1 of 2

৭৩. পুত্রদের যুদ্ধ

অধ্যায় ৭৩ – পুত্রদের যুদ্ধ

২৮৫ থেকে ২০২ সালের মাঝে আলেকজান্ডারের উত্তরাধিকারীরা তাদের রাজত্ব নিয়ে ব্যস্ত রইলেন এবং হ্যানিবল তার হস্তিবাহিনী নিয়ে আল্পস পার হলেন।

আলেকজান্ডারের এককালের সেনাপতি ও মিশরের বর্তমান রাজা, বর্ষীয়ান টলেমি ৮২ বছর বয়সে অবসরে গেলেন এবং তার স্থলাভিষিক্ত হলেন তার ছোটছেলে দ্বিতীয় টলেমি। বৃদ্ধ টলেমি তার শেষ বয়সে শান্তিপূর্ণভাবে আলেকজান্ডারের অভিযানের ইতিহাস লিখলেন, যেখানে তিনি নিজেকে সবচেয়ে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেন।

বড়ছেলে টলেমি সেরাউনাস রেগে রাজসভা ত্যাগ করলেন। একই বছরে তিনি তার বোন আর্সিনোর সঙ্গে দেখা করতে থ্রেসে এসে উপস্থিত হলেন। আর্সিনো ছিলেন লিসিমাকাসের স্ত্রী।

এই বিয়েটি ছিল লিসিমাকাসের জন্য একধরনের বিমা। তিনি চেয়েছিলেন থ্রেস, মেসিডোনিয়া ও এশিয়া মাইনরের ভূখণ্ড দখলে রাখতে। কিন্তু পূর্বাঞ্চলে সেলুকাস ছিল এক বড় হুমকি। তাই মিশরের টলেমির সঙ্গে আত্মীয়তা করে তিনি সেলুকাসকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা চালান। আর্সিনো ছিলেন লিসিমাকাসের দ্বিতীয় স্ত্রী এবং দুইজনের বয়সের ব্যবধান ছিল অন্তত ৩০ বছর। আগের ঘরের বড়ছেলে আগাথোক্লেস ছিলেন লিসিমাকাসের বৈধ উত্তরাধিকারী।

সেরাউনাসের উপস্থিতিতে অনুপ্রাণিত হলেন আর্সিনো। তিনি ভাবলেন : আগাথোক্লেসের বদলে তার নিজের সন্তানরা রাজত্ব পেলে মন্দ হয় না! এই দুই ভাইবোন আগাথোক্লেসের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনলেন—সেলুকাসের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে লিসিমাকাসকে হত্যা-চেষ্টার অভিযোগ।

বর্ষীয়ান লিসিমাকাস ততদিনে বেশ দুর্বল ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। সেরাউনাসের আগমনের এক বছরের মাথায় তিনি আগাথোক্লেসকে বিষ খাইয়ে হত্যা করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু হয়নি। তখন বৃদ্ধ রাজা তাকে অন্ধকার কারাগারে আটকে রাখেন, লোকচক্ষুর অন্তরালে। সেখানেই একপর্যায়ে তার মৃত্যু হয়।

তবে পরবর্তী যুগের ইতিহাসবিদরা বিশ্বাস করেন টলেমি সেরাউনাসই আগাথোক্লেসকে হত্যা করেছিলেন।

নিঃসন্দেহে ঝামেলাবাজ সেরাউনাস বেশ সক্রিয় ছিলেন। শিগগির তিনি সেলুকাসের দরবারে উপস্থিত হলেন। তাকে প্রলুব্ধ করলেন ‘সন্তান-হন্তারক’ অশুভ শক্তি লিসিমাকাসকে দমনের অভিযানে তার সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য। সেলুকাসের বয়স ততদিনে ৮০র কোঠায়, আর লিসিমাকাসের ৭১। সেলুকাস তার সেনা নিয়ে লিসিমাকাসের রাজ্যে হানা দিলেন।

প্রায় ৪০ বছর আগে এই দুই রাজার পরিচয় হয় এবং দুইজনই ছিলেন আলেকজান্ডারের সহযোগী। হেলেসপন্ট পার হয়ে এশিয়া মাইনরে এই দুই পুরনো বন্ধুর সরাসরি যুদ্ধ হল। সেলুকাসের চূড়ান্ত আঘাতে মারা গেলেন লিসিমাকাস। বেশ কয়েকদিন যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে রইল তার দলিত মথিত মরদেহ। পরে তার ছোটছেলে এসে বাবার মরদেহ সংগ্রহ করল।

হেলেসপন্ট পেরিয়ে মেসিডোনিয়ার দখল নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন সেলুকাস। সেসময় তার আসল রূপ দেখালেন টলেমি সেরাউনাস। সেরাউনাসের হাতে নিহত হলেন সেলুকাস।

মেসিডোনিয়া ও থ্রেসের সিংহাসন দখল করে নিলেন সেরাউনাস। তিনি তার নিজের বোন আর্সিনোকে বিয়ে করলেন। এটা মিশরীয় আচার ছিল, গ্রিকরা এতে খুব একটা খুশি হতে পারেনি।

এরপর যা করলেন, তা তার জনপ্রিয়তায় আরও ফাটল ধরাল। তিনি আর্সিনোর আগের ঘরের দুই পুত্রসন্তানকে হত্যা করলেন। ফলে আর্সিনো তাকে ছেড়ে মিশরে চলে গেলেন তার অপর ভাই দ্বিতীয় টলেমির কাছে। এই টলেমিকেও বিয়ে করলেন আর্সিনো, ফলে টলেমি নতুন নাম পেলেন ‘টলেমি ফিলাডেলফাস’, যার অর্থ ‘ভ্রাতাসুলভ প্রেম’, যা মোটেও ভালো কোনো উপাধি ছিল না।

ততদিনে বৃদ্ধ টলেমি মারা গেছেন। সম্ভবত আলেকজান্ডারের একমাত্র সহযোগী বা উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বাভাবিক মৃত্যু উপভোগ করেন তিনি।

টলেমি সেরাউনাস তার রক্তমাখা মুকুট দুই বছর ধরে রাখতে সক্ষম হন। ২৭৯ সালে ইতালীয় উপদ্বীপের ত্রাস, ‘কেল্ট’ জাতি এশিয়া মাইনরে উপস্থিত হয়। গল নামেও পরিচিত এই জাতি মেসিডোনিয়ায় বন্যার মতো ছড়িয়ে পড়ল। সেরাউনাস তাদের বিরুদ্ধে লড়তে যেয়ে মারা পড়লেন। এভাবেই প্রাচীন আমলের এক গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু মোটামুটি অজ্ঞাত খলনায়কের প্রয়াণ হল। তার মসনদ চলে গেল এক-চোখা অ্যান্টিগোনাসের নাতি তৃতীয় অ্যান্টিগোনাসের কাছে।

সেলুকাসের ছেলে অ্যান্টিওকাস তার বাবার রাজত্বের হাল ধরলেন। অ্যান্টিওকাসের রাজত্ব ছিল পারস্যের আদলে তৈরি। তার মা ছিলেন এক পার্সি অভিজাত পরিবারের সন্তান। আলেকজান্ডারের গণবিবাহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেলুকাস তাকে বিয়ে করেছিলেন। প্রদেশগুলো সাতরাপের মতো কাজ করত। পারস্যবাসীরা সুসা, একবাতানা, সারদিস ও ব্যাবিলনকে প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার করেছিল। সেলুকাস সারদিস ও ব্যাবিলন বহাল রাখলে আরও দুইটি নতুন শহরের গোড়াপত্তন করেছিলেন—ওরন্তেস নদীর কাছে অ্যান্টিওক শহর এবং টাইগ্রিসের পশ্চিম তীরের সেলেউশিয়া। এ শহরটি ইউফ্রেতিসের সঙ্গে একটি খালের মাধ্যমে সংযুক্ত ছিল।

৭৩.১ সেলেউসিদের জগৎ

সেরাউনাসের মৃত্যুর এক বছর পর গলরা হেলেসপন্ট পার হয়ে সেলেউসিদ সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াল।

অ্যান্টিওকাস তাদের বিরুদ্ধে লড়লেন এবং তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে ‘রক্ষাকর্তা অ্যান্টিওকাস’ খেতাব পেলেন। গলরা পিছু হটে এশিয়া মাইনরে আশ্রয় নিল। পরবর্তীতে তাদের নাম হল ‘গ্যালাশীয়’।

এক দশক পর রোমান সেনারা ইতালীয় উপদ্বীপের উপকূল ধরে সিসিলির দিকে রওনা হল। ইতিহাসবিদ পলিবিয়াস আমাদেরকে জানান, এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, কারণ ‘সেবারই প্রথমবারের মতো রোমানরা ইতালি থেকে সমুদ্র পার হয়’। এবং সিসিলিই ছিল ইতালির বাইরে প্রথম দেশ, যেখানে রোমানদের পা পড়ে। এই মাহেন্দ্রক্ষণে রোমের বৈদেশিক আগ্রাসনের ইতিহাসের সূত্রপাত ঘটে।

বেশিরভাগ উচ্চাভিলাষী সাম্রাজ্যবাদীদের মতোই রোমও এই আগ্রাসনের পেছনে বলিষ্ঠ যুক্তি তুলে ধরে। সিসিলি তখন সিরাকিউস ও কার্থেজের যৌথ নিয়ন্ত্রণে ছিল। সিসিলির উপকূলীয় শহর মেসিনা (সাবেক গ্রিক উপনিবেশ) দখল করে নেন সিরাকিউজ। কিন্তু কামপানিয়া থেকে একদল বিদ্রোহী ইতালীয় ভাড়াটে সেনা সম্প্রতি সিসিলি যেয়ে এই শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। মেসিনার শাসক কার্থেজ ও রোমের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে বার্তা পাঠায়।

রোম ও কার্থেজের মধ্যে শান্তি বিরাজ করছিল। কার্থেজ সেখানে আগে পৌঁছে জানতে পারে, সিরাকিউসের একনায়ক দ্বিতীয় হিয়েরো (আগাথোক্লেস আরও ২০ বছর আগে নিহত হন) ইতোমধ্যে সেখানে পৌঁছে গেছেন। তিনি মেসিনার এই ভিনদেশিদের ডেকে আনার বিষয়টি একেবারেই পছন্দ করলেন না। কার্থেজীয়রা ত্রিমুখী যুদ্ধ শুরু না করে দ্বিতীয় হিয়েরোর সঙ্গে যোগ দিয়ে মেসিনাকে দখলদারমুক্ত করল।

রোমানরা সবার শেষে এসে পৌঁছে খালিহাতে ফিরে যেতে চাইল না। তারা কার্থেজীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা চালিয়ে বসল। পরবর্তীতে রোমান বাহিনী পুরো দ্বীপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। তারা কার্থেজের অধিকৃত ভূখণ্ড দখল করল এবং সিরাকিউসের বিরুদ্ধেও হামলা চালাল।

পরবর্তী ২৩ বছর (২৬৪ থেকে ২৪১ সাল পর্যন্ত) প্রথম পিউনিক যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত এই যুদ্ধে রোম বা কার্থেজ নিশ্চিতভাবে জয়লাভ করেনি।

এই যুদ্ধে আসার আগে রোমান নৌবাহিনী গড়ে ওঠে মিত্রদেশ থেকে পাওয়া জাহাজ ও নাবিকদের মাধ্যমে। রোম অনুধাবন করে, সুসংহত ও শক্তিশালী নৌবাহিনীর অভাবে তারা জিততে পারছে না। কার্থেজের একটি যুদ্ধজাহাজকে রোমের উপকূলে আটক করার পর সেই জাহাজের আদলে রোমান যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ শুরু করে। তবে এই ‘নতুন’ নৌবহরকে খুব সহজেই পরাভূত করে কার্থেজ। এরপর আবারও ভুল শুধরে নৌবাহিনী গঠনে মন দেয় রোম। পলিবিয়াস জানান, আরও দুই বছরে কার্থেজ-রোমের নৌবাহিনীর সক্ষমতা কাছাকাছি পর্যায়ে এসে যায়। রোমানরা তাদের যুদ্ধকৌশল, আইন, সরকারব্যবস্থা, এমনকি পুরাণও অন্যান্য সংস্কৃতি থেকে ধার করে এনেছিল। কিন্তু তারা খুব দ্রুত শিখতে পারত।

এই যুদ্ধের ১৭ বছরের মাথায় রোম সামান্য হলেও সুবিধা আদায় করে নিতে সক্ষম হয়। রোমান সেনারা উত্তর-আফ্রিকায় পৌঁছে সেখানে ঘাঁটি নির্মাণ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু তখনও কার্থেজে সরাসরি হামলা চালানোর মতো সক্ষমতা ছিল না রোমের হাতে। সিসিলির দখল নেওয়া তখন ছিল শুধু সময়ের ব্যাপার।

কার্থেজের নেতারা অযোগ্যতার কারণে প্রধান সেনাপতিকে বরখাস্ত করে এক নতুন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়। হামিলকার বার্কা নামের এই ব্যক্তির বয়স ছিল ২৫।

হামিলকারের নেতৃত্বে ছিল কার্থেজীয় ও ভাড়াটে সেনাদের সমন্বয়ে গঠিত ১০ হাজারের সেনাবাহিনী আর তার সঙ্গে ৭০টি হাতিও ছিল। তিনি সিসিলির একটি ঘাঁটি দখল করে নেন। সেখান থেকে ইতালির উপকূলে গেরিলা হামলা চালাতে থাকেন তিনি এবং বেশ কয়েকটি যুদ্ধে সাফল্যও পান। এতে কার্থেজীয়দের মনোবল অনেকাংশে চাঙা হয়।

২৪১ সালে কার্থেজ রণে ভঙ্গ দেয়। হামিলকার বেশ ভালো করছিলেন, কিন্তু রোমান নৌবাহিনীর দাপটে সিসিলি থেকে তার কাছে অস্ত্রশস্ত্র আর রসদ পাঠানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারা হামিলকারকে জানান, ‘যা ভালো বোঝেন করেন’। এ-ধরনের নখদন্তহীন সার্বভৌমত্ব(!) পেয়েও তার কোনো লাভ হয়নি। তিনি আত্মসমর্পণ করলেন।

যুদ্ধের অবসান হল। সিনেট ঘোষণা দিল, জানুসের মন্দিরের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে, যা সমগ্র রোম ভূখণ্ডে শান্তি আসার প্রতীক।

সিসিলি রোমের প্রথম বিদেশি প্রদেশের মর্যাদা পেল। তবে এই সাময়িক শান্তি থেকে আরও ভয়াবহ সংঘাতের উৎপত্তি হল।

পূর্বে অন্যান্য যুদ্ধ চলতে থাকল। দ্বিতীয় টলেমি (বোনকে বিয়ে করেছেন যিনি এবং প্রথম অ্যান্টিওকাস (সেলুকাসের ছেলে) তাদের ভূখণ্ডের মাঝে থাকা সিরিয়ার সীমান্ত নিয়ে বিবাদে জড়ালেন। এবং তাদের এই ঝগড়া তাদের সন্তানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেহত্যাগ করলেন।

২৪৬ সালে দ্বিতীয় টলেমির মৃত্যুর পর তৃতীয় টলেমি সিংহাসনে বসলেন এবং অ্যান্টিওকাসের মৃত্যুর পর রাজা হলেন দ্বিতীয় অ্যান্টিওকাস। মেসিডোনিয়ায় একচোখা অ্যান্টিগোনাসের নাতি দ্বিতীয় অ্যান্টিগোনাস প্রায় ৫০ বছর রাজত্ব করার পর মারা গেলে তার ছেলে সিংহাসনে বসলেন।

তৃতীয় টলেমি মিশরে নির্বিঘ্নে ২২ বছর দেশ শাসন করেন।

দ্বিতীয় অ্যান্টিওকাসের ভাগ্য এতটা সুপ্রসন্ন ছিল না। সেলেউসিদ রাজত্বের দায়ভার নেওয়ার ছয় বছর পর তিনি বাষ্ট্রিয়া সাতরাপের নিয়ন্ত্রণ হারান। গ্রিক গভর্নর ডিওডোটাসের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে এই সাতরাপ স্বাধীন হয়ে যায় এবং ডিওডোটাসকে রাজা হিসেবে ঘোষণা দেয়। নিজ রাজধানী থেকে বেশ দূরে হওয়া বাষ্ট্রিয়া তিনি আর পুনর্দখল করতে পারেননি।

অল্পদিনের মাথায় আরসাচেস নামে পারথিয়ার এক স্থানীয় নেতা পারথিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পশ্চিম সীমান্ত নিয়ে ঝামেলায় ছিলেন অ্যাটিওকাস। তিনি পশ্চিমা সেমাইটদের পুরনো ভূখণ্ড নিয়ে মিশরের সঙ্গে যুদ্ধ লড়ছিলেন, যার মধ্যে ফিনিশীয়, ইসরায়েলি ও জুডিয়ান ভূখণ্ড অন্যতম। একসঙ্গে বিশাল সাম্রাজ্যের দুই সীমান্ত রক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

সাময়িকভাবে বিবাহবন্ধনের মাধ্যমে এই দুই রাজা সন্ধিতে পৌঁছালেন। তৃতীয় টলেমির মেয়ে উত্তরে যেয়ে দ্বিতীয় অ্যান্টিওকাসকে বিয়ে করে তার দ্বিতীয় স্ত্রী হলেন। তবে এই চুক্তিতে পারথিয়া বা বাষ্ট্রিয়া ফিরে এল না। এবং দ্বিতীয় অ্যান্টিওকাসের প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রথম স্ত্রী তাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেললেন। সব মিলিয়ে বলা যায়, এই “শান্তি” ছিল পুরোপুরি অর্থহীন।

তার স্থলাভিষিক্ত হলেন প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান (স্বভাবতই) দ্বিতীয় সেলুকাস। কিন্তু তিনিও সেই দুই বিদ্রোহী সাতরাপি ফিরে পেতে ব্যর্থ হলেন এবং ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যেয়ে বেশ অস্বাভাবিকভাবে মারা গেলেন। এরপর দ্বিতীয় সেলুকাসের সবচেয়ে বড়ছেলে তিন বছর দেশ শাসন করার পর তার নিজের সেনাপতিরাই তাকে হত্যা করলেন। এরপর সিংহাসন পেলেন ছোটছেলে তৃতীয় অ্যান্টিওকাস। ২২৩ সালে মাত্র ১৫ বছরে সেলুসিডস-এর রাজা হলেন তিনি।

বালক-রাজার আগমনে মেদিয়া ও পুরনো পারস্য বাষ্ট্রিয়া ও পারথিয়ার সঙ্গে জোট বেঁধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। তবে তৃতীয় অ্যান্টিওকাস তার পূর্বসূরিদের মতো দুর্বল ছিলেন না। তিনি একের পর এক অভিযানে যেয়ে সব শত্রুকে পরাভূত করলেন। ১৮ বছর বয়স হতে হতে তিনি মেদিয়া ও পারস্যকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করলেন। বাষ্ট্রিয়া ও পারথিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে না যেয়ে তাদের রাজাদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি করলেন তিনি। এভাবে তিনি তার পূর্বসীমান্তকে সুরক্ষিত করে পশ্চিমে নজর দেওয়ার সুযোগ পেলেন।

এটা বেশ সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ছিল, কারণ মিশর তার নিজের সীমান্তের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিল ধীরে ধীরে।

২২২ সালে তৃতীয় টলেমির বদলে ক্ষমতায় এসেছেন চতুর্থ টলেমি। তাকে সবধরনের ইতিহাসবিদ ও জীবনীকার অপছন্দ করতেন। তারা বলেন, ‘তিনি ছিলেন দুশ্চরিত্র, পেটুক ও খামখেয়ালি রাজপুত্র।’ প্লুটার্ক বলেন, ‘তিনি সর্বক্ষণ মদ ও নারীতে মেতে থাকতেন। তিনি এমনভাবে দেশ শাসন করতেন যেন তা একটি নিরন্তর উৎসব উদ্যাপনের বিষয়।’

বাবার মৃত্যুর পরপরই তিনি তার মাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেন এবং তার ছোটভাই ম্যাগাসকেও ফাঁসি দেন, কারণ সেনাবাহিনীতে ম্যাগাস খুবই জনপ্রিয় ছিলেন।

চতুর্থ টলেমির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতেন মূলত তার রক্ষিতা, ভাই আগাথোক্লেস (প্লুটার্ক তাকে ‘পতিতাদের দালাল’ হিসেবে অভিহিত করেন) এবং সোসিবিয়াস নামে এক গ্রিক উপদেষ্টা। টলেমি মদে চুর থাকার সময় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো এই গ্রিক ব্যক্তি নিতেন।

চতুর্থ টলেমি ২০৪ সালে মারা যান। ধারণা করা হয়, অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণেই তার মৃত্যু ঘটে। তার মৃত্যুর পর পাঁচ বছর বয়সি সন্তান পঞ্চম টলেমিকে সিংহাসনে বসানো হয়। নথি জালিয়াতি করে সোসিবিয়াস ও সেই ‘দালাল’ এই শিশুটির প্রতিনিধি হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করেন।

সোসিবিয়াস কয়েক মাসের মধ্যে মারা যান। ফলে আগাথোক্লেস, তার বোন ও তাদের মা মিশরীয় ক্ষমতার চূড়ায় অধিষ্ঠিত হন। তবে বেশিদিনের জন্য নয়। এই ত্রয়ী এতটাই অজনপ্রিয় হয়ে পড়েন যে, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে একদল মিশরীয় রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়ে। তারপর তিনজনকে জোর করে বাইরে এনে বিবস্ত্র করে তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধরে টেনে টেনে নির্মমভাবে হত্যা করে। পলিবিয়াস বলেন, ‘জনতা এতটাই ক্রুদ্ধ ছিল যে, কেউ কেউ তাদের চোখ উপড়ে আনেন, কেউ তাদের ছুরিকাঘাত করেন আর কোনো একজনের দেহ মাটিতে পড়লেই আঁচড়ে কামড়ে তাদের ক্ষতবিক্ষত করেন। অনেকে কামড়ও বসিয়ে দেন।’

এরপর পঞ্চম টলেমিকে মেমফিসে বসে শাসনকার্য চালাতে একদম দক্ষ মিশরীয় উপদেষ্টামণ্ডলী নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু যখন তার বয়স ১২ হল, তখন তৃতীয় অ্যান্টিওকাস মিশরের উত্তর সীমান্তে হামলা চালালেন। ১৯৮ সালে পানিয়ামের যুদ্ধে এই আগ্রাসনের অবসান হয়। জর্ডান নদীর তীরে সেলেউসিদ ও মিশরীয় বাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধশেষে শেষবারের মতো পশ্চিমা সেমাইটদের ভূখণ্ডের দখল হারায় মিশর। এরপর আর কখনোই তারা এই উত্তরের ভূখণ্ড পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি।

পঞ্চম টলেমির শাসনামলকে বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ মিশরীয় সভ্যতার যবনিকাপাত হিসেবে চিহ্নিত করেন। গ্রিক শাসকদের আওতায় মিশরীয় রেনেসাঁ শেষ হয় এর মাধ্যমে।

পশ্চিমে রোমানদের জারি করা শান্তিচুক্তির আওতায় হামিলকার বার্কা তখনো বুদ্ধিমানের মতো তার শাসন চালিয়ে যাচ্ছেন। কার্থেজের শক্তিমত্তা কমে এসেছে ততদিনে। তাদের সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপগুলো, কিন্তু ততদিনে রোমানরা সেখানে গভীরভাবে ঢুকে পড়েছে।

হামিলকার এই ক্ষতি পোষাতে কার্থেজীয় সাম্রাজ্যকে পশ্চিমদিকে আরও বিস্তৃত করার চেষ্টা চালালেন। তিনি আইবেরিয়ার (আধুনিক স্পেন) দিকে একদল সেনা নিয়ে রওনা হলেন। তিনি এটাও ভেবেছিলেন যে, এ অঞ্চল দখল করতে পারলে এখান থেকে খুব সহজে রোমের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা যাবে। সিসিলিতে লজ্জাজনক পরাজয় বরণের পর তার মনে প্রবল রোম-বিদ্বেষের জন্ম নেয়। পলিবিয়াস জানান, এই ঘৃণা তিনি সফলভাবে তার সন্তান হ্যানিবলের মাঝেও প্রবাহিত করেন।

হামিলকার স্পেনের অভিযানে যাওয়ার আগে দেবতাদের উদ্দেশে প্রাণী উৎসর্গ করছিলেন। সেই বেদিতে দাঁড়িয়ে তিনি তার নয়বছর বয়সি সন্তান হ্যানিবলকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘বাবা, তুমি কি আমার সঙ্গে যুদ্ধে যাবে?’ উত্তরে শিশু হ্যানিবল উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠে, ‘অবশ্যই যাব!’ তখন তার বাবা তার হাত সেই প্রাণীর গায়ে স্পর্শ করিয়ে বলেন, ‘অঙ্গীকার করো, কখনো তুমি রোমানদের বন্ধু হবে না।’

এভাবেই আজীবন ঘৃণার অঙ্গীকার করে হামিলকার, তার ছেলে ও সেনাবাহিনী জাহাজের পাল তুলল।

২৩৬ সালে কার্থেজের দলটি আইবেরিয়া পৌঁছে নতুন রাজত্ব দখলে উদ্যোগী হয়। এই অভিযানের কেন্দ্রস্থল হিসেবে গাদির (আজকের দিনের কাদিজ) অঞ্চলকে নির্বাচন করা হয় এবং এখান থেকে তিনি সফলভাবে নতুন উপনিবেশ তৈরি করেন। এখানেই হ্যানিবল বড় হন।

পলিবিয়াস বলেন, পরবর্তী ৯ বছরে হামিলকার অসংখ্য গোত্রকে কার্থেজীয় জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত করে তোলেন—কাউকে পেশিশক্তির বলে, কারও কারও ক্ষেত্রে কূটনীতির প্রয়োগে। এ সবকিছুই কাছে থেকে দেখে বড় হতে থাকেন হ্যানিবল। তিনি ইতালীয় উপদ্বীপের উত্তরে আল্পস পাহাড়ের অপরপারে গুপ্তচর পাঠিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যতের সম্ভাব্য আগ্রাসনের জন্য গোপন পথ খুঁজে বের করা। হ্যানিবল তার বেড়ে ওঠার বছরগুলোতে একবারও জন্মভূমি কার্থেজে ফিরে যাননি।

ইতোমধ্যে, রোমানরা প্রথমবারের মতো সমুদ্র পেরিয়ে গ্রিসে এসে উপস্থিত হল। তাদের উদ্দেশ্য, কোরসাইরা শহরকে অন্যান্য বৈরী গ্রিক শহর ও উত্তরাঞ্চলের গলদের হাত থেকে রক্ষা করা। তাদের এই উদ্যোগ সফল হলেও রোমান সেনাবাহিনী সেখানেই থেকে যায়। কাগজে কলমে তারা ‘শান্তিরক্ষা বাহিনীর’ ভূমিকা পালন করছিল। তখনো গ্রিক প্রতিবেশীদের ওপর হামলা চালানোর মতো পর্যায়ে পৌঁছেনি রোমের শক্তিমত্তা।

২২৯ সালে হামিলকার বার্কা গলদের একটি দুর্গে হামলা চালানোর সময় নিহত হন। ১৮ বছর বয়সি হ্যানিবলকে কমবয়সি হওয়ার কারণে নেতৃত্বের জন্য বিবেচনা করা হয়নি। তার বদলে আইবেরীয় উপনিবেশের দায়িত্ব পেলেন তার বোনের জামাই, যিনি বয়সে বড় ছিলেন। এই ব্যক্তির রোমের বিরুদ্ধে খুব একটা ক্ষোভ ছিল না। তিনি পরবর্তী আট বছরে আইবেরীয় উপনিবেশের রক্ষণাবেক্ষণে মন দেন। তিনি নিউ কার্থেজ নামে নতুন একটি শহরও তৈরি করেন। পূর্বের রোমানদের তিনি পাত্তা দেননি একেবারেই। কিন্তু ২২১ সালে এক ভৃত্য তাকে হত্যা করে এবং ২৬ বছর বয়সি হ্যানিবল আইবেরিয়া বা স্পেনের শাসনভার গ্রহণ করেন।

হ্যানিবল নিউ কার্থেজ থেকে নজর সরিয়ে রোমান ভূখণ্ডে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। তিনি উপকূল ধরে যুদ্ধ করতে করতে আগাতে লাগলেন, যাতে সেনাবাহিনীর পূর্ণ সক্ষমতা নিয়ে নিরাপদে আল্পস পর্বতের দিকে আগানো যায়।

তার পর তিনি মাসালিয়া শহরের কাছে পৌঁছালেন। এ শহরটিকে ঘুসের বিনিময়ে আগ্রাসী গলদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল রোম। স্বভাবতই, তারা আবারও রোমের কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠাল।

রোমের কাছ থেকে কার্থেজে হুঁশিয়ারি পাঠানো হল। যদি হ্যানিবল সাগুনতাম শহর পেরিয়ে যায়, তাহলে তারা একে রোমের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করবে। হ্যানিবল শিগগির সেখানে হামলা ও লুটপাট চালাল। এরপর রোম থেকে সরাসরি কার্থেজে দূত পাঠানো হল। তারা কার্থেজীয় সিনেটের কাছে চরমপত্র দিলেন—হ্যানিবলকে তাদের হাতে ধরিয়ে দিতে হবে। আর তা না-করা হলে দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ শুরু হবে।

কার্থেজীয়রা আপত্তি জানাল, সাগুনতাম প্রকৃতপক্ষে কেল্টিক উপনিবেশ, এবং এটি রোমের মিত্র নয়। আবার রোমের দূতরা জানালেন, সাগুনতাম একবার রোমের সাহায্য প্রার্থনা করেছিল-বহু বছর আগে, যার অর্থ, শহরটি রোমান সুরক্ষাব্যূহর অংশ।

৭৩.২ পিউনিক যুদ্ধের বিশ্ব

সার্বিক বিবেচনায় যা বোঝা যায়, তা হল, উভয় পক্ষই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল। দুই দেশের সিনেটের সম্মতি নিয়ে যুদ্ধের আয়োজন শুরু হল।

হ্যানিবল ২১৮ সালে আল্পস-এর উদ্দেশে রওনা হলেন। তিনি তার ভাই হান্নোকে আইবেরীয় উপনিবেশের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। সঙ্গে নিলেন এক লাখ পদাতিক সেনা, ২০ হাজার ঘোড়সওয়ার ও ৩৭টি হাতি।

এর প্রতিক্রিয়ায় রোম দুইটি জাহাজভর্তি সেনা পাঠাল—একটি উত্তর- আফ্রিকার উপকূলের দিকে আর অপরটি আইবেরীয় উপদ্বীপের দিকে। আফ্রিকার দিকে যাওয়া বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেলিয়াস স্কিপিও। তিনি রোন নদীর উপকূলে নোঙর করতে চাইলেন। ভাবলেন, হ্যানিবল ও তার বাহিনী আসার আগেই তাদেরকে সেখানে বাধা দেবেন এবং নদী পার হতে দেবেন না। কিন্তু কর্নেলিয়াস পৌঁছানোর তিনদিন আগেই রোন নদী পেরিয়ে পর্বতের দিকে এগিয়ে গেছে হ্যানিবলের বাহিনী—অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে।

হ্যানিবলের জন্য রোমানদের চেয়ে তার নিজের লোকেরাই বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্য আফ্রিকায় বেড়ে উঠেছেন এবং স্প্যানিশ উপকূল ছিল তাদের জন্য সবচেয়ে ঠাণ্ডা জায়গা। এই যোদ্ধারা আল্পস পর্বতের অজানা, খাড়া পাথর বেয়ে ওঠার চিন্তায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। দূর থেকে আল্পস-এর চূড়া দেখে তারা আরও ভয় পেয়ে যান। যাত্রাপথে তারা বারবার স্থানীয় গোত্রদের কাছ থেকে হামলার শিকার হন। এতে সেনা ও তাদের বহনকারী ঘোড়া, উভয়ই মারা পড়ে। অনেক ঘোড়া আতঙ্কিত হয়ে দিগ্‌বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে গিয়ে আরোহীসহ পাহাড়ের খাদে পড়ে মারা যায়। আরও উঁচুতে ওঠার সময় পিছলে পড়ে ও বরফের নিচে চাপা পড়ে আরও অনেক মানুষ ও প্রাণী মারা পড়ে।

১৫ দিনের এই আরোহণে হ্যানিবল ৩৬ হাজার সেনা ও ৩৪টি হাতি হারান। পো নদীর কাছে অবস্থিত সমতলভূমিতে এসে পৌঁছান হ্যানিবল। সেসময় তার সেনাবাহিনীর আকারও ছোট হয়ে গেছে, তাদের মনোবলও ভেঙে গেছে। ততদিনে উত্তর-আফ্রিকা থেকে তার বাহিনীর একটি ছোট অংশ নিয়ে ফিরে এসেছেন কর্নেলিয়াস স্কিপিও। হ্যানিবলের আল্পস পার হওয়ার সংবাদে কর্নেলিয়াসকে তড়িঘড়ি করে ডেকে আনা হয়।

২১৮ সালের নভেম্বর মাসে কর্নেলিয়াস স্কিপিও ও হ্যানিবল টাইসিনিয়াস নদীর তীরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। কার্থেজের বাহিনী ক্লান্ত হলেও রোমান সেনাদলকে খুব সহজেই তাদের ঘোড়সওয়ার বাহিনী ছত্রভঙ্গ করে দিতে সমর্থ হয়। স্কিপিও নিজেও গুরুতরভাবে আহত হন। লাইভি জানান, ‘এই যুদ্ধে এগিয়ে ছিল কার্থেজ’।

উত্তর-আফ্রিকায় মোতায়েন সেনাবাহিনীর বাকি অংশের কনসাল ছিলে লংগাস। তিনি যখন তার বাহিনী নিয়ে রোমে ফিরে এলেন, তাদেরকে সবাই বীরের সংবর্ধনা দিল। কিন্তু আদতে এই বাহিনী উত্তর-আফ্রিকা আসা-যাওয়া করা ছাড়া কিছুই করেনি—তারা পৌঁছানোর আগেই সেখান থেকে চলে গেছেন হ্যানিবল।

রোমানদের এই আচরণ থেকে রোমের বাহিনী সম্পর্কে জনগণের চিন্তাধারা ও বাস্তবতার ফারাক ফুটে উঠেছে। তারা তখনো মনে করতেন যুদ্ধক্ষেত্রে রোমান বাহিনীর উপস্থিতিই যুদ্ধজয়ের জন্য যথেষ্ট।

 প্রায় এক মাস পর লংগাস ও কর্নেলিয়াসের সমন্বিত বাহিনী আবারও ট্রেবিয়া নদীর সামনে হ্যানিবলের মুখোমুখি হয়। এই যুদ্ধে রোমবাহিনীর এক-তৃতীয়াংশের পতন হয়।

এই দুই কনসালের সমন্বিত বাহিনীর এই মর্মান্তিক পরিণতির সংবাদে রোমের মানুষের শিরদাঁড়া দিয়ে আতঙ্কের ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। লাইভি বলেন, ‘অনেকেই ভাবতে থাকেন, যেকোনো মুহূর্তে রোমের তোরণে হ্যানিবল এসে উপস্থিত হবেন’। রোম পুরোপুরি সতর্ক অবস্থায় চলে যায়—পুরো দ্বীপের বিভিন্ন অংশে সেনা মোতায়েন করা হয়, মিত্রদের কাছে বাড়তি সেনা ও অস্ত্রশস্ত্র চেয়ে বার্তা পাঠানো হয় এবং নতুন করে জাহাজ নির্মাণ করা হয়।

২১৭ সাল নাগাদ হ্যানিবল এতরুরিয়ার মধ্যদিয়ে দোর্দণ্ডপ্রতাপে রোমের দিকে আগাতে থাকেন। কনসাল গাইয়াস ফ্লামিনাস ও তার বাহিনী কার্থেজের বিরুদ্ধে লেক ত্রাসিমেনোর যুদ্ধক্ষেত্রে মুখোমুখি হয়। এই যুদ্ধ ছিল আরও একটি বিপর্যয়। ১৫ হাজার রোমান সেনা নিহত হয়। ফ্লামিনাস নিজেও মারা পড়েন। পরবর্তী কিছুদিন রোমে চূড়ান্ত গোলযোগ চলতে থাকে। নারীরা দলে দলে শহরের তোরণের সামনে যেয়ে হাজির হন—তাদের পিতা, সন্তান বা স্বামীদের কোনো সংবাদ পাওয়ার আশায়।

কোনোদিক থেকেই কোনো ভালো খবর আসছিল না। হ্যানিবলের সেনাবাহিনীকে অপ্রতিরোধ্য মনে হচ্ছিল। তিনি দক্ষিণে আগাতে থাকলেন এবং একপর্যায়ে রোম পেরিয়ে কিছুদূর সামনেও চলে গেলেন। কিন্তু এর পেছনে কারণ ছিল শহরের নিচের দিকে অবস্থিত অন্যান্য ভূখণ্ডের দখল নেওয়া। পলিবিয়াস জানান, ‘রোমানরা সবসময়ই কার্থেজের বাহিনীর পেছনে ছিল-কিন্তু তারা সরাসরি হামলা না চালিয়ে অন্তত দুইদিনের দূরত্বে থাকত।’

পরের বছর নবনিযুক্ত কনসাল পাউলাস ও ভারো যৌথভাবে হ্যানিবলকে পরাজিত করার প্রচেষ্টায় প্রায় এক লাখ সেনা জোগাড় করলেন। এই বাহিনী নিয়ে ২১৬ সালের ২ আগস্ট দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে কানাই নামক অবস্থানে কার্থেজের ৫০ হাজার সেনার বিরুদ্ধে লড়াই করেন তারা।

রোমানরা সংখ্যায় বেশি থাকায় তাদের যুদ্ধকৌশলে ‘ওজন’কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল। তারা সেনাবাহিনীকে বড় বড় গুচ্ছে ভাগ করে, যাতে সরাসরি এই ভারী অস্ত্র, বর্ম ও ঢাল সজ্জিত গুচ্ছগুলো দ্রুত এগিয়ে যেয়ে শত্রুকে পরাস্ত করতে পারে। এর প্রতিক্রিয়ায় হ্যানিবল তার বাহিনীর সামনের অংশটাকে একদম হালকা করে সজ্জিত করেন, যাতে মনে হয় কার্থেজ একেবারেই রোমের আক্রমণ সামলাতে সক্ষম নয়। অপরদিকে তিনি একেবারে ডানে ও বাঁয়ে, এবং তার পেছনে সবচেয়ে শক্তিশালী ও দক্ষ যোদ্ধাদের দুই দলে ভাগ করে রাখেন। এই যোদ্ধারা ছিলেন মূলত আফ্রিকা থেকে আসা ভাড়াটে সেনা। তিনি নিজে সামনের সারিতেই দাঁড়ালেন। তার মনে ভাবনা ছিল, এই সামনের সারির যোদ্ধাদের জন্য যে কঠিন দায়িত্ব তিনি সাজিয়েছেন, তা তারা কখনোই পালন করতে পারবে না যদি-না তিনি নিজে সেখানে উপস্থিত থেকে একইরকম ঝুঁকি নেন।

যখন রোমান যোদ্ধারা এগিয়ে এল, এই সরু ফ্রন্টলাইন খুব দক্ষতার সঙ্গে লড়াই করল, কিন্তু তারা ধীরে ধীরে পেছনে হটতে লাগল। রোমানরা আগাতেই থাকল, আর হ্যানিবলের যোদ্ধারা তাদেরকে ইংরেজি অক্ষর ‘ভি’র মতো এলাকায় সংকুচিত করে ফেলল। তারপর যখন এই ভি’র উভয়পাশ থেকে আফ্রিকার ভাড়াটে সেনারা হামলা চালানো শুরু করল, তখন রোমান বাহিনী খেই হারিয়ে ফেলল। এই ত্রিমুখী হামলা তাদের কাছে ছিল এক নজিরবিহীন অভিজ্ঞতা। চূড়ান্ত গোলযোগের মাঝে ৫০ হাজার সেনা নিমিষেই নিহত হল। ছয় হাজার ঘোড়সওয়ার সেনার মধ্যে ৭৫ জন পালিয়ে ভেনুশিয়া শহরে চলে যায়। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন কনসাল ভারো, যিনি এই পরাজয় ও যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে পালানোর জন্য অসম্মানিত হন।

কানাইর যুদ্ধের খবর রোমে এসে পৌঁছালে সেখানকার প্রায় প্রতিটি পরিবার অনুধাবন করল, তারা হয় বাবা, ভাই বা পুত্র সন্তান হারিয়েছে।

পলিবিয়াস বলেন, ‘এই পরাজয়ের পর রোমানরা ইতালীয়দের ওপর আধিপত্য বজায় রাখার স্বপ্ন ত্যাগ করে। তারা নিজ ভূখণ্ডের নিরাপত্তা ও তাদের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায়।’

পরিস্থিতির আরও অবনতি হল যখন কার্থেজীয় জাহাজ গ্রিসের উদ্দেশে যাত্রা করল। তারা একটি বিশেষ কাজের জন্য মেসিডোনিয়ার তৎকালীন রাজা পঞ্চম ফিলিপের (একচোখা অ্যান্টিগোনাসের বংশধর) সহায়তা চাইল। কাজটি আর কিছুই নয়, গ্রিক উপদ্বীপ থেকে রোমান ‘শান্তিরক্ষীদের’ বিদায় করা। পঞ্চম ফিলিপ এতে সম্মতি দিলেন এবং মেসিডোনিয়া ও কার্থেজ একযোগে ভূমি দখল করে রাখা রোমান ও তাদের গ্রিক মিত্রদের বিরুদ্ধে লড়াই করল। গ্রিক মিত্রদের মধ্যে স্পার্টা ও এতোলিয়ান লিগের শহরগুলো ছিল। এই প্রথম মেসিডোনীয় যুদ্ধের সঙ্গে দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ একীভূত হল এবং রোম দ্বিমুখী সংকট মোকাবিলা করতে বাধ্য হল।

২১১ সালে রোমানরা সিসিলির কিছু অংশ পুনর্দখল করতে সক্ষম হল। তারা দুই বছরের সফল অভিযানে সিরাকিউসের বিরুদ্ধে জয়ী হয়। শহর লুণ্ঠনের সময় প্রখ্যাত গণিতবিদ আর্কিমিডিস নিহত হন। কিন্তু স্পেনে তারা সেভাবে সফল হতে পারেননি। স্কিপিও পরিবারের দুই সদস্য, পাবলিয়াস ও নেইয়াস আইবেরীয় উপদ্বীপে হামলা চালালে তাদের মোকাবিলা করেন হ্যানিবলের ভাই হাসদ্রুবাল। এই যুদ্ধে দুই ভাইয়ের মৃত্যু হয়। তবে রোমানদের পুরোপুরি বিদেয় করতে ব্যর্থ হন হাসদ্রুবাল।

রোমের বিরুদ্ধে হ্যানিবলের যেমন প্রবল ঘৃণা ছিল, ঠিক তেমনভাবে কার্থেজকে ঘৃণা করতেন পাবলিয়াসের ছেলে। পরবর্তীতে ‘স্কিপিও’ নামে পরিচিতি পাওয়া এই রোমান কর্মকর্তা তার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে নিউ কার্থেজের দিকে রওনা হন। সাফল্যের সঙ্গে তিনি এই শহর দখল করেন। হাসদ্রুবাল পালিয়ে তার ভাইয়ের মতো আল্পসের দিকে রওনা হন।

তবে এই বিষয়টি কার্থেজীয়দের জন্য খারাপ ছিল না। হাসদ্রুবাল তার সঙ্গে শুধু নিজের বাহিনীই নয়, আট হাজার ভাড়া-করা কেল্ট সেনা এবং পথিমধ্যে বন্দি বা জিম্মি হিসেবে আরও বেশকিছু সেনা নিয়ে আল্পস পৌঁছান। তিনি হ্যানিবলের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে আমব্রিয়াতে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তার উদ্দেশ্য, সেখান দুই ভাইয়ের বাহিনী সমন্বিত হবে।

তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই চিঠি রোমানদের হাতে পড়ে। তাৎক্ষণিকভাবে নিকটবর্তী রোমান বাহিনী হাসদ্রুবালের বিরুদ্ধে অতর্কিতে হামলা চালায়। আমব্রিয়া পৌঁছানোর আগেই কচুকাটা হলেন হাসদ্রুবাল ও তার ৫০ হাজার সেনা। কোনো এক বিচিত্র কারণে হাসদ্রুবালের সঙ্গে থাকা অন্যান্য দেশের সেনারা সেই হামলার কোনো জবাব দিতে পারেনি। যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি বেগতিক দেখে হাসদ্রুবাল বীরের মতো সরাসরি রোমান বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের দিকে ঘোড়া চালিয়ে এগিয়ে আসেন। সেখানে তিনি বীরদর্পে লড়াই করে বেশ কয়েকজনকে হতাহত করার পর প্রাণ হারান। রোমানরা তার মাথা কেটে নিয়ে তা সংরক্ষণ করে। পরবর্তীতে তারা এই ছিন্নমস্তক হ্যানিবলের শিবিরের কাছে ছুড়ে মারে।

এভাবে হ্যানিবল তার নিজের ভাই ও আইবেরীয় উপনিবেশের দখল হারালেন। ধীরে ধীরে যুদ্ধে রোমের দিকে পাল্লা হেলে পড়ছিল এবং তারা মেসিডোনিয়ার যুদ্ধ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়ে হ্যানিবলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মনোযোগ দিল। ২০৭ সালে হাসদ্রুবালের মৃত্যু হয়। সে-বছরই রোমান সেনাবাহিনী গ্রিক উপদ্বীপের অর্থহীন লড়াই থেকে সরে আসে। গ্রিসের সব শহর ও পঞ্চম ফিলিপ, উভয়ই নিরন্তর যুদ্ধে বিরক্ত ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। স্কিপিও পরামর্শ দেন, উত্তর-আফ্রিকাই হবে নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। সময় এসেছে রোমানদের সরাসরি কার্থেজের মূল ভূখণ্ডের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর। এতে হ্যানিবল বাধ্য হয়ে ইতালি ছেড়ে নিজ দেশের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসতে বাধ্য হবেন।

২০৫ সালে পঞ্চম ফিলিপ গ্রিসের দক্ষিণাঞ্চলের শহরগুলোর সঙ্গে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির শর্তমতে রোমের কাছে কয়েকটি ছোট শহরের দখল এল। বাকি শহরগুলো গেল মেসিডোনিয়ার কাছে। এতে এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা হল এবং রোমের সব সেনা উত্তর-আফ্রিকার হামলার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ পেল। স্কিপিও বড় একটি বাহিনীকে সমন্বিত করে উত্তর-আফ্রিকার উপকূলে এসে পৌঁছালেন। তার বাহিনীর সদস্য ছিলেন রোমান ও উত্তর-আফ্রিকার ভাড়াটে সেনারা।

প্রত্যাশামতো, কার্থেজ থেকে হ্যানিবলের কাছে বার্তা এল। দেশবাসীর তাকে প্রয়োজন। খুবই অনিচ্ছাসত্ত্বে এই আহ্বানে সাড়া দিলেন হ্যানিবল। কেননা এই মাতৃভূমি বা জন্মভূমির প্রতি তিনি তেমন কোনো টানই অনুভব করেননি। ৯ বছর বয়সে ছেড়ে আসা দেশকে রক্ষার চেয়ে বাবাকে দেওয়া অঙ্গীকার তার কাছে বেশি মূল্য বহন করত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি ইতালীয় ভূখণ্ড ছেড়ে গেলেন। বারবার অনুশোচনা করতে লাগলেন, কেন আরও আগে রোমে হামলা চালালেন না, একথা ভেবে। ইতালিতেই রেখে আসলেন তার বাহিনীর বড় একটি অংশ—এই প্রত্যাশায় যে, শিগগির সেখানে ফিরবেন।

কার্থেজে এসে তিনি সেনাবাহিনী গঠন করলেন। কার্থেজীয়, আফ্রিকার ভাড়াটে সেনা ও নিজের সঙ্গে নিয়ে আসা সামান্য অভিজ্ঞ সেনা—এদের সমন্বয়ে গঠিত হল এই বাহিনী। ২০২ সালে ফেয়ার প্রোমনটরির থেকে দক্ষিণে অবস্থিত জামা শহরে শান্তি-আলোচনায় বসলেন হ্যানিবল ও স্কিপিও। তবে এই আলোচনার ছলে বিভিন্ন জায়গা থেকে সেনা জমায়েত করছিলেন স্কিপিও। কানাইর যুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয়ের স্মৃতি তখনো রোমানদের মনে দগদগে ঘায়ের মতো—সেসময়ের পিতৃহীন সন্তানরা এখন ২০ এর কোঠায়; যুদ্ধে লড়ার জন্য তাদের রক্ত টগবগ করে ফুটছে।

রোমের ‘রিইনফোর্সমেন্ট’ বাহিনী জমায়েত হল। শান্তি-আলোচনা ব্যর্থ হল এবং শেষবারের মতো রোম ও কার্থেজ যুদ্ধে অবতীর্ণ হল।

স্কিপিও বেশ ভালো পরিকল্পনা আঁটলেন। ইতালির খোলা ময়দানে আগ্রাসী হ্যানিবল ছিলেন অদম্য ও অপরাজেয়। কিন্তু এখন যুদ্ধক্ষেত্র পালটে গেছে। এখানে তাকে ‘প্রতিরক্ষামূলক’ যুদ্ধে লড়তে হল এবং সেখানকার পাথুরে ভূখণ্ডের সঙ্গে তিনি পরিচিত ছিলেন না। তার সেনাবাহিনীর মাঝে ছিল না কোনো ধরনের সমন্বয়—তাদের ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, অস্ত্র, নিয়ম-কানুন, আইন, পোশাক, চেহারা—সবই একে অপর থেকে ভিন্ন ছিল। তাদের সামনে কোনো আদর্শও ছিল না। বেশিরভাগ যোদ্ধাই শুধু অর্থ-উপার্জনের জন্য হ্যানিবলের জোড়াতালি দেওয়া বাহিনীতে নাম লিখিয়েছিলেন। যখন স্কিপিওর সুপ্রশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল বাহিনী হারেরেরে করে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তাদের অনেকেই ভয়ে আতঙ্কে পিঠটান দিল।

জামার যুদ্ধের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল স্কিপিওর। হ্যানিবলকে পালিয়ে গিয়ে কার্থেজে আশ্রয় নিতে হল। সেখানে তিনি সিনেটকে জানালেন, রোমের বিরুদ্ধে বিজয় অসম্ভব—তাদের সঙ্গে সন্ধি করা ছাড়া উপায় নেই। কার্থেজের সিনেট এই প্রস্তাবে সম্মত হল। কার্থেজ স্কিপিওর কাছে আত্মসমর্পণ করল। এই জয়ের জন্য দেশবাসীর কাছ থেকে ‘স্কিপিও আফ্রিকানাস’ খেতাব পেলেন স্কিপিও। কার্থেজের নৌবাহিনী ক্রোক করা হল। ফলে তাদের পশ্চিমাঞ্চল দখলের আকাঙ্ক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটল। উপকূল থেকে ৫০০ জাহাজ সরিয়ে নিয়ে সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। এই ৫০০ জ্বলন্ত জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার মাধ্যমে অবসান হল দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের।

পরিশেষে হ্যানিবল বাধ্য হলেন রোম-জয়ের স্বপ্ন বিসর্জন দিতে। তাকে এমন এক শহরে থাকতে হল, যার বিষয়ে তার তেমন কোনো স্মৃতি নেই। তিনি কার্থেজের সিনেটে যোগ দিয়ে তাদের পুনর্নির্মাণ উদ্যোগে সহায়তা করলেন। তবে এই কাজের জন্য তিনি কোনো প্রশংসা বা ধন্যবাদ পাননি। জামার যুদ্ধের প্রায় ছয় বছর পর হ্যানিবল এক চক্রান্তের খোঁজ পেলেন—কার্থেজের জনগণ রোমের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন করতে তাকে বলির পাঁঠা হিসেবে রোমে পাঠিয়ে দিতে চাইছে।

তিনি একটি জাহাজ নিয়ে কার্থেজ ছেড়ে পালালেন। মাতৃভূমিতে সাত বছরও টিকতে পারেননি তিনি। এরপর আর কখনোই সেখানে ফেরেননি তিনি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *