এখন চার মাইল দূরত্ব হলেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আগ্নেয়গিরির কালো লাভা দিয়ে তৈরি লে মর্ন ব্রাব্যান্ট পর্বত মালার সুউচ্চ চূড়া। মরিশাস দ্বীপের চারপাশে বসে চলা স্বচ্ছ নীল জলের প্রবাহ এমন এক সমৃদ্ধিশালী মেরিন লাইফের সৃষ্টি করেছে যে দুনিয়া জোড়া মৎস্য প্রেমিদের কাছে এ জায়গা “হটস্পট।” ছিপ দিয়ে মাছ ধরার জন্য এমন দ্বিতীয়টি নেই।
শাসা কোর্টনি সবসময় দ্বীপের পূর্ব-পরিচিত ক্রু আর একই বোটংকেই চার্টার করতে পছন্দ করেন। ইঞ্জিনে প্রপেলার আর হাল মিলিয়ে পানিতে প্রতিটি নৌকার আছে নিজস্ব এক ছন্দ, যা মাছের ঝাককে আকর্ষণও করতে পারে আবার তাড়িয়েও দিতে পারে।
লে বনহুর এরকম একটি ভাগ্যবান নৌকা। এর স্কিপারের চোখ দুটো ঠিক সামুদ্রিক পাখি গ্যানিটের মতোই শ্যেন। এক মাইল দূর থেকে দেখলেও চিনে ফেলে দশ কিলো ওজনের মার্লিন।
কিন্তু আজ কী যে হয়েছে, টোপের মাছও পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে কেটে গেছে দুই ঘণ্টা।
ভারত মহাসাগরের চারপাশে আজ থিকথিক করছে মাছের আঁক। জেলেদের জীবনে এ এক ট্র্যাজেডি মাখা দিন; যখন আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত ছোট ছোট মাছ। লে বনহুর ক্রুদের ফেলে রাখা পালক লাগানো বঁড়শিটা এগুলোর নজরেই পড়ছে না, ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে ঝকের মাঝে ঢুকে পড়া দানবীয় মাছগুলোর হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য।
ডেকের পনের ফুট উপরের ঝুলন্ত ব্রিজে দাঁড়িয়ে নিচের স্বচ্ছ পানি পরিষ্কারভাবেই দেখতে পাচ্ছেন শাসা। লে বনহুরের পাশ দিয়ে ছোটাছুটি করা মাছের ঝাঁক দেখে প্রায় আকুতির মতো করে বলে উঠলেন, “আমাদের একটা দরকার শুধু, একটা টোপ ফেলার মাছ। গ্যারান্টি দিচ্ছি যে মার্লিন ধরা পড়বেই।
তাঁর সাথে পাশেই ব্রিজের রেইলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এলসা পিগটেলি। পরনে রক্তলাল সংক্ষিপ্ত বিকিনি; মোলায়েম দেহতত্ত্ব দেখে মনে হচ্ছে যেন সদ্য ওভেন থেকে বের করে আনা হানি ব্রেড।
“দেখো!” এলসার চিৎকার শুনে একেবারে সময় মতো মাথা ঘোরালেন শাসা। লে বনহুরের পাশে চক্কর কাটছে একটা মার্লিন। পানি কেটে এত দ্রুত বেগে চলে গেল যে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল বোনিত ঝক। সূঁচালো মুখটা পুরোপুরি একটা বেস বল ব্যাট। ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাওয়া গায়ের রঙ ইলেকট্রিক ব্লু আর লাইল্যাক হয়ে যেন আকাশের নীলের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
“কত্ত বড় আর সুন্দর!” হা হা করে উঠল শাসার অন্তর।
কামানের গোলার মতো পানি কেটে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে বিশাল মার্লিন।
“একটা টোপ!” মনে হলো যেন তছনছ হয়ে গেছে জীবন; এমনভাবে মুষড়ে পড়লেন শাসা।
“আমার পুরো রাজ্য দিয়ে দেব একটা টোপ পেলে।”
দিগন্তে ছড়িয়ে থাকা আরো আধ ডজন নৌকার অবস্থাও এক জাহাজের রেডিও’তে শোনা যাচ্ছে স্কিপারদের হতাশা ভরা কণ্ঠস্বর। কারো কাছে কোনো ফাঁদ নেই; অথচ সুইসাইডের জন্য অপেক্ষা করছে মার্লিন।
“আমি কী করব?” জানতে চাইল এলসা, “তুমি কী চাও আমি আমার যাদু দেখাই?”
“ঠিক হবে কিনা জানি না” হেসে ফেললেন শাসা, “কিন্তু আমি রাজি, দেখাও তোমার যাদু সুন্দরী!”।
পার্স খুলে লিপস্টিক হাতে নিলেন এলসা। “এ্যাবড়া কা জ্যাবড়া, এ্যাবড়া কা জ্যাবড়া!” ভক্তি ভরে মন্ত্র উচ্চারণ করে শাসা’র নগ্ন বুকে রক্তরাঙা হায়ারোগ্লিফিক আঁকলেন এলসা; আপন মনেই বিড়বিড় করতে লাগলেন কোনো মন্ত্র।
“ওহ ইয়েস! আই লাভ ইট।” অট্টহাসি দিয়ে উঠলেন শাসা, “আমার মনে হচ্ছে সত্যিই কাজ হবে! কী বলো?”
“তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে।” সাবধান করে দিলেন এলসা, “নতুবা যাদু কাজ করবে না।”
‘বিশ্বাস করছি বাবা!”
হঠাৎ করেই নিচ থেকে শোনা গেল এক নাবিকের চিৎকার। ছোট্ট একটা বঁড়শিতে আটকা পড়েছে মাছ।
হাসি মুছে গেল শাসা’র মুখ থেকে; মুহূর্তখানিক অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন এলসা’র দিকে। “ধুত্তোরি, তুমি তো দেখছি সত্যি একটা ডাইনি।” বিড়বিড় করতে করতে সিঁড়ির দিকে দৌড়ে গেলেন শাসা।
তড়পাতে থাকা বোনিতো’কে আদর করে হাতের মাঝে ধরে রেখেছে এক ক্রু। বুকের কাছে ঝাপটে ধরে রাখায় সুবিধে করতে পারছে না মাছটা। স্বস্তি পেলেন শাসা; চোয়ালের কাছে আটকে আছে বঁড়শি। ফুলকার কোনো ক্ষতি হয়নি।
বঁড়শিটা খুলে ফেলে ক্রু’কে আদেশ দিলেন, “টার্ন হিম!” উল্টো করেই ধরতেই সাথে সাথে স্থির হয়ে গেল বোনিতো/ টুনি মাছ।
সার্জনের মতো করে টোপ ফেলার যন্ত্রপাতি মেলে বসলেন শাসা। কাপড়ে ফুল তোলার লম্বা হুক নিয়ে সাবধানে ঢুকিয়ে দিলেন বোনিতো’র চোখের গহ্বরে। আইবলটা একপাশে সরিয়ে দিলেও একটু’ও কোনো ক্ষতি করল না হুক। মাছের খুলি ভেদ করে বিপরীত দিকের চোখের একই অংশ দিয়ে বের হয়ে এলো সুই। ১২০ পাউন্ড ড্যাকরন লাইন দিয়ে আটকে দিলেন বোনিতো’র চোখ। এরপর তুলে নিলেন বিশাল ১২/০ মারলিন হুক। কয়েকবার ফাঁস লাগিয়ে গিটের মতো আটকে দিলেন বোনিতো’র চোখে, জীবিত মাছের দৃষ্টিশক্তিও অক্ষুণ্ণই রইল বলা চলে।
এরপর উঠে দাঁড়িয়ে কু’র দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন শাসা গানওয়েলের পাশে হাঁটু গেড়ে পাশ দিয়ে ছেড়ে দিল বোনিতো। মুক্তি পাবার সাথে সাথে ডারকন লাইন নিয়ে পালিয়ে গেল বোনিতো। হারিয়ে গেল গভীর নীল মহাসমুদ্রের মাঝে।
ফাইটিং চেয়ারে পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন শাসা। ফিন-এর টাইকুন রীল মেরিন গ্রেড অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি হয়েছে। পাঁচ কিলো ওজনের রীলটাতে জড়ানো আছে এক কি.মি’র বেশি ডারকনলাইন। হিস হিস শব্দে রীল থেকে ছুটে যাচ্ছে লাইন। বোনিততর সাথে সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে সমুদ্রের বুক। টেনশন কমাতে আঙুলের ডগা দিয়ে লাইন স্পর্শ করলেন শাসা।
প্রতি পঞ্চাশ গজ পরপর সিল্কের সুতা দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে লাইন। একশ গজ ছাড়ার পর রীলের লিভার টেনে দিলেন।
এরই মাঝে লাইনকে সেপারেট রাখা আর মারলিন গেঁথে গেল টেনে তোলার জন্য বিশ ফুট লম্বা আউটরিগার বের করে আনল নৌকার ত্রু। কিন্তু চিৎকার করে উঠলেন শাসা,
“না, এটাকে আমিই ধরবো।”
ফাঁদের গভীরতা আর ড্রপ ব্যাকের সম্পর্কে জানার জন্য এর চেয়ে ভালো আর কোনো উপায় নেই। তবে এর জন্য প্রয়োজন ধৈর্য। অভিজ্ঞতা আর সামর্থ্য।
খুব সাবধানে রীল থেকে একশ ফুট লাইন বের করে ডেকের উপর পেঁচিয়ে রেখে দিলেন শাসা। তারপর সে বনহুর’র স্টার্নে গিয়ে চিৎকার করে ডাকলেন স্কিপারকে “আলিজ!”
স্পিপার গিয়ার লিভার এনগেজ করে দিতেই প্রপেলার অলসভাবে ঘোরা শুরু করল। ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোতে লাগল লে বনহুর।
ধীরে ধীরে হাঁটার গতিতে বেড়ে চলল স্পিড। শাসা’র হাতে ধরা লাইনের ওজনও বেড়ে গেল। বেল্ট বাঁধা কুকুরের মতো বোটটাকে অনুসরণ করছে বোনিতো। পানিতে লাইনের অ্যাংগেল দেখে গভীরতা আন্দাজ করে নিলেন শাসা। তিনি মাছের অবস্থাও বলে দিতে পারবেন লেজের বাড়ি, টার্ন কিংবা ডাইভ দেখে।
মিনিট খানেকের মাঝেই হাতে ঝি ঝি ধরে গেলেও পাত্তা দিলেন না শাসা। বরঞ্চ ব্রিজে ডেকে পাঠালেন এলসা’কে : “তোমার কালা যাদু আরেকবার দেখাও তো পাখি।”
“এটা শুধু একবারই কাজ করে।” মাথা নাড়লেন এলসা।” বাকিটা এবার নিজের কাজ নিজেই সামলাও।”
শাসা’র নির্দেশে উত্তর দিকে টার্ন নিল লে বনহুর।
মোড় ঘোরার অর্ধেকে শাসা’র হাতের লাইন টান টান হয়ে পড়ায় দ্রুত সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন শাসা।
“কী হয়েছে?” আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন এলসা।
“বোধহয় কিছু না।” স্বীকার করলেন সমস্ত মনোযোগ দিয়ে লাইনটাকে ধরে আছেন শাসা।
আবারো টান পড়লেও এবার বদলে গেল বোনিতো’র আচরণ। সমানে খাবি খাচ্ছে, ডাইভ দিচ্ছে, ঘুরে যেতে চাইছে; কিন্তু সামনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে লে বনহুর।
“অ্যাটেনশন!” নাবিকদেরকে সতর্ক করে দিলেন শাসা।
“কী হচ্ছে?” আবারো জানতে চাইলেন এলসা।”
“কিছু একটা বোনিতো’কে ভয় দেখাচ্ছে” উত্তর দিলেন শাসা, “নিচে মাছটা কিছু দেখেছে।”
ঠিক যেন উপলব্ধি করতে পারছেন গভীর মহাসমুদ্রের নিচে দানবীয় ছায়া দেখে আঁতকে উঠা ছোট্ট মাছটার ভয়। কিন্তু বোনিতো’র হাবভাব দেখে হয়ত সাথে সাথে চলে যাবে মারলিন। মিনিট কেটে গেল। তারপর আরেক মিনিট। উত্তেজনায় শক্ত হয়ে বসে আছেন শাসা।
হঠাৎ করেই আঙুলের ফাঁক গলে চলে যেতে শুরু করল লাইন। মুহূর্ত খানেকের জন্য বিশাল মাছটার ওজন অনুভব করলেন শাসা।
মাথার উপর দু’হাত তুলে গর্জন করে উঠলেন, “স্ট্রাইক! স্টপ ইঞ্জিনস?”
বাধ্য ছেলের মতো গিয়ার লিভার নিউট্রাল করে দিল স্কিপার। পানির মাঝে স্থির হয়ে গেল লে বনহুর। লাইনটাকে তুলে পরীক্ষা করলেন শাসা। জীবনের কোনো চিহ্নই নেই-মার্লিনের এক আঘাতেই মৃত্যুবরণ করেছে বোনিতে।
কল্পনার চোখে যেন পুরো দৃশ্যটাই দেখতে পেয়েছেন শাসা। বোনিতো’কে। মেরে চারপাশে চক্কর দিচ্ছে মার্লিন। এখন প্রয়োজন হচ্ছে লাইনটাকে একেবারে নাড়াচাড়া না করা; যেন ভয় পেয়ে পালিয়ে না যায় মার্লিন।
সেকেন্ডগুলো যেন হয়ে উঠল অনন্তকাল।
“মার্লিন নিশ্চয়ই আরেকবার চক্কর মারতে আসছে।” কিছুই না ঘটাতে নিজেই নিজেকে উৎসাহ দিচ্ছেন শাসা।
স্কিপার কিছু একটা বলতেই খেঁকিয়ে উঠলেন।
হঠাৎ করেই আঙুলের নিচে কেঁপে উঠল লাইন। স্বস্তির চোটে চিৎকার দিয়ে উঠলেন শাসা,
“ওই তো আছে! এখনো আছে।”
হাততালি দিয়ে উঠলেন এলসা, “মাছটাকে খেয়ে ফেল মার্লিন, মিষ্টি মাছটাকে খেয়ে ফেল।”
মাঝে মাঝেই আলতোভাবে দুলে উঠছে লাইন। আঙুলের ফাঁক দিয়ে আরো কয়েক ইঞ্চি ছেড়ে দিলেন শাসা। মানস চক্ষে দেখতে পাচ্ছেন বোনিতো’কে গিলে খাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মারলিন।
“ও যেন বঁড়শিটা না দেখতে পায়।” মনে মনে প্রার্থনা করে ফেললেন শাসা। বোনিতো’র মাথার ভেতর গেঁথে যাওয়া হুক এতক্ষণ মার্লিনের পেটে চলে যাওয়ার কথা; কিন্তু যদি তা না হয়-আর ভাবতে চাইলেন না শাসা।
খানিকক্ষণ কেটে যাবার পর আবার নড়ে উঠল লাইন।
“টোপটা গিলে ফেলেছে” উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন শাসা। ডেক থেকে আড়কাঠের উপর দিয়ে একের পর এক লাইন চলে যাচ্ছে পানিতে।
সুইভেল চেয়ারে বসে ঝাঁকুনি খেলেন শাসা। ফিন-এর রীলের হার্নেশ চেয়ারের সাথে পেঁচিয়ে আরেকটু হলেই পাঁচশ ফুট নিচে ফেলে দিচ্ছিল তাঁকে। শুধু নিজের ব্যালান্স আর শক্তির ভারে টিকে গেলেন শাসা। নতুবা হাজার পাউন্ডের বেশি ওজনের মাছটা মেরিন ডিজেল ইঞ্জিনের মতো টেনে নিয়ে জাহাজের পাশ দিয়ে টুপ করে শাসা’কে পানিতে ফেলে দিলেও কেউ টের পেত না।
বেক এনগেজ করতেই প্যাচানো লাইন খানিকটা থেমে গেল। ফটবোর্ডের উপর পা দিয়ে আটকে রাখলেন শাসা। তাড়াতাড়ি চিৎকার করে স্কিপার মাটির্নকে ডাকলেন, “আলেজ গো!”
থ্রটল খুলে দিতেই কালো তেলতেলে ডিজেলের মেঘ একজস্ট থেকে বের হতে লাগল। লাফ দিয়ে আগে বাড়ল লে বনহুর।
বোটের শক্তি আর গতিকে কাজে লাগিয়ে মাছের ভেতরে বঁড়শিটাকে গাঁথার চেষ্টা করলেন শাসা।
“আরেতেজ ভওস! “বঁড়শিটা বিধে গেছে বুঝতে পারলেন শাসা। “স্টপ?” চিৎকার করতেই থ্রটল বন্ধ করে দিলো মার্টিন।
পানির ভেতর স্থির হয়ে রইল লে বনহুর। এখনো ব্রেক থাকায় আটকে আছে রীল।
নিচে হঠাৎ করেই নড়ে উঠল মারলিন।
“এইরে চলে যাচ্ছে!” গর্জন করে উঠলেন শাসা। রীলের রডটা ভেঙে গেছে। আর লাইন ছুটে যাওয়াতে ভড়কে গেছে মাছটা। কোথাও কোনো গণ্ডোগোল হয়েছে বুঝতে পেরে পাগলের মতো দৌড় শুরু করেছে মারলিন। আরো একবার ঝাঁকুনির চোটে নিজের সিট থেকে লাফিয়ে উঠলেন শাসা। বিশাল ফিন-এর পর্যন্ত সহ্য করতে পারল না; ধোঁয়া উঠল রীলের ভেতর থেকে। বীয়ারিভের গ্রিজ গলে গলে পড়তে লাগল।
শরীরের সমস্ত ভার দিয়ে চেয়ারে চেপে বসে রইলেন শাসা। দুই হাত দিয়েও ধরে রাখতে পারছেন না রীল। কসাইয়ের চাকু’র মতই ধারাল ড্যাকরন লাইন- অত্যন্ত বিপদজনক হয়ে উঠেছে; যে কোনো মুহূর্তে আঙুল কেটে যেতে কিংবা মাংস থেলে যেতে পারে।
কিন্তু বিনা বাধায় ছুটে যাচ্ছে মারলিন। সেকেন্ডের মাঝে পানির ভেতর উধাও হয়ে গেল আধা কি.মি. লাইন।
“হতচ্ছাড়া চায়নাম্যান বাবার বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে” দাঁত কিড়মিড় করে উঠলেন শাসা, “মনে হচ্ছে জীবনেও থামানো যাবে না!”
হঠাৎ করেই দু’ভাগ হয়ে গেল মহাসমুদ্রের সাদা জল দেখা দিল মারলিন। মনে হলো সবকিছু স্লো মোশন হয়ে গেছে। লাফ দিয়ে ঠিক যেন আকাশে উঠে গেল মারলিন। সাবমেরিনের মত গা থেকে ছিটকে পড়ল পানির ফোয়ারা। লে বনহুর থেকে পাঁচশ গজ দূরে থাকলেও মনে হলো যেন গোটা আকাশ ঢাকা পড়ে গেল।
“আরেব্বাস, কত বড়! আর্তচিৎকার করে উঠল মার্টিন। শাসা’ও জানেন কথাটা কতটা সত্য-এত বড় মারলিন আগে আর দেখেননি। নীলের ছটায় যেন স্বর্গও আলোচিত হয়ে উঠল।
একইভাবে সমুদ্রের বুকে আঁছড়ে পড়ল মারলিন। চারপাশে শক ওয়েভ ছড়িয়ে চলে গেল, নিজের রাজসিক স্মৃতি রেখে।
রীল থেকে ছুটে যাচ্ছে লাইন। ভারী ব্রেক দেয়া থাকলেও কিছুতেই আটকানো যাচ্ছে না।
‘টার্নি! টর্নি!” ধাতস্থ হতেই আতঙ্কের চিৎকার জুড়ে দিলেন শাসা। স্কিপারের উদ্দেশ্য বলে উঠলেন, “টার্ন অ্যান্ড চেস হিম!”
সর্বশক্তি দিয়ে মারলিনের পিছু নিল লে বনহুরের ইঞ্জিন। বাতাস আর ঢেউ কেটে সাদা ফোয়ারা ছিটিয়ে তরতর করে এগোচ্ছে লে বনহুর।
চেয়ারে বসে সমানে এপাশ ওপাশ করছেন শাসা। শক্ত করে চেয়ারের হাতল ধরে রাখলেও স্থির থাকতে পারছেন না। এদিকে লে বনহুর ফুল থ্রটলে ছুটতে লাগলেও লাইন থামছে না। তাদের চেয়েও দশ নট গতিতে এগিয়ে আছে মারলিন। অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলেন শাসা।
“শাসা!” ব্রিজ থেকে ভেসে এলো এলসার চিৎকার “মারলিন ঘুরে গেছে।” উত্তেজনায় ইতালি ভাষা বলছেন এলসা।
“স্টপ!” স্কিপারের উদ্দেশ্য হাঁক ছাড়লেন শাসা।
কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে ঘুরে গিয়ে নৌকার পেছন দিকে ছুটতে শুরু করল মারলিন।
কোন এক ভাবে পানির ভেতরে লাইন ফাঁস দিয়ে ফেলেছে মারলিন। ঠিক সময়ে ব্যাপারটা দেখতে পেয়েছেন এলসা।
মারলিন নৌকার নিচে আসার আগেই ফাসটাকে খুলতে চাইছেন শাসা। হ্যাঁন্ডেল ঘোরাতে লাগলেন। আস্তে আস্তে ভেজা লাইন উঠে আসছে নৌকার উপরে। লাইনের গিটও উপরে উঠে এসেছে আর একই সময়ে নৌকার নিচে এসেছে মারলিন। আবারো টান টান হয়ে গেল লাইন।
কিন্তু মরিয়া হয়েও রীল আর লাইন টানতে পারছেন না শাসা।
“টার্ন নাউ।” কোন মতে আদেশ দিলেন। খোলা বুক থেকে টপটপ করে ঝড়ে পড়ছে ঘাম। এলসা’র এঁকে দেয়া লিপস্টিকের নকশা ধুয়ে মুছে শটর্সের উপর পড়তে লাগল।
“টার্নং কুইকলি! কুইকলি!”
দ্রুত গতিতে বিপরীত দিকে ছুটে যাচ্ছে মারলিন আর লাইনটা টাইট হতেই লে বনহুরকেও ঘুরিয়ে নিল স্কিপার। রডের মাথায় মাছটার পুরো ওজন পড়াতে ঝড়ে কাত হয়ে থাকা উইলো গাছের মতো বেঁকে গেল রড।
এতক্ষণ কষ্ট করে যতটুকু লাইন গুটিয়ে এনেছিলেন তার সবটুকুই আবার পানিতে টেনে নিয়ে গেল মারলিন। হতাশা ভরে তাকিয়ে রইলেন শাসা।
ঘণ্টা খানেক কেটে গেলেও থামল না এই পিছু নেয়া। ড্যাকরন লাইনের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ছে। রীলের উপর চেয়ার রেখে তার উপরে দাঁড়িয়ে পড়লেন শাসা।
বালতি থেকে নোনা জল নিয়ে শাসা’র কাঁধে ছিটিয়ে দিল এক ত্রু। কোমরের কাছে হার্নেসের নাইলন’কে পেঁচিয়ে নিয়েছেন শাসা; ফলে টাইট হয়ে বসে যাওয়া জায়গাটার চামড়া কেটে রক্ত বের হতে লাগল। মাছটার ছোটার সাথে সাথে গম্ভীর হচ্ছে ক্ষত।
দ্বিতীয় ঘণ্টা হলো আরো বিভীষিকাময়। মারলিনের ছোটার গতি একটুও ক্ষীণ হলো না। শাসা’র মাথা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝড়ে পড়ছে। ব্রিজ থেকে নিচে নেমে এলেন এলসা; হার্নেস আর শাসা’র রক্তাক্ত কোমরের মাঝে কুশন। রেখে একমুঠো সল্ট ট্যাবলেট খাইয়ে দিলেন; সাথে দু’ক্যান কোক। মুখের উপর ক্যান ধরতেই ঢকঢক করে খেয়ে নিলেন শাসা।
“আচ্ছা বলতো তো” এক চোখ ভর্তি আকুতি নিয়ে এলসা’র দিকে তাকালেন শাসা,
“এসবের কোনো দরকার আছে?”
“কারণ তুমি যে একটা পাগল। আর পুরুষদেরকে কিছু কাজ করতেই হয়।” ভোয়ালে দিয়ে শাসা’র মুখে ঘাম মুছে কি করলেন এলসা; বোঝাই যাচ্ছে শাসা’কে নিয়ে কতটা গর্বিত বোধ করছেন।
তৃতীয় ঘণ্টার মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে দ্বিতীয়বার সুযোগ পেলেন শাসা। কেমন যেন অসাড় হয়ে হালকা হয়ে গেল পা; টের পেলেন না কোমরের ব্যথা। ফুটবোর্ডের উপর যেন দৃঢ়ভাবে গেঁথে গেল পা।
“তো ঠিক আছে”, মোলায়েম স্বরে বলে উঠলেন শাসা, “এবারে তোমার পালা শেষ। এখন আমার টান এসেছে।” বুঝতে পারলেন দুর্বল হয়ে পড়েছে মার্লিন।
চাঙ্গা হয়ে উঠলেন শাসা, “তো বাছা, এখন তো তুমিও ব্যথা পাচ্ছো তাই না?” লাইন টেনে টেনে রীলের গায়ে পেঁচাতে গিয়ে বানিয়ে ফেললেন চারটা কয়েল। জানেন এবার আর ছুটবে না লাইন। অবশেষে মারলিনকে বাগে পেয়েছেন।
চতুর্থ ঘণ্টা শেষে একেবারেই কাবু হয়ে গেল মারলিন। শুধু তিনশ ফুট গভীর চক্কর কেটে চলল বেচারা। কাঁধের কাছে প্রায় চার ফুট চওড়া মাছটার ওজন হবে এক টনের চার ভাগের তিন ভাগ। আধা অন্ধকারে ওপালের মতো জ্বলছে চোখ। দেহ ছড়াচ্ছে লাইলাক আর নীল রঙা শিখা।
ফাইটিং চেয়ারে কুঁজো হয়ে বসে আছেন শাসা কোর্টনি। পা ভাঁজ করে আবার মেলে ধরতেই নিজেকে মনে হলো আথ্রাইটিসের রোগী। প্রতিটি নড়াচড়ার সাথে টের পাচ্ছেন ব্যথা।
মাছ আর মানুষ মিলে ভয়ংকর এক লড়াই করেছে শেষাংশে পৌঁছে। খুব দ্রুত দু’বার লাইন গুটিয়ে নিলেন শাসা। মাছটার প্রতিটা চক্করের সাথে একটু একটু করে লাইন টেনে আনলেও ব্যথা আর ঘামে সিক্ত হয়ে গেছে শরীর। তবুও টের পাচ্ছেন যে শেষ হয়ে আসছে এই প্রতীক্ষা। বুকের মাঝে লাফাচ্ছে হৃদপিণ্ড; মেরুদণ্ডে যেন আগুন জ্বলছে। ভেতরে মনে হচ্ছে কোন একটা বিস্ফোরণ ঘটে যাবে; তারপরেও সর্বশেষ শক্তি দিয়ে মারলিনকে দিলেন টান।
“প্লিজ” ফিসফিস করে উঠলেন শাসা।
“তুমি আমাদের দুজনকেই মেরে ফেলছ। এবার ক্ষান্ত দাও, প্লিজ।”
আবারো লাইন ধরে টানলেন শাসা; এবারে রণ ভঙ্গ দিল মারলিন। ধীরে ধীরে উঠে এলো ভারী মাছ। স্টার্নের এত কাছে দিয়ে মারলিনের মাথা দেখে শাসা’র মনে হলো ইচ্ছে হলেই বিশাল চোখ দুটোকে ছুঁয়ে দেখা যায়।
আকাশের দিকে নাক উঁচিয়ে মারলিন মাথাটাকে এমনভাবে ঝাঁকুনি দিল যে মনে হলো পানি থেকে উঠে এসে কান ঝাড়ছে একটা স্প্যানিয়েল কুকুর।
পানিতে থেকেই তেকোণাকার বিশাল ঠোঁটটা খুলে মাথা নাড়তে লাগল মারলিন; এতটা ভীষণ শক্তির সামনে অসহায় হয়ে পড়লেন শাসা। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। হাতের মাঝে ঝাঁকি খাচ্ছে রড।
মারলিনের খোলা চোয়ালের ভেতর বেঁকে যাওয়া বঁড়শি দেখে মন খারাপ করে ফেললেন শাসা।
“স্টপ ইট!” মাছটাকে টেনে ধরতে চাইলেন শাসা। কিন্তু বঁড়শিটাকে ধরার আগেই বার বার পিছলে যাচ্ছে। মারলিন হা করতেই কালো ঠোঁটের গায়ে দেখা গেল হালকাভাবে ঝুলছে বঁড়শি। আরেকটাবার মাথা ঝাঁকালেই স্টিলের দড়ি ছুঁড়ে ফেলে দেবে মারলিন।
চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে নিজের অবশিষ্ট শক্তি জড়ো করলেন শাসা। ফেনার মাঝে সমুদ্রে হারিয়ে গেল মারলিন।
“দড়ি” চিৎকার করে ডে’কের কু’কে ডাকলেন শাসা, “দড়ি ধরো” স্টিলের দড়ি ধর সরাসরি টানলে তবেই যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায় মারলিনের শক্তি!
লড়াইয়ের পুরো চার ঘণ্টাতে স্বয়ং জেলে ব্যতীত আর কারো বঁড়শি কিংবা লাইন ধরার অনুমতি নেই। ইন্টারন্যাশনাল গেম ফিশিং অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করেছে এ নীতি।
কিন্তু মারলিন যাতে হাতছাড়া না হয় তাই কু’দেরকে অনুমতি দেয়া হলো ত্রিশ ফুট স্টিলের পঁড়ি ধরার জন্য।
“দড়ি!” আকুতি জানালেন শাসা। ভারী লেদারের গ্লাভস্ পরে চটপট করে স্টার্নের কাছে চলে গেল নাবিকদের দল।
আবারো উপরে উঠে এলো মারলিন। যেন একটা মরা কাঠ।
“আর একবার উঠে দাঁড়ালেন শাসা। এত হালকাভাবে গেঁথে আছে বঁড়শিটা যে একটু ঝাঁকুনি লাগলেই খুলে গিয়ে মারলিনকে মুক্ত করে দেবে।
ডে’কের উপর এনে রাখা হল স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি বিশাল একটা বঁড়শি। খুলে ফেলা যায় এমন একটা পোলের শেষ মাথায় লাগানো হয়েছে বঁড়শিটা আর একবার মারলিনের কাঁধে বিধিয়ে দিতে পারলেই সব ঝামেলা শেষ।
গ্লাভস্ পরিহিত ক্রু’র হাত মাত্র ছয় ইঞ্চি দূরে থাকতেই শেষবারের মতো লেজের বাড়ি মাল মারলিন; রডের মাথা খানিকটা বেঁকে যেন সম্মতি দিল আর খুলে গেল বঁড়শি-মুক্ত হয়ে গেল মারলিন।
তড়াক করে সোজা হয়ে গেল রঙ আর বঁড়শিটা বাতাসে শিষ কেটে গিয়ে বিধল লে বনহুরের গানওয়েলে। চেয়ারে লাগতেই উলটে পড়ে গেলেন শাসা। মাত্র চল্লিশ ফুট দূরেই সমুদ্রে ভেসে রইল মার্লিন। মুক্তি পাবার পরেও সাঁতার কেটে সরে যাবার শক্তি পাচ্ছে না।
হা হয়ে তাকিয়ে রইল বিস্মিত নাকিবেরা; তবে সবার আগে সম্বিৎ ফিরে পেল স্পিকার মার্টিন। লে বনহুর’কে রিভার্স করে নিয়ে চলল মারলিনের দিকে।
“আমরা এটাকে ধরবোই!”
বঁড়শিযুক্ত লাঠি হাতে থাকা ক্রু’র দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন-স্কিপার। স্টানের গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে মারলিন। রেলিং এর কিনারে দৌড়ে গিয়ে চকচকে বঁড়শিটা মারলিনের পিঠে ছুঁড়ে মারবে –এমন সময় টলমল পায়ে উঠে দাঁড়ালেন শাসা। সীসার মতো ভারী পা দুটোতে যেন কোনো শক্তিই নেই। কিন্তু ঠিক সময় মতো ধরে ফেললেন নাবিকটার কাধ।
“না” ভাঙ্গা গলায় জানালেন শাসা। “না” বঁড়শিটা নিয়ে ডেকের উপর ফেলে দিলেন; মন খারাপ করে তাকিয়ে রইল ডে’কের নাবিক। এতক্ষণ ধরে মাছটার জন্য প্রায় শাসা’র মতই পরিশ্রম করেছে সকলে।
কিন্তু এতে কিছু যায় আসে না। পরে সবাইকে বুঝিয়ে বলবেন যে স্বাধীন একটা মাছের গায়ে লাঠির বঁড়শি ফেলা ঠিক না। যে মুহূর্তে মারলিন হুকটাকে ছুঁড়ে ফেলেছে সে মুহূতেই লড়াইয়ে জিতেও গেছে। এখন এটাকে মেরে ফেললে সেটা খেলুড়ে সুলভ হবে না।
দেহের ওজন আর ধরে রাখতে পারছে না তার পা। হাঁটু ভেঙে বসে পড়ালেন শাসা। স্টার্নের কাছেই ভেসে রইল মারলিন। একটু কাত হয়ে মারলিনের কুচকুচে কালো পিঠের পাখনাটা স্পর্শ করলেন শাসা। প্রান্তগুলো প্রায় তরবারির মতই ধারালো।
“ওয়েল ডান ফিশ” ফিসফিস করে উঠলেন শাসা। নিজের স্বেদবিন্দুর লবণ আর জলে ভরে উঠল চোখ। “ফাইট একটা দেখিয়েছে বটে।”
এমনভাবে মারলিনের পিঠে হাত বোলালেন যেন কোনো সুন্দরী রমণী শাসার স্পর্শে যেন প্রাণ ফিরে পেল মারলিন। লেজটা আরো দ্রুত নাড়তে শুরু করল। নিঃশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে সরে পড়ল।
প্রায় আধা মাইল পর্যন্ত মারলিনকে অনুসরণ করল লে বনহুর। রেইলের কিনারে হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন শাসা আর এলসা। তাকিয়ে দেখলেন আস্তে আস্তে শক্তি ফিরে এসেছে বিশাল মারলিনের দেহে।
নিজের মহিমা দেখিয়ে পানির গভীরে চলে গেল মারলিন। বহু নিচে নিয়ে গেল অন্ধকার একটা ছায়া। চলে গেছে মারলিন।
দীর্ঘ পথটুকু পাড়ি দিয়ে আবারো বন্দরে ফিরে এলো লে বনহুর। পুরো পথটুকু জুড়েই কাছাকাছি বসে রইলেন শাসা আর এলসা। মন ভরে উপভোগ করলেন দ্বীপের সৌন্দর্য আর মাঝে মাঝে এক কী দু’বার একে অন্যের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে হাসলেন যেন দু’জনেই পড়তে পেরেছেন দু’জনের হৃদয়ের কথা।
ব্ল্যাক রিভার হারবারে লে বনহুর ফিরে আসতে আসতে ড’কে চলে এলো অন্য নৌকাগুলো। ক্লাবহাউজের সামনে টাঙ্গিয়ে রাখা হয়েছে। দুটো মৃত মার্লিনের দেহ। তবে কোনটাই শাসা’র হৃত মাছের অর্ধেকও নয়। চারপাশে জটলা করছে মানুষ। বঁড়শি নিয়ে পোজ দিচ্ছেন সফল অ্যাংলার। বোর্ডে লেখা হয়েছে তাঁদের নাম আর মার্লিনের ওজন। পোর্ট লুইসের ইন্ডিয়ান ফটোগ্রাফার ট্রাইপডের উপর উপুড় হয়ে তুলছে বিজয়ীদের ছবি।
“কখনো চাওনি যে তোমার মাছটাও এখানে ঝোলানো থাকুক?” জানতে চাইলেন এলসা।
“জীবিত থাকলেই তো মারলিনকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখায়।” বিড়বিড় করে উঠলেন মাসা। “আর মারা গেলেই কুৎসিত হয়ে যায়।” মাথা নেড়ে জানালেন, “আমার মার্লিন এর চেয়ে বেশি কিছুরই যোগ্য।”
“আর তুমিও।” পথ দেখিয়ে শাসা’কে ক্লাব হাউজের বারে নিয়ে গেলেন এলসা। বুড়োদের মতো খানিক শক্ত হয়ে হাঁটলেও কেমন একটা অদ্ভুত গর্ব অনুভব করছেন শাসা।
গ্রিন, আইল্যান্ড রাম আর লাইমের অর্ডার দিলেন এলসা। “এবারে নিশ্চয় বাড়ি ফিরে যাবার শক্তি পাবে, তাইনা?” ভালোবেসে ভর্ৎসনা করে উঠলেন পিগটেলি।
বাড়ি মানে মেইসন ডেস্ আলিজেস ট্রেডইউন্ডস্ হাউজ। প্রায় শত বছর আগে নির্মাণ করে গেছে এক ফরাসী ব্যারন। শাসা’র আর্কিটেক্টের দল এটির পুনর্সংস্কার করলেও প্রাচীন আবহ পুরোপুরি বজায় রেখেছে।
বিশ একর বিস্তৃত বাগানের মাঝে চকচকে ওয়েডিং কেকের মতো লাগে পুরো দালান। ব্যারনের ট্রপিক্যাল গাছ সগ্রহের আগ্রহকে টিকিয়ে রেখেছেন শাসা। এসব গাছের মাঝে শাসা’র অন্যতম গর্ব হল রয়্যাল ভিক্টোরিয়া ওয়াটার লিলিস। ফিশ পন্ডে ভাসমান ওয়াটার লিলি’র পাতাগুলোর চার ফুট চওড়া আর কিনারের কাছটা বাঁকানো। ফুল’তো ঠিক যেন একটা মানুষের মাথা। এত বড় সাইজ।
ব্ল্যাক রিভার হারবার থেকে মাত্র বিশ মিনিট ড্রাইভ করলেই মেইসনে পৌঁছে যাওয়া যায়। গাছের চাঁদোয়ার নিচ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ফিরতে গিয়ে শাসা বলে উঠলেন, “ওয়েল, বাকি দলটাও মনে হচ্ছে নিরাপদে পৌঁছে গেছে।”
হাউজের মেইন পোর্টালের সামনের ড্রাইভওয়েতে দেখা গেল ডজন খানেক পার্ক করা গাড়ি। এলসা’র পার্সোনাল জে’টে করে জুরিখ থেকে এসেছেন দুইজন ইঞ্জিনিয়ার। পিগটেলি কেমিক্যালস এর টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে সিনডেক্স-২৫ এর প্ল্যান্টের নকশা’ও উনারাই করবেন। জার্মান ডিরেক্টর ওয়ার্নার স্টলজ’র সাথে ইউরোপে দেখা করেছেন শাসা।
এই সম্মেলনে যোগ দিতে জোহানেসবার্গ থেকে উড়ে এসেছেন ক্যাপরিক কেমিক্যালস’র টেকনিক্যাল ডিরেকটর আর ইঞ্জিনিয়ারদের দল। এর মালিক কোর্টনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল হোল্ডিংস।
ট্রান্সভ্যালের জার্মিস্টন শহরের কাছেই রয়েছে এ কোম্পানির প্রধান প্ল্যান্ট। বর্তমান প্ল্যান্টের অত্যন্ত সুরক্ষিত একটি অংশ তৈরি করা হয় উচ্চ পর্যায়ের বিষাক্ত কীটনাশক। কিন্তু প্রতিষ্ঠানকে বড় করার মতো যথেষ্ট জায়গা খালি পড়ে থাকায় লোকচক্ষুর অন্তরালে স্থাপন করা হবে সিনডেক্স প্ল্যান্ট।
পিগটেলি আর ক্যাপরিকর্নের প্রতিনিধিরা এই নতুন প্ল্যান্টের ব্লু-প্রিন্ট আর প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে আলোচনা করতেই এখানে জড়ো হয়েছেন। তাই সঙ্গত কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকাতে মিটিংটা করা হচ্ছে না; কিংবা এলসাও এও চেয়েছেন যেন তার কোনো স্টাফ প্ল্যান্টে নাই যাক; যাতে করে পিগটেলিকে কোনো ভাবেই দোষারোপ করা না যায়।
অবশেষে মরিশাসকেই বেছে নেয়া হয়েছে। শাসামেইন কেনার পরেও দশ বছর পার হয়ে গেছে। মরিশাস সরকার আর দ্বীপের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথেও উনার চমৎকার সম্পর্ক আছে।
অসুস্থ হয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত ব্রুনো পিগটেলি নিজেও নিয়মিত মরিশাসে মাছ ধরতে আসতেন। তাই দ্বীপের সকলেই এলসা’কে চেনে আর সম্মান করে। মেইসন ডেস আলিজোসে এলসা’র আগমন নিয়ে তাই কারো কোন মাথা ব্যথাই নেই।
টপ ফ্লোরে পৃথক হলেও ইন্টারকানেকটেড দু’টি স্যুইটে থাকেন শাসা আর এলসা। লোক দেখানো এই ব্যাপারটাতে বেশ মজা পায় পুরো পরিবার। পুলের পাশের লনে সকলে তাই এ জুটিরই অপেক্ষা করছে। ইভনিং ককটেলের সময় হয়েছে।
শাসাকে গোসল করিয়ে ক্ষতস্থানে মলম লাগিয়ে দিয়েছেন এলসা। তাই খানিকটা খুঁড়িয়ে হাঁটলেও বেশ তরতাজা বোধ করছেন শাসা। একসাথে দু’জনকে সিঁড়ি বিয়ে নামতে দেখে চোখে দুষ্টুমি নিয়ে জানতে চাইল গ্যারি, “শয়তানগুলোর দিকে দেখো, মনে হচ্ছে যে তারা শুধুই ভালো বন্ধু?” একে অন্যের দিকে তাকালো হোলি আর বেলা। এমনকি হাসি লুকোতে জাপানিজ পাখা দিয়ে মুখ ঢাকলেন সেনটেইন কোর্টনি।
সিনেটের অধিবেশন চললেও মেইসন ডেস আলিজেসে ইসাবেলার না। আসার কোনো কারণ-ই নেই। চিজোরা ট্রিপের পর থেকেই সি সি আই’র ব্যাপারে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে বেলা। সিনেটের এগ্রিকালচার স্ট্যান্ডিং কমিটিতে নিয়োগ পাবার পর গ্যারি’কে কিছু হিন্টস্ দিতেই সি সি আই বোর্ডে জায়গা পেয়ে যায় বেলা। ক্যাপরিকর্নের ম্যানেজমেন্ট টিমের সদস্য হিসেবে অত্যন্ত সক্রিয় বেলা একটিও মিটিং মিস করে না। সিনডেক্স নিয়েও আগ্রহ প্রকাশ করাতে বাধা দেয়নি গ্যারি।
একই সাথে হোলি আর বাচ্চাদেরকেও নিয়ে এসেছে। টেকনিক্যাল ডিসকাশনস নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও পরিবারের সাথে অবকাশ যাপনের সুযোগও হারাতে চায় না গ্যারি। পৌত্র-পপৗত্রিদের কাছ থেকে দূরে থাকতে নারাজ সেনটেইনও তাই ল্যানসেরিয়া প্রাইভেট এয়ারপোর্ট থেকে লিয়ারে চড়ে বসেছেন।
বস্তুত পুরো পরিবার আর তাদের লাগেজ থাকায় জায়গাই পাননি ক্যাপরিকর্নের ডিরেক্টরের দল। বাধ্য হয়েছেন কমার্শিয়াল ফ্লাইট ধরতে।
শাসা আর এলসা নেমে আসতেই ক্রুগের ফোয়ারা ছুটল পুরো পার্টি জুড়ে; একই সাথে পিঠ চাপড়ানো, হ্যান্ডশেক আর চিৎকার চেঁচামেচির জ্বালায় কান পাতা দায় হয়ে উঠল।
লিয়ার পাঠিয়ে জোহানেসবার্গ থেকে ইমপেরিয়াল ক্যাভিয়ার, ক্রুগ, ফ্রেশ ফুট আর বেবী ফুড আনিয়েছেন সেনটেইন। সাথে এনেছেন ফাইব স্টার বীচ রিসোর্টের সুপ্রশিক্ষিতি স্টাফ।
আগের দিন সন্ধ্যায় সেনটেইনের সাথে দেখা করেছেন এলসা। ক্লান্ত থাকলেও একে অন্যের সাথে সহজেই মিশে গেছেন সেনটেইন আর এলসা। প্রথমে খানিক জরিপ করে নিয়ে হেসে হাত বাড়িয়েছেন সেনটেইন, “তোমার ব্যাপারে শাসা অনেক ভালো ভালো কথা বললেও বুঝতে পারছি সত্যিটুকুর অর্ধেকও জানায় নি।” সেনটেইনের ইটালিয়া ভাষায় দক্ষতা আর প্রশংসা শুনে হেসে ফেললেন এলসা।
“আমি জানতাম না যে আপনি ইটালীয় ভাষা জানেন সিগনোরা কোর্টনি ম্যালকমস।”
“দু’জনের এমন আরো অনেক কিছুই জানে যা আমরা জানি না।”
মাথা নাড়লেন সেনটেইন।
“আই লুক ফরওয়ার্ড টু দ্যাট “ উত্তর দিলেন এলসা। এখন পাটিতে এসে তাই সহজভাবেই সেনটেইনের দিকে এগিয়ে গেলেন এলসা।
ওয়েল, এলসা’র সাথে হাত মিলিয়ে ভাবলেন সেনটেইন, খুঁজে পেতে অনেক দেরি করলেও শাসা’র অপেক্ষা সার্থক হয়েছে।
একে অন্যের পেছনে ছোটাছুটি করে খেলছে গ্যারির ছেলেমেয়েরা। তাদের আনন্দ দেখে যারপরনাই বিরক্ত শাসা। “আমার মনে হচ্ছে দিনকে দিন আমি অষ্টম হেনরীর মতো হয়ে যাচ্ছি-ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে বেশি ভালো লাগে না।”
“আমার যতদূর মনে পড়ে এই বয়সে তুমিও এমন চঞ্চল ছিলে।” নাতি নাতনীদের সমর্থনে জোর গলায় বলে উঠলেন সেনটেইন।
“তাহলে তুমি আমাকে তেলের মাঝে সেদ্ধ করে ফেলার কথা ছিল। আর মা, তুমিও দিনকে দিন বেশি বেশি স্নেহ প্রবণ হয়ে যাচ্ছ।”
হেসে ফেললেন সেনটেইন। পিগটেলি ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে গল্পে ব্যস্ত ইসাবেলার দিকে এগিয়ে গেলেন শাসা।
চারপাশে তাকিয়ে কেমন বিবমিষা বোধ করল বেলা। সবাই হাসছে। চিৎকার করছে। সম্রাজ্ঞীর মতো সবকিছুর দরবার বসিয়েছেন সেনটেইন। হোলি আর এলসা’র পরনের মহামূল্যবান সিঙ্ক আর শিফনের দাম যে কোনো শ্রমিকের এক বছরের বেতনের সমান। অথচ ওর ছোট্ট নিকোলাস কমব্যাট ক্যামোফ্লেজ পোশাক পরে হাতে যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে খেলা করে; সেন্য আর সন্ত্রাসীরা-ই হলো তাঁর সঙ্গী।
বেলা নিজে ফ্লার্ট করছে মাঝ বয়সী এক টাকলুর সাথে; যার সাথে মুদি দোকানদার কিংবা বার ম্যানের কোনো তফাৎ নেই। অথচ এই মুখোশের আড়ালে মৃত্যু নিয়ে খেলছে লোকটা আর এটাই হলো বাস্তবতা।
টেডি বিয়ার বড় ভাই আর বাবার দিকে তাকিয়ে হাসছে বেলা অথচ মনে মনে ষড়যন্ত্র করছে কিভাবে তার পরিবার আর দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা যায়। এই সুন্দরী আর সফল বুদ্ধিমান তরুণীর হাতেই আছে ভবিষ্যৎ আর তার চারপাশের পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ।
“একবারে মাত্র একটি দিন নিজেকে সাবধান করল বেলা,
“প্রতি পদক্ষেপে মাত্র এক পা।” আর পরের পদক্ষেপ হলো সিনডেক্স ২৫ প্রজেক্ট।
হয়ত রামোনের প্রতিশ্রুতি মতো এটাই হলো তার শেষ কাজ। একবার তাদের হাতে সিনডেক্স পৌঁছাতে পারলেই হয়ত চিরতরে মুক্তি পাবে এই মাকড়সার জাল থেকে-সে, রামোন আর নিকোলাস। হয়ত তখন শেষ হবে এই দুঃস্বপ্ন।
***
পরের দিন সকালবেলা মেইসন ডেস্ আলিজেসের ডাইনিং রুমে শুরু হলো কনফারেন্স। লম্বা ওয়ালনাট টেবিলের দু’পাশে বসে থাকা ত্রিশজন মানুষের আলোচনার বিষয় হলো মৃত্যু। এমনভাবে এর মেকানিকস, কেমিকেল স্টাকচার প্যাকেজিং আর কোয়ালিটি কন্ট্রোল নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হলো যেন সকলে ব্যস্ত কোনো পটেটো চিপস কিংবা ফেইস ক্রিম নিয়ে।
কোনো কিছুতেই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না স্ট্রিলের মতো শক্ত হয়ে বসে থাকা ইসাবেলা; ভালোভাবেই জানে যে গ্যারির পর্যবেক্ষণ শক্তি কতটা তীক্ষ্ণ। চশমার ওপাশে থাকা চোখ দুটো প্রায় কিছুই মিস করে না। বেলার বিতৃষ্ণা কিংবা ভীতি নিমিষেই টের পেয়ে যাবে গ্যারি। আর তাহলেই শেষ হয়ে যাবে ওর সব প্রচেষ্টা।
ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত প্রত্যেকের সামনে একটি করে চামড়ার ফোল্ডার রাখা হয়েছে; ভেতরে পিগটেলি টেকনিশিয়ানদের তৈরি সংক্ষিপ্ত দলিল। তুলে ধরা হয়েছে নার্ভ গ্যাসের সাথে সম্পর্কিত প্রতিটি সমস্যা।
প্রতিবারে একটি করে প্যারা পড়ছেন ওয়ানার স্টলজ। শুনতে শুনতে নিজের অভিব্যক্তি নিরপেক্ষ রাখার জন্য হিমশিম খাচ্ছে আতঙ্কিত ইসাবেলা।
“নির্দিষ্ট কিছু উপাদানের উপস্থিতি থাকাতে পূর্বের নার্ভ গ্যাসগুলোর তুলনায় সিনডেক্স-২৫ অনেকটাই পৃথক…” বৈশিষ্ট্যগুলোর নাম শুনতে গিয়ে মনে হলো কাক্ষিত শব্দটাই হয়তো বেশি যুক্তিযুক্ত হবে; কিন্তু কিছুই না বলে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল বেলা।
“সিনডেক্স-২৫ এর বৈশিষ্ট্যগুলো অত্যন্ত অভিনব ও মৌলিক বিষাক্ততা, দ্রুত কাজ করার ক্ষমতা; মানব শরীরের ফুসফুস আর মিউকাস মেমব্রেন দ্রুত শোষণ করে নেয় এ গ্যাস। এছাড়া ম্যানুফ্যাকচার, স্টোর আর হ্যান্ডেলের জন্য বেশ কার্যকর এই গ্যাস। সিনডেক্স-২৫ এর প্রধান দুটি উপাদান একত্রে মেশানোর পর এই গ্যাসের আয়ু হয়ে পড়ে স্বল্প। তাই কার্যক্ষেত্রে একে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ।”
“এবারে এসব বৈশিষ্ট্য আরো সবিস্তারে আলোচনা করা যাক। যেমন বিষাক্ততা। এই গ্যাস এতটাই ক্ষতিকর যে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাসলেন ওয়ার্নার-দুই মিনিটে শত্রু পক্ষের ৫০ শতাংশ আর দশ মিনিটে পুরো ১০০ শতাংশ মেরে ফেলতে সক্ষম। সারিনের চেয়েও গ্যাসকে দ্রুত শুষে নেয় দেহতুক, চোখ, নাক, গলা আর পরিপাকতন্ত্র, এক মাইক্রোলিটার পরিমাণ সিনডেক্স গ্যাস নগ্ন দেহত্বকে লাগানো হলে দুই মিনিটে অসাড় হওয়া সত্ত্বেও পনের মিনিটেই মৃত্যুবরণ করবেন আক্রান্ত ব্যক্তি। তাই সারিনের চেয়েও চারগুণ বেশি সম্ভাবনাময়। এবারে আলোচনার বিষয় উৎপাদনের খরচ প্রসঙ্গে। প্লিজ বারো নম্বর পাতা খুলুন সকলে।”
বিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-মেয়ের মতো বাধ্য ভঙ্গিতে আদেশ পালন করলেন উপস্থিত প্রত্যেক ব্যক্তি আর ওয়ার্নরা বলে চলেছেন, “প্রাথমিকভাবে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে প্ল্যান্টের পেছনে ব্যয় হবে বিশ মিলিয়ন ইউএস ডুলারস আর ম্যানুফ্যাকচার খরচ প্রতি কিলো বিশ ডলার।”
ভাষার ব্যবহার শুনে এই অবস্থাতেইও বেলা’র হাসি পেল; যাই থোক বলে চলেছেন ওয়ার্নার,
“তুলনা করলে দেখা যাবে যে গোটা প্ল্যান্টের খরচ পড়বে ব্রিটিশ অ্যারোস্পেস থেকে একটা সিংগেল হ্যারিয়ার জেট কেনার সমান। আর সিনডেক্সের এক স্টক উৎপাদনের অর্থ দিয়ে বারো মাস যে কোনো দেশের প্রতিরক্ষা ব্যয় মেটানো যাবে; কেনা যাবে পঞ্চাশটা সাইডউন্ডার এয়ার স্টু-এয়ার মিসাইলস…”।
“এ ধরনের প্রস্তাব আসছে অগ্রাহ্য করার কিছু নেই।” মিটমিট করে হেসে উঠল গ্যারি, ভাইয়ের প্রতি মনের মাঝে এতটা ঘৃণার সঞ্চার হলো যে অবাক হয়ে গেল বেলা।
এমন কোনো কিছু নিয়ে কেউ কিভাবে তামাশা করে? চোখ তুলে তাকাবার সাহস করল না বেলা। যদি গ্যারি বুঝে ফেলে! মাথা নেড়ে গ্যারি’র সাথে একমত হলেন ওয়ার্নার।
“সিনডেক্স প্রয়োগ করার জন্য কোনো বিশেষ ভেহিকেলের প্রয়োজন নেই। সাধারণ শস্য ছিটানোর এয়ারক্রাফটসহ আর্টিলারী প্রজেক্টাইলকেও কাজে লাগানো যাবে। তবে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আদর্শ হচ্ছে আর্মসকোরের নতুন জি-ফাইভ লংরেঞ্জ ছোট কামান।”
দুপুরবেলা পুলে সাঁতার কাটা আর ছাদে ব্যুফে লাঞ্চের জন্য বিরতি ঘোষণা করা হলো। অবশেষে আবার সবাই ডাইনিং রুমে ফিরে এলো সিনডেক্স-২৫ এর উপসর্গ নিয়ে আলোচনা করার জন্য।
“কখনো হিউম্যান সাবজেক্টের উপর প্রয়োগ করা না হলেও সিনডেক্স অ্যারোসলের উপসর্গগুলো অন্যান্য জি এজেন্টে নার্ভ গ্যাসের চেয়ে তেমন ভিন্ন কিছু নয়।” জানালেন ওয়ার্নার। “এগুলো হলো বুকে ব্যথা হওয়াসহ নাক আর চোখ জ্বালাপোড়া আর দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া।”
শোনার সাথে সাথে ভিজে উঠতে চাইল ইসাবেলা’র চোখ জোড়া; তারপরেও ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল।
“এই উপসর্গগুলোই ধীরে ধীরে রূপ নেবে মাথা ঘোরানো। ঘেমে যাওয়া, হার্টের ব্যথা, পাকস্থলী খামচেধরাসহ বমি আর ডায়রিয়া’তে সাথে শুরু হবে চোখ, নাক, মুখ আর যৌনাঙ্গ দিয়ে রক্তপাত। প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়াও স্বাভাবিক। কিন্তু তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর কারণ হবে শ্বাসতন্ত্রের অকার্যকারীতা সেন্ট্রাল নাভার্স সিস্টেমের ক্ষতি করবে সিনডেক্স।”
ওয়ার্নার শেষ করার পর পুরো এক মিনিট ধরে চুপ করে রইলেন বিমুগ্ধ শ্রোতার দল। অবশেষে মোলায়েম স্বরে গ্যারি জানতে চাইল, “যদি কখনো হিউম্যান সাবজেক্টের উপর না-ই প্রয়োগ করা হয়ে থাকে তাহলে এ সকল উপসর্গ কিভাবে নিরূপণ করা হয়েছে?”
“প্রাথমিকভাবে সারিনের কথাই ধরা হয়েছে প্রথমবারের মতো খানিক অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন ওয়ার্নার, “এরপর ল্যাবরেটরীতে শিম্পাঞ্জির উপর পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে।” খক খক করে গলা পরিষ্কার করলেন জার্মানস ডিরেক্টর।
বহু কষ্টে নিজের ক্রোধ দমন করল ইসাবেলা। কিন্তু নিজেকে সামলানো কষ্টকর হয়ে উঠল যখন শুনল, “ল্যাবরেটরিতে শিম্পাঞ্জিরা অত্যন্ত দামি হওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকাতে সহজলভ্য চাকমা বেবুনের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে।
“আমরা তো জীবিত প্রাণীদের উপর পরীক্ষা করতে পারি না?” নিজের কানেই বেখাপ্পা ঠেকল ইসাবেলা’র চিৎকার; সাথে সাথে নিজেকে শান্ত করে ফেলল বেলা, “আমি বলতে চাইছি যে এর কী সত্যি কোনো দরকার আছে?”
সকলেই এক দৃষ্টিতে বেলা’কে দেখছেন। ভেতরে ভেতরে নিজের উপর অসম্ভব রেগে উঠল বেলা। অবশেষে নীরবতা ভাঙ্গল গ্যারি।
কথাগুলো হালকাভাবে বললেও চশমার ওপাশের চোখ জোড়া হয়ে উঠল অত্যন্ত কঠিন। “বেবুন আমার পছন্দের কোনো প্রাণী নয়।” ক্যামডিবু’তে এগুলোকে আমি সদ্যজাত মেষের বাচ্চা খুন করতে দেখেছি। নানা জানবেন কিভাবে উনার গোলাপ আর সবজি বাগান তছনছ করেছে বেবুন। তবে আমি নিশ্চিত যে কোনো বন্যপ্রাণীর উপর অহেতুক নির্যাতনের ব্যাপারে তোমার সাথে আমরাও একমতো হবো।” থেমে গেল গ্যারি।
“তবে এই মুহূর্তে আমাদের কাছে মুখ্য হলো দেশের প্রতিরক্ষা, জাতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আর মিলিয়ন মিলিয়ন কোর্টনি অর্থের ব্যয়।”
শাসার দিকে তাকাতেই মাথা নেড়ে পুত্রের কথায় সায় দিলেন মিঃ কোর্টনি।
“সংক্ষেপে বলতে গেলে, হ্যাঁ আমাদেরকে টেস্ট করতেই হবে। এটি অত্যন্ত জরুরি। আমি দুঃখিত বেলা। যদি তোমার ভাল না লাগে তাহলে এই প্রজেক্ট নিয়ে আর দ্বিতীয়বার চিন্তা করো না। ক্যাপকির্ন বোর্ড থেকে রিজাইন দিলেও কেউ তোমাকে কিছুই বলবে না। তোমার অনুভূতিকে আমরা শ্রদ্ধা করি।”
“না” দ্রুত বেগে মাথা নাড়তে শুরু করল বেলা, “আমি প্রয়োজনীয়তাটুকু বুঝতে পেরেছি। দুঃখিত যে প্রসঙ্গটা তুলেছি।” মনে মনে প্রমাদ গুণল বেলা। আরেকটু হলেই হারিয়ে যাচ্ছিল রামোন আর নিকোলাস। তাদের নিরাপত্তা আর মুক্তির জন্যেও যেন কিছু করতে পারবে। জোর করে হেসে উঠল বেলা। হালকা স্বরে জানাল, “তুমি এত সহজে আমাকে তাড়াতে পারবে না। আমার সিট আমি ছাড়ব না, থ্যাঙ্ক ইউ।”
খানিকক্ষণ বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল গ্যারি; তারপর ভাল হলো যে ব্যাপারটা এখানেই মিটে গেল।” এবারে ওয়ার্নার স্টলজের দিকে তাকাল গ্যারি।
কোলের উপর দু’হাত রেখে চোখে-মুখে মনোযোগী ভাব ফুটিয়ে বসে রইল বেলা, “এই প্রজেক্টের রিপোর্ট করতে লাল গোলাপের একটুও হাত কাঁপবে না।” মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল বেলা।
***
কেপ টাউনে ফিরে আসার তিনদিন পর রিপোর্ট পাঠিয়ে দিল লাল গোলাপ।
বছরের পর বছর ধরে রুটিনের মতো দাঁড়িয়ে গেছে ব্যাপারটা, লন্ডনের ঠিকানাতে লাল গোলাপ টেলিগ্রাম পাঠানোর চব্বিশ ঘণ্টা পরেই পোরশে পার্ক করার জন্য তাকে জানিয়ে দেয়া হয় সময় আর স্থান। বেশির ভাগ সময় জায়গাটা হয় কোন পাবলিক কার পার্ক।
গাড়ির দরজা লক না করে ড্রাইভারের সিটের নিচে ওয়ান টাইম প্যাডে লেখা মেসেজটা খামে ভরে রেখে দিল বেলা। ঘণ্টাখানে পরে ফিরে এসে দেখল উধাও হয়ে গেছে খাম! আর ওর জন্য টাইপ করা ইনস্ট্রাকশন পড়ে আছে।
সিনডেক্স প্রজেক্ট সম্পর্কিত কোনো লেখাই যেন অন্য কারো হাতে না পড়ে সে ব্যাপারে বেশ সাবধান ছিল গ্যারি। আলোচনা চলাকালে ইসাবেলা কয়েকটা : নোট নিলেও চেয়ে নিয়েছে গ্যারি।
“তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না, টেডি বিয়ার?” মিটিমিটি হাসলেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইল গ্যারি,
“আমি এমনকি নিজেকেও বিশ্বাস করি না।” বেলা’র নোট প্যাডের জন্য হাত বাড়াল গ্যারি, “তুমি যদি কোনো কিছু জানতে চাও, তাহলে আমাকে এসে জিজ্ঞেস করো; কিন্তু কোথাও কিছু লিখবে না-মানে কিছুই না।”
আর কোনো কথা বাড়াল না বেলা।
তাই সিনডেক্স-২৫ এর যথাযথ অ্যাটোমিক উপাদান কিংবা উৎপাদনের প্রক্রিয়া জানাতে না পারলেও অনেকটুকুই রিপোর্ট হিসেবে পাঠিয়ে দিল লাল গোলাপ। তবে প্ল্যান্টের সম্ভাব্য অবস্থান আর নির্মাণ কাজের সময় জানাতে ভুলল না। তার মাস সাতেকের ভেতর উৎপাদন শুরু করবে প্ল্যান্ট।
এছাড়া কেমিকেল গ্রেড স্টেইনলেস স্টিল দক্ষিণ আফ্রিকাতে উৎপাদিত না হওয়ায় বাইরে থেকে আমদানি করতে হবে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত আই এস সি ও আর-এর ব্যাপারে কাজ শুরু করায় ধরে নেয়া হচ্ছে যে আঠারো মাস পরে থেকে বাইরে থেকে আর কিছুই আনতে হবে না। সিনডেক্স উৎপাদনের ক্ষেত্রে পুরোপুরি স্বনির্ভর হয়ে উঠবে দক্ষিণ আফ্রিকা। মধ্যবর্তী সময়টুকুতে প্রি কারসর সাপ্লাই করবে তাইপেতে অবস্থিত পিগটেলি কোম্পানি।
তবে এ সমস্যা ছাড়াও আরেকটা সমস্যা হলো প্ল্যান্ট চালাবার জন্য দক্ষ টেকনিশিয়ানের অভাব। পিগটেলি কেমিকেলস আগেই জানিয়ে দিয়েছে যে তারা কোন কর্মী সরবরাহ করবে না, তাই ধারণা করা হচ্ছে এখানে ব্রিটেন কিংবা ইস্রায়েল থেকে লোক নেয়া হবে। এক্ষেত্রে সিকিউরিটি ক্লিয়ারান্সের ব্যাপারেও মাথা ঘামাতে হবে।
রিপোর্টে ইসাবেলা আরো জানাল যে পুমা হেলিকপ্টারস আর ইম্পালা জেট ফাইটারস ডেলিভারী ভেহিকেল হিসেবে কাজ করবে। দুটিই দক্ষিণ আফ্রিকা এয়ারফোর্সের অংশ। এছাড়া খুব শীঘ্রই শুরু হবে ১৫৫ গ্রাম এম এম সি ডব্লিউ ই আর এফবি কার্গো তৈরির নকশা আর টেস্ট করার যাবতীয় প্রস্তুতি। সর্বোচ্চ পঁয়ত্রিশ কি.মি. রেঞ্জে এগারো কিলো সিনডেক্স-২৫ ডেভিভারী করবে এই শেল।
এহেন তথের গুরুত্ব কতটা তা খুব ভালো ভাবেই জানে লাল গোলাপ। তাই ছাব্বিশ পৃষ্ঠা রিপোটের একেবারে শেষ লাইনে লিখল,
“যত দ্রুত সম্ভব ছেলের সাথে দেখা করতে চায় লাল গোলাপ।”
উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করল উত্তর পাবার জন্য। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখা গেল না।
সময় যাবার সাথে সাথে কোনো রিপ্লাই না পেয়ে সত্যি সত্যি চিন্তায় পড়ে গেল বেলা। তাই ভাবল দেখা করতে চাওয়াটা হয়ত তার অধৈর্য আর উদ্ধত আরচণ হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে। তাই দ্বিতীয় মাস শেষে ক্ষমা চেয়ে মেসেজ পাঠিয়ে দিল লন্ডনের ঠিকানাতে।
“লাল গোলাপ সাক্ষাতের জন্য পীড়াপীড়ি করাতে যারপরনাই অনুতপ্ত। অপেক্ষা করছে পরবর্তী নির্দেশ পাবার জন্য।”
আরো এক মাস কেটে যাবার পর এলো সেসব আদেশ।
ইসাবেলাকে যে কোনো মূল্যে সিনডেক্স প্ল্যান্টের জন্য কর্মী নিয়োগ আর বাছাই কল্পে ব্রিটেন আর ইস্রায়েলে পাঠানো ক্যাপরিকন টিমে নিজের জায়গা নিশ্চিত করতে হবে।
কেমন করে এই অসাধ্য সাধন করা যায় ভেবে অস্থির হয়ে গেল বেলা। গ্যারি’কে কী এমন বলবে যাতে করে বোনের উপর কোনো সন্দেহও করবে না? তবে পরবর্তী বোর্ড মিটিঙে ব্যাপারটার এত সুন্দর একটা সমাধান হয়ে গেল যে বিস্মিত হলো বেলা।
এজেন্ডাতে না থাকলেও মিটিঙে রিক্রুটমেন্টের ইস্যু উঠতেই পুরো বিষয়টা নিয়ে বেলা এত সুনিপুণ ভাষা আর যুক্তি দিয়ে সাজানো নিজের মতামত তুলে ধরল যে গ্যারি আপনা থেকেই বলে ফেলল : “সম্ভবত তোমাকেই এ দায়িত্ব দিয়ে পাঠাতে হবে, কোর্টনি।”
অতিরিক্ত আগ্রহ না দেখিয়েই কাঁধ ঝাঁকাল ইসাবেলা, “কেন নয়? আমার কিছু শপিংও হয়ে যাবে কয়েকটা নতুন ফ্রক কিনতে হবে।”
“টিপিক্যাল উম্যান” দীর্ঘশ্বাস ফেলল গ্যারি; ছয় সপ্তাহ পরেই আবার কাভোগন স্কয়ারের ফ্ল্যাটে চলে এলো বেলা। ফ্ল্যাটের চাইনিং রুমে নেয়া হলো সব ইন্টারভিউ।
যে রাতে লন্ডনে পৌঁছালো, উড়ো একটা ফোন কল পেল বেলা। তবে মেসেজটা স্পষ্ট, “লাল গোলাপ, কাল তুমি বেনজামিন আফ্রিকার ইন্টারভিউ নেবে আর সে যেন অবশ্যই সিলেক্ট হয়ে যায়।”
ফাইলের অ্যাপ্লিকেশনগুলো চেক করতেই দেখা গেল বেনজামিন আফ্রিকার জন্ম হয়েছে কেপ টাউনে অন্যতম দাবিদার সে। কিন্তু অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন থাকা সত্ত্বেও ছোকরা একেবারেই ইয়াং। যাই হোক জুনিয়র পোস্ট থাকাতে বেলার জন্য কাজটা সহজ হয়ে গেল।
কিন্তু কাতোগান স্কয়ারের ফ্ল্যাটে সকাল এগারোটায় বেনজামিন আফ্রিকাকে দেখে আতঙ্কে জমে গেল বেলা।
কৃষাঙ্গ এই যুবক আর কেউ নয়, তার সৎ ভাই যাকে সে বেন গামা নামে চেনে।
এতটাই আতঁকে উঠল যে মুখ থেকে কোনো কথাই বের হল না। ওয়েভ্রেদেনের এক অন্ধকার ছায়ার নাম তারা কোর্টনি-কেউই সেখানে এ নাম উচ্চারণও করে না; তাই বেলা’কে কিনা তারই সন্তানকে কোর্টনি কোম্পানিতে চাকরি দিতে হবে? নানার তো হার্নিয়া হয়ে যাবে, বাবা আর গ্যারি…।
ভাগ্য ভালো যে ইসাবেলা’র সঙ্গী সি সি আই পার্সোনেল ম্যানেজার নিজেও বেনজামিনের গায়ের রঙ নিয়ে বিরক্ত হওয়াতে খানিকটা সময় পাওয়া গেছে। নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো বেলা। অন্যদিকে চুপচাপ রইল বেনজামিন।
হঠাৎ করেই নিজের কৃতকর্মের অনুশোচনাস্বরূপ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন সি সি আই ম্যানেজার। বেনজামিনের সাথে হাত মিলিয়ে জানালেন,
“আমি ডেভিড মিকীন, সিসিআই পার্সোনাল হেড। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।” লোকটা বিড়বিড় করতে করতে বেনজামিনের দিকে চেয়ারও এগিয়ে দিল,
“আপনার সি ভি পড়ে আমরা মুগ্ধ-সত্যি মুগ্ধ।”
বেনজামিনকে সিগারেট অফার করল মিকীন। “ইনি হচ্ছেন সি সি আই ডিরেক্টর ড. কোর্টনি।”
সিট থেকে খানিকটা উঠে মাথা নোয়ালো যেন, “হাউ ডু ইউ ডু, ম্যাম?”
কথা বলার সাহস পেল না বেলা। মাথা নেড়েই বেনজামিনের আবেদন পত্রে চোখ নামিয়ে নিল। ইন্টারভিউ নিলেন মিকীন।
এরই মাঝে নিজের প্ল্যান সাজিয়ে ফেলল বেলা। আফ্রিকা পদবী যদি সেই চিনতে না পারে তাহলে কোর্টনি পরিবারের আর কারো চেনার কথাই নয়। উপরন্তু মাইকেল ব্যতীত বেন গামা’কে ওয়েল্টেভ্রেদেনের আর কেউ দেখেওনি। সুতরাং একটা শহরের শত শত ফ্যাক্টরির একটাতে জুনিয়র অ্যামপ্লয়ী হিসেবে ঢোকা বেন’কে নিয়ে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হবে না।
আর কোনো প্রশ্ন না থাকাতে ইসাবেলার দিকে তাকালেন মিকীন। “আপনি তো কেপ টাউনে জন্মগ্রহণ করেছেন মিঃ আফ্রিকা, তাহলে কি এখনো সে দেশের নাগরিকত্ব আছে? নাকি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন?”
“না, ড, কোর্টনি মাথা নাড়ল বেন।
“আমি এখনো একজন সাউথ আফ্রিকান। লন্ডনের সাউথ আফ্রিকা হাউজ আমার জন্য পাসপোর্ট ইস্যু করে।”
“গুড। আপনার পরিবার সম্পর্কে কী কিছু বলা যাবে? তারা কি এখনো দক্ষিণ আফ্রিকাতেই থাকেন?”
“আমার বাবা-মা দুজনেই ছিলেন স্কুলটিচার। ১৯৬৯ সালে কেপ টাউনে মোটর অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন।”
“অ্যাম সরি” চোখ নামিয়ে ফাইলের দিকে তাকাল বেলা। নির্ঘাৎ মিথ্যে কোনো বার্থ সার্টিফিকেট নিয়েছেন তারা। যাই হোক আবারো বেনের দিকে তাকাল বেলা, “আশা করছি আমার পরবর্তী প্রশ্নটা নিয়ে আপনি কিছু মনে করবেন না মিঃ আফ্রিকা। যাই হোক, ক্যাপরিক কেমিকেল আর্মসকোরের ডিফেন্স কন্ট্রাকটর। তাই এর সমস্ত কর্মী সম্পর্কেই তদন্ত করে দক্ষিণ আফ্রিকান সিকিউরিটি পুলিশ। তাই খুব ভালো হয় আপনি আমাদেরকে জানান যে কখনো কি কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্য ছিলেন কিংবা আছেন?”
হেসে ফেলবেন। সৌভাগ্যক্রমে পূর্ব-পুরুষদের সৌন্দর্যের সবটুকুই পেয়েছে এই সুদর্শন তরুণ।
“আপনি কি জানতে চাইছেন যে আমি এএনসি’র সদস্য কিনা?” বিরক্ত হল বেলা।
“অথবা অন্য কোন কট্টর রাজনৈতিক সংগঠন?” বাকা স্বরে উত্তর দিল বেলা।
“আমি কোনোরকম রাজনীতি করি না। ড, কোর্টনি। আমি শুধু একজন বিজ্ঞানী আর প্রকৌশলী। সোসাইটি অব ইঞ্জিনিয়ারস্ এর সদস্য। ব্যস।” আর “ মানে বেন রাজনীতিতে আগ্রহী নয়?
“এরকম সোজাসাপ্টা উত্তরের জন্য ধন্যবাদ যা কিনা পরবর্তীতে যে কোনো করনের অস্বস্তি থেকে আমাদের উভয়কেই রক্ষা করবে। দক্ষিণ আফ্রিকা’তে ভোট দিতে না পারলেও ইংল্যান্ডে আপনি কোনো রকম বর্ণবাদের স্বীকার হচ্ছেন না।”
“হ্যাঁ, আমি জানি।” একমত হল বেন।
“তাহলে এমন একটি দেশে কেন ফিরে যেতে চাইছেন যেখানে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হতে হবে আর যে কোনো অর্জনের পরিমাপক হবে আপনার গাত্রবর্ণ?”
“আমি একজন আফ্রিকান ড, কোর্টনি। আই ওয়ান্ট টু গো হোম। নিজের দেশ আর জনগণের জন্য কাজ করতে চাই। বিশ্বাস করি যে জন্মস্থানে আমার জন্য সুন্দর একটা জীবন অপেক্ষা করছে।”
দীর্ঘক্ষণ একে অন্যের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর বেলা মোলায়েম স্বরে জানাল, “আমি এতে কোনো ভুল দেখছি না মিঃ আফ্রিকা। আমাদের সাথে কথা বলতে আসার জন্য ধন্যবাদ। আপনার ফোন নাম্বার আর ঠিকানা রইল। সময় মতো যোগযোগ করা হবে।”
বেন চলে যাবার পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত বেলা কিংবা মিকীন কেউ কোনো কথা বলল না। উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে চলে গেল বেলা। নিচে তাকাতেই বেন’কে দেখতে পেল। ওভারকোট খুলে উপরে তাকিয়ে বেলা’কে দেখল বেন। বিদায়ের ভঙ্গিতে এক হাত তুলে চলে গেল বেন।
“ওয়েল”, পাশ থেকে বলে উঠলেন মিকীন, “আমরা এর নাম লিস্ট থেকে কেটে দিতে পারি।”
“কেন?” জানতে চাইল বেলা; অবাক হয়ে গেল মিকীন। ভেবেছিল বেলাও তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যাবে।
“ছেলেটার কোয়ালিফিকেশন, অভিজ্ঞতা…”
“গায়ের রঙ?” বলে উঠল বেলা।
“হ্যাঁ, সেটাও। মাথা নাড়লেন মিকীন। “ক্যাপরিকর্নে হয়ত তার নিচে শ্বেতাঙ্গ’রা কাজ করবে। তাই শ্বেতাঙ্গ কর্মচারীদেরকে আদেশ দেয়া, শ্বেতাঙ্গ নারীদের সাথে কাজ করা; ব্যাপারগুলো তেমন ভাল দেখাবে না।”
“কিন্তু অন্যান্য কোর্টনি কোম্পানিতেও না হলেও আরো ডজন খানেক কৃষাঙ্গ ম্যানেজার আছেন।” মনে করিয়ে দিল বেলা।
“হ্যা” তাড়াতাড়ি মেনে নিলেন মিকীন।
“কিন্তু তাদের অধস্তন সকলেই তো কৃষাঙ্গ; শ্বেতাঙ্গ নয়।”
“আমার বাবা আর ভাই কালো’দের উন্নতির ব্যাপারে বেশ সচেষ্ট। বিশেষ করে আমার ভাইয়ের মতে, দেশের মাঝে শান্তি আর ঐক্য স্থাপন করার জন্য, প্রয়োজন সকলের মাঝে দায়িত্ব বোধ গড়ে তোলা আর সমৃদ্ধি অর্জন।
‘আমি’ও এ মত’কে একশ ভাগ সমর্থন করছি।”
“আমার তো মনে হয়েছে মিঃ আফ্রিকা বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন তরুণ। তবে হ্যাঁ বয়সে একটু বেশিই তরুণ। আর অভিজ্ঞতারও ঘাটতি আছে। তাই সিনিয়র পোস্ট হয়ত দেয়া যাবে না, কিন্তু-”।
নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় সাথে সাথে অবস্থান বদলে ফেললেন-মিকীন “আমার ধারণা মিঃ আফ্রিকাকে ডিরেক্টর টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট পোস্টের জন্য শর্ট লিস্টেড করা যায়।”
“আমারও সেরকমই মনে হচ্ছে। নিজের সবচেয়ে চমৎকার হাসিটা হাসল বেলা।
বিকেল চারটায় শেষতম ক্যান্ডিডেন্ডের ইন্টারভিউ নেয়ার পর বার্কলে হোটেলে ফিরে গেলেন মিকীন। সাথে সাথে মাকে ফোন করল বেলা,
“দ্যা লর্ড কিচেনার হোটেল, গুড আফটারনুন” মায়ের গলা চিনতে পারল। বলে উঠল, “হ্যালো তারা, আমি ইসাবেলা” খানিকটা থেমে আরো জানালো, “ইসাবেলা কোর্টনি, তোমার মেয়ে।”
“বেলা, মাই বেবি। কতদিন হয়ে গেছে অন্তত আট বছর। আমি তো ভেবেছিলাম যে তুমি তোমার বুড়ি মাকে ভুলেই গিয়েছে” ইসাবেলাকে সবসময় অপরাধবোধে ফেলে দেন এই নারী। আমতা আমতা করে বেলা জানাল, “অ্যায়াম সরি, তারা। এত ব্যস্ততা, জানোই তো…”
“হ্যাঁ। মিকি জানিয়েছে যে তুমি কতটা বুদ্ধিমান আর সফলতার সাথে দায়িত্বও পালন করছ। তুমি তো নাকি এখন ড, কোর্টনি আর একজন সিনেটর” হঠাৎ করেই ফেটে পড়লেন তারা, “কিন্তু বেলা, এসব বর্ণবাদী হামবড়া ভাব দেখানো জাতী পার্টির বুড়োরগুলোর সাথে তুমি কী করো? কোন সভ্য সমাজ হলে এতদিনে জন ভরস্টারের কোনো পাত্তাই থাকত না।”
“তারা, বেন আছে?” মা-কে থামিয়ে দিল বেলা।
“আমি তো ভেবেছিলাম যে আমার মেয়েটা হয়ত আমার সাথেই কথা বলতে চেয়েছে তারা’র কণ্ঠে ঝড়ে পড়ল বিষণ্ণতা। “ঠিক আছে বেন’কে ডেকে দিচ্ছি।”
“হ্যালো বেলা।” প্রায় সাথে সাথে উত্তর দিল বেন।
“আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই।” জানাল বেলা।
“কোথায়?” দ্রুত ভেবে নিয়ে জানাল “হ্যাচাডস।”
“পিকাডোলি’র বুক শপ? ঠিক আছে, কখন?”
“কাল সকাল দশটায়।”
আফ্রিকান ফিকশন সেকশন দাঁড়িয়ে আছে বেন। পাশে দাঁড়িয়ে শেল্ফ থেকে বই তুলে নিল বেলা।
“বেন, আমি এসব সম্পর্কে কিছুই জানি না।”
“আমি শুধু একটা চাকরির জন্য দরখাস্ত করেছি বেলা, ব্যস। সহজ হিসাব।” হেসে ফেলল বেন।
“আমি অন্যকিছু জানতেও চাইনা।” দ্রুত বলে উঠল বেলা, “শুধু এটুকু বল যে আফ্রিকা নামে তোমার সব কাগজ-পত্র বৈধ তো?”
“তারা তার কৃষাঙ্গ এক বন্ধু সম্পত্তির নামে আমার বার্থ সার্টিফিকেট বের করেছে। আমার বাবাকে কখনোই বিয়ে না করতে তাদের সম্পর্কটা বৈধ ছিল না। হয়তো মোজেস গামা’কে বিয়ে করা আর আমাকে জন্মদানের জন্য তাকে জেলেও যেতে হত।” বেশ সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জানাল বেন। ছেলেটার মুখে রাগ কিংবা তিক্ততার কোনো ছায়াই দেখল না বেলা। “অফিসিয়ালি তাই আমি বেনজামিন আফ্রিকা। এই নামেই বার্থ সার্টিফিকেট আর সাউথ আফ্রিকান পাসপোর্টও আছে।”
“তোমাকে খানিকটা সাবধান করে দিচ্ছি বেলা। কোর্টনি পরিবার এ বিষয়টা নিয়ে বেশ ক্ষেপে আছে। তোমার বাবা নানা মানে সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম এর স্বামীকে খুন করেছেন।”
“হ্যাঁ, আমি জানি।”
“দক্ষিণ আফ্রিকা তুমি আর আমি কেউ কখনো পরিচিতের মতো আচরণ করতে পারব না।”
“বুঝতে পেরেছি।”
“যদি নানা অথবা বাবা কেউ কখনো তোমার সম্পর্কে জানতে পারে-ওয়েল, কী যে ঘটবে আমি কল্পনাও করতে পারছি না।”
“আমার কাছ থেকে উনারা কিছুই জানতে পারবেন না।”
“যদি আমার কথা বলো তো, আমিও…” গলার স্বর নিচু করে বেলা জানাল, “বেন, সাবধানে থেকো। আমরা কখনই পরস্পরের তেমন কাছে আসতে পারি নি। তারপরেও তুমি আমার ভাই; তোমার কিছু হোক আমি চাই না।”
“থ্যাঙ্ক ইউ বেলা।” বেনে’র মুখে এখনো হালকা হাসি দেখে বেলা বুঝতে পারল যে এ দূরত্ব কিছুতেই ঘোচাবার-নয়।
তাই বলে চলল, “মাইকেল’কেও জানাব যে তুমি দেশে ফিরছ। কিন্তু বিশ্বাস করো, সম্ভাব্য সব রকমভাবে তোমাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছি; তাই দরকার হলেই মাইকেলকে জানাবে। সরাসরি যোগাযোগ না করাই ভালো।”
হঠাৎ করেই হাতের বইটা ফেলে দিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরল বেলা, “ওহ, বেন বেন! আমরা কতটা ভয়ংকর এক পৃথিবীতে বাস করি। ভাই-বোন হয়েও… এতটা নিষ্ঠুরতা যে কী বলল, আমি ঘৃণা করি। সত্যিই ঘৃণা করি এ সিস্টেম।”
“হয়ত পৃথিবীকে বদলানোর জন্য আমরা সাহায্য করতে পারি।”
বোনের আলিঙ্গনে সাড়া দিয়েই আবার চট করে আলাদা হয়ে গেল বেন আর বেলা।
“অনেক ব্যাপারই আছে, যা কখনো তোমাকে বলতে পারব না বেন। এ শক্তি আমাদের নাগালের বাইরে। বিরোধিতা করতে চাইলেই ধ্বংস হয়ে যাব। ওরা অনেক শক্তিশালী।”
“তারপরেও আমাদের কাউকে না কাউকে তো চেষ্টা করতেই হবে।”
“ওহ, গড, বেন। তুমি তো এভাবে কথা বলে আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছ।”
“গুড বাই, বেলা।” বিষণ্ণ ভঙ্গিতে বলে উঠল বেন। “যদি সবকিছু খানিকটা অন্য রকম হত, আমাদের সম্পর্কটাও হয়ত মধুর হত।” হাতের বই শেঙ্কে রেখেই গট গট করে হেঁটে বের হয়ে গেল বেন। একবারও পেছন ফিরে তাকাল না।
***
জোহানেসবার্গ এলেই গ্যারি আর হোলির বাসায় উঠে ইসাবেলা; কয়েক বছর ধরে এমনটাই হয়ে আসছে।
ফুল-টাইম মা আর স্ত্রী হবার আগে হোলি ছিল দেশের প্রথম সারির স্থপতিদের একজন। ওর নকশা আন্তর্জাতিকে বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড ও পেয়েছে। তাই নিজেদের বাড়ি করার সময়ে তাকে উদার হস্তে বাজেট দিয়েছে গ্যারি। তাই অনিন্দ্য সুন্দর এই বাড়ি ওয়েন্টেভেদ্রেনের চেয়েও বেশি পছন্দ করে বেল।
ছোট্ট লেকের মাঝখানে বানানো মনুষ্য নির্মিত দ্বীপে বসে ব্রেকফাস্ট করে পুরো পরিবার। ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যাবার জন্য তৈরি গ্যারির ছেলে-মেয়েরা আর সবচেয়ে ছোটজন। এক বছর বয়সী নিজের গড-ডটারকে ফিডার খাওয়াচ্ছে বেলা। আর ভেতরটা হাহাকার করছে নিজের অতৃপ্ত মাতৃত্বের জন্য।
টেবিলের মাথায় বসে উজ্জ্বল পোশাক পরিহিত গ্যারি দিনের প্রথম সিগারেটটা ধরিয়েছে। “কে আমাকে কমজোরি বলতে চায়? আমি বুঝি সামান্যতেই আহত হই?” গড ডটারের মুখে চামচ ভর্তি ডিম ঢুকিয়ে দিল বেলা।
“ব্যাপারটা তা না।” বোনকে তোষমোদ করে উঠল গ্যারি। “আজ সকালে আমার পাঁচটা মির্টি আছে, সন্ধ্যায় হোলি’র চ্যারিটি বল।”
তুমি চাইলেই যে কোনো একটা কিংবা সবকিছুই বাতিল করে দিতে পারো।” মনে করিয়ে দিল বেলা।
“দেখো, সেখানে এত এত রাজনীতিবিদ আর জেনারেলরা থাকবেন যে আমি চাইলেই যে কোনো কিছু করতে পারবনা।
“শুধু শুধু বাহানা বানিও না, টেডি বিয়ার, সত্যিটা আমরা সকলেই জানি।”
হোলি’র দিকে তাকাল গ্যারি, “সন্ধ্যায় কখন যেতে হবে যেন?” কিন্তু ননদের পক্ষ নিল হোলি।
“কেন তুমি বেলা’কে দিয়ে এসব জঘন্য ব্যবসার কাজ করাচ্ছ?”
“আমি কিছুই করছি না।” অবাক হয়ে গেল গ্যারি।” এটা পুরোপুরি ওর সিদ্ধান্ত।” হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়েই ছেলে-মেয়েদের উদ্দেশ্যে ফাঁকা গর্জন করে উঠল, “এই যে দুষ্ট ছেলে-পেলের দল, স্কুলের জন্য দেরি হচ্ছে তো!” সারি বেঁধে বাবাকে কিস করে ব্রিজের উপর দিয়ে সৈন্যদের মতো সার্চ করতে করতে চলে গেল পিচ্চিরা।
“আমিও যাচ্ছি।” গড় ডটারের মুখ মুছে দিয়ে উঠে দাঁড়াল বেলা; কিন্তু বোনকে থামালো গ্যারি।
“লুক বেলা, মাফ চাইছি। জানি আমি বলেছিলাম যে তুমি পারবে না। কিন্তু তুমি যে, যে কোন পুরুষের মতই শক্ত তা-ও আমি জানি। “তোমাকে তার প্রমাণ দিতে হবে না।”
“তার মানে স্বীকার করছ যে তুমি আমাকে হাঁদারাম ভেবেছ?” জানতে চাইল বেলা।
“অল রাইট” হার মানল গ্যারি।
“আমি নিজেই তো এসব দেখতে চাই না। তাই ভেবেছিলাম তোমারও দরকার নেই।”
“আমি ক্যাপরিকর্নের ডিরেকটর” হাত ব্যাগ আর ব্রিফকেস গুছিয়ে নিল বেলা, “আটটায় দেখা হবে, তোমার সাথে।”
পোরশে’তে চড়ে বসতেই অপরাধ বোধে ছেয়ে গেল বেলার মন। কিন্তু এবার যদি সিনডেক্স-২৫-এর টেস্ট সফলভাবে হয়েছে কিনা জানিয়ে রিপোর্ট করতে পারে তাহলেই নিকি’র কাছে যেতে পারবে।
নতুন হাইওয়ে ধরে জার্মিস্টনে পৌঁছাতেও প্রায় এক ঘণ্টার বেশি লেগে গেল। ক্যাপরিক কেমিকেলস্ প্রান্টের আর্কিটেক্ট হোলি হওয়াতে এটাকে মোটই কোনো ফ্যাক্টরি বলে মনে হয় না। এখানে লন্ আছে, গাছপালা আছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিল্ডিংগুলোকে আড়ালে রেখে কাঁচ আর ন্যাচারাল স্টোন দিয়ে ঢেকে রাখা দালানগুলোকে মুখ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কয়েকশত একর নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে পুরো স্থাপনা।
নিজের ইলেকট্রনিক কী-কার্ড দিয়ে গেইটের তালা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল বেলা। গাড়ি দেখে স্যালুট করল গার্ড। কারপার্ক ভর্তি গাড়িগুলোর বেশির ভাগই কালো লিমুজিন; মিনিস্টারিয়াল কিংবা মিলিটারি নাম্বার প্লেট লাগানো আছে প্রায় প্রতিটিতে।
লিফটে চড়ে ডিরেকটরস্ স্যুইটে ঢুকেই দ্রুত পুরো রুমে চোখ বোলালো বেলা। মাত্র বিশ জনের দলটাতে সে একাই নারী।
উপস্থিত কর্তা ব্যক্তিদের বেশির ভাগকেই চেনে বেলা। রিফ্রেশমেন্ট টেবিলে অ্যালকোহল থাকলেও কেউ কফি ছাড়া আর কিছু নেয়নি। কিন্তু তারপরেও এত নগ্ন বিভক্তি দেখে চমকে উঠল বেলা। ইংলিশ সেকশনের আলোচনার বিষয় হলো ফিন্যান্স আর কমার্স। অন্যদিকে হলে উপস্থিত আফ্রিকানারদের বিষয় রাজনৈতিক আর সামরিক শক্তি। কোর্টনিদের তুলনায় একেবারেই গরীব হলেও এদের রাজনৈতিক প্রভাব পুরো সমাজের উপর ছড়িয়ে আছে।
সেকেন্ডের মাঝেই রুমের মাঝে উপস্থিত সবচেয়ে প্রভাবশালীদের চিহ্নিত করে তাদের দিকেই এগিয়ে গেল বেলা। হ্যান্ড শেক আর হাসি বিনিময় করল। অন্যদের সাথে।
ডিফেন্স মিনিস্টারের সাথে হাত মিলিয়ে তাঁর ডেপুটির দিকে ফিরল বেলা।
“গুড মর্নিং জেনারেল ডিলারে” চোস্ত আফ্রিকান ভাষায় সম্ভাষণ জানাল বেলা। লোথার ডিলারের সাথে ছয় মাস লিভ টুগেদার করার পর বেলা’কে ছেড়ে ম্র ভদ্র একটা আফ্রিকান মেয়েকে বিয়ে করেছে লোকটা। নচেৎ এখন আর ডেপুটি মিনিস্টার হওয়া হত না।
“গুড মর্নিং, ডঃ কোর্টনি।” নম্র স্বরে জানালেও লোহার প্রশংসার দৃষ্টিতেই দেখছে বেলা’র শরীর।
নিজের মাঝে অভিমান থাকা সত্ত্বেও বেলাও আপন মনে সুদর্শন লোহারের প্রশংসা না করে পারল না। এখনো দশ বছর আগের মতই হালকা পাতলা রয়ে গেছে।
তোমার উপর আমি প্রতিশোধ নেবই। মনে মনে ভাবল বেলা; একবার তো লোথারের জন্য সুইসাইডও করতে গিয়েছিল। তাই তাকে লাল গোলাপের ইনফর্মার বানাতে পারলেই কলজে ঠাণ্ডা হবে। এরপর হঠাৎ করেই রামোনের কথা মনে পড়ল; ওর রামোন আর চোখের সামনে থেকে মুছে গেল লোথার।
আর ঠিক সময়ে চোখ পড়ল ক্যাপরিকর্নের জেনারেল ম্যানেজারের দিকে; চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতির জন্য ক্ষমা চেয়ে স্বাগত বক্তব্য দিল বেলা। এরপর প্রজেকশন রুমে সকলকে আমন্ত্রণ জানাল।
আগে থেকেই হাই কোয়ালিটি প্রফেশনাল ভিডিও ফিল তৈরি করে রেখেছে ক্যাপরিক। অন্ধকার রুমের চারপাশে চোখ বোলালো বেলা। উপস্থিত সামরিক কর্তাব্যক্তিদের মাঝে এই নতুন অস্ত্র নিয়ে উত্তেজনার শেষ নেই। হা করে গিলছেন পর্দার প্রতিটি দৃশ্য। যুদ্ধক্ষেত্রে সিনডেক্ট-২৫ প্রয়োগের চলমান চিত্র দেখাচ্ছে, ভিডিও ফিল্ম।
পল সালে, তেল আবিবের ইস্রায়েলী টেকনিক্যাল ডিরেকটর, উঠে দাঁড়াতেই একের এক এক প্রশ্নবানে ভদ্রলোককে জর্জরিত করে ফেললেন সবাই। ইসাবেলা খেয়াল করে দেখলেন যে বেন নেই। রুমের পেছনে কোথাও লুকিয়ে আছে সেই বাদামি মুখ। হঠাৎ করেই বেলার মতো করেই একজন জেনারেল জানতে চাইলেন,
“এই গ্যাস কী কখনো মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়েছিল? আমাদেরকে সবিস্তারে জানান।”
“হয়ত জেনারেল আমাদেরকে অ্যাংগোলা থেকে ধৃত কয়েকজন কিউবিনা যুদ্ধবন্দি দেখাতে পারবেন।” ডিরেকটরের কথা শুনে হেসে কুটি কুটি হলো পুরো রুম। “সিরিয়াসলি জেনারেল, আপনার প্রশ্নের উত্তর হলো না। কিন্তু ল্যাবরেটরি কন্ডিশনে দারুণ রেজাল্ট পাওয়া গেছে। আর সত্যি কথা বলতে আজই আপনাদের জন্য প্রথম টেস্ট চাক্ষুষ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
মিনিস্টারের কালো ক্যাডিলাককে সামনে রেখে পুরো দলটা চলল হাফ মাইল দূরের পেস্টিসাইড আর পয়জন ডিভিশনের উদ্দেশ্যে। মিনিস্টারের সাথে পেছনের সিটে বসে প্ল্যান্টের সম্পর্কে জানাচ্ছে ইসাবেলা।
ডিফেন্স মিনিস্টারের মেজাজ অত্যন্ত কড়া স্বভাবের হলেও তার সাথে বেলা’র সম্পর্ক বেশ সহজ আর লোকটার রাজনৈতিক সফলতাকে শ্রদ্ধা করে বেলা। অবশেষে মেইন কমপ্লেক্সের ভেতর পৃথক অংশটার সামনে এসে থামল গাড়ির বহর।
বারো ফুট বেড়া দিয়ে ঘেরা এলাকার গেইটে ঝুলছে তিন ভাষায় লেখা সতর্ক সংকেত। মেইন গেইটের গার্ডদের সাথে রটওয়েলার জাতের কুকুরও আছে। সকলকেই এমনকি মিনিস্টারকেও যেতে হলো ইলেট্রিক স্ক্যানারের ভেতর দিয়ে।
একগাদা কার্পেট পাতা করিডোরের মাঝে দিয়ে পথ দেখালেন ইস্রায়েলী ডিরেক্টর অবশেষে নতুন সিনডেক্স এক্সটেনশন এলো। পুরো দালানটা এতটাই নতুন যে কাঁচা কংক্রীটের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ছোট্ট এন্ট্রান্স লবিতে এসে সকলেই জড়ো হবার পর স্বাগতম জানালেন ডিরেক্টর।
“দালানের এই অংশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত জোরদার করে তোলা হয়েছে। এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম দেখলেই বুঝতে পারবেন যে, সর্বদা পরীক্ষা করা হচ্ছে। বাতাসের কোয়ালিটি। দশ সেকেন্ডের মাঝেই বাতাস পাম্প করে ফেলে দিয়ে পরিবর্তন করে দেয়াও সম্ভব এখন।” আরো কয়েক মিনিট ধরে কেবল নিরাপত্তা নিয়েই বক বক করলেন ডিরেকটর। “কিন্তু তারপরেও সুরক্ষার নিশ্চয়তার জন্য মেইন প্ল্যান্টে ঢোকার আগে প্রটেকটিভ স্যুট পরতে হবে।
পৃথক পৃথক চেঞ্জিং রুমে সকলের জন্য রাখা আছে সাদা প্লাস্টিকের ওভারঅল, জুতা গ্লাভস্ আর হেলমেট। স্যুট পরে নিয়ে লবি’তে এসে বাকিদের সাথে যোগ দিল বেলা।
“যদি আমরা সকলেই প্রস্তুত থাকি মাই লেডি অ্যান্ড জেন্টেলমেন” দেয়ালের দিকে দরজা বরাবর হাঁটতে শুরু করলেন ডিরেকটর। অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে চারজন টেকনিশিয়ান। ইসাবেলা খেয়াল করে দেখল যে টেকনিশিয়ানদের ড্রেসের রঙ হলুদ আর ডিরেকটর পরে আছেন লাল। হলুদ স্যুট পরা একজন টেকনিশিয়ান সকলকে পথ দেখিয়ে আরেকটা চিকন করিডোরে নিয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে বেলা’র পাশে চলে এলো সেই তরুণ।
“গুড মর্নিং। ডঃ কোর্টনি” মোলায়েম গলার স্বরটা চিনতে পেরেই লোকটার দিকে তাকাল বিস্মিত বেলা।
“হ্যালো, মিঃ আফ্রিকা” বিড়বিড় করে উঠে জানতে চাইল, “ক্যাপরিকর্নের চাকরি কেমন লাগছে?” লন্ডন থেকে আসার পর এই প্রথম তাকে দেখল বেলা।
“ইন্টারেস্টিং থ্যাঙ্ক ইউ।” টেস্ট রুমে ঢোকার আগে দু’জনের মাঝে কেবল এটুকুই কথা হল। কিন্তু বেলা’কে খেয়াল করছিলেন লোথার। চামড়ার আর্মচেরারে বসার পর বেলার পাশে বসে পড়ে লোথার জানতে চাইলেন” কে এই নিগার?”
“উনার নাম আফ্রিকা। কেমিকেল ইঞ্জিনিয়াভের ডিগ্রি আছে।”
“আপনি কিভাবে চেনেন?”
“আমি সিলেকশন কমিটিতে ছিলাম।”
“সিকিউরিটি ক্লিয়ারান্স আছে নিশ্চয়ই?”
“অবশ্যই। আপনার ডিপার্টমেন্ট-ই তো দিয়েছে।” কাটা কাটা জবাব শুনে ডিরেকটারের দিকে তাকালেন লোথার।
“এগুলো হলো টেস্ট কিউবিকলস” ছোট ছোট চারটা কেবিনেটের সাথে টেলিফোন ব্যুহের চেয়ে টয়লেট কেবিনেটেরই মিল বেশি। ভাবল বেলা।
“কেবিনেটের দেয়ালে লাগানো জানালাতে ডাবল আমারড গ্লাস লাগানো আছে। প্রতিটির উপরে আবার মনিটরও আছে।” ইলেকট্রনিক প্যানেল দেখিয়ে দিলেন ডিরেকটর।
জানালার পেছনে সাদা প্লাস্টিকের চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে চারটা মানবসদৃশ জীব। এক মুহূর্তের জন্য ইসাবেলার’র মনে হলো যে এগুলো হয়ত মানব শিশু।
“টেস্ট সাবজেক্ট হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে বেবুন। লোম হেঁটে এগুলোকে মানুষের কাছাকাছি আদল দেয়া হয়েছে। নাম্বার ওয়ান গায়ে প্রায় কিছুই নেই।”
“নাম্বার টু সাধারণ মিলিটারি ইউনিফর্মের মতো পোশাক পরে আছে।”
“নাম্বার থ্রীর চোখ, নাক আর মুখ ব্যতীত প্রায় পুরো শরীরটাই ঢাকা।”
“আর নাম্বার ফোর ঠিক আপনাদের মতোই প্রটেকটিভ স্যুট পরে আছে।”
ইসাবেলার পেটের মাঝে গুড়গুড় শব্দ শুরু হলো। আর পরিষ্কার বাতাস পাওয়া সত্ত্বেও মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে।
“সিনডেক্স-২৫ এর কোন রঙ কিংবা গন্ধ নেই। কিন্তু নিরাপত্তার কথা ভেবে আমাদের গ্যাসে আমন্ডের গন্ধ মেশানো হয়েছে। মনিটরিং ইকুপমেন্ট ছাড়া কোনো ধরনের কুয়াশা কিংবা কিছুই দেখা যাবে না।” খানিক বিরতি দিলেন ডিরেক্টর। গলা পরিষ্কার করে বলে উঠলেন, “নাউ জেন্টেলমেন অ্যান্ড মাই লেডি, আপনারা তৈরি থাকলে আমরা ডেমনস্ট্রেশন শুরু করছি।”
হেলমেট পরিহিত মাথা নাড়লেন মিনিস্টার। ডেস্কে থাকা মাইক্রোফোনে কী যেন অর্ডার দিলেন ডিরেকটর। পেছন দিককার রুমে কন্ট্রোল নিয়ে কিছু একটা করছে হয়তো বেন কিংবা অন্য টেকনিশিয়ান; ভাবলো বেলা।
কয়েক সেকেন্ড কিছুই ঘটল না। স্বাভাবিকভাবেই নিঃশ্বাস নিচ্ছে বেবুনগুলো। এরপরই বাতাসে সিনডেক্স-২৫ পরিমাপক প্যানেলটা ধপ করে জ্বলে উঠল। জিরো থেকে রেঞ্জ উঠে গেল পাঁচ পর্যন্ত।
পর মুহূর্তেই বদলে গেল দৃশ্য। সারা শরীর আবৃত্ত বেবুনটা ছাড়া বাকীগুলোর হার্টবিট দ্রুত বেড়ে গেল; ডিসপ্লে প্যানেল দেখাচ্ছে সবচেয় ভয়ানক অবস্থায় পড়ল নগ্নদেহ বেবুন।
প্রচণ্ড আতঙ্ক নিয়েও তাকিয়ে রইল বেলা। বেবুনটার চোখের পাতা কেঁপে উঠতেই চোখ দিয়ে দরদর করে পানি ঝড়তে লাগল। মুখের ভেতর দুলছে জিহ্ববা আর বুকের উপর গড়িয়ে পড়ল লালা।
“পনের সেকেন্ড” ডিরেকটরের গলা শোনা গেল, সাবজেক্ট নাম্বার ওয়ান পুরোপুরিভাবে অর্থ হয়ে পড়লেও অক্ষত আছে নাম্বার ফোর। দ্বিতীয় আর। তৃতীয় জনের অবস্থা’ও মিডিয়াম মাত্রার।”
শরীরে এঁটে বসে থাকা স্ট্র্যাপ খোলার জন্য প্রাণপণে লড়ছে নগ্নদেহী বেবুন। হঠাৎ করেই মুখ খুলে তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করে উঠল। জোড়া পাল্লা লাগানো জানালা ভেদ করেও পরিষ্কার শোনা গেল সে শব্দ। ইসাবেলা মনে হলো আর সহ্য করতে পারছে না; পেটের মধ্যে কী যেন পাঁক দিয়ে উঠছে। দু’হাত মুঠি করে শক্ত হয়ে বসে রইল। পাশে বসে থাকা লোথারসহ অন্যরাও অস্বস্তিতে পড়েছে। এরা সকলেই সৈন্য আর পুলিশের লোক হলেও এতটা করুণ দৃশ্য সকলকেই নাড়া দিয়েছে।
উদোম গায়ে থাকা তিনটা বেবুনই মাথা নাড়ছে, পা ছুঁড়ছে। জিভ আর খোলা মুখ পুরোপুরি রক্ত লাল ধারণ করেছে। আই বলের চারপাশে রক্ত জমে ফুটে উঠেছে শিরা। বমি শুরু করে দিল বেবুনের দল। প্রথমে বেলুনের পরনে থাকা ন্যাপি ভিজে গেল। প্রস্রাব পায়খানা করে দিচ্ছে অবলা জীবগুলো।
ইসাবেলার ইচ্ছে হলো চিৎকার করতে করতে পালিয়ে যায় এ আতঙ্ক থেকে।
“এক মিনিট পাঁচ সেকেন্ড; এরপরই জীবনের সমস্ত স্পন্দন হারিয়ে ফেলেছে নাম্বার ওয়ান।” ঝুলতে লাগল ছোট্ট শিশুর মতো দেহ।
“দুই মিনিট পনের সেকেন্ড। নাম্বার টু টার্মিনেটেড।”
“তিন মিনিট আট সেকেন্ড। নাম্বার থ্রি টার্মিনেডেট।”
“আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে নাম্বার ফোরের বিন্দুমাত্র কোনো ক্ষতি হয়নি। পরনের স্যুট এটিকে সুরক্ষিত রেখেছে।”
উঠে দাঁড়াল বেলা।” এক্সকিউজ মি, ছুটে বের হয়ে গেল ইসাবেলা। ধুপধাপ করে করিডোর পার হয়ে উইমেন চেঞ্জিং রুমে ঢুকে পড়ল।
মাথা থেকে হেলমেট খুলেই হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে আঁকড়ে ধরল পোর্সেলিনের তৈরি ঠাণ্ডা টয়লেট বোল। হড়হড় করে বমির সাথে বেরিয়ে এলো যত আতঙ্ক, অনুশোচনা আর অপরাধবোধ।
***
এইমাত্র যে অভিজ্ঞতা হলো এরপর গ্যারি আর হোলি’র ওই চমৎকার বাসায় ফিরতে মোটেই ইচ্ছে করছে না।
মিনিস্টার লোথার কিংবা অন্য কারো সাথে দেখা না করেই ক্যাপরিক প্ল্যান্ট ছেড়ে চলে এলো। কোনো দিকে না তাকিয়ে কেবল পোরশে’তে তুলল। গতির ঝড়। ঘণ্টাখানেক পর আবারো জোহানেসবার্গে ফিরে পোরেশে’র গতি কমাতে বাধ্য হলো।
ফুয়েল-ট্যাঙ্ক বলতে গেলে একেবারে খালি। সার্ভিস স্টেশনে আসতেই বুঝতে পারল রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। অ্যাটেনড্যান্টের কাছে জানতে চাইল স্যান্ডটনে ফেরার পথ। ছেলেটা রাস্তার নাম জানাতেই বেলা’র মনে হলো ওর অবচেতন মন কিংবা ভাগ্যদেবীই তাকে নিয়ে এসেছেন এখানে। আর মাত্র দুই কি তিন মাইল দূরেই মাইকেলের বাসা। কয়েক বছর আগে পঞ্চাশ একরের উপর তৈরি ভাঙ্গাচোরা একটা ফার্ম হাউজে নিয়ে এসেছিল মাইকেল। গোল্ডেন সিটি মেইলের অফিসও কাছেই। বাড়ি ভর্তি শখানেক ফলের গাছ লাগিয়েছে মিকি আর ছেড়ে দিয়েছে এক পাল মুরগী। “ওয়েল এটা ওগুলোর’ও বাসা।” রান্নাঘর। সিঙ্ক আর ফ্রিজের দরজায় মুরগির হাগু দেখে আঁতকে উঠা বেলাকে বুঝিয়েছে মাইকেল।
“মাইকেল!” ভাইয়ের কথা মনে হতেই খুশি হয়ে উঠল বেলা। হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখর মাত্র ছয়টা। এতক্ষণে নিশ্চয় বাসায় চলে এসেছে। এখন আমার আসলে মাইকেলকেই দরকার।”
আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে মাইকেলের এস্টেটের সামনে উঠে এলো পোরশে। পার্ক করে রাখা ভোক্সওয়াগন কোমবি দেখে বোঝা গেল যে অবশেষে বিদায় নিয়েছে মিকি’র বহুদিনের সাথী ভ্যালিয়ান্ট। মনে পড়ল মাইকেল বলেছিল কিভাবে রাশ আওয়ারে রাস্তার মাঝে শর্ট সার্কিট হয়ে জ্বলে উঠে পাঁচ মাইল লম্বা ট্রাফিক জ্যাম বাধিয়ে দিয়েছিল গাড়িটা; তবে কোমরি’র অবস্থাও তার চেয়ে বেশি পদের বলে মনে হলো না।
মাইকেলের বাড়ির টিনের ছাদের অর্ধেকের রং ফ্রেশ আপেলের মতো সবুজ আর বাকি অর্ধেক মরচে পড়া। মেরাতের মাঝপথেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে মিকি।
নিজের প্রপার্টির মাঝে ল্যান্ডিং স্ট্রিপও বানিয়েছে মাইকেল। ফল বাগানের শেষ মাথায় হ্যাঙ্গারে থাকে সেসনা সেঞ্চুরিয়ন এয়ারক্রাফট।
সাদা-নীল এয়ারক্রাফটের ভেতরে ভাইকে খুঁজে পেল বেলা। ওভারঅলের পা ধরে টান দিতেই হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে বের হয়ে এলো বিস্মিত মিকি। দু’ভাই-বোন পরস্পরকে প্রায় বছর খানেক হলো দেখেনি।
পুরনো রেফ্রিজারেটর থেকে ওয়াইনের বোতল এনে দুই গ্লাসে ঢালল মাইকেল। আর তখনই বেলা’র মনে হলো যে কোনো কারণে নার্ভাস হয়ে আছে মাইকেল। বারে বারে নিজের ঘড়ি আর হ্যাঙ্গারের দরজার দিকে তাকাচ্ছে। মনে মনে অসন্তুষ্ট হলো বেলা।
“তুমি কি কারো জন্য অপেক্ষা করছ?” জিজ্ঞেস করল বেলা, জানাল, আই এম সরি মিকি; তোমাকে আগেই ফোন করা উচিত ছিল। আশা করি রাগ করোনি।”
“আরে নাহ্, তা না। তাড়াতাড়ি বলে উঠল মিকি “কিন্তু কেন যেন স্বস্তিও পেল, “আসলে…সত্যি কথা বলতে…” আটকে গেল মিকি’র কথা। আবারো গলা বাড়িয়ে দরজার দিকে তাকাল।
নিশ্চয় ওর লাভার, তিক্ততায় ছেয়ে গেল বেলা’র মন। মিকি ভয় পাচ্ছে যে আমি ওর ছেলে বন্ধুকে দেখে ফেলব। নাহ্ ভাল লাগছে না। ভাইকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলো বেলা।
গাড়ি চালিয়ে চলে আসার সময় রিয়ারভিউ মিররে ভাইয়ের একাকী দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য দেখে অবশ্য বেলার রাগ পানি হয়ে গেল।
বেচারা মিকি, ভাবল বেলা; তুমিও আমার মতই ছন্নছাড়া।
মেইনরোডে এসে পূর্ব দিকে গাড়ি ছোটাল; গন্তব্য স্যান্ডটন। সামনে। থেকে আসছে আরেকটা গাড়ি। ধূসর রঙা ভ্যান। পাশাপাশি আসতেই ড্রাইভারকে দেখে সিধে হয়ে বসল বেলা। বেন। বেলা’কে দেখতে পায়নি বেন, পাশে বসে থাকা কৃষাঙ্গের সাথে মশগুল হয়ে গল্প করছে।
পোরশে’র গতি ধীর করে রিয়ার ভিউ মিররে তাকিয়ে রইল বেলা। হঠাৎ করেই মোড় ঘুরে ভ্যানটা চলে গেল মাইকেলের বাড়ির দিকে।
“যাক, রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে।” পোরশে’র গতি বাড়াল বেলা। “যদিও বুঝতে পারছি না, মাইকেল কেন চায়নি যে আমি বেনকে দেখে ফেলি। কিন্তু পাশের লোকটা কে?”
প্রায় আটটার দিকে স্যান্ডটনে গ্যারি বাড়ির গ্যারাজে গাড়ি পার্ক করল বেলা। ততক্ষণে অস্ত গেছে সূর্য।
“ড্যাম ইট” লিভিং রুমে ঢুকতেই খেঁকিয়ে উঠল গ্যারি, “কোন চুলায় ছিলে এতক্ষণ? জানো কয়টা বাজে?” গ্যারি আর হোলি দু’জনেরই পরনে ইভনিং ড্রেস। গ্যারিকে কখনো এতটা রাগ করতে দেখেনি বেলা।
“ওহ মাই গড! দ্য বল! আয়্যাম সরি!”
এরপরই বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে গলে গেল গ্যারি, “আহারে বেচারি, চোহারার কী হাল হয়েছে দেখ। যাও, আমরা অপেক্ষা করছি, চেঞ্জ করে এসো।”
“না” তাড়াতাড়ি বলে উঠল বেলা, “তোমরা রওনা দাও, আমি আসছি।”
সারা সন্ধেটা মাটি হলো। একটা বোরিং ইউনিভার্সিটি প্রফেসরকে ওর পার্টনার করে দিল হোলি। বেলা সিনেটর হওয়াতে সারা সন্ধ্যা নোকটা শুধু রাজনীতি নিয়েই বকবক করল।
তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এলো বেলা। সারারাত ঘুমের মাঝেও অসহায় বেবুনগুলোকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখল। কখন যেন আবার বেবুনের চেহারা মুছে গিয়ে ভেসে উঠল ক্যামোফ্লেজ পোশাক পরা নিকির মুখ। আতঙ্কে ঘামে নেয়ে উঠল বেলা’র শরীর।
সারা শরীর এতটাই কাঁপছে যে ঘুমোতেও ভয় লাগছে। ভোর না হওয়া পর্যন্ত চেয়ার নিয়ে জানালার কাছেই বসে রইল। এরপর হাতের বই রেখে গোসলে যাবার জন্য উঠতেই দরজায় টোকার শব্দ শুনে খুলতেই দেখল ড্রেসিং গাউন পরে দাঁড়িয়ে আছে গ্যারি। মাথার সব চুল এলোমেলো, চোখ ভর্তি এখনো ঘুম।
“এই মাত্র ওয়েন্ট্রেভেদেন থেকে বাবা ফোন করেছিল” জানাল গ্যারি।
“এই সময়ে? সব ঠিক আছে? নানা?
“না। আমাকে জানিয়েছে যে তোমাকে বলি যে ওরা দুজনেই সুস্থ আছে।”
“তো, কেন ফোন করেছে?”
“আমি আর তুমি যেন এক্ষুণি ওয়েল্টেভ্রেদেন যাই।”
“আমরা দুজনেই?
“হ্যাঁ। তুমি আর আমি। এক্ষুণি।” !
“কেন বলেনি?
“বলতে চায়নি, শুধু জানিয়েছে এটা নাকি জীবন আর মৃত্যুর প্রশ্ন।”
একদৃষ্টে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল বেলা, “কী হতে পারে?”
“কত দ্রুত রেডি হতে পারবে? আধা ঘণ্টা?”
“হ্যাঁ, ঠিক আছে।”
“আমি ল্যানসেরিয়া এয়ারপোর্টে ফোন করে লিয়ার রেডি করে পাইলটকে স্ট্যান্ডবাই রাখার জন্য ফোন করে দিচ্ছি।” হাতঘড়ির দিকে তাকাল গ্যারি, “দশটার আগেই কেপ টাউনে পৌঁছে যাব।”
কেপ টাউনের ডি এফ মালান এয়ারপোর্টে নামতেই দেখা গেল গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে ক্লোনকি।
গান রুমে অপেক্ষা করছেন শাসা আর সেনটেইন। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী এই রুমেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কদর্য বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। তাই রুমে ঢোকার আগে খচখচ করে উঠল বেলা’র মন।
পুরাতন ডেস্কের পেছনে কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নানা আর বাবা। দু’জনের অভিব্যক্তিতে এমন একটা কিছু ছিল যে হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে গেল বেলা, ওর সাথে পিছন থেকে ধাক্কা খেল গ্যারি।
“কী হয়েছে?” ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল বেলা আর ঠিক তখন বুঝতে পারল ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ন্যানি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন বুড়ি মহিলা। চোখ দুটো পুরো লাল, এক হাতে ভেজা রুমাল ধরে বলে উঠল,
“ওহ মিস বেলা, নাক টানল ন্যানি, “অ্যায়াম সো সরি, চাইল্ড, তোমার জন্যই এটা করতে বাধ্য হয়েছি…”
“কী বলছ ন্যানি? “ন্যানি’র দিকে এগোতে গিয়েও থেমে গেল বেলা।
ডেস্কের উপর পড়ে থাকা জানাল দেখে মনে হলো মাথা ঘুরে পড়ে যাব।
বেলা’র চামরায় মোড়া জার্নাল ন্যানি ওর সেইফে হাত দিয়েছে।
“এটা তুমি কী করেছ ন্যানি?” হতাশায় গুমড়ে উঠল বেলা, “তুমি আমাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছ।”
“মাই বেবি! ওহ্, ন্যানি তুমি এটা কিভাবে করলে!”
জার্নালের খোলা পাতায় দেখা যাচ্ছে নিকি’র চুল। পাশেই পড়ে আছে ওর ছোট্ট বেলার জুতা আর বার্থ সার্টিফিকেট।
“হতচ্ছাড়া বুডি” ক্ষেপে উঠল বেলা, “এটা তুমি কী করলে, তমি আমার নিকি’কে মেরে ফেলেছ। এর জন্য কক্ষনো মাফ করব না, কক্ষনো না।”
দু’হাতে মুখ ঢেকে রুম থেকে চলে গেল ন্যানি।
“এটা করেছে কারণ ও তোমাকে ভালবাসে, বেলা।” তীব্র স্বরে চিৎকার করে উঠলেন শাসা।” ও যেটা আজ করেছে সেটা তোমার আট বছর আগেই করার কথা ছিল।”
“এটা মোটেই ওর মাথা ব্যথা নয়। তোমাদের কারোও নয়। আসলে বুঝতেই পারবে না তোমরা কেউ। তাহলে ভয়ংকর বিপদে পড়ে যাবে নিকি আর রামোন।”
দৌড় দিয়ে ডেস্কের কাছে গিয়ে ছোঁ মেরে জার্নালটা তুলে বুকের কাছে ধরে রাখল বেলা।
“এটা আমার। তুমি এর ভেতরে নাক গলাতে এসো না।”
“কী হচ্ছে? কী এসব?” বেলার পাশে এসে দাঁড়াল গ্যারি।
“কাম অন, বেলা। উই আর আ ফ্যামিলি। উই স্ট্যান্ট টুগেদার।”
হ্যাঁ বেলা, গ্যারি সত্যি কথাই বলছে।”
“যদি তুমি আমাদেরকে তাই মনে কর” শাসাকে থামিয়ে দিলেন সেনটেইন; ডেস্কের পিছনে বসে পড়ে বললেন, “একে অন্যের উপর দোষ ছুঁড়লেই কোনো লাভ হবে না। সবাই মিলে একসাথে কাজ করতে হবে। বসো, বেলা। বেশিরভাগটাই অনুমান করতে পারছি; বাকিটা আমাদেরকে তুমিই না হয় জানাও। নিকি আর রামোন সম্পর্কে সব খুলে বলল।”
ইসাবেলার মনে হল হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবে। পায়ের নিচে কাঁপছে পুরো দুনিয়া। বোনের কাঁধে হাত রেখে সান্তনা দিতে চাইল গ্যারি।
“ইটস্ ওকে বেলা; আমরা সবাই তোমার সাথে আছি। এখন বলো নিকি কে? আর রামোনই বা কে?”
“নিকি আমার সন্তান আর রামোন ওর পিতা।” নরম স্বরে বলে উঠল বেলা; ভাইয়ের বিশাল বুকে মুখ লুকিয়ে শক্ত করতে চাইল নিজেকে।
খানিকক্ষণ বেলা’কে মন ভরে কাদার সুযোগ দিয়ে টেলিফোন তুললেন সেনটেইন।” আমি ডাক্তার মন্তারস’কে ফোন দিচ্ছি। এসে বেলা’কে ওষুধ খাইয়ে শান্ত করবেন।”
তড়িৎ বেগে দাদীর দিকে তাকাল বেলা, “না, নানা, আমার কিছুই দরকার নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাকে শুধু এক মিনিট দাও।”
ক্রেডলে ফোন রেখে দিলেন সেনটেইন। চামড়ার গদি আটা সোফাতে বোন’কে ধরে বসিয়ে দিল গ্যারি; নিজেও ওর পাশে বসে পড়ল। অন্য পাশে এসে বসলেন শাসা। দু’পাশ থেকে দুজন মিলে বেলাকে ধরে রাখলেন।
“অল রাইট” অবশেষে বলে উঠলেন সেনটেইন “যথেষ্ট হয়েছে। তুমিও পরে কাদার বহু সময় পাবে; এখন কাজের কথায় আসা যাক।”
সোজা হয়ে বসল বেলা; বুক পকেট থেকে রুমাল বের করে মেয়ের দিকে এগিয়ে দিলেন শাসা।
“বলো যে কিভাবে এসব ঘটেছে” আদেশ দিলেন সেনটেইন।
বড় করে একটা শ্বাস নিল বেলা, “ড্যাডি আর আমি লন্ডনে থাকাকালীন হাইড পার্কের কনসান্টে রামোনের সাথে পরিচয় হয়েছিল।” ফিসফিস করে জানাল বেলা। ধীরে ধীরে শক্তি ফিরে এলো। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে একটানা কথা বলে জানাল কেন সে আর রামোন বিয়ে করেনি আর কিভাবেই বা স্পেনে নিকি’র জন্ম হলো। “আমি ওকে এখানে ওয়েল্টেভ্রেদেনে ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিলাম। প্ল্যান ছিল রামোন মুক্তি পাবার সাথে সাথে আমরা বিয়ে করব।”
এরপর একের পর এক বলে গেল রামোন আর নিকি’র অপহরণের কাহিনী, শিশু অবস্থায় নিকি’র উপর অত্যাচার আর তারপর থেকে দুঃস্বপ্নের মতো পার করা প্রতিটি দিনের কথা।
“এই রহস্যময় লোকগুলো তোমার কাছ থেকে কী চায়? রামোন আর নিকির নিরাপত্তার জন্য তোমাকে কোনো মূল্য দিতে হচ্ছে? নিকি’কে দেখতে পাবার সুযোগের পরিবর্তে তুমি তাদেরকে কী দিচ্ছ?” তীক্ষ্ণ স্বরে জানতে চাইলেন শাসা।
কাঠের মেঝেতে নিজের হাতের বেতের লাঠি ঠুকলেন সেনটেইন, “এ মুহূর্তে এসব তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়; এগুলো নিয়ে আমরা পরে ভাবব।”
“না” মাথা নাড়ল বেলা, “উত্তর দিতে আমার কোনো সমস্যা নেই। ওরা আমার কাছ থেকে কিছুই চায় না। আমার ধারণা উনারা রামোনকে দিয়ে জোর করে কিছু করিয়ে নিচ্ছে। তার পরিবর্তে আমার আর নিকোলাসের সাথে দেখা করতে দিচ্ছে।”
“তুমি মিথ্যে বলছ বেলা” কর্কশ হয়ে উঠল শাসার গলা।” রামোন মাচাদো তোমাকে ব্যবহার করছে। তুমি বাধ্য হচ্ছ তার আর তার প্রভুদের ফরমায়েশ পূর্ণ করতে।”
“না” এক অর্থে খুশিই হলো বেলা যে বাবা ওর মিথ্যে এত সহজে টের পেয়ে গেছে। “রামোনও আমার মতই অসহায়। আমাদেরকে ভয় দেখিয়ে ব্লাকমেইল করা
“স্টপ ইট, বেলা” মেয়েকে থামিয়ে দিলেন শাসা, “তুমিই একমাত্র মূল্য চুকাচ্ছো। নিকোলাস হলো ওদের তুরুপের তাস। রামোনই হলো সেই শয়তান যার হাতে আছে আসল নাটাই”
আর্তচিৎকার করে উঠল বেলা : “না! তুমি জানো না! রামোন তো”
“আমি তোমাকে বলছি যে কে এই রামোন ডি সান্তিয়াগো-ই-মাচাদো; তুমিই আমাদেরকে ওর পারিবারিক নাম জানিয়েছ” শাসা ইশারা করতেই জার্নালটাকে আগলে ধরল বেলা। “তুমি তো জানই যে ইস্রায়েলে আমার বন্ধুরা আছেন। এদেরই একজন মোসাদের ডিরেকটর। আমি ফোন করাতে ওদের কম্পিউটারে খুঁজে দেখেছে রামোনের নাম। সি আই’এর সাথে যুক্ত ওদের কম্পিউটার। আমাদের নিজেদের সিকিউরিটি ফোর্সেরও রামোনের উপর ওপেন ফাইল আছে। ন্যানি তোমার জার্নাল নিয়ে আসার তিন দিনের মাঝে তোমার রামোন সম্পর্কে বেশ মজার কিছু তথ্য খুঁজে পেয়েছি; সোফা থেকে লাফ দিয়ে উঠে ডেস্কের কাছে গেলেন শাসা। একটা ড্রয়ার খুলে বের করলেন বেশ মোটাসেটা একটা ফাইল। ঠাস্ করে ছুঁড়ে ফেললেন বেলা’র সামনে রাখা কফি টেবিলের উপর। পুরু ফাইলের কাভার উপচে ছড়িয়ে পড়েছে প্রেস কাটিং ছবি। ডকুমেন্টস আর একতাড়া কম্পিউটার শীট।
“গত রাতে তেল আবিব থেকে ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে ভরে ইস্রায়েল থেকে এসেছে এটি। নিজে না দেখা পর্যন্ত আমি তোমাকে ডাকিনি। পড়ে অবশ্য ভালই লেগেছে।” স্কুপের মধ্য থেকে একটা ছবি টেনে নিলেন শাসা।” বিজয়ীর বেশে ১৯৫৯ এর জানুয়ারিতে হাভানা’তে ঢুকছেন ফিদেল ক্যাস্ট্রেী। দ্বিতীয় জিপে একসাথে চে গুয়েভারা আর রামোন।” আরেকটা চকচকে সাদা কালো ছবি তুলে নিয়েছেন শাসা।” কঙ্গো ১৯৬৫। প্যাট্রিস লুমাম্বা ব্রিগেড। বাম পাশ থেকে দ্বিতীয় শ্বেতাঙ্গটিই হলো রামোন। সাথে সিম্বা বিদ্রোহীদের মৃতদেহ।” আরেকটা ছবি হাতে নিয়ে জানালেন, বে অব পিগস’র পরে কাজিন ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে রামোনল্যান্ডিং এর বুদ্ধি বের হয়েছে রামোনের মাথা থেকে।” একগাদা ছবির মধ্যে হাতড়াচ্ছেন শাসা; “এই ছবিটা মাত্র কদিন আগে ভোলা। কর্নেল জেনারেল রামোন ডি সান্তিয়াগো-ই-মাচাদো, কেজিবি’র ফোর্থ ডিরেকটরের আফ্রিকান সেকশন হেড, জেনারেল সেক্রেটারি ব্রেজনেভের কাছ থেকে অর্ডার অব লেনিন অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করছে। ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় বেশ সুদর্শনই লাগছে। তাই না বেলা? ওই মেডেলগুলো দেখো”।
এমন ভাবে ছবিটার কাছ থেকে সরে গেল বেলা যেন বাবা কোনো কালো মাম্বা ধরে রেখেছে।
শাসা’র হাত থেকে ছবিটা নিল গ্যারি, “এই লোকটা রামোন?” বোনের মুখের সামনে ছবি ধরে জানতে চাইল গ্যারি। চোখ নামিয়ে নিল বেলা; কিছু বলল না।
“কাম অন, বেলা। তোমাকে বলতেই হবে, এই লোকটাই তোমার রামোন?” এবারেও কোনো উত্তর দিল না বেলা; মেয়েকে ধরে ঝাঁকুনি দিলেন শাসা। এর সবই হচ্ছে সাজানো নাটক, বিরাট বড় একটা থোকা। ওই তোমাকে ভিকটিম বানিয়েছে। আমি প্রায় নিশ্চিত যে অপহরণ আর তোমার ছেলেকে পানিতে ডুবিয়ে নির্যাতন করার বুদ্ধিও তার। তখন থেকেই তোমাকে নিয়ে খেলছে। তুমি কি জানো যে ওর নিক নেইম হল এল জোরো ভোরাডো? ও নির্ঘাৎ ক্যাস্ট্রো নিজেই দিয়েছে এই নাম, দ্য গোল্ডেন ফক্স।”
ঝট করে মুখ তুলে তাকাল বেলা। মনে পড়ল জোসের কথা, “পেলে হলো শিয়াল ছানা, এল জোরো”। এই ছোট্ট একটা বাক্যের জন্যই সত্যিটাকে স্বীকার করতে বাধ্য হলো বেলা।
“এল জোরো ইয়েস।” শক্ত হয়ে গেল বেলা’র অভিব্যক্তি। চোখে ফুটে উঠল ঘৃণার আগুন। অবচেতন ভাবেই তাকাল দাদি’র দিকে। “এখন আমরা কী করব, নানা?”
“ওয়েল আমাদের প্রথম কাজ হলো নিকোলসাকে উদ্ধার করা।” সোজা সাপটা উত্তর দিলেন সেনটেইন।
“তুমি জানো না যে কী বলছ, নানা বাধা দিল গ্যারি। হতবুদ্ধি হয়ে গেছে। দাদির কথা শুনে।
“কী বলছি তা আমি সব সময় জানি।” দৃঢ়স্বরে ঘোষণা করলেন সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকমস্।
“এ কাজের দায়িত্ব তোমাকেই দিচ্ছি গ্যারি; এটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তুমি যা যা প্রয়োজন সব কিছুই পাবে। খরচ নিয়ে আমি মাথা ঘামাবো না। শুধু আমাকে বাচ্চাটা এনে দাও। এটাই হলো আসল কথা। আমি কি পরিষ্কার ভাবে বোঝাতে পেরেছি ইয়াং ম্যান?”
ধীরে ধীরে কেটে গেল গ্যারির চেহারার মেঘ; মিটিমিটি হেসে বলে উঠল, “ইয়েস নানা, সবকিছু জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে।”
***