৩. ক্লাস নাইনের সাথে ফুটবল খেলা

ক্লাস নাইনের সাথে ফুটবল খেলায় কে ক্যাপ্টেন হবে সেটা নিয়ে ক্লাসের পর আলোচনা হচ্ছিল। তারিকের লজ্জাশরম বরাবরই কম। সে সোজাসুজি ক্যাপ্টেন হতে চাইল। দীপু আপত্তি করে বলল, যে সবচেয়ে ভাল খেলে—রফিক, সে হবে ক্যাপ্টেন। রফিক ভয়ে ভয়ে বলল, তার ক্যাপ্টেন হবার ইচ্ছে নেই, তারিকই হোক!

দীপুর খুব খারাপ লাগছিল, সবগুলো ছেলে তারিককে ভয় পায়, তাই ন্যায় হোক আর অন্যায় হোক তারিক যেটা বলে সেটাই সবার মেনে নিতে হয়। রফিকের ক্যাপ্টেন হবার খাঁটি অধিকার আছে। ওর মতো ভাল ফুটবল সারা স্কুলে কেউ খেলতে পারে কি না সন্দেহ আছে। শুধু যে ভাল খেলে তা-ই নয়, ওর মতো ভাল খেলা কেউ বুঝতে পারে না। খেলার মাঝখানে ঠিক কাকে কোনখানে বদলে দিয়ে কী করতে দিলে খেলা ম্যাজিকের মতো পাল্টে যায় সেটা শুধু রফিকই বলতে পারে। অথচ তারিক জোর জবরদস্তি করে ক্যাপ্টেন হতে চাইছে, যেন ক্যাপ্টেন হওয়াটাই সব।

দীপু পরিষ্কার করে বলে দিল, রফিক ক্যাপ্টেন না হলে খেলা হবে না। ড্রিল ক্লাসের ঘটনার পর অনেকেই তারিকের থেকে দীপুর কথাকে বেশি গুরুত্ব দেয়, কাজেই সত্যি সত্যি রফিককে ক্যাপ্টেন করে টম করে ফেলা হল। টীমে তারিকও থাকল—শুধু যাবার সময় দাঁতে দাঁত ঘষে দীপুকে বলে গেল, সে তাকে দেখে। নেবে একহাত। এর আগেও তারিক অনেকবার দীপুকে দেখে নিতে চেয়েছে। কাজেই সে খুব-একটা গা করল না।

ক্লাস নাইনের সাথে খেলার জন্যে ওদের খুব জোর প্র্যাকটিস শুরু করতে হল। প্রতিদিন বিকেলে ওরা অনেকক্ষণ মাঠে খেলে যেত। বাসায় যেতে যেতে প্রায়ই সন্ধ্যা হয়ে যায়, আর ভাত খাবার পর কিছুতেই জেগে থাকতে পারে না। আব্বা পড়ার টেবিল থেকে মাঝে মাঝে কোলে করে ওকে বিছানায় এনে শুইয়ে দেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে ওর লজ্জা সীমা থাকে না।

সেদিন সন্ধ্যার ঠিক আগে দীপু ফুটবল খেলে ফিরে আসছিল। পুরানো জমিদার বাড়িটির কাছে ফাঁকা জায়গাটায় হঠাৎ সে তারিক আর তার দু’জন বন্ধুকে আবিষ্কার করল। প্রায় অন্ধকারে ওরকম একটা জায়গায় ওরকম তিনটা ছেলেকে দেখেই দীপুর মনে হল, ওরা তার জন্যে অপেক্ষা করছে। ভয়ে ওর বুক ধক করে উঠলেও সে গলায় জোর এনে জিজ্ঞেস করল, কিরে তারিক, কী করছিস ওখানে?

তারিক উত্তর না দিয়ে বলল, এদিকে শোন।

দীপু এগিয়ে গেল। কাছাকাছি এগিয়ে যেতেই তারিক হঠাৎ করে তার মুখে এক ঘুষি মেরে বলল। কিছু বলার আগে পাশের দু’জন তাকে জাপটে ধরে ফেলল।

দীপু নোনতা রক্তের স্বাদ পেল, ঠোঁট কেটে গেছে বোধ হয়। আবছা অন্ধকারে তারিকের মুখ ঠিক দেখা যাচ্ছিল না, আবার মারবে কি না তাও বুঝতে পারছিল না। মার খেলেই পাল্টা মার দিয়ে এসেছে দীপু, কিন্তু এখন ওকে দু’জন যেভাবে ধরে রেখেছে যে, ওর নড়ার শক্তি নেই। ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। নিজেকে বাঁচাতে হলে এখন ওর উল্টো দিকে দৌড়ানো উচিত। কিন্তু ওর দৌড়াতে লজ্জা হল। তারিকের দিকে তাকিয়ে বলল, লজ্জা করে না তিনজন মিলে একজনকে মারছিস?

ধর হারামজাদাকে!

আবার তিনজন মিলে ওকে জাপটে ধরল। কয়টা ঘুষি যে সে খেল তার আর কোনো হিসেব নেই। প্রাণপণে সে মারামারি করে গেল কিন্তু তিনজন শক্ত ছেলের সাথে তার একার পেরে ওঠা অসম্ভব। অল্পক্ষণের মাঝে দু’জন তাকে ধরে মাটিতে ফেলে দিল। দুই হাত পেছন দিকে নিয়ে তাকে এমনভাবে ধরেছিল যে, সে নড়তে পারছিল না।

তুলে দাঁড় করা শুয়োরকে।

তারিকের কথামতো অন্য দু’জন অনুগত ভৃত্যের মতো তাকে তুলে দাঁড় করাল। দীপুর চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসতে চাইছিল, কিন্তু অনেক কষ্টে সে পানি আটকে রাখল।

আমার সাথে আর লাগতে আসবি?

আমি কারো সাথে লাগতে যাই না।

আবার মুখে-মুখে কথা! তারিক এগিয়ে এসে পেটে প্রচণ্ড এক ঘুষি মারল। মুহূর্তের জন্যে দীপু চোখে অন্ধকার দেখে, ওর দম বন্ধ হয়ে আসে যন্ত্রণায়। মিনিটখানেক সময় লাগল ওর ঠিক হতে। মুখ হা করে ও বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল।

বল, আমার সাথে লাগতে আসবি?

আমি কারো সাথে লাগতে যাই না। তুই আমার সাথে লাগতে আসিস।

আবার একটা ঘুষি, এবার চোয়ালে! কট করে কোথায় যেন একটা শব্দ হল, মিনিট দুয়েক সে কিছু শুনতে পায় না।

বল হারামজাদা, আমার সাথে লাগতে আসবি কি না।

দীপুর কেমন যেন একটা রোখ চেপে গেল। ও খ্যাপার মতো বলল, আমি লাগতে আসি না, তুই লাগতে আসিস—তুই-তুই–

আবার ঘুষি খেল একটা। তারিক ওর বুকের কলার চেপে ধরে বলল, বল—না। নইলে মেরে তক্তা বানিয়ে দেব।

বলব না।

বল, আর কখনও করব না, ছেড়ে দেব তা হলে।

দীপু চিৎকার করে বলল, বলব না।

দাঁড়া হারামজাদা, দেখাচ্ছি মজা।

তারিক পকেট থেকে একটা পেন্সিল বের করে নিয়ে দীপুর ডান হাতের দুই আঙ্গুলের মাঝখানে রেখে দু’পাশ থেকে চাপ দিতে থাকে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় দীপু চিৎকার করে উঠল, মনে হল ওর আঙ্গুল দুটি বুঝি ভেঙে যাবে।

বল হারামজাদা, আর কখনও করবি কি না, বল।

দীপু তবু বলল না, প্রাণপণে ছাড়া পাবার চেষ্টা করতে লাগল। ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে হুটোপুটি করতে করতে একসময়ে তিনজনেই মাটিতে পড়ে গেল। জাপটা-জাপটি করতে লাগল মাটিতে পড়ে, তার মাঝে তারিক দুই আঙ্গুলের মাঝখানে পেন্সিল রেখে চাপ দিতে লাগল আর বলতে লাগল, বল আর করব না, বল, তা হলে ছেড়ে দেব।

মরে গেলেও বলব না—মরে গেলেও বলব না—দীপু ঠোঁট কামড়ে যন্ত্রণা সহ্য করতে চেষ্টা করে, মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে ওর, বুঝতে পারে আর একটু জোরে হলেই ওর আঙুল ভেঙে যাবে মটু করে। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় ওর। মুখ শুকিয়ে যায় কাগজের মতো, তবুও পাগলের মতো নিজেকে বলতে থাকে, বলব না, বলব না, বলব না।

হঠাৎ করে তারিক ওর হাত ছেড়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, কে জানি আসছে।

সত্যি?

হুঁ। ওকে ঠেলে দাঁড় করায় ওরা, তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করে সত্যি কেউ আসছে কি না। দেখা গেল সত্যিই কে-একজন হেঁটে হেঁটে আসছে এদিকে।

পালা–

দীপুকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে ওরা দেয়াল টপকে পালিয়ে যায়। দুর্বল দীপু ধাক্কা সামলাতে পারে না, হুমড়ি খেয়ে গিয়ে দেয়ালের ওপর পড়ে। হাত দিয়ে দুর্বলভাবে আটকাতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না, প্রচণ্ডভাবে ওর মাথা ঠুকে যায় দেয়ালের সাথে। মনে হল ওর, ও মরে যাবে এখনই। হঠাৎ করে ওর ভীষণ কান্না পেল, চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসে ঝরঝর করে। লোকটি এগিয়ে এসে দীপুকে দেখে থেমে যায়, কে? কে ওখানে?

গলার স্বরে চিনতে পারে দীপু, ওদের স্যার, ক্লাস-টীচার।

দীপু ওঠার চেষ্টা করছিল, স্যার টেনে তুললেন ওকে। কে? দীপু? তুই!

দীপু মাথা নাড়ল। কী হয়েছে? কী করছিস?

অন্ধকারে ভাল দেখা যায় না, তবু বোঝা যায় মারামারি না করলে এরকম অবস্থা হয় না।

কার সাথে মারামারি করছিলি?

হঠাৎ স্যারের মনে হল দীপুর কানটা ভেজা, চিটচিটে। ম্যাচ জ্বেলে দেখলেন—রক্ত।

ওকী! মাথা ফেটে গেছে নাকি?

দীপু মাথা নাড়ল। ওরও তাই মনে হচ্ছিল। মাথার পেছন দিকটা দেয়ালে ঠুকে ফেটে গেছে। স্যার ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন রাস্তায়, তারপর রিকশা করে তার পরিচিত এক ডাক্তারের কাছে। মাথা ব্যান্ডেজ করে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেলেন নিজে। কিন্তু হাজার ধমক দিয়েও বের করতে পারলেন না কে তার এই অবস্থা করেছে। কখনও কিছু নিয়ে নালিশ করবে না প্রতিজ্ঞাটা ভেঙে ফেলতে চাইছিল না, যদিও ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিল পুরো ঘটনাটা স্যারকে বলে তারিকের ওপর মনের ঝালটা মেটাতে।

.

বাসায় খেতে বসে আব্বা হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, কী, তারিক তা হলে ধোলাই দিল শেষ পর্যন্ত।

দীপু কাঁদবে না ভেবেও হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আব্বা এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ওকী কাঁদছিস কেন? ছি, পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই। মার খেয়ে কেউ কাঁদে নাকি বোকা ছেলে!

পরদিন দীপু স্কুলে যেতে পারল না। রাতে প্রচণ্ড জ্বর এসেছিল। বিকেলে ওর বন্ধুরা দেখা করতে আসে। যদিও দীপু কাউকে বলেনি, তবুও ওরা ধরে নিয়েছিল তারিকই দীপুর এ অবস্থা করেছে। দীপুর বিছানা ঘিরে সবাই বসে রইল, আর বালিশে হেলান দিয়ে বসে দীপু পুরো ঘটনাটা শোনাল। সব শুনে নান্টু জিজ্ঞেস করল, স্কুলে যাবি কবে?

কাল যেতে পারি। তারিক এসেছিল আজ স্কুলে?

না, আমি দেখেছি বিকেলে রামের ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছে।

তোকে কিছু বলল?

আমাকে জিজ্ঞেস করল, স্যার ওর খোঁজ করেছেন কি না!

তুই কী বললি?

আমি বললাম, না। শুনে খুব অবাক হল। তুই স্যারকে কিছু বলিসনি?

উঁহু।

কেন, বললি না কেন? সামাদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

এমনি।

বাবু বলল, স্যার এমনিতে কাউকে মারেন না, কিন্তু যদি কখনও সত্যিকারের খেপে যান, হুঁ হুঁ বাবা, ছাল তুলে দেন মেরে। মনে আছে একবার কিবরিয়াকে কী মারটা দিলেন!

ওহ!। নান্টু মাথা নাড়ল, তুই যদি কালকে স্যারকে বলে দিতি তা হলে দেখতি মজা। দীপু কথা বলল না। আহাদ জিজ্ঞেস করল, স্কুলে যাবি তো কাল? গিয়েই স্যারকে বলিস।

উঁহু। কেন?

আমি কাউকে নালিশ করব না। কখনও করি না। যদি পারি নিজে পেটাব তারিককে, এমন টাইট করে দেব–

তুই পেটাবি তারিককে? সবাই অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল দীপুর দিকে, দীপু মুখ শক্ত করে বসে রইল! ওরা বিশ্বাস না করতে চায় তো না করুক, কিন্তু সে এর শোধ নেবে না?

.

ক্লাস নাইনের সাথে ফুটবল খেলায় দীপু খেলতে পারল না। খেলার দিনে মাঠের পাশে বসে সে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে গেল অন্যদের সাথে। যদিও তাতে কোনো লাভ হল না, ও হেরে গেল। তারিক খুব খেটে খেলছিল, দু বার সে গোল বাঁচাবার জন্যে এমন ঝুঁকি নিয়েছিল যে আরেকটু হলে পা ভেঙে যেতে পারত। দীপু খেলতে পারলে হয়তে খেলা আরেকটু ভাল হতো, কিন্তু ওরা হেরে যেত ঠিকই, ক্লাস নাইনের সবাই খুব ভাল খেলে।

খেলা দেখে বাসায় ফিরে আসার সময় রাস্তার মোড়ে তারিককে দেখতে পেল দীপু। কাদামাখা কাপড়জামা পরে বাসায় যাচ্ছিল। দীপুকে দেখে একটু অপরাধীর মতো হাসল তারিক, দীপু না-দেখার ভান করে এগিয়ে যেতে লাগল। খেলার পর তারিকের ওপর থেকে রাগ অনেকটা কমে গেছে, কিন্তু মার খাওয়ার ঘটনাটা এখনও ভোলেনি, মাথায় তখনো তার ব্যান্ডেজ!

তারিক একটু এগিয়ে এসে দীপুর পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। আস্তে আস্তে বলল, এই দীপু!

উঁ।

ইয়ে, মানে, শোন–

কী?

আমি কিন্তু তোর মাথা ফাটাতে চাইনি। কীভাবে যে—

ভ্যাদর ভ্যাদর করিস না। বাড়ি যা তুই।

খেপেছিস আমার ওপর, না? অবশ্যি খ্যাপারই কথা। একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল, মেজাজটা কেন যে এত খারাপ হল সেদিন! আর তুইও এরকম-হঠাৎ সুর পাল্টে তারিক জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, তুই স্যারকে আমার নাম বললি না কেন? আমি যা ভয় পেয়েছিলাম!

দীপু কথা না বলে হেঁটে যেতে লাগল। তারিক একটু বিব্রত হয়ে জিজ্ঞেস করল, অ্যাঁ? নালিশ করলি না কেন?

তোকে যদি কুত্তায় কামড়ায় তুই কাউকে নালিশ করিস?

অপমানে তারিকের মুখ কালো হয়ে উঠলো। আস্তে আস্তে বলল, তার মানে আমি কুত্তা?

একশোবার। মানুষ হলে কখনও তিনজন মিলে একজনকে পেটায়? শুনেছিস কখনও? ব্যাটাছেলেরা তিনজন মিলে একজনকে পিটিয়েছে? থুঃ। দীপু ঘেন্নায় থুতু ফেলল রাস্তায়।

তারিকের মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠল লজ্জায়। দীপু খেয়াল না করে বলে যেতে লাগল, নালিশ করিনি দেখে ভাবিস না আমি ভয় পেয়েছি বা ভুলে গেছি। একটু ভাল হয়ে নিই তারপর তোকে আমি পেটাব, খোদার কসম।

আমাকে পেটাবি?

হ্যাঁ, খোদার কসম। ব্যাটাছেলে হলে একলা আসিস, আমি বন্ধুদের নিয়ে আসব না।

দীপু গটগট করে বাসায় হেঁটে গেল, আর তারিক একা একা রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে লাগল। ওর এমন মন-খারাপ হল যে তা আর বলার নয়। দীপু ওকে পেটাবে এটা সে বিশ্বাস করে না, কিন্তু তিনজন মিলে একা দীপুকে পিটিয়েছে বলে দীপু ওকে ঘেন্না করে সেটা তো অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। ও বুঝতে পারে অনেকেই তাকে ঘেন্না করে, কিন্তু দীপু প্রথম তার মুখের উপর বলে দিয়ে গেল। আর সত্যিই তো, দীপু তো ওকে ঘেন্না করতেই পারে।

খানিকক্ষণ পর তারিকের নিজের উপর নিজের ঘেন্না হতে লাগল।

.

বেশ কয়েকদিন পার হয়ে গেছে। দীপু এখনও তারিককে পেটায়নি, পেটাবে সেরকম সম্ভাবনা কম। রাগটা প্রথম দিকে যেরকম বেশি ছিল, এখন আর সেরকম নেই। তা ছাড়া কোনোরকম ঝগড়া-বিবাদ ছাড়া আগে মার খেয়েছিল বলে একদিন পাল্টা মার দেয়া বেশ কঠিন। মানুষ খেপে না উঠলে মারামারি করবে কেমন করে? তা ছাড়া তারিক আজকাল অনেক ভাল হয়ে গেছে অন্তত দীপুর সাথে। আগে সবসময় যেরকম একটা ঝগড়া খুঁচিয়ে তুলতে চাইত এখন আর তা করে না, কাজেই দীপু আর মারামারি করার উৎসাহ পায় না।

এমনিতে সময় মোটামুটি খারাপ কাটছিল না। বিকেলে ফুটবল খেলে সন্ধ্যার আগে আগে বাসায় ফিরে আসে। সামনে হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা, তাই আজকাল একটু পড়াশোনার চাপ। পরীক্ষাটা শেষ হয়ে গেলে সবাই বাঁচে।

সেদিন খেলা শেষ করে সবাই দল বেঁধে ফিরে আসছিল। পানির ট্যাংকটার কাছে এসে কে যেন বলল, তার বড় ভাই স্কুলে পড়ার সময় একবার ওটার উপরে উঠেছিল।

তারিক ফ্যাকফ্যাক করে হেসে বলল, কী আমার বীর! আমি এইটার ওপর কতবার উঠেছি।

গুল মারিস না।

তারিক খেপে উঠল, সত্যি সত্যি সে কয়েকবার এটার ওপরে উঠেছে। চেঁচিয়ে বলল, যদি এখন উঠে তোদের দেখাই?

দেখা না!

যদি উঠি, কী দিবি?

দরকার নেই বাবা, আছাড় খেয়ে পড়বি, পরে আমার দোষ হবে।

তারিক খেপে উঠল, কী বললি? আছাড় খাব? তা হলে দেখ আমি উঠছি।

দীপু বাধা দিয়ে বলল, সন্ধ্যার সময়ে ওঠার দরকারটা কী? বিশ্বাস করলাম তুই পারিস।

উঁহু, তোরা বিশ্বাস করিস না, আমি এখন উঠব।

দীপু একটু বিরক্ত হয়ে বলল, এটা এমন কী ব্যাপার যে বিশ্বাস করব না?

তার মানে এটা খুব সোজা, তুইও পারবি?

একশো’বার পারব।

ওঠ দেখি!

দীপু খেপে উঠে বলল, ভাবছিস উঠতে পারব না?

ওঠ না দেখি।

তারিকের উপর নান্টুর অনেকদিনের রাগ, সে তারিককে খেপানোর জন্যে বলল, এটা আর কঠিন কী আমিও পারব।

নান্টু ছোটখাট হালকা-পাতলা-ভীরু বলে বন্ধুমহলে পরিচিত! যখন সেও বলে বসল যে সে পর্যন্ত উঠতে পারবে, তখন তারিক সত্যি সত্যি খেপে গেল। চোখ ছোট করে বলল, যদি সত্যি বাপের বেটা হোস, আয় আমার সাথে, ওঠ।

তারিক পানির ট্যাংকের দিকে এগিয়ে গেল, আর সত্যি সত্যি লম্বা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। দীপু নান্টুকে বলল, যা ওঠ!

নান্টু দুর্বল গলায় বলল, ঠাট্টা করে বলেছিলাম।

দীপু বলল, যা পারিস না তা বলতে যাস কেন? গরু কোথাকার!

তারিক অনেক দূর উঠে গেছে, চেঁচিয়ে বলল, বাপের ব্যাটা হলে আয়, আর ভয় পেলে থাক—বাসায় গিয়ে বার্লি খা গিয়ে।

দীপু ট্যাংকটার দিকে এগিয়ে গেল আর হঠাৎ কী মনে করে নান্টুও পেছনে পেছনে এগিয়ে গেল—সেও উঠবে।

ওঠার আগে দীপু নান্টুকে জিজ্ঞেস করল, সত্যি উঠবি?

হুঁ।

ভয় পেলে থাক–

না আমি উঠব!

ঠিক আছে, ওঠ। দীপু নান্টুকে আগে যেতে দিল। পেছনে পেছনে সেও উঠতে লাগল। ভয়ানক উঁচু পানির ট্যাংকটা। নিচ থেকে বোঝা যায় না। প্রায় আধাআধি ওঠার পর দীপু নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে, নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সবাইকে ছোট ছোট পুতুলের মতো দেখাচ্ছে। দেখে মাথা ঘুরে উঠতে চায়। তারিক তরতর করে উঠে যাচ্ছে, নান্টু তরতর করে না উঠলেও বেশ চমৎকার উঠে যাচ্ছে। ঠান্ডা লোহার সিঁড়িটা শক্ত করে ধরে রাখতে হচ্ছিল। শুধু ভয় হচ্ছিল এই বুঝি ফসকে যায় হাত, আর ছিটকে পড়ে নিচে।

শেষ অংশটুকু সবচেয়ে ভয়ানক। একেবারে খাড়া উঠে গেছে। তারিক পর্যন্ত একটু দ্বিধা করল ওঠার আগে। মাঝামাঝি উঠে আবার একটা হাঁক ঠিকই দিল ওদের দেখানোর জন্যে।

নান্টু শেষ অংশটায় এসে একটু ভয় পেয়ে গেল মনে হয়। সিঁড়ি ধরে ভয়ে ভয়ে উপর দিকে তাকাল, দীপু এসে জিজ্ঞেস করল, ভয় লাগছে?

নান্টু দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল।

নেমে যা তা হলে, তোর আর উঠে কাজ নেই।

নান্টুও নেমে যেতে চাইছিল, কিন্তু ঠিক সেই সময়ে উপর থেকে তারিকের গলার স্বর শুনতে পেল, মুরগির বাচ্চারা দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

দীপু ধমকে উত্তর দিল, ফ্যাচফ্যাচ করবি না বলে রাখলাম!

ভয় করছে নাকি? তারিক ভয় পাওয়ার ভঙ্গি করে ঠাট্টা করে চেঁচাতে লাগল, ও মাগো, ভয় করে গো, বার্লি খাব গো, দুধ খাব গো…..

দীপু তারিকের ঠাট্টায় কান না দিয়ে বলল, নান্টু ভয় পেলে নেমে যা।

নান্টু কী মনে করে ঠান্ডা গলায় বলল, না, উঠব।

সত্যি?

হুঁ।

দেখিস—

কিছু হবে না।

দীপুকে অবাক করে দিয়ে নান্টু সত্যি সত্যি উঠতে শুরু করল। এক পা এক পা করে নান্টু উঠতে থাকে। প্রত্যেকবার পা তোলার আগে লোহার সিঁড়িটা শক্ত করে ধরে রাখে। একেবারে খাড়া সিঁড়ি, পেছন দিকে তাকাবে না তাকাবে না করেও শেষ তিনটা ধাপের আগে হঠাৎ নিচের দিকে তাকাল নান্টু, আর তাকানোর সাথে সাথেই তার যেন কী হয়ে গেল! কত উপরে সে ঝুলে আছে, আর কত নিচে মাটি, ছোট ছোট গাছপালা বাড়িঘর ছোট ছোট পুতুলের মতো লোকজন। মাথা ঘুরে গেল, নান্টুর হাত ফসকে যাচ্ছিল, একটা চিৎকার করে প্রাণপণে সিঁড়িটা ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল।

দীপু ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, নান্টু কী হয়েছে?

নান্টু কোনো উত্তর দিল না।

নান্টু, নান্টু, এই নান্টু। কোনো উত্তর নেই নান্টুর। দীপু ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে আসে অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না, কাছে এসে হাত দিয়ে ওর পা ধরে নাড়া দিল দীপু।

একটা অদ্ভুত শব্দ করল নান্টু। দীপু অবাক হয়ে দেখল নান্টু থরথর করে কাঁপছে। ভয়ে দীপুর শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল মুহূর্তে।

উপর থেকে তারিকের হাসি ভেসে আসে, কী রে মুরগির বাচ্চারা, উঠিস না কেন? বার্লি খাবি?

দীপু আবার নান্টুকে ডাকল, নান্টু দাঁড়িয়ে থাকিস না, ওপরে ওঠ।

নান্টু কোনো উত্তর দিল না, গোঁ-গোঁ করে একটা শব্দ করল।

ওঠ। ওঠ বলছি!

ভাঙা গলায় নান্টু বলল, পারব না।

পারবি না মানে?

নান্টু গোঙাতে গোঙাতে বলল, পারব না, পারব না।

আর অল্প বাকি, উঠে পড়।

পারব না, পারব না, পারব না—

নেমে আয় তা হলে।

পারব না, আমি পারব না।

পারবি না মানে?

উঁহু, আমি কিছু পারব না।

উপর থেকে তারিক একটু অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে, তোরা ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

দীপু বলল, নান্টু বলছে উপরে উঠতে পারবে না।

তা হলে নেমে যায় না কেন?

নামতেও পারছে না।

মানে?

ঠিক তক্ষুণি নান্টু হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল।

অন্ধকারে, প্রায় দুশো ফিট উপরে সরু লোহার খাড়া সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেউ যদি কাঁদতে শুরু করে, তখন অবস্থাটা কল্পনা করা যায় না। তারিক ভয় পেয়ে বলল, এই দীপু, কাঁদছে কেন নান্টু?

জানি না।

উপরে তুলে আন ওটাকে।

আমি কীভাবে তুলব?

দাঁড়া, আমি টেনে তুলছি?

উপর থেকে তারিক নান্টুর শার্টের কলার ধরে টানতে লাগল আর নিচে থেকে দীপু লোহার মতো হয়ে অ্যাঁকড়ে থাকা নান্টুর হাত খুলে উপরে ধরিয়ে দিতে লাগল, তারপর সাবাধানে পা ঠেলে ঠেলে উপরের সিঁড়িতে তুলে দিল। মুখে ক্রমাগত ধমক আর অনুরোধ করে যেতে লাগল। তিনটি ধাপ ওকে তুলে আনতে অন্তত দশ মিনিট সময় লেগে গেল।

উপরে উঠে নান্টু মুখ চেপে শুয়ে পড়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে কাঁদতে লাগল। দীপুর মনে হল বুঝি মরেই যাবে।

তারিক ভারি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ওরকম করছে কেন?

বোধ হয় ভয় পেয়েছে।

ভয় পেয়েছে তো উঠেছে কেন?

আমি কী জানি।

যত্তসব ফাজলেমি! মুরগির বাচ্চার মতো ভয়, তা হলে উঠতে যায় কেন?

আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?

ওকেই জিজ্ঞেস কর।

দীপু খুব ঘাবড়ে গেল। নিচে থেকে অন্যরা বুঝতে পেরেছিল একটা কিছু গোলমাল হয়েছে। বাবু চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে দীপু?

দীপু কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না। সন্ধ্যার সময় কয়টি ছেলে পানির ট্যাংকের নিচে দাঁড়িয়ে আছে আবার কয়টি ছেলে এত উঁটু ট্যাংকের উপরে উঠে গেছে, আশেপাশে এমনিতেই লোকজনের ভিড় জমে যাবার কথা। দীপুর সব মিলিয়ে খুব অস্বস্তি লাগতে থাকে। তাকিয়ে দেখল, সত্যি সত্যি নিচে লোকজনের ভিড় জমে গেছে। কেউ যে ব্যাপারটি ভাল চোখে দেখছে না তা আর বলতে হল না। আরও বেশি লোক জমে যাবার আগেই একটা-কিছু করা দরকার। সে চেঁচিয়ে বলল, তোরা বাসায় চলে যা।

কেন?

যা বলছি, এখানে দাঁড়িয়ে থাকিস না। খবরদার!

যেসব লোক এর মাঝে জমা হয়ে গিয়েছিল তারা জানতে চেষ্টা করল ব্যাপারটি কী। কিন্তু নিচে যারা আছে, তারা ব্যাপারটি আসলেই জানে না, অন্যদের কী বলবে! দীপুর কথামতো তারা সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করল। কৌতূহলী লোকজন খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে চলে গেল।

শেষ লোকটি চলে যাবার পর তারিক বলল, আমি গেলাম।

মানে?

মানে আবার কী? সারারাত বসে থাকব নাকি?

সত্যি সত্যি তারিক উঠে দাঁড়িয়ে নামার আয়োজন করতে থাকে। দীপু নান্টুকে ডাকল, নান্টু কোনোমতে উঠে বসে থরথর করে কাঁপতে লাগল। ওকে নামার কথা বলার কোনো অর্থ হয় না, এখানে বসে থেকেই সে একটা অস্বাভাবিক ভয়ে কাঁপছে। কিছু-একটা হয়ে গেছে ওর।

দীপু তবু চেষ্টা করে দেখল, নান্টু, নামবি না?

নান্টু জবাব দিল না। আগের মতো কাঁদতে লাগল।

বসে থাকবি নাকি সারা রাত?

নান্টু তবু জবাব দিল না, কাদাটা একটু বেড়ে গেল শুধু।

আমরা গেলাম তা হলে।

নান্টু একটু জোরে কেঁদে উঠল এবার।

তারিক বিরক্ত হয়ে বলল, আমি জানি না বাপু, তোর যা ইচ্ছে হয় কর। আমি যাচ্ছি।

এই তারিকের জন্যই যত গন্ডগোল, দীপু তারিকের উপর রেগে উঠল। কিন্তু রেগে তো আর সমস্যার সমাধান হয় না। সত্যি সত্যি যদি নান্টু নামার সাহস না পায় তা হলে অবস্থাটা কী হবে ভাবতে পারে না।

তারিককে খুব বেশি চিন্তিত মনে হল না। সে দীপুর উপর সমস্ত দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নেমে গেল। উপর থেকে দেখল, তারিক শিস দিতে দিতে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে রাস্তা ধরে।

দীপু একা একা বসে রইল নান্টুকে নিয়ে। অনেক বুঝিয়ে ধমক দিয়ে বা ভয় দেখিয়েও কোনো লাভ হল না। নান্টু ঐভাবে বসে কেঁদে যেতে লাগল। দীপু বুঝতে পারছিল, ও ঠিক স্বাভাবিক নেই, হঠাৎ খুব বেশি ভয় পেয়ে একটা কিছু ঘটে গেছে ওর ভেতর। কিন্তু বুঝেই-বা লাভ কী। আরও কিছুক্ষণের ভেতর নিশ্চয়ই খোঁজাখুঁজি শুরু হবে। তখন কী হবে সে ভেবে পায় না। এক হতে পারে সে নিজে নেমে গিয়ে নান্টুর বাসায় খবর দিয়ে পালিয়ে যায়, তারপর নান্টুর বাসার লোজকন যা ইচ্ছে হয় করুক! কিন্তু পর মুহূর্তে সে এটা উড়িয়ে দেয়। পুরো ঘটানার দায়িতু ওকেও নিতে হবে। আব্বাকে জানালে আব্বা নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করবেন, কিন্তু তার আগে তার গলায় দড়ি দিয়ে মরতে হবে। ওর আব্বা ওকে যত স্বাধীনতা দিয়েছেন তত স্বাধীনতা আর কাউকে কারো আব্বা দেননি। স্বাধীনতা পেয়ে যা ইচ্ছে করে ঝামেলা বাধিয়ে আব্বার কাছে হাজির হওয়ার থেকে লজ্জার কী আছে? আব্বা হয়তো কিছু বলবেন না—হয়তো ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকাবেন, দীপু বুঝতে পারে ও তার আব্বার সামনে লজ্জায় মরে যাবে তা হলে। তার ইচ্ছে হল বসে বসে খানিকক্ষণ কেঁদে নেয়।

প্রায় আধ ঘণ্টা পরে হঠাৎ দীপু নিচে থেকে তারিকের গলার স্বর শুনতে পেল, হেই–হেই দীপু।

কী?

এখনও আছিস তোরা?

আছিই তো কী করব তা হলে?

নান্টু এখনও কাঁদছে?

হ্যাঁ।

লাথি মেরে ফেলে দে নিচে।

দীপুরও তাই ইচ্ছে করছিল, কিন্তু সত্যি সত্যি তো আর ফেলে দেয়া যায় না।

কী করবি এখন?

জানি না। দীপু চিন্তিত মুখে বলল, আমার আব্বাকে খবর দিতে পারবি একটু?

মাথা খারাপ! আমি ওসবের মাঝে নাই।

তারিক চলে গেল না, নিচে ঘুরে বেড়াতে লাগল। খানিকক্ষণ পর বলল, তুই দাঁড়া, আমি আসছি।

বেশ খানিকক্ষণ পর তারিক এক গাছা দড়ি নিয়ে ট্যাংকের উপরে উঠে আসে। দীপু ভারি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, দড়ি দিয়ে কী করবি?

হারামজাদার গলায় বেঁধে লটকে দেব।

যাঃ। ফাজলেমি করিস না, কী করবি বল।

নান্টুকে ঘাড়ে করে নামাব। কিন্তু হারামজাদাকে বিশ্বাস নাই। ওটাকে পিঠে তুলে নেবার পর তুই শক্ত করে আমার শরীরে সাথে বেঁধে দিবি।

দীপুর চোখ কপালে উঠে গেল। অবাক হয়ে বলল, তুই নান্টুকে ঘাড়ে করে নামাবি? এখান থেকে?

হ্যাঁ।

মাথা খারাপ?

বকবক করিস না। এছাড়া কী করবি?

সত্যি কিছু করার নেই। কিন্তু নান্টুকে ঘাড়ে করে প্রায় দুশো ফিট খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাওয়া কি সোজা কথা! দীপু ভাবতে গিয়ে ভয় পেয়ে গেল, বলল, তারিক, বেশি বাড়াবাড়ি করতে যাসনে, একটা-কিছু হয়ে গেলে–

তুই ভাদর ভ্যাদর করবি না। আমি তোদের মতো ডিম মাখন খাওয়া বড়লোকের ন্যান্যাদা বাচ্চা না! ছোটলোকের পোলা আমি—ওই হারামজাদার মতো দু-চারটা বোঝা আমি ঘাড়ে করে মাইল মাইল যাই প্রায় রোজ।

দীপু চুপ করে রইল। সত্যি যদি সে সাহস করে, তা হলে ঠিকই নেমে যাবে।

নান্টু কিছুতেই তারিকের পিঠে উঠতে রাজি হচ্ছিল না। দীপু নিজেও ওরকম অবস্থায় কখনও রাজি হতো না। কিন্তু ওকে রাজি করানোর জন্যে তারিক যে কাজটি করল সেটির তুলনা নেই! পকেট থেকে একটা ছোট চাকু বের করে চোখ লাল করে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, যদি পিঠে না উঠিস, চাকু মেরে দেব শালার!

অন্ধকারে তারিকের চকচকে চোখ আর হিসহিসে গলার স্বর শুনে নান্টু সত্যি ভয় পেয়ে গেল। ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠতে চাইছিল, তার আগেই তারিক চাকুটা গলার মাঝে ধরল। বলল, খবরদার, খুন করে ফেলব হারামির বাচ্চা।

নান্টু শুকনো মুখে খাবি খেতে খেতে ফ্যাসফাস করে কাঁদতে লাগল, তারপর বাধ্য ছেলের মতো তারিকের পিঠে উঠল। দীপু খুব শক্ত করে নান্টুকে তারিকের সাথে বেঁধে দিল যেন ভয়ে ছেড়ে দিলেও পড়ে না যায়। তারিক কোথা থেকে গরুর। দড়ি খুলে এনেছে, ছিঁড়ে যাবারও ভয় নেই!

তারিক নামাতে শুরু করার আগে হঠাৎ দীপুর ভীষণ ভয় করতে লাগল। ওঠার সময় দেখেছে খাড়া সিঁড়িতে সবসময় মনে হয় পেছন দিকে কে যেন টানছে, হাত একটু ডিল করলেই বুঝি পড়ে যাবে। শক্ত করে ধরে রাখতে রাখতে হাত ব্যথা হয়ে যায়। এর মাঝে কেউ যদি কাউকে পিঠে নিয়ে নামতে চেষ্টা করে তা হলে যে কী ভয়ানক লাগবে সে চিন্তাও করতে পারে না। কিন্তু তারিক যখন সত্যি সাহস করছে, তখন ওর কিছু বলার নেই। আস্তে আস্তে বলল, তুই আগে নিচে নামবি, না আমি?

তুই আগে শুরু কর। একটু ঝামেলা-টামেলা হলে ইয়ে করিস।

আচ্ছা, ঘাবড়াস না—আমি থাকব তোর নিচে নিচে।

দীপু নামতে শুরু করে। নিচে—কত নিচে কে জানে ছোট ছোট গাছপালা, ছোট ছোট ঘর বাড়ি! কত ওপরেই না ওরা দাঁড়িয়ে আছে! সিঁড়ি বেয়ে দু-তিন ধাপ নেমে ও দাঁড়ায়, তারিককে ডেকে বলল, এবারে তুইও নাম।

নামছি, বলে তারিক নামার জন্যে এগিয়ে আসে। দীপু উপরে তাকাতে পারছিল না ভয়ে। কিন্তু তারিকের সাহস আছে সত্যি, ঠিকই সিঁড়িতে পা দিয়ে। নামতে শুরু করে দিল। মুখে বলতে লাগল, নান্টু হারামজাদা যদি একটু নড়িস তা হলে শুয়োর হাত ফসকে যাবে, আমি তো মরবই, তুইও মরবি

নান্টু কোনো শব্দ করছিল না, শব্দ করার মতো সাহস বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই।

তারিক এক পা এক পা করে নামতে থাকে। সাথে সাথে দীপুও, তারিক নিচে তাকাতে পারছিল না, যতটুকু সম্ভব সোজা হয়ে সিঁড়ির সাথে মিশে নামতে হচ্ছিল। দীপু সাবধানে মাঝে মাঝে তারিকের পা সিঁড়িতে লাগিয়ে দিচ্ছিল। খুঁজে সিঁড়ির। ধাপ না পেয়ে তারিকের পা ফসকালে হাত দিয়ে ধরে তাল সামলাতে পারবে না। কত নিচে নামতে হবে কে জানে! দীপুর কাছে একেকটি মুহূর্ত মনে হচ্ছিল একেকটি বছর।

উপর থেকে আবার তারিকের গলার স্বর শোনা গেল, দেখে তো মনে হয় শুকনো, শালার ওজন তো ঠিকই আছে। কী খাস হারামজাদা? সীসা নাকি? বাবাগো! হাত না ছিঁড়ে যায়! খবরদার—খবরদার নান্টু—নড়বি না। তুই মরতে চাস মরিস, আমার কোনো আপত্তি নেই, আমাকে নিয়ে মরিস না।

নান্টু কোনো উত্তর দিল না, উত্তর দেয়ার মতো অবস্থাও নেই।

প্রথম অংশটুকু সবচেয়ে ভয়ানক, একেবারে খাড়া আর ভয়ানক লম্বা। এক সময়ে সত্যি সেটা শেষ হয়ে গেল। পরের অংশটুকু শুরু হবার আগে খানিকটা জায়গা রেলিং দিয়ে ঘেরা, পা ছড়িয়ে বসাও যায় ইচ্ছে হলে। তারিক নেমে এসে মুখ হা করে শ্বাস নিতে থাকে—ভীষণ পরিশ্রম হয়েছে ওর। পরিশ্রম থেকে বড় কথা, সারাক্ষণ পড়ে যাবার ভয়ে তারিক গলগল করে ঘামছিল।

দীপু জিজ্ঞেস করল, একটু বিশ্রাম নিবি?

বিশ্রাম? এই হারামজাদাকে ঘাড়ে নিয়ে বিশ্রাম নেব কেমন করে?

খুলে দিই কিছুক্ষণের জন্যে?

নাহ্, থাক। খোলা, আবার বাঁধা অনেক ঝামেলা। নে শুরু কর।

আবার নামতে শুরু করে ওরা। প্রথম প্রথম তারিক নান্টুকে গালিগালাজ করছিল, মাঝে মাঝে দীপুর সাথে কথা বলছিল। আস্তে আস্তে তার গলার স্বর থেমে গিয়ে শুধু লম্বা লম্বা নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। নান্টুকে ঘাড়ে করে নিয়ে নামতে যে কী পরিমাণ পরিশ্রম হচ্ছে দীপু খুব ভাল করে বুঝতে পারে।

কতক্ষণ লেগেছিল কে জানে! শেষ ধাপটা নেমে দীপুর ইচ্ছে করছিল আনন্দে চিৎকার করে উঠতে। তারিক টলতে টলতে কোনোমতে দাঁড়িয়ে থাকে। মুখ হা করে শ্বাস নিতে নিতে বলে, খুলে দে তাড়াতাড়ি।

দীপু তাড়াতাড়ি খুলে দিতে চেষ্টা করে। খুব শক্ত হয়ে এঁটে গিয়েছিল, তাই তারিকের কাছ থেকে চাকু নিয়ে দড়ি কেটে নান্টুকে আলগা করল। সাথে সাথে তারিক লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে।

নান্টু অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইল, তখনও ফোঁসফোঁস করে কাঁদছিল, কী। জন্যে কে জানে!

দীপু তারিককে জিজ্ঞেস করল, বাতাস করব খানিকক্ষণ?

তারিক হাত নেড়ে না করল। দীপু তবুও শার্ট খুলে বাতাস করতে থাকে। তারিকের জন্যে একটা-কিছু করতে ইচ্ছে করছিল ওর।

তারিকের উঠে দাঁড়াতে বেশ খানিকক্ষণ সময় লাগল। বারকয়েক হাত-পা ছুঁড়ে একটু তাজা হয়ে দীপুকে বলল, বাড়ি যা এখন, মার খাবি গিয়ে। কত রাত হয়েছে দেখেছিস? তারপর নান্টুকে ডাকল ঠান্ডা গলায়, নান্টু শোন।

কী?

শোন বলছি।

নান্টু ভয়ে ভয়ে কাছে এগিয়ে আসে আর কিছু বোঝার আগেই পেটে প্রচন্ড ঘুষি!

বাবাগো বলে নান্টু নাক মুখ চেপে পেটে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ে। তারিক ওর দিকে না তাকিয়ে হালকা শিস দিতে দিতে হেঁটে চলে গেল।

দীপু খানিকক্ষণ তারিককে চলে যেতে দেখল। তারপর নান্টুকে ঘাড় ধরে টেনে তুলল। হাসতে হাসতে বলল, কাদিস না বেকুব কোথাকার! আমি হলে অন্তত দশটা ঘুষি মারতাম, তারিক তো মোটে একটা মারল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *