ভিতরের শক্তি তো স্বেচ্ছা! তবে জীবনের কোন্ স্তরে এই শক্তির উদ্ভব হইয়াছে? শুষ্ক তৃণ জল-স্রোতে ভাসিয়া যায়। কিন্তু জীব কেবল বাহিরের প্রবাহ দ্বারাই পরিচালিত হয় না, বরং ঢেউয়ের আঘাতে উত্তেজিত হইয়া স্রোতের বিরুদ্ধে সন্তরণ করে। কোন্ স্তরে তবে এই যুঝিবার শক্তি জাগিয়া উঠিয়াছে? ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র জীব-বিন্দু কখনও বাহিরের শক্তি গ্রহণ করে, কখনও ভিতরের শক্তি দিয়া প্রতিহার করে। গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যান করিবার ক্ষমতাই তো ইচ্ছা-শক্তি।
আর ভিতরের শক্তিই বা কিরূপে উদ্ভৃত হইয়াছে? বাহিরের ও ভিতরের শক্তি কি একেবারেই বিভিন্ন? পূর্বে বলিয়াছি যে, বনচাঁড়ালের পাতা দুইটি ভিতরের শক্তিবলে আপনা-আপনিই নড়িতে থাকে। কিন্তু গাছটিকে দুই দিন অন্ধকারে রাখিয়া দেখিলাম যে, পাতা দুইটি একেবারেই নিশ্চল হইয়া গিয়াছে। ইহার কারণ এই যে, ভিতরের শক্তি যাহা সঞ্চিত ছিল তাহা এখন ফুরাইয়া গিয়াছে। এখন পাতা দুইটির উপর ক্ষণিকের জন্য আলো নিক্ষেপ করিলে দেখা যায় যে, পাতা নড়িয়া সাড়া দিতেছে; কিন্তু আলো বন্ধ করিলেই পাতার স্পন্দন থামিয়া যায়। ইহার পর অধিক কাল আলোক নিক্ষেপ করিলে এক অত্যদ্ভুত ঘটনা দেখা যায়। এবার আলো বন্ধ করিবার পরেও পাতা দুইটি বহুক্ষণ ধরিয়া যেন স্বেচ্ছায় নড়িতে থাকে। ইহা অপেক্ষা বিস্ময়কর ঘটনা আর কি হইতে পারে? দেখা যায়, আলোরূপে যাহা বাহিরের শক্তি ছিল, গাছ তাহা গ্রহণ করিয়া নিজস্ব করিয়া লইয়াছে এবং বাহির হইতে সঞ্চিত শক্তি এখন ভিতরের শক্তির রূপ ধারণ করিয়াছে। সুতরাং বাহিরের ও ভিতরের শক্তি প্রকৃতপক্ষে একই; সামান্য বিভিন্নতা এই যে, যাহা পর্দার ওপারে ছিল তাহা এ-পারে আসিয়াছে; যাহা পর ছিল তাহা আপন হইয়াছে। আরও দেখা যায় যে, এইরূপ স্বতঃস্পন্দিত অবস্থায় পাতাটি বাহিরের আঘাতে বিচলিত হয় না। সে এখন বাহিরের শক্তি-নিরপেক্ষ, অর্থাৎ ভিতরের শক্তি দিয়া বাহিরের শক্তি প্রতিরোধ করিতে সমর্থ হইয়াছে। যখন ভিতরের সঞ্চয় ফুরাইবে কেবল তখনই গ্রহণ করিবে এবং পরে স্বেচ্ছাক্রমে প্রত্যাখ্যান করিবে। জীবনের কোন্ স্তরে তবে ভিতরের শক্তি ও স্বেচ্ছা উদ্ভুত হইয়াছে?
জন্মিবার সময় ক্ষুদ্র ও অসহায় হইয়া এই শক্তিসাগরে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিলাম। তখন বাহিরের শক্তি ভিতরে প্রবেশ করিয়া আমার শরীর লালিত ও বর্ধিত করিয়াছে। মাতৃস্তন্যের সহিত স্নেহ মায়া মমতা অন্তরে প্রবেশ করিয়াছে এবং বন্ধুজনের প্রেমের দ্বারা জীবন উৎফুল্ল হইয়াছে। দুর্দিন ও বাহিরের আঘাতের ফলে ভিতরে শক্তি সঞ্চিত হইয়াছে এবং তাহারই বলে বাহিরের সহিত যুঝিতে সক্ষম হইয়াছি।
ইহার মধ্যে আমার নিজস্ব কোথায়? এই সবের মূলে আমি না তুমি?
একের জীবনের উচ্ছ্বাসে তুমি অন্য জীবন পূর্ণ করিয়াছ; অনেকে তোমারই নির্দেশে জ্ঞান-সন্ধানার্থে জীবনপাত করিয়াছে, মানবের কল্যাণহেতু রাজ্যে-সম্পদ ত্যাগ করিয়া দুঃখ-দারিদ্য বরণ করিয়াছে এবং দেশসেবায় অকাতরে বধ্যমঞ্চে আরোহণ করিয়াছে। সেই সব জীবনের বিক্ষিপ্ত শক্তি অন্য জীবন জ্ঞান ও ধর্মে, শৌর্য ও বীর্যে পরিপূরিত করিয়াছে। ভিতর ও বাহিরের শক্তি-সংগ্রামেই জীবন বিবিধরূপে পরিস্ফুটিত হইতেছে। উভয়ের মূলে একই মহাশক্তি, যদ্দ্বারা অজীব ও সজীব, অণু ও ব্রহ্মাণ্ড অনুপ্রাণিত। সেই শক্তির উচ্ছ্বাসেই জীবনের অভিব্যক্তি। সেই শক্তিতেই মানব দানবত্ব পরিহার করিয়া দেবত্বে উন্নীত হইবে।