কারপার্কে নিজের পরিত্যক্ত ভ্যালিয়ান্টের কাছে আবার মাইকেলকে ফিরিয়ে আনা হল। এবারে ভ্যানের সামনে ড্রাইভারের পাশে বসেছেন তাবাকা। আর পেছনে হামাগুড়ি দিয়ে ছিল মাইকেল। নিজের পুরনো গাড়িটাকে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাইকেল তো রীতিমতো বিস্মিত।
“কেউ এটা চুরি করার কষ্টও করেনি!”
“না” একমত হলেন রালেই। আমাদের লোকেরা পাহারা দিয়ে রেখেছিল। নিজেদের জিনিস আমরা ভালই দেখ ভাল করতে পারি।”
হ্যান্ডশেক করে মাইকেল ঘুরতে যেতেই থামালেন রালেই, “আপনার তো একটা প্লেন আছে তাই না মাইকেল?”।
“আরে ধূর!” হেসে ফেলল মাইকেল। “পুরনো একটা সেঞ্চুরিয়ন, এরই মাঝে তিন হাজার ঘণ্টা উড়ে ফেলেছে।”
“আমাকে একটু উপকার করতে হবে তাহলে।”
“আমি রাজি। বলুন কী করতে হবে?”
“বৎসোয়ানায় যাবেন?” জানতে চাইলেন তাবাকা।
“প্যাসেঞ্জার নিয়ে?”
“না। একা যাবেন-একাই ফিরবেন।”
“দ্বিধায় পড়ে গেল মাইকেল। “এটাও কী লড়াইয়ের অংশ?”
“অবশ্যই।” হৃষ্টচিত্তে উত্তর দিলেন রালেই, “আমার জীবনের প্রতিটি কাজই হলো লড়াই।”
“কখন যাবো?” নিজের সন্তুষ্টি ঢেকে রাখতে চাইলেন তাবাকা।
যাক লন্ডনের ফ্ল্যাটে ভিডিও করা ফুটেজ ব্যবহারের হুমকি দিতে হলো না!
“কখন আপনি সময় পাবেন?”
***
বাবা কিংবা অন্য ভাইদের মতো উড়ে বেড়ানোটাকে প্রথম দিকে আমল দেয়নি মাইকেল। এখন বুঝতে পারে যে আসলে মনে মনে ওদের কারও মতো না হতে চাওয়াটাই তাকে বিতৃঞ্চ করে তুলেছে এসবের প্রতি। যেমন চায়নি বাবার ইচ্ছে মতো নিজের জীবন পরিচালনা করতে।
পরবর্তীতে অবশ্য ফ্লাই করতে নিজেরই ভাল লাগত। নিজের সেভিংস থেকেই সেঞ্চুরিয়ন কিনেছে। বুড়ো হওয়া সত্ত্বেও দ্রুতগতির আরামদায়ক প্লেনটা মাত্র তিন ঘণ্টাতেই উত্তর বৎসোয়ানায় পৌঁছে দিল মাইকেলকে।
পুরো আফ্রিকাতে এই একটাই মাত্র গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে বহুদলীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা থাকার পাশাপাশি নিয়মিত নির্বাচনও হয়। আফ্রিকার অন্যান্য জায়গার তুলনায় দুর্নীতি প্রায় নেই বললেই চলে। বর্ণবাদ কিংবা জাতি বিদ্বেষও তেমন নেই। দক্ষিণ আফ্রিকার পর এটাই আফ্রিকার অন্যতম সমৃদ্ধিশালী দেশ।
মন’য়ে নেমে এক কামরার ছোট্ট দালানটাতে কাস্টমস আর ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে আবারো প্লেনে চড়ে বসল উত্তরে ওকাভাঙ্গো ব-দ্বীপের উদ্দেশ্যে।
বেশ বড় একটা দ্বীপের এয়ারস্ট্রিপে সেঞ্চুরিয়ন নিয়ে ল্যান্ড করল মাইকেল। ক্যানোতে করে জলপদ্ম ভরা লেগুন পার করে দিল দু’জন মাঝি। ক্যাম্পে পৌঁছে গেল মাইকেল। ক্যাম্পের নাম গে গুজ লজ। ছবির মতো ছোট্ট কুঁড়ে ঘরগুলোতে চল্লিশ জন অতিথি থাকার মতো ব্যবস্থা আছে। এদের কাজ হল পড়াশোনা কিংবা চারপাশের জীব জগতের ছবি ভোলা। কৃষাঙ্গ মাঝিরা এসে প্রাচীন ক্যানোতে করে নিয়ে যায় খালে।
অতিথিদের বেশিরভাগই পুরুষ। সাউথ আফ্রিকা থেকে আগত এক রাজনৈতিক শরণার্থী এই ক্যাম্পের পরিচালক। মধ্য তিরিশের ব্রায়ান সাসকিন্ড দেখতেও বেশ সুদর্শন। লম্বা সোনালি চুল রোদে পুড়ে প্রায় সাদা হয়ে গেছে। অলংকার পরতেও বেশ ভালবাসেন।
মাইকেলকে দেখেই এগিয়ে এলেন,
“গড ডার্লিং, আপনাকে দেখে সত্যিই খুব খুশি হয়েছি। রালেই আমাকে সব জানিয়েছে। দেখবেন এখানে কত ভাল লাগবে। এত মজার সব লোক আছে এখানে। ওরাও আপনাকে দেখার জন্য অধীর হয়ে আছে।”
অত্যন্ত রূপবান, তরুণ সোয়ানা স্টাফদেরকে দেখে বোঝা গেল সার্থক হয়েছে গে গুজ নাম।
উত্তেজনায় ভরপুর এক উইকেন্ড কেটে গেল ক্যাম্পে। ফেরার সময় মাকোরো ক্যানু পর্যন্ত সঙ্গে এলেন ব্রায়ান।
“বেশ ভাল লেগেছে, মিকি। মাইকেলের হাতে চাপ দিয়ে জানালেন, “আরো নিশ্চয় দেখা হবে। তবে সাবধানে টেক অফ করবেন। খানিকটা ভারিই হয়ে গেছে বোধহয়।”
প্যাসেঞ্জার সিটের নিচে গোপন কম্পার্টমেন্টে একবারও না তাকিয়ে টেক অফ করল মাইকেল।
ল্যানসেরিয়া এয়ারপোর্টের কাস্টমস পার হবার সময় তো দম বন্ধ হয়ে আসছিল। যদিও ভিত্তিহীন ছিল ভয়। আগেও বহুবার দেখা হওয়াতে কাস্টমস অফিসার ওকে ভালোভাবেই চেনে। তাই লাগেজ কিংবা সেঞ্চুরিয়ন চেক্ করার কোন কষ্টই করল না।
সে রাতেই ল্যানসেরিয়ার হ্যাঙ্গারে কৃষাঙ্গ পাহারদার সেঞ্চুরিয়ন থেকে ভারি একটা বক্স নিয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে তুলে দিল নীল ডেলিভারি ভ্যানের ড্রাইভারের হাতে।
ড্রেকস ফার্মের নবস হিলের রান্নাঘরে ক্রেটের সীল পরীক্ষা করে দেখলেন তাবাকা। পুরোপুরি ইনট্যাক্ট। কেউ কার্গোতে হাতও দেয়নি। সন্তুষ্ট হয়ে ঢাকনা খুলে ফেললেন তাবাকা। পাওয়া গেল সন্তুর কপি পবিত্র বাইবেল। আরেকটা পরীক্ষায় উৎরে গেল মাইকেল কোর্টনি।
পাঁচ সপ্তাহ পরে আবারো গে গুজু ক্যাম্পে এলো মাইকেল। এবার ফেরার পথে নিয়ে এলো রাশিয়ায় তৈরি বিশটা মিনি লিম্পেট মাইন ভর্তি বাক্স। পরের দুই বছরে আরো নয়বার আসতে হল এই ক্যাম্পে। ল্যানসেরিয়া এয়ারপোর্টে সাউথ আফ্রিকান কাস্টমস্ পার হতে আর কোনো খারাপ লাগে না।
পাঁচ বছর পরে আবারো দেখা হল রালেই তাবাকা’র সাথে। মাইকেলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে আফ্রিকান ন্যাশন্যাল কংগ্রেসের সামরিক শাখায় যোগ দান করার জন্য।
“কয়েকদিন ধরেই আসলে ভাবছিলাম।” রালেইকে উত্তর দিল মাইকেল। “শেষ পর্যন্ত মনে হল কলম আসলে যথেষ্ট নয়। বুঝতে পেরেছি কখনো কখনো তলোয়ার’ও ধরতে হয়। এক বছর আগে হলেও হয়ত আপনার কথায় রাজি হতাম না। কিন্তু এখন, সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশ নেয়ার জন্য আমি পুরোপুরি প্রস্তুত।”
***
“অল রাইট বেলা-” দৃঢ় ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম। “তুমি রাস্তার ওই মাথা থেকে শুরু করবে-আমি এই মাথা থেকে। এরপর শফারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ক্লোনকি, আমাদেরকে মোড়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে যাও। লাঞ্চটাইমে আবার নিয়ে যাবে।”
বাধ্য ছেলের মতো হলুদ ডেইমলার’কে স্লো করল ক্লোনকি।
গাড়ি থেকে নেমে এলো দুই নারী। “তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না যে ভোটাররা তোমাকে এত দামি আর বিশাল কোনো ওয়াগনে চড়তে দেখুক।” বুঝিয়ে বললেন সেনটেইন। নাতনীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুব সাবধানে চোখ বুলিয়ে দেখলেন।
শ্যাম্পু করা লাল রঙা চুলগুলো মাথার উপরে চূড়া করে বাঁধা। ময়েশ্চারাইজার ক্রীম লাগানো মুখখানা দেখতে স্কুল গার্লদের মতো লাগছে। সন্তুষ্ট হলেন সেনটেইন।
“ঠিক আছে, বেলা, চলো। মনে আছে তো, আজ তুমি নারীদের সাথে কথা বলবে!” দিনের এই সকাল দিকটায় ঘরের পুরুষেরা বাইরে চলে যায়; বাচ্চারা স্কুলে থাকায় লোয়ার মিডল ক্লাস হাউস ওয়াইভরা ব্যস্ত থাকে গৃহকর্ম নিয়ে।
এর আগের দিন সন্ধ্যায় স্ িপয়েন্ট ম্যাসোনিক হলে পুরুষ দর্শকদের সামনে বক্তৃতা দিয়েছে ইসাবেলা। বেশির ভাগই আগ্রহ নিয়ে এসেছিল ন্যাশনাল পার্টির প্রথম নারী ক্যান্ডিডেটের কথা শোনার জন্য।
হলে’র কেউ কেউ বেলা’র ড্রেস আর মেক-আপ দেখে হুইসেল দিয়ে উঠতেই খেপে উঠল, নার্ভাস বেলা। ফলে একদিকে লাভও হলো। সাপের মতো ফনা তুলে ছোবল হানল প্রথম সুযোগেই, “জেন্টলম্যান, আপনাদের ব্যবহার কারো কোনো লাভ হবে না। বরঞ্চ খেলার মানসিকতা থাকলে, আমাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখুন কী হয়।”
লজ্জিত মুখে হেসে নীরব হয়ে গেল উপস্থিত দর্শক।
অন্যগুলোর চেয়ে খানিকটা দূরত্ব রেখে বানানো হয়েছে করাগেটেড টিনের ছাদঅলা নাম্বার টুয়েলভ কটেজ। সামনের বাগানে ফুটে আছে চমৎকার সব ডালিয়া। বাড়ির সামনে এসে চিৎকাররত ফক্স টেরিয়ারকে এক ধমকে চুপ করিয়ে দিল ইসাবেলা। কুকুর আর ঘোড়ার সাথে ওর কোনো সমস্যাই হয় না কোনোদিন।
দরজার কাছে এসে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে উঁকি দিয়ে দেখছে ঘরের গৃহিণী জানতে চাইল,
“ইয়েস? কী চান?”
“আমি ইসাবেলা কোর্টনি। আগামী মাসের বাই-ইলেকশনে ন্যাশনাল পার্টির ক্যান্ডিডেট। কিছুক্ষণ আপনার সাথে কথা বলতে পারি?”
“দাঁড়ান।” ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেও একটু পরেই মাথায় স্কার্ফ চাপিয়ে ফিরে এলো।
“আমরা ইউনাইটেড পার্টির সমর্থক।” দৃপ্ত ভঙ্গিতে ঘোষণা করল মহিলা। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল ইসাবেলা।
“ডালিয়াগুলো কী সুন্দর!”
বোঝাই যাচ্ছে এটা প্রতিদ্বন্দীদের গোড়া সমর্থকের আখড়া। তার নিজের পার্টিও কোনো নিরাপদ আসনে লড়তে দেবে না। এসব আসন কেবল তাদের জন্যই বরাদ্দ যারা এরই মাঝে সফল হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে। নানা। গত সাধারণ নির্বাচনে পাঁচ হাজার মেজরটি নিয়ে এই আসন জিতেছে ইউনাইটেড পার্টি।
“যদি আমরা একে তিন হাজারে নামিয়ে আনতে পারি তাহলে পরের ইলেকশনে ওদেরকে বাধ্য করতে পারব তোমাকে আরো ভালো আসন দেয়ার জন্য।” হিসাব করে ফেলেছেন নানা।
নিজের ডালিয়ার দিকে ইসাবেলা’কে মুগ্ধ চোখে তাকাতে দেখে এবারে নরম হয়ে গেল ঘরের স্ত্রী।
“আমি কি একটু ভেতরে আসতে পারি?” নিজের সবচেয়ে চমৎকার হাসি হাসল বেলা; একপাশে সরে দাঁড়াল মহিলা।
“ঠিক আছে, কিন্তু শুধু কয়েক মিনিটের জন্য।”
“আপনার স্বামী কী করেন?”
“মোটর মেকানিক।”
“ট্রেড ফ্রাগমেন্টেশন আর ব্ল্যাক ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে উনি কি কিছু ভাবেন?” মোক্ষম জায়গায় আঘাত হেনেছে ইসাবেলা। পরিবারের সমৃদ্ধি আর ছেলে-মেয়েদের অন্নের কথা মনে পড়ে গেল।
“আপনাকে এক কাপ কফি দেব মিসেস কোর্টনি?” মহিলার ভুল ভাঙ্গালো না বেলা।
পনের মিনিট পরে মহিলার সাথে হ্যান্ডশেক করে বের হয়ে এলো ছোট্ট বাগান থেকে। নানা’র কথা মতই কাজ করেছে : “চাপ দেবে কিন্তু সংক্ষেপে।”।
মনে হচ্ছে, জিতে গেছে। প্রথমে “না” বললেও ধীরে ধীরে “হয়ত” তে নেমে এসেছে মহিলা।
রাস্তা পেরিয়ে এগারো নাম্বার দরজার কাছে আসতেই খুলে দিল ছোট্ট একটা ছেলে।
“তোমার মা বাসায় আছেন?”
জ্যাম লাগানো আধখানা পাউরুটি এক হাতে নিয়ে, ইসাবেলাকে দেখে লাজুক হাসি হাসল সোনালি কোঁকড়া চুলঅলা ছেলেটা।
নিকি’র কথা মনে পড়তেই শক্ত হয়ে গেল বেলা।
“আমি ইসাবেলা কোর্টনি, আগামী মাসের বাই ইলেকশনে ন্যাশনাল পাটি ক্যান্ডিডেট। এরই মাঝে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে বাচ্চাটার মা।
তিন নম্বর ঘর শেষ হবার পর অবাক হয়ে আপন মনেই নিজের আনন্দ অনুভব করল বেলা। বেশ মজা তো! জীবনের এমন একটা দিক দেখছে যার অস্তিত্ব সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না। সাধারণ সব কথাবার্তার মাধ্যমেই বুঝতে পারছে ওদের সমস্যা আর ভয়গুলো। কী করা যায় ভেবে এরই মাঝে চিন্তায় পড়ে গেছে।
বাবা প্রায়ই একটা কথা বলেন, “ক্ষমতাবানদের দায়িত্বও বেশি।” কথাটা বুঝতে পারলেও কখনো তেমন করে ভাবেনি বেলা। ব্যস্ত ছিল নিজের জগৎ, আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে।
আর এখন মেশার পর অনুভব করছে সত্যিকারের এক সহানুভূতি আর ওদের নিরাপত্তা দেয়ার এক আত্মিক টান।
মা হবার ফলেই হয়ত এ পরিবর্তন এসেছে; ভাবনাটা মাথায় আসতেই মনে হল সে এদেরকে সত্যিকার অর্থে সাহায্য করতে চায়।
খানিকটা বিরক্ত লাগল, যখন আট নম্বর ঘর ভিজিট করার পর হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল নানার সাথে দেখা করার সময় হয়ে গেছে।
রাস্তার কোণায় নাতনীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন নানা।
যে কোনো তরুণীর মতই সতেজ আর প্রাণশক্তিতে ভরপুর নানা বেলাকে দেখেই জানতে চাইলেন, “কেমন কাটল দিন? কয়টা সাড়া পেয়েছ?”
“আট।” সন্তুষ্ট চিত্তে উত্তর দিল বেলা।”দুটো-ইয়েস আর একটা-হয়ত। তোমার কী খবর?”
“চৌদ্দটার মাঝে পাঁচটাতে ইয়েস। হয়ত কিংবা হতে পারে’কে আমি কখনো গণনায় ধরি না।”
হলুদ ডেইমলার এগিয়ে এসে গতি ধীর করতেই গাড়িতে উঠে বসল দু’জনে।
“এবার কাজ হলো, ঘরে ফেরার পরেই প্রত্যেককে নিজ হাতে নোট লিখে পাঠিয়ে দেবে। বাচ্চাদের নাম, বয়স, কিছু ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য নোট করে এনেছ না?”
“প্রত্যেককেই লিখতে হবে?”
“হ্যাঁ, সবাইকে। হ্যাঁ, না, হয়ত, প্রত্যেককে। এরপর নির্বাচনের আগে আরেকবার মনে করিয়ে দেবে নোট পাঠিয়ে, ঠিক আছে?”
“এত কাজ করতে হবে, নানা?” প্রতিবাদ করতে চাইল বেলা।
“পরিশ্রম বিনা কিছুই অর্জন করতে পারবে না, ডিয়ার।” ক্রীম রঙা চামড়ায় সোফায় আরাম করে বসে আরও জানালেন, আজ সন্ধ্যায় মিটিং’র কথা মনে আছে না? বক্তৃতা লিখে ফেলেছ? কী বলবে সব ঠিক করে নাও। একসাথে যাবো দুজনে।”
“নানা, বাবা’র এখনো একগাদা কাজ জমে আছে আমার হাতে।”
“এসব বাতিল করে দাও।”
সেক্রেটারিকে দিয়ে প্রত্যেক ভোটারের জন্য নোট টাইপ করিয়ে নিজের হাতে চেক করে সাইন করে দিল বেলা।
***
সেনটেইন হাউজের কোণার একটা স্যুইট বেলা’কে অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য দিয়েছেন শাসা। বেলা’র নতুন সেক্রেটারি গত বিশ বছর ধরে কোর্টনি এন্টারপ্রাইজে কাজ করছে। ইসাবেলা’র ইনার অফিস সাজানো হয়েছে দুইশ বছরের পুরাতন একটা বিল্ডিং থেকে খুলে আনা কাঠের প্যানেল দিয়ে। উজ্জ্বল মাখন রঙা কাঠের কাজ ছাড়াও শাসা মেয়েকে কানেকশন থেকে চারটা পেইন্টিংস দিয়েছেন। পিয়ারনিফ আর হুগো নড়ের আঁকা।
স্যুইটের জানালা দিয়ে তাকালেই চোখে পড়ে পার্ক আর সেন্ট জর্জ ক্যাথেড্রাল। বহুদূরের টেবল মাউন্টেনও অস্পষ্টভাবে দেখা যায়।
সবশেষ চিঠিটাতে সাইন করেই সেক্রেটারি’র অফিসে গেল বেলা। দেখা গেল শূন্য অফিসে কেউ নেই। হাত ঘড়িতে সময় দেখেই আঁতকে উঠল, “ওহ্ ঈশ্বর! এরই মাঝে পাঁচটার বেশি বাজে।”
নিকি’কে হারাবার পর থেকে এত দ্রুত সময় আর কখনো যায়নি। কঠোর পরিশ্রম করেই নিজের দুঃখ ভুলে থাকে বেলা।
ওয়েল্টেভ্রদেনে ডিনার হয় সাড়ে আটটায়, আধ ঘণ্টা আগে ককটেল। সময় আছে এখনো, তাই আবারো নিজের ডেস্কে ফিরে এসে দেখল ড্রাফট কফি রেখে গেছেন বাবা। উপরে নোট : “কাল সকালেই এটা ফেরৎ চাই। লাভ ইউ, বাবা।”
অ্যামব্যাসিতে থাকার সময় থেকেই বাবার লিখিত বক্তব্য কিংবা রিপোর্ট চেক করে দেয় বেলা। এ সাহায্যটুকু শাসা’র না হলেও চলে। তারপরও পিতা কন্যা দুজনেই আনন্দ পায় এ কাজটুকু করতে।
বারো পাতার রিপোর্টটা খুব সাবধানে চেক করে একটা মাত্র পরিবর্তনের সুপারিশ করে নোট লিখল বেলা : “আমার বাবা’টা কত বুদ্ধিমান!” জানে মেয়ের প্রশংসা বেশ উপভোগ করেন শাসা।
বাবা’র অফিস লক করা থাকলেও নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে তালা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল বেলা।
বাবার এই অফিস তার নিজের অফিসের চেয়েও চারগুণ বেশি বড় আর
ভার্সেইলেসের ডফিন অ্যাপার্টমেন্ট থেকে লিনামে কেনা ১৭৯১ সালের ডেস্কের উপর রিপোর্টটাকে রাখতে গিয়েও থেমে গেল বেলা। দেশের নিরাপত্তার সাথে জড়িত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ ফাইলটা এভাবে ভোলা রাখা ঠিক হবে না।
বাবা’র পার্সোনাল সেফে রাখতে গিয়ে ফলস্ বুককেস সরিয়ে ফেলল বেলা। বুককেসের উপরে থাকা বাম্বের ব্রাকেটের সাথে লাগানো আছে এর হুড়কো। ব্রাকেটটা ঘোরাতেই ফলস বুককে খানিকটা সরে গেল।
শাসা নিজে ছাড়া এর কম্বিবেশন আর জানে একমাত্র বেলা; নানা কিংবা গ্যারি’ও জানে না।
কম্বিনেশন সেট করে ভারি স্টিলের দরজাটা খুলে ভেতরে পা রাখল বেলা। রুমটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রায়ই বাবার সাথে চিৎকার করে। আর এখন তো দেখে হযবরল অবস্থা। দুটো সবুজ আর্মসকোর ফাইল স্তূপ হয়ে আছে মাঝখানের টেবিলের উপর। তাড়াতাড়ি সবকিছু গুছিয়ে সে হাউজ লক করে লেডিস ওয়াশরুম ঘুরে এলো বেলা।
এরপর মিনি’তে বসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল, এত ক্লান্তিকর একটা দিন কাটালেও রক্ষে নেই। ডিনারের পর ইলেকশন মিটিং আছে। মাঝরাত পার হয়ে যাবে বিছানায় যেতে যেতে।
একবার ভাবল শর্টকাট ধরে ওয়েল্টেভ্রেদেনে ফিরে যাবে। কিন্তু গাড়িটা মনে হল কোনো এক অদৃশ্য শক্তির টানে চলে এলো ক্যাম্পস বে পোস্ট অফিসে।
প্রতিবারের মতো এবারেও পেটের মাঝে পা দিয়ে উঠল; বক্সের সামনে এসে দাঁড়াতেই মনে হল আজও শূন্যই দেখবে? কতদিন নিকি’র কোনো খবর পায় না।
কিন্তু বাক্সটা খুলতেই মনে হল বুকের ভেতর লাফ দিল হৃদপিণ্ড। চোরের মতো ছোঁ মেরে চিকন খামটা তুলে নিয়েই চালান করে দিল জ্যাকেটের পকেটে।
অভ্যাস মতো সৈকতের উপরে গাড়ি পার্ক করে খাম খুলে পড়ে ফেলল চার লাইনের টাইপ করা নির্দেশিকা।
নতুন কাজ দেয়া হয়েছে।
অর্ডার মুখস্থ করেই চিঠিটা পুড়ে ছাই বানিয়ে ফেলল বেলা।
***
লাল গোলাপের চিঠি পাবার তিন দিন পর শুক্রবার সকালবেলা ক্লেয়ারমেন্টের নতুন পি এন পে সুপারমার্কেটের সামনে মিনি পার্ক করল ইসাবেলা।
ড্রাইভারের দরজা বন্ধ করলেও নির্দেশ মতো ইঞ্চিখানেক ভোলা রাখল।
দ্রুত সামনের রাস্তা ধরে হেঁটে গিয়ে বাম দিকে মোড় দিল বেলা। ভিড় ঠেলে পৌঁছে গেল নতুন পোস্ট অফিসে।
বামদিকের প্রথম পাবলিক টেলিফোন বুথের কাঁচের কিউবিকলে কথা বলছে এক জোড়া কিশোরী।
ঘড়িতে সময় দেখল বেলা। এক ঘণ্টা হতে পাঁচ মিনিট বাকি। দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে খুব।
কাঁচের দরজায় নক করল বেলা। অসম্ভব বিরক্ত হয়ে রিসিভার নামিয়ে রেখে বের হয়ে এলো মেয়ে দুটো। তাড়াহুড়া করে ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিল বেলা।
রিসিভার না তুলেই পার্সের ভেতর কিছু খোঁজার ভান করল। চোখ কিন্তু হাতঘড়ির দিকে। বারোটার ঘরে কাটা যেতেই বেজে উঠল টেলিফোন।
“লাল গোলাপ” এক নিঃশ্বাসে ফিসফিস করতেই শুনতে পেল, “এখনি গাড়ির কাছে ফিরে যাও।” কেটে গেল কানেকশন। মানসিক এক অস্থিরতার মাঝেও, প্রায় তিন বছর আগে টেমস্ নদীর তীরে তাকে গাড়িতে তুলে নেয়া বিশালদেহী সেই নারীর ভারি কণ্ঠস্বর চিনতে পারল বেলা।
ক্রেডল রিসিভার রেখেই বুথ থেকে বেরিয়ে এলো বেলা। তিন মিনিটে পৌঁছে গেল কারপার্কে। চাবি ঢুকিয়ে গাড়ির দরজা খুলতেই দেখা গেল ড্রাইভারের সিটের উপর খাম পড়ে আছে।
কারপার্কের চারপাশে দ্রুত একবার চোখ বোলাল বেলা। নিশ্চিতভাবেই জানে যে, কেউ একজন তার উপর নজর রেখেছে। কিন্তু শপিং ট্রলি ঠেলতে থাকা ক্রেতার দল, ভিখারি আর স্কুল ফেরত অলস ছেলে-মেয়ের ভিড়ের মাঝে তাকে খুঁজে পাবার কোন উপায় নেই। তাই গাড়িতে উঠে সাবধানে ওয়েল্টেভ্রেদেনে ফিরে এলো বেলা। চিঠিটা নিশ্চয়ই এতটা গুরুত্পূর্ণ যে পোস্টাল সার্ভিসকেও ভরসা করা যায়নি। নিজের বেডরুমের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার মাঝে বসে খামটাকে খুলে ফেলল।
সবার প্রথমে চোখে পড়ল নিকির একেবারে লেটেস্ট রঙিন একটা ছবি। প্রায় তিন বছর বয়সী নিকি বাথিং ট্রাংকস্ পড়ে, পেছনে সমুদ্র নিয়ে দাঁড়িয়ে সৈকতের সাদা বালির উপর।
ছবির সাথে আসা চিঠির লেখাগুলো যেন দৈব বাণী :
“যত দ্রুত সম্ভব কেপ পোনিনসুলাতে সিলভার মাইন নেভাল হেডকোয়াটার’স এর উপর লাগানো সিমেন্স কম্পিউটার লিঙ্কড কোস্টাল রাডার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করো।
পুরো পরিকল্পনা আমাদেরকে ডেলিভারী দেয়ার পরপরই ছেলের সাথে প্রথমবারের মতো দেখা করার সুযোগ পাবে।”
কোনো সিগনেচার নেই স্পষ্ট ভাষায় লেখা চিঠিতে।
বাথরুমের টয়লেটের বোলের ভেতরে চিঠিটা পুড়িয়ে ছাই ফেলে দিল বেলা। কাজ শেষ করে টয়লেট কাভারের উপর বসে তাকিয়ে রইল বিপরীত দিকের টাইলস করা দেয়ালের দিকে।
অবশেষে এলো সেই কাজ জানত যে কখনো না কখনো আসবেই। তিন বছর অপেক্ষার পর এবার এলো বিশ্বাসঘাতকতার পালা।
ফেরার আর কোনো পথ নেই। চাইলে এখনো পরিত্যাগ করতে পারে ছেলের আশা অথবা এগিয়ে যেতে পারে বিপদজনক অনিশ্চিতের দিকে।
“ওহ ঈশ্বর! আমাকে সাহায্য করো।” জোরে জোরে চিৎকার করে উঠল। বেলা, “এখন আমি কী করব?”
বুঝতে পারছে ভয়ংকর এক অপরাধবোধ সাপের মতো। ফেলছে; তারপরেও প্রশ্নের উত্তরটা ঠিকই জানে।
এই মুহূর্তে সেনটেইন হাউজের বাবা’র সেফ রুমে পড়ে আছে সিমেন্স রাডার ইনস্টলেশন রিপোর্টের কপি। সোমবারের মধ্যেই ফাইলটাকে পাঠিয়ে দেয়া হবে সিলভার মাইন মাউন্টেলের নিউক্লিয়ার প্রুফ বাঙ্কারে।
যাই হোক, আনন্দের সংবাদ হচ্ছে ছুটি কাটাতে বাবা ক্যামডি শীপ র্যাঞ্চে যাবে। কাজের কথা বলে এরই মাঝে এড়িয়ে গেছে বেলা। গ্যারি ইউরোপে আর নানা গান-ডগ ট্রায়ালনিয়ে ব্যস্ত। তাই সেনটেইন হাউজের পুরো টপ্ ফ্লোর বেলা’র জন্য খালি পড়ে থাকবে।
***
উত্তুরে হাওয়া বইছে চারপাশে। ধূসর রঙা আকাশ থেকে ঝড়ে পড়ছে রুপালি তুষার কণা।
সমাধি ক্ষেত্রে ডজনখানেক পুরুষ দাঁড়িয়ে থাকলেও নেই কোনো নারী। এখনকার মতো বেঁচে থাকা কালীনও জো সিসেবোর জীবন ছিল নারীশূন্য। জো সিসেরোর কোনো বন্ধুও ছিল না। সবাই তাকে হয় ভয় পেত, নতুবা শ্রদ্ধা করত।
রাইফেল আকাশের দিকে তুলে মৃতদেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এগিয়ে এলো গার্ডের দল।
শোক প্রকাশের জন্য আসা অফিসাররা এতক্ষণ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল। এবারে গার্ডের দল অস্ত্র কাঁধে নিয়ে ফিরে যেতেই একে অন্যের সাথে হ্যান্ডশেক করে গাড়িতে ফিরে গেল সকলে।
রয়ে গেল কেবল একজন। রামোন মাচাদো। কেজিবি কর্নেলের ফুল ইউনিফর্মের নিচে মাথায় ঘুরছে কয়েকটা লাইন, “এতদিনে তোমার খেলা ফুরোল বুড়ো শূয়োর, কিন্তু বড় দেরি করে ফেললে।” দুই বছর আগে থেকেই সেকশন হেড হলেও জো সিসেরো বেঁচে থাকাকালীন পদবীটা কখনোই পুরোপুরি উপভোগ করতে পারেনি রামোন।
বীরত্বের সাথে মারা গেছে বুড়োটা। বহু মাস ঠেকিয়ে রেখে ছিল ক্যান্সারকে। এমনকি শেষ দিনও অফিসে এসেছেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জ্বালিয়ে গেছেন রামোনকে।
“গুডবাই জো সিসেরো। এবার শয়তান তোমাকে মজা দেখাবে।”
হেসে ফেলল রামোন। ঠাণ্ডায় ঠোঁট জোড়া মনে হল ফেটেই যাবে।
অপেক্ষমাণ শেষ গাড়িটাতে এসে চড়ে বসল রামোন। পদাধিকার বলে কালো চাইকা আর কর্পোরাল ড্রাইভারও পাচ্ছে। ড্রাইভার দরজা খুলে দিতেই ব্যাক সিটে বসে কাঁধ থেকে তুষার কণা ঝেড়ে ফেলল রামোন।
“ব্যাক টু দ্য অফিস।”
মস্কো’কে ভালবাসে রামোন। ভালবাসে জোসেফ স্ট্যালিনের বানানো চওড়া বুলেভাদগুলোকে। উত্তেজিত হয়ে উঠে সোভিয়েত বিশালতা দেখে।
কোথাও কোন ধরনের বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন নেই। কোকাকোলা, মার্লবোরো। ইনস্যুরেন্স কিংবা সান।
চাইকার ব্যাকসিট থেকে রাস্তায় রাশান জনগণকে দেখে একধরনের আত্মতৃপ্তি বোধ করল রামোন। এরা প্রত্যেকেই রাষ্ট্রের উন্নতির কথা ভাবে, ব্যক্তির কথা নয়। ধৈর্য ধরে বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাস স্টপে, খাবারের সারিতে।
মনে মনে এদের সাথে আমেরিকানদের তুলনা করে দেখল। সেখানে সারাক্ষণ একে অন্যের পেছনে লেগে থাকে। লালসা যেখানে সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ আর ধৈর্য হল সর্বনিকৃষ্ট। ইতিহাসে আর কোনো জাতি কি আছে যারা গণতন্ত্রের আদর্শকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে যেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতা আর অধিকার রক্ষা মানে হল বাকি সমাজকে অবজ্ঞা করা? এমন কোনো জাতি আছে যেখানে আছে বনি অ্যান্ডক্লাইড, আল-কাঁপোন, বিলি দ্য কিড, মাফিয়া আর ব্ল্যাক ড্রাগ লর্ডদের মতো অপরাধী?
ট্রাফিক লাইট দেখে থেমে গেল চাইকা।
দুটো পাবলিক বাস ব্যতীত এটাই রাস্তায় একমাত্র গাড়ি। প্রতিটি আমেরিকানের নিজস্ব অটোমোবাইল থাকে; কিন্তু রাশান সমাজে অর্থকে এভাবে খোলামকুচির মতো ছিটানো হয় না। গাড়ির সামনে দিয়ে সারিবদ্ধভাবে চলে যাওয়া পথচারীদের দিকে তাকাল রামোন, সুদর্শন আর বুদ্ধিদীপ্ত মুখগুলোতে ধৈর্য আর সহিষ্ণুতার ছাপ। পোশাক নিয়ে আমেরিকান রাস্তার মতো বন্য উন্মাদনা চোখে পড়ল না। মিলিটারি ইউনিফর্ম বিনা নারী-পুরুষ সকলেরই পোশাক বেশ মার্জিত আর রুচিসম্পন্ন।
এহেন শিক্ষিত আর বিদ্বানদের তুলনায় আমেরিকানগুলো তো অশিক্ষিত গোঁয়ার। রাশান খামারে কাজ করা যেসব শ্রমিক, তারাও পুশকিন থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারবে। ব্ল্যাক মার্কেটে সবচেয়ে বেশি খোঁজা হয় এসব বস্তুগুলোর মাঝে ক্লাসিক বইও আছে। লেলিনগ্রাডের আলেকজান্ডার নেভস্কি সমাধিক্ষেত্রে গেলেই দেখা যায় দেস্তরভস্কি আর চাইকোভস্কির সমাধি সাধারণ মানুষের দেয়া তাজা ফুলে ছেয়ে আছে। এর তুলনায় আমেরিকানদের অর্ধেক গ্র্যাজুয়েট বিশেষ করে কালোরা ব্যাটমান কমিকু বুক’ই ভালো করে পড়তে পারে না।
এমনকি রাশান অর্থনীতিও পশ্চিমাদের চোখে ধোয়াশা ছাড়া আর কিছুই নয়। খাবারের সারিতে দীর্ঘ লাইন আর দানবীয় জি ইউ এম ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কনস্যুমার গুডসের অভাব দেখে আমেরিকানরা ভাবে ব্যর্থ হয়ে পড়েছে পুরো সিস্টেম। অথচ তাদের চোখে পড়েনি-সামরিক উৎপাদন মেশিনের গোপন অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি। আমেরিকান পুঁজিবাদী প্রতিদ্বন্দ্বীকে যা বহু আগেই পিছনে ফেলে গেছে।
তেমনভাবে রামোন এও জানে যে রাশান সামারিক বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে প্রত্যাখ্যান হবার কিংবা “সমান অধিকারের” নামে শিফটিং হবার কোনো সুযোগ নেই। এখানে শুধু সর্বশ্রেষ্ঠরাই থাকে; সে নিজে যেমন একজন, সর্বশ্রেষ্ঠ একজন।
ঝরঝিনস্কি স্কোয়ারে চাইকা পৌঁছাতেই নিজের আসনে সিধে হয়ে বসল রামোন।
পাহাড়ি পথ বেয়ে লুবিয়াঙ্কা’র দিকে এগিয়ে চলল গাড়ি।
অন্যান্য কেজিবি ভেহিকেলগুলোর সারিতে নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত অংশে গাড়ি থামাল ড্রাইভার। দরজা খুলে দেয়ার জন্য অপেক্ষা করল রামোন। তারপর বিশাল কাস্ট আয়রনের গ্রিলের দরজা খুলে দালানের ভেতর ঢুকে গেল।
সামনের সিকিউরিটি ডেস্কে আরো দু’জন কেজিবি অফিসার আছে। অপেক্ষা করল ক্লিয়ারেন্সের জন্যে নিজের টার্ন আসার। সিকিউরিটি গার্ডের ক্যাপটেন ব্যাটা মহা শয়তান। রেজিস্টারে সাইন করতে দেয়ার আগে তিনবার রামোনের চেহারা মিলিয়ে দেখল আইডেনটিটি ডকুমেন্টের ছবি’র সাথে।
কাঁচ আর পলিশ করা ব্রোঞ্জেরও অ্যান্টিক লিফটে চড়ে সেকেন্ড ফ্লোরে উঠে এলো রামোন। বিপ্লবের আগে এ বিল্ডিংও ছিল বিদেশি অ্যামব্যাসী। সেখান থেকেই এসেছে লিফট আর ঝাড়বাতিগুলো।
অফিসে ঢুকতেই ডেস্কের পাশে দাঁড়িয়ে গেল সেক্রেটারি।
“গুড মর্নিং, কমরেড, কর্নেল।” দেখতে পেল সারা রাত জেগে চুল ঠিক করে শক্ত পোক্ত কোঁকড়া বানিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। খোলা আর মসৃণ থাকলেই বরঞ্চ বেশি ভালোবাসে রামোন। এয়ারফোর্সের মৃত টেস্ট পাইলটের বিধবা পত্নী ক্যাটরিনার বয়স চব্বিশ।
ডেস্কের কোণায় থাকা কার্ডবোর্ডের বাস্কের দিকে নির্দেশ করে মেয়েটা জানতে চাইল, “এটা দিয়ে আমি কী করব কমরেড় কর্নেল?”
ঢাকনা খুলতেই রামোন ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল জেনারেল সিসোরো’র ব্যবহৃত কিছু জিনিস। ডেস্কের ড্রয়ার পরিষ্কার করে ফেলায় এবারে সবকিছু রামোন একাকী ভোগ করতে পারবে।
বক্সে একটা পার্কার বলপেন আর ওয়ালেট ছাড়া আর কোনো পার্সোনাল আইটেম নেই। ওয়ালেটটা তুলে নিল রামোন। খুলতেই দেখল ভেতরে আধ ডজন ছবি। বিখ্যাত আফ্রিকান লীডারদের সাথে পোজ দিয়েছেন জো সিসেরো।
বক্সে ওয়ালেটটা রাখতে গিয়ে ক্যাটরিনার নরম আঙুলের ছোঁয়া লেগে গেল রামোনের হাতে। খানিকটা কেঁপে উঠে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল মেয়েটা।
“এগুলো সব আর্কাইভে নিয়ে যাও। ওদের কাছ থেকে রশিদ নিয়ে আসবে।”
“এখনি যাচ্ছি” কমরেড কর্নেল।”
রামোন আর এই আকর্ষণীয় মেয়েটার সম্পর্ক মোটামুটি সবাই জানে। বুড়ো বাপ-মা আর তিন বছর বয়সী পুত্র সন্তান থাকলেও ক্যাটরিনার ফ্ল্যাটই ছিল মস্কোতে থাকাকালীন রামোনের আবাস স্থল।
“আপনার ডেস্কে একটা সবুজ রাঙা প্যাকেজও আছে কমরেড কর্নেল।” আজ রাতেই মস্কো ছেড়ে যেতে হবে বলে বিরক্ত হলো রামোন। দুই বছর হয়ে গেলেও ক্যাটরিনার আবেদন এখনো পুরোপুটি-অটুট, অক্ষত।
রামোনের মনের কথা নিশ্চয় টের পেয়ে গেছে মেয়েটা, তাই গলার স্বর নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে জানালো, “যাবার আগে আজ ফ্ল্যাটে খাবেন? মাম্মা বেশ ভালো একটা সসেজ আর ভদকা পেয়েছে।”
“ঠিক আছে; তবে সামান্য” নিজের অফিসে ঢুকে গেল রামোন।
নিজের টিউনিক খুলে ডেস্কে থাকা সবুজ রঙা বাক্সটার সিকিউরিটি সীল ছিঁড়ে ফেলল।
লাল গোলাপ কোড পড়তেই দ্রুত হয়ে গেল হৃদপিণ্ডের গতি। ব্যাপারটাতে নিজেই উপরই যারপরনাই বিরক্ত হলো।
তার নিয়ন্ত্রণে থাকা অন্য শত শত এজেন্টের মতই একজন লাল গোলাপ। কিন্তু বক্স থেকে কোল্ডার তুলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল স্প্যানিশ পাহাড়ি নদীর বুকে কালো পাথরের উপর শুয়ে থাকা এক অনাবৃত নারী দেহের ছবি। দশ্যটা এতটাই স্পষ্ট যে গভীর নীল চোখ জোড়া’ও দেখা যাচ্ছে।
ফাইল খুলতেই দেখা গেল সাউথ আফ্রিকান নেভাল রাডার চেইনের রিপোর্ট। লন্ডন অ্যামবাসী ব্যাগের মাধ্যমে এখানে এসেছে। সন্তুষ্ট চিত্তে মাথা নাড়ল রামোন। সামনে ল বুক খুলে ডিপার্টমেন্টাল ইন্টারকমের হ্যান্ডসেট তুলে ডায়াল করল।
“একটা প্রিন্টআউট। রেফারেন্স প্রোটিয়া, আইটেম নাম্বার-১১৭৮। খুব জরুরি।”
প্রিন্টআউটের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গেল রামোন। বাইরের দৃশ্য অত্যন্ত নান্দনিক হলেও বারে বারে মনে পড়ে যাচ্ছে পুরনো স্মৃতি। একই সাথে চিন্তায় এলো মাঝ রাতে শেরিমেতইয়েভো এয়ারপোর্টে শুরু হওয়া ভ্রমণ আর তার শেষে অপেক্ষারত বাচ্চাটার কথা।
দুই মাস কেটে গেছে, নিকোলাসের সাথে ওর দেখা হয়নি। এতদিনে নিশ্চয় আরেকটু বড় হয়ে গেছে। এই বয়সেই ওর শব্দভাণ্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ। পিতা সুলভ কোনো অনুভূতি মনের মাঝে স্থান দিতে চায় না রামোন। তাই জানালায় দাঁড়িয়ে দিবা-স্বপ্ন দেখারও কোনো মানে হয় না। হাতঘড়ির দিকে তাকাতেই মনে হলো আটচল্লিশ মিনিট পরের মিটিংটা হয়তো আগামী দশকের জন্য ওর ক্যারিয়ারটাকেই বদলে দেবে।
ডেস্কের কাছে ফিরে এসে উপরের ড্রয়ার থেকে মিটিং’র জন্য প্রস্তুত করে রাখা নোট বের করল।” পাতা উল্টাতে গিয়ে মনে হলো সময় নষ্ট হবে। কেননা প্রতি শব্দ এরই মাঝে আত্মস্থ হয়ে গেছে। বার বার রিভাইস দিলে বরঞ্চ স্বতস্ফূর্ততা নষ্ট হবে। একপাশে সরিয়ে রেখে দিল রির্পোট।
দরজায় নক হতে ঘুরে তাকাল রামোন। রেকর্ডস ক্লার্ককে নিয়ে এসেছে ক্যাটরিনা। রেডকস্ বুকে সাইন করে দিল রামোন। ক্যাটরিনা আর ক্লার্ক বের হয়ে যেতেই খাম ছিঁড়ে প্রিন্টআউট বের করে ডেস্কের উপর রাখল।
প্রোটিয়া নামে আরেক জন সাউথ আফ্রিকান এজেন্ট আছে। জার্মান নাগরিক এই প্রোটিয়ার আসল নাম ডায়েটার রিনহাউট। বার্লিন ওয়াল থেকে পশ্চিমে পালিয়ে আসার সময় প্রোটিয়াকে পুরো সাহায্য করেছেন জো সিসেরো। ১৯৬০ সালে সাউথ আফ্রিকাতে অভিবাসন হিসেবে ঢোকার কিছুদিন পর নাগরিক বনে যাওয়া ডায়েটার এখন সিলভার মাইন কমান্ড বাঙ্কারের চিফ অব সিগনলস।
ক্লার্কের এনে দেয়া প্রিন্টআউট ‘রা তিন সপ্তাহ আগে প্রোটিয়া পঠিয়েছে; রোডার চেইনের উপর আসা লাল গোলাপের রিপোর্ট নিয়ে এবারে দুটোর তুলনা করল রামোন। মিলিয়ে দেখল লাইনের পর লাইন। দশ মিনিট পরেই সন্তুষ্টির হাসি ফুটল চেহারাতে। ফাইল দুটি হুবহু একই রকম।
ক্লাস ওয়ান রেটেড প্রোটিয়ার বিশ্বস্ততা দশক আগে থেকেই বহুবার প্রমাণিত হয়েছে।
আর প্রথম সিকিউরিটি চেক পার হল লাল গোলাপ। মেয়েটাকে এখন অনায়াসে ক্লাস থ্রি রেটিং দেয়া যায়। চার বছর ধরে নজরে রাখার পর এবারে ও’কে পুরস্কার দেয়ার সময় হয়েছে।
প্রাইভেট লাইনে ফোন করল ক্যাটরিনা। “কমরেড কর্নেল, ছয় মিনিটের মধ্যে আপনাকে টপ ফ্লোরে যেতে হবে।”
“ধন্যবাদ কমরেড। ডক্যুমেন্ট নষ্ট করা দেখার জন্য নেমে এসো।”
ক্যাটরিনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল কাগজ কাটার মেশিন দিয়ে প্রোটিয়া রিপোর্টকে কুচি কুচি করে ফেলল রামোন। তারপর ডে-বুকে কাউন্টার সাইন করে অ্যাটেস্টেড় করে দিল।
টিউনিকের বোম লাগিয়ে ছোট্ট ওয়াল-আয়নাতে নিজের মেডেলগুলো ঠিক করে নিল রামোন।
“গুডলাক্ কমরেড কর্নেল” মুখ উঁচু করে প্রত্যাশা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ক্যাটরিনা।
“থ্যাংক ইউ।” মেয়েটাকে না ছুঁয়েই বের হয়ে গেল রামোন। অফিসে কখনোই এমন কিছু করে না মিঃ মাচাদো।
***
দশ মিনিট ধরে উপর তলায় কনফারেন্স রুমে অপেক্ষা করছে রামোন। সাদা দেয়ালের কোথাও কোন প্যানেল নেই; যেন লুকানো মাইক্রোফোনের কোনো সম্ভাবনাই না থাকে। লম্বা কনফারেন্স টেবিলের সাথে ডজন খানেক লাগোয়া চেয়ার থাকলেও ঝাড়া দশ মিনিট ধরেই দাঁড়িয়ে আছে রামোন।
অবশেষে খুলে গেল ডিরেক্টরের সুইটের দরজা। কোর্থ ডিরেকটরেটের হেড জেনারেল ইউরি বোড়োদিনকে রামোন একই সাথে ভয় পায় এবং শ্রদ্ধা করে।
এর পরে যিনি কনফারেন্স রুমে এলেন তিনি আরো বেশি শ্রদ্ধা পাবার যোগ্য। বোয়োদিনের চেয়ে বয়সে ছোট এই লোকটা ডিপার্টমেন্টস অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স’র ডেপুটি মিনিস্টার।
রামোনের রিপোর্ট শুনে যতটা আশা করেছিল তার চেয়েও বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা গেল সকলের মাঝে। তাকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে রাশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী একশ মানুষের একজনের সামনে নিজের থিসিস ডিফেন্ড করার জন্য।
আলেক্সেই ইউদিনিচ মানুষটা দেখতে ছোট-খাটো হলেও ভদ্রলোকের রহস্যময় অন্তর্ভেদী দৃষ্টি যেন বুকের ভেতরটাও দেখে নিতে পারে। বোরোদিন দু’জনের পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় রামোনের সাথে হ্যান্ডশেক করে মুহূর্ত খানেক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কী যেন দেখলেন আলেক্সেই। এরপর দু’পাশে সহকারীদেরকে নিয়ে বসে গেলেন টেবিলের একেবারে মাথায়।
“তোমার আইডিয়াগুলো বেশ মহৎ টাইপের, ইয়াংম্যান।” তারুণ্যকে এরা তেমন পাত্তা দেয় না বলেই তো জানে রামোন। “দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা আন্দোলনে আমাদের লং-স্ট্যান্ডিং সাপোর্টকে তুমি পরিত্যাগ করতে বলছ-শুরু করতে চাইছ স্বশস্ত্র আন্দোলন।
“উইদ রেসপেক্ট, কমরেড ডিরেকটু” খুব সাবধানে উত্তর দিল রোমোন, “এটি আসলে আমার অভিপ্রায় নয়।”
“তার মানে তোমার পেপার আমি ঠিক মতো পড়িনি। তুমি লেখোনি যে, আধুনিক ইতিহাসে এএনসি হলো সবেচেয় অনুৎপাদনশীল গেরিলা অর্গানাইজেশন?”
“আমি এর পেছনের কারণগুলো আর পূর্বের ভুলগুলোকে কিভাবে শোধরানো যায় যেসব পথও তুলে ধরেছি।”
সম্মতি জানিয়ে নিজের রিপোর্টের কপি উল্টালেন ইউদিনিচ, “বলে যাও ব্যাখ্যা করো। দক্ষিণ আফ্রিকাতে তে সশস্ত্র বিপ্লব কেন সফল হবে না, যেমনটা হয়েছে ধরো আলজেরিয়াতে।”
“মৌলিক কিছু পার্থক্য আছে মিনিস্টার। আলজেরিয়াতে বসতি স্থাপনকারীরা সকলেই ফরাসি’ চাইলে নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ফ্রান্সে চলে যেতে পারে। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানদের এমন কোনো পথ নেই। আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেয়ার জন্যে-তাদেরকে যুদ্ধ করতে হবে। আফ্রিকাই তার মাতৃভূমি।”
“হ্যাঁ।” মাথা নাড়লেন ইউদিনিচ।
“বলে যাও।”
“এছাড়াও আলজেরিয়ার এফ.এল.এন গেরিলাদের ধর্ম আর ভাষা একই। জিহাদ করেছে একসাথে। কিন্তু কৃষাঙ্গ আফ্রিকানদের এমন কোনো সামঞ্জস্যতা নেই। তাদের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা আর গোত্রভিত্তিক শত্রুতা আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়। এ এনসি’তে বিশেষভাবে ঝোসা উপজাতি আছে অথচ সংখ্যায় এদের চেয়ে বেশি জুলু’রা নেই।”
কোনো বাধা না দিয়েই পনের মিনিট চুপচাপ রামোনের কথা শুনলেন ইউদিনিচ। একবারের জন্যেও ওর মুখের উপর থেকে চোখ সরালেন না। অবশেষে নরম স্বরে জানতে চাইলেন, “তো বিকল্প হিসেবে তুমি কী ভাবছ?”
“বিকল্প নয়।” মাথা নাড়ল রামোন। “সশস্ত্র বিপ্লব চালিয়েই যেতে হবে। অনেক তরুণ আর মেধাবী-রাও এখন এগিয়ে আসছেন যেমন রালেই তাবাকা। এদের কাছ থেকেই ভবিষ্যতে দারুণ সফলতা আসবে। আমি যেটা প্রস্তাব করেছি তা হল লড়াইয়ের পাশাপাশি অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করা, বয়কট আর বিভিন্ন নীতি মেনে নীতে বাধ্য করা…।”
“দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে আমাদের অর্থনৈতিক কোনো যোগাযোগ নেই।” তিরস্কার করে উঠলেন ইউদিনিচ। “আমার প্রস্তাব হলো, এই কাজটা আমাদের জাত-শত্রুরাই করে দিক না কেন। আমেরিকা আর পশ্চিম ইউরোপ দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতি ধ্বংস করার জন্য ক্যাম্পেইন করবে। বিপ্লবের বীজ ওরাই বুনে দেবে, আমরা কেবল ফসল তুলব।”
“এ ব্যাপারে তোমার পরামর্শ কী?”
“আপনি তো জানেন যে আমেরিকান ডেমোক্রেটিক পার্টির ভেতরে আমাদের লোক আছে। আমেরিকান মিডিয়াতেও একই অবস্থা। এনএএসিপি আর ট্রান্স আফ্রিকা ফাউন্ডেশনের মতো সংগঠনের উপরেও আমাদের প্রভাব বিশাল। আমরা যেটা করব দক্ষিণ আফ্রিকা আর বর্ণবাদের ইস্যু নিয়ে আমেরিকান বাম দলগুলোকে মাথা ঘামাতে বাধ্য করব। ফলে সেটা ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার রাজনৈতিক ইস্যুই হয়ে যাবে। কৃষাঙ্গ আমেরিকানদের ভোট পাবার জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টিও ওদের অনুসরণ করবে। ফলে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা সাংশন চাপিয়ে দেয়া হলে দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতি আর সরকার উভয়েই ভেঙে পড়বে। আর তখন মঞ্চে প্রবেশ করে নিজের সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে আমাদের আর কোনো বাধা থাকবে না।
কনফারেন্স রুমের সকলে চুপ হয়ে গেল। স্তব্ধ হয়ে অনুভব করতে চাইল পুরো পরিকল্পনার বিশালতু। নীরবতা ভাঙ্গলেন আলেক্সেই-ইউদিনিচ। কাশি দিয়ে জানতে চাইলেন, “কত খরচ পড়বে এতে?”
“বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার।” রামোন স্বীকার করতেই শক্ত হয়ে গেল ইউপিনিচের চেহারা।” ডেমোক্রেটিক পার্টি আমাদের হয়ে সুর বাজাবে; কিন্তু বংশীবাদকে পয়সা দেবে আমেরিকান জনগণ।”
সারা বিকেলে প্রথমবারের মতো হাসলেন মিনিস্টার ইউদিনিচ। আরো দুই ঘণ্টা আলোচনার পর বেল বাজিয়ে সহকারীকে ডাকলেন ইউরি বেরোদিন।
“ভদকা” অর্ডার করলেন ইউরি।
রূপার ট্রে’তে করে এলো ঠাণ্ডা বোতল।
আমেরিকার ডেমোক্রেটিক পার্টির নামে প্রথম টোস্ট করলেন আলেক্সেই হাসতে হাসতে একে অন্যের পিঠ চাপড়ে দিল সকলে।
আস্তে আস্তে রামোনের কাছে সরে এসে কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়ালেন ডিরেক্টর বোরোদিন। মেধাবী এই সাব অর্ডিনেটের প্রতি যে অত্যন্ত খুশি হয়েছেন তা বলাই বাহুল্য।
***
শহরের সবচেয়ে সুন্দর অংশগুলোর একটাতে ক্যাটরিনার ফ্ল্যাট। জানালা দিয়ে দেখা যায় গোকিং পার্ক। লিফট না থাকায় সিঁড়ি বেয়ে ছয় নম্বর ফ্লোরে উঠে এলো রামোন। মাথা থেকে ভদকার নেশা কাটাতেও সাহায্য করেছে এই এক্সারসাইজ।
বাধা কপির সাইড ডিশ দিয়ে পোর্কের সসেজ বানিয়েছেন ক্যাটরিনার মা; পুরো অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক বাধাকপি সেদ্ধর গন্ধে ম-ম করছে।
ক্যাটরিনার পিতা-মাতা রামোনকে তাদের মনিবের মতই সম্মান করে। প্রতিবেশীর অ্যাপার্টমেন্টে নাতাঁকে নিয়ে টেলিভিশন দেখতে চলে গেলেন বুড়ো-বুড়ী; যেন পরস্পরকে বিদায় জানাবার জন্যে অখণ্ড অবসর পায় ক্যাটরিনা আর রামোন।
“আপনাকে অনেক মিস করবো।”
ফিসফিস করে উঠল ক্যাটরিনা। পায়ের উপর খসে পড়ল টিউনিকের স্কার্ট। নিজের ছোট্ট রুমটার একমাত্র বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আহলাদী স্বরে রামোনকে জানালো, “তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন, কিন্তু।”
এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে এখনো ঘণ্টাখানেক বাকি আছে। নরম ভেলভেটের মতো মসৃণ দেহতুক স্পর্শ করে মেয়েটাকে উত্তেজিত করে তোলার জন্য তাই যথেষ্ট সময় পাওয়া গেল।
নিঃশেষিত অবসন্ন দেহে, মাথায় এলোমেলো চুল নিয়ে রামোনকে বিদায় জানালো ক্যাটরিনা, “আমার কাছে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন, প্লিজ!”
রাস্তাতে ট্রাফিক জ্যাম না থাকাতে আধ ঘণ্টারও কম সময়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল রামোন।
সবসময় এত ট্রাভেল করতে হয় যে জেট-ল্যাগ এখন আর টের পায় না। বললেই চলে। কিছুই না খাওয়া আর অ্যালকোহল স্পর্শ না করার নিয়মও মেনে চলে। এছাড়া যে কোনো পরিস্থিতিতেই ঘুমিয়ে পড়ার টেকনিক ও শিখে নিয়েছে। যে মানুষটা ইথিওপিয়ায় বেয়াল্লিশ ডিগ্রি গরমের মাঝে কিংবা মধ্য আমেরিকার রেইনফরেস্টে গায়ের উপর শুয়োপোকা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারে, তার জন্যে ইলুশিন প্যাসেঞ্জার সিটের অত্যাচার কিছুই না।
হাভানা’র জোসে মারতি এয়ারপোর্টে নেমে পুরাতন ডাকোটা’তে চড়ে পৌঁছে গেল সিয়েনফুগোস। অতঃপর পুনরায় এয়ারপোর্টে নেমে ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে বহুত দর-কষাকষির শেষে ডেট্রয়েট মডেলের ট্যাক্সিতে চড়ে বসল বুয়েনাভেনতারার মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে।
পথে পার হয়ে এলো বাহিয়া ডি কোচিনোস্ আর বে অব পিস যুদ্ধের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত যাদুঘর। আমেরিকান বর্বরগুলোকে হঠানোর ক্ষেত্রে নিজের ভূমিকার কথা স্মরণ করে মনের মাঝে সবসময় সন্তুষ্টি বোধ করে। রামোন।
বিকেলের দিকে বুয়েনে ভেনতারা ক্যাম্পের কাছে এসে নামিয়ে দিল ট্যাক্সি। দিনের কাজ শেষ করে চেগুয়েভার প্যারাট্রুপার রেজিমেন্টের সৈন্যরা সার্চ করে ব্যারাকে ফিরে যাচ্ছে। হাভানা’তে পোলিত বুরোর শেষ মিটিং এর পর থেকে এদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে আফ্রিকাতে পাঠানোর জন্য।
এরকম এক ইউনিট পাশ দিয়ে চলে যাবার সময় খানিক দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখল রামোন। এসব তরুণ তরুণীর মুখে বিপ্লবের একটা গান শুনে মনে পড়ে গেল সিয়েরা মায়েস্ত্রা’র সেসব ভয়ংকর দিনগুলোর কথা। “ভূমিহীনের ভূমি” গানটার কথা শুনে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। এরপর হেঁটে গিয়ে পাশ দেখলো ম্যারেড অফিসারদের কোয়ার্টারের গেইটে।
রামোন স্পোর্টস শার্ট আর পায়ে খোলা স্যান্ডাল পরে থাকলেও নাম আর। পদবী চিনতে পেরে স্যালুট করল গার্ড। বিরাশি জুন হিরো’র মাঝে একজন হলো এই রামোন মাচাদো। বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ থেকে শুরু করে গানের পাণ্ডুলিপি পর্যন্ত সর্বত্র উচ্চারিত হয় এসকল হিরোদের নাম।
সৈকতের উপরে পাম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে দুই বেডরুম অলা সারি সারি কর্টেজ। এরই একটাতে থাকে আদ্রা আর নিকি। পামের নিচে এসে আঁচড়ে পড়ে বে অব পিগ’র শান্ত জল।
রামোন একশ কদম দূরে থাকলেও সামনের বারান্দা থেকে চোখ তুলে ওকে ঠিকই দেখতে পেল আদ্রা অলিভারেস।
“ওয়েলকাম কমরেড কর্নেল” আস্তে করে রামোনকে স্বাগত জানালেও দৃষ্টি থেকে ভয় লুকাতে পারল না আদ্রা।
“নিকোলাস কোথায়?”
কংক্রীটের মেঝেতে ধপ করে নিজের কিট ব্যাগটা রেখেই জানতে চাইল রামোন। উত্তরে সৈকতের দিকে তাকাল আদ্রা।
পানির কিনারে খেলা করছে একদল ছেলে-মেয়ে, এতদূর থেকেও শোনা যাচ্ছে ওদের চিৎকার-চেঁচামেচি।
অন্যদের থেকে খানিকটা তফাতে দাঁড়িয়ে আছে নিকোলাস। ছেলেকে দেখতে পেল রামোন, বুকের ভেতরটা যেন কেমন করে উঠল। মাত্র গত বছর থেকে জন্ম নেয়া এই অনুভূতি এর আগে সীমাবদ্ধ ছিল “দ্য চাইল্ড” কিংবা “লাল গোলাপের সন্তান” নামে। এখন আমার ছেলে” ভাবলেও তা কোথায় উচ্চারণ করা কিংবা লিখে রাখা হয় না।
কটেজের বারান্দা থেকে নেমে সৈকতের দিকে এগিয়ে গেল রামোন। নিচু একটা দেয়ালের উপর বসে দেখতে লাগত ছেলের কাণ্ড কারখানা।
বয়স মাত্র তিন হলেও নিকোলাসকে এর চেয়েও বড় দেখায়। ইতিমধ্যেই বেশ লম্বা হয়ে উঠতে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা দেখে মনে পড়ে গেল মাইকেল অ্যাঞ্জোলর ‘ডেভিড”-এর কথা।
ছেলেটার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ পাবার পর থেকেই বেড়ে গেছে রামোনের আগ্রহ। ক্যাম্প নার্সারি স্কুলের টিচার রিপোর্টে লিখেছে, নিকোলাসের ড্রেয়িং আর কথা-বার্তা বড় বয়সী বাচ্চাদেরই মতন। এরপর থেকেই নিকোলাসের বেড়ে উঠা নিয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে রামোন। হাভানা’র ডিজিএ’র মাধ্যমে আদ্রা আর নিকোলাসের জন্য এ জায়গার ব্যবস্থা করেছে।
স্টেট সিকিউরিটিতে এখন আদ্রার পদবী লেফটেন্যান্ট। এ ব্যবস্থাও রামোনেরই করা। নতুবা বুয়েনেভনতারার কটেজ কিংবা মিলিটারি নার্সারি স্কুলে নিকোলাসকে ভর্তি করা যেত না।
প্রথম দুই বছর বাচ্চাটাকে একবারও দেখেনি রামোন। কেবল লাল গোলাপকে পাঠানোর জন্য তৈরি করা মিলিটারি ক্লিনিক আর এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টগুলো পড়ত। ধীরে ধীরে এসব রিপোর্ট আর ছবি দেখে মনের মাঝে আগ্রহ জন্মে উঠে।
প্রথমবার, মনে হলো ওকে দেখার সাথে সাথে চিনে ফেলেছিল নিকোলাস। আদ্রা’র পায়ের ফাঁকে লুকিয়ে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে ছিল রামোনের দিকে। বুয়েনেভেনতারা’র সামরিক ক্লিনিকের সাদা অপারেটিং রুমে শেষবার দেখেছিল পিতার মুখ। নিকোলাসকে তখন আংশিকভাবে ডুবিয়ে রাখার নাটক করা হয়েছিল লাল গোলাপকে বশে আনার জন্যে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ বয়সের নিকোলাসের তো এ স্মৃতি মনে থাকার কথা নয়-তারপরেও রামোনকে দেখে ওর প্রতিক্রিয়া কাকতালীয় হতে পারে না।
বাচ্চাটার ভয়ার্ত চেহারা দেখে রামোন নিজেও অবাক হয়ে গিয়েছিল।
নিজের মা আর কাজিন ফিদেল ছাড়া আর কোনো মানুষের প্রতিই তার তেমন কোনো গভীর সহানুভূতি নেই। আর সবসময় এটাকে নিজের সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবেই ভেবে এসেছে। পুরোপুরি যুক্তি নির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে তাই কোনো সমস্যাও হয় না। প্রয়োজন হলে সঙ্গী কমরেডকে বলি দিতেও দ্বিধা করে না। কোন রকম মায়া মমতার স্থান না দিয়ে নিজেকে ইস্পাত কঠিন হিসেবে গড়ে তোলার পরেও আজকাল হৃদয় ভরে উঠে আর্দ্র সব অনুভূতিতে।
রৌদ্রস্নাত উজ্জ্বল ক্যারিবীয় সৈকতে বসে ছেলেটাকে দেখে আপন মনেই হাসল রামোন। “তলোয়ারের গায়ে চুল সমান চিকন একটা ফাটল; কেননা ও আসলে আমারই অংশ। আমার রক্ত মাংস দিয়ে গড়া অমরত্বের প্রত্যাশা।”
আবারও মনে পড়ে গেল মিলিটারি ক্লিনিকের কথা। চোখের সামনে ভেসে উঠল ডাক্তারের হাতে ধরা ছটফট করতে থাকা ছোট্ট শরীর আর্ত চিৎকার করতে করতে ট্যাংকে ডুবে যাওয়া ছোট্ট একটা মাথা।
সে সময় আসলে সেটাই জরুরি ছিল; যা নিয়ে এখন মনস্তাপের কিছু নেই। আর বুদ্ধিমানরা তাই করে।
নিচু করে পায়ের কাছ থেকে ঝিনুকের খোসা কুড়িয়ে নিল নিকোলাস। হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখল।
ঘন আর কালো কোকড়া চুলগুলোতে লেগে আছে সামুদ্রিক নোনা জল। মায়ের সাথে বেশ মিল দেখা যাচ্ছে ছেলেটার। ক্ল্যাসিক্যাল নাক আর চোয়ালের পরিষ্কার মিষ্টি রেখা এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রামোন। কিন্তু সবুজ চোখগুলো ঠিক তার নিজের মত।
হঠাৎ করেই শান্ত জলে হাতের ঝিনুক ছুঁড়ে মারল নিকোলাস। এরপর ঘুরে দাঁড়িয়ে পানির কিনার দিয়ে একা একা হাঁটতে শুরু করল। ঠিক সেই মুহূর্তে ছেলে-মেয়েদের হট্টগোলের মাঝে থেকে চিৎকার শুরু হল। ছোট্ট একটা মেয়ে সাদা বালির উপর গড়িয়ে পড়ে গর্জন করে উঠল, “নিকোলাস!”
কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে কাছে গিয়ে মেয়েটাকে তুলে দাঁড় করালো নিকোলাস। ছোট্ট সুন্দরীর বিশাল কালো চোখ জোড়া থেকে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু, গালে বালি, গায়ের পোশাক খুলে হাঁটুর উপর নেমে এসেছে।
মেয়েটার বাথিং স্যুট ঠিক করে দিয়ে, হাত ধরে পানির কাছে নিয়ে গেল নিকোলাস। গাল থেকে বালি আর চোখ থেকে পানি ধুয়ে দিল। অবশেষে চিৎকার থামালো মেয়েটা।
নিকোলাসের হাত ধরে পাশাপাশি দৌড়ে দুজনে উঠে এলো সৈকতে।
“চলো তোমাকে তোমার মাম্মার কাছে দিয়ে আসি।” কথা বলতে বলতেই চোখ তুলে বাবাকে দেখে থেমে গেল নিকোলাস।
রামোন দেখল চোখে ভয়ের আভা তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলল ছেলেটা। চিবুকটাকে দৃপ্ত ভঙ্গিতে তুলে ধরে অভিব্যক্তি শূন্য হয়ে গেল চেহারা।
যা দেখল তাতে খুশিই হল রামোন। কেননা ছেলেটার ভয় থেকেই জন্ম নিবে শ্রদ্ধা আর বাধ্যতা। আবার এটাও ভালো যে নিজের ভয়কে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। নেতৃত্ব দিতে পারার প্রধান গুণগুলোর একটি হলো, ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা।
ও আমার ছেলে; ভাবতে ভাবতেই এক হাত উঁচু করে আদেশ দিল রামোন, “এখানে এসো।”
নিকোলাসের হাত ছাড়িয়ে সৈকতের দিকে চলে গেল ছোট্ট মেয়েটা। স্পষ্ট দেখা গেল শরীর শক্ত করে বাবার দিকে এগিয়ে এলো নিকোলাস; হাত বাড়িয়ে দিয়ে জানালো, “গুড ডে, পাত্রে।”
“গুড ডে, নিকোলাস।” ছেলের বাড়ানো হাত ধরে হ্যান্ডশেক করল রামোন।”
“পাদ্রে” শব্দটা নিশ্চয়ই আদ্রা শিখিয়েছে। এতদূর পর্যন্ত মেনে নেবে বলে কখনো ভাবেইনি রামোন। কিন্তু অবশেষে খুশিই হলো। যাই হোক এতটা সামাল দেবার মতো চারিত্রিক দৃঢ়তা তার আছে।
“এখানে বসো।” দেয়ালের উপর নিজের পাশে ছেলেকে জায়গা দেখিয়ে দিল রামোন। ছোট্ট পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল নিকোলাস।
পিতা-পুত্র দু’জনেই খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর রামোন জানতে চাইল,
“কী করেছিলে?”
প্রশ্নটাকে গভীরভাবে ভেবে নিকোলাস জানাল, “সারাদিন স্কুলে ছিলাম।”
“স্কুলে কী পড়ায়?”
ড্রিল শিখি আর বিপ্লবের গান।” খানিক ভেবে যোগ করল। “ছবিও আঁকি।”
আবারো চুপ হয়ে গেল বাপ-বেটা। একটু পরে নিকোলাসই আবার শুরু করল, “বিকেল-বেলা সাঁতার কাটি, ফুটবল খেলি। সন্ধ্যাবেলা আদ্রাকে ঘরের কাজে সাহায্য করি। এরপর দুজনে একসাথে টিভি দেখি।
ওর বয়স মাত্র তিন; নিজেকে মনে করিয়ে দিল রামোন। কোনো পশ্চিমা বাচ্চাকে একই প্রশ্ন করা হলে উত্তরে হয়ত বলত কিছুই না।” কিংবা “এমনিই’ অথচ নিকোলাস একেবারে বিজ্ঞের মতো ভেবে চিন্তে উত্তর দিচ্ছে। ছোট্ট একটা বুড়া।
“তোমার জন্য একটা উপহার এনেছি।” জানাল রামোন।
“ধন্যবাদ, পাদ্রে।
“জানতে চাও না, কী?”
“তুমি আমাকে দেখাবে, তাহলেই জেনে যাব।”
একে অ্যাসল্ট রাইফেলের প্লাস্টিক মডেল। মিনিয়েচার হলেও আসলের মতো বুলেট। ম্যাগাজিন সবকিছু আছে।
চকচক করে উঠল নিকোলাসের চোখ। কাঁধে তুলে সৈকতের দিকে নিশানা করল। রামোন আসার পর এতক্ষণে স্বতস্ফূর্তভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করল ছেলেটা। ট্রিগার টিপতেই খেলনা রাইফেল যুদ্ধের মতো কটকট শব্দ করে উঠল। “বেশ সুন্দর। ধন্যবাদ, পাদ্রে।” খুশি হলো নিকোলাস।
“বিপ্লবের সন্তানের জন্য এটা সত্যিই ভাল একটা খেলনা।” জানাল রামোন।
“আমি সত্যিই বিপ্লবের সাহসী সন্তান?”
“একদিন হবে।”
“কমরেড কর্নেল, ওর গোসলের সময় হয়েছে।” এগিয়ে এলো আদ্রা।
নিকোলাসকে নিয়ে কটেজের ভেতর চলে গেল আদ্রা। ওদের সাথে যাবার ইচ্ছে করলেও বুর্জোয়া অনুভূতি ভেবে সে চিন্তা বাতিল করে দিল রামোন। তার বদলে বারান্দার কোণে রাখা টেবিলের উপর থেকে লাইম জুস আর বিশ্বসেরা হাভানা ক্লোব রাম নিল। সাথে মিগেল ফারনানদেজ সিগার। ওর পছন্দ জানে আদ্রা। সব জায়গামতই আছে।
বাথরুম থেকে ভেসে আসছে আদ্রা আর তার পুত্রের আনন্দোচ্ছল হুটোপুটির শব্দ। নিজেকে যোদ্ধা ভাবতেই ভালোবাসে রামোন। অথচ বাচ্চাটা থাকতে মনে হচ্ছে আপন গৃহে ফিরেছে।
খাবারে চিকেন সাথে ব্ল্যাকবিন আর হোয়াইট রাইস এনে দিল আদ্রা। ডিজি’এর মাধ্যমে রেশনের ব্যবস্থাও করেছে রামোন। যেন ছেলের বেড়ে উঠায় কোনো অভাব না থাকে।
“কদিন পরেই আমাদের সাথে বেড়াতে যাবে তুমি।” খেতে খেতে নিকোলাসকে জানাল রামোন, “সমুদ্রের ওপারে। তোমার ভাল লাগে ভ্রমণ?”
“আদ্রাও কি আমাদের সাথে আসবে?”
প্রশ্নটা শুনে খানিক বিরক্ত হয়ে গেল রামোন। বুঝতে পারল না যে এটি ঈর্ষা। সংক্ষেপে উত্তর দিল, “হ্যাঁ।”
“তাহলে ভাল লাগবে।” মাথা নাড়ল নিকোলাস, “কোথায় যাবো?”
“স্পেন। তোমার পূর্বপুরুষের ভূমি, তোমার জন্মস্থানে।”
ডিনারের পর নিকোলাসকে এক ঘণ্টা টিভি দেখার অনুমতি দেয়া হয়। তারপর চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে গেলেই ওকে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেয় আদ্রা।
এরপর লিভিং রুমে ফিরে এলো আদ্রা। রোমোনের কাছে জানতে চাইল, “আমাকে দরকার আজ রাতে?”
মাথা নাড়ল রামোন। আদ্রার বয়স চল্লিশেরও বেশি। কখনো সন্তানের মা না হওয়া এই নারী রামোনকে উত্তেজিত করে তোলার বিভিন্ন কৌশল জানে। আর মাঝে মাঝেই তা প্রয়োগও করে। এরকম সহজাত প্রেমিক স্বভাবের আর কাউকে দেখেনি রামোন-এছাড়াও সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো আদ্রা ও’কে ভয় পায়; যা দু’জনের আনন্দই বাড়িয়ে তোলে।
***
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে স্রোতের বিপরীতে প্রায় দুই মাইল সাঁতার কেটে এলো রামোন।
ফিরে এসে দেখল, স্কুলের যাবার জন্য তৈরি হয়ে গেছে নিকোলাস। বাদামি প্যারাট্রুপারের পোশাক আর নরম টুপি পরে নিল রামোন। অপেক্ষারত জিপে গিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে বাবার পাশে বসল নিকোলাস। এরপর মেইন গেইটের পাশে নার্সারী স্কুল।
আখের ক্ষেত্রে কাজ চলাতে হাভানা’তে পৌঁছাতে প্রায় দুই ঘণ্টারও বেশি। লেগে গেল। পাহাড়ের উপর আকাশ ছেয়ে আছে আখের ধোয়ায়।
শহরে পৌঁছে বিশাল প্লাজা ডি লা রেভোলিউশন এর কোণায় রামোনকে নামিয়ে দিল ড্রাইভার। পাশেই আছে জনগণের হিরো জোসে মারতির ওবেলিস্ক।
ফিদেল ক্যাস্ট্রোর বক্তৃতা শোনার জন্য এ জায়গাতেই এসে জড়ো হয় হাজার হাজার কিউবান।
প্রেসিডেন্টের অফিসও এখানে। এই অফিসেই রামোনকে স্বাগত জানালেন, ফিদেল ক্যাস্ট্রো।
কাগজপত্র-আর রিপোর্ট দিয়ে ভর্তি বিশাল ডেস্কের ওপাশ থেকে উঠে এসে রামোনকে জড়িয়ে ধরলেন ক্যাস্ট্রো।
“মি জোরো ডোরাডো” খুশিতে হেসে উঠলেন ফিদের ক্যাস্ট্রো।” মাই গোল্ডেন ফক্স, অনেকদিন পর তোমাকে দেখে বেশ ভালো লাগছে।”
“ফিরে এসে আসলেই ভাল লাগছে এল জেফে। সত্যিকথাই বলল রামোন। সবার চেয়ে বেশি এই মানুষটাকেই সে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে।
রামোনের চেহারাতে কী যেন দেখলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো, “তোমাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে কমরেড। বেশি বেশি পরিশ্রম করছ?”
“রেজাল্ট তো ভাল পাচ্ছি।” আশ্বস্ত করল রামোন।
“চলো, জানালার পাশে বসি।”
ডেস্কের উপরে কোণার বাক্স থেকে দুটো সিগার পছন্দ করে এনে রামোনের হাতে দিলেন। রামোনকে সিগারেট জ্বালাতে সাহায্য করে নিজেরটাও ধরালেন; তারপর মুখের এক কোণায় জ্বলন্ত সিগারেট রেখে জানতে চাইলেন,
“তো মস্কোর কী-খবর?
ইউদিনিচের সাথে দেখা হয়েছে?”
“হ্যাঁ। আর মিটিংটাও ভাল হয়েছে…”।
নিজের রিপোর্ট সম্পর্কে খুলে বলল রামোন। দুজনের চরিত্রে বেশ কিছু মিল আছে। কেউই কোনো পদবী কিংবা সুবিধার জন্য লালায়িত নয়। রামোন জানে তার অবস্থান কোথায়। দুই ভাইয়ের মাঝে আছে রক্ত আর আত্মার সম্পর্ক।
হ্যাঁ, ক্যাস্ট্রো বদলে যেতে পারেন। যেমনটা হয়েছে চে গুয়েভারার ক্ষেত্রে; গ্রনমা থেকে আসা সেই হিরো; বিরাশি জনের মাঝে তিনিও একজন। কিন্তু ক্যাস্ট্রোর অর্থনৈতিক নীতির বিরোধিতা করায় দু’জনের আর বনিবনা হয়নি। কিন্তু রামোনের সাথে কখনো এমন কিছু হবে না।
‘রপ্তানি পরিকল্পনার নতুন অংশকে সহায়তা করতে রাজি হয়েছেন ইউদিনিচ।” রামোনের কথা শুনে মিটিমিটি হাসলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো।
তিনটি মাত্র শস্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে কিউবার সম্পদ; চিনি, কফি, তামাক। কিন্তু সামাজিক সমৃদ্ধি আর শহরায়ণের জন্যে ক্যাস্ট্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে যথেষ্ট অর্থের যোগান দিতে অক্ষম এসব সম্পদ।
বিপ্লবের পরের সময়ের চেয়ে এখনকার জনসংখ্যাও দ্বিগুণ। আগামী দশ বছর আরো বেড়ে যাবে। এসব সমস্যারই সমাধানের পরিকল্পনা করেছে রামোন। অর্থের পাশাপাশি বেকারত্ব দূর হবে।
“নতুন রপ্তানিযোগ্য এই পণ্য হলো মানুষ। নারী এবং পুরুষ যোদ্ধা। পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় এদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হবে ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে বিপ্লবের বীজ বপনের জন্য। আর এভাবে দ্বীপের প্রায় দশ শতাংশ জনশক্তি রপ্তানি হয়ে যাবে। একবারের ধাক্কাতেই বেকারত্ব দূর হয়ে যাবে।
প্রথম যেদিন রামোনের মুখে এ পরিকল্পনা শুনেছেন সেদিন থেকেই তা পছন্দ করে ফেলেছেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। এ ধরনের অর্থনীতি তিনি সহজেই বোঝেন আর প্রশংসাও করেন।
“ইউদিনিচ। ব্রেজনেভকে জানাবেন” নিশ্চয়তা বিড়ালের গায়ে হাত বোলানোর মতো করে নিজের দাঁড়িতে হাত বোলালেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো।
“যদি ইউদিনিচ সুপারিশ করেন, তাহলে আমাদের আর ভয় নেই।” হাঁটুর উপর হাত রেখে সামনে ঝুঁকলেন ক্যাস্ট্রো,
“আর আমরা তো জানিই যে তুমি ওদেরকে কোথায় পাঠাতে চাও।”
“আজ বিকেলে তানজানিয়ার অ্যামব্যাসিতে মিটিং করব” জানাল রামোন।
হাবানা’তে আফ্রিকার সতেরটি দেশের দূতাবাস আছে। এদের মধ্যে। সবচেয়ে বড় মার্কসিস্ট হলেন তানজানিয়ার জুলিয়াস নায়ারে।
আফ্রিকার অন্যান্য যেসব কলোনিয়াল স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করছে, তাদেরকে সক্রিয় সহযোগিতা করে তানজানিয়াবাসী। পর্তুগিজ, অ্যাংগোলা, মোজাম্বিক, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইথিওপিয়া সব দেশের মুক্তিযযাদ্ধারাই তানজানিয়াতে আশ্রয় পেয়েছে।
“ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনীর সাথেও আমি মিটিং করেছি। মাকর্সিস্ট সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এ সৈন্যরা রুখে দাঁড়াতে প্রস্তুত।”
“হ্যাঁ, মাথা নাড়লেন ক্যাস্ট্রো।”
“ইথিওপিয়া আমাদের বেশ কাজে লাগবে।”
নিজের সিগারের দিকে তাকিয়ে দেখল রামোন। ছাই প্রায় দুই ইঞ্চি লম্বা হয়ে গেছে। জানাল, “আমরা সবাই জানি যে ভাগ্য কী চাইছে? আফ্রিকা অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।”
সন্তুষ্ট হয়ে চেয়ারে হেলান দিলেন ক্যাস্ট্রো, বলে চলল রামোন : “মাদার রাশিয়াকে আফ্রিকানরা অন্তর থেকে অবিশ্বাস করে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে অসংখ্য-গুণ থাকা সত্ত্বেও রাশানরা বর্ণবাদী। বহু আফ্রিকান নেতা রাশিয়াতে পড়াশোনা করেছেন। আবার প্যাট্রিস লুমাম্বা ইউনিভার্সিটি করিডর দিয়ে হাঁটার সময় “বানর” খেতাবও শুনেছেন। শ্বেতাঙ্গ রাশানদেরকে তাই কোন মতেই বিশ্বাস করেনা আফ্রিকা।”
সিগারেটে টান দিয়ে চুপ করে গেল রামোন। নীরবতা ভাঙ্গলেন ক্যাস্ট্রো’ “তারপর”
“অন্যদিকে এল জেফে আপন হচ্ছেন আফ্রিকার পৌত্র….কিন্তু মাথা নাড়লেন ক্যাস্ট্রো।
“আমি স্প্যানিশ।” শুধরে দিলেন।
হেসে ফেলে রামোন বলে চলল, “যদি আপনি বলেন যে, আপনার পিতৃপুরুষকে হাভানা’তে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল, তাহলে কেই-বা, সন্দেহ করবে?” পরামর্শ দেবার মতো করে আরো যোগ করল, “আর তাহলে ভাবুন তো আফ্রিকার’র উপরে আপনার কতটা প্রভাব পড়বে?”
নিঃশব্দে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলেন ক্যাস্ট্রো। ওদিকে রামোন মোলায়েম স্বরে জানালো, “আমরা আপনার জন্যে একটা ট্যুরের ব্যবস্থা করব। মিশর থেকে শুরু করে এই বিজয়ে যাত্রা দক্ষিণ বিশটা দেশের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে, আর আপনি প্রচার করবেন আফ্রিকার জনগণ নিয়ে উদ্বেগ ও প্রত্যাশার কথা। এক্ষেত্রে নিজেকে যদি ওদের একজন হিসেবে তুলে ধরতে পারেন তাহলে দু’শ মিলিয়ন আফ্রিকান কতটা প্রভাবিত হবে, বলতে পারেন?” সামনে ঝুঁকে ক্যাস্ট্রোর কব্জি স্পর্শ করল রামোন। “আর নয় ছোট্ট একটা দ্বীপের রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা আমেরিকার হাতের পুতুল, হয়ে উঠবেন মহান আর শক্তিশালী এক বিশ্বনেতা।”
“মাই গোল্ডেন ফক্স” মিষ্টি হেসে বলে উঠলেন, ক্যাষ্ট্রো, “কেন যে তোমাকে এত ভালোবাসি!”
***
পুরাতন শহরের স্প্যানিশ কলোনিয়াল দালানগুলো একটাতে সাময়িক তানজানিয়ার দূতাবাস স্থাপন করা হয়েছে।
এখানেই ইথিওপিয়ার লোকেরা রামোনের জন্য অপেক্ষা করছিল। তিনজন তরুণই সম্রাট হালি সেলেসি’র রাজকীয় সেনা বাহিনীর অফিসার। এদের মাঝে একজনকে যথেষ্ট পছন্দ করে রামোন মাচাদো। ক্যাপ্টেন গেটাশ আবিবি’র সাথে এর আগেও কয়েকবার আদ্দিস আবাবা’তে দেখা হয়েছে।
ক্যাপ্টেন গেটাশ’র মাঝে ঐতিহ্যবাহী খাঁটি আফ্রিকান এভাবে পুরোপুরি ভাবে বিদ্যমান আদ্দিস আবাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও লেকচারার হিসেবে। জো সিসেরো আমেরিকান এবং ব্রিটিশ মার্সিস্ট ভাবধারা ছড়িয়ে কিছু শিষ্য তৈরি করে গেছেন। যেসব প্রতিভাবান ছাত্রদের একজন গেটাশ আৰিবি হয়ে উঠেছে নিবেদিত প্রাণ মাকর্সিস্ট লেনিনিস্ট।
লোকটাকে নির্বাচন করার আগে বহু বছর ধরে তাকে পরখ করে দেখেছে রামোন। প্রমাণ পেয়েছে বুদ্ধিমান, নিষ্ঠুর আর কঠিন হৃদয়ের এক কর্মে বিশ্বাসী সৈনিককে।
‘গেটাশ’র বয়স ত্রিশের খানিকটা উপরে হলেও তাকেই ইথিওপিয়ার পরবর্তী নেতা হিসেবে পছন্দ করে রেখেছে রামোন।
তাই তানজানিয়া দূতাবাসের পেছন দিকে আবদ্ধ এক সিটিং রুমে হাত মেলানোর সময় চোখ পাকিয়ে ইশারা করে সাবধান করে দিল গেটাশ’ কে। দেয়ালে ঝোলানো আফ্রিকার উপজাতির মুখোশগুলোর যেকোনটাতে লুকিয়ে থাকতে পারে গোপন মাইক্রোফোন।
মাত্র আধ ঘন্টার সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষ করে বিদায়ক্ষণে আবারো হাত মেলাতে গিয়ে আবিবি’র কানে ফিসফিস করে মাত্র চারটা শব্দ বলে দিল রামোন-একটা জায়গা আর সময়।
এক ঘণ্টা পরে আবারো বোদোগিটা ডেল মিডিওতে দেখা করল দু’জনে। এটিই পুরাতন শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত বার। দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতির মাঝে দেখা গেল সাধারণ থেকে শুরু করে বহু বিখ্যাত মানুষের সিগনেচার : হেমিংওয়ে, স্পেনসার ট্রেসি অ্যান্ড এডওয়ার্ড, ডিউক অব উইন্ডসর সবাই এসেছিলেন এখানে ডিংক করতে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন লম্বা রুমটাতে কাস্টোমারদের চিৎকারের সাথে পাল্লা দিয়ে বাজছে “বেম্বে” ফোক মিউজিক। দুজনে একেবারে কোণার দিকে বসে মোজিতে অর্ডার করেছে। গ্লাসের গা বেয়ে পড়ে টেবিলের উপর গোলকার বৃত্ত রচনা করেছে।
কিন্তু কেউই ড্রিংক ছুঁয়েও দেখেনি।
“কমরেড সময় প্রায় হয়ে গেছে।” রামোনের কথা শুনে মাথা নাড়ল আবিবি।
“আমহারার’র সিংহের যথেষ্ট বয়স হয়েছে, দাঁত ও পড়ে গেছে; আর ছেলেটা তো মহাগাধা শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আর ক্ষুধার জ্বালায় ধুকছে। সুতরাং এখনই উপযুক্ত সময়।”
“তবে দুটো ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে।” সাবধান করে দিল রামোন। “ প্রথমটা হচ্ছে সশস্ত্র বিপ্লব পরিহার করতে হবে। যদি সেনাবাহিনী এখনই ক্ষেপে গিয়ে সম্রাটকে মেরে ফেলে, তোমার কোনো লাভ হবে না। র্যাঙ্কিং এর দিক থেকে জুনিয়র হওয়াতে তোমাকে টপকে কোনো জেনারেল ক্ষমতায় বসে যাবে।’
“তাহলে?” জানাতে চাইল আবিবি, “এর সমাধান কী?”
“নিঃশব্দ বিপ্লব।” রামোনের মুখে উচ্চারিত শব্দদুটো জীবনে এই প্রথমবার শুনলো আবিবি।
“তাই নাকি!” বিড়বিড় করে উঠল আবিবি। অন্যদিকে রামোন ওকে বুঝিয়ে বলল,
“এখন যেটা করতে হবে তা হল, ডার্গ হালি সেলসি’কে জানিয়ে দেবে সিংহাসন ত্যাগ করার দাবি। তোমার কথা মত। বুড়ো সিংহ তার দাঁত হারিয়ে বাধ্য হবে এ দাবি মেনে নিতে। আর এপাশ থেকে তুমি ডার্গকে প্রভাবিত করবে অন্যপাশ থেকে আমি।”
বিভিন্ন গোত্র আর সেনাবাহিনী, সরকারের সব ধরনের ডিপার্টমেন্ট আর ধর্মীয় প্রধানদের নিয়ে গঠিত ডার্গ হচ্ছে ইথিওপিয় সংসদ। আদ্দিস আবাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কসিস্ট এসব সদস্যের বেশির ভাগ রামোনের চতুর্থ ডিরেকটরেটের কথায় উঠে আর বসে। গেটাশ আবিবিকেও সবাই নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে।
“এরপর প্রভিশনাল মিলিটারি বেসড জান্তা বসিয়ে কিউবা থেকে সৈন্য নিয়ে আসবো। যাতে করে শক্ত হবে তোমার অবস্থান। সবকিছু একবার খাপে খাপে বসে গেলেই শুরু হবে পরবর্তী পদক্ষেপ।”
“সেটা কী?” জানতে চাইল আবিবি।
“সম্রাটকে সরিয়ে দিতে হবে; নচেৎ রাজপরিবারের সমর্থকেরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।”
“মেরে ফেলা?”
“এটা আসলে একটু বেশিই পাবলিক আর আবেগপ্রবণ হয়ে যায়।” মাথা নাড়ল রামোন।
“তারচেয়ে বৃদ্ধ হওয়াতে এমনিই মারা যাবে আর এরপর…”
“আর এরপর একটা নির্বাচন?” বাধা দেয়াতে আবিবি’র দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল রামোন। ইথিওপিয়াটার পুরু বেগুনি ঠোঁটে কৌতুকের হাসি দেখে কেবল নিজেও হাসল।
“তুমি তো আমাকে চমকে দিয়েছ কমরেড।” স্বীকার করল রামোন। “এক মুহূর্তের জন্য তো মনে হয়েছিল যে তুমি সত্যি সিরিয়াস। নতুন প্রেসিডেন্ট আর সরকার গঠন করার আগে এটাই হবে আমাদের শেষ কাজ। জনগণ নিজেদেরকে চালানো তো দূরের কথা ব্যক্তিটাকেও পছন্দ করতে পারে না। তাই তাদের হয়ে এ দায়িত্ব আমরাই পালন করব। এরও বহুদিন পরে তোমাকে মার্কসিস্ট সোশালিস্ট সরকার হিসেবে ঘোষণা করার পরেই নিয়ন্ত্রিত আর সুশৃঙ্খল নির্বাচন দেয়া হবে।”
“আদ্দিসে আপনাকে আমার দরকার, কমরেড।” আকুতি করল-আবিবি। “সামনের বিপদজনক দিনগুলোতে আপনার গাইডেন্স আর কিউবার ডান হাত প্রয়োজন আমার।”
“আমি ঠিক পৌঁছে যাব, কমরেড।” প্রতিজ্ঞা করল রামোন।
“তুমি আর আমি একসাথে দুনিয়াকে দেখিয়ে দেব যে কিভাবে বিপ্লব হয়।”
***
সবকিছুতেই ঝুঁকি আছে, কিন্তু সম্ভাব্য পুরস্কারের কথা ভেবে খুব সাবধানে সেগুলোকে সামাল দিতে হবে, ভাবল রামোন। ঝুঁকিগুলোকে কমানোর জন্য তাই পূর্বসতর্কতাও নিতে হবে।
সন্তানের কাছে লাল গোলাপকে নিয়ে যাবার সময় হয়েছে; যেভাবে তাকে জনোর পর সময় দেয়া হয়েছিল নিকোলাসের সথে সখ্যতা গড়ে তোলার জন্য। তিন বছর পার হয়ে যাওয়ায় খানিকটা ফিকে হয়ে যাওয়া এই বন্ধনকে আবারো দৃঢ় করে তুলতে হবে। এর মাঝে নিয়মিত ক্লিনিক আর নার্সারী স্কুলের রিপোর্ট ফটোগ্রাফ পাঠানো হলেও লাল গোলাপের উপর নিজের প্রভাব দুর্বল হয়ে গেছে বলে ভাবল রামোন।
সিমেন রাডার রিপোর্ট পাঠানোর ফলে পুরস্কৃত করে মেয়েটাকে জানিয়ে দিতে হবে যে সহযোগিতা বিনা ওর সামনে আর কোনো পথ নেই। একই সাথে খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনো হঠকারিতা না করে বসে। ওর ভেতরে এমন একটা প্রত্যয় আর শক্তি আছে যে রামোন ‘ও ভয় পায়। খানিক সময়ের জন্যে কাজে লাগানো গেলেও চিরতরে কি দাস বানানো যাবে? এখনো নিশ্চিত নয় রামোন। খুব সাবধানে এগোতে হবে।
মাতা-পুত্রের মিলন হলে সম্ভাব্য কী কী ঘটতে পারে সে সম্পর্কে আগেই ভেবে রেখেহে রামোন। সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হল বোকার মতো লাল গোলাপ হয় সন্তানকে নিয়ে পালাতে চাইবে।
তাই পূর্ব সতর্কতা হিসেবে পরিবার নিয়ে নিউইয়র্কে বেড়াতে যাওয়া স্প্যানিশ কনিস্ট পার্টির এক সদস্যের প্রপার্টি হাসিয়েন্দা মিটিং প্লেস হিসেবে নির্বাচন করে কেজিবি সদস্যদের পাহারা বসাল রামোন।
হাসিয়েন্দার চারপাশে আর ভেতরে পজিশন নিল বাগোন সশস্ত্র গার্ড। টু-ওয়ে রেডিও আর সন্তানকে দেখে লাল-গোলাপ অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে পড়লে ব্যবহার করার জন্য ড্রাগসহ সমস্ত অস্ত্র ডিপ্লোমেটিক ব্যাগে ভরে মাদ্রিদে নিয়ে আসা হলো।
স্পেনকে বেছে নেয়ার আরেকটা কারণ আছে। নিকোলাসের সঠিক আস্তানা লাল গোলাপ কখনোই জানবে না। কোর্টনি পরিবারের প্রভাব আর ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রামোন জানে লাল গোলাপ যদি বাবার কাছে গিয়ে সব জানায় তাহলে কী ঘটবে। হয়ত ভাড়া করা সৈন্যদের দল কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার সিকিউরিটি ফোর্স কিডন্যাপ অভিযান চালিয়ে বসবে।
তাই ইসাবেলাকে বিশ্বাস করাতে হবে যে নিকোলাসকে স্পেনে রাখা হয়েছে। এখানে অবাক হবার কিছু নেই; নিকলাসের জন্য আর রামোনের পরিচয় স্প্যানিশ হিসেবেই জানে-সে, তাই আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে নিকোলাসের অন্য কোথাও নেবার কথা ভাবতেই পারবে না।
হাসিয়েন্দার বেল টাওয়ারের বন্ধ জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। রামোন। ট্র্যাডিশনাল নকশায় তৈরি দালানের মাঝখানের আঙ্গিনার চারধারে মোটা সাদা প্লাস্টার করা দেয়াল। আঙ্গিনার মাঝখানে আবার সুইমিং পুল। পুলের চারধারে চারটা ফল ভর্তি পাম গাছ।
টাওয়ারে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে শুধু আঙ্গিনা নয়, আশপাশের মাঠ আঙ্গুর ক্ষেত’ও দেখতে পাছে রামোন, এস্টেটের চারপাশে আটজন গার্ড বসিয়েছে। আঙ্গিনার দিকে তাকিয়ে একেকটা জানালার ওপাশে বসে আছে প্রত্যেকে। একজনের কাছে আছে সাইপার রাইফেল, আরেকজনের কাছে ডার্ট গান। তবে মনে হয় না কাউকে রেডিওতে ডাকতে হবে।
এয়ারফেয়ার আর গার্ডদের খরচ মিলিয়ে পুরো অপারেশনটা বেশ কস্টলি হলেও মাদ্রিদের রাশান অ্যামব্যাসি থেকে গার্ড আর ভেহিকেল পাওয়ায় এবং হাসিয়েন্দার মালিক কোনো অর্থ না নেয়া গাটের পয়সা খরচ করতে হচ্ছে না এ যাত্রায়। ফিনান্স সেকশনের কড়াকড়ির কথা মনে এলে এখনো গা জ্বালা করে উঠে।
একটা কিপটে অ্যাকাউন্ট্যান্ট কিভাবে বুঝবে ফিল্ড অপারেশনের প্রয়োজন আর গুরুত্ব?
রেডিওতে নরম স্বরে শব্দ হতে থাকায় ছেদ পড়ল-চিন্তার জগতে।
“দা? ইয়েস?” মাইক্রোফোনে রাশান বলে উঠল রামোন।
“নাম্বার থ্রি বলছি, গাড়িটাকে দেখা যাচ্ছে।” জানিয়ে দিল এস্টেটের সর্ব দক্ষিণের গার্ড।
টাওয়ারের দক্ষিণ দিকের জানালায় দৌড়ে গেল রামোন। দেখতে পেল আঙ্গুর ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে আসা গাড়ির হলুদ ধুলা।
“ঠিক আছে।” নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে অ্যামবাসির ফিমেল সিগনাল ক্লার্কের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। ইলেকট্রনিক কনসোলের সামনে বসে থাকা মেয়েটার কাজ হলো নিচের আঙ্গিনার প্রতিটি শব্দ আর দৃশ্য রেকর্ড করা।
টয়লেট আর বাথরুম সহ লাল গোলাপ যেতে পারে এমন সর্বত্র গোপন ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন লাগানো আছে।
এস্টেটের গেইটের কাছে এসে মোড় নিল গাড়িটা। ডিপ্লোমেটিক প্লেট লাগানো নীল কার্টিনা এসে থামল হাসিয়েন্দার সদর দরজার সামনে।
এয়ারপোর্ট থেকে এসকার্ট করে আনা নারী অ্যামব্যাসি গার্ডের সাথে সাথে এগিয়ে এলো ইসাবেলা কোর্টনি। হঠাৎ করেই পায়ে চলা ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে টাওয়ারের বদ্ধ জানালার দিকে তাকাল বেলা। মনে হল যেন টের পেল রামোনের অস্তিত্ব। বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে মেয়েটার ঊর্ধ্বমুখ দেখল রামোন।
শেষবার দেখার পর থেকে নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে মেয়েটা। বালিকাসুলভ চপলতা ঝেড়ে ফেলে এক পুরোপুরি নারী। চলাফেরায় যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ। এতদূর থেকেও দেখা যাচ্ছে চোখের নিচের কালি আর চোয়ালের দৃঢ়তার রেখা। এমন একটা করুণ কিছু দেখতে পেল যে মায়াবোধ করল রামোন। আগের মতো সুন্দরী না হলেও আরো আকষর্ণীয় হয়ে উঠেছে। বেলা।
আর হঠাৎ করেই মনে হল এ মেয়েটা নিকোলাসের মা, ভাবতেই কেমন আর্দ্র হল হৃদয়। কিন্তু একই সাথে এহেন অনুভূতি হওয়ায় রেগেও উঠল ভেতরে ভেতরে। আগে কখনো কোন সাবজেক্টের প্রতি এমনটা আর হয়নি। নিজের উপরের রাগ এবার গিয়ে পড়ল বেলার উপর। এই দুর্বলতার জন্য মেয়েটাই দায়ী। শীতের রাতে আগুনের তাপের উপর হাত মেলে দেয়ার মতো করে নিজের রাগকে দমিয়ে ফেলল রামোন।
অন্যদিকে নিচ থেকে তাকিয়ে ইসাবেলার মনে হলো বদ্ধ জানালার ওপাশে কারো অস্পষ্ট নাড়াচাড়া দেখা যাচ্ছে। যাই হোক ওর মনের ভুলও হতে পারে।
এসকর্ট করে নিয়ে আসা মেয়েটা ওর বাহুতে হাত রেখে বলল, “চলুন, ভেতরে যেতে হবে।”
বেল টাওয়ার থেকে চোখ নামিয়ে খোদাই করা কাঠের দরজার দিকে নজর দিল ইসাবেলা। দরজা খুলে যেতেই দেখা গেল আরেকটা মেয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। নিজের ছাই রঙা বিজনেস স্যুটের বোম আটকে কাঁধ উঁচু করে এগিয়ে গেল ইসাবেলা।
শীতল অন্দরে বেশ মনমরা একটা ভাব। হঠাৎ করে থেমে যেতেই ছোট্ট একটা অ্যান্টিচেম্বারের দিকে পথ দেখিয়ে মেয়েটা বলল, “এইদিকে!” ইসাবেলার স্যুটকেস আর বড়সড় একটা পার্সেল সাথে বয়ে আনছে এসকর্ট মেয়েটা। ভারী ওক কাঠের টেবিলের উপর পার্সেল আর স্যুটকেশ রেখে দরজা বন্ধ করে দিল।
“চাবি” হাত বাড়িয়ে দিতেই হ্যান্ডব্যাগ খুঁজে পেতে চাবি বের করে মেয়েটার হাতে দিল বেলা।
দুটো মেয়ে মিলে আতিপাতি করে খুঁজে দেখল পুরো স্যুটকেস। বোঝাই যাচ্ছে এ কাজে তারা বেশ দক্ষ। প্রতিটি কাপড়ের লাইনিং, ক্রীম আর অয়েন্টেমেন্টে সুই ঢুকিয়ে চেক করে দেখল। একস্ট্রা জুতার হিল চেক করে ইলেকট্রিক শেভারের ব্যাটারি খুলে নিল। এরপর নজর দিল পার্সেলের দিকে। একজন আবার হাত বাড়াল হ্যান্ডব্যাগের দিকে।
“প্লিজ কাপড় খুলে ফেলুন। কাঁধ ঝাঁকিয়ে ড্রেস খুলে ফেলল ইসাবেলা। প্রতিটি আইটেম সহ জ্যাকেন্টের সোল্ডার-প্যাড পর্যন্ত চেক করে দেখল মেয়ে দুটো।
পুরোপুরি উলঙ্গ হবার পরে একজন আদেশ দিল : হাত তুলুন।
কথা মতো কাজ করেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল বেলা। মেয়েদের একজন হাতে সার্জিক্যাল গ্লাভস্ পরে ভ্যাসলিনের পটের মধ্যে-দুটো আঙুল চুবিয়ে দিল।
“ওদিকে ঘুরুন।” আদেশ দিতেই মাথা নাড়ল বেলা, “না।”
“আপনি ছেলেটাকে দেখকে চান?” ভারী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করতেই ভ্যাসলিন মাখা হাত তুলে ধরল মেয়েটা। “ঘুরে যান।”।
কাঁপতে কাঁপতে ইসবেলা টের পেল হাতের সব লোম দাঁড়িয়ে গেছে।
“ওদিকে ঘুরুন।” একটুও বদলায়নি মেয়েটার গলা। ধীরে ধীরে ওদিকে ফিরল বেলা।
“উপুড় হয়ে হাত টেবিলের উপর রাখুন।”
সামনে ঝুঁকে শক্ত করে টেবিলের কিনারা আঁকড়ে ধরল বেলা।
“পা দুটো আলগা করুন।”
বুঝতে পারল ইচ্ছে করেই তাকে অপমান করা হচ্ছে। জানে এসবই প্রক্রিয়াটার অংশ। মনটাকে জোর করে অন্যদিকে ঘোরাতে চাইলেও মেয়েটার হাত নিজের ভেতরে টের পেয়ে নড়াচড়া শুরু করে দিল।
“নড়বেন না।”
ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল বেলা। বেশ খানিক সময় বাদে মেয়েটা পিছিয়ে দাঁড়াল,
“ঠিক আছে, কাপড় পরে নিন।”
গালের উপর কান্নার ফোঁটা টের পেল বেলা। জ্যাকেটের পকেট থেকে ক্লিনেক্স নিয়ে মুছে ফেলল। এগুলো আসলে ক্রোধের অশ্রু।
“এখানেই অপেক্ষা করুণ।” হাত থেকে গ্লাভস খুলে ওয়েস্টপেপার বিনে ছুঁড়ে মারল মেয়েটা।
দুজনেই দরজা আটকে চলে গেল। রয়ে গেল একা।
তাড়াতাড়ি কাপড় পরে বেঞ্চে বসে পড়ল ইসাবেলা। হাতগুলো এখনো। কাঁপছে। জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে দিল মুষ্টিবদ্ধ হাত।
প্রায় একঘণ্টা অপেক্ষা করতে হলো।
***
রিমোট ভিডিও ক্যামেরাতে সার্চের পুরো অংশটুকু দেখল রামোন। ক্যামেরাটা এমনভাবে বসানো হয়েছিল যেন ইসাবেলার মুখটা স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু যা দেখল তাতে খচখচ করছে মনের ভেতরে। ভেবেছিল হয়ত মেয়েটাকে বশে আনা গেছে; অথচ তার বদলে বেলার চোখে দেখেছে শীতল ক্রোধের আগুন; চোয়ালের শক্ত, একরোখা ভাবা। এই ক্রোধ কি হত্যা না আত্মহত্যা ডেকে আনবে? নিশ্চিত হতে পারেনি রামোন।
ঠিক সেই মুহূর্তে চোখ তুলে লুকানো ক্যামেরাতে সরাসরি রামোনের চোখের দিকে তাকাল বেলা। নিজেকে সামলে নিল। গাঢ় নীল চোখের উপর যেন পর্দা পড়ে ঢেকে গেল মেয়েটার অভিব্যক্তি।
সোজা হয়ে বসল রামোন। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। যেমনটা ভেবেছিল তাই হলো, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কেবল ওকে রুখে রাখা যাবে। এসে গেছে সেই সময়। ভেঙে পড়ার সময় এসেছে মেয়েটার, ঠিক আছে, রামোনও কৌশল পরিবর্তন করতে জানে। এ পরিবর্তনটুকু ও’কে দ্বিধায় ফেলে দেবে। এসব রামোনের কাছে কোনো ব্যাপারই না।
পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে মোলায়েম স্বরে আদেশ দিল : “বাচ্চাটাকে নিয়ে এসো।”
নিকোলাসের হাত ধরে পাশের রুম থেকে এদিকে এলো আদ্রা।
মায়ের মতো খুব সাবধানে ছেলের হাবভাবও লক্ষ করল রামোন। আজ সকালেই চুল ধুয়ে দিয়েছে আদ্রা। কপালের উপর লুটিয়ে পড়েছে উজ্জ্বল কোকড়ানো চুল। সাদাসিধা ড্রেস পরিয়ে দেয়ায় ফুটে উঠেছে শরীরের মসৃণ ভাব, গোলাপি ঠোঁট, বড় বড় চোখের উপরে বাকানো। যে কোনো মায়ের অন্তর বিগলিত করার জন্য যথেষ্ট।
“মনে আছে আমি কী বলেছি নিকোলাস?”
“হ্যাঁ পাদ্রে।”
“খুব লক্ষ্মী একজনের সাথে দেখা হবে এখন। উনি তোমাকে অনেক পছন্দ করেন। একটা উপহার’ও এনেছেন। ভদ্র ব্যবহার করবে আর মাম্মা” ডাকবে।”
“উনি কি আমাকে আদ্রার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাবেন?”
“না, নিকোলাস। শুধু তোমার সাথে খানিক গল্প করতে আর উপহার দিতে এসেছেন। এরপর চলে যাবেন। যদি তার সাথে ভালভাবে আচরণ করো তাহলে সন্ধ্যায় আদ্রা উডি উডপোর কাটুন দেখতে দেবে। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে, পাদ্রে।” খুশি হয়ে হাসল নিকোলাস।
“এখন যাও।”
বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে নিচে তাকাল রামোন। নিচের আঙ্গিনাতে বেলাকে নিয়ে এসেছে কেজিবি নারী সদস্য। সুইমিং পুলের পাশের বেঞ্চ দেখিয়ে বেলা’কে আদেশ দিতেই গমগমে গলা মাইক্রোফোনের মাধ্যমে পৌঁছে গেল রামোনর কাছে।
“প্লিজ এখানে অপেক্ষা করুন। বাচ্চাটাকে নিয়ে আসা হবে।”
মেয়েটা চলে যেতেই বেঞ্চে বসে পড়ল বেলা। চোখের উপর সানগ্লাস পরে নিল। ডার্ক লেন্সের ওপাশ থেকে দেখতে লাগল চারপাশ।
টু-ওয়ের রেডিও’র বোতাম টিপে দিল রামোন।
“অল-স্টেশনস্, ফুল অ্যালার্ট।”
ইলেকট্রনিক সারভেইল্যান্স ইকুপমেন্ট ছাড়াও ইসাবেলার উপর তা করা হল ৭.৬২ মিলিমিটার ড্রাগোনভ স্নাইপার-রাইফেল আর ডার্ট গান। টোনল ঢোকানো ডার্ট গান দু’মিনিটে অচল করে দিতে পারে যেকোনো মানব শরীর। তারপরেও শেষ কথা হল লাল গোলাপের মতো সম্ভাবনাময় অপারেটিভ হারাতে চায় না রামোন।
হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়িয়ে আঙ্গিনার ওপাশে তাকাল বেলা। নিচে তাকাল রামোন। টাওয়ারের ঠিক নিচেই দেখা গেল নিকোলাস আর আদ্রার মাথা।
বহুকষ্টে দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছেটাকে দমন করল বেলা। জানে তাহলে হতবাক হয়ে যাবে ছোট্ট মানুষটা।
আস্তে আস্তে সানগ্লাস খুলে ফেলল বেলা। আদ্রার হাত ধরে আগ্রহ নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে নিকোলাস।
ছেলের দুই মাস বয়সের শেষ ছবি দেখেছিল বেলা। মনে মনে নিকি’র গড়নের কথাও চিন্তা করে রেখেছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সবকিছুই ভিন্ন। ওর গায়ের রং, দেহতত্ত্বের মাধুর্য আর ওই কোকড়ানো চুল-চোখজোড়া! ওহ, চোখজোড়া তো!
“ঈশ্বর!” ফিসফিস করে উঠল বেলা, “আমার বাবুটা এত সুন্দর হয়েছে দেখতে! প্লিজ, গড়, ও যেন আমাকে পছন্দ করে।”
নিকোলাসের হাত ছেড়ে দিয়ে ওকে সামনে ঠেলে দিল আদ্রা; সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে দু’জনে এসে দাঁড়াল বেলার সামনে।
“বুয়েনস ডায়াস, সিনোরিটা বেলা” স্প্যানিশে বলে উঠল আদ্রা। “নিকোলাস সাঁতার কাটতে পছন্দ করে। আপনাদের দুজনের জন্যে সুইমিং কস্টিউম রাখা আছে। যদি চান তো ওর সাথে সাঁতার কাটতে পারবেন।” বাথ হাউজের বদ্ধ দরজার দিকে ইশারা করল আদ্রা, “ওখানে চেঞ্চ করতে পারবেন। এরপর নিকোলাসের দিকে তাকাল,
‘মা’কে অভ্যর্থনা জানাও।” ঘুরে দাঁড়িয়ে এস্ত পায়ে আঙিনা ছেড়ে চলে গেল আদ্রা।
নিকোলাস এখন পর্যন্ত একবারও হাসেনি কিংবা বেলা’র উপর থেকে চোখ সরায়নি। এবারে দায়িত্ব পেয়ে খানিক সামনে এসে ডান হাত এগিয়ে দিল।
“গুড ডে, মাম্মা। আমার নাম নিকোলাস মাচাদো আর তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালই লাগছে।”
ইসাবেলার ইচ্ছে হল হাঁটু গেড়ে বসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। “মাম্মা” শব্দটা যেন বেয়নেটের মতো ঢুকে গেছে বুকের ভেতরে। কিন্তু তার বদলে ছেলের সাথে হাত মেলাল কেবল।
“তুমি তো দেখতে বেশ সুন্দর হয়েছ, নিকোলাস। শুনেছি নার্সারি স্কুলেও বেশ ভালো করছ।”
“হ” মাথা নাড়ল নিকি।
“আগামী বছর ইয়াং পাইওনিয়ারদের সাথে যোগদেব।”
“তাহলে তো খুবই ভাল হবে। কিন্তু এরা কারা?”
“সবাই জানে।” মায়ের অজ্ঞতা শুনে মজা পেল নিকোলাস।” তারা সকলে বিপ্লবের সন্তান।”
ও, ওয়ান্ডারফুল। খানিকটা দ্বিধা নিয়ে তাড়াহুড়া করে উত্তর দিল ইসাবেলা, “আমি তোমার জন্য একটা প্রেজেন্ট এনেছি।”
“থ্যাংক ইউ, মাম্মা।” প্যাকেজের দিকে তাকাল নিকোলাস।
বেঞ্চে বসে ছেলের হাতে উপহার তুলে দিল বেলা। সাবধানে খুলে ফেলল নিকোলাস। আর তারপরই কেমন চুপ করে গেল।
“তোমার পছন্দ হয়েছে?” নার্ভাস ভঙ্গিতে জানতে চাইল বেলা।
“সকার বল।” অস্ফুটে বলে উঠল বেলা।
“হ্যাঁ, পছন্দ হয়নি?”
“এত সুন্দর গিফট আগে আর কেউ দেয়নি আমাকে।”
চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকাতেই ছেলের দৃষ্টিতে সত্যিকারের খুশি দেখতে পেল বেলা। এই বয়সেই কতটা রিজার্ভ ছেলেটা। কতটা ভয়ংকর সব দুঃস্বপ্ন ওকে এরকম বানিয়ে দিয়েছে?
“আমি কখনো ফুটবল খেলিনি।” বলে উঠল বেলা। “তুমি আমাকে শিখিয়ে দেবে?”
“তুমি তো মেয়ে দ্বিধায় পড়ে গেল নিকোলাস।
“তারপরেও আমি চেষ্টা করতে চাই।”
“ঠিক আছে।” এক হাতের নিচে বল নিয়ে উঠে দাঁড়াল নিকি। “কিন্তু তোমাকে জুতা খুলে ফেলতে হবে।”
মিনিটখানেকের ভেতরে কেটে গেল নিকোলাসের আড়ষ্ঠতা। বলের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়ল। ছোট্ট একটা ইঁদুর ছানার মতো পুরো আঙ্গিনা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, ইসাবেলা’ও ওর পিছনে ছুটছে, ওর কথা শুনছে, বেঞ্চের নিচে পাঁচটা গোল দিয়ে ফেলল নিকোলাস।
অবশেষে ক্লান্ত হয়ে দুজনেই বসে পড়ল লনের উপর। এবারে নিকি মাকে জানাল-”মেয়ে হলে-তুমি ভালই খেলেছ।”
সুইমিং কস্টিউম পরে নিল দু’জনে আর মা’কে নিজের নানা কসরৎ দেখাল নিকি। বিভিন্নভাবে সাঁতার কাটতে কাটতে একেবারে লাল হয়ে উঠল চেহারা।
কোমর সমান পানিতে সিঁড়ির শেষ ধাপের উপর বসে কঁকি দিয়ে উঠল ইসাবেলার শরীর; মনে পড়ে গেলো ট্যাংকের মাঝে ছেলের ডুবে যাবার দৃশ্য। তারপরেও নিজেকে সামলে হেসে ফেলল, নিকিকে প্রশংসা জানিয়ে বলে উঠল,
“ওহ, ওয়েলডান নিকোলাস।”
হাপাতে হাপাতে মায়ের কাছে এসে হঠাৎ করে কোলে উঠে গেল।
“তুমি বেশ সুন্দরী। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।”
যেন মূল্যবান কোনো ক্ৰিসালস্ট একটু আঘাতেই ভেঙে যাবে; এমনভাবে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল বেলা। ছোট উষ্ণ দেহটাকে ধরে ভেতরে ভেতরে গুমড়ে উঠল বেলার হৃদয়। “নিকোলাস, মাই বেবি, আমি তোকে কত ভালবাসি, কত মিস করি!”
চোখের পলকে কেটে গেল পুরো বিকেল। এরপর এলো আদ্রা, “নিকোলাসের ডিনারের সময় হয়েছে। আপনি ওর সাথে খেতে বসবেন সিনোরিটা?
আঙ্গিনাতে ওদের জন্যে পাতা টেবিলের উপর বসে আল ফ্রেসকো খেলো-মাতা-পুত্র। নিকোলাসের জন্য এলো ফ্রেস কমলার রস আর বেলার জন্য শেরী। ইসাবেলা ব্রিমের কাটা বেছে দিলেও নিকোলাস একাই খেল।
নিকোলাস যখন আইসক্রীম খাচ্ছে, তখন চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখতে শুরু করেছে বেলা। কানের কাছে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে শুনতে যেন ফেটে পড়ল নিকোলাসের মুখ।
চেয়ার থেকে পড়ে যাবার আগেই বেলা’কে ধরে ফেলল আদ্রা। পেছনের দরজা দিয়ে আঙ্গিনাতে নেমে এলো রামোন; সাথে কেজিবি’ ফিমেল মেম্বার।
“তুমি বেশ লক্ষ্মী হয়ে ছিলে, নিকোলাস। এখন আদ্রার সাথে ঘুমাতে যাও।”
“উনার কী হয়েছে?”
“কিছুই হয়নি।” জানাল রামোন। “উনার ঘুম পেয়েছে। তোমারও তো ঘুম পেয়েছে নিকোলাস।”
“হ্যাঁ। পাদ্রে। হাই তুলতে তুলতে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মছুল নিকি। আদ্রা ওকে নিয়ে যেতেই কেজিবি নারী সেনাদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল রামোন।
“রুমে নিয়ে যাও।”
ডিনার টেবিল থেকে খালি শরীর গ্লাস তুলে রুমাল দিয়ে ওষুধের শেষ কোণাটুকুও মুছে ফেলল রামোন।
***
অদ্ভুত একটা বেডরুমে ইসাবেলার ঘুম ভেঙে গেল। কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগছে। ঘুম ঘুম চোখে কাঁধের উপর টেনে নিল চাদর।
হঠাৎ করেই খেয়াল হল যে চাদরের নিচে ওর শরীরটা পুরোপুরি নগ্ন। মাথা তুলতেই দেখতে পেল বাথরুমের দরজার পাশে পরিষ্কারভাবে ওর ভাজ করা কাপড় রাখা আছে। লাগেজ র্যাকে সুটকেস।
চোখের কোণে কেউ একজনকে নড়তে দেখে পুরোপুরি সজাগ হয়ে উঠল দৃষ্টি। বেডরুমে ওর সাথে একজন পুরুষও আছে। চিৎকার করার জন্য মুখ খুলতেই তাড়াতাড়ি লোকটা ওকে চুপ করার জন্য ইশারা করল।
“রাম-” নাম উচ্চারণ করার আগেই দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে ওর মুখে হাত চাপা দিল রামোন।
হা করে তাকিয়ে রইল হতভম্ব। বাকরুদ্ধ বেলা। ভেতরে উৎলে উঠেছে। আনন্দ। রামোন!
বেলাকে ছেড়ে আবারো কাছের একটা দেয়ালের দিকে চলে গেল রামোন। গোঁয়ার স্টাইলে একটা অয়েল পেইন্টিং ঝুলছে। পেইন্টিংটা সরাতেই দেয়ালের গায়ে আটকানো গোপন মাইক্রোফোনটাকে দেখা গেল।
আবারো চুপ থাকার ইশারা করে কাছে এগিয়ে এলো রামোন। বেডসাইড টেবিলের ল্যাম্পের শেড় ছড়িয়ে দেখাল দ্বিতীয় মাইক্রোফোন।
এরপর বেলা’র এত কাছে এসে বসল যে ওর গালে লাগল রামোনের উষ্ণ নিঃশ্বাস।
“এসো।” কেমন লাজুক হয়ে গেল বেলা। কতদিন কেটে গেছে!
“আমি সব বলছি এসো।”
রামোনের কষ্ট মাখা দু’চোখ দেখে উবে গেল বেলা’র আনন্দ
ওর হাত ধরে বিছানা থেকে নামাল রামোন। তারপর নগ্ন অবস্থাতেই নিয়ে গেল বাথরুমে ড্রাগের কল্যাণে এখনো পুরোপুরি মতিচ্ছন্ন ভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি বেলা।
বাথরুমের গ্লাস ওয়ালড কেবিনেটের শাওয়ার ছেড়ে দিল রামোন।
এখনো ওকে স্পর্শ করতে ভয় পাছে বেলা, “এসব কী হচ্ছে? তুমিও কি ওদেরই একজন? রামোন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। প্লিজ বলল কী ঘটছে!”
হাহাকার করে উঠল রামোন, “আমার অবস্থাও তোমার মত। আমাকে এসব করতে হচ্ছে, নিকির খাতিরে। এখন সব বুঝিয়ে বলতে পারব না–তবে এদের শক্তি আমাদের চেয়ে বেশি। আমরা তিনজনেই এদের কাছে বাঁধা। ওহ মাই ডার্লিং, আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে সব বলি, কিন্তু সময় যে নেই।”
“রামোন। শুধু এটুকু বলল যে তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো।” ফিসফিস করে উঠল বেলা।
“ইয়েস, মাই ডার্লিং। জানি, তোমার উপর দিয়ে কতটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমারও ঠিক একই অবস্থা। জানি তুমি আমাকে কি ভাবছ, কিন্তু একদিন ঠিকই জানতে পারবে যে আমি সবকিছু নিকি আর তোমার জন্যেই করেছি।”
রামোন’কে বিশ্বাস করতে চাইল বেলা। মন বলছে ওর কথাই যেন সত্যি হয়।
“শীঘ্রিই হাতের মাঝে বেলার মুখখানা ধরে জানাল, রামোন, “আবার আমরা একসাথে হবো-শুধু আমরা তিনজনে। তুমি, আমি, নিকি। বিশ্বাস করো।”
“রামোন!” ফোঁপাতে ফোঁপাতে সর্বশক্তি দিয়ে রামোনের গলা জড়িয়ে ধরল বেলা। কোনো যুক্তিবোধের তোয়াক্কা না করেই আজও ওকে বিশ্বাস করে বসল।
“আর কয়েক মিনিট মাত্র একসাথে কাটাতে পারব। এর বেশি ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। নতুবা বিপদ হয়ে যাবে। তুমি জানোও না যে নিকি কতটা বিপদের মাঝে আছে।”
“আর তুমিও।” ধরে এলো বেলা’র গলা।
“আমার জীবন কোনো ব্যাপার না; কিন্তু নিকি…”
“তোমাদের দুজনেরই জীবন অনেক মূল্যবান, রামোন।” তাড়াতাড়ি বলে। উঠল বেলা।
“আমাকে প্রমিজ করো যে নিকি’র ক্ষতি হবে এরকম কিছু করবে না।” বেলা’কে কিস করল রামোন।” ওরা যাই বলুক, প্লিজ করো। আর বেশিদিন এসব সইতে হবে না। তুমি সাহায্য করলে আমি যত তাড়াতাড়ি পারি আমাদেরকে মুক্ত করতে চেষ্টা করব। কিন্তু আমাকে তোমার বিশ্বাস করতে হবে।”
“ওহ মাই লাভ, আমি জানতাম যে কোনো একটা কারণ নিশ্চয়ই আছে। অবশ্যই আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।”
“আমি জানি, ডার্লিং, আমি জানি।”
“আমাদের জন্যে তোমাকে শক্ত হতে হবে।”
“তোমার নামে শপথ কেটে বলছি, ঈশ্বর জানেন আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি, কবে থেকে সবকিছু কেবল বুকের মাঝে জমিয়ে রেখেছি।” ভীষণ ভাবে মাথা নাড়ছে বেলা। “প্লিজ আমাকে আদর করো রামোন। কবে থেকে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। আর পারছি না। চলে যাবার আগে আমাকে আদর করো।”
হারিকেনের মতো হাওয়া এসে বেসামাল করে দিল দু’জনকে।
রামোন চলে যাবার পর দু’পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর মতো শক্তিটুকুও পাচ্ছে না বেলা। টাইলসের দেয়াল ঘেষে বসে পড়ল মেঝের উপর। বাথরুম ভরে গেল পানিতে। মাথায় যেন কিছুতেই ঢুকছে না। শুধু দুটো নাম রামোন। আর নিকি।
“ওহ্ থ্যাঙ্ক গড।” ফিসফিস করে নিজেকে শোনাল বেলা, “ভয়গুলো সব আসলেই মিথ্যে। রামোন এখনো আমাকে ভালবাসে। আবার আমরা তিনজনে একসাথে হবো। কোনো একদিন, কোনো না কোন ভাবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
বহু কষ্টে উঠে দাঁড়াল বেলা। “এখন আমাকে ধৈর্য ধরতে হবে; ওদের যেন সন্দেহ না হয়…” শাওয়ার নিল টলতে টলতে।
শুধু অন্তর্বাস পরে দাঁড়িয়ে আছে বেলা, এমন সময় একবারও নক না করে দরজা খুলে রুমে ঢুকে পড়ল এয়ারপোর্ট থেকে এসকর্ট করে আনা দুই নারীর একজন। এমনভাবে বেলা’র শরীরের দিকে তাকালো যে তাড়াহুড়ো করে স্কার্ট পরে নিল বেলা।
“কী চান?”
“বিশ মিনিটের মাঝে এয়ারপোর্টে যেতে হবে।”
“নিকি কোথায়? আমার ছেলে?”
“চলে গেছে।”
“আমি আরেকবার ওকে দেখতে চাই, প্লিজ।”
“সম্ভব না। বাচ্চাটা চলে গেছে।”
রামোনের সাথে দেখা হবার পর থেকে মনের মাঝে যে ক্ষীণ আশার জন্ম হয়েছিল তা সাথে সাথে উবে গেল।
আবারো শুরু হচ্ছে সব দুঃস্বপ্ন। নিজেকে বোঝাল বেলা, “আমাকে শক্ত হতে হবে। রামোনকে বিশ্বাস করতে হবে।”
এয়ারপোর্টে যাবার সময় কটিনার ব্যাক সিটে বেলার পাশে বসল কেজিবি’র সেই নারী সেনা। এয়ার কন্ডিশনড় না থাকায় কেজিবি’র গায়ের গন্ধে টেকা দায় হয়ে পড়ল। সাইড উইন্ডো খুলে দিতেই ঠাণ্ডা বাতাসে জুড়িয়ে গেল অন্তর।
ইন্টারন্যাশনাল ডিপারচার টার্মিনালে গাড়ি থামার পর প্রথমবারের মতো কথা বলে উঠল কেজিবি; হাসিয়েন্দা ছাড়ার পর এতক্ষণ টু শব্দও করেনি। বেলা’র হাতে তুলে দিল ঠিকানা বিহীন খাম।
“এটা আপনার জন্য।”
হ্যান্ডব্যাগ খুলে খামটাকে রেখে দিল বেলা। কটিনা থেকে বের হয়ে স্যুটকেস তুলে নিল; ড্রাইভার সাথে সাথে দরজা আটকে চলে গেল গাড়ি নিয়ে।
হাজারো প্যাকেজ-টুর ট্রাভেলারদের মাঝে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড় একা মনে করল বেলা, নিকি আর রামোনকে দেখার আগেও যেন এতটা একা ছিল না।
“ওকে আমার বিশ্বাস করতেই হবে। নিজেকে আবারো মনে করিয়ে দিয়ে ডেস্কের দিকে পা বাড়ার বেলা।
ফার্স্টক্লাস লাউঞ্জের উইমেন ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা আটকে ছিঁড়ে ফেলল খাম। লাল গোলাপ,
আর্মসকোর আর পেলিনড়াবা নিউক্লিয়ার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের যৌথভাবে বানানো নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের কাজ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে জানতে পারার সাথে সাথে টেস্ট সাইট আর ডেট জানিয়ে দেবে।
এ ডাটা পাবার পরেই পুত্রের সাথে তোমার পরবর্তী সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হবে। তথ্যের গুরুত্বের উপর নির্ভর করবে সাক্ষাতের সময় সীমা।
সাদা পৃষ্ঠার উপর টাইপ করা মেসেজটাতে কোনো স্বাক্ষর নেই। দৃষ্টিশূন্য-ভাবে তাকিয়ে রইল বেলা।
“আরো চাই, আরো চাই।”
ফিসফিস করে উঠল বেলা, “প্রথমে রাডার রিপোর্ট। সেটা ততটা খারাপ ছিল না। ডিফেন্সিভ উইপন-কিন্তু এখন? অ্যাটম বোমা? কখনো কি এর শেষ হবে?”
মাথা নাড়ল বেলা, “আমি পারব না-বলে দেব-পারব না, ব্যাস।”
পেলিনডাবা ইনস্টিটিউট নিয়ে বাবার কখনো কোনো আগ্রহই দেখেনি। এতদসম্পর্কিত কোনো ফাইল তো দূরে থাক। প্রাইম মিনিস্টার নিজে কয়েকবার বলেছেন যে সাউথ আফ্রিকা নিউক্লিয়ার বোমা বানাচ্ছে না।
অথচ এর উপরে আবার ওকে খবর নিতে হবে প্রথম ডিভাইসটা কবে কোথায় ফাটবে। কাঁপা কাঁপা আঙুলে মেসেজটাকে ছিঁড়ে ফেলল বেলা।
“আমি পারব না।” টয়লেট সিট থেকে উঠে প্রতিটি টুকরা পানিতে ফেলে ফ্ল্যাশ করে দিল। “বলে দেব পারব না।” কিন্তু মনে মনে আবার বাবাকে কিভাবে কাবু করা যায় সেই প্ল্যান করা শুরু করে দিল।”
***
স্পেনে যাওয়ায় মাত্র পাঁচদিন দেশে ছিল না বেলা। কিন্তু ইলেকশন ক্যাম্পেইন মাঝপথে ছেড়ে যাওয়ায় অসম্ভব রেগে আছেন নানা। নির্বাচনের আগের দিন শুক্রবারে প্রধানমন্ত্রী জুন ভরসটার সী পয়েন্ট টাউন হলে ন্যাশনাল পার্টি ক্যান্ডিডেটদের সমর্থনে মিটিং ডাকলেন।
এখানে বক্তৃতা করার জন্য ছেড়ে এসেছেন গুরুত্বপূর্ণ বাকি দুই প্রোগ্রাম। আর এসবই সম্ভব হয়েছে সেনটেইন কোর্টনি-ম্যালকমসের বদান্যতায়।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শোনার জন্যে পুরো ভর্তি হয়ে গেল টাউন হল। কোথাও তিল ধারণের জায়গা পর্যন্ত নেই।
প্রথম বক্তা ইসাবেলা। মাত্র দশ মিনিটেই শেষ করে দিল অবশ্য! পুরো ক্যাম্পেইনে এটাই হল ওর শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা। গত কয়েক সপ্তাহে বহু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে মেয়েটা আর স্পেন থেকে আসার পর তো যেন প্রাণশক্তি ফিরে পেয়েছে। নানা আর শাসা দু’জনের সামনেই প্র্যাকটিকস করে এসেছে বেলা।
হলভর্তি দর্শকেরা মুগ্ধ হয়ে গেল ইসাবেলা’র তারুণ্যমাখা সৌন্দর্যে। বক্তৃতার শেষে সকলে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো বেলা’কে; অন্যদিকে ওর পাশে দাঁড়িয়ে অনবরত হাততালি আর মাথা নেড়ে সমর্থন দিল লাল মুখো জনে ভরসটার।
পরের বুধবার সন্ধ্যাবেলা ইসাবেলা’র দু’পাশে পার্টি সাজে এসে দাঁড়িয়েছেন শাসা আর নানা। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হচ্ছে।
যেমন আশা ছিল তেমন হয়েছে। বিজয়ী দলের মূল্যবান বারোশ ভোটার কেড়ে নিয়েছে ইসাবেলা কোর্টনি, সমর্থকেরা ওর চেয়ার কাঁধে তুলে নাচতে শুরু করে দিল।
পরের সপ্তাহে পার্লামেন্টে বিল্ডিংয়ে নিজের অফিসে বেলা’কে মিটিং করতে ডাকলেন জন ভরসটার। বাবা যখন কেবিনেট মিনিস্টার ছিল, তখন থেকেই বিল্ডিংটা চেনে বেলা।
নিজের মেয়াদকালে মেয়েকে অফিসের দায়িত্ব দিয়েছিলেন শাসা। আর মধ্য কেপ টাউনে এলেই একে ক্লাব হিসেবে ব্যবহার করত বেলা। চওড়া করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে গেল বহু স্মৃতি। টিন এজার থাকার সময়ে কখনো মাথা ঘামায়নি জমকালো দালানটার ইতিহাসের মহিমা নিয়ে।
মাত্র পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করিয়ে রাখলেন প্রধানমন্ত্রী। বেলা অফিসে ঢোকার পর ডেস্ক থেকে বের হয়ে এলেন ওকে অভিবাদন জানানোর জন্য।
“আমাকে ডেকে পাঠানোর জন্য ধন্যবাদ, ওওম জন।” বিশুদ্ধ আফ্রিবান ভাষায় কথা বলে উঠল বেলা। যাই হোক, ওওম অথবা আংকেল ডেকে বেশ সম্মান দেখানোয় মনে মনে মেয়েটার নার্ভের প্রশংসা করলেন জন।
“সী পয়েন্টে তোমার পারফরম্যান্সের জন্য কনগ্রাচুলেশন্স বেলা।” পেট নেইম ব্যবহার করায় নিশ্চিন্ত হল বেলা।
“এখন আমার কফি-ব্রেক চলছে।” সাইড টেবিলের উপর রাখা সিলভার আর পোর্সেলিন সার্ভিসের দিকে ইশারা করলেন প্রধানমন্ত্রী, “আমাদের দু’জনের জন্য কফি ঢেলে নেবে?”
কাপের উপর দিয়ে তাকালেন বেলার দিকে, “নাউ ইয়াং লেডি, এমপি তো হলে না, এখন কী করবে?”
“ওয়েল, ওওম জন, আমি বাবা’র হয়ে কাজ-”
“আমি জানি” বেলা’কে থামিয়ে দিলেন জন। “কিন্তু ফ্রেশ ইয়াং পলিটিক্যাল ট্যালেন্টকে’তো এমনই পড়ে থাকতে দিতে পারি না। সিনেটে একটা সিটের কথা কখনো ভেবেছ?”
“সিনেট?” হকচকিয়ে যাওয়ায় কফি’তে পুড়ে গেল ইসাবেলার জিহ্বা। “না, আমি কখনো এ ব্যাপারে ভাবিইনি। কেউ তো বলেওনি-”।
“ঠিক আছে। এখন বলছে। আগামী মাসেই-রিটায়ার করবেন বুড়ো ক্লেইনহান। উনার আসনের জন্যে কাউকে মনোনীত করতে হবে; তাই লোয়ার হাউজে তোমার জন্যে সেইফ সিট না পাওয়া পর্যন্ত এতে কাজ চালাতে হবে।”
রিপাবলিক অব সাউথ আফ্রিকার দুটো লেজিসলেটিভ হাউসের আপার লেভেল হল সিনেট। আপার হাউসের কয়েকটা সিট প্রধানমন্ত্রীর গিফট হিসেবে গণ্য করা হয়; যার একটা এখন বেলা’কে দেয়া হলো।
কফি কাপ নামিয়ে রেখে নির্বাক হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইল ইসাবেলা। সহসা এতটা উপরে যাবার সিঁড়ি পেয়ে মাথা যেন কাজ করতে চাইছে না। “তুমি রাজি…?” জানতে চাইলেন প্রধানমন্ত্রী।
এতটা শর্ট কাটের কথা নানা কিংবা শাসা’ও কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি।
হেড্রিক ভারউড নিজে সিনেটে তাঁর পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন সিনেটের হিসেবে। মাত্র আটাশ বছর বয়সে বেলা’ই হতে যাচ্ছে আপার হাউজের সবচেয়ে তরুণ, বুদ্ধিমান আর আকর্ষণীয় সিনেটর।
ন্যাশনাল পার্টি থেকে কিছুদিনের মাঝেই ও হয়ে উঠবে প্রাইম ফেমিনিস্ট পলিটিক্যাল ফিগার। ক্ষমতার একেবারে ভেতরের অংশে, রাষ্ট্রের গোপন সব অলিগলিতে ওর বিচরণ কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
“এতটা সম্মানিত আর কখনো বোধ করিনি, মিঃ প্রাইম মিনিস্টার।” প্রায় ফিসফিস করে জানিয়ে দিল বেলা।
“জানি তুমি দেশের জন্য এরচেয়েও বেশি সম্মান বয়ে নিয়ে আসবে। হাত বাড়িয়ে দিলেন ভরসটার, কনগ্রাচুলেশন্স সিনেটর।”
প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরতেই বেলা’র মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল অপরাধবোধের শীতল স্রোত; বিশ্বাসঘাতকতার বোধ। কিন্তু সাথে সাথে চিন্তার ঝড় বইতে লাগল মাথার মধ্যে; লাল গোলাপ এখন হয়ে উঠবে ওদের তুরুপের তাস। তাই শীঘিই ওর সব দাবি পূরণ করতে হবে ওদেরকেও।
নিকি আর রামোন। আর বেশি দিন দূরে নেই-সেদিন। আবার আমরা একসাথে হবো।
***
নিরাভরণ আর বিশাল কারু’কে কখনোই তেমন পছন্দ করত না বেলা। কিন্তু কৈশোরে ইভ পালমা’রের লেখা ‘দ্য প্লেইনস্ অব ক্যামডিবু পড়ার পর থেকে কারু’র বিস্ময়কর দুনিয়ার প্রেমে পড়ে যায়। ওর ছোট্ট বেলাতেই এই বিশাল র্যাঞ্চটাকে কিনে নিয়েছেন শাসা।
এখানেই বাবার সাথে খুঁজে বেরিয়েছে দানবীয় সরীসৃপদের ফসিল।
ভয়ংকর যেসব প্রাণীর স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে খামারবাড়ির নাম রাখা হয়েছে ড্রাগন’স ফাউন্টেন। এছাড়াও টেবিল টপড় মাউন্টনের নিচ থেকে বেরিয়ে আসে মিষ্টি পানির ঝরনা। এর পানি থেকেই পুষ্টি পায় প্রাসাদের সামনের বাগান আর সবুজ লন।
ষাট হাজার একরেরও বেশি জমি নিয়ে ছড়িয়ে আছে এই র্যাঞ্চ। এখানে একসাথে চড়ে বেড়ায় লম্বা পশম অলা ভেড়ার দল আর সুদৃশ্য ছোট ছোট স্প্রিংবক হরিণের পাল। দেখে মনে হয় বাতাসে ভেসে বেড়ানো ধূলিকণা। দারুচিনি রঙা শরীরে মিশে গেছে চকোলেট আর সাদা রঙ। চমৎকার প্যাটার্নের মাথা আর শিংয়ের কারণে ক্যামডিবুর সমভূমিতে চড়ে বেড়ানো অসংখ্য প্রাণের মধ্যে এগুলোই হয়ে উঠেছে। ইসাবেলার সবচেয়ে প্রিয়। আর মরুভূমির ছোট ছোট ঝোঁপ থেকে আহার খুঁজে নেয়ায় ভেড়া আর অ্যান্টিলোপগুলোর সুস্বাদু মাংসে পাওয়া যায় ভেষজ স্বাদ।
প্রতি শীতে, হান্টিং সিজন শুরু হবার আগে বার্ষিক স্প্রিংবক নিধন প্রতিযোগিতার জন্যে ড্রাগন’স ফাউন্টেনে পার্টি দেন শাসা। চার ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হলেই কারু’তে বেড়ে যায় এদের সংখ্যা। তাই এগুলোর বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বছরে অন্তত হাজার খানেককে মেরে ফেলতে হয়।
জোহানোবার্গ থেকে নিজের বন্ধু আর তাদের পরিবারকে নিয়ে আসে গ্যারি। নতুন লিয়ার জেট নামার মতো করে সম্প্রসারণ করা হয়েছে ল্যান্ডিং স্ট্রিপ। কেপ টাউন থেকে বাকি অতিথিদেরকে জোড়া ইঞ্জিনের কুইন এয়ারে করে নিয়ে আসেন শাসা।
সিনেটের অধিবেশন শেষ করে ঊনত্রিশতম জন্মদিনে বাবার কাছ থেকে পাওয়া ছাই রঙা পোরেশে’তে নানা’কে সাথে নিয়ে পৌঁছে গেল বেলা। লং ড্রাইভের লম্বা ঘন্টাগুলো কিভাবে যেন পার হয়ে যায় এই বুড়ীর গল্প শুনতে শুনতে। স্পিডমিটারের দিকে তেমন খেয়ালই করেন না নানা। তাই বুফোর্ট ওয়েস্ট আর র্যাঞ্চের মাঝখানের রাস্তায় গিয়ে গাড়ির স্পিড ১৬০ মাইল পর্যন্ত তুলে ফেলল বেলা।
ড্রাগনস ফাউন্টেনের রান্না ঘরের আঙ্গিনাতে যখন গাড়ি থামল তখন প্রায় মাঝদুপুর। ভৃত্য আর কুকুরদের দল এগিয়ে এলে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। অবশেষে বেলা যখন নিজের রুমে যাবরার ফুরসৎ পেল ততক্ষণে তার তিনটা স্যুটকেস খুলে ফেলতে শুরু করেছে ন্যানি।
“গড ন্যানি, আমি শেষ। আগামী এক সপ্তাহ শুধু ঘুমাবো।”
“অকারণে তোমার প্রভুর নাম নিওনা।” সর্তক করে দিল ন্যানি।
“তুমি তো মুসলিম ন্যানি। এভাবে বলছ যে?”
“নিয়ম তো সবার জন্যই এক।” ঘোঘোৎ করে উঠল ন্যানি।
“পুরুষেরা সব কই?” বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ল বেলা।
“শিকারে গেছে, আর কি!”
“সুদর্শন কেউ আছে নাকি?”
“হ্যাঁ, কিন্তু সকলেই বিবাহিত। তোমারটা তোমারই খোঁজা উচিত মিস বেলা।” থেমে গেল ন্যানি। “একজন আছে যার স্ত্রী নেই।” পরক্ষণে মাথা নেড়ে জানাল। “কিন্তু তুমি তাকে পছন্দ করবে না।”
“কেন?”
“ওর তালুতে একটাও চুল নেই।” হাসতে লাগল ন্যানি, “একেবারে ডিমের খোসার মতো টাক।”
“ঠিকই বলেছে ন্যানি। চোখ জোড়া আর চেহারাটা খানিক সহৃদয় হলেও মাথা একেবারে ন্যাড়া। পেছন দিকে ফ্রায়ার টাকের মতো কোকড়ানো।
ডিনারের আগে ককটেলের জন্য নিচে নেমে এসে বেশ ভাল বোধ করল বেলা। উষ্ণ জলে স্নান করে এরই মাঝে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নিয়েছে। আর পরনের নীল সিল্কের ড্রেসটা’র কল্যাণে সৌন্দর্য যেন ফুটে বের হচ্ছে। বিবাহিত কিংবা অবিবাহিত সকলেই কাৎ।
প্রথমেই গ্যারি’র কাছে গেল বেলা। বহুমাস দু’জনের দেখা হয়নি। “মাই বিগ টেডি বিয়ার” ভাইকে জড়িয়ে ধরল বেলা।
বোনের কোমর ধরে টাকলুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল গ্যারি। “বেলা, উনি প্রফেসর অ্যারন ফ্রাইডম্যান। অ্যারন এ হচ্ছে আমার ছোট্ট বোন সিনেটর ডক্টর ইসাবেলা কোর্টনি।”
“ওহ, কাম অন গ্যারি!” ভাইকে মৃদু ভর্ৎসনা করে অরনের সাথে হাত মেলালো বেলা। পিয়ানিস্ট কিংবা সার্জনের মতো শক্ত হাত। জেরুসালেম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর অ্যারন এখন ছুটিতে আছেন।”
“ওহ, আই লাভ জেরুসালেম।” নম্রভাবে উত্তর দিল বেলা।” বলতে গেলে ইসরয়েলকেই ভালেবাসি।”
এরপর আরো মিনিট খানেক থেকে বাবার খোঁজে বারান্দার দিকে গেল বেলা। আগত অতিথি স্ত্রীদের মাঝে সবচেয়ে তিনজন ঘিরে ধরে আছে শাসা’কে।
“মাই বিউটিফুল ড্যাডি” বাবাকে কিস্ করল বেলা। এরপর বাবার হাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে গেল। আর সবসময়ে যেটা হয় ওদেরকে ঘিরে শুরু হয়ে গেল জটলা।
শ্যাম্পনে চুমুক দিতে দিতে হাসছে সকলে, গল্প করছে। বাইরে অস্তাচলে বসেছে কারুর সূর্য। মেঘের গায়ে যেন আগুন ধরে গেছে।
হঠাৎ করেই কে যেন বলে উঠল: “ড্রেস পরার সময় রেডিওতে শুনেছি ইথিওপিয়ানরা হালি সেলাসিকে সিংহাসন ত্যাগে বাধ্য করেছে।”
“আর যতসব ভক্কর-চক্কর; ডাকাতের দল।” বলে উঠল আরেকজন। “যুদ্ধের সময় সিক্সস ডিভিশনের সাথে ওখানে ছিলাম-পায়ে হেঁটে গেছি, আর শাসা তো হারিকেন নিয়ে ঘুরেছে।”
চোখের কালো পট্টিটা স্পর্শ করলেন শাসা, “তখন এর নাম ছিল আবিসিনিয়া।”
আবারো হাসতে শুরু করল সকলে, এরই মাঝে কেউ বলে উঠল : “হালি সেলাসি কিন্তু বুড়ো হলেও খারাপ ছিল না। এখন কী হবে কে জানেন!”
“কৃষাঙ্গ আফ্রিকার সর্বত্র তো একই অবস্থা-দ্বন্দ্ব, কম্যুনিজম, গুম, অরাজকতা, হত্যা আর মার্কসিজম।”
বিড়বিড় করে অনেকেই সম্মতি জানালেও সবাই এবারে মন দিল সূর্যাস্তের অনিন্দ্র সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করার জন্য।
মঞ্চের পর্দা নামার মতো করে হঠাৎ করেই ঝুপ করে নেমে এলো রাত। এতক্ষণে ঠাণ্ডা এসে কাঁপিয়ে দিল সকলকে। ঠিক সময়ে বেজে উঠল ডিনারের মূৰ্ছনা। বারান্দার শেষ মাথায় নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন, ফ্রেঞ্চ-উইনডো দিয়ে পথ দেখিয়ে সকলকে নিয়ে গেলেন লম্বা ডাইনিং রুমে; যেখানে সিলভার আর ক্রিস্টালের উপর মোমবাতির আলো পড়ে চমকাচ্ছে পলিশ করা অ্যান্টিক ওয়ালনাট টেবিল।
নিজের আসনের দু’পাশে গ্যারি আর অ্যারনকে পেল ইসাবেলা। বোঝাই যাচ্ছে এটা নানার চাল।
তাড়াহুড়ো করে এসে ওর চেয়ার টেনে দিল অ্যারন। ধুভ্যোরি। কিন্তু একটু পরেই অ্যারনের মজার সব কথা শুনে বিস্মিত বেলা ভুলেই গেল লোকটার টাকের কথা।
গ্যারি এতক্ষণ অন্যপাশে ব্যস্ত থাকলেও এবারে ইসাবেলার দিকে ফিরে অ্যারনের সাথে কথা বলা শুরু করে দিল।
“বাই দ্য ওয়ে অ্যারন, তুমি যদি সত্যিই সোমবার বিকেলে পেলিনড়াবাতে ফিরতে চাও, তাহলে আমি লিয়ারে করে পৌঁছে দেব।”
নামটা শুনেই চমকে উঠল বেলা। গালদুটো যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেল। পোলিনডাবা। “তুমি ঠিক আছ তত বেলা?” উদ্বেগ নিয়ে বলল গ্যারি।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছি।”
“অথচ মুহূর্তের জন্য কেমন অদ্ভুত লাগছিল তোমাকে দেখতে।”
“কিছু না। গ্যারি, তোমার কল্পনা।” কিন্তু চিন্তার ঝড় চলছে বেলার মাথায়। গ্যারি আবার অন্যদিকে তাকাতেই নিজেকে সামলে নিল বেলা।
‘আমি তো আপনাকে জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছি প্রফেসর, আপনার পড়নোর বিষয় কী?”
“আমাকে অ্যারন ডাকা যায় না ডক্টর?”
হেসে ফেলল বেলা, “তাহলে আমাকেও ইসাবেলা ডাকতে হবে।”
“আমি একজন ফিজিসিস্ট, নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট। বেশ বোরিং, তাই না?”
“মোটেই না, অ্যারন।” হালকাভাবে ওর কব্জি ছুলো বেলা।” এটাই তো ভবিষ্যতের বিজ্ঞান, শান্তি কিংবা যুদ্ধ যাই হোক না কেন।”
অ্যারনকে ধরা অবস্থাতেই ওর দিকে খানিক ঝুঁকে গেল বেলা। অন্তর্বাস না থাকায় দেহের উপরের অংশ অনেকটাই উন্মুক্ত হয়ে গেল। চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে রইল অ্যারন। মিনিট দুয়েক দেখার সুযোগ দিয়ে সোজা হয়ে বসল বেলা। ছেড়ে দিল আরনের কব্জি।
এই দুই সেকেন্ডেই বদলে গেছে অ্যারন ফ্রাইডম্যান। সম্মোহিত হয়ে বেলার বংশদব হয়ে গেছে যেন।
“আপনার স্ত্রী কোথায় অ্যারন?”
“প্রায় পাঁচ বছর আগে আমাদের ডির্ভোস হয়ে গেছে।”
“ওহ্, আই অ্যাম সো সরি।”
আদুরে গলায় চোখে সহানুভূতি নিয়ে তাকিয়ে রইল বেলা।
সন্ধ্যা শেষে নিজ রুমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মেক-আপ তুলতে তুলতে আপন মনে হাসল বেলা, “ইস্রায়েল, পেলিনডাবা, নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে…আমাকে আর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।”
গত দুই বছরে প্রতি মাসেই কোনো না কোনো তথ্য পাঠিয়েছে লাল গোলাপ। অবশেষে সময় এসেছে নিকোলাসের সাথে ওর সাক্ষাতের সুযোগ তৈরি করার।
ডিনারের সময় জানা গেল আরনের ঘোড়া প্রীতির কথা। তাই পরের দিন খুব ভোরবেলা রাইডে যাবার প্ল্যান করল দুজনে।
“আর কতদূরে যাবে তুমি?” আয়নায় নিজেকে শুধোল ইসাবেলা। উত্তর দেবার আগে বেশ খানিকক্ষণ ভেবে নিল।
“ওয়েল, লোকটা সত্যি বেশ মজার আর মিষ্টি চেহারার অধিকারী; সবাই তো বলে যে টাকলুদের কামনা-বাসনাও বেশি হয়।” আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকালো বেলা, “তুমি এত বিচ্ছু, মাতা হারি একটা।”
চৌদ্দ বছর বয়সে বড় ভাই শন মাতা হারি’কে নিয়ে একটা ছড়া শিখিয়েছিল।
“মেয়েটা জেনে গেছে সে জায়গা।
গভীর গোপনে আছে যা,
তেইশতম অবস্থানে গিয়ে,
নিগর্তকরণ”।
“নিগতকরণ” এর মানে জানতে চাইলে দুর্বোদ্ধভাবে হেসেছিল শন। ডিকশনকারী দেখেও তেমন সুরাহা করতে পারেনি। এবারে তাই হেসে ফেলে ভাবল,
“সত্যি এতদূর যাবে? যাইড হোক তেইশতম অবস্থান পর্যন্ত যেতে হবে না। প্রথম কিংবা দ্বিতীয় কোন কৌশলেই কাজ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। তবে মনের গভীরে ঠিকই টের পেল যে নিকি আর রামোনের জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত আছে।
ঠিকভাবে ভোরও হয়নি, আস্তাবলে নেমে এলো বেলা। আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল অ্যারন। সহিসকে অ্যারনের জন্য একটা শান্ত স্বভাবের বুড়ো, খাসি করা ঘোড়া আনার অর্ডার দিল বেলা। অস্বস্তি নিয়ে ভাবলো এটাকে নিশ্চয় সামলাতে পারবে অ্যারন। কিন্তু স্বচ্ছন্দেই ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে গেল প্রফেসর।
দিগন্তে সূর্য দেখা দিতে দিতে অনেক দূর পর্যন্ত চলে এলো দুজনে। মরুভূমির অদ্ভুত আলো খেলার জন্য মনে হল পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে বেলা।
মাথার উপর পাখা ছড়িয়ে উড়ে যাচ্ছে শকুনের দল। গতদিনের শিকারের ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সন্ত্রস্ত প্রিংকের পাল। পরিষ্কার মিষ্টি বাতাস ঠিক যেন শ্যাম্পেনের মতো নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। বাঁধনহারা বেলা আজ কোনো কিছুতেই দমবে না।
ঘোড়া দু’টোর ওয়ার্ম আপ শেষ হতেই টবগ করে গতি বাড়ালো দু’জনেই। নেমে গেল বাঁধের নিচে শুকনো নদীর বুকে। তীরে পৌঁছাতেই দেখা গেল কর্দমাক্ত বাদামি পানি থেকে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে মিশরীয় রাজহাঁস।
ঘোড়া থেকে নেমে নাটকীয়ভাবে স্কার্ফের কোণা দিয়ে চোখ মুছলো বেলা। উদ্বিগ্ন মুখে নেমে এলো অ্যারন।
“আপনি ঠিক আছেন তো ইসাবেলা?”
“মনে হচ্ছে চোখে কিছু পড়েছে।”
“আমি দেখব?”
অ্যারনের দিকে মুখ বাড়িয়ে দিল বেলা। আলতো করে দু’হাত দিয়ে ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল অ্যারন।
“আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।”
চোখ পিটপিট করে উঠল বেলা। লম্বা আর ঘন পাপড়ি ভেদ করে সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করে উঠল বিশুদ্ধ নীলকান্তমণি।
“আপনি নিশ্চিত?” অ্যারনের পুরুষালি গন্ধ আর নিঃশ্বাসের মিষ্টি ভাব এসে লাগল বেলার গালে। পোড়া মধুর মতো গাঢ় রঙা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে রইল বেলা।
আস্তে করে ওর চোখ ম্যাসাজ করে দিল অ্যারন।
“এখন কেমন লাগছে?” আবারো চোখ পিটপিট করে উঠল বেলা।
“আপনার হাতে তো যাদু আছে। এখন বেশ ভাল লাগছে।”
অ্যারনকে কিস করল বেলা।
প্রথমে খানিক হকচকিয়ে গেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিল অ্যারন। বেলা’র কোমর জড়িয়ে ধরতেই কয়েক সেকেন্ড ওর স্বাদ নেয়ার সুযোগ দিল মেয়েটা। যখনই বুঝতে পালর যে অ্যারন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়াল বেলা।
“চলুন, আস্তাবলে কে আগে যায় দেখি।” কামুক হাসি হেসে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসল বেলা। ওর চেস্টনাট ঘোটকীর ধারে কাছেও আসতে পারবে না। বুড়ো খোঁজা।
পরবর্তী তিনদিনে অ্যারন ফ্রাইডম্যানের জীবন অতিষ্ট করে তুলল বেলা। সুইমিং পুলে ওয়াটার পোলো খেলা, ডিনার টেবিলের নিচে অ্যারনের ঊরুতে হাত রাখা, লনে শুয়ে ওর সামনে বিকিনির টপ ঠিক করা; অ্যারনের মাথা খারাপ হবার যোগাড়। উপরন্তু হান্টিং ল্যান্ড রোভারে উঠার সময় সাহায্য করতে গিয়ে নিজের স্বচ্ছ প্যান্টি দেখারও সুযোগ করে দিল বেলা। বারান্দায় ডান্স করার সময় অলস ভঙ্গিতে ঘুরতে থাকা বেলা’র কোমর দেখে তো রীতিমতো দমবন্ধ করে ফেলল অ্যারন।
ড্রাগনস ফাউন্টেন ছেড়ে গ্যারির সাথে ট্রান্সভ্যালে যাবার আগের দিন নিজের রুমে অ্যারনকে অনুমতি দিল বেলা; এমনকি করিডোরে দাঁড়িয়ে গুড নাইটও জানালো। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পরস্পরকে কিস করতে গিয়ে নিজের আকুতিও আবিষ্কার করল বেলা। অ্যারনের মতই সেও প্রচণ্ড ভাবে কামনা করছে তার সান্নিধ্য। চাইছে না থামুক ওর স্কার্টের নিচে ঘুরে বেড়ানো সেই স্পর্শ। পিয়ানিস্টদের মতো হালকা চালে দুলছে অ্যারনের স্পর্শ।
“আজ রাতে দরজা খোলা রাখবে না?” ফিসফিস করে বেলা’র কানে কানে বলল অ্যারন। বহুকষ্টে নিজেকে সামলে অ্যারনকে দূরে সরিয়ে দিল বেলা।
“তুমি পাগল?” ফিসফিস করেই জানালো, “ঘর ভর্তি সব আমার পরিবারের লোকজন বাবা, ভাই, দাদিমা আর ন্যানি।”
“হ্যাঁ আমি পাগল হয়ে গেছি- তুমি আমাকে পাগল করে দিয়েছ। আই লাভ ইউ; আই ওয়ান্ট ইউ। আর সইতে পারছি না এই নির্যাতন। এভাবে আর পারছি না।”
“আমি জানি। আমারও একই অবস্থা। জোহানে বার্গে চলে আসব, ভেবো না।
“কবে? ওহ, প্লিজ বলো কবে ডালিং?”
“তোমাকে ফোন করে জানাবো। নাম্বার রেখে যাও।”
***