অধ্যায় ২১
বিশ্বমঞ্চে অসংখ্য সাফল্যের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এডমন্ড কিয়ার্শ খুব কম সময়ই পরিপূর্ণ তৃপ্তি পেয়েছে। এ মুহূর্তে পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে যে উচ্ছ্বসিত করতালি আর ওভেশন পাচ্ছে সেটা অতুলনীয়। পৃথিবীকে বদলে দেবার যে রোমাঞ্চ সেটা এখন পুরোপুরি উপভোগ করছে সে।
বসে পড়ন, বন্ধুরা, তার বলতে ইচ্ছে করছে। এখনও আসল কথা বলাই হয়নি।
কুয়াশা কেটে গেলে উপরের দিকে তাকানো থেকে নিজেকে বিরত রাখলো এডমন্ড। সে ভালো করেই জানে, তার মুখের ক্লোজআপ ছবি এখন সম্প্রচারিত করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপি। লক্ষকোটি দর্শক সেটা দেখছে।
এটা বৈশ্বিক একটি মুহূর্ত, গর্বের সাথেই ভাবলো সে। এটা সীমানা, শ্রেণি আর বিশাস, সবকিছুকে ছাপিয়ে যাবে।
বামদিকে ফিরে অ্যাম্ব্রা ভিদালকে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য নড করবে বলে তাকালো সে, এককোণে দাঁড়িয়ে সে এই অনুষ্ঠানটি দেখছে। আজকের এই অনুষ্ঠানটির পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে মেয়েটা। কিন্তু অবাক হয়ে সে দেখ পেলো মেয়েটা তাকিয়ে আছে দর্শকদের দিকে, তার অভিব্যক্তিতে দুশ্চিন্তার ছাপ।
*
কিছু একটা সমস্যা হয়েছে, উইংসে দাঁড়িয়ে থেকে অ্যাম্ব্রা ভাবলো।
ঘরের মাঝখানে লম্বা, অভিজাত পোশাক পরা এক লোক মানুষজন। ঠেলেঠুলে হাত নাড়তে নাড়তে অ্যাম্ব্রার দিকে আসছে।
এটা তো রবার্ট ল্যাংডন, আমেরিকান প্রফেসরকে দেখে চিনতে পারলো সে। একটু আগে কিয়ার্শের ভিডিওতে তাকে দেখেছে।
খুব দ্রুত ছুটে আসছে ল্যাংডন, অ্যাম্ব্রার দু-জন দেরক্ষি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখালো। সামনে এগিয়ে এসে পথরোধ করতে চাইলো তার।
সে চায়টা কী?! ল্যাংডনের চোখেমুখে আতঙ্ক দেখতে পাচ্ছে অ্যাম্ব্রা। পোডিয়ামের দিতে তাকালো সে, এডমন্ড এটা লক্ষ্য করেছে কিনা দেখতে চাইলো, কিন্তু এডমন্ড কিয়ার্শ দর্শকদের দিকে চেয়ে নেই, অদ্ভুতচোখে সে তাকিয়ে আছে তারই দিকে!
এডমন্ড! কিছু একটা হয়েছে!
সঙ্গে সঙ্গে ডোমের ভেতরে কানফাটা একটি শব্দ প্রতিধ্বনি তুলতেই এডমন্ডের মাথাটা প্রবলভাবে পেছনের দিকে ঝাঁকি খেয়ে গেল। সুতীব্র ভীতির সাথেই অ্যাম্ৰা দেখতে পেলো এডমন্ডের কপালে ছোট্ট একটা লালবিন্দু ফুটে উঠেছে। তার চোখদুটো উল্টে গেল এবার, তারপরও পোডিয়ামটা শক্ত করে ধরে রেখেছে সে। একটুখানি কেঁপে উঠলো তার সারা শরীর। তার চোখেমুখে ভড়কে যাবার চিহ্ন সুস্পষ্ট। কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না। তারপরই কাটাগাছের মতো এক পাশে হুরমুরিয়ে পড়ে গেল। আর্টিফিশিয়াল টার্ফে তার রক্তমাখা মাথাটা বাড়ি খেলো প্রচণ্ড জোরে।
অ্যাম্ব্রা পুরোপুরি বুঝে ওঠার আগেই পের পেলো এক গার্ডিয়া এজেন্ট তাকে জাপটে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে।
সময় যেন থমকে দাঁড়ালো কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপরই…হট্টগোল।
প্রজেক্টরে দেখা এডমন্ডের রক্তাক্ত দেহটা তীব্র আতঙ্কের সৃষ্টি করলো অতিথিদের মধ্যে। গুলির হাত থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে হলের পেছন দিকে যাবার জন্য ছুটতে শুরু করে দিলো সবাই।
চারপাশে এমন হট্টগোলের মধ্যে রবার্ট ল্যাংডন টের পেলো আতঙ্কে সে প্যারালাইজড হয়ে গেছে। খুব বেশি দূরে নয়, তার বন্ধু মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, এখনও তার দৃষ্টি অডিয়েন্সের দিকেই নিবদ্ধ। বুলেট তার কপালে লালরঙের ছোট্ট একটি বিন্দু সৃষ্টি করেছে। নির্মম ব্যাপার হলো, এডমন্ডের নিষ্প্রাণ দেহটা আলোকিত হয়ে আছে স্পটলাইটের কারণে। ক্যামেরাম্যান ছাড়া টিভি ক্যামেরাটা এখনও তার দিকেই ফোকাস করা। বোঝাই যাচ্ছে, পুরো দৃশ্যটা লাইভ সম্প্রচারে দেখছে সারা বিশ্ব।
অনেকটা স্বপ্নের ঘোরে হাটার মতোই, ল্যাংডন ছুটে গেল টিভি ক্যামেরাটার কাছে, ওটা ধরে আকাশের দিকে তাক করে দিলো সে। ছুটে পালাতে থাকা অতিথিদের মধ্য দিয়েই পোডিয়ামের দিকে তাকালো এবার। ভালো করেই জানে, তার সাবেক ছাত্র-বন্ধু এডমন্ড আর বেঁচে নেই।
হায় ঈশ্বর…আমি তোমাকে সতর্ক করে দেবার চেষ্টা করেছিলাম, এডমন্ড। কিন্তু উইনস্টনের ওয়ার্নিংটা বড্ড দেরিতে পেয়েছি।
এডমন্ডের মৃতদেহ থেকে একটু দূরেই, ল্যাংডন দেখতে পেলো এক গার্ডিয়া এজেন্ট উপুড় হয়ে অ্যাম্ব্রা ভিদালকে প্রটেকশান দেবার জন্য মেঝের সাথে চেপে ধরে রেখেছে। ল্যাংডন দ্রুত তার দিকে ছুটে যেতেই ঐ এজেন্ট সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখালো। চোখের নিমেষে ছুটে এসে নিজের শরীরটা দিয়ে ধাক্কা মেরে বসলো তাকে।
গার্ডের কাঁধটা ল্যাংডনের বুকে এসে লাগতেই তার ফুসফুঁসের সমস্ত বাতাস যেন এক লহমায় বের হয়ে গেল। সেই সঙ্গে তীব্র যন্ত্রণার সাথে তার শরীরটা ছিটকে পড়ে গেল পেছনদিকে। কৃত্রিম টার্ফের উপর পড়ার পর দম নেবার আগেই ল্যাংডন টের পেলো শক্তিশালি দুটোহাত তার পেটটা ধরে উল্টে দিলো তাকে, ডানহাতটা বেঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো পিঠের কাছে। এক হাতের শক্তিশালি তালু চেপে বসলো তার মাথার পেছনে। ল্যাংডনের গাল স্পর্শ করছে কৃত্রিম ঘাস, নড়াচড়া করার কোন সুযোগই রইলো না তার।
তুমি এটা ঘটার আগেই জানতে, চিৎকার করে বলল সেই গার্ড। তুমি কিভাবে এসবের সাথে জড়িত!
*
বিশ গজ দূরে, গার্ডিয়া রিয়েল এজেন্ট রাফা ডিয়াজ পালাতে থাকা অতিথিদের ভিড়ের মধ্য দিয়েই ছুটে যাচ্ছে সাইডওয়ালের সেই জায়গাটার কাছে, যেখান থেকে সে গানশটের স্ফুলিঙ্গ দেখেছে।
অ্যাম্ব্রা ভিদাল নিরাপদে আছে, নিজেকে আশ্বস্ত করলো সে। তার পার্টনার যে মহিলাকে জাপটে ধরে মেঝেতে চেপে রেখেছে নিজের শরীরটা ব্যবহার করে কাভার দিয়ে রেখেছে সেটা সে দেখেছে। ডিয়াজ আরো বুঝতে পেরেছে, ভিক্টিমের জন্য এখন আর কিছু করারও নেই। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার আগেই এডমন্ড কিয়ার্শ মারা গেছেন।
বিস্ময়ের সাথে ডিয়াজ আরো খেয়াল করেছে, আক্রমণের ঠিক আগে অতিথিদের একজন পোডিয়ামের দিকে ছুটে আসছিল সতর্ক করে দেবার জন্য।
ডিয়াজ জানে এ মুহূর্তে তার কাজ একটাই।
শুটারকে গ্রেফতার করা।
স্পটের কাছে পৌঁছাতেই ডিয়াজ দেখতে পেলো কাপড়ের দেয়ালে ছোট্ট একটা ফাঁক। সেই ফাঁকটা দু-হাতে ধরে কাপড়টা পুরোপুরি মেঝে পর্যন্ত চিড়ে ফেলতেই ডোমের বাইরে অসংখ্য মাচাঙ দেখতে পেলো সে।
বামদিকে একটা মানুষের অবয়ব দেখতে পেলো এজেন্টলম্বা একজন মানুষ, পরনে সাদা রঙের মিলিটারি ইউনিফর্ম-ইমার্জেন্সি এক্সিটের দিকে দৌড়ে ছুটে যাচ্ছে সে। চোখের নিমেষে দরজা দিয়ে উধাও হয়ে গেল লোকটা।
ডোমের বাইরে ইলেক্ট্রনিক্সের যন্ত্রপাতির দঙ্গল এড়িয়ে ডিয়াজও ছুটে গেল সেদিকে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় রেলিং থেকে উঁকি দিয়ে দুই ফ্লোর নিচে পালাতে থাকা লোকটাকে দেখতে পেলো। প্রচণ্ড দ্রুতগতিতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে সে। একেক বার পাঁচ পাঁচটি ধাপ টপকে যাচ্ছে। নিচের কোথাও এক্সিট ডোরটা খোলার শব্দ কানে গেল তার, এরপরই সশব্দে বন্ধ করার শব্দ হলো।
সে এই বিল্ডিং থেকে পালাচ্ছে!
ডিয়াজ গ্রাউন্ডফ্লোরে আসতেই, সে বের হবার দরজার দিকে ছুটে গেল-দুই পাল্লার একটি দরজা, সেইসাথে পথ আটকে রাখার একটা ব্যারিয়ার নিজের শরীরের সমস্ত ওজন দিয়ে ওটাতে হামলে পড়লো। কিন্তু উপরতলার দরজার মতো ধরাম করে খুলে গেল না এটা, মাত্র সামান্য ইঞ্চিখানেক ফাঁক হয়ে আবার বন্ধ হয়ে গেল। ডিয়াজের শরীর স্টিলের দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লো মেঝেতে। কোমর আর কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো সে।
যন্ত্রণা উপেক্ষা করে কোনমতে উঠে আবারো চেষ্টা করলো দরজাটা খুলতে।
সামান্য যেটুকু ফাঁক হলো সেটা দিয়ে দেখতে পেলো কেন দরজাটা খুলছে না।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, দরজাটার হ্যান্ডেল বাইরে থেকে শক্ত তার দিয়ে পেচিয়ে আটকে রাখা হয়েছে-একটা শক্ত চেইন দিয়ে। ডিয়াজের কনফিউশন আরো গাঢ় হলো যখন সে বুঝতে পারলো জিনিসটা কি। জিনিসটা তার কাছে পরিচিত লাগছে। অন্য অনেক স্প্যানিশ ধার্মিক ক্যাথলিকের মতোই এটাকে সে চেনে।
এটা কি একটা রোসারি?
শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে আবারো দরজাটা খোলার চেষ্টা করলো ডিয়াজ কিন্তু জপমালার তারটা এতটাই শক্তিশালি যে ছিঁড়ে গেল না, দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে আবারো বাইরে তাকিয়ে দেখলো সেটা।
ওলা? দরজার ফাঁক দিয়ে চিৎকার করে বলল সে। হেই আলগুয়েন?!
কোন সাড়া নেই।
দরজার ঐটুকু সামান্য ফাঁক দিয়ে ডিয়াজ একটা কংক্রিটের দেয়াল আর ফাঁকা সার্ভিস অ্যালি দেখতে পেলো। কেউ এসে চেইনটা দরজার হ্যান্ডেল থেকে খুলে দেবে সে সম্ভাবনা একেবারেই কম। আর কোন উপায় না দেখে ব্লেজারের ভেতর থেকে পিস্তলটা বের করে আনলো সে। দরজার ফাঁক দিয়ে পিস্তলের নল ঢুকিয়ে, রোসারি চেইনটা লক্ষ্য করে গুলি চালাতে উদ্যত হলো এবার।
আমি একটা পবিত্র রোসারিওতে গুলি করছি? কুয়ে দিওস মে পারদোনে।
গুলির শব্দে প্রকম্পিত হলো সিঁড়ির ল্যান্ডিং, সেই সঙ্গে খুলে গেল দরজাটা। রোসারিওটা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। ডিয়াজ ফাঁকা সার্ভিস অ্যালিটা ধরে সামনের দিকে ছুটে গেল।
সাদা পোশাকের ঘাতক সটকে পড়েছে।
*
এক শ মিটার দূরে, অ্যাডমিরাল লুই আভিলা কালো রঙের একটি রেনল্ট গাড়ির পেছনের সিটে চুপচাপ বসে আছে। জাদুঘর থেকে দ্রুত গতিতে বের হয়ে যাচ্ছে গাড়িটা।
ভোন ফাঁইভারে তৈরি রোসারির মজবুত চেইনটা তার কাজ ঠিকমতোই করতে পেরেছে, তার পেছনে আসা লোকটাকে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আটকে রাখতে পেরেছে ওটা।
এখন আমি উধাও হয়ে গেছি।
আভিলার গাড়িটা নারভিওন নদীর উত্তর-পশ্চিম তীর ঘেষে চলে এলো অ্যাভেনিদা আবানদোইবারায়, দ্রতগতিতে ছুটে চলা যানবাহনের মধ্যে মিশে যেতেই অবশেষে হাফ ছাড়লো সে।
আজকের রাতে তার মিশনটা এরচেয়ে ভালোভাবে করা সম্ভব ছিল না।
তার মাথায় এখন বেজে উঠলো উজ্জ্বল ওরিয়ামেন্দি স্তবগীতটি-বহু পুরনো এটার কথাগুলো এক সময় এখানে, এই বিলবাওতে যুদ্ধের ময়দানে গাওয়া হতো। পর দিওস, পর লা পাত্রিয়া ভে এল রেই!
আভিলা মনে মনে গেয়ে উঠলো। ঈশ্বরের জন্য, দেশের জন্য, আর রাজার জন্য!
যুদ্ধের এই দামামা অনেক আগেই বিস্মৃত হয়ে গেছে…কিন্তু যুদ্ধটা সবে হলো বলে।
.
অধ্যা।য় ২২
মাদ্রিদের পালাসিও রিয়েল ইউরোপের সবচাইতে বৃহৎ রাজপ্রাসাদ। চোখ ধাঁধানো এই স্থাপত্যটি নির্মিত হয়েছে ক্লাসিক্যাল আর বারোক স্টাইলের মিশ্রণে। নবম শতকের একটি মুরিশ প্রাসাদের উপর এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রাসাদটির তিনতলা উঁচু সামনের দিকের কলামগুলো ছড়িয়ে আছে পাঁচশ ফিট প্রশস্ত পুজা দে লা আরমেরিয়া নামে পরিচত জায়গাটির সমগ্র এলাকা জুড়ে। ভবনের ভেতরে অবিশ্বাস্য ৩৪১৮টি কামরা রয়েছে, যার সম্মিলিত আয়তন আনুমানিক দেড় মিলিয়ন বর্গফুটের মতো হবে। সেলুন, বেডরুম, আর হলওয়েগুলো সজ্জিত করা হয়েছে অমূল্য সব চিত্রকর্ম দিয়ে, তার মধ্যে ভেলাজকুয়েজ, গয়া আর রুবেন্সও রয়েছে।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে এটি স্পেনের রাজা এবং রাণীর বাসস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে অবশ্য, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের জন্যই এটা ব্যবহার করা হয়। শহরের বাইরে, পালাসিও দে লা জারজুয়েলাতে অপেক্ষাকৃত কম জাঁকজমকপূর্ণ একটি প্রাসাদে রাজপরিবার বসবাস করে।
সাম্প্রতিক সময়ে মাদ্রিদের এই সাবেক প্রাসাদটি ক্রাউন প্রিন্স হুলিয়ানের স্থায়ী আবাস হয়ে উঠেছে বিয়াল্লিশ বছরের ভবিষ্যৎ রাজা-সিংহাসনে আসীন হবার আগে তাকে আরো বেশি জনগণের কাছে দৃশ্যমান হতে হবে, তার মন্ত্রণাদাতাদের এমন পরামর্শে হুলিয়ান এখানে উঠে এসেছেন।
যুবরাজ হুলিয়ানের বাবা, বর্তমান রাজা কয়েক মাস ধরেই শয্যাশায়ি হয়ে আছেন নানা রকম প্রাণঘাতি অসুখে আক্রান্ত হয়ে। রাজার এমন ভঙ্গুর অবস্থা দেখে রাজপ্রাসাদের কর্মকর্তারা ধীরে ধীরে ক্ষমতার পালা বদল ঘটাচ্ছে, যুবরাজকে সিংহাসনে আসীন করানোর জন্য প্রস্তুত করে তুলছে, যাতে করে বাবার মৃত্যুর পর পরই তিনি রাজা হিসেবে মসনদে বসতে পারেন। ক্ষমতার এই পরির্বতন যখন অনিবার্য তখন স্পেনের জনগণের চোখ গিয়ে পড়েছে। যুবরাজ হুলিয়ানের উপরে, তাদের মনে একটাই প্রশ্ন :
তিনি কী ধরণের শাসক হিসেবে আবির্ভূত হবেন?
যুবরাজ হুলিয়ান সব সময়ই ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। বিচক্ষণ আর সতর্ক। শৈশব থেকেই তিনি স্বাধীনচেতা। হুলিয়ানের মা দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন বহু আগেই, কিন্তু রাজা সবাইকে অবাক করে দিয়ে দ্বিতীয়বার আর বিয়ে করেননি। ফলে হুলিয়ান এখন রাজসিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারি।
একমাত্র বংশধর, আর কোন উপায় নেই, বৃটিশ ট্যাবলয়েড এভাবেই যুবরাজকে ইঙ্গিত করেছিল।
হুলিয়ান যেহেতু তার অতি রক্ষণশীল বাবার ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছে তাই রক্ষণশীল আর ঐতিহ্যবাদি স্পেনিয়ার্ডরা বিশ্বাস করে, ছেলে তার বাবার মতোই আগের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখবে, বজায় রাখবে ঐতিহ্যবাহি সব ধরণের রক্ষণশীল আচার-অনুষ্ঠান। স্পেনের সমৃদ্ধ ক্যাথলিক চার্চের প্রতিও থাকবে শ্রদ্ধাশীল।
শত শত বছর ধরে, ক্যাথলিক রাজাগণ স্পেনের নীতি-নৈতিকতার কেন্দ্র হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবশ্য দেশটির এই ভিত্তিমূল কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে। স্পেনে এখন পুরনো আর নতুনের মধ্যে এক ধরণের সহিংস টাগ-অব-ওয়ার চলছে।
প্রচুর সংখ্যক উদারপন্থি লোকজন ব্লগ আর সোশ্যাল মিডিয়াতে গুজবের প্লবন বয়ে দিচ্ছে এই বলে যে, হুলিয়ান তার বাবার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসবে-সাহসি, প্রগতিশীল আর সেকুলার একজন নেতা হিসেবে স্বেচ্ছায় অন্য আরো অনেক ইউরোপিয়ান দেশের মতোই রাজতন্ত্রের পরিসমাপ্তি ঘটাবে।
হুলিয়ানের বাবা রাজা হিসেবে বেশ সক্রিয় ছিলেন, হুলিয়ানকে তিনি খুব একটা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে দেননি। রাজা প্রকাশ্যেই বলেছেন, হুলিয়ান তার যৌবন উপভোগ করুক। বিয়ে করে থিতু না হওয়া পর্যন্ত সে যেন রাজকার্যে জড়িত না হয়। এরফলে হুলিয়ানের প্রথম চল্লিশটি বছর-স্প্যানিশ পত্রপত্রিকায় যার বিশদ বিবরণ পাওয়া যাবে কেটেছে প্রাইভেট স্কুলে পড়ে, ঘোড়ায় চড়ে, রিবন কাটিং করে, ফান্ডরেইজিং অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আর ভ্রমণ করে। জীবনে তেমন উল্লেখযোগ্য কাজ না করে থাকলেও যুবরাজ হুলিয়ান যে স্পেনের সবচাইতে কাঙ্খিত ব্যাচেলর সে ব্যাপারে কারো মনে সন্দেহ নেই।
বিগত বছরগুলোতে বিয়াল্লিশ বছরের এই হ্যান্ডসাম ব্যাচেলর প্রায় প্রকাশ্যেই অসংখ্য মেয়ের সাথে ডেট করে বেরিয়েছেন। একজন হোপলেস রোমান্টিক মানুষ হিসেবে কেউই তার হৃদয় চুরি করতে সক্ষম হয়নি। তবে কয়েক মাস ধরে হুলিয়ানকে এক সুন্দরি মহিলার সাথে দেখা যাচ্ছিল। দেখতে অবসরে যাওয়া ফ্যাশন মডেলদের মতো হলেও, আদতে সে বিলবাওর গুগেনহাইম মিউজিয়ামের স্বনামধন্য একজন ডিরেক্টর।
মিডিয়া দেরি না করেই মন্তব্য করে ফেলেছিল, অ্যাম্ব্রা ভিদাল হবে তাদের আধুনিক রাজার জন্য একদম সোনায় সোহাগা। মহিলা সংস্কৃতমনা, সফল এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, স্পেনের সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর কেউ নয় সে। অ্যাম্ব্রা ভিদাল তাদের মতোই সাধারণ একজন মানুষ।
মনে হয় মিডিয়ার মতো যুবরাজও একই ধারনা পোষণ করেন। খুব অল্প সময়ের পরিচয়েই হুলিয়ান তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দেন-একেবারেই। অপ্রত্যাশিত আর রোমান্টিকভাবে-আর অ্যাম্ব্রা ভিদালও সেই প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছে।
এরপর থেকে পত্রপত্রিকাগুলো অ্যাস্ত্রা ভিদালের উপরে প্রায় প্রতিদিনই খবর দিতে শুরু করে। অল্পদিনের মধ্যেই সে নিজেকে প্রকাশ করে প্রচণ্ড স্বাবলম্বি এক নারী হিসেবে, নিজের ব্যক্তিগত জীবনের স্বাভাবিকতা নষ্ট হবে বলে স্পেনের ভবিষ্যৎ এই রাণী গার্ডিয়া রিয়েলের নিরাপত্তা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কেবল মাত্র পাবলিক ইভেন্টে এই সুবিধাটুকু নিয়ে থাকে সে।
গার্ডিয়া রিয়েলের কমান্ডার অ্যাম্রাকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করে বলেছিল, সে যেন একটু রক্ষণশীল আর কম টাইটফিট পোশাক পরে, তখন এই স্বাধীনচেতা নারী প্রকাশ্যে ঠাট্টা করে বলেছিল, গারদারোপিয়া রিয়েল-এর কমান্ডার তাকে অপমান করেছে-যে শব্দের অর্থ হলো রাজকীয় ওয়ার্ডরোব।
উদারপন্থি ম্যাগাজিনগুলো প্রায় সবাই তার ছবি কাভার হিসেবে ছাপিয়েছে। অ্যাম্ৰা! স্পেনের সুন্দরতম মুখশ্রী! সে যখন কোন ইন্টারভিউ দিতে অস্বীকৃতি জানায় তখন আবার তারা সেটাকে স্বাবলম্বী হিসেবে উল্লেখ করে। আবার ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়ে গেলে তারাই প্রশংসা করে বলে, সে একজন মাটির মানুষ।
রক্ষণশীল ম্যাগাজিনগুলো আবার এর বিপরীত। তারা মন্তব্য করে থাকে, হবু রাণী একজন ক্ষমতালোভি সুবিধাবাদি, ভবিষ্যৎ রাজার জন্য তিনি বিপজ্জনক হয়ে উঠবেন।
তাদের প্রাথমিক চিন্তাটা হলো, যুবরাজ হুলিয়ানকে অ্যাম্ৰা কেবল তার প্রথম নাম ধরে ডাকে। ঐতিহ্যগতভাবে তাকে ডন হুলিয়ান কিংবা সুআলতেজা বলে ডাকে না।
তাদের দ্বিতীয় চিন্তার বিষয় হলো, এটা অবশ্য অনেক বেশি সিরিয়াস ব্যাপার-বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে কাজের ব্যস্ততার কারণে যুবরাজকে তেমন একটা সময় দিচ্ছে না অ্যাম্রা। তারচেয়েও বড় কথা, তাকে ঘনঘন বিলবাওতে দেখা গেছে এডমন্ড কিয়ার্শ নামের এক আমেরিকান এবং সুপরিচত নাস্তিকের সাথে জাদুঘরের আশেপাশের রেস্তোরাঁয় বসে লাঞ্চ করতে।
অ্যাম্ৰা যদিও জোর দিয়ে বলেছে, এই লাঞ্চগুলো আদতে জাদুঘরের একজন বড় ডোনারের সাথে মিটিংয়ের অংশ ছিল, কিন্তু প্রাসাদের ভেতরে কিছু সোর্সের মতে, এতে নাকি যুবরাজ হুলিয়ান ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়েছেন।
এরজন্যে তাকে অবশ্য কেউ দোষ দিতে পারে না।
আসল সত্য হলো, হুলিয়ানের সুন্দরি বাগদত্তা-তাদের এনগেজমেন্টের কয়েক সপ্তাহ পরই-অন্য একজন পুরুষের সাথে সময় কাটাতে শুরু করে দিয়েছিল।
.
অধ্যায় ২৩
ল্যাংডনের মুখটা এখনও টার্ফের সাথে শক্ত করে চেপে রাখা হয়েছে। তার উপরে এজেন্টের পুরো ওজনটা তাকে চিড়েচ্যাপ্টা করে দিচ্ছে।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো তার কিছুই অনুভূত হচ্ছে না।
ল্যাংডনের আবেগ বিক্ষিপ্ত আর ভোতা হয়ে আছে-দুঃখবোধ, ভয় আর ক্রোধে। তার পরম বন্ধু, এ বিশ্বের অন্যতম প্রতিভাবান একজন মানুষকে এইমাত্র প্রকাশ্যে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার জীবনের সবচাইতে সেরা আবিষ্কারটি ঘোষণা দিতে যাবে এমন সময় তাকে খুন করা হয়েছে।
ল্যাংডন এখন বুঝতে পারছে, একজন মানুষের করুণ পরিণতির সাথে। সাথে বিজ্ঞানেরও অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।
পূথিবী আর কখনও জানতে পারবে না এডমন্ড কী আবিষ্কার করেছিল। হঠাৎ করে ল্যাংডনের মধ্যে প্রচণ্ড ক্রোধ আর দৃঢ়প্রতীজ্ঞা জেগে উঠলো।
এই ঘটনার জন্য কে দায়ি সেটা আমি যে করেই হোক খুঁজে বের করবোই। এডমন্ড, আমি তোমার লিগ্যাসিকে সম্মান করবো। যেভাবেই হোক
কেন, তোমার আবিষ্কারের কথা আমি বিশ্ববাসিকে জানাবোই।
তুমি সব জানতে, গার্ডের ফ্যাসফেসে কণ্ঠটা বলে উঠলো তার কানে। তুমি এমনভাবে পোডিয়ামের দিকে ছুটে আসছিলে, যেন তুমি জানতে কিছু একটা হবে।
আমাকে…সতর্ক…করা হয়েছিল, কোনমতে বলতে পারলো ল্যাংডন। শাস নিতেই পারছে না সে।
কে তোমাকে সতর্ক করেছে?!
গালের উপরে লেপ্টে থাকা চিকন হেডসেটটা টের পেলো ল্যাংডন। আমার হেডসেট থেকে…ওটা একটা অটোমেটেড ডোসেন্ট। এডমন্ড কিয়ার্শের কম্পিউটার সতর্ক করে দিয়েছিল আমাকে। ওটা অতিথিদের তালিকায় একটা অসঙ্গতি ধরতে পেরেছিল-স্প্যানিশ নেভির একজন অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডমিরাল।
গার্ডের মাথাটা এখন ল্যাংডনের কানের এতটাই কাছে যে, তার ইয়ারপিসে কী বলা হচ্ছে সেটা সে শুনতে পাচ্ছে। কণ্ঠটা দম ফুরিয়ে হাফচ্ছে। যেন। ল্যাংডনের স্প্যানিশ অতোটা ভালো না হলেও কথাগুলোর মর্মোদ্ধার করতে পেরেছে সে।
…এল অ্যাসেসিনো আ উইদো…
অ্যাসাসিন পালিয়ে গেছে।
…সালিদা ব্লোকুয়েদা…
একটা এক্সিট ব্লক করে দেয়া হয়েছিল।
…ইউনিফর্মে মিলিতার ব্লাঙ্কো…
মিলিটারি ইউনিফর্ম শব্দটা শোনার পরই ল্যাংডনের উপর থেকে গার্ড সরে এলো। ইউনিফর্মে নাভাল? পার্টনারের কাছে জানতে চাইলো সে। ব্লাঙ্কো…? কোমো দে আলমিরাস্তে?
নেভির ইউনিফর্ম, বুঝতে পারলো ল্যাংডন। উইনস্টন তাহলে ঠিকই বলেছে।
ল্যাংডনকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো গার্ড। চিৎ হোন।
খুব কষ্টে, তীব্র যন্ত্রণার সাথে ল্যাংডন শরীরটা গড়িয়ে চিৎ হতে পারলো। কনুইর উপর ভর দিয়ে একটু উঠেও বসলো সে। তার মাথা ভনভন করে ঘুরছে, বুকে হচ্ছে তীব্র ব্যথা।
একদম নড়বেন না, গার্ড বলল তাকে।
নড়াচড়া করার কোন ইচ্ছে নেই ল্যাংডনের। যে অফিসারটি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার ওজন কমপক্ষে দুশো পাউন্ড তো হবেই। পেটানো শরীরের লোকটি এরইমধ্যে দেখিয়ে দিয়েছে নিজের কাজে সে কতোটা সিরিয়াস।
ইমেদিয়াতামেন্তে! ওয়াকিটকিতে চিৎকার করে বলল গার্ড। স্থানীয় পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়ে যাচ্ছে সে। জাদুঘরের আশেপাশে রাস্তা ব্লক করার কথাও বলছে।
…পোলিশিয়া লোকাল…ব্লকুয়েস দে কারেতেরা…
টার্ফে বসে থেকেই ল্যাংডন দেখতে পাচ্ছে অ্যাম্ব্রা ভিদালকে। সাইডওয়ালের কাছেই, এখনও সে মেঝেতেই শুয়ে আছে। ওঠার চেষ্টা করলেও ধপাস করে বসে পড়লো মহিলা।
কেউ তাকে সাহায্য করো!
গার্ডটা এখন ডোমের ভেতরে চিৎকার করে যাচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে না কারোর উদ্দেশে বলছে কথাগুলো। লিউসেস! ই কোবারতুরা দে মভিল! আমার দরকার বাতি আর ফোন সার্ভিস!
ল্যাংডন তার হেডসেটটা খুলে হাতে নিয়ে নিলো। উইনস্টন, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?
গার্ড অদ্ভুত চোখে তাকালো ল্যাংডনের দিকে।
আমি শুনতে পাচ্ছি। নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল উইনস্টন।
উইনস্টন, এডমন্ডকে গুলি করা হয়েছে। এক্ষুণি বাতিগুলো জ্বালানোর দরকার। ফোন সার্ভিসও চালু করতে হবে। তুমি কি এটা করতে পারবে? নাকি অন্য কারোর সাথে যোগাযোগ করবে?
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ডোমের ভেতরে বাতিগুলো জ্বলে উঠলো, ঘাসের উপরে রাতের তারাভরা আকাশের ইস্যুশনটা উধাও হয়ে গেল নিমেষে। এবার দেখা গেল, কৃত্রিম ঘাসের একটি ফাঁকা মাঠ, এখানে সেখানে অসংখ্য কম্বল বিছানো। সবগুলোই পরিত্যাক্ত।
ল্যাংডনের এমন ক্ষমতা দেখে গার্ড লোকটি মনে হচ্ছে খুবই চমকে গেছে। প্রফেসরের সামনে এসে তাকে টেনে দাঁড় করালো সে। উজ্জ্বল। আলোতে দু-জন মানুষ এবার মুখোমুখি।
এজেন্ট লোকটি বেশ লম্বা, প্রায় ল্যাংডনের সমান হবে। মাথা কামানো, পেশিবহুল শরীরটা নীলরঙের ব্লেজারের উপর দিয়েও দৃশ্যমান। তার মুখ ফ্যাকাশে হলেও তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে ল্যাংডনের দিকে। যেন বিদ্ধ করে ফেলবে তাকে।
আজকের ভিডিওতে আপনি ছিলেন। আপনি রবার্ট ল্যাংডন।
হ্যাঁ। এডমন্ড কিয়ার্শ আমার সাবেক ছাত্র এবং বন্ধু।
আমি এজেন্ট ফনসেকা…গার্ডিয়া রিয়েলে আছি, চমৎকার ইংরেজিতে কথাটা বলল সে। এখন আমাকে বলুন, আপনি কী করে নেভি ইউনিফর্মের কথাটা জানতে পারলেন।
এডমন্ডের লাশের দিকে তাকালো ল্যাংডন। পোডিয়ামের পাশে নিথর হয়ে পড়ে আছে সেটা। তার পাশেই অ্যাম্ব্রা ভিদাল হাটু গেড়ে বসে আছে। মহিলাকে ঘিরে রেখেছে জাদুঘরের দু-জন সিকিউিরি গার্ড আর একজন প্যারামেডিক। এডমন্ডের ব্যাপারে কিছুই করার নেই এই প্যারামেডিকের, তাই অ্যাম্ৰা আস্তে করে একটা কম্বল দিয়ে তার লাশটা ঢেকে দিলো।
ল্যাংডনের মনে হলো, সে বুঝি বমি করে দেবে। নিহত বন্ধুর উপর থেকে চোখ সরাতে পারছে না কোনমতে।
তার ব্যাপারে আমাদের কিছু করার নেই, গার্ড বলল। আপনি কিভাবে জানতে পারলেন, বলেন।
গার্ডের দিকে তাকালো ল্যাংডন। লোকটা আসলে তাকে প্রশ্ন করেনি, হুকুম দিয়েছে।
উইনস্টন তাকে কী বলেছে দ্রুত বলে দিলো ল্যাংডন-ডোসেন্ট প্রোগ্রাম করা হেডসেটগুলোর একটা পরিত্যাক্ত করা হলে জাদুঘরের একজন ডোসেন্ট সেটা ট্র্যাশ-ক্যান থেকে খুঁজে পায়। তারা চেক করে দেখে কোন্ অতিথির জন্য এটা বরাদ্দ করা ছিল। তারা নড়েচড়ে বসে যখন দেখতে পায়, শেষ মুহূর্তে এই অতিথিকে তালিকাভূক্ত করা হয়েছে।
অসম্ভব। গার্ডের চোখদুটো কুঁচকে গেল। গতকাল থেকেই অতিথিদের তালিকা লক্ করা হয়েছে। সবার ব্যাকগ্রাউন্ডও চেক করা হয়েছে এরপর।
এই লোকটার বেলায় সেটা হয়নি, ল্যাংডনের হেডসেটে উইনস্টনের কণ্ঠটা বলে উঠলো। আমি চিন্তায় পড়ে গেছিলাম খবর শোনার পর, তারপর নিজে অতিথিদের তালিকা চেক করে দেখি, সে স্প্যানিশ নেভির সাবেক অবসরপ্রাপ্ত একজন অ্যাডমিরাল। অতিরিক্ত মদ্যপান এবং পাঁচবছর আগে সেভিয়াতে এক সন্ত্রাসি হামলার পর মানসিক চাপের মধ্যে ছিল বলে তাকে কাজ থেকে অব্যহতি দেয়া হয়।
গার্ডের কাছে কথাগুলো রিলে করে দিলো ল্যাংডন।
ক্যাথেড্রালে বোমা বিস্ফোরণের কথা বলছে? গার্ড যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না।
আরো আছে, ল্যাংডনকে বলল উইনস্টন, আমি খুঁজে দেখলাম এই অফিসারের সাথে মি. কিয়ার্শের কোন রকম কানেকশান নেই। এটা জানার পর আমি আরো বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ি, জাদুঘরের সিকিউরিটির সাথে যোগাযোগ করে বলি অ্যালার্ম বাজিয়ে দিতে, কিন্তু এত অল্প তথ্যের উপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অ্যালার্ম বাজিয়ে সবকিছু ভেস্তে দিতে চায়নি তারা বিশেষ করে এটা যখন সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছিল বিশ্বব্যাপি। এডমন্ড আজকের অনুষ্ঠানের জন্য কতোটা পরিশ্রম করেছেন, সেটা জানতাম, তাই আমিও তাদের যুক্তি মেনে নেই। এ কারণে আমি সঙ্গে সঙ্গে রবার্ট ল্যাংডনের সাথেই যোগাযোগ করি, এই আশায়, যাতে করে সবার অলক্ষ্যে একটি সিকিউরিটি টিম পাঠিয়ে লোকটাকে চিহ্নিত করে তাদের জিম্মায় নিয়ে নিতে পারে। আমার আরো শক্ত পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল। আমি এডমন্ডকে ব্যর্থ করে দিয়েছি।
এডমন্ডের মেশিন অপরাধবোধে ভুগছে, এটা দেখতে পেয়ে লাংডনের কাছে বেশ অদ্ভুত লাগলো। এডমন্ডের কম্বলে ঢাকা দেহটার দিকে তাকালো সে, দেখতে পেলো অ্যাম্ব্রা ভিদাল তার দিকেই আসছে।
ফনসেকা মহিলাকে আমলে না নিয়ে ল্যাংডনের দিকেই চেয়ে আছে। কম্পিউটার আপনাকে ঐ নেভি অফিসারের নামটা বলেছে? জিজ্ঞেস করলো সে।
মাথা নেড়ে সায় দিলো প্রফেসর। তার নাম অ্যাডমিরাল লুই আভিলা।
নামটা শোনামাত্র অ্যাম্ব্রা থমকে দাঁড়ালো কয়েক মুহূর্তের জন্য, ল্যাংডনের দিকে তাকালো সে। তার চোখেমুখে সুতীব্র ভীতি।
তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে ফনসেকা এগিয়ে গেল সেদিকে। মিস ভিদাল, নামটা কি আপনার কাছে পরিচিত লাগছে?
জবাব দিতে পারলো না অ্যাম্ব্রা। চোখ নামিয়ে মেঝের দিকে তাকালো সে, যেন এইমাত্র ভুত দেখেছে।
মিস ভিদাল, ফনসেকা আবারো একই প্রশ্ন করলো। অ্যাডমিরাল লুই আভিলা-এই নামটা আপনার কাছে পরিচিত লাগছে?
অ্যাম্রার ভড়কে যাওয়া অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছে, সে খুনিকে চেনে। কয়েক মুহূর্ত পর তার গভীর কালো চোখ পলক ফেলল, যেন সম্মোহন থেকে জেগে উঠেছে। না…আমি তাকে চিনি না, ফিসফিসিয়ে বলল কথাটা। ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে তার নিরাপত্তারক্ষিদের দিকে ফিরলো এবার। আমি. ..মানে, খুনি স্প্যানিশ নেভির একজন অফিসার কথাটা শুনে খুবই শকড হয়ে গেছি আর কি।
মহিলা মিথ্যে বলছে, ল্যাংডন আঁচ করতে পারলো। ভেবে পেলো না, মহিলা কেন তার প্রতিক্রিয়া লুকোতে যাবে। আমি এটা তার মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছি। লোকটার নাম সে আগে থেকেই জানতো।
অতিথিদের তালিকার দায়িত্বে কে ছিল?! ফনসেকা জানতে চাইলো। অ্যাম্ব্রার দিকে আরেক পা এগিয়ে গেল সে। এই লোকের নাম কে যোগ করেছে?
অ্যাম্ৰার ঠোঁটদুটো কাঁপছে এখন। আমার…আমার কোন ধারণাই নেই।
হঠাৎ করেই ডোমের ভেতরে বেজে ওঠা মোবাইলফোনের রিং আর বিপের শব্দে বাধাগ্রস্ত হলো গার্ডের জেরা করা। মনে হচ্ছে, উইনস্টন সেলফোন সার্ভিস আবার চালু করতে সক্ষম হয়েছে। ফনসেকার ব্লেজারের ভেতরে থাকা ফোনটা বাজছে এখন।
ফোনটা বের করে হাতে নিয়ে কলার আইডি দেখে গভীর করে দম নিলো গার্ডিয়া এজেন্ট। অ্যাম্ব্রা ভিদাল এস্তা আ সালভো, জানালো সে।
অ্যাম্ব্রা ভিদাল নিরাপদে আছেন। হতভম্ব মহিলার দিকে তাকালো ল্যাংডন। এরইমধ্যে সে তার দিকে চেয়ে আছে। দু-জনের চোখাচোখি হতেই দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তারা একে অন্যের দিকে চেয়ে থাকলো।
এরপরই হেডসেটে উইনস্টনের কণ্ঠটা শুনতে পেলো ল্যাংডন।
প্রফেসর, ফিসফিসিয়ে বলল সে। অ্যাম্ব্রা ভিদাল ভালো করেই জানে কিভাবে লুই আভিলাকে অতিথিদের তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। সে নিজেই এ কাজটা করেছে।
কথাটা হজম করতে কয়েক মুহূর্ত লেগে গেল ল্যাংডনের। অ্যাম্ব্রা ভিদাল নিজে খুনির নাম অতিথিদের তালিকায় ঢুকিয়েছে? আর এখন কিনা সে অস্বীকার করছে সেটা?!
তথ্যটা ল্যাংডন পুরোপুরি বোধগম্য করার আগেই ফনসেকা তার ফোনটা বাড়িয়ে দিলো অ্যাম্বুার দিকে।
এজেন্ট বলল, দন হুলিয়ান কোয়্যারে আবলার কন উস্তেদ।
মনে হলো ফোন থেকে একটু সরে দাঁড়ালো অ্যাম্ব্রা। তাকে বলো আমি ঠিক আছি। একটু পর আমি নিজেই তাকে ফোন দেবো।
গার্ড যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না এটা। ফোনটা হাত দিয়ে ঢেকে অ্যাম্ব্রাকে নিচুকণ্ঠে বলল, সু অলতেজা দন হুলিয়ান, এল প্রিন্সিপে, হা পেদিদো-।
সে যুবরাজ কিনা তাতে আমার কিছু যায় আসে না, রেগেমেগে বলল মহিলা। সে যদি আমার স্বামী হতে চায় তাহলে তাকে শিখতে হবে, আমার যখন দরকার পড়বে তখন একটু স্পেস যেন দিতে হয়। আমি একটু আগে একটা মানুষকে খুন হতে দেখেছি। নিজেকে ধাতস্থ করতে আমার একটু সময়। লাগবে! তাকে বলো, একটু পরই আমি তাকে ফোন দিচ্ছি।
মহিলার দিকে আহতদৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো এজেন্ট। এরপর সে ঘুরে কানে ফোন ঠেকিয়ে কথা বলতে বলতে চলে গেল একটু দূরে।
এই অদ্ভুত দৃষ্টি বিনিময় থেকে ল্যাংডনের কাছে ছোট্ট একটি রহস্য পরিষ্কার হয়ে উঠলো। অ্যাম্ব্রা ভিদাল স্পেনের যুবরাজ হুলিয়ানের সাথে এনগেজড? এখন সে বুঝতে পারছে, এই মহিলা কেন সেলিব্রেটিদের মতো খাতির পায়, কেন তার সঙ্গে গার্ডিয়া রিয়েলের দু-জন সদস্য আছে। তবে তার বাগদত্তার ফোন কল কেন সে রিসিভ করলো না এটা পরিষ্কার নয় ল্যাংডনের কাছে। এই ঘটনাটা যদি যুবরাজ টিভিতে দেখে থাকেন তাহলে তিনি নিশ্চয় যার পর নাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, ল্যাংডনের মনে আরেকটি ভাবনার উদ্রেক হলো, আরো বেশি খারাপ কিছু।
ওহ ঈশ্বর…অ্যাম্ব্রা ভিদাল মাদ্রিদের রাজপরিবারের সাথে কানেক্টেড।
এডমন্ডকে হুমকি দেয়া বিশপ ভালদেসপিনোর ভয়েসমেইলের কথা মনে পড়তেই এই অপ্রত্যাশিত কাকতালিয় ব্যাপারটি তার মধ্যে এক ধরণের সুতীব্র ভীতি ছড়িয়ে দিলো।
.
অধ্যায় ২৪
মাদ্রিদের রাজপ্রাসাদ থেকে দুশো গজ দূরে, আলমুদেনা ক্যাথেড্রালের ভেতরে, বিশপ ভালদেসপিনোর নিঃশ্বাস কয়েক মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। এখনও তার পরনে সেরেমোনিয়াল আলখাল্লা, নিজের অফিসের ল্যাপটপের সামনে বসে আছেন তিনি। তার সমস্ত মনোযোগ বিলবাও থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের দিকে নিবদ্ধ করে রেখেছেন।
এটা হবে বিরাট বড় একটি সংবাদ।
তিনি ভালো করেই বুঝতে পারছেন, সারাবিশ্বের মিডিয়া এরইমধ্যে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। বড় বড় টিভি চ্যানেলগুলো প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আর ধর্মবেত্তাদের জড়ো করেছিল এডমন্ড কিয়ার্শ তার প্রেজেন্টেশনে কী দেখাবেন সে-ব্যাপারে অনুমান করার জন্য, এখন তাদের সবার কাছে একটা প্রশ্নই করা হচ্ছে, এডমন্ড কিয়ার্শকে কে খুন করলো এবং কেন খুন করলো। মনে হচ্ছে সব মিডিয়া এ ব্যাপারে একমত, দৃশ্যত বোঝাই যাচ্ছে, কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠি আছে যারা চায় না এডমন্ড কিয়ার্শের আবিষ্কারটি দিনের আলো দেখুক।
অনেকক্ষণ ধরে ভেবে যাবার পর, ভালদেসপিনো তার সেলফোনটা বের করে একটা কল করলেন।
রাবাই কোভেস প্রথমবার রিং হবার পরই কলটা ধরলেন। ভয়ানক! রাবাইর কণ্ঠ যেন থর থর করে কাঁপছে। টিভিতে আমি সবই দেখেছি। আমাদের উচিত এক্ষুণি পুলিশকে ডেকে আমরা যা জানি তার সব কিছু বলে। দেয়া!
রাবাই, ভালদেসপিনো খুবই মেপে মেপে কথা বললেন। আমি স্বীকার করছি খুবই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেছে। কিন্তু কোন পদক্ষেপ নেবার আগে আমাদের একটু ভেবে নিতে হবে।
ভাবার কিছু নেই! কোভেস পাল্টা বললেন। বোঝাই যাচ্ছে কেউ না কেউ আছে যারা যেকোন উপায়ে কিয়ার্শের আবিষ্কারটি মাটিচাপা দিয়ে রাখতে চায়। তারা কসাই ছাড়া আর কিছু না! আমি এখন নিশ্চিত, তারাই সাঈদকে হত্যা করেছে। তারা অবশ্যই জানে আমরা কে, পরবর্তিতে তারা আমাদের। পেছনেও লাগবে। আপনার এবং আমার এখন নৈতিক দায়িত্ব হয়ে উঠেছে পুলিশকে বলে দেয়া, কিয়ার্শ আমাদেরকে কী বলেছিল।
নৈতিক দায়িত্ব? ভালদেসপিনো চ্যালেঞ্জের সুরে বললেন। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনি চাচ্ছেন তথ্যটা সবাইকে জানিয়ে দিতে, যাতে করে আমাদের দুজনের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা আর কেউ না করে।
অবশ্যই, আমাদের নিরাপত্তার কথাটা বিবেচনায় নিতে হবে, রাবাই তর্ক করলেন, তবে এছাড়াও দুনিয়ার কাছে আমাদের নৈতিক একটি দায় আছে। আমি বুঝি, এই আবিষ্কারটি ধর্মগুলোর একেবারে মূল বিশ্ব সের জায়গাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, কিন্তু আমি আমার সুদীর্ঘ জীবনে একটা ক্ষা পেয়েছি, তা হলো ধর্মবিশ্বাস সব সময়ই টিকে থাকে। যতো কঠিন পরিস্থি,তই আসুক না কেন। আমার বিশ্বাস, ধর্ম এবারও টিকে যাবে, কিয়ার্শের আবিষ্কারটি প্রকাশিত হবার পরও।
আপনার কথা আমি শুনলাম, বন্ধু, অবশেষে বললেন বিশপ। যতোটা সম্ভব কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেন তিনি। আপনার কণ্ঠে যে সমাধানের কথা শুনছি সেটাকে আমি সম্মানও করি। আমি চাই আপনি জানুন, দোদুল্যমনতা থাকা সত্ত্বেও আমি আলোচনা করতে প্রস্তুত আছি। তারপরও আমি আপনাকে অনুরোধ করে বলবো, আপনি যদি এই আবিষ্কারটি দুনিয়ার কাছে প্রকাশ করতে চান তো সেটা আমরা দুজনে মিলেই করবো। দিনের আলোতে। সম্মানের সাথেই। ভয়ঙ্কর একটি গুপ্তহত্যার কারণে ভড়কে গিয়ে নয়। আসুন আমরা পরিকল্পনা করি, ওটা নিয়ে চর্চা করি, তারপর যথাযথভাবে সংবাদটি প্রকাশ করি।
কোভেস কিছুই বললেন না, তবে ভালদেসপিনো বৃদ্ধ মানুষটির শাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলেন।
রাবাই, বিশপ আবারো বললেন, এই মুহূর্তে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ইসু হলো আমাদের দুজনের নিরাপত্তা। আমরা একদল খুনির মোকাবেলা করছি, আপনি যদি খুব বেশি লোকচক্ষুর মধ্যে থাকেন-যেমন, পুলিশের কাছে যাওয়া, টিভিতে গিয়ে এ বিষয়ে কথা বলা-তাহলে এটা হিংসাত্মকভাবেই শেষ হতে পারে। বিশেষ করে আমি আপনাকে নিয়েই বেশি ভয়ে আছি; আমি এই প্যালেস কমপ্লেক্সের ভেতরে সুরক্ষিত আছি, কিন্তু আপনি…আপনি বুদাপেস্টে একেবারেই একা! কিয়ার্শের আবিষ্কারটি যে জীবন-মরণ সমস্যা সেটা পরিষ্কার। দয়া করে আপনার সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে দিন আমাকে, ইয়েহুদা।
কোভেস আবারো চুপ মেরে গেলেন কিছুক্ষণের জন্য। মাদ্রিদ থেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা করবেন? কিভাবে সেটা সম্ভব হতে—
রাজপরিবারের সিকিউরিটি ব্যবহার করার সামর্থ্য আমি রাখি। নিজের বাসায় তালা লাগিয়ে রাখুন। আমি দু-জন গার্ডিয়া রিয়েল এজেন্ট পাঠাচ্ছি। আপনাকে সেখান থেকে মাদ্রিদে নিয়ে আসার জন্য। এখানে চলে এলে আমরা দু-জন নিরাপদে বসে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে পারবো কিভাবে এগিয়ে গেলে সবচেয়ে ভালোটা হয়।
আমি যদি মাদ্রিদে আসি, রাবাই একমত পোষণ করে বললেন, আর তখন যদি কী করবো না করবো তা নিয়ে দু-জন একমত হতে না পারি তখন। কী হবে?
আমরা একমত হবো, আশ্বস্ত করে বললেন তাকে। আমি জানি আমি খুব সেকেলে একজন মানুষ, তবে আমি একই সঙ্গে ভীষণ বাস্তববাদিও বটে। ঠিক আপনার মতোই। আমরা দুজন একসঙ্গে বসে সবচেয়ে সেরা সিদ্ধান্তটাই নিতে পারবো। আমার এতে দৃঢ় বিশ্বাস আছে।
আর আপনার এই বিশ্বাস যদি পাল্টে যায়? কোভেস আরেকটু বাজিয়ে দেখতে চাইলেন।
ভালদেসপিনোর মনে হলো তার পেটটা শক্ত হয়ে এলো, কিন্তু তিনি কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকলেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্তকণ্ঠে জবাব দিলেন, ইয়েহুদা, আমরা দু-জন যদি এই বিষয়টা নিয়ে একমত না হতে পারি তাহলে আমাদের বন্ধুত্বও থাকবে না। তখন আমাদের যার কাছে যেটা ভালো মনে হবে সেটাই করবো। আপনাকে আমি কথা দিলাম।
ধন্যবাদ আপনাকে, জবাবে বললেন কোভেস। আপনার কথায় তাহলে আমি মাদ্রিদে আসছি।
বেশ। তোক্ষণে আপনি আপনার দরজা তালা মেরে রাখুন। কারো সাথে কথা বলবেন না। ব্যাগ-ট্যাগ সব গুছিয়ে রাখুন। সবকিছুর ব্যবস্থা করার পর আপনাকে আমি কল দেবো। ভালদেসপিনো একটু থামলেন। বিশ্বাস রাখুন। খুব শিঘ্রই আপনার সাথে দেখা হচ্ছে।
ফোনটা রেখে দিলেন ভালদেসপিনো। খুব ভয় করছে তার। কোভেসকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে যুক্তি-বুদ্ধির চেয়েও বেশি কিছু লাগে।
কোভেস আতঙ্কের মধ্যে আছে…ঠিক যেমনটি ছিল সাঈদ। তারা দুজনেই পুরো চিত্রটা দেখতে ব্যর্থ।
ভালদেসপিনো তার ল্যাপটপটা বন্ধ করে বগলে নিয়ে নিলেন, পা বাড়ালেন অন্ধকারাচ্ছন্ন স্যাঙ্কচুয়ারির দিকে। এখনও তার পরনে সেরেমোনিয়াল আলখাল্লা, ক্যাথেড্রাল থেকে বের হয়ে বাইরে চলে এলেন তিনি, প্লাজাটা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে লাগলেন সাদা রঙের রাজপ্রসাদের দিকে।
প্রধান প্রবেশদ্বারের উপরে স্প্যানিশ কোট অব আর্মস নামে পরিচিত রাজকীয় ক্রেস্টটি-এমন একটা ক্রেস্ট যার দুদিকে হারকিউলিসের পিলার আর প্রাচীন মন্ত্র PLUS ULTRA লেখা। এর অর্থ, সীমানা পেরিয়ে। অনেকে বিশ্বাস করে, এটা দিয়ে স্পেনের শতবছরব্যাপি সোনালি যুগে যে সাম্রাজ্য বিস্তার করা হয়েছিল সেটাকেই নির্দেশ করে। অন্যেরা বিশ্বাস করে এটা দিয়ে আসলে বোঝানো হয়েছে, দেশটির দীর্ঘদিনের ধর্মবিশ্বাসকে যে, স্বর্গের একটা জীবনের অস্তিত্ব রয়েছে এর পরেই।
যাই হোক না কেন, ভালদেসপিনোর মনে হলো, এই মটোটা প্রতিদিনই কম প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। প্রাসাদের উপরে স্পেনের পাতাকাটা উড়তে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। অসুস্থ রাজার কথা মনে গেছে তার।
উনি চলে গেলে আমি উনাকে ভীষণ মিস করবো। তার কাছে আমার অনেক ঋণ।
কয়েক মাস আগেও, বিশপ প্রায় প্রতিদিনই তার প্রিয় বন্ধুর সাথে দেখা করতে আসতেন। উনি শয্যাশায়ি আছেন শহরের বাইরে পালাসিও দে লা। জারজুয়েলা প্রাসাদে। কয়েক দিন আগে রাজা তাকে ডেকে নিয়ে গেছিলেন তার শয্যার পাশে। তখন তার চোখেমুখে গভীর চিন্তার ছাপ দেখেছিলেন তিনি।
আন্তোনিও, ফিসফিসিয়ে বলেছিলেন রাজা, আমার ভয়ে হচ্ছে আমার ছেলের এনগেজমেন্টটা…খুব তাড়াহুড়ো করে নিচ্ছে।
তাড়াহুড়ো না বলে মাথানষ্ট বলাই বেশি ভালো হবে, ভালদেসপিনো মনে মনে বলেছিলেন।
দু-মাস আগে যুবরাজ ভালদেসপিনোর কাছে স্বীকার করেছিলেন, তিনি অ্যাম্ব্রা ভিদালকে খুব অল্পদিন ধরে চিনলেও তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিতে চাচ্ছেন, কথাটা শুনে হতবুদ্ধিকর হয়ে পড়েছিলেন বিশপ। হুলিয়ানকে তিনি আরো অনুরোধ করে বলেছিন তিনি যেন আরো বেশি বিচক্ষণতার পরিচয় দেন এ বিষয়ে। যুবরাজ তর্ক করে বলেছিলেন তিনি ঐ মহিলার প্রেমে পড়েছেন, আর তার বাবাও চাচ্ছেন তার বিয়েটা দেখে যেতে। তাছাড়া অ্যাম্ব্রার গর্ভে যদি সন্তান পেতে চান তবে মেয়েটার বয়সের কথা বিবেচনায় নিলে আর দেরি করা ঠিক হবে না।
ভালদেসপিনো শান্তভাবে হেসে রাজাকে বলেছিলেন, হ্যাঁ, এটা আমি মানি। ডন হুলিয়ানের এই বিয়ের প্রস্তাবের কথা শুনে আমরা সবাই বেশ চমকে গেছি। তিনি কেবল আপনাকে খুশি করার জন্য এটা করতে চাইছেন।
তার আসল দায়িত্ব হলো এই দেশ, রাজা জোর দিয়ে বলেছিলেন, তার বাবাকে খুশি করা নয়। মিস ভিদাল চমৎকার একজন মহিলা হলেও সে তো আমাদের কাছে একদমই অচেনা। বহিরাগত একজন। সে যে ডন হুলিয়ানের প্রস্তাবটা গ্রহণ করেছে তাতে করে তার উদ্দেশ্য নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে। এটা অনেক বেশি তাড়াহুড়ো করে নিচ্ছে, আত্মসম্মান থাকলে একজন মেয়ের উচিত হবে তার প্রস্তাবটা প্রত্যাখান করা।
আপনার কথা ঠিক, জবাবে বলেছিলেন ভালদেসপিনো। যদিও অ্যাম্ব্রার পক্ষ নিয়ে বলা যেতে পারে, ডন হুলিয়ান মেয়েটাকে রীতিমতো বাধ্যই করেছে।
রাজা আস্তে করে তার দূর্বল হাতটা দিয়ে বিশপের হাত ধরেছিলেন। বন্ধু, আমি জানি না সময় কোথায় চলে গেছে। তোমার আমার বয়স হয়ে গেছে। তোমাকে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই। এতগুলো বছর ধরে তুমি আমাকে বিজ্ঞের মতো উপদেশ দিয়ে গেছে। আমার স্ত্রী-বিয়োগের সময়, আমাদের দেশের পরিবর্তনের সময়, তোমার বিচক্ষণতার কারণে আমি অনেক উপকৃত হয়েছি।
আমাদের বন্ধুত্বটা এমন একটি সম্মানের ব্যাপার যা আমি চিরকাল শ্রদ্ধা জানিয়ে যাবো।
দূর্বল হাসি দিয়েছিলেন রাজা। আন্তোনিও, আমি জানি তুমি আমার সাথে থেকে গিয়ে বিরাট বড় একটা ত্যাগ স্বীকার করেছে। চাইলে তুমি রোমেও যেতে পারতে।
ভালদেসপিনো কাঁধ তুললেন। কার্ডিনাল হলে তো আমি ঈশ্বরের আরো বেশি সন্নিকটে যেতাম না। আমার স্থান এটাই, সব সময়ই আপনার সাথে থাকা।
এতগুলো বছর ধরে আমার প্রতি তোমার এই অনুরাগের কথা কখনও ভুলবো না আমি। রাজা চোখ বন্ধ করে বিশপের হাতটা আরো শক্ত করে ধরলেন। আন্তোনিও…আমি খুব চিন্তায় আছি। আমার ছেলে খুব জলদি বিশাল বড় একটা জাহাজের হাল ধরবে, কিন্তু এই জাহাজ চালানোর জন্যে সে পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। দয়া করে তাকে গাইড করো। তার দিশা হও। তোমার সুদৃঢ় হাতটা রাখো তার হাল ধরা হাতের পাশে, বিশেষ করে উত্তাল সাগর যখন পাড়ি দেবে। আমি আরো চাইবো, সে যখন পথ হারাবে, তুমি যেন দয়া করে তাকে পথের দিশা খুঁজে দিতে সাহায্য করো…বিশুদ্ধতার পথে নিয়ে এসো আবার।
আমেন, বিশপ বিড়বিড় করে বলেছিলেন। আমি আপনাকে আমার কথা দিচ্ছি।
এখন রাতের এই ঠাণ্ডা বাতাসে, প্লাজা পেরিয়ে প্রাসাদে ঢোকার পথে ভালদেসপিনো আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। ইওর ম্যাজেস্টি, দয়া করে জেনে নিন, আমি সবই করছি আপনার শেষ ইচ্ছাকে সম্মান জানানোর জন্য।
এই ভেবে ভালদেসপিনো একটু স্বস্তি পেলেন যে, রাজা বর্তমানে এতটাই অসুস্থ যে তার পক্ষে টিভি দেখা সম্ভবপর নয়। বিলবাও থেকে প্রচারিত আজকের অনুষ্ঠানটি যদি তিনি দেখতেন, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যুবরণ করতেন তার দেশ আজ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে এটা দেখতে পেয়ে।
ভালদেসপিনোর ডানদিকে, লোহার দরজার ওপাশে, কতোগুলো মিডিয়া ট্রাক এসে জড়ো হয়েছে, স্যাটেলাইট টাওয়ার বসানোর কাজ করছে তারা।
শকুনের দল, ভালদেসপিনো ভাবলেন। রাতের বাতাসে তার আলখাল্লাটা উড়ছে।
.
অধ্যায় ২৫
শোক করার সময় পাওয়া যাবে, ল্যাংডন নিজেকে সুধালো, তীব্র আবেগের সাথে লড়াই করছে সে। এখন সময় অ্যাকশনের।
ল্যাংডন এরইমধ্যে উইনস্টনকে বলে দিয়েছে জাদুঘরের সিকিউরিটি ক্যামেরা থেকে সম্ভাব্য খুনি সম্পর্কে কোন কিছু পাওয়া যায় কিনা সেটা খতিয়ে। দেখতে। এরপর সে আস্তে করে বলেছে, উইনস্টন যেন বিশপ ভালদেসপিনো আর আভিলার মধ্যে কোন কানেকশান আছে কিনা সেটাও খুঁজে দেখে।
এজেন্ট ফনসেকা এখন ফিরে এসেছে, এখনও তার কানে ফোন ধরা। সি…সি, সে বলেই যাচ্ছে। ক্লারো। ইমিদিয়াতেমেন্তে। ফোনকল শেষ করে অ্যাম্ৰার দিকে ফিরলো। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে মহিলা। তাকে দেখে হতবিহ্বল দেখাচ্ছে।
মিস ভিদাল, আমরা চলে যাচ্ছি, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল ফনসেকা। ডন হুলিয়ান চাচ্ছেন আমরা যেন আপনার নিরাপত্তার জন্য আপনাকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাই।
স্পষ্টত বোঝা গেল অ্যাম্ব্রার শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেল এ কথা শুনে। এডমন্ডকে এভাবে ফেলে রেখে আমি কোথাও যাচ্ছি না! কম্বলে ঢাকা। লাশটার দিকে ইঙ্গিত করলো সে।
লোকাল পুলিশ এটা দেখবে, জবাবে বলল ফনসেকা। কোরোনার এখনই চলে আসবেন। মি. কিয়ার্শকে সম্মানের সাথেই যা করার করা হবে। এ মুহূর্তে আমাদেরকে চলে যেতে হবে। আমাদের আশঙ্কা আপনি বিপদের মধ্যে আছেন।
আমি একদমই বিপদের মধ্যে নেই! এজেন্টের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল অ্যাম্ব্রা। এক ঘাতক একটু আগেই আমাকে খুন করার দারুণ সুযোগ পেয়েছিল কিন্তু সে তা করেনি। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে তার টার্গেট ছিল এডমন্ড!
মিস ভিদাল! ফনসেকার ঘাড়ের রগগুলো ফুলে উঠলো। যুবরাজ হেন আপনাকে ওখানে নিয়ে যেতে। উনি আপনার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।
না, পাল্টা বলল মহিলা। ও আসলে রাজনৈতিক বিপর্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন।
ফনসেকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কণ্ঠটা নামিয়ে ফেলল। মিস ভিদাল, আজ যা রয়েছে সেটা স্পেনের জন্য খুবই মারাত্মক একটি ঘটনা। এটা যুবরাজের জন্যও খুবই বিরাট বড় একটি সমস্যা হয়ে গেছে। আজকের অনুষ্ঠানটি যে আপনি উপস্থাপনা করেছেন সেটা খুবই দুভার্গ্যজনক একটি সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে।
আচমকা উইনস্টনের কণ্ঠটা শোনা গেল ল্যাংডনের হেডসেটে। প্রফেসর? বাইরের ক্যামেরাগুলোর ফিড পরীক্ষা করে দেখেছে জাদুঘরের সিকিউরিটি টিম। মনে হচ্ছে তারা কিছু একটা পেয়েছে।
পুরো কথাটা শোনার পর ফনসেকার উদ্দেশে হাত নাড়লো ল্যাংডন। কম্পিউটার বলছে, জাদুঘরের ছাদের উপরে বসানো একটি ক্যামেরায় খুনি যে গাড়িতে করে পালিয়ে গেছে সেটার আংশিক ছবি পাওয়া গেছে।
তাই নাকি? ফনসেকাকে খুবই অবাক হতে দেখা গেল।
উইনস্টন কী বলেছে সেটা তাকে জানিয়ে দিলো ল্যাংডন। কালো রঙের একটি সিডান সার্ভিস অ্যালি দিয়ে পালিয়ে গেছে…ঐ অ্যাঙ্গেল থেকে লাইসেন্স প্লেট নাম্বারটা দেখা যায়নি অবশ্য…তবে গাড়িতে একটি অন্যরকম স্টিকার লাগানো ছিল।
কিসের স্টিকার? জানতে চাইলো ফনসেকা। আমরা স্থানীয় পুলিশকে এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে বলতে পারি।
স্টিকারটি, ল্যাংডনের হেডসেটে বলে উঠলো উইনস্টন, আমি চিনতে পারিনি, তবে ওটাকে আমি এ বিশ্বের প্রায় সব পরিচিত সিম্বলের সাথে মিলিয়ে দেখার পর একটাই ম্যাচ পেয়েছি।
উইনস্টন কতো দ্রুত এসব করতে পারছে দেখে বিস্মিত হলো প্রফেসর।
আমার কাছে যে ম্যাচটি আছে সেটা, উইনস্টন বলল, প্রাচীন অ্যালকেমিক্যাল সিম্বল-আমালগামেশন।
কী বললে? ল্যাংডন আশা করেছিল কোন পাকিং গ্যারাজ কিংবা রাজনৈতিক সংগঠনের স্টিকার হবে বুঝি। ঐ গাড়িতে…আমালগামেশন-এর সিম্বল লাগানো ছিল?
ফনসেকা তার কথা শুনে কিছুই বুঝতে পারলো না।
কিছু একটা ভুল হয়ে গেছে, উইনস্টন, বলল রবার্ট ল্যাংডন। অ্যালকেমিক্যাল প্রসেসের সিম্বল কেন কেউ এভাবে দেখাতে যাবে?
আমি জানি না, জবাব দিলো উইনস্টন। আমি শুধু এই একটা ম্যাচই বের করতে পেরেছি। প্রায় নিরাব্বই শতাংশ মিলে গেছে।
ল্যাংডনের তুখোড় মস্তিষ্ক আমালগামেশন-এর সিম্বলটি ভিজুয়ালাইজ করতে পারলো।
উইনস্টন, গাড়িতে তুমি কী দেখেছো সেটার বিবরণ দাও আমাকে।
সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটার জবাব দিলো। এই সিম্বলে একটি খাদ্র রেখা আছে, তাতে আছে তিনটি আড়াআড়ি রেখা। খাড়া রেখাঁটির উপরে উল্টো করে একটি খিলান বসানো আছে।
একদম ঠিকঠিক মিলে গেছে। ল্যাংডনের ভুরু কপালে উঠে গেল। উপরের সেই খিলানের কি ক্যাপস্টোন আছে?
হ্যাঁ। দুই বাহুর উপরে বসানো আছে ছোট্ট দুটো রেখা।
ওকে, তাহলে এটা আমালগামেশনই।
কয়েক মুহূর্তের জন্য ল্যাংডন হতবিহ্বল হয়ে রইলো। উইনস্টন, তুমি কি ঐ সিম্বলটার ছবি আমাদেরকে দেখাতে পারবে?
অবশ্যই।
তাহলে ওটা আমার ফোনে পাঠিয়ে দিতে বলেন, ফনসেকা জোর দিয়ে বলল।
এজেন্টের সেলনাম্বারটা উইনস্টনকে জানিয়ে দিলো ল্যাংডন। কিছুক্ষণ পরই ফনসেকার ফোনে বিপ হলো একটা। তারা সবাই ফোনের ডিসপ্লে দেখার জন্য এজেন্টের কাছে জড়ো হলো, দেখতে পেলো কম রেজুলুশনের একটি সাদা-কালো ছবি। সার্ভিস অ্যালি দিয়ে পালিয়ে যাবার সময় ছাদের উপর থেকে তোলা হয়েছে এটা।
গাড়ির উইন্ডশিল্ডের নিচে, বামদিকে স্টিকারটি লাগানো।
আমালগামেশন। কী অদ্ভুত।
হতভম্ব ল্যাংডন ফনসেকার ফোনের ডিসপ্লের উপরে আঙুল রেখে ছবিটা বড় করে দেখলো। একটু ঝুঁকে ইমেজটার আরো ডিটেইল দেখে নিলো সে।
সঙ্গে সঙ্গেই ল্যাংডন সমস্যাটা ধরতে পারলো। এটা আমালগামেশন না, ঘোষণা দেবার সুরে বলল সিম্বলজির প্রফেসর।
যদিও উইনস্টন যে বিবরণ দিয়েছে এই ইমেজটা তার প্রায় কাছাকছি, কিন্তু হুবহু এক নয়। সিম্বলজিতে কাছাকাছি আর হুবহুর মধ্যে যে পার্থক্য সেটা নাৎসিদের সোয়াস্তিকা আর বৌদ্ধধর্মের আত্মোন্নয়ের প্রতাঁকের মধ্যেকার পার্থক্যের মতোই।
এজন্যে কখনও কখনও মানুষের মস্তিষ্ক কম্পিউটারের চেয়ে ভালো।
এটা সেই স্টিকার না, ল্যাংডন আবারো বলল কথাটা। এটাকে দুটো ভিন্ন স্টিকারের সমন্বয় বলা যেতে পারে। নিচের স্টিকারটি বিশেষ ধরণের একটি ক্রুশিফিক্স-এটাকে বলে পাপাল ক্রশ। এটা এখন খুবই জনপ্রিয়।
ভ্যাটিকানের ইতিহাসে সবচাইতে উদারপন্থি পোপ নির্বাচিত হবার পর থেকে এ বিশ্বের হাজার হাজার মানুষ পোপের নতুন পলিসির পক্ষে সমর্থন প্রদর্শন করার জন্য এই ট্রিপল ক্রশ দেখিয়ে থাকে। এমনকি সেটা ল্যাংডনের নিজের এলাকা ম্যাসাচুসেটসের ক্যামব্রিজেও।
আর উপরে U-আকৃতির সিম্বলটা, বলল প্রফেসর, ওটা একেবারেই আলাদা একটি স্টিকার।
এখন বুঝতে পারছি আপনার কথাই ঠিক, উইনস্টন বলল। আমি ঐ কোম্পানির ফোন নাম্বার জোগার করে দিচ্ছি আপনাকে।
আবারো ল্যাংডন বিস্মিত হলো উইনস্টনের দুর্দান্ত গতি দেখে। সে এরইমধ্যে কোম্পানির লোগোটাও চিনে ফেলেছে? দারুণ, বলল ল্যাংডন। আমরা তাদেরকে বললে তারা গাড়িটা ট্র্যাক করতে পারবে।
ফনসেকাকে বেশ হতবুদ্ধিকর দেখালো। গাড়িটাকে ট্র্যাক করা হবে! কিভাবে?
খুনি যে গাড়িতে করে পালিয়ে গেছে সেটা, উইন্ডশিল্ডের উপরে U-এর দিকে ইঙ্গিত করলো সে, উবারের গাড়ি।
.
অধ্যায় ২৬
এজেন্ট ফনসেকার বিস্মিত চোখদুটো দেখে ল্যাংডন বুঝতে পারলো না কোনটা বেশি তাকে অবাক করেছে : দ্রুততার সাথে উইন্ডশিল্ড স্টিকারের পরিচয় বের করা নাকি পালানোর জন্য অ্যাডমিরাল আভিলা যে এরকম একটি কোম্পানির গাড়ি ব্যবহার করেছে সেটা।
সে একটা উবার ভাড়া করেছে, ল্যাংডন ভাবলো। অবাক হলো খুব, এরকম কাজ করে খুনি দারুণ কোন চালাকি করেছে নাকি অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে বুঝতে পারছে না।
বিগত কয়েক বছর ধরে উবার নামের এই গাড়ি-সার্ভিসটি দুনিয়াব্যাপি ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। স্মার্টফোনের মাধ্যমে যে কেউ উবার থেকে গাড়ি ভাড়া করতে পারে। এর ড্রাইভাররা নিজেরাই গাড়ির মালিক, বাড়তি আয়ের জন্য টাকার বিনিময়ে লিফট দিয়ে থাকে। স্পেনে এটা কয়েকদিন আগে লাইসেন্স পেয়েছে। স্পেনে উবার ড্রাইভারদের গাড়ির উইন্ডশিল্ডে U লোগোটা লাগিয়ে নিতে হয়। বোঝাই যাচ্ছে, যে গাড়িতে করে খুনি পালিয়েছে তার ড্রাইভার নতুন পোপেরও ভক্ত।
এজেন্ট ফনসেকা, ল্যাংডন বলল। উইনস্টন বলছে সে নিজের উদ্যোগেই এ গাড়িটার ছবি স্থানীয় পুলিশকে পাঠিয়ে দিয়েছে পথেঘাটে রোডব্লক বসিয়ে চেক করার সুবিধার্থে।
ফনসেকার মুখ হা হয়ে গেল। ল্যাংডনের কাছে মনে হলো, লোকটা বুঝতে পারছে না সে উইনস্টনকে এজন্যে ধন্যবাদ দেবে নাকি বলবে, নিজের চরকায় তেল দাও। তোমাকে এটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
এখন সে উবারের ইমার্জেন্সি নাম্বারে ডায়াল করছে।
না! আদেশের সুরে বলল ফনসেকা। আমাকে নাম্বারটা দিন। আমি নিজে ফোন করবো। একটা কম্পিউটারের অনুরোধের চেয়ে উবার নিশ্চয় রয়্যাল গার্ডের সিনিয়র কোন সদস্যের কথা বেশি গুরুত্ব দিয়ে শুনবে; সহযোগিতা করবে।
ল্যাংডনকে মানতেই হলো, ফনসেকার কথাই সম্ভবত ঠিক। তাছাড়া, অ্যাসোকে মাদ্রিদে নিয়ে যাওয়ার কাজে গার্ডিয়া রিয়াল তাদের দক্ষতা অপচয় না করে যদি খুনিকে ধরার কাজে নিয়োজিত থাকে তাহলেই বরং বেশি ভালো হয়।
উইনস্টনের কাছ থেকে নাম্বারটা নিয়ে ফনসেকাকে দিলো ল্যাংডন। সে। সঙ্গে সঙ্গে কল করলো সেই নাম্বারে। ল্যাংডনের মনে হচ্ছে, খুব দ্রুতই খুনিকে ধরা সম্ভব হবে এভাবে। যানবাহনের অবস্থান আর গতিবিধি খুঁজে বের করাটাই উবারের মূল কাজ। স্মার্টফোনের সাহায্যে যেকোন কাস্টমারই পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে থাকা উবার ড্রাইভারের সঠিক লোকেশন খুঁজে বের করতে পারে। ফনসেকাকে শুধু কোম্পানিকে অনুরোধ করে বলতে হবে, একটু আগে গুগেনহাইম মিউজিয়ামের পেছনে যে গাড়িটা যাত্রি তুলে নিয়ে গেছে সেটা এখন কোথায় আছে।
অস্তা! ফনসেকা আক্ষেপে বলে উঠলো। অতো মাতিজাদা। ফোনের কিবোর্ডে একটা নাম্বার প্রেস করে অপেক্ষা করলো সে। বোঝাই যাচ্ছে, মেনু অপশনের একটি অটোমেটেড লিস্টের নাম্বারে ডায়াল করেছে সে। প্রফেসর, উবারকে দিয়ে ঐ গাড়িটা ট্রেস করার পর আমি পুরো ব্যাপারটার দায়িত্ব স্থানীয় পুলিশের কাছে তুলে দেবো, যাতে করে এজেন্ট ডিয়াজ আর আমি মিস ভিদাল এবং আপনাকে নিয়ে মাদ্রিদে চলে যেতে পারি।
আমাকে? চমকে উঠলো ল্যাংডন। না, আমি আপনাদের সাথে যেতে পারবো না।
আপনি পারবেন, আপনাকে পারতেই হবে, ফনসেকা জোর দিয়ে বলল। যেমনটা যাবে আপনার ঐ কম্পিউটার খেলনাটা, ল্যাংডনের হেডসেটের দিকে ইঙ্গিত করলো সে।
আমি দুঃখিত, শক্ত কণ্ঠে বলল ল্যাংডন। আপনাদের সাথে মাদ্রিদে যাবার প্রশ্নই ওঠে না।
এটা তো অদ্ভুত, ফনসেকা জবাবে বলল। আমি ভেবেছিলাম আপনি হারভার্ডের একজন প্রফেসর?
অবাক হলো ল্যাংডন। আমি তো তা-ই।
বেশ, চট করে বলল এজেন্ট। তাহলে আমি ধরে নিচ্ছি, এছাড়া যে আর কোন উপায় নেই সেটা বোঝার মতো যথেষ্ট স্মার্ট আপনি।
এ কথা বলে এজেন্ট তার ফোনটা কানে নিয়ে একটু দূরে চলে গেল। তার দিকে চেয়ে রইলো ল্যাংডন। হচ্ছেটা কী?
প্রফেসর? ল্যাংডনের খুব কাছে এসে অ্যাম্ব্রা ফিসফিসিয়ে বলল। আমার কথা ভালো করে শুনুন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ল্যাংডন ঘুরেই দেখতে পেলো অ্যাম্ব্রার চোখেমুখে সুতীব্র ভীতি। চমকে উঠলো সে। প্রাথমিক শক কাটিয়ে উঠেছে মহিলা। তার কণ্ঠ এখন মরিয়া আর একদম পরিষ্কার।
প্রফেসর, সে আবারো বলল, এই প্রেজেন্টেশনে আপনার ভিডিও দেখিয়ে এডমন্ড আপনার প্রতি তার শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছে। এ কারণে, আমি আপনাকে বিশ্বাস করবো। আপনাকে আমার কিছু কথা বলা দরকার।
কী বলবে বুঝতে না পেরে মহিলার দিকে তাকালো ল্যাংডন।
এডমন্ড খুন হয়েছে আমার দোষে, নিচুকণ্ঠে বলল সে। তার ঘন বাদামি চোখদুটো ছলছল করে উঠলো।
কী বললেন?
অ্যাম্ৰা নার্ভাস ভঙ্গিতে তাকালো ফনসেকার দিকে, সে এখন বেশ দূরে আছে। তাদের কথাবার্তা তার কানে যাবে না। অতিথিদের তালিকায়, ল্যাংডনের দিকে ফিরে সে বলল, শেষ মুহূর্তে যে নামটা যোগ করা হয়েছে। সেটা আমিই যোগ করেছি। মেয়েটার কণ্ঠ ধরে আসলো। আমিই করেছি!
উইনস্টন ঠিকই বলেছিল…অবাক হয়ে ভাবলো ল্যাংডন।
আমার কারণেই এডমন্ড খুন হয়েছে, প্রায় কান্না করে দেবার পর্যায়ে চলে এসেছে মহিলা। এই ভবনের ভেতরে আমি তাকে খুন হতে দিয়েছি।
দাঁড়ান, বলল ল্যাংডন, কম্পিত মহিলার কাঁধে তার হাতটা রাখলো। আমাকে বলুন। আপনি কেন এই নামটা যোগ করেছিলেন?
আরেকবার উদ্বিগ্ন চোখে ফনসেকার দিকে তাকালো অ্যাম্ব্রা। বিশগজ দূরে এখনও ফোনে কথা বলে যাচ্ছে সে। প্রফেসর, শেষ মুহূর্তে এমন একজন আমাকে এই নামটি যোগ করার জন্য অনুরোধ করে, যাকে আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি। তার অনুরোধেই আমি এটা করেছি। অনুষ্ঠানের জন্য এই জাদুঘরের দরজা খোলার ঠিক আগে দিয়ে অনুরোধটা করা হয়। আমি খুবই ব্যস্ত ছিলাম তখন, সে-কারণে অতো ভাবনা-চিন্তা না করে নামটা যোগ করি তালিকায়। বুঝতে পারছেন, লোকটা নেভির একজন অ্যাডমিরাল ছিল! আমি কী করে বুঝবো, তার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব? আবারো এডমন্ডের লাশের দিকে তাকিয়ে মুখে হাতচাপা দিলো সে। আর এখন…।
অ্যাম্রা, ল্যাংডন নিচুকণ্ঠে বলল। কে আপনাকে বলেছিল আভিলার নামটা যোগ করার জন্য?
বহুকষ্টে ঢোক গিলল অ্যাম্ব্রা। আমার ফিয়ান্সে…স্পেনের পরবর্তি রাজা যুবরাজ ডন হুলিয়ান।
অবিশ্বাসে মহিলার দিকে চেয়ে রইলো ল্যাংডন। কথাটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে তার। গুগেনহাইমের ডিরেক্টর দাবি করছে, এডমন্ড কিয়ার্শকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের সাথে স্পেনের পরবর্তি রাজা সরাসরি জড়িত। এটা অসম্ভব!
আমি নিশ্চিত, রাজপ্রাসাদ কখনও আশা করেনি আমি খুনির পরিচয় জানতে পারবো, বলল সে। কিন্তু এখন জেনে গেছি আমি…আমার ভয় হচ্ছে, আমি বিপদে পড়ে গেছি।
তার কাঁধে আবারো হাত রাখলো ল্যাংডন। আপনি এখানে একদম নিরাপদে আছেন।
না, জোর করে নিচুকণ্ঠে বলল সে, এখানে আরো কিছু ব্যাপার আছে। আপনি সেসবের কিছুই জানেন না। আপনাকে এবং আমাকে এখান থেকে বের হতে হবে। এক্ষুণি!
আমরা পালাতে পারবো না, বোঝানোর চেষ্টা করলো প্রফেসর। তাহলে আমরা কখনও-
আমার কথা ভালো করে শুনুন, প্লিজ, তাড়া দিয়ে বলল সে। কিভাবে এডমন্ডকে সাহায্য করতে হবে সেটা আমি জানি।
কী বললেন? ল্যাংডনের মনে হচ্ছে মহিলা এখনও শকটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এডমন্ডকে সাহায্য করার মতো কিছু নেই এখন।
আছে, জোর দিয়ে কিন্তু পরিষ্কার কণ্ঠে বলল মহিলা। তবে সবার আগে আমাদেরকে এখান থেকে বের হয়ে বার্সেলোনায় তার বাড়িতে যেতে হবে।
আপনি এসব কী বলছেন?
দয়া করে আমার কথাটা শুনুন। আমি জানি এডমন্ড এটাই চাইতো আমাদের কাছ থেকে।
পরবর্তি পনেরো সেকেন্ড বেশ নিচুকণ্ঠে ল্যাংডনের সাথে কথা বলল অ্যাম্ৰা ভিদাল। মহিলার কথা শুনে ল্যাংডনের হৃদস্পন্দন দ্রুত বেড়ে গেল। হায় ঈশ্বর,
ভাবলো সে। তার কথা তো ঠিক। এটা সবকিছু বদলে দেবে।
কথা শেষ হবার পর অ্যাম্ৰা তার দিকে তাকালো ক্ষোভের সঙ্গে। এখন কি আপনি বুঝতে পেরেছেন কেন আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়া দরকার?
কোন রকম দ্বিধা না করে মাথা নেড়ে সায় দিলো ল্যাংডন। উইনস্টন, হেডসেটে কথা বলল সে। তুমি কি শুনেছো অ্যাম্ব্রা আমাকে কী বলেছেন?
শুনেছি, প্রফেসর।
তুমি কি এ ব্যাপারে কিছু জানতে?
না।
পরের কথাটা খুব সতর্কতার সাথে বলল ল্যাংডন। উইনস্টন, আমি জানি না কম্পিউটারের কোন আনুগত্য আছে কিনা তার স্রষ্টার প্রতি, যদি সেরকম কিছু তোমার মধ্যে থেকে থাকে তো সেই আনুগত্য দেখানোর সময় এখনই। আমরা কি আসলেই তোমার সাহায্য কাজে লাগাতে পারবো?
.
অধ্যায় ২৭
পোডিয়ামের দিকে এগিয়ে যাবার সময় ফনসেকার দিকে চোখ রাখলো ল্যাংডন, সে এখনও উবারের সাথে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত। সে অ্যাম্ব্রাকে দেখতে পাচ্ছে ডোমের মাঝখানে চলে যাচ্ছে ফোনে কথা বলার ভান করতে করতে-ঠিক যেমনটা ল্যাংডন তাকে করতে বলেছিল।
ফনসেকাকে বলুন, আপনি যুবরাজ হুলিয়ানকে কল করবেন।
পোডিয়ামের কাছে পৌঁছাতেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেঝেতে পড়ে থাকা এডমন্ডের লাশের দিকে চোখ গেল তার। আস্তে করে লাশের উপর থেকে কম্বলটা সরালো সে। এক সময় এডমন্ডের উজ্জ্বল চোখ এখন নিষ্প্রাণ, আর সেই দুচোখের মাঝখানে বুলেটের লাল গর্ত। ভয়ঙ্কর দৃশ্যটি দেখে আৎকে উঠলো সে। বন্ধু হারনোর শোক আর ক্ষোভের কারণে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। তার।
ল্যাংডনের চোখে ভেসে উঠলো এলোমেলো ঝাকড়া চুলের এক মেধাবি ছাত্র ঢুকছে তার ক্লাসে-সংক্ষিপ্ত সময়ে অনেক বড় বড় কাজ করে ফেলেছিল তার এই সাবেক ছাত্রটি। আর আজ, এই প্রতিভাবান মানুষটির বিশাল একটি আবিষ্কার চিরতরের জন্য মাটিচাপা দিতে কেউ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
আমি যদি সাহসি কোন পদক্ষেপ না নেই, ল্যাংডন জানে, আমার ছাত্রের সবচাইতে বড় অর্জনটি কখনও দিনের আলোর মুখ দেখবে না।
নিজেকে পোডিয়ামের আড়ালে নিয়ে গেল সে, যাতে করে দূর থেকে ফনসেকার দৃষ্টিতে না পড়ে। এডমন্ডের লাশের পাশে হাটু গেড়ে বসলো ল্যাংডন, চোখ বন্ধ করে দু-হাত ভাজ করে প্রার্থনা করার একটি ভঙ্গি করলো সে।
একজন নাস্তিকের জন্য এভাবে প্রার্থনা করাটা যে কতো বড় পরিহাসের ব্যাপার সে-কথা ভেবে প্রায় হেসেই ফেলেছিল ল্যাংডন। এডমন্ড, আমি জানি। তোমাদের মতো মানুষেরা চায় না তাদের জন্য কেউ প্রার্থনা করুক। চিন্তা কোরো না, বন্ধু…আমি এখানে সত্যি সত্যি প্রার্থনা করছি না।
এডমন্ডের সামনে এভাবে বসে থাকার সময় নিজের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ভীতিটা টের পেলো সে। আমি তোমাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলাম, বিশপ তোমার কোন ক্ষতি করবে না। যদি দেখা যায়, ভালদেসপিনো এই ঘটনায় জড়িত …মাথা থেকে জোর করে এই ভাবনাটা সরিয়ে দিলো ল্যাংডন।
যখন সে নিশ্চিত হলো ফনসেকা তাকে প্রার্থনারত অবস্থায় দেখেছে, ল্যাংডন খুব সাবধানে এডমন্ডের জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে তার বিশাল আকারের ফোনটা বের করে নিলো।
ফনসেকার দিকে আবারো তাকালো, সে এখনও ফোনেই ব্যস্ত আছে। তাকে দেখে মনে হলো ল্যাংডনের ব্যাপারে তার আগ্রহ নেই খুব একটা, যতোটা আগ্রহ তার অ্যাম্রার ব্যাপারে। মহিলা এখন ফোনে কথা বলার ভান। করতে করতে ফনসেকা থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যাবার চেষ্টা করছে।
এডমন্ডের ফোনের দিকে তাকালো ল্যাংডন, আস্তে করে দম নিয়ে নিলো সে।
আরেকটা কাজ করতে হবে।
এডমন্ডের ডান হাতটা একটু উপরে তুলল সে। এরইমধ্যে বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে ওর শরীর। ফোনটার ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডিস্কের উপরে তার মৃত বুড়ো আঙুলের ছাপ নিয়ে নিলো এবার।
ক্লিক করে শব্দ হতেই ফোনটা আনলক হয়ে গেল।
দ্রুত সেটিং মেনুতে গিয়ে পাসওয়ার্ড প্রটেকশনটা বন্ধ করে দিলো ল্যাংডন। স্থায়ীভাবেই আনলক এখন। এরপর দ্রুত ফোনটা নিজের জ্যাকেটে ঢুকিয়ে কম্বল দিয়ে আবারো এডমন্ডের লাশটা ঢেকে দিলো।
*
ফাঁকা অডিটোরিয়ামের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কানে ফোন চেপে কথা বলার ভান করছে অ্যাম্রা, দূর থেকে ভেসে আসা সাইরেনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। দেখতে পেলো দূর থেকে তার উপরে চোখ রাখছে এজেন্ট ফনসেকা।
জলদি করুন, রবার্ট।
এক মিনিট আগে, অ্যাম্ব্রা যখন তাকে জানায় কিছুদিন আগে এডমন্ড কিয়ার্শের সাথে তার কী কথা হয়েছিল, তারপরই প্রফেসর দ্রুত কাজে নেমে। পড়ে। ল্যাংডনকে সে বলেছে, দুই রাত আগে ঠিক এই ঘরেই তারা দুজন। যখন আজকের প্রেজেন্টেশনটা নিয়ে শেষ মুহূর্তের কাজ করছিল তখন কাজের ফাঁকে ব্রেক নেবার সময় এডমন্ডকে তৃতীয়বারের মতো স্পিনাচ খেতে দেখার সময় বেশ ক্লান্ত দেখতে পায় অ্যাম্রা।
আমাকে বলতেই হচ্ছে, এডমন্ড, বলেছিল সে, এই নিরামিষী জিনিস তোমার বেলায় তেমন একটা কাজ করছে না। তোমাকে ফ্যাকাশে আর খুব রোগাটে দেখাচ্ছে।
রোগাটে? হেসে উঠেছিল সে। এ কথা কে বলছে দেখো।
আমি অতোটা রোগাটে না!
প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছো। চোখ টিপে বলেছিল এডমন্ড। আমাকে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেন সেটা বলি। আমি একজন কম্পিউটার গিক, যে কিনা সাদিন বসে থাকে এলসিডি মনিটরের সামনে।
দু-দিন পর তুমি সারা দুনিয়ার উদ্দেশে বক্তৃতা দেবে, গায়ের রঙটা একটু পোড়ালে ভালো দেখাবে। হয় আগামিকাল বাইরে থেকে ঘুরে আসো নয়তো এমন একটা কম্পিউটারের পর্দা আবিষ্কার করো যেটা তোমার গায়ের রঙকে কিছুটা ট্যান করতে পারবে।
আইডিয়াটা কিন্তু খারাপ না, মুগ্ধ হয়েই বলেছিল সে। তাহলে ঐ জিনিসটার প্যাটেন্ট তোমার নামেই দেয়া উচিত হবে। কথাটা বলে সে হেসে ফেলার পরই মনোযোগ দেয় হাতের কাজটার দিকে। তাহলে শনিবার রাতের ইভেন্টটার কখন কি হবে সে ব্যাপারে তুমি বুঝে নিয়েছো?
স্ক্রিপ্টের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল অ্যাম্ব্রা। বাইরের ঘরে আমি অতিথিদেরকে স্বাগত জানাবো, তারপর তাদেরকে নিয়ে আসবো এই অডিটোরিয়ামে ভিডিওটা দেখানোর জন্য। ওটা শেষ হলেই নাটকিয়ভাবে তুমি হাজির হবে পোডিয়ামের সামনে। ঘরের সামনের অংশটার দিকে হাত তুলে দেখালো সে। এরপরই পোডিয়াম থেকে তুমি তোমার ঘোষণাটা দেবে।
একদম ঠিক, বলেছিল এডমন্ড, ছোট্ট একটা বাড়তি জিনিসও আছে। তার মুখে ছিল হাসি। আমি যখন কথা বলা শুরু করবো সেটা হবে অনেকটা ইন্টারমিশনের মতো-আমার অতিথিদেরকে স্বশরীরে স্বাগত জানানোর একটা সুযোগ আর কি। সবাই যেন তাদের হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে নেয় আমার। আসল প্রেজেন্টেশনের আগে-একটা মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশন হবে ওটা, ওভাবেই আমি আমার আবিষ্কারের কথাটা ব্যাখ্যা করবো সবার কাছে।
তাহলে শুরুর ঘোষণাটাও কি রেকর্ড করা থাকবে আগে থেকে? ভূমিকার মতো?
হ্যাঁ, কয়েকদিন আগেই ওটা আমি করে রেখেছি। আমরা ভিজুয়াল কালচারে বাস করছি-পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে যেকোন বিজ্ঞানীর কথা বলার চেয়ে মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশন অনেক বেশি আকর্ষনীয় হয়ে থাকে।
তুমি কিন্তু যেকোন বিজ্ঞানী নও, বলে অ্যাম্ৰা, তবে আমি স্বীকার করছি, এটা দেখার জন্য মুখিয়ে আছি আমি।
অ্যাম্ব্রা জানে, নিরাপত্তার স্বার্থেই এডমন্ড তার প্রেজেন্টেশনটা একেবারে নিজস্ব আর বিশ্বস্ত কোন অফসাইট সার্ভারে স্টোর করে রেখেছে। কোন একটা জায়গা থেকে সবকিছু এই জাদুঘরে প্রজেকশনের মাধ্যমে লাইভ সম্প্রচার করার কথা।
আমরা যখন সেকেন্ড-হাফের জন্য প্রস্তুত হবো, সে জানতে চেয়েছিল, প্রেজেন্টেশনটা কে অ্যাক্টিভ করবে, তুমি নাকি আমি?
এটা আমি নিজেই করবো, তার ফোনটা বের করে বলেছিল কিয়ার্শ। এটা দিয়ে। বিশাল আকারের স্মার্ট ফোনটা তুলে ধরেছিল সে। এটা আমাদের শোয়ের একটা অংশ। এখান থেকে বহু দূরে রাখা আমার একটি সাভার আছে, একটা এনক্রিপেটড কানেকশানে এটা দিয়ে ডায়াল করলেই হয়ে যাবে…আর কিছু করতে হবে না।
এডমন্ড তার ফোনের কিছু বাটন চাপলে স্পিকারফোনটা বেজে ওঠে একবার। তারপরই কানেকশন পেয়ে যায়।
একটা কম্পিউটারাইজড নারীকণ্ঠ জবাব দেয় তখন : গুড ইভনিং, এডমন্ড। আমি তোমার পাসওয়ার্ডের জন্য অপেক্ষা করছি।
হেসে ফেলেছিল এডমন্ড। আমি আমার ফোনে একটা পাসওয়ার্ড টাইপ করার পরই এখানে এই অডিটোরিয়াম এবং সারাবিশ্বে লাইভ সম্প্রচার শুরু হয়ে যাবে আমার আবিষ্কারের কথাটা।
খুবই নাটকিয় বলে মনে হচ্ছে, মুগ্ধ হয়ে বলেছিল অ্যাম্ৰা। যদি না তুমি তোমার পাসওয়ার্ডটা ভুলে যাও।
সেটা হবে খুবই বাজে ব্যাপার। আমার বিশ্বাস তুমি ওটা লিখে রেখেছো? মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল অ্যাম্ব্রা।
ব্লাসফেমি, হাসতে হাসতে বলেছিল এডমন্ড। কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা কখনও পাসওয়ার্ড লিখে রাখে না। চিন্তা কোরো না। আমারটা মাত্র সাতচল্লিশ ক্যারেক্টারের..আমি নিশ্চিত ওটা ভুলবো না।
অ্যাম্ব্রার চোখদুটো গোল গোল হয়ে গেছিল। সাতচল্লিশটা?! এডমন্ড, তুমি তো তোমার মিউজিয়াম সিকিউরিটি কার্ডের চার ডিজিটের পিন নাম্বারটাই মনে রাখতে পারো না! তাহলে সাতচল্লিশটা এলোমেলো ক্যারেক্টার তুমি কীভাবে মনে রাখবে?
আবারো হেসে ফেলে সে। আমাকে সেটা করার কোন দরকারই নেই। ওগুলো এলোমেলো কোন ক্যারেক্টার না। কণ্ঠটা নিচে নামিয়ে তারপর বলে, আমার পাসওয়ার্ড আসলে আমার প্রিয় কবিতার একটা পঙক্তি।
অ্যাম্ব্রা বুঝতে পারলো না। তুমি পাসওয়ার্ড হিসেবে কবিতার লাইন ব্যবহার করেছো?
কেন নয়? আমার প্রিয় কবিতার পঙক্তিটা একদম সাতচল্লিশ অক্ষরের। আমার কাছে এটা খুব বেশি নিরাপদ বলে মনে হচ্ছে না।
না? তোমার ধারণা তুমি আমার পছন্দের কবিতার লাইনগুলো অনুমাণ করতে পারবে?
আমি এমনকি এ-ও জানি না তুমি কবিতা পছন্দ করো কিনা।
ঠিক বলেছো। কেউ যদি জেনেও যায় আমার পাসওয়ার্ডটা হলো কবিতার একটা লাইন, আর কেউ যদি ঠিকঠাকভাবে লক্ষ-কোটি সম্ভাবনা মধ্যে থেকে অনুমাণও করে নিতে পারে সঠিক লাইনটা, তাহলে তাদেরকে সবার আগে অনুমাণ করে নিতে হবে আমি অনেক লম্বা একটি ফোন নাম্বার, যেটা দিয়ে আমি আমার সিকিউড সার্ভারে ডায়াল করি।
এইমাত্র যে ফোননাম্বারটি তুমি স্পিড-ডায়াল করলে সেটা?
হ্যাঁ। এমন একটা ফোন যেটার নিজস্ব একটি অ্যাকসেস পিন নাম্বার আছে, আর যেটা কখনওই আমার বুক পকেট থেকে বেহাত হয় না।
দু-হাত তুলে মজা করে বলেছিল অ্যাম্ব্রা, ওকে, বাবা…তুমি হলে বস্। ভালো কথা, তোমার প্রিয় কবি কে?
চেষ্টাটা কিন্তু মন্দ নয়, হাত নাড়িয়ে বলেছিলো সে। শনিবারের আগপর্যন্ত তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। যে কবিতার লাইন আমি বেছে নিয়েছি সেটা একদম পারফেক্ট। দাঁত বের করে হেসে বলেছিল সে। এটা ভবিষ্যৎ নিয়ে, মানে একটা ভবিষ্যদ্বাণী। আর আমি খুব খুশি যে, সেটা এরইমধ্যে ফলেও গেছে।
এখন তার চিন্তাভাবনা বর্তমানে ফিরে আসতেই একটু দূরে পড়ে থাকা এডমন্ডের লাশের দিকে তাকালো অ্যাম্ব্রা। ল্যাংডনকে ওখানে দেখতে না পেয়ে আতঙ্ক গ্রাস করলো তাকে।
সে কোথায় গেল?!
আরো খারাপ খবর হলো, এখন সে দ্বিতীয় গার্ডিয়া অফিসার এজেন্ট ডিয়াজকেও দেখতে পাচ্ছে। কাপড়ের কাটা অংশ দিয়ে ঢুকে ডোমে প্রবেশ করছে সে। ডোমটা ভালো করে দেখে নিয়ে অ্যাম্ব্রার দিকে আসতে লাগলো সে।
সে আমাকে কখনও এখান থেকে যেতে দেবে না!
হুট করে কোত্থেকে যেন ল্যাংডন এসে দাঁড়ালো তার পাশে। সে তার পিঠে আলতো করে হাত রেখে তাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। এজেন্ট দু-জন এ দৃশ্য দেখে দ্রুত ছুটে গেল ডোমের আরেক প্রান্তে-যেখান দিয়ে এই ডোমে প্রবেশ করেছিল সবাই।
মিস ভিদাল! চিৎকার করে বলল ডিয়াজ। আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?!
আমরা একটু আসছি, বেশ জোরে বলল ল্যাংডন, অ্যাম্রাকে নিয়ে দ্রুত ফাঁকা চত্বরটা পেরিয়ে এক্সিট টানেলের দিকে যেতে শুরু করলো।
মি. ল্যাংডন! এবার চিৎকার করে ডাকলো এজেন্ট ফনসেকা। এ ঘর থেকে আপনাদের বের হওয়া নিষেধ!
অ্যাম্ব্রা টের পেলো তার পিঠের উপরে রাখা ল্যাংডনের হাতটা তাকে আরো বেশি তাড়া দিচ্ছে।
উইনস্টন, হেডসেটে আস্তে করে বলল ল্যাংডন। এখনই! সঙ্গে সঙ্গে পুরো ডোমটা অন্ধকারে তলিয়ে গেল।
.
অধ্যায় ২৮
এজেন্ট ফনসেকা আর তার পার্টনার অন্ধকার ডোমের টানেলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নিজেদের মোবাইলফোনের ফ্ল্যাশলাইটের আলো জ্বালিয়ে। একটু আগে ল্যাংডন আর অ্যাম্ৰা এদিক দিয়েই উধাও হয়ে গেছে।
টানেলের অর্ধেক পথে আসতেই ফনসেকা দেখতে পেলো অ্যাস্ত্রার সেলফোনটা কার্পেটের মেঝেতে পড়ে আছে। খুবই অবাক হলো সে।
অ্যাম্ৰা তার ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে?
অ্যাম্রার অনুমতি নিয়েই গার্ডিয়া রিয়েল খুবই সহজ একটি ট্র্যাকিং অ্যাপস ব্যবহার করেছিল মহিলার লোকেশন সব সময় তাদের নজরে রাখার জন্য। এভাবে ফোনটা ফেলে দেয়ার একটাই মানে থাকতে পারে : সে চাচ্ছে তাদের। প্রটেকশন থেকে পালাতে।
এই ভাবনাটা ফনসেকাকে নার্ভাস করে ফেলল। অবশ্য এতটা নাভাস নয়। যে, তার বসকে এই খবরটা জানাতে ভুলে যাবে, তাদের ভবিষ্যৎ রাণীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যুবরাজ এবং তার স্বার্থের প্রশ্নে গার্ডিয়া কমান্ডার খুবই তটস্থ থাকে। এ ব্যাপারে সে যেমন নির্মম তেমনি কড়া দৃষ্টি তার। আজ রাতে। কমান্ডার নিজে ফনসেকাকে একটা সহজ-সরল ডিরেকশন দিয়ে বলেছিলেন : অ্যাম্ব্রা ভিদালকে নিরাপদে রাখবে। সব সময় সমস্যা থেকে দূরে রাখবে। তাকে।
উনি কোথায় আছেন সেটা না জানতে পারলে আমি উনাকে নিরাপদে রাখতে পারবো না!
টানেলটা দ্রুত পার হয়ে মাঝখানে ছোট্ট ঘরটাতে চলে এলো এজেন্ট দু জন। যথারীতি এই ঘরটাও অন্ধকারে ঢেকে আছে। মনে হচ্ছে ভুতের আসর বসেছে এখানে-তারা যখন নিজেদের ফোন কানের কাছে ঠেকিয়ে বাইরের সাথে যোগাযোগ করতে গেল এখানে কী হয়েছে সেটা জানাতে, তখন ফোনের ডিসপ্লের আলোতে তাদের মুখদুটো দেখা গেল ফ্যাকাশে আর আতঙ্কগ্রস্ত।
বাতি জ্বালাও! কয়েকজন লোক চিষ্কার করে বলল। ফনসেকার ফোনটা বেজে উঠলে জবাব দিলো সে।
এজেন্ট ফনসেকা, আমি জাদুঘরের সিকিউরিটি বলছি, এক তরুণী বলল স্প্যানিশে। আমরা জানি উপরে আপানাদের ওখানে বাতি বন্ধ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এটা কম্পিউটারের সমস্যার কারণে হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা ঠিক করে ফেলবো।
ভেতরের সিকিউরিটি ক্যামেরার ফিড কি এখনও পাওয়া যাচ্ছে? জানতে চাইলো ফনসেকা। ভালো করেই জানে ক্যামেরাগুলো সব নাইটভিশন প্রযুক্তির।
হ্যাঁ। ওগুলো ফিড দিচ্ছে এখনও।
অন্ধকার ঘরটা ভালো করে দেখে নিলো ফনসেকা। অ্যাম্ব্রা ভিদাল একটু আগে থিয়েটারের টানেলের সামনের যে ঘরটা আছে সেখানে ঢুকেছিল। তুমি কি দেখতে পাচ্ছো সে কোথায় গেছে?
এক মিনিট, প্লিজ।
অপেক্ষা করার সময় ফনসেকার হৃদস্পন্দন লাফাতে শুরু করলো। একটু আগে সে উবার থেকে জানতে পেরেছে, খুনির গাড়িটা ট্র্যাক করতে পারছে না তারা।
আজ রাতে এসব হচ্ছেটা কী?
দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, আজই প্রথম সে অ্যাম্ব্রা ভিদালের হয়ে কাজ করছে। সাধারণত একজন সিনিয়র অফিসার হিসেবে তাকে কেবলমাত্র যুবরাজ হুলিয়ানের জন্যই অ্যাসাইন করা হয়ে থাকে। কিন্তু আজ সকালে তার বস্ তাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলেছে : আজ রাতে মিস ভিদাল যুবরাজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপন করবেন। তুমি তার সঙ্গে থাকবে, সে যেন নিরাপদে থাকে সেটা নিশ্চিত করবে।
ফনসেকা কখনও ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি, অ্যাম্ব্রা এমন একটি অনুষ্ঠানে উপস্থাপনার কাজ করবে যেখানে ধর্মের বিরুদ্ধে সরাসরি আঘাত হানা হবে, আর প্রকাশ্যে হত্যা করা হবে কাউকে। তার মাথায় এখনও ঢুকছে না, যুবরাজ উদ্বিগ্ন হয়ে যখন ফোন দিলেন তখন কেন অ্যাম্ৰা কথা বলল না।
মনে হচ্ছে সবটাই বোধগম্যতার বাইরে, আর মহিলার অদ্ভুত আচরণ সেটাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। দেখেশুনে যা মনে হচ্ছে, অ্যাস্ত্রা ভিদাল তার নিজের সিকিউরিটি পরিত্যাগ করে ঐ আমেরিকান প্রফেসরের সাথে পালিয়ে গেছে।
যুবরাজ যদি এ খবর শুনতে পান…।
এজেন্ট ফনসেকা? সিকিউরিটির সেই মেয়েটির কণ্ঠ ফিরে এলো ফোনে। আমরা দেখতে পাচ্ছি মিস ভিদাল এবং তার সঙ্গে থাকা এক ভদ্রলোক একটু আগে ঐ ঘর থেকে বের হয়ে ক্যাটওয়াকের দিকে গেছে। এখন তারা লুই বুর্জোয়ার সেক্স যেখানে প্রদর্শন করা হচ্ছে সেই গ্যালারিতে আছে। ওখান থেকে বের হয়ে ডানদিকে চলে যান। দ্বিতীয় গ্যালারিটা আপনাদের ডানদিকে।
ধন্যবাদ তোমাকে! তাদেরকে ট্র্যাক করতে থাকো!
ফনসেকা আর ডিয়াজ ঘর থেকে বের হয়ে ক্যাটওয়াকের দিকে চলে গেল। নিচে তারা দেখতে পেলো দলে দলে অতিথিরা বের হবার পথের দিকে ছুটে যাচ্ছে।
ডানদিকে, যেমনটা সিকিউরিটির মেয়েটা বলেছে, ফনসেকা দেখতে পেলো একটা বিশাল গ্যালারির খোলা মুখ। এক্সিবিট সাইনে লেখা : সেলস।
গ্যালারিটা বিশাল, সেখানে রাখা আছে অনেকগুলো সাদারঙের বিমূর্ত ভাস্কর্য।
মিস ভিদাল! ফনসেকা চিৎকার করে বলল। মি. ল্যাংডন! কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে এজেন্ট দু-জন তল্লাশি করতে শুরু করলো।
*
গার্ডিয়া এজেন্টরা এখন যেখানে আছে তার থেকে কয়েকটা ঘর পেছনে, ডোম অডিটোরিয়ামের ঠিক বাইরে ল্যাংডন আর অ্যাম্ৰা অসংখ্য মাচাঙের মধ্য দিয়ে সতর্কতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে মৃদু আলোতে এক্সিট লেখা একটি সাইনের দিকে।
শেষ কিছু মুহূর্তে তাদের কর্মকাণ্ড ছিল খুবই অস্পষ্ট-ল্যাংডন আর উইনস্টনের সম্মিলিত প্রয়াসে খুব দ্রুতই একটা ধোঁকা তৈরি করা গেছে।
ল্যাংডনের কথামতো নির্দিষ্ট সময়ে বাতি অফ করে দেয় উইনস্টন, ফলে অন্ধকারে ঢেকে যায় ডোমের ভেতরটা। তাদের অবস্থান থেকে টানেলের এক্সিটে যাবার পথটির দিক আর দূরত্ব ল্যাংডন নিজের মাথায় গেঁথে নিয়েছিল। টানেলের মধ্যে এসে অ্যাম্ব্রা তার ফোনটা ফেলে দেয়, এরপর টানেল থেকে বের না হয়ে তারা আবার চলে যায় ডোমের ভেতরে। ডোমের একপাশের কাপড়ের দেয়াল হাতরে একটা ছেঁড়া অংশ খুঁজে পায় তারা, এই জায়গাটা দিয়েই একটু আগে গার্ডিয়া এজেন্ট ডিয়াজ এডমন্ডের খুনিকে ধাওয়া করার জন্য চলে গেছিল। কাপড়ের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে তারা দু-জন চলে। যায় ঘরের বাইরের দিকে দেয়ালের দিকে। সেখান থেকে জ্বলজ্বলে সাইনটা দেখে বুঝতে পারে ওটা ইমার্জেন্সি এক্সিটের সিঁড়ি।
উইনস্টন কতো দ্রুত তাদেরেকে সাহায্য করার জন্য রাজি হয়ে গেছিল কথাটা মনে পড়তেই বিস্মিত হলো ল্যাংডন। এডমন্ডের ঘোষণাটি যদি একটা পাসওয়ার্ড দিয়ে সচল করা যায়, বলেছিল উইনস্টন, তাহলে আমাদেরকে সেটা খুঁজে বের করতে হবে, ব্যবহার করতে হবে সঙ্গে সঙ্গে। আমাকে বলা হয়েছিল, আমি যেন সবদিক থেকে আজকের এই ঘোষণার অনুষ্ঠানটি সফল করার জন্য এডমন্ডকে সহযোগিতা করি। কিন্তু এ কাজে আমি ব্যর্থ হয়েছি। সুতরাং আমার ভুল সংশোধন করার জন্য যা যা করার দরকার আমি করবো।
ল্যাংডন তাকে ধন্যবাদ দিতে উদ্যত হলেও উইনস্টন কোন বিরতি না দিয়েই বলে চলেছিল। উইনস্টনের বলা কথাগুলোর যে গতি ছিল সেটা মানুষের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব। যেন দ্রুতগতিতে পড়ার জন্য কোন অডিওবুকের গতি বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
আমি যদি এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনটাতে অ্যাকসিস করতে পারতাম, উইনস্টন বলেছিল। তাহলে আমি সেটা তক্ষুণি করে ফেলতাম। কিন্তু আপনি তো শুনেছেনই, ওটা স্টোর করা আছে নিরাপদ কোন সার্ভারে। মনে হচ্ছে তার আবিষ্কারটির কথা সারা দুনিয়ার কাছে রিলিজ করতে হলে তার কাস্টমাইজড ফোন আর পাসওয়ার্ডটার দরকার পড়বে। আমি এরইমধ্যে। সাতচল্লিশ সংখ্যার পঙক্তি আছে এরকম প্রকাশিত সব কবিতা সার্চ করে ফেলেছি। দুর্গের কথা হলো, সম্ভাব্য সংখ্যাটি কয়েক লাখ। তারচেয়েও বড় কথা হলো, এডমন্ডের ফোন থেকে সার্ভারে ঢুকতে গেলে যে পাসওয়ার্ড লাগবে সেটাও একটা সমস্যা। কারণ মাত্র কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টা করা যাবে। এরপর আর কোনভাবেই সেটা করা সম্ভব হবে না। ফলে আমাদের হাতে মাত্র একটাই অপশন আছে : আমাদেরকে তার পাসওয়ার্ডটা অন্যকোনভাবে খুঁজে বের করতে হবে। আমি মিস ভিদালের ঐ কথাটার সাথে পুরোপুরি একমত, আপনাদেরকে এক্ষুণি বার্সেলোনায় এডমন্ডের বাড়িতে যেতে হবে। এই চিন্তাটা খুবই যৌক্তিক যে, এডমন্ডের বাড়িতে সেই বইটি থাকতে পারে যেটাতে তার প্রিয় কবিতাটি রয়েছে। এমনকি সেই লাইনগুলো দাগিয়ে রাখার সম্ভাবনাও আছে। সেজন্যে আমি হিসেব করে দেখেছি, এডমন্ড চাইতেন আপনারা যেন তার বার্সেলোনার বাড়িতে গিয়ে পাসওয়ার্ডটা খুঁজে বের করেন, সেটা ব্যবহার করে তার ঘোষণাটি প্রচার করেন। আমি এখন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, শেষ মুহূর্তে অ্যাডমিরাল আভিলাকে অতিথিদের তালিকায় ঢোকানোর জন্য মাদ্রিদের রাজপ্রাসাদ জড়িত, ঠিক যেমনটি মিস ভিদাল স্বীকার করেছেন। এ কারণে আমি ঠিক করেছি আমাদের উচিত হবে না গার্ডিয়া রিয়েলকে বিশ্বাস করা। আমি তাদেরকে ভিন্নপথে পরিচালিত করার জন্য একটা উপায় বের করবো, যাতে করে আপনাদের পালাতে সুবিধা হয়।
অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, উইনস্টন সত্যি সেটা করার মতো একটা উপায় বের করতে পেরেছে।
ল্যাংডন আর অ্যাম্ৰা এখন ইমার্জেন্সি এক্সিটের কাছে পৌঁছে গেছে। আস্তে করে প্রফেসর দরজাটা খুলে দিলো অ্যাম্রাকে বের হয়ে যাবার জন্য, তারপর সে নিজেও বের হয়ে বন্ধ করে দিলো সেটা।
দারুণ, ল্যাংডনের মাথার মধ্যে উচ্চারিত হলো উইনস্টনের কণ্ঠটা। আপানারা এখন সিঁড়িঘরে আছেন।
আর গার্ডিয়া এজেন্টরা? জানতে চাইলো ল্যাংডন।
আপনাদের থেকে বেশ দূরে, জবাব দিলো উইনস্টন। আমি এখন তাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলছি। জাদুঘরের সিকিউরিটি অফিসার সেজে তাদেরকে এই ভবনের এককোণের একটি গ্যালারিতে নিয়ে গেছি।
অবিশ্বাস্য, ভাবলো ল্যাংডন। অ্যাম্রাকে আশ্বস্ত করার ইশারা করলো সে। সবকিছু ভালোমতোই এগোচ্ছে।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান নিচের গ্রাউন্ড লেভেলে, বলল উইনস্টন, এই জাদুঘর থেকে বের হয়ে যান। এই ভবন থেকে বের হবার সঙ্গে সঙ্গে আপনার হেডসেটটা দিয়ে আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে না।
ধ্যাত্তারি! এই চিন্তাটা ল্যাংডনের মাথায় আসেনি। উইনস্টন, তড়িঘরি বলল সে, তুমি কি জানো, গত সপ্তাহে এডমন্ড তার আবিষ্কারটা নিয়ে কিছু ধর্মিয় নেতার সাথে আলোচনা করেছিল?
কথাটা শুনে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, উইনস্টন জবাব দিলো। যদিও আজ রাতে তার সূচনা বক্তব্যে তিনি জানিয়েছেন, তার আবিষ্কারটি ধর্মগুলোর উপরে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে, সেজন্যে সম্ভবত উনি চেয়েছেন ধর্মিয়গোষ্ঠির নেতাদের সঙ্গে এ নিয়ে আগেই আলাপ করে নিতে?
আমারও তাই মনে হয়। তাদের মধ্যে অবশ্যই মাদ্রিদের বিশপ ভালদেসপিনো ছিলেন।
ইন্টারেস্টিং তো। আমি অনলাইনে অসংখ্য রেফারেন্স দেখেছি, তিনি স্পেনের রাজার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
হ্যাঁ। আরেকটা বিষয়, বলল সিম্বলজিস্ট। তুমি কি জানো, তাদের সঙ্গে মিটিং করার পর ভালদেসপিনোর কাছ থেকে এডমন্ড একটি হুমকি পেয়েছিল ভয়েসমেইলে?
এটা আমার জানা ছিল না। মেইলটা নিশ্চয় তার প্রাইভেট লাইনে দেয়া হয়েছিল।
এডমন্ড ওটা আমাকে শুনিয়েছিল। ভালদেসপিনো তাকে জোর দিয়ে বলেছিলেন প্রেজেন্টেশনটা যেন সে বাতিল করে। তাকে এই বলে সাবধানও করে দিয়েছিলেন, যেসব ধর্মিয় নেতাদের সঙ্গে সে মিটিং করেছে তারা তার ঘোষণার আগেই এই আবিষ্কারের কথাটি সবাইকে জানিয়ে তার আবিষ্কারকে হেয় প্রতিপন্ন করার কথাও বিবেচনা করে দেখছেন। অ্যাম্রাকে সিঁড়িটা দেখিয়ে নামার জন্য ইশারা করলো ল্যাংডন। এবার কণ্ঠটা নিচে নামিয়ে সে বলল, তুমি কি ভালদেসপিনো আর আভিলার মধ্যে কোন কানেকশান খুঁজে পেয়েছো?
উইনস্টন কয়েক সেকেন্ডের জন্য থামলো। আমি তাদের মধ্যে সরাসরি কোন কানেকশান পাইনি। তার মানে এই নয় যে, এরকম কোন কিছু নেই। এর একটাই অর্থ, এটার কোন ডকুমেন্ট নেই।
তারা গ্রাউন্ডফ্লোরের দিকে নেমে যাচ্ছে।
প্রফেসর…উইনস্টন বলল। আজকের রাতে যা ঘটে গেছে সেটা বিবেচনায় নিয়ে বলছি, যুক্তি বলছে অসম্ভব ক্ষমতাবান কিছু মহল চাচ্ছে। এডমন্ডের আবিষ্কারটি যেন প্রকাশ না পায়। তার প্রেজেন্টেশনে আপনার অংশগ্রহনের কথাটা মাথায় রাখলে এডমন্ডের শত্রুরা আপনাকেও বিপজ্জনক মনে করতে পারে।
এটা ল্যাংডনের ভাবনায় কখনও আসেনি। গ্রাউন্ডফ্লোরে পৌঁছাতেই বিপদটা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠলো সে। অ্যাম্ৰা তার আগেই ওখানে নেমে লোহার দরজাটা খুলে অপেক্ষা করছে।
আপনি যখন এখান থেকে বের হয়ে যাবেন, বলল উইনস্টন, তখন একটা গলি দেখতে পাবেন। আপনার বামদিকে সেটা। ওখান থেকে চলে যাবেন নদীর দিকে। ওখানে গেলেই আমি আপনার জন্য একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে পারবো। যে ঠিকানাটা নিয়ে আমরা এর আগে কথা বলেছি সেখানে আপনাদেরকে পৌঁছে দিতে পারবো আমি।
BIO-EC346, ল্যাংডন ভাবলো। উইনস্টন তাদের সাথে থাকলে যে ভালো হতো সেই তাড়না অনুভব করলো সে। অনুষ্ঠানের পর যেখানে এডমন্ডের সাথে আমার মিটিং করার কথা ছিল। ল্যাংডন অবশেষে কোডটার অর্থোদ্ধার করতে পারলো। বুঝতে পারলো, BIO-EC346 গোপন কোন সায়েন্স-ক্লাব নয়, এটা অনেক বেশি জাগতিক কিছু। তাসত্ত্বেও সে আশা করলো এটাই হবে বিলবাও থেকে তাদের পালানোর চাবিকাঠি।
আমরা যদি সেখানে সবার অলক্ষ্যে চলে যেতে পারি…ভাবলো সে। ভালো করেই জানে, খুব জলদিই সবখানে রোডব্লক বসানো হবে। আরো দ্রুত রওনা দিতে হবে আমাদেরকে।
অ্যাম্ব্রাকে নিয়ে দরজা দিয়ে বের হতেই ল্যাংডনের চোখে পড়লো রোসারি জপমালার টুকরোগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ওগুলো কেন এখানে পড়ে আছে তা নিয়ে ভাবার মতো সময় তার হাতে নেই। উইনস্টন এখনও কথা বলে যাচ্ছে।
আপনারা নদীর কাছে পৌঁছালেই, আদেশের সুরে বলল তার কণ্ঠটা, লা সালভে ব্রিজের নিচ দিয়ে ফুটপাত ধরে এগিয়ে যাবেন, ওখানেই অপেক্ষা করবেন যতক্ষণ না-
ল্যাংডনের হেডসেটটা হঠাৎ করেই কানফাটা ঘরঘর শব্দ করতে শুরু করলো।
উইনস্টন? চিৎকার করে বলল সে। অপেক্ষা করবো যতোক্ষণ–এরপর কী?
কিন্তু উইনস্টন আর নেই, লোহার দরজাটা তাদের পেছনে শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল।
.
অধ্যায় ২৯
বিলবাও শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে, একটা উবার সিডান ছুটে চলেছে হাইওয়ে এপি-৬৮ ধরে মাদ্রিদের দিকে। পেছনের সিটে বসে থাকা অ্যাডমিরাল আভিলা তার সাদা জ্যাকেট আর নেভির ক্যাপটা খুলে ফেলল। এত সহজে কাজটা করে সুন্দরমতো পালাতে পেরে এক ধরণের প্রশান্তি অনুভব করছে সে।
রিজেন্ট যেমনটা কথা দিয়েছিল ঠিক তেমনি।
উবারের গাড়িটাতে ওঠার পর পরই আভিলা তার পিস্তলটা ঠেকায় ড্রাইভারের মাথার পেছনে। আভিলার কথামতো ড্রাইভার তার স্মার্ট ফোনটা ফেলে দেয় গাড়ির জানালা দিয়ে। এটাই কোম্পানির হেডকোয়ার্টারের সাথে তার একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম ছিল।
এরপর আভিলা লোকটার ওয়ালেট থেকে তার বাসায় ঠিকানা, তার স্ত্রী আর দুই সন্তানের নামগুলো মুখস্ত করে নেয়। আমি যেমনটা বলবো তেমনটাই করবে, তাকে বলেছিল আভিলা, নইলে তোমার পরিবারের সবাই মারা যাবে। কথাটা শুনে ভীষণ ভড়কে যায় লোকটা। তাকে দেখে আভিলা বুঝতে পারে, আজ রাতে সে যা বলবে এই লোক তাই করবে।
আমি এখন অদৃশ্য, পুলিশের গাড়িগুলো সাইরেন বাজাতে বাজাতে বিপরীত দিকে ছুটে যেতে দেখে ভাবলো আভিলা।
গাড়িটা দক্ষিণ দিকে যেতে শুরু করলে আরাম করে বসলো দীর্ঘ ভ্রমণের জন্য। নিজেকে শান্ত করে নিলো এবার। আমি আমার কাজ ঠিকমতোই করতে পেরেছি, ভাবলো সে। তার হাতের ট্যাটুর দিকে তাকালো। বুঝতে পারলো, যে সুরক্ষা দেয়া হয়েছে তাকে সেটা তার কোন কাজে লাগেনি। অন্তত এখন পর্যন্ত।
ভড়কে যাওয়া উবার ড্রাইভার যে তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত সে। গাড়িটা মাদ্রিদের দিকে দ্রুতগতিতে ছুটে যাবার সময় উইন্ডশিল্ডে লাগানো দুটো স্টিকার তার চোখে পড়লো।
ওটা হবার চান্স কতোটুকু? ভাবলো সে।
প্রথম স্টিকারটি প্রত্যাশিতই ছিল-উবারের লোগো সেটা। কিন্তু দ্বিতীয় স্টিকারের শুধুমাত্র উপরের দিকটিই দেখা যাচ্ছে।
পাপালের ক্রশ। আজকাল এই সিম্বলটি সবখানেই দেখা যায়-সমগ্র ইউরোপের ক্যাথলিকরা নতুন পোপের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশের জন্য এটা দেখিয়ে থাকে। এই নতুন পোপ চার্চের যে উদারনৈতিকীকরণ আর আধুনিকায়ন শুরু করেছেন তার প্রশংসা করে তারা।
পরিহাসের ব্যাপার হলো, আভিলা বুঝতে পারছে নতুন আর উদার পোপের একজন ভক্ত এই ড্রাইভারের মাথার পেছনে পিস্তল ঠেকানোটা তার জন্য খুবই প্রীতিকর একটি অভিজ্ঞতা। আভিলা খুবই হতাশার সাথে ভাবে, কী করে গর্দভের দল এই নতুন পোপকে শ্রদ্ধা করে, যে কিনা খৃস্টের অনুসারিদেরকে ঈশ্বরের আদেশ-নিষেধের বুফে টেবিল থেকে কোন্ প্লেটটা নিতে হবে আর কোনটা নিতে হবে না সেটা নির্ধারণ করে দেয়। প্রায় রাতারাতি, ভ্যাটিকানের ভেতরে জন্মনিয়ন্ত্রণ, সমকামি বিয়ে, নারী-যাজক আর অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে মুক্ত আলোচনার সূত্রপাত হতে থাকে। চোখের নিমেষে দু-হাজার বছরের ঐতিহ্য হাওয়া হয়ে গেল বলতে গেলে।
সৌভাগ্যের কথা, এখনও পুরনো ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য লড়াই করার মতো মানুষ আছে।
আভিলা তার মাথার ভেতরে শুনতে পেলো ওরিয়ামেন্দি স্তবগীতিটা।
আর আমি তাদের জন্য কাজ করতে পেরে সম্মানিত বোধ করছি।
.
অধ্যায় ৩০
স্পেনের সবচাইতে পুরনো আর এলিট সিকিউরিটি ফোর্স হিসেবে মধ্যযুগ থেকেই গার্ডিয়া রিয়েলের রয়েছে সহিংস ঐতিহ্য। গার্ডিয়ার এজেন্টরা মনে করে, ঈশ্বরের কাছে করা তাদের শপথ তাদেরকে রাজপরিবারের নিরাপত্তা, তাদের সম্পত্তি আর সম্মান রক্ষা করার পবিত্র দায়িত্বে নিয়োজিত করেছে।
কমান্ডার ডিয়েগো গারজা একজন ষাট বছরের ছোটখাটো, হাড্ডিসার মানুষ, গার্ডিয়ার আনুমানিক দুই হাজার সদস্যকে দেখভাল করে সে। তার গায়ের রঙ কিছুটা তামাটে। ছোটছোট চোখ আর তেলতেলে পাতলা কালো চুলগুলো মাথার উপরে লেপ্টে থাকে। ইঁদুরমুখো চেহারাটা ছোটখাটো গড়নের কারণে গারজাকে মানুষজনের ভিড়ে আলাদা করাই কঠিন। রাজপ্রাসাদের ভেতরে যে তার অসামান্য প্রভাব রয়েছে এটা তাকে আড়াল করতে সাহায্য করে।
অনেক কাল আগেই গারজা শিখেছে, সত্যিকারের ক্ষমতা দৈহিক গড়ন থেকে আসে না, আসে রাজনীতির সুবিধা থেকে। গার্ডিয়া রিয়েলে তার কমান্ড নিশ্চিতভাবেই তাকে ক্ষমতাধর মানুষে পরিণত করলেও তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতাই তাকে প্রাসাদের ঘনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। প্রাসাদের ব্যক্তিগত কিংবা পেশাদার যেকোন ব্যাপারেই তার প্রভাব রয়েছে।
গোপনিয়তার একজন বিশ্বস্ত কিউরেটর হিসেবে গারজা কখনও একবারের জন্যেও তার প্রতি আস্থার অবমূল্যায়ন করেনি। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সব সমস্যার চমত্যার সমাধান দিতে পারায় তার সুনাম রয়েছে। এজন্যে রাজার কাছে রয়েছে তার অপরিহার্য গুরুত্ব। ইদানিং অবশ্য ভগ্ন স্বাস্থ্যের রাজা পালাসিও দে লা জারজুয়েলা প্রাসাদে শয্যাশায়ি হতেই গারজাসহ রাজপ্রাসাদের বাকিরা এক। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে মধ্যে পড়ে গেছে।
ছত্রিশ বছরের অতি-রক্ষণশীল জেনারেল ফ্রাঙ্কোর স্বৈরাচারি শাসনের অবসানের পর সংসদীয় রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে প্রায় চার দশক ধরে রাজা শাসন করে গেছেন একটি অস্থিতিশীল দেশকে। ১৯৭৫ সালে ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর সরকারের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল।
যদিও যুবকদের কাছে এই পরিবর্তনটি খুবই ধীরগতির বলে মনে হয়েছে।
আর বয়স্ক ঐতিহ্যবাদিদের কাছে মনে হয়েছে পরিবর্তনগুলো রীতিমতো ব্লাসফেমির পর্যায়ে পড়ে।
স্পেনের এমন অনেক স্ট্যাবলিশমেন্ট রয়েছে যারা তুমুলভাবে এখনও ফ্রাঙ্কোর রক্ষণশীল মতবাদকে সমর্থন করে। বিশেষ করে ক্যাথলিজমকে রাজধর্ম এবং দেশের নীতিনৈতিকতার মেরুদণ্ড বিবেচনা করার তার যে দৃষ্টিভঙ্গি সেটা তাদের কাছে এখনও গ্রহণযোগ্যতা রাখে। তবে স্পেনের ক্রমবর্ধমান তরুণ জনগোষ্ঠি ঠিক এর বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গিই পোষণ করে-খোলাখুলিভাবেই তারা সংগঠিত ধর্মগুলোকে নিন্দা জানায়, আর লবিং করে চার্চ থেকে রাষ্ট্রকে আলাদা করার জন্য।
এখন, মধ্যবয়স্ক যুবরাজ সিংহাসনে বসার দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন, কিন্তু কেউ জানে না নতুন রাজা কোনদিকে ঝুঁকবেন। কয়েক দশক ধরে হুলিয়ান তার বাবার সব ধরণের কর্মকাণ্ডের সাথেই ছিলেন, প্রশংসা করার মতো অসংখ্য কাজ করেছেন তিনি। কখনও বাবার সাথে রাজনীতি থেকে শুরু করে কোন ব্যাপারেই তাকে ভিন্নমত পোষণ করতে দেখা যায়নি। তারপরও বেশিরভাগ পণ্ডিত সন্দেহ করে থাকে, তিনি হবেন তার বাবার থেকে অনেক অনেক বেশি উদার। অবশ্য এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবার কোন উপায়ই নেই।
আজ রাতে অবশ্য এর যবনিকাপাত হতে পারে।
বিলবাওতে মারাত্মক একটি ঘটনা ঘটে গেছে, কিন্তু অসুস্থতার জন্য রাজার পক্ষে সে-ব্যাপারে জনসম্মুখে কিছু বলা যেহেতু সম্ভব নয় তাই এই দায়িত্বটা অনিবার্যভাবেই যুবরাজের উপরে গিয়ে বর্তায়।
দেশের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে সরকারের উঁচুপদে থাকা অনেকেই এরইমধ্যে এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে। রাজপ্রাসাদ থেকে কোন স্টেটমেন্ট আসার আগপর্যন্ত তারা আর এর বেশি কিছু বলেনি-এজন্যে সবটাই এখন যুবরাজের উপরে গিয়ে পড়েছে। গারজা মোটেও অবাক হয়নি, এই ঘটনায় ভবিষ্যৎ রাণী অ্যাম্ব্রা ভিদালের জড়িয়ে পড়ার কারণে ব্যাপারটা হয়ে উঠেছে একটি রাজনৈতিক গ্রেনেডের মতো, যা কেউ স্পর্শ করতে চাইবে না।
আজ রাতে হুলিয়ানের শক্ত একটি পরীক্ষা হয়ে যাবে, প্রাসাদের বিশাল সিঁড়িটা দিয়ে রয়্যাল অ্যাপার্টমেন্টের দিকে যাওয়ার জন্য দ্রুত উঠতে উঠতে ভাবলো গারজা। তার গাইডেন্সের দরকার পড়বে, আর যেহেতু তার বাবা পুরোপুরি অক্ষম, সেই গাইডেন্সটা অবশ্যই আমাকে দিতে হবে।
রেন্সিদিনসিয়া হলওয়ে দিয়ে বড় বড় পা ফেলে অবশেষে যুবরাজের দরজার কাছে এসে পৌঁছে গভীর করে দম নিয়ে টোকা দিলো গারজা।
আজব, ভাবলো সে। কোন সাড়াশব্দ পেলো না। আমি জানি তিনি ভেতরেই আছেন। বিলবাও থেকে এজেন্ট ফনসেকা তাকে জানিয়েছে, হুলিয়ান একটু আগে তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তাকে ফোন করে অ্যাম্ব্রা ভিদাল নিরাপদে আছে কিনা জানতে চেয়েছিলেন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, সে নিরাপদেই আছে।
আবারো দরজায় নক করলো গারজা। এবারও কোন সাড়া না পেয়ে চিন্তিত হয়ে উঠলো সে। তড়িঘরি দরজাটা খুলে ফেলল। ডন হুলিয়ান? ভেতরে পা দিয়েই ডাক দিলো। লিভিংরুমে একটা টিভির আলো ছাড়া পুরো ঘরটাই
অন্ধকারে ডুবে আছে।
হ্যালো?
ঘরের ভেতরে দ্রুত ঢুকে পড়তেই গারজা দেখলো যুবরাজ জানালার সামনে মুখ করে অন্ধকারে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছেন। এখনও তার গায়ে রাতের মিটিংয়ের সময় পরা পরিপাটি সুটটা দেখতে পেলো। এমনকি ঘরে আসার পরও নেকটাইটা আলগা করেননি।
চুপচাপ দেখতে লাগলো গারজা। যুবরাজকে এভাবে দেখতে পেয়ে বুঝতে পারছে না কী করবে। এই সঙ্কটটা মনে হচ্ছে তাকে পুরোপুরি ভড়কে দিয়েছে।
গলা খাকাড়ি দিলো গারজা তার উপস্থিতি জানান দেবার জন্য।
জানালার দিকে চেয়ে থেকেই যুবরাজ অবশেষে মুখ খুললেন। আমি অ্যাম্রাকে ফোন করেছিলাম, বললেন তিনি, ও আমার সাথে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। হুলিয়ানের কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে তিনি যতোটা কষ্ট পেয়েছেন, তারচেয়েও বেশি যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
কী বলবে ভেবে পেলো না গারজা। আজকের রাতে যে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেছে সেটা বিবেচনায় নিলে অ্যাম্ব্রার সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে দুশ্চিন্তা করাটা কোনমতেই বোধগম্য হলো না তার। এই মেয়ের সাথে যুবরাজের এনগেজমেন্টটা শুরু থেকেই অস্বস্তিকর একটি ব্যাপার হয়ে উঠেছে।
আমার মনে হয় মিস ভিদাল খুবই শক পেয়েছেন, শান্তকণ্ঠে বলল গারজা। এজেন্ট ফনসেকা উনাকে আজ রাতে আপনার কাছে নিয়ে আসবে। তখন কথা বলে দেখেন। উনি যে নিরাপদে আছেন সেটা জানতে পেরে আমি যার পর নাই স্বস্তি পেয়েছি।
উদাস হয়ে যুবরাজ মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
শুটারকে ট্র্যাক করা হচ্ছে, প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য গারজা বলল। ফনসেকা আমাকে আশ্বস্ত করেছে, খুব জলদিই তারা সন্ত্রাসিটাকে নিজেদের কাস্টডিতে নিয়ে নিতে পারবে। ইচ্ছে করেই সন্ত্রাসি শব্দটা ব্যবহার করলো সে এই আশায় যুবরাজ যেন ঘোরগ্রস্ত অবস্থা থেকে মুক্তি পায়।
কিন্তু যুবরাজ কেবল আরেকবার সায় দিয়ে গেলেন।
প্রেসিডেন্ট এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছেন, বলতে লাগলো গারজা, কি এই অনুষ্ঠানের সাথে অ্যাম্ব্রার জড়িত থাকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে…সরকার আশা করছে না, আপনি আর কোন মন্তব্য করুন। একটু থামলো গারজা। বুঝতে পারছি পরিস্থিতিটা খুবই বিচ্ছিরি। তবে আমি আপনাকে বলবো, আপনি যেন বলেন, আপনি আপনার বাগদত্তার যে জিনিসটা পছন্দ করেন সেটা হলো তার স্বাবলম্বিতা। সেজন্যে আপনি যখন জানতে পারলেন এডমন্ডের সাথে তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মিল না থাকা সত্ত্বেও জাদুঘরের ডিরেক্টর হিসেবে তিনি তার অনুষ্ঠানে থাকবেন তখন সেটাকে সাধুবাদই জানিয়েছিলেন। এরকম কিছু একটা আপনার জন্য লিখে দিতে পারি আমি, দেবো কি? সকালের নিউজের জন্য আমাদেরকে একটা স্টেটমেন্ট দিতে হবে এক্ষুণি।
হুলিয়ানের চোখ জানালা থেকে একটুও সরলো না। আমরা যে স্টেটমেন্টই করি না কেন, আমি চাই তাতে যেন বিশপ ভালদেসপিনোর কোন অবদান থাকে।
গারজার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, অনেক কষ্টে হজম করে নিলো কথাটা। ফ্রাঙ্কো-পরবর্তি স্পেন হলো এদো এফেকশনাল, এর মানে রাষ্ট্রধর্ম বলে আর কিছু নেই। রাজনৈতিক কোন বিষয়ে চার্চ কোনভাবেই জড়িত থাকবে না। রাজার সাথে ভালদেসপিনোর বন্ধুত্ব সব সময়ই বিশপকে রাজপরিবারের নিত্যদিনকার কাজকর্মে অস্বাভাবিক রকমের প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ করে দিয়েছে। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, ভালদেসপিনোর মধ্যে যে কট্টর রাজনীতি আর রক্ষণশীল ধর্মিয় মনোভাব রয়েছে সেখানে কূটনীতি আর কৌশলের কোন স্থান নেই। অথচ আজ এ মুহূর্তের যে সঙ্কট তাতে এটাই সবচেয়ে বেশি দরকার।
আমাদের দরকার প্রজ্ঞা আর কৌশল-ধর্মিয় মতবাদ এবং কথার ফুলঝুরি নয়!
গারজা বহুঁকাল আগেই জানতে পেরেছে, ভালদেসপিনোর ধার্মিক মুখোশের আড়ালে সহজ একটি সত্য লুকিয়ে আছে : ঈশ্বরের চেয়ে নিজের প্রয়োজনকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন তিনি। কিছুদিন আগপর্যন্ত এই ব্যাপারটা গারজা তেমন একটা পাত্তা না দিলেও এখন যখন রাজতন্ত্রে ক্ষমতার পালা বদল ঘটতে যাচ্ছে তখন যুবরাজের দিকে এভাবে দিন দিন বিশপের ঝুঁকে পড়াটা গভীর চিন্তার উদ্রেক করে।
ভালদেসপিনো এখন যুবরাজের খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছেন।
গারজা জানে, হুলিয়ান সব সময়ই বিশপকে তার পরিবারের একজন বলে মনে করেন-ধর্মিয়নেতার চেয়েও বিশ্বস্ত মামা-চাচার মতো তার অবস্থান। রাজার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে ভালদেসপিনো হুলিয়ানের শৈশবকাল থেকেই তাকে নৈতিক শিক্ষা দিয়ে গেছেন-এ কাজে তিনি এতটাই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন যে, হুলিয়ানের প্রায় সব টিউটরকে রীতিমতো পরীক্ষা নিতেন। ছোট্ট হুলিয়ানকে তিনি ধর্মের বিভিন্ন মতবাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন। এমনকি হৃদয়ঘটিত ব্যাপারেও তাকে পরামর্শ দিতেন তিনি। এখন, এত বছর পর হুলিয়ান আর ভালদেসপিনোর মধ্যে খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও তাদের মধ্যেকার সম্পর্কটা রক্ত-সম্পর্কিয় আত্মীয়ের মতোই রয়ে গেছে।
ডন হুলিয়ান, শান্তকণ্ঠে বলল গারজা, আমার মনে হয় আজ রাতের পরিস্থতিটা এমনই যে, আপনি আর আমি মিলেই সেটা সামলালে ভালো হয়। অন্য কারোর দরকার নেই এতে।
তাই নাকি? অন্ধকারেই বলে উঠলো একটা কণ্ঠ।
গারজা চমকে ঘুরে দাঁড়ালো। আলখাল্লা পরিহিত ভুতটা দেখে হতভম্ব হয়ে গেল সে।
ভালদেসপিনো।
কমান্ডার, ভালদেসপিনো হিসহিস করে বললেন, আমি ধরে নিতে পারছি, আপনারা সবাই বুঝতে পারছেন আজ রাতে আমাকে আপনাদের কতোটুকু দরকার হবে।
এটা রাজনৈতিক পরিস্থিতি, গারজা দৃঢ়তার সাথে বলল, ধর্মিয় কোন ঘটনা নয়।
ভালদেসপিনো অপমানিত বোধ করলেন। আপনার এই বক্তব্য শোনার পর আমার মনে হচ্ছে, আমি আপনাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে অনেক বেশি বড় করে দেখে ফেলেছি। আপনি যদি আমার মতামত জানতে চান তবে বলবো, এই সঙ্কটময় মুহূর্তে একটা জিনিসই কেবল করার আছে-আমাদেরকে এক্ষুণি পুরো জাতিকে আশ্বস্ত করতে হবে যে, যুবরাজ হুলিয়ান খুবই ধার্মিক একজন মানুষ, স্পেনের ভবিষ্যৎ রাজা একজন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক।
আমি আপনার সাথে একমত…আমরা ডন হুলিয়ানের এই কথাটা তার যেকোন স্টেটমেন্টেই উল্লেখ করবো।
আর যুবরাজ হুলিয়ান যখন প্রেসের সামনে হাজির হবেন, তার পাশে আমাকে দরকার হবে তখন। চার্চের সাথে তার সুদৃঢ় বন্ধনের একটি প্রতীক হিসেবে তার কাঁধে থাকবে আমার হাত। এই একটা ছবি আপনার লেখা যেকোন বক্তৃতার চেয়ে পুরো জাতিকে অনেক বেশি আশ্বস্ত করতে পারবে।
গারজা ক্ষুব্ধ হলো কথাটা শুনে।
একটু আগে সারা দুনিয়া দেখেছে স্পেনের মাটিতে বর্বরোচিত একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে, বললেন ভালদেসপিনো। সহিংসতার সময়ে ঈশ্বরের হাতের চেয়ে আর কোন কিছু স্বস্তি দিতে পারে না।