খানিকক্ষণের ভেতরেই জায়গাটা পুলিশে ভরে গেল। বিলু দীপুর আব্বাকে নিয়েই থানায় গিয়েছিল। পুলিশ ইন্সপেক্টরের সাথে দীপুর আব্বাও এসেছেন। ওদের মুখে সব শুনে পুলিশ ইন্সপেক্টর রিভলবার হাতে নিয়ে কালাচিতার মুখে দাঁড়িয়ে এমন চিৎকার করে ধমক দিল যে সুড়সুড় করে সবাই হাত তুলে বের হয়ে এল। বিদেশীটার মাথার বিভিন্ন জায়গা ফুলে ঢোল হয়ে আছে। যে লোকটা এতক্ষণ কথা বলছিল তার কপাল ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। দীপুর ইটের জন্যে সম্ভবত। পোশাক দেখে ওদের তাক লেগে গেল। গলায় টাই পর্যন্ত আছে।
সকাল হয়ে আসছে, আবছা আলোয় চারদিকে এত হৈচৈ, লোকজন, সব কেমন অবাস্তব মনে হয় দীপুর কাছে। সব ভালয় ভালয় শেষ হল তা হলে! সারা রাত জেগে আছে, কিন্তু ঘুম পাচ্ছে না কারও। নান্টুর শুধু শরীর খারাপ হয়ে গেল। বমি করে ফেলল কেন জানি। ওকে ধরাধরি করে নিয়ে গেল জীপে। হঠাৎ করে ওরা সবাই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে।
দীপুর ওর আব্বার সামনে যেতে একটু ভয় লাগছিল। আস্তে আস্তে সাহস করে গিয়ে বলল, আব্বা–
কী?
তুমি কি রাগ করেছ আমার উপর?
আব্বা আস্তে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। বললেন, হলেই আর কী লাভ, তুই কি আমার কথা শুনিস কখনও। কারও যদি কিছু হতো?
দীপু মাথা নিচু করে বলল, হয়নি তো!
হুঁ, হয়নি। আচ্ছা যা, রাগ করিনি।
সত্যি?
সত্যি। আব্বা ওর মাথায় হাত রাখলেন। হঠাৎ করে মনে হল তাঁর দীপু অনেক বড় হয়ে গেছে। কেন জানি আবার একটা নিঃশ্বাস ফেললেন আস্তে আস্তে।
.
রাতে বাসা থেকে পালিয়েছিল বলে সেবারে আর কারও মার খেতে হয়নি। খবরের কাগজে পরের দিনই সব বের হয়েছিল—ওরা হাসিমুখে বসে আছে, পেছনে হাতকড়া লাগানো মূর্তিচোরের দলের ছবি। খুব হৈচৈ হল কয়দিন। জামশেদ সাহেব তার দলবল নিয়ে জায়গাটা খোঁড়াখুড়ি শুরু করে দিলেন। আব্বার সাথে দেখা হলেই বলতেন তারিক আর দীপু খুঁড়তে চেষ্টা করে জায়গাটার কী কী ক্ষতি করেছে। ওরা যে বের করে দিল সেটি যেন কিছু না।
দীপু ওর আব্বাকে তারিকের কথা আর তার আম্মার কথা খুলে। বলল—কালাচিতা হাতছাড়া হবার পর তারিকের দিকে তাকানো যায় না। ওখানে। গুপ্তধন পাবে সেরকম আশাও আর নেই। আব্বা সব শুনে-টুনে কয়দিন কী যেন করলেন, কোথায় কোথায় চিঠি লিখলেন, কার কার সাথে কথা বললেন। তারপর একদিন তারিককে ডাকিয়ে এনে তার একটি ছবি তুলে নিলেন। দীপু কিছু বুঝতে পারছিল না, আব্বাকে জিজ্ঞেস করেও কোনো লাভ নাই। জিজ্ঞেস করলেই বলেন, উঁহু, বলা যাবে না, টপ সিক্রেট।
টপ সিক্রেট আর বেশিদিন টপ সিক্রেট থাকল না। একদিন খবরের কাগজ খুলেই দীপু অবাক হয়ে দেখল প্রথম পৃষ্ঠাতেই তারিকের ছবি! নিচে লেখা, খুদে নৃতত্ত্ববিদ পুরস্কৃত। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল দীপু—মৌর্যসভ্যতার একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা খুঁজে বের করেছে বলে বাংলাদেশ সরকার তারিককে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দিয়েছে। তারিকের এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্যে জায়গাটার নাম তারিকের দেয়া কালাচিতাই থাকবে। চিৎকার করে উঠে মুখ না ধুয়েই খবরের কাগজ হাতে খালিপায়ে দীপু ছুটে বেরিয়ে পড়ল। তারিককে খবরটা সে প্রথমেই দিতে চায়।
তিন মাইল রাস্তা ছুটে যাওয়া সোজা কথা নয়। তারিকের বাসায় গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে তারিককে ডেকে বের করে আনল।
তারিক ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে রে দীপু?
দীপু খবরের কাগজটা ওর সামনে খুলে ধরল।
পুরোটা পড়তে পারল না তারিক, তার আগেই দীপুকে ধরে ভেউভেউ করে কেঁদে ফেলল। মানুষ খুশি হলে কেন যে কাঁদে কে জানে, দীপু অবাক হয়ে নিজের চোখও মুছে নেয় সাবধানে।
.
অনেকদিন পার হয়ে গেছে। বছর ঘুরে শেষ হয়ে হয়েছে প্রায়। ফাইনাল পরীক্ষার দেরি নেই আর। আব্বা আবার ছটফট করছেন, মন বসছে না আর তার এখানে। দীপুকে তাগাদা দেন শুধু।
কত দেরি তোর?
কিসের?
পরীক্ষার। শেষ কর তাড়াতাড়ি, যাব অন্য জায়গায়।
কোথায় যাবে আব্বা?
ঠিক করিনি এখনও। পাহাড়ের কাছে কাছে। রাঙামাটি না হয় বান্দরবন।
দীপু পড়ায় আর মন দিতে পারে না, বই খুলে রেখে দৈকে মণ্ডের চোখের সামনে দিয়ে সব ভেসে যায়। মাত্র এক বছর আগে এসেছিল এখানে, অথচ মনে হয় কতকাল পার হয়ে গেছে। কত কী হল এখানে—স্কুলে, খেলার মাঠে, কালাচিতায়। কত বন্ধুরা আছে এখানে। কত ঝগড়া, মারামারি, আবার। মিটমাট হয়ে হৈচৈ, চেঁচামেচি, ফুটবল খেলা। দীপু ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে তাকে চলে যেতে হবে।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, ওর বন্ধুরা যখন শুনবে কী বলবে তারা? তারিক নিশ্চয়ই মন খারাপ করবে। ওর আম্মা নাকি ভাল হয়ে যাচ্ছেন, কয়দিন থেকেই তারিক বলছে ওর আম্মা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেই ও দাওয়াত করে। খাওয়াবে দীপুকে। ওর আম্মা নাকি খুব ভাল রাঁধতে পারেন।
দীপু নিশ্চয়ই আসবে এখানে আবার। নিশ্চয়ই আসবে।
Best book ever
একবারের জন্য মনে হয়নি এটি গল্প।পুরো চরিত্রগুলোই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম।এজন্যই জাফর ইকবাল স্যারকে এত ভালো লাগে