সাফল্যের ব্যক্তিত্ব : শেষের কথা
পাঠক, আপনি এ বইটি অবশ্যই যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে পড়ে ফেলেছেন আশা করতে পারি।
এ বই পড়ে আপনি কি ফল লাভ করলেন বা করতে চলেছেন এখন এই মুহূর্তেই তার মূল্যায়ন করা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়, তাই না?
কথাটা ঠিক।
এ বইটিতে মোট আঠারোটি পরিচ্ছেদ রয়েছে। প্রতিটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বলতে পারেন। তবুও মনযোগী পাঠক নিশ্চয়ই এও লক্ষ্য করেছেন যে প্রত্যেকটি পরিচ্ছেদের সঙ্গে অপর পরিচ্ছেদের একটা সূক্ষ্ম যোগসূত্র রয়ে গেছে। হ্যাঁ, পাঠকের চোখে সেটা অবশ্যই ধরা পড়বে।
এ বইয়ের মূল কথা কিন্তু সেই সাফল্যের কথা, সফল হবার কথা। তারই সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে এসে পড়েছে ব্যক্তিত্বের কথা। অর্থাৎ ব্যক্তিত্বই যে সাফল্যের চাবি।
এবার আসুন, বইটার কথা আরও বিশদভাবে একটু আলোচনা করা যাক। একটু বাজিয়ে নেওয়া যাক বিষয়বস্তু।
আমরা প্রথমেই প্রথম পরিচ্ছেদের কথাটাই ধরতে পারি। সেখানে শুরু করা হয়েছে ব্যক্তিত্বের কথা দিয়ে।
হ্যাঁ, আবার সেই পুরনো কথাতেই আমরা ফিরতে চাইছি অর্থাৎ ব্যক্তিত্বই সাফল্যের মূল।
এ বই পড়ে আপনারা অবশ্যই দেখেছেন ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে গিয়ে কত নানা ব্যাপারের সম্মুখীন হতে হয় বা তা হওয়া দরকার।
কোন মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনে অপরের ভূমিকাকেও অস্বীকার করা যায় না। অন্যকে মূল্য দিতে হয় তাকে শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতেও হয় আর ফলশ্রুতিতে আকর্ষণ করা সম্ভব শ্রদ্ধা।
আসল কথা হল অপরকে প্রভাবিত করতে হয়। এই প্রভাবিত করার জন্য চাই প্রভাব বিস্তার। আর প্রভাব বিস্তার তার পক্ষেই সম্ভব যে ব্যক্তিশালী।
এই ব্যক্তিত্ব ব্যাপারটা এ বইয়ে আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
ব্যক্তিত্ব কি সে কথা আরও একবার উল্লেখ করলে ক্ষতি নেই। এই ব্যক্তিত্ব বলতে বুঝতে হবে বিশেষ যে ক্ষমতার সাহায্যে বিশেষ কেউ অন্য একজনকে প্রভাবিত করে স্বমতে আনতে সক্ষম।
আসল কথা হল এই যে, ব্যক্তিত্ব যে কেবল পার্থিব সুখসমৃদ্ধি আর ক্ষমতা প্রসারে সহায়ক তাই নয়। এই পথে লাভ করা যায় অনাবিল আনন্দ। কারণ নতুন পরিচয় আর বন্ধুত্ব লাভে ব্যক্তিত্বই যে একমাত্র সহায়ক।
না, একথা অবশ্যই বলছি না ব্যক্তিত্ব কেবল অপরকে জয় করার কাজেই ব্যবহার করা হয়, ব্যক্তিত্ব এমন একটি জিনিস যার সাহায্যে এই পৃথিবী সুখের নীড় হয়ে উঠতে পারে।
ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার কাজটি অবশ্যই তেমন সহজ নয়। এ কাজ তাই ধীরে ধীরে গড়ে তোলা দরকার। এই ব্যক্তিগত কাজটি হতে পারে নিজেকে বিশ্লেষণ করার মধ্য দিয়ে। আগেই তাই বলা হয়েছে নিজের বিশেষত্ব পরীক্ষার কাজটি আগেই করে ফেলুন। নিজের ভাবাবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করুন। নিজের দক্ষতাও বিচার করতে ভুললে চলবে না। এটাও আবশ্যিক একটি কর্তব্য।
তাহলে মোটামুটি একটা ধারণা সকলের হয়েছে এ বই পাঠ করে, তাই নয়কি? হ্যাঁ, আমি ব্যক্তিত্ব গড়া ও সাফল্য লাভ করার কথাটাই বলতে চাইছি। এই বইটির পরিচ্ছেদগুলি আপনি মন দিয়ে পাঠ করেছেন সে তো বলাই বাহুল্য। এবার আপনার সামনে কটি প্রশ্ন রাখতে পারি কি? আমরা জানি এতে আপনি খুশিই হবেন।
যেমন, ধরুন, এই বইয়ের আঠারোটি পরিচ্ছেদের মধ্যে, যদি প্রশ্ন করা হয় কোন্ পরিচ্ছেদটি আপনার মনোযোগ সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে?
আপনি একটু ধাঁধায় পড়েছেন, তাই না?
হ্যাঁ, আপনি দ্বিধাগ্রস্ত তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ বিশেষ ভাবে কোন একটি পরিচ্ছেদকে আলাদা করে নিলে এ বইয়ের উপর অত্যন্ত অবিচার করা হবে।
হ্যাঁ, আপনাদের সঙ্গে আমরা একমত। যেহেতু কোন পরিচ্ছেদই একক হিসেবে নয়, একসঙ্গেই গড়ে তুলেছে বইটিকে। প্রতিটি পরিচ্ছেদ তাই বিশেষভাবে নজর দেওয়া চাই।
কথাগুলো বলার বিশেষ কারণ রয়েছে তা বলাই যে বাহুল্য।
এ বইয়ে পৃথিবীর বহু বিখ্যাত আর নিজের নিজের ক্ষেত্রে প্রথিতযশা মানুষের জীবন কাহিনীও উল্লেখ করা হয়েছে। পাঠক সেগুলো মন দিয়ে অবশ্যই পড়ে ফেলেছেন আর দেখেছেন কিভাবে তারা বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন।
ব্যক্তিত্বকে গড়ে তুলে সফলতা লাভ করতে গিয়ে মানবচরিত্র বিশ্লেষণ একান্ত জরুরী। এই ভাবেই যুগে যুগে মহান ব্যক্তিরা আলোড়ন তুলে জনপ্রিয়তার শিখরে উঠেছেন। আপনার পক্ষেও যে তা সম্ভব সে কথা বলাই এ বইটির উদ্দেশ্য। খ্যাতি কে না চায়? প্রতিটি মানুষের মনের অন্তস্থলে লুকানো থাকে এই বাসনা।
অথচ আমাদের অনেকেই জানি না, বা জানারও চেষ্টা করি না সাধারণ মানুষের মন কোন পদ্ধতিতে বা পথে জয় করা সম্ভব।
এ বিষয়ে গ্রীক দার্শনিক অ্যারিষ্টটল যা বলে গেছেন একবার শুনে নিন। অ্যারিষ্টটল বলেছিলেন : জ্ঞানবান মানুষের মত চিন্তা করুন কিন্তু কথা বলুন সাধারণ মানুষের মত।
আসল কথা হলো মানবিক সম্পর্কের দিক নিয়ে ভাবনা চিন্তার কাজই একান্তভাবে জরুরী এবং মানুষকে বোঝানো তাই অপরিহার্য।
আর এই মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে বিশেষ ব্যক্তিত্ব আর তারই ফলশ্রুতিতে সেই অপররিহার্য ব্যক্তিত্বও।
ব্যক্তিত্বকে এতখানি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কেন এই বইটিতে?
এ প্রশ্নটি অতি স্বাভাবিকভাবেই পাঠকেরা করতে পারেন। যেহেতু সাফল্যলাভ করার কাজ ব্যক্তিবিশেষের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। তাই অনিবার্যভাবে ব্যক্তিত্বের উপরেই বেশিমাত্রায় মনোযোগের কথা বলতে চেয়েছি।
তবে এখানেও একটা কথা অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে না। তা হল, ব্যক্তিত্ব কথাটি কিছুটা আপেক্ষিক। যেহেতু, ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার কাজে যে কোন উচ্চাকাঙখী মানুষের অনেক কিছুই বিশ্লেষণ প্রয়োজন। আর তার বিশেষ পদ্ধতিও রয়ে গেছে।
পাঠক নিশ্চয়ই অনুধাবন করেছেন কি বলতে চাই। এই বইটিতে সেই ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়ার ব্যাপারটিই যথাসাধ্য আক্ষরিকভাবে প্রাঞ্জল করার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র।
একটি অধ্যায়ে বলা হয়েছে সাফল্যের মূল কথা হল সাফল্যলাভের আকাঙক্ষা। নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে অবশ্যই থাকা দরকার উচ্চাকাঙক্ষা। আবার উচ্চাকাঙক্ষাই শুধুমাত্র লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে না তার জন্য চাই প্রচেষ্টা আর আত্ম-বিশ্বাস।
হ্যাঁ, শেষের কথাটাই ধরুন না, আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস না থাকলে কোন কাজই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা আদপেই সম্ভব নয়। এই আত্মবিশ্বাস মানুষ জন্মের সময় সঙ্গে নিয়ে কখনই আসে না। ক্রমে ক্রমে তা নিজের হৃদয়ে জমা হয়।
পৃথিবীর বিখ্যাত সব মানুষের জীবনকাহিনী লক্ষ করলেই উপলব্ধি করতে পারবেন কথাটির সত্যতা।
প্রথমেই দেখুন আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের জীবন। প্রখর আর অদমিত এক আত্মবিশ্বাসই জর্জ ওয়াশিংটনকে বিশ্বের এক বিশাল দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল।
আর এক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের জীবনও এই আত্মবিশ্বাসের জ্বলন্ত একটি উদাহরণ। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের অগ্নিগর্ভ দিনগুলোয় লিঙ্কন তার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়েই তার মোকাবিলা করে আমেরিকাকে রক্ষা করেছিলেন।
এ বইয়ের কোন এক পরিচ্ছেদে আপনারা পেয়েছেন কথা বলার যাদুর উল্লেখ। কথা বলাও এক শিল্প, নিজে সঠিক কথা বলুন আর অপরকেও বলতে দিন। এটাও হল সাফল্যের আর একটি মূল কথা। আর একটা কথাও জানা দরকার-অপরকেও প্রস্ফুটিত হতে দিন। এই পথেই আসে বন্ধুত্ব, যা মানুষকে কাছে টেনে নেওয়ার চাবি। ব্যবসা আর ক্রেতার মন জয়ের ক্ষেত্রেও এই যাদু কাজ করে। মানুষের সফলতা আসে কিভাবে? এ নিয়ে গবেষণা আর পরীক্ষা দেশে দেশে নেহাত কম হয়নি।
এ জন্য প্রথমেই কি দরকার?
এটা জানা অবশ্যই জরুরী। অনেকেই হয়তো প্রথম আদপেই উপলব্ধি সম্ভব হয় না, সবার আগে যা সামান্য লাভে একান্ত প্রয়োজন সেই কঠিন ধৈর্য আর প্রবল ইচ্ছা থাকাটা কতখানি জরুরি।
যে কোন কাজেই তাই সবার আগে প্রয়োজনীয় আকাঙক্ষাকে আলাদা করে নেওয়া চাই। ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে ধাপে ধাপে, সেটাই হবে সাফল্যের চাবি। কথাটা সারা বইয়ে ছড়িয়ে আছে আর আপনি তা আগেই পড়ে নিয়েছেন।
ধরুন কোন কারণে বিশেষ পরিস্থিতিতে আপনার মানসিক আর শারীরিক অবস্থা আপনার আকাঙক্ষা বা উচ্চাভিলাষের পরিপন্থী হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে হতাশ হওয়ার আদৌ কোনো কারণ নেই। আপনার অদম্য ইচ্ছা আর ব্যক্তিত্বই আপনাকে সমস্যা থেকে পরিত্রাণ করতে পারে।
আমেরিকার প্রথম সারির একজন মনস্তাত্ত্বিক অধ্যাপক উইলিয়াম জেম্স একবার বলেছিলেন, ‘অনুভূতিই আসল। অনুভব করার পরেই প্রকৃত কাজ শুরু হয়! বস্তুত অনুভব করা আর কাজ করা একই সঙ্গে চলতে থাকে।‘
কথাটা একান্তভাবেই সত্যি। তাই কর্ম সম্প্রদানকে অনুভব করা চাই ইচ্ছাশক্তির কাছে। মানুষ আবার পরোক্ষভাবে অনুভবের উপর নিয়ন্ত্রণও রাখতে পারে–সেখানে প্রত্যক্ষ হওয়া চাই ইচ্ছাশক্তি।
এখানে সুযোগ্য পাঠককে কিছু পরামর্শ দেওয়া নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। পরামর্শ সেই আত্মবিশ্বাস সম্পর্কে।
অনেকেই মনে করেন আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর কাজটা অত্যন্ত কঠিন। এ কখনই সহজে হতে পারে না পারিপার্শ্বিকতা আর পরিস্থিতি হয় তার প্রধান অন্তরায়।
ব্যাপারটা আদপেই ঠিক নয়।
আসলে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলা আর সাহস সঞ্চয় করার কাজটি সাধারণ মানুষ যতখানি কঠিনভাবে, ব্যাপারটা কখনই তা নয়। এই আত্মবিশ্বাস একবার আয়ত্ত করার কাজটি সম্পন্ন হলে, বাকি কাজ সহজ হয়ে আসে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের জীবনী পড়লেই ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
এ বইয়ের শেষপর্যায়ে আমরা পৌঁছে গেছি। আমাদের মূল সমস্যা হল সাফল্যকে হস্তগত করা।
পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই সাফল্য চাইলেও সেটা করায়ত্ত হয় মুষ্টিমেয় কজনেরই। এ আমরা আগেই আলোচনা করে দেখেছি।
অনেকেই সাফল্যের দরজায় পৌঁছেও ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ফিরে আসেন।
তারা ভুলে যান সাফল্য নেহাতই স্বনির্ভর কোন কৌশল। আসলে সাফল্য লাভ করার মধ্যেও ঝুঁকি জড়িয়ে থাকে। আর অধিকাংশ মানুষই ঝুঁকি নিতে ভয় পান। তারা জানেন না, বা অনুভবও করতে চান না যে সাফল্যের পথ সর্বদাই কণ্টকাকীর্ণ। সাফল্যের মূল্যায়ন বেড়ে যায় বিফল হলেই। পারলে সবই সাফল্যের যে গভীরতা তা নষ্ট হয়ে যায়।
অতএব শুধু সফলতার জন্য লালায়িত না থেকে নিজেকে প্রস্তুত করে তুলুন, সাফল্য আসবে অনায়াসেই সঙ্গে গড়ে তুলুন ব্যক্তিত্বকেও, এই দুয়ের সহযোগিতাই হয়ে উঠবে আপনার সাফল্যের চাবি। আত্মবিশ্বাস, ব্যক্তিতু আর সাফল্য হাত ধরাধরি করেই চলে।
এই বইয়ের শেষে আমরা পৌঁছে গেছি। আশা করি এ বই পাঠ করে এর বক্তব্য আপনি আপনার ব্যক্তিগত জীবনে কাজে লাগাতে পেরে সাফল্য লাভের অনাবিল আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন।