০৬-১০. এককাপ চা

ফ্ল্যাটে ঢুকেই অরা বিস্পতিকে ডেকে এককাপ চা করে দিতে বলল, লিকার, চিনি ছাড়া, একটু লেবু আর বিটনুন দিয়ে।

রুরু বলল, তোমার না প্রেশার বেড়েছে বলছিলে কালকে? বিটনুন খাওয়া কি ভালো?

–আমার ভালো, খারাপ নিয়ে তোর মাথা ঘামাতে হবে না। নিজের পায়ে দাঁড়া, ভালো করে পড়াশুনো কর। তোর লিটল ম্যাগ আর বাংলা ব্যাণ্ডের হুজুগ একটু কমা। জীবনে ‘সময়’-এর চেয়ে দামি আর কিছুই নেই। সময়ের জিনিস সময়ে না করলে পরে পস্তাতে হয়। যে-সময় চলে যায়, তা আর ফিরে আসে না।

রুরু অরার কাছে এসে অরার হাতের সঙ্গে নিজের হাত জড়িয়ে বলল, তোমার কী হয়েছে মা? শরীর খারাপ?

–হ্যাঁ। শরীরটা ভালো না। তা ছাড়া, স্কুলেও খুব ঝামেলা গেছে। এত নোংরা রাজনীতি স্কুলে, যে বলার নয়। সব ব্যাপারেই জনগণায়ন আর রাজনীতিকরণ দেশটার সর্বনাশ করে দিচ্ছে। ভবিষ্যতে এর কুফল যখন ফলবে তখন বড়োই দেরি হয়ে যাবে। এই ক্ষতি আর পূরণ হবে না কোনোমতেই। ওই মনীষা রায় মহিলা একেবারে পেইন ইন দ্যা নেক। তার ওপরে কোথায় তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে স্নান করে একটু শুয়ে থাকব এককাপ চা খেয়ে, না তোর অগ্নিকাকা স্কুলের সামনে পৌঁছে আমাকে নতুন গাড়িতে চড়িয়ে সেলিব্রেট করতে এল। সবসময়ে সকলের মন যে, সেলিব্রেশনের জন্যে তৈরি থাকে না, এ-কথাটা যদি সবাই বুঝত।

উনি কী করে জানবেন যে, তোমার শরীর খারাপ আর স্কুলে ঝঞ্ঝাট গেছে। উনি তো ভালোবেসেই নতুন গাড়ি নিয়ে তোমাকে চড়াবার জন্যে এসেছিলেন।

–সবসময়ে সকলের ভালোবাসা সহ্য হয় না। আজও মাইনে হল না। ইনক্রিমেন্টের পরে চার মাসের ব্যাক পে বাকি রেখেছে। এদিকে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। ব্যাঙ্কের সুদের হারও কমে গেছে। সঞ্চিত অর্থের রোজগার-ই যাদের প্রধান আশ্রয়, তাদের কথা তারাই জানে। শুধু মাইনের টাকাতে তো চলে না।…

-মা, আমি তোমাকে মাসে হাজার টাকা করে দেব।

-এখনও দরকার হবে না। তেমন প্রয়োজন হলে বলব। তোদের তো পকেট-মানি বলে কিছুই দিতে পারি না। নিজের সব খরচ তো তুই নিজেই চালিয়ে নিস। তাছাড়া তৃষা তো, প্রতিমাসেই দেয়। না, না, তোর কিছু দিতে হবে না। আজ মাইনেটা হলে মেজাজ এমন বিগড়ে যেত না। কাল সকালেই তো দুধওয়ালা, কাগজওয়ালা সব এসে হামলা করবে। রেশনও তুলতে হবে। বাড়তি টাকা বলতে হাতে তো কিছুই থাকে না।

তারপর বলল, যাই হোক, এ নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না। কালও মাইনে না হলে, ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে নেব। তুই তোর পড়াশুনোর চিন্তা কর।

.

০৭.

বিস্পতি চা-টা নিয়ে এলে চা খেয়ে, অরা স্নানে গেলেন। সব ঘরেই অ্যাটাচড বাথরুম আছে। নিজের ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দেওয়ার আগে বললেন, আমি স্নান করে একটু বিশ্রাম করব। তৃষা ফিরলে তোদের যদি খিদে পায় তো, তোরা খেয়ে নিতে পারিস। আমি পরে খাব। আর শরীর ভালো না লাগলে খেতে নাও পারি। ফোন এলে ধরিস। কেউ এলে দরজা খুলিস। কি-হোল’ দেখে নিয়ে দরজা খুলিস। দিনকাল ভালো নয়। গতকাল সন্ধেবেলাতেই তো ‘স্বর্ণালি’ অ্যাপার্টমেন্টে মস্ত ডাকাতি হয়ে গেল। আমাদের বাড়িতে নেওয়ার মতো তো, কিছু নেই–তবু হাতঘড়ির জন্যে, টিভি-র জন্যেও ডাকাতি হয় আজকাল।

–পুলিশ তো কিছু করে না।

-পুলিশ কী করবে। এত মানুষ। পুলিশের কী দোষ? পুলিশ ভগবান হলেও কিছু করতে পারত না। জনসংখ্যাই তো আমাদের দেশের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা।

–অথচ তা নিয়ে কোনো দলের-ই মাথাব্যাথা নেই একফোঁটা।

একথা বলে বিরক্তির সঙ্গে দরজা বন্ধ করে অরা ভেতরে গেল। ঘরে গিয়ে জামাকাপড় সব ছেড়ে একেবারে নিরাবরণ হয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়াল। বহুদিন পরে নিজেকে এমন মনোযোগ সহকারে দেখল। ভাবল, ওর কী এমন আছে যে, অগ্নি আজ ওকে এমন পাগলের মতো পেতে চাইল। এতবছর ধরে ওর কাছ থেকে ঠাঁই-নাড়া হল না।

তারপর স্নানঘরে গিয়ে গরম-ঠাণ্ডা জল মিশিয়ে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করল অরা, খুব ভালো করে সাবান মেখে। শরীরের মধ্যেও একটা জ্বলন বোধ করছিল–অগ্নির ওপরে রাগ যেমন হচ্ছিল, তেমন তার জন্যে দুঃখও হচ্ছিল। বেচারা! তার পক্ষে এতদিন ধরে এতকিছু করার পরে একদিন অরাকে শরীরে চাওয়াটা তো অপরাধের নয়। সে দেবতা বলেই এতদিন চায়নি। দেবতাদেরও তো চাওয়া থাকে।

ছাড়া-জামাকাপড় বাথরুমের কোণাতে রাখা ডার্টি লিনেন বক্সে ফেলে শায়া ব্রা কিছুই না পরে, শুধু নাইটিটা পরে বিছানাতে এসে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল অরা।

ঘুম যখন ভাঙল তখন ঘড়িতে দেখল, সাড়ে দশটা বাজে। দরজা খুলে রান্নাঘরে গিয়ে বিস্পতির কাছে শুনল যে, তৃষা ও রুরু দু-জনেই খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়েছে। কাল ওদের দু-জনকেই নাকি সকাল সকাল বেরোতে হবে।

অরা বললেন, তুমি খেয়ে শুয়ে পড়ো বিম্পতি। আমি কিছু খাব না।

–দুটো থোকা খাও মা অন্তত।

–না গো। শরীরটা ভালো নেই। আমাকে ঘরে এক বোতল জল আর একটা গ্লাস দিয়ে যাও। কাল ওরা যদি সকালেই বেরোয় তাহলে খাবার কিছু আছে তো?

–সব আছে মা। রুটি, ডিম, দুধ, কর্নফ্লেক্স, চিড়ে, ফল, যা-বলবে ওরা বানিয়ে দেব।

–ঠিক আছে। আমার উঠতে একটু দেরি হলে ওদের ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিয়ে। না খেয়ে যেন বাড়ির বাইরে কেউ না বেরোয়। তবে ওরা বেরোবার আগেই আমি অবশ্যই উঠে পড়ব।

–ঠিক আছে মা।

বিস্পতি বলল।

ঘরে এসে, খাটের পাশে রাখা চেয়ারটাতে কিছুক্ষণ বসে রইল অরা। বিস্পতি খাওয়া দাওয়ার পর ভলিউমটা কমিয়ে বসার ঘরে টিভি দেখে রাতে সাড়ে-বারোটা একটা অবধি। বাংলা সিরিয়াল। এই ওর রিক্রিয়েশান। তারপর, খাওয়ার ঘরের মেঝেতে পাখা চালিয়ে ওর বিছানা পেতে শুয়ে পড়ে চুল ছড়িয়ে। পাখার হাওয়াতে ওর চুলের নারকেল তেলের গন্ধ ওড়ে।

চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ ভাবল অরা। আজকের ঘটনার অভিঘাত, ওর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে। অগ্নির জন্যে যেমন কষ্ট হচ্ছে খুব, ওর নিজের জন্যেও হচ্ছে। কী ন্যায় আর কী অন্যায় ভেবে ঠিক করতে পারছে না। সাত-পাঁচ ভেবেও যখন কূলকিনারা পেল না, তখন আলো নিবিয়ে শুয়েই পড়ল।

মাঝরাতে কতগুলো পথের কুকুরের চিৎকারে অরার ঘুম ভেঙে গেল। বিছানাতে উঠে বসে শূন্যদৃষ্টিতে পর্দা দেওয়া জানলার ফাঁক দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল। পথের মার্কারি ভেপার ল্যাম্পের খয়েরি আলো এসে, ওর ঘরকেও আলোকিত করে দেয়। পেলমেট-এর নীচের পর্দা একটু ফাঁক করা থাকে। তা দিয়েই আসে আলো।

বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে লেখার টেবিলে এসে বসল অরা।

তারপর চিঠি লেখার প্যাড নিয়ে ব্যাগ থেকে কলমটা বের করে অগ্নিভকে চিঠি লিখতে বসল। চিঠিটা আরম্ভ করেই ওর মনে হল, ওর মন শান্ত হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। ওর খুব ইচ্ছে হল যে, অগ্নিভকে একটা ফোন করে দেখে সেও এমন জ্বলনে জ্বলছে কি-না–নাকি বেশি হুইস্কি খেয়ে শান্তি পাওয়ার জন্যে অঘোরে ঘুমোচ্ছে? কিন্তু ফোন তো বসার ঘরে। ওর নিজের মোবাইল ফোন নেই। ছেলেমেয়েরা নিজেরাই কিনেছে। অগ্নিভ অনেকবার বলেছে যে, ওকে এটা উপহার দেবে। কিন্তু কী দরকার? প্রয়োজন বাড়ালেই বাড়ে। প্রয়োজন বাড়ানোর কোনো শেষ নেই।” এই বলে অরা প্রতিবারেই ‘না’ করে দিয়েছে।

আজ রাতে এই প্রথমবার মনে হল তার একটা মোবাইল ফোন থাকলে আজ তার ঘরে শুয়ে শুয়েই অগ্নির সঙ্গে কথা বলতে পারত। মনে মনে ঠিক করল ব্যাক পে-টা পেলেই নিজের জন্যে একটা ফোন কিনে নেবে। অল্প টাকার ক্যাশ কার্ডেই চলে যাবে ওর। ক-টাই বা করবে ফোন।

কলম হাতে অনেকক্ষণ বসে থাকার পরে আরম্ভ করেছিল চিঠি লেখা। কী সম্বোধন করবে ভেবে পেল না। আগে আগে লিখত অগ্নিভবাবু, তারপরে অগ্নিবাবু, তারও পরে মশাই, তারপরে বন্ধু। মাঝে অনেকদিন চিঠি লেখেনি, দরকার হয়নি অগ্নিভ কলকাতাতে চলে আসায়। অগ্নিভই লিখত বেশি, অরা সংক্ষেপে জবাব দিত। আজ প্রথম সম্বোধন করল ‘প্রিয়বরেষু অগ্নি’ বলে। তারপরেই দেখল তার কলম তরতর করে লিখে চলেছে। তার বুকের মধ্যে এই সম্বোধনটি যে, কত দিন না-ফোঁটা ফুলকুঁড়ির মতো সুপ্ত ছিল তা ও নিজেও উপলব্ধি করেনি। আশিস চলে যাওয়ার পরেও তার যে, প্রিয়বরেষু’ বলে সম্বোধন করার মানুষ কেউ আছে, এইটে ভেবেই ওর মনে হঠাৎ শিহরন জাগল।

প্রিয়বরেষু অগ্নি,

এখন রাত কত জানি না। বিছানার পাশেই টেবিল ক্লক আছে। ইচ্ছে করলেই দেখা যায় কিন্তু ইচ্ছে করছে না। আমার জীবনে সময়ের কোনো ভূমিকা সম্ভবত আর নেই। গত সন্ধেতে তোমাকে দেখে, তোমার কথা শুনে আমার সব গোলমাল হয়ে গেছে।

জানি না, তুমিও জেগে আছ কি না। তোমার কথাতে আমার মনের ওপরে যে-অভিঘাত হয়েছে তেমন-ই তোমার মনের ওপরেও নিশ্চয়ই হয়েছে আমার কথাতে। এ-কথা মনে করেই আমি ভীষণ-ই কষ্ট পাচ্ছি।

তোমাকে কী বলব জানি না। তোমরা পুরুষ। তোমরা যত সহজে তোমাদের মনের কথা অকপটে প্রকাশ করতে পারো আমরা তা পারি না। আমরা মেয়েরা অন্য ধাতুতে তৈরি। নারীবাদীরা যতই সোচ্চার হন না কেন, নারীরা কখনোই পুরুষের মতো হতে পারবে না। পুরুষের পোশাক পরলে বা আমার মেয়ে তৃষার মতো পুরুষদের সঙ্গে সমান দায়িত্ব নিয়ে কাজ করলে বা, দেশবিদেশ চষে বেড়ালেও নারী আর পুরুষে তফাত থাকবেই। এটা বড়ো ছোটোর প্রশ্ন নয়। এটা গড়নের প্রশ্ন। আমাদের সম্পর্কটা পরিপূরণের, প্রতিযোগিতার নয়। নারীকে নইলে পুরুষের চলে না, নারীরও পুরুষকে নইলে চলে না। নারী, সে যতই স্বয়ম্ভর ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হোক না কেন, একজন মনের মতো পুরুষের কাছে সে, নিজেকে সমর্পণ করতে পারলে, তার শরীর এবং মনকেও নিবেদন করতে পারলে, সার্থক হয়।

তুমি আমার কাছে যা-চেয়েছিলে তা তুমি আশিস চলে যাওয়ার, কিছুদিন পরেই চাইতে পারতে। একবারের জন্যেও চাওনি যে, সে তোমার-ই মহত্ত্ব। এই দীর্ঘ সময়, তুমি শুধু আমার-ই নয়, আমার সন্তানদের জীবনেও যে-ভূমিকা পালন করেছ তা, অস্বীকার করার মতো নীচ আমি বা আমার ছেলেমেয়েরা কখনো হব বা হবে, তা আমার মনে হয় না।

তুমি যে, শুধু বন্ধুকৃত্যই করেছ তা নয়, আমার বুঝতে ভুল হয়নি যে, তুমি আমাকে প্রথম দেখার দিন থেকেই ভালোবেসেছ। তুমি জানো না যে, সে ভালোবাসা আমার ‘প্রসাদি’ ফুল।

তোমাকে একটা কথা বলব অগ্নি। ভালোবাসার নানারকম হয়। ভালোবাসার পাত্রপাত্রীরও নানারকম হয়। তুমি ও আমি কেউই সাধারণ নই। আমাদের এই অসাধারণত্বর গর্বটা যেমন আমাদের-ই, তার দুঃখটাও তেমনই আমাদের-ই।

আজ বাড়ি ফিরে স্নানঘরে নিরাবরণ হয়ে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে সাবান মাখতে মাখতে আয়নাতে নিজেকে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম যে, কী আমার আছে? যারজন্যে তোমাকে এত কষ্ট পেতে হবে বা আমি তোমাকে এত কষ্ট দেব? আমার কাছ থেকে তুমি যা চাও তা তো যেকোনো মেয়েই এত দীর্ঘদিনের মধ্যে তোমাকে দিতে পারত। এখনও দিতে পারে। সেই সহজ সুখে নিজেকে সুখী না করে এতদিন ধরে আমার জন্যে এবং আমার সন্তানদেরও জন্যে নিজেকে এত কষ্ট কেন দিলে তুমি? তুমি তো এখনও একটা বিয়ে করতে পারো। আজকালকার দিনে উনষাট বছর কোনো বয়স-ই নয়।

আসলে কথাটা কী জান? তুমি যে, আমার কাছে শুধুমাত্র একজন প্রিয় পুরুষ-ই নও, আমার প্রিয়তম-ই নও, তুমি যে, আমার দেবতা। তোমাকে যে, কুলুঙ্গির ঠাকুর করেছি আমি। সেই আসন থেকে তোমাকে নামিয়ে, বিছানাতে এনে আধঘণ্টার শারীরিক সুখ পেতে যে, আমি কখনো চাইনি। তুমিও নিজেকে জিজ্ঞেস করে দেখো যে, তুমি আমার এবং আমার তিন ছেলেমেয়ের কাছ থেকে তোমার সব কৃতকর্মের প্রতিদানে যে, নির্মল নৈবেদ্য পেয়েছ তার আনন্দর সঙ্গে আমাকে শরীরী আদর করার এলেবেলে কি কোনোভাবেই তুলনীয়?

তুমি জানো যে, আমার ছেলেবেলা কেটেছে হাজারিবাগে। আমরা ব্রাহ্ম। ব্রাহ্মসমাজ কম্পাউণ্ডের মধ্যে আমাদের বাড়ি ছিল না বটে তবে আমার বাবা হাজারিবাগের ব্রাহ্মসমাজের একজন মাথা ছিলেন। তিনি বিয়ে ও স্মরণসভাতে আচার্যর ভূমিকাও পালন করতেন। অভ্র খাদানের মালিক ছিলেন তিনি। গিরিডির মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতার মন্ত্রশিষ্য ছিলেন। পন্ডিত ও দেশপ্রেমী। আমাদের বাড়িতে যে, লাইব্রেরি ছিল, তা তুমি আশিসের সঙ্গে আমাকে দেখতে যখন হাজারিবাগে এসেছিলে তখন-ই দেখেছ। সেই লাইব্রেরি-ঘরে বসেই তোমরা দু-জনে আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলে। পরেও একাধিকবার গেছ। তখন আমার বাড়ির অন্য কেউই সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। আমি অতিসাধারণ কিন্তু আমি আমিই। তুমি দেবতা। এ জন্মে যা দিতে পারলাম না, সেই অপারগতার জন্যে তুমি আমাকে ক্ষমা করো। ক্ষমা না করতে পারলে আমার লজ্জা রাখার জায়গা থাকবে না। তুমি আমার জন্ম জন্মান্তরের প্রিয় তুমি তোমার জায়গাতেই থাকবে চিরদিন। আমি এখনও মনস্থির করতে পারিনি। আশিসের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতেও পারিনি। তা বলে তোমাকে আমি আশিসের চেয়ে একটুও কম ভালোবাসিনি। অবশ্যই জেনো, একথা আমার অন্তরের কথা।

আমার ছেলেমেয়ে এবং তাদের বন্ধু-বান্ধবীদের দেখে বুঝি যে, এই পৃথিবী বড়োই দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কিন্তু আমাকে আশীর্বাদ করো তুমি, আমাকে জোর দাও, আমি যেন না বদলাই। তুমি যেকোনো মেয়ের শরীরেই যেতে পারে। তাতে যদি তুমি আনন্দ পাও তাহলে আমি আনন্দিতই হব। এবং মনে কিছুই করব না।

আমি তোমাকে যা দিয়েছি, যা দিতে পারি, তাই নিয়েই এ জন্মে সুখী থেকো। যা দিতে পারি না, তার দুঃখ এমনিতেই আমাকে মর্মে মর্মে দুখি করে রেখেছে। সেই দুঃখ আমাকে চেয়ে তুমি আর বাড়িয়ো না। এইটুকুই প্রার্থনা।

এই ইন্টারনেট আর মোবাইল ফোনের যুগে এরকম চিঠি কেউ লেখে না জানি। কিন্তু ইন্টারনেটে কি এরকম চিঠি কারওকে কখনোই লেখা যেত? তাই আমার মনে হয় যে, ইন্টারনেট কাজের পক্ষে খুব-ই ভালো কিন্তু আমার তোমার মতো সম্পর্কে যারা বিশ্বাসী তাদের জন্যে নয়। আমরা অন্য যুগের অন্য মানব-মানবী, অন্য ‘মূল্যবোধ বিশ্বাসী। আমরা হয়তো শিগগিরই বাতিল হয়ে যাব কিন্তু তবু ওরা ওরা, আমরা আমরাই। এই গর্বটুকু নিয়েই যেন আমরা বাঁচতে পারি বাকি জীবন, এই আশীর্বাদ করো।

–ইতি–তোমার চিরদিনের অরা।

চিঠিটি লিখে, টিকিট লাগানো খাম বন্ধ করে, অগ্নিভর ঠিকানা লিখে, নিজের হাতব্যাগের মধ্যে রেখে, টেবিল লাইট নিভিয়ে অরা শুয়ে পড়ল। চিঠিটি লিখে ফেলতে পেরে, ওর অশান্ত মন শান্ত হল।

সকালে তৃষা দরজাতে ধাক্কা দিল—’মা, মা’ করে ডেকে। অরা ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলেন সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। পৌনে নটার মধ্যে বেরোতে হবে স্কুলে।

দরজা খুলতেই, তৃষা বলল, তুমি ভালো আছ তো? কাল রাতে কিছু খাওনি, এতবেলা অবধি ঘুমিয়ে আছ, কী হয়েছে মা তোমার? ডাক্তার সেনকে কি ফোন করব?

-না, না। কাল শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল। সম্ভবত প্রেশারটা বেড়েছিল। ব্রেকফাস্টের পরে ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।

–ডাক্তার সেনকে ডাকি না, প্রেশারটা চেক করে যাবেন।

সে কথার উত্তর না দিয়ে অরা বললেন, তুই এরই মধ্যে তৈরি হয়ে গেছিস?

–কী করব? আজ নটাতে মুম্বাই-র বড়ো ক্লায়েন্ট আসবে। প্রেজেন্টেশান আছে। কিছু কাজ এখনও বাকি। ফিনিশিং টাচ দিতে হবে। আমি ব্রেকফাস্টও করে নিয়েছি। বেরোতে হবে এখুনি মা।

-কী খেলি?

–দুধ আর কর্নফ্লেক্স। ব্যাগে কলা আর আপেল নিয়ে নিয়েছি। অফিসে গিয়ে কাজ করতে করতে খাব।

-তোর এই অ্যাড এজেন্সির কাজটা ছেড়ে দে। এ কী কাজ! রাত বারোটা একটা অবধি কাজ করতে হয় আবার সাতসকালে যাওয়া। দুপুরে কী খাস কে জানে! এমন করলে শরীর থাকবে?

–কাজ করলে শরীর খারাপ হয় না মা। বরং কাজ না করলেই হয়।

তারপরই বলল, এই নাও দু-হাজার টাকা রাখো। কাল এ.টি.এম. থেকে তুলেছিলাম তিন হাজার। রুরু বলছিল তোমার মাইনে হয়নি কাল।

–টাকা লাগবে না তৃষা। তুই তো মাসে পাঁচ হাজার দিস-ই আমাকে। আমার মাইনেতেই তো কুলিয়ে যায়। তোর এত কষ্টের রোজগার। তোর কাছেই রাখ। তোরও তো ভবিষ্যৎ আছে। বিয়ে করবি, সংসার করবি, ছেলেমেয়ে হবে, ভবিষ্যৎ-এর কথা না ভাবলে চলবে কী করে? তোর বাবার সঞ্চয় থেকে সুদও তো পাই–ইনভেস্টমেন্টস-এর ডিভিডেণ্ডস। তবে কোনো কোনো সময়ে একটু টানাটানি হয়। কিছুদিনের জন্যে। এই যা।

–দুধওয়ালা আর কাগজওয়ালাকে আমি টাকা দিয়ে দিয়েছি মা।

–তাই? রুরু বলেছিল বুঝি?

–হ্যাঁ।

–তোকে বলার কী ছিল?

–কেন? আমি কি সংসারের কেউ নই?

–তা কেন? তুই তো দিস-ই। পয়লা বৈশাখ আর পুজোর সময়েও দিস। তা ছাড়া, আটকে গেলে তোর অগ্নিকাকার কাছ থেকে ধার চেয়ে নেব।

অগ্নিকাকাকে আর কত জ্বালাতন করব মা আমরা? তা ছাড়া, আমাদের যখন টেনে টুনে চলেই যায়।

–টাকা তো নিই না এমনিতে। নিলে, ধার হিসেবেই নেব। তবে তার দরকার হবে না বোধ হয়। আজ চেক পেলে ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে আজ-ই টাকা তুলে নেব। তা ছাড়া ব্যাঙ্কেও আছে কিছু। এ নিয়ে তোদের চিন্তা করতে হবে না।

তারপর বললেন, রুরু কোথায়?

সে অগ্নিকাকার বাড়িতে গেছে স্নান করে। অগ্নিকাকা ফোন করেছিলেন। সেখানেই খেয়ে ইউনিভার্সিটিতে যাবে।

-কী হল আবার? সাতসকালে তোর অগ্নিকাকা শমন পাঠালেন?

–কীসব কথা আছে নাকি রুরুর সঙ্গে।

–ভালো লাগে না আমার।

–কেন মা?

–রুরুটার আত্মসম্মান জ্ঞান একটু কম আছে।

–এ কথা বলছ কেন মা? অগ্নিকাকা কি আমাদের পর?

–পর নয়তো কী? আর আপন হলেও তার কাছ থেকে আর কতরকমের উপকার নেওয়া যায়?

–অগ্নিকাকা নাকি গাড়ি কিনেছেন?

–হ্যাঁ। সেইজন্যেই তো ভাবনা। রুরুটা বড়ো হ্যাংলা হয়েছে। সে গাড়ি তার-ই ভোগে লাগবে হয়তো। তোর বাবার আত্মসম্মান জ্ঞান অত্যন্তই তীব্র ছিল। রুরুটা একেবারেই তার বাবার মতো হয়নি।

-অগ্নিকাকাও তো আমাদের বাবার-ই মতো। বিরক্তিমাখা মুখ তুলে অরা বলল, তুইও দেখি রুরুর মতো কথা বলছিস। তাঁর সঙ্গে কি আমার স্ত্রীর সম্পর্ক? একটা মানুষ নিজ স্বার্থপরায়ণ নয় বলেই কি, আমরা চিরদিনই তাঁর ওপর অত্যাচার করেই যাব?

তৃষা জবাব দিল না কোনো। বলল, টাকাটা রাখো। না লাগলে পরে আমাকে না হয় ফেরত দিয়ে। তোমার হাত একদম খালি।

–বললাম না, ভবিষ্যতের কথা ভাব।

তৃষা হেসে বলল, আমাদের বর্তমানটাই ভবিষ্যৎ মা। আমরা “ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পীবেৎ” এর যুগের ছেলেমেয়ে। আমাদের কাছে বর্তমানটাই সব।

–টাকাটা তুই-ই রাখ। বললাম, না যে, আমার দরকার নেই। মাইনে না পেলেও ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নেব।

.

০৮.

অগ্নিভর বন্ধু ব্রতীন আর নরেশ ওকে নিয়ে ‘আইনক্স’-এ সিনেমা দেখতে গেছিল। তারপর সেখান থেকে ক্যালকাটা ক্লাবে গিয়ে একটু হুইস্কি খেয়ে চাইনিজ খেয়ে ওরাই ওদের গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল। কলকাতাতে ওর বেশি বন্ধুবান্ধব নেই। নাগপুর, রায়পুর এবং মুম্বাইতে অনেক বন্ধুবান্ধুব আছে। এই বয়সে আর নতুন বন্ধু পাতানোর ইচ্ছেও করে না। মাঝে মাঝে ওদের-ই কারও গেস্ট হয়ে ক্যালকাটা সাউথ ক্লাবে বা টলি ক্লাবে টেনিস খেলে উইক-এণ্ডে। ব্রতীন বিবাহিত তবে নরেশ ব্যাচেলার। যেদিন ব্রতীন বলছিল নরেশ আর অগ্নিভকে ”A Bachelor is the souvenir of some woman who had found someone better than him at the last moment”. ব্রতীন বিবাহিত হলেও তার বাড়িতে বিশেষ নিয়ে যায় না কারওকেই। তার স্ত্রী খুব বড়োলোকের মেয়ে। তার ওপর দু-দিনটি শখের N.G.O.-র সঙ্গে যুক্ত আছে। হাই-সোসাইটির মহিলা। তাঁর উদ্ধত হাবভাব, ইংরেজিতে কথা বলা ইত্যাদি পছন্দ করে না অগ্নি। অগ্নি অরা, তার ছেলেমেয়ে এবং তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের নিয়েই খুশি ছিল এবং থাকে। ওর ধারণা অগণ্য মানুষের সঙ্গে ভাসা ভাসা সম্পর্কর চাইতে অল্পক-টি গভীর সম্পর্কের মধ্যেই একজন মানুষ সার্থক হয়।

তৃষার বিয়ে হলে গেলে ও কন্যা হারানোর শোক পাবে। রুরুকেও সে, নিজের ছেলের মতোই দেখে এবং সবরকম প্রশ্রয় দেয়। রুরু কম্পারেটিভ লিটারেচারে এম এ করার পর স্কলারশিপের পরীক্ষাতে বসে স্টেটস বা কানাডাতে পড়বে এমন ইচ্ছে রাখে। কানাডার মনট্রিয়ালের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার ইচ্ছে খুব ওর। স্কলারশিপ না পেলেও অগ্নিভই ওকে পাঠাতে পারে কিন্তু সেটা রুরুর পক্ষে সম্মানজনক হবে না। বাবার পয়সায় যারা বিদেশে পড়তে যায় তাদের প্রতি রুরু এক গভীর বিদ্বেষ পোষণ করে। অগ্নিও তেমন ছেলেদের অনুকম্পার চোখেই দেখে। মাঝেমাঝেই রুরু তার বাংলা-ব্যাণ্ডের বন্ধুবান্ধব বা লিটলম্যাগ করা তরুণ কবির দলকে নিয়ে অগ্নিকাকার বাড়িতে চলে আসে। একটু বিয়ার টিয়ার খায়। গান ও কবিতার চর্চা হয়। অগ্নি ওদের সঙ্গ পছন্দ করে। নানা কারণে ও এই তরুণ প্রজন্মে বিশ্বাসী। ওদের সঙ্গে মিশে ওর বয়েস কমে যায় বলেই ধারণা হয় অগ্নির। বন্ধুদের বলে, লিটল ম্যাগ-এর জন্যে বিজ্ঞাপন এবং বাংলা ব্যাণ্ডের জন্যে স্পনসরশিপ জোগাড় করে দেয়। এই দু-দলের গোটা কুড়ি ছেলে রুরুর বন্ধুত্বের খাতিরে তাকে অগ্নিকাকা বলে এবং নিঃসংকোচে নানা অত্যাচার করে। সেইসব অত্যাচার সইতে অগ্নির ভালোও লাগে। তার যা-সঞ্চয় আছে, তারজোরে এইসব তরুণদের নানাভাবে প্রশ্রয় দেওয়ার সামর্থ্য সে রাখে। কত স্বপ্নমাখা থাকে ওদের চোখে। মাঝে মাঝে দল বেঁধে ওরা নানা জায়গাতে বেরিয়ে পড়ে। অগ্নিকাকাকেও সঙ্গে নিতে চায় কিন্তু অগ্নি মুখ্যত অরার-ই কারণে যায় না। অরা একা থাকবে, কখন কী দরকার হয়, অসুখবিসুখ হয়, এইসব ভেবেই থেকে যায়। সকলে মিলে একবার পুণেতে গেছিল হর্ষদের সঙ্গে ক-টি দিন কাটাতে। হর্ষদের ছুটি ছিল সেই সময়ে। পুণে থেকে ওরা মহাবালেশ্বর এবং পঞ্চগণিতেও গেছিল। ভারি ভালো ছেলে হর্ষদ। অত্যন্ত বিত্তবান মা-বাবার একমাত্র সন্তান। গান ভালোবাসে, সাহিত্যও। নিজেও একসময় উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখত। ভীমসেন জোশীজি তো পুণেতেই থাকেন। তাঁর-ই এক শিষ্যর কাছে তালিম নেয় ও এখনও। মাঝে মাঝে এর তার বাড়িতে ছোটোখাটো জলসাতে গানও গায়। নাগপুরের বেঙ্গলি সোসাইটির প্রদীপ গাঙ্গুলিকে বলে নাগপুরেও একবার ওর গানের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল অগ্নিভ। তৃষার খুব-ই ভাগ্য যে, অমন ছেলের সঙ্গে সে ‘স্টেডি’ যাচ্ছে। তবে বিয়ের কথা দু-জনের কেউই বলে না। কবে যে, বিয়ে করবে তা ওরাই জানে। বিয়ে করলে, তৃষা নাকি চাকরি ছেড়ে দেবে। ও বলে, সন্তান পালন আর কেরিয়ার একসঙ্গে হয় না। ছেলেমেয়ে হলে তাদের কুকুর বেড়ালের বাচ্চার মতো চাকর বা আয়ার কাছে ফেলে রেখে কাজ করা তার একেবারেই পছন্দ নয়।

ওদের পৃথিবীটা আর সত্যিই নেই। সব স্বামী-স্ত্রীই আজকাল কাজ করে। স্বামীর যতই রোজগার থাক, স্ত্রীরা হাউসওয়াইফ হয়ে আর থাকতে রাজি নয় কেউই। মেয়েদের এই নবলব্ধ ‘স্বাধীনতার স্বাদ তারা পুরোপুরিই উপভোগ করে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও বদলে গেছে একেবারে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এই নীরব বিপ্লব ঘটে গেল। ভাবলে অবাক লাগে। অগ্নিভরা আর অরারা ক্রমশই অন্য গ্রহের জীব বলে গণ্য হচ্ছে। যদিও তারা দুজনেই অত্যন্তই আধুনিক তাদের মানসিকতাতে।

বাড়ি ফিরে গরম জলে স্নান করে টিভি-টা একটু খুলল। আজকালকার বাংলা বা হিন্দি সিরিয়াল ওর দেখতে ভালো লাগে না। অদ্ভুত ভঙ্গির নাচ আর তারসঙ্গে উদ্ভট গান অত্যন্তই বিরক্তি ঘটায়। ন্যাশানাল জিয়োগ্রাফিক চ্যানেল, ডিসকভরি চ্যানেল দেখে। কখনো-কখনো স্টার মুভিজ বা এইচ.বি.ও। সেখানেও শুধু মারপিট, গোলাগুলি। সারাপৃথিবীর মানুষের রুচিই কেমন বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। আগেকার দিনের মূল্যবোধ-সম্পন্ন ক্লাসিক’ ছবি আর দেখতে পায় না বলে মন খারাপ লাগে। ক্যাসেট বা সি.ডি. এনে দেখা যায়, কুঁড়েমি লাগে। নরেশ এবং ব্রতীন-ই মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে নন্দনে যায় ভালো ছবি দেখতে। ফিলম ফেস্টিভ্যালেও যায়। তখন সময় করতে পারলে অরাও যায়। অরা মাসে, দু-মাসে একবার ব্রতীন আর নরেশকে অগ্নিভর সঙ্গে অরাদের যোধপুরের ফ্ল্যাটে নেমন্ত্রণ করে খাওয়াও, তবে ব্রতীনের হাই-ব্রাওড স্ত্রী কখনো যাননি। নরেশের তো বউই নেই–সে একাই যায়। নরেশের বিয়ে হয়েছিল কিন্তু বিয়ের চারমাসের মধ্যেই ডিভোর্স হয়ে যায় অনেক বছর আগে। তারপর থেকে মেয়েদের ব্যাপারে ওর একটা ভীতি জন্মে গেছে।

দিনে যা চিঠিপত্র আসে তা একটি রুপোর ট্রেতে করে রুপোর পেপার-কাটারের সঙ্গে বিছানার পাশে রেখে দেয় চন্দন। অগ্নিভর ম্যান-ফ্রাইডে। কুক-কাম-ভ্যালে-কাম-এভরিথিং। নরেশ আর ব্রতীনকে তো বলেইছে, চন্দনকেও বলেছে একটি বয়স্ক ও বিশ্বাসী ড্রাইভার দেখতে। অগ্নি গাড়ি কেনাতে ও যেমন খুশি সেই গাড়ি যে, রুরুবাবুদের বাড়িতে থাকবে– এই খবরে সে একটু অখুশিও। অগ্নির ফ্লাটে কোনো গ্যারাজও নেই। ফ্ল্যাট কেনার সময়ে গাড়ি কেনার কথা ভাবেনি। গাড়িটা আপাতত পাশের পেট্রোল পাম্পে থাকে রাতের বেলা, দিনের বেলা অ্যাপার্টমেন্টের সামনেই পার্ক করানো থাকে।

চিঠির ট্রেতে তাকিয়েই একটা মোটা খাম দেখতে পেল। অরার হাতের লেখা। নাগপুরে থাকতে সপ্তাহে অন্তত একটি করে চিঠি পেত। অরার হাতের লেখাতেই-তার চরিত্রের সারল্য ও দার্ট পুরোপুরিই প্রকাশিত হয়। তাই অরার হাতের লেখা চিনতে তার কোনো

অসুবিধেই হল না। পিঠে একটা বালিশ দিয়ে আধশোয়া হয়ে শুয়ে পেপার-কাটার দিয়ে চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল।

চিঠিটি দু-তিন বার করে পড়ল অগ্নি। তারপর ঠিক করল কাল সকালে উঠেই এর উত্তর দেবে।

চিঠিটি পেয়ে ওর মধ্যে এক চাপা উত্তেজনা হল। বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেও ঘুম এল না। বারোটা নাগাদ উঠে পড়ে পাশের লেখাপড়ার ঘরের টেবিলে গিয়ে বসে রাইটিং প্যাড খুলে উত্তর দিতে বসল।

আনওয়ার শাহ রোড

টালিগঞ্জ

কলকাতা/বৃহস্পতিবার

কল্যাণীয়াসু অরা,

তোমার চিঠি আজ পেলাম।

আমি তো বাংলার শিক্ষিকা নই, তাই তোমার মতো ভালো চিঠি লিখতে পারি না, পারব না। ইংরেজিটা আমি বাংলার চেয়ে ভালো লিখি। এ সত্যটি গর্বের নয়, লজ্জার-ই, তবে ‘সত্য সত্যই।

আমি অত্যন্তই লজ্জিত। সেদিন যে, আমার কী হয়ে গেছিল আমি নিজেই জানি না। ঘামে তোমার দুই বগলতলির কাছে ব্লাউজ ভিজে ছিল। তোমার দু-নাকের পাটাতে ঘাম ছিল। এতবছর পরে যে-বাসনা আমার মধ্যে সুপ্ত ছিল তা হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছিল। ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল। আমার এতদিনের সংযমের বাঁধ ভেঙে গেছিল। এই লজ্জা আমার রাখার জায়গা নেই।

আসলে, তোমার বিয়ের দিন সালংকারা সুসজ্জিতা তুমি যখন, তোমাদের হাজারিবাগের বাড়ির সাদা মার্বেলের মস্ত হলঘর পেরিয়ে ঝাড়-লণ্ঠনের আলোর মধ্যে দিয়ে হেঁটে বাসরঘরের দিকে যাচ্ছিলে, সেইমুহূর্ত থেকেই তোমাকে আমি ভালোবেসে এসেছি। তোমাকে দেখে আমার বুকটা হু হু করে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, যা হবার তা হয়ে গেছে এ জন্মের মতো। মনে হয়েছিল, তুমি আমার-ই জন্যে এ পৃথিবীতে এসেছিলে। তোমার আর কোনো গন্তব্য নেই। তোমাকে নইলে আমার জীবন বৃথা। অথচ তখন তুমি আমার বন্ধুর বিবাহিতা স্ত্রী।

আশিস তার আগে আমার বন্ধু ছিল ঠিকই কিন্তু শুধু তোমার-ই কারণে আমি তাকে আমার প্রিয়তম বন্ধু করেছিলাম।

তোমাকে যখন দেখতে গেছিলাম তখনও, তোমাকে খুব ভালো লেগেছিল কিন্তু বিয়ের রাতে লাল বেনারসি পরা, জড়োয়াতে মোড়া তোমার রূপ আমাকে বিদ্ধ করেছিল। শুধুমাত্র রূপেই কেউ অমন মন কাড়তে পারে না। তোমার হাঁটা, মানে ঋতি, তোমার কথা বলার ধরন, তোমার হাসি, তোমার পায়ের পাতার গড়ন থেকে হাতের আঙুলের গড়ন, তোমার চোখ, চিবুক, তোমার গ্রীবা, তোমার পাতলা দু-টি ঠোঁট আমাকে কেন এমনভাবে আলোড়িত করেছিল তা বলতে পারব না।

সত্যিই বলছি যে, তোমাদের বিয়ের পরে বেশ কিছুদিন আশিসকে আমার খুন করতে ইচ্ছে করত। ছেলেমানুষি ইচ্ছে। অথচ সেই আশিস-ই যখন অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল তখন তোমার ও তোমার ছেলেমেয়েদের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম। সেদিন আমি হৃদয়ে বুঝেছিলাম যে, ভালোবাসার সব মহত্ত্ব ভালোবাসার জনকে সুখী’ দেখার-ই মধ্যে। নিজের বুকে তাকে টেনে নিয়ে পিষ্ট করার মধ্যে নয়। সেদিন, আমি আসলে-যা তার চেয়ে অনেক বড়ো হয়ে গেছিলাম। কোনো মানুষ-ই নিজের মহত্ত্ব অথবা নীচত্বর মাপটা প্রথম থেকেই জানে না, হঠাৎ কোনো অভিঘাতে তা বিদ্যুৎ চমকের মতো তার সামনে উদ্ভাসিত হয়।

আমি অতিসাধারণ একজন মানুষ। তুমিই আমাকে দেবত্ব দান করেছ। নিজের অজান্তেই তোমার সংস্পর্শে এসে আমি নিজের চেয়ে অনেক বড়ো হয়ে গেছি। তোমার চাবুক খাওয়ার আমার দরকার ছিল।

আমাদের উপনিষদে আছেঃ

আহার নিদ্রা ভয় মৈথুনম সামান্যমেতাৎ পশুভিঃ নরানাঃ
ধর্মহি তোষাম অধিকো বিশেষোঃ ধর্মেনাহীনা পশুভিসমানাঃ।

মানে, আহার, নিদ্রা, ভয় এবং মৈথুন মানুষেরও আছে পশুরও আছে কিন্তু যে-মানুষ ধর্মরহিত, সে পশুর-ই সমান। এই ধর্ম হিন্দু মুসলমানদিগের ধর্ম নয়, এই ধর্ম সকলের। এ ধর্ম মনুষ্য’ধর্ম।

আমার পশুত্ব তুমি ক্ষমা করো। আর যার সঙ্গে যাই করি না কেন, তোমার সঙ্গে এ জীবনে মানুষের মতোই ব্যবহার করব। দেবতা না হয়েও দেবতা সেজে থাকার চেষ্টা করব, দেবত্বর মূল্য দিতে নিজেকে কোনোরকম কষ্ট দিতেই দ্বিধা করব না।

তবে আমার কঠিনতম পরীক্ষার দিন শেষ হয়ে গেছে। আমার দুঃখরাত পেরিয়ে এসেছি। গত দু-যুগ মনে মনে তোমাকে চেয়ে যে, কী নিদারণ কষ্ট ভোগ করেছি তা আমিই জানি আর ঈশ্বর-ই জানেন। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলতেন “A man can be destroyed but he cannot be defeated”, আমি ধ্বংস হয়ে গেছি তোমাকে কামনা করে। কিন্তু হারিনি।

তবে একথা ঠিক যে, সে রাতে হারার কাছাকাছি এসেছিলাম কিন্তু সাধারণ্যের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া থেকে সেদিন তুমিই আমাকে বাঁচিয়েছ। তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ।

“আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি তুমি অবসর মতো বাসিও।
আমি নিশিদিন হেথায় বসে আছি তুমি অবসর মতো আসিও।”

অনেকদিন হয়ে গেছে এই গানটা তোমার গলাতে শুনিনি। একদিন শুনিয়ে অরা।

–ইতি তোমার কুলুঙ্গির উপোসি দেবতা

অগ্নিভ

.

০৯.

সেদিন অরা স্কুলের পিকনিক-এ যাবে বলে বাড়ি থেকে সকাল আটটাতে বেরিয়েছিল। যাবে, বাদুর এক বাগানবাড়িতে। সকলে মিলে বাসে করে যাবে স্কুল থেকে ন-টার সময়ে। তৃষা অফিসের কাজে মুম্বাই গেছে। সেখান থেকে উইকএণ্ডে হর্ষদের কাছে যাবে পুণেতে। হর্ষদ পুণে ক্রিকেট ক্লাবে ঘর ঠিক করে রেখেছে ওর জন্যে।

স্কুলে যখন টিচাররা ও মেয়েরা বেরোবার তোড়জোর করছে, এমন সময়ে মীনাক্ষীর হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হল। ভূগোলের টিচার মীনাক্ষী বিবাহিতা। একটি আট বছরের ছেলে আছে। স্বামী সেলস ট্যাক্স অফিসার। ওর বয়স হবে তেতাল্লিশ মত। খুব হাসিখুশি মেয়ে। তবে দিন তিন-চার হল খুব-ই মনমরা থাকত। পাপিয়া বলেছিল যে, মীনাক্ষীদের পাড়ার কার কাছে শুনেছে যে, তার স্বামী অফিসের-ই একজন আপার ডিভিশন ক্লার্ক-এর সঙ্গে অ্যাফেয়ার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ধরা পড়ে গেছেন চারদিন হল। ব্যাপারটা শুধু পাড়া প্রতিবেশীই নয়, অফিসের ওপর মহল অবধি পৌঁছেছে। সেজন্যেই নাকি মীনাক্ষী অমন অফ-মুড-এ থাকত এই ক-দিন। সঙ্গে ওর ছেলেকেও এনেছিল পিকনিকে নিয়ে যাবে বলে। ওদের কো-এড স্কুল, কোনো অসুবিধে নেই।

অ্যাটাক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে ওকে এস.এস.কে.এম-এ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ডাক্তাররা বলেছেনঃ ব্রট ডেড। সেই মর্মে ডেথ সার্টিফিকেটও দিয়েছেন। ওর স্বামীকে অফিসে এবং ওর শ্বশুরবাড়িতেও খবর দেওয়া হয়েছে। এখনও ডেডবডি নিয়ে যেতে কেউই আসেনি। পিকনিক বাতিল করে ছেলেমেয়েদের বাড়ি চলে যেতে বলা হয়েছে। মীনাক্ষীর ছেলেটা পাগলের মতো করছে। নীচু ক্লাসের ছেলেমেয়েদের বাড়িতে ফোন করে দেওয়া হয়েছে, যাতে বাড়ি থেকে কেউ এসে ওদের নিয়ে যান। টিচারেরা, যাঁরা পিকনিকে যাবেন বলে এসেছিলেন, তাঁরা সকলেই স্কুলেই রয়ে গেছেন। সকলেই মীনাক্ষীর গুণপনা নিয়ে আলোচনা করছেন। ভারী প্রাণবন্ত হাসিখুশি মেয়ে ছিল মীনাক্ষী। যাঁরা ওকে দেখতে পারতেন না এবং ওর সম্বন্ধে ঈর্ষাকাতর ছিলেন নানাকারণে, তাঁরাও এখন ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। মৃত্যু এসে মৃত মানুষের সব দোষ মুছে দেয়।

মীনাক্ষীর বাড়ি থেকে স্বামী, তাঁর অফিসের সহকর্মীরা, আত্মীয়স্বজন সকলে এসে বডি নিয়ে যেতে যেতে প্রায় একটা বাজল। টিচাররা এবং উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা একে একে ফিরে যেতে লাগলেন ও লাগল। একটা মিনি ধরে অরা যখন বাড়ি পৌঁছোল তখন আড়াইটে বাজল। মনটা বড়োই খারাপ হয়ে গেছে। ঠিক করল, বাড়ি গিয়ে বিস্পতিকে বলে এককাপ চা খেয়েই শুয়ে পড়বেন। খিদে তো নেইই কিছু খাওয়ার প্রশ্নও ওঠে না মনের এই অবস্থাতে। হেমিংওয়ের For whom the Bells Tolls-এর মুখবন্ধে আছে–

For whom the bell Tolls:

The bell tolls for Thee.

প্রত্যেক মৃত্যুর মধ্যেই অরা নিজের মৃত্যু’কে উপলব্ধি করে।

ওর কাছে দরজার চাবি থাকে তবে বিস্পতি আর রুরু বাড়িতে আছে বলে আজ আর চাবি নিয়ে যায়নি। যখন বাড়ি ফেরার কথা ছিল তখন রুরু কোথাও বেরোলেও বিস্পতি থাকবেই।

ফ্ল্যাটে পৌঁছে বেল দিতেই বেলটা কয়েকবার বাজলেও দরজা কেউই খুলল না। অবাক হলেন অরা। বেশ কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলল এসে রুরু। রুরুর মুখ-চোখ কেমন অপ্রকৃতিস্থ দেখাল। উদবিগ্ন হল অরা। দরজাটা খুলে দিয়েই প্রায় দৌড়ে গিয়ে নিজের ঘরের দরজাটা বন্ধ করে অরার কাছে ফিরে এসে যেন হতাশ গলায় বলল, কী হল? তুমি পিকনিকে গেলে না?

–না।

–কেন? কী হল?

–একজন অল্পবয়সি টিচারের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে স্কুলেই।

–কেমন আছেন?

–নেই।

বলেই, অরা জিজ্ঞেস করল, বিস্পতি কোথায়? ঘুমোচ্ছে? তোর খাওয়া হয়ে গেছে?

–হ্যাঁ তা হয়েছে।

–বিস্পতিকে একটু ডেকে দে তো।

–বিস্পতিদি খেয়ে সিনেমায় গেছে।

–সিনেমাতে?

অবাক হয়ে বলল, অরা।

তারপর বলল তিনবছর কাজ করছে কোনোদিন তো সিনেমাতে যায়নি? কোন হল-এ গেল?

-প্রিয়াতে। –

-প্রিয়া? সে তো অনেক দূরে। ও তো টিভির সিনেমা ছাড়া আর কোনো সিনেমা দেখে না। চিনে যেতে পারবে? টিকিট-ই বা কিনে দিল কে?

–আমিই কিনে দিয়েছি গতরাতে ওকে। আমি বাসেও চড়িয়ে দিয়ে এসেছি। বুঝিয়ে দিয়েছি কী করে আসবে। ফোন নাম্বার দিয়ে দিয়েছি। আসতে না পারলে ফোন করলে আমি গিয়ে নিয়ে আসব।

এমন সময়ে রুরুর ঘরের দরজা খুলে ভেতর থেকে চুমকি বেরিয়ে এল।

–তুই? কখন এসেছিস?

অবাক হয়ে বলল, অরা। ও একটা ষড়যন্ত্রর গন্ধ পাচ্ছিল। বেশ তীব্র গন্ধ।

-একটু আগে।

চুমকি বলল।

-খেয়েছিস কিছু?

–আমি খেয়ে এসেছি মাসিমা।

–কী করছিলি তোরা?

বিরক্তির গলায় বলল অরা। তার ও তৃষার অনুপস্থিতিতে বিস্পতিকে সিনেমা দেখতে পাঠিয়ে ওরা দু-জনে যুক্তি করেই ফাঁকা ফ্ল্যাটে যে, কেন এসেছে তা বুঝতে দেরি হল না অরার। মীনাক্ষীর মৃত্যুতে এমনিতেই কেঁদেছিল স্কুলে, এখন এই অঘটনে তার আবারও কান্না পেতে লাগল। ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল অরার।

অরা রুরুকে কিছু না বলে চুমকিকেই বলল, তুই রুরুর ঘরে কী করছিলি? বসার ঘরে টিভি না দেখে বা গানটান না শুনে?

চুমকি কেঁদে ফেলল হাতে মুখ ঢেকে। তারপর বলল, কিছু করিনি মাসিমা। তবে আপনি এই সময়ে ফিরে না এলে কী ঘটত জানি না!

–কী হয়েছে, মানে তোরা কী করছিলি? আমাকে সত্যি কথা বল চুমকি। নইলে আমি তোর মাকে এখুনি ফোন করব।

–অনেকদিন থেকে রুরু দেখতে চাইছিল।

–কী দেখতে চাইছিল?

–আমাকে।

–মানে? বুঝলাম না।

–মানে, আঙ্গাপাঙ্গা আমাকে। বলেছিল, শুধু একবার দেখতে চায়। কোনোদিনও দেখেনি। কারওকেই দেখেনি।

–আঙ্গাপাঙ্গা মানে?

অবাক হয়ে শুধোলেন অরা।

–মানে, আমার Nakedness। ও নাকি কখনো কোনো মেয়েকে Naked দেখেনি।

–তুই কী করলি?

–আমি কী করব? ও তো নিজেই আমাকে খাটে শুইয়ে জোর করে আমাকে আনড্রেস করে দেখল।

–তারপর কী হল?

–কিছুই হয়নি।

–অরা Awestruck হয়ে গেল।

–ঠিক সেইসময়েই আপনি বেল বাজালেন।

–রুরুর কাছে কনট্রাসেপটিভও ছিল? কনডোম-টনডোম?

–তা আমি জানি না মাসিমা। বোধ হয় ছিল না। ও সত্যিই আমাকে কিন্তু শুধু দেখতেই চেয়েছিল। ও খুব-ই ভদ্র ছেলে।

–তা তো বুঝতেই পারছি।

–আর ওর কথাতেই তুমি ওকে দেখতে দিলে?

–বহুদিন ধরে কাকুতি-মিনতি করছিল মাসিমা। বিশ্বাস করুন। তবে ওর মনে কোনো কু মতলব ছিল না।

–হ্যাঁ। তুমি পুরুষদের কতটুকু জানো?

তারপরে প্রায় অপ্রকৃতিস্থ গলাতে বলল, সংযমী হতে হয় মেয়েদের-ই। তুমি তো ছোটো মেয়ে নও চুমকি। কুড়ি বছর বয়স হয়ে গেছে। দেখতে চাইল বলেই রীতিমতো প্ল্যান করে ফাঁকা বাড়িতে মেয়েদের Modesty–যা সবচেয়ে মূল্যবান তাই তুমি বিকিয়ে দিতে এসেছিলে? তোমার মা জানলে তাঁরও তো হার্ট-অ্যাটাক হবে। আমারও হতে পারে।

-বিশ্বাস করুন মাসিমা। ও আমাকে শুধু আঙ্গাপাঙ্গাই দেখেছে। আর কিছুই করেনি।

উদ্ভট একটা ওয়ার্ড। ‘আঙ্গাপাঙ্গা’। কোন ভাষার শব্দ এটা?

–কোনো ভাষার নয়। আমার মায়ের কাছেই শোনা। আমাদের ছোটোবেলাতে মা চান করাবার সময়ে বলতেন, আঙ্গাপাঙ্গা হও, চান করাব তোমাকে।

অরার মুখে এসে গেছিল কথাটা। ও দৃঢ় গলায় চুমকিকে বলতে যাচ্ছিল, তুমি এ বাড়িতে আর কখনো আসবে না। কিন্তু বলতে গিয়েও বললেন না। দোষ তো চুমকির নয়, দোষ তো রুরুর-ই। উনিশ-কুড়ি বছরের ছেলেমেয়ে ওরা কি এখনও দেবশিশু? আঙ্গাপাঙ্গা দেখতে ও দেখাতে এমন তীব্র ইচ্ছা ওদের? শুধুই দেখতে?

কারওকেই কিছু না বলে অরা ঘরে গিয়ে শব্দ করে দরজা বন্ধ করলেন বিরক্তির তীব্রতম প্রকাশ ঘটিয়ে। তারপর দরজাটা খুলে চুমকিকে বললেন, তুমি রুরুকে আঙ্গাপাঙ্গা দেখোনি?

–না মাসিমা।

–কেন? তোমার ইচ্ছে করেনি?

-–না মাসিমা। আমাদের বাড়ির পাশের গলিতে রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, কুলি এরাসব শুশু করে। আমি ছোটোবেলা থেকেই অনেক দেখেছি। আমার কোনো উৎসাহ ছিল না। বিচ্ছিরি দেখতে।

কথা শুনে হাসবেন না কাঁদবেন বুঝতে না পেরে দুটো পাঁচ মিলিগ্রামের অ্যালজোলাম খেয়ে অরা জোরে পাখা চালিয়ে শুয়ে পড়লেন ল্যাণ্ড-লাইনের এক্সটেনশান রিসিভারটাকে নামিয়ে রেখে।

শুয়ে পড়ার আগে রুরুকে বললেন, দরজার চাবি নিয়ে যাও, চুমকিকে বাড়ি পৌঁছে, ‘প্রিয়া’ সিনেমার সামনে দাঁড়িয়ে থেকো। বিস্পতি গ্রামের মেয়ে, হারিয়ে গেলে পুলিশ-কেস হবে। তারপর বলল, আমার পরম সৌভাগ্য যে, তুমি বিস্পতির আঙ্গাপাঙ্গা দেখতে চাওনি। পুলিশে বলে দিলে তোমার জেল হয়ে যেত। মুখে চুনকালি পড়ত আমার। আর শোনো, আমি নিজে এই ঘটনার কথা তোমার অগ্নিকাকাকে বলব না। কাল তুমি গিয়ে নিজে বলবে। তারপরে তিনি যা-শাস্তি দেন তা দেবেন। বিস্পতিকে নিয়ে ফিরলে ওকে বোলো, আমাকে আটটার সময়ে এককাপ চা দিয়ে ঘুম থেকে তুলবে। স্নান করে আমি আবার ঘুমোব। রাতে খাব না কিছু। তৃষা পুণে থেকে ফোন করতে পারে। করলে বলবে যে, কাল কথা বলব।

অরা দরজাটা বন্ধ করল কিন্তু লক করল না। অরা শুয়ে শুয়ে ভাবছিল অগ্নিও হয়তো সেইদিন তাকে শুধু আঙ্গাপাঙ্গাই দেখতে চেয়েছিল।

এই পুরুষরা সত্যিই এক আশ্চর্য জাত। সত্যি। ব্যাপারটাকে ঠিক কীভাবে নেওয়া যাবে, কতখানি প্রাধান্য একে দিতে হবে, এ নিয়ে অগ্নির সঙ্গে পরে ঠাণ্ডামাথাতে আলোচনা করা যাবে। ছেলেটা কি তার একেবারেই বয়ে গেল এই বয়েসে। রুরু?

আঙ্গাপাঙ্গা।

শব্দটা মনে করেই আবার হাসি পেল অরার। তারপর-ই ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল। একাঘরে হেসেও ফেললেন একবার। যাই হোক, তার অসময়ে বাড়ি ফিরে আসাতে একটা মস্ত দুর্যোগ কেটে গেল তার জীবনের। ঈশ্বর যাই-ই করেন তাই মঙ্গলের জন্যে। মীনাক্ষীর অসময়ের মৃত্যুর শোকটাকে তার ব্যক্তিজীবনের এই কেটে যাওয়া দুর্যোগ যেন অনেকখানি লাঘব করে দিল।

.

১০.

পুণের ক্রিকেট ক্লাবটা ছোটো কিন্তু ভারি সুন্দর। ক্যালকাটা ক্রিকেট অ্যাণ্ড ফুটবল ক্লাব’-এর সঙ্গে অনেক মিল আছে। তবে ‘সি.সি.এফ.সি’ ক্লাবে কোনো গেস্টরুমস নেই। পুণের ক্রিকেট ক্লাব-এ আছে।

তৃষা এর আগে কখনো পুণেতে আসেনি। এবারেও এসেছে মাত্র দু-দিন একরাত্রির জন্যে। হর্ষদ ব্যাঙ্কের অফিসার। তার পক্ষেও ছুটি পাওয়া খুব মুশকিল, ছুটি ম্যানেজ করতে পারলে ওকে নিয়ে মহাবালেশ্বর এবং পঞ্চগণি ঘুরে আসত। তৃষা মুম্বাই থেকে ট্রেনেই এসেছে পুণেতে। যদি হাতে যথেষ্ট সময় থাকত তবে ম্যাথেরান-এ স্টপ ওভার আসতে পারত। এখন পুণে থেকে কলকাতা থ্রু ট্রেইন হয়ে গেছে। সেই ট্রেনেই ফিরে যাবে আগামীকাল। কিন্তু ‘মুম্বাই-কলকাতা’ প্লেনের টিকিটও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে ও। তবে এত শর্ট নোটিশে কনফার্মড সিট পাবে না হয়তো। তা ছাড়া, তাকে মঙ্গলবার অফিসে যেতেই হবে।

সকালে হর্ষদ ওকে গাড়ি ভাড়া করে শিবাজির একটা দুর্গ দেখাতে নিয়ে গেছিল। গাড়ি, ও অফিস থেকেই পেতে পারত কিন্তু ট্রাভেলিং অ্যালাউন্স থেকে বেশ কিছু বাঁচিয়ে নেয়। যখন দরকার হয় তখন ট্রাভেল এজেন্সি থেকে গাড়ি নিয়ে নেয়। খাদাকভাসালার পাশ দিয়ে পথ। হ্রদ আছে ওখানে একটা। তৃষার এক কাকা কমপিটিটিভ পরীক্ষা পাশ করে আর্মির কমিশানড অফিসার হওয়ার জন্যে, এই খাদাকভাসালার মিলিটারি আকাঁদেমিতে ট্রেনিং নিয়ে আর্মির কমিশনড অফিসার হয়েছিলেন। কাশ্মীরে সেই কাকা মারা গেছিলেন উগ্রপন্থীদের গুলিতে বছর পনেরো আগে। কাকা বিয়ে করেনি।

হর্ষদ বলছিল, দুর্গর ওপরে তৃষাকে নিয়ে কিছুটা চড়ে যে, ভাবতে পারো একজন মানুষ। এক জীবনে এতগুলি দুর্গম দুর্গ বানিয়েছিলেন, আজ দাক্ষিণাত্য বিজয় করছেন, কাল দিল্লির দরবারে বন্দি হয়ে যাচ্ছেন। আর এই ক্রিস-ক্রসিং করছেন জেট প্লেন-এ চড়ে নয়, স্রেফ ঘোড়ায় চড়ে। তখনকার দিনের মানুষদের শৌর্যবীর্যর কথা ভাবলেও নিজেদের লিলিপুট বলে মনে হয়। তাই নয়? তাঁরা যেসব অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করতেন তা আমরা হয়তো তুলতেই পারব না। অন্য এক সময় ছিল সেসব।

দুর্গের নীচেই ভালো ক্যানটিন আছে। মারাঠি খাবার পাওয়া যায়। সেখানেই কাড়হি, বেসনের রুটি, পোহা (মানে চিড়ে) এসব দিয়ে গাছতলাতে বসে জমিয়ে লাঞ্চ করল ওরা দু জন। হর্ষদ অনেক ছবিও তুলল তৃষার। তৃষা বলল, বেঙ্গালুরুতে আমার একটা চাকরির কথা হচ্ছে। যদি হয়, তাহলে ডিসেম্বর নাগাদ হবে। ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয়েন করতে হবে।

হর্ষদ বলল, আরে! আগে বলবে তো। আমি তো এদিকে তোমার-ই জন্যে কলকাতায় ট্রান্সফার চাইছিলাম। তোমাকে যদি বেঙ্গালুরুতেই আসতে হয়, তবে আমিও বেঙ্গালুরু চাইব। তাহলে বিয়ের কথাটাও ভাবা যাবে। মা ইন্টারনেটে রোজ-ই মনে করান।

মাসিমা আমাকেও বলেন মাঝে মাঝেই। গত সপ্তাহেও তত গেছিলাম। কলকাতাতে তোমাদের বাড়িতে।

–তুমি কী বলে?

–আমি কনভিনিয়েন্টলি তোমার ঘাড়ে দোষ চাপাই।

তৃষা বলল।

–আর আমিও তোমার ঘাড়ে। তবে ব্যাপারটাকে আর বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না মনে হচ্ছে। আগে তো তিন-চার বছর হানিমুন করে নেব। তারপর ফ্যামিলির কথা ভাবা যাবে। আসলে তুমি তোমার মা-বাবাকে এবং আমি আমার ভাবী শ্বশুর-শাশুড়িকে যতই ভালোবাসি বা পছন্দ করি না কেন আজকাল সকলেই আলাদা থাকতে চায়। আলাদা কিচেন, অপার স্বাধীনতা, বন্ধুদের আসা-যাওয়া, পার্টি…. আসলে এখন কোনো আধুনিক দম্পতিই বাবা-মাকে নিয়ে জড়িয়ে-মড়িয়ে থাকতে চায় না।

–আমার কথা আলাদা। আমার তো শুধুই মা–আর মা যে, আমাদের অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছেন।

–তোমার অগ্নিকাকা আছেন মাকে দেখার জন্যে। উনি তো আর একেবারে একা হয়ে যাবেন না।

-তা হলেও। অগ্নিকাকা তো বাবার অভাব পূরণ করতে পারবেন না।

তারপর বলল, তিন-চার বছর হানিমুন করতে করতে ততদিনে তোমার মাইনেও নিশ্চয়ই অনেক বেড়ে যাবে। আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে তখন ভালো মা হয়ে বাচ্চার দেখাশোনা করব।

হর্ষদ বলল, সুইটি পাই। দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল। আমারও তাই-ই ইচ্ছে। খাওয়া-দাওয়ার পরে একটা গাছতলাতে বসে হর্ষদ বলল, একটা গান শোনাও। কতদিন তোমার গান শুনি না।

-আমি কীই বা গান জানি। গান জানেন মা আর অগ্নিকাকা। সেদিন ভ্যালেন্টাইনস ডে তে কত যে, গান হল। মাকে আমাদের ছেলেবেলা থেকে অর্গান বাজিয়ে গান গাইতে শুনেছি। গানের আবহতেই বড়ো হয়ে উঠেছি আমরা। রবীন্দ্রসংগীত আর অতুলপ্রসাদের গানের আবহে। দিদিমাও খুব-ই ভালো ব্রহ্মসংগীত গাইতেন। অগ্নিকাকাও ভালো গান। কিন্তু পুরাতনি গান। নিধুবাবু, শ্রীধর, কথক দাশরথী রায়, গোপাল ওড়িয়া এঁদের গানও দারুণ গান। কীসব টপ্পা রে বাবা। আমরা গাইতে গেলে দাঁত খুলে যাবে। আমাদের রুরুও কিন্তু বেশ ভালো গায়। তবে আজকাল বাংলা ব্যাণ্ডের গান নিয়েই বেশি মেতেছে।

-এবারে গানটি গাও।

–কী গান গাইব?

–”তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে, এখন ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে।”

বেশ। বলে, গানটি গাইল তৃষা।

গান শেষ হলে হর্ষদ বলল, বাঃ। ভারি ভালো লাগল। আমরা যখন হানিমুনে যাব তখন কোন কোন গান শোনাবে আমাকে তার একটা লিস্ট বানিয়ে রেখো।

কিছু না বলে, হাসল তৃষা।

তারপর বলল, গ্লোব নার্সারি ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে ফুলগুলো কিন্তু ভারি সুন্দর দিয়েছিল। ইয়ালো রোজেস।

পুণেতে থাকাকালীন ওরা অন্য অনেক কিছুও করতে পারত কিন্তু করেনি। তৃষা সবসময়ই বলে, বাকি থাক কিছু। এখন থাক। সবকিছুই এখন-ই হয়ে গেলে ভবিষ্যতের স্বপ্নটাই মাঠে মারা যাবে। বিয়ে হোক। তারপরে সব হবে। তাড়া কীসের? সংযমী জীবনযাপনের মধ্যে যে, গভীর আনন্দ তা, আপাত-কষ্টেরও বটে। তবে যারা এই কষ্টটা স্বীকার করে নেয় স্বেচ্ছাতে, তারাই ভবিষ্যতে গভীরতর আনন্দের শরিক হতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *