৭০-৮০. কন্সপিরেসিনেট.কম

অধ্যায় ৭১

কন্সপিরেসিনেট.কম

ব্রেকিং নিউজ

এখনও কিয়ার্শের আবিষ্কার জানার সুযোগ আছে আমাদের!

মাদ্রিদ প্রাসাদের গণসংযোগ বিভাগের প্রধান মনিকা মার্টিন আজ রাতে কিছুক্ষণ আগে এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে জানিয়েছেন যে, স্পেনের হবু রাণী মিস অ্যাম্ব্রা ভিদালকে অপহরণ করে জিম্মি করে রেখেছে আমেরিকান প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডন। প্রাসাদ থেকে স্থানীয়দের সাহায্য কামনা করা হয় অ্যাম্ব্রা ভিদালকে উদ্ধারের জন্যে।

আমাদের তথ্যদাতা, জনগণের প্রতিনিধি [email protected] নিচের বিবৃতিটা পাঠিয়েছে আমাদের ঠিকানা :

প্রাসাদ থেকে যা দাবি করা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যে-ইচ্ছে করে এমনটা করা হচ্ছে যাতে বার্সেলোনায় নিজের লক্ষ্যে পৌঁছুতে না পারেন রবার্ট ল্যাংডন (ভিদাল/ল্যাংডনের বিশ্বাস এখনও কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশন সবার জন্যে উন্মুক্ত করতে পারবেন তারা। আর তারা যদি সফল হয় তাহলে যে কোন সময় শুরু হয়ে যেতে পারে প্রেজেন্টেশনের সম্প্রচার। তৈরি থাকুন সবাই।

অবিশ্বাস্য এই তথ্যটা এখান থেকেই প্রথম জানতে পারলেন আপনারা। ল্যাংডন এবং ভিদাল গুগেনহাইম থেকে পালিয়েছেন কারণ এডমন্ডের কিয়ার্শের অসমাপ্ত ঘোষণাটা শেষ করতে চান তারা। কিন্তু প্রাসাদ থেকে তাদের বাঁধা দেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। (এটাও কি ভালদেসপিনোর চাল? প্রিন্স হুলিয়ান কী করছেন এ ব্যাপারে?)

নতুন খবর পাওয়ামাত্র আপনাদের জানানো হবে। তৈরি থাকুন, আজ রাতেই হয়তো সম্প্রচারিত হবে এডমন্ড কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশন।

.

অধ্যায় ৭২

ওপেল সেডান গাড়িটা শহরতলি পেছনে ফেলে এসেছে কিছুক্ষণ আগে। সেটার পেছনের সিটে বসে বিশপ ভালদেসপিনোর এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ খোঁজার চেষ্টা করছেন প্রিন্স হুলিয়ান।

কিছু একটা লকাচ্ছেন ভালদেসপিনো।

সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রাসাদ থেকে বেরোনোর পর এক ঘন্টারও বেশি। সময় পার হয়েছে ইতিমধ্যে-খুবই অদ্ভুত ঠেকেছিল ওর কাছে ব্যাপারটা, কিন্তু বিশপ ভালদেসপিনো এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন, যা করছেন সেটা ওর ভালোর জন্যেই।

তার ওপর ভরসা করতে বলেছিলেন।

হুলিয়ানের নিজের কোন চাচা না থাকলেও সেই অভাবটা পূরণ করে দিয়েছেন ভালদেসপিনো। ওর বাবার একদম ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে প্রাসাদে অবাধ যাতায়াত তার। কিন্তু এভাবে চোরের মতন পালিয়ে আসার প্রস্তাবটা শুরু থেকেই ওর মনে সন্দেহের উদ্রেক ঘটিয়েছিল। কিছু একটা সমস্যা তো আছেই-আমাকে এভাবে সবার থেকে আলাদা করে ফেলা হচ্ছে। ফোন নেই সাথে, খবর শুনতে দেয়া হচ্ছে না আর আমি কোথায় যাচ্ছি এটাও কেউ জানে না।

একটা মাটির তৈরি উঁচুনিচু রাস্তা দিয়ে চলছে এখন গাড়িটা। আর কিছুদূর গেলেই চোখে পড়বে ক্যাসিতা দেল প্রিন্সিপেতে যাওয়ার রাস্তা। দুপাশে সারি। সারি গাছের বুক চিড়ে সামনে অগ্রসর হয়েছে ওটা।

খালি ম্যানশনটার কথা মনে হতেই একটা অজানা আশঙ্কা চেপে বসলো হুলিয়ানের মনে। কিন্তু এই আশঙ্কার উৎপত্তিস্থল কোথায়, সেটা তিনি নিজেও জানেন না। ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা তরুণ যাজকের কাঁধে হাত দিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, গাড়িটা রাস্তার পাশে রাখো।

অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন ভালদেসপিনো, কিন্তু আমরা তো প্রায়-।

আমি জানতে চাই, কী ঘটছে! চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে। পারলেন না হুলিয়ান। ছোট্ট গাড়িটার ভেতরে বড্ড বেশি জোরালো শোনালো তার রাগত কণ্ঠস্বর।

প্রিন্স হুলিয়ান, আজ রাতটা সবার জন্যেই সমান খারাপ যাচ্ছে, কিন্তু আপনাকে অবশ্যই-

ভরসা রাখতে হবে আপনার ওপর?

হ্যাঁ।

গাড়ি থামান, আবারও তীক্ষ্ণ স্বরে নির্দেশ দিলেন হুলিয়ান।

না, থামিও না, পালটা নির্দেশ দিলেন ভালদেসপিনো, প্রিন্স হুলিয়ান, আমি ব্যাখ্যা-

গাড়ি থামান! এবার চিৎকার করে উঠলেন প্রিন্স।

সাথে সাথে ব্রেক কষলো তরুণ যাজক।

আমাদের কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে, তুমি বাইরে অপেক্ষা করো, হুলিয়ান বললেন।

দ্বিতীয়বার বলতে হলো না তরুণ যাজককে। দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে গেল সে। গাড়িতে এখন কেবল ভালদেসপিনো এবং প্রিন্স হুলিয়ান।

এই চাঁদের আলোতে বিশপের চেহারায় কিছুটা ভয়ের ছাপ দেখতে পেলেন হুলিয়ান।

ভয় পাওয়াই উচিত আপনার, নিজের কর্তৃত্বপরায়ণ কণ্ঠস্বর শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেলেন হুলিয়ান। চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তার দিকে তাকালেন ভালদেসপিনো। আগে কখনও তার সাথে এভাবে কথা বলেননি যুবরাজ।

আমি স্পেনের যুবরাজ, হুলিয়ান বললেন। আর আপনি কিনা আজ রাতে আমার নিরাপত্তাকর্মিদের থেকে দূরে নিয়ে এসেছেন আমাকে, ফোন রেখে আসতে বাধ্য করেছেন, এমনকি খবরও শুনতে দিচ্ছেন না। আমার হবু। স্ত্রী এখন কেমন পরিস্থিতিতে আছে সেটা পর্যন্ত জানি না আমি।

আমি সত্যিই দুঃখিত…ভালদেসপিনো বলা শুরু করলেন।

শুধু দুঃখিত হলে চলবে না, তার কথার মাঝেই বললেন হুলিয়ান। ভালদেসপিনোকে এভাবে নিচুস্বরে কথা বলতে দেখেননি আগে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন বিশপ। এরপর আঁধারের মাঝেই প্রিন্সের দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ রাতে আমার সাথে যোগাযোগ করে বলা হয়-

কে যোগাযোগ করেছিল?!

কিছুক্ষণ দ্বিধাবোধ করলেন ভালদেসপিনো। আপনার বাবা। গোটা ঘটনায় খুবই বিচলিত তিনি।

দু-দিন আগেও জারজুয়েলার প্রাসাদে গিয়ে বাবার সাথে দেখা করেছেন হুলিয়ান। তখন তো ভালো মেজাজেই ছিলেন তিনি। মানে শরীরের এমন অবস্থায় যতটা ভালো থাকা যায় আর কি।

কেন বিচলিত তিনি? জিজ্ঞেস করলেন যুবরাজ।

আজকে রাতের…এডমন্ড কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশনটা দেখছিলেন আপনার বাবা।

চোয়াল শক্ত হয়ে গেল হুলিয়ানের। ওর বাবা দিনের অধিকাংশ সময় ঘুমিয়েই কাটান। আর এডমন্ড কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশনটা যখন শুরু হয়েছিল তখন জেগে থাকার কথা নয় তার। সবচেয়ে বড় কথা, স্পেনের রাজা নিজেই। তার ঘরে কোন কম্পিউটার বাবা টেলিভিশন রাখতে মানা করেছিলেন, যাতে অবসর সময়টা বই পড়ে কাটাতে পারেন। সেখানকার সেবিকারাও নিশ্চয়ই তাকে ওরকম শরীর নিয়ে বাইরে কোথাও গিয়ে টেলিভিশন দেখার সুযোগ করে দেয়নি।

আমার দোষ, হঠাৎ বলে উঠলেন ভালদেসপিনো। আমিই একটা ট্যাবলেট কম্পিউটার দিয়েছিলাম তাকে কয়েক সপ্তাহ আগে, যাতে একাকিত্বে

ভোগেন তিনি আর জানতে পারেন, কী হচ্ছে গোটা বিশ্বে। ইমেইল করাও শিখতে চেয়েছিলেন তিনি। ওটাতেই কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশনটা দেখেন আপনার বাবা।

জীবনের একদম শেষ পর্যায়ে এসে এরকম একটা ক্যাথলিক বিরোধি প্রেজেন্টেশন তার বাবার মনে কেমন প্রভাব ফেলবে সেটা মনে হতেই অস্থির বোধ হতে লাগলো হুলিয়ানের। নিশ্চয়ই ঐ বিভৎস হত্যাকাণ্ডটারও সাক্ষি হতে হয়েছে তাকে। অথচ এই সময়গুলো দেশের জন্যে যা অর্জন করেছেন তিনি। সেগুলো নিয়ে ভেবে কাটানোর কথা ছিল।

আপনি বুঝতেই পারছেন নিশ্চয়ই, নিজেকে সামলে নিয়েছেন। ভালদেসপিনো, পুরো ঘটনা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েন তিনি। তবে তাকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দিয়েছে এডমন্ড কিয়ার্শের কথা বলার ধরণ এবং আপনার বাগদত্তার সেই প্রেজেন্টেশনের ব্যাপারে সাহায্য করার বিষয়টি। স্পেনের ভবিষ্যৎ রাণীর এমন আচরণ আপনার এবং প্রাসাদের ভাবমূর্তির ওপরও প্রভাব ফেলবে বলে তার বিশ্বাস।

অ্যাম্ব্রা নিজের ইচ্ছেমত চলে, আর সেটা করার পূর্ণ অধিকার আছে তার। বাবাও এই কথা ভালোমতোই জানেন।

হতে পারে। কিন্তু আজ রাতে যখন ফোনে কথা হয়েছে তার সাথে তখন প্রচণ্ড রেগে ছিলেন তিনি। অনেক দিন এভাবে রাগতে দেখিনি তাকে। তৎক্ষণাৎ আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন আপনার বাবা।

তাহলে আমরা এখানে কেন? সামনের রাস্তাটা দেখিয়ে জানতে চাইলেন হুলিয়ান। তিনি তো জারজুয়েলায়।

না, গম্ভীর স্বরে বললেন ভালদেসপিনো, ওখানকার লোকজনের সহায়তায় প্রস্তুত হয়ে হুইলচেয়ারে করে অন্য এক জায়গায় গিয়েছেন তিনি। যাতে সেখানে তার দেশের ইতিহাসের মধ্যে বসে শেষ দিনগুলো কাটাতে পারেন।

এতক্ষণে সবকিছু পরিষ্কার হলো হুলিয়ানের কাছে।

লা কাসিতায় যাওয়ার জন্যে বের হয়নি তাহলে ওরা।

ভালদেসপিনোর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন হুলিয়ান। সেদিকে অনেক দূরে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে করকটা গম্বুজ। একটি বিশাল দালানের অংশ ওগুলো।

এল এসকোরিয়াল।

এখান থেকে এক মাইলেরও কম দূরত্বে অ্যাবাস পাহাড়ের দাঁড়িয়ে আছে দূর্গসম দালানটা। পুরো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধর্মিয় স্থাপনাগুলোর একটি এল এসকোরিয়াল। আট একরেরও বেশি জায়গার জুড়ে অবস্থিত গোটা এল এসকোরিয়াল কমপ্লেক্স। তার ভেতরে একটি উপাসনালয়, একটি ব্যাসিলিকা, একটি রাজপ্রাসাদ, একটি লাইব্রেরি আর হুলিয়ানের দেখা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কয়েকটি ডেথ চেম্বার।

রয়্যাল ক্রিপ্ট। রাজ সমাধিস্থল।

আট বছর বয়সে বাবার সাথে প্রথম এখানে এসেছিলেন হুলিয়ান। নিজে ঘুরে দেখিয়েছিলেন দ্য প্যান্থেওন দি ইনফান্তেস-যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছে রাজ পরিবারের শিশুরা।

সেই ক্রিপ্টের সবচেয়ে অদ্ভুত সমাধিটার নাম বার্থডে কেক টম্ব-বৃত্তাকার কেকের আদলে গড়া সাদা রঙের কবরটা ষাটজনেরও বেশি রাজশিশুদের শেষ আশ্রয়স্থল।

এই অদ্ভুত দর্শন সমাধিটা দেখে ছোট্ট হুলিয়ান ভয় পেলেও সেই ভয় কেটে যায় কয়েক মিনিট পর। যখন তার মার সমাধিস্থলের সামনে তাকে নিয়ে যায় বাবা। হুলিয়ান প্রথমে ভেবেছিলেন, তার মার সমাধিটা হবে একদম রাজকীয়, বিশাল-একজন রাণীর ক্ষেত্রে যেমনটা হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। একটি পাথুরে রুমের একদম সাধারণ দর্শন বাক্সসদৃশ কবরের একটি কবরে মাকে শুয়ে দেখতে দেখে অবাক হন তিনি। পরে তার বাবা তাকে বুঝিয়ে বলে, ওর মার দেহাবশেষ বর্তমানে যেখানে রাখা হয়েছে সেগুলোকে বলা হয় পুদিদেরো বা ডিকেয়িং চেম্বার-রাজপরিবারের সব সদস্যদের ক্ষেত্রেই এমনটা করা হয়। এখান থেকে তিরিশ বছর পরে তাদের। মৃতদেহের অবশেষ নিয়ে স্থাপন করা হবে মূল সমাধিক্ষেত্রে। খুব কষ্ট করে সেদিন চোখের পানি আটকিয়েছিলেন হুলিয়ান।

এরপর তার বাবা তাকে নিয়ে যায় একটি পাতাল সিঁড়ির সামনে। ঘুরতে ঘুরতে নিচের অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে খাড়া খাড়া ধাপগুলো। তবে এখানকার সিঁড়ি এবং দেয়ালগুলো সাদা রঙের নয় বরং পীত বর্ণের। গোটা ব্যাপারটাই রাজসিক ঠেকে হুলিয়ানের চোখে। প্রতি তিনধাপ পর পর জ্বলছে দামি মোমবাতি।

প্রাচীন আমলের দড়ির তৈরি রেলিং ধরে সাবধানে বাবার পেছন পেছন অন্ধকারের উদ্দেশ্যে নামতে থাকে হুলিয়ান। সিঁড়ির একদম নিচে এসে একটা কারুকাজ করা দরজা খুলে সরে দাঁড়ায় ওর বাবা। ভেতরে প্রবেশের ইঙ্গিত দেয় হুলিয়ানকে।

প্যান্থিওন অব কিংস, রাজাদের সমাধিস্থল-ওর বাবা বলেন সশ্রদ্ধ কণ্ঠে।

মাত্র আট বছর বয়স হলেও এই জায়গাটার নাম আগেই শুনেছিলেন। হুলিয়ান। কিংবদন্তিদের শেষ আশ্রয়স্থল।

কাঁপা কাঁপা পায়ে চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে পা দেন হুলিয়ান। একটি আলোকজ্বল ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করেন। আটকোণা আকৃতির ঘরটার ছাদ থেকে ঝুলছে একটি দানবীয় ঝারবাতি। ধূপের গন্ধে ম ম করছিল চারপাশ। একদম মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ান হুলিয়ান। অবাক চোখে তাকান চারপাশে। কেমন যেন একটা বিষণ্ণতা বিরাজ করছিল ঘরটায়। নিজেকে হঠাৎই খুব ক্ষুদ্র প্রতীয়মান হয় তার।

আটটা দেয়ালেই নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত আলাদা আলাদা কুঠুরিতে রাখা কালো রঙের অনেকগুলো কফিন। প্রত্যেকটার গায়ে সোনালি রঙের নামফলক। আর এই নামগুলো হুলিয়ান পড়েছেন তার ইতিহাসের বইয়ে-রাজা ফার্ডিনান্ড-রাণী ইসাবেলা-সম্রাট পঞ্চম চার্লস, হলি রোমান এম্পায়ার।

এ সময় কাঁধে বাবার আন্তরিক হাতের স্পর্শ অনুভব করেন তিনি। একটা ভীষণ রকম রুঢ় সত্য মেনে নিতে বাধ্য হন সেদিন, একদিন আমার বাবার স্থানও হবে এখানে।

কিছুক্ষণের নীরবতার মধ্যে কাটিয়ে পাতালপুরি থেকে একসাথে সিঁড়ি বেয়ে আলোর রাজ্যে উঠে আসে বাবা-ছেলে। বাইরে বের হবার পর আট বছরের হুলিয়ানের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসেন তার বাবা।

চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন, মেমেস্তা মোরি। মৃত্যুর কথা মনে রাখবে সবসময়। এতদিন যে এত প্রতাপশালী রাজা-রাণীদের কথা শুনে এসেছে, তাদের শেষ পরিণতিটা দেখলে তো? মৃত্যুকে জয়ের জন্য কেবল একটি মাত্র উপায়ই আছে। নিজেকে নিয়ে যেতে হবে অনন্য উচ্চতায়, যেখানে একজন উদ্ভাসিত হবে আপন আলোকে। তোমার চোখ ঠিক তোমার মার মত। আর তার মত ভালো মানুষের দেখা খুব কমই পেয়েছি আমি জীবনে, তুমিও তেমনই হবে আশা করি। বিপদের সময় নিজের বিবেক যা বলে সেই সিদ্ধান্তটা নেবে সবসময়, কান পেতে শুনবে নিজের হৃদয়ের কথা।

সেই দিনের পর আজ পর্যন্ত হুলিয়ান নিজেকে এই বলে ধিক্কার দেন যে গোটা জীবনে এমন কিছু করতে পারেননি তিনি, যাতে করে আপন আলোয় উদ্ভাসিত হবেন। লোকে এখনও তার বাবার পরিচয়েই চেনে তাকে, তার ছায়া থেকে বের হতে পারেননি হুলিয়ান।

আমাকে নিয়ে নিশ্চয়ই হতাশ তিনি।

বাবার দেয়া উপদেশটি জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে মনে রেখেছেন হুলিয়ান। নিজের হৃদয়ের কথা শুনেছেন। কিন্তু তার হৃদয় এমন এক স্পেনের কথা বলে যেটা কিনা তার বাবার স্পেন থেকে একদম ভিন্ন। নিজের দেশের। ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা তার স্বপ্নগুলো এতটাই দুঃসাহসিক যে, তার বাবার মৃত্যুর আগে সেগুলোর কথা উচ্চারণও করা যাবে না। এমনকি রাজার মৃত্যুর পরেও তার নেয়া পদক্ষেপগুলো গ্রহণযোগ্য হবে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন তিনি। তাই অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না হুলিয়ানের হাতে।

কিন্তু তিন মাস আগে বদলে যায় সব সমীকরণ।

আম্রা ভিদালের সাথে দেখা হয় আমার।

এই দৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারি, প্রাণবন্ত স্বভাবের সুন্দরি পাল্টে দেয় তার জীবনের নক্সা। তার সাথে প্রথম সাক্ষাতের কয়েকদিনে মধ্যেই হুলিয়ান বুঝতে পারেন আট বছর বয়সে তার বাবার দেয়া উপদেশটার প্রকৃত অর্থ। হৃদয় যা বলবে তা মনোযোগ দিয়ে শুনবে…জীবনে প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করবে তাহলে। প্রেমে পড়ার এই অনুভূতি আগে কখনও অনুভব করেননি তিনি। আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে তার। হয়তো মহৎ একটি জীবনের দিকে অবশেষে পা বাড়াতে যাচ্ছেন।

তবে এখন স্পেনের রাজকুমার যা অনুভব করছেন সেটা হচ্ছে একাকিত্ব। তার বাবা মৃত্যুশয্যায়, ভালোবাসার মানুষটা কথা বলছে না তার সাথে আর কিছুক্ষণ আগে খুব কাছে একজন মানুষ, যার পরামর্শ নির্দ্বিধায় মেনে নেন তার বাবা, বিশপ ভালদেসপিনোর সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছেন।

প্রিন্স হুলিয়ান, তাকে শান্তস্বরে ডাক দিলেন বিশপ ভালদেসপিনো। আমাদের যাওয়া উচিত এখন। আপনার বাবার শরীরটা বড্ড দূর্বল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন তিনি।

আস্তে করে বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর দিকে চোখ ফেরালেন হুলিয়ান, আর কতটা সময় আছে তার কাছে?

ভালদেসপিনোর কণ্ঠ শুনে মনে হলো খুব কষ্ট করে কান্না চাপার চেষ্টা করছেন তিনি। আপনাকে এ ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করতে মানা করেছেন তিনি। তবুও বলাটা উচিত মনে করছি। খুব বেশি সময় নেই তার কাছে। আপনার কাছ থেকে চির বিদায় নিতে চান তিনি।

কোথায় যাচ্ছি এটা আমাকে আগে খুলে বলেননি কেন আপনি? হুলিয়ান জিজ্ঞেস করলেন, এত মিথ্যে আর গোপনীয়তার আশ্রয় কেন?

আমি দুঃখিত। আপনার বাবার কড়া নির্দেশ ছিল যাতে আপনাকে কিছু

বলে বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। যেন। খবরটা না পান আপনি। সবার আগে নিজে আপনার সাথে কথা বলতে চান তিনি।

যেন কোন খবরটা না পাই?

সেটা আপনার বাবার মুখ থেকে শুনলেই ভালো হবে।

দীর্ঘ একটা সময় বিশপের চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকলেন হুলিয়ান। তার সাথে দেখা করার আগে একটা কথা জানতে চাই আমি। মানসিক অবস্থা ঠিক আছে তো বাবার?

এটা কেন জিজ্ঞেস করছেন? অনিশ্চয়তার ছাপ ভালদেসপিনোর চোখে।

কারণ তার আজ রাতের নেয়া সিদ্ধান্তগুলো অদ্ভুত এবং আবেগতাড়িত ঠেকছে আমার কাছে, জবাব দিলেন হুলিয়ান।

বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন ভালদেসপিনো। আবেগতাড়িত হোক আর যাই হোক, এখনও স্পেনের রাজা তিনি। তাকে শ্রদ্ধা করি আমি, তার আদেশ শিরোধার্য। প্রত্যেকেরই এমনটাই ভাবা উচিত।

.

অধ্যায় ৭৩

ডিসপ্লে কেসটার পাশে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে ভেতরের বইটার দিকে তাকিয়ে আছে রবার্ট ল্যাংডন এবং অ্যাম্ব্রা ভিদাল। প্রদীপের টিমটিমে আলোয় একটা ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। বেঞ্চগুলো ঠিক করে রাখার অজুহাতে তাদের একান্তে কাজ করতে দিয়ে সরে গেছেন ফাদার বেনা।

ছোট ছোট অক্ষরে লেখা কবিতার লাইনগুলো পড়তে অসুবিধে হচ্ছে ল্যাংডনের। কিন্তু কবিতার নামটা বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকায় সেটা বুঝতে কোন সমস্যা হলো না।

দ্য ফোর জোয়াস

নামটা দেখার সাথে সাথে খুশি হয়ে উঠলো ল্যাংডন। এই কবিতাটি ব্লেকের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজগুলোর মধ্যে একটি। আশার বিষয় হচ্ছে গোটা কবিতাটিকেই একটি ভবিষ্যৎবাণী হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে। আকারে বেশ বড় কবিতাটি নটি অংশে বিভক্ত। ল্যাংডনের যতদূর মনে পড়ে ব্লেকের এই কবিতার বিষয়বস্তু হচ্ছে ধর্মকে ছাপিয়ে বিজ্ঞানের রাজত্ব।

স্তবকগুলো পড়ার চেষ্টা করতে লাগলো ল্যাংডন। পুরো পৃষ্ঠায় চোখ বুলিয়ে দেখলো যে, মাঝ বরাবর এসে শেষ হয়েছে লেখা।

কবিতার শেষ পাতা এটা, বুঝতে পারলো সে।

খুব চেষ্টা করেও প্যাঁচানো লেখাগুলো পড়তে পারলো না প্রদীপের ক্ষীণ আলোতে।

অ্যাম্ব্রা ইতোমধ্যে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়েছে। ডিসপ্লে কেসের কাঁচটা থেকে বড়জোর এক ইঞ্চি দূরে হবে তার মুখ। দ্রুত পুরো কবিতার ওপর চোখ বোলালো সে। একটা পঙক্তি জোরে জোরে পড়ে শোনালো ল্যাংডনকে, And Man walks forth from midst of the fires, the evil is all consumd,  এটুকু বলে ল্যাংডনের দিকে তাকালো সে, শেষ লাইনটুকু দিয়ে কী বোঝানো হচ্ছে?

হয়তো নিজের অন্যান্য ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর মতনই এমন একটা ভবিষ্যতের কথা উল্লেখ করেছে যেখানে ধর্ম হবে সকল প্রকার কুসংস্কার থেকে মুক্ত, কিছুক্ষণ ভেবে জবাব দিলো ল্যাংডন।

এডমন্ড বলেছিল, ওর পছন্দের কবিতাটা এমন একটি ভবিষ্যৎবাণী যেটা সত্য হলে খুশি হবে সে, আশান্বিত স্বরে বলল অ্যাম্ব্রা।

বেশ, তাহলে তো এই কবিতাটা এডমন্ডের চিন্তাভাবনার ধরণের সাথে ভালো মানাবে। কয়টা অক্ষর আছে এই পংক্তিতে?

পঞ্চাশটার বেশি, গোণার পর মাথা দুলিয়ে বলল অ্যাম্ব্রা। আবার কবিতাটা পড়া শুরু করলো সে। কিছুক্ষণ পর বলল, এটা কেমন? The Expanding eyes of Man behold the depths of wondrous worlds।

হতে পারে, বলল ল্যাংডন। যতই দিন যাবে মানুষের জ্ঞানের পরিধি বাড়তে থাকবে, চেনা পৃথিবীকে অচেনা আলোয় আবিষ্কার করবে তারা।

নাহ, হবে না। এটাতেও বেশি অক্ষর, বলল অ্যাম্ব্রা। পড়তে থাকি।

সে আবারো কবিতাটা পড়তে শুরু করলে তার পেছনে পায়চারি শুরু করলো ল্যাংডন। যে পঙক্তিগুলো তাকে পড়ে শুনিয়েছে অ্যাম্ব্রা সেগুলো পুরনো দিনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে ওকে। বিশেষ করে প্রিন্সটনে পড়াকালীন বৃটিশ লিটারেচার ক্লাসের কথা।

দুর্দান্ত স্মৃতিশক্তির কারণে এখনও সবকিছু একদম পরিষ্কার মনে আছে তার। সেদিন ব্লেকের এই কবিতাটা পড়ানো শেষ করে ছাত্রদের সামনে দাঁড়িয়ে প্রফেসর জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমরা কি বেছে নেবে? বিজ্ঞানহীন জগত নাকি ধর্মহীন জগত? এরপরেই ওদের জবাবের জন্যে অপেক্ষা না করে বলেন তিনি, ব্লেক কিন্তু একটাকে বেছে নিয়েছিলেন, সেটা তার কবিতার শেষ লাইনটা পড়লেই বোঝা যাচ্ছে। সেই পঙক্তিতে ভবিষ্যৎকে কেমন দেখতে চান তিনি, সেটা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন।

দ্রুত অ্যাম্ব্রার দিকে এগিয়ে গেল ল্যাংডন। কবিতার শেষে কী লেখা আছে সেটা মনে পড়েছে তার।

অ্যাম্ব্রা, একদম শেষ লাইনটা পড়ুন তো।

বিনা বাক্যব্যয়ে ঠিক তেমনটাই করলো অ্যাম্ব্রা। পড়া শেষ করে চোখ বড় বড় করে তাকালো তার দিকে।

ল্যাংডন নিজেও হাঁটুগেড়ে বসে পড়লো তার পাশে। যেহেতু কবিতার শেষ পঙক্তিটা মনে পড়েছে গিয়েছে তার, তাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাতের লেখাগুলো পড়তে অসুবিধে হলো না :

The dark religions are departed & sweet science reigns.

The dark religions are departed, জোরে জোরে পড়লো অ্যাম্ব্রা, And sweet science reigns.

পঙক্তিটা শুধু নিছক কোন ভবিষ্যৎবাণীই নয় বরং আজ রাতের এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনটার সারমর্মও বলা যায়।

বিজ্ঞানের জয়জয়কার হবে ভবিষ্যতে। বিজ্ঞানই রাজত্ব করবে।

অ্যাম্ব্রা গোণা শুরু করলো যে কয়টা অক্ষর আছে পঙক্তিটায়। কিন্তু তার কোন দরকার নেই, ল্যাংডন জানে, যা খুঁজছিলো সেটা পেয়ে গেছে ওরা। মনে মনে কিভাবে উইনস্টনের কাছে পৌঁছুতে হবে সেটা নিয়ে ভাবা শুরু করে দিয়েছে। তবে সেটার জন্যে অ্যাম্ব্রার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে হবে তাকে।

ফাদার বেনার দিকে ঘুরলো ল্যাংডন, ওদের দিকে কেবলই হেঁটে আসছিলেন বয়স্ক ভদ্রলোক। ফাদার? বলল ও, আপনি কি দয়া করে উপরে গিয়ে গার্ডিয়া রিয়েলের দুই এজেন্টকে হেলিকপ্টারটা ডেকে পাঠানোর কথা বলতে পারবেন? আমাদের কাজ প্রায় শেষের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রওনা হয়ে যাবো এখান থেকে।

অবশ্যই, বলে সিঁড়ির দিকে রওনা হয়ে গেলেন বেনা, আশা করি যা খুঁজছিলেন তা পেয়েছেন। খুব শিঘ্রই দেখা হচ্ছে ওপরে।

বয়স্ক যাজক ওপরে অদৃশ্য হয়ে যাবার সাথে সাথে ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে অ্যাম্ব্রা বলল, একটা অক্ষর কম এটায়। ছেচল্লিশটা, সাতচল্লিশটা নয়।

কি? তার দিকে হেঁটে গেল ল্যাংডন। চোখ কুঁচকে হাতে লেখা gefssot ECT id, The dark religions are departed & sweet science reigns। আসলেই ছেচল্লিশটা অক্ষর। চিন্তায় পড়ে গেল সে। আপনি নিশ্চিত, এডমন্ড সাতচল্লিশটা অক্ষরের কথাই বলেছিলো?

একদম।

আবারো পঙক্তিটা পড়লো ল্যাংডন। এটা ছাড়া অন্য কোনটা হতে পারে। কিছু একটা ভুল হচ্ছে, কিন্তু কি?

সময় নিয়ে প্রতিটা অক্ষর আলাদা আলাদাভাবে দেখলো ল্যাংডন। হাল ছেড়ে দেবে এমন সময় ব্যাপারটা ধরতে পারলো সে।

…& sweet science reigns

অ্যাম্পারস্যান্ড, বলল ল্যাংডন, মানে and-এর বদলে যে চিহ্নটা ব্যবহার করেছেন ব্লেক।

বিস্মিত চোখে ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে অ্যাম্ব্রা বলল, রবার্ট, and হলেও কিন্তু লাভ হচ্ছে না আমাদের, তখন একটা অক্ষর বেশি হয়ে যাচ্ছে, আটচল্লিশটা।

না, ল্যাংডন ভাবলো, এটা হচ্ছে সংকেতের ভেতরে সংকেত।

এডমন্ডের চালাকিটা ধরতে পেরে অবাক না হয়ে পারলো না ল্যাংডন। একটা টাইপোগ্রাফিক কৌশলকে পাসওয়ার্ডের গোপনীয়তা রক্ষার্থে ব্যবহার করেছে সে। যদি কেউ বের করেও ফেলে তার পছন্দের পঙক্তিটা, তবুও সমস্যা হবে তাদের। অ্যাম্পারস্যান্ড সংকেতের কথা তাহলে মনে ছিল এডমন্ডের।

সিম্বলজির ক্লাসের একদম শুরুতেই এই সংকেত সম্পর্কে পড়ায় ল্যাংডন। সংকেতটা প্রকৃতপক্ষে একটি লোগোগ্রাম। দুটি অক্ষরকে প্রতিস্থাপন করে সংকেতটা। অনেকের ধারণা যে and-এর বদলে ব্যবহৃত হয় এটা, কিন্তু সেই ধারণা ভুল। প্রকৃতপক্ষে এটা আসলে ল্যাটি et. শব্দটার প্রতিস্থাপন। ইংরেজি E এবং T অক্ষরের মিশেলে গঠিত হয়েছে। কেউ যদি এমএস ওয়ার্ডে Trebuchet MS ফন্ট ব্যবহার করে তাহলে পরিষ্কার বুঝতে পারবে সেটা। কারণ এই ফন্টের অ্যাম্পারস্যান্ড সংকেতটা ল্যাটিন উৎপত্তির কথা মাথায় রেখে বানানো হয়েছে–

ল্যাংডনের মনে আছে, এডমন্ডদের ক্লাসে সে এটা পড়ানোর কয়েকদিন পর একটা টিশার্ট পরে ক্লাসি হাজির হয়েছিল ছেলেটা। সেখানে লেখা ছিল, অ্যাম্পারস্যান্ড ফোন হোম! ল্যাংডনের বুঝতে অসুবিধে হয়নি, কথাটা দিয়ে স্পিয়েলবার্গের বিখ্যাত সিনেমা ইটির ভিনগ্রহের প্রাণীটার তার নিজ গ্রহে ফিরে যাবার ব্যাপারটা ইঙ্গিত করছিল সে। ইটি ফোন হোম-সংলাপটি খুবই বিখ্যাত।

এবারে সাতচল্লিশ অক্ষরের পাসওয়ার্ডটা একদম মিলে গেছে।

Thedarkreligionsaredepartedetsweetsciencereigns

অ্যাম্ব্রাকে নিজের উপলব্ধির কথাটা খুলে বলল সে দ্রুত। বোঝালো, এডমন্ড তার পাসওয়ার্ডের গোপনীয়তা রক্ষার জন্যেই এমনটা করেছে।

চওড়া হাসি ফুটলো অ্যাম্ব্রার মুখে। এডমন্ড যে বড় মাপের আঁতেল, সে ব্যাপারে কখনই সন্দেহ হয়নি আমার।

তার কথাটা শুনে না হেসে পারলো না ল্যাংডনও।

পাসওয়ার্ডটা তো আপনার জন্যে পেয়ে গেলাম আমরা, কৃতজ্ঞচিত্তে বলল অ্যাম্ব্রা। ইশ! তখন যদি ফোনটা না হারাতাম! তাহলে এখনই এডমন্ডের আবিষ্কারটা সবার জন্যে উন্মুক্ত করে দিতে পারতাম আমরা।

আপনি তো আর ইচ্ছে করে হারাননি, তাকে আশ্বস্ত করার জন্যে বলল ল্যাংডন, আর আমি তো বলেছিই, উইনস্টনের কাছে কিভাবে যেতে হবে সেটা জানা আছে আমার।

আশা করি আমার ধারণাটা ঠিক, মনে মনে বলল ল্যাংডন।

হেলিকপ্টার থেকে দেখা গোটা বার্সেলোনার চিত্রটা আবারো চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার। ঠিক এই সময়ে সমাধিক্ষেত্রের নীরবতা চিড়ে ওপর থেকে ভেসে এলো ফাদার বেনার চিৎকার।

ওদের নাম ধরে তারস্বরে ডাকছেন তিনি!

.

অধ্যায় ৭৪

মিস ভিদাল! প্রফেসর ল্যাংডন! ওপরে আসুন জলদি!

ফাদার বেনার এই চিৎকার শুনে যত দ্রুত সম্ভব সিঁড়ি ডিঙিয়ে ওপরে উঠতে লাগলো ওরা দু-জন। অবশেষে যখন পৌঁছুলো, ল্যাংডনের খেয়াল হলো, পুরো উপাসনালয় অন্ধকারের চাঁদরে আচ্ছন্ন।

কিছুই দেখা যাচ্ছে না!

কিছুক্ষণ পর খানিকটা সয়ে আসলো অন্ধকার। বুঝতে পারলো, তার পাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে অ্যাম্ব্রা।

এখানে! ফাদার বেনা ডাক দিলেন ওদের।

শব্দ অনুসরণ করে সেদিকে হাঁটতে লাগলো ওরা। নিচের সমাধিকক্ষ থেকে আগত মৃদু আলোতে বৃদ্ধ যাজকের অবয়বটা বোঝা যাচ্ছে কোনমতে। হাঁটুতে ভর দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা একজনের দেহের পাশে বসে আছেন তিনি।

মুহূর্তের মধ্যে তার পাশে গিয়ে বসে পড়লো ওরা। যা দেখলো তাতে পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো ল্যাংডনের। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দেহটা এজেন্ট ডিয়াজের। তবে তার মাথাটা বর্তমানে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে ক্যাথেড্রালের ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক দৃষ্টিতে। ফাদার বেনা কেন ওভাবে আতঙ্কিত

স্বরে ডাকছিলেন বুঝতে পারছে এবার।

ভয়ের শীতল একটা সোত নেমে গেল ল্যাংডনের শিরদাঁড়া বরাবর। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশে তাকালো সে। কারো নড়াচড়া দেখা যায় কিনা বোঝার চেষ্টা করলো।

ওনার বন্দুকটা বেল্ট থেকে খুলে নেয়া হয়েছে, ভয়ার্ত স্বরে বলল অ্যাম্ব্রা। এজেন্ট ফনসেকা?! ডাক দিলো সে।

এ সময় অন্ধকারের মধ্যেই ক্যাথেড্রালের একপাশ থেকে ধস্তাধস্তির শব্দ কানে আসলো ওদের। এরপর প্রচণ্ড শব্দে গর্জে উঠলো একটা বন্দুক। খুব কাছেই চালানো হয়েছে গুলি। ল্যাংডন, অ্যাম্ব্রা এবং ফাদার বেনা পেছন দিকে। সরে গেল সাবধানে। একটা যন্ত্রনাকাতর কণ্ঠস্বর কানে এলো ওদের, ও কোররে! পালান!

দ্বিতীয়বারের মত গর্জে উঠলো বন্দুক। থপ করে ভারি কিছু মেঝেতে পড়ার শব্দ শুনতে পেলো ওরা। বুঝতে বাকি থাকলো না কিসের শব্দ।

অ্যাম্ব্রার হাত ধরে ইতিমধ্যে চার্চের কোণার দেয়ালের দিকে দৌড় দিয়েছে ল্যাংডন। তাদের ঠিক পেছনেই আছেন ফাদার বেনা। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঠাণ্ডা দেয়ালের নিকষ ছায়ার আড়ালে আশ্রয় নিলো ওরা।

অন্ধকারের মধ্যেই পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো ল্যাংডন।

এজেন্ট ডিয়াজ এবং ফনসেকাকে হত্যা করা হয়েছে! অন্ধকারে লুকিয়ে আছে কেউ। কিন্তু কে? কি চায় সে?

সত্যটা অনুধাবন করতে বেশি কষ্ট কতে হলো না ল্যাংডনকে। নিশ্চয়ই এখানে দু-জন রয়্যাল গার্ডকে হত্যা করতে আসেনি ঘাতক। তার মূল লক্ষ্য ল্যাংডন এবং অ্যাম্ব্রা।

কেউ এখনও এডমন্ডের আবিষ্কার চিরদিনের মত মুছে ফেলতে চাইছে।

এ সময় একটা উজ্জ্বল ফ্ল্যাশলাইট জ্বলে উঠলো চার্চের মাঝখানে। সব দিকে আলো ফেলে ওদের খুঁজতে লাগলো ওটার মালিক। কিছুক্ষণের মধ্যেই যে ওদের অবস্থান জেনে যাবে সে, তা বুঝতে অসুবিধে হলো না ল্যাংডনের।

এদিকে, ফিসফিস করে বলে অ্যাম্ব্রার হাত ধরে দেয়ালের বিপরীত দিকে নিয়ে যেতে থাকলেন ফাদার বেনা। তাদের পিছু নিলো ল্যাংডন। আলোটা আরেকটু হলে সরাসরি ওদের গায়ের ওপর এসে পড়তো। ফাদার। বেনা এবং অ্যাম্ব্রা হঠাৎ করে ডানে একটা ফাঁকা জায়গায় ঢুকে গেলে তাদের অনুসরণ করলো ল্যাংডন, কিন্তু সাথে সাথে হোঁচট খেতে হলো তাকে। একটা সিঁড়িঘর এটা। অ্যাম্ব্রা এবং ফাদার বেনা ওপরে উঠে যাচ্ছেন। সামলে নিয়ে তাদের পেছন পেছন উঠতে লাগলো সে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো আলো এসে পড়েছে সিঁড়ির একদম নিচের ধাপে। ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হতে লাগলো আলোটা।

এদিকেই আসছে লোকটা!

যতটা কম শব্দ করে সম্ভব উপরে উঠে যাচ্ছে ফাদার বেনা এবং অ্যাম্ব্রা। ঘুরে ওপরের সিঁড়িতে পা রাখতে গিয়ে একটা দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেলো ল্যাংডন। বুঝতে পারলো, সোজা নয়, পেঁচিয়ে উপরে উঠে গেছে সিঁড়িটা। দেয়াল হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলো সে। কোথায় আছে এখন সেটা বুঝতে পেরেছে।

সাদা ফামিলিয়ার বিপজ্জনক প্যাঁচানো সিঁড়িতে আছে এখন ওরা।

ওপরের দিকে তাকালে একটা আবছা আলো চোখে পড়লো ল্যাংডনের। সেই আলোতে দেখলো, একদম সংকীর্ণ সিঁড়িগুলো পেঁচিয়ে উঠে গেছে অনেকদূর অবধি। বদ্ধ জায়গায় হঠাৎই পা কাঁপতে শুরু করলো তার। বরাবরই ক্লস্ট্রোফোবিক সে।

ওপরে ওঠো! নিজেকেই তাড়া লাগালো সে। কিন্তু পায়ের মাংসপেশিগুলো যেন জমে গেছে।

এসময় নিচ থেকে কারো পায়ের আওয়াজ কানে আসলো ওর। জোর করে যদ্রুত সম্ভব দেয়াল হাতড়ে হাতড়ে প্যাঁচানো সিঁড়িগুলো ডিঙিয়ে ওপরে উঠতে লাগলো ল্যাংডন। যত উপরে উঠছে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এ সময় দেয়ালের গায়ে একটা খালি জায়গা পেরোলো সে। সেই ফাঁক দিয়ে বার্সেলোনা শহরের জ্বলতে থাকা আলো এসে পড়লো ওর গায়ে। ঠাণ্ডা বাতাস প্রায় কাঁপুনি ধরিয়ে দিলো। সময় নষ্ট না করে আগের চেয়ে দ্রুত ওপরে উঠতে শুরু করলো ল্যাংডন।

আবারো নিচ থেকে পদশব্দ শুনতে পেলো। চক্রাকার সিঁড়ির মাঝের ফাঁকা অংশ বরাবর নিচ থেকে ফ্ল্যাশলাইটের আলো ধরলো কেউ। দেয়ালের সাথে প্রায় সেঁটে গেল। কিছুক্ষণ পরেই আবার ওপরে উঠতে শুরু করলো ফ্ল্যাশলাইটের মালিক, আগের চেয়ে দ্রুত।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাদার বেনা এবং অ্যাম্ব্রার কাছে পৌঁছে গেল সে। দুজনেই হাঁপাচ্ছে প্রচণ্ড। সাবধানে সিঁড়ির কোণায় গিয়ে চক্রাকার ফাঁকা অংশটা দিয়ে একবারের জন্যে নিচে উঁকি দিলো ল্যাংডন, সাথে সাথে মাথা ঘুরে উঠলো তার। কোন সুরক্ষা বেষ্টনি নেই সিঁড়ির এই পাশটায়। একবার পা হড়কালে একদম প্রপাত ধরণীতল।

ওপরের। দিকে তাকালো ল্যাংডন। ওর জানামতে চারশরও বেশি ধাপ রয়েছে এই সিঁড়িতে। সেটা যদি সত্যি হয়, তবে কোনভাবেই নিচের লোকটা ওদের ধরে ফেলার আগে ওপরে পৌঁছানো সম্ভব হবে না।

আপনারা দুজন উঠে যান! ফাদার বেনা বললেন শ্বাস নেয়ার ফাঁকে। না! একসাথেই উঠব আমরা, অ্যাম্ব্রা বলল। বৃদ্ধ যাজককে সাহায্য করার জন্যে গতি কমিয়ে দিলো সে।

অ্যাম্ব্রার আচরণে মুগ্ধ হলেও ল্যাংডন ভালোমতোই জানে, সিঁড়ি বেয়ে এভাবে ওপরে উঠতে থাকার পরিণত হচ্ছে মৃত্যু। এক না এক সময় পেছন থেকে গুলি চালাবেই আততায়ী। বিপদে পড়লে যে কোন প্রাণীর কাছে দুটো উপায় থাকে। হয় লড়াই করতে হবে, নাহলে পালাতে হবে। এক্ষেত্রে পালানোটা সম্ভব নয়।

অ্যাম্ব্রা এবং ফাদারকে ওপরে উঠতে দিয়ে যে সিঁড়িতে ছিল সেখানেই থেমে গেল ল্যাংডন। দেয়ালের সাথে গা ঘেষে নিচু হয়ে ঝুঁকে অপেক্ষা করতে লাগলো আধো-অন্ধকারে। ফ্ল্যাশলাইটের আলো উজ্জ্বল হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। এরপর হঠাৎ করেই তার দৃষ্টিগোচর হলো আততায়ী। এক হাতে ফ্ল্যাশলাইট এবং অন্য হাতে বন্দুক ধরে রেখেছে সে।

চকিতে উঠে দাঁড়িয়ে শূন্যে লাফ দিলো ল্যাংডন। লোকটা ওর দিকে বন্দুক তাক করার আগেই গোড়ালি দিয়ে আঘাত হানলো তার বুকে। ছিটকে পেছনের দিকে পড়ে যেতে লাগলো আততায়ী।

এরপরের কয়েক সেকেন্ডে কী হলো তা বুঝে উঠতে পারলো না ল্যাংডন।

পাথুরে সিঁড়ির ওপর আছড়ে পড়লো সে। প্রচণ্ড ব্যথার একটা অনুভূতি পা বেয়ে উঠে গেল ওপরে। তার কয়েক সিঁড়ি নিচে গিয়ে পড়েছে আততায়ী। তার হাতের ফ্ল্যাশলাইটটা গড়াতে গড়াতে আরও নিচে চলে গেল। তবে সেটার আলোয় একবারের জন্যে আক্রমনকারী আর ওর থেকে সমান দূরত্বে একটা ধাতব জিনিস পড়ে থাকতে দেখলো ল্যাংডন।

অস্ত্রটা।

দু-জনেই একই সময়ে ঝাঁপ দিলো ওটা নেয়ার জন্যে, কিন্তু ল্যাংডন ওপরে থাকায় সে-ই আগে পৌঁছে গেল বন্দুকটার কাছে। সেটা হাতে তুলে নিয়ে তাক করলো আক্রমনকারীর দিকে। জায়গাতেই থেমে গেল লোকটা।

তাকিয়ে আছে বন্দুকের ব্যারেলের দিকে।

ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় লোকটার চেহারা দেখতে পেলো ল্যাংডন। ধবধবে সাদা প্যান্টটাও চোখ এড়ালো না। সাথে সাথে তাকে চিনে ফেললো সে।

গুগেনহাইমের সেই নেভি অফিসার!

লোকটার কপালের বরাবর বন্দুক তাক করে ট্রিগারে হাত রাখলো ল্যাংডন। আমার বন্ধু এডমন্ড কিয়াকে হত্যা করেছেন আপনি!

ওটা তার প্রাপ্য ছিল। আমার পুরো পরিবারকে হত্যা করেছে আপনার বন্ধু, ঠাণ্ডা স্বরে বলল লোকটা।

.

অধ্যায় ৭৫

পাঁজরের প্রচণ্ড ব্যথা সত্ত্বেও খুব কষ্ট করে চেহারা স্বাভাবিক রেখেছে আভিলা।

কটা হাড় ভেঙেছে কে জানে! হারভার্ডের এক প্রফেসরের কাছ থেকে আর যা-ই হোক এরকম অতর্কিত আক্রমণ আশা করেনি সে। প্রতিটা শ্বাস নিতে বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। কিছুটা ওপর থেকে ওর কপাল বরাবর পিস্তলটা তাক করে রেখেছে রবার্ট ল্যাংডন।

সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীন বেশ কয়েকবার এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে আভিলাকে, তাই ভালমতোই জানে, কী করতে হয় এরকম বিপদের সময়। শক্রর প্রতিটি পদক্ষেপের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। যাচাই করতে হবে সম্ভাব্য পরিণতিগুলো।

খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই আভিলা। শক্রর হাতে বন্দুক এবং তার থেকে উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সে। তবে ল্যাংডন যেভাবে ধরে আছে বন্দুক তাতে মনে হচ্ছে না, এ ব্যাপারে খুব বেশি পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে তার।

আমাকে গুলি করার ইচ্ছে নেই তার, মনে মনে ভাবলো আভিলা। বন্দুক তাক করে রেখে সিকিউরিটি গার্ডদের আশা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে সে।

চার্চের বাইরে থেকে আগত শোরগোলের আওয়াজ শুনে বোঝা যাচ্ছে, গুলির শব্দ কানে গিয়েছে সাদা ফামিলিয়ার সিকিউরিটি গার্ডদের।

যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।

দুই হাত কাঁধের ওপরে তুলে রেখে হাঁটু গেড়ে বসলো আভিলা।

ল্যাংডনকে এমনটা ভাবতে বাধ্য করতে হবে যেন তার মনে হয় পুরো পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রনে আছে।

সিঁড়িতে কয়েক ধাপ গড়িয়ে পড়া সত্ত্বেও কোমরের পেছনে বেল্টের সাথে আটকানো বস্তুটার উপস্থিতি অনুভব করতে পারছে আভিলা। একটা। সিরামিকের পিস্তল-যেটার সাহায্যে গুগেনহাইমে কিয়াকে হত্যা করেছে সে। শেষ বুলেটটা পিস্তলে এখনও রয়ে গেছে, সেটা ব্যবহারের দরকার পড়েনি তার। সাদা ফামিলিয়ার ভেতরে প্রবেশের পর একজন রয়্যাল গার্ডকে নিঃশব্দে হত্যা করে তার কাছ থেকে বন্দুকটা ছিনিয়ে নিয়ে সেটা দিয়েই অপরজনকে হত্যা করে সে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এখন সেই বন্দুকটাই শোভা পাচ্ছে ল্যাংডনের হাতে। সেফটি ক্লাচটা বন্ধ করে দিলেই ভালো হতো, ল্যাংডন নিশ্চয়ই বন্দুকের ব্যাপারে বেশি কিছু জানে না।

আভিলা একবার ভাবলো কোমর থেকে সিরামিকের বন্দুকটা বের করে নিয়ে সেটা দিয়ে আক্রমন করবে ল্যাংডনকে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও তার গুলি খাওয়া এবং না খাওয়ার সম্ভাবনা অর্ধেক অর্ধেক। অনভিজ্ঞ বন্দুক চালকদের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় যে ভুলবশত গুলি বের হয়ে গিয়েছে।

যদি দ্রুত বন্দুকটা বের করে আনতে পারতাম….

গার্ডদের গলার আওয়াজ আগের চেয়ে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। এখন যদি তাকে আটক করে গার্ডরা তবে তার হাতের তালুতে আঁকা ভিক্টর ট্যাটুটা দেখে নিশ্চয়ই ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। অন্তত রিজেন্ট এমনটাই বলেছিলেন। কিন্তু দুজন রয়্যাল গার্ডের এজেন্টকে খুন করার পরেও সেটা কতটা কার্যকর হবে সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে আভিলার।

একটা গুরুত্বপূর্ণ মিশন নিয়ে এখানে এসেছি আমি, নিজেকে শোনালো আভিলা, যেভাবেই হোক সেটা পূরণ করতে হবে আমাকে। ল্যাংডন এবং অ্যাম্ব্রা ভিদালকে সরিয়ে দিতে হবে পৃথিবী থেকে।

রিজেন্ট তাকে বলেছিলেন চার্চের পূর্ব দিকে সার্ভিস গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে, কিন্তু সেদিকে পুলিশি পাহাড়া থাকায় নিরাপত্তা বেষ্টনি ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকেছে সে। অর্থাৎ সবসময় যে রিজেন্টের কথানুযায়ী সব করতে হবে এমন নয়। পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে তাকে।

আপনি যে বললেন এডমন্ড কিয়ার্শ আপনার পুরো পরিবারকে হত্যা করেছে-অভিযোটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আর যাই হোক, খুনি ছিল না এডমন্ড।

ঠিক বলেছেন। খুনির চেয়েও খারাপ।

কিয়ার্শের চরিত্রের এই অন্ধকার দিকটার কথা কয়েকদিন আগে রিজেন্টের কাছ থেকে ফোনে জেনেছিল আভিলা। পোপ চান, বিখ্যাত ফিউচারিস্ট এডমন্ড কিয়াকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন আপনি রিজেন্ট বলেছিলেন ওকে, আপনার জন্যে যে এটা একটা ব্যক্তিগত মিশন হতে যাচ্ছে সেটা জানা আছে তার।

কিন্তু আমি কেন? জানতে চেয়েছিল আভিলা।

অ্যাডমিরাল, রিজেন্টের খসখসে কণ্ঠস্বরটা কখনও ভুলবে না আভিলা, আপনাকে দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, এডমন্ড কিয়ার্শই ক্যাথেড্রালে বোমা বিস্ফোরণের মূল হোতা। যে বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছে আপনার পরিবারের সবাই।

আপনি আগে সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন, অ্যাডমিরাল, তাকে ব্যাখ্যা করে বলেন রিজেন্ট, তাই এটা আপনি ভালো করেই জানেন যে সাধারণ সৈনিকেরা আদেশ অনুযায়ি কাজ করে কেবলমাত্র। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা থেকে যায় পর্দার আড়ালে।

কথাটা যে সত্য সেটা জানতো আভিলা।

সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যারা আদেশ পালন করে তাদের কেউই মূল অপরাধি না। বরং বিভিন্ন নেতারা এসব করতে বাধ্য করে তাদের। ভুল বার্তা দিয়ে মগজ ধোলাই করা হয়। কেবলমাত্র একজন ধূর্ত ব্যক্তির পক্ষেই অনেককে ভুল পথে পরিচালিত করা সম্ভব, যদি অশুভ শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয় সে।

সহমত প্রকাশ করে আভিলা।

প্রকৃত খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে পুরো পৃথিবী জুড়ে, রিজেন্ট বলেন, আর এই আক্রমনের পেছনে যারা আছে তাদের একজন হচ্ছে এডমন্ড কিয়ার্শ।

রিজেন্টের এই কথাটা শুনে আভিলার মনে হয়েছিল, হয়তো একটু বাড়িয়েই বলছেন তিনি। এডমন্ড কিয়ার্শ খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে অনেক কিছু বললেও কখনও তাদের হত্যা করার ব্যাপারে কিছু বলেনি।

আপনি আপত্তি করার আগে জানিয়ে রাখি, যেন ওর সন্দেহটা ফোনের ওপাশ থেকেই ধরতে পেরেছিলেন রিজেন্ট, ক্যাথেড্রালে বোমা আক্রমনের প্রধান লক্ষ্য ছিল পালমেরিয়ান চার্চের অনুসারিরা। আর সেটাতেই প্রাণ হারায় আপনার পরিবার।

এই কথাটা শোনার পরও সন্দেহ পুরোপুরি দূর হয় না আভিলার। সেভিয়া ক্যাথেড্রাল তো পালমেরিয়ানদের না।

আক্রমনের দিন ভোরে সেভিয়া চার্চে অবস্থান করছিল পালমেরিয়ান চার্চের চারজন সদস্য। নতুন অনুসারিদের আহ্বানের কাজে সেখানে গিয়েছিল তারা। তাদের একজনকে আপনি চেনেন-মার্কো। অন্য তিনজন মারা যায় বিস্ফোরণে। তারাই ছিল গোটা আক্রমনের মূল লক্ষ্য।

ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট মার্কোর চেহারা মানসপটে ভেসে ওঠে আভিলার। এক পা হারাতে হয়েছিল তাকে।

আমাদের শত্রুরা ক্ষমতাধর এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এল পালমার দে ত্রয়াতে প্রবেশের সুযোগ না পেয়ে আমাদের চারজন মিশনারিকে অনুসরণ করে সেভিয়া ক্যাথেড্রালে তাদের ওপর হামলা চালায় তারা। আপনার ক্ষতির জন্যে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত, অ্যাডমিরাল। এই কারণেই পালমেরিয়ানরা আপনার দিকে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা মনে করি আপনাদের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর দায়ভার অনেকটাই আমাদের। পালমেরিয়ানদের বিরুদ্ধে ঘোষিত যুদ্ধের কারণেই মারা গেছে তারা।

কিন্তু কে এই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে? জানতে চায় আভিলা।

আপনার ইমেইল দেখুন, জবাবে বলেন রিজেন্ট।

ইমেইলের ইনবক্সে ঢুকে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় আভিলার। সেখানে কিছু ডকুমেন্ট পাঠানো হয়েছে তাকে, যেখানে প্রমাণ রয়েছে পালমেরিয়ানদের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধের। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলছে এই যুদ্ধ। পালমেরিয়ানদের ওপর নজরদারি করার জন্যে গড়ে ওঠা সংগঠনগুলোর ফান্ডও ফুলে ফেপে উঠছে প্রতিনিয়ত। আইনী ঝামেলা থেকে শুরু করে সরাসরি হুমকি দিতেও পিছপা হয় না তারা।

আর সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এই সব কার্যক্রমের পেছনে কেবল একজন মানুষ দায়ি-এডমন্ড কিয়ার্শ।

পালমেরিয়ানদের বিরুদ্ধে কিয়ার্শের এই তীব্র বিদ্বেষের কারণ কি? হতবাক কণ্ঠে জানতে চায় সে।

জবাবে রিজেন্ট তাকে বলেন, এই উত্তরটা স্বয়ং পোপেরও জানা নেই কেন পালমেরিয়ানদের এত ঘৃণা করে এডমন্ড কিয়ার্শ। তবে এটা জানেন, পালমেরিয়ানদের নিশ্চিহ্ন করে না দেয়া অবধি যুদ্ধ চালিয়েই যাবে এই বিখ্যাত ধনকুবের এবং ফিউচারিস্ট।

এরপরে ইমেইলের মাধ্যমে পাঠানো শেষ ডকুমেন্টটা আভিলাকে খুলতে বলেন রিজেন্ট। সেখানে সেভিয়ায় বোমা বিস্ফোরণের জন্যে দায়ি একজনের পক্ষ থেকে পালমেরিয়ানদের কাছে পাঠানো চিঠিটা সংযুক্ত করা আছে। চিঠির প্রথম লাইনেই লেখা-এডমন্ড কিয়ার্শের অনুসারি।

তবে এই চিঠিটা কখনও জনসম্মুখে প্রকাশ করেনি পালমেরিয়ান চার্চ, কারণ তাতে করে ভীতির সঞ্চার হবে সাধারণ মানুষদের মধ্যে। তাছাড়া তাদের নিজেদের ভাবমূর্তিও নষ্ট হবে।

এডমন্ড কিয়ার্শের কারণে মারা গেছে আমার পরিবারের সবাই।

এখন, এই আধো অন্ধকারে সাদা ফামিলিয়ার বিখ্যাত সিঁড়িঘরে দাঁড়িয়ে আভিলা এটা অনুধাবন করতে পারছে, এডমন্ড কিয়ার্শের আসল রূপ সম্পর্কে অবগত নয় রবার্ট ল্যাংডন। কিয়ার্শের কারণেই যে সেদিন বোমা হামলাটা হয়েছিল সেটাও জানে না।

জানুক বা না জানুক এখন আর সেটাতে কিছু আসে যায় না, আভিলা ভাবলো, আমার মতনই একজন সাধারণ সৈনিক সে। আর আজকে এই সম্মুখযুদ্ধ থেকে কেবল একজনই বেঁচে ফিরবে। আমাকে আমার নির্দেশ অনুযায়ি কাজ করতে হবে।

তার থেকে কয়েক ধাপ ওপরে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে ল্যাংডন। দুই হাত দিয়ে ধরে রেখেছে পিস্তলের বাট। আনাড়িপনার লক্ষণ। দৌড় দেয়ার আগে দৌড়বিদরা যেভাবে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে বসে, আস্তে আস্তে সেই অবস্থানে নিজেকে নিয়ে গেল আভিলা। এক মুহূর্তের জন্যেও চোখ সরায়নি ল্যাংডনের ওপর থেকে।

আপনার হয়তো কথাটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, আভিলা বলল, কিন্তু কিয়াই আমার পরিবারের মৃত্যুর জন্যে দায়ি। এই নিন প্রমাণ।

নিজের হাতের তালুর ট্যাটুটা ল্যাংডনের উদ্দেশ্যে প্রদর্শন করলো সে। ট্যাটুটা মোটেও কোন প্রমাণ নয়, তবে সে যা চেয়েছিল তেমনটাই হলো, ল্যাংডন তাকালো সেদিকে।

ঠিক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে অন্যমনস্ক ল্যাংডনকে লক্ষ্য করে লাফ দিলো আভিলা। নিজেকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো তাক করে রাখা বন্দুকের নলের দিক থেকে। যেমনটা ভেবেছিল সে, অসাবধানতায় লক্ষ্য ঠিক না করেই গুলি চালিয়ে দিলো ল্যাংডন। বিকট শব্দ হলো বদ্ধ জায়গাটায়। আভিলার কাঁধ ছুঁয়ে পাথুরে দেয়ালে গিয়ে বিধল গুলিটা।

ল্যাংডন পিস্তলের নলটা আবার তার দিকে তাক করার আগেই শূন্যে ভাসমান অবস্থা থেকে ল্যাংডনের হাতে জোরে কিল বসালো সে। সিঁড়িতে পড়ে গেল বন্দুকটা, তাদের দুজনের সীমার বাইরে।

বুকে এবং কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে ল্যাংডনের ঠিক নিচের সিঁড়িটায় গিয়ে পড়লো আভিলা। কিন্তু ব্যথা আমলে নিলো না সে। কোমরে গুঁজে রাখা সিরামিকের পিস্তলটা বের করে আনলো এক ঝটকায়। একদম ওজনহীন মনে হচ্ছে ওটাকে এখন।

ল্যাংডনের বুকের দিকে পিস্তলটা তাক করে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ ছাড়াই ট্রিগার টেনে দিলো সে।

গর্জে উঠলো পিস্তলটা, কিন্তু যে ফলাফল আশা করেছিল তেমনটা হলো। বরং পিস্তল ধরে রাখা হাতটা পুড়ে যাবার জোগাড় হলো তার। বন্দুকের ব্যারেলটা ফেটে যাওয়াতে এমনটা হয়েছে। অধাতব এই বন্দুকগুলো কেবলমাত্র একবার গুলি করার জন্যে উপযোগি। গুলিটা আর যেখানেই হোক ল্যাংডনের গায়ে লাগেনি, নাহলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতো না সে। অস্ত্র ফেলে দিয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো আভিলা। দুজনেই চলে আসলো পাক খাওয়া সিঁড়ির বিপজ্জনক কিনারায়।

আভিলা বুঝতে পারলো, লক্ষ্য পূরণের খুব কাছে চলে এসেছে সে।

আমাদের কারো হাতেই কোন অস্ত্র নেই, ভাবলো সে, কিন্তু আমি সুবিধাজনক অবস্থানে আছি।

যে খালি জায়গাটাকে ঘিরে পেঁচিয়ে ওপরে উঠে গেছে সিঁড়িটা সেটা আগেই দেখে নিয়েছে সে। একবার সেখান দিয়ে নিচে পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু। হাত দিয়ে ল্যাংডনকে ধীরে ধীরে সেদিকে ঠেলতে লাগলো সে, ডান পা দেয়ালে চেপে রেখেছে বাড়তি শক্তির জন্যে।

ল্যাংডনও নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে প্রাণপনে। কিন্তু আভিলা যে অবস্থানে আছে তা বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে তাকে। কী হতে যাচ্ছে সেটা যে প্রফেসর নিজেও বুঝতে পারছে তা তার চোখের দৃষ্টিতেই স্পষ্ট।

*

মুহূর্তের সঠিক সিদ্ধান্ত বদলে দিতে পারে ফলাফল-এতদিন কেবল এই কথাটা শুনেই এসেছিল রবার্ট ল্যাংডন।

এ মুহূর্তে আভিলার কাঁধে হাত রেখে নিজের পতন ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে, কিন্তু সুবিধা করে উঠতে পারছে না। দু-পা পেছনেই একশ ফিটেরও বেশি গভীর একটা গর্ত।

একবার সেদিকে তাকালো সে। গোলাকার খালি জায়গাটুকুর প্রশস্ততা হবে বড়জোর তিনফুট। কিন্তু নিচে পড়ে যাবার জন্যে সেই জায়গাটুকুই যথেষ্ট।

আর একবার পড়লে বাঁচার কোন আশা থাকবে না।

হুংকার ছেড়ে সর্বশক্তিতে ল্যাংডনকে পেছনে ঠেলতে লাগলো আভিলা। এখন আর একটা মাত্র উপায়ই ভোলা আছে ওর জন্যে।

বাঁধা দেয়ার বদলে লোকটাকে সাহায্য করবে সে।

আভিলার বাঁধা সত্ত্বেও কোনমতে সিঁড়িতে হাঁটুভাজ করে বসলো ল্যাংডন। মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেছে সামনের দিকে।

কিছুক্ষণের জন্যে নিজেকে বিশ বছর বয়সি থাকাকালীন সময়ের প্রিন্সটনের সুইমিং পুলে কল্পনা করলো সে…ব্যাকস্ট্রোক প্রতিযোগিতা…হাঁটু ভাঁজ করে তৈরি সে…পানির দিকে উল্টো ঘুরে আছে…পুরো শরীর শক্ত করে অপেক্ষা করছে গুরুর সংকেতের জন্যে।

টাইমিংয়ের ওপর নির্ভর করছে সবকিছু।

তবে এবার কোন সংকেত ধ্বনি শুনতে হলো না ল্যাংডনকে। ঐ অবস্থা থেকেই পেছনের দিকে লাফ দিলো সে খালি জায়গাটার ওপর দিয়ে। সামনের দুশ পাউন্ড ওজনের বাঁধা হঠাৎ সরে যাওয়ায় ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো আভিলা।

যত দ্রুত সম্ভব ল্যাংডনের শরীর থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো আভিলা, কিন্তু বেশি সুবিধা করতে পারলো না। বাতাসে ভাসমান অবস্থাতেই ল্যাংডন প্রার্থনা করতে লাগলো যাতে সিঁড়ির অপর পাশে গিয়ে পড়ে সে, ছয় ফিট নিচে। সিঁড়ির বাইরের অংশে যদি ধাক্কা খায় তবুও নিচে পড়ে যেতে হবে।

পারবো না আমি।

মৃত্যু নিশ্চিত।

প্রমাদ গুনলো ল্যাংডন। অপেক্ষা করতে লাগলো পতনের। কিন্তু খুব কম সময়ই ভেসে থাকতে হলো তাকে।

অসমান পাথুরে মেঝের ওপর আছড়ে পড়লো ল্যাংডন। মাথা ঠুকে গেল সিঁড়ির ধাপে। প্রায় অজ্ঞান হবার দশা হলো তার, কিন্তু এটুকু বুঝতে পারলো যে খালি জায়গাটুকু পুরোটা পার হয়ে সিঁড়িঘরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়েছে সে।

বন্দুকটা দরকার এখন, ভাবলো ল্যাংডন। অজ্ঞান হওয়া চলবে না।

যেকোন মুহূর্তে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে আভিলা।

কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে।

চেতনা হারাতে শুরু করেছে সে।

চোখে অন্ধকার পুরোপুরি নেমে আসার আগে নিচে থেকে একটা ভোতা শব্দ কানে আসলো তার…একবার না বেশ কয়েকবার শুনতে পেলো শব্দটা। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে যেন কিছু একটা।

ওপর থেকে ভারি কিছু নিচে পড়তে থাকলে এমন শব্দ হয়।

.

অধ্যায় ৭৬

ভালদেসপিনো যে সত্য কথাই বলছেন তা এল এসকোরিয়ালের মূল প্রবেশপথের সামনে কতগুলো পরিচিত গাড়ির জটলা দেখেই বুঝতে পারলেন প্রিন্স হুলিয়ান।

বাবা আসলেই এখানে এসেছেন।

এসইউভি গাড়িগুলো সংখ্যা দেখে বোঝা যাচ্ছে, রাজার সাথে তার পুরো নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও উপস্থিত আছে এখানে।

প্রবেশদ্বারের বেশ আগে ওপেল সেডান গাড়িটা থামালো তরুণ যাজক। ফ্ল্যাশলাইট হাতে এগিয়ে এসে ভেতরে উঁকি দিয়েই ঘাবড়ে গেল কর্তব্যরত এজেন্ট। প্রিন্স হুলিয়ান এবং বিশপ ভালদেসপিনোকে এরকম একটা গাড়িতে আশা করেনি সে।

মহামান্য যুবরাজ! কম্পিত কণ্ঠে বলল সে, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম আমরা, এরপরে ওপেল সেডান গাড়িটার পেছনের রাস্তায় উঁকি দিলো লোকটা, আপনার নিরাপত্তাকর্মিরা কোথায়?

প্রাসাদে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্যে থেকে গেছে তারা, হুলিয়ান বললেন জবাবে। বাবার সাথে দেখা করতে এসেছি আমরা।

অবশ্যই, অবশ্যই! আপনি এবং বিশপ ভালদেসপিনো যদি একটু কষ্ট করে গাড়ি থেকে নেমে-

সামনের রোডব্লকটা সরানোর ব্যবস্থা করুন এখনই, ধমকে উঠলেন ভালদেসপিনো, গাড়ি নিয়েই ভেতরে ঢুকে যাবো আমরা। মহারাজ তো এখন উপাসনালয়ের হাসপাতালে আছেন বোধহয়?

ছিলেন, দ্বিধান্বিত স্বরে বলল রয়্যাল গার্ডের এজেন্ট, কিন্তু এখন আর নেই তিনি।

আতঙ্কের ছাপ ভর করলো ভালদেসপিনোর চেহারায়। বাবা মারা গেছেন? বুকের কাছটা ভারি লাগতে লাগলো হুলিয়ানের।

না! মানে…তোতলালো এজেন্ট, আমি বলতে চেয়েছি এল এসকোরিয়ালে নেই তিনি। প্রধান নিরাপত্তা বহরকে নিয়ে এক ঘন্টা আগে চলে গেছেন।

স্বস্তির অনুভূতিটা দ্রুত বিভ্রান্তিতে রূপ নিলো হুলিয়ানের। এখানকার হাসপাতালে নেই তিনি?

কী আবোলতাবোল বলছেন? ভালদেসপিনো চড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, রাজা নিজে আমাকে ফোন করে প্রিন্স হুলিয়ানকে এখানে নিয়ে আসতে বলেছেন!

জি, আমাদের ওপর নির্দেশ দেয়া আছে যেন এখানে পৌঁছানো মাত্রে একটা রয়্যাল গার্ডের গাড়িতে তুলে দেয়া হয় আপনাদের।

বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকালেন হুলিয়ান এবং ভালদেসপিনো। গাড়ি থেকে নেমে আসলেন তারা। তরুণ যাজককে প্রাসাদে ফিরে যেতে বলা হলো। কোন কথা না বলে নির্দেশ পালন করলো সে। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল যেন এই অদ্ভুত ঘটনাপ্রবাহ থেকে মুক্তি পেয়ে অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে।

তাদের পথ দেখিয়ে একটা এসইউভির দিকে নিয়ে যেতে লাগলো রয়্যাল গার্ডের এজেন্ট।

রাজা এখন কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন বিশপ ভালদেসপিনো। কোথায় নিয়ে যাবে গাড়িটা আমাদের?

সরাসরি মহামান্য রাজার আদেশ পালন করছি আমরা, রয়্যাল গার্ড এজেন্ট বলল, তিনি আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন এখানে আসার পর যাতে একটা গাড়ি এবং এই চিঠিটা দেয়া হয় আপনাদের, একটা মুখবন্ধ খাম বের করে হুলিয়ানের উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে ধরলো সে।

বাবার কাছ থেকে চিঠি? বিষয়টা কেমন যেন অস্বস্তিকর ঠেকলো হুলিয়ানের কাছে। একটা আনুষ্ঠানিকতার ছাপ আছে গোটা ব্যাপারটায়। খামটাও সিলগালা করা। বাবার মানসিক অবস্থা ঠিক আছে তো? ভাবলেন মনে মনে।

দ্রুত খামের মুখ খুলে ভেতর থেকে একটা নোট কার্ড বের করলেন তিনি। ছোট ছোট হস্তাক্ষরে কিছু একটা লেখা আছে সেখানে। বাবার হাতের লেখা চিনতে কোন অসুবিধে হলো না তার। নোট কার্ডে লেখা প্রতিটা শব্দ বিস্ময়কর ঠেকলো ওর কাছে।

পড়া শেষ করে কার্ডটা খামের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখলেন। এরপর চোখ বন্ধ ভাবতে লাগলেন আসন্ন কর্মপরিকল্পনা নিয়ে।

উত্তর দিকে চলুন, গাড়িতে উঠে বসার পর চালকের উদ্দেশ্যে বললেন হুলিয়ান।

ভালদেসপিনো যে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারছেন তিনি। কী লিখেছে আপনার বাবা? কোথায় যাচ্ছি আমরা? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলেন বিশপ।

লম্বা করে একবার শ্বাস নিয়ে বাবার ঘনিষ্ঠ সহচরের চোখের দিকে তাকালেন হুলিয়ান, যেমনটা কিছুক্ষণ আগে বলেছিলেন আপনি, মৃদু হেসে বললেন তিনি, আমার বাবা এখনও স্পেনের রাজা। তিনি যা বলবেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো আমরা।

.

অধ্যায় ৭৭

রবার্ট…? একটা কণ্ঠস্বর কানে আসলো ওর।

জবাব দিতে গিয়েও গলায় কথা আটকে গেল ল্যাংডনের। মাথা দপদপ। করছে।

রবার্ট…?

চেহারায় একটা আলতো হাতের ছোঁয়া অনুভূব করলো ল্যাংডন। চোখ খুললো ধীরে ধীরে। কিছুক্ষণের জন্যে মনে হলো যেন স্বপ্ন দেখছে। একটা সাদা পরি কৌতূহলি চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

কিছু সময় পরে চেহারাটা চিনতে পেরে একটা দূর্বল হাসি দিলো ল্যাংডন।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! স্বস্তির সাথে বলল অ্যাম্ব্রা। গুলির শব্দ শুনেছিলাম আমরা, তার পাশে বসলো সে, ওঠার চেষ্টা করবেন না।

চেতনাবোধ ফিরে আসতে লাগলো ল্যাংডনের, মনে পড়লো কিছুক্ষণ আগের কথা, যে লোকটা আক্রমণ…

মারা গেছে সে, শান্তস্বরে বলল অ্যাম্ব্রা। এখন একদম নিরাপদ আপনি। খালি জায়গাটা দিয়ে একদম নিচে পড়ে গেছে লোকটা।

খবরটা হজমের চেষ্টা করলো ল্যাংডন। এখন সব পরিষ্কার মনে পড়ছে। তবে সেসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বোঝার চেষ্টা করলো শরীরের কোথায় কোথায় ব্যথা করছে। কোমরে এবং মাথা দপদপ করছে ব্যথায়। এছাড়া সব ঠিকই আছে, কোন হাড় ভাঙেনি। পুলিশের ওয়াকিটকির শব্দ শুনতে পেলো সে।

কতক্ষন ধরে…অজ্ঞান…।

এই কয়েক মিনিট, অ্যাম্ব্রা বলল। বেশ কয়েকবার হুঁশ ফিরেছিলো এরমধ্যেই। মেডিক্যাল চেক-আপ দরকার আপনার।

কষ্ট করে উঠে বসে সিঁড়ির দেয়ালে হেলান দিলো ল্যাংডন। ঐ নেভি অফিসারটা…বলল সে, যে…

জানি আমি, মাথা নেড়ে বলল অ্যাম্ব্রা, যে এডমন্ডকে হত্যা করেছে। পুলিশ তাকে সনাক্ত করেছে কিছুক্ষণ আগে। নিচে তার লাশের পাশেই আছে। এখনও তারা, আপনার জবানবন্দি নিতে চায়। কিন্তু ফাদার বেনা পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন-আগে একটা মেডিক্যাল টিম এসে দেখবে আপনাকে, এরপর অন্য সবকিছু হবে।

মাথা নাড়লো ল্যাংডন। এখনও কমেনি ব্যথাটা।

আপনাকে বোধহয় হাসপাতালে নিয়ে যাবে তারা, অ্যাম্ব্রা বলল তাকে, তাই আমাদের উচিত এখনই কথাটা সেরে নেয়া, কেউ এসে পড়ার আগে।

কিসের কথা?

উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকলো অ্যাম্ব্রা, আপনার কি মনে নেই, রবার্ট? জিজ্ঞেস করলো সে, এডমন্ডের পাসওয়ার্ডটা পেয়েছিলাম আমরা-The dark religions are departed and sweet science reigns।

অ্যাম্ব্রার কথাটা শুনে সব ধোঁয়াশা পরিষ্কার হয়ে গেল ল্যাংডনের মন থেকে।

আমাদের এতদূর নিয়ে এসেছেন আপনি, অ্যাম্ব্রা বলল, বাকি কাজ টুকু আমিই চালিয়ে নিতে পারবো। আপনি বলছিলেন, উইনস্টনকে কোথায় পাওয়া যাবে সেটা জানা আছে আপনার। কোথায় যেতে হবে বলুন। আমাকে।

হ্যাঁ, জানি আমি, বলল ও। অন্তত এরকমটাই ধারণা আমার।

খুলে বলুন।

শহরের অন্য পাশে যেতে হবে আমাদের।

কোথায়?

ঠিকানাটা জানি না আমি, কম্পিত পায়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল ল্যাংডন, কিন্তু আপনাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারবো আমি।

দয়া করে ওঠার চেষ্টা করবেন না, রবার্ট! অ্যাম্ব্রা অনুরোধ করলো তাকে।

হ্যাঁ, বসে থাকুন, আরেকটা কণ্ঠস্বর কানে আসলে নিচের দিকের সিঁড়ি থেকে। ফাদার বেনাকে দেখতে পেলো ওরা। জরুরি মেডিক্যাল টিম যে কোন মুহূর্তে এসে পড়বে।

ঠিক আছি আমি, মিথ্যে বলল ল্যাংডন, আমার এবং অ্যাম্ব্রাকে যেতে হবে এখন।

বেশিদূর চাইলেও যেতে পারবেন না, ফাদার বেনা বললেন, পুলিশের লোক অপেক্ষা করছে আপনার জন্যে। আপনার কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনতে চায় তারা। তাছাড়া গোটা চার্চ ঘিরে রেখেছে গণমাধ্যম কর্মিরা। কেউ একজন আপনাদের অবস্থান তাদের কাছে ফাঁস করে দিয়েছে, ল্যাংডনের পাশে এসে একটা ক্লান্ত হাসি দিলেন তিনি। আপনি সুস্থ আছেন দেখে ভালো লাগছে। আমার এবং মিস ভিদালের জীবন বাঁচিয়েছেন আপনি।

আমি না, আপনি আমাদের জীবন বাঁচিয়েছেন, পাল্টা বলল ল্যাংডন।

যাইহোক, পুলিশের সাথে কথা না বলে এখান থেকে নামতে পারবেন না আপনারা।

সাবধানে খাটো পাথুরে রেলিঙে হাত দিয়ে নিচে তাকালো ল্যাংডন। আভিলার মৃতদেহের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছি বেশ কয়েকটা ফ্ল্যাশলাইটের আলো।

এসময় একটা ব্যাপার মাথায় আসল ল্যাংডনের। বেশ কিছুদিন আগে সাগ্রাদা ফামিলিয়ার ওয়েবসাইটে ঢুকেছিল সে এখানকার আন্তোনি গওদি স্মৃতি জাদুঘরের ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার জন্যে। সেখানে পুরো স্থাপনার বেশ কয়েকটা মডেলের ছবি চোখে পড়ে তার। কম্পিউটারে ক্যাড প্রোগ্রাম এবং থ্রিডি মডেলিংয়ের সহায়তায় তৈরি নিখুঁত মডেলগুলোর ছবিতে ফুটে উঠেছিল সাগ্রাদা ফামিলিয়ার সৃষ্টিলগ্ন থেকে কাজ সম্পূর্ণ শেষ হওয়া অবধি পর্যন্ত দৃশ্য, যার এখনও প্রায় বেশ কবছর বাকি। সেই মডেলগুলোর একটার কথা বিশেষ। করে মনে হচ্ছে তার এখন।

যদি মডেলটা নিখুঁত হয়ে থেকে থাকে, তবে সবার অগোচরে এখান থেকে কেটে পড়ার একটা উপায় আছে এখনও।

ফাদার বেনার দিকে তাকালো ল্যাংডন। ফাদার, আপনি কি আমার হয়ে একজনকে একটা মেসেজ দিতে পারবেন?

বিভ্রান্ত মনে হলো বদ্ধ যাজককে।

নিজের পরিকল্পনাটা অ্যাম্ব্রা এবং ফাদারকে খুলে বলল ল্যাংডন। মাথা ঝাঁকাতে লাগলো অ্যাম্ব্রা, রবার্ট, এটা অসম্ভব। ওপরে এমন-।

আছে, ফাদার বেনা বললেন এই সময়, তবে সারাজীবন থাকবে না। এই মুহূর্তে মি.  ল্যাংডন ঠিক কথাই বলছেন, ব্যাপারটা সম্ভব।

তবুও সংশয় দূর হলো না অ্যাম্ব্রার চেহারা থেকে। রবার্ট, আমরা না-হয় এখান থেকে বের হয়ে গেলাম, কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত মেডিক্যাল চেকআপ না করানোর ব্যাপারে?

পরে না হয় করানো যাবে, অনিশ্চিত স্বরে বলল ল্যাংডন। কিন্তু এখন এডমন্ডের জন্যে হলেও কাজটা শেষ করতে হবে আমাদের, এটুকু বলে সরাসরি ফাদার বেনার চোখের দিকে তাকালো সে। আপনার কাছ থেকে কিছু লুকোতে চাই না আমরা, ফাদার। সত্যটা জানার অধিকার আছে আপনার। এডমভের আজ রাতে একটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ব্যাপারে ঘোষণা দেয়ার কথা ছিল।

হ্যাঁ, বৃদ্ধ যাজক বললেন, আর তার কথার সুর শুনে মনে হচ্ছিল, তার বিশ্বাস আবিষ্কারটা পৃথিবীর সব ধর্মের ওপর আঘাত হানবে।

জি, সেজন্যেই ব্যাপারটা আপনাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করছি। তার আবিষ্কারকে পৃথিবীর সবার জন্যে উন্মুক্ত করার জন্যই বার্সেলোনায় এসেছি আমরা। আর সেই লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছেও গেছি প্রায়। অর্থাৎ…পরের কথাগুলো বলার আগে কিছুক্ষণ সময় নিলো ল্যাংডন। আমাদের যদি আপনি সাহায্য করেন, পক্ষান্তরে এডমন্ডের মত একজন অবিশ্বাসিকে সাহায্য করা হবে।

ল্যাংডনের কাঁধে হাত রাখলেন ফাদার বেনা, প্রফেসর, মুচকি হেসে বললেন তিনি, ইতিহাসে এডমন্ড কিয়াদের অভাব কোনদিনই ছিল না। সামনেও অভাব হবে না। তার আবিষ্কার হয়তো আলোচনা ঝড় তুলবে, কিন্তু সেটা আমি বাঁধা দেয়ার কে? সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষের জ্ঞানের পরিধি ধীরে ধীরে বাড়ছে, আমার বাঁধা সেটায় কোন প্রভাব ফেলতে পারবে না। আর আমার ব্যক্তিগত ধারণা, ঈশ্বরকে ছাড়া এই প্রগতি কখনোই সম্ভব হতো না।

ওদের দুজনের উদ্দেশ্যে একবার হেসে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন ফাদার বেনা।

*

বাইরে পার্ক করে রাখা হেলিকপ্টারের ককপিটে বসে সাগ্রাদা ফামিলিয়ার বাইরে উপস্থিত হওয়া গণমাধ্যমকর্মিদের ভিড়ের দিকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে পাইলট। ভেতরে যাওয়া রয়্যাল গার্ডের দুজন এজেন্টের সাথে অনেকক্ষন যাবৎ কোন যোগাযোগ হয়নি তার। তাদের সাথে যোগাযোগ করতে যাবে এই সময় ব্যাসিলিকার দিক থেকে কালো আলখেল্লা পরিহিত একজন পাদ্রি এসে দাঁড়ালেন হেলিকপ্টারের পাশে।

নিজেকে সাগ্রাদা ফামিলিয়ার জ্যেষ্ঠ পাদ্রি হিসেবে পরিচয় দিয়ে সংক্ষেপে তাকে খুলে বললেন ভেতরে কী ঘটেছে কিছুক্ষণ আগে। গার্ডিয়া রিয়েলের এজেন্ট দুজন মারা গেছেন আততায়ীর হাতে। প্রফেসর ল্যাংডন এবং স্পেনের ভবিষ্যৎ রাণীকে নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে হবে তাকে, কিছুক্ষণের মধ্যেই। এই তথ্যগুলোই একজন মানুষকে অবাক করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট, কিন্তু ল্যাংডন এবং অ্যাম্ব্রাকে কোথা থেকে তুলে নিতে হবে এটা যখন জানতে পারলো সে, মুখ একদম হা হয়ে গেল।

অসম্ভব! মনে মনে বলল পাইলট।

তবে কিছুক্ষণ পরে সাগ্রাদা ফামিলিয়ার গম্বুজগুলোর ওপরে হেলিকপ্টার নিয়ে উঠে পাদ্রির কথা সত্যতা পেলো সে। চার্চটার সবচেয়ে বড় গম্বুজটা এখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি। অনেকগুলো গম্বুজের ভিড়ে শুধু একটা পিলারের মত দাঁড়িয়ে আছে, যার উপরিভাগটা একদম সমান। গভীর বনে বিশাল কোন গাছ কাটার পর শুধু কান্ডটা থেকে গেলে যেমন দেখায় ওরকম। লাগছে সেটাকে।

খুব সাবধানে সেখানে হেলিকপ্টারটা নামালো সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজন মানুষ উদয় হলো সিঁড়িঘর থেকে। অ্যাম্ব্রা ভিদাল এবং আহত প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডন।

লাফ দিয়ে নিচে নেমে তাদের হেলিকপ্টারে উঠতে সাহায্য করলো পাইলট।

সিটবেল্ট বাঁধা শেষ হলে তার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে একবার মাথা নাড়লো অ্যাম্ব্রা ভিদাল।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, শান্তকণ্ঠে বলল স্পেনের হবু রাণী। মি.  ল্যাংডন আপনাকে বলবেন কোথায় যেতে হবে।

.

অধ্যায় ৭৮

কন্সপিরেসিনেট.কম

ব্রেকিংনিউজ

এডমন্ড কিয়ার্শের মার মৃত্যুর কারণ পালমেরিয়ান চার্চ?

আমাদের তথ্যদাতা [email protected] আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন! কন্সপিরেসি নেটের কাছে কিছু ডকুমেন্ট পাঠিয়েছেন তিনি যেখানে দেখা যাচ্ছে কয়েক বছর আগে পালমেরিয়ান চার্চের বিরদ্ধে মগজধোলাই, শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার-এই তিন অভিযোগে মামলা ঠোকার চেষ্টা করেছিলেন এডমন্ড কিয়ার্শ। এসব কারণেই নাকি তিন যুগ আগে মৃত্যু হয়েছিল তার মার।

পালমেরিয়ান চার্চের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন পালোমা কিয়ার্শ। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে চার্চের উধর্বতন সদস্যদের হাতে অত্যচারিত হতে হয় তাকে, একপর্যায়ে নিজ ঘরে ফাঁস নেন তিনি।

.

অধ্যায় ৭৯

মহারাজ নিজে! কমান্ডার গারজা বিড়বিড় করে বলল আবার, আমাকে গ্রেফতার করার আদেশ মহারাজ নিজে দিয়েছেন! এত বছরের বিশ্বস্ততার এই পুরষ্কার।

ঠোঁটে আঙুল রেখে তাকে চুপ করতে অনুরোধ করলো মনিকা মার্টিন। অস্ত্রাগারের কাছে গিয়ে একবার দেখে আসলো যে বাইরে থেকে কেউ আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করছে কিনা তাদের কথা। আপনাকে তো বলেছিই, বিশপ ভালদেসপিনো যা বলেন সেটাই করেন তিনি। বিশপই নিশ্চয়ই তাকে বলেছেন, সবকিছুর পেছনে আপনি দায়ি, আর দোষ চাপাচ্ছেন তার ঘাড়ে।

বলির পাঠা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে আমাকে, মনে মনে বলল গারজা। অবশ্য অনেক আগে থেকেই এটা তার জানা ছিল, কখনো যদি ভালদেসপিনো এবং তার মধ্যে কোন একজনকে বেছে নিতে হয় তবে রাজা বৃদ্ধ যাজককেই বেছে নেবেন। তাছাড়া অনেক দিনের পুরনো বন্ধু তারা। বন্ধুত্বের কাছে পেশাদারিত্ব সবসময়ই হার মানে।

তবুও গারজার কেন যেন মনে হলো, মনিকার ব্যাখ্যার মধ্যে কিছু একটা গোলমাল আছে। অপহরণের ঘটনাটা, বলল সে, রাজা নিজে সেটা বলতে বলেছিলেন আপনাকে?

হ্যাঁ, সরাসরি আমাকে ফোন দেন তিনি। সেখানেই নির্দেশ দেন, প্রাসাদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে যেন বলা হয় ল্যাংডনের হাতে অপহৃত হয়েছেন অ্যাম্ব্রা ভিদাল। অপহরণের ঘটনাটা তিনি সাজিয়েছিলেন যাতে স্পেনের ভবিষ্যত রাণীর অচেনা একজন পুরুষের সাথে পালানোর ব্যাপারটা নিয়ে কোন বিতর্ক সৃষ্টি না হয়, গারজার দিকে তাকিয়ে বলল মনিকা। আমাকে এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন? বিশেষ করে এখন যখন আপনি জানেন যে, এজেন্ট ফনসেকাকেও ফোন করে মিথ্যে অপহরণের ব্যাপারটা বলেছিলেন মহারাজ।

একজন বিশিষ্ট মার্কিন নাগরিককে এভাবে ফাঁসিয়ে দেয়ার চক্রান্ত করেছেন তিনি, এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমার, গারজা বলল।

অনেক ঝুঁকি আছে ব্যাপারট তে। কেবলমাত্র

পাগলের পক্ষেই এটা করা সম্ভব? তার কথার মাঝেই জিজ্ঞেস করলো মনিকা।

জবাব না দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো গারজা।

কমান্ডার, মনিকা বলল অবশেষে, আপনাকে কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, বয়স হয়েছে মহারাজের। হয়তো ব্যাপারটা নিয়ে খুব

বেশিক্ষন না ভেবেচিন্তে আবেগের বশে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন?

অথবা খুব বড় একটা চালও হতে পারে এটা, গারজা বলল, ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত হোক বা না হোক, স্পেনের ভবিষ্যৎ রাণী নিরাপদে আছেন এখন।

সেটাই তো, চোখ সরু হয়ে আসলো মনিকার, তাহলে এটা নিয়ে এত ভাবছেন কেন?

ভালদেসপিনো, বলল সে। লোকটাকে আমি পছন্দ করি না। কিন্তু তার মানে এটা না যে কিয়ার্শের খুনের পেছনে তার হাত আছে, সেটা বিশ্বাস করতেই হবে।

আমার কিন্তু ধারণা খবরটা সত্যও হতে পারে, তীক্ষ্ণস্বরে বলল অ্যাম্ব্রা। ইতিহাস ঘাটলে কিন্তু স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের মত অনেক ঘটনা চোখে পড়বে। যেখানে আমরা দেখেছি রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে বরাবরই হস্তক্ষেপে আগ্রহি চার্চ। ভালদেসপিনোকে সবসময়ই অহংকারী, স্বার্থপর আর সুযোগসন্ধানী বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। কোন গুণ বাদ পড়ছে?

হ্যাঁ, গারজা বলল, আপনি যা বলেন সেগুলোর প্রত্যেকটা গুণের অধিকারী সে। কিন্তু তার কাছে ঐতিহ্য আর দেশের সম্মান সবার আগে, কখনো যে তাকে ভালদেসপিনোর হয়ে কথা বলতে হবে সেটা কিছুক্ষণ আগেও কল্পনাতে আসেনি তার। আর মহারাজ যাকে তাকে ভরসা করেন না, কিন্তু ভালদেসপিনোর মতামত সবসময় গুরুত্বসহকারে শোনেন তিনি। তাই এটা বিশ্বাস করতে স্বভাবতই বেগ পেতে হচ্ছে আমার যে, রাজপ্রাসাদ এবং রাজার সাথে এরকম বিশ্বাসঘাতকতা করবে সে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করলো মনিকা। কমান্ডার, বিশপকে হয়তো একটু বেশিই বিশ্বাস করেন আপনি। এটা দেখুন, কিছুক্ষণ আগে সুরেশ পাঠিয়েছে, ফোনটা গারজার হাতে দিতে দিতে বলল সে।

একটা লম্বা মেসেজ দেখা যাচ্ছে সেখানে।

আজ রাতে ভালদেসপিনোর ফোনে আসা একটা মেসেজের স্ক্রিনশট এটা, ফিসফিস করে বলল মনিকা। পড়ুন পুরোটা। আমি হলফ করতে বলতে পারি নিজের সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হবেন এরপর।

.

অধ্যায় ৮০

মাথা এবং কোমরের প্রচণ্ড ব্যথা ল্যাংডনের উফুল্ল ভাবটা কমাতে পারেনি একটুও। সাগ্রাদা ফামিলিয়া থেকে হেলিকপ্টারে চড়ে কেটে পড়ার মুহূর্তটা উপভোগ করলো সে।

এখনও বেঁচে আছি আমি!

ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড উত্তেজিত বোধ করছে ল্যাংডন। অ্যাড্রেনালিনের প্রভাবে যে এমনটা হচ্ছে সেটা জানা আছে তার। যতটা সম্ভব আস্তে করে শ্বাস নিয়ে জানালা দিয়ে নিচে তাকালো সে। ধীরে ধীরে চাৰ্চটার বিশাল গম্বুজগুলোর মধ্য থেকে আকাশে উঠে আসলো হেলিকপ্টারটা। দেখতে দেখতে দূরের একটা ছোট বিন্দুতে পরিণত হলো সেটা। নিচের শহরতলীর অবয়ব অবাক চোখে দেখছে ল্যাংডন। সাধারণত বড় বড় শহরগুলোর বিভিন্ন আবাসিক এলাকার ব্লকগুলোর আকৃতি হয় বর্গাকার কিংবা আয়তাকার। কিন্তু এখন যেটার ওপর দিয়ে উড়ছে ওরা সেটা প্রায় অষ্টভূজাকৃতির।

অষ্টভূজাকৃতি

LEixample LEixample, মনে মনে ভাবলো ল্যাংডন। কাতালান ভাষায় এর অর্থ প্রশস্তকরণ।

নগরস্থাপত্যবিদ ইলদেন কেরদার দূরদর্শী চিন্তার ফসল শহরতলীর এই অংশটুকু। বার্সেলোনার সবচেয়ে পরিকল্পিত এলাকা বললেও ভুল হবে না। এমনভাবে এই অঞ্চলটুকুর সীমানা প্রশস্ত করেছিলেন ইলদেন যাতে কোন জায়গা নষ্ট না হয়। দেখার মতও অনেক কিছু রয়েছে এটুকুর ভেতরে।

আমরা কোথায় যাচ্ছি? ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো পাইলট।

দুই ব্লক দূরের একজায়গায় নির্দেশ করলো ল্যাংডন। যেখানে শহরের সবচেয়ে উজ্জ্বল, প্রশস্ততম রাস্তাটা অবস্থিত। নামটাও যথার্থ রাস্তাটার।

আভিনিউদা দায়াগনাল, জোরে বলল ল্যাংডন। পশ্চিম দিকে।

বার্সেলোনার যে কোন মানচিত্রে একদম স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে এই রাস্তাটা। গোটা শহরের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত আড়াআড়িভাবে ছুটে যাওয়ার কারণে এই নামকরণ করা হয়েছে। নতুন-পুরনো অনেক বিখ্যাত। দালানের সমাহার এই রাস্তায়। স্পেনের সবচেয়ে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক দন কিহহাতের সম্মানার্থে নির্মিত পার্ক দে সার্ভান্তেস নামের গোলাপ বাগানটাও এখানে অবস্থিত।

মাথা নেড়ে হেলিকপ্টার সেদিকে ঘোরানোর ব্যবস্থা করলো পাইলট। আড়াআড়ি ছুটে চলা রাস্তার ওপর দিয়ে চালিয়ে নিতে লাগলো ওদের। ঠিকানা? আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো সে।

ঠিকানা তো এখনও জানি না, মনে মনে বলল ল্যাংডন। ফুটবল স্টেডিয়ামটার দিকে যান।

ফুটবল? অবাক মনে হলো পাইলটকে। এফসি বার্সেলোনা?

সায় জানালো ল্যাংডন, ও নিশ্চিত, ফুটবল স্টেডিয়ামটার অবস্থান ভালোমতোই জানা আছে পাইলটের। আভিনিউদা দায়াগনাল থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে হবে স্টেডিয়ামটা।

গতি বাড়িয়ে সামনে এগোতে লাগলো পাইলট।

রবার্ট? শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করলো অ্যাম্ব্রা। আপনি ঠিক আছেন তো? এমন ভঙ্গিতে তার দিকে তাকালো স্পেনের ভবিষ্যৎ রাণী যেন মাথার আঘাতের কারণে উল্টাপাল্টা বকছে সে। উইনস্টনকে কোথায় খুঁজতে হবে সেটা আসলেও জানেন?

হ্যাঁ, জানি, জবাব দিলো ল্যাংডন। সেখানেই যাচ্ছি আমরা।

একটা ফুটবল স্টেডিয়ামে? আপনার ধারণা এডমন্ড তার সুপারকম্পিউটারটা একটা স্টেডিয়ামের ভেতরে তৈরি করেছিল?

মাথা দুলিয়ে না করে দিলো ল্যাংডন। ওটার নাম বলেছি কারণ পাইলট খুব সহজেই খুঁজে পাবে স্টেডিয়ামটা। আমি মূলত স্টেডিয়ামের পাশে অবস্থিত দ্য গ্র্যান্ড হোটেল প্রিন্সেস সোফিয়া দেখতে আগ্রহি।

এখন আগের চেয়েও বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে অ্যাম্ব্রাকে। রবার্ট, আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। একটা বিলাসবহুল হোটেলের ভেতরে কখনোই সুপার কম্পিউটার তৈরি করবে না এডমন্ড। আপনাকে বোধহয় এখনই। ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া উচিত আমাদের।

আমি ঠিক আছি, অ্যাম্ব্রা। ভরসা রাখুন।

যাচ্ছিটা কোথায় আমরা?

যাচ্ছি কোথায় আমরা? চিবুকে হাত বুলিয়ে পুণরুক্তি করলো ল্যাংডন, আজ রাতে এই প্রশ্নটার উত্তর পাওয়া যাবে বলে কথা দিয়েছিল এডমন্ড।

হতাশ একটা ভঙ্গি ভর করলো অ্যাম্ব্রার চেহারায়।

দুঃখিত, বলল ল্যাংডন। সব খুলে বলছি দাঁড়ান। দু-বছর আগে এডমন্ডের সাথে দ্য গ্র্যান্ড হোটেল প্রিন্সেস সোফিয়ার আঠারোতলার এক প্রাইভেট ক্লাবে বসে লাঞ্চ করেছিলাম আমি।

সেখানে সাথে করে একটা সুপারকম্পিউটার নিয়ে এসেছিল এডমন্ড? হেসে জিজ্ঞেস করলো অ্যাম্ব্রা।

ল্যাংডনও হেসে উঠলো। নাহ, খালি হাতে সেখানে এসেছিল এডমন্ড। বলেছিল যে, ও যেখানে সুপারকম্পিউটারটা বানাচ্ছে সেখান থেকে কাছে হওয়াতে ওখানেই প্রতিদিন দুপুরের খাবার সারে সে। সেই সাথে এটাও বলে। যে সিন্থেটিক ইন্টেলিজেন্স নামের একটি প্রজেক্টে কাজ করছে সে আর সেটা। নিয়ে দারুণ উৎসাহিও ছিল।

উইনস্টনের কথা বলেছিল তাহলে! হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো অ্যাম্ব্রার চেহারা।

সেরকমটাই ধারণা আমার।

আপনাকে নিজের ল্যাবে নিয়ে গিয়েছিল ও?

না।

ল্যাবটা কোথায় সেটা বলেছিল?

নাহ, গোপন রেখেছিল ব্যাপারটা।

আবার সংশয় ভর করলো অ্যাম্ব্রার চেহারায়।

তবে, ল্যাংডন বলল, উইনস্টন কিন্তু কৌশলে ওর অবস্থানের কথা আমাদের জানিয়ে দিয়েছে।

নাহ তো, জানায়নি, অবাক স্বরে বলল অ্যাম্ব্রা।

জানিয়েছে, বলে হাসলো ল্যাংডন। আসলে সবাইকেই ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়েছে সে।

অ্যাম্ব্রা আর কিছু জানতে চাওয়ার আগেই পাইলট বলে উঠলো, ঐ যে স্টেডিয়ামটা। বার্সেলোনার বিশাল স্টেডিয়ামটার দিকে ইঙ্গিত করলো সে।

দ্রুত পৌঁছে গেছি তো! ভাবলো ল্যাংডন। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্র্যান্ড হোটেল প্রিন্সেস সোফিয়ার বিশাল দালানটা দৃষ্টিগোচর হলো ওর। পাইলটকে হোটেলটার ওপরে যাওয়ার নির্দেশ দিলো সে।

মুহূর্তের মধ্যে কয়েকশো ফিট ওপরে উঠে গেল হেলিকপ্টারটা। নিচে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে গ্র্যান্ড হোটেল প্রিন্সেস সসাফিয়া। এডমন্ড বলেছিল, ওর কম্পিউটার ল্যাবটা এখান থেকে মাত্র দুই ব্লক দূরে।

সতর্ক চোখে আশেপাশে চোখ বোলাতে লাগলো ল্যাংডন। এখানকার ব্লকগুলো সাগ্রাদা ফামিলিয়ার যে এলাকায় অবস্থিত সেখানকার মত গোছানো না।

এখানেই কোথাও হবে।

যতই সময় যেতে থাকলো অনিশ্চয়তায় ভুগতে লাগলো ল্যাংডন। একটা নির্দিষ্ট আকৃতির ব্লক খুঁজছে সে। কোথায় সেটা?

অবশেষে উত্তর দিকের প্লাজা দে পিয়াস-এর ট্রাফিক চত্বর দৃষ্টিগোচর হওয়াতে আশার আলো দেখতে পেলো সে। ওদিকে যান, পাইলটকে বলল সে, গাছগুলো যে দেখা যাচ্ছে, ওখানে।

উত্তরপশ্চিম দিকে এক ব্লক সমান দূরত্ব অতিক্রম করলো হেলিকপ্টারটা। অনেকটা বনের মত দেখাচ্ছে নিচের জায়গাটুকু। অবশ্য পুরো গাছপালায় ঘেরা জায়গাটুকু একটামাত্র স্থাপনার অংশবিশেষ।

রবার্ট, উচ্চস্বরে বলল অ্যাম্ব্রা, পরিষ্কার হতাশা তার কণ্ঠে, এটা তো পেদ্রালবেস প্রাসাদ। এর ভেতরে কী করে কম্পিউটার বানাবে এডমন্ড?

এদিকে না, ওদিকে তাকান! ল্যাংডন হাত দিয়ে প্রাসাদটার ঠিক পেছনের ব্লকটার দিকে নির্দেশ করলো।

জানালার দিকে ঝুঁকে ল্যাংডন যেদিকটা দেখে এত উত্তেজিত হয়ে উঠেছে সেদিকে তাকালো অ্যাম্ব্রা। প্রাসাদের পেছনের ব্লকটা অবস্থিত চারটা রাস্তার মধ্যেখানে। উজ্জ্বল আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে সবগুলো রাস্তায়। রাস্তাগুলো যেখানে মিলিত হয়েছে সেখানটায় একটা হীরকখন্ড আকৃতির স্কয়ার চোখে পড়লো তার। তবে একটুর জন্যে আদর্শ হীরকখণ্ডের আকৃতির স্বীকৃতি পাবে না ওটা, কারণ ডানপাশটা একটু ভোতা দেখাচ্ছে। সেখান দিয়ে চলে গেছে আরেকটা আঁকাবাঁকা রাস্তা।

ওই আঁকাবাঁকা রাস্তাটা দেখতে পাচ্ছেন? চিনতে পারছেন কিছু?

পরিচিত মনে হচ্ছে। কেন বলুন তো? আমার কি চেনার কথা সেটা?

পুরো ব্লকটা খেয়াল করুন, ল্যাংডন বলল তাকে। হীরকখণ্ড আকৃতির, কিন্তু নিচে ডানদিকে একটু ভোঁতা, অ্যাম্ব্রার উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো সে। এই ব্লকের ছোট পার্কদুটোর দিকে দেখুন। মাঝখানের গোল পার্কটা এবং ডানদিকের অর্ধবৃত্তাকার পার্কটার দিকে ইঙ্গিত করলো সে।

মনে হচ্ছে, জায়গাটা চিনি আমি, অ্যাম্ব্রা বলল, কিন্তু ঠিক মনে-

চিত্রকলার কথা ভাবুন, ল্যাংডন বলল, আপনাদের গুগেনহাইম জাদুঘরের সংগ্রহের কথা ভাবুন। আর-

উইনস্টন! উত্তেজিত স্বরে বলল অ্যাম্ব্রা। গুগেনহাইমে নিজের আত্মপ্রতিকৃতি এভাবেই উপস্থাপন করেছিল উইনস্টন!

এই তো বুঝতে পারছেন, হেসে বলল ল্যাংডন।

জানালায় কপাল ঠেকিয়ে নিচের ব্লকটা দেখতে লাগলো অ্যাম্ব্রা। ল্যাংডনের দৃষ্টিও সেদিকে, মনে মনে উইনস্টনের আত্মপ্রতিকৃতিটার কথা ভাবছে। সন্ধ্যাবেলা থেকেই ব্যাপারটা খোঁচাচ্ছিল ওকে।

এডমন্ড আমাকে আত্মপ্রতিকৃতি আঁকতে বললে এটাই আঁকি আমি, উইনস্টন বলেছিল ওকে।

আত্মপ্রতিকৃতি

মিয়োর কাজের সাথে নিজের আত্মপ্রতিকৃতির তুলনা করেছিল উইনস্টন। এখানে চোখের মত দেখতে জায়গাটায় অবস্থান করছে এডমন্ডের তৈরি করা সুপারকম্পিউটারটা-এ ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত সে। এখান থেকেই পুরো দুনিয়ার ওপর নজর রাখে উইনস্টন।

জানালা থেকে চোখ ফেরালো অ্যাম্ব্রা, উইনস্টনের আত্মপ্রকৃতি আসলে একটা ম্যাপ!

ঠিক ধরেছেন, বলল ল্যাংডন। উইনস্টন যেহেতু একটা যন্ত্র, সেহেতু আত্মপ্রতিকৃতির কথা বলাতে সে যে এলাকায় অবস্থান করছে সেটারই একটা নক্সা এঁকেছিল।

চোখটা, অ্যাম্ব্রা বলল, মিরোর ছবিগুলোতে এরকম দেখা যায়। কিন্তু এখানে যেহেতু একটাই চোখ, সেটাই বোধহয় উইনস্টনের অবস্থান।

আমিও ঠিক এটাই ভাবছিলাম, বলল ল্যাংডন। এরপর পাইলটকে নির্দেশ দিলো উইনস্টনের ব্লকের দুটো পার্কের একটায় ওদের নামিয়ে দিতে। নামতে শুরু করলো হেলিকপ্টারটা।

হায় ঈশ্বর! অ্যাম্ব্রা বলল, আমি বোধহয় বুঝতে পারছি, কেন মিরোকে নকল করেছে উইনস্টন।

তাই?

কিছুক্ষন আগেই পেদ্রালবেস প্রাসাদের ওপর দিয়ে উড়ে আসলাম আমরা।

পেট্রালবেস? জিজ্ঞেস করলো ল্যাংডন। এটা তো-

মিরোর সবচেয়ে বিখ্যাত ছবিগুলোর একটার নাম। ব্যাপারটা নিয়ে যে বেশ ঘাঁটাঘাঁটি করেছে উইনস্টন সেটা বোঝাই যাচ্ছে।

উইনস্টনের সৃজনশীলতায় অভিভূত না হয়ে পারলো না ল্যাংডন। আরও অবাক করার মত বিষয় হচ্ছে, সম্পূর্ন নিজের বুদ্ধিমত্তা থেকে গোটা ব্যাপারটা সাজিয়েছে এডমন্ডের সুপারকম্পিউটার। ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসতে লাগলো হেলিকপ্টারটা। উইনস্টনের আত্মপ্রতিকৃতির যেখানে চোখটা অবস্থান করছে সেই জায়গায় একটা বড় অন্ধকার দালানের অবয়ব চোখে পড়লো ল্যাংডনের।

ওটাই বোধহয়, সেদিকে নির্দেশ করে বলল অ্যাম্ব্রা।

ভালো করে দালানটা দেখার চেষ্টা করলো ল্যাংডন। ওপর থেকেও বিশাল লাগছে ওটাকে।

কোন বাতি জ্বলতে দেখছি না, অ্যাম্ব্রা বলল। আমরা ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে তো?

কেউ না কেউ তো আছেই এখানে, ল্যাংডন বলল, বিশেষ করে আজ রাতে। তারা যখন বুঝতে পারবে, এডমন্ডের পাসওয়ার্ড জানি আমরা, তখন নিশ্চয়ই সাহায্য করবে।

পনেরো সেকেন্ড পর উইনস্টনের ব্লকের অর্ধবৃত্তাকৃতির পার্কটার পূর্বপাশে নেমে আসলো হেলিকপ্টারটা। ওরা নেমে যাওয়ার সাথে সাথে আবার আকাশে উঠে গেল ওটা। পরবর্তি নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত হেলিকপ্টারের পাশে অপেক্ষা করবে ওদের জন্যে।

গাছপালার মধ্য দিয়ে অন্ধকার দালানটার উদ্দেশ্যে হেঁটে চললো ওরা।

বাতি জ্বলছে না, ফিসফিসিয়ে বলল অ্যাম্ব্রা।

একটা বেড়াও আছে দেখছি, ভ্রু কুঁচকে দশ ফিট উচ্চতার লোহার তৈরি বেড়ার দিকে তাকিয়ে বলল ল্যাংডন। পুরো জায়গাটা ঘিরে রয়েছে ওটা। বেড়াটার ফাঁক গলে ভেতরে উঁকি দেয়ার চেষ্টা করলো সে, কিন্তু গাছগাছালির কারণে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কোন আলো জ্বলতে না দেখে ও নিজেও অবাক হয়ে গেছে।

একটা গেট, বিশ হাত দূরে বেড়ার মাঝে একটা জায়গায় নির্দেশ করলো অ্যাম্ব্রা।

দ্রুত সেদিকে এগিয়ে গিয়ে বন্ধ একটা গেট দেখতে পেলো ওরা। বাইরে একটা বৈদ্যুতিক কল বক্স ঝুলছে ওটার গা থেকে। ল্যাংডন কিছু বলার আগেই কল বাটনে চাপ দিলো অ্যাম্ব্রা।

দুই বার রিং হবার পর সংযোগ পেলো।

নীরবতা।

হ্যালো? বলল অ্যাম্ব্রা। হ্যালো?

স্পিকার থেকে কারো গলার আওয়াজ ভেসে এলো না। শুধু লাইনের খসখসে শব্দ।

জানি না আপনারা শুনতে পাচ্ছেন কি না, বলল অ্যাম্ব্রা। আমি অ্যাম্ব্রা ভিদাল এবং আমার সাথে আছেন রবার্ট ল্যাংডন। এডমন্ড কিয়ার্শের বন্ধু আমরা। আজকে রাতে তার সাথে দেখাও হয়েছিল। আমাদের কাছে এমন কিছু তথ্য আছে যেগুলো এডমন্ড, উইনস্টন এবং আপনাদের সবার কাজে আসবে।

একটা ক্লিকের শব্দ কানে আসলো ওদের।

সাথে সাথে গেটের হাতলটা ঘোরালো ল্যাংডন। খুলে গেল ওটা।

বলেছিলাম না ভেতরে কেউ আছে! উত্তেজিত স্বরে বলল সে।

দরজাটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গাছপালার মধ্যে দিয়ে অন্ধকার দালানটার দিকে যত দ্রুত সম্ভব এগোতে লাগলো ওরা। যত কাছে গেল দালানটার অবয়ব পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠতে লাগলো। ওটার ছাঁদের দিকে তাকিয়ে থেমে যেতে বাধ্য হলো ল্যাংডন আর অ্যাম্ব্রা। এরকম কিছু দেখতে হবে সেটা। কল্পনাতেও আসেনি।

এটা কিভাবে সম্ভব? ছাদের ওপরের বস্তুটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো ল্যাংডন। এডমন্ডের কম্পিউটার ল্যাবের ছাদে একটা পনেরো ফুট লম্বা কুশ?

আরও কিছুদূর এগোনোর পর গাছপালা ঘেরা অঞ্চল থেকে বেরিয়ে আসলো ওরা। এবার পুরো দালানটা দেখতে পাচ্ছে। একটা পুরনো আমলের চার্চের মত দেখতে ওটা।

রবার্ট, আমরা বোধহয় ভুল করে একটা ক্যাথলিক চার্চের উঠোনে ঢুকে পড়েছি, কণ্ঠে অবিশ্বাস অ্যাম্ব্রার।

এ সময় চার্চের সামনে একটা সাইন দেখে হাসতে শুরু করলো ল্যাংডন। নাহ, আমরা একদম ঠিক জায়গাতেই এসেছি।

কয়েক বছর আগে এই স্থাপনাটা নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ শোরগোল হয়েছিল, কিন্তু ল্যাংডন জানতো না, জায়গাটা বার্সেলোনায়। একটা পরিত্যাক্ত ক্যাথলিক চার্চের ভেতরে গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক কম্পিউটার ল্যাব। এডমন্ড যে ইচ্ছে করেই জায়গাটা বেছে নিয়েছিল সে ব্যাপারে নিশ্চিত ল্যাংডন।

এমনকি ল্যাবটার সামনে দাঁড়িয়ে এডমন্ডের পাসওয়ার্ডটাও অর্থবহ মনে হচ্ছে এখন। The Dark Religions are departed & sweet science reigns.

অ্যাম্ব্রাকে সাইনটা দেখালো ল্যাংডন। সেখানে লেখা :

BARCELONA SUPERCOMPUTING CENTER CENTRO NACIONAL DE SUPERCOMPUTACIÓN

ক্যাথলিক চার্চের ভেতরে সুপারকম্পিউটিং সেন্টার? বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞেস করলো অ্যাম্ব্রা।

মাঝে মাঝে সত্য বাস্তবতার চেয়েও অদ্ভুত হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *