আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতে / মূল: এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ / অনুবাদ: মুহাম্মদ শফিউল আলম
অর্পণ:
প্রিয়তমা স্ত্রীকে,
আমার মতো অভাজন যাকে কিছুই দিতে পারেনি। তার এক পাশে আবদুল্লাহ মারযুক সাদী আর অন্য পাশে আবদুল্লাহ মাসরুর মাহদী। যাদেরকে নিয়ে আমার দিনের সাধনা, আর রাতের আরাধনা। যাদের সুখের জন্য আমি বিনিদ্র রজনী যাপন করি, যাদের কল্যাণের জন্য আমি নিরলস দিবস অতিবাহিত করি।
—অনুবাদক
.
প্রথম সংস্করণের প্রসঙ্গ–কথা
৭১১ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই জুলাই কয়েক হাজার অকুতোভয় মর্দে মুজাহিদ আন্দালুসিয়ার (স্পেন) সমুদ্রসৈকতে অবতরণ করার পর নিজেদের রণতরী জ্বালিয়ে দেন, যেন ফিরে যাওয়ার কোন উপায় না থাকে। রণতরী জ্বালিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাঁরা বীরত্ব ও সাহসিকতার এমন এক কীর্তিগাথা রচনা করেন, যা ইসলামী ইতিহাসে অত্যন্ত বিস্ময়কর ও ঈমান-জাগানিয়া ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত। এই অমর বীরত্বগাথা নিয়ে রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতে।
এমনিতেই আমাদের সমাজে ইতিহাস অধ্যয়নের আগ্রহ খুবই কম, তার উপর ইসলামী ইতিহাস অধ্যয়নের আগ্রহ নেই বললেই চলে। এ কারণেই বোধ হয়, বাংলা ভাষায় ইসলামী ইতিহাস নিয়ে মৌলিক কোন রচনা তেমন একটা দেখা যায় না। বাংলা ভাষায় যেসব ইসলামী ইতিহাস আমরা দেখতে পাই, তার বেশির ভাগই বিদেশী ভাষার অনুবাদ।
ইসলামী ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে উর্দু সাহিত্যকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ বলেই মনে হয়। তাই আমরা দেখতে পাই, উর্দু ভাষায় মৌলিক ইসলামী সাহিত্যের পাশাপাশি ইসলামী ইতিহাস নির্ভর উপন্যাসের বিশাল সংগ্রহ গড়ে উঠেছে এবং সেসব ঐতিহাসিক উপন্যাস বাংলা ভাষায় অনুদিত হয়ে বাংলা ভাষার ভাণ্ডারকে সুসমৃদ্ধ করছে।
উর্দু ভাষায় ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করে যে সকল উপন্যাসিক আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমাদ্ভূত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ অন্যতম। তিনি তাঁর অনবদ্য রচনাশৈলী ও শিকড়সন্ধানী লেখনীর মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যে বিশেষ অবস্থান গড়ে তুলেছেন। তাঁর লেখালেখির বিষয়-বস্তু ইতিহাসের মতো একটি রস-কষহীন বিষয় হলেও তিনি তাঁর নান্দনিক উপস্থাপনা ও বিশ্লেষণধর্মী আলোচনার মাধ্যমে এমন একটি সাবলিল আবহ সৃষ্টি করেন যে, পাঠকগোষ্ঠী মোহমুগ্ধ হয়ে পড়েন।
এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস রচনা করলেও ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠতা কোথাও লজ্জিত হতে দেন না। এখানেই অন্যান্য উপন্যাসিকের সঙ্গে তাঁর স্বাতন্ত্র সুনির্দিষ্ট। তাঁর যুগে এবং পরবর্তী সময়ে অনেকেই ইসলামী ইতিহাসকে আশ্রয় করে উপন্যাস রচনা করেছেন; কিন্তু নির্মম সত্য হলো, তাদের অনেকেই ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠতা লঙ্ঘন করেছেন। তারা কাল্পনিক পাত্র-পাত্রির মাধ্যমে প্রেম-প্রীতির আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছেন এবং খালেদ বিন ওয়ালিদ, মুহাম্মদ বিন কাসেম ও তারিক বিন যিয়াদের মতো ইতিহাসখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্বদেরকে সিনেমার নায়ক-নায়িকার সমপর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। পক্ষান্তরে এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরেছেন। পাঠক তাঁর লেখায় তথ্যসূত্রসহ পরিপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস দেখতে পাবেন। সেই সঙ্গে উপন্যাসের যাবতীয় উপকরণ, রোমাঞ্চ ও এ্যাডভেঞ্চার উপভোগ করবেন।
অনুবাদটি সুখপাঠ্য করার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে চেষ্টার কোন ত্রুটি করা হয়নি, তারপরও ভুল-ক্রটি থেকে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই স্বহৃদয় পাঠকের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করছি।
—মুহাম্মদ শফিউল আলম
মোবাইল : ০১৯১ ৬০০৯১৫৯
.
অখণ্ড সংস্করণের প্রসঙ্গ–কথা
‘আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতে’ বিশাল কলেবরে লেখা ঐতিহাসিক এক উপন্যাস। পাঠকের সুবিধার কথা চিন্তা করে তিন খণ্ডে উপন্যাসটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সে অনুযায়ী নাদিয়াতুল কুরআন প্রকাশনী থেকে ‘আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় আট বছর আগে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে। প্রথম খণ্ড প্রকাশের পর পাঠকদের প্রচণ্ড চাহিদা এবং দ্বিতীয় খণ্ডের জন্য বারবার তাগাদার ফলে অল্প সময়ের মধ্যে দ্বিতীয় খণ্ডের কাজ সমাপ্ত করে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে উক্ত প্রকাশনীর পক্ষ থেকে অবশিষ্ট খণ্ডগুলো প্রকাশে অপারগতা প্রকাশ করা হয়। ফলে তৃতীয় খণ্ডের কাজ একেবারে থমকে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ না হওয়ার বেদনায় আর অন্য কাজের ব্যস্ততায় ‘আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতে’র তৃতীয় খণ্ড সমাপ্ত করা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি। কালেভদ্রে তৃতীয় খণ্ড নিয়ে বসলেও কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি। যদিও অধিকাংশ কাজ ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছিল। এভাবে দিন-সপ্তাহ-মাস-বছর গড়িয়ে যেতে থাকে।
অবশেষে ২০১৫ সালে ডিসেম্বর মাসে প্রকাশনা জগতে ‘পয়গাম প্রকাশন’ আত্মপ্রকাশ করলে কিছু গ্রন্থ প্রস্তুত করার দায়িত্ব আমার উপর ন্যস্ত হয়। এই সুযোগে ‘আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতের তৃতীয় খণ্ডের কাজ সমাপ্ত করার তাগাদা অনুভব করি এবং যথা সময়ে তৃতীয় খণ্ডের কাজ সমাপ্ত হয়। কিন্তু পয়গাম প্রকাশন’ খণ্ড খণ্ড রূপে উপন্যাসটি প্রকাশ করতে চায় না, বরং সম্পূর্ণ উপন্যাসটি এক সঙ্গে এক মলাটের ভিতরে প্রকাশ করতে চায়। এতে করে প্রকাশকের যেমন ব্যয়-সংকোচন হবে, তেমনি পাঠককেও অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করতে হবে না। তার উপর এক সঙ্গে সম্পূর্ণ উপন্যাস পড়ার আনন্দ পাঠকের জন্য ‘উপরি পাওনা’ থাকবে।
প্রকাশকের খরচ কমল, আর পাঠকের সাশ্রয় হল, কিন্তু অনুবাদক হিসেবে সব ভার এসে পড়ল আমার কাঁধে। আগাগোড়া সম্পূর্ণ উপন্যাস দেখতে গিয়ে অনেক অসঙ্গতি দৃষ্টিগোচর হল। বিশেষ করে উর্দু ভার্সনে স্থানসমূহের যে নাম ব্যবহার হয়েছে, সেগুলোর সাথে আমাদের দেশে প্রচলিত নামের বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। যেমন, উর্দু ভার্সনে আছে ‘গোয়াডিলেট। এটি একটি নদীর নাম। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা এই নদীকে চিনি ‘গুইডেল কুইভার’ নামে। ব্যক্তি ও স্থানের নামের ব্যাপারে এমন অসংখ্য অমিল আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। তারপরও যেহেতু উর্দু থেকে গ্রন্থটি অনুবাদ করা হয়েছে, সেহেতু উর্দু ভার্সনে যেমনটি লেখা আছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটিই বহাল রেখেছি। তবে অল্প কিছু ক্ষেত্রে আমরা পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে।
সবচেয়ে বড় যে কৈফিয়তটি পাঠকের সামনে আমাকে দিতে হবে, তা হল অনুবাদকের নাম নিয়ে। ‘আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতের ১ম খণ্ড যখন প্রকাশিত হয় তখন অনুবাদকের নাম ছিল আদনান আজাদ। মূলত এটি আমার একটি ছদ্মনাম। নামের এই ছদ্মাবরণে আমি আর থাকতে চাই না। তাই স্বনামে পাঠকের সামনে উপস্থিত হলাম। আশা করি, প্রিয় পাঠক আমার এই ‘লুকোচুরি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে হেফাযত করুন। আমীন!
–অনুবাদক
.
তারিক বিন যিয়াদ কর্তৃক স্পেনের সদ্রসৈকতে রনতরী জ্বালিয়ে দেওয়ার ঈমানদীপ্ত দাস্তান
আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতে
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
০১.
৯৭ হিজরী মোতাবেক ৭১৫ খ্রিস্টাব্দের কথা। প্রতি বছরের মতো এ বছরও হজ্জের মৌসুমে মক্কা শরীফে বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটেছে। শহর ও শহরের আশপাশে, অলিগলিতে, রাস্তাঘাটে হাটবাজারে সর্বত্রই শুধু মানুষ, আর মানুষ। যেন সুদূর বিস্তৃত উপচে পড়া এক জনসমুদ্র।
এই বিশাল জনসমুদ্রের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, তাঁদের সকলের লেবাস এক। ডান বগলের নিচ দিয়ে বাম কাঁধের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে টাখনু পর্যন্ত নেমে আসা সফেদ চাদর। মুণ্ডানো মাথা, আর নাঙ্গা পা। তাঁদের সকলের দৃষ্টির লক্ষ্যস্থল, আর আশা-আকাক্ষার কেন্দ্রবিন্দু এক। তাদের অন্তর, আর অন্তরলোকের দীপাধার একমাত্র খানায়ে কাবা।
তাঁদের লেবাস যেমন এক, তেমনি তাদের চিন্তা-চেতনা ও ধর্মবিশ্বাসও এক। তাঁদের মুখে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর গুঞ্জন-ধ্বনি, আর বুকে ঈমান সংরক্ষণের শপথবাণী। তাঁরা সকলেই হলেন হাজি। হজ্জ আদায়ের উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়েছেন।
গোটা মক্কা শহর ছোট বড় তাবুতে ভরে গেছে। তাবুতে ঘেরা এই ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় নারী-পুরুষ আছেন, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েও আছে।
এই বিপুল জনসমুদ্রের লেবাস এক। কিন্তু গায়ের রং ভিন্ন। তাদের মাঝে গৌরবর্ণের মানুষ যেমন আছে, তেমনি চাঁদহীন অন্ধকার রাতের ন্যায় কালো চেহারার মানুষও আছে। বাদামী রং-এর মানুষ যেমন আছে, তেমনি গোলাপী চেহারার মানুষও আছে। আছে কমজোর ও দুর্বল মানুষ। সিপাহী আছে, আছেন সিপাহসালার। মনিব আছেন, আছে গোলামও।
মনে হচ্ছে, সকলেই যেন একই গোত্রের মানুষ। তাদের চাল-চলন এক। স্বরবে ও নীরবে তারা এক। তাঁদের বাচনভঙ্গি এক। তারা কোন এক মুলুক থেকে আসেননি; এসেছেন বিভিন্ন মুলুক থেকে। তাদের মধ্যে কেউ এসেছেন আফ্রিকা। থেকে, কেউ আবার চীন থেকে। কেউ এসেছেন ইরান থেকে, কেউ আবার তুরান, থেকে। মোটকথা, যেখানেই ইসলামের নূর পৌঁছেছে, ঈমানের আলো ফুটেছে সেখান থেকেই মুসলমানগণ হজ্জ উপলক্ষে মক্কা শরীফ চলে এসেছেন।
তারা একজন অন্যজনের ভাষা বুঝেন না, কিন্তু তাদের সকলের হৃদয় একই সুতার বাঁধনে বাঁধা। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে হৃদয় দিয়ে অনুভব করছেন। একজনের আবাস-ভূমি অন্যজনের আবাস ভূমি থেকে যোজন যোজন মাইল দূর, কিন্তু তাদের হৃদয়-ভূমির মাঝে নেই কোন দূরত্ব। সকলের মাঝেই এমন সজ্জনভাব যে, কেউ কাউকে আজনবী মনে করেন না। মনে করেন না পরদেশী।
সফেদ এহরাম পরিহিত এই বিশাল জনসমুদ্রের সকলের অনুভূতিও সফেদ। তাদের অবচেতন মনের অনুভূতি হল–এটাই তাদের প্রিয় ভূমি। এটাই তাদের জীবন-সফরের আখেরী মনযিল। আস্থা ও বিশ্বাসের পবিত্র অনুভূতি তাদের চেহারায় এক অভূতপূর্ব উজ্বল্য এনে দিয়েছে।
মক্কা শরীফের আকাশে-বাতাসে মৃদুমন্দ ছন্দে সুরের ঝঙ্কার তুলে সকলের মুখ থেকে বের হয়ে আসছে :
“লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নালহামদা ওয়াননে’মাতা লাকা ওয়ালমুল লা-শারিকা লাক্।”
মোহনীয় এই পবিত্র সুরের মূর্ঘনায় চতুর্দিকে এক নৈসর্গিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। রাজা-বাদশাহদের গর্ভিত মস্তকও বিনয়াবনত হয়ে পড়ছে। হৃদয়ের তন্ত্রিতে তন্ত্রিতে আল্লাহ প্রেমের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ভাষা-বর্ণ, উঁচু-নীচুর বিভেদ ভুলে সকলেই যেন আল্লাহর রঙ্গে নিজেকে রাঙ্গিয়ে তুলছে।
হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতে এখনও কয়েকদিন বাকি। দূরদরাজ থেকে এখনও হাজিগণ আসছেন। বিস্তৃত প্রান্তর জোড়ে তাঁবুর বসতি গড়ে উঠছে। দিন দিন উট আর দুম্বার আওয়াজ বেড়ে চলছে।
***
এই বিশাল জনসমুদ্রের মাঝে কিছু লোক ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে বসে আছে। তাদের একটি হাত সামনের দিকে প্রসারিত। কেউ কেউ তাদের সামনে এক খণ্ড কাপড় বিছিয়ে রেখেছে। কারো কারো হাত কাপড়ের থলির মধ্যে। তারা সকলেই ভিখারী। তাদের কেউ কেউ আবার অঙ্গহীন। তারা সকলেই মরু বেদুইন।
হজ্জের দিনগুলোতে তারা মক্কা শরীফ চলে আসে। ভালো আয়-রোজগার করে হজ্জ শেষ হলে চলে যায়।
এই ভিখারিদের মাঝে একজন বৃদ্ধ ভিখারিও আছেন। এই ভিখারির মাঝে বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য নেই। অন্যান্য ভিখারির মতো তার লোবাসও ছিন্নভিন্ন। হাত পায়ে ময়লা। চেহারা ধূলিধূসরিত। দাঁড়িতে লেগে থাকা বালুকণা রোদের আলোতে চিকচিক করছে।
অন্যান্য ভিখারি ও তার মাঝে পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ ও কমজোর। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। চোখে পড়ার মতো আরেকটি বিষয়ও তার আছে, যে কারণে লোকেরা তার দিকে কিছুক্ষণ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার পা বেড়ি দিয়ে বাঁধা। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তিনি একজন কয়েদি। বিশেষ অনুগ্রহে তাকে ভিক্ষাবৃত্তির অনুমতি দেয়া হয়েছে।
‘তুমি কয়েদি নাকি?’ প্রথম দিনই একজন হাজি সাহেব তাকে জিজ্ঞেস করলেন।
বৃদ্ধ সম্মতিসূচক মাথা উপরে নিচে করলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো।
‘তুমি কি চুরি করেছ?” আরেকজন হাজি সাহেব জানতে চাইলেন।
‘চুরি করলে তো আমার হাত কেটে দেওয়া হত।‘ বৃদ্ধ তাঁর বলিষ্ঠ দুটি বাহু সামনের দিকে প্রসারিত করে উত্তর দিলেন।
‘কোন মেয়েলোকের সাথে ধরা পড়েছিলে নাকি?’ অন্য আরেকজন হাজি সাহেব জিজ্ঞস করলেন।
‘তাহলে তো আমি যিন্দা থাকতাম না। বৃদ্ধ কাঁপা কাঁপা আওয়াজে বললেন। ‘তাহলে তো আমাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা হত।
‘তাহলে কী অন্যায় করেছ তুমি?’ প্রথমজন জানতে চাইলেন। ‘ভাগ্য আমার সাথে প্রতারণা করেছে।’ বৃদ্ধ উত্তর দিলেন।
‘অপরাধীদের ভাগ্য এমনই প্রতারণা করে থাকে। দ্বিতীয়জন ফোড়ন কেটে বললেন।
বৃদ্ধ ভিখারির দৃষ্টি মুহূর্তের জন্য জ্বলসে উঠল। তিনি তাঁর আশ-পাশে দাঁড়ানো লোকগুলোর দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে রইলেন।
‘অপরাধী তার অপরাধের কথা কখনও স্বীকার করে না। তৃতীয়জন দার্শনিকের ন্যায় মন্তব্য করলেন।
‘আমার অপরাধ হল, খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেক ইন্তেকাল করেছেন। বৃদ্ধ ভিখারি বললেন। আর তার স্থানে তাঁর ভাই সুলায়মান বিন আবদুল মালেক খলীফা নিযুক্ত হয়েছেন। দামেস্কের কয়েদখানায় গিয়ে দেখ, আমার মতো বহু কয়েদি বিনা অপরাধে সেখানে শাস্তি ভোগ করছে।
অন্য একজন হাজি বললেন, “তুমি কে? তোমার নাম কি? কোন কবিতার সাথে তোমার সম্পর্ক?
‘আমার কোন নাম নেই। বৃদ্ধ ভিখারি বললেন। কেবলমাত্র আল্লাহ তা’আলার নামই অবশিষ্ট থাকবে। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে আবারো বললেন। কেবলমাত্র আল্লাহর নামই অবশিষ্ট থাকবে…। যদি কিছু দাও তাহলে আল্লাহকে দেবে…। আল্লাহ তোমাদের হজ্জ কবুল করবেন। আমি আমার অপরাধের কথা বলতে পারব না। যদি বলি, তাহলে সেটাও আমার অপরাধ হবে। “ওয়া তুইঙ্গু মান তাশাউ ওয়া তুযিল্প মান তাশাউ…।” তিনি যাকে ইচ্ছা ইজ্জত দান করেন, যাকে ইচ্ছা বেইজ্জত করেন…।’
হাজিগণ কিছু পয়সা নিক্ষেপ করে চলে গেলেন। বৃদ্ধ ভিখারী তার পায়ে বাধা বেড়ি কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন। এই বেড়ি দেখে মানুষের মনে যে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়, তার উত্তর তার জানা আছে, কিন্তু সে উত্তর দেওয়ার সাহস তার নেই। তিনি খলীফা সুলাইমান বিন আবদুল মালেকের সাথে দামেস্ক থেকে এসেছেন। খলীফার কাফেলার সাথে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে। তার শাস্তি এটাই নিধারিত হয়েছে যে, তিনি মক্কা এসে ভিক্ষা চাইবেন।
তিনি হাত প্রসারিত করে চুপচাপ বসে থাকতেন। হাজিগণ তাঁকে বয়োবৃদ্ধ মনে করে অন্যদের তুলনায় সামান্য বেশিই দান করতেন। কিন্তু তিনি তাতে খুশী হতে পারতেন না।
এশার নামাযের পর হাজিগণ নিজ নিজ তাঁবুতে চলে গেলে তিনি উঠে সামান্য খাদ্য কিনে খেয়ে নিতেন। তারপর সারাদিনের সঞ্চয় গুনতে বসতেন। গুনা শেষ হলে তাঁর মন দমে যেত। তিনি আরো বেশী দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়তেন। হজ্জের এই কয়েকটি দিনে তাকে দুই লাখ দিনার সগ্রহ করতে হবে। অল্প সময়ে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ সগ্রহ করা তাঁর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না।
তাঁর মনে হতো, তিনি চুপচাপ বসে থাকেন বলেই পয়সা কম পান। অগত্যা তিনি পয়সা চাইতে শুরু করলেন। কিন্তু অন্যান্য ভিখারিদের মতো দরদ মেশানো আওয়াজে ভিক্ষা চাইতে পারতেন না। তাদের মতো ক্ষুধার্ত শিশু-সন্তানের নাম করে কাঁদতে পারতেন না। তিনি একটিমাত্র কথাই বলতেন, তিনি যাকে ইচ্ছা ইজ্জত দান করেন, যাকে ইচ্ছা বেইজ্জত করেন।
***
বৃদ্ধ ভিখারি ভিক্ষা চাচ্ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি তার পিছন দিক থেকে এসে পা দিয়ে তাঁকে খোঁচা মারল। বৃদ্ধ ঘুরে তার দিকে তাকালে সে বলল, ‘বুড়ো, পালানোর চিন্তা করছ নাকি?
‘কখনও শুনেছ, আন্দলুসিয়ার জিহাদী ময়দান থেকে কোন মুজাহিদ পালিয়ে গেছে? বৃদ্ধ বললেন। আমি পালিয়ে যেতে চাইলে তো…।
‘এখনও তোমার দেমাগ থেকে আন্দালুসিয়ার খোয়াব দূর হয়নি? লোকটি তাকে আরেকবার আঘাত করে বলল।
“তোমার খলীফাকে বলে দিও, তার হুকুমত অতিসত্বর খতম হয়ে যাবে।’ বৃদ্ধ ভিখারি বললেন। মুহাম্মদ বিন কাসেমের হত্যাকারীকে আমার এই পয়গাম পৌঁছে দিও। আর তুমি আমাকে যে দুটি আঘাত করেছ, তার জবাব কেয়ামতের দিন দেব।’
আঘাতকারী তাচ্ছিল্যভরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেল।
আরেক দিনের ঘটনা। আফ্রিকা থেকে আগত দু’জন হাজি সাহেব বৃদ্ধ ভিখারির সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। বৃদ্ধ বলছিলেন, ‘আল্লাহ যাকে চান ইজ্জত দান করেন, যাকে চান বেইজ্জত করেন।
এই বৃদ্ধকে তো বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে।’ একজন আফ্রিকান বললেন।
‘হ্যাঁ, অন্যান্য ভিখারিদের মতো নিজের অক্ষমতার কথা বলে না। নাকি-কান্না কাঁদেনা। দ্বিতীয়জন বললেন।
উভয়েই নিজ নিজ থলিতে হাত ঢুকিয়ে পয়সা বের করে আনলেন। ভিখারি মাটিতে বসে মুখ উঁচু করে তাদের দেখছিলেন। এক আফ্রিকান তাঁকে পয়সা দিতে গিয়ে চমকে উঠলেন। তিনি ভিখারির সামনে বসে পড়লেন। বৃদ্ধ ভিখারির চিবুক ছেয়ে চেহারা উঁচু করে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম কি?
‘আমার কোন নাম নেই। বৃদ্ধ বললেন। আমি আল্লাহ তাআলার এই ফরমানের বাস্তব নিদর্শন–তিনি যাকে চান ইজ্জত দান করেন, যাকে চান বেইজ্জত করেন।
আফ্রিকান আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলেন। আল্লাহর কসম, আপনি মুসা, মুসা বিন নুসাইর। আফ্রিকার সম্মানিত আমীর।
‘আন্দালুসিয়ার বিজেতা মুসা বিন নুসাইর! দ্বিতীয়জন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
বৃদ্ধ ভিখারির চোখ থেকে অশ্রুধারা নেমে এল।
‘এ কোন অপরাধের শাস্তি আপনি ভোগ করছেন? প্রথমজন জানতে চাইলেন।
‘কিছু না। বৃদ্ধ আসমানের দিকে ইশারা করে বললেন। তিনি আবেগে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে ছিলেন।
‘আমরা শুনে ছিলাম, আপনি খলীফার রোশানলে পড়েছেন। দ্বিতীয়জন বললেন।
‘আমরা তো কখনও কল্পনাও করতে পারিনি যে, আপনি ভিখারি হয়ে গেছেন। প্রথমজন বললেন।
‘আমাকে ভিখারি বানানো হয়েছে।’ মুসা বিন নুসাইর তার পায়ের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দিয়ে বললেন। আমি খলীফার কয়েদি। দামেস্কের সেই কয়েদখানায় আমি ছিলাম, যেখানে খলীফা সিন্ধু-বিজেতা মুহাম্মদ বিন কাসেমকে নির্যাতন করে হত্যা করেছেন।
খলীফা সুলায়মান হজ্জ আদায়ের জন্য মক্কা শরীফ এসেছেন। আমাকেও সাথে করে নিয়ে এসেছেন। ভিক্ষা করে আমি যেন তাকে দুই লাখ দিনার আদায় করে দেই। অন্যথায় এমনিভাবে পায়ে বেড়ি বাঁধা অবস্থায় আমাকে আজীবন ভিক্ষা চাইতে হবে।
‘দুই লাখ দিনার!’ প্রথমজন আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। এটা কি আন্দালুসিয়া বিজয়ের জরিমানাস্বরূপ আদায় করতে হবে?
এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন ছিল। সম্ভবত মুসা বিন নুসাইরের দীর্ঘ সময় কথা বলার মতো হিম্মত ছিল না, কিংবা তিনি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চাচ্ছিলেন না। তিনি প্রশ্নকারীর চেহারার প্রতি এক মুহূর্ত চেয়ে থেকে এমন ভঙ্গিতে মাথা ঝুঁকিয়ে দিলেন, যেন তার ঘুম পেয়েছে।
তাঁর বয়স প্রায় আশি বছর হয়েছিল। তাঁর যিন্দেগীর ষাটটি বসন্ত অতিবাহিত হয়েগেছে জেহাদের ময়দানে ঘোড়ার পিঠে শাহসওয়ারী করে। কয়েকটি যুদ্ধে তিনি বেশ জখমী হয়ে ছিলেন। তাঁর শরীরে এমন কোন স্থান নেই যেখানে জখমের কোন চিহ্ন নেই। তার ক্ষত বিক্ষত শরীর ছিল একটি চলমান ইতিহাস। সেই ইতিহাস ইসলামের গৌরবের; গর্বের ইতিহাস। জ্ঞানে-গুণে, বিদ্যা-বুদ্ধিতে তার অবস্থান ছিল অনেক উর্ধ্বে।
এই দুই আগন্তক ছিলেন আফ্রিকান। জাতিতে তারা ছিলেন বার্বার। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিবাসী। আজ জুলুম ও নির্যাতনের চরম অবস্থা বুঝানোর জন্য যে ‘বর্বর’ শব্দ ব্যবহার করা হয়, তাও এই বার্বার জাতির প্রতি ইঙ্গিত করেই বলা হয়। তারা যুদ্ধ-বিগ্রহ, ঝগড়া-বিবাদ, হিংসা-হানাহানি, আর লুটতরাজের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। যুদ্ধনীতি সম্পর্কে তাদের তেমন কোন ধারণা ছিল না। কিন্তু তাদের দুঃসাহস আর হিংস্রতা শক্তিশালী দুশমনকেও ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলত। মোটকথা, তারা ছিল হিংস্র ও জিঘাংসা পরায়ন এক জাতি।
তারা কয়েকবারই শক্রর হাতে পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু কোন শক্তিই তাদেরকে বেশি দিন দাবিয়ে রাখতে পারেনি। অবশেষে আরব মুজাহিদগণ তাদের দেশ আক্রমণ করেন। এই মুজাহিদ লস্করের সিপাহসালার ছিলেন, উতবাহ বিন নাফে ফেস্ত্রী। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর তিনি এই বার্বারদের উপর বিজয় লাভ করতে সক্ষম হন।
বার্বার জাতি কিছু দিন পর্যন্ত পরাজয় মেনে না নিয়ে লড়াই করতে থাকে। তারা অপরিকল্পিতভাবে আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে। আর সিপাহসালারগণ তাদেরকে বাহুবলে দাবিয়ে রাখার পরিবর্তে ইসলামের সুমহান শিক্ষার মাধ্যমে বশীভূত করে ফেলেন।
বার্বারদের নিজস্ব একটি ধর্ম ছিল, কিন্তু তার কোন ভিত্তি ছিল না। বিজয়ী মুসলমানগণ তাদের সামনে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরলে তারা দ্রুত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নেয়। তাদেরকে ফৌজ ও প্রশাসনের বড় বড় পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের উপর বিভিন্ন যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ফলে তাদের মাঝে শৃঙ্খলাবোধ জন্ম নেয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে তারা ইসলামের পক্ষে এক বিশাল সামরিক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে।
***
মুসা বিন নুসাইর যখন আফ্রিকার আমীর ছিলেন তখন তিনি বার্বারদের বিদ্রোহের সর্বশেষ ফুলিঙ্গকে নির্বাপিত করে দেন। যে মুসা বিন নুসাইর যুদ্ধের ময়দানে কাফেরদের জন্য ছিলেন আপাদমস্তক গজব, সেই মুসাই বিদ্রোহী বার্বারদের জন্য ছিলেন রেশমের চেয়েও কোমল, আর মধুর চেয়েও মিষ্ট। মূলত তাঁর এই বন্ধুসুলভ আচরণই সমগ্র বার্বার জাতি, বিশেষ করে বাবার সরদারদেরকে ইসলামের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করতে বাধ্য করে। তাদেরকে ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গকারী বানিয়ে দেয়।
হজ্জ করতে আসা বার্বার সেই দুই সরদারও প্রকৃত মুসলমান হিসেবে মুসা বিন নুসাইরের হাতে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তাঁরা নিজেদেরকে প্রকৃত মুসলমান হিসেবে গড়ে তুলে ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন, ইউসুফ বিন হারেছ। অন্যজন খিযির বিন গিয়াস। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁদের এই নাম রাখা হয়। তারা উভয়ে মুসাকে ভিখারি রূপে দেখা সত্তেও আগের মতোই সম্মান ও তাজীম প্রদর্শন করছিলেন।
‘আফ্রিকার সম্মানিত আমীর!’ ইউসুফ বিন হারেছ বললেন। আপনি বলুন, আমরা আপনার কী মদদ করতে পারি?
‘কিছুই না।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। নিশ্চয় আল্লাহ আমাকে আমার কোন গুনাহের শাস্তি দিচ্ছেন।
‘কিছু একটা বলুন, ইবনে নুসাইর! আপনি চাইলে আমরা খলীফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করব।’ খিযির বিন গিয়াস বললেন।
ইউসুফ বিন হারেছ মুসার কানে কানে বললেন, ‘আমরা সুলায়মান বিন আবদুল মালেককে হত্যা পর্যন্ত করতে পারি। তিনি হজ্জ আদায়ের জন্য এসেছেন, কিন্তু লাশ হয়ে দামেস্ক ফিরে যাবেন।
তারপর কি হবে?’ মুসা বিন নুসাইর জিজ্ঞেস করলেন।
‘নতুন খলীফা আপনাকে এই শাস্তি থেকে অব্যহতি দেবেন।’ ইউসুফ বললেন। আমরা বুঝতে পারছি, আপনি সুলায়মান বিন আবদুল মালেকের ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হয়েছেন।’
‘আমি যদি তাকে হত্যা করাই তাহলে আমিও আল্লাহর দরবারে ব্যক্তিগত হিংসা চরিতার্থকারী হিসাবে অপরাধী সাব্যস্ত হব। মুসা বিন নুসাইর বললেন। আমি নিজেই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারতাম, কিন্তু বন্ধু আমার! আপন প্রাণের চেয়েও ইসলামের আজমত আমার নিকট অনেক বেশি প্রিয়। আমি এবং আমার পূর্ববর্তী আমীরগণ আফ্রিকায় তোমাদের জাতিগত বিদ্রোহ কেন দমন করে ছিলাম? তোমাদেরকে গোলাম বানানোর জন্য নয়; বরং মুসলমানদের মাঝে ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার জন্য। কাফেরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য।’
‘আমি আর কদিন বাঁচব? আমার জীবন-আকাশে আর কটা চাঁদ উদিত হবে? সুলায়মানও চিরকাল বেঁচে থাকবে না। তাকেও একদিন মরতে হবে। একমাত্র দ্বীন-ইসলামই যিলা থাকবে। একবার যদি খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয় তাহলে এই বিদ্রোহের আগুন সে সকল মুলুককেও আক্রান্ত করবে, যেখানে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাকে তো কেবল নিজেকে বাঁচালে চলবে না। প্রাণপ্রিয় ধর্ম ইসলামকেও বাঁচাতে হবে।
এই দুই বার্বার সরদার যখন মুসা বিন নুসাইরের নিকট খলীফা সুলায়মানকে হত্যা করার পরিকল্পনা পেশ করছিলেন আর তার খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কথা বলছিলেন, সেই মুহূর্তে এক হাজি সাহেব তাঁদের সামনে এসে দাঁড়াল। সে আগ্রহ নিয়ে তাঁদের কথা শুনতে লাগল। ইউসুফ তার দিকে তাকিয়ে বললেন।
‘তুমি কি এই বৃদ্ধ ভিখারির তামাশা দেখছ? তাঁকে কিছু দিতে হলে আল্লাহর নামে দিয়ে চলে যাও।’
‘আমার আফ্রিকান ভাই।’ লোকটি বলল। আমি তোমাদের কথা শুনছিলাম। এই বৃদ্ধের দুঃখের কথা শুনে আমার অন্তর ভারাক্রান্ত হয়ে গেছে। আল্লাহর কসম! এই বুযুর্গ যদি আমাকে নির্দেশ দেন তাহলে আমি জীবনবাজি রেখে খলীফাকে হত্যা পর্যন্ত করতে পারব। এই মহান ব্যক্তিকে যে চিনতে পারবে, সে এই কথাই বলবে, যা তোমরা বলছ, আর আমি বলছি।’
‘তুমি কে? খিযির তাকে জিজ্ঞেস করলেন। কথার টানে তোমাকে শামের অধিবাসী বলে মনে হচ্ছে।’
‘হা’, লোকটি বলল। তোমরা ঠিকই বুঝতে পেরেছ। আমি শামের অধিবাসী।
লোকটি তার থলি খোলে দুটি দিনার বের করে মুসা বিন নুসাইরের কোলের উপর নিক্ষেপ করে বলল, ‘আমি অতিসত্বর তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করব এবং কোন ভালো সংবাদ নিয়ে ফিরে আসব।’ এই বলে লোকটি চলে গেল।
“যে ব্যক্তি আপনাকে চিনতে পারবে সেই আপনার মুক্তির জন্য জীবনবাজি রাখতে প্রস্তুত হয়ে যাবে।’ খিযির বললেন।
‘কিন্তু নিজের জন্য আমি অন্যকে বিপদে ফেলতে পারি না।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। আমি কেবলমাত্র আল্লাহর কাছেই মুক্তি কামনা করি।’
‘আপনার মুক্তিপণের দুই লাখ দিনার আমরা আদায় করে দেব।’ ইউসুফ বললেন। তবে আফ্রিকা ফিরে যাওয়ার পর তা সম্ভব হবে। এখন তো আমরা শুধুমাত্র পথের পাথেয় নিয়ে এসেছি।’
‘আমার কবিতা আপনার কথা শুনলে দেরহাম-দিনারের স্তূপ লাগিয়ে দেবে। খিযির বললেন।
এই দুই বার্বার সরদার মুসা বিন নুসাইরের সামনে থেকে উঠার নামই নিচ্ছিলেন না। তাঁদের মনের মাঝে মুসার প্রতি ভক্তি ও আবেগের এমন এক ঝর্নাধারা বয়ে চলছিল যে, তাঁরা চাচ্ছিলেন, মুসাকে এখান থেকে উঠিয়ে নিজেদের সাথে নিয়ে যাবেন।
‘তোমরা চলে যাও।’ মুসা বিন নুসাইর তাঁদেরকে বললেন। আমি খলীফার কয়েদী। তিনি আমাকে এখানে বসিয়ে রেখে ভুলে যাননি। অবশ্যয় লোক পাঠিয়ে আমার উপর নরদারী করছেন। তিনি ভালো করেই জানেন, আমি যাদের আমীর ছিলাম, তাদের নিকট আমার মান-সম্মান নিঃশেষ হয়ে যায়নি। তারা আমাকে এই যিল্লতির মাঝে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে যে কোন প্রকারের আঘাত হেনে বসতে পারে।’
কথা শেষ করে উভয় সরদার যখন উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন তখন চার-পাঁচ জন সিপাহী নাঙ্গা তরবারী নিয়ে তাদেরকে ঘিরে ফেলল। সিপাহীদের একজন বলল, ‘খলীফা তেমাদের দু’জনকে তলব করছেন।’
‘আমাদের কাছে খলীফার কী প্রয়োজন?’ ইউসুফ জিজ্ঞেস করলেন।
এর জবাব শুধু খলীফাই দিতে পারেন। আমরা হুকুমের গোলাম মাত্র। এক্ষুণি চল।’ সেই সিপাহীটি বলল।
‘যদি আমরা না যাই তাহলে…।’ খিযির জানতে চাইলেন।
‘তাহলে তোমাদেরকে ঘোড়ার পিছনে বেঁধে টেনেহেঁছড়ে নিয়ে যাওয়া হবে।’ সিপাহীটি বলল। এটাও খলীফার হুকুম। বুদ্ধিমানের কাজ হল, তার আগেই তোমরা আমাদের সাথে রওনা হবে।’
‘খলীফার নির্দেশ তোমরা এড়িয়ে যেতে পার না বন্ধু!’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। তাদের সাথে চলে যাও। অপমান হওয়া থেকে বাঁচ। আল্লাহ তোমাদের হেফাযত করুন।
সিপাহীরা তাঁদেরকে নিয়ে চলে গেল। মুসা বিন নুসাইরের চোখ থেকে কফুটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
***
হাজিদের তাঁবু থেকে সামান্য দূরে সারিবদ্ধ কয়েকটি তাঁবুর বসতি গড়ে উঠেছে। এ সকল তাঁবুর মাঝে একটি তাঁবু অনেক বড়। দেখতে তাঁবু মনে হলেও সেটি একটি শাহীকামরা। কামরার চতুর্পাশে বহু মূল্যবান রঙ্গিন রেশমী কাপড়ের পর্দা ঝুলছে। সূক্ষ্ম কারুকাজ করা শামিয়ানা কামরার উপর অংশে শুভা পাচ্ছে। শামিয়ানার চার পাশে সোনালী জরির নকশা করা ঝালর লাগানো হয়েছে।
তাঁবুর মধ্যখানে রয়েছে একটি বড় পালঙ্ক। পালঙ্কের উপর রেশমী সুতা দিয়ে বোনা মশারি পালঙ্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে। নিচে মহামূল্যবান গালিচা বিছানো। পালঙ্কের অনতি দূরে গদি লাগানো ছোট্ট একটি কুরসি। কুরসির সামনে সুন্দর নকশা করা একটি জলচৌকি। জলচৌকিটি দামি মখমলের কাপড়ে ঢাকা। কুরসিতে আসন গ্রহণকারী সেই জলচৌকিতে পা রাখেন।
সেই সুশোভিত নরম কুরসীতে একজন লোক বসে আছেন। তার চাকচিক্যময় আর জৌলুসপূর্ণ পোশাক দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে, নিশ্চয় তিনি কোন মুলুকের বাদশাহ হবেন।
এই জাঁকজমকপূর্ণ বিলাসবহুল কামরায় একজন সিপাহী এসে প্রবেশ করল। সিপাহী তার মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করে বলল। খলীফাতুল মুসলিমিন! তাদের দু’জনকে নিয়ে আসা হয়েছে।
‘তাদের সাথে কি কোন অস্ত্র আছে?’ খলীফা জিজ্ঞেস করলেন।
“না, জাঁহাপনা! তারা হজ্জের জন্য এহরাম বাধা অবস্থায় রয়েছে। তারা নিরস্ত্র। তাদের শরীরে তল্লাশী নেওয়া হয়েছে। সিপাহীটি বলল।
খলীফা সুলায়মান বিন আবদুল মালেক রাজকীয় ভঙ্গিতে মাথা সামন্য কুঁকালেন। সিপাহীটি উল্টাপদে কামরা থেকে বের হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর ইউসুফ বিন হারেছ এবং খিযির বিন গিয়াস কামরায় প্রবেশ করলেন। তারা এক সাথে বলে উঠলেন, ‘আমীরুল মুমিনীন! আসোলামু আলাইকুম।
‘বার্বারদের সম্পর্কে আমি যা শুনেছি, তা ভুল শুনিনি।’ খলীফা বললেন।
‘সম্মানিত খলীফা বার্বারদের সম্পর্কে কী শুনেছেন? খিযির জানতে চাইলেন।
‘শুনেছি বার্বাররা শিষ্টাচার বিবর্জিত অসভ্য, হিংস্র। তোমাদের চেয়ে গ্রাম্য বেদুইনরা অনেক ভালো। তারা আদব-কায়দা সম্পর্কে গাফেল নয়।’
ইউসুফ ও খিযির বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলেন। খলীফা রাজকীয় গাম্ভির্যের সাথে ধমকে উঠে বললেন।
‘আমার দিকে তাকাও, একে অপরের দিকে কী দেখছ? তোমাদের কোন কসুর নেই। তোমাদেরকে দরবারে খেলাফতের আদব শিখানো হয়নি, তাই তোমরা জান না যে, খলীফার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করতে হয়?
‘আমীরুল মুমিনীন!’ ইউছুফ বললেন। আমরা শুধু সেই দরবারে মাথা কুঁকাতে শিখেছি, এতদূর থেকে যেখানে হাজিরি দিতে এসেছি। মহান আল্লাহর সেই দরবারে আমরা শুধু মাথাই ঝুকাই না; বরং পরম ভক্তিভরে সেজদায় লুঠিয়ে পড়ি। ইসলাম আমাদেরকে এই আদবই শিক্ষা দিয়েছে।
এই মুহূর্তে তোমরা খলীফাতুল মুসলিমীনের দরবারে রয়েছ, এখানেও ঝুঁকে সালাম করা আবশ্যক। খলীফা রাগতস্বরে বললেন।
‘খলীফাতুল মুসলিমীন!’ ইউসুফ বললেন। আমরা এ জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলাম যে, ইসলামের রীতি-নীতি আমাদের কাছে ভালো লেগেছিল। ইসলামের হুকুম হল, মানুষ মানুষের সামনে মাথা ঝুঁকাবে না। একমাত্র আল্লাহর সামনে মাথা ঝুঁকাবে। আপনি যদি আমাদেরকে আপনার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম করার হুকুম দেন তাহলে আমরা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে আমাদের পূর্বের ধর্মে ফিরে যেতে বাধ্য হব।’
‘আমি ইসলামেরই খলীফা। আমাকে ইসলামের হুকুম-আহকাম শিখাতে এসো না। তোমাদের মতো অসভ্য, জংলী, হিংস্র বার্বার আমাকে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান দেবে, এটা আমি বরদাশত করব না।’
‘খলীফা!’ খিযির উত্তেজিত হয়ে বললেন। আপনি যদি বার্বারদের সভ্যতা আর চারিত্রিক সৌন্দর্য দেখতে চান, তাহলে আন্দালুসিয়ায় গিয়ে দেখুন। আপনার হয়তো জানা নেই যে, আন্দালুসিয়া বিজয়ের জন্য বার্বাররা তাদের মাথার নাযরানা পেশ করেছিল।
‘তারিক বিন যিয়াদও বার্বার। ইউসুফ বললেন। খলীফা আজ আপনি যাদেরকে হিংস্র, জংলী আর অসভ্য বলছেন, তারাই একদিন আন্দালুসিয়ার কাফেরদের হৃদয়-রাজ্য জয় করে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে এসেছিল।
‘খলীফাতুল মুসলিমীন!’ খিযির বললেন। আপনি আন্দালুসিয়ার বিজেতাদের ডেকে এনেছেন। তাঁরা আন্দালুসিয়ার মাটিতে বিজয় পতাকা নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তারিক বিন যিয়াদ আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতে ফৌজ নামিয়ে দিয়ে যুদ্ধ জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন, যেন পালিয়ে যাওয়ার কোন রাস্তা না থাকে। কিন্তু যখন তিনি আন্দালুসিয়া জয় করে সামনে অগ্রসর হওয়ার চিন্তা করছিলেন তখন আপনি তাকে দামেস্ক ডেকে আনেন। আপনি তাঁর গর্বিত মস্তক মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। আপনি চান, ইতিহাসের গহ্বরে তাঁর নাম যেন হারিয়ে যায়।
আন্দালুসিয়ার আরেক বিজেতা, আফ্রিকার আমীর মুসা বিন নুসাইরের পায়ে বেড়ি বেঁধে আপনি তাঁকে ভিখারি বানিয়েছেন। আন্দালুসিয়া গিয়ে দেখুন, আজ এই বার্বাররাই সেখানে ইসলামের ঝাণ্ডা উঁচু রেখেছে।
‘শুনেছি, মুসার এই অপমান আর লাঞ্ছনার প্রতিশোধ তোমরা আমার থেকে নিতে চাও। খলীফা বললেন। “তোমাদের এত বড় দুঃসাহস যে, তোমরা আমাকে হত্যা করতে চাও? আমার খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেও তোমাদের কোন দ্বিধা নেই?
‘মুসা বিন নুসাইয়ের সাথে আমাদের যে কথা হয়েছে, আপনার গুপ্তচর যদি সে কথা আপনার কাছে পৌঁছিয়ে থাকে তাহলে আমরা তা অস্বীকার কবর না। ইউসুফ বললেন।
‘খলীফা, আপনি মুসার কৃতজ্ঞতা আদায় করুন। খিযির বললেন। তিনি আমাদেরকে বিদ্রোহ করা থেকে নিবৃত করেছেন। তাঁর কথা কি আপনার কানে এসে পৌঁছেনি? তিনি বলেছেন, বিদ্রোহের নামও নিও না। অন্যথায় ইসলামী সালতানাত কমজোর হয়ে যাবে। অথচ আপনি ইসলামের শিকড় কাটার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।
খলীফা রাগে-গোসায় উন্মাদ হয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, এই কে আছ, এই বদযবান জংলীদের এখান থেকে নিয়ে যাও। এদেরকে দামেস্কের কয়েদখানায় পাঠিয়ে দাও। এটাই এদের শেষ ঠিকানা।
তৎক্ষণাৎ ছয়-সাত জন সিপাহী কামরায় এসে প্রবেশ করল। তাদের উন্মুক্ত তরবারীর অগ্রভাগ ইউসুফ ও খিযিরের শরীর স্পর্শ করল। সিপাহীরা তাদেরকে টেনেহেঁছড়ে কামরার বাহিরে নিয়ে গেল।
ইউসুফ ও খিযির খলীফার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলতে লাগলেন। হজ্জ আদায়ে বাঁধা দানকারী জালেম। তোমার বাদশাহীর দিন শেষ হয়ে এসেছে।
তাদের চিৎকার-চেঁচামেচি ক্ষীণ হতে হতে হাজিগণের আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক’ ধ্বনির মাঝে হারিয়ে গেল। তার পর এই দুই সরদারের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
***
খলীফা সুলাইমান বিন আবদুল মালেক হলেন ওলিদ বিন আবদুল মালেকের ভাই। সুলাইমানের পূর্বে ওলিদ খলীফা ছিলেন। ওলিদের ইচ্ছা ছিল, তাঁর মৃত্যুর পর খলীফা হবেন তার ছেলে। কিন্তু আকস্মিকভাবে তিনি এমন এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পরেন যে, অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। খলীফা হিসেবে ছেলের নাম পেশ করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে সুলায়মান খেলাফতের মসনদ দখল করে বসেন।
ওলিদ ও সুলায়মান দুই ভাই। কিন্তু তাঁদের উভয়ের মাঝে যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। ওলিদ মুহাম্মদ বিন কাসেমকে হিন্দুস্তান আক্রমণ করার জন্য পাঠিয়ে ছিলেন। তিনি তাকে ফৌজ প্রেরণসহ সবধরনের সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন। একই সময়ে তিনি উত্তর আফ্রিকার আমীর মুসা বিন নুসাইরের সেই ঐতিহাসিক পরিকল্পনা অনুমোদন করেছিলেন, যে পরিকল্পনা অনুযায়ী বার্বার বংশোদ্ভূত সিপাহসালার তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে আন্দালুসিয়ায় আক্রমণ করা হয়েছিল। ওলিদ শুধু আন্দালুসিয়া আক্রমণের অনুমতিই দেননি; বরং আক্রমণ পরিচালনার জন্য যত ধরনের সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল, সব কিছুই তিনি আঞ্জাম দিয়েছিলেন।
ওলিদের ভাই সুলায়মান যখন খলীফা নিযুক্ত হন তখন হিন্দুস্তানে মুহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু পর্যন্ত ইসলামী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন। নতুন নতুন এলাকা বিজিত করার জন্য তিনি দুর্বার গতিতে সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন। অপর দিকে মুসা বিন নুসাইর, আর তারিক বিন যিয়াদ আন্দালুসিয়ার শহর-নগর-বন্দর জয় করে অপ্রতিরোধ্য গতিতে সামনে এগিয়ে চলছিলেন।
সুলায়মান খলীফা নিযুক্ত হয়েই হিন্দুস্তান থেকে মুহাম্মাদ বিন কাসেমকে একজন অপরাধী হিসেবে ফিরিয়ে আনেন। তিনি তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করেন। সেই সাথে তিনি আন্দালুসিয়ার বিজয় অভিযানও মুলতবী করার নির্দেশ জারি করেন। তিনি মুসা বিন নুসাইর ও তারিক বিন যিয়াদকে দামেস্কে ডেকে এনে কারাগারে নিক্ষেপ করেন।
ওলিদের ছেলে যদি খলীফা হতেন এবং বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করতেন তাহলে ইউরোপ আর হিন্দুস্তানের ইতিহাস আজ অন্য রকম লেখা হত। ঐতিহাসিকগণ লেখেন, হিন্দুস্তান এবং ইউরোপে মুসলিম সৈন্যবাহিনী প্রেরণের ব্যাপারে কুতায়বা বিন মুসলিমের বিরাট ভূমিকা ছিল। কুতায়বা সে সময় চীন দেশে জিহাদ পরিচালনা করছিলেন। সুলায়মান তাকেও দামেস্ক ডেকে এনে জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন।
***
মুসা বিন নুসাইর হজ্জের দিনগুলোতে মক্কার অলিগলিতে ভিক্ষা চেয়ে ফিরছিলেন। সারা দিন ভিক্ষা করে যে পয়সা জমা হত, তিনি তা খলীফা সুলায়মানকে দিয়ে দিতেন। মুসা খোলা আকাশের নিচে বসে থাকতেন। তাঁর জন্য একজন পাহারাদার নিযুক্ত করা ছিল। তাকে কোন প্রকার খাদ্যদ্রব্য দেওয়া হত না। তিনি ভিক্ষা করা পয়সা থেকে খানা কিনে খেয়ে নিতেন। দীর্ঘ এক বছর যাবৎ তিনি এই নির্যাতন সহ্য করে আসছিলেন। খলীফা সুলায়মানের নিকট তাঁর আজীবনের বিজয়-কীর্তির কোন মূল্যায়ন ছিল না। উপরন্তু তাঁর বার্ধক্যের প্রতিও তিনি কোন ভ্রূক্ষেপ করেননি।
মুসা বিন নুসাইর এখন তাঁর জীবন সফরের আখেরী মনযিলে এসে উপনীত হয়েছেন। খলীফা সুলায়মান ব্যক্তিগত বিদ্বেষবসত তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেই ক্ষান্ত হননি, বরং অমানবিক নির্যাতন করে তার দেহ ক্ষতবিক্ষত করে
দিয়েছিলেন। প্রচণ্ড রোদের মাঝে উত্তপ্ত বালুর উপর তাঁকে ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হত। উত্তপ্ত বালু আর তীব্র রোদ্রের দহনজ্বালা সহ্য করতে না পেরে তিনি বেহুশ হয়ে পড়ে যেতেন। তাঁকে জীবিত রাখার জন্য কয়েক টুক পানি, আর সামান্য খাবার দেওয়া হত।
মুসা বিন নুসাইরকে খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেক বিশেষ এক উদ্দেশ্যে আন্দালুসিয়া থেকে দামেস্ক ডেকে এনেছিলেন। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্যই বলতে হয়, যখন তিনি এসে পৌঁছলেন তখন ওলিদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছিলেন।
ফলে সুলায়মান মুসার নাগাল পেয়ে যান। তিনি তাঁর উপর অন্যায় অপবাদ আরোপ করে নির্মম নির্যাতন চালান। সুলায়মান তার উপর দুই লাখ দিনার জরিমানা ধার্য করেন এবং তাঁকে মক্কা নিয়ে এসে জরিমানা আদায়ের জন্য ভিক্ষাবৃত্তি করতে বাধ্য করেন।
***
খলীফা সুলায়মানের ইঙ্গিতে ইউসুফ ও খিযিরকে টেনেহেঁচড়ে কামরার বাহিরে নিয়ে যাওয়ার পর কামরার এক পার্শ্বের পর্দা সরিয়ে একটি রূপসী, ষোড়শী মেয়ে কামরায় এসে প্রবেশ করলো। মেয়েটি দামেস্কের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী ছিল। সে সুলায়মানের পিছনে এসে দাঁড়াল। সে তার দুটি হাত সুলায়মানের কাঁধের উপর রেখে তার গলায় আঙ্গুলের আলতো পরশ বুলিয়ে দিতে লাগল। সুলায়মান তার হাত উঁচু করে মেয়েটির হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিলেন।
‘কুলসুম সুলায়মান নিচু স্বরে বললেন। যুবতী মেয়েটি সামনে এসে সুলায়মানের রানের উপর বসে পড়ল। তুমি শুনেছ, আমি কী করেছি?
‘হ্যাঁ, আমীরুল মুমিনীন! কুলসুম সুলায়মানের ঘন মোটের উপর আঙ্গুলের আলতো পরশ বুলিয়ে দিতে দিতে বলল। আমি পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে সব শুনেছি।
সুলায়মান এক হাত দিয়ে কুলসুমের সরু কোমর জড়িয়ে ধরে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, বদনসীব বাবার কোথাকার! আফ্রিকা থেকে এত দূরে আমার হুকুমে মরতে এসেছে। এদের কত বড় সাহস, মুসাকে বাঁচানোর জন্য বিদ্রোহের কথা বলে।
‘আপনি কি নিশ্চিত হয়ে গেছেন, আপনার হুকুমতে আর কেউ বিদ্রোহের কথা বলবে না? কুলসুম জিজ্ঞেস করল।
‘যে বিদ্রোহ করবে তারও এই পরিণতি হবে। সুলায়মান বললেন। মানুষ আমাকে জালেম বলবে, ঐতিহাসিকগণ আমাকে রক্তপিপাসু শ্বৈরাচার লিখবে; কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম এ কথা শুনবে না যে, আমার শাসনামলে কোন রাজ্যে বিদ্রোহ হয়েছে।
‘আমিরুল মুমিনীন! এটা কী আপনার ভ্রান্ত ধারণা নয়?’ কুলসুম বলল। শুধুমাত্র দু’জন বার্বার সরদারকে হত্যা করে বিদ্রোহের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
কুলসুম খলীফার সাথে আবেগঘন চিত্তাকর্ষক অঙ্গ-ভঙ্গি করে বলল। আপনি মুসাকে কয়েদ করে অনেক বড় বিপদ ডেকে এনেছেন।
সুলায়মানের অর্ধনিমীলিত মুগ্ধ দৃষ্টি কুলসুমের চেহারার উপর স্থির হয়ে রইল। তার দেহ-মন যেন কোন এক অজানা জাদুর আবেশে অবশ হয়ে আসছিল।
‘আপনি ভেবে দেখেছেন কি, মুসা তার ছেলে আবদুল আযীযকে আন্দালুসিয়ার আমীর নিযুক্ত করে এসেছে। কুলসুম বলল। হয়তো আবদুল আযীযের নিকট এ খবর পৌঁছে গেছে যে, তার বাবাকে নির্যাতন করে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। তারিক বিন যিয়াদকে আপনি নযরবন্দী করে রেখেছেন, যেন সে দামেস্কের বাইরে যেতে না পারে। আবদুল আযীয আর তারিক একই আদর্শের অনুসারী। আন্দালুসিয়ার তামাম ফৌজ মুসা, তারিক বিন যিয়াদ আর আবদুল আযীযকে পীরের মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করে।
‘তুমি কি বলতে চাচ্ছ, আবদুল আযীয আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে?
‘কেন নয়, সে তার বাবার বেইজ্জ্বতীর প্রতিশোধ অবশ্যই নিতে চাইবে। সে আযাদীর এলানও করে বসতে পারে। বিশাল এক সেনাবাহিনী রয়েছে তার। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন, অর্ধেকের চেয়ে বেশী ফৌজ বার্বার। বার্বাররা আইনত এ দাবি করতে পারে যে, তারাই আন্দালুসিয়ার বিজেতা। আজ আপনি দুজন বার্বার সরদারকে শাস্তি দিয়েছেন। অন্য যে বার্বাররা হজ্জ করতে এসেছে তারা নিশ্চয় তাদের সরদার দুজনকে তালাশ করবে। যেভাবেই হোক তারা জানতে পারবে, আপনি তাদের সাথে কী আচরণ করেছেন।’
‘থামো, আমি তো আবদুল আযীয বিন মুসা সম্পর্কে কোন চিন্তাই করিনি। আমাকে কিছুক্ষণ ভাবতে দাও।’ সুলায়মান বললেন।
***
খলীফা সুলায়মান বিন আবদুল মালেকের চিন্তা-চেতনায় আত্মঅহমিকা আর ক্ষমতার দাপট জেঁকে বসেছিল। কুলসুমের রূপ-সৌন্দর্য আর মোহনীয় অঙ্গ-ভঙ্গি তার নেশার মোহ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
খলীফার মসনদে বসার কয়েক মাস পূর্বে তার হেরেমে কুলসুমের আগমন ঘটে। সুলায়মানের এক বন্ধুর তোহফা ছিল কুলসুম। সে তার জাদুর ছোঁয়ায় যে কোন পুরুষকে ইশারায় নাচানোর মতো প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। সে এসেই সুলায়মানের দেহ-মন জয় করে নিলো। আর হেরেমের অন্য সকল মেয়েদেরকে তার হুকুমের দাসী বানিয়ে ফেলল।
কুলসুমের রূপে ও অঙ্গ-ভঙ্গিতে জাদু ছিল কি ছিল না, কুলসুম জাদুবিদ্যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল কি ছিল না–এটা বড় কথা নয়; বড় কথা হল, সুলায়মান বিন আবদুল মালেকের ঈমান ছিল কমজোর। তিনি ছিলেন নারী ও মদের নেশায় বিভোর। উম্মতে মুহাম্মদীর দুর্ভাগ্য যে, তার মতো ব্যক্তি খলীফা নিযুক্ত হয়েছেন। তিনি তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে খেলাফতকে রাজতন্ত্রে পরিণত করেন। তিনি অন্যান্য রাজা-বাদশাহদের ন্যায় স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা চালু করেন।
ইতিহাস সাক্ষী যখন কোন পুরুষ তার ধমনীর উপর নারীর প্রভুত্ব স্বীকার করে নেয় তখন সে পুরুষ শুধু নিজেই ধ্বংস হয় না; বরং সে যদি কোন খান্দানের কাণ্ডারি হয় তাহলে সেই খান্দানেরও ভরাডুবি করে। আর যদি কোন রাজ্যের বাদশাহ হয়, তাহলে সেই রাজ্যকে ধ্বংস ও বরবাদ করে ছাড়ে।
কুলসুম সুলায়মানের স্ত্রী ছিল নাকি হেরেমের রক্ষিতা ছিল–এ ব্যাপারে সঠিক কোন তত্ব পাওয়া যায় না। তবে ইতিহাসে এমন বেশুমার ঘটনা বর্ণিত আছে, যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সুলায়মান ছিলেন নারীলোভী, একনায়কতন্ত্রী, রক্তপিপাসু, স্বৈরচার এক বাদশাহ।
তার হুকুমত ছিল মূলত খেলাফতের নামে মোড়া রাজতন্ত্র। বাহ্যত তিনি হজ্জ আদায় করতে এসে ছিলেন, কিন্তু প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে জাকজমকের কোন কমতি ছিল না। তার সাথে ছিল হেরেমের শোভা কুলসুম ও অসংখ্য দাস দাসী, আর ছিল রক্ষীবাহিনী ও গুপ্তচর বাহিনী। তিনি আল্লাহর দরবারকে নিজের দরবার বানিয়ে নিয়েছিলেন।
সন্ধ্যায় দুই বার্বার সরদারকে শাস্তির নির্দেশ দিয়ে রাতের আঁধারে খলীফা তার প্রাসাদসম তাঁবু থেকে বের হয়ে এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছলেন যেখানে মুসা বিন নুসাইর রাত্রি যাপন করতেন। খলীফার সাথে ছিল দুজন সিপাহী ও দু’জন মশালধারী। মুসা বিন নুসাইর সারা দিনের ক্লান্ত শরীর মাটিতে এলিয়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন।
সুলায়মান মুসা বিন নুসাইরের পাঁজরে পা দিয়ে খোঁচা দিয়ে বললেন, ‘উঠ বুড়ো।
দুর্বল বয়োবৃদ্ধ মুসা বিন নুসাইর বহু কষ্টে উঠে বসে চোখ মেলে তাকালেন।
‘মনে হচ্ছে, তুমি বোধশক্তি ফিরে পাচ্ছ।’ সুলায়মান বললেন। ঐ দুই বার্বার তোমার সাথে বিদ্রোহের কথা বলছিল, আর তুমি তাদের বাধা দিচ্ছিলে।’
‘তোর ভয়ে নয়, সুলায়মান। মুসা বিন নুসাইর আসমানের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন। আল্লাহর ভয়ে। আমি তোর খেলাফতের কোন পরওয়াই করি না। তোকে মোটেই ভয় পাই না।
‘বদবত! তুই কি মনে করি, আমার অন্তরে আল্লাহর ভয় নেই।’ সুলায়মান বিদ্রুপের হাসি হেসে বললেন।
‘না, তোর অন্তরে মোটেই আল্লাহর ভয় নেই। মুসা বললেন। “তুই তো আল্লাহর হুকুম-আহকাম সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। কুরআন খোলে দেখ, আল্লাহর তা’আলার হুকুম হল, “তোমরা হজ্জ করতে এসে নিজ স্ত্রীদের থেকে দূরে থাক। মন্দ কাজ থেকে বিরত থাক। লড়াই-ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ো না। তোমরা যে নেক কাজ করবে আল্লাহ তা জানতে পারবেন। হজ্জের সফরে সাথে পাথেয় রাখ। মনে রাখবে, সর্বোত্তম পাথেয় হল, (সর্ব বিষয়ে) সংযম প্রদর্শন করা। সুতরাং হে বিবেকবান লোক সকল! তোমরা আমার নাফরমানী করো না।” সুলায়মান, তুই কি আল্লাহর এই হুকুম মেনে চলিস?’
খলীফা সুলায়মান মুসা বিন নুসাইরের প্রতি অবজ্ঞাভরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন।
***
হজ্জ শেষ হয়ে গেছে। হাজিগণ নিজ নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছেন। খলীফা সুলায়মানের কাফেলাও দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে। মুসা বিন নুসাইরকেও কাফেলার সাথে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সামান্য সময়ের জন্য তাঁকে উটে আরোহণ করানো হত, আর সারা দিন তিনি পায়ে হেঁটে চলতেন। তিনি ভিক্ষা করে যা কিছু জমা করে ছিলেন, খলীফা তা নিয়ে নিয়েছেন।
দেড়-দুই মাস পর কাফেলা দামেস্ক এসে পৌঁছলে মুসা বিন নুসাইরকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হল। দামেস্ক পৌঁছার পর প্রথম রাতেই কুলসুম খলীফাকে স্মরণ করিয়ে দিল যে, আন্দালুসিয়ার আমীর এখন মুসার ছেলে। সে তার বাবার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য যে কোন সময় আন্দালুসিয়ার স্বাধীন শাসক হিসেবে বিদ্রোহ করতে পারে।
‘কুলসুম!’ সুলায়মান বললেন। আমি মুসলমানদের খলীফা। মুসলমানগণ এক নতুন রাজ্য জয় করেছেন। সেখানে নতুন নিয়ম-কানুন আরোপ করা হচ্ছে। এখনও খণ্ড খণ্ড লড়াই চলছে। খলীফা হিসেবে আমার কি সেখানে যাওয়া উচিত নয়? আমি যদি সেখানে যাই তাহলে সর্বসাধারণের নিকট আমার গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে।
‘না, খলীফাতুল মুসলিমীন!’ কুলসুম বললআমার ভয় হয়, যারা আপনার সাথে যাবে তাদের মধ্যে কেউ যদি বলে দেয়, মুসা বিন নুসাইর এখন কারাগারে, তার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়, তাহলে সেখান থেকে যিন্দা ফিরে আসা আপনার পক্ষে অব হয়ে পড়বে।’
‘কিন্তু সেখানের অবস্থা সম্পর্কে আমার অবগত হওয়া উচিত। সুলায়মান। বললেন। বিদ্রোহের সামান্য আভাস পেলেও আমি আবদুল আযীযকে তার আসল ঠিকানায় পৌঁছে দেব।’
পরের দিন খলীফা সুলায়মান সর্বাগ্রে একজন দূতকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ঘোড়ায় সওয়ার করিয়ে আন্দালুসিয়ার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিলেন। তাকে বলে দেওয়া হল, সেখানকার সাঠিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহ করে অতিদ্রুত দামেস্ক ফিরে আসতে।
খলীফা তাকে বললেন, কেউ যেন জানতে না পারে যে, তুমি আমার প্রেরিত দূত। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, আন্দালুসিয়া এসেছি, এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা যায় কিনা দেখতে।
***
আন্দালুসিয়ার যাবতীয় সংবাদ সংগ্রহ করে যথা সম্ভব দ্রুত ফিরে আসতে দূতের দেড় মাস লেগে গেল। এই দেড়মাস মুসা বিন নুসাইরের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তিনি যেন খুব ভোরে কারাগার থেকে বের হয়ে শহরে ভিক্ষাবৃত্তি করেন, আর সন্ধ্যার পূর্বেই ফিরে এসে কারা-রক্ষকের নিকট সংগৃহীত টাকা জমা করে দেন।
বার্তাবাহক আন্দালুসিয়া থেকে ফিরে সরাসারি খলীফা সুলায়মানের সাথে সাক্ষাৎ করল। সে খলীফাকে সেখানকার পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলল, ‘খলীফাতুল মুসলিমিন! আন্দালুসিয়ার মতো সুন্দর, সবুজ-শ্যামল দেশ সম্ভবত দুনিয়াতে দ্বিতীয়টি নেই।’
‘আমি কোন দেশের ভৌগলিক বিবরণ শুনতে চাইনি। সুলায়মান বললেন। ‘আমাকে শুধু এই সংবাদ দাও, আমীর আবদুল আযীয কী করছে? সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষ তার সম্পর্কে কিরূপ ধারণা পোষণ করে?’
‘সেনাবাহিনী ও জনসাধারণের নিকট আন্দালুসিয়ার আমীর আবদুল আযীয অত্যন্ত সম্মানিত ব্যাক্তি।’ বার্তাবাহক বলল। তিনি খোদাভীরু ও দুনিয়াবিমুখ আলেমেদ্বীন। আরব ও বার্বাররা তো তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করেই খ্রিস্টানরা পর্যন্ত তাঁর প্রশংসা করে।
আবদুল আযীয আন্দালুসিয়ার জনসাধারনের জন্য কল্যাণকর ও উন্নয়ণমূলক যে কাজ করে যাচ্ছেন, তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে বার্তাবাহক বলল, ‘আন্দালুসিয়ার আমীর আবদুল আযীয সেখানকার লোকদের ভাগ্য পাল্টে দিয়েছেন। সেখানে বিত্তশালী খ্রিস্টানরা বিত্তহীনদের উপর জুলুম-নির্যাতন করত।
যারা স্বর্ণ, মুদ্রা ও ধন-সম্পদের মালিক ছিল, তারাই যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও বিলাস-বৈভবের একচ্ছত্র অধিকারী ছিল।
আমীর আবদুল আযীয গরীব জনসাধারণকে এমন এক জীবনের সন্ধান দিয়েছেন যে, তারা এখন শুধু পেট ভরে খানাই খায় না; বরং মানুষ হিসেবে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাও হয়।
‘বাবার সম্প্রদায় আবদুল আযীয সম্পর্কে কেমন ধারণা পোষণ করে? খলীফা বার্তাবাহককে জিজ্ঞেস করলেন।
‘খলীফাতুল মুসলিমিন নিশ্চয় অবগত আছেন, তারিক বিন যিয়াদ যে সকল সৈন্য নিয়ে আন্দালুসিয়া আক্রমণ করে ছিলেন তাদের সকলেই ছিল বার্বার। মালে গনিমত হিসেবে যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ বার্বারদের হস্তগত হয়েছিল, তা তারা স্বপ্নেও কখনও দেখেনি। আমীর আবদুল আযীয বার্বারদের অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। তিনি তাদেরকে অত্যন্ত সম্মানিত করেছেন। মুসা বিন নুসাইর দীর্ঘকাল আফ্রিকার আমীর ছিলেন। বার্বারদের উপর তার অনুগ্রহ এত বেশি যে, বার্বাররা তাকে পীর-মুরশেদ মনে করে। এ কারণেই বার্বাররা আবদুল আযীযের জন্য নিজেদের জান-মাল কোরবান করতে সদা প্রস্তুত থাকে।
‘ওখানে কি কেউ আমাদের প্রশংসাও করে?’ সুলায়মান জিজ্ঞেস করলেন।
‘খলীফা অভয় দিলে এ ব্যাপারে অধমের কিছু কথা আছে।’ বার্তাবাহক বলল।
‘নির্ভয়ে বল।’ খলীফার পরিবর্তে কুলসুম বলে উঠল। সে খলীফার শরীরের সাথে লেগে বসেছিল।
‘খলীফাতুল মুসলিমীন!’ বার্তাবাহক বলল। আমি অনেক সরাইখানায় গিয়েছি, সেখানে আমি মুসলমান, খ্রিস্টান এমন কি বার্বার মুসলমানদের সাথেও কথা বলেছি, কিন্তু কেউ দামেস্কের খেলাফতের নাম পর্যন্ত নেয় না। সেখানকার নতুন নির্মিত মসজিদেও আমি গিয়েছি, সেখানেও খলীফার নাম নেওয়া হয় না। লোকদের মুখে মুখে শুধু আমীর আবদুল আযীযেরই নাম।
‘মুসা বিন নুসাইর ও তারিক বিন যিয়াদ সম্পর্কে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি।’ সুলায়মান জানতে চাইলেন।
‘আমি অনেককেই দেখেছি, তারা একজন অন্যজনকে জিজ্ঞেস করে, মুসা বিন নুসাইর এবং তারিক বিন যিয়াদ কোথায় গেছেন? বার্তাবাহক বলল। ‘খলীফাতুল মুসলিমীন! যে ব্যক্তিই জানতে পেরেছে যে, আমি দামেস্ক থেকে এসেছি, সেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, মুসা বিন নুসাইর এবং তারিক বিন যিয়া কি দামেস্কে আছেন? তাঁরা কবে ফিরবেন? ইত্যাদি। আমি দেখেছি, দারুল খেলাফতের সাথে আন্দালুসিয়ার কোন সম্পর্কই নেই। খলীফাতুল মুসলিমীন। আপনার সেখানে যাওয়া উচিত।’
‘হ্যাঁ, আমার সেখানে যাওয়া উচিত। আমি যদি সেখানে না যাই তাহলে একদিন খোতবা থেকেও আমার নাম মুছে যাবে।’ সুলায়মান বললেন।
‘তুমি এখন যেতে পার।’ কুলসুম বার্তাবাহককে বলল।
বার্তাবাহক চলে গেলে কুলসুম সুলায়মানকে বলল, ‘আপনি আন্দালুসিয়া যাবেন। আপনি কি বার্তাবাহকের এমন সুস্পষ্ট কথা থেকেও বুঝতে পারেননি যে, আন্দালুসিয়া একদিন একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে? আপনি কি চান, উমাইয়া বংশের হাত থেকে খেলাফতের বাগডোর অন্যের হাতে চলে যাক? আপনি কি মুসার খান্দানকে খেলাফতের মসনদে বসাতে চান?
‘না, কুলসুম! কক্ষণও না।’ সুলায়মান বললেন। আমি মুসার বংশ নির্বংশ করে তবেই ক্ষান্ত হব।
‘মুসা এই অধিকার কোত্থেকে পেল যে, সে নিজের ছেলেকে একটি বিজিত এলাকার আমীর বানিয়ে দিয়েছে। কুলসুম বলল। শুধু মুসাকে খতম করলেই হবে না। তার গোটা বংশকেই খতম করে দিতে হবে।’
‘এখনই আবু হানিফকে ডাক। খলীফার কথা শুনে কুলসুম উঠে দাঁড়াল। খলীফা তাকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ? প্রহরীকে পাঠাও।’
‘আবু হানিফকে ডাকার জন্য আমারই যাওয়া উচিত।’ কুলসুম বলল। সে তো আপনার হুকুমের অপেক্ষায় এখানেই বসে আছে।’
কুলসুম খলীফার কামরা থেকে বের হয়ে দুটি কামরা অতিক্রম করে তৃতীয় একটি কামরায় প্রবেশ করল। কামরাটি অত্যন্ত সুন্দর ও সাজানো-গুছানো। সেখানে মধ্য বয়সী বলিস্ট চেহারার সুদর্শন এক পুরুষ বসেছিল। কুলসুমকে দেখামাত্র সে দাঁড়িয়ে তার দুই বাহু প্রসারিত করে ধরল। কুলসুম সোজা তার বাহুবন্ধনে আশ্রয় নিল। এ লোকটিই হল, আবু হানিফ।
কুলসুম তাকে একটি কুরসীতে বসিয়ে নিজে একটি কুরসী টেনে বসে বলল, “তিনি আন্দালুসিয়া যাওয়ার খোয়ব দেখছেন। তুমি হলে তার প্রধান পরামর্শদাতা, তার পরামর্শদাতা তো আরো অনেকেই আছে, কিন্তু আমি তোমাকে তার মনের মাঝে স্থান করে দিয়েছি।’
‘এটা কোন নতুন কথা নয়।’ আবু হানিফ বলল। নতুন কথা বল, বার্তাবাহক কি সংবাদ এনেছে, আর সুলায়মানই বা কি বলেছে?
কুলসুম আবু হানিফকে বার্তাবাহকের সব কথা শুনাল। বার্তাবাহকের কথা শুনে সুলায়মানের কী প্রিতিক্রিয়া হয়েছিল এবং সে নিজে সুলায়মানকে কী পরামর্শ দিয়েছে তাও শুনাল।
‘আমিও তাকে এই পরামর্শই দেব।’ আবু হানিফ বলল। সুলায়মানের সালতানাত যত দিন স্থায়ী হবে তত দিন আমাদের ভাগ্যও সুপ্রসন্ন থাকবে। কিন্তু মনে রেখো কুলসুম, মুসা বিন নুসাইর আন্দালুসিয়ার যে সকল দাসী-বান্দি তোহফা স্বরূপ খলীফা ওলিদের নিকট পাঠিয়ে ছিল, তাদের প্রত্যেকেই অত্যন্ত রূপসী ও লাস্যময়ী রূপে-গুণে তাদের কোন তুলনা হয় না। এ সকল খ্রিস্টান মেয়েদের বিবেক-বুদ্ধি অত্যন্ত প্রখর। আমি ভালো করেই জানি, এ সকল মেয়েরা সেখানে দাসী-বান্দি ছিল না। তারা সকলেই শাহীখান্দানের মেয়ে। তাদের কেউ যেন তোমাকে পিছনে ফেলে সুলায়মানের হৃদয়-মন্দিরে জায়গা করে না নেয়।
‘এ বিষয়ে পরেও কথা বলা যাবে।’ কুলসুম বলল। এখন সুলায়মান তোমাকে ডাকছে, সে আন্দালুসিয়ার আমীর আবদুল আযীযের ব্যাপারে তোমার। সাথে পরামর্শ করতে চায়।’
‘তাকে কী পরামর্শ দেব?’ আবু হানিফ জানতে চাইল।
কুলসুম তার ডান হাত ছুরির মতো করে গর্দান স্পর্শ করে বলল, জলদি যাও। সুলায়মান তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। তাকে আন্দালুসিয়া যাওয়ার পরামর্শ দিও না।
আবু হানিফ দ্রুত সুলায়মানের কামরার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। সে কামরায় প্রবেশ করতেই সুলায়মান তাকে নিয়ে গোপন বৈঠকে বসলেন।
***
সেদিন আপরাহ্নে দামেস্ক থেকে একজন বার্তাবাহক আন্দালুসিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। তার সাথে ছিল একটি লিখিত পয়গাম। লিখিত পয়গামটি একটি চামড়ার থলিতে ভরে আবু হানিফ সুলায়মানের সামনে মোহর অঙ্কিত করল। সুলায়মান আবু হানিফকে দিয়ে পয়গামটি লিখিয়ে ছিলেন।
ইতিহাসে বার্তাবাহকের নাম লেখা আছে আবু নসর। এই বার্তাবাহককেই পূর্ববর্তী খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেক পাঠিয়ে ছিলেন মুসা বিন নুসাইরকে আন্দালুসিয়া থেকে ডেকে আনার জন্য।
আবু নসর ছিল রাজকর্মচারীদের মাঝে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। সুলায়মান আবু নসরকে লিখিত পয়গামটি দিয়ে বললেন, তুমি ভালো করেই জান, আমার বড় ভাই ওলিদ তোমার উপর কতটা আস্থা রাখতেন। শাহীমহলে তোমার প্রতি সেই আস্থা এখনও অটুট আছে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পয়গাম। কোন অবস্থাতেই যেন রাস্তায় এই পয়গাম ভোলা না হয়। কোন কারণে যদি এই পয়গাম হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, তাহলে মোহর ভেঙ্গে থলি থেকে পয়গাম বের করে জ্বালিয়ে দেবে অথবা গিলে ফেলবে। এই পয়গাম কোনভাবেই যেন অন্যের হাতে না পৌঁছে।’
‘আমীরুল মুমিনীন, এমনই হবে।’ আবু নসর বলল।
‘আরেকবার ভালো করে শুনে নাও।’ সুলায়মান বললেন। পয়গাম হাবীৰ বিন উবায়দার হাতে পৌঁছাবে। কেউ যেন জানতে না পারে যে, তুমি কোন পয়গাম নিয়ে গিয়েছ। তাছাড়া আর সব কিছুই তো তোমাকে বলে দেওয়া হয়েছে।
আবু নসর সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে আন্দালুসিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।
***
আন্দালুসিয়ার রাজধানী টলেডো। আমীর আবদুল আযীয টলেডোতেই অবস্থান করছিলেন। আবু নসর রাতের বেলা টলেডোর উপকণ্ঠে এসে পৌঁছলো। সন্ধ্যায় শহর রক্ষা প্রাচীরের ফটক বন্দ হয়ে যাওয়াতে শহরের বাইরেই তাকে রাত যাপন করতে হয়েছে। ফটক খোলা হলে সে শহরে প্রবেশ করল।
পূর্বেই সে তার চেহারায় কিছুটা পরিবর্তন এনেছিল। সে এমন লেবাস পরেছিল যে, তাকে আরব বরে মনে হচ্ছিলো না। পূর্বেও সে এখানে এসেছে, তাই এখানের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা সম্পর্কে তার ধারণা ছিল। সে জানত, হাবীব বিন উবায়দা কোথায় থাকে।
ঐতিহাসিকদের মতে হাবীব বিন উবায়দা ছিল ফৌজের উচ্চ পদস্থ একজন কর্মকতা। সম্ভবত এ কারণেই তার নামের সাথে আমীর শব্দটি লেখা হত।
আবু নসর হাবীবের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। এ সময় হাবীবের এক দোস্ত–যায়েদ বিন নাবাহ সেখানে উপস্থিত ছিল। খাদেম এসে বলল, একজন মুসাফির আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়।’
হাবীব বাইরে এসে আগন্তুকের দিকে এক দৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল। তুমি আবু নসর নও? কারো জন্য খলীফার পয়গাম নিয়ে এসেছ নাকি?
‘আপনার জন্যই পয়গাম এনেছি।’ আবু নসর বলল। খলীফার বিশেষ গোপন পয়গাম। তার নির্দেশ হল, কেউ যেন এই পয়গামের ব্যাপারে জানতে না পারে। এই নিন পয়গাম। আর আমাকে আত্মগোপন করে থাকার ব্যবস্থা করে দিন। জবাব নিয়ে আমি ফিরে যাব।’
হাবীব তার থেকে পয়গামের থলি নিয়ে খাদেমকে বলল, এই মুসাফিরের জন্য আলাদা কামরার ব্যবস্থা কর এবং তার খাওয়া-দাওয়ার প্রতি বিশেষ খেয়াল রেখো।
বৈঠকখানায় এসে হাবীব দোস্ত যায়েদের সামনে থলি খোলে পয়গাম বের করে পড়তে লাগল। পয়গাম খুব দীর্ঘ ছিল না। পয়গাম পড়তে গিয়ে হবীব বিন উবায়দার হাত কাঁপতে শুরু করল। তার হাত এতটা সজোরে কাঁপছিল যে, পয়গাম তার হাত থেকে পড়ে গেলো, আর চোখ থেকে কান্নার দমকে তপ্ত অশ্রু বের হয়ে এলো। পড়ে যাওয়া পয়গমটি উঠিয়ে নিয়ে যায়েদ পড়তে লাগল…।
‘আন্দালুসিয়ার আমীর আবদুল আযীযকে হত্যা করে তার মস্তক দামেস্ক পাঠিয়ে দাও। কেউ যেন জানতে না পারে।’
‘যায়েদ, তুমি তো জান, মুসা বিন নুসাইরের সাথে আমার বন্ধুত্ব কতটা গভীর হাবীব বলল। আমি তার ছেলের মস্তক কাটার নির্দেশ দিতে পারি না। এ কাজ আমার দ্বারা কিছুতেই হবে না।’
‘তাহলে নিজেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। যায়েদ বলল। খলীফার নির্দেশ না মানলে সে তোমার পরিবারের প্রত্যেকটি শিশু-সন্তানকে পর্যন্ত হত্যা করে ছাড়বে। হত্যা করার পূর্বে তোমাকে কয়েদখানায় বন্দী করে এমন নির্মম নির্যাতন। করবে যে, দিন-রাতে অসংখ্যবার তুমি মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে যাবে।
‘তুমি কি এ ব্যপারে আমাকে সাহায্য করবে?’ হাবিব যায়েদকে জিজ্ঞেস করল।
‘তুমি বললে অবশ্যই সাহায্য করব। যায়েদ বলল। খলীফার এই নির্দেশ পালন করা ছাড়া তোমার কোন উপায় নেই।’
****
ইউরোপিয়ান ও মুসলিম ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রায় সকলেই লেখেছেন যে, হাবীব বিন উবায়দা এবং মুসা বিন নুসাইরের সাথে অত্যন্ত গভীর বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু মরহুম খলীফা ওলিদ এবং তাঁর ভাই সুলায়মানের পক্ষ থেকে হাবীবের খান্দানের উপর এমন অজস্র অনুগ্রহ ছিল, যা অস্বীকার করা হবীবের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ছিল। তাছাড়া সুলায়মানের প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাবের কারণেও এই নির্দেশ অমান্য করা সম্ভব ছিল না।
অনেক চেষ্টার পর হাবীব পাঁচজন ফৌজি অফিসারকে নিজের মতের সাথে একাত্ম করতে সক্ষম হল। এই পাঁচজন ফৌজি অফিসারই ছিল উমাইয়া বংশের। তারা আমীর আবদুল আযীযকে হত্যা করার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছল।
কিন্তু সমস্যা হল, আমীর আবদুল আযীয জনকল্যাণমূলক কাজে ও সামাজিক উন্নয়নকল্পে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে, কখনও তিনি এক জায়গায় স্থির থাকতে পারেন না। আন্দালুসিয়ার কয়েকটি জায়গায় তখনো লড়াই চলছিল। খ্রিস্টানরা মুসলমানদেরকে আন্দালুসিয়া থেকে বিতাড়িত করতে একেবারে অক্ষম হয়ে পড়েছিল। কিন্তু যে সকল অঞ্চল তখনো মুসলমানদের করতলগত হয়নি সেগুলো রক্ষার জন্য খ্রিস্টানরা প্রাণপণ লড়াই করছিল। আমীর আবদুল আযীয কখনও কখনও আকস্মিকভাবে যুদ্ধ ক্ষেত্রে চলে যেতেন।
আমীর আবদুল আযীযকে হত্যা করার জন্য গুপ্তঘাতকদের লেলিয়ে দেওয়া হল। তারা কয়েকবারই চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য চেষ্টা করল; কিন্তু তাদের প্রতিটি প্রচেষ্টাই চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে গেল। আবদুল আযীয নিজেও আঁচ করতে পারেননি যে, কেউ তাঁকে হত্যা করার জন্য ছায়ার মতো তার পিছনে লেগে আছে।
অবশেষে হাবীব বিন উবায়দা এক বিকৃত মস্তিষ্ক গুপ্তঘাতকের সন্ধান পেল। সে অত্যন্ত সাহসী ও ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন ছিল। সে ছায়ার মতো আমীর আবদুল আযীযের পিছনে লেগে থাকত। আমীর আবদুল আযীয সর্বদা দেহরক্ষী বেষ্টিত হয়ে থাকতেন। তাঁর পর্যন্ত একটি তীর পৌঁছাও ছিল অসম্ভব।
এই গুপ্তঘাতকের নাম কোন ঐতিহাসিকই উল্লেখ করেননি। গুপ্তঘাতক একটি মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় ছিল। তখনকার যুগে যিনি সিপাহসালার হতেন তিনিই ইমামতের দায়িত্ব পালন করতেন। জামে মসজিদের ইমামতের দায়িত্ব তাঁর উপরই ন্যস্ত থাকত।
একদিন আমীর আবদুল আযীয ফজরের নামাযের ইমামতের জন্য দাঁড়িয়েছেন। তিনি সূরা ফাতেহা তিলাওয়াত করে সুরা ওয়াকিয়া শুরু করেছেন মাত্র। এমন সময় এক ব্যক্তি বিদ্যুৎগতিতে প্রথম কাতার থেকে বের হয়ে, চোখের পলকে তলোয়ারের এক আঘাতে আমীর আবদুল আযীযের শরীর থেকে মস্তক আলাদা করে ফেলল। নামাযীগণ কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই গুপ্তঘাতক মস্তক নিয়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
গুপ্তঘাতক আমীর আবদুল আযীযের কর্তিত মস্তক কাপড়ে পেঁচিয়ে হাবীব বিন উবায়দার ঘরে এসে পৌঁছল। হাবীব তার অপেক্ষায় ছিল। সে চামড়ার একটি থলি বানিয়ে রেখেছিল। কর্তিক মস্তক সেই থলিতে রেখে সেলাই করে আরেকটি মখমলের থলিতে ভরে বার্তাবাহক আবু নসরকে দিয়ে বলল, এটা খলীফা সুলায়মান বিন আবদুল মালেকের নিকট পৌঁছে দাও।’
‘কি আছে এর মধ্যে? বার্তাবাহক জিজ্ঞেস করল।
‘খলীফার পয়গামের উত্তর। হাবীব বলল। এখনই রওনা হয়ে যাও।’
আবু নসর তৎক্ষণাৎ বের হয়ে পড়ল। সে প্রায় বিশ দিন লাগাতার সফর করে দামেস্ক এসে পৌঁছল। দামেস্ক পৌঁছেই সে খলীফার সাথে সাক্ষাৎ করল। হাবীব খলীফার পয়গামের উত্তর হিসেবে যে থলি তাকে দিয়ে ছিল, সেই থলি সে খলীফার সামনে পেশ করল।
খলীফা সুলায়মান থলির মধ্যে আমীর আবদুল আযীযের কর্তিত মস্তক দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। তিনি চিৎকার করে নির্দেশ দিলেন, ‘আন্দালুসিয়ার আমীরের কর্তিত মস্তক কয়েদখানায় তার বাবার সামনে রেখে এসো।’
সাথে সাথে তার নির্দেশ পালন করা হল। আমীর আবদুল আযীযের কর্তিত মস্তক মুসা বিন নুসাইরের সামনে পেশ করা হল।
মুসা বিন নুসাইর প্রথম থেকেই অসহনীয় দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত ছিলেন। নিত্য নতুন নির্যাতন, আর অনাহারে-অর্ধাহারে তাঁর শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিল। শারীরিক ও মানসিক আর কোন প্রকার দুঃখ সহ্য করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এমন সময় প্রিয় পুত্রসন্তানের কর্তিত মস্তক দেখে তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়ে যান। হুঁশ ফিরে এলে দেখেন, মস্তক সেখানে নেই।
প্রচণ্ড দুঃখ-কষ্টে আক্ষেপ করে মুসা বিন নুসাইর বলে উঠলেন। তারা এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, যে দিনের আলোতে ইনসাফ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় আত্মবিস্মৃত হয়ে থাকত। আর নিঝুম রাতের আঁধারে আল্লাহর দরবারে সেজদায় পড়ে থাকত। সে ছিল আধার রাতের এবাদতগুজার, আর যুদ্ধদিনের সিপাহী শাহসওয়ার। সে দিনে রোজা রাখত, আর রাতে জায়নামাযে বিনিদ্র রজনী কাটাত।
মুসা বিন নুসাইর যে কারাগারে পুত্র শোকের অসহ্য যন্ত্রণা বুকে নিয় তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সেই একই কারাগারে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন সিন্ধু বিজয়ী বীরপুরুষ মুহাম্মদ বিন কাসেম। খলীফা সুলায়মানের নির্দেশে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। নির্মম অত্যাচারের অসহ্য যাতনা সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন।
“তোমরা এমন এক যুবককে হত্যা করে ফেলছ, যে আর দশটা যুবকের মতো নয়।’
আরেক সিংহপুরুষের হৃদয় বিদারক আর্তচিৎকারেও এই কারাপ্রাচীরের ইট-পাথরগুলো প্রকম্পিত হয়েছিল। খলীফা সুলায়মানের নির্দেশে তাকেও হত্যা করা হয়। সেই মহান মুজাহিদ হলেন, সমরকন্দ বিজেতা কুতায়বা বিন মুসলিম। মৃত্যুর পূর্বে তিনি নিস্তদ্ধ কারাপ্রাচীরের মধ্যে চিৎকার করে বলেছিলেন :
হে রাসূলে আরাবীর উম্মত! আমি তো তোমাদের উন্নতি আর মঙ্গলের জন্য সচেষ্ট ছিলাম। সেই আমাকেই তোমরা বাঁচতে দিলে না। আজ তোমাদের উপর যে অধঃপতন, আর ধ্বংস নেমে এসেছে, তা থেকে তোমাদেরকে কে বাঁচাবে?
আন্দালুসিয়ার আমীর আবদুল আযীয শহীদ হওয়ার পর মুসা বিন নুসাইর বেশি দিন বাঁচেননি। তার এক-দেড় বছর পর সুলায়মান বিন আবদুল মালেকও মৃত্যুবরণ করেন।
এটা কোন কল্পকাহিনী নয়। এটা এমন এক ঈমানদীপ্ত উপাখ্যানের শেষ পরিণতি, যার শুরু হয়েছে পাঁচই রজব ৯২ হিজরী মোতাবেক ৯ই জুলাই ৭১১ খ্রিস্টাব্দে। যখন একজন খ্রিস্টান প্রশাসক মিসর ও আফ্রিকার আমীর মুসা বিন নুসাইরের দরবারে এসে ফরিয়াদ করেন, আন্দালুসিয়ার বাদশাহ রডারিক তার কুমারী মেয়ের শ্লীলতাহানী করেছে। সে এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে চায়। মুসলমানদের মদদ ছাড়া তার একার পক্ষে তা কিছুতেই সম্ভব নয়। সেই খ্রিস্টান প্রশাসককে সাহায্য করার জন্য মুসা বিন নুসাইর তারিক বিন যিয়াদকে ডেকে পাঠান।