০৭.
তারিক বিন যিয়াদ নিষ্পলক দৃষ্টিতে সেই দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন, যে দরজা দিয়ে মেরিনা এ কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল–’আমি এখন মুক্ত, আমি এখন মুক্ত।
তারিক বিন যিয়াদের কপালে চিন্তার বলিরেখা ফুটে উঠল। সুনিশ্চিতরূপে কারও পক্ষেই এ কথা বলা সম্ভব ছিল না, তিনি এখন কী চিন্তা করছেন।
তিনি হয়তো ভাবছিলেন, কী অদ্ভুত মেয়ে মানুষ! এই নারী যদি ঐ জাদুকরকে হত্যা না করত! কিংবা তিনি হয়তো এ কথা ভাবছিলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে স্বপ্নে বিজয়ের যে সুসংবাদ দিয়েছেন, তা পূর্ণ করার জন্য আল্লাহ তাআলা কত আশ্চর্যজনক ও অলৌকিক ঘটনাপ্রবাহের জন্ম দিচ্ছেন। সতীতৃহারা একজন অমুসলিম নারী, যে ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমন ইহুদি সম্প্রদায়ের একজন সদস্য–সে কিনা আপন গোত্রের এক জাদুকরকে হত্যা করেছে, যে তার জাদুবিদ্যার মাধ্যমে মুসলিম বাহিনীকে পরাজিত করার চেষ্টা করছিল।
তারিক বিন যিয়াদের চেহারায় গভীর চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল। দরবারের বাইরে কয়েকজন মানুষের কথার আওয়াজ শুনা গেল। কিছুক্ষণ পর প্রহরী দরবারে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করে বলল, ‘মুসলিম বাহিনীর কয়েকজন সিপাহী সিপাহসালারের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছে।’
এই মহল যে বাদশাহর ছিল সে মৃত্যুবরণ করেছে। তারিক বিন যিয়াদ সম্বিত ফিরে পেয়ে বললেন। এখন এখানে কোন বাদশাহ নেই, যার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য অনুমতির প্রয়োজন হবে। যারা আসতে চায় তাদেরকে আসতে দাও।
প্রহরী দরজা থেকে সরে দাঁড়ালে তিনজন ব্যক্তি একটা টেবিল ধরাধরি করে ভিতরে প্রবেশ করল। তিনজনই তারিক বিন যিয়াদের বাহিনীর লোক। তাদের একজন উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তা। টেবিলটি খুব বড় ছিল না। দেখলে মনে হত, একজনই এই টেবিল উঠাতে পারবে। কিন্তু টেবিলের ওজন ছিল খুবই বেশি।
‘এটি আবার কি?’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন।
‘সিপাহসালার। এটি একটি টেবিল।’ সেনাকর্মকর্তা বলল। আমরা শহর থেকে পলায়মান লোকদেরকে বাধা দিচ্ছিলাম এবং তাদেরকে এই বলে অভয় দিচ্ছিলাম যে, তারা যেন আমাদেরকে ভয় না পায় এবং সকলেই যার যার ঘরে চলে যায়। আমরা তাদেরকে এই প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছিলাম যে, তাদের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরুর হেফাযত করা হবে। এমন সময় আমরা দেখতে পেলাম, শহরের পিছন দিকের ফটক দিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি বের হয়ে গেল। আমরা গাড়ি থামানোর জন্য নির্দেশ দিলাম, কিন্তু গাড়োওয়ান দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। আমার সন্দেহ হল, আমি এই দুই সিপাহীকে সাথে নিয়ে তাদের পিছু নিলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর আমরা তাদেরকে ধরতে সক্ষম হলাম। গাড়িতে পাদ্রির মতো দেখতে তিনজন লোক ছিল। তাদের কাছে এ টেবিলটি ছিল। এটি সম্পূর্ণ স্বর্ণের তৈরী।
আমি পাদ্রিদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা গাড়ি থামাতে বলার পরও কেন তোমরা গাড়ি থামালে না? তারা বলল, এই টেবিল রক্ষা করার জন্য আমরা থামিনি। আমি তাদেরকে শহরে ফিরে আসতে বললে তারা আমাকে অনুনয়-বিনয় করে বলল, এই টেবিল অত্যন্ত পূত-পবিত্র ও বরকতময়। তারা চায় না যে, এটা অন্য ধর্মের কোন লোকের হাতে পড়ুক। আমি তাদেরকে সাথে করে নিয়ে এসেছি।’
‘তাদেরকে ভিতরে আসতে বল।’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন।
কিছুক্ষণ পর পাদ্রি তিনজন ভিতরে প্রবেশ করল।
‘এই টেবিল যদি স্বর্ণের হয় তাহলে তো নিশ্চয় এর মূল্য অনেক বেশি। তারিক বিন যিয়াদ পাদ্রিদেরকে লক্ষ্য করে বললেন। আমি তোমাদেরকে সম্মান করি। কারণ, তোমরা ধর্মগুরু। তবে এ টেবিল আমি তোমাদেরকে ফেরত দিব না।’
‘এই টেবিল সম্পূর্ণ স্বর্ণের তৈরী।’ একজন পাদ্রি বললেন। টেবিলটির চারপাশে আছে দুর্লভ মণি-মুজা আর হীরা-জহরতের কারুকাজ। পায়াগুলো তৈরী হয়েছে মহামূল্যবান নীলকান্তমণি, পদ্মরাগ আর মরকত পাথর দিয়ে। এই টেবিল অত্যন্ত মূল্যবান, এ জন্য আমরা এটা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি না; বরং এটা আমাদের নিকট এক পবিত্র স্মৃতি। দেখুন, এই টেবিলের উপর স্বর্ণের একটি রেহাল বানানো আছে। রেহালটি টেবিলের সাথে জোড়া লাগান। এই টেবিল আমাদের গির্জার সম্পত্তি। আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না যে, এই টেবিল হযরত সুলায়মান আলাইহিসসালামের। বহুকাল পূর্বে টাইটিস নামে আন্দালুসিয়ার এক বাদশাহ জেরুজালেম আক্রমণ করেছিলেন। এই টেবিল তিনি সেখানকার সবচেয়ে বড় উপাসনালয় থেকে নিয়ে এসেছিলেন। তখন থেকে রডারিক পর্যন্ত যত বাদশাহ অতিবাহিত হয়েছেন তারা সকলে এই টেবিলের সাথে একটি মূল্যবান হীরা সংযুক্ত করে এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছেন। আমরা আপনার কাছে আবেদন করছি, আপনি আমাদের থেকে এই টেবিল ছিনিয়ে নিবেন না। এটা হযরত সুলায়মান আলাইহিসসালামের স্মৃতি, এ থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করবেন না।’
‘এখন আন্দালুসিয়ার রাজমুকুট ও সিংহাসন আমাদের কজায়, সুতরাং এই টেবিলও আমাদের কাছেই থাকবে। তারিক বিন যিয়াদ বললেন।
প্রায় সকল ঐতিহাসিকই অতি মূল্যবান এই টেবিলের কথা উল্লেখ করেছেন। এই টেবিলের প্রতিটি পায়া টেবিল থেকে পৃথক করা যেত এবং মুহূর্তের মধ্যে টেবিলের সাথে লাগানো যেত। তারিক বিন যিয়াদ টেবিলটি পাদ্রিদেরকে ফিরত দিলেন না। মালে গনিমত হিসেবে নিজের কাছে রেখে দিলেন।
এই মুহূর্তে এই টেবিলের গুরুত্ব শুধু এতটুকুই ছিল যে, এটি একটি মহামূল্যবান টেবিল। পরবর্তী সময়ে এই টেবিল মুসা বিন নুসাইরের জন্য এমন এক লজ্জার বিষয়ে পরিণত হয় যে, ইতিহাসে সে ঘটনা আজও লেখা আছে।
তারিক বিন যিয়াদের আশে-পাশে যেসব সালার ছিল তাদেরকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন,
‘আমীরুল মুমিনীনের জন্য এর চেয়ে চিত্তাকর্ষক হাদিয়া আর কী হতে পারে? আমি দামেস্ক গিয়ে নিজ হাতে এ টেবিল খলীফাতুল মুসলিমীনের খেদমতে পেশ করব।’
‘আমরা সিপাহসালারকে সতর্ক করা কর্তব্য মনে করছি। একজন পাদ্রি বললেন। এ পর্যন্ত কোন বাদশাহ এই টেবিলের মালিকানা দাবি করেনি। সকলেই বলেছে, এর মালিক হলেন, হযরত সুলায়মান আলাইহিসসালাম। আর হযরত সুলায়মান ছিলেন মানব ও জিন জাতির নবী। এই টেবিলের হেফাজতকারী হল জিন জাতি। এ জন্য এই টেবিল এতদিন গির্জার হেফাযতে ছিল। যদি সিপাহসালার বা অন্য কেউ এর মালিকানা দাবি করেন তাহলে তিনি লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার হয়ে ধুকে ধুকে অসহায়ের মতো মৃত্যুবরণ করবেন।
‘এই টেবিলের মালিকানা হযরত সুলায়মান আলাইহিসসালামেরই থাকবে। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। আমরা মুসলমান, আর মুসলিম জাতি কখনও স্বর্ণ-রোপাকে নিজেদের মালিকানায় রাখে না। তোমরা এখন যেতে পার। শহর থেকে পালানোর কোন প্রয়োজন নেই। তোমাদের গির্জা বা উপাসনালয়ে চলে যাও। তোমাদের এবং তোমাদের গির্জাসমূহের কোন অসম্মানি করা হবে না।’
***
পর দিন সকালে তারিক বিন যিয়াদ শাহীমহলের সামনের প্রশস্ত মাঠে ফজরের নামাযের ইমামতি করলেন। নামায শেষ করে তিনি শাহীমহলে ফিরে যাচ্ছিলেন। এমন সময় একজন ভারপ্রাপ্ত প্রশসক–যিনি রাজদূতের দায়িত্বও পালন করতেন–দৌড়ে এলেন। তার নাম ইদ্রিস আবুল কাসেম। তিনি অনেক দূর থেকে এসেছিলেন।
‘বিন যিয়াদা’ রাজদূত তারিক বিন যিয়াদকে সালাম জানিয়ে আরয করলেন। ‘আপনি কি জানেন, আফ্রিকার আমীর মুসা বিন নুসাইর আঠার হাজার সিপাহী নিয়ে আন্দালুসিয়া এসে পৌঁছেছেন?
“তিনি কবে এসেছেন?’ তারিক বিন যিয়াদ এমনভাবে জিজ্ঞেস করলেন যে, অবাক হওয়ার পরিবর্তে তার কণ্ঠ থেকে আনন্দ ঝরে পড়ল। তিনি এখন কোথায়? আমি জানতাম, তিনি আমার সাহায্যের জন্য অবশ্যই আসবেন।
প্রায় এক বছর হতে চলল তিনি আন্দালুসিয়া এসেছেন।’ ইদ্রিস আবুল কাসেম বলল। যেসকল শহর আপনি জয় না করে ছেড়ে এসেছিলেন, তা তিনি বিজিত করেছেন।’
‘মুসা বিন নুসাইর জিন্দাবাদ!’ তারিক বিন যিয়াদ আনন্দের আতিশয্যে চিৎকার করে উঠলেন। তিনি আমার কাজ পূর্ণ করে দিয়েছেন, আমি তাকে শুধু আমীর মনে করি না; আমার বাবাও মনে করি।’
‘আপনি যেসব শহর জয় করেছিলেন সেগুলো হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। ইদ্রিস বলল। যদি সঠিক সময়ে আফ্রিকার আমীর মুসা বিন নুসাইর জানতে না পারতেন তাহলে মেদুনা, সেদুনা এবং কারমুনায় বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠত। সেখানে বিদ্রোহ শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমীর মুসা সঠিক সময়ে আক্রমণ করে সে সকল শহর নিজ হেফাযতে নিয়ে নিয়েছেন।
তারিক বিন যিয়াদের কণ্ঠ থেকে মুসা বিন নুসাইরের প্রশংসা ও স্তুতি ঝরে পড়ছিল। তিনি মুসা বিন নুসাইরকে আল্লাহ তাআলার পাঠানো ফেরেশতা বলে দাবি করছিলেন। মুসা বিন নুসাইর যেসব স্থান দখল করেছিলেন ইদ্রিস আবুল কাসেম তারিক বিন যিয়াদকে সেসব স্থানের বিবরণ দিচ্ছিলেন।
‘তিনি আমার সাহয্যের জন্য এসেছেন। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। এখন আমি নিশ্চিন্তে সামনে অগ্রসর হতে পারব। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই পুরো আন্দালুসিয়া ইসলামী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।’
ইদ্রিস আবুল কাসেম তারিক বিন যিয়াদকে মুসা বিন নুসাইরের বিজয় অভিযানের দাস্তান বর্ণনা করে শুনাচ্ছিলেন। তারিক বিন যিয়াদ সেসব বিবরণ শুনে মুসা বিন নুসাইরকে আল্লাহর প্রেরিত ফেরেশতা সাব্যস্ত করছিলেন। তিনি মুসা বিন নুসাইরের প্রশংসায় আত্মহারা হয়ে পড়ছিলেন। এই সময় মুসা বিন নুসাইর মেরিডা শহরের অদূরে একটি তাঁবুতে বসে সর্বশেষ অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁর নিকট কুরাইশ বংশের দু’জন সম্মানিত ব্যক্তি বসেছিলেন। একজন আলী বিন আবি লাহমী, আর অপরজন হায়াত বিন তামিমী।
‘এমন অবাধ্য আর অহঙ্কারী সিপাহসালারকে কি ক্ষমা করা উচিৎ? মুসা বিন নুসাইর ক্রোধান্বিত হয়ে সভাসদকে লক্ষ্য করে বললেন। আমি এই জংলি বার্বারকে নির্দেশ দিয়েছিলাম, তুমি যেখানে আছ সেখানেই থাক, সামনে অগ্রসর হয়ো না। কিন্তু সে আমার নির্দেশ অমান্য করে তার ফৌজকে তিন ভাগে ভাগ করে বড় বড় শহরগুলো বিজয় করে নিজে টলেডো গিয়ে বসে আছে।’
‘অন্তত টলেডো আপনার বিজয় করা দরকার ছিল।’ হায়াত বিন তামিমী বললেন। এখন এটাই প্রসিদ্ধ হয়ে যাবে যে, বার্বাররা আন্দালুসিয়া জয় করেছে।
‘আমি আরবদেরকে আন্দালুসিয়ার বিজয়ী বানাতে চাই।’ মুসা বললেন। ‘আমি এই বার্বার তারিককে সিপাহসালারের পদ থেকে অপসারিত করব।
‘আরেকটা বিষয় লক্ষ্য রাখা উচিৎ, বিন নুসাইর! আলী বিন আবি শাহমী বললেন। তারিকের কাছে গনিমতের যেসব মূল্যবান সম্পদ রয়েছে, তা তার থেকে নিয়ে নেওয়া উচিৎ। সে নিশ্চয় এটা চিন্তা করে রেখেছে যে, এসব মূল্যবান সম্পদ খলীফার নিকট হাদিয়াস্বরূপ পেশ করবে। সেসব মূল্যবান বস্তু আপনি নিজে দামেস্ক নিয়ে যাবেন। বাবার তারিককে এ ব্যাপারে কৃতিত্ব লাভের মওকা দেওয়া ঠিক হবে না। অন্যথায় সে আমীরুল মুমিনিনের আস্থাভাজন হয়ে যাবে।
কী আশ্চর্য! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করেছেন মাত্র আশি বছর হয়েছে। প্রিয়নবীর সান্নিধ্যধন্য কিছু লোক তখনও জীবিত ছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহর শিক্ষা মানুষের অন্তর থেকে ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছিল। মুসলমানদের মাঝে উঁচু-নীচুর মানদণ্ড বদলে যাচ্ছিল।
তারিক বিন যিয়াদ অত্যন্ত খুশী হচ্ছিলেন। কারণ, তিনি মুসা বিন নুসাইরকে জন্মদাতা পিতার মতোই সম্মান করতেন। তিনি মনে মনে ভাবছিলেন, মুসা বিন নুসাইর তাঁর সাহায্যের জন্য এত দূর এসেছেন। অর্ধেক আন্দালুসিয়া জয় করার দরুন মুসা তাঁকে প্রাণ খোলে অভিনন্দন জানাবেন।
***
মুসা বিন নুসাইরের তিন ছেলে। আবদুল্লাহ, মারওয়ান ও আবদুল আযীয়। বড় ছেলে আবদুল আযীযকে তিনি আফ্রিকায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে এসেছিলেন। আর বাকী দুজনকে নিজের সাথে আন্দালুসিয়া অভিযানে নিয়ে আসেন। তিনি আন্দালুসিয়া এসে যখন বিভিন্ন জায়গায় বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠতে দেখলেন তখন তিনি তার বড় ছেলেকে আন্দালুসিয়া নিয়ে আসা সমীচীন মনে করলেন।
মুসা বিন নুসাইর মেরিডার দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। মুসার গুপ্তচর বাহিনীর চৌকস একটি দল পূর্বেই মেরিডা পৌঁছে গিয়েছিল। তারা ফিরে এসে সেই শহরের সম্পূর্ণ ইতিহাস এবং শহর রক্ষাপ্রাচীরের অভ্যন্তরীণ সামরিক ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরেন।
মেরিডা আন্দালুসিয়ার এক বিশাল বড় শহর ছিল। আন্দালুসিয়ার রাজধানী টলেডো থেকেও মেরিডা অনেক সুন্দর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আর নয়নাভিরাম দৃশ্যে মেরিডা টলেডোকেও হার মানাবে। এই শহরের এমন সৌন্দর্যের স্রষ্টা ছিলেন একজন রুমী বাদশাহ। রুমী বাদশাহ এই শহরটিকে কেবল সৌন্দর্যের মহিমায় সুশোভিতই করেনি; বরং তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও করেছিলেন সুসম। তিনি স্থাপত্য সৌন্দর্যের নিদর্শনস্বরূপ অসংখ্য ভবন নির্মাণ করেন। সেসব ভবনের ধ্বংসাবশেষ আজও তার অপরূপ সৌন্দর্যের চিহ্ন বহন করছে। রুমী বাদশাহর নাম ছিল আগাষ্টাস। তিনি এই শহরের সৌন্দর্য এতটাই বৃদ্ধি করেছিলেন যে, মনে হচ্ছিল, এটাই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।
রুমী বাদশাহ শুধুমাত্র মেরিডার সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করেননি; বরং তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এতটাই মজবুত করেছিলেন যে, শহরটি এক অপ্রতিরোধ্য দুর্গে পরিণত হয়। তিনি শহর রক্ষাপ্রাচীরই শুধু মজবুত করেননি, বরং তার সৈন্যদেরকেও এমন ট্রেনিং দিয়েছিলেন যে, কোন শক্তিশালী শত্রুবাহিনীও শহর অবরোধ করতে সাহস করত না। তিনি শহরের চতুর্পার্শ্বে এমন প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন যে, কোন হানাদার বাহিনী শহরের কাছেও আসতে পারত না। তার নিজস্ব সেনাবাহিনীকে এমন প্রশীক্ষণ দেওয়া হয়েছিল যে, তারা শহর থেকে বের হয়ে হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ করতে এবং দীর্ঘ দিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম ছিল।
ঐতিহাসিক ‘কোভে’ লেখেন, কি কারণে কে জানে, রোমের বাদশাহরা এই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, মেরিডাকে রোম থেকেও বেশি সুন্দর বানাবে। রোমের তুলনায় মেরিডাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করার ক্ষেত্রে তারা জিদের বশবর্তী হয়ে পড়েছিল। শহরের পাশ দিয়ে ‘দাদিয়ানা’ নদী প্রবাহিত ছিল। সেই নদীর উপর যে পুল নির্মাণ করা হয়েছিল, তার পিলার নদীর মাঝে তৈরী করা হয়েছিল। সে যুগে নদীর মধ্যে পিলার স্থাপন করার চিন্তাই করা যেত না। তার পরও রোমানরা এই আশ্চর্য বিষয়টিও করে দেখিয়েছিল।
এই শহরের গির্জাগুলো ছিল খুবই সুন্দর। প্রতিটি গির্জার মাঝে বিপুল পরিমাণ ধন-দৌলত জমা করে রাখা হয়েছিল। মেরিডার প্রধান পাদ্রি টলিডোর প্রধান পাদ্রির চেয়েও বেশি গুরুত্ব রাখত। তার নির্দেশেই গোটা রাজ্য চলত। এ জন্য তাকে রাজ্যের প্রধান পাদ্রি বলা হত। কখনও কখনও তার জুলুস বের হত। উদ্দেশ্য জনসাধারণের মাঝে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি আর সম্মান বজায় রাখা। জনসাধারণের মাঝে প্রভাব বিস্তার করার কারণ হল, এই শহরের মানুষ ছিল বিত্তশালী। এই শহরের লোকদের মতো বিত্তশালী লোক আন্দালুসিয়ার অন্য কোন শহরে ছিল না। প্রধান পাদ্রি বিত্তশালীদের কাছ থেকে অর্থ-কড়ি নিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিল।
মেরিডার উদ্দেশ্যে মুসা বিন নুসাইর যে গোয়েন্দা বাহিনী পাঠিয়েছিলেন, তারা ফিরে এলে তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন :
‘মেরিডার সৈন্যদের মাঝে যুদ্ধ করার স্পৃহা কেমন দেখলে?’ তারপর নিজেই নিজের কথার জবাব দিলেন। না, যুদ্ধের স্পৃহা না থাকারই কথা। মানুষের কাছে একটি বস্তুই থাকে। দৌলত অথবা স্পৃহা। দুটো এক সাথে থাকতে পারে না। কারণ ধন-দৌলত মানুষকে বিলাসী করে দেয়।’
‘না, আমীরে মুহতারাম!’ গুপ্তচর বাহিনীর প্রধান বলল। মেরিডার অধিবাসীদের কাছে দুটো বস্তুই আছে। আমি খ্রিস্টান ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশ নিয়ে সেখানে প্রবেশ করেছিলাম। একটি সরাইখানায় আমি অবস্থান করেছিলাম। সেখানের দু’টি গির্জায়ও আমি গিয়েছি। আমি তাদের অনেককেই জিজ্ঞেস করেছি, মুসলিম বাহিনী তো গোটা রাজ্যই দখল করে নিয়েছে। এখন কি হবে? তারা তো মেরিডাও দখল করে নিবে।
আমীরে মুহতারাম! সকলে আমাকে একই জবাব দিয়েছে, তারা বলেছে, মেরিডার খ্রিস্টানদের মাঝে আত্মমর্যাদা যেমন আছে তেমনি সাহস ও বীরত্বও আছে। গির্জা ও উপাসনালয়ে যারা থাকে তাদের ঢিলা-ঢালা পোশাক আর লম্বা দাড়ি দেখে তাদেরকে নিরীহ মনে করো না। তারা প্রত্যেকেই যুদ্ধবাজ। তারা গির্জার পবিত্রতা রক্ষার জন্য জীবন উৎসর্গ করে দেবে। তবে জীবন দেওয়ার আগে যে মুসলমানই সামনে আসবে তাকে সে অবশ্যই খতম করবে। সাধারণ মানুষও প্রাণপণ লড়াই করবে। কেহই যুদ্ধ ছেড়ে পলায়ন করবে না। মুসলমানরা তখনই মেরিডায় প্রবেশ করতে পারবে যখন একজন খ্রিস্টানও জীবিত থাকবে না।
আমীরে মুহতারাম। শহরের কোন মানুষের মাঝে আমি ভয়-ভীতির ছাপও দেখতে পাইনি। তাদের বাহিনীকে অত্যন্ত চৌকস মনে হল। তারা শহর থেকে বের হয়েই যুদ্ধ করবে। শহরে ধন-সম্পদের প্রাচুর্য ভোলা চোখেই দেখা যায়। কিন্তু ভোগ-বিলাসের প্রতি মোটেই কারো ক্ষেপ নেই। প্রধান পাদ্রি জনসাধারণকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে।’
***
মেরিডার দিকে রওনা হওয়ার পূর্বে মুসা বিন নুসাইর নিজ বাহিনীকে লক্ষ্য করে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। ফলে সৈন্যদের মাঝে নতুনভাবে যুদ্ধের স্পৃহা ও উদ্দীপনা জেগে উঠে। মেরিডার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সময় মুসা বিন নুসাইরের তিন ছেলে তার সাথেই ছিল। তিনি তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন :
‘আমার প্রিয় সন্তানরা! আমার প্রতিটি কথা খুব মনযোগ দিয়ে শুন। আমার এই কথাকেই আমার অন্তিম ওসিয়ত মনে করবে। আমার বয়সের দিকে লক্ষ্য কর, আমার শরীর একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। আমার আধ্যাত্মিক শক্তিই আজ আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। সে শক্তির বলেই আমি যুদ্ধ করছি। তোমরা ভালো করেই জান, আমি কত যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছি। আমার জীবনের অর্ধেকের চেয়েও বেশি সময় কেটেছে যুদ্ধের ময়দানে। মনে করতে পার, আমার একার শারীরিক শক্তি তোমাদের তিনজনের শরীরে স্থানান্তরিত হয়েছে। এখন তো আমি যে কোন সময়ই মারা যেতে পারি। যুদ্ধের ময়দানে ঘোড়ার পিঠে আমার মৃত্যু হতে পারে। আবার বিছানায় শুয়ে শুয়েও আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি। একমাত্র তোমাদেরকেই আমার মৃত্যুর পর আমার সুনাম ও আমার আদর্শকে জিন্দা রাখতে হবে।
আমি তোমাদেরকে এক নতুন মুলুক জয় করে দিয়ে যাচ্ছি। এটাই আমার জীবনের শেষ যুদ্ধ। হতে পারে–এই যুদ্ধেই আমি মারা যাব। আমার এই উত্তরাধিকার তোমাদেরকেই ধরে রাখবে হবে…। আবদুল আযীয! তোমাকে আমি এখনই বলে দিচ্ছি, তুমিই হবে আন্দালুসিয়ার প্রথম আমীর। কাকে আমীর বানাব–সেই এখতিয়ার আমার আছে। তোমার ব্যাপারে আমি খলীফার কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে নিব।’
‘শ্রদ্ধেয় আব্বা হুজুর!’ মুসার পুত্র আবদুল্লাহ বললেন। “বিন যিয়াদ কি আন্দালুসিয়ার আমীর হওয়ার হকদার নয়? সেই তো আন্দালুসিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। আজ সে আন্দালুসিয়ার রাজধানী টলেডোর শাহীমহলে অবস্থান করছে। টলেডো হল আন্দালুসিয়ার রাজধানী, আন্দালুসিয়ার প্রাণ।
‘বৎস!’ মুসা বললেন। আমি যা জানি তোমরা তা জানি না। আমি যা চিন্তা করি তোমরা তা চিন্তা করো না। এখন আমার এই উপদেশ হৃদয়ঙ্গম করে নাও, রণাঙ্গনে থাক কিংবা শত্রুর বেষ্টনীর মাঝে থাক, কোন অবস্থাতেই পিষ্টপ্রদর্শন করবে না। দ্বিতীয় কথা হল, এই রাজ্যে এত বিপুল পরিমাণ ধন-দৌলত আছে–মনে হয় যেন, স্বর্ণ-রোপার নদী বয়ে যাচ্ছে। এখানের নারীদের রূপ-সৌন্দর্য এমনই চোখ ধাঁধানো, আর অশ্লীলতা এতটাই ব্যাপক যে, ইতিপূর্বে তোমরা কখনও তা দেখনি, কোথাও শুনি। তোমরা এখনও যুবক, আর যৌবনকাল অন্ধ হয়ে থাকে। যদি তোমাদের পদস্খলন ঘটে তাহলে তোমরা ঘরে-বাইরে সবখানে লাঞ্ছিত হবে। যেসকল শহীদ আন্দালুসিয়া বিজয়ের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের বিদেহী আত্মার অভিশাপ তোমাদের জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে।
এমনটি হবে না, আব্বা হুজুর!’ আবদুল আযীয বললেন। আমরা কিছুতেই এমনটি হতে দেব না।’
এখন সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হল, মেরিডার অবরোধ খুব একটা সহজ হবে না।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। মেরিডায় আমাদেরকে অনেক বেশি জান-মালের কুরবানী দিতে হবে।
‘আমরা জান-মাল কুরবানী দিতে প্রস্তুত আছি।’ মুসা বিন নুসাইরের তিন পুত্র এক সাথে দৃপ্তকণ্ঠে জবাব দিলেন।
***
মেরিডার এক বিশাল শাহীমহল। বাদশাহর প্রতিনিধি এই শাহীমহলেই অবস্থান করে। বাদশাহর প্রতিনিধি শাহীখান্দান থেকে হওয়ার রীতি ছিল। সেই সময় মেরিডার শাহীমহলে যে প্রতিনিধি অবস্থান করছিল, সে ছিল রডারিকের নিকট আত্মীয়। বাদশাহর প্রতিনিধি নিজেকে বাদশাহই মনে করত। কিন্তু রডারিকের মৃত্যুর পর তার প্রতিনিধি রাজেলিউর বাদশাহী ছিল নামে মাত্র। তার কারণ এই নয় যে, রডারিক মারা গেছে; বরং তার কারণ হল, রডারিকের এক স্ত্রী মেরিডা চলে এসেছে। সে এখানে রানীর মর্যাদা নিয়ে অবস্থান করছিল। তা ছাড়া মেরিডায় শাহীখান্দানের অনেক সদস্যই অবস্থান করছিল।
রডারিকের মত্যুর কারণে অনেক রমণীই আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল। তাদের মধ্যে একজন হল, এজেলুনা। এজেলুনার বয়স সাতাশ কি আঠাশ হবে। এজেলুনা যেহেতু শাহীখান্দানের সদস্য ছিল, তাই তখনও যেসব অঞ্চল মুসলমানদের করতলগত হয়নি, সেসব অঞ্চলে এজেলুনার প্রভাব বিদ্যমান ছিল। সেসব অঞ্চলের রাজ-প্রতিনিধি ও সেনাপ্রধান তার অনুগত ছিল।
রডারিক যখন গোয়াডিলেটের রণাঙ্গনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায় তখন এজেলুনা মেরিডা চলে এসেছিল। রডারিক তার শাহীমহলে এমন সব রমণীদের রেখেছিল, যারা একজন আরেকজনের চেয়ে রূপসী ছিল। কিন্তু এজেলুনা এত বেশি রূপসীছিল যে, তার মত এমন অতুলনীয় রূপসী নারী সচরাচর দেখা যায় না।
রডারিকের মৃত্যুর পর এজেলুনা তার অতুলনীয় রূপ-সৌন্দযের মাধ্যমে ইতিহাসের গতিকে তার দিকে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। প্রায় সকল ঐতিহাসিকই তার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
তারা লেখেন যে, এই নারীর রূপের মাঝে এক ধরনের বিশেষ মোহাচ্ছন্নতা ছিল। যেমন সুন্দর ছিল তার দেহ-সৌষ্ঠব, তেমনি আকর্ষণীয় ছিল তার বাচনভঙ্গি, আর চাল-চলন। সে মুহূর্তেই সকলের হৃদয়-মন জয় করে নিতে পারত। তার মুখের ভাষার চেয়ে চোখের ভাষা ছিল অধিক কার্যকরী। সবসময় তার ঠোঁটে এক চিলতে রহস্যময় মুচকি হাসি লেগে থাকত।
কোন কোন ঐতিহাসিকগণ লেখেছেন, তার মা ছিল ইহুদি। অনেকের মতে, তার মা ছিল খ্রিস্টান। সে যাইহোক, এজেলুনা ছিল শাহীমহলের একজন প্রভাবশালী নারী।
আসল রাজরানী ছিল অন্যজন। সে ছিল রাজমান্ডের মা। কিন্তু রডারিক এজেলুনাকে শাহীমহলে রানীর সম্মান দিয়ে রেখেছিল। এজেলুনা চোখের ইশারায় তার কথা মানিয়ে নিত। কারও এই সন্দেহ হত না যে, সে একজন ছলনাময়ী নারী।
রডারিকের মৃত্যুর খবর পেয়ে মেরিডার শাহী প্রতিনিধি রাজেলিউ টলেডোতে এসে এজেলুনার সাথে সাক্ষাৎ করল। পূর্ব থেকেই এই রমণীর সাথে রাজেলিউ বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল।
এজেলুনা! এখানে কেউ তোমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। রাজেলিউ বলল। রাজ-সিংহাসন দখলের জন্য এখানে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র চলছে। সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকার হল রাজমান্ড। কারণ, সে হল রানীর একমাত্র পুত্র। অন্যান্য নারীদের থেকেও রডারিকের পুত্র সন্তান আছে। কিন্তু তাদের কেউই রানী নয়। তোমার ভাগ্য ভাল যে, তোমার কোন সন্তান নেই। আমি শুনতে পেরেছি, তোমার ব্যাপারে রানীর মনে সন্দেহ আছে। তুমি জেনারেল ও প্রশাসকদের সাথে আতাত করে রানী হওয়ার চেষ্টা করছ। আমি তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি, তুমি এখান থেকে অন্যত্র চলে যাও।’
‘কোথায় যাব?’ এজেলুনা নিরাশার সুরে জানতে চাইল।
‘মেরিডা। রাজেলিউ বলল। আমার সাথে মেরিডা চল।’
‘সেখানে গিয়ে আমি কি করব?’ এজেলুনা জিজ্ঞেস করল। সেখানে আমার অবস্থানের ভিত্তি কি হবে?
‘সেখানে তুমি রানী হবে। রাজেলিউ উত্তর দিল। আমি তোমাকে সঙ্গ দেব। তুমি যদি অন্য কোন স্বপ্ন দেখে থাক, তাহলে তা মন থেকে মুছে ফেল। মুসলিম বাহিনী আন্দালুসিয়ার রাজত্ব তছনছ করে দিয়েছে। রডারিকের মৃত্যুর পর আমাদের সামরিক শক্তি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এখন মুসলিম বাহিনী টলেডুর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমাদের প্রশাসকগণ যে যেখানে আছে, সে সেখানের বাদশাহ হয়ে গেছে। আমরা উভয়ে শাহীখান্দানের সদস্য। মেরিডায় আমরা আমাদের নিজস্ব রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করব। তুমি হয়তো জান, মেরিডার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুবই মুজবুত। মেরিডার বাহিনী খুবই শক্তিশালী। মেরিডার বাহিনীর মাধ্যমে আমরা আমাদের রাজত্বের বিস্তার ঘটাতে পারব। তাছাড়া মেরিডা আমাদের ধর্মীয় কেন্দ্রও বটে। প্রধান পাদ্রিও মেরিডায় অবস্থান করছেন। তোমার মধ্যে এমন জাদু আছে যে, তার মাধ্যমে তুমি প্রধান প্রাদ্রিকে তোমার হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে পারবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তুমি গির্জাকে তোমার অনুগত করতে সক্ষম হবে। সব ধরনের চিন্তা বাদ দিয়ে আমার সাথে চল।
পর দিন সকালে এজেলুনা কয়েকটি ঘোড়াগাড়িতে তার প্রয়োজনীয় সামানপত্র উঠিয়ে নিল। কেউ তাকে কোন রকম বাধা দিল না। রডারিকের বৈধ-অবৈধ সকল স্ত্রীই এ কথা ভেবে মনে মনে খুশি হচ্ছিল যে, সিংহাসনের দাবিদার একজন কমল। কেউ জানতে চাইল না, সে কোথায় যাচ্ছে, সাথে করে কী নিয়ে যাচ্ছে?
এজেলুনা নিজের সাথে বিপুল পরিমাণ মণি-মুক্তা, আর সোনা-দানার অলংকার নিয়ে যাচ্ছিল। তার ব্যক্তিগত দাস-দাসী সকলেই তার সাথে ছিল।
রাজেলিউ তার সাথে ছিল না। সে পূবেই মেরিডর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গিয়েছিল। টলেডু থেকে কয়েক ক্রোশ অগ্রসর হয়ে সে এজেলুনার জন্য অপেক্ষা করছিল। তার রক্ষী বাহিনীও ছিল। এজেলুনার কাফেলা সেখানে পৌঁছার পর তারা এক সাথে মেরিডার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।
***
মেরিডা পৌঁছে রাজেলিউ এজেলুনাকে নিয়ে শাহীমহলে বসবাস করতে লাগল। কিন্তু তাদের কেউই কোন প্রশাসককে বলল না যে, তারা এখন কেন্দ্র থেকে মুক্ত ও স্বাধীন। কারণ, তারা এই আশঙ্কা করছিল যে, তারা যদি এ কথা প্রকাশ করে, তাহলে সেখানের সেনাপ্রধান ও প্রধান প্রশাসক তাদের আনুগত্য গ্রহণ নাও করতে পারে। তারা নিজেদের পুর্বের অবস্থানই প্রকাশ করছিল।
মেরিডায় দুইজন জেনারেল, আর তিনজন প্রশাসক ছিল। প্রধান পাদ্রি ছাড়া ছোট-বড় আরও কয়েকজন পাদ্রিও ছিল। এজেলুনা সেখানে পৌঁছেই নাচ-গান, আর খানাপিনার আসর জমিয়ে তুলল। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই প্রত্যেক জেনারেল, পাদ্রি, আর রাজেলিউ সকলেই এই আত্মতৃপ্তিতে ভোগতে লাগল যে, রডারিকের এই সুন্দরী বিধবা স্ত্রী এখন তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। এজেলুনা সকলকেই কার গুণগ্রাহী বানিয়ে নিল।
এজেলুনা। একদিন রাজেলিউ তাকে বলল। এখানের সকলকেই তোমার আশেক মনে হয়। সম্ভবত প্রত্যেক জেনারেল, আর প্রত্যেক পাদ্রি এই আশা করছে যে, তুমি তাদেরকে বিবাহ করবে।
‘এটা কি আমার সফলতা নয় যে, আমি আমার আশেক তৈরী করতে সক্ষম হয়েছি।’ এজেলুনা বলল। প্রত্যেককেই আমি এই স্বপ্ন দেখাচ্ছি যে, সেই আমার স্বামী হবে।’
‘আমিও স্বপ্ন দেখছি না তো?’ রাজেলিউ বলল।
‘তুমি কেন স্বপ্ন দেখবে?’ এজেলুনা হৃদয় কাড়া মুসকি হাসি হেসে জবাব দিল। তোমার কি মনে হয়, আমি এই বৃদ্ধ জেনারেলদের কারও স্ত্রী হব? অন্য যারা আমার রূপে মোহমুগ্ধ হয়ে আছে, তাদের কেউ কি আমার যোগ্য? আমি তাদের সকলের মনে আমার রূপের নেশা লাগিয়ে দিয়েছি। তারা সকলেই মেরিডাকে মুসলমানদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়েছে। তুমি কেন অযথা পেরেশান হচ্ছ? আমি তোমাকে মেরিডার বাদশাহ বানাব। আর আমি হব তোমার রানী।’
‘তাহলে কি আমি এ কথা বিশ্বাস করতে পারি যে, তুমি শুধু আমার? রাজেলিউ আবেগতাড়িত কণ্ঠে জানতে চাইল।
‘তুমি ছাড়া আমি আর কার হতে পারি?’ এজেলুনা বলল। ‘শুন, আমি তোমাকে আমার মনের কথা বলছি, আমি রানী হতে চাই। এটাই আমার একমাত্র চাওয়া। তুমি কি আমাকে রানী বানাতে পারবে?
কী অদ্ভুত প্রশ্ন করছ তুমি?’ রাজেলিউ বলল। ‘তুমি ছাড়া আর কে রানী হবে?
‘তুমি কি জানতে পেরেছ যে, গ্রানাডা আর কডোবা মুসলিম বাহিনীর দখলে চলে গেছে।’ এজেলুনা বলল। তুমি কি জান, মুসলমানদের আরেকটি ফৌজ আন্দালুসিয়া প্রবেশ করেছে?
‘শুনেছি। ‘রাজেলিউ উত্তর দিল। আমার কাছে এ সংবাদ এসেছে যে, এই নতুন ফৌজের গন্তব্য হল মেরিডা’।
‘তুমি কি এই বাহিনীর হাত থেকে মেরিডাকে রক্ষা করতে পারবে? এজেলুনা জিজ্ঞেস করল।
‘অবশ্যই এজেলুনা! মুসলিম বাহিনী এখানে মরার জন্য আসছে। রাজেলিউ বলল।
‘এমন কথা আমি টলেডোতেও শুনেছিলাম।’ এজেলুনা বলল। কিন্তু আমি জানতে পেরেছি, মুসলমানদের প্রথম বাহিনী যখন টলেডো অবরোধ করে, তখন শহরের অধিবাসীরা ফটক খুলে দিয়ে মুসলিম বাহিনীকে স্বাগতম জানিয়ে ছিল। তুমি কি এমন বীরত্ব দেখাতে পারবে যে, নিজের নেতৃত্বে বাহিনীর একটি অংশ নিয়ে শহরের বাহিরে গিয়ে মুসলমানদের উপর এমন আক্রমণ করবে যে, তারা হয়তো পালিয়ে যাবে অথবা ধ্বংস হয়ে যাবে?
‘তুমি দেখে নিয়ে, আমি কী করতে পারি।’ রাজেলিউ বলল।
‘তুমিও দেখে নিও, আমি কীভাবে আমার দেহ-মন তোমার কাছে সমর্পণ করে তোমার রানী হয়ে যাই। এজেলুনা বলল।
এজেলুনা মেরিডার সকল জেনারেল, পাদ্রি আর প্রশাসকের সাথে এই একই কথা বলে বেড়াত। সে সকলের কাছে রাতের মেহমান হয়ে আগমন করতএবং নিজ হাতে তাদেরকে শরাব পান করাত। এজেলনার রূপের ঝলক আর শরাবের ঝাঁঝে সকলেই বেহুশ হয়ে পড়ত। ভোরের আলো ফুটার আগেই এজেলুনা মরীচিৎকার প্রহেলিকা হয়ে তার কামরায় ফিরে আসত।
***
‘হানাদার বাহিনী আসছে।
প্রস্তুত হয়ে যাও।
‘সতর্ক হয়ে যাও।
শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মুহূর্তে এমন সতর্ক সংকেত ছড়িয়ে পড়ল। শহরের সবত্র সাজ সাজ রব পড়ে গেল। মানুষের মাঝে হুড়াহুড়ি রু হয়ে গেল। কিন্তু এই হুড়াহুড়ির মাঝে ভয়-ভীতির কোন চিহ্ন ছিল না; বরং তাদের মাঝে এক ধরনের উত্তেজনা পরিলক্ষিত হচ্ছিল। লোকজন পলায়ন করার জন্য এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছিল না; বরং লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল এবং সকলেই নিজেকে সমরাস্ত্রে সজ্জিত করছিল।
বহুদিন ধরেই তীর-বর্শী তৈরী করা হচ্ছিল। হাতে নিক্ষেপ করা যায়–এমন বর্শা বানানো হচ্ছিল। কিশোর-কিশোরী ও মধ্য বয়সী নারীরাও তীরন্দাজীর প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। সক্ষম সকল যুক, আর বৃদ্ধ পুরুষরা কয়েক মাস যাবত সৈন্যবাহিনীর সাথে মিলে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছিল। এজেলুনার আগমনের পর গোটা শহরে যুদ্ধের স্পৃহা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। এজেলুনা স্বয়ং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো পরিদর্শনে যেত এবং শহরের অধিবাসীদেরকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করত।
এজেলুনা মুসলিম বাহিনীর আগমনের সংবাদ পাওয়ামাত্র উন্মুক্ত তলোয়ার নিয়ে রাজেলিউর ঘোড়ায় চড়ে শহরের অলিগলিতে ছুটে বেড়াতে লাগল, আর চিৎকার করে বলতে লাগল :
‘মেরিডার অধিবাসীগণ, তোমাদের মাঝে দেশপ্রেমের পরীক্ষা দেওয়ার সময় এসেছে। মা মরিয়মের সতীত্ব তোমাদেরকে আহ্বান করছে।’
যেখানেই লোকজন জড়ো হত সেখানেই এজেলুনা থেমে গিয়ে সুউচ্চ আওয়াজে জ্বালাময়ী ভাষণের মাধ্যেমে লোকদেরকে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করত। সে তার ভাষণে বলত :
‘যারা হাতিয়ার সমর্পণ করে মুসলমানদের হাতে নিজেদের শহর তুলে দিয়ে গোলাম হয়ে গেছে তারা কাপুরুষ, তারা আত্নমর্যাদাহীন। তারা তাদের মেয়েদেরকেও মুসলিম বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে। তোমরাও কি তোমাদের মেয়েদেরকে হিংস্র বার্বারদের হাতে ছেড়ে দেবে?
সমবেত জনতা এক সাথে উত্তর দিল, না…, না…, না…। আমরা জান দেব, তবু মান দেব না।
‘ভুলে যেয়ো না, এটা গ্রানাডা বা কর্ডোভা নয়, এটা হল মেরিডা। এটা প্রধান ধর্মগুরুর শহর। আজ গীজার ইজ্জত তোমাদের হাতে। ক্রুসের ইজ্জত-আবরু তোমাদের কাছে। সে ঝুলানো ঈসা মসীহের পবিত্র আত্মা দেখছে, তোমরা কি খ্রিস্টবাদ রক্ষার্থে জীবন বিলেয়ে দাও, নাকি নিজের জীবনকে বেশি মহব্বত কর। তোমরা যদি এখানে মুসলমানদেরকে পরাজিত করতে পার তাহলে যেসব শহর মুসলিম বাহিনী কজা করেছে, সেগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য তোমরা অগ্রসর হতে পারবে। আন্দালুসিয়া হতে মুসলিম বাহিনীকে বিতাড়িত করার সৌভাগ্য তোমাদের হবে। আর তোমরা যদি হীনমন্য হয়ে বসে থাক তাহলে তোমাদের গিজা মসজিদে পরিণত হবে। তোমাদের গিজার এমন বেহুরমতি হোক–এটা কি তোমরা কামনা কর?
‘না…, না…, না…।’ সকলেই এক সাথে উত্তর দিল।
এজেলুনা এখানে বক্তৃতা শেষ করে সেনাছাউনিতে গিয়ে উপস্থিত হল। সেনা ছাউনিতেও সে এমনি এক জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদান করল। এজেলুনার জ্বালাময়ী ভাষণ, অপরূপ সৌন্দর্য, আর মুগ্ধ করার মত ব্যক্তিত্ব মানুষের মাঝে এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করল যে, মনে হচ্ছিল–গোটা জনপদ আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভায় পরিণত হয়েছে। কোন সাধারণ নারীও যদি পুরুষ মানুষের পৌরুষ উদ্দিপ্ত করার জন্য জ্বালাময়ী আহ্বান জানায় তাহলে কোন পুরুষ মানুষের পক্ষেই আত্মসংবরণ করে রাখা সম্ভবপর হয়ে উঠে না। এজেলুনার মত বাকচতুর আর ছলনাময়ী নারীর জ্বালাময়ী ভাষণে সামর্থবান প্রতিটি পুরুষ যুদ্ধ করার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠল।
***
মুসা বিন নুসাইরের প্রত্যাশা এটাই ছিল যে, তিনি সহজেই মেরিডা অবরোধ করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু গোয়েন্দা সূত্রে তিনি অবগত হন যে, মেরিডার সৈন্যবাহিনী শহরের বাহিরে এসে যুদ্ধ করবে। তারা শহরের বাহিরে এমন শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেবে যে, শহরের প্রধান ফটকের কাছে যাওয়াই সম্ভব হবে না। মুসা বিন নুসাইর দূর থেকে দেখতে পেলেন, শহর রক্ষাপ্রাচীর থেকে অনেক সামনে মেরীডার সৈন্যবাহিনী ব্যরিকেট সৃষ্টি করে পাহাড়ের ন্যায় অবিচল দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছিল, তারা নিজেদের শহরকেই অবরোধ করে আছে।
মুসা বিন নুসাইর তার বাহিনীকে খানিকটা দূরে অবস্থান করালেন। মুসলিম বাহিনী অনেক দূরের পথ অতিক্রম করে এসেছিল। ঘোড়াগুলো অনেক ক্লান্ত হয়ে পরেছিল। পদাতিক বাহিনীর সৈন্যরা সবচেয়ে বেশি ক্লান্ত ছিল। মুসা বিন নুসাইর মুসলিম বাহিনীকে বিশ্রাম করার নির্দেশ দিয়ে তাঁর তিন সন্তান ও দুই-একজন জেনারেলকে সাথে নিয়ে শহরের চারপাশ পর্যবেক্ষণ করার জন্য বের হলেন। তিনি শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন, আর মনে মনে আক্রমণের প্রান তৈরী করছিলেন।
শহরের পিছন দিকটা তীক্ষ্ম ফলাবিশিষ্ট ছোট-বড় পাথরে ভরা। সেই সব পাথরের ফাঁকে ফাঁকে বড় বড় গাছপালা ছেয়ে আছে। চার দিকে সবুজের সমারোহ। কোন কোন গাছের ডালপালা দূর্গের প্রাচীরের সমান উঁচু। প্রাচীরের উপরেও গাছপালা আছে। সেসব গাছগাছালীর ফাঁকে ফাঁকে প্রাকৃতিকভাবে আঁকা বাঁকা পাহাড়ী পথ তৈরী হয়েছিল। সেই পথ দূৰ্গ-প্রাচীরের দিকে চলে গেছে। পিছন দিক থেকে এই পথ ধরে ভিতরে যাওয়া অনেকটা অসম্ভব মনে হচ্ছিল।
‘আমরা এই গাছগাছালী আর টিলার আড়াল নিয়েই দূর্গ প্রাচীরের ভিতরে পৌঁছতে পারব।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। তা ছাড়া এদিকটায় কোন সৈন্যও দেখা যাচ্ছে না।’
মুসা বিন নুসাইর ঘোড় নিয়ে টিলার দিকে অগ্রসর হলেন। তিনি গাছের আড়াল নিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এমন সময় একটা তীর এসে গাছের গোড়ায় সমূলে বিদ্ধ হল। মুসা বিন নূসাইর সাথে সাথে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলেন। সাথে সাথে আরেকটি তীর এসে ঘোড়র ঠিক দু-এক কদম সামনে মাটিতে বিদ্ধ হল। মুসা বিন নুসাইর দ্রুত ঘোড়া ঘুরিয়ে সেখান থেকে চলে এলেন। তীর দুটি হয়তো অনেক দূর থেকে এসেছিল। তাই মুসা বিন নুসাইর বা তার ঘোড়র শরীরে বিদ্ধ হয়নি। মাটিতে বিদ্ধ হয়েছে। হতে পারে তীরন্দাজ বাহিনী মুসা বিন নুসাইরকে সতর্ক করে দিতে চাচ্ছিল, তিনি যেন আর এক কদম সামনে অগ্রসর হওয়ার দুঃসাহস না করেন।
এই পাহাড়ী এলাকায় সৈন্যবাহিনীর সদস্যরা আত্মগোপন করে ছিল। শহরের সম্মুখ দিকে যে সকল সৈন্যবাহিনী আছে, এ সকল সৈন্যবাহিনী তার চেয়েও ভয়ঙ্কর। টিলা আর ছোট-বড় পাথরে রা এবড়ো-থেবড়ো মাটিতে পায়ে চলাই অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এমন এলাকায় ঘোড়া নিয়ে দ্রুতগতিতে সামনে অগ্রসর হওয়া একেবারেই অসম্ভব।
‘আমার প্রিয় সাথীরা। মুসা বিন নুসাইর তার সাথীদের লক্ষ্য করে বললেন। আমাদের জন্য অনেক বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলার রহমতের ব্যাপারে আমাদের নিরাশ হওয়া চলবে না।’
নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিকগণের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ তাআলা তার অপার কুদরতের মাধ্যমে মেরিডা শহরের জন্য নিচ্ছিদ্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করে। দিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও মেরিডার সৈন্যবাহিনী আর শহরের অধিবাসীরা যে আবেগ আর উচ্ছ্বাস নিয়ে শহরের প্রতিরক্ষার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করে তুলছিল, তা দেখলে বাহ্যত এটাই মনে হবে যে, মেরিডা এক অপরাজেয় দূর্গ। শহরের ভিতরে, শহর রক্ষা প্রাচীরের উপরে, আর দূর্গের বাইরে প্রধান পাদ্রির নেতৃত্রে সকল পাদ্রিরা কুশ হাতে নিয়ে মিছিল করে বেড়াচ্ছিল। অপর দিকে এজেলুনা ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়ে নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছিল। সে মাঝে মাঝে বের হয়ে সেনাছাউনিগুলো ঘুরে আসত। তাকে দেখে লোকজন জড়ো হলেই সে তার জ্বালাময়ী ভাষণ, আর অনলবর্ষী বক্তৃতার মাধ্যমে লোকদেরকে উত্তেজিত করে তুলত।
***
মুসা বিন নুসাইর তাঁর দুই সালার ও ছেলেদেরকে সাথে নিয়ে শহরের পিছনে অবস্থান করছিলেন। তারা ঘুরে ঘুরে শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এমন সময় তারা দূর থেকে চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পেলেন। মুসা এবং তাঁর সাথীবৃন্দ এই আওয়াজ সম্পকে অবগত ছিলেন। তারা বুঝতে পারলেন যে, এটা রণাঙ্গনের চিৎকার-চেঁচামেচি। শত শত ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনি আর পদাঘাতে গোটা এলাকা থরথর করে কাঁপছিল।
মুসা বিন নুসাইর দ্রুতবেগে ঘোড়া হাঁকিয়ে রণাঙ্গনের দিকে রওনা হয়ে গেলেন। তাঁর সন্তান ও সালারগণ তাঁকে অনুসরণ করল। তারা যখন শহরকে এক পাশে রেখে রণাঙ্গনের দিকে অগ্রসর হলেন তখন তারা এমন এক দৃশ্য দেখতে পেলেন যে, নিজেরাই নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তারা দেখতে পেলেন, মেরিডার যে বাহিনী শহরের বাহিরে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা মুসলিম বাহিনীর উপর আক্রমণ করে বসেছে। মুসলিম বাহিনী এমন অতর্কিত হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। মুসলিম অশ্বারোহীগণ ঘোড়ার জিন খুলে ঘোড়াগুলোকে পানি পান করানোর জন্য এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। পদাতিক বাহিনীর সৈন্যরা শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। আর ময়দানের এক পাশে সকলের জন্য খানা তৈরি করা হচ্ছিল।
খ্রিস্টান বাহিনীকে তেড়ে আসতে দেখে মুসলিম বাহিনীর যে যেই অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় হাতিয়ার উঠিয়ে মুকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। অশ্বারোহী সিপাহীরা ঘোড়ার পিঠে জিন বাঁধার কোন সুযোগ পেল না। তারা পদাতিক বাহিনীর মতো ঢাল-তলোয়ার আর তীর-বর্শী হাতে নিয়ে লড়াই শুরু করে দিল। যেসব ঘোড়া বাঁধা ছিল সেগুলোকে বাচাঁনোই ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা।
মুসলিম তীরন্দাজ বাহিনী তীর-ধনুক নিয়ে ক্ষীপ্রগতিতে সামনের দিকে চলে এলো। আক্রমণকারীরা সামনে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথেই তীরন্দাজ বাহিনী তাদের উপর বৃষ্টির মত তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। খ্রিস্টান বাহিনীর অগ্রভাগে ছিল অশ্বারোহী সৈন্যদল। প্রথমে এই অশ্বারোহী দলই তীরের লক্ষ্যে পরিণত হল। তীর লাগার সাথে সাথেই তারা ঘোড়ার উপর লুটিয়ে পড়ল। যারা নিচে পড়ে যেত, ক্ষীপ্রগতির ঘোড়ার পদতলে পিষ্ঠ হয়ে সেখানেই তাদের জীবন লীলা সাঙ্গ হত। কিন্তু তা সত্ত্বেও অশ্বারোহী বাহিনীর গতি রোধ করা সম্ভব হল না।
অশ্বারোহী বাহিনী এতটাই কাছে চলে এলো যে, মুসলিম তীরন্দাজ বাহিনীর পক্ষে মোকাবেলা করাও অসম্ভব হয়ে পড়ল। তারা জীবন বাঁচানোর জন্য ডানে বায়ে ছড়িয়ে পড়ল। এবার পদাতিক বাহিনী খ্রিস্টান অশ্বারোহী বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য সামনে অগ্রসর হল। তারা তলোয়ারের আঘাতে বেশ কয়েকজন অশ্বারোহীকে ধরাশায়ী করল। কিন্তু তারাও বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। বেশ কয়েকজন পদাতিক সিপাহী ঘোড়ার পদাঘাতে, আর অশ্বারোহীদের বর্ষার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হল। মুসলিম বাহিনী তাদের সিপাহসালারের অনুপস্থিতিতে লড়াই করছিল। তাছাড়া এমন পরিস্থিতিতে সিপাহসালার উপস্থিত থাকলেও তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব হত না। এমন অবস্থায় জীবন বাঁচানো ছাড়া আর কোন রণ-কৌশল প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। মুসলিম বাহিনী একদিকে নিজেদের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছিল, অন্য দিকে খ্রিস্টান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলছিল।
মেরিডার এই বাহিনী ময়দানে অবস্থান গ্রহণ করে যুদ্ধ করার জন্য আসেনি। মুসলিম বাহিনী যতক্ষণ তাদেরকে ময়দানে আটকে রেখেছিল, ততক্ষণই তারা ময়দানে আটকে ছিল। তারা তুফানের গতিতে এসে ডানদিক থেকে আক্রমণ করে বাম দিক দিয়ে বের হয়ে গেল। তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন সিপাহী মুসলিম বাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে পিছন দিকে চলে গেল। সেখান থেকে বহু দূরের পথ পাড়ি দিয়ে তাদের দূর্গের সামনে গিয়ে পৌঁছল। এই সিপাহীদের কয়েকজন জখম হয়ে মুসলিম বাহিনীর হাতে পাকড়াও হল।
মুসা বিন নুসাইর যখন রণাঙ্গনে পৌঁছলেন ততক্ষণে লড়াই শেষ হয়ে গেছে। প্রচণ্ড তুফানের পর কোন জনবসতির অবস্থা যেমন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, মুসলিম বাহিনীর অবস্থাও হয়েছিল ঠিক তেমনি। খ্রিস্টান ও মুসলিম বাহিনীর আহত সৈন্যরা ছটফট করছিল। বেশ কয়েকজন সিপাহী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।
মেরিডার বাহিনী অতর্কিত আক্রমণ করে পুনরায় তাদের দুর্গের সামনে গিয়ে অবস্থান গ্রহণ করল। তারা মুসলিম বাহিনীকে লক্ষ্য করে দুয়োধ্বনি দিতে লাগল।
‘এটা গ্রানাডা বা কর্ডোভা নয়। একজন খ্রিস্টান অশ্বারোহী মুসলিম বাহিনীর একেবারে কাছে এসে বলল। এটা মেরিডা, তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাও।
একথা বলে অশ্বারোহী ঘোড়া ছুটিয়ে দ্রুত গতিতে দুর্গের দিকে চলে গেল। দুর্গ-প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেসব নারী-পুরুষ আর শিশুরা এই দৃশ্য দেখছিল, তারা চিৎকার করে তাদের বাহিনীকে বাহবা দিচ্ছিল।
***
প্রথম দিন খ্রিস্টান বাহিনী এভাবেই আক্রমণ পরিচালনা করল। খ্রিস্টান বাহিনীর পক্ষ থেকে এটা ছিল একটি সতর্ক বার্তা। মুসা বিন নুসাইর বিষয়টি ভাল করেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি সতর্ক হয়ে গেলেন। খ্রিস্টান বাহিনী তাদের আক্রমণের ধারা অব্যাহত রাখল।
মুসা বিন নুসাইর তার বাহিনীকে চার ভাগে বিভক্ত করে শহরের চারদিকে পাঠিয়ে দিলেন। মুসলিম বাহিনীর মতো খ্রিস্টান বাহিনীও চার ভাগে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ অব্যাহত রাখল। মুসলিম বাহিনীর কোন অংশ সামনে অগ্রসর হলে খ্রিস্টান বাহিনী ঝড়ের গতিতে সামনে এসে মুসলিম বাহিনীকে পিছু হটিয়ে দিত কিংবা মুসলিম বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে তারা নিজেদের জায়গায় ফিরে যেত। মুসলিম বাহিনী শহরের নিকট পৌঁছার জন্য কোন সুবিধা করতে পারছিল না। এভাবে প্রতিদিনই উভয় বাহিনীর মাঝে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হচ্ছিল। মুসলিম বাহিনী কিছুতেই শহর অবরোধ করতে পারছিল না।
প্রফেসর ডোজি এবং ডা. কোডে লেখেছেন, খ্রিস্টান বাহিনী মেরিডার জন্য জীবনবাজি রেখে লড়াই করছিল। পাদ্রিরাও গিজা ছেড়ে বের হয়ে এসে লড়াই করছিল। পুরুষের সাথে কাঁধ মিলিয়ে নারীরাও ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরীব, উঁচু-নীচু, গোলাম-মনিব সকলেই নিজেদের ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছিল।
সাত-আট মাস পর্যন্ত শহরের বাহিরে এভাবে লড়াই চলতে লাগল। উভয় পক্ষেরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হল। মুসা বিন নুসাইর সামনে অগ্রসর হওয়া বন্ধ করে দিলেন এবং তাঁর জেনারেলদের সাথে সলা-পরামর্শ করতে লাগলেন।
‘আমি এটা মানতে পারছি না, শহরে এত বিপুল পরিমাণ খাদ্যসামগী মওজুদ আছে যে, এত দীর্ঘ দিনেও তা নিঃশেষ হচ্ছে না। মুসা বিন নুসাইর জেনারেলদেরকে লক্ষ্য করে বললেন। “নিশ্চই কোন রাস্তা দিয়ে বাহির থেকে খাদ্যসামগ্ৰী শহরে প্রবেশ করছে। যদি আমরা জানতে পারতাম, কোন রাস্তা দিয়ে শহরে খাদ্যসামগ্রী প্রবেশ করছে, তাহলে সেই রাস্তা বন্ধ করে দিতাম এবং লড়াই করার পরিবর্তে শহর অবরোধ করে বসে থাকতাম।
‘আমরা শহরের চারদিকে ঘুরে দেখেছি, এমন কোন রাস্তা আমরা পাইনি, যেখান দিয়ে বাহির থেকে রসদ-পত্র আসতে পারে। আবদুল আযীয বিন মুসা বললেন।
‘রাস্তা আছে। অবশ্যই কোন রাস্তা আছে।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। আমরা প্রথম দিন শহরের পিছনে একটি পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে ছিলাম। আমি সামনে অগ্রসর হতেই দুটি তীর এসে আমার সামনে পড়েছিল।
‘সেদিনের ঘটনা আমাদের মনে আছে। সকলেই এক সাথে বলে উঠল।
‘আমার মনে হয়, সেটাই খাদ্যসামগ্রী আসার রাস্তা। মুসা বিন নুসাইর বললেন। ‘আজ রাতে কয়েক জন সেদিকে গিয়ে দেখবে, সে পথ দিয়ে শহরে রসদপত্র প্রবেশ করে কিনা? যুদ্ধ বন্ধ করে দেওয়াই আমি উত্তম মনে করছি। তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ না যে, আমাদের সামরিক শক্তি দিন দিন নিঃশেষ হয়ে আসছে? আমাদের শত্রুদের চাল হল, আমরা যেন এমনিভাবে শক্তিহীন হয়ে পড়ি। অবশেষে আমরা যখন শক্তিহীন হয়ে পড়ব তখন শহরের সৈন্যবাহিনী দুর্গ থেকে বের হয়ে এসে আমাদের উপর আক্রমণ করে আমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।
‘আজ রাতে আমি সেদিকে নজর রাখব।’ মুসা বিন নুসাইরের ছেলে আবদুল্লাহ বলে উঠলেন।
‘তোমার সাথে আরও চারজন মুজাহিদ নিয়ে যেয়ো।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। তোমরা পায়ে হেঁটে সেখানে যাবে। ঘোড়ায় চড়ে গেলে দুশমন তোমাদের আগমন সম্পর্কে টের পেয়ে যেতে পারে। সাথে করে একজন দোভাষী নিয়ে যেতে ভুলো না।
***
সেই রাতে আবদুল্লাহ বিন মুসা বহু দূরের পথ ঘুরে শহরের পিছন দিকে সেই স্থানে গিয়ে পৌঁছল, যে স্থানটি ছোট-বড় পাথর, আর পাহাড়ী টিলায় ঘেরা ছিল। সেখান কার মাটি অনুর্বর, আর খানাখন্দে ভরপুর। পুরো এলাকাটাই যুদ্ধ করার জন্য অনুপযুক্ত। এই এলাকার পিছন দিক দিয়ে দাদিয়ানা নদী বয়ে গেছে। নদীর দুই কূল টিলার মত উঁচু।
আবদুল্লাহ খুব সতর্কতার সাথে ধীরে ধীরে পা ফেলে নদীর কুল ধরে সামনে অগ্রসর হতে লাগলেন। গোটা এলাকা ঘন গাছ-গাছালীতে ভরা। কোথাও কোথাও আছে জলাভূমি। আবদুল্লাহ ও তার সাখীরা কয়েকবারই সেই জলাভূমিতে ফেসে গেলেন। প্রতিবারই তারা একজন আরেকজনের সাহায্যে সেই জলাভূমি থেকে নিরাপদে বের হয়ে আসতে সক্ষম হলেন।
চাঁদনী রাত। চারদিকে সুনসান নিরবতা। বহুদূর থেকে নদীর ঢেউয়ের ছলছল আওয়াজ ভেসে আসছে। নদীর পাড় ধরে সামনে অগ্রসর হতেই মানুষের আওয়াজ শুনা গেল। ধীরে ধীরে আওয়াজটা সামনের দিকে এগিয়ে আসল। আবদুল্লাহ ও তাঁর সাথীরা নদীর তীরের উঁচু ঘাসের মাঝে লুকিয়ে পড়লেন।
দুই-তিনজন ব্যক্তি নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছিল। কিছুক্ষণ পর তারা এতটাই কাছে চলে এলো যে, আবদুল্লাহ ও তার সাথীরা তাদের পদধ্বনি শুনতে পেলেন। আবদুল্লাহদের সাথে একজন আন্দালুসিয় ছিল। সে মাতৃভাষার মতই আরবি বলতে পারত। মুসলিম বাহিনী সবসময় তাদের সাথে একজন দোভাষী রাখত। এই দোভাষীদেরকে যথেষ্ট পারিশ্রমিক প্রদান করা হত। এসকল দোভাষী আন্দালুসিয় ও মুসলিম বাহিনীর মাঝে আলোচনার ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা পালন করত।
আগন্তুক ব্যক্তিরা কথা বলতে বলতে আবদুল্লাহদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারা স্থানীয় ভাষায় নিজেদের মাঝে কি বিষয়ে যেন কথা বলছিল। আবদুল্লাহ দোভাষীর কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, তারা কি বলছে?
‘তারা কিস্তির ব্যাপারে কথা বলছে।’ দোভাষী আরবী ভাষায় ফিস ফিস করে বলল। তাদের একজন বলছে, আজও কিস্তি এলো না। আর অন্যজন গালি দিয়ে বলছে, আজ যদি কিস্তি না আসে তাহলে সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে।’
অগম্ভক দুজন কথা বলছিল। দোভাষী আবদুল্লাহকে বলল, রহস্য উদঘাটিত হয়েছে। কিস্তির মাধ্যমেই রসদপত্র পৌঁছে। আর সেই রসদপত্র এই বিপদসংকুল পথ ধরেই শহরে প্রবেশ করে।’
‘তুমি মাথা নিচু করে হামাগুড়ি দিয়ে পিছনের দিকে চলে যাও।’ আবদুল্লাহ বললেন। আমাদের সাথীদের কাছে গিয়ে বল, তারা যেন হামাগুড়ি দিয়ে এখানে চলে আসে।’
আবদুল্লাহর সাথীরা কয়েক কদম পিছনে মাটির উপর শুয়েছিল। সংবাদ পৌঁছা মাত্র হামাগুড়ি দিয়ে তারা আবদুল্লাহর কাছে চলে এলো।
‘আন্দালুসিয়ার এই দুই সৈনিককে পাকড়াও করতে হবে।’ আবদুল্লাহ তার সাথীদেরকে লক্ষ্য করে বললেন। তারপর আবদুল্লাহ দোভাষীর দিকে ফিরে বললেন, ‘তুমি দাঁড়িয়ে এমনভাবে চলতে চলতে তাদের কাছে পৌঁছে যাও, যেন তুমি অনেক দূর থেকে আসছ। তারা তোমার দিকে লক্ষ্য করলে, তুমি আশ-পাশের কোন গ্রামের নাম বলে সেখানে যাওয়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করবে। তারপর যুদ্ধের কথা বলতে বলতে তাদেরকে এদিকে নিয়ে আসবে।’
আন্দালুসিয়ার দোভাষী লোকটি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিল। আন্দালুসিয়ার সৈনিক দু’জনের মুখ অন্য দিকে ফিরানো ছিল। দোভাষী ধীরে ধীরে উঠে তাদের দিকে চলতে শুরু করল। দোভাষীর পায়ের আওয়াজ শুনে সৈনিক দু’জন তার দিকে ফিরে তাকাল। তারা একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করল, এ-লোক আবার কে? দোভাষী পা হেঁচড়ে দুই-তিন কদম অগ্রসর হয়ে বসে পড়ল। ভাবটা এমন যেন অনেক দূর থেকে আসার কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
‘ভাই আমি অনেক দূর থেকে এসেছি।’ দোভাষী স্থানীয় ভাষায় বলল। একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ভাই, এখানে এসো, আমাকে রাস্তা দেখিয়ে দাও।
আন্দালুসিয়ার সৈনিক দু’জন দোভাষীর কাছে এলো। দোভাষী দাঁড়িয়ে তাদের সাথে আলাপ করতে করতে এমন এক স্থানে গিয়ে দাঁড়ালো যে, তাদের পিঠ থাকল আবদুল্লাহর দিকে। সৈনিকদের থেকে মাত্র দুই গজ দূরে আবদুল্লাহ তার বাহিনীকে নিয়ে উৎপেতে ছিলেন। সৈনিক দু’জন কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই আবদুল্লাহ তাঁর চার সঙ্গীকে নিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং মুহূর্তেই তাদের হাতিয়ার ছিনিয়ে নিলেন। অতঃপর তাদেরকে সাথে নিয়ে নদীর তীর ধরে ক্যাম্পে চলে এলেন।
মুসা বিন নুসাইর ঘুমিয়ে ছিলেন। আবদুল্লাহ তাকে জাগ্রত করে বিস্তারিত বিবরণ দিলেন। এতোমধ্যে অন্যান্য জেনারেলগণও সেখানে এসে একত্রিত হলেন। আন্দালসিয়ার সৈনিক দু’জনকে মাঝখানে বসানো হল। তারা ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল।
‘ভয় পেয়ো না।’ মুসা বিন নুসাইর দোভাষীর মাধ্যমে তাদেরকে বললেন। তোমাদেরকে হত্যা করা হবে না। মেরিডা বিজয়ে যদি তোমরা আমাদেরকে সাহায্য কর তাহলে তোমাদেরকে মুক্ত করে দেওয়া হবে। তোমরা কেবল এতটুকু বল যে, শহরে রসদপত্র কোন পথে আসে এবং শহরের ভিতর খাদ্যসামগ্রীর মওজুদ কি পরিমাণ আছে?
‘রসদবাহী কিস্তি দেখার জন্যই আমরা নদীর তীরে গিয়েছিলাম।’ একজন আন্দালুসিয়ার সৈনিক বলল। আমরা দুজনই সেনাবাহিনীর অফিসার। দশ-বার দিন পরপর খাদ্যসামগ্রী ও অন্যান্য আসবাবপত্র নৌপথে আনা হয়। আমরা সেখান থেকে ঘোড়াগাড়ির মাধ্যমে সেসব সামানপত্র শহরে নিয়ে যাই। তারপর সেসব সামানপত্র শহরের অধিবাসী ও সৈন্যদের মাঝে বণ্টন করা হয়। দুই দিন পূর্বেই কিস্তি আসার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত আসেনি। জানা নাই, কোন অসুবিধা হয়েছে কি না?
‘শহরে কি রসদপত্র বিপুল পরিমাণে মওজুদ আছে? মুসা জিজ্ঞেস করলেন।
‘খুব সামান্য রয়েছে। একজন সৈনিক বলল। আজ রাতে যদি কিস্তি না আসে তাহলে শহরে ও সৈন্যদের মাঝে খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেবে।’
‘শরাবের মওজুদ একেবারেই নিঃশেষ হয়ে এসেছে। অন্য সৈনিক বলল। ‘শহরে শরাব তৈরি করার কোন ব্যবস্থা নেই। শহরের বাহির থেকে শরাবের যোগান দেওয়া হয়। যখন থেকে যুদ্ধ শুরু হয়েছে তখন থেকে লোকজন খুব বেশি শরাব পান করছে। শহরের প্রশাসক ও পাদ্রিগণ লোকদেরকে বেশি বেশি শরাব পান করতে বলেছেন। কারণ, শরাব পান করলে মনের মধ্যে ভীতি সঞ্চারিত হয় না; বরং সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রদর্শন করা সহজ হয়। আপনি নিশ্চয় দেখেছেন যে, আমাদের শহরের অধিবাসীগণ কী বিপুল পরিমাণ উৎসাহের সাথে আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করছে।
‘আপনি নিশ্চয় আমাদের বাহিনীকে লড়াই করতে দেখেছেন। প্রথমজন বলল। আমাদের কথার অর্থ এই নয় যে, আমরা কেবল শরাব পান করেই লড়াই করতে পারি। আমাদের মাঝে আত্মমর্যাদাবোধ আছে এবং দেশ রক্ষার জযবাও আছে। কিন্তু এই শরাব আমাদেরকে অনেক বেশি সাহসী বানিয়ে দেয়। এখন পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে যে, আমাদের সৈনিকরা রুটি-গোসতের পরিবর্তে শরাব পানে বেশি অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে।
‘ঐ রাস্তা ছাড়া শহরে রসদ পৌঁছার অন্য কোন রাস্তা আছে কি? মুসা বিন নুসাইর জিজ্ঞস করলেন।
‘রাস্তা তো কয়েকটাই আছে। প্রথমজন বলল। কিন্তু আপনার ফৌজের উপস্থিতির কারণে এই একটি রাস্তাই অবশিষ্ট আছে। আমরা এখন এই রাস্তাই ব্যবহার করছি। এই রাস্তাটি নিরাপদ হওয়ার কারণ হল, এটি শহরের পিছন দিকে নদীর তীরে। আর নদী থেকে শহর পর্যন্ত পুরো এলাকাটাই পাহাড়ী ও দুর্গম। আপনি এদিকটাই সম্ভবত এ কারণেই আপনার বাহিনী মোতায়েন করেননি যে, এলাকাটি লড়াই করার উপযুক্ত নয়। আমরা অনেক কষ্টে এই রাস্তা দিয়ে শহরে সামানপত্র নিয়ে যাই। এই রাস্তাটিও যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে শহরে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।’
এই দুজনকে নিয়ে যাও।’ মুসা বললেন। এদের সাথে ভাল ব্যবহার করবে।
আন্দালুসিয়ার সৈনিক দুজনকে নিয়ে যাওয়ার পর মুসা বিন নুসাইর তাঁবু থেকে বের হয়ে আসমানের দিকে তাকালেন। তিনি রাতের আকাশে তারার দিকে তাকিয়ে সময় অনুমান করতে চেষ্টা করলেন। তখন ছিল রাতের শেষ প্রহর। সেনাপ্রধানকে তিনি নির্দেশ দিলেন, পাঁচশ’ অশ্বারোহী আর দেড় হাজার পদাতিক সৈন্যের একটি বাহিনী এখনই সেখানে পাঠিয়ে দাও, যেখানে রসদবাহী কিস্তি এসে নোঙ্গর করে।
‘আবদুল্লাহ। মুসা বিন নসাইর তাঁর ছেলেকে লক্ষ্য করে বললেন। তুমিও বাহিনীর সাথে সেখানে যাবে। কেননা, তুমি সেই জায়গাটি দেখে এসেছ। শহরে রসদ আসা প্রতিহত করতে হবে। বহু দূরের পথ ঘুরে তোমরা সেখানে যাবে, যাতে শত্রুপক্ষ তোমাদের গতিবিধি সম্পর্কে কোন কিছু জানতে না পারে। এই বাহিনীকে নদীর পাড়ের ঢালু কোন জায়গায় গোপন করে রাখবে। যদি তোমাদের উপর আক্রমণ হয় তাহলে আমি পাল্টা আক্রমণের ব্যবস্থা করব। তোমরা এখনই রওনা হয়ে যাও। সুবেহ সাদিকের পূর্বেই সেখানে তোমাদের পৌঁছতে হবে। প্রত্যেক পদাতিকের কাছে অন্যান্য হাতিয়ারের সাথে তীর-ধনুকও থাকতে হবে। শত্রুপক্ষকে কিস্তির কাছেও ভিড়তে দেবে না। মেরিডার লোকজন রুটি-গোত ব্যতীত বাঁচতে পারবে, কিন্তু শরাব ছাড়া তারা একেবারে অন্ধ, আর উন্মাদ হয়ে যাবে। এখন থেকে তোমরা মেরিডাকে নিজেদের সম্পত্তি মনে করতে পার।
আবদুল্লাহ অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত পাঁচশত অশ্বারোহী, আর দেড় হাজার সৈন্যের এক পদাতিক বাহিনী নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন। প্রত্যেক সৈন্যের কাছে ছিল একটি ধনুক, আর তীর ভরা দুটি তুনির। আবদুল্লাহ বিন মুসা সোজা পথ ছেড়ে বহু দূরের পথ ঘুরে নদীর তীরে গিয়ে পৌঁছলেন। পথের দূরত্ব খুব বেশি ছিল না। আবদুল্লাহ তার বাহিনীকে হাঁটু পানিতে নেমে সামনে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন। যে জায়গাটিতে কিস্তি সামানপত্র খালাশ করত, আবদুল্লাহ যখন তার বাহিনীকে নিয়ে সেখানে পৌঁছলেন তখন মেরিডা শহরের বড় গির্জার ঘণ্টা বেজে উঠল আর মুসলিম বাহিনীর ক্যাম্প থেকে মোয়াজ্জিনের সুললিত কন্ঠের আজানের ধ্বনি ভেসে এলো।
আবদুল্লাহ যে জায়গাটিতে তার বাহিনীকে নিয়ে উৎপেতে ছিলেন, সেটি ছিল একটি গঞ্জের মত এলাকা। নদীর তীরে পাথর আর কাঠ দিয়ে বড় রকম একটি ঘাট বানানো ছিল। লোকজন নদী পথে সফর করার জন্য এই ঘাট থেকেই কিস্তিতে উঠত। এই নদীর উপর একটি ব্রিজও ছিল, কিন্তু সেখানে মুসলিম বাহিনী উপস্থিত থাকার কারণে সেই পথে রসদপত্র শহরে আনা সম্ভব ছিল না।
আবদুল্লাহ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে তার বাহিনীকে চার দিকে ছড়িয়ে দিলেন। অল্প কিছুক্ষণ পরেই পূর্বের আকাশ ধীরে ধীরে ফর্সা হয়ে উঠল।
***
আন্দালুসিয়ার অফিসার দুজন যখন সকাল হওয়ার পরও ফিরে এলো না তখন তাদের খুঁজে একজন সৈনিককে পাঠানো হল। এই ব্যক্তি ঘোড়ায় চড়ে বের হয়ে ছিল। সে যখন নদীর তীরে পৌঁছল তখন তার এক কাঁধে একটি তীর বিদ্ধ হল। সে তৎক্ষণাত ঘোড়া হাঁকিয়ে শহরের দিকে চলে গেল। সে ফিরে গিয়ে শুধু এই সংবাদ দিল যে, নদীর ঘাট মুসলিম বাহিনী দখল করে নিয়েছে।
সংবাদ শুনে একদল অশ্বারোহী প্রেরণ করা হল। এই অশ্বারোহী বাহিনী পাহাড়ি এলাকা ছেড়ে সামনে অগ্রসর হওয়ামাত্র তাদের উপর তীরবৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। অশ্বারোহী দলটি তীর বিদ্ধ হয়ে পলায়ন করা ছাড়া আর কোন উপায়: খুঁজে পেল না। তারাও বাধ্য হয়ে পিছু হটে গেল। মুসা বিন নুসাইর এই জায়গার ডানে ও বামে আরও কয়েকটি সৈন্যদল পাঠিয়ে দিলেন।
সেদিন আর কোন সংঘর্ষ হল না। বেলা গড়িয়ে যখন রাতের আঁধার নেমে এলো তখন মুসলিম বাহিনী দেখতে পেল যে, চারটি বড় বড় কিস্তি এসে নদীর ঘাটে নোঙ্গর করছে। মুসলিম বাহিনী অতিসহজেই কিস্তিগুলো দখল করে নিল। একটি কিস্তি মেষ আর বকরীতে পরিপূর্ণ ছিল। আর অন্যগুলো আটা, মাখন, ঘি, ডাল, তরিতরকারী আর শরাবের পিপে দিয়ে ভরপুর ছিল। আবদুল্লাহর হুকুমে শরাবের পিপেগুলো নদীতে ফেলে দেওয়া হল, আর মুসা বিন নুসাইরকে সংবাদ দেওয়া হল যে, সমস্ত সামানপত্র যেন অতিসত্তর এখান থেকে উঠিয়ে মুসলিম ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।
এই ঘটনার পর মুসলিম বাহিনী মেরিডার অধিবাসীদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। সাত-আট দিন অতিবাহিত হওয়ার আগেই মেরিডা শহরে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। মেরিডার অধিবাসীরা সবচেয়ে বড় যে সমস্যার সম্মুখীন হল, তা হল তাদের শরাবের মওজুদ একেবারেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। খানাপিনার অভাবে মানুষের মানসিক অবস্থা কিছুটা বিরূপ হলেও সারাক্ষণ নেশায় ডুবে থাকা মানুষ যখন নেশাকর দ্রব্য থেকে বঞ্চিত হয় তখন তাদের অবস্থা পাগলা কুকুরের মত হয়ে যায়। মেরিডার অধিবাসী আর সৈন্যদের অবস্থাও প্রায় এমনই হয়ে গিয়েছিল। তারা পরস্পরে মারামারি, আর হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ল। তাদের মন থেকে লড়াই করার স্পৃহা আর মনোবল ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে এলো।
আন্দালুসিয়ার সৈন্যরা নদীর ঘাট দখলমুক্ত করার জন্য বার দুয়েক হামলা করল বটে; কিন্তু মুসা বিন নুসাইর নদীর ঘাটে এমন মুজবুত পাহারার ব্যবস্থা করেছিলেন যে, প্রত্যেক বারই তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল। তৃতীয়বার আক্রমণ করার কোন চেষ্টাই তারা আর করল না।
***
বলো, এজেলুনা! এমন পরিস্থিতিতেও কি তুমি সিপাহীদের মনোবল বৃদ্ধি করতে পারবে? ‘রাজেলিউ জিজ্ঞেস করল।
‘হ্য আমি পারব।’ এজেলুনা বলল। আমি জানি, শক্তিশালী দুশমনের মুকাবেলা করা সম্ভব, কিন্তু ক্ষুধ-পিপাসার মুকাবেলা করা কোন শক্তিশালী দুশমনের পক্ষেও সম্ভব নয়। তারপরও আমি পূর্বের মতই মানুষের মাঝে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করার চেষ্টা করব।’
‘বাস্তবতার প্রতি আমাদের লক্ষ্য করা উচিত, এজেলুনা!’ রাজেলিউ বলল। ‘সকলই ক্ষুধার্ত। আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে কথা বলছি। এখন আর মেরিডাকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। ক্ষুধার্ত প্রজারা বিদ্রোহ শুরু করে দিয়েছে। সিপাহীরা শরাব চাচ্ছে। জনগণকে ক্ষুধার্ত রেখে সিপাহীদের খানার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর ফলাফল হল এই যে, জনগণ সিপাহীদেরকে আর কখনও ভাল চোখে দেখবে না। আমি তোমাকে এই পরামর্শ দিচ্ছে যে, চল আমরা রাতের আঁধারে অন্য কোথাও চলে যাই। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। রাতে শহরের ফটক আমাদের জন্য খোলা থাকবে।
‘কোথায় যাব?’ এজেলুনা জিজ্ঞেস করল। এমন কোন শহর কি অবশিষ্ট আছে, যা এখনও মুসলিম বাহিনীর হস্তগত হয়নি?
‘আমি তোমাকে ফ্রান্স নিয়ে যাব।’ রাজেলিউ বলল।
‘না।’ এজেলুনা বলল ‘এখনই এখান থেকে চলে যাওয়ার কোন ইচ্ছা আমার নেই।’
এর পরিণাম কি হবে তুমি জান?’ রাজেলিউ বলল। মুসলমানদের সিপাহসালার বা কোন জেনারেল তোমাকে তার দাসী বানিয়ে রাখবে। মনে রেখ, দাসী কখনও স্ত্রীর মর্যাদা পায় না। লালসার সামগ্রী হয় মাত্র। তাছাড়া তুমি তো রানী হওয়ার স্বপ্ন দেখছ। চল, এখনও সময় আছে। আমরা এখান থেকে ফ্রান্স চলে যাই। সেখানে গিয়ে আমরা বিবাহ করব। আমরা শাহী খান্দানের লোক। সেখানে আমাদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করা হবে। যে পরিমাণ ধন-দৌলত আমি সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি, তা দেখলে তুমি অবাক হয়ে যাবে।
এজেলুনার ঠোঁটে তিরস্কারের সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠল।
তুমি কি আমাকে কোন জবাব দেবে না? রাজেলিউ বলল।
‘আরও দুই-এক দিন অপেক্ষা কর।’ এজেলুনা বলল।
***
সকাল বেলা এজেলুনা ঘোড়ায় আরোহণ করে শহরে বের হলে শহরবাসী তাকে ঘিরে ধরল। কিছুদিন পূর্বেও মানুষ তাকে দেখে মেরিডার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়ে যেত। তাকে দেখে জয়ধ্বনী করত। আর এখন পরিস্থিতি পুরোপুরি উল্টে গেছে। লোকজন তাকে দেখলেই বিক্ষোভ করছে। একের পর এক প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে হতে হচ্ছে।
কেউ জিজ্ঞেস করছে, আমাদের সেনাবাহিনী দূর্গের বাইরে কি করছে?
কেউ বা বলছে, সেনাবাহিনী হামলা করে অবরোধ ভাঙতে পারছে না কেন?
‘আমরা আর কত দিন আমাদের বাচ্চাদেরকে ক্ষুধার্ত রেখে সিপাহীদের উদরপূর্তি করব?
‘আমরা ক্ষুধার্ত, আমাদেরকে খাদ্য দাও, আমরাই লড়াই করব।’ এজেলুনা এ ধরনের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছিল। অবশেষে সে জেনারেলদের কাছে গেলে তারা তাকে বলল, ‘সেনাবাহিনীর খাদ্যের মওজুদও শেষ হয়ে গেছে। দুই-একটি সেনাছাউনি থেকে এ সংবাদও এসেছে যে, তারা হৃষ্টপুষ্ট দুটি ঘোড়া জবাই করে খেয়ে ফেলেছে। তুমি রাজেলিউকে বলো, সে যেন মুসলমানদের হাতে শহরের দায়িত্ব অর্পণ করে দেয়।’
এজেলুনা রাজেলিউর কাছে গিয়ে বলল, তুমি শহরের ফটক খুলে দেওয়ার নির্দেশ দাও।’ কিন্তু রাজেলিউ এজেলুনার প্রস্তাবে সম্মত হতে চাচ্ছিল না।
‘তুমি কি চাও, জনসাধারণ আর সেনাবাহিনী, বেঘোরে জীবন হারাক। এজেলুনা রাজেলিউকে বলল। মুসলিম বাহিনী অতিসত্বর এ কথা জানতে পারবে যে, আমাদের সেনাবাহিনী ক্ষুধ-পিপাসায় দিন অতিবাহিত করছে। তারা লড়াই করার জন্য মোটেই প্রস্তুত নয়। তখন তারা হামলা করে দেবে এবং শহরে প্রবেশ করে প্রতিটি ঘরে লুটতরাজ চালাবে। যুবতী মেয়েদেরকে নিজেদের ইচ্ছা মতো ব্যবহার করবে, আর শহরে ব্যাপকহারে হত্যাযজ্ঞ চালাবে।
ঐতিহাসিকগণ লেখেন, এজেলুনার সাথে রাজেলিউর আলোচনা শেষ হওয়ার অল্প কিছুক্ষণ পর একজন জেনারেল চারজন সিপাহীসহ সফেদ ঝাণ্ডা নিয়ে দুর্গ হতে বের হল। মুসা বিন নুসাইর তাদেরকে দেখে ঘোড়ায় চড়ে সামনে অগ্রসর হলেন। দুইজন সালার আর একজন দোভাষী তার সাথে ছিল। মুসা আন্দালুসিয়ার জেনারেলের সাথে হাত মিলালেন।
আন্দালুসিয়ার ইতিহাস রচনাকারী ঐতিহাসিকগণ লেখেছেন যে, আন্দালুসিয়ার সেই জেনারেল সন্ধির জন্য কতগুলো শর্ত পেশ করল, যার সবগুলোই ছিল অর্থহীন, আর অযৌক্তিক। কোন ঐতিহাসিকই সবগুলো শর্তের কথা উল্লেখ করেননি। ডা. কোন্ডে দুটি শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন। একটি শর্ত হল, মেরিডার সকল সৈন্যকে এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার অনুমতি দিতে হবে। কাউকে যুদ্ধ বন্দী করা যাবে না। দ্বিতীয় শর্ত হল, সেনাবাহিনীর জন্য খানার ব্যবস্থা করতে হবে।
মুসা বিন নুসাইর এ সকল শর্ত প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে আন্দালুসিয়ার জেনারেলকে বললেন, তোমরা পরাজিত হয়েছ, নাকি আমরা পরাজিত হয়েছি? তোমরা নও আমরা শর্ত আরোপ করব। তোমরা যদি আমাদের শর্ত না মান তাহলে তোমাদের বাহিনীকে আমাদের সাথে মুকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হতে বল।
‘আপনার শর্ত কি? আন্দালুসিয়ার জেনারেল জানতে চাইল।
‘তোমাদের সকল সিপাহী হাতিয়ার সমর্পণ করবে। মুসা বিন নুসাইর বললেন। তোমাদের সকল সিপাহী আমাদের কয়েদী হবে। আমরা নয় মাস পর্যন্ত তোমাদেরকে অবরোধ করে রেখেছি। এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের বহু সিপাহী জীবন দিয়েছে। আমরা তার মূল্য আদায় করব। শহরে যত স্বর্ণ, অলংকার আছে–চাই তা সরকারী হোক বা জনগণের হোক, সেগুলো আমাদের কাছে অর্পণ করতে হবে। তোমাদের উদ্দেশ্য যেহেতু পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে না, তাই তোমাদের কয়েকজন নেত্রীস্থানীয় লোক ও সকল প্রশাসককে আমাদের কাছে পণ হিসাবে রাখতে হবে। তোমরা এখন ফিরে যেতে পার, যদি শর্ত মঞ্জুর হয় তাহলে তোমাদের সিপাহীকে এক জায়গায় সমবেত কর এবং তাদের হাতিয়ার এক স্থানে একত্রিত কর। আর তোমাদের সকল প্রশাসককে আমাদের কাছে নিয়ে এসো।’
আন্দালুসিয়ার জেনারেল কথা না বাড়িয়ে ফিরে গেল। মুসা বিন নুসাইর তার বাহিনীকে হামলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বললেন।
অল্প কিছুক্ষণ পরেই সেই জেনারেল দূর্গ থেকে বের হয়ে এলো। তার সাথে কমপক্ষে পঞ্চাশজন পুরুষ, আর সমসংখ্যক নারী ছিল। তাদের লেবাস-ছুরত এ সাক্ষ্য দিচ্ছিল যে, তারা সকলেই সম্ভ্রান্ত ও উচ্চ বংশের লোক।
‘এদের সবাইকে আপনি পণ হিসাবে রাখতে পারেন। জেনারেল মুসা বিন নুসাইরকে বলল। তবে আমি আপনাকে অনুরোধ করব, এদের সাথে সাধারণ কয়েদীর মত ব্যবহার যেন না করা হয়। এরা সাধারণ কোন মানুষ নয়; বরং এরা সকলই শীর্ষস্থানীয় প্রশাসক। এদের মাঝে শাহীখান্দানের লোকও আছে। সেনাবাহিনী তাদের হাতিয়ার এক জায়গায় একত্রিত করেছে, আপনি এখন শহরে প্রবেশ করতে পারেন।
‘আমরা এ সকল পণবন্দীকে সম্মানের সাথেই রাখব।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। তুমি তো অবশ্যই জান যে, আমরা কেন এদেরকে পণবন্দী করতে চেয়েছি?’
‘আমি একজন যুবতী মেয়ের ব্যাপারে কিছু বলতে চাই। জেনারেল বলল। তার নাম হল, এজেলুনা। সে বাদশাহ রডারিকের বিধবা স্ত্রী। আপনার কাছে তার হয়তো কোন গুরুত্ব নেই, কিন্তু সে আমাদের কাছে একজন পূজনীয় ব্যক্তি।
সে তোমাদের বাদশহর বিধবা পত্নী–এ জন্যই কি তার প্রতি তোমাদের এই ভক্তি?’ মুসা বিন নুসাইর জিজ্ঞেস করলেন।
‘না, সিপাহসালার। ঠিক এ জন্য নয়। জেনারেল বলল। রডারিকের বিধবা স্ত্রীর সংখ্যা কত হবে, তার সঠিক হিসাব কারও জানা নেই। তবে এই নারীর প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করার কারণ হল, তিনিই মেরিডার জনসাধারণ আর সিপাহীদের মাঝে এক দুর্দমনীয় স্পৃহা আর সাহস জাগিয়ে তুলেছিলেন। তার উৎসাহে-ই আমাদের সিপাহীরা জীবনবাজি রেখে লড়াই করছিল। তিনি শহরের প্রতিটি নারী আর শিশুকে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিলেন। যদি রসদ বন্ধ না হয়ে যেত তাহলে আপনি এ শহরের কাছেও আসতে পারতেন না। এই নারী দিন-রাত সিপাহী ও শহরবাসীকে উদ্দীপ্ত করে রাখতেন, তাদের সাহস যোগাতেন। আপনি হয়তো তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে শাস্তি দেবেন। কারণ, সেই আপনার এত দীর্ঘ অবরোধকে সফল হতে দেয়নি। তার জন্যই আপনার অনেক সিপাহীকে জীবন দিতে হয়েছে। তার ব্যাপারে আপনার উপর কোন শর্ত আরোপ করার ক্ষমতা আমার নেই, তবে আমি আপনাকে অনুরোধ করব–এই মহীয়সী নারীর যেন কোন অসম্মান না হয়।’
‘এমন নারীকে আমরাও সম্মানের অধিকারী মনে করি।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। আমরা মানুষের সম্মান ও ইজ্জতের হেফাযতকারী। এ সকল নারীদের মাঝে কে সেই নারী–তাকে আমি দেখতে চাই।’
জেনারেল পণবন্দী নারীদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে ইশারা করল। নারীদের মধ্যে থেকে কালো পোশাক পরিহিতা ও কালো নেকাবে মুখ ডাকা একজন নারী সামনে অগ্রসর হল। একমাত্র এই নারীর চেহারায়-ই নেকাব ছিল। আর অন্যদের চেহারা ছিল উন্মুক্ত। এই নারীই হল এজেলুনা। কালো নেকাবের ভিতর থেকে তার নীলাভ চোখের দীপ্তি, আর ফর্সা চেহারার উজ্জ্বল্য দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। কিন্তু স্পষ্টরূপে কোন কিছুই বুঝা যাচ্ছিল না। তার দীর্ঘ ও চমৎকার দেহ-সৌষ্ঠব যে কোন পুরুষের জন্যই ছিল কামনার বস্তু। তার চলনে-বলনে এক অদৃশ্য আকর্ষণ ছিল।
‘আমরা তার চেহারা নেকাব ছাড়া দেখতে চাই।” মুসা বিন নুসাইর বললেন।
‘আমি আমার চেহারা কেবল তার সামনেই উন্মুক্ত করব, যে আমাকে বিবাহ করবে। এজেলুনা বলল। আর আমি কেবল তাকেই বিবাহ করব, যার সম্মান ও মর্যাদা হবে বাদশাহী। আমি কারও দাসী বা রক্ষিতা হবো না। আমি কোন শাহী পুরুষের স্ত্রী হতে চাই। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যদি কেউ আমাকে ভোগ করতে চায়, তাহলে সেদিন হবে আমার ও তার জিন্দেগীর শেষ দিন। আমি রানী ছিলাম, রানীই থাকব। আপনি তো নিজেই ওয়াদা করেছেন, আপনি আমার ইজ্জত-সম্মান রক্ষা করবেন।’
‘আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করি।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। ‘আমাদের মনযোগ এখন গোটা আন্দালুসিয়ার দিকে। সুন্দরী কোন রমণীর দিকে নয়। আমরা তোমার সাহসিকতা ও ইজ্জতের প্রতি পূর্ণরূপে খেয়াল রাখব। আমি তোমাকে অভয় দিচ্ছি, তুমি কারো দাসী বা রক্ষিতা হবে না।’
ফরাসী ঐতিহাসিক ডন পাস্কেল লেখেছেন, এজেলুনার রূপ-যৌবনে আর চলনে-বলনে এক ধরনের চৌম্বকীয় আকর্ষণ তো ছিলই, কিন্তু তার কথা বলার স্টাইলই এমন ছিল যে, মুহূর্তেই সে যে কোন পুরুষকে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলতে পারত। মুসা বিন নুসাইর, তাঁর পুত্রদ্বয় ও যেসকল জেনারেল সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তারা সকলেই এজেলুনার স্পষ্টবাদিতা আর চারিত্রিক দৃঢ়তা দেখে এত বেশি প্রভাবিত হয়ে পড়লেন যে, এর প্রতিক্রয়া তাদের চেহারায় সুস্পষ্টরূপে ফুটে উঠল।
মুসলিম বাহিনী শহরে প্রবেশ করার সাথে সাথে মুসা বিন নুসাইর নির্দেশ দিলেন, যেন মেরিডাবাসী ও সেনাবাহিনীর জন্য খানা তৈরী করা হয়। কেউ-ই যেন ক্ষুধার্ত না থাকে সেদিকে যেন সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়। আর আটক করা রসদপত্র যেন বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
***
মেরিডার যুদ্ধে বিজয় লাভ করা কোন সাধারণ ঘটনা ছিল না। ইট-পাথরের বিবেচনায় এই দূর্গ এমনিতেই অত্যন্ত মুজবুত ছিল। কিন্তু জনসাধারণের নির্ভিক মনোবল আর যুদ্ধ জয়ের স্পৃহা এই দূর্গকে দুর্ভেদ্য ও অপরাজেয় এক দূর্গে পরিণত করেছিল। একমাত্র মেরিডার দূর্গই এমন একটি দূর্গ ছিল, যা কেবল অবরোধের মাধ্যেমে দখল করা সম্ভব ছিল না। মেরিডা রাজধানী টলেডু থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, এটি ছিল ধর্মীয় তীর্থস্থান। প্রধান পাদ্রি এখানেই অবস্থান করতেন।
মুসা বিন নুসাইর শহর ও আশপাশের এলাকার প্রশাসনিক কার্যক্রম সম্পাদন করার জন্য আরব প্রসাশক নিয়োগ করেন, আর খ্রিস্টানদেরকে তাদের অধীনস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। তিনি বিশেষভাবে তাদেরকে এই নির্দেশ প্রদান করেন যে, প্রত্যেক খ্রিস্টান নাগরিক থেকে তার সামর্থ অনুপাতে কর উসুল করবে। কাউকে এতবেশি কর আদায় করতে বাধ্য করবে না, যাতে তাকে বিবি-বাচ্চা নিয়ে উপোস থাকতে হয়।
প্রধান পাদ্রি পাদ্রিদের সংক্ষিপ্ত একটি দল নিয়ে মুসা বিন নুসাইরের সাথে দেখা করতে এলেন। মুসা বিন নুসাইর সেসময় শহর দেখতে বের হয়েছিলেন। শহরের মাঝখানে বড় ধরনের একটি মাঠ ছিল। সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখানে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করত। বিভিন্ন পাল-পার্বণ উপলক্ষে এখানে খেলা-ধূলা ও মেলার আয়েজন করা হত। মুসা বিন নুসাইর এই মাঠ পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এ সময় তাঁকে সংবাদ দেওয়া হল যে, প্রধান পাদ্রি তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে চায়। সে জানতে চাচ্ছে, সম্মানিত আমীর কখন শাহী দরবারে বসবেন?
মুসা বিন নুসাইর দেখলেন, প্রধান পাদ্রি আরও কয়েকজন পাদ্রিকে সাথে নিয়ে মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি তাদেরকে ডেকে পাঠালেন।
‘আমীরে আলা, দরবারে কখন বসবেন?’ প্রধান পাদ্রি বলল। আমি ব্যক্তিগত কয়েকটি আবেদন নিয়ে আপনার সাথে কথা বলতে চাই।’
‘আপনি যখন এসে গেছেন তখন এখানেই দরবার বসিয়ে নিচ্ছি।’ মুসা বিন নুসাইর মুচকি হেসে বললেন। আমরা সর্বক্ষণ আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে আছি। বান্দার কোন দরবার থাকতে পারে না। আসুন, এখানেই বসা যাক।
এ কথা বলেই মুসা বিন নুসাইর মাটিতে বসে পড়লেন।
ডন পাস্কেল লেখেছেন, প্রধান পাদ্রি মাটিতে বসতে ইতস্তত করছিলেন। তিনি খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জুব্বা পরেছিলেন। জুব্বার নিচে পাতলুন ছিল। তার জুতার কালার চকচক করছিল। পাদ্রি হতভম্ব হয়ে চিন্তা করতে লাগলেন, একজন বিজয়ী সিপাহসালার, যিনি এই রাজ্যের গভর্নরও তিনি এমন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মাটিতে বসে পড়লেন! পাদ্রির এই হতভম্ব চাহনীর মাঝে এমন একটা ভাব ছিল যে, তিনি নিজেকে বাদশাহর সমপর্যায়ের মনে করতেন। তাই মাটিতে বসাকে নিজের জন্য অপমানকর মনে করছিলেন।
‘বসে পড়ন। মুসা বিন নুসাইর বললেন। আমাদের নিয়ম-কানুন এমনই। যেখানেই কেউ কোন নিবেদন, অভিযোগ বা সমস্যা পেশ করে, সেখানেই আমরা তা শুনি এবং তার সমাধান করি। আমি যদি আপনাকে বলি, অমুক দিন, অমুক সময় আপনি শাহীদরবারে আসুন, সেখানে আমি আপনার কথা শুনব তাহলে আমি একজন অপরাধী হব। আল্লাহ তাআলার ইরশাদ হল, “যেখানে এবং যে অবস্থায় তোমরা আমাকে আহ্বান করবে, আমি তোমাদের কথা শ্রবণ করব।” আল্লাহ তাআলার এই ফরমানের পর বান্দার আর কি অধিকার থাকতে পারে? আল্লাহর দেওয়া সম্মান পেয়ে বান্দা যদি আল্লাহর অন্যান্য বান্দাদের জন্য সময় ও স্থান নির্ধারণ করে দেয় তাহলে কি তা ঠিক হবে? আমি ফেরাউন নই; আমি কোন বাদশাহও নই। আপনি তো আপনার সম্প্রদায়ের নেতা ও সম্মানিত ব্যক্তি। আপনার সম্প্রদায়ের একজন সাধারণ ব্যক্তিও যদি চলার পথে আমাকে দাঁড়াতে বলে তাহলে আমি তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে যাব এবং তার কথা শুনব।’
‘আপনাকে আল্লাহ তাআলার হুকুমের অনুগত মনে হয়। প্রধান পাদ্রি মাটিতে বসতে বসতে বললেন। আমি আপনার কাছে নিবেদন করতে চাই যে, আমাদের গির্জাগুলোর কোন অসম্মানী যেন না করা হয় এবং আমাদের ইবাদত-বন্দেগীর উপর যেন কোন বাধ্য-বাধকতা আরোপ করা না হয়।’
‘এ ব্যাপারে আমি কোন নির্দেশ দেব না।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। বরং এ ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশ হল, কোন জাতিকে পরাজিত করলে সেই জাতির ধর্ম ও ইবাদতখানার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা যাবে না। ইসলাম ধর্মের প্রচার অবশ্যই করতে হবে, তবে কারও মনে কষ্ট দিয়ে নয়। কথাবার্তা ও আচার-আচরণে উত্তম আদর্শ পেশ করতে হবে। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, আপনাদের উপাসনালয়ের সম্মান পূর্ণমাত্রায় রক্ষা করা হবে। তবে আপনাকে আমি এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেব, যেন আপনাদের গির্জাসমূহে হুকুমতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহমূলক কোন কথা না হয় এবং আপনি ও আপনার পাদ্রিদের কেউ যেন নিজ ধর্মের প্রচার-প্রসার না করে।’
‘আপনি কি ইসলামের তাবলীগ করবেন? প্রধান পাদ্রি বললেন।
‘ইসলামের তাবলীগ করার কোন প্রয়োজনই হবে না।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। বেশ কয়েক দিন হয়ে গেছে, এই রাজ্য ইসলামী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আপনি কি এ ব্যাপারে কাউকে কোন অভিযোগ করতে শুনেছেন বা এমন কোন সংবাদ পেয়েছেন যে, কোন মুসলিম সিপাহী বা কোন অফিসার কোন নারীর উজ্জতের উপর আক্রমণ করেছে?
“জ্বি না। প্রধান পাদ্রি বললেন।
‘কোন মুসলমান কি কারও ঘরে প্রবেশ করে কোন কিছু চেয়েছে?”
‘জি না।’
‘কোন মুসলমান কি কারও সাথে অভদ্র আচরণ করেছে?
‘জ্বি না।’
‘এটাই ইসলামের তাবলীগ। আমরা আমাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে এই তাবলীগই করে থাকি। মুসা বিন নুসাইর বললেন। আপনার ওয়াজ-নসীহত আমাদের এই তাবলীগের কোন ক্ষতিই করতে পারবে না। আমি আপনার উপর আরেকটি হুকুম জারি করব, আপনি বা আপনার কোন পাদ্রি যেন কোন ইহুদি বা খ্রিস্টান মেয়েকে জোরপূর্বক গির্জার সেবিকা না বানায়। আমি ভাল করেই জানি, এ সকল মেয়েদের সাথে আপনাদের গির্জাসমূহে কী ধরনের আচরণ করা হয়ে থাকে। আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমরা আমাদের সাথে কোন শাহী ফরমান বা শাহী প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে আসিনি। আমরা একটি আদর্শ ও একটি জীবনপদ্ধতি নিয়ে এসেছি। আমরা মানুষের মুখ বন্ধ করার জন্য আসিনি; বরং মানুষের মুখে ভাষা দিতে এসেছি। আমরা চাই, আল্লাহর প্রতিটি বান্দা তাদের নিজস্ব মত প্রকাশ করুক। তাদের মাঝে এই পরিমাণ সাহস সঞ্চারিত হোক যে, আমি যদি ভুল পথে চলি তাহলে তারা আমাকে প্রতিহত করবে এবং আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে।’
প্রধান পাদ্রি হয়তো আরও কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু মুসা বিন নুসাইরের কথা তার মুখ বন্ধ করে দিল। প্রধান পাদ্রিকে প্রভাবিত করার জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল যে, একজন বিজয়ী সিপাহসালার তার কথা শুনার জন্য যেখানে ছিলেন, সেখানেই মাটির উপর বসে পড়েছিলেন। প্রধান পাদ্রি উঠে সম্মান প্রদর্শন করে চলে গেলেন।
***
‘সম্মানিত পিতা! এক রাতে মুসা বিন নুসরাইরের বড় ছেলে আবদুল আযীয একাকী তার বাবাকে বলল। ঐ মেয়েটিকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, যাকে আপনার সামনে উপস্থিত করা হয়েছিল। তার নাম হল, এজেলুনা।’
‘তার চেহারার উপর তো নেকাব ছিল। মুসা বিন নুসাইর বললেন। ঐ পাতলা নেকাবের ভিতরেও মেয়টিকে অত্যন্ত সুন্দরী মনে হচ্ছিল। বাস্তবে এতটা সুন্দরী নাও হতে পারে।’
‘সম্মানিত পিতা! আমি তার চেহারার প্রতি লক্ষ্য করিনি। আবদুল আযীয বললেন। তার সাহসিকতা আমাকে প্রভাবিত করেছে। সে আপনার সাথে যেভাবে কথা বলছিল, আন্দালুসিয়ার কোন জেনারেলও এমনভাবে আপনার সাথে কথা বলতে সাহস করেনি। আমি এখানকার জেনারেলদের কাছ থেকে এবং দুরক্ষক রাজেলিউর কাছ থেকে তার সম্পর্কে সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করেছি। অনেক বেসামরিক লোকদের কাছেও জিজ্ঞেস করেছি, তারা সকলেই আমাকে জানিয়েছে যে, সে অত্যন্ত আত্মমর্যাদাশীলা এক নারী। শাহী খান্দানের সাথে তার সম্পর্ক। এখানের প্রত্যেক জেনারেল, দুর্গরক্ষক এবং কয়েকজন প্রশাসক তাকে বিয়ে করার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এই নারী সকলকে বলেছিল, প্রথমে মেরিডাকে রক্ষা কর। অতঃপর হামলাকারীদেরকে চিরতরে ধ্বংস করে দিয়ে বেদখল হওয়া নিজেদের অন্যান্য শহরগুলোর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা কর।
শিশু-বৃদ্ধ-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের অন্তরে সে দেশপ্রেমের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। প্রতিটি সিপাহী এবং প্রত্যেকটি নাগরিক দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। সামরিক, কী বেসামরিক–একজন মানুষও রাতের বেলা ঘুমিয়ে আরাম করত না। এই নারী ঘোড়ায় আরোহণ করে নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে শহরের অলিগলিতে আর সিপাহীদের ছাউনিসমূহে ঘুরে বেড়াত। আমি এমনই এক নারীকে বিয়ে করতে আই।’
‘প্রিয় পুত্র আমার! মুসা বিন নুসাইর বললেন। এই নারীকে বিয়ে করার অনুমতি আমি তোমাকে দেব। তার আগে তুমি তাকে ভালোভাবে যাচাইবাছাই করে নাও। সে শাহীখান্দানের মেয়ে। তাছাড়া সে একজন বাদশাহর স্ত্রীও ছিল। তুমি ভাল করে জান, শাহী খান্দানের লোকদের স্বভাব-চরিত্র কেমন হয়ে থাকে। এমন যেন না হয় যে, তার পেট থেকে আমাদের বংশের যে ধারা বিস্তার লাভ করবে, তারা আমাদের জন্য লজ্জা ও অপমানের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
***
মেরিডার শাহীমহলের একটি পৃথক কামরায় এজেলুনার থাকার ব্যবস্থা করা হল। মুসা বিন নুসাইর এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, যুদ্ধবন্দী কোন নারীকে বিরক্ত করা হবে না। এজেলুনার জন্য তো পৃথক খাদেমাও রাখা হয়েছিল। একদিন এজেলুনার খাদেমা তাকে সংবাদ দিল যে, এক আরব সেনাপতি তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়।
‘বৃদ্ধ না যুবক? এজেলুনা জিজ্ঞেস করল।
‘যুবক, আপনার সমবয়সীই হবে।’ খাদেমা বলল।
‘তাকে ভিতরে পাঠিয়ে দাও।’ এজেলুনা বলল।
আবদুল আযীয যখন ভিতরে প্রবেশ করল তখন এজেলুনার চেহারায় পাতলা নেকাবে ঢাকা ছিল। আবদুল আযীয তার সাথে একজন দোভাষী নিয়ে এসেছিলেন। দোভাষীর মাধ্যমে তিনি এজেলুনাকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে তার কোন সমস্যা হচ্ছে না তো? তার সমস্ত প্রয়োজন পূরণ করা হচ্ছে তো? এজেলুনা স্বস্তি প্রকাশ করে দোভাষীকে লক্ষ্য করে বলল, ইনি কে? এখানে কেন এসেছেন?
‘আমি সিপাহসালারের বড় ছেলে। আবদুল আযীয বললেন। সিপাহসালার মুসা বিন নুসাইর আফ্রিকার আমীর। বর্তমানে তিনি আন্দালুসিয়ারও আমীর। তার পর আমি হব আন্দালুসিয়ার আমীর।
‘আমার এখানে আপনার আগমনের কারণ?’ এজেলুনা জানতে চাইল।
‘এতটাই অহংকার?’ আবদুল আযীয বললেন। “তুমি কি এখনও নিজেকে আন্দালুসিয়ার রানী মনে কর?
‘আমি আন্দালুসিয়ার রানী নই বটে, তবে আমি নিজের মনের রানী তো অবশ্যই।’ এজেলুনা বলল। এটা এমন এক সালতানাত, যা আমার থেকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। এ কথা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে, আমি একজন বাদশাহর বিধবা স্ত্রী। আমি শাহী খান্দানে জন্ম নিয়েছি, তাই আমার চাল-চলন সেসব মেয়েদের চেয়ে ভিন্ন, যারা আমার চেয়ে নিম স্তরের। তারা তো তোমাদের মত সালারদের দাসী বা রক্ষিতা হওয়াকে নিজেদের জন্য গর্বের বিষয় মনে করে।
এজেলুনা কয়েক মুহূর্তের পরিচয়ে আবদুল আযীযকে আপনি থেকে তুমি সম্বোধন করে কথা বলতে শুরু করল।
‘আমি তোমাকে দাসী বা রক্ষিতা বানাতে আসিনি।’ আবদুল আযীয বললেন। “তুমি বাদশাহর বিবি ছিলে, বাদশাহর বিবি-ই হবে। তবে মুসলমানদের মাঝে কোন বাদশাহ হয় না। আমাদের একজন খলীফা হন, তার অধীনে বেশ কয়েকজন আমীর থাকেন। তাদের সকলেই তোমাদের বাদশাহদের সমমর্যাদার হয়ে থাকেন। কিন্তু তাদের চিন্তা-ভাবনা বাদশাহদের মত হয় না।’
‘তুমি কি আমাকে বিবাহ করতে চাও?’ এজেলুনা জানতে চাইল।
‘হ্যাঁ।’ আবদুল আযীয বললেন। আমি আমার পিতার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছি। তোমাকে যদি দাসী বা রক্ষিতা বানানোর ইচ্ছা আমাদের থাকত তাহলে আমরা তোমাকে এতদিন এখানে রানী বানিয়ে রাখতাম না।’
‘আমি কি কেবলমাত্র গৃহিণী হব না রানী হব? এজেলুনা বলল।
‘তুমি যদি চেহারার উপর থেকে নেকাব সরিয়ে নাও তাহলে সঠিক উত্তর পাবে।’ আবদুল আযীয বললেন।
এজেলুনা সাথে সাথে চেহারা থেকে নেকাব উঠিয়ে নিল এবং মাথার কাপড়ও সরিয়ে দিল। আবদুল আযীয এই তন্বী যুবতীর ব্যাপারে যার কাছেই জিজ্ঞেস করেছিল সেই তাকে বলেছিল, এই যুবতীর বয়স ত্রিশ বছরের চেয়ে দু-এক বছর কম হবে। কিন্তু তাকে দেখলে মনে হয়, বিশ বছরের উদ্ভিন্ন যৌবনা এক নারী। তার রূপের উজ্জ্বলতা আর অনিন্দ্য দেহসৌষ্ঠবের মাঝে এমন এক আকর্ষণ আছে যে, কেউ তাকে প্রথমবার দেখলে সে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়বে। তার চোখে এমন এক জাদু আছে, যে তাকে দেখবে সেই মোহমুগ্ধ হয়ে পড়বে। তার কথা বলার ভঙ্গি এমন, যে তার কথা শুনবে, সেই কৃতদাসের মত তার কথায় নাচতে শুরু করবে। আন্দালুসিয়ার এক জেনারেল আবদুল আযীযকে বলেছিল, এই নারীর রূপ-যৌবন, আর পা থেকে মাথা পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এমন অসম্ভব আকর্ষণীয় যে, সে রডারিকের মত জালেম বাদশাহকেও মোমের মূর্তিতে পরিণত করেছিল।
এজেলুনা তার চেহারা থেকে নেকাবের আবরণ সরিয়ে নেওয়ার সাথে সাথে আবদুল আযীয একেবারে আঁতকে উঠলেন। বিষ্ময়ে বিস্ফারিত চোখে তিনি শুধু তাকিয়ে রইলেন। তার মুখ থেকে একটি কথাও সরল না। শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা বলতে যা বুঝায়—-আবদুল আযীযের অবস্থা হয়েছিল ঠিক তেমন। এজেলুনার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠল। সে নেশা ছড়ানো রহস্যময় দৃষ্টিতে আবদুল আযীযের দিকে অপলক তাকিয়ে রইল।
‘তুমি রানী হবে। অবচেতন মনে আবদুল আযীযের মুখ থেকে বের হয়ে এলো। এ রাজ্যের রানী হবে তুমি। তুমি হবে আমার অন্তর রাজ্যের রাজরানী।
‘কোন নিয়ম অনুযায়ী বিয়েশাদী হবে? এজেলুনা জিজ্ঞেস করল।
‘ইসলামী রীতি অনুযায়ী বিবাহ হবে।’ আবদুল আযীয বললেন। আর তুমি হবে…।’
‘আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করব না।’ এজেলুনা বলল। তবে ইসলামী রীতি অনুযায়ী বিয়ে বসতে রাজি আছি আমি।
আবদুল আযীয হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি বারবার এজেলুনাকে বুঝালেন; কিন্তু এজেলুনা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে রাজি হল না।
আবদুল আযীযের বারবার বুঝানোর কারণে এজেলুনা বলল, ‘ঠিক আছে, আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করব; তবে কয়েক দিন পর।’
অগত্যা আবদুল আযীয এজেলুনার শর্ত মেনে নিলেন এবং এজেলুনার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করার বিষয়টি গোপন রাখলেন। পর দিন আবদুল আযীযের সাথে এজেলুনার বিয়ে হয়ে গেল। আবদুল আযীয এজেলুনার রূপের মোহে এমনই অন্ধ হয়ে পড়লেন যে, তিনি নিজের ব্যক্তিত্বকে এজেলুনার অস্তিত্বের সামনে বিলীন করে দিলেন। তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন যে, কিছু দিন পরে এ নারীই তাকে এমন এক পরিণতির সম্মুখীন করবে, যা দেখে ইতিহাস স্তব্ধ হয়ে যাবে।
***
প্রায় দেড় বছর পূর্বে মুসা বিন নুসাইর মেরিডার মত আরেকটি বড় শহর এ্যাশবেলিয়া জয় করেছিলেন। সেখানে প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজকর্ম সম্পাদনের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক আরবী প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তাই অনুপায় হয়ে ইহুদিদের উপর বেশ কয়েকটি প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল।
পূর্বেও এ কথা বলা হয়েছে যে, আন্দালুসিয়ার ইহুদিরা ছিল নির্যাতিত-নিপীড়িত এক জাতি। রডারিকের সময় তাদের সাথে তৃতীয় শ্রেণীর নাগিরকের মত ব্যবহার করা হত। তাদের আয়-রোজগারের সিংহভাগ তাদের উপর কর আরোপ করার মাধ্যমে নিয়ে নেওয়া হত।
সেনাবাহিনী ও সরকারি অফিস-আদালতে তাদেরকে নিম্নমাণের কাজ দেওয়া হত। তাদের উপর সবচেয়ে বড় যে অবিচার করা হত, তা হল তাদের যুবতী কোন মেয়েকে যদি কোন পাদ্রির চোখে ভাল লাগতে তাহলে পাদ্রি তার লালসা চরিতার্থ করার জন্য সে মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যেত এবং তাকে গির্জার সেবিকা হতে বাধ্য করত। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও ইহুদিদের সাথে এমন আচরণ করত। মোটকথা, আন্দালুসিয়ার সমাজ ব্যবস্থায় ইহুদিদের কোন মান-সম্মান ছিল না।
এ কারণেই তারা রডারিকের বিরুদ্ধে তারিক বিন যিয়াদকে গোপনে সাহায্য করেছিল। প্রতিদান হিসেবে তারিক বিন যিয়াদ যে শহর জয় করতেন সেখানে ইহুদিদেরকে বড় বড় পদ প্রদান করতেন এবং ইহুদিদের উপর যেসব অন্যায্য টেক্স আরোপিত ছিল, সেগুলো তিনি মওকুফ করে দেন। এ ছাড়াও তিনি তাদেরকে অনেক রকম সুযাগ-সুবিধা প্রদান করেন।
তারিক বিন যিয়াদের আন্দালুসিয়া আক্রমণ করার কয়েক মাস পর মুসা বিন নুসাইর আন্দালুসিয়া আক্রমণ করেন। ইহুদি সম্প্রদায় মুসা বিন নুসাইরের প্রতিও এত বেশি আনুগত্য প্রদর্শন করে যে, মুসা বিন নুসাইরের মত অভিজ্ঞ জেনারেলের পক্ষেও তাদের আনুগত্য উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ইহুদিরা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তিও করত। তাদের এই গুপ্তচর বৃত্তির কারণে খ্রিস্টানদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে মুসলিম বাহিনী অবগত হয়ে যেত। ইহুদিদের এ জাতীয় সহযোগিতার কারণে মুসা বিন নুসাইরও তাদেরকে রাষ্ট্রের উঁচু উঁচু পদে বসিয়েছিলেন।
মুসা বিন নুসাইর এবং তারিক বিন যিয়াদ ইহুদিদের আনুগত্য দেখে এত বেশি প্রভাবতি হয়েছিলেন যে, তারা এ কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন, ইহুদিদের চেয়ে বড় দুশমন ইসলাম ও মুসলমানদের আর কেউ নেই।
এক পাপিষ্ঠা ইহুদি নারী বিশ মিশ্রিত গোশত খাইয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করতে চেয়েছিল, কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক টুকরা গোশত মুখে দিয়ে সাথে সাথে বমি করে ফেলে দেন।
ইহুদিদের সেই স্বভাবজাত শয়তানী বুদ্ধি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তাদের ষড়যন্ত্রের দাবানল সর্বপ্রথম এ্যাশবেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল। দু’জন ইহুদি রাব্বি আর চারজন খ্রিস্টান পাদ্রি এক ঘরে গোপন বৈঠকে মিলিত হল।
‘আমাদের কাজ হয়ে গেছে।’ একজন ইহুদি রাব্বি বল। রডারিককে উৎখাত করা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, মুসলমানদের সাথে মিলে আমরা আমাদের সেই উদ্দেশ্যে সফল হয়েছি। এখন আমাদের আসল উদ্দেশ্য সাধনে কাজ করা দরকার। আপনারা সকলেই জানেন, আমাদের সেই আসল উদ্দেশ্য কী?
আমাদের আসল উদ্দেশ্য হল, জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করা। জেরুজালেমে ‘সুলায়মানী প্রতিমা স্থাপন করা আমাদের ধর্মীয় কর্তব্য। সফলভাবে এই কর্তব্য পালন করার জন্য আমাদেরকে খ্রিস্টানদের সহযোগিতা গ্রহণ করতে হবে। মুসলমানদের সাথেই আমাদের চূড়ান্ত লড়াই হবে। আপনারা সকলেই জানেন যে, মুসলমানরা জেরুজালেমকে বায়তুল মাকদাস বলে। তারা এই বায়তুল মাকদাসকেই তাদের প্রথম কেবলা ও মসজিদে আকসা বলে থাকে। এখানেই আমাদেরকে সুলায়মানী প্রতিমা স্থাপন করতে হবে। একদিন আমাদেরকে জেরুজালেম ফিরে যেতে হবে। জেরুজালেম আমাদের স্বদেশ। আজ সেই জেরুজালেম মুসলমানদের দখলে।
আন্দালুসিয়ায় খ্রিস্টানদের রাজত্ব ধ্বংস করা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল। আমরা মুসলমানদের সাহায্যে আমাদের সে উদ্দেশ্য হাসিল করেছি। মুসলমানদের থেকে আমাদের ফায়দা এই হয়েছে যে, আমরা তাদের রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদ দখল করে নিয়েছি। এ কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, মুসলিম জাতি আমাদের সবচেয়ে বড় দুশমন। এই দুশমনী কখনও শেষ হবে না।
আপনারা অবশ্যই লক্ষ্য করছেন, গোটা বিশ্বে প্রতিদিনই ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটছে। ইসলাম ধর্মের এই প্রসার আমাদেরকে রুখতে হবে। প্রথমেই আমি আপনাদেরকে বলেছি, খ্রিস্টানদের সাথে মিলেই আমাদেরকে এই কাজ করতে হবে। আমাদেরকে অতি সংগোপনে সামনে অগ্রসর হতে হবে। আন্দালুসিয়াই হবে মুসলমানদের শেষ কবরস্থান।
ইহুদি সম্প্রদায়ের ষড়যন্ত্র আর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পারঙ্গমতা শুরু থেকেই প্রসিদ্ধ ছিল। ইহুদিরা যে যেখানেই গিয়েছে, সেই সেখানকার শাসক সম্প্রদায়ের চক্ষুশূল হয়েছে। আন্দালুসিয়ায় তারা এ কথা ভুলে গেল যে, মুসলমানগণ এখানে তাদেরকে সম্মানজনক অবস্থান দান করেছেন। তারা মুসলমানদেরকে পিছন দিক থেকে ছুরি মারার চিন্তা করতে লাগল।
এ সময় এ্যাশবেলিয়ার প্রশাসক ও দুর্গপ্রধান ছিলেন দামেস্কের অধিবাসী আবু বকর। একদিন বিকেলে তিনি বাগানে পায়চারী করছিলেন। এমন সময় খুব রূপসী একটি মেয়ে উসকু-খুসকু চুলে এ দিকে এগিয়ে এলো। মেয়েটির গায়ে ছিড়া-ফারা পোশাক। তাকে খুবই দরিদ্র মনে হচ্ছিল। মেয়েটি আবু বকরের পথ আগলে দাঁড়িয়ে কি যেন বলতে লাগল। তাদের কেউ-ই কারও ভাষা বুঝল না। অগত্যা ময়েটি ইঙ্গিতে আবু বকরকে কিছু একটা বুঝাতে চাচ্ছিল। সে তার কাপড় উঠিয়ে সম্ভবত এ কথাই বুঝাতে চাচ্ছিল যে, তার উপর অনেক জুলুম-নির্যাতন করা হয়েছে।
আবু বকর বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলেন। তিনি জানতে চাচ্ছিলেন, এই মেয়েটির উপর কে বা কারা নির্যাতন করেছে? কোন মুসলমান এই অপরাধের সাথে জড়িত নয় তো? মেয়েটি কাঁদতে লাগল। আবু বকর তার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। মেয়েটি আবু বকরের হাত নিজের হাতে নিয়ে চুমু খেল। মেয়েটির কাছে একটা ছোট্ট ঝুড়ি ছিল। ঝুড়িতে কয়েকটি আপেল ও অন্যান্য ফল রাখাছিল। মেয়েটি একটি আপেল আবু বকরের হাতে দিয়ে ইঙ্গিতে খেতে বলল।
আবু বকর ভাবলেন, এই দরিদ্র মেয়েটি সম্ভবত তার স্নেহের শুকরিয়া আদায় করতে চাচ্ছে। তাই তিনি মেয়েটির হাত থেকে আপেলটি নিয়ে খেয়ে ফেললেন। মেয়েটি মাথায় হাত ঠেকিয়ে সালাম করে চলে গেল।
সন্ধ্যার ঘন অন্ধকারে চার দিক আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। আবু বকর তার বাড়ির দিকে ফিরে আসছিলেন। পথিমধ্যে তার মাথা ঘুরতে শুরু করল। বাড়িতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে তার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেল। হেকিম ডাকা হল। হেকিম গভীরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জিজ্ঞেস করলেন, “কিছুক্ষণ পূর্বে আপনি কি কিছু খেয়েছিলেন?
আবু বকর একটি মেয়ের সাথে তার সাক্ষাতের ঘটনা বর্ণনা করে বললেন, মেয়েটি তাকে একটি আপেল খেতে দিয়েছিল।
‘আপেলের ভিতর হয়তো বিষাক্ত কোন পোকা ছিল।’ হেকিম বললেন। “কিংবা বিষাক্ত কোন পোকা আপেলের উপর দিয়ে হেঁটে গেছে অথবা কৌশলে তার ভিতর বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আবু বকর মেয়েটির কথা বলতে বলতে ছটফট করতে লাগলেন। হেকিম তাকে ঔষুধ দিলেন, কিন্তু ঔষুধে কোন কাজ করল না।
***
মুসা বিন নুসাইরকে সংবাদ দেওয়া হল। তিনি আরেকজনকে এ্যাশবেলিয়ার প্রশাসক নিযুক্ত করলেন। ইতিহাসের কোথাও তার নাম উল্লেখ করা হয়নি।
আবু বকরের মৃত্যুর দুই-তিন দিন পর সেনাবাহিনীর এক সহকারী সেনাপতি ঐ মেয়ের হাত থেকে কিছু একটা খেয়ে মারা গেলেন। এই ঘটনার দুই-তিন দিন অতিবাহিত হতে না হতেই একজন মুসলিম প্রশাসক রাতের বেলা শহরের কোন এক গলি দিয়ে একাকী হেঁটে যাচ্ছিলেন। এমন সময় পিছন দিক থেকে খঞ্জর মেরে তাকে হত্যা করা হল। সকালে সেই গলিতে তার লাশ পাওয়া গেল। এভাবে দুই-তিন দিনের ব্যবধানে ত্রিশজন মুসলিম প্রশাসককে হত্যা করা হল। কেউ বিষপানে মারা গেল, কেউ বা তলোয়ারের আঘাতে, আর কেউ মারা গেল খঞ্জরের আঘাতে। ইতিহাস গ্রন্থে এমন গুপ্ত হত্যার শিকার প্রশাসকের সংখ্যা ত্রিশজন উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রফেসর ডোজি এবং ডা. কোডে লেখেছেন, মুসা বিন নুসাইরকে ঘটনা সম্পর্কে এভাবে অবগত করা হল।
‘ত্রিশজন ছোট-বড় প্রশাসকের রহস্যজনক মৃত্যু এই প্রমাণ বহন করছে যে, আমাদের বিরুদ্ধে কোন কঠিন ষড়যন্ত্র কাজ করছে। পরাজিত খ্রিস্টান সম্প্রদায় সম্ভবত এই ষড়যন্ত্রের পিছনে আছে। ষড়যন্ত্রের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল, রাজস্ব আদায়ে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করা হচ্ছে। সরকারি বিধি-নিষেধ পালনে লোকজন খুবই অবহেলার পরিচয় দিচ্ছে। আরেকটি ভয়াবহ সংবাদ হল এই যে, যুদ্ধ বন্দীদেরকে নিরস্ত্র রাখা হত এবং তাদের থেকে সাধারণ শ্রমিকের কাজ নেওয়া হত। জানা গেছে যে, বেশ কয়েকজন যুদ্ধবন্দী অস্ত্র হাতিয়ে নিয়ে কোথাও যেন লুকিয়ে রেখেছে। এখনই যদি এই অবস্থার পরিবর্তন না করা হয় তাহলে যে কোন সময় এ্যাশবেলিয়ায় বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে।‘
ইহুদিরা এতটাই সংগোপনে খ্রিস্টানদেরকে বিদ্রোহের জন্য উদ্বুদ্ধ করছিল, যাতে সন্দেহের তীর খ্রিস্টানদের দিকেই যায়। ইহুদিদের কথা কারও চিন্তায়ও আসেনি। উঁহুদি ও খ্রিস্টানদের উপাসনালয় এক হয়ে গিয়েছিল। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মেয়েদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছিল।
মুসা বিন নুসাইর ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহের সংবাদ পাওয়া মাত্রই তার বড় ছেলে আবদুল আযীযকে বললেন, সাত-আটশ সিপাহী নিয়ে এখনই এ্যাশবেলিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাও। তিনি আরও নির্দেশ দিলেন, বিদ্রোহ শুধু দমনই করবে না, বরং যারা এই বিদ্রোহের সাথে জড়িত তাদেরকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসবে।
‘ষড়যন্ত্রকারীদের সর্বনিম্ন শাস্তি দেবে মৃত্যুদণ্ড।’ মুসা বিন নুসাইর আবদুল আযীযকে লক্ষ্য করে বললেন। আমার সন্দেহ হচ্ছে, এই ষড়যন্ত্রের পিছনে ইহুদিদের হাত রয়েছে।
“ইহুদি’ আবদুল আযীয আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। ইহুদিরা তো আমাদের সাথে রয়েছে।
‘ইহুদিরা ইহুদি ছাড়া আর কারও সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে না। মুসা বিন নুসাইর বললেন। ইহুদিদেরকে তো স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই ষড়যন্ত্রকারী সম্প্রদায় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাছাড়া কখনই কাউকে সন্দেহের উর্ধ্বে মনে করবে না।
***
আবদুল আযীয তার খ্রিস্টান স্ত্রী এজেলুনাকে নিয়ে এ্যাশবেলিয়া পৌঁছে গেলেন। তার সাথে ছিল সাতশ চৌকস সিপাহী। এ্যাশবেলিয়া পৌঁছেই তিনি গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধানকে ডেকে কঠোরভাবে নির্দেশ দিলেন যে, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত করে বের করতে হবে, বিদ্রোহ কীভাবে শুরু হয়েছে এবং এই বিদ্রোহের পিছনে কাদের হাত রয়েছে। অতঃপর তিনি যুদ্ধবন্দীদের যারা প্রতিদিন পারিশ্রমিকের মাধ্যমে কাজ করত, তাদেরকে একত্রিত করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন, তাদের মধ্যে কারা অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে?
যুদ্ধবন্দীরা ভয় পেয়ে অস্বীকার করল। আবদুল আযীয দুজন আরব প্রশাসসকে দায়িত্ব দিলেন, তারা যেন একেকজন যুদ্ধবন্দীকে উদ্বুদ্ধ করে অপরজন সম্পর্কে তথ্য প্রদান করতে। সহজে যদি তারা মুখ না খুলে তাহলে তাদেরকে মুখ খুলতে বাধ্য করবে। প্রয়োজনে তাদেরকে মৃত্যুর হুকমী দেবে কিংবা এই লোভ দেখাবে যে, যারা সঠিক তথ্য দেবে তাদেরকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হবে।
আবদুল আযীযের এই পলিসি বেশ সফলই মনে হচ্ছিল। চারজনকে চিহ্নিত করা হল। তিনজন খ্রিস্টান, আর একজন ইহুদি। অস্ত্র-শস্ত্র একটি গির্জায় একত্রিত করা হচ্ছিল। চিহ্নিত চারজনকে গ্রেফতার করা হল। এই ষড়যন্ত্রের সাথে যারা জড়িত তাদেরকে খুঁজে বের করার জন্য গ্রেফতারকৃতদেরকে কঠোর শস্তি দেওয়া হল। তারা আরও দুইজনের কথা স্বীকার করল। তাদেরকেও গ্রেফতার করা হল।
এজেলুনা লক্ষ্য করছিল, আবদুল আযীয এত বেশি অস্থিরতা আর পেরেশানীর মাঝে সময় অতিবাহিত করছিলেন যে, রাতে ভালোমত তার ঘুমও আসছিল না।
‘আযীয! এক রাতে এজেলুনা তার স্বামীকে বিদ্রি রজনী যাপন করতে দেখে বলল। সকল প্রশাসকরা দিন-রাত বিদ্রোহীদের খুঁজে দৌড়-ঝাঁপ করছে। তারপরও আপনি এত পেরেশান হচ্ছেন কেন? আপনি যখনই যে নির্দেশ দিচ্ছেন, তখনই তা পালন করা হচ্ছে।’
‘বিদ্রোহের ছোট্ট একটা স্ফুলিঙ্গ গোটা রাজ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে। আবদুল আযীয বললেন। আমার দায়িত্ব হল এই রাজ্যকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করা। তুমি তো জান, এ রাজ্যে আমরা অনেক জান কুরবান করেছি। সেসকল শহীদানের সামনে এবং মহান আল্লাহর সামনে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। সেদিনই আমার চোখে ঘুম আসবে, যেদিন বিদ্রোহীদের সর্বশেষ ব্যক্তিকে আমার সামনে হত্যা করা হবে। একটু চিন্তা করে দেখ, যদি বিদ্রোহীরা সফল হয়ে যায় তাহলে আমাদের পরিণতি কী হবে? আমাকে হত্যা করা হবে, আর বিদ্রোহীদের সরদার তোমার সাথে পাশবিক আচরণ করবে। তুমি তো রানী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে, তাই না? একটু ভেবে দেখ, আমরা পরাজিত হলে তোমার সেই স্বপ্ন কি সত্য হবে?
আবদুল আযীয পরিস্থিতির ভয়াবহতা এমনভাবে তুলে ধরলেন যে, এজেলুনার শরীর শিহরে উঠল।
‘আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই।’ এজেলুনা বলল। ‘অনুমতি হলে আমি এই ষড়যন্ত্রের শিকড় খুঁজে বের করতে সক্ষম হব।
‘তুমি কী করবে?’ আবদুল আযীয জিজ্ঞেস করলেন।
‘আমি আগামীকাল বড় গির্জায় যাব।’ এজেলুনা বলল। আমি বড় পাদ্রিকে বলব, আমি এক মুসলমানকে বিয়ে করেছি ঠিক, কিন্তু খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করিনি। তারপর আমি যা কিছু করব, তা আপনি জানতে পারবেন।
আবদুল আযীয তাকে অনুমতি দিলেন।
***
পরদিন সকালে এজেলুনা বড় গির্জায় চলে গেল। বড় পাদ্রি তাকে দেখে হতবাক হয়ে গেল।
‘আমি তো শুনেছি, আপনি এক মুসলিম কমান্ডারকে বিয়ে করেছেন। পাদ্রি বলল। এখন গির্জায় আপনার আবার কি কাজ?
‘গির্জায়-ই তো আমার কাজ।’ এজেলুনা মুচকি হেসে বলল। গির্জার সম্মান রক্ষার্থে আমি যে কাজ করেছি, আপনারা সকল পুরুষ মিলেও তা করতে পারেননি।
এ কথা বলেই এজেলুনা বৃদ্ধ পাদ্রির হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। এজেলুনার মুচকি হাসিতে ছিল জাদুময়ী আকর্ষণ। সেই জাদুকে অট্টহাসি আরও বেশি মোহনীয় করে তুলল। তার উপর এজেলুনা পাদ্রির হাতকে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিল। সে যুগের পাদ্রিরা গির্জার সেবিকাদেরকে নিজেদের রক্ষিতা বানিয়ে রাখত। এজেলুনা ছিল অসাধারণ সুন্দরী এবং আকর্ষণীয় যৌবনের অধিকারী। পাদ্রির চেহারার রং মুহূর্তে বদলে গেল। পলকের জন্য তার চোখ দুটি জ্বলসে উঠল। তার ঠোঁটের কোণে এমন এক রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে পড়ল, যা কোন নতুন সেবিকাকে দেখলে ছড়িয়ে পড়ত।
‘তাহলে কি তুমি অন্য কোন অভিপ্রায়ে ঐ সালারকে বিয়ে করেছ?’ পাদ্রি এজেলুনাকে জিজ্ঞেস করল।
‘হা!’ এজেলুনা প্রতিউত্তরে বলল। সর্বপ্রথম আমি এ ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে চাই যে, আপনি আমার সব কথা গোপন রাখবেন। আমি উপাসনা করার বাহানায় গির্জায় আপনার কাছে এসেছি। আমাকে একজন বন্ধু মনে করে কথা বলতে পারেন। আমাকে কোন বাদশাহর বিধবা স্ত্রী বা কোন বিজয়ী সালারের বিবাহিতা স্ত্রী মনে করবেন না।
‘একি বলছ তুমি, এজেলুনা! পাদ্রি বলল। আমি গির্জায় বসে আছি। তুমি যদি বল তাহলে আমি কুমারী মরিয়মের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে, কুশ হাতে নিয়ে কসম খেয়ে বলতে পারি যে …।
‘না, ফাদার। এজেলুনা তাকে বাধা দিয়ে বলল। আপনার এই একটি বাক্যই আমার কাছে কসম খাওয়ার সমতুল্য। আমি বলছিলাম যে, আমি ঐ সালারের সাথে বিয়ে করেছি ঠিকইকিন্তু নিজ ধর্ম বিসর্জন দেইনি। সে আমাকে পাওয়ার জন্য এতটাই পাগলপারা হয়ে পড়েছিল যে, আমার সকল শর্ত সে মেনে নিয়েছে। আমি তাকে খুশী করার জন্য বলেছিলাম, কয়েকটা দিন অতিবাহিত হতে দিন। দেখবেন, আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নেব।’
‘এটা তোমার সৌন্দর্যের কারিশমা। পাদ্রি হাসতে হাসতে বলল।
‘তাই যদি হয় তাহলে আমি আমার সৌন্দর্য দ্বারা আরও বেশি ফায়দা উঠাতে চাই।’ এজেলুনা বলল। আমার স্বামী এখানের বিদ্রোহের আগুন নিভানোর জন্য এসেছেন, আর আমি বিদ্রোহের সেই আগুন আরও তীব্র করার জন্য এসেছি। আমি জানি, যেসব লোক ধরা পড়েছে, তারা দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর লিডার। মূল পরিকল্পনাকারীরা আত্মগোপন করে আছে। আমি জানতে চাই, তারা কারা এবং কোথায় আছে? তাদেরকে বাঁচানোর ব্যবস্থা আমি করতে চাই।’
‘তুমি কি তোমার স্বামীকে বলবে, তাদেরকে ক্ষমা করে দিতে। পাদ্রি বলল।
‘না, ফাদার!’ এজেলুনা বলল। আমার স্বামী কাউকে ক্ষমা করবেন না। আমার স্বামীর অবস্থা হল এমন যে, তার কাছে কেউ যদি কারও নাম পেশ করে তাহলে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে তার উপর এমন নির্যাতন করা হয় যে, দুই-তিন দিনের মধ্যে সে মারা যায়। কেউ যদি না মরে তাহলে তাকে হত্যা করা হয়। আমি এমন ব্যবস্থা করে রেখেছি যে, সকলকে এখান থেকে বের করে দিতে পারব। আপনি হয়তো দেখেছেন যে, শহরের একটি মাত্র ফটক খোলা আছে। যারা বাইরে যেতে চায় তাদের সকলের ব্যাপারে ভালোভাবে খোঁজ-খবর নেওয়া হয়। আমি এসকল লোকদেরকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এখান থেকে বের হতে সাহায্য করব।’
‘সবার আগে আমাকে এখান থেকে বের কর। পাদ্রি বলল। “এ গির্জাই হল, বিদ্রোহের প্রধান ঘাটি।
‘আমি এটা জানি।’ এজেলুনা মিথ্যা বানিয়ে বলল। আমি এই ঘাটিকে বহাল রাখতে চাই। আমার ব্যাপারে আপনার বিশ্বাস থাকা উচিত যে, আমি সালার আবদুল আযীযকে শুধু এজন্য বিয়ে করেছি, যাতে ইসলামী সালতানাতকে অন্তঃসারশূন্য করে চিরতরে খতম করে দিতে পারি। আমি এটা কীভাবে করব, সে প্রশ্ন আমাকে করবেন না। শুধু এতটুকু বলছি যে, আমি আমার শ্বশুরকে আমার রূপের মোহে আবদ্ধ করে তার সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলব। তারপর আমি এমন নাটক শুরু করব যে, বাপ-বেটা একজন আরেকজনের খুনপিয়াসী হয়ে যাবে।
‘তোমার প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। পাদ্রি বলল।
এজেলুনা তার রূপ-যৌবনের মোহজালে আর মিষ্টি কথার মাধুর্যে পাদ্রিকে একেবারে অভিভূত কলে ফেলল।
‘এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব যদি তুমি তোমার হাতে তুলে নাও তাহলে আশা করা যায় আমরা কামিয়াব হতে পারব।’ পাদ্রি বলল।
‘আমরা অবশ্যই কামিয়াব হব।’ এজেলুনা বলল। আমাদেরকে অবশ্যই কামিয়াব হতে হবে। যদি আমরা কামিয়াব হতে না পারি তাহলে আমি জানি, খ্রিস্টবাদ ও আমাদের পরণতি কী হবে? আপনার মিশনে যারা রয়েছে, তাদের সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিন। তারা কি আগামীকাল এ সময় এখানে আসতে পারবে?
‘তারা সকলে এসে পড়বে। পাদ্রি বলল।
‘আমিও আসব।’ এ কথা বলেই এজেলুনা উঠে দাঁড়াল। পাদ্রিও উঠে দাঁড়াল। এজেলুনা তার দুই বাহু প্রসারিত করে দিল। পাদ্রি ধারণ করতে পারেনি যে, এজেলুনা এতটা সাহসের পরিচয় দেবে। পাদ্রি প্রথমে কিছুটা ইতস্তত করছিল, তারপর এজেলুনার বাহু-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল। এজেলুনা পাদ্রিকে জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁটে চুমু খেল।
‘আমি এই গির্জার সেবিকা হতে চাই।’ এজেলুনা বলল। তবে আন্দালুসিয়ার বিজয় নিশ্চিত করার পর। এটাই আমার জীবনের একমাত্র মিশন।
এজেলুনা পাদ্রির বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে চলে গেল। পাদ্রি পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল। সে এজেলুনার গোড়াগাড়ির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল। ঘোড়ার খুড়ের আওয়াজও তার কানে আসছিল। কিন্তু পাদ্রির চেহারায় এমন এক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পাচ্ছিল যে, মনে হচ্ছিল, সে এখনও এজেলুনার শরীরের উষ্ণতা অনুভব করছে।
***
দ্বিতীয় দিন এজেলুনা সেই গির্জায় এসে উপস্থিত হল। এজেলুনা গতকাল যে কামরায় পাদ্রির সাথে দেখা করেছিল, সে কামরার পরিবর্তে অন্য এক কামরায় এসে উপস্থিত হল। এ কামরাটি চতুর্দিক থেকে বেশ কয়েকটি কামরা দ্বারা বেষ্টিত ছিল। গির্জার বাইরে আট-দশজন প্রহরী পাহারা দিচ্ছিল। তারা এজন্য পাহারা দিচ্ছিল যে, সন্দেহভাজন কেউ এসে পড়লে সাথে সাথে ভিতরে সংবাদ পৌঁছাবে।
আজকের এই আলোচনা সভায় বার-তেরজন ব্যক্তি উপস্থিত হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন হল ইহুদি। বিদ্রোহ সৃষ্টির পিছনে এদের সকলেরই হাত আছে। এখনও পর্যন্ত তাদের টিকিটির সন্ধান পাওয়া যায়নি।
‘রানী এজেলুনা!’ একজন ইহুদি প্রথমে কথা বলল। আমরা আপনাকে এ ব্যাপারে সতর্ক করতে চাচ্ছি যে, আপনি যদি আমাদেরকে ধোঁকা দেন তাহলে আমরা গ্রেফতার হব এবং আমাদেরকে হত্যা করা হবে। কিন্তু আপনিও বেঁচে থাকতে পারবেন না। আমরা এমন ব্যবস্থা করে রেখেছি। আমাদের লোকেরা আপনাকে সাথে সাথে হত্যা করবে না; বরং আপনাকে অপহরণ করা হবে। আপনি নিশ্চয় ভাবতে পারছেন, অপহরণ করার পর আপনার সাথে কী ধরনের আচরণ করা হবে? আপনাকে তখনই ছাড়া হবে যখন আপনার নির্মম মৃত্যু হবে।’
‘আপনাদেরকেও হত্যা করা হবে না এবং আমাকেও অপহরণ করার প্রয়োজন হবে না।’ এজেলুনা বলল। আমার মনে হয়, ফাদার আমার সম্পর্কে আপনাকে সব কিছু খুলে বলেননি।
“তিনি সবকিছু বলেছেন।’ ইহুদি বলল। অন্যথায় আমরা এখানে উপস্থিত হতাম না। তারপরও আপনাকে সতর্ক করা আমাদের কর্তব্য। এটা আমরা কীভাবে ভুলতে পারি যে, আপনি একজন মুসলমান কমান্ডারের বিবাহিতা স্ত্রী। স্বাভাবিকভাবেই আপনি আপনার স্বামীর সাথে বিশ্বস্ততার পরিচয় দেবেন।
‘আমার বিশ্বস্ততা একমাত্র গির্জার সাথে।’ এজেলুনা বলল। আমার স্বামীকে আমি আমার প্রতি আস্থাশীল করে গড়ে তুলেছি। সে আমার প্রতি এতটাই দুর্বল যে, আমি যে কোন কথাই তাকে বিশ্বাস করাতে পারি।’
‘আমার মনে হয়, আপনি স্বপ্ন দেখছেন। অন্য একজন বলল। আপনার এই স্বামী কিছু দিন পর যখন অন্য কোন শহর বা রাজ্য জয় করবে তখন সেখানে আপনার মত কোন সুন্দরী তার পছন্দ হলে, তার প্রতি সে দুর্বল হয়ে পড়বে। আর আপনি তখন তার কাছে গুরুত্বহীন হয়ে যাবেন।
এমন সময় আসার পূর্বেই আমাদের বিদ্রোহ সফল হয়ে যাবে।’ এজেলুনা বলল। আপনি কি জানেন না যে, মালাগা ও গ্রানাডায়ও বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে? বিদ্রোহের এই আগুন আরও ছড়িয়ে দিতে হবে। এটা আপনাদের কাজ। আমার দায়িত্ব হল, উপযুক্ত সময়ে বিষ প্রয়োগ করে বা অন্য কোন উপায়ে আমার স্বামীকে হত্যা করা। কিন্তু এখন আমার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হল, আমার স্বামীর চোখে ধুলো দিয়ে আপনাদের সকলকে গ্রেফতারির হাত থেকে রক্ষা করা। এই শহর ত্যাগ করা আপনাদের জন্য একান্ত জরুরি। এযাবত যারা গ্রেফতার হয়েছে, তাদের কেউ জীবন বাঁচানোর জন্য আপনাদের নাম বলে দিতে পারে। এখান থেকে বের হয়ে আপনাদেরকে নিশ্চিন্তে বসে থাকলে চলবে না। আন্দালুসিয়ার প্রতিটি ঘরে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে হবে আপনাদের।
‘এ ছাড়া আমাদের আর কোন উপায়ও নেই। একজন ইহুদি বলল। মুসলিম বাহিনীর কাছে এত বিপুল সংখ্যক সিপাহী নেই যে, তারা সমগ্র দেশের বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হবে।’
‘আমি একটা কথা বলতে চাই। অন্য ইহুদি বলল। যেখানেই বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে, সেখানেই ইহুদিরা মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। আমরা বাদশাহ রডারিকের আচরণে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আপনি ভালভাবেই জানেন, সমাজে আমাদের অবস্থান কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল? আমরা মুসলমানদের সাথে মিলে রডারিককে সিংহাসন থেকে উচ্ছেদ করেছি। এখন আমরা মুসলমানদের মূলোৎপাটন করছি। তাদেরকে আমরা শান্তিতে থাকতে দেব না। তবে আমরা এখানে আমাদের রাজত্বও প্রতিষ্ঠা করব না। রাজত্ব থাকবে খ্রিস্টানদের। আমরা শুধু এতটুকু চাই যে, এই রাজ্যে এবং রাজ দরবারে খ্রিস্টানদেরকে যতটা সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করা হয়, ততটা সম্মান ও মর্যাদা যেন ইহুদিদেরকেও প্রদান করা হয়।
এর চেয়েও বেশি সম্মান তোমাদেরকে প্রদান করা হবে। এক খ্রিস্টান লিডার বলল। তোমরা যে কাজ করতে পার, খ্রিস্টানরা তা করতে পারে না। ইহুদিদের এই কাজের প্রতিদান, তাদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি দেওয়া হবে।
‘আপনারা নিশ্চিন্ত মনে কাজ করে যান।’ এজেলুনা বলল। ‘অধিকার ও প্রাপ্তির বিষয়টি পরে বিবেচনা করা হবে। এখন আপনারা সকলে এই শহর থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। আমি আপনাদেরকে বলছি, কোন্ ছদ্মবেশে আপনারা এখান থেকে বের হবেন।’
ইতিহাসের বিভিন্ন রেকর্ড থেকে জানা যায় যে, এজেলুনা তাদেরকে বলেছিল, তারা যেন ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে পনের-বিশটি খচ্চরে কাঁচা তরকারি ও বিভিন্ন সামানপত্র বোঝাই করে শহরের ফটকের দিকে রওনা হয়। এ রাজ্যের বড় ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে তিন-চারজন লোক তাদের সাথে থাকবে। তারা ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, তারা হলেন, কর্ডোভার সম্মানিত বণিক দল। তারা তাদের ব্যবসায়ী পণ্য বিক্রি করে এখান থেকে পণ্য ক্রয় করে নিজ দেশে চলে যাচ্ছে।’
এজেলুনা একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে দিয়ে তাদেরকে সেখানে সমবেত হতে বলল।
দ্বিতীয় দিন এগারজনের একটি বণিক দল সতের-আঠারটি খচ্চর নিয়ে সীমান্তবর্তী একটি জায়গায় দাঁড়াল। এই বণিক দলের সাথে আরও তিন-চারজন ব্যক্তি এসে মিলিত হল। এরাও বিদ্রোহের সাথে জড়িত ছিল। তারা সকলেই ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশধারী লোকদের জন্য অপেক্ষা করছিল। কথা ছিল, ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশধারী লোকেরা এসে তাদেরকে ফটক পার হওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করবে। এজেলুনা তাদেরকে বলেছিল, ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশ ধারণকারী লোকেরা তার নিজস্ব লোক হবে।
বিদ্রোহী নেতারা ব্যবসায়ীদের পথ চেয়ে অপেক্ষা করছিল। এমন সময় হঠাৎ চল্লিশ-পঞ্চাশজনের একটি অশ্বারোহী দল সেখানে এসে উপস্থিত হল। তাদেরকে দেখে বিদ্রোহী নেতারা মুখ ঘুরিয়ে নিল। অশ্বারোহী দলটি দুজন দুজন করে বিদ্রোহী নেতাদের নিকট দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। অশ্বারোহী দলের প্রায় অর্ধেক সদস্য বিদ্রোহী নেতাদেরকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেল। এমন সময় হঠাৎ তারা পেছন ফিরে বিদ্রোহী নেতাদেরকে ঘিরে ফেলল। সকল অশ্বারোহীর কাছে বর্শা ছিল। তারা তাদের বর্শার অগ্রভাগ বিদ্রোহী নেতাদের বুকের উপর চেপে ধরল।
‘তোমরা সকলে বন্দী। অশ্বারোহী দলের কমান্ডার বলল। নীরবে আমাদের সামনে সামনে চলতে থাকে।
অশ্বারোহী দলটি বিদ্রোহী নেতাদেরকে নিয়ে আবদুল আযীযের সামনে উপস্থিত হল।
সকলকে হত্যা করে ফেলে।’ আবদুল আযীয নির্দেশ দিলেন।
সাথে সাথে নির্দেশ পালন করা হল। আর সেই সাথে বিদ্রোহের আশঙ্কা একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেল।
‘এখন নিশ্চয় আমার প্রতি আপনার পূর্ণ আস্থা সৃষ্টি হয়েছে? এজেলুনা আবদুল আযীযকে বলল। আমি আমার সম্প্রদায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরকে ধোকা দিয়ে হত্যা করিয়েছি। আপনাকে বিয়ে করে যদিও আমি আপনার ধর্ম গ্রহণ করেনি, তাতে কী হয়েছে? আমার ভালোবাসাই আমার ধর্ম। আমি আপনার উপাসনা করি।’
আবদুল আযীয শুরু থেকেই এজেলুনার জন্য জীবন উৎসর্গ করে বসেছিল। তিনি এজেলুনার প্রতি এতটাই আসক্ত ছিলেন যে, বিয়ের পরও তাকে খ্রিস্টান থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন। আর এখন এজেলুনার এই বিশাল কৃতিত্বের জন্য তিনি তার আজ্ঞাবহ কৃতদাসে পরিণত হয়ে গেলেন। এজেলুনা বিদ্রোহের সকল নেতাকে ধরিয়ে দিয়ে সমূলে বিদ্রোহের মূলোৎপাটন করল। বিদ্রোহ সৃষ্টির অপরাধে অভিযুক্তদের মধ্যে বড় পাদ্রিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। অন্যান্য বিদ্রোহীদের সাথে তাকেও হত্যা করা হল।
আবদুল আযীয বিদ্রোহ সৃষ্টির অপরাধে নব্বইজন খ্রিস্টান এবং কয়েকজন ইহুদি নেতা ও তাদের সহযোগীদেরকে হত্যা করেন। ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিক লেনপুল ও এইচপি স্কাট তাদের রচনায় আবদুল আযীযের বিরুদ্ধে অনেক বিষোদগার করেন। তারা লেখেন, বিদ্রোহীরা মাত্র ত্রিশজন আরব প্রশাসককে হত্যা করেছিল। প্রতিশোধ হিসেবে আবদুল আযীয প্রায় একশজন খ্রিস্টান ও ইহুদিকে হত্যা করেন। এ সকল লোকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন খ্রিস্টান পাদ্রি ও ইহুদি রাব্বী (ইহুদিদের ধর্মীয় নেতা) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
এজেলুনা আবদুল আযীযকে সবিস্তারে বলেছিল যে, ইহুদিরাই বিদ্রোহের পেছনে ইন্ধন যোগাচ্ছে। তারা মুসলমানদেরকে সবচেয়ে বড় দুশমন মনে করে। মুসলমানদেরকে সাহায্য করার কারণে ইহুদিদেরকে অনেক জায়গির প্রদান করা হয়েছিল। আবদুল আযীয ইহুদিদের থেকে সমস্ত জায়গির ছিনিয়ে নেন এবং সরকারি পদ ও পদবী থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করেন। খ্রিস্টানদের শাসনামলে ইহুদিরা যতটা লাঞ্ছিত ও ধিকৃত ছিল, মুসলমানদের শাসনামলে তার চেয়েও বেশি লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার শিকারে পরিণত হল। মূলত ইহুদি সম্প্রদায় এমনই লাঞ্ছনা-গঞ্জনার উপযুক্ত ছিল।
যেসকল শহরে বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠছিল, আবদুল আযীয সেসকল শহরে গিয়ে চিরণী অভিযান পরিচালনা করেন এবং অপরাধীদেরকে কঠোর হস্তে দমন করেন। ফলে সকল বিজিত শহর বিদ্রোহীদের কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত হয়ে যায়।