আগে কোনো শিপ এতোক্ষণ ধরে এতে ত্বরণ সয়নি। যদি ইউনিভার্স সয়ে যেতে পারে তো সে প্রথম শিপ হিসাবে নাম লেখাবে ইতিহাসের বুকে।
শিপ উপরের দিকে মুখ করে (শুনতে বেখাপ্পা লাগে) সোজা বরফ-বাষ্পের স্তম্ভের দিকে উঠে যাচ্ছে।
কী করছে লোকটা? অস্থির হয়ে প্রশ্ন তুলল মাইকেলোভিচ।
নিশ্চই ক্যাপ্টেন জানে এ প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে তাকে। তাই সে নিজে থেকেই কাঠখোট্টা জবানিতে ব্যাখ্যা করল।
ছেড়ে যাবার আগে এই একটু চেখে নেয়া। আমি ঠিকই জানি, কী করছি না করছি। নাম্বার টু ও আমার সাথে একমত। আপনারা কী বলেন?
ইয়েস, স্যার-যদিও প্রথমদিকে মনে হল আপনি ঠাট্টা করছেন…
ব্রিজে কী হচ্ছে? হচ্ছেটা কী? প্রশ্ন ঝুলে আছে উইলিসের কণ্ঠে।
এখন শিপ ধীর একটা কাজ শুরু করল। প্রস্রবণটার কাছাকাছি চলে এসেছে তারা, আরো বেশি করে জেনেভা হ্রদের কথা মনে পড়ছে ফ্লয়েডের।
নিশ্চই সে আমাদেরকে এটার ভিতরে নিতে চাচ্ছে না…
কিন্তু সে তাই চাচ্ছে। ফোমের উঠতি স্তম্ভের গায়ে লেগে গিয়েই ইউনিভার্স ছোটখাট একটা ঝাঁকি খেল। তারপর ভিডিও মনিটর আর বাকী সবকিছুতে একটা অস্পষ্ট সাদাটে আলো ছাড়া অন্য কিছুই দেখা গেল না।
পুরো কাজের পেছনে খুব বেশি হলে দশ সেকেন্ড ব্যয় হল, তারপরই উঠে এল * অনেকটা উপরে এবং বেরিয়ে এল অন্যপাশে। ইতস্তত বোধ করছে সবাই, অফিসার অন ডিউটিও চঞ্চল দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে চারদিকে। বেচারার ভাব, যাত্রীরা প্রশ্ন তুললে কী জবাব দেবে!
এবং অবশেষে শব্দ ভেসে এল, ক্যাপ্টেনের গলা থেকেই, আমরা এখন যেতে প্রস্তুত। আবার একটা ঝকঝকে তকতকে শিপে করে যাত্রা হোক শুরু।
.
পরের আধঘণ্টা পৃথিবী আর চাঁদে উথাল পাথাল চলল। দশ সহস্রাধিক অপেশাদার ধূমকেতু দর্শক হা-পিত্যেশ করে মরল! হ্যালির উজ্জ্বলতা বেড়ে গেছে অনেকগুণ। কমেট ওয়াচ নেটওয়ার্ক অতি ভারে পুরোপুরি ব্লক হয়ে গেল সাথে সাথে। এবং ভয়াবহ রূপ নিল পেশাদার অ্যাট্রোনোমাররা।
সাধারণ মানুষ ব্যাপারটাকে দারুণভাবে নিচ্ছে। আর কটা দিন কাটুক না, তারপর ভোরের দিকে আরো বড় চমক অপেক্ষা করছে।
শিপটা, প্রতি ঘণ্টায় যেটা দশ হাজার কিলোমিটারের চেয়েও অনেক বেশি গতি বাড়াচ্ছে, সেটা এখন শুক্রের এলাকায়। সে সূর্যেরও বেশ কাছ দিয়ে সৎ করে বেরিয়ে যাবে, এবং তখন, তার গতি থাকবে যে কোনো পার্থিব-অপার্থিব বস্তুর চেয়ে অনেক অনেক বেশি। গন্তব্য লুসিফারের সাম্রাজ্য।
সূর্য ছাড়িয়ে পৃথিবীর কাছাকাছি দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় পৃথিবীর মানুষ খালি চোখেই আরো একটা মজার ব্যাপার দেখতে পেল। অসম্ভব গতিতে একটা বিশাল তারা এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে, খুব কাছ দিয়ে, এবং তার লেজটা জ্বলজ্বলে, হাজার কিলোমিটার লম্বা।
সৃষ্টি জগতের যে কোনো বস্তুর চেয়ে বেশি (এমনকি সূর্যের বা চাঁদের দিকেও সারা পৃথিবীতে এতো মানুষ একই সময়ে তাকিয়ে থাকেনি কোনোদিন, গ্রহণের সময়ও না।) মানুষের চোখে একেবারে একই সময়ে ধরা পড়ার নতুন রেকর্ড গড়ল এই মহাকাশযান, ইউনিভার্স।
৩৫. দিকচিহ্নহীন
সিস্টার শিপ ইউনিভার্স আসছে। এমন এক গতিতে এমন এক অভাবনীয় পন্থায় এমন এক সাহসিকতা দেখিয়ে আসছে যে কথা মানুষ স্বপ্নেও দেখতে সাহস পায় না। তারা আসছে অনেক অনেক আগে। এর যে কী প্রভাব পড়ল গ্যালাক্সির উপর তার কোনো তুলনা নেই, মানুষজন যেন অজান্তেই নেশার চরম শিহরন অনুভব করছে, যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার।
তারা যে অজানা সাগরের বুকে অচেনা অপার্থিব জলদানব পরিবেষ্টিত হয়ে বসে আছে, তাও নিষিদ্ধ জগতে, সেকথা যেন সবাই ভুলে গেছে।
একই কথা জানোদের ক্ষেত্রেও বলা চলে, তারা আশপাশে আসে, এমনকি সেই হাঙরেরাও আসে, কিন্তু যথেষ্ট দূরত্ব রেখে চলে। এমনকি ময়লা ফেলার সময়ও কাছেধারে ঘেঁষে না। অবাক ব্যাপার, দেখেশুনে মনে হয় তারাও যেন যোগাযোগের দারুণ একটা পদ্ধতি মেনে চলে। এখন মনে হচ্ছে তারা হাঙরের চেয়ে ডলফিনদের সাথেই বেশি আত্মীয়তা তাদের।
এবং ছোট্ট মাছেদের বেশ বড় বড় সমাজ দেখতে পাওয়া যায় যার কোনোটাই কোনোকালে পৃথিবীর মেছো হাটগুলোয় পাওয়া যায়নি।
হাজার যত্নআত্তি করে এক অফিসার একটা ধরতে পারল হুক দিয়ে। ভিতরে আনতে নিলে ক্যাপ্টেন খুনখারাবি বাঁধিয়ে দিবে। কী দরকার বাবা! তারচে বেশ কয়েকটা ছবি নিয়ে সাগরে নামিয়ে দিলেই হল।
এবং এ কাজের জন্য খেলোয়াড়কে সাথে সাথেই মূল্য দিতে হয়েছিল। তার প্রেশার স্পেসস্যুটে মাছটার গা লেগে যায় সামান্য সময়ের জন্য। তারপর শিপে প্রবেশ করেই যত বিপত্তি। পঁচা ডিমের গন্ধ এল তার গা থেকে। যতই বলা হোক, কেউ মানল না, বিশ্রী ব্যাপারটা নিয়ে কথা চালাচালি চলতেই থাকবে এবার। গায়ের গন্ধ ঠিকই যায় মনের গন্ধ যায় না। হায়রে অ্যালিয়েন বায়োকেমিস্ট্রি!
তারপরই বেঁধে ফেলা হল বিজ্ঞানীদলকে, আপনারা প্রকৃতিবিদ নন, ভূগোলবিদ। তাই প্রকৃতিবিদ্যা নিয়ে গবেষণার সময় দূর থেকে ডাটা কালেক্ট এবং রেকর্ড করতে পারবেন, প্রকৃতিকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে । কেউ ফরমালিন আনার কথা ভাবেনি। হাজার হলেও এখানে নামতে হবে তা কার মাথায় ছিল? রোজি আনলে আলাদা কথা।
সামনে শিপ সবুজ সবুজ শ্যাওলা জাতীয় দলের মুখোমুখি হল। জিনিসগুলো প্রায় দশফুটি, ডিম্বাকার এবং প্রায় সমান সমান। বিনা বাধায়ন জাহাজ সেগুলোকে এড়িয়ে এগিয়ে গেল সামনে। কোনো ধরনের কলোনিয়াল উদ্ভিদ হবে হয়তো।
তারপর এক সকালে অফিসার ইন ডিউটি সমুদ্রের বুক থেকে পেরিস্কোপ জেগে উঠতে দেখে যারপরনাই অবাক হল। একটু পর পুরো ব্যাপারটা বুঝে উঠেই সে বর্ণনা করেছিল, জিনিসটা নাকি অনেকটা মরা গরুর চোখের মতো। ঠাণ্ডা, নীল। সেটা তাকে বেশ অনাগ্রহ আর তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সাথে বেশ কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে ভুস করে আবার সাগরে ডুব দিল।
এখানে কোনোকিছুই দ্রুত চলে না। ব্যাখ্যাটা বেশ সরল, পৃথিবীর ভারী অক্সিজেন স্তর সব প্রাণীকেই জন্ম থেকে ও-টু বিস্ফোরণে শক্তির জোগান দিয়ে আসছে। এখানে হাল্কা বায়ুমণ্ডল এবং তারচেও পল্কা অক্সিজেন গ্যাসের হার থাকায় কেউ জুতসই প্রসেসিং চালাতে পারে না, ফলে দ্রুত কার্যক্ষম হয় না দেহঘড়ি।
শুধু হাঙর গুলোর মধ্যে বেশ ব্যতিক্রম দেখা গেল। প্রথম পরিচয়ে তেমন গতি দেখাতে না পারলেও শেষবেলায় তার শক্তিমত্তার একটু দেখতে পেয়েছিল সবাই।
স্পেসস্যুটে নিজেদের যারা জড়িয়ে রাখছে তাদের জন্য এটা বেশ সুখবর। এখানে চাইলেও কেউ তাদের ধরে খেতে পারছে না। আপাতত।
.
ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস সমস্ত শিপের ভার পার্লারের হাতে ছেড়ে দিয়ে মৌজেই আছে বলা চলে। এই দূর সমুদ্রে, সাগর-মাটির সন্ধিক্ষণের কাছাকাছি চলে এসে শিপ-হিসাব রক্ষককে পুরো শিপের কর্ণধার করে দেয়ার মতো কাজ করার মধ্যে গভীর একটা দার্শনিকতাও যেন আছে।
অবশ্য মি. লির করার মতো তেমন কোনো কাজ নেই। গ্যালাক্সি একটা স্থিত গতিতে ঢিমে তালে এগিয়ে চলছে; এক তৃতীয়াংশ মুখ বাইরে ভাসিয়ে রেখে, পাঁচ নটের মৃদুমন্দ গতিতে, সমান্তরালে। দু চারটা ছিদ্র পেয়ে সাথে সাথে ঠিক করা হয়েছে আগেই, মূল খোল ভালই আছে, একেবারে অটুট।
বেশিরভাগ নেভিগেশন ইকুইপমেন্ট ভালই আছে, যদিও তারা একেবারে অকর্মার টেকি। গ্যানিমিড় প্রতি ঘণ্টার বিকন দিয়ে গ্যালাক্সির সাথে যোগাযোগ রাখছে। এ গতিতে চলতে থাকলে তিন দিনের মধ্যে একটা নতুন দ্বীপে চলে যেতে পারবে তারা।
বড় দ্বীপটায় ঠেকতে না পারলে বিপদ। শিপ সোজা ভেসে যাবে মধ্য ইউরোপার দিকে, বা মধ্য দিবসের দিকে-যেখানে সর্বক্ষণ লুসিফারের রাক্ষস-চোখ কুটিল দৃষ্টি হেনে থাকে। তখন বড় সমস্যায় পড়তে হবে। অ্যাক্টিং ক্যাপ্টেন লির চিন্তার অনেকাংশ জুড়ে এ ভাবনাটা থাকে।
পালে তেমন কোনো ফারাক পড়বে না। টানানো সম্ভব কিনা তাও ভাবার বিষয়। এরই মধ্যে নোঙর বানানোর কাজ শেষ, পাঁচশো মিটার গভীরেও বসিয়ে দেয়া হয়েছে, লুকানো জলস্রোতের খোঁজে। তাও বিন্দুমাত্র কাজ দেয়নি। না পেয়েছে তলা, না ভিন্ন স্রোতের অস্তিত্ব। এখন তার একটা কথা ভাবা ছাড়া কোনো উপায় থাকছে না, আমিতো এর আগে কখনো দুঃস্বপ্নে স্পেসশিপকে জাহাজ হিসেবে চালানোর ট্রেনিং নিইনি।
অবশ্য অতল হওয়ায় লাভও হয়েছে একটা, মাটির নিচে পানির নিচে সর্বক্ষণ ভূ-আকৃতি ঠিক করার যে কসরৎ চলছে তার কম্পন টের পেতে হচ্ছে না মোটেও। মাঝেমধ্যে নিচ থেকে উঠে আসা শকওয়েভে গ্যালাক্সি কেঁপে ওঠে, যেন বিশাল কোনো হাতুড়ির বাড়ি খেয়েছে। আর ঘণ্টা কয়েক পর ইউরোপার কোথাও না কোথাও প্রায় কয়েক ডজন মিটার উঁচু সুনামি আছড়ে পড়বে কোনো অচেনা সাগরতীরে। কিন্তু এখানে একটা জোর কাঁপন, ব্যস।
তারপরই দেখা গেল সামুদ্রিক ঘূর্ণি, সেইসাথে ঝড়। এতো বেশি ভয়াল যে ইচ্ছা করলে মুহূর্তেই গ্যালাক্সিকে টেনে নিতে পারে অতলে; কিন্তু ভাগ্য প্রসন্ন, সেগুলোও অনেক দূরে। তার পরও সেই ক্ষমতার দাপটে এখানেই শিপটা লাটুর পাক খেয়ে হেনস্থা হতে পারে।
এবং মাত্র একবার, পানি থেকে বিশাল এক বুদ্বুদ উঠল, মাত্র একশ মিটারের মতো দূরে। তারপর সবার মনে যা ছিল তা নির্লজ্জের মতো বলে বসল ডাক্তার, স্রষ্টার কী লীলাখেলা! আমরা ঐ আযাবের কোনো গন্ধই শুঁকতে পারব না। থ্যাঙ্কস গড!
.
দুনিয়া কী অদ্ভুত রীতিতে চলে! এখন, এই অকল্পনীয় রুটিনও গা সওয়া হয়ে গেছে। আর ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাসের একমাত্র চেষ্টা ক্রুদের নিজের দখলে রাখা, ব্যস।
সে পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আলসেমির চেয়ে বড় অপনীতি আর নেই। কুঁড়েমির চেয়ে বড় মনোবলহীনতা আর সৌর জগতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই নিষ্কমতা বন্ধ রাখতেই সবাইকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা এবং সে চেষ্টা করতে গিয়েই তার গলদঘর্ম হওয়া।
কীভাবে যে আগের দিনের সাগর অভিযানে কাঠখোট্টা কাপ্তান তার মাঝিমাল্লাদের সব সময় ব্যস্ত আর সুশৃঙ্খল রাখত আল্লা মালুম। মাস্তুল বেয়ে ওঠা নামা আর ডেক ধুয়েমুছে ঝকঝকে করার কাজ কাঁহাতক করানো সম্ভব?
আর বিজ্ঞানীদলের কাছ থেকে বিপরীত সমস্যা আসছে সারাক্ষণ, খেয়ে না খেয়ে তারা পড়েছে টেস্টিংয়ের পেছনে। জান তিতিবিরক্ত করে ছাড়ছে।
কাজগুলো অনুমোদন না করলে অবস্থা কাহিল করে ফেলে, অনুমতি দিলে শিপের সীমিত যোগাযোগ ক্ষমতার সবটুকু দখল করে নিবে।
মাত্র কয়েক মেগাহার্টজের ব্যান্ড উইথড এ কথা পাঠাতে হয় গ্যানিমিডে, সেই কথা উপগ্রহটা ঘুরে পৃথিবীতে রিলে হয়। কারণ মূল অ্যান্টেনা পানির নিচে চলে গেছে।
একটা ক্যামেরা কাজ করছে ডাটা পাঠানোর চ্যানেলে। সেটা বিরক্তিকর সাগর, একঘেয়ে শিপের অভ্যন্তরভাগ আর এখনো শান্ত কিন্তু ধীরে ধীরে হতাশ হয়ে ওঠা ক্রুদের খবর প্রচার করতে পারে সারাক্ষণ।
এতো বেশি পরিমাণ ডাটা একা তরুণ অফিসার ক্রিস ফ্লয়েডের কাছে আসছে যে ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস কথা না বলে পারল না।
নিজের কেবিনের গোপনীয়তায় বসে সে বলল, ফ্লয়েড সাহেব, আপনি যদি দয়া করে আপনার পার্ট টাইম জবটার কথা একটু খুলে বলেন তো আমি বেশ খুশি হতাম।
ফ্লয়েড অপ্রস্তুত হয়ে টেবিল আঁকড়ে ধরল, হঠাৎ আসা ঢেউয়ের ধাক্কায়, নাকি কথায় কে জানে!
পারলে খুশি হতাম, স্যার। খুশি হয়েই বলতাম। কিন্তু অনুমতি নেই।
কার অনুমতি নেই? প্রশ্নটা করা যাবে তো?
খোলামেলা বলতে গেলে, আমি নিজেও জানি না।
কথাটা এক্কেবারে সত্যি।
তার সন্দেহ সংস্থাটার নাম অ্যাস্ট্রোপোল। কিন্তু যে দুজন ভদ্রলোক গ্যানিমিডে তাকে ব্রিফ করেছে তারা কথাটা জানায়নি।
শিপের ক্যাপ্টেন হিসেবে-স্পেশালি এই বিশেষ মুহূর্তে… আমি আপনাকে এখানকার আগাগোড়া সব জানাতে চাই। এই গাড়া থেকে উদ্ধার যদি পাইও, আগামী কয়েক বছর কাটবে প্রশ্নের উত্তর দিতে। আমার বিশ্বাস আপনার একই হাল হতে যাচ্ছে।
কোনোমতে একটা ফ্যাকাসে হাসি ঝুলল ক্যাপ্টেনের ঠোঁটে।
যদিটা থেকেই যাচ্ছে। যদি উতরে যাই, তাই না, স্যার? আমি শুধু এটুকুই জানি, কোনো এক উচ্চ স্তরের এজেন্সি জানত যে এখানে কোনো না কোনো সমস্যা হবে। সমস্যাটা কী তা জানত না। শুধু চোখ কান খোলা রাখার কাজ পেয়েছিলাম আমি। জানি, কাজটা ঠিক ভালমতো করতে পারিনি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আমাকেই তারা পেয়েছিল, একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে।
মনে হয় না আপনি কোনো ভুল করেছেন। যাই হোক, কী মনে হয়? এই রোজি মেয়েটা কে…
তারপর হঠাৎই সে থেমে গেল। আপনি কি আর কাউকে পেয়েছেন এর সাথে যুক্ত? ঠিক যুতসই কথাটা বেরুচ্ছিল না মুখ থেকে, তারপর ক্যাপ্টেন বলেই বসল, অন্য কাউকে কি সন্দেহ করছেন? একটু ইতস্তত করে, যেমন আমাকে?
শান্ত চোখে একটু তাকিয়ে থেকে ফ্লয়েড কথা শুরু করল আবার।
হয়তো আপনার সাথে আগেই কথা বলে নেয়া উচিত ছিল, স্যার। কিন্তু দেখেছি সারাক্ষণ কেমন ব্যস্ত ছিলেন। আমি শিওর, ড. ভ্যান ডার বার্গ কোনো না কোনোভাবে জড়িত। কীভাবে, বলতে পারব না। তিনিও একজন… কথাটা আসলে অন্যরকম শোনায়, কিন্তু বলতেই হচ্ছে, কালো। এবং তারা দুজনই এমন ছিলেন শিপে। সত্যি, তাদের ঠিক বুঝতে পারিনি।
অথবা পছন্দ করতে, সে বলতে পারতো।
ভ্যান ডার বার্গ… হুম। অন্য বিজ্ঞানীদের বেলায়?
তাদেরকেও চেক করেছি, অবশ্যই। কোনো গড়মিল পাইনি।
সব কথা সত্যি নয়। ড. সিম্পসনের স্ত্রীর সংখ্যা বেশি, অন্তত বে-আইনি ধারার একজনতো আছেই। আর ড. হাগিন্স বিস্তৃত বইয়ের এক ভাণ্ডার নিজের সম্প্রহে রাখে। ফ্লয়েড জানে না ঠিক কেন তাকে এত কথা বলা হয়েছিল তখন, সম্ভবত তার নিয়োগকর্তারা তাদের ক্ষমতা এবং দক্ষতার দু একটা নমুনা দেখাতে চাচ্ছিল। আর সে মনে করেছিল অ্যাস্ট্রোপোল বা এমন যে কোনো বড় সংস্থার হয়ে কাজ করাটা বেশ সৌভাগ্যের কথা, ভবিষ্যতের জন্যও।
ভাল, চমৎকার। অ্যামেচার গুপ্তচরকে সমাপ্তির দিকে টেনে আনল ক্যাপ্টেন, যখনই শিপের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কিছু টের পাবেন-যখনই-আমাকে জানাবেন দয়া করে।
এই পরিস্থিতিতে শিপের জন্য ক্ষতিকর আর কী থাকতে পারে? এরচে বেশি ক্ষতিকর কিছু আর আশা করা যায় কি?
৩৬. অচেনা বেলাভূমি
সামনের দ্বীপটা চোখে পড়েছে চব্বিশ ঘন্টা হল। কেউ জানে না সেখানেই যাওয়া যাবে, নাকি কেন্দ্রের নরকে গিয়ে হাজির হবে শিপ! দ্বীপটার অবস্থান গ্যানিমিড থেকে নিশ্চিত করে পাঠিয়ে পথও বাৎলে দেয়া হয়েছে, তারপরও প্রতিদিন প্রত্যেকে পালা করে বেশ কয়েকবার দেখে নেয়, নিজের সন্তুষ্টির জন্য হলেও।
দ্বীপের দেখা পেলে ভালর বদলে মন্দও হতে পারে, বিগড়ে যেতে পারে হিসাবের খাতা। ভদ্র কোনো উপকূলের বদলে শিপ পাথুরে দেয়ালেও ধাক্কা খেতে পারে। তখন আর শিপ বলে কিছু থাকার কথা নয়।
অ্যাক্টিং ক্যাপ্টেন লি এই সব ব্যাপারেই সতর্ক। এক কেবিন ক্রুজারের ইঞ্জিন। বিগড়ে যাবার পর শিপ ভেঙে পড়ার ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল তাকে। জাহাজটা আছড়ে পড়ে বালির একটা দ্বীপে। একটু বিপদ আর একগাদা অ্যাডভেঞ্চার জড়ো হলেও তেমন কোনো অভিজ্ঞতা আবার পাবার কোনো ইচ্ছাই নেই তার। বিশেষত এমন কোথাও, যেখানে এসে উদ্ধার করার মতো কোনো কোস্টগার্ড নেই।
এখানে যেন সত্যিকার এক মহাজাগতিক প্রহসন হয়ে গেল। তারা মানবসৃষ্ট সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি ও বাহন নিয়ে এতদুরে এল, এমন ক্ষমতা নিয়ে যা দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই সৌর জগৎ পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব; সেকেন্ডে দেড়-দু হাজার কিলোমিটার পেরিয়ে যাওয়া কোনো ব্যাপারই না-এখন কিনা মাত্র কয়েক ফুট এদিক-সেদিক করার যো নেই।
কিন্তু একেবারে হেরে বসেনি তারা, লির হাতে খেলার মতো আরো কিছু পাশাগুটি রয়ে গেছে, এখনো।
এই তীক্ষ্ণ ধারওয়ালা দুনিয়ায় প্রান্ত তেমন বিস্তৃত নয়, মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরের জিনিসও দেখা যায় না গোলকটা ছোট হওয়াতে। এবং দেখা যাচ্ছে দ্বীপটাকে। লি হাঁপ ছেড়ে বাঁচল, ভয় ধরানো পাথুরে টিলা নেই উপকূলের দিকে। কিন্তু প্রত্যাশিত বালুকাবেলাও নেই।
ভূগোলবিদরা আগেই সাবধান করেছিল, এখানে বালু জন্মাতে আর মাত্র ত্রিশ চল্লিশ লাখ বছর লাগবে। ইউরোপার বালু তৈরির কারখানা এখনো গড়ে ওঠেনি ঠিকমতো ।
সরাসরি মাটিতে গিয়ে উঠতে হবে দেখেই লি ট্যাঙ্কগুলো সাথে সাথে খালি করে ফেলার আদেশ দিল, টাচডাউনের পর যেগুলো ভরার পরামর্শ সেই দিয়েছিল।
বেশ অস্বস্তিকর কয়েকটা মুহূর্ত ভুগতে হল তাদের। কী হয়-কী হয়! তারপর উৎসাহ হারিয়ে ফেলল এক চতুর্থাংশ কু। হাজার হলেও, এক কাজে কতক্ষণ ব্যস্ত থাকা যায়!
একটু একটু করে জলের আড়াল থেকে আবার শরীর জাগাচ্ছে গ্যালাক্সি; আবার বাড়ছে ঢেউয়ের দোলা। পুরনো দিনের মাছধরা নৌকারা ডুবে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে ঠিক যেভাবে নিজেদের হাল্কা করত, সেভাবে ।
সাহায্য করল সবাই, তারপর ঢেউয়ের তোড় উপেক্ষা করে তীরের জন্য অপেক্ষা।
একটা ছোটখাট তীর এগিয়ে আসছে, পাশে ছোট ঘোঁট দুটো বোল্ডার। বালু না পেলে ছাই ফেলতে ভাঙা কুলোই ভাল…
তারপর আরো বড় একটা ঢেউয়ে ভেসে তীরের দিকে এগুনো। কিন্তু এখানেই বিপদের আশঙ্কা থেকে যায়। কারণ একবার আছড়ে পড়বে ঠিকই, তারপর আবার ঢেউয়ে নেমে আসতে হতে পারে, অথবা বারবার ঢেউয়ের ধাক্কায় পর্যুদস্ত হওয়াও বিচিত্র নয়।
এবং অবশেষে অ্যাক্টিং ক্যাপ্টেন লি শেষ চালটা চালল।
গ্যালাক্সি শেষবারের মতো তার ল্যান্ডিং গিয়ার প্রসারিত করেছে সামনের দিকে। তারপর, কে জানে, এই প্রথম হয়তো ইউরোপার বুকে কোনো কাঁকড়ার পা পড়ল। মহাকাশ তরী গ্যালাক্সি শেষবারের মতো থামল একটা নিরাপদ জায়গায়, যেখানে সামুদ্রিক ঢেউ বা বাতাস কোনো আঘাত হানবে না।
গ্যালাক্সি যে শেষবারের মতো তার বিশ্রামস্থান পেয়েছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই-আর, বাকীটাও সম্ভব, হয়তো সে কুদের মায়া ছাড়তে পারবে না।