2 of 2

৫৪. লম্বা রেল গাড়ির বাষ্পীয় ইঞ্জিন

লম্বা রেল গাড়ির বাষ্পীয় ইঞ্জিন দৈত্যের মতন ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে এসে থামল হাওড়া স্টেশনে। থামার পরেও সে ধোঁয়া উদগিরণ করতে লাগল। থামার সঙ্গে সঙ্গে কামরা থেকে সাধারণ যাত্রীদের নামার নিয়ম নেই, দরজা খোলা হয় না। আগে ফার্স্ট ক্লাশ থেকে সাহেবলোকরা অবতরণ করবে, তাদের মালপত্র কুলিরা নিয়ে যাবে, তারপর সাধারণ যাত্রীদের পালা। তৎক্ষণাৎ হুড়োহুড়ি, শোরগোল শুরু হয়ে গেল। যারা পৌঁছাল এবং যারা এই ট্রেনে যাবে, সেই দুই দলের চলতে থাকে ধাক্কাধাক্কি, একদল কামরা থেকে নামবার আগেই অন্য দল ওঠার চেষ্টা করে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান টিকিট পরীক্ষক এই ঠেলাঠেলি দেখে বক্রভাবে হাসছেন। এই নেটিভদের মধ্যে কিছুতেই শৃঙ্খলা আনা যাবে না। শৃঙ্খলাবোধ জিনিসটাই ভারতীয়দের জাতিগত চরিত্রে নেই। সেই জন্যই তো বারবার এরা সংখ্যালঘু বিদেশি আক্রমণকারীদের কাছে মস্তক বিক্রয় করে।

ভরতের বুকের মধ্যে যেন ধক ধক শব্দ হচ্ছে। বর্ধমান ছাড়াবার পর থেকেই চাপা উত্তেজনা বোধ করছে সে। অনেকদিন পর তার কলকাতায় ফেরা। তাও সে স্বেচ্ছায় আসতে চায়নি, শিউজনের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গী হতেই হল। ভরত অনেকবার অনিচ্ছা প্রকাশ করলেও কলকাতায় না আসার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ সে দেখাতে পারেনি। সে রকম কোনও কারণও তো নেই, সে এই শহর থেকে বিতাড়িতও হয়নি, কোনও রকম অপরাধ করেও পালায়নি।

শিউপূজনের আন্তরিক অনুরোধ উপেক্ষা করাও তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। শিউপজন অনেক সাহায্য করেছে তাকে, আগুনে সব পুড়ে যাবার পর ভরতকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে। একটা পায়ের গোড়ালির হাড় ভেঙে গিয়েছিল, প্রায় দুমাস শুয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিল ভরত, তখন শিউপূজনের বাড়ির লোকজনই তো সেবা করেছে তার। এখন সুস্থ হলেও মাঝে মাঝে বাঁ হাঁটুর মালাইচাকি টনটন করে।

প্ল্যাটফর্মে টেবিল পেতে বসে আছে কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবকরা। এই ট্রেনে উত্তর ভারতের নানা রাজ্য থেকে বহু প্রতিনিধি এসেছে, তারা লাইন দিচ্ছে এক একটা টেবিলের সামনে। শিউপজন ভরতকে নিয়ে এক জায়গায় যেতেই একজন স্বেচ্ছাসেবক বলল, কোন স্টেট থেকে এসেছেন? বিহার? বিহারের ডেলিগেটদের থাকার জায়গা হয়েছে রিপন কলেজে। সুরেন বাড়জ্যের রিপন কলেজ কোথায় চেনেন তো? না চিনলে শেয়ালদা স্টেশনের কাছে চলে যান। ওখানে যে-কোনও লোককে জিজ্ঞেস করলে বলে দেবে।

জাহাজ চলাচলের জন্য হাওড়ার সেতু এখন খুলে রাখা হয়েছে, তাই গঙ্গা পেরুতে হল নৌকায়। গলুইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে বুক ভরে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল ভরত। অনেক দিন পর তার বুকে এল বাংলার বাতাস। তার নিয়তি তাকে এখানে টেনে এনেছে। আবার কী ঘটবে কে জানে!

এপারে এসে ওরা একটা ফিটন গাড়ি ভাড়া করল। শিউপজন ধনী ব্যবসায়ী, সে ইচ্ছে করলেই হোটেলে উঠতে পারে। কিন্তু সে কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানেই থাকবে ঠিক করেছে। অনেক বড় বড় উকিলব্যারিস্টারও সাধারণ প্রতিনিধিদের সঙ্গে থাকা-খাওয়া করছেন। নেতা হতে গেলে প্রথম প্রথম এই সব প্রতিনিধিদের সম পর্যায়ে নেমে এসে তাদের মন জয় করতে হয়।

ফিটনের জানলা দিয়ে ভরত উৎসুকভাবে দেখছে দু’পাশের দৃশ্য। এই কবছরে কলকাতা শহরের বহিরঙ্গের বিশেষ কিছু পরিবর্তন ঘটেনি, বাড়িঘরগুলি একই আছে। প্রায় দশ বছর পর। ছাত্র বয়েসে এই সব রাস্তা দিয়ে কতবার পায়ে হেঁটে ঘুরেছে ভরত।

হঠাৎ পাশ দিয়ে পক পক শব্দ করে কী একটা গাড়ি যেতেই ওরা চমকে উঠল। শিউপূজন জিজ্ঞেস করল, ওটা কী?

ভরত একটু সামলে নিয়ে ভাল করে দেখে বলল, এটাই মনে হচ্ছে মটোরকার, অর্থাৎ অটো বা অটোমোবিল! ইদানীং এই গাড়ির কথা খুব শোনা যাচ্ছে। শিউপূজন বলল, এই সেই গাড়ি? এ কী বিচ্ছিরি!

গাড়িটার ওপর ও চারদিক খোলা। একটি গোল স্টিয়ারিং ধরে টুলের ওপর বসে আছে চালক। গাড়ি চালাবার জন্য তার কোনও পরিশ্রম নেই, সে এক হাতে একটি রবারের বলের মতন বস্তু টিপে পক পক শব্দ করছে অনবরত। গাড়িটা চলছে ধক ধক করে কেঁপে কেঁপে। অবশ্য গতি আছে বেশ।

শিউপূজন জিজ্ঞেস করল, কেউ ঠেলছে না, কিংবা কিছুতে টানছে না, তা হলে এ গাড়ি চলছে কী করে?

ভরত বলল, আমরা যে রেলগাড়িতে এলাম, তা কি কেউ ঠেলেছে বা টেনেছে, বাষ্প-যন্ত্র টেনে নিয়ে এল। এ গাড়িও টানছে সে রকম কোনও যন্ত্র।

শিউপজন নাসিকা কুঞ্চিত করে বলল, কিন্তু ভরতভাইয়া, আমাদের দু’ঘোড়ার জুড়িগাড়ি কত সন্দর। কিংবা চার ঘোড়ার গাড়ি যখন ঝমঝমিয়ে চলে, তখন মনে হয় না যে রাজা-মহারাজদের এই রকম গাড়িই মানায়। তার সঙ্গে এই ন্যাড়া গাড়িগুলোর কোনও তুলনা চলে? আমি বলে রাখলাম দেখো, এ গাড়ি চলবে না! কেউ নেবে না।

ঘোড়ার গাড়ির ঘোড়াগুলোও এই অদ্ভুত দর্শন মটোর গাড়ির দিকে অবজ্ঞার চক্ষে তাকাচ্ছে।

রিপন কলেজ ছুটি দিয়ে কলেজের ঘরগুলিতে বেশ কিছু প্রতিনিধিদের রাখার ব্যবস্থা হয়েছে, সেখানে অব্যবস্থার চূড়ান্ত। যত লোক এসেছে, সেই তুলনায় ঘরের সংখ্যা কম। চেয়ার-বেঞ্চগুলি বারান্দায় জড়ো করা ছিল, অনেকে সেইগুলিও সাজিয়ে বারান্দায় খানিকটা অংশ দখল করে প্রায় সংসার সাজিয়ে ফেলেছে। তার ফলে পদে পদে বাধা পড়ছে যাতায়াতের পথে। কিছু আগে জল ঢেলে ঘরগুলি ধোওয়া হয়েছিল, এখনও জল থিকথিক করছে চারদিকে। এরই মধ্যে আবার কেউ কেউ স্বপাকে খাবার জন্য ছোট ছোট উনুন ধরিয়ে ফেলেছে, ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে।

শিউপূজন ও ভরত হাওড়া স্টেশনের স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে একটি কুপন এনেছিল, সেটির জোরে একটি ঘরের দখল পেল। তখন তাদের মনে পড়ল, তারা তো বিছানা আনেনি। গরমকাল হলে তবু কথা ছিল, এখন বেশ শীত, বিছানাকম্বল ছাড়া তো রাত কাটানো যাবে না। অন্য ঘরে অনেকেই বিছানা পাততে শুরু করেছে, তারা সবাই কি বিছানা এনেছে? পাশের ঘরটিতে উঁকি মেরে সে কথা জিজ্ঞেস করতেই জানল যে, দুচারজন বুদ্ধি করে বেডিং সঙ্গে এনেছে বটে, তবে অনেকেই আনেনি। তা হলে কি নতুন বিছানা কিনতে হল? না, তারও দরকার নেই, এখানে বিছানা ভাড়া পাওয়া যায়, মশারি সমেত, মোড়ের মাথায় হোটেলের উল্টো দিকে ডেকরেটার্সের দোকান।

শিউপূজন বলল, আজব শহর, এখানে বিছানাও ভাড়া পাওয়া যায়!

একজন কেউ টিপ্পনি কাটল, শুধু বিছানা কেন, চাইলে সারা রাতের জন্য শয্যাসঙ্গিনীও ভাড়া পাওয়া যেতে পারে এই শহরে।

কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দিতে এসেছে বলে যে রঙ্গরসিকতা করতে পারবে না, এমন কোনও কথা নেই। কেউ কেউ এর চেয়ে অনেক গাঢ় রসের কথা বলতেও দ্বিধা করে না।

কোনওভাবে রাত্রি কেটে গেল, সকালবেলা আর এক বিপর্যয়। এত মানুষ প্রাতঃকৃত্য সারবে। কোথায়? স্কুল কলেজের শৌচালয় এমনিতেই অপরিচ্ছন্ন থাকে, এখন এত মানুষের ব্যবহারে তা নরককুণ্ডের রূপ ধারণ করেছে। দুর্গন্ধে কাছেই যাওয়া যায় না। কোনও ধাঙড়ের টিকিরও দেখা নেই। শিউপূজন কানে পৈতে লাগিয়ে, হাতে গাড় নিয়ে নীচে নেমে এসে এই অবস্থা দেখে আমসিপানা মুখ করে ভরতকে বলল, কী সর্বনাশ, এখানে থাকা যাবে কী করে!

নানা প্রদেশের, নানা ভাষার মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছে। প্রত্যেকেই নিজের নিজের ভাষায় অভিযোগ শুরু করেছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, দূর থেকে শোনা যায় শুধু একটা কলরোল। অভ্যর্থনা সমিতির একজন সদস্য সকালের চা-জলপানের ব্যবস্থা করতে যেই এলেন, অমনই সকলে হই হই করে ঘিরে ধরল তাঁকে। তিনি আসলে যাচ্ছিলেন বাল গঙ্গাধর তিলকের সেবাযত্ন করতে, তিলক আছেন এই বাড়ির অন্য অংশে, প্রিন্সিপালের কোয়ার্টারে, সেখানে ব্যবস্থার কোনও ত্রুটি নেই। বিব্রতভাবে তিনি বলে উঠলেন, তাই তো, কেউ সাফাইয়ের ব্যবস্থা করেনি, সে কী কথা। ভলান্টিয়াররা কোথায়? ভলান্টিয়ার, ভলান্টিয়ার

হাঁকডাক করে একজন স্বেচ্ছাসেবককে আনা হল। অভ্যর্থনা সমিতির সদস্য তাকে বললেন, ওহে হরদুলাল, শিগগির ধাঙড়ের ব্যবস্থা করো। এই সব ভদ্রলোকদের কত কষ্ট হচ্ছে, এঁরা বাইরে থেকে এসেছেন

তিনি হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন তিলকের কাছে। হরদুলাল চেঁচিয়ে বামাচরণ, বামাচরণ বলে একজনকে ডাকল। বামাচরণ এলে হরদুলাল বলল, ওহে বামাচরণ, শিগগির দুচারটি মেথর ডেকে আনো, প্রতিনিধিরা পাইখানায় যেতে পারছেন না। আমার অন্য কাজ আছে। হরদুলাল সরে পড়তেই বামাচরণ আবার হাঁক দিল, ওহে ভক্তিভূষণ, একবার এদিকে এসো তো, এই পাইখানা-পেচ্ছাবখানাগুলো কী করে সাফ করা যায় একটু দেখো তো, ধাঙরপট্টি থেকে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে এসো, এনাদের খুব অসুবিধে হচ্ছে, আমাকে আবার ফুল জোগাড় করতে হবে, অনেক ফুল

এই অবস্থার মধ্যেও ভরত হাসি দমন করতে পারছে না। বাঙালিদের সে ভাল করেই চেনে, জেরা কোনও কাজে হাত লাগাবে না, দায়িত্ব হস্তান্তরের ব্যাপারে তারা খুব পটু। স্বেচ্ছাসেবকরা একজন আর একজনের নাম হাঁকাহাঁকি করছে, সারা দিনেও কোনও ব্যবস্থা হবে কিনা সন্দেহ।

বেগ সামলাতে না পেরে শিউপূজন বসে পড়েছে উঠোনের এক কোণে। লজ্জার মাথা খেয়ে এরকম আরও কয়েকজন এখানে সেখানে বসে পড়ে। ভরত কোন দিক থেকে যে চোখ ফেরাবে তা বুঝে পায় না। শুধু যে অস্বস্তি লাগে, তাই না, হঠাৎ ঝাঁকুনি লাগার মতন গা ঘিনঘিন করে ওঠে। ভরত তখনই ঠিক করে নিল, এখানে আর থাকা চলবে না।

এই সময় একটি অত্যাশ্চর্য কাণ্ড ঘটল। একজন লোক হাতে একটি নতুন ব্যাটার বান্ডিল ঝুলিয়ে নিয়ে এসে জটলার মাঝখানে দাঁড়াল। তারপর শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে, প্রথমে হিন্দিতে, তারপর ইংরেজিতে বলল, ভাই ও বন্ধুরা, আমার একটি নিবেদন অনুগ্রহ করে শুনুন। দেখাই যাচ্ছে, অভ্যর্থনা কমিটি মেথর-মুদ্দোফরাস নিযুক্ত করার ব্যবস্থা ঠিক মতন করেননি বা করতে পারেননি। আগামীকাল নিশ্চয়ই করবেন। শৌচালয়গুলি অত্যন্ত নোংরা, দৃষিত ও অস্বাস্থ্যকর অবস্থায়। রয়েছে। শৌচালয় ব্যবহার না করে শহরের সভ্য সমাজে জীবনধারণ করা যায় না, দেশোদ্ধারও করা যায় না। সুতরাং এগুলি আমাদেরই পরিষ্কার করে নিতে হবে। আমি বৈঠকখানা বাজার থেকে চারটি নতুন ঝাঁটা কিনে এনেছি। আমার সঙ্গে হাত লাগাবার জন্য আরও তিনজন অন্তত এগিয়ে আসুন!

সবাই স্তম্ভিত! এই লোকটা বলে কী! ভদ্রঘরের ছেলেরা নিজেরা ঝাঁটা হাতে নিয়ে পায়খানা পরিষ্কার করবে! তাতে জাত যাবে না! কলিকাল বলে কি বামুনকায়েত আর মেথর এক হয়ে যাবে?

সেই লোকটি ধুতি ও ফতুয়া পরা, চেহারায় তেমন কিছু বৈশিষ্ট্য নেই, শ্যামবর্ণ, মধ্যম আকৃতি, নাকটা একটু লম্বা, বয়স হবে ত্রিশ-বত্রিশ। তার দাঁড়াবার ভঙ্গির মধ্যে রয়েছে আত্মবিশ্বাস। ঠোঁটে মৃদু হাসি। তার ইংরেজি উচ্চারণ খুব পাক্কা। তবে তাকে এখানে অন্য আর কেউ চেনে না।

সে আবার বলল, আপনারা কি এ কাজটা ঘৃণ্য মনে করছেন? আমাদের প্রত্যেকের শরীরের মধ্যেই তো খানিকটা করে পূরীষ ও প্রস্রাব জমে থাকে। তা হলে তো নিজের শরীরটাকেই ঘৃণা করতে হয়! উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা কারুর শরীরই পূরীষ-প্রস্রাব মুক্ত নয়। তা হলে? আসুন, হাত মেলান, দেখবেন নিজের কাজ নিজে করার মধ্যে বিশেষ আনন্দ আছে।

তবু কেউ এগিয়ে গেল না।

লোকটি তাতেও রাগ করল না বা আর কথা বাড়াল না। হাত জোড় করে নমস্কার জানাল সবাইকে। তারপর একটি ঝটা নিয়ে সে মল-মুত্র ঝাঁট দিতে শুরু করে দিল।

ভরত আস্তে আস্তে সরে যাবার উপক্রম করছিল, হঠাৎ তার খুব বিবেক-দংশন হল। এতগুলি মানুষের মধ্যে ওই একজন শুধু একদিকে, বাকি সকলে অন্য দিকে। ওই লোকটি যেন এক অসম সাহসী যোদ্ধার মতন, আর অন্যরা সবাই কাপুরুষ!

সে ছুটে গিয়ে একটা ঝটা তুলে নিল। লোকটি সস্মিতভাবে বলল, এসো বন্ধু। আমি গুজরাত থেকে আসছি। এই প্রথম কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দিতে এলাম। আমার নাম এম কে গান্ধী। আর তুমি?

ভরত বলল, আমার নাম ভরতকুমার সিংহ, আমি …. আমি এসেছি পাটনা থেকে।

গান্ধী বলল, আমরা কিন্তু সব কটা শৌচালয় পরিষ্কার করবো না। কেউ যেন মনে না করে, আমরা বিনা খরচের মেথর। সবাইকে বোঝাতে হবে, এটা তাদেরই কাজ। আমি ঠিক মতন উদ্বুদ্ধ করতে পারিনি বলে অন্য আর কেউ হাত লাগাতে আসেনি।

গান্ধী ও ভরত যে দু’টি শৌচালয় পরিষ্কার করে দিল তা ব্যবহার করবার জন্য অন্যদের মধ্যে আবার ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গেল। এবং এই ব্যবহারকারীরাই পরে নির্লজ্জের মতন ঘৃণার চোখে তাকাতে লাগল ওই দুজনের দিকে। যদিও ওরা দুজন স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র পরেছে, তবু যেন ওরা অস্পৃশ্য। কেউ চিড়ে মুড়ি খেতে বসে হঠাৎ গান্ধী বা ভরতকে দেখতে পেলে মুখ ফিরিয়ে বসে। এমনিতেই এখানে বারো জাতের তেরো হাঁড়ি। এক প্রদেশের প্রতিনিধিরা অন্য প্রদেশের প্রতিনিধিদের হাতের ছোঁওয়াও খাবে না। এর পরেও আছে একই প্রদেশের মানুষের মধ্যে জাতের ভাগাভাগি। তামিলদের ছুঁৎমার্গ সবচেয়ে বেশি। খাদ্য গ্রহণের সময় অন্য কোনও জাতের মানুষকে দেখলেই তাদের সব কিছু দূষিত হয়ে যায়। তাই উঠোনের মাঝখানে খানিকটা জায়গা চ্যাঁচার বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে তামিল গোষ্ঠীর জন্য, সেখানেই তাদের রান্না বান্না, খাওয়া দাওয়া, হাত ধোওয়া, সব কিছু চলে। ভেতরটা অত্যন্ত নোংরা ও রাশি রাশি মাছি ভনভন করে। তবু অন্য মানুষের দৃষ্টি বাঁচিয়ে তাদের পবিত্রতা রক্ষা হয়।

গান্ধী নামে যুবকটির সঙ্গে ভরতের বেশ ভাব হয়ে গেল। সে অতি স্বল্পাহারী ও নিরামিষাশী, কিন্তু শরীরে আলস্য বলে কোনও বস্তু নেই। অতি ভোরে উঠে প্রাতভ্রমণ করে আসে কয়েক মাইল, ফিরে এসে প্রতিদিনই শৌচালয় ঘটিত সমস্যা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যরক্ষা বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে আলোচনায় বসে। সারাদিন ধরে সে ঘুরে ঘুরে কলকাতার দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখে, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়, লোকমান্য তিলক কিংবা গোখলের মতন প্রখ্যাত নেতাদের কাছে রাজনৈতিক ব্যাখ্যা শোনে। এতেও তার কর্মতৃষ্ণা মেটে না। কংগ্রেস অধিবেশনের আরও কয়েক দিন বাকি। সারা ভারত থেকে যত প্রতিনিধি এসেছে, তারা এই কদিন শুধু খাবেদাবে আর গল্পগুজব করে সময় কাটাবে কেন, তাদের প্রত্যেককেই কোনও না কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত করা উচিত।

গান্ধী এর আগেও একবার কলকাতায় এসেছিল বছর চারেক আগে। সেবার এসেছিল সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে, এখানে পরিচিত কেউ ছিল না। উঠেছিল গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে, অঙ্গে ছিল সাহেবি পোশাক, মাথায় শোলার টুপি পর্যন্ত। এবার সে এসেছে কংগ্রেসের একজন সাধারণ প্রতিনিধি হিসেবে। সে যে একজন বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার সে পরিচয়টাও কাউকে জানাতে চায় না। এখন সে রাস্তায় বেরুবার সময় প্যান্টালুনের ওপর পার্শিদের মতন গলাবন্ধ কোট পরে, মাথায় পাগড়ি।

লোকটিকে খানিকটা মজারও মনে হয় ভরতের। এমন জোর দিয়ে এক একটা বিষয়ে কথা বলে যেন বিশ্ব সংসারে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের ওপর কী সব অবিচারের কথা সে বারবার উত্থাপন করে। এদেশে ইংরেজের অত্যাচার-অবিচারের শেষ নেই, দক্ষিণ আফ্রিকার কলোনিতে তার ব্যতিক্রম আর কী হবে।

গান্ধী কলকাতা শহর ঘুরে ঘুরে দেখতে চায়, ভরত তাকে রাস্তা চিনিয়ে সঙ্গে যাবার প্রস্তাব দিয়েছিল। গান্ধী ধন্যবাদের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছে। সে একা পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখবে, মাঝে মাঝে পথ ভুল করলেও ক্ষতি নেই, পায়ে হেঁটে না ঘুরলে শইর চেনা যায় না।

একদিন ঘুরতে ঘুরতে কালীঘাটের মন্দিরে পৌঁছে যাবার পর গান্ধীর এই শহর দেখার শখ অনেকটাই ঘুচে গেল। এই বিখ্যাত মন্দিরের কথা গান্ধী আগেই শুনেছিল। কাছাকাছি যেতে যেতেই দেখল পাল পাল পাঁঠা-ছাগল তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মন্দিরের দিকে। রাস্তার দুধারে সারিবদ্ধ হয়ে বসে আছে ভিখিরিরা, কতরকম তাদের কৃত্রিম আর্তরব। কিছু কিছু সাধুসন্ন্যাসীও ঘুরে বেড়াচ্ছে। মন্দির প্রাঙ্গণে গড়াচ্ছে রক্তস্রোত, কোথাও জমে থাকা রক্ত চাটছে কুকুর, হড়িকাঠে আর একটি ছাগবলির উদ্যোগ চলছে, ঢাক-ঢোল কাঁশির শব্দ ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে সেই অসহায় পশুটির মৃত্যুচিৎকার। কোথাও একটুও আধ্যাত্মিক পরিবেশ নেই, স্নিগ্ধ সৌন্দর্য নেই। এই দেবস্থানে শুধু বীভৎসতা আর হিংস্রতার প্রকাশ। গান্ধীর মাথা ঘুরতে লাগল, দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করল।

এক সাধু হাতছানি দিয়ে ডেকে বলল, এই বেটা, কোথা যাচ্ছিস, বোস এখানে!

গান্ধী এক বাড়ির রকে বসে ঘন ঘন নিশ্বাস নিয়ে খানিকটা সুস্থ হল। বাপরে বাপ, এরকম রক্তারক্তির দৃশ্য সে জীবনে কখনও দেখেনি, বাকি জীবনে ভুলতে পারবে না বোধহয়। মুখ ফিরিয়ে, সে জিজ্ঞেস করল, সাধু মহারাজ, এই পশুবলির সঙ্গে ধর্মের কী সম্পর্ক। আমায় একটু বুঝিয়ে দেবেন?

সাধুটি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, এর আবার বোঝাবার কী আছে? কোনও সম্পর্কই নেই। পশুবলি-টলির সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই! যে সব হিন্দুরা নিজেরা মাছ মাংস খায়, তারাই দেবতার নামে পশুবলি দেয়। আর যে সব হিন্দু নিরামিষাশী, তাদের কখনও পশুবলি দিতে দেখেছ?

গান্ধী বলল, তা হলে আপনারা এই পশুবলির বিরুদ্ধে প্রচার করেন না কেন?

সাধুটি বলল, কিছু প্রচার-ট্রচার করা আমাদের কাজ নয়। আমরা ঈশ্বরের আরাধনা করার জন্য সংসার ছেড়েছি।

গান্ধী বলল, তা হলে এই রক্ত-ক্লেদ মাখা পরিবেশ ছেড়ে আপনারা পবিত্র কোনও স্থানে ঈশ্বরের আরাধনা করতে যেতে পারেন না!

সাধুটি দুহাত উল্টে বলল, আমাদের কাছে সব জায়গাই সমান।

পাশে দাঁড়িয়ে একটি কলেজে-পড়া ছেলে এই কথাবার্তা শুনছিল। সে এবার টিপ্পনি কাটল, হ্যাঁ। সাধুদের কাছে সব জায়গাই সমান। তবে, যে-সব সাধুরা মদ-মাংস-মাগি নিয়ে সাধনা করে তারাই এই রকম মন্দিরের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। আজকাল আর হিমালয়ে সাধুদের মন টেকে না।

সাধুটি চিমটে তুলে ছোঁকরাটিকে মারতে তাড়া করল।

সারাদিন মন ভার হয়ে রইল গান্ধীর। বারবার চোখে ভেসে ওঠে সেই বীভৎস রক্তের দৃশ্য। পশুবলির কথা সে আগে শুনেছে বটে, কিন্তু তার এই রূপ, তা সে জানত না। সদ্য কাটা পশুর ধড় তখনও ছটফট করছে, তার পাশেই দাঁড়িয়ে নির্বিকার মুখে হাসি-গল্প করছে অন্য লোকেরা। এই বলির ব্যাপারটা বাংলা দেশেই বেশি হয়।

সন্ধেবেলা এক বাঙালিবাবুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতে হল গোখলের সঙ্গে। রুচিশীল পোশাক পরিচ্ছদ পরা সব ব্যক্তি, দু’একজন মহিলাও সকলের সামনে বসে গান গাইলেন। অনেকেই বেশ শিক্ষিত, বাঙালিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আরাম পাওয়া যায়। তারা অনেক কিছু জানে, এমনকী দক্ষিণ আফ্রিকার বুয়র যুদ্ধ সম্পর্কেও খোঁজখবর রাখে।

গান্ধী ভাবল, এই সব ভদ্র, সুসভ্য মানুষেরা কি জানে না যে ধর্মের নামে তাদের মন্দিরগুলিতে অসহায় পশুদের কী নৃশংশভাবে বলি দেওয়া হচ্ছে।

ভদ্রলোকের সঙ্গে কথায় কথায় প্রসঙ্গটা উত্থাপন করতেই তিনি অবহেলার সঙ্গে বললেন, ওতে কী হয়, পাঁঠা-ছাগলদের তো ব্যথার বোধই নেই। বলি দেবার সময় এত জোরে জোরে ঢাক-ঢোল বাজানো হয় যে, পাঁঠারা মৃত্যু-যন্ত্রণাও টের পায় না।

এমন অদ্ভুত যুক্তি ও সিদ্ধান্ত গান্ধী কখনও শোনেনি। পাঁঠারা কি মানুষদের জানিয়ে দিয়েছে যে তাদের ব্যথা-ট্যাথা লাগে না, মৃত্যুর কষ্টও তারা বুঝতে পারে না। তারা শুধু শুধু আর্ত চিৎকার করে!

গান্ধী কলল, তা হলেও… দেবস্থান পবিত্র স্থান, সেখানে জীবহত্যা, অত রক্তের ছড়াছড়ি, দেখতেও তো খারাপ লাগে!

ভদ্রলোক অধর উল্টে বললেন, কে ওসব বলি-টলি দেখতে যায়! আমি যাই না। হ্যাঁ, মাংস খেতে ভাল লাগে তা ঠিকই, তা কোথায় সে পাঁঠা কাটা হল, দোকানে না ঠাকুরের সামনে, তা নিয়ে কে মাথা ঘামায়!

গান্ধী বুঝতে পারে না, এটা নির্লিপ্তি না উদাসীনতা, না সূক্ষ্মবোধের অভাব?

রাত্রে রিপন কলেজে ফিরে এসে সে অনেকক্ষণ ভরতের সঙ্গে গল্প করে। শীত পড়েছে। জাঁকিয়ে। অধিকাংশ প্রতিনিধিই তাড়াতাড়ি শয্যায় আশ্রয় নেয়। গান্ধীর ঘুম কম। সে ঘুমোতে যায় সকলের শেষে, জেগে ওঠে সকলের আগে। ভরত আর সে অন্য কোথাও স্থান না পেয়ে সিঁড়িতে বসে সারাদিনের অভিজ্ঞতার কথা বলে।

কালীঘাট মন্দিরের দৃশ্যের বর্ণনা দিতে দিতে বারবার শিহরিত হচ্ছে গান্ধী। ভরত অবশ্য বলিদান অনেক দেখেছে। ত্রিপুরাতেও অনেক মন্দিরেই নিয়মিত বলি হয়। ওড়িশায় কিন্তু তেমন চল নেই। বিহার, যুক্তপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রেও বিশেষ চোখে পড়ে না। কালীঘাট মন্দিরে অনেকেই মানতের বলি দিতে আসে, এক একদিন দুশো-আড়াইশো ছাগবলিও হয়।

গান্ধী জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা ভাই, একটা বিষয়ে একটু বুঝিয়ে দাও তো। এই বাঙালি জাতি এত বিদ্যোৎসাহী, এমন তীক্ষ্মবুদ্ধি, আবার আবেগপ্রবণও বটে, সমাজ ও ধর্মসংস্কারের জন্য তারা কত কা করেছে, তাদের গানবাজনা কত সুন্দর, তবু এই বাঙালিরাই ধর্মের নামে পশুবলির মতন এমন বর্বর প্রথা মেনে নিতে পারে? কেউ প্রতিবাদ করে না।

ভরত বলল, বাঙালিরা কী রকম জাত তুমি শোনো তা হলে। বাঙালিরা ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করে, ধর্মসংস্কারের ব্যাপারে কেউ কিছু বললেই গেল গেল রব তোলে, কিন্তু এই বাঙালিরাই ব্যক্তি জীবনে ধর্মের প্রায় কোনও নির্দেশই মানে না। সততা, পবিত্রতা, সেবা, এই সব ব্যাপারে তারা প্রায় অধার্মিক। বাঙালিরা খুব পরের সমালোচনা করে, পরনিন্দা করে কিন্তু আত্মসমালোচনা করে না। বাইরে খুব উদার মত প্রচার করে, নিজের পরিবারের মধ্যে অতি রক্ষণশীল। খবরের কাগজে তর্জন গর্জন দেখলে মনে হবে খুব সাহসী, আসলে অত্যন্ত ভীরু। নিজের মা-বোন-স্ত্রীকে যদি কোনও দস্যু চোখের সামনে ধর্ষণ করে যায়, তা হলেও বাধা দিতে সাহস করবে না। বাঙালিদের কিছু কিছু গান-বাজনা সত্যি ভাল বটে, কিন্তু কত রকম বিকট শব্দকে যে এই সমাজ প্রশ্রয় দেয়, তার ঠিক নেই। তুমি তো এখনও মাঝরাতে ‘বল হরি হরি বোল’ রব শোনোনি। হরির নাম শুনলে ভয়ে পিলে চমকে ওঠে। মোট কথা হল, বাঙালিরা বাইরে যতই উদার, শিক্ষাভিমানী, রুচিশীল ভাব দেখাক, আসলে তারা ভেতরে ভেতরে ভণ্ড! মুখে যা বলে, নিজে তা বিশ্বাস করে না। এমন ভণ্ড তুমি আর কোথায় পাবে।

গান্ধী বিস্মিতভাবে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল ভরতের দিকে। তারপর বলল, বাঙালিদের ওপর তোমার খুব রাগ দেখছি। তুমি বুঝি বাঙালি নও?

ভরত ইদানীং সর্বত্র বলে, আমি বাঙালি নই, আমি আসামের মানুষ। এখন অবশ্য তা বলল না। সে হঠাৎ খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, শরীরে খুব রাগ এসে গিয়েছিল, রাগের কারণ সে নিজেই বুঝতে পারল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, নাঃ, আমিও ওদেরই একজন, আমারও এই সব দোষ আছে।

গান্ধী বলল, কিন্তু তুমি তো বেশ আত্মসমালোচনা করলে। বাংলায় এত বড় বড় মানুষ আছেন, কেউ কি এই বলিদান বন্ধ করার কথা বলেননি? এতে যে মহান হিন্দু ধর্ম সম্পর্কেই অন্যদের ভুল ধারণা হবে।

ভরত বলল, বড় বড় লোকদের কথা জানি না। তবে আমাদের একজন কবি বারবার প্রতিবাদ করেছেন, একটা উপন্যাসে, তারপর নাটকে, ‘বিসর্জন’ নাটকটির অভিনয়ও হয়েছে, তা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু আমি পড়েছি, বড় অপূর্ব। ত্রিপুরা রাজ্য নিয়েও বাংলার কেউ আগে এমন কিছু লেখেননি। কবির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তুমি নাম শুনেছ?

গান্ধী বলল, না শুনিনি। উনি কি শুধু বাংলায় লেখেন? ইংরিজিতে কিছু অনুবাদ হয়েছে? ভরত বলল, তা আমি জানি না। ইংরিজিতে কিছু বেরিয়েছে বলে তো মনে হয় না। গান্ধী বলল, আমি তো বাংলা জানি না, অনেকদিন ভারতেই ছিলাম না। বাঙালি কবির লেখা পড়ব কী করে, বলো। এই কবি প্রতিবাদ করেছেন?

ভরত বলল, এই কবির বাবা আরও বিখ্যাত। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অনেকে তাঁকে এখন মহর্ষি বলে।

গান্ধী এবার উৎসাহিত হয়ে বলল, অবশ্যই তাঁর নাম জানি। বিলেতে থাকার সময় … ওখানে অনেক ব্রাহ্মদের কথা শুনেছি। আমি ব্রাহ্মদের সম্পর্কে ভাল করে জানতে আগ্রহী। প্রতাপ মজুমদারের বক্তৃতা শুনেছি একবার।

ভরত বলল, উনি তো কেশব সেনের দলের। ব্রাহ্মদের এখন অনেকগুলি ভাগ, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেন আদি ব্রাহ্ম সমাজের গুরু।

গান্ধী বলল, আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব নিশ্চিত। কংগ্রেসের অধিবেশন হয়ে গেলে আরও কয়েকদিন থেকে যাব ভাবছি। কলকাতা শহরটা ভাল করে দেখব, বাঙালিদের ভাল করে চিনব।

পরদিন গান্ধী আর নগর পরিক্রমায় বেরিয়ে সোজা চলে এল কংগ্রেস অফিসে। অভ্যর্থনা সমিতি দুবেলা খাওয়াচ্ছে, তার বদলে সে, কিছু শ্রমদান করতে চায়। কিন্তু কার কাছে সে প্রস্তাব দেবে?

অনেক বড় বড় নেতা এসেছেন এবারের সমাবেশে যোগ দিতে। সভাপতি হয়েছেন দিনশা ওয়াচা, তা ছাড়া এসেছেন ফিরোজ শা মেটা, চিমনলাল শেতলবাদ। গোখলে ও তিলককে নিয়ে মহারাষ্ট্রের দলটি বেশ প্রবল। সভাপতিকে হাওড়া স্টেশন থেকেই বিরাট শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট একটি বাড়িতে। স্বেচ্ছাসেবকদের দৌরাত্ম্যে তাঁর কাছে এখন আর পৌঁছনোই যাবে না। ফিরোজ শা মেটা প্রায় রাজকীয় বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত, তিনি বম্বে থেকে এসেছেন নিজের খরচে, ট্রেনে নিজস্ব সালুন ভাড়া নিয়ে, এখানে এসেও উঠেছেন বড় হোটেলে।

একমাত্র তিলকই রয়েছেন সাধারণ প্রতিনিধিদের সঙ্গে রিপন কলেজে। বহিরাগত নেতাদের মধ্যে। তিলকই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। তিনি বিলাসী নন, সরল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত, কিন্তু রাজা-মহারাজদের মতন প্রতিদিনই যেন নিজের কক্ষে একটা দরবার বসান। বিছানার মাঝখানে সোজা হয়ে বসে থাকেন তিলক, লোকজনের নানান প্রশ্নের উত্তর দেন একটুও দ্বিধা না করে তীক্ষ্ম ভাষায়, চক্ষু দুটি যেন ঝকঝক করে। একমাত্র তাঁর মুখে হাসি ফোটে তাঁর বন্ধু মতিলাল ঘোষ এলে। মতিলাল সদাহাস্যময় পুরুষ।

তিলকের চেয়ে গোখলের সান্নিধ্যেই গান্ধী বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করে। দু’জনের চরিত্র একেবারে বিপরীত, গোখলে ধীর স্থির, ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। আর তিলক কথায় কথায় দপ করে জ্বলে ওঠেন, স্বভাবে উগ্র ও চরমপন্থি। এই দুজনের মধ্যে একটা রেষারেষির ভাবও রয়েছে। গান্ধী গোখলের কাছে কাজের প্রস্তাব দিতে তিনি বললেন, বাবু ভূপেন্দ্রনাথ বসু ও জানকীনাথ ঘোষাল হলেন এবারের কংগ্রেসের দুই সম্পাদক, তুমি তাঁদের সঙ্গে কথা বলো।

আর তিনদিন পর অধিবেশনের উদ্বোধন, দুই সম্পাদকই খুব ব্যস্ত। ভূপেন্দ্রনাথ গান্ধীর কথা শুনে বললেন, আমি তো ভাই তোমায় কোনও কাজ দিতে পারছি না, তুমি ভাই ঘোষালবাবুর কাছে গিয়ে বলে দেখো ভো, উনি যদি কিছু পারেন।

একটা প্রকাণ্ড টেবিলের এক পাশে বসে আছেন জানকীনাথ, প্রায় মুখ ডুবিয়ে আছেন কাগজের স্কুপে। পুরো দস্তুর সাহেবি পোশাক, এখন অবশ্য কোটটি চেয়ারে ঝোলানো, জামার বোতামগুলি খোলা। মুখ তুলে তিনি এই শ্যামলা রঙের লোগা যুবকটির পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, নাম কী?

গান্ধী বলল, এম কে গান্ধী।

জানকীনাথ বলল, এম কে মানে? মুরলিকৃষ্ণ?

গান্ধী বলল, আজ্ঞে না, মোহনদাস করমচাঁদ।

জানকীনাথ বললেন, ওহে মোহনদাস, তুমি নিজে থেকেই কাজ করতে চাইছ, এ তো ভাল কথা। কিন্তু আমি যে কাজ দিতে পারি, তা অতি সাধারণ কেরানির কাজ। তুমি তাতে রাজি?

গান্ধী বলল, অবশ্যই। আমার সাধ্যমতন যে-কোনও কাজ করতেই আমি রাজি আছি।

জানকীনাথ বললেন, বাঃ, এই তো চাই! যুবকদের এ রকম মনোভাব থাকলে দেশের অনেক উপকার হয়।

কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবককে ডেকে বললেন, ওহে, শোনো শোনো, এই ছোঁকরাটি কী বলছে, কোনও রকম কাজেই এর আপত্তি নেই, নিজে থেকে কাজ চাইতে এসেছে।

গান্ধীর আকৃতি, বেশভূষা দেখে স্বেচ্ছাসেবকরা খুব একটা মুগ্ধ হল না।

জানকীনাথ এক তাড়া কাগজের স্তূপের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, মোহনদাস, এখানে রাশি রাশি চিঠি জমে আছে। ওই চেয়ারটায় বসে এগুলো পড়তে শুরু করো। শত শত লোক রোজ আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, আমি কী করব বলো তো? অত লোকের সঙ্গে দেখা করে তাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেবার মতন সময়ই বা কোথায়, চিঠিগুলিই বা পড়ি কখন? আমার সাহায্যের জন্য কোনও লোক দেওয়াও হয়নি। তুমি চিঠিগুলো পড়ে দেখো, যেগুলো খুব প্রয়োজনীয় মনে হবে, আমাকে দিয়ে।

গান্ধী বেশ খুশি হয়েই প্রতিটি চিঠি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে লাগল।

নানারকম লোকজন আসছে যাচ্ছে, তাতেও তার মনোযোগ বিঘ্নিত হল না। জানকীনাথ এক একবার উঠে চলে যাচ্ছেন কোথাও যাবার জন্য তিনি উঠে দাঁড়াতেই একজন আদালি ছুটে এসে তাঁর জামার বোম লাগিয়ে, কোট পরিয়ে দিচ্ছে। অপরাহের দিকে তিনি একবার উঠে দাঁড়িয়ে আদালি, আদালি বলে হাঁক দিলেন। সেই লোকটিকে কাছাকাছি কোথাও দেখা গেল না। জানকীনাথ নিজের জুতোও পরতে পারেন না, একটা কাগজ নিয়ে পড়ছেন, টেবিলের তলা থেকে জুতো খুঁজতে খুঁজতে ডাকছেন আলিকে।

গান্ধী সকৌতুকে তাকিয়ে রইল জানকীনাথের দিকে। এ দেশের মানুষকে স্বাবলম্বী হতে আরও কতদিন অপেক্ষা করতে হবে!

উঠে গিয়ে সে নিজেই আদলির বদলে জানকীনাথের জামার বোম লাগিয়ে, কোট পরিয়ে দিল। জানকীনাথ অন্যমনস্কভাবে বললেন, তোমার কি আরও বাকি আছে? আমি চলি, কাল দেখা হবে।

পরদিন জানকীনাথ এসে দেখলেন, গান্ধী আগে থেকেই উপস্থিত হয়ে তার জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসে কাজ শুরু করে দিয়েছে। জানকীনাথকে দেখে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার। আপনার জন্য কয়েকটি চিঠির উত্তর মুসাবিদা করে রেখেছি—

জানকীনাথ গান্ধীর মুখের দিকে একটুক্ষণ অপলকভাবে তাকিয়ে রইলেন। তারপর খানিকটা লজ্জিতভাবে বললেন, কাল রাতে গোখলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তুমি যে একজন ব্যারিস্টার, সে কথা আমাকে বলনি কেন? দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের অধিকার নিয়ে যে আন্দোলন করছে, তুমিই সেই গান্ধী! আরে ছি ছি, তোমাকে দিয়ে আমি কেরানি আর আদালির কাজ করিয়েছি। কী লজ্জার কথা! কিছু মনে কোরো না।

গান্ধী বিনীতভাবে বলল, না, না, আমি কিছু মনে করিনি। আপনারা কংগ্রেসের কাজ করতে করতে মাথার চুল পাকিয়ে ফেলেছেন, আমাদের অল্প বয়েস, আমরা কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হতে চাই, আমাদের সব রকম কাজই শেখা উচিত। আপনাদের কিছু সেবা করার সুযোগ পেলেও আমরা ধন্য হব।

জানকীনাথ মুগ্ধভাবে বললেন, তোমার মতন যদি সবাই বুঝত! কংগ্রেসের সৃষ্টির সময় থেকে আমি আছি। মিস্টার হিউমের সঙ্গে সঙ্গে আমিও কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার কিছুটা কৃতিত্ব নিতে পারি। তবে তোমাকে দিয়ে জামার বোতাম লাগানোটা বড়ই লজ্জার ব্যাপার! তুমি দেখলে তো, কংগ্রেসের সেক্রেটারিকে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে, নিজের জামার বোতাম আটকাবারও সময় পান না।

দুজনেই এবার হেসে উঠলেন এক সঙ্গে।

আগের দিন জানকীনাথ প্রায় কথাই বলেননি গান্ধীর সঙ্গে, আজ কাজের বদলে গল্পই করতে লাগলেন শুধু। দুপুরে খাবার সময় ওকে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে। তাকে খাইয়ে অবশ্য আনন্দ পাওয়া যায় না। অনেক কিছুই সে খায় না, আমিষ তো ছোঁয় না বটেই, নিরামিষের পরিমাণও যৎসামান্য।

কংগ্রেসের মূল অধিবেশন দেখে গান্ধী বেশ হতাশই হল। দারুণ সাজানো গোছানো মঞ্চ, উদ্বোধনের জাঁকজমকও চোখ ধাঁধানো, তবু সব কিছুই যেন অন্তঃসারশূন্য। সব মিলিয়ে যেন তিন দিন ব্যাপী এক বিরাট তামাশা। বড় বড় নেতারা লম্বা লম্বা বক্তৃতা দিচ্ছেন ইংরিজিতে, এত ইংরিজির প্রাবল্য গান্ধীর পছন্দ হল না। ক’জন শুনছে আর ক’জন বুঝছে? দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এই অধিবেশনের যেন কোনওই যোগ নেই।

শেষ দিকে একটার পর একটা রেজোলিউশন পাস হয়। আগের দিকে বক্তৃতায় এত বেশি সময় নষ্ট হয় যে শেষের দিকে তাড়াহুড়ো করে সারতে হয় সব কাজ। দক্ষিণ আফ্রিকা বিষয়ে গান্ধীর নিজেরও একটা প্রস্তাব আছে, কিন্তু সেটা উত্থাপন করার জন্য সময়ই পাওয়া যাচ্ছে না। গান্ধী গোখলেকে ধরে বসে আছে।

মূল সভাপতি, সাবজেক্ট কমিটির সভাপতি ও অন্য সবাই এখন শেষ করার জন্য ব্যস্ত। ফিরোজ শা মেটা মাঝে মাঝেই বলছেন, আর কিছু নেই তো? আর কিছু নেই তো? একবার গোখলে বললেন, এম কে গান্ধীর একটা রেজোলিউশন আছে, আমি পড়ে দেখেছি, সেটা বেশ যুক্তিসঙ্গত। ফিরোজ শা বললেন, তুমি যখন দেখেছ, ভাল বলছ, তখন আর আমাদের দেখার দরকার নেই। পাস করিয়ে দাও।

সভাপতি ওয়াচা বললেন, গান্ধী, এ বিষয়ে বলার জন্য তুমি ঠিক পাঁচ মিনিট সময় পাবে—

গান্ধী উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করেছে, দুতিন মিনিট যেতে না যেতেই সভাপতি টং টং করে ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেন। গান্ধী থেমে গেল, হঠাৎ তার খুব অভিমান হল। এই কদিন সে দেখেছে অনেক বক্তা আর একটা কথা বলব বলে লাগিয়ে দিয়েছে আধ ঘণ্টা, তখন তাদের থামানোর জন্য বেল বাজানো হয়নি, আজ তার ক্ষেত্রে পাঁচ মিনিট সময় দিয়েও তা পূর্ণ হতে দেওয়া হল না। কিংবা এটা ওয়ার্নিং বেল? সে যাই হোক, গান্ধী আর একটাও কথা না বলে বসে পড়ল।

সবাই এক সঙ্গে হাত তুলে বলে উঠলেন। এই প্রস্তাব পাস, পাস।

কংগ্রেস অধিবেশন শেষ হয়ে যাবার পরেও গান্ধী রয়ে গেল কলকাতায়।

কালীঘাট মন্দিরের সেই অভিজ্ঞতা তার মনে আছে। এর মধ্যে সে জেনেছে যে ব্রাহ্মরা ধর্মের নামে পশুবলির সম্পূর্ণ বিরোধী। গান্ধী ঘুরে ঘুরে ব্রাহ্ম সমাজের তিন দলের নেতাদের সঙ্গেই দেখা করতে চাইল। আলাপ হল শিবনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে, প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের কাছ থেকে কেশব সেনের জীবনী গ্রন্থটি সংগ্রহ করে পড়ে নিল। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি গিয়েও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা হল না অবশ্য, স্বাস্থ্যের কারণে তিনি আর বাইরের লোকদের সঙ্গে দেখা করছেন না। কিন্তু সেখান থেকে গান্ধী খুব তৃপ্তি নিয়ে ফিরল। যথারীতি এবারেও ঠাকুর বাড়িতে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের জন্য। বাংলা গানগুলি কী মধুর, শ্রুতিসুখকর। দূর থেকে দেখা গেল কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গায়কের ভূমিকায়।

ব্রাহ্মদের দৃষ্টিভঙ্গি জানার পর গান্ধী ভাবল, এই শহরে অনেক ক্রিশ্চানও আছে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও জানা দরকার। স্থানীয় ক্রিশ্চানদের মধ্যে কালীচরণ ব্যানার্জি একজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি। ভারতীয় ক্রিশ্চানরা কংগ্রেসে যোগ দেয়নি, অনেকেই নিজেদের রাজার জাতের লেজুড় মনে করে। হিন্দু-মুসলমানদের সঙ্গে মেশে না। কালীচরণ সে রকম নন, তিনি কংগ্রেসের একজন উৎসাহী নেতা।

বাড়িতে কালীচরণ ধুতি-কুতা পরে থাকেন, সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালিদের সঙ্গে কোনও তফাত নেই, বিনয়ী ও ভদ্র মানুষ। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসে অতি কট্টর, গান্ধীর সঙ্গে প্রায় তর্কই লেগে যায় তাঁর। তাঁর মতে, হিন্দু ধর্মে মানুষের মুক্তি সম্ভব না, জন্মের আদি পাপ থেকে উদ্ধারের একমাত্র উপায় যিশুর শরণ। কালীঘাটের মন্দিরের উল্লেখ করে তিনি বললেন, ওই তত হিন্দু ধর্মের চেহারা।

এবার হিন্দু সমাজের একজন নেতার সঙ্গে দেখা করা দরকার। অন্য নেতাদের কাছে ঘোরাঘুরি করে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে যদি দেখা করা যায়, তার চেয়ে ভাল আর কিছু হতে পারে না। স্বামী বিবেকানন্দ পাশ্চাত্যে হিন্দু ধর্মের জয়ধ্বজা তুলে এসেছেন। শুধু ভক্তি দিয়ে নয়, তাঁর মতন ইদানীং কালে প্রবল বিশ্বাস ও মর্যাদার সঙ্গে হিন্দুধর্মের কথা আর কে বলতে পেরেছে। গান্ধী দূর থেকে মনে মনে বিবেকানন্দর অনুরাগী।

বেলুড়ে মঠ স্থাপিত হয়েছে, স্বামী বিবেকানন্দ সেখানে থাকেন। বেলুড় জায়গাটা ঠিক কত দূরে সে সম্পর্কে গান্ধীর ধারণা নেই, লোকের কথা শুনে ভেবেছিল হাওড়া স্টেশনের পাশেই। গঙ্গা পেরিয়ে সে হাঁটতে লাগল। এক সময় হাঁটতে হাঁটতেই পৌঁছে গেল বেলুড় মঠের প্রাঙ্গণে। বুক দুরুদুরু করছে। স্বামীজি কি দেখা করবেন তার সঙ্গে। তিনি এখন বিশ্ববিখ্যাত, কত ব্যস্ত মানুষ।

অন্য একজন সাধুকে দেখতে পেয়ে গান্ধী তাঁকে নিজের উদ্দেশ্য জানাল।

সাধুটি বললেন, ইস, খানিক আগে এলেন না? এই তো দশ মিনিট আগে স্বামীজি নৌকো করে চলে গেলেন কলকাতায়। ওঁর শরীর ভাল নয়, চিকিৎসার জন্য ওখানেই কয়েক দিন থাকবেন।

একটুর জন্য বিবেকান্দর সঙ্গে গান্ধীর দেখা হল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *