কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে ব্রাহ্মসমাজের উল্টো দিকে শিবনারায়ণ দাসের গলি। সেই গলির একটি বাড়িতে বহু যুবকের আনাগোনা হয়। একতলায় ফিল্ড অ্যান্ড আকাঁদেমি ক্লাব, দোতলায় ছাত্রদের একটি মেস, একটি ঘরে সতীশ মুখোঁপাধ্যায়ের ডন সোসাইটি। এখানে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বক্তৃতা করতে আসেন, প্রায়ই আসেন নিবেদিতা।
এ বাড়ির বারান্দা থেকে দেখা যায় একটা মস্ত বড় মাঠ। পান্তির মাঠ নামে পরিচিত এই খোলা জায়গাটায় প্রায়ই নানা রকম সভা বসে, সম্প্রতি একেবারে সরগরম। ছাত্ররা বারান্দায় দাঁড়িয়েই বক্তৃতা শুনতে পায়, এখান থেকেই হাততালি দেয় এবং শ্লোগানে কণ্ঠ মেলায়। সভায় কখনও উত্তেজনার সৃষ্টি হলে তারা বারান্দার রেলিং টপকে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছুটে যায় মাঠের মধ্যে।
আজকের সভায় খুব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে। বয়কট আন্দোলনে উদ্বেল হয়ে আছে সারা দেশ, প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও অনুষ্ঠিত হচ্ছে সভা। খ্যাতিমান নেতারা মফস্বলের বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন জনমত সংগঠন করার জন্য। সাধারণ মানুষ নির্দেশ চায়।
বয়কট আন্দোলন তো চলছেই, সম্প্রতি আর একটি বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে, পক্ষে-বিপক্ষে তর্কবিতর্ক চলছে অনবরত। দেশ জুড়ে বিলেতি দ্রব্য বর্জনের জন্য পিকেটিং চালাচ্ছে প্রধানত ছাত্ররাই। কোনও দল নেই, কোনও সর্বমান্য নেতা নেই, তবু ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেমে এসেছে রাস্তায়। এর আগে ছাত্রসমাজের এমন ভূমিকা কেউ দেখেনি। আহার-নিদ্রা তুচ্ছ করে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবার শপথ নিয়েছে।
এ বার টনক নড়েছে ইংরেজ সরকারের। দু-চার জন নেতাকে কারারুদ্ধ করা যায়, কিন্তু হাজার হাজার ছাত্রকে দমন করা যাবে কী উপায়ে? সমস্ত দোকানের সামনে পথ অবরোধ করে আছে ছাত্ররা। ক্রেতাদের তারা প্রতিরোধ করছে। অনেক জায়গায় বিলিতি বস্ত্রের বান্ডিলে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে, মদের দোকানের বোতল ভাঙছে, সর্বক্ষণ পথে পথে ছাত্রদের মিছিল, তারা ধ্বনি দিচ্ছে বন্দেমাতরম।
সরকার পক্ষ থেকে একটা কড়া নির্দেশ জারি করা হয়েছে। এর নাম কালাইল সারকুলার। ছাত্রদের সভা-সমিতিতে যোগদান নিষিদ্ধ, তারা মিছিলে অংশগ্রহণ করতে পারবে না, বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতে পারবে না। ছাত্রদের সংযত করার দায়িত্ব স্কুল-কলেজের। যে-সব স্কুল বা কলেজের ছাত্ররা এই নির্দেশ অমান্য করবে, সেই সব স্কুল-কলেজ সব রকম সরকারি সাহায্য থেকে বঞ্চিত হবে। ইতিমধ্যেই এই অভিযোগে রংপুরের দুটি স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও মিছিল ছত্রভঙ্গ করার জন্য চালানো হয়েছে পুলিশের লাঠি ও বেত।
ছাত্ররাও খেপে উঠেছে। তারা তো সরকারের নির্দেশ মানবেই না, তারা স্কুল কলেজও বয়কট করবে। বিলিতি দ্রব্যের মতন বিলিতি শিক্ষাও বর্জনীয়।
গোলদিঘিতে সভা করে ছাত্ররা নিজেরাই তৈরি করল প্রথম ছাত্র-সংগঠন। তার নাম হল অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি। তারা বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্রদের বেরিয়ে আসার ডাক দেবে।
অভিভাবকরা শঙ্কিত। বিভিন্ন নেতার বিভিন্ন মত। তবে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিই ছাত্রদের এই প্রতিবাদের পক্ষপাতী। ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্ররা ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কিছুই শেখে না। পরীক্ষায় পাশ করে রাশি রাশি কেরানি তৈরি হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই শিক্ষাব্যবস্থার ঘোর বিরোধী। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় এখন ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকার সম্পাদক হয়ে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে আগুন ছড়াচ্ছেন, তাঁর ভাষা এখন হাট-বাজারের লোকের মুখের ভাষার মতো, তিনি ছাত্রদের উদ্দেশে ডাক দিলেন, তোমরা গোলদিঘির গোলামখানায় প্রস্রাব করিয়া দিয়া চলিয়া
প্রধান মতবিরোধ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিপিন পালের। সুরেন্দ্রনাথ সর্বভারতীয় অন্যতম প্রধান নেতা, কংগ্রেসের সঙ্গে প্রথম থেকে যুক্ত। বিপিন পাল কংগ্রেসের কেউ নন, বর্তমান আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন। তিনি অসাধারণ বাগ্মী, তাঁর বক্তৃতায় শ্রোতারা আবেগে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। বিপিন পাল সরকারের কাছে আবেদন-নিবেদনে বিশ্বাসী নন, তাঁর বক্তব্যে ফুটে ওঠে স্বরাজের দাবি। ছাত্রদের স্কুল-কলেজ ছেড়ে আসার জন্য তিনি দারুণ উৎসাহ দিচ্ছেন।
সুরেন্দ্রনাথ এ পন্থা কিছুতেই মানতে রাজি নন। এ যে ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নিয়ে জুয়া খেলা! রাজনীতির স্বার্থে ছাত্রদের বলিদান। ছেলেরা এমনিতেই লেখাপড়া করতে চায় না, তার ওপর গুরুজন শ্রেণীর নেতারা তাদের স্কুল কলেজ ছাড়ার উস্কানি দিলে তারা ধেই ধেই করে নাচবে। তাদের ভবিষ্যৎ গোল্লায় যাবে! যারা ছাত্রদের এই ভাবে ব্যবহার করতে চায়, তারা আসলে ছাত্রদের শত্রু!
সুরেন্দ্রনাথের এই রকম নীতিবাগীশ জ্যাঠামশাইয়ের মতন ভূমিকা দেখে অনেকে আড়ালে তাঁর সম্পর্কে কটুক্তি করতে শুরু করেছে। কেউ কেউ বলাবলি করছে যে সুরেন্দ্রনাথের এই মতামতের পিছনে ব্যক্তিগত স্বার্থ আছে। তাঁর নিজের একটি কলেজ আছে, ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করলে সেই রিপন কলেজও যে বন্ধ হয়ে যাবে।
বিপিন পাল, রবীন্দ্রনাথ, সতীশ মুখার্জি প্রমুখরা ছাত্রদের পড়াশুনো বন্ধ করার কথা মোটেই বলেন না। ছাত্ররা সরকারি বিদ্যালয়ে যাবে না, তাদের জন্য গড়া হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এ দেশের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার ভার নেবে এ দেশেরই মানুষ। সরকারকে গ্রাহ্য করা হবে না, জাতীয় নেতারা প্রণয়ন করবেন নতুন পাঠ্যসূচি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। গত সপ্তাহে এই পান্তির মাঠেই কী কাণ্ড হল! ওই বিষয় নিয়ে একটি সভা ডাকা হয়েছিল, বিভিন্ন বক্তা মতপ্রকাশ করছেন, হঠাৎ সুবোধ মল্লিক নামে এক শিক্ষিত ধনাঢ্য যুবক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আর বেশি কথার প্রয়োজন কী? অবিলম্বে কাজ শুরু হোক। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকল্পে আমি এক লক্ষ টাকা দিতে রাজি আছি!
প্রথমে কয়েক মুহূর্ত বিস্ময়, তারপর উল্লাসধ্বনিতে সভাস্থল ফেটে পড়ল! এক লক্ষ টাকা? কতখানি দেশপ্রেম থাকলে এক জন মানুষ এই বিপুল অর্থ দান করতে পারে। অনেকে চেঁচিয়ে উঠল, রাজা, রাজা! সেই সভাতেই জনতার পক্ষ থেকে রাজা খেতাব দেওয়া হল সুবোধ মল্লিককে। একদল ছাত্র দৌড়ে গিয়ে সুবোধচন্দ্রকে কাঁধে তুলে নিল। বাড়ি ফেরার সময় তাঁর গাড়ির ঘোড়া খুলে নিয়ে টানতে লাগল ছাত্ররা।
সুবোধচন্দ্রের দৃষ্টান্তে আরও দান আসতে লাগল। কেউ কেউ দিতে চাইলেন সুবোধচন্দ্রের চেয়েও বেশি। কেউ দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি। বয়কট আন্দোলনের এহেন সার্থকতার কথা অনেকেই কল্পনা করতে পারেনি।
সুরেন্দ্রনাথ তবু গোঁ ধরে বসে আছেন। জনসাধারণের মধ্যে ইংরেজ-বিরাগ যে এতখানি পুঞ্জীভূত হয়েছে, তা যেন বুঝতে পারছেন না তিনি। রাজশক্তির সঙ্গে সর্ব বিষয়ে অসহযোগিতার কথা তিনি মনে স্থান দেন না, তাঁর মতে এটা অসম্ভব! আজকের সভায় সুরেন্দ্রনাথ আবার বললেন, আমি বয়কট আন্দোলনের পক্ষে, তার জন্য আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে অবশ্যই, কিন্তু ছাত্রগণ, আমি ক্লাস বয়কটের কথা একবারও বলিনি। এটা তোমাদের পক্ষে চরম ক্ষতিকর। ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ! আগে লেখাপড়া, তারপর অন্য কিছু! তোমরা—
হঠাৎ হো-হো-হো-হো করে একটা শব্দ হল। এক কোণ থেকে একদল চেঁচিয়ে উঠল, দুয়ো দুয়ো!
সেই গোলমাল, চ্যাঁচামেচি বাড়তে লাগল ক্রমশ। কয়েক জন কমলালেবুর খোসা ছুঁড়ে মারল মঞ্চের দিকে। বিবর্ণ মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন সুরেন্দ্রনাথ। সভার উদ্যোক্তারা দু হাত তুলে বলতে লাগলেন, চুপ করুন, সাইলেন্স প্লিজ, বসুন, বসুন! কিন্তু কে শোনে কার কথা! সুরেন্দ্রনাথ আর মুখ খুলতেই পারলেন না। এত বড় একজন প্রবীণ নেতা! সারা ভারতে অনেক নেতা আছে, কিন্তু একজন কোনও দেশনায়ক নেই! রাজশক্তির প্রতিপক্ষ হিসেবে নতুন ভারতীয় সমাজে এমন একজন দেশনায়কের প্রয়োজন, যাঁর কথা সকলে মান্য করবে। রবীন্দ্রনাথ সেই দেশনায়কের পদটি সুরেন্দ্রনাথকে দিতে চেয়েছিলেন। সেই সুরেন্দ্রনাথের এমন হেনস্থা!
অপমানিতভাবে, ঘাড় নিচু করে তিনি সভাস্থল থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ভরত আর হেম প্রতিটি মিটিং শুনতে যায়, আজও এসেছে। সুরেন্দ্রনাথের বক্তব্য তাদেরও পছন্দ হয়নি, তারাও প্রতিবাদে কণ্ঠ মিলিয়েছে। ডন সোসাইটির বাড়ির বারান্দায় দাঁড়ানো একদল ছাত্রও হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চিৎকার করছিল, সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভরত হঠাৎ বিস্মিত হল। হেমের কাঁধে চাপ দিয়ে বলল, ওই দিকে দ্যাখো! যে ছাত্রদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন এক দীর্ঘকায় শ্বেতাঙ্গিনী। শ্বেতবসনা, মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা। চিনতে ভুল হবার কোনও উপায় নেই। হেম বলে উঠল, ওই তো ভগিনী!
হেমের পা অনেকটা ঠিক হয়ে এসেছে, ঈষৎ খুঁড়িয়ে হাঁটে। সভা ভেঙে গেছে, সকলে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতে দিতে ফিরে যাচ্ছে। হেম বলল, ভরত, চলো ভগিনীর সঙ্গে দেখা করে আসি।
কয়েক বছর আগে যখন সার্কুলার রোডে গুপ্ত সমিতি খোলা হয়েছিল, তখন মাঝে মাঝেই দল বেঁধে যাওয়া হত নিবেদিতার কাছে। তিনি এই উগ্রপন্থি যুবকদের উৎসাহ দিতেন, তাদের নানা দেশের বিপ্লবের ইতিহাস পড়াতেন। অনেক দিন আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ নেই।
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ভরত আর হেম উঠে এল দোতলায়। ডন সোসাইটির কক্ষে একটি টেবিল, গুটিকয়েক চেয়ার ও একটি আলমারি ছাড়া আর কোনও আসবাব নেই, কক্ষটি বেশ বড়, আলোচনা সভার সময় মেঝেতে মাদুর পেতে দেওয়া হয়। দেওয়ালে ভারতের একটি মানচিত্র।
এখন সেখানে বসে আছেন নিবেদিতা, সতীশ মুখুজ্যে ও আরও কয়েকজন। ভরত ও হেম ঢুকে এসে নিবেদিতাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যেতেই তিনি ওদের হাত ধরে ফেলে বললেন, না, না, প্রণাম না, নমস্কার, নমস্কার।
দু’জনকেই তিনি চিনতে পেরে কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করলেন।
নিবেদিতার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে এই ক’ বছরে। শীর্ণকায় বা স্থূল হননি, বয়েসের ছাপও ঠিক বোঝা যায় না, সেই নীল চোখ, সেই সোজা হয়ে বসে থাকার ভঙ্গি, তবু শরীরের শ্রী যেন আর আগের মতন নেই। কেমন যেন পুরুষালি ভাব, মুখের চামড়াও নয় আগেকার মতন কোমল। ছেলেছোঁকরারা আড়ালে তাঁকে বলে ধবলগিরি।
ভরত ও হেম ফাঁকা দুটি চেয়ারে বসে পড়ল। নিবেদিতা জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা আজকের সভায় উপস্থিত ছিলে? সুরেন্দ্রবাবুকে এরকম হেল্প করা মোটেই ঠিক হয়নি। এতে মুভমেন্টের ক্ষতি হবে। এখন দলাদলি ভাল না, ভাল না। এতে নিজেদের শক্তিক্ষয় হয়।
মধ্যবয়েসী সতীশ মুখোঁপাধ্যায়ের পোশাক অতি সাদাসিধে, ধুতি চাদর, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। নভেম্বরের মাঝামাঝি, কদিন ধরে বেশ শীত পড়েছে, নিবেদিতা গায়ে একটা শাল জড়িয়েছেন, কিন্তু সতীশচন্দ্রের কোনও শীত বস্ত্র নেই।
তিনি বললেন, সুরেনবাবুকে ও ভাবে অপমান করা অবশ্যই অন্যায় হয়েছে। কিন্তু উনি ছাত্রসমাজের মুড বুঝতে পারছেন না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার ঘোষণা হয়ে গেছে, তবু উনি পুরনো মত আঁকড়ে ধরে আছেন। ছাত্ররা তো ক্ষেপে যাবেই!
নিবেদিতা বললেন, আমিও ওঁর মত সমর্থন করি না। তা বলে ওঁর ভিন্ন মত প্রকাশে বাধা দেওয়া হবে কেন? সকলেরই মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। চিল্লামিল্লি করে ওঁকে থামিয়ে দেওয়া, না, না, ঠিক নয়, ঠিক নয়। উনি যদি এখন এই মুভমেন্ট থেকে সরে দাঁড়ান, তার ফল খুব খারাপ হবে। শীঘ্রই কংগ্রেসের কনফারেন্স হবে কাশীতে, সেখানে উনি যদি এই ইস্যু না তোলেন, তা হলে বাংলার জোর থাকবে না। ওঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে ওঁকে ফিরিয়ে আনা উচিত।
সতীশচন্দ্র বললেন, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন, আমি চেষ্টা করব। মুশকিল হচ্ছে কী জানেন, এর মধ্যেই দলাদলি শুরু হয়ে গেছে। এমন কেউ নেই, যিনি সমস্ত দলের উধ্বে।
পাশ থেকে এক জন ফস করে বলে উঠল, আহা, স্বামী বিবেকানন্দ অকালে চলে গেলেন। তাঁর কথা খুব মনে পড়ে। তিনি যদি বেঁচে থাকতেন, তিনি উপযুক্ত নেতৃত্ব দিতে পারতেন। তাঁর কথা সবাই মানত!
সতীশচন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন, না, সবাই মানত না। ব্রাহ্মরা মানত না। আমাদের অধিকাংশ নেতাই তো ব্রাহ্ম।
সেই ব্যক্তিটি বলল, তা হতে পারে। ব্রাহ্মদের প্রভাব শুধু কিছু শিক্ষিত লোকের মধ্যে। স্বামী বিবেকানন্দ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী ভ্রমণ করেছেন, আপামর জনসাধারণ তাঁকে চিনেছে। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ডাক দিলে সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠত! আমার খুব মনে হয়, এই সময় ওঁর মতন একজন নেতার প্রয়োজন ছিল!
মুখ মোছার ছলে নিবেদিতা ঘাড়টা অন্য দিকে ঘোরালেন। অন্যদের সামনে তিনি আবেগ প্রকাশ করতে চান না। কারুর মুখে হঠাৎ স্বামীজির নাম শুনলে এখনও তাঁর চোখ জ্বালা করে ওঠে, গলার কাছটায় ব্যথা ব্যথা বোধ হয়।
জীবিত থাকলে স্বামীজি সত্যিই কি এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসতেন? নিবেদিতা স্বয়ং এক সময় তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি বারংবার দৃঢ় স্বরে বলেছেন, তিনি সন্ন্যাসী, রাজনীতিতে মাথা গলানো তাঁর কাজ নয়। মানুষের সেবা করা তাঁর মতে ঈশ্বরসেবার সমান, কিন্তু রাজশক্তির বিরুদ্ধাচরণ করতে চাননি কখনও। আবার এ কথাও ঠিক, স্বামীজি ছিলেন তীব্র দেশপ্রেমিক, পরাধীনতার জ্বালা তিনি অনুভব করতেন। ভীরুতা ও ক্লৈব্য ত্যাগ করে দেশের মানুষকে জাগাবার কথা তিনি অনেকবার বলেছেন। তিনি তো এরকম জনজাগরণ দেখে যাননি। হাজার হাজার মানুষ পথে নেমে পড়েছে, পুলিশের চোখ রাঙানি ও লাঠি অগ্রাহ্য করে বয়কট কার্যকর করে যাচ্ছে, এ দৃশ্য দের্শেও কি তাঁর বেলুড় মঠের কুঠরিতে চুপ করে বসে থাকতে পারতেন?
সতীশচন্দ্র বললেন, স্বামী বিবেকানন্দর অকালমৃত্যু খুবই দুঃখজনক ঘটনা তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু বেলুড় মঠে তাঁর যে গুরুভাইরা রয়েছেন, তাঁরাও তো কেউ এই সময়ে একবারও মুখ খোলননি। তাঁরা অতি সাবধানে রাজনীতি থেকে দূরে সরে আছেন।
পাশের ব্যক্তিটি বলল, স্বামীজির মানসকন্যা তো আমাদের মধ্যেই রয়েছেন। তিনি
সতীশচন্দ্র নিবেদিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ, কিন্তু সে জন্য ভগিনীকে বেলুড় মঠের সংস্রব ত্যাগ করতে হয়েছে। ভাই, আমি আর একটা কথা বলি। মৌলবি মুজিবর রহমান, মৌলবি লিয়াকৎ হোসেন প্রতিবাদ আন্দোলনের বিভিন্ন সভায় বক্তৃতা করছেন। কিন্তু কোনও হিন্দু
সন্ন্যাসীকে কেউ কখনও দেখেছ? হিন্দু সন্ন্যাসীদের মধ্য থেকে কিন্তু একজনও এগিয়ে আসেননি।
হেম এবার গলাটা উঁচু করে বলল, আমি একটা কথা বলব? আমার মনে হয়, ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। দু-চার জন মৌলবি বক্তৃতা করলেও কিন্তু সামগ্রিক ভাবে মুসলমানরা এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে আছে। তাদের আমরা একাত্মক করে নেবার চেষ্টা করেছি কি? অধিকাংশ সভাতেই বেদ-উপনিষদ-গীতার উদ্ধৃতি দেওয়া হয়। তাতে কি মুসলমানরা কাছে আসবে?
সতীশচন্দ্র বললেন, মুসলমানরা যোগ দেয়নি কে বলল? বর্ধমানের আবুল হোসেন সাহেব কী করেছেন জানেন? তিনি সভায় গিয়ে বক্তৃতা করার সময় দু গেলাস জল আনতে বলেন। তারপর কুতার জেব থেকে দুটি পুরিয়া বার করে বলেন, এই দেখুন, এর মধ্যে আছে বিলিতি চিনি আর বিলিতি নুন। এই দুটো যে-ই মিশিয়ে দেব, অমনি ভেসে উঠবে গরু আর শুয়োরের রক্ত। এর পরেও কি হিন্দু ও মুসলমান ভাইরা বিলিতি চিনি আর নুন খাবেন? তাঁর এই বক্তৃতায় খুব কাজ হয়, তখনই সকলে বিলিতি চিনি আর নুন বর্জনের শপথ নেয়। র সতীশচন্দ্র হা-হা করে হাসতে লাগলেন।
হেম তবু বলল, তিনি বর্ধমানের লোক। এদিককার কিছু কিছু মুসলমান সমর্থন করছেন ঠিকই, কিন্তু পূর্ববাংলায় কী ঘটছে? সেখানকার মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গের পক্ষে। ঢাকার নবাব সলিমুল্লা জোর প্রচার চালাচ্ছেন। দলবল নিয়ে তিনি বয়কট ভাঙার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, অনেক জায়গায় মারামারি শুরু হয়ে গেছে।
সতীশচন্দ্র বললেন, ঢাকার নবাব কি মুসলমান সমাজের নেতা নাকি? তাঁর সে শিক্ষা-দীক্ষা আছে! নিজের স্বার্থে তিনি ইংরেজদের ধামাধরা হয়েছেন। নিজের কিছু প্রজাদের তিনি দলে টেনেছেন, কিন্তু সব মুসলমান তাঁকে মানে না। এই তো কদিন আগে এক সভায় সভাপতিত্ব করলেন বগুড়ার নবাব আবদুল শোভান চৌধুরী। তিনি ঢাকার নবাবের চেয়ে কম কীসে?
হেম বলল, তিনিও কি সমগ্র মুসলমান সমাজের নেতা? নবাব-জমিদার হলেই নেতা হওয়া যায়? মুসলমানদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত, সর্বজনশ্রদ্ধেয়, উদারমনা নেতা কে আছেন? খুঁজে বার করতে হবে, তাঁর মতামত নিতে হবে।
নিবেদিতা চুপ করে শুনছিলেন। এবার মৃদু কণ্ঠে বললেন, ব্যারিস্টার চৌধুরী। তিনি
সতীশচন্দ্র বললেন, ঠিক! ব্যারিস্টার আবদুল রসুল চৌধুরী, বিলেত ফেরত উচ্চশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান মানুষ। এপ্রিল মাসে বরিশালে যে প্রাদেশিক কনফারেন্স হবে, তাতে তাঁকে সভাপতি করার চেষ্টা চলছে।
হেম জিজ্ঞেস করল, তিনি রাজি হয়েছেন?
সতীশচন্দ্র বললেন, মিস নোব্ল-এর সঙ্গে তাঁর ভাল পরিচয় আছে। আপনিই বলুন না, তিনি রাজি হবেন না?
নিবেদিতা বললেন, আমি যত দূর জানি, তিনি মিস্টার সুরেন ব্যানার্জিকে কথা দিয়েছেন।
হেম বলল, আমি এক দিন ওর সঙ্গে দেখা করে মুসলমান সমাজের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাই। তবে যাই-ই বলুন, আমাদের নেতারা বেশি হিন্দু হিন্দু ভাব করলে এ আন্দোলনের ক্ষতিই হবে। সন্ন্যাসীরা দূরে আছেন, দূরে থাকাই ভাল।
এর পর আলোচনা অন্য দিকে ঘুরে গেল।
বিলিতি দ্রব্য বয়কট নিয়ে যে উন্মাদনা দেখা দিয়েছে, তা কত দিন টিকে থাকবে জনসাধারণের মধ্যে? সব মানুষের ব্যবহারযোগ্য এত স্বদেশি দ্রব্য কোথায়? গুজরাতের কলগুলি কাপড় সরবরাহ করে কুল পাচ্ছে না। এখানে বঙ্গলক্ষ্মী মিল, মোহিনী মিল স্থাপিত হয়েছে, অনেকে ঘরে ঘরে চরকা বসিয়ে সুতো কাটছে, তাও যথেষ্ট নয়। বিলিতি দ্রব্য বর্জন করে ইংরেজের অর্থনীতিতে জোর ধাক্কা দিতে গেলে আরও বেশ কিছু দিন কৃচ্ছসাধন করা দরকার। এর মধ্যেই মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে। আর একটা ব্যাপারও ঘটছে, বাজারে যত জার্মান ও জাপানি জিনিসপত্র ছিল সেগুলিতে স্বদেশি ছাপ মেরে বিক্রি করা হচ্ছে, বয়কটপন্থিরা তা মেনে নিয়েছে। বিলিতি জিনিস না হলেই হল।
সতীশচন্দ্র বললেন, এই আন্দোলন টিকিয়ে রাখতে হলে পত্র-পত্রিকায় জোর প্রচার চালিয়ে যাওয়া দরকার। আরও পত্রিকা চাই। বিশেষত বাংলা পত্রিকা, যা সাধারণ মানুষ পড়বে। সঞ্জীবনী’ আর ‘সন্ধ্যা পত্রিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে বটে, কিন্তু আরও কাগজ বার করতে হবে।
একজন বলল, ওঃ, ‘সন্ধ্যা’ কাগজে প্রত্যেক সংখ্যায় ব্রহ্মবান্ধব কী জ্বালাময়ী লিখছেন! পড়লেই রক্ত গরম হয়ে যায়। হোল ইন্ডিয়াতে বাঙালির মতন এ রকম লেখা আর কেউ লিখতে পারবে না!
সতীশচন্দ্র বললেন, তা হলে তোমাদের একটা ঘটনা বলি, শোনো! একবার রেওয়ার মহারাজ এসেছিলেন কলকাতা ভ্রমণে। প্রসন্নকুমার ঠাকুরের বাড়িতে তাঁর একদিন নেমন্তন্ন ছিল। খুব এলাহি বন্দোবস্ত। একটা খুব কারুকার্য করা দারুণ সিংহাসনে বসতে দেওয়া হল মহারাজকে। পাশের দেওয়ালে ঝুলছে মণি-মুক্তো বসানো একখানা খাপসুদু তলোয়ার। সেই তলোয়ারটা হাতে নিয়ে মহারাজ ঈষৎ বিদ্রুপের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, বাঙালিরা এখনও তলোয়ার ব্যবহার করে নাকি? প্রসন্নকুমার ঠাকুর উত্তর দিলেন, না, বাঙালিরা অনেক দিন ধরেই তলোয়ার ধরতে ভুলে গেছে। কিন্তু বাঙালিরা এখন কলম ধরেছে, এখন আর তাদের তলোয়ার ব্যবহার করার দরকার হয় না!
গল্প শেষ করে সতীশচন্দ্র বললেন, কেমন জুতসই উত্তর দিয়েছিলেন বলে!
হেম বলল, মুখুজ্যেমশাই, এটা কিন্তু সুবিধেবাদীর মতন কথা হল। ইংরেজরা কলম চালাতেও জানে, অস্ত্রও ধরতে পারে। আমরা কি শুধু কলম হাতে নিয়েই বীরত্ব দেখাব?
ভরত সাধারণত চুপ করেই থাকে, বেশি লোকের সামনে মুখ খোলে না। এখন সেও আর থাকতে পারল না, ফস করে বলে উঠল, জাপানিরা কিন্তু শুধু কলমের জোরে রুশদের হারায়নি!
নিবেদিতা মুখ তুলে সপ্রশংস দৃষ্টিতে এই যুবকটির দিকে তাকালেন। স্পষ্ট বোঝা গেল, তিনি এদের সমর্থন করেন।
রাশিয়াকে ইংরেজরাও সমীহ করে! ভারত সীমান্ত দিয়ে রুশ আক্রমণের জুজুতে ইংরেজরা অনেকবার বিচলিত হয়েছে। সেই মহাশক্তিমান রুশ বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেছে জাপানের মতন একটি ছোট দেশ। এবং জাপানিরা এশিয়ার মানুষ। এতকাল ধারণা ছিল যে ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ জাতিগুলি অপ্রতিরোধ্য, তাদের তুলনায় প্রাচ্যদেশীয়রা হীনবল। সেই ধারণা উল্টে দিয়েছে জাপান, তারা রাশিয়াকে যুদ্ধে পরাজিত করে সন্ধি করতে বাধ্য করেছে। জাপানের এই জয় থেকে ভরসা পেয়েছে এশিয়ার অন্য দেশগুলি। তা হলে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যও চিরকালীন হতে পারে না। এই বিশ্বাস ক্রমশ দানা বাঁধছে বলেই সাধারণ মানুষ এখন পুলিশকেও তেমন ভয় পাচ্ছে না।
গত বৎসর জাপানিদের এই জয় কাহিনী এখনও লোকের মুখে মুখে ঘুরছে।
সতীশচন্দ্র বললেন, হ্যাঁ, তা বটে। তবে আমাদের তো সে রকম অস্ত্র নেই, এখন যুব সমাজকে সাহসী করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হচ্ছে!
হেম বলল, মিত্ৰসাহেবের ওই লাঠি খেলা আর কুস্তির আখড়া, আর সরলাদেবীর বীর পূজা আর প্রতাপাদিত্য উৎসব, এই নিয়ে যুব সমাজকে গড়তে গেলে যে আরও অন্তত একশো বছর লেগে যাবে! এ সব তো ছেলেখেলা। দেখছেন না, ইংরেজ সরকার এ সব অবজ্ঞার চোখে দেখে বলেই কোনও দিন বাধা দিতে আসেনি। ইংরেজরা শক্তের ভক্ত, নরমের যম। যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল চাই। অ্যান আই ফর অ্যান আই, এ টুথ ফর এ টুথ! বন্দুক-পিস্তলের জবাব দিতে হবে বন্দুক-পিস্তল দিয়ে।
সতীশচন্দ্র বিস্ময়-কৌতুকের সঙ্গে বললেন, বাঃ! বন্দুক! ইয়াংম্যান, তুমি খোয়াব দেখছ নাকি? ও সব কোথায় পাবে? বিপিন পালমশাই যে বলেন, নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ, সেটাই সঠিক পথ। তার জন্য দরকার প্রচুর মনোবল।
ভরত আড়চোখে হেমের দিকে তাকাল। হেমের কোমরে যে প্রায় সময়ই একটা পিস্তল গোঁজা থাকে, তা কেউ জানে না।
বিদায় নেবার জন্য ওরা উঠে দাঁড়াতেই নিবেদিতা বললেন, তোমরা একদিন এসো আমার বাড়িতে।
নমস্কার জানিয়ে ওরা বেরিয়ে এল রাস্তায়। সাহেবপাড়ায় বিজলি আলো এসে গেলেও এ দিকে এখনও গ্যাসের বাতি জ্বলে। অধিকাংশ দোকানপাটই বন্ধ হয়ে গেছে। হঠাৎ শীত পড়ে যাওয়ায় সাথে মানুষজন কম। একটি বাড়িতে হরিনাম সংকীর্তন হচ্ছে উচ্চকণ্ঠে।
দু হাতে আড়মোড়া ভেঙে হেম বলল, অনেকক্ষণ বকর বকর করা হয়েছে। এ বার অন্য কিছু করা যাক। এখন একটা থিয়েটার দেখতে গেলে কেমন হয়?
ভরত নীরস কণ্ঠে বলল, নাঃ, থিয়েটারে যাব না।
হেম বলল, কেন, চলো না। সাড়ে আটটায় শো শুরু হয়। গিরিশবাবু বুড়ো বয়েসে নতুন নাটকটি নাকি খুব জমিয়েছেন, মেসের লোকরা বলাবলি করছিল।
ভরত বলল, তোমার ইচ্ছে হয়তো তুমি যাও। আমার থিয়েটার পাড়াতেই পা দিতে ইচ্ছে করে না।
হেম বলল, তুমি অত নীতিবাগীশ হলে কেন? মাঝে মাঝে থিয়েটার দেখতে দোষ কী?
ভরত বলল, নাঃ নীতিবাগীশ নই। তবে থিয়েটার আমার রং-মাখা সঙের নাচ মনে হয়। মেয়েগুলোকে মনে হয় অবিকল কাকাতুয়া পাখি।
হেম হেসে বলল, সে কী হে! নয়নমণি, কুসুমকুমারী এই সব অ্যাকট্রেসদের তো খুব খ্যাতি। আমি নয়নমণির অ্যাকটিং একবার দেখেছি, খাসা গানের গলা।
ভরত আড়ষ্ট হয়ে গেল। নয়নমণি? না, সে কিছুতেই যাবে না। এই নামের আড়ালে যে আসল মানুষটি, তাকে এখন আর ভরত স্বপ্নেও দেখতে পায় না। আবার তার স্মৃতি ফিরিয়ে আনতেও চায় না সে।
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হেম, এখন মেদিনীপুরে ফিরে গেলে হয় না? তুমি যা দেখতে এসেছিলে, তা তো দেখা হল।
হেম বলল, এ তো বড় তাজ্জবের কথা। মেদিনীপুরে আমার না হয় বউ-ছেলেমেয়ে আছে, তোমার কে আছে? তোমার ফিরে যাওয়ার কীসের টান?
ভরত বলল, আমার খামার বাড়িতে কত গাছপালা লাগিয়েছি। তারা আমায় টানে। কোন গাছে ফুল এসেছে, কোনটাতে ফল ফলেছে তা দেখতে ইচ্ছে করে। এই শীতে কত গাছের পাতা ঝরছে, সেই পাতা ঝরার শব্দও শুনতে বড় ভাল লাগে।
হেম বলল, গাছপালার চেয়ে মানুষের আকর্ষণ আমার বেশি। এখানকার মানুষের মুখে যে নতুন উদ্দীপনা দেখছি, তা ছেড়ে এখন মফস্বলে গিয়ে বসে থাকব, পাগল নাকি? আমার দৃঢ় ধারণা, বঙ্গভঙ্গ রদ হবেই, সেই শেষ না দেখে আমি যাব না। ঠিক আছে, যদি থিয়েটার দেখতে না চাও, চলো, আজ কোনও দোকানে গিয়ে ভাল খাবার খাই। রোজ রোজ মেসের রান্না মুখে রোচে না।
কলুটোলার দিকে একটা কাবাব-রুটির দোকান অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। সে দিকে হাঁটতে লাগল দু জনে।
একটু পরে হেম জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা ভরত, সেবারে সার্কুলার রোডে আমাদের আখড়া ভেঙে যাবার পর আমাদের দলের ছেলেরা অনেকেই টপাটপ বিয়ে করে ফেলল। তুমি কিছু করলে না। আমাদের মেদিনীপুরেও ভাল মেয়ের অভাব নেই, তুমি কারুর দিকে তাকাও না। একটা কথা সত্যি করে বলো তো, নারীজাতি সম্পর্কে তোমার কোনও আগ্রহ নেই? এমন উদাসীন ভাব দেখি কেন?
ভরত চুপ করে রইল। হেম তাকে খোঁচা মেরে বলল, কী হে, উত্তর দিচ্ছ না কেন? মনের মধ্যে কোনও পুরনো দুঃখ জমা আছে নাকি?
ভরত বলল, তুমি আমাকে মেদিনীপুরে নিয়ে গিয়ে মহা উপকার করেছ। ওই খামার বাড়িতে একলা দিনের পর দিন থাকতে থাকতে আমার চোখ খুলে গেছে। প্রকৃতির মধ্যে একটা নারী সত্তা আছে, আমি তার প্রণয়ে আবদ্ধ হয়ে গেছি। আর কোনও রক্ত-মাংসের নারীর প্রয়োজন নেই আমার।
হেম চক্ষু সঙ্কুচিত করে বলল, এটা যেন গালভরা কথা হয়ে গেল। তুমি যা বলছ, তা কি সত্যি। নাকি কোনও কিছু চাপা দেবার জন্য এরকম বলছ? শুধু প্রকৃতিতে শরীরের দাবি মেটে?
ভরত হেসে বলল, জোরে পা চালাও। এর পর আর কোনও দোকান খোলা পাবে না।