1 of 2

৭৫. পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে

অধ্যায় ৭৫ – পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে

খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে ১১০ সালের মাঝে হান-রাজবংশ সিল্করোড চালু করে। প্রথম হান-সম্রাট গাও জু একজন কৃষকের ছেলে হিসেবে জন্ম নেন। তিনি একীভূত চীনের শাসক হলেও পুরনো সাম্রাজ্যগুলো থেকে তখনো বিদ্রোহের আগুনের ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছিল।

গাও জু তার সাম্রাজ্যের শান্তি রক্ষার জন্য কঠোর আইন ও দয়াশীলতার সমন্বয় ঘটালেন। তিনি বিদ্রোহী ডিউকদের দমন করলেন, কিন্তু রাজ্যজুড়ে সাধারণ ক্ষমার প্রথাও চালু করলেন। আগে যে যাই করুক না কেন, তার সাম্রাজ্যে সবাই শান্তিমতো বসবাস করার অধিকার পায়। অর্থাৎ, আগে বিদ্রোহে অংশ নিয়ে থাকলেও নির্বিচারে গ্রেপ্তার বা হত্যার শিকার হতো না কেউই। শুধু কেউ যদি তাকে অভিশাপ দিতেন, তাহলে তাকে হত্যা করতেন সম্রাট গাও জু।

গৃহযুদ্ধের বদলে চীনের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় লড়াইগুলো হতো বাইরের শত্রুর সঙ্গে। চীনের মহাপ্রাচীর দেশটিকে সুরক্ষিত রাখতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

চীনের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়ায় বর্বর গোত্রের সংগঠিত জোট শিশুংনু। গোত্রদের এই জোটের প্রতিটি সদস্যের নিজ নিজ নেতা ছিল এবং তাদের সবার একজন রাজা বা চানিউ ছিলেন। বস্তুত এই শিশুংনু জোটটি দক্ষিণ চীনের সরকারব্যবস্থার আদলে তৈরি করা হয়েছিল।

এই মানুষগুলোযে সবাই ‘বর্বর’ গোত্রের সদস্য ছিলেন, তা নয়। অনেকেই তি, জাং ও অন্যান্য পুরনো রাজত্বের সদস্য ছিলেন। তারা ‘চীনের জনগণ’ থেকে খুব একটা ভিন্ন ছিলেন না।

হান সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে শিওংনু’র চানিউ ছিলেন মাও-তুন নামের এক সেনাপতি। অল্প কয়েকজন যাযাবর নেতার মধ্যে তিনি অন্যতম, যার নাম আজও ইতিহাসের পাতায় টিকে আছে। তিনি এই জোটকে বেশ সুসংহত পর্যায়ে নিয়ে যান। মঙ্গোলিয়ার কোনো এক অংশে তারা বার্ষিক সম্মেলনও করতে শুরু করলেন। সেখানে ভোটের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হত। গাও জু তিন লাখ সেনা সঞ্চয় করে উত্তরে তাদের মোকাবিলা করতে গেলেন।

তবে এক শতাব্দী আগে স্কাইথিয়ানদের অবলম্বন করা কৌশল কাজে লাগায় যাযাবররা। তারা পেছনে হটে এবং বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে থেকে এই বাহিনীর মুখোমুখি হওয়া থেকে রক্ষা পায়। সম্রাট ও তার বাহিনীর বেশিরভাগ অংশ এগিয়ে যাওয়ার পর চার লাখ ঘোড়সওয়ার বাহিনী নিয়ে গাও জুর বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যাযাবররা। এই পরিস্থিতি থেকে শুধু বের হয়ে আসতেই গাও জুর সাতদিন লেগে যায়।

এই ঘটনার পর গাও জু যাযাবরদের সঙ্গে শান্তিপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেন। তিনি শিওং জোটের সদস্যদের কাছে অর্থ উপহার পাঠালেন এবং মাও-তুনের সঙ্গে নিজের এক মেয়ের বিয়ে দিলেন।

হান সাম্রাজ্যের শুরুর বছরগুলো নিষ্কণ্টক ছিল না। মাত্র সাত বছর রাজত্ব করার পর ১৯৫ সালে গাও জুর মৃত্যু হলে তার তরুণ সন্তান হুই-তি সিংহাসনে বসে। তবে প্রকৃত ক্ষমতা ছিল প্রয়াত সম্রাটের বিধবা স্ত্রী কাও-হউর হাতে। তিনি তার সন্তানের পক্ষে রিজেন্ট হিসেবে শাসনকাজ চালান।

প্রাচীন আমলের রাজা-বাদশাহরা যেমন ছিলেন, গাও জু ও তাদের থেকে খুব একটা ভিন্ন ছিলেন না। কাও-হউ’র পাশাপাশি তার ছিল অসংখ্য বৈধ-অবৈধ স্ত্রী, রক্ষিতা, বান্ধবী ও তাদের গর্ভেও জন্ম নেয় অসংখ্য সন্তান। তবে গাও জু যখন দরিদ্র ও সাধারণ মানুষ ছিলেন, তখন তার একমাত্র স্ত্রী ছিল এই কাও-হউ। তিনি একের পর এক রাজ-সন্তান হত্যা করতে লাগলেন। বিষয়টি তরুণ রাজা হুই-তির ওপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ফেলে। তিনি বিষণ্ন হয়ে পড়েন এবং প্রতিদিন মদ খেয়ে চুর হয়ে পড়ে থাকতে লাগলেন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। এতে তার মা খুব একটা দুঃখ পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না।

ছেলের মৃত্যুতে তিনি তার নিজের পরিবার থেকে ভাই, বোন, চাচাতো- মামাতো ভাই-বোন ও অন্যান্য আত্মীয়দের সেনাপতি, মন্ত্রী, সচিব ও ডিউকের পদে বসিয়ে নিজের ক্ষমতাকে আরও সুসংহত করেন। তিনি হুই-তির দুই সন্তানকে পরপর সিংহাসনে বসিয়ে নিজেই দেশ শাসন অব্যাহত রাখেন।

আরও ৯ বছর ক্ষমতা দখল করার পর ১৭৯ সালে তিনি মারা যান। শেষের দিকে তিনি এতটাই অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছিলেন যে, কাও-হউর প্রয়াণের পর তার সব আত্মীয়স্বজনকে ধরে ধরে হত্যা করা হয়। তবে এই সংকটে চিন রাজবংশের মতো হান রাজবংশ বিলীন হয়ে যায়নি।

কাও-হউ’র পরিবারের সবাইকে হত্যার পর মৃত গাও জুর এক রক্ষিতার ঘরের পুত্র সন্তানকে সম্রাটের মর্যাদা দেওয়া হল।

ওয়েন্দি নামের তরুণ সম্রাট তার বাবার মতোই বিচক্ষণ ছিলনে। ১৭৯ থেকে ১৫৬ সালে পর্যন্ত প্রায় ২৩ বছরের শাসনামলে তিনি বড় কোনো ঝামেলায় জড়াননি। সবার সঙ্গে সদয় আচরণ করে চীনকে আরও সমৃদ্ধশালী করেন। প্রাকৃতিক কারণে তার মৃত্যু হয়। তিনি মরার আগ পর্যন্ত দেশ শাসন করেন।

৭৫.১ হানদের চীন

তার বাবার মতো তিনি যাযাবরদের মোকাবিলা করেন। তবে এরা শিশুংনু যাযাবর নয়, বরং উয়েঝি নামের নতুন একটি জোট। তারা প্রথমে শিওংনুর অঞ্চলের দিকে হামলা চালায়।

তবে এই ঝামেলার সমাধান শিওংনুই করে। তারা উয়েঝির রাজাকে হত্যা করে। সিমা কিয়ান বলেন, ‘তারপর তারা তার খুলিকে মদের পাত্রে পরিণত করে’।

এই পরাজয়ের পর উয়েঝি গোত্র ১৬০ সালে বাষ্ট্রিয়ায় চলে যায়। তারা এই অঞ্চল দখল করে অক্সাস নদী পর্যন্ত তাদের সীমানা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। এটাই ছিল দূরপ্রাচ্য থেকে আসা জনগোষ্ঠীর ভূমধ্যসাগরের কাছাকাছি কোনো অঞ্চলে বসতি স্থাপনের প্রথম, দীর্ঘস্থায়ী উদাহরণ। হান রাজবংশ এই বিপদ থেকে রক্ষা পেল, শিওংনু তাদের দক্ষতার প্রমাণ দিল এবং ওয়েন্দি বড় সেনাবাহিনী গঠনের ঝামেলা থেকে মুক্তি পেলেন।

এরপর আরো দুই সম্রাটের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ষষ্ঠ বা সপ্তম হান সম্রাট হিসেবে শাসনামল শুরু করেন উদি। তার ৫৩ বছরের শাসনামলে তিনি শিংনুদের বিরুদ্ধে চড়াও হন এবং তাদের ভূখণ্ডের কিছু অংশ দখলে নেন। এই সময় থেকে হান রাজবংশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কৌশলে পরিবর্তন আসে।

তবে এটাই তার সবচেয়ে বড় সাফল্য নয়। ততদিনে চীনের অভ্যন্তরের ও বাইরের বেশিরভাগ শত্রুর বিনাশ হয়েছে। সম্রাট তার সাম্রাজ্যকে প্ৰকৃত সাম্রাজ্য হিসেবে গড়ে তুলতে বেশকিছু উদ্যোগ নিলেন। তিনি করব্যবস্থা পুনর্বহাল করলেন। তিনি লোহা, লবণ ও মদের ব্যবসাকে একচেটিয়া সরকারি ব্যবসায় রূপান্তর করলেন। তিনি স্থানীয় কর্মকর্তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেন। হান সাম্রাজ্যের শুরুর দিকের স্বাধীনতার ভাব পুরোপুরি বদলে গেল। তিনি একধরনের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করলেন—প্রশাসনিক পদে নিয়োগের জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন তিনি।

উদি পশ্চিমে ঝাং কিয়ান নামে এক দূতকে পাঠালেন। সেখানে শুরুতে শিওংনুদের হাতে আটক হলেও পরবর্তীতে পালিয়ে যেয়ে তিনি বাষ্ট্রিয়া ও পার্থিয়া সফর করেন। সেখানে তিনি বিশ্বের উত্তর-অংশে উয়েঝি যাযাবরদের বলিষ্ঠ উপস্থিতি নিজের চোখে দেখেন। ১২৬ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি এসব ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানান।

৭৫.২ পার্থিয়ানরা

ঝাং কিয়ান আরও পশ্চিমে অবস্থিত পার্থিয়া সম্পর্কেও তথ্য নিয়ে আসেন। পার্থিয়ানরাও শিওংনুদের মতো যাযাবর জাতি থেকে উদ্ভূত। তারা ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করতেন।

পার্থিয়ানরা যুদ্ধ জয় করে ব্যাবিলনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছিল। ঝাং কিয়ান পার্থিয়ানদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে তার রাজাকে অবহিত করেন। তিনি বলেন, ‘পার্থিয়ানরা খুবই শক্তিশালী ও সুসংহত সভ্যতা। তাদের প্রাচীরে ঘেরা শহর রয়েছে। এরকম প্রায় ১০০ শহর আছে, যেগুলোর আকার ভিন্ন।’

পার্থিয়ানদের সাম্রাজ্য ‘উষ্ণ ও শুষ্ক’ এক ভূখণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যাকে ঝাং কিয়ান ‘তিয়াও-চিহ্ন’ বলে অভিহিত করেন। আদতে এটি ছিল মেসোপটেমীয় উপত্যকার বর্ণনা। এ থেকে আমরা যা বুঝতে পারি, তা হল, সেলেউসিদদের আরও দূরে সরিয়ে দিয়ে পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক বানিয়ে দেওয়া হয়েছে ততদিনে এবং রোমানরা তাদেরকে আর ধর্তব্যে নিচ্ছিল না।

এই অঞ্চলের দখল নিয়েছিল পার্থিয়ানরা। উদির দীর্ঘ শাসনামলের সময় পার্থিয়ার শাসকের ভূমিকায় ছিলেন তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল রাজা দ্বিতীয় মিথরিদাতেস। ১২৩ সালে তিনি পার্থিয়ার ক্ষমতায় বসেন। অল্পদিনের মাঝেই এশিয়া মাইনরে রোম কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। তারা লুসিয়াস কর্নেলিয়াস সুল্লা নামে এক দূতকে ‘মিথরিদাতেসের নিরলস পদক্ষেপের ওপর নজর রাখতে সেখানে পাঠান। সুল্লা ইউফ্রেতিস পর্যন্ত ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি মিথরিদাতেসের এক দূতের সঙ্গে আলোচনা করেন। এর আগে এই দুই জাতির মধ্যে কোনো যোগাযোগ হয়নি। সুল্লাই ছিলেন প্রথম রোমান যার কাছে পার্থিয়ানরা বন্ধুত্ব ও মৈত্রীর প্রস্তাব দেয়।

ঝাং কিয়ানের সফরের পর পূর্ব থেকে পশ্চিমে আরও বেশি করে প্রতিনিধি আসা শুরু করে। হান দরবার থেকেও অনেকে সেখানে যান।

এসব যাত্রায় কখনো কখনো যুদ্ধেরও সূত্রপাত হয়। নতুন বাণিজ্যপথে ছোটখাটো গোত্রদের দমন করে হানরা। ১১০ সালের মাঝে পূর্ব থেকে পশ্চিমের মাঝে একটি সুস্পষ্ট ও কার্যকর বাণিজ্যিক পথ চালু হয়। সড়কের দুইপাশে অসংখ্য চৌকি বসানো হয়। সেগুলোতে চীনা যোদ্ধাদের মোতায়েন করা হয়, যাতে তারা দস্যুদের হাত থেকে বণিকদের সুরক্ষা দিতে পারে। পার্থিয়ানরা চীন থেকে পণ্য আমদানি শুরু করে, বিশেষত রেশম (সিল্ক) ও লেকার কাঠ। এসব পণ্য তারা নিজেরা বানাতে পারতেন না।

অপরদিকে, চীনের সম্রাট পার্থিয়া থেকে ঘোড়া আমদানি করতেন। সেগুলো দেখতে খুবই সুন্দর ও দ্রুতগতির ছিল। হান দরবারে একের পর এক বিদেশি আসতে লাগল। সম্রাট বিদেশি মেহমানদের তার সাম্রাজ্যের শানশওকত সম্পর্কে ধারণা দিতে তাদেরকে নিয়ে শহরে বের হতেন। পার্থিয়া হয়ে দাঁড়ায় পূর্ব ও পশ্চিমের দুই মহান সাম্রাজ্যের মাঝে সেতুবন্ধন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *