‘কেঁচে গন্ডূষ’-এর একটি অনুষ্ঠান আছে আগামী রবিবারে, স্বভূমিতে। তার-ই মহড়া ছিল বোদেদার বাড়িতে। বোদেদার বাবা বড়ো ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালিস্ট। লনঅলা বাড়ি। একতলায় বসবার ঘরটাও মস্তবড়া। ওদের ব্যাণ্ডের মহড়া সাধারণত সেখানেই করে। কিন্তু এতবেশি ডেসিবল এ গাঁক-গাঁক করে বাজনা ও গান হয় যে, প্রতিবেশীরা পুলিশে ফোন করেছিলেন তিনদিন। তারপর থেকে মহড়া লন থেকে সরিয়ে বসার ঘরে করা হয়।
বয়স্করা বলেন, নয়েজ পলিউশন। কিন্তু উঁচুগ্রামে বাজনা এবং তারসঙ্গে উঁচুগ্রামে যৌবনদীপ্ত গান রুরুদের রক্তে নাচন তোলে। তবে এখন অলিতে-গলিতে বাংলা ব্যাণ্ডের জন্ম হয়েছে। সংখ্যাতে বেশি হলে যা হয় আর কী! তাই হয়েছে মান বিঘ্নিত হয়েছে এবং হচ্ছে।
রুরু আর একটা গান বেঁধেছে তার প্রথম দু-পঙক্তি হল এইরকম—
বৃন্দাবনে দেখে এলাম মাটি উঁচু নীচু
সেথা ময়ুর ময়ুরী নাচে উঁচু করে ফুচু।
বোদেদা বলেছে, জমিয়ে দিয়েছিস রুরু।
বোদেদাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বড়োরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়েছিল রুরু মিনি ধরবে বলে। এখন প্রায় সন্ধে ছ-টা বাজে। সকাল দশটা থেকে মহড়া শুরু হয়েছিল। দুপুরে লাঞ্চ খাইয়েছে বোদো। শুয়োরের সসেজ, সালামি বেকন ভাজা তারসঙ্গে ফ্রায়েড এগস এবং শুকনো শুকনো খিচুড়ি। একেবারে জমে গেছিল।
একটা বাস এল কিন্তু তাতে পা রাখার জায়গা নেই। পরের বাসের জন্যে অপেক্ষা করছিল, এমন সময়ে পেছন থেকে চুমকি ডাকল–কী রে রুরু। তুই বেপাড়াতে কী করছিস?
রুরু ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, তুইও বেপাড়াতে কী করছিলি?
–কোচিং নিতে এসেছিলাম। আমি তো তোর মতো ব্রিলিয়ান্ট নই।
–ছাড় তো। ব্রিলিয়ান্ট তো তোর বান্ধবী তৃষা, মানে আমার দিদি। নইলে প্রায় এক-ই বয়সি হয়ে পড়শুনোতে এততেজি হয়।
–তা অবশ্য ঠিক।
–মাসিমা কেমন আছেন?
–ভালোই। তবে কলকাতাতে নেই।
-কোথায় গেছেন?
–জানি না।
উদাসীন গলাতে বলল রুরু।
-মানে?
–মানে ফানে নেই। পরশু সকালে উঠে একটা নোট দেখলাম বসার ঘরের টেবিলে, মা লিখেছেন, আমি দিনকয়েকের জন্যে কলকাতার বাইরে যাচ্ছি। সব বাজার-টাজার করে দিয়ে গেলাম। বিস্পতিকেও সব বলে গেছি। তৃষা কলকাতাতে ফিরলে ওকেও এই চিঠি দেখিয়ো।
-হঠাৎ? মাসিমা কি এর আগে কখনো এমন করেছেন?
–না, কখনো করেননি।
–তৃষা কোথায়?
–সে তো কুয়ালালামপুরে। সত্যি! এই অ্যাড এজেন্সির কাজের কোনো মাথামুন্ডু নেই। হর্ষদদা পুণে থেকে তিনবার ফোন করেছিল। ওর সঙ্গে তো অন্তত মোবাইলে বা ই-মেইল-এ কথা বলতে পারে। কিছুই বুঝি না।
–দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলবি নাকি? তার চেয়ে আমাদের বাড়ি চল-না। মা-বাবা, কেউই নেই। আমিও একা। বাড়িতে শুধু রঘুদা আছে। দারুণ চাইনিজ রাঁধে রঘুদা। আমাদের বাড়িতেই খেয়ে যা-না। তুইও তো একা।
–বলছিস? তাহলে চল।
–তুই কি অগ্নিকাকার বাড়ি যাবি ভেবেছিলি নাকি? তাঁর বাড়ি তো কাছেই। গতসপ্তাহেই ওঁর বাড়িতে কী জমজমাট পার্টি হল বল? গান হল কত, খাওয়াদাওয়া, খাসির রেজালা, বাখখরখানি রুটি, বটি কাবাব আর রাবড়ি। আহা। এখনও মুখে লেগে আছে।
–অগ্নিকাকা থাকলে যাওয়া যেত। কিন্তু উনিও তো নেই কলকাতাতে।
বলেই বলল, তুই কি হেঁটেই যাবি?
–মিনিবাসের অপেক্ষাতে অনির্দিষ্ট কাল অপেক্ষা না করে থেকে হাঁটাই তো ভালো। আজকাল ট্যাক্সির যা ভাড়া। ট্যাক্সি করার মতো সামর্থ্যও আমার নেই।
–আমার তো নেই-ই।
–তুই আমাকেও পড়ালে, তোর আরও কিছু আয় বাড়ত।
–দুস। তোকে পড়ালে কি, তোর কাছ থেকে টাকা নিতাম নাকি?
অন্যদের কাছ থেকে নিতে পারিস আর আমার কাছ থেকে নিতে বাধা কী ছিল? তোর ‘ব্রিলিয়ান্স’-এর একটা দাম তত আছে।
–তা হয় না। তোর সঙ্গে আমার একটা আলাদা সম্পর্ক। সব সম্পর্কর মধ্যেই কি টাকাপয়সা আনতে হয়? আনলে, সম্পর্কর মাধুর্যই নষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া, বাধার কত্ত রকম।
–জানি না। হয়তো তুই ঠিক-ই বলছিস।
চুমকি বলল, অরামাসির জন্যে তোর চিন্তা হচ্ছে না?
–হচ্ছে বই কী। মা তো কখনো এমন করে চলে যাননি। দিদিও বার বার ই-মেইল করছে মায়ের ব্যাপারে জানতে চেয়ে কুয়ালালামপুর থেকে।
-”কয়েকদিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছি”–ব্যস এইটুকুই লিখে গেছেন শুধু?
–ঠিক ওইটুকুই নয়। তারপরে যা-লিখেছেন, তাতেই আমার চিন্তা আরও বেড়েছে।
–কী লিখেছেন?
–লিখেছেন যে, “তোমাদের বাবার মৃত্যুর পর থেকে তোমাদের পাখি-মায়ের-ই মতো দু-ডানার নীচে রেখে বড়ো করেছি। আজ তোমরা উড়তে শিখেছ। স্বয়ম্ভর হয়েছ। তৃষা তো স্বাবলম্বী হয়েই গেছে। তুমিও শিগগির হবে–তুমিও মেধাবী হয়েছ–তাই তোমাদের নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নেই। আমি আমার নিজের দিকে তাকাইনি কখনোই। নিজের সুখ, নিজের আনন্দ, নিজের অবকাশ বলতে আমার কিছুই ছিল না গত কুড়ি বছরে। এখন সময় হয়েছে এই কর্তব্যের বাঁধন থেকে, অভ্যেসের একঘেয়েমি থেকে নিজেকে অন্তত কয়েকদিনের জন্যে ছুটি দেওয়ার। আশাকরি তোমরা দু-জনে, আমার এই ছুটি না-মঞ্জুর করবে না।”
–এই অবধি বলে রুরু চুপ করে গেল।
চুমকি, রুরুর চিন্তিত, বিভ্রান্ত মুখের দিকে চেয়ে বলল, সত্যিই আশ্চর্যের ব্যাপার তো!
–আসলে মুশকিলটা কী হয়েছে জানিস–মায়ের অনুপস্থিতিতে আমাদের লোকাল গার্জেন অপমাসি আর মেসোমশাই। তাঁরা দু-জনেও কলকাতাতে নেই।
–তাহলে কি ওঁরা চারজনে একসঙ্গে কোথাও হলিডে করতে গেছেন? মানে, অগ্নিকাকাসুন্ধু? তোদের আসল লোকাল গার্জেন তো অগ্নিকাকাই। তোরা নিজেরাও তো শতমুখে সে-কথা বলিস।
তারপর বলল, যাই বল আর তাই বল, আমার কিন্তু পুরো ব্যাপারটা জেনে কারও জন্যেই একটুও চিন্তা হচ্ছে না, বরং খুব এক্সাইটেড ফিল করছি আমি। এ একটা গ্রেট অ্যাণ্ড প্লেজেন্ট মিস্ত্রি। ফুল অফ এক্সপেক্টেশান। রীতিমতো রহস্যময় ব্যাপার, তবে খারাপ কিছু ভাবিস না। আমি তো এই চারজনের হঠাৎ অন্তর্ধানের জন্যে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ-ই দেখছি না।
-না, তা নয়। তবে সব রহস্যময়তার মধ্যে চিন্তা তো থাকেই।
তারপর-ই বলল, চুমকি, আজকে তোর বাড়ি নাই বা গেলাম। আমার তো মোবাইল ফোন নেই। মায়েরও নেই। বাড়িতে দিদি আর মা ফোন করতে পারে। কাল রবিবার আছে। তুই-ই বরং কাল সকালে আয়। কী খাবি বল? বিস্পতি দিদি রাঁধবে। সারাদিন গান শুনব। ভালো ছবি দেখব। দিদি অনেকগুলো ভালো সিডি এনেছে কুয়ালালামপুরে যাবার আগের দিন-ই।
–দেখি। রাতে জানাব। তুই আবার অসভ্যতা করবি না তো কোনো?
–প্রমিস। করব না।
–তাহলে তুই তোর মিনি ধর। তোদের বাড়ি তো কাছেই, হেঁটেই তো যেতে পারিস। আমি বরং সামনের বাসস্টপ থেকে একটা মিনি ধরি। টা-টা।
-টা-টা।
.
৩২.
ঘোষসাহেব ও অরা হোটেলের ঘরের লাগোয়া বারান্দাতে বসেছিলেন। সামনে উথাল-পাতাল করছে সমুদ্র। পুরীতে গিয়েছিল অরা বিয়ের পরে পরে। কিছুদিন পরে গেছিল গোপালপুরে। পুরী আর গোপালপুর অন-সির সঙ্গে ভাইজাগ-এর অনেক তফাত আছে। গোপালপুরের সমুদ্রে স্নান করা যায় না। বড়ো বড়ো পাথর আছে জলের উপরে এবং নীচে। সকালে জেলেরা তাদের মাছ-ধরা নৌকো বোঝাই করে লাল-রঙা ভেটকি মাছ ধরে আনে। এইরকম লাল-রঙা ভেটকি কোথাও-ই দেখেনি অরা আগে।
ঘোষসাহেব অরাকে বললেন, আর ইউ হ্যাপি? মাদাম?
–হুঁ।
স্বল্পহাসি হেসে বলল। অরা। গতকাল প্লেনেই এসেছিল ভাইজাগ-এ, ওরা দু-জনে কিন্তু আলাদা দু-টি ঘরে আছে। দু ঘরে আছে চরিত্র বা সুনাম রক্ষার জন্য নয়। অরার অভ্যেস চলে গেছে বহুদিন কারও সঙ্গে একঘরে শোয়ার। তা ছাড়া শারীরিক সংসর্গ করবেন বলেও আসেননি, দু-জনে একসঙ্গে বাইরে। অপালাকে নিয়ে অগ্নি যে, পুরীতে গেছে এ, কথা ওরা দু-জনেই জানেন। ওঁরা লুকিয়েই গেছেন কিন্তু হয়তো ইচ্ছে করেই সূত্র রেখে গেছেন যাতে ঘোষসাহেব এবং অরা দু-জনেই জেনে যান ব্যাপারটা। ওদের দুজনকে-দুরকম কষ্ট দেওয়ার জন্যেই হয়তো গেছেন। ওঁরা।
সত্যি! মানুষের মন বড়ো দুর্জ্ঞেয়।
–রাতে ঘুম হয়েছিল মাদাম?
–না। প্রথম রাতে হয়নি। মাঝরাতে উঠে একটা পাঁচ মিলিগ্রামের অ্যালজোলাম খেয়েছিলাম। তার রেশ এখনও কাটেনি।
–আর একটু ঘুমোলেই তো পারতেন।
–পারতাম। কিন্তু আপনি একা উঠে বসে থাকবেন। ভেবেই, অপরাধী লাগল নিজেকে।
–অপরাধী লাগার তো কোনো কারণ নেই। আমরা তো কোনো অপরাধ করিনি। আমাদের একে অন্যর প্রতি তো করিইনি, অন্য কারও প্রতিও নয়।
–তা করিনি। তবুও অপরাধী লাগল। অপা আর অগ্নিও তো কোনো অপরাধ করেনি।
–না। তা করেননি।
–কিন্তু ওদের এই নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনের কারণ নিয়ে কি, কিছু ভেবেছেন আপনি?
–ভেবেছি।
–আর আপনি?
–আমিও ভেবেছি।
ঘোষসাহেব বললেন, কী ভেবেছেন আপনি?
–আসলে, অপাকে নিয়ে অগ্নির এমন করে বাইরে আসার পেছনে হয়তো, আমার-ই প্রচ্ছন্ন প্ররোচনা ছিল।
-বলেন কী? অপা আর অগ্নিকে আপনিই পাঠিয়েছেন নাকি?
–ঠিক তা নয়। অপা নয়, আমি অগ্নিকে বলেছিলাম যে, তুমি যেকোনো নারীতে যেতে পারো। শুধু আমাকে চেয়ো না। তাতে অসম্ভব আহত হয়েছিল ও।
–আপনিই বা অতনিষ্ঠুর হলেন কেন? কী হারাত আপনার? অগ্নিবাবু তো আপনার স্বামীর-ইমতো।
–স্বামী আর স্বামীর মতোতে তফাত আছে।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, ওকে আমি কুলুঙ্গির ঠাকুর করেছি। যে-আসনে ওকে আমি বসিয়েছি, সেই আসন থেকে ওকে টেনে নামিয়ে আনতে চাইনি। কিন্তু আমি ওকে দেবত্ব দান করলে কী হয় ও সেই আসন নিয়ে সুখী থাকতে পারেনি। ও একজন সাধারণ পুরুষের স্তরে নিজেকে নামিয়ে আনতে চেয়েছিল। হয়তো নামিয়ে এনেছিল।
-ও কি আপনার শরীর চেয়েছিল? চাইলেও আমি তো দোষ দেখি না। আপনার মতো একজন নারীকে না-চেয়ে থাকাও তো, কম কষ্টর ব্যাপার নয়। তা ছাড়া, আপনার ছেলেমেয়েরাও যখন ওকে বাবার মতোই মান্যিগণ্যি করে, ভালোবাসে। তা ছাড়া, এতদিন ও যখন আপনাদের জন্যে এত করেছে। ওকে বিয়ে করতে আপনার অসুবিধে কী ছিল?
অরা একটু হাসল। বলল, শরবাবুর ‘গৃহদাহ’তে সেই আছে-না, অচলা সুরেশকে বলছে: “একসময়ে যাকে বাঁচানো যায়, আর এক সময়ে ইচ্ছে করলেই বুঝি তাকে খুন করা যায়?”
তারপর বলল, তা ছাড়া, বাবার “মতো হওয়া” আর “বাবা হওয়া” তো সমার্থক নয়।
-না, তা নয়।
–আপনার আর অগ্নির মতো, কৃতবিদ্য পুরুষেরা হয়তো অনেক-ই বোঝেন কিন্তু সব বোঝেন না। অরা বলল।
–হয়তো তাই।
–এবারে আপনি বলুন, আপনি কী ভেবেছিলেন?
–মানে?
–মানে, অপা আর অগ্নির অমন একসঙ্গে চলে যাওয়া সম্বন্ধে।
ঘোষসাহেব বললেন, সেরকম কিছু নয়। মানে, কিছুই ভাবিনি। ইটস আ ফ্যাক্ট অফ লাইফ। আমি অপাকে দোষ দিই না। ও যা কিছু ওর স্বামীর কাছ থেকে চেয়েছিল, যেমন করে চেয়েছিল, তা আমি ওকে দিতে পারিনি। তবে ওর ওপরে আমার অভিমান এইটুকুই যে, আমি ওর কাছ থেকে আশা করেছিলাম যে, যতটুকু আমি ওকে দিতে পেরেছিলাম, তার দাম ও বুঝবে। আজকে আমি দিনরাতে পেশার কাজে কুব্যস্ত থেকে থেকে হয়তো চেহারাতে আনকুথ হয়ে গেছি কিন্তু যে, অঢেল স্বাচ্ছল্য এবং সামাজিক সম্মান ওকে আমি দিয়েছি তার পেছনে আমার স্যাক্রিফাইসও তো কম নয়।
–আসলে, স্ত্রী বা পুরুষ, আমরা কেউই তো স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। আমাদের প্রত্যেকের-ই কিছু না কিছু অপূর্ণতা থাকেই। আর অন্যক্ষেত্রে আমাদের সব সাফল্য ওই সামান্য অপূর্ণতার কারণেই হয়তো বাতিল হয়ে যায়।
-তা ঠিক। আর সেই অপূর্ণতার হাত ধরেই অন্য পুরুষ বা নারী আমাদের জীবনে প্রবেশ করে, লখিন্দরের লোহার বাসরঘরে যেমন করে সাপ প্রবেশ করেছিল।
-–’প্রবেশ করা’ কথাটার গভীরতা এক এক ক্ষেত্রে এক এক রকম। এই অনুপ্রবেশে শরীর যে, থাকবেই তার কোনো মানে নেই। এই ‘প্রবেশ’ বা অনুপ্রবেশ পুরোপুরি মানসিকও হতে পারে।
–তা পারে। অবশ্যই পারে।
–আমি যদিও অনেকদিন থেকেই একা তবু একদিন তো আমিও বিবাহিত স্ত্রী ছিলাম একজনের। তাই দাম্পত্যর রকমটা বুঝি।
অরা বলল।
–তা তো অবশ্যই বুঝবেন।
ঘোষসাহেব বললেন।
–তবে এত দীর্ঘদিন আপনার একা থাকার দরকার কী ছিল, আমি ভেবে পাই না। নিজেকে এমন করে বঞ্চিত করার কি দরকার ছিল কোনো? যেকোনো ব্যাপারেই আত্মত্যাগের মধ্যে আনন্দ অবশ্যই থাকে তবে এই ব্যাপারে একটা সীমারেখা টানা অবশ্যই দরকার বলে মনে হয় আমার।
তারপর বললেন, অগ্নির সঙ্গে আপনার যে-সম্পর্ক, তা পুরোপুরি মানসিক থেকে শারীরিকে গড়িয়ে যেতে বাধা কোথায় ছিল, সে-কথা আমি ভেবেও বুঝে উঠতে পারিনি।
–আমার সম্বন্ধে আপনি তো অনেক ভেবেছেন দেখছি।
অরা বলল।
–আপনার বহিরঙ্গ রূপ দেখে আপনার অন্তরঙ্গ রূপের কোনো হদিশ পাওয়া মুশকিল।
–হয়তো তাই-ই।
ঘোষসাহেব বললেন।
–তবে এ-কথা সত্যি যে, আপনাকে আমার খুবই ভালো লাগে, প্রথম আপনার সঙ্গে আলাপিত হওয়ার পরমুহূর্ত থেকেই। তাই যখন-ই অবকাশ পেয়েছি তখন-ই আপনাকে নিয়ে ভেবেছি। ভেবেছি, অগ্নিকে নিয়েও। আর যতই ভেবেছি ততই অবাক হয়েছি।
–অপা তো খুব-ই প্রাণবন্ত এবং উচ্ছল মেয়ে। ভালো মেয়েও। অপালার সান্নিধ্য সত্ত্বেও আপনি আমাকে নিয়ে এত ভাবাভাবি করলেন কেন?
–সব কেনর তো উত্তর হয় না অরা দেবী।
অরা হেসে ফেলে বলল, আবারও বলছি। আমি প্রচন্ড রকমের মানবী। দেবী’, দেবী’ করবেন না প্লিজ। দেবী বললে মনে হয় যাত্রা করছেন। আমাকে শুধুই অরা বলেই ডাকবেন আপনি।
–বেশ। তাই হবে মাদাম।
–অরা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আর এক কাপ চা খাবেন?
–আপনি দিলে বিষও খেতে পারি।
–বিষ দিতে যাব কেন আপনাকে? তা ছাড়া, এই আপনি-আজ্ঞে-টাজ্ঞেও কি পুরোনো হয়ে যাওয়া জামার-ই মতো ত্যাগ করা যায় না?
–থাকুক-ই না। কিছু পুরোনো জামা থাকে, যা অতিপ্রিয়। সহজে ফেলে দেওয়া যায় জেনেও ফেলা হয়ে ওঠে না, কেমন মায়া পড়ে যায়। আপনাকে এই ‘আপনি’ বলাটাও সেরকম-ই একটা অভ্যেস। দেবীত্বকে না হয় বিসর্জন দেওয়া গেল, আপনিটা থাকুক।
–যা আপনার ইচ্ছা।
–আপনিও তো আমাকে ‘আপনি’ই বলেন।
–অরা হেসে ফেলে বলল, যা-কিছুই আপনা-আপনি না ঘটে, তাকে না ঘটানোই ভালো।
–বাঃ। ভারি চমৎকার বললেন তো আপনি।
অরা সে-কথার জবাব না দিয়ে বলল, এই যে-আমরা ভাইজ্যাগ-এর হোটেলের বারান্দাতে ভরদুপুরের ঘুঘুর মতো একে অন্যের ঘনছায়ার নীচে বসে আছি, এটা আমার কাছে বিশ্বাস-ই হচ্ছে না। অথচ এ এক অন্য গাছ, অন্যরকম পাতা সে গাছের, অন্যরকম ছায়া। এবং এ কথাও সত্যি যে, আমরা দুজনেই, দু-জনের পুরোনো গাছে ফিরে যাব। সেই পুরোনো গাছটিই স্থায়ী। নিত্য। আর আমাদের এই হঠাৎ-উৎসাহটাই অনিত্য। একেবারেই টেম্পোরারি। তাই-না? এটা একটা দুর্ঘটনা।
–হয়তো তাই। কিন্তু কিছু দুর্ঘটনা হয়তো থাকে যা, সুখবহ। এও তেমন-ই এক দুর্ঘটনা।
–তা তো বটেই! আসলে আপনি অগ্নির কাছে, আর আমি অপার কাছে নিজেদের নতুন করে প্রমাণিত করতে চেয়েছিলাম হয়তো।
–হয়তো তাই। “আমি নারী আমি পারি”–এ কথাটাও হয়তো নিজের কাছে প্রমাণ করার ছিল।
–অগ্নি কি বিশ্বাস করবে যে, আমরা হঠাৎ করে বাঁধন ছিঁড়ে বাইরে এলেও আমরা আলাদা ঘরে আছি। অগ্নির প্রিয়তমা অরাকে যে, আমি স্পর্শও করিনি, সেইকথা?
একটু ভেবে অরা বলল, অগ্নিকে যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয় যে, করবে বিশ্বাস। আর এ-কথা ও অবিশ্বাস করলে, আমাকে ও ক্ষমা করবে না। হয়তো খুন-ই করে দেবে। তবে মনে হয় না তা। সে খুব বুঝি মানুষ।
–এতই যদি বুঝি, তাহলে পরস্ত্রীকে নিয়ে এমনভাবে পালিয়ে গেল কেন? তাও আবার ব্যারিস্টারের স্ত্রীকে নিয়ে। দুঃসাহস তো কম নয়।
–পরস্ত্রীটি তো নাবালিকা নয়। তাই অগ্নি তাকে ইলোপ করেছে একথা বলা চলে না। পরস্ত্রীটি যথেষ্টই সাবালিকা এবং অগ্নির জন্যে সে, অনেক-ই দিন হল প্রেম ও কাম জরজর। তা ছাড়া ইলোপ তো করেনি। দাম্পত্যর একঘেয়েমি কাটাবার জন্যেই হয়তো।
–আচ্ছা, ওরা কোথায় যেতে পারে তা নিয়ে আপনার কোনো মাথাব্যথা নেই?
–না। একটুও নেই। পাখি কখন খাঁচা থেকে উড়ে যায় তখন কোন দিকে যায় আদিগন্ত সুনীল আকাশে সেটা বড়োকথা নয়, উড়ে যে গেল, এইটাই বড়োকথা। চিরদিনের মতো গেলে চিন্তা হয়তো হত। পায়রারা যেমন সন্ধের আগে গ্রামীণ গৃহস্থের বাড়ি ফিরে এসে, বাড়ির টিনের চাল-এ সার দিয়ে বসে, অপাও একসময়ে ফিরে এসে আমার ঘরেই সেঁধোবে। কিছুদিনের জন্যে ঠাঁই-নাড়া হয়েছে মাত্র। এটা ওর শরীর ও মনের স্বাস্থ্যের জন্যে খুবই ভালো হল।
অরা বলল, আপনি আশ্চর্য মানুষ সত্যি। অপালার দুর্ভাগ্য যে, ও আপনাকে ঠিক বুঝতে পারল না।
–কেই বা কাকে ঠিকমতো বোঝে। সবাই ঠিকঠাক অন্যকে বুঝতেই যদি পারত তবে আর গোল ছিল কী? কে জানে! সব মানুষের মধ্যে দুর্বোধ্যতা হয়তো ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই রোপিত হয়েছে। প্রত্যেক মানুষ এইজন্যেই বোধ হয় এত ইন্টারেস্টিং।
তারপরে একটু চুপ করে থেকে ঘোষসাহেব বললেন, আমার স্ত্রী অপা কি প্রেম আর কাম-এর মধ্যে তফাত বোঝে? আপনার কী মনে হয়?
অরা একটু চুপ করে থেকে বলল, ঠিক জানি না। নাও বুঝতে পারে। খুব কম মানুষই বোঝে।
–এই যে ‘জরজর’ শব্দটা ব্যবহার করলেন আপনি, এতে আমার জ্বর-এর কথা মনে পড়ে গেল। জ্বরের কতরকম হয় আপনি কি জানেন?
–টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হিট-ফিভার এইসব জানি।
–না, এ ছাড়াও মানুষের জ্বর হয়। অন্যরকম জ্বর। তারমধ্যে কামজ্বর-ই প্রধান। কারও কারও আবার ভাল্লুকের জ্বরও হয়।
–ভাল্লুকের জ্বর? সেটা কীরকম?
ভরতি চায়ের কাপটা ঘোষসাহেবের দিকে ঠেলে দিতে দিতে বলল, অরা।
–সেই জ্বর হঠাৎ করে আসে আবার হঠাৎ করে ছেড়েও যায়। অনেকের কামজ্বরও এমন ভাল্লুকের জ্বরের-ই মতো।
বলেই, বললেন, তবে অপার কামজ্বর, ভাল্লুকের জ্বর নয়। আসলে ও খুব-ই শরীর সর্বস্বী। তা ছাড়া, ও বৈচিত্রেও বিশ্বাসী। তবে ও একদিন বুঝতে পারবে, রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতার মানে।
–কোন কবিতা?
অরা বলল।
–”যাহা পাই তাহা ভুল করে পাই, যাহা চাই তাহা পাই না।”
অরা বলল, অপা তো বটেই অগ্নিও এত শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান হয়েও একটা ব্যাপারকে জীবনে উপলব্ধি করেনি। অথচ করা উচিত ছিল দু-জনেরই।
-কী ব্যাপার?
–মানুষের মুক্তি আসে তার ‘মন’-ই মাধ্যমে, শরীরের মাধ্যমে নয়। শরীরের প্রয়োজন স্বীকার করে নিয়েও বলছি। সেই মুক্তি গৃহীর-ই হোক, কী সন্ন্যাসীর।
–এ তো অনেক গভীর কথা। সাধু-সন্তদের কথা। এ কথা ওর কেন? আমার মতো সাধারণ মানুষেও বুঝবে এটা আশা করাই অন্যায়।
ঘোষসাহেব বললেন।
-জানি না। এটা বুঝতে অসাধারণত্বর কী দরকার?
–আপনার মতো যাঁরা অসাধারণ, তাঁরা নিজেদের অসাধারণত্ব সম্বন্ধে নির্বিকার, উদাসীন। আমি আপনার মতো অত জানি না।
অরা বলল, আমিও বিশেষকিছু জানি না। তবে সেইন্ট অগস্তিনের, সেই উক্তির-ই মতো আমি বিশ্বাস করি যে, ‘The sufficieny of my knowledge consists in knowing that my knowledge is not sufficient’.
-বাঃ। সুন্দর কথা তো!
ঘোষসাহেব বললেন।
তারপর বললেন, রুরু আর তৃষার কথা আপনার মনে হচ্ছে না?
–হচ্ছে না তা নয়, মনে হচ্ছে। কিন্তু বাঘিনিও তার বাচ্চাদের বড় করে তুলে তাদের স্বাবলম্বনের শিক্ষা দিয়ে, একটা সময়ে তাদের ত্যাগ করে। কারও ছেলেমেয়েই তাদের চিরদিনের নয়। তাদের একটা সময়ে পৌঁছে, ছেড়ে দিতেই হয়। তাদের কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করাটাও উচিত নয়। পশ্চিম দেশ-এ কেউ করেও না। ওদের জীবন ওদের। পশ্চিমি জগতের অনেক কিছুই আমার ভালো লাগে না কিন্তু ওদের এই ‘স্বাবলম্বন’-এর ঐতিহ্যটা আমার খুব ভালো লাগে। আসলে, প্রত্যেক মানুষ-ই চিরদিনের একা। মায়ার বাঁধনে, কর্তব্যের বাঁধনে, কম বা বেশিদিনের জন্যে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে-জড়িয়ে থাকি এইমাত্র। আমরা যে, একা-এই সত্যটা খুব কম মানুষ-ইউপলব্ধি করে।
তারপর বললেন, চলুন ব্রেকফাস্ট করে গাড়ি নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি অরাকু ভ্যালির দিকে। এই পথের সৌন্দর্য-ই আলাদা। লাঞ্চ বাইরেই করে নেব। ফিরে এসে রাতে ডিনার খাব হোটেলেই। শ্রীকাকুলম দেখিয়ে আনব আপনাকে।
–শ্রীকাকুলম কোথায়?
-ওই পথেই পড়বে। উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়ির পরে এই শ্রীকাকুলমে, এই নকশাল আন্দোলন ভিত পেয়েছিল। দেশের যা অবস্থা, আমার নিজেরই মাঝে মাঝে নকশাল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। এই ভুড়ি নিয়ে তো, এখন বন্দুক রাইফেল হাতে জঙ্গলে পাহাড়ে ঘুরতে পারব না। কিন্তু আমি ব্যারিস্টার বলেই বলছি। সারাজীবন আইনি তামাশা দেখার পর আমারও মনে হয় যে, সব ক্ষমতার উৎস হচ্ছে বন্দুকের নল। এখনও বঙ্কিমচন্দ্রের সেই উক্তি “আইন! সে তো তামাশামাত্র! বড়োলোকেরাই পয়সা খরচ করিয়া সে তামাশা দেখিতে পারে” আজও সত্যি। গণতন্ত্র যদি সত্যি গণতন্ত্রই না হয়ে উঠতে পারল, পঞ্চাশ বছরের বেশি সময়ে–চারদিকে এত দুর্নীতি, এত অনাচার অত্যাচার, গরিব আরও গরিব হয়ে রইল আর পয়সা আর ক্ষমতা কুক্ষিগত হল সামান্যসংখ্যক মানুষের হাতে, তাতে এ ছাড়া পথই বা কী?
-একজন ডাকসাইটে ব্যারিস্টার যদি, এ-কথা বলেন তবে তো অবশ্যই চিন্তার কথা।
–চিন্তা আর কে করে এখানে? সকলেই তো নিজের নিজের স্বার্থ, অর্থ আর যশের চিন্তাই করে। দেশ নিয়ে ভাবে আর ক-জন!
–সত্যি! এসব কথা ভাবলেও উত্তেজনা হয়।
–আমাদের ছোটো ছোটো সুখ, ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া নিয়েই আমরা ব্যতিব্যস্ত সর্বক্ষণ, দেশ-এর মতো বড়োব্যাপার নিয়ে ভাবার সময় কার আছে? অথচ ‘দেশ না থাকলে যে, আমরাও থাকব না’ –এই সরল সত্যটা কাররো-ই মাথায় ঢোকে না।
.
৩৩.
অগ্নি বলল, পৃথিবীর এত দেশের এত সমুদ্রতীরে গেলাম, অথচ পুরীর সমুদ্রের মতো চান করে আরাম আর কোথাও-ই নেই।
ও আর অপা সমুদ্রমুখী বারান্দাতে বসে ছিল। পুরীর একটি নতুন হোটেলে।
তারপর বলল, ভালো লেগেছে তোমার?
–খু-উ-উ-ব। আর তোমার?
–আমি তো উপোসি ছারপোকা হয়েই ছিলাম। তোমাকে চেটেপুটে খেয়ে যে-সুখ। পেলাম, পাচ্ছি, তার কোনো তুলনা নেই।
-চলো, ব্রেকফাস্ট করে আমরা সমুদ্রস্নানে যাই। তারপর ফিরে এসে তোমাকে নিজে হাতে স্নানঘরে স্নান করাব আজ আমি। নোনাজলের চ্যাটচেটে ভাব তুলে দিয়ে, মিষ্টিজলে সাবান দিয়ে তোমাকে নতুন করে নিয়ে আবারও আদর করব।
অগ্নি বলল।
–আমরা কি হানিমুনিং কাপল?
–আমার তো হানিমুন হয়নি। কী করে তুলনা করি?
অপালা বলল, আমাদের বিয়ের পর গোপালপুর অন সি-তে হানিমুনে গেছিলাম। তখন চান করা, খাওয়া আর ঘরে আগল তুলে ঘনঘন আদর। একজন চাইনিজ ম্যানেজার ছিল আমাদের হোটেলের। সে তোমার ঘোষসাহেবকে আলাদা করে ডেকে বলেছিল, “ইউ সি, দেয়ার আর ওনলি টু ওয়েজ উইথ দ্যা উইমেন। আইদার ইউ কিস দেম অর কিল দেম ইউ, দেয়ার ইজ নো ইন-বিটউইন ওয়ে।”
–ঘোষ সাহেব কী বলেছিলেন?
কৌতুকের স্বরে বলল অগ্নি।
–ঘোষসাহেব বলেছিলেন, হাউ বাউট ইয়োর ওয়াইফ? উত্তরে সেই চিনে বলেছিল, ইউ থি, আই কুদ নাইদার কিস হার নর কিল হার। থো আই লেফট তায়না অ্যাণ্ড কেম টু ইন্দিয়া।
হো হো করে হেসে উঠল অপা।
তারপর বলল, সত্যিই মনে হচ্ছে আমরা হানিমুনিং কাপল।
অগ্নি বলল।
–শরীরের মধ্যে যে, এতসুখ আছে, তা তুমি আমার জীবনে না এলে বোধ হয় কখনো জানতেই পেতাম না। অরা জানলও না, জীবনে ও কী হারাল।
–অরা আর দশজনের মতো নয়। ওর সুখদুঃখ ওর-ই একার! ও দেবী।
–দেবীরা দূরে থাকলেই ভালো। তাদের পুজো করা যায় কিন্তু তাদের কাছে আনা যায় না।
–কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ বলেও তো কিছু নেই। আমি তোমার সঙ্গে চলে এসে দুঃসাহসী হয়েছি বটে কিন্তু আমাকে তো ঘোষসাহেবের ঘরে ফিরেই যেতে হবে ক-দিন পরেই। আমাদের সন্তান না থাকলেও ঘর-ভাঙাটা আমার দ্বারা সম্ভব হবে না।
–অরা, তৃষা এবং রুরুকে জড়িয়ে আমার যে-জীবন, সেই জীবনেরও একটা আলাদা আনন্দ আছে। আমার এই মিথ্যেঘরও আমার পক্ষে ভাঙা সম্ভব নয়।
অগ্নি বলল।
–আমরা এইভাবে চলে এসে, দু-জনে দু-জনের শরীর নিয়ে অনেক খেলা করছি বটে, গভীর শারীরিক আনন্দে বদ্ধ হয়ে রয়েছি বটে, কিন্তু মিথ্যে বলব না, উজ্জ্বলের ওপরে আমার যা-কিছু অভিমান ছিল, সব-ই ভেঙে গেছে। মানুষটাকে আমি যেন এক অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছি। এখন মন চাইছে, কখন ফিরে যাব। মানুষ অত্যন্ত নীচ ও নিজ স্বার্থপরায়ণ না হলে, তার পক্ষে ঘর ভাঙা সম্ভব নয়।
–উজ্জ্বল মানে?
–আরে! তোমাদের ঘোষসাহেবের নাম তো উজ্জ্বল ঘোষ-ই।
–ও। ভুলে গেছিলাম।
অগ্নি বলল।
–ঘর ভাঙাটা উচিতও নয়।
অগ্নি বলল।
–বাঃ।
বলল, অপা।
তারপর বলল, তোমার সঙ্গে এসে এখন বুঝতে পারছি যে, দাম্পত্যটা একটা ঘর। কিন্তু সব দাম্পত্যর-ই একটি বারান্দা থাকা উচিত। দাম্পত্যকে সুন্দর করে তুলতে। এই বারান্দাই পরকীয়া। ঘর ছেড়ে এই বারান্দাতে এসে দাঁড়ালে একটু চাঁদের আলো, পাখির ডাক, ফুলের গন্ধে নিজেকে নবীকৃত করা যায়। কিছুক্ষণ বারান্দাতে থাকলেই ঘর থেকে ডাক আসে। মেয়ে বলে, মা ব্লাউজ খুঁজে পাচ্ছি না, স্বামী বলেন টাইটা বেঁধে দাও, ছেলে বলে, মা খাবার দাও, এখুনি বেরোতে হবে। তারপর-ই ঘরে ফিরে যেতে হয়। প্রত্যেক বিবাহিত স্ত্রী ও পুরুষের জীবনেই একটি বারান্দার দরকার। এই বারান্দাই দাম্পত্যর সবচেয়ে বড়ো সেফটি-ভালভ। যে-বিবাহিত স্ত্রী-পুরুষের জীবনে একটি বারান্দা নেই তারা সাংঘাতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে বাধ্য। না থাকলে, অধিকাংশক্ষেত্রেই তাদের দাম্পত্য একঘেয়েমি আর অভ্যেসেই পর্যবসিত হয়। তাতে হয়তো আর কোনো মাধুর্যই থাকে না, তা তাঁরা স্বীকার করুন আর নাই-ই করুন। তবে এ কথাও বলব যে, ব্যতিক্রম থাকেই। ‘Exception proves the rule’. তোমার কি তাই মনে হয়-না?
আমি কী বলি বলো। আমি তো বিবাহিত জীবনযাপন করিনি। অথচ স্বামী না-হয়েও অরা আর ওর দুই সন্তানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছি। তোমার কথা পুরো না বুঝলেও একটু একটু বুঝতে পারি বই কী! অরার শরীর না পেলেও, তার কাছে থেকে এবং সন্তানের কাছ থেকে যা পেয়েছি তাও তো ফেলনা নয়।
–বুঝি, তোমার কথা বুঝি।
অপালা বলল।
সামনের সমুদ্র উথাল-পাতাল করছিল। তবে উদ্দাম নয়। সকালের সমুদ্র সাধারণত শান্তই থাকে জোয়ারের সময় ছাড়া। জোয়ার শুরু হয়ে গেছে। সাদা সি-গাল, টার্ন আর স্যাণ্ডপাইপার পাখিরা ওড়াওড়ি করছে। জোয়ারের পরে ভাটা আসবে তারপরে আবার জোয়ার। এই চলেছে পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে। মানুষের জীবনও এরকম হলে ভালো হত। কিন্তু কোনো মানুষ সার্ক-রাইডার-এর মতো সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আর ফেনার সঙ্গে বেগে ভেসে চলে আর অন্য কেউ ভাটার সমুদ্রের প্রায় নিস্তরঙ্গ টান টান জলরাশির মতো শান্ত স্থিরভাবে বাঁচে। তাদের প্রত্যেকের বাঁচার রকমটা বোধ হয় ‘প্রি-ডেস্টিনড’। সব বোধ হয় আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। দম্পতির মধ্যে একজন জোয়ার আর অন্যজন ভাটা হলে বোধ হয় তাদের দাম্পত্য খুব সুখের হয়। ভাবছিল অপালা। অগ্নি হঠাৎ বলল, তুমি কী ভাবছ তা জানি না। তবে আমার মনে হয়, আমাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ-ই, এই সমুদ্রের ঢেউ ছুঁয়ে ছুঁয়ে, জল-সইয়ে, উড়তে-বসতে থাকা টার্ন আর স্যাণ্ডপাইপার পাখিদের-ই মতো জীবনকে ছুঁয়ে ছুঁয়েই জীবন কাটিয়ে দিই, জীবনের আবর্তে প্রবেশ করি না। করতে পারলে, ওই তোলপাড়ের মধ্যে ভাসতে-উঠতে পারলে, জীবন বড়ো ইন্টারেস্টিং হতে পারত, গভীর, নোনা স্বাদে স্বচ্ছ।
অপা সমুদ্রের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে অন্যমনস্কর মতো বলল, বোধ হয়।