৫. ব্যক্তিত্বের ক্রিয়া

ব্যক্তিত্বের ক্রিয়া

যে সব জিনিস ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে–
১। ”বিশ্বে আমাদের নিজেদের জায়গা আমাদের জন্য অংশত গড়ে তোলা হয়।”
২। ”এই পৃথিবীতে আমাদের স্থান নির্ণয়ের ব্যাপারে অন্যেরও কিছু বক্তব্য থাকে–অবশ্য বিশেষ কিছুদূর পর্যন্তই।”
৩। ”এই পৃথিবীতে বাস্তব অবস্থা আমাদের স্থান নিয়ন্ত্রণ করে–তবে সম্পূর্ণ নয়।”
৪। ”এই বিশ্বে আমাদের স্থান নির্বাচনে মাঝে মাঝে ভাগ্যের ভূমিকা থাকে।”
৫। ”আপনি নিজেই পৃথিবীতে নিজের স্থান নির্ণয় করেন–প্রায় সম্পূর্ণভাবেই।”–স্মরণশক্তি বৃদ্ধির প্রণালী বিষ্কারক–ডব্লিউ জে. এনেভার

.

এক. পারা ও না পারা

আমার মনে হয় সকলেই বোধহয় কাগজে ইনোর বিজ্ঞাপন দেখে থাকবেন। এগুলো মোটামুটি শ্রীযুক্ত পারেন (যিনি ইনোজ খেয়ে থাকেন) আর শ্রীযুক্ত পারেন না’র (যিনি ইনোজ খান না) সম্পর্কে।

এই দুই ভদ্রলোককেই বেশ মজার মানুষ মনে হয়, তবে তাদের সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানার আছে।

দুজনেই লাইনে থেকে শুরু করেন। একজন নিশ্চয়ই প্রথম হবেন আর বাকিজনকে কোথাও খুঁজেই পাওয়া যাবে না। শ্রীযুক্ত পারেন অবশ্যই জিতবেন। আর শ্রীযুক্ত পারেন না নির্ঘাৎ ব্যর্থ।

এখন কথা হলো আপনি এঁদের মধ্যে কার মত? আপনি শ্রীযুক্ত পারেনের মত বেশ হাসিখুশি? না, আপনি শ্রীযুক্ত পারেন না’র মত সবসময় এলোমেলো, সফল হওয়ার সম্ভাবনাই যার নেই?

এর সবই আপনার উপরে নির্ভর করছে।

এবার তাই ওই দুজন, অর্থাৎ শ্রীযুক্ত পারেন আর পারেন না’কে পাশাপাশি রেখে তুলনা করে দেখুন। এটা কোথাও যেতে হলে কোন রাস্তায় যাবেন সেটা বেছে নেবার মতই।

আসলে শ্রীযুক্ত পারেন আর পারেন না’র মধ্যে তফাৎ হলো এই রকম :

শ্ৰীযুক্ত পারেন (মনে মনে) বলেন : ‘একাজ আমি পারবো…অন্য গুলোও পারবো…।‘ শ্রীযুক্ত পারেন না’র মুখ গম্ভীর, হতাশায় ভরা। তিনি (মনে মনে) বলেন : ‘একাজ পারবো না। এ আমার ক্ষমতার বাইরে। জীবনে এটা ভালোবাসিনি। ছেড়ে দেওয়াই ভালো।‘

আশ্চর্য ব্যাপার হলো শ্রীযুক্ত পারেন কাজটি করতে পারেন, চেষ্টাও করেন। অন্যদিকে শ্রীযুক্ত পারেন সহজ কাজও পারে না, এমন কি চেষ্টাও করেন না। দুঃখের কথাটাই হলো এই।

আসুন, এখনই মনস্থির করে ফেলুন যে আপনি ওই শ্রীযুক্ত পারেন হবেন।

কোন কাজ করতে গিয়ে প্রথমেই নিজেকে বলুন : ‘কাজটা আমি পারবো। নিশ্চয়ই পারবো।’ বেশ মনোযোগ দিয়েই কথাটা বারবার বলুন। এ হলে যে কোন বাধার সামনে দাঁড়াতে পারবেন। নিজের মনে বিশ্বাস রাখুন, নিশ্চয়ই পারবেন। কাজ করতে গিয়ে মনে আনন্দ পাবেন এতে। আপনার জীবন এতে সজীব হয়ে উঠবে, দেখতে পাবেন কাজটা প্রায় অর্ধেক সময়েই করে ফেলতে পারেন।

যখন কোন ব্যাপারে কোথাও ব্যথা বেদনার সামনে পড়তে হয় শ্রীযুক্ত পারেন হাসিমুখেই তার মোকাবিলা করেন, ‘হ্যাঁ যন্ত্রণা হচ্ছে বটে তবে সহ্য করতে পারছি।’ কাথাটা তার নিজের মনেই খেলে যায়। শ্রীযুক্ত পারেন না সম্ভবত মনস্থিরই করতে পারেন না। দাঁতের ডাক্তার তাকে সেরা জ্ঞান হারানোর ওষুধ দিলেও শ্রীযুক্ত পারেন না দাঁত তোলাতে চান না।

দুজনের মধ্যে শ্রীপারেন নাই বেশি ভুগে থাকেন। শ্রীযুক্ত পারেন দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি তীব্র যন্ত্রণাও সহ্য করতে পারেন। ব্যথার কোন বোধই তার নেই। তার মন সেটা জানতে দেয় না।

অবশ্য ভাববেন না এভাবে আপনার দাঁতের ডাক্তারকে সরিয়ে রাখতে পারেন। এটাও সত্য যে আপনি যন্ত্রণা টের পাবেন না। তবে এটুকুই সব। দাঁতের ওই যন্ত্রণা পচা দাঁতের জন্যই রয়ে গেছে। পৃথিবীর সব রকম ভাবনাও এটা সারিয়ে তুলতে পারবে না!

তবে যাই হোক, ভাবনার মধ্যে কিছু একটা আছে! একটা সেনাবাহিনী অনেক ভালো লড়াই করতে পারে যখন প্রতিটি মায়ের সন্তানই বলে : বাজি রাখতে পারেন শত্রুদের গুঁড়িয়ে দিতে পারবো!

যে ব্যক্তি বলেন, আমি পারি (মনের থেকেই) তিনি দক্ষ মানুষ, শতকরা নব্বই ভাগ জয়ই তার মুঠোর মধ্যে। তাই আমি পারি’ কথাটা আসে ‘আমি করব’ কথাটার ঢের আগে।

এ ধরণের চিন্তার সুবিধা হলো, এ আপনাকে আপনি সত্যিই যা চিন্তা করতে বা অনুভব করতে চান তাই করতে সাহায্য করে। আপনি যা চান না (যেমন, চিন্তা, অনুভুতি, ভয়, দুশ্চিন্তা, ভাবনা ইত্যাদি) আপনি মন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন। আপনি এরকম করার মধ্য দিয়ে সহজেই বহু ঘন্টা, দিন, মাস, বছর, এমন কি সারা জীবনই যন্ত্রণাবোধের থেকে সরিয়ে রাখতে পারেন। আপনি তাই বিছানায় অসংখ্যবার নিদ্রাহীন যন্ত্রণাকাতর ছটফটানি থেকে রেহাই পেতে পারেন। তাই এইভাবে আপনার স্নায়ুকে রেহাই দিতে পারেন, শক্তির অপব্যয় রোধও করতে পারেন।

আসলে আপনি কর্তৃত্ব করতে পারেন দৃঢ়তার সঙ্গে, যদি বিশ্বাস করেন যে আপনি পারবেন।

.

দুই. আত্মবিশ্বাস

জীবনের প্রতিটি দিনেই আমরা শুনতে অভ্যস্ত এই কথাগুলো : কঠিন পরিশ্রমই হলো আসল রহস্য। আর কোন পথ নেই। কঠিন পরিশ্রমী মানুষকে কেউ সফল হওয়া থেকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না!

কথাটা আমরাও স্বীকার করি–তবে পুরোপুরি নয়।

আসলে আমরা লক্ষ লক্ষ জ্বরাগ্রস্ত মানুষের কথাই ভাবতে চাই যারা দূরে ছিটকে যায় অথচ কোথাও পৌঁছুতে পারে না। তারা পশ্চাৎপট তৈরি করে আর তাদের মধ্যে সামান্য কয়েকজন কেবল মঞ্চে পাদপ্রদীপের সামনে আসতে পারে।

এই সব মানুষের বেলায় অস্বাভাবিক কি থাকে? অর্থাৎ যাঁরা আলোয় এসে দাঁড়ান? বাকিরা যেখানে পারেন না তারা পারেন কিভাবে? অন্যদের সঙ্গে তাদের তফাৎ কোথায়?

আমরা এই ধরণের বহু প্রথম সারির মানুষের পরিচয় জানি। তাদের মধ্যে রয়েছেন শক্ত ধাতের ব্যবসায়ী, সংবাদপত্র জগতের মানুষ, ধর্মযাজক, শেয়ার মার্কেটের মহারথীরা, সেনা আর নৌবাহিনীর মানুষ ইত্যাদি। অথচ তাদের মধ্যে মিল প্রায় চোখেই পড়ে না–তাদের মধ্যে স্কুল শিক্ষা, শিক্ষণ ব্যবস্থা, আপাত আবরণ, দৈনন্দিন কাজকর্ম কোনটাতেই মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

তাসত্বেও প্রথম সারির মানুষ হিসেবে তাঁরা বিশিষ্ট হয়ে উঠেছেন-একই ধরণের স্ত্রী পুরুষ। তাঁদের মধ্যে এমন কিছু আছে যা অন্যদের মধ্যে নেই। এটাকে ‘চালনাশক্তি’, ‘উদ্যম’, ‘প্রতিভা’, ‘ব্যক্তিত্ব’ যা খুশি বলতে পারেন। এটা আমার, আপনার বা অন্য যে কোন মানুষেরই জীবন গড়ে তোলার কাজে একান্ত অপরিহার্য। এ ছাড়া আমরা লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে আমরা কেউই নই, অতি সাধারণ জনগণ মাত্র। এরই সাহায্যে আমরা এগিয়ে চলি, লড়াই করি, ধাক্কা মারতে চাই, আমরা যা চাই তাই শেষ অবধি পাই।

এ সব মানুষ একেবারে আলাদা। আপনি তাদের লক্ষ্য না করে কিছুতেই পারবেন না।

এই সব মানুষ নিজেদের অন্যভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেন। তাঁরা মানুষকে অন্য ভাবেই নাড়াচাড়া করে থাকেন। সব ব্যাপার আমাদের যে ভাবে স্পর্শ করে তাদের কিন্তু সে ভাবে করে না। এই সব মানুষ জীবনকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন। আমরা এটা জানি, আমরা সেটা অনুভব করি। এইসব মানুষরা আমাদের আপনাদের মতই খাওয়া-দাওয়া পান করেন, ঘুমোন। তাসত্বেও তারা আলাদা কিছু, আমাদের মতন আদৌ নন। তাঁদের দাম সম্পূর্ণ আলাদা। যে ভাবেই ধরুন তারা সম্পূর্ণ অন্য রকম।

এই তফাৎ কি রকম? এটা হলো অতি প্রাচীন প্রশ্ন। এর কোন উত্তর আছে কি? আমাদের তা অবশ্য জানা নেই। তা হলেও আমরা জানি, এই সব তফাৎ বিশিষ্ট স্ত্রী পুরুষেরা-কোন রকমেই ভীত নন। তারা নিজেরা যে রকম তাই থাকেন আর সেটা প্রকাশ করতেও ভয় পান না কোন ভাবেই।

তারা নিজের নিজের ভাবধারাতেই যা তাই-স্বাভাবিক, লজ্জাহীন, বিনা ছদ্মবেশেই থাকেন। তারা নিজেদের ধ্যান ধারণা আর আকাঙক্ষা। অনুযায়ী কাজ করে চলেন। জীবন কাটানোর উদ্দেশ্যে তাদের নিজস্ব একটা পরিকল্পনা থাকে। এই সব স্ত্রী পুরুষ অপরে কি বলে বা করে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না। তাঁরা দুনিয়া যেভাবে প্রকাশ তা মানেন না। বরং তাদের আদর্শে, রুচিতে আর পরিকল্পনায় তাকে গড়ে তুলে রূপদান করতে চান। নিজেদের পছন্দ মত কাজ করতে তাঁরা লজ্জিত হন না বরং সাহসের সঙ্গে তা করেন। তাঁরা নিজেদের ইচ্ছা মতই চলতে চান। হয়তো কেউ তাতে হাসতে পারে তবে কে গ্রাহ্য করে।

তাঁরা মোটেই পাত্তা দিতে চান না। তারা নিজেদের উপর বিশ্বাস রাখেন। অবশ্য এরকম করার পরিণতিতে মাঝে মাঝে তারা অতি সাহসী খারাপ মানুষ হয়ে ওঠেন। আবার শুধু এটাই নয়, তাঁরা সাহসী অথচ সৎ মানুষও হতে পারেন। এই সব মানুষ যদি একাজে আস্থা না রাখতেন তাহলে কাজের কাজ কিছুই বোধ করতে পারতেন।

আমাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই কিন্তু পিছনের সারির। আর তার ভালো কারণও আছে। কারণ হলো, আমরা ভাবি আমাদের ওটাই উপযুক্ত জায়গা। আসলে আমরা সামনের সারিতে আসতে ভয় পাই।

জনসাধারণের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে আমরা সঠিক পথে চলতে ভয় পাই (হয়তো সেটা ভালোই হতে পারতো)–আমরা এ ভাবে আমাদের আসল সত্তাকে প্রমাণ করতেও ভীত হই।

এ ব্যাপারে আমাদে চিন্তাধারা হঠাৎ গজিয়ে ওঠে, এটা আমাদের নিজেদের নয়।

একটা নির্দিষ্ট নকশা অনুযায়ী আমরা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা এমনকি নিজেদেরই জানি না। ক্ষমা চাইবার ভঙ্গীতে আমরা কতবারই ভয়ে বলতে চাই : আমি নিজের মধ্যে ছিলাম না!

তা সত্ত্বেও কিন্তু যে অদ্ভুত সত্বা (অন্যসবের মধ্যে) দেখে আপনি আতঙ্কিত হন তা কিন্তু আপনার নিজেরই। আসল ব্যাপার হলো আপনার কণামাত্রও ধারণা নেই আপনার আসল সত্বা কেমন দেখতে। অতএব আপনি নিজেও স্তম্ভিত হয়ে পড়েন।

নিজের কথাটাই তাই ভাবুন।

তবে প্রথমে নিজের উপর আস্থা রাখুন। অন্যরকম কিছু হওয়ার ভাবনায় ভীত হয়ে বাস করবেন না। আপনার নিজের জাহাজকে নিজেই পরিচালনা করুন। আপনার নিজের মনকেই ইঞ্জিন পরিচালনা করতে দিন।

তা যদি না হয় তাহলে জাহাজ আপন মনে ভাসতে ভাসতে চড়ায় আটকে যাবে। আর তাহলে আপনিও উদ্দেশ্য থেকে বহুদূর গিয়ে পড়বেন। এর অর্থ হয়তো হবে জাহাজটিরই ভগ্নদশা।

.

তিন. দমনের বিপদ

যে মানুষের শক্তি আছে তিনি তার সমস্ত পরিকল্পনাই সফল বাস্তবায়িত করতে পারেন। তিনি অতি সহজেই এগিয়ে যেতে পারেন। কোন কিছুই তাঁকে থামাতে পারে না।

বেশির ভাগ মানুষই সব জায়গায় বাধা, গর্ত, কদর্যতা আর নানা ধরণের দুশ্চিন্তার মুখোমুখি হন। কিন্তু যে মানুষের ক্ষমতা আছে তার কাছে এসবের কোনই অস্তিত্ব থাকে না। তিনি এমনই একজন মানুষ যার প্রতিভা অনস্বীকার্য, তিনি যেন কোন পরিবাহী তার। তিনি আসলে হয়ে থাকেন গলিত কোন শক্তি।

একদল দুর্বল মানুষের মাঝখানে তিনি হলেন একজন শক্তিমান পুরুষ। তিনিই কাজ করেন। সর্বদাই তাকে ব্যস্ত মনে হয়। সব কাজ তিনি পরিচালনা করে চলেন। তিনি নিজে হয়তো বেশি কিছু বলেন না বা নিজেকে ব্যয় করেন না। তবে তার মধ্যে থাকা বিশেষ ক্ষমতা সব কিছু বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্য দিয়ে করিয়ে নিয়ে যায়। তাকে শুধু হয়তো বলে দিতে হয় বা হুকুম জানাতে হয়–আর তাহলেই সুষ্ঠুভাবে সবকিছু হতে থাকে।

এমন হওয়ার ফলে যেন ঘুমিয়ে থাকা অবস্থাটা জেগে ওঠে। শোনা যায় পদশব্দ। বাতাসে শোনা যায় কণ্ঠস্বর। জেগে ওঠে তৎপরতা! মঞ্চে যেন রাজকুমারের আবির্ভাব ঘটে যায়।

এই জিনিসই ঘটাতে পারে ব্যক্তিত্ব। এটাই মানুষকে চালনা করে নিয়ে যায়। মানুষের উপর যা কিছু কাজ করে।

এটাই হলো শক্তির প্রকাশ। এহলো ভিতরের কিছু আর এটাই চারদিকে সব কিছুকে জ্বালিয়ে দিয়ে চলে। এ যখন সর্বশ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে তখন আর বাস্তব থাকে না। এ স্ত্রী পুরুষের অনুভূতিকে, সহজ প্রবৃত্তিকে এবং চেতন আর অবচেতন অবস্থাকে দ্রুততর করে দেয়। একে অনুভব করা যায়। এ হলো আসল, বাস্তবতাময়। আসলে বলতে গেলে এই হলো একমাত্র বাস্তব।

শিক্ষার এর সঙ্গে করার কিছু থাকে না।

আপনি যদি সত্যিই ভেবে দেখেন, তাহলে দেখবেন শিক্ষা অনেক সময়েই একে দৃষ্টির আড়ালে রেখে চেপে রাখতে চায়।

শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই এটি জংলী মানুষকে সভ্য করে তোলার হাতিয়ার। আমরা বলি শিক্ষা পরিবর্তন আনুক।

আসলে এটা আমাদের একটা আবরণ গায়ে দিতেই সাহায্য করে–আর সেই আবরণ হয়তো অনুভূতি, ধ্যানধারণা আর কখনও বা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ, যেটা আর সব শিক্ষিত স্ত্রী-পুরুষ করে থাকে।

তবে মনে রাখা দরকার ঐ আবরণ আসল মানুষটি নয়। কোন ভাবেই তা নয়। শিক্ষা বা সভ্যতা তাকে অনেক গভীরে চালান করে দেয়-অনেকটা মিশরের সেই মমির মত। অনেক ক্ষেত্রেই তার ধারণাই থাকে না আসল মানুষটি কেমন।

তবুও মানুষটি সেই বরাবরের মতই বন্য রয়ে যায়–সভ্যতার যত বড় খোলসই তার থাকুক। সে আসলে অতি অসহায়। সে তার আঙুলও নাড়তে পারে না। এই জড়িয়ে ফেলা সত্বেও তিনি যদি নিজেকে সাহায্য করতে সক্ষম হন তাহলে ভালোই। তা যদি না হয় তাহলে তিনি যেখানে আছেন সেখানেই পড়ে থাকবেন। তার পড়ে থাকাই ভাগ্য।

ভুল শিক্ষার এটাই হলো ত্রুটি। এটা একটা বোঝার মত হয়ে মূল্যহীন হয়ে ওঠে। এ শিক্ষা যেমন বিশাল, তেমনই আবার মূল্যহীন। তাই বেচারি শিক্ষার্থী এ শিক্ষার চাপে চাপা পড়ে এক পাও এগোতে পারে না।

যে মানুষের ক্ষমতা থাকে সে প্রকৃতই যা দরকার তাই সে গ্রহণ করে আর এটা করে সে প্রায় প্রকৃতিজ অবস্থায় লজ্জা না করেই উঠতে শুরু করে।

সে তখন নিজের সত্ত্বা খুঁজে পায়। সে নিজেকে সাহায্য করতে পারে। আর এটাই হলো জীবিত থেকে প্রখর সূর্যালোকে থাকার প্রধান কাজ। জীবন আর সাফল্য হলো তাই প্রকাশিত করা।

আর এই কারণেই আমরা যদি আমাদের ভিতরের সেরা জিনিসটির প্রকাশ ঘটাতে পারি তাহলে সেটা হয়ে ওঠে চমৎকার উত্তেজনাপ্রদ।

অতএব কখনই ভাবতে চাইবেন না এটা করার কথা নয়।

মাঝে মাঝে মনে হয় এমন অনেক কিছুই আছে যা করা হয়েছে আর এমনও আছে যা’করা হয়নি’ আমরা যা সত্যিই চাই তা আমরা পাই না।

আমাদের কাজ হলো আসল মানুষকে দমন করা। যে অত্যন্ত খারাপ, তাকে সামনে প্রকাশ করা যায় না।

আর একাজ করার সময় আমাদের কাছে সেটা একটা খারাপ অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। আমরা এ সম্পর্কে পাগল হতে চাই।

সে মজাদার ব্যবহারই করতে চায়। আমাদের এটা বাঁকা চোখে থাকতে বাধ্য করে বলা যায়। আসলে এ হলো তার প্রতিশোধ।

মূল কথা হলো, এই সবই দমন আর গোপনীয়তা থেকেই আসে। আর আমরাই এসব নিজেদের জীবনে নিয়ে আসি।

এসবের নীতিকথা হলো এই রকম।

যা কিছু করবেন সচেতন থাকুন। আপনার শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করুন। এটা করতে গেলে হয়তো দৃষ্টি আকর্ষণ করা হতে পারে, লোকে আপনাকে নির্দেশ করতে পারে। মাঝে মাঝে তাই আপনার কাছে ব্যাপারটা বিশ্রী লাগতে পারে। তাসত্বেও কায়দা বা শিক্ষার ধাঁচ আপনাকে যেন বেঁধে না ফেলতে পারে। যে ভাবে মানানসই হয় সেই ভাবেই আপনার কোট পরিধান করুন। এ অনেকটা ক্লান্তিকর জিনিস। তাই জবুথুবু মমির মত একজন মানুষ না হয়ে বরং ছটফটে দুরন্ত মানুষই হওয়া ভালো।

.

চার. হীনমন্যতা

আপনার যদি অন্য কারও মত তীক্ষ্ণবুদ্ধি আর সুযোগ থাকে তাহলে তার মত আপনিও কেন উচ্চতম শিখরে আরোহণ করতে পারবেন না? না, এর কোন কারণ নেই।

যেখান থেকে যাত্রা করছেন সেখানেই আপনাকে কেন আটকে থাকতে হয়, কেন আপনার জাহাজের পাল পত্ পত্ করে ওড়ে না? কি এমন জিনিস আপনার পেশীর ক্ষমতা আর মস্তিষ্কের শক্তি কেড়ে নেয়?

নিজেকে বিচার করে দেখুন। তারপর অন্য সবাইর বিচার করুন। সবরকম সুযোগই আপনার রয়েছে। তাসত্বেও কিন্তু আপনি আপনার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রচেষ্টাকে কাজে লাগাতে পারছেন না। আপনি আরও ভালো করতে পারতেন আর সেটা আপনার জানাও আছে। তাসত্বেও যে কোন কারণেই হোক আপনি নিজের উপর কর্তৃত্ব করতে পারছেন না। আপনি আপনার মধ্যে যে সেরা জিনিসটি আছে তাকে কোন রকমেই কাজে লাগাতে পারছেন না।

এ হলো একরকম রোগ। আর এটা এমনই একটা জিনিস যা একটু একটু করে আপনাকে নিশ্চিতভাবেই ধ্বংস করে ফেলেছে। এ এমন এক রোগ যা সারা দুনিয়াতেই ছড়ানো রয়েছে। প্রত্যেকেই এই রোগে সম্ভবতঃ আক্রান্ত হয়। এটা শুরু হয় মাঝে মাঝে আমরা ভাববার আগেই। এটা যে কেবল মাত্র আপনাকে বা আমাকেই মেরে ফেলতে পারে তাই নয়, এ রোগ বিশ্বের বড় বড় দেশকেও ধ্বংস করে ফেলেছে।

এ রোগ তা হলে কি?

ঠিক এটাই :

এই ধারনা, যে আপনি অন্য মানুষটির মত উপযুক্ত নন। এই ধারনা যে,তার আরও শ্রেষ্ঠতর মস্তিষ্ক, বড় আকারের পেশী, (আর এটাও কি বলবো?) উজ্জ্বল সৌভাগ্য তার আছে? এই ধারনা যে, সে জয়ী হবেই আর আপনি কিছুতেই বিজয়ী হবেন না। এই ধারনা যে, তিনি পারেন–আর আপনি পারেন না।

যে যোদ্ধা এই রকম ভাবতে থাকে সে কখনই যুদ্ধ করছে বলা যায় না। লড়াই আরম্ভ করার আগেই সে হেরে বসে আছে বলতে হয়। বহু সেনাবাহিনী বড় আকারের কামান দাগায় বা কৌশলের ফলে পরাজয় বরণ করেনি বরং তারা পরাজিত হয় এই দুর্বল করা ধারণার জন্য।

মাঝে মাঝেই আমরা আসল ব্যাপার কি সে বিষয়ে অন্ধকারেই থেকে যাই : কেন মুখে কথা জোগায় না, মস্তিষ্ক কেন কাজ করে না আর শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেন শক্ত হয়ে পড়ে।

আমরা যা জানি তা হলো এই অনুভূতি : ‘এটা মূল্যহীন। এ আমার নাগালের বাইরে। তাই এর জন্য ঝামেলা নেওয়া পোষায় না। তাই যত তাড়তাড়ি সম্ভব হাল ছাড়াই ভালো।‘

এর মধ্যে আগাগোড়াই কিন্তু সেই যাচ্ছেতাই ধারনা কাজ করে চলেছে যে আমরা বড় ছোট, দূর্বল আর অক্ষম।

মনে রাখবেন আপনি বা আমি যা ভাবি এর শিকড় তার চেয়েও ঢের গভীরে। এতে বোঝা যায় আনন্দের কোন সুযোগই নেই, সবই আমাদের বিপক্ষে।

এটা আমাদের অনুভব করাতে চায় যে আমাদের বাঁচানোর আর কোন পথই নেই, একমাত্র কোন তাড়া খাওয়া জানোয়ার যা করে …তেড়ে আক্রমণ করা বা মৃত্যু বরণে ঝাঁপিয়ে পড়া।

হ্যাঁ, তাই। এই দুর্বল করে তোলা ধারনার পিছনে রয়ে গেছে সেই ভয়ের অনুভূতি। এর সঙ্গে সবাই জড়িত। ভয় ছাড়া এটা অন্য কিছুই নয়। এ ভয় হলো যা অচেনা, বড় আকারের আর অজানা কিছুর। আমরা এই রোগের কারণ–আর তার নিরাময়ে আবিষ্কারও করেছি।

এই ভয়ের কাছে মাথা নত করার বদলে আসুন আমরা এর চোখে চোখ রেখে দেখার চেষ্টা করি তাকে পরীক্ষা করে দেখি। যত বেশি আমরা এ কাজ করতে পারবো, জানবেন ততই তার ক্ষমতা ক্ষীণতর হয়ে আসবে …. শেষ পর্যন্ত এটা ধোয়ার রূপই নিতে চাইবে। আপনি হাত বাড়িয়ে এগিয়ে চলুন, দেখতে পাবেন–সবটাই স্পর্শ বিহীন একটা ধোয়ার পরদা মাত্র। সবটাই ধোয়াটে শূন্যতায় ভরা।

আপনি যখন নিজেকে ক্ষুদ্র মনে করছেন, ভাবছেন আপনি রুগ্ন, অসুস্থ বা আশাহত। যেহেতু অপর ব্যক্তি তার পিছনে সবই পেয়ে গেছে–কোনভাবেই আপনি স্নায়বিক রোগগ্রস্ত বা ভীত-সন্ত্রস্ত হবেন না। এই বিপদকে মনে মনে মেপে দেখুন। ভাবুন। চোখের পাতা ফেলবেন না, ধীরে ধীরে সব পরিমাপ করুন।

ঐ ভয়ের নিজস্ব কোন ভালো বক্তব্য বা আত্ম সমর্থনের কারণ থাকা সম্ভব। অবশ্য তার দুর্বলতাও আছে। গায়ে আঁশ থাকলেও কুমীরেরও তা থাকে। তাই তাকে উল্টোপাল্টে দুর্বলতম স্থান আবিষ্কার করে ফেলুন।

তাছাড়ও আপনার নিজের সম্পর্কে যা মনে হয় তার চেয়েও আপনার বহু কিছু আপনার পক্ষে থাকতে পারে। শুধু আপনি সেটা আবিষ্কারের চেষ্টাই করেন নি।

আসুন, সবকিছুতেই বিচার করে দেখে নিন–কারণ আসলে আপনি সে রকম অপদার্থ কখনই নন। আপনি জয়ী হতে পারেন।

এইভাবেই আপনি ভীতি দূর করতে পারেন–পারেন এই দুর্বলতার অনুভূতি, ব্যর্থতা আর হাতাশা দূর করতে।

.

পাঁচ. মানুষকে প্রভাবিত করা

যে মানুষটি বহুজনের মুখোমুখি হয়ে তার পাশে সকলকে টেনে নিতে ভীত হন না, ঠিক তারই মত হয়ে উঠতে আপনার কি রকম লাগবে?

আহা, এমন কারও মত যদি হতে পারতেন তাহলে আপনার কাজে কর্মে সেটা কেমন চমৎকার কাজে লাগতো। তাহলেই দেখতে পেতেন ঝামেলা, বিরোধিতা, অপছন্দের ভাব, কুসংস্কার, এসবই কেমন আপনার সামনে দূর হয়ে যেত। গোমড়া মুখো মেঘ, শীতল তুষার মাখা বাতাস, কুয়াশার পরদা…ধ্বংসকারী সব কিছুই ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বল ঝলমলে রোদ্দুরে নিমেষেই কোথায় মিলিয়ে যাবে।

আপনি যদি এই ধরনের মানুষ হন তাহলে ব্যবসায় উন্নতি করতে পারবেন, আপনার ভাগ্যে বিরাট কাজের সুযোগও থাকবে। স্রোতের মতই আপনার কাছে কাজ আসতে থাকবে। বিক্রি রকেটের মত উধ্বমুখে ছুটতে থাকবে। আপনার ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠবে।

এটা প্রধানতঃ হলো ব্যক্তিত্বের–আর কৌশলের ফলেই। আপনি কোন ব্যক্তিত্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন।

আপনাকে কাজে লাগাতে হবে আপনার প্রভাবকে, স্পর্শ করতে হবে সঠিক সুইচটি, আর এইভাবেই যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

যাতে আপনিই হয়ে উঠতে পারেন একমাত্র কর্তৃত্বের অধিকারী।

মনে রাখবেন ডেল কার্নেগী কি বলেছেন। তিনি বলেছেন কারও পক্ষে নিজস্ব সত্বাই হলো প্রধান কার্যকরী সত্ত্বা, ক্ষমতার সত্ত্বা। যে সত্বা সব কাজ করতে পারে। যে সত্ত্বা মুক্ত স্বাধীন চিত্তে কাজ করতে পারে। যে সত্বাকে সকলে পছন্দ করে, মূল্য দেয় আর প্রশংসা করে। যে সত্বা অন্য সব সত্বার চেয়ে বড় আর ভালো। যে সত্বা কখনও কোন ভুল করে না।

সত্ত্বা সম্বন্ধে এটাই হলো আমাদের প্রিয় ধারণা।

এটা প্রত্যেকের সত্ত্বা সম্পর্কেই খেটে যায়। প্রত্যেকটি কাজের পিছনে রয়ে গেছে এই ধারণা। আসলে কাজের উৎপত্তি ঘটে এরই মধ্য থেকে।

এছাড়া আমরা সঠিকভাবে কাজ করতে পারি না। এটা নিয়ে নিন–আমাদের সমস্ত ক্ষমতাই নিঃশেষ হয়ে যাবে। আমরা তাহলে শক্তিহীন হয়ে দুর্বল চিত্তে টলে পড়ে যাবো।

আমরা যখন মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করি তখন এই সত্বারই মুখোমুখি হই। তাহলে একে আমাদের দিকে ঘুরিয়ে আমাদের পক্সে আনুন না কেন?

একটা সঠিক তরঙ্গের মুখে চালনা করার ব্যবস্থা করুন। আমরা ড্যাশবোর্ডের সবই চিনি–তাই। যথারীতি সুইচ টিপুন। আর এটাই আমাদের কাজ হবে।

প্রশংসা করার চেষ্টা করুন।

তার সব ভালো দিক লক্ষ্য করুন। সেগুলোর প্রশংসা করুন। এটা প্রকাশ করুন। দেখিয়ে দিন আপনাকে ওগুলো প্রভাবিত করেছে। খুব কম লোকই প্রশংসায় বিগলিত হওয়া রোধ করতে পারে।

এতে মানুষ নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ, বড় আর উন্নতমানের বলে ভাবে। অপর ব্যক্তি তাই আপনাকে পছন্দ না করে থাকতে পারে না। এর কারণ হলো আপনি নিজেকে তার তুলনায় ক্ষুদ্র, অনুকম্পার বস্তুর করে তোলেন।

এই অনুকম্পা জিনিসটি আমাদের সকলের সহজাতবোধ থেকেই জন্ম নেয় : এটা হলো পিতামাতার সহজ প্রবৃত্তি। এর ফলে আমরা দুর্বল, অসহায়কে ভালোবেসে রক্ষা করতে চাই।

এই সহজাতবোধ কাজের ইচ্ছাকে প্রভাবিত করে। তাই একে সুইচ টিপে চালনা করুন … এর মধ্যে থাকা চাই সৎ প্রশংসার বাণী।

নিজের ত্রুটির বিষয়ে আলোচনা করুন। সে বিষয়ে প্রশ্নও করুণ। অপর ব্যক্তির ভুল বা ত্রুটির সম্পর্কে ঘুরিয়ে পরোক্ষে কথা বলুন।

কোন হুকুম করতে চাইবেন না। ধৈর্য ধরে শ্রবণ করুন। অপর ব্যক্তিকে তার ”মুখ রক্ষা করতে দিন।”

তাকে চমকার মনোভাবে থাকতে দিন। তার মনে আগ্রহ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করুন। তাকে আনন্দে উফুল্ল হতে দিন তাকে হাসতে বাধ্য করুন।

শেষ অবধি তাকে ‘হ্যাঁ’ বলতে দিন।

তাকে আপনার বন্ধু করে তুলুন। তিনি যদি অনেক ব্যাপারে আপনাকে খুশি করতে চেয়ে থাকেন, তাহলে তিনি বিশেষ কোন ব্যাপারেও আপনার যা ধারণা তার চেয়েও আগে আপনার মতেই মত দেবেন।

ডেল কার্নেগী দেখেছেন যে এই পদ্ধতিতে চমৎকার কাজ হয়। তিনি এটা হাজার হাজার কঠিন অবস্থায় কাজে লাগিয়ে দেখেছেন। তাঁর ছাত্ররা এটা অবলম্বন করেছে। এটি সবচেয়ে কঠিন ব্যক্তিত্বকেও বিগলিত করতে সক্ষম। এর যেন যাদুস্পর্শ থাকে–আর তাই গ্রানাইট পাথরকেও সোনায় পরিণত করে।

.

ছয়. ব্যক্তিগত আকর্ষণ

ব্যাপারটি যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এটা আমাকে বলতেই হবে।

আপনাকে বহু স্ত্রী পুরুষকে জয় করতে হবে। আপনাকে বন্ধুত্ব করতে হবে। আপনাকে বহু মানুষকে কাছে টানতে হবে।

মনে রাখা দরকার আপনার বা আমার এ ক্ষমতা আছে।

আর এটা কিন্তু কোন রকম অপার্থিব, লৌকিক, অলৌকিক বা মন্দ কিছু আপনি হয়তো ভাবতে পারেন। তাছাড়া এটা দোষণীয়, ক্ষতিকর ও মারাত্মক কিছু নয়।

তাছাড়াও নিজের মধ্যে এটি ভালো বা মন্দ এর কোনটাই নয়। এর সদ্বব্যবহার বা মন্দ ব্যবহারেই এর নামকরণ।

আপনি হয়তো এক্ষেত্রে একটি পাখিকে মারতে উদ্যত কোন মাপের ক্ষমতার কথাই ভাবছেন। বা আপনার হয়তো মনে পড়ছে সেই কুখ্যাত নোঙরা কৃষক-পুরোহিত রাসপুটিানের কথা। যে রাশিয়াকে প্রায় চূর্ণ করেছিল।

এ ক্ষমতা থাকার ক্ষেত্রে পাপের কোন অস্তিত্ব নেই। এটা নির্ভর করবে এটা নিয়ে আপনি কি করবেন তারই মধ্যে।

এখনও পর্যন্ত কেউই এ ক্ষমতা সম্পকে বেশি কিছু জানেন না। তবে আমাদের জানা আছে এ ক্ষমতা স্ত্রী আর পুরুষের মধ্যে জলন্ত অবস্থায় থাকে।

আমরা অনুভব করি মানুষের মধ্যে থেকে অনুভূতি কিভাবে প্রবাহিত হয়। স্ত্রীলোকরাই পুরুষের চেয়ে আগে আরও দ্রুত এটা অনুভব করতে পারে। আপনি যখন কারও সম্পর্কে বলেন : ‘অদ্ভুত ব্যাপার। আমি ওকে পছন্দ (বা অপছন্দ) না করে পারছি না।‘ আপনি যদি না জেনেও একথা বলেন আপনি সেটা বলছেন ওই প্রভাবের ফলেই। একে প্রভাব না প্রবাহ, কি বলবো?

এমন বহু মানুষ আছেন যাদের কাছাকাছি এলে আপনি বেশ সহজ, সুখী, নিরাপদ আর নিজেকে বেশ বড় ভাবতে পারেন। আবার অন্য সবাই আপনাকে বেশ অসুখী, ভীত, ছটপটে, অবিশ্বাসী করে তোলে। আপনি অদ্ভুতভাবে গুটিয়ে যান। যেন পথের মাঝখানে একটা ঝুমঝুমি সাপকে পড়ে থাকতে দেখেছেন।

এর কারণ কি জানেন? ওই অদ্ভুত কিছু তাদের মধ্যে থেকে প্রকাশ হতে চায় বলেই এরকম হয়। বিদ্যুৎ সম্বন্ধে আজকের যুগে আমরা অনেক কথাই জানি। আমরা জানি বিদ্যুৎ কি করতে পারে। আমরা

প্রতি মুহূর্তেই বিদ্যুতের কাজ দেখতে পাই … অন্যের ভিতরে আমাদেরও মধ্যে।

আপনি যখন অত্যন্ত ক্লান্ত, তখন আপনি বুঝতে পারেন আপনার মধ্য থেকে কিছু বেরিয়ে গেছে।

সে রকম পরিস্থিতিতে আপনি যতখানি সম্ভব মানসিক জোর নিয়ে ভাবুন না কেন কিছুতেই অন্যকে জয় করতে পারবেন না। কারণ আপনি তখন সেই প্রবহমান যাদুশক্তিকে (অদ্ভুত ভাবে) হারিয়ে ফেলেছেন–এটাই যে আপনার সব কাজ কথার মূল।

এই কারণেই ওই ক্ষমতাকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার।

আমরা এটা ঠেলে ফেলে দিই যখন আমরা অস্থির বা চঞ্চল হয়ে উঠি। যোগীরা যেমন স্থির হয়ে থাকতে পারেন আমাদের তা হওয়ার দরকার নেই। আমাদের নিজেদের কাজকর্মের জন্য জাগ্রত আর তৈরি থাকা চাই।

তবে আমাদের মাঝে মাঝে অবশ্যই শান্তভাবে বসে থাকা দরকার, তখন পা দোলানো বা চেযারের হাতলে শব্দ তোলা এসব করা উচিত নয়।

এর আসল উদ্দেশ্যই হলো ঐ ক্ষমতাকে বাঁচিয়ে রাখা, অপব্যয় না করা। এই ধরণের ছোটখাটো স্নায়বিক ত্রুটিতে এ ক্ষমতার অপচয় ঘটে যায়। আপনি এই সব অভ্যাস অনায়াসে দমন করতে পারেন। আজই সেটা শুরু করুক না কেন।

এইসব ব্যাপার যা আপনাকে দুর্বল, কর্মহীন করে দিতে পারে সেসব জিনিসের কথা একবার ভাবুন। রোগ, দুর্বল স্বাস্থ্য মানেই হলো আপনি কাজ করার বা ভালোভাবে খেলার ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি হারাচ্ছেন। আপনি ক্ষমতা হারাচ্ছেন বন্ধুত্ব অর্জন বা তা বজায় রাখতে। মানুষের আপনাকে পছন্দ আর বন্দনা করতে, আপনাকে সাহায্য করতে। ভাল খাদ্য, আরামদায়ক বিশ্রাম, যথেষ্ট ব্যায়াম-এসবই আপনাকে বন্ধুত্ব অর্জনের ওই মায়াময় শক্তি জোগানের জন্য অপরিহার্য।

এ ব্যাপারে আপনার মনের অনেক কিছুই করার আছে। আপনার যখন অত্যন্ত অসহায় বা খারাপ লাগতে থাকে আপনি নিজে কোন কাজই করতে পারেন। অন্য লোকের সঙ্গে তো কথাই ওঠে না।

তাই আসুন, আপ্রাণ চেষ্টা করে ভদ্র, উজ্জ্বল আর খুশিতে ভরপুর হওয়ার ব্যবস্থা করুন। আসল কথা হলো ভ্রু কুঁচকে কথা বলার বদলে হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুলুন। কথায় বলে সুখ আনন্দ অন্যের মধ্যেও সঞ্চারিত হতে চায়। আপনার মন থেকে সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর করে ফেলুন। মনে রাখবেন, কোন রকম দুশ্চিন্তা থাকা চলবে না! ভালো চিন্তা করুন, পরিষ্কার বন্ধুত্বপূর্ণ চিন্তা তাছাড়াও এসব বন্ধুত্বপূর্ণ কাজেও লাগান।

এর ফলে মানুষ যেভাবেই হোক আপনাকে পছন্দ না করে পারবে না।

তারা দেখবেন, নিজেদের গণ্ডি ত্যাগ করে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে আসতে থাকবে। আপনি দেখতে পাবেন অত্যন্ত কঠিন মানুষও কেমন বন্ধু হয়ে উঠতে থাকবে। আপনি যা কল্পনা করে দেখেন তার চেয়েও অনেক বেশি বন্ধু পেয়ে গেছেন।

এটা তাই চেষ্টা করে দেখার মতই। এমন কোন দরজা নেই যা কোন বন্ধুর পক্ষে উন্মুক্ত করা সম্ভব নয়।

.

সাত. নির্ভরশীলতা

মানুষ সাধারণত যা ইচ্ছে করে টিক তাই করে। অন্তত আমাদের তাই বিশ্বাস। এটাই আমরা সব জায়গায় দেখি। মানুষের মনে বা ভালো লাগে সে তাই করে।

অনুভূতি যাই হোক না কেন, কোন মানুষ তাতেই নিমগ্ন হতে চায়। এটা হয়তো বা ক্ষুধা, ভয়,বিতৃষ্ণা বা আগ্রহ বা এরকম যা কিছুই হতে পারে।

মানুষ কাজ করে যেহেতু তাদের অনুভূতি তাকে সেদিকেই ঠেলে দেয়।

আপনার যদি ইচ্ছে যাগে আপনার ইচ্ছে মত কাউকে দিয়ে কোন কাজ করিয়ে নেবেন, তাকে অর্থাৎ তার মনে এরকম অনুভূতি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে দেখুনতো! তার যদি আপনার প্রতি ভালো ধারণা থাকে, তাহলে নিশ্চিত থাকতে পারেন সে আপনাকে সন্তুষ্ট করবেই। তাকে আপনার প্রতি বিশ্বাস রাখতে দিন। তাকে বুঝতে দিন যে সে নিরাপদ। আপনার সঙ্গে কাজ করা নিরাপদ, আপনি তার কাছে নির্ভশীল, যে সে আপনাকে সন্তুষ্ট না করলে তার সমূহ লোকসানের সম্ভাবনা বরং আপনার সঙ্গে মানিয়ে চলায় তার লাভ ষোল আনা।

এই ধরণের বিশ্বাসই প্রায় সব রকম কাজের পিছনে দেখা যায়। যে ব্যক্তি এ ধরণের জিনিস তৈরি করতে পারেন তার পক্ষে তাঁর সঙ্গীদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে আদৌ বেগ পেতে হয় না।

তাহলে তিনি কী ধরনের মানুষ? আমরা এমনও শুনে থাকি মানুষের বাইরের হাবভাবের এতে কিছু করার রয়েছে। মানুষ বাইরের পোশাক ব্যবহার আর কথাবার্তার মধ্যে থেকেই বিচার করে থাকে।

অবশ্য এটা নির্দিষ্ট কিছুদূর পর্যন্তই সত্য। যে ব্যক্তি ফিটফাট, নিটোল, সব জায়গায় বেশ সহজ, সপ্রতিভ তিনি অনেকখানি আকর্ষণীয়।

তবু যে ব্যবসায়ী মানুষটি প্রথম ছাপ রাখার ব্যাপারে বেশি রকম মনযোগী, সে রকম বহু মানুষকেই আমরা দেখেছি বিশেষ রকম সাফল্য সৃষ্টিতে সক্ষশ নন।

আমাদের বিশ্বাস বাইরের মানুষটির আত্মবিশ্বাস সম্পর্কে অনেক অনেক কিছুই করার থাকে। এর চেয়েও বেশি কিছু দরকার হয়। আসল মানুষটিরই মূল্য অনেক বেশি : পোশাকের আড়ালে থাকা আসল ব্যক্তিটি, হাসির আড়ালের ব্যক্তিত্বটি। আমরা নিশ্চিত হতে চাই তার মূল্য আছে। সেই হবে নিশ্চয়ই বন্ধু। এরকম একজনের সঙ্গেই আমরা নিরাপদে চলতে পারি? তিনি যদি নির্ভরশীল হন, আমরা কোন রকম না চিন্তা করেই তার ইচ্ছানুযায়ী কাজ করবো।

এই নির্ভরশীল মানুষই ক্ষমতার অনুভূতি এনে দেন।

তার মধ্যে কিছু বস্তু’ আর কার্যকরী ক্ষমতা থাকে। তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ী। তিনি চট করে সরে যান না। তিনি বদলে যান না। তিনি এককথায় শক্ত এক কাঠামো। তিনি বৃথা বাগাড়ম্বর রাখেন না-কাজ করেন।

যে কোন মুল্যেই হোক তিনি কথার দাম রাখেন। তিনি কখনই ওজোর তোলেন না। কোন সময় ভুল করলে তিনি তা স্বীকার করেন, অপরের কাঁধে সে দোষ চাপাতে চান না। তিনি মেজাজী মানুষ নন। তার একটা বিশেষ “নীতি” আছে। আপনি বুঝতে পারবেন তাঁর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে।

তিনি কাজ করার আগে চিন্তা করেন। যে কাজই তিনি করে থাকেন তার পিছনে একটা সুনির্দিষ্ট কারণ বর্তমান।

নিজেকে তিনি ভালো ভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখেন। দেখেই বুঝতে পারবেন তিনি নিজেই নিজের প্রভু। তিনি সত্যিই যা ইচ্ছা করেন তাই করেন।

নিজের অনুভূতির তাড়নায় তিনি কখনই “ভেসে” যান না। তিনি সত্যিকার একজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। আমরা তা জানি আর অনুভবও করি। তিনি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারেন। আর মনে রাখবেন, হয় তো এই কারণেই আমরাও তাকে বিশ্বাস করি।

এ ধরণের মানুষ কখনই একদিনে তৈরি হন না। তিনি সব সময়েই নিজের উপর লক্ষ্য রেখে চলেন। তিনি কি ধরণের মানুষ তার পরিচয় তার সারা দেহেই যেন আঁকা থাকে।

আসলে বেঁচে থাকার মধ্যেই তাঁর বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। আপনিও এটা করে দেখতে পারেন। আপনিও তা হলে তাই হবেন।

নির্ভরশীলতা গড়ে উঠতে সময় লাগে। তবে যখন তা গড়ে ওঠে সেটা সত্যিই কাজের মতই কিছু। তাই একেই চোখের সামনে রেখে দেবেন।

.

আট. ব্যক্তিত্বের যাদু

আপনি ঈর্ষা করেন এরকম মানুষ অন্ততঃ একজন নিশ্চয়ই আছেন।

আপনি হয়তো বলেন, ‘আহা’ ওর মত যদি হতে পারতাম। কেমন চমৎকার মানুষ! যেখানেই উনি যান সকলকে বেশ মানিয়ে চলেন! মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে ওর কোন রকম অসুবিধাই হয় না!

আসলে মানুষটির মধ্যে কি আছে সেটা বলা অত্যন্ত কঠিন কাজ। অন্ততঃ বিশেষ কিছু তো চোখে পড়ে না।

তিনি মোটেই বেশি রকম বুদ্ধিমান বলেও মনে হয় না।

অন্য কারও তো নয়ই। অহঙ্কার করার মত কোন চাকচিক্যও নেই। এটা তার পোশাকেও নেই। কথা বার্তাতেও না।

অথচ আশ্চর্যের কথা তার সেই ক্ষমতা কিন্তু রয়ে গেছে। ‘এমন লোককে সত্যিই পছন্দ না করে পারা যায় না!’

যে লোকই তাঁর সংস্পর্শে আসে তাকেই কথাটা বলতে শোনা যায়।

সত্যিই বিরাট একটা ব্যাপার–এরকম কিন্তু থাকা সত্যিই কাজের। সেই এমন কিছু যা চট করে মানুষকে জয় করে নেয় … তাতে কোন ঝামেলাও হয় না। এই জিনিসটা হলো এই : মানুষকে চট করে বন্ধু করে নেওয়া, সত্যিকার চিরকালীন বন্ধু-আর সে বন্ধু করে ভোলা আপনাকে সাহায্য করতে, সেবা করতে।

কোন মানুষের সঙ্গে প্রথম যখন দেখা হয় আপনি হয়তো তখন চিন্তিত হয়ে পড়েন ঠিক কি কথা বলবেন বা সঠিক কোন কথা বলবেন-ঐ সময় আপনি নিশ্চয়ই ভাবতে পারেন মনোরঞ্জন করার ওই যাদু যদি আপনার থাকতো!

আসুন ব্যাপারটা নিয়ে এখনই ভাবা যাক। একরকম একজন মানুষের মধ্যে, তার বাইরের প্রকাশে কি দেখি আমরা?

তিনি কখনই স্বার্থপর মানুষ নন। কিছুতেই তা নন। তিনি তা যদি হতেন, কে আর তা হলে তাকে পছন্দ করতে চাইতেন?

তিনি কোন সময়েই নিজের সম্পর্কে ভাবেন না–এটা পরিষ্কার তিনি কোনভাবেই কখনও তাঁকে আপনার উপর চাপিয়ে দিতে চান না …কখনই তিনি তাঁর মতবাদ, তাঁর ইচ্ছা বা ভাবনাকে অপরের উপর চাপাতে চান না।

এ বিষয়ে আপনি যতই চিন্তা করবেন এটা ততই পরিষ্কার হয়ে যাবে। যে কোন রকমেই হোক তিনি পশ্চাৎপটে থাকার ব্যবস্থা করে ফেলেন।

যে কোন মুহূর্তেই তিনি আপনাকে দেখে খুশি নন।

আপনার কথা শুনে যেতে কখনই তাঁর ক্লান্তি আসে না। কখনই তিনি অবসাদেও ভোগেন না। অন্তত শ্রোতা হিসেবে কখনই আপনার তা মনে হবে না।

তার চমৎকার ধৈৰ্য্য আছে–প্রতিটি ক্ষেত্রেই তা প্রকট। কোন রকম বাধা না দিয়েই তিনি আপনার কাহিনীর শেষ পংক্তি অবধি শুনে যাবেন। এই পরামর্শটা আপনি একবার নিয়ে দেখতে পারেন।

তিনি বেশ আগ্রহ নিয়ে শোনেন। আপনিও জানেন তিনি বেশ আগ্রহী। তিনি মাঝে মাঝে প্রশ্ন করেন। তিনি আপনাকে অনুসরণ করেন।

তিনি যেখানেই থাকুন একই রকম থাকেন। কার সঙ্গে কথা বলছেন তিনি ভাবতে চান না, তার কথা শুনে যান।

তার মন বোধশক্তি হারায় না–পাঁচ বছরের শিশু বা পঞ্চাশ বছরের কারও সঙ্গে কথা বললেও তার মন তৈরি আর ব্যস্ত থাকে। আসলে তার আগ্রহ জাগে।

তিনি সব কিছুর মধ্যেই আনন্দ পেতে থাকেন। এ ব্যাপারটা বেশ ভালোভাবে মনে করে রাখার চেষ্টা করুন।

তাঁর মন বেশ সজীবতায় ভরা বলেই যে কোন দিকেই মোড় নিতে পারে। সে মন সর্বদাই তাজা। মরচে পড়া কোন মন নয়।

সেই মন সব জায়গাতেই–সহজ।

তিনি কোন জায়গাতেই বেমানান নন। সব জায়গাতেই তিনি সুস্বাগতম। যে কোন অবস্থাতেই তিনি মানিয়ে নিতে পারেন। এক ধরণের বহুরূপী বলেই তাঁকে হয়তো আপনার মনে হবে।

তবে তাঁর সম্পর্কে আসল ব্যাপার হলো তাঁর চারপাশের সবকিছু সম্পর্কেই তিনি ওয়াকিবহাল আর জাগ্রত। তারও নানা ঝামেলা আছে–সে অর্থে কারই বা তা নেই? তা সত্বেও তার অভ্যাস হলো সে সবে আদৌ নজর না দেওয়া।

আসলে তার আশে পাশের সব কিছু আর-তার বাইরের জিনিস আর মানুষের মধ্যেই তিনি আকর্ষণ অনুভব করেন।

তিনি অপরের প্রশংসা করেন। আর তাই আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে অন্যরাও তার প্রশংসা করে থাকেন। তাই কি?

.

নয়. কথা বলার যাদু

আপনিও এই দুনিয়ায় অনায়াসে এগিয়ে যেতে পারেন। সহজেই পথ করে নিয়ে বাধা বিপত্তি হটিয়ে আপনার সঙ্গীর চেয়ে দ্রুতই বোধ হয় এগোতে পারেন।

আপনিও নতুন নতুন বন্ধুত্ব অর্জন করে তাদেরই কাঁধে বাহিত হয়ে এগিয়ে চলতে পারেন। আপনিও একটা শক্তি হতে পারেন–সে শক্তিতে ছুটেও চলতে পারেন। আপনাকে যা করতে হবে তা হল নিজেকে ব্যক্তিত্বের যাদুতে ভরিয়ে তুলতে হবে। এটাই আপনাকে সামনের সারিতে পৌঁছে দিতে পারে। এরই সাহায্যে আপনি পেতে পারেন যথাযোগ্য স্থান।

এর ফলে আপনাকে করে তোলা হয় দলের অধিনায়ক। আপনিই হয়ে ওঠেন কাজের অধিকারী। সকলেই কথাটা জানে। আপনি সকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তাতে কোনই সন্দেহের অবকাশ নেই।

এর অর্থ আপনি আলাদা কিছু।

আপনাকে যা করতে হবে তা হলো নিজেকে কখনই এমনভাবে প্রকাশ করতে চাইবেন না যাতে লোকে বলতে পারে : ‘যাঃ! লোকটার মধ্যে কিছুই নেই! ওর মধ্যে এমন কিছু দেখতে পাচ্ছিনা। সস্তাদরের কিছু। এমন মানুষ সম্পর্কে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।‘

লক্ষ্য রাখবেন যাতে আপনি আপনার কাছাকাছি সকলকে প্রভাবিত করতে পারেন। তারা এর ফলে আপনাকে দেখে খুশি হবে। তারা যেন কখনই মনেনা করে যে আপনার সঙ্গে কথা বলার অর্থ সময় নষ্ট করা। বলার মতই কিছু বলতে চেষ্টা করুন। ভালোভাবেই তা বলুন।

সবকিছু বলার একটা রাস্তা আছে, সময়ও আছে।

আপনি হয়তো বাধা বিঘ্নর মধ্য দিয়ে কথা বলার অবস্থাতেও পড়বেন। আপনি একটা বিষয়ে বা মানুষ সম্পর্কে কথা বলে যেতে পারেন। একজন ভালো বক্তা প্রায় সবই করতে পারেন, যা হতে চান তাই হতে পারেন।

তার কণ্ঠস্বরই তাকে সাহায্য করে চলেছে। আপনি ঘন্টার পর ঘন্টা শুনে যেতে পারেন। এ যেন সঙ্গীত। এ সঙ্গীতের মতই বয়ে চলে। মাঝে মাঝে মনে হতে পারে এ যেন বাক্যের অতীত। কোন বাজে শব্দ নেই সবই মুচ্ছুনায় ভরা।

আপনি যখন কথা বলবেন তাতে সকলকে আনন্দ দান করুন।

দেখা আর নেয়াই হলো এ খেলার নিয়ম। অতএব কথা বলুন আর তারই সঙ্গে অপরকেও বলতে দিন।

শ্রবণ করতে শিক্ষা করুন। শ্রেষ্ঠ বক্তাই শ্রেষ্ঠ শ্রোতা হতে পারে।

অনেক অবুঝ মানুষ চান সবাই তাদের কথা শুনুক। তারা কিন্তু সত্যিকার অবুঝ নন। আসলে তারা বক্তব্য ঢেলে দিতে চান। সুযোগ দিন-বৃষ্টিধারার মতই তা ঝড়ে পড়ে। একটু পরেই কোন মেঘ থাকে না। শুধু স্থির হয়ে বসে তারপর শুনুন। সবই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

যখন কথা বলবেন অপর ব্যক্তির কথাটাও ভাবুন।

তারও কিছু বলার আছে। তাই তাকে থামাতে চাইবেন না। এটাই তাকে চনমনে করে তোলার নিশ্চিত পথ।

গোলমাল করে ফেলবেন না। এটা বিরক্তিকর। মানুষ অর্ধ পথের কোন ঘটনা চায় না। যা মনে হয় তাই বলে ফেলুন আর যা বলতে চাইবেন সঠিক ভাবেই বলুন।

এরকম যিনি করতে পারেন তাকে স্বভাবতই সকলে পছন্দ করে যে মানুষ এটা করেন না তার ভাগ্যে জোটে দ্রুত বঞ্চনা। তার আসল কারণ শিগগিরই প্রকাশ হয়ে পড়ে। শ্রোতা তখন ভাবেন : ‘লোকটি আমার কাছ থেকে কিছু বের করে নিতে চাইছে। এই ফাঁকা কথা বার্তার পিছনে কিন্তু একটা কথা রয়েছে। লোকটি কৌশলে আমাকে ফাঁদে ফেলতে চাইছে! নোঙরা লোক। একে বিদায় করতে হবে।’

আপনাকে কথা বলার সময় চাষাড়ে বা খারাপ হতে হবে না। কখনই সেরকম হওয়া উচিত নয়। আপনি শুধু তাতে আপনার সত্তাকে প্রকাশ করে দেবেন। নোঙরা আর খারাপ কথার টিকে থাকে না। এতে সত্যিকার আনন্দ মেলে না। কিছুক্ষণ পরই তা বিতৃষ্ণা এনে দেয়। পরিষ্কার, সোজা পরিচ্ছন্ন কথায় যাদু থাকে। যে কোন মানুষই যে কোন জায়গাতেই যে কোন সময় দাঁড়িয়ে এধরণের কথা শুনবেনই।

আপনি যদি উজ্জ্বল, পরিষ্কার কথা বলতে পারেন, তাহলে আপনি ভাগ্যবান।

মানুষ একই সঙ্গে হাসতে গিয়ে ভূকুঞ্চিত করতে পারে না। এটা হয়ে উঠবে হাসির ব্যাপার। আর এতে যে কেউ সত্যিই ভালো বোধও করতে পারে।

বেঠিক জায়গায় কোন ঠাট্টা করা অন্যদিক আবার সে দারুণ বিরক্তিকর হয়ে ওঠে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ অতি বাজে রুচিও বটে। এটা অসময়ের আর বেসুরো। যে মানুষ এরকম করেন (আমরা অনুভব করি) তিনি মনোযোগ দিচ্ছেন না। তিনি বুঝতেই পারেন না তার ভাঁড়ামো কেউ চাইছে না। তার রুচি বলে কিছু নেই। সে আসলে একজন সব কাজ পণ্ড করার মানুষ।

কোন বাজে গোছের ভার সত্যি বাজে মানুষ। এ ধরনের মানুষ আমাদের থেকে যতদূরে থাকে ততই ভালো। এমন ধরনের মানুষকে আবর্জনা স্থূপেই নিক্ষেপ করা দরকার। তার আসল জায়গা এরকম জায়গাতেই।

.

দশ. আমাদের সবার মুখের মুখোশ

আপনি আর আমি দুজনে ভালোভাবেই জানি মানুষের মনে কী ঘটে চলেছে তা আমাদের কারও পক্ষেই জানা অত্যন্ত কঠিন।

মানুষের বাইরের আকৃতিতে কখনই তার মনের ভিতরে কি ঘটে চলেছে তার কণামাত্রও প্রকাশ ঘটে না।

প্রায়শ দেখা যায় কোন মানুষের কাজে কর্মে সে যা ভাবে তার ঠিক বিপরীত প্রকাশই ঘটে চলে। এমন বহু মানুষ আছে উদাহরণ দেওয়া যায় তাদের বাইরের কর্কশতা, তাদের সঠিক পরিচয় মোটেই নয়।

মনে রাখতে হবে আমরাও সব সময় স্বাভাবিক নই।

অপরিচিতদের কাছে আমরা আমাদের আসল সত্তা প্রকাশ করতে চাই না, এটা যাদের আমরা বিশ্বাস করিনা বা যারা আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করে বা আমাদের দুর্বলতা দেখাতে চায়, তাদের কাছে প্রকাশ করি না।

আমাদের মাঝে মাঝে মনে হয় স্বাভাবিক আচরণ করলে আখেরে কোন কাজই হয় না।

অতএব এই কারণেই আমরা খোলসের মধ্যে ঢুকে পড়ি। আমাদের নিজেদের রক্ষা করতে হয়। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কোন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। আবার শেষ পর্যন্ত আমরা নিজেরাই এই দ্বিতীয় সত্তাকে প্রথম আসল সত্তার সঙ্গে আলাদা করে চিনে উঠতে পারি না।

শুনে বেশ হতাশাব্যঞ্জক মনে হচ্ছে, তাই না?

অন্য মানুষটি, যখন তার নিজের সত্তাসহ পরিপূর্ণতায় হাজির তখন কি? তার দিকে লুকিয়ে দেখার কোন সামান্য সুযোগ থাকে?

আমরা একটা বন্ধ দেওয়ালে ধাক্কা খাব তাতে আর সন্দেহ কি? এখন অনুমতি ছাড়া সে দূর্গে এক পাও রাখার সুযোগ নেই।

যদি ধরা যায় কোনরকমে আমরা বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারি, তাহলেই ভিতরে ঢোকানো সেতু নামিয়ে দেওয়া হবে আর আমরাও হেঁটে ঢুকতে পারবো এবং তখনই মানুষটিকে তার বর্ম ছাড়া অবস্থায় শিশুর সঙ্গে খেলায় মত্ত দেখতে পাবো।

গোলমাল হলো সেখানেই। মানুষ খুবই লাজুক। তারা ভয় পায়। আর ঠিক এই কারণেই আমরা তাকে সঠিকভাবে জানতে পারি, বুঝতে পারি না ভুল কাজই বা করি কেন বা অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তাই বা বলি কেন।

কারণ হলো তারা আসলে ছদ্মবেশে থাকে।

এখন আপনার কাজ হলো তার ওই বাইরের পোশাক খোলার ব্যবস্থা করা। অবশ্য যতখানি সহজ ভাবছেন ততটা নয়। এতে অনেক সময় বছরের পর বছরও কেটে যায়। কখনও বা সারা জীবনেও হয় না।

অপর মানুষটিকে সহজ হতে দিন এটা হলো সবসেরা উপায়। তাকে বুঝিয়ে দিন ভয় পাওয়ার মত কোন কারণ নেই। তাকে নিরাপদ মনে হতে দিন। তাকে আপনাকে বিশ্বাস করতে সুযোগ দিন।

.

ব্যক্তিত্ব বিকাশ

যদি বন্ধুত্ব অর্জন করতে আগ্রহী হন, তাহলে বন্ধু হয়ে উঠুন। আপনি নিজেকে ক্ষুদ্র করে তুলুন। যার অর্থ হলো : অপর ব্যক্তিকে বিরাট মনে হতে দিন।

তাকে আপনার দুর্বলতাগুলির কথা বলুন। তাকে বুঝিয়ে দিন যে আপনি অনুকম্পা বা সাহায্য চাইছেন।

তাকে আপনার জন্য সামান্য কাজ করার জন্য অনুরোধ করুন। যে কোন ভাবেই হোক তাকে শ্রেষ্ঠতর ভাবতে সুযোগ দিন।

তার মত ফিটফাট পোশাক পরিধান করবেন না। কখনই দেখাতে চাইবেন না আপনি তার থেকে বেশি জানেন। বরং প্রশ্ন করুন। তাকেই কথা বলতে দিন। সব ব্যাপারে তার পরামর্শ আর মতামত চাইতে থাকুন।

মাঝে মাঝে সামান্য প্রশংসায় প্রায়ই কাজ সমাধা হয়। তবে অতিমাত্রা কিন্তু বিপজ্জনক। তিনি হয়তো ব্যাপারটায় : সন্দেহ করতে পারেন পেছনে কিছু আছে মনে করে।

তিনি যখন কথা বলবেন বাধা দেবেন না। শ্রবণ করার কৌশলটা শিখে ফেলুন। তার মুখ বন্ধ হতে দেবেন না। কখনই জানার ভান করবেন না বা কাটা কাটা কথাও বলবেন না।

কখনই তর্ক করবেন না এতে অপর ব্যক্তিকে নিজেকে ছোট ভাবতে সুযোগ দেয়। আমরা কখনই এই মনে করে কাজ করি না যে আমাদের নিজেদের মনেই তর্ক করে নিয়েছি। আমরা কাজ করি আমাদের অনুভূতির তাগিদে। কোন মানুষের যদি অন্তর্মুখী মন থাকে তবুও সে মানুষ, শুধু তার যদি অনুভূতি থাকে। অনুভব শক্তি ছাড়া কোন কাজই করতে পারে না। তর্কের ফলে বন্ধুত্ব হারাতে হয়। এ হলো দুই মনের লড়াই। এরকম ব্যাপার কখনই করবেন না … অপর ব্যক্তির সঙ্গে লড়াই।

অতএব, তর্ক করবেন না। তার অনুভূতিকে নাড়া দিন।

.

এগার. অপরের প্রশংসা করুন

সারা পৃথিবী আপনার বিরুদ্ধে থাকলে আপনার পক্ষে বেশিদূর এগোনো কখনই সম্ভব নয়, নয় কি?

সবচেয়ে ভালো পথটি হলো যত বেশি সম্ভব মানুষকে জয় করে আপনার পাশে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা।

যাদের সঙ্গে দেখা হয় তাকেই বন্ধু করে তোলার ব্যবস্থা করুন। বন্ধুত্ব জিনিসটিই অত্যন্ত দামী। এই শিল্পকলার কৌশলটা শিখে নিন। এমন কোন দরজা নেই যা বন্ধুত্ব খুলতে পারে না।

একটু থেমে ব্যাপারটা ভাবুন। মানুষ অমুক অমুককে পছন্দ করে কেন? মানুষ অমুক–অমুককে পছন্দ করে না কেন? মানুষ কি আমাকে দেখে খুশি হয়? তারা কি আমায় সাহায্য করে খুশি?

মূল কথাটা হলো এই :

স্ত্রী বা পুরুষ কি চায় কোন বুদ্ধিমান মানুষই সেটা জানত চেষ্টা করে : তারা কিভাবে বন্ধু তৈরি করে।

আপনি যখন চেনেন না এমন মানুষের সংস্পর্শে আসেন, অথচ জানেন তাকে কাজে লাগানো যেতে পারে, তখন আপনি কি করবেন?

কেন, অবশ্যই তাকে আপনাকে পছন্দ করার ব্যবস্থা করতে হবে। দেখুন কিভাবে তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেন। তার আগ্রহ জাগাবার চেষ্টা করুন। দ্রুত শিখে ফেলুন তার সন্তোষ বিধান কিসে হয়। অপর ব্যক্তিটির কথা চিন্তা করুন–কৌশল হলো এটাই।

বন্ধু হয়ে উঠুন, তাহলেই দেখবেন আপনি বন্ধুত্ব করতে পারছেন। অপরের জন্য ছোট-খাটো (বা বড়) সেবামূলক কাজ করায় নিজেকে নিয়োজিত করুন।

অপরকে বুঝতে দিন, অনুভব করতে দিন আপনার জন্যে চিন্তা করা কাজের। তাহলেই তারা আপনার কাজে আসবে।

আমরা এভাবেই তৈরি। আমরা প্রধানত যা চাই তাই নিয়েই ব্যস্ত থাকি। অমুক, অমুক, যদি কাজে লাগার মত না হয় তাহলে তাকে আমরা বাতিল করে দিই।

ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর আর স্বার্থপর বলে মনে হচ্ছে। তবে জানবেন এটা সাংঘাতিক রকমের সত্য।

প্রত্যেকে কি চায়?

আপনি হয়তো এটা, ওটা নানা জিনিস ভাবতে পারেন। আপনি হয়তো এখনও বলবেন, একজন মানুষ যা চায় তার সীমা নেই।

কথাটা ঠিকই। কিন্তু সব চাহিদার উপর কোন্ চাহিদা আছে? সবার সেরা চাহিদা। যতক্ষণ পারেন ব্যাপারটা একটু চিন্তা করে দেখুন।

আপনি আমাকে প্রশ্ন করলে আমার বলা উচিত: আমরা সবাই চাই মানুষ আমাদের ভালো চিন্তা করুক। আমাদের দিকে তাকিয়ে লোকে হাসাহাসি করবে তা আমরা সহ্য করতে পারবো না। আমরা চাই মানুষের কাছে আমাদের দাম থাকুক–ঠিক তাই। আমরা চাই মানুষ যে আমাদের পছন্দ করে সেটা প্রকাশ করে দেখাক। আমাদের সঙ্গে ঠাণ্ডা ব্যবহার করলে আমরা আহত বোধ করি। আমরা সূর্যালোক আর আরাম ভালোবাসি। কেই বা তা না চান?

তাই ঠাণ্ডা ভাব প্রকাশ করবেন না। এতে শুধু মানুষকে দূরেই ঠেলে দেওয়া হয়।

নিজেকে তাই বলুন : অমুক, অমুকের পরিচয় জানা দরকার। এমন অনেক বিষয় আছে ওরা জানেন আমরা তার কণামাত্রও জানি না। চেষ্টা করা যাক ওঁদের কাছ থেকে কি কি শেখা যায়।

যে বই পাঠ করতে আপনি রাত কাটিয়ে দেন মানুষ যেন ঠিক সেইভাবেই আপনাতে নিমগ্ন হতে পারে।

প্রকাশ করে দেখান যে তাদের আপনি আগ্রহের মনে করেন। তাদের শীতল করে তুলবেন না। তাদের মধ্যে উত্তাপ সঞ্চার করুন।

তবে মনে রাখবেন, কখনই বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না, তাতে মানুষ ভাববে আপনি ঠিক আসল নন।

একটি সততায় ভরা আগ্রহ দেখানোর ব্যবস্থা করুন–তাকে প্রকাশ করুন।

কোন মানুসের ভালো গুণগুলো লক্ষ্য করবেন। তাকে নির্দিষ্ট করুন। বেশির ভাগ সময়েই তার উপর নজর রাখুন!

তার মধ্যে যে সব ক্ষুদ্র বিষয় দেখতে পাবেন সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। কোন রকমেই কাটাকাটি ভঙ্গী, তীব্র বা খিটখিটে ভাব জাগাবেন না।

আপনাকে যা করতে হবে তা হলো গুহামানবকে তার গুহার মধ্য থেকে টেনে বের করে আনতে হবে। আপনাকে তাকে আপ্যায়ন করতে হবে আলো, বাতাস আর রোদ্দুরে মেলে ধরে। আর তাতে সে কিছুতেই আপনাকে এড়িয়ে যেতে পারবে না।

.

বারো. অপরেই প্রথম

সম্ভবতঃ এটা না করে পারাও যায় না। আমরা এইভাবেই তৈরি। কারণ আমরা সারাক্ষণ ধরে খালি আমাদের নিজেদের কথাই চিন্তা করতে থাকি।

আমরা যা চাই, তাই আসে প্রথমে! আমাদের অপছন্দের ব্যাপারটি কাজ করে …. দারুণ ভাবে। আমরা যা চাই সেই ভাবেই সব ব্যাপার ঘটা উচিত। আমাদের এই ছোট্ট পৃথিবী আমরা যেন আমাদের চারপাশে দোল খেতে থাকে।

আর ঠিক এইসব কারণেই আমরা আঘাত পাই।

আমরা এমন সব ভুল ভ্রান্তি করি, যার জন্য প্রচুর ক্ষতি সহ্য করতে হয়। কারণ আমরা পরিষ্কারভাবে আর সঠিক পথে সব দেখতে পাই না।

অথচ আমরা কিন্তু কেন্দ্র বিন্দু আদৌ নই। আমরা হলাম পরিপূর্ণতার এক সামান্য অংশই মাত্র যে পরিপূর্ণতা আমাদের মরণে বা বেঁচে থাকায় কণামাত্র কিছু যায় আসে না।

আমরা যত বেশিদিন জীবিত থাকবে, ততই অধিকতর ভালোভাবে যতখানি সম্ভব আমাদের নিজেদের ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করা উচিত।

তাই ভোলার চেষ্টা করা দরকার নিজেদের ঠেলে দিতে, এগিয়ে নিতে। ঝগড়া করতেও ভুলে যাওয়া দরকার! আর ভোলা দরকার আমাদের নিজের স্বার্থেই। অপর ব্যক্তিকে নিচে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করাও ভুলে যান।

কথাগুলো হয়তো দুর্বল আর মূল্যহীন কচকচি মনে হতে পারে : সেটা হলো নিজেকে নিজের সত্তাকে ভুলে যাওয়া …. স্বার্থহীনতা আনতে চাওয়া।

প্রাত্যহিক জীবন আর কাজকর্মে, অবশ্য এরকম কিছু কাজ দেয়। এতে যন্ত্রটি ভালোভাবে চলায় সাহায্য করে। এতে বন্ধুত্ব অর্জন হয়। এতে তিক্ততা, বিরুদ্ধতা আর কষ্টকর বাধা দূর হয়ে যায়।

এসব থেকে বোঝা যায় প্রত্যেককে একটা উদার মনোভাব গ্রহণ করতে হবে।

যে নিজের কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসে সে অন্য এক জগত আবিষ্কার করে ফেলে। সে নিজের দৃষ্টি, অনুভূতি, মতবাদ ত্যাগ করে। সে চেষ্টা করে সম্পূর্ণ অপর ব্যক্তি হয়ে উঠতে। অপর ব্যক্তিটি যে দৃষ্টিতে সব কিছু দেখে সেও সেই দৃষ্টিতে সব কিছু দেখতে চায়।

সে যা কিছু করে যা কিছু বলে আর লক্ষ্যকরে তার মধ্যে থাকে এই উদ্দেশ্য। সে আসলে অপর ব্যক্তির শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে তার প্রকৃত অনুভূতিটা টের পেতে চেষ্টা করে।, এই রকমই যদি আমাদেরও উদ্দেশ্য হয় তা হলে আমরা সত্যিই লাভবান হব। আমরা তাতে কম ভুলও করব। এতে আমাদের অনেক কৌশল আয়ত্ত হবে। আমরা এর ফলে এখন যা আমরা করি তার চেয়ে ঢের কমই অপর মানুষের কাছে হারতে চাইব।

এর অর্ধেক সময়েই আমরা আরও বেশি এগিয়ে যাবো।

আসুন আমরা মানুষকে বুঝতে চেষ্টা করি। আসুন তাদের মনের অভ্যন্তরটা দেখে নিই। কাজেই তাদের অনুভূতি হৃদয়ঙ্গম করি আর দেখে নিই আমাদের এই সব কাজে কর্মে তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়।

ঠিক একথাই আমরা বলতে চাই আমরা যখন কারো সঙ্গে মেলামেশা করার সময় নিজেদের বলতে চাই : ওহ্ যদি জানতাম লোকটা কি ভাবছে।

এক কথায় অপর ব্যক্তিটির মতবাদ বা দৃষ্টিকোণ আপনার বা আমার কাছে খুবই প্রয়োজনীয় হতে পারে।

এতে তার প্রকাশ ঘটে। আপনি সে প্রকৃতই যা তাই দেখতে পারেন। আপনি তাকে সম্পূর্ণভাবে জানতে পারেন। আপনি তার শক্তি আর দুর্বলতার কথা জানতে পারেন। সে কি চায় তাও আপনি জানতে পারবেন। তিনি যা চান আপনি তাকে তা দিলে তিনি আপনার ইচ্ছা মতই কাজ করে যাবেন।

একজন সমঝদার ব্যক্তি হওয়ার এটাই হলো যোগ্য পুরস্কার, যিনি সহজেই অপর ব্যক্তির মন আর হৃদয়ে প্রবেশের ক্ষমতা রাখেন।

.

তের. আগ্রহ ও কল্পনা শক্তি

একজন সফল মানুষ যা আকাভক্ষা করেন তাই পান। কোন কিছুই তাকে আটকে বা দমিয়ে রাখতে পারে না।

নিজের প্রতি তার কোন দরদ থাকে না। প্রয়োজন দেখা দিলে, তিনি খাদ্য, ঘুম, টাকা পয়সা আর বন্ধুদের ত্যাগ করে চলতে পারেন। তার মাথায় ঘুরপাক খায় একটা চমৎকার ধারনা আর বুকের মধ্যে চাপা থাকে তীব্র কোন অনুভূতি। এগুলোই তাকে শক্তি জোগায়। এগুলোই তাকে একজন বীরের ঔজ্জ্বল্য দেয়।

তিনি হলেন আগ্রহের জ্বলন্ত প্রকাশ। তিনি যদি সফল না হন তাহলে আর কে হবেন? তিনি যা চান তাই ই পান। কারণ তিনি যা পান তাই চান। আপনাকে বা আমাকে যে বিরাট ব্যাপারকে মোকাবিলা করতে হবে তা হলো এটাই।

কোন মানুষই তার গন্তব্যস্থলে উপস্থিত হতে পারবেন না আর নিজের বা অন্যের কোন কাজেও লাগতে পারবেন না, যদি না তিনি সেখানে উপস্থিত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। আর ঠিক এই কারণেই বহু মানুষ পিছিয়ে থাকেন–তারা এগিয়ে যাওয়ার কোন রকম ইচ্ছাই মনে পোষণ করেন না।

এই আগ্রহ ব্যাপারটা একটা তীব্র শক্তি।

এটা মানুষকে উত্তপ্ত করে তোলে। এ শক্তি মানুষের মনে উজ্জ্বল প্রভায় জ্বলতে থেকে তাকে আনন্দ আর স্বর্গীয় আলোকে স্নান করায়। এ শক্তি আবার একজন বা তার আশে পাশের সকলকেই প্রজ্জ্বলিত করে ধুলোয় পরিণত করতে পারে।

এ এমন এক শক্তি, যে শক্তি কখনই ব্যর্থ হয় না। এ শক্তি তীরকে লক্ষ্যে নিয়ে যায়। এটা অনায়াসে লক্ষ্যভেদ করতে পারে।

এ হলো প্রমত্ত শক্তি।

এ শক্তিকে আবার রক্ষাও করে। এ শক্তির জন্ম দেয়।

আগ্রহ জীবনকে উদ্দেশ্য দান করে। আপনার মধ্যে তীব্র আগ্রহ থাকলে আপনি কখনই আপনার নিজেকে আর নিজের সুযোগকে নষ্ট করতে পারবেন না। আগ্রহ আর বিনষ্ট করার কাজ পাশাপাশি চলতে পারে না।

যে মানুষ আগ্রহী তিনি জানেন তার চাহিদা কি। তিনি জানেন কোথায় চলেছেন তিনি। তিনি কাজ করেন, স্বপ্ন দেখেন না। তিনি কাজকে খেলার মতই দেখেন। ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি খুঁজে পান কাজের আনন্দ। তার একটা মিনিটও নষ্ট করার মত থাকে না, পৃথিবীতে তিনিই সবচেয়ে সুখী মানুষ। তার আগ্রহ আছে, তিনি গভীরভাবে নিমগ্ন হয়ে পড়েন। সব কিছুর মধ্যেই তিনি মিশে যান। সব বিষয়ের মধ্যেই তিনি মিশে যান। সব বিষয়ের মধ্যেই তিনি সমর্পণ করেন দেহ-মন।

আগ্রহ এরকম কিছুই করতে পারে। সত্যিই এ অমূল্য কিছুই। আগ্রহ জীবনকে ধারালো করে তোলে।

এর আর এক নাম হলো মনোযোগ। যে ব্যক্তির আগ্রহ আছে তিনি মনোযোগ দেবেনই। তার কাছে একটা কাজ করার মতই সময় থাকে। একটা কাজের কথাই তিনি ভাবেন আর করার আশা করেন।

এটা একটা গৌরবময় একাগ্রতা।

এ হলো শরীরে, মনে কোন ধারনা, আদর্শ ঢুকিয়ে পবিত্র করে তোলা। আর এই ভাবেই অদৃশ্য বস্তুটি এসে যায়।

অতএব নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন কোন ধারণা (বা আদর্শ) একজনের ব্যাপারে কি করতে পারে।

এটা তাকে এমন জায়গায় তুলে দিতে পারে বা এমন গভীরে প্রোথিত করতে পারে যা তিনি ভাবতেও সাহস পাবেন না।

আর ঠিক এমনটাই তাকে তিনি যা আছেন বা হতে যাচ্ছেন তাই করে তোলে। তিনি সফল হতে পারেন বা ভেসে যেতেও পারেন। এটা পরিপূর্ণ নির্ভর করে তার আদর্শ কেমন তারই উপরে।

আমাদের প্রত্যেকেরই কোন আদর্শ আছে। এটা না থাকলে আমাদের কিছুই করা বা হওয়া সম্ভব হতো না।

ব্যাপারটা হয়তো এখনই পরিস্কার হতে চাইবে না, তবে সেটা আছে : আমরা কি হতে চাই তার সেই আদর্শ।

আমরা যে রকম, সেটা আমাদের আদর্শেরই ফলশ্রুতি।

আমাদের কাজ কর্ম বা আমাদের ভবিষ্যত এ দুনিয়ায় নিছক ওই আদর্শের প্রকৃত রূপদানের ফলে সত্য হয়ে ওঠে।

আমাদের নিজেদের এই রূপ, হয় আমাদের তৈরি করতে পারে বা বিনষ্টও করে দিতে পারে।

এ আদর্শ আপনার মনোমত না হলে তাকে নষ্ট করে ফেলুন। তারপর আবার নতুন করে আরম্ভ করে দিন। নিজেকে একটা নতুন আদর্শ দিন। আপনি যা হতে চান নিজেকে সেই ভাবেই গড়ে তুলুন। নিজেকে অপরের মতই কল্পনা করুন। তাকে আপনার সামনে আদর্শ হিসেবে রাখুন। আপনি যা চিন্তা করছেন তাই আপনি হবেন। একজন মানুষ মনে মনে যা চিন্তা করে সে তাই হয়ে ওঠে।

মনস্তত্ত্ববিদরাও তাই বলে থাকেন। তাদের বক্তব্য হল আগে মানসিক কোন প্রতিবিম্ব না থাকলে কোন কাজই সম্পন্ন হতে পারে না। ওই প্রতিবিম্বর মধ্য থেকে কাজের তাগিদ আর আকাঙক্ষা না এলে কোন কাজই হতে পারে না। কোন কাজ তা সেটা ভালো বা মন্দ যাই হোক সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে প্রতিবিম্বে যেমন ধরা পড়ে ঠিক তেমন ভাবেই।

আমরা যদি আমাদের নিজেদের উপরেই সন্তুষ্ট না হই তাহলে ওই প্রতিবিম্বকে দোষ দিতে হবে। মিথ্যাকে তাই চূর্ণ করুন। শুধু সত্যকেই বরণ করে নিন।

কারণ আমাদের মনে আর হৃদয়ে যে প্রতিবিম্ব আমরা পূজা করি আমরা ঠিক তাই।

.

চৌদ্দ. প্রত্যেকের সর্বস্ব

আপনি বা আমি ঠিক কি ধরনের মানুষ হতে চাই সেটা পরিস্কার ঠিক করার যোগ্য সময় এসে গেছে।

আপনি হয়তো বলবেন : তাতে কিছু আসে যায় না। আমরা একটা ইচ্ছা নিয়ে কাজ করি। তাই, ভাববার আর কি আছে?

আপনি যদি ভালো করে ভাবেন তাহলে অবশ্য আপনি দেখতে পাবেন এটা সত্যিই দারুন কার্যকর।

কারণ আসল খেলাটা হলো সঠিক গন্তব্যে কিভাবে তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যায়, সেই যাত্রা পথে মানুষদের কিভাবে সামলানো যায় আর কেমন করেই বা তাদের মোকাবিলা করে এগুনো যায়।

মানুষের সঙ্গে আমাদের মেলামেশা করতেই হবে। মানুষও আমাদের সঙ্গে কাজ করতে আসবে। তারা আমাদের জয়ী হতে সাহায্য করবে, পরাজয় বরণ করতে নয়। এটাই হলো আসল উদ্দেশ্য।

কারণ প্রথম কথাই হলো আমরা ঘৃণার বস্তু হতে চাই না।

অনেকে হয়তো বলে : ‘অমুককে দেখলাম! উঃ একেবারে অসহ্য। ওরকম লোকের ছায়া না মাড়ানোই ভালো।‘

এ ধরণের মানুষ যে, স্ত্রী বা পুরুষ যাই হোক অনুকম্পা করতে হয়। সে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখে। সে একাকী থাকে, লোকে তাকে এড়িয়ে চলতে চায়। সাধারণত তাই হয়। এর কারণ হলো লোক তার সম্বন্ধে যা ভাবে তার জন্য সে নিজেই দায়ী।

এ রকম লোক তার সঙ্গীদের সঙ্গে চলতে পারে না। সে যেখানেই থাকুক নিজের অবস্থা সে নিজেই জটিল করে তোলে। সেটা অফিস, বাড়ি বা ক্লাব, যেখানেই হোক।

সারা দুনিয়া যখন তার বিরুদ্ধে তখন তার পক্ষে ভালো কিছু করা কিভাবেই বা সম্ভব? আর এক ধরণের মানুষ আছে যার কোন বিশেষত্ব নেই।

দশ ভাগের এক ভাগেও তার মধ্যে কোন গোলমাল খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ তাসত্বেও সে অপরকে প্রভাবিত করতে পারে না। সে কাউকেই আকর্ষণ করে না। সে তার মনিব বা বন্ধুদের বলাতে পারে না, ‘আহা, কি চমৎকার লোক। এমন লোকের জন্য না পারি কোন কাজ নেই!’ অথচ সে হয়তো বা আরও দশগুণ বেশি গ্রহণীয়। তবে মানুষ তার পুরোপুরি মূল্যায়ন করতে পারে না। সে তার নিজের সখ, তার কাজ, তার ধারণা সব কিছুই নিম্নতম দামে বিক্রি করে, সর্বোচ্চ দামে নয়।

সে শুধু যদি জানতো জীবনের ভাণ্ডার থেকে আরও অনেক ঐশ্বর্য আদায় করা যায়!

অপর পক্ষে আপনি বা আমি হয়তো চলার পথে এমন দু’একজনের সাক্ষাৎ পেয়েছি যাদের কোনদিনই ভুলতে পারি না।

আমরা নিজেরাই বলাবলি করি : ‘অমুকের মধ্যে বিশেষ ব্যাপার আছে। তবে সেটা কি আমরা ঠিক ঠিক জানি না। কথায় তা প্রকাশ করা যায় না। তার মধ্যে কেবল এটুকু জানি যে মানুষকে আকর্ষণ করে কাছে টানে, দুলিয়ে দেয়। আপনি অনুভব করেন তিনি চমৎকার কিছু। তিনি অনেক উঁচু মানের মানুষ, সত্যিকার মানুষ। আপনি তাকে ভালো না বেসে পারেন না। তার মুখ থেকে শুধু কথা বেরোনোর অপেক্ষা, আপনি তা পালন করার জন্য তৈরি… আর আপনি যা করবেন তা সন্দেহ নেই। বন্ধুত্ব অর্জন। করার ক্ষেত্রে তার অদ্ভুত দক্ষতা আছে। তার বন্ধুরাই তাকে এমন তৈরি করেছে। তিনি আজকে যা হয়েছেন তারাই তা বানিয়েছে!’

এরকম একজন মানুষ হতেই আমরা চেষ্টা করবো।

আপনি হয়তো ভাবছেন কাজটা বড়ই কঠিন। আপনি অনুভব করেন তিনি সত্যিই আলাদা রকম। আপনি বা আমি যে জায়গায় অতি সাধারণ স্তরের।

চিন্তা করে বলতে গেলে, আমরা তার কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছতেও পারি।

এটা অবশ্যই আমাদের নাগালের মধ্যে। আসুন, ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখি।

ভাবার কথাটা হলো তিনি আমাদের চেয়ে কোন্ কোন্ ব্যাপারে আলাদা? তিনি তো বিশেষ কোন ভাবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন নি।

একটা উদাহারণ রাখছি : তিনি বিশেষ রকম আঁটোসাঁটো কোন খেলোয়াড় বা পালোয়ান নন। তাছাড়া তিনি অস্বাভাবিক রকমের তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও নন। তা হলেও, সকলেই তাকে প্রশংসা করে।

সকলের কাছে তিনিই সর্ব!

তিনি বেশি কথা বলেন না। তাসত্বেও তিনি কথাবার্তা ভালোই বলেন। অপর লোকের হাজার কথায় যা হয় তার দশটিতেই তা হয়। মানুষ তার সঙ্গ পছন্দ করে। তিনি তাদের আরও সুখী, বড় করে তোলেন যখনই কাছাকাছি আসেন। তিনি সোচ্চার হন; তিনি কখনই নিজেকে ঠেলতে চান না। কখনই তিনি কোন আঘাত দিয়ে কথা বলে না।

আসলে বলতে গেলে তিনি অপর ব্যক্তিকে মাঝপথে ধরে ফেলে নিজের দিকেই টেনে নেন।

যে কোন ধরনের জনতার সঙ্গে তিনি চমৎকার ভাবে মিশে যেতে পারেন। তার বিশেষ কৌশল জানা আছে। তিনি কৌশল জানতেন (একে শিল্প কলা বা ইচ্ছা যা বলুন) কিভাবে স্ত্রী বা পুরুষকে জয় করতে হয়।

আমরাও আমাদের সব দোষ ত্রুটি দূর করে ফেলতে পারি।

কেনই বা নয়?

অপরের ভালো দিকগুলো লক্ষ করুন।

তাছাড়াও, আসুন তাকে নকল করি।

.

পনেরো. কার্নেগির পরামর্শ

মানুষের উপর এই প্রভাব বিস্তার করার ধারণাটা নিয়ে সম্ভবত আপনি সেরকম ভাবে ভাবতে চাইছেন না।

একেবারে আধুনিক কালের আগে খুব কম মানুষই একাজ করেছেন। আসল ফলাফল লক্ষ্য করে অবশ্য তারা বেশ চমকে যান।

ডেল কার্নেগী, হার্বার্ট ক্যাসন, পেলম্যান, এনেভার, নেপোলিয়ান হিল এবং আরও অনেক অভিজ্ঞ ব্যক্তি তাদের জীবনের প্রতিটি মিনিট দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন মানুষকে ব্যবহার করার এক সঠিক ও বেঠিক পদ্ধতি আছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অপরের প্রশংসা আদায় কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া, ব্যবসাকে বড় করে গড়ে তোলা, এমন সব কিছুই।

এখন আপনার কাছে মেনে নেওয়া জরুরী–এসব কিভাবে হতে পারে।

আপনাকে প্রথমেই জানতে হবে মানুষ কাজ করে কেন। আপনাকে অবশ্যই দেখতে হবে যতটা পরিষ্কারভাবে সম্ভব, চাহিদা, ইচ্ছা, ভাবাবেগ, ধারণা এই সব কিভাবে কাজ করে।

একজন মানুষ হিসাবে আপনাকে ভাবতে হবে কোন্ যন্ত্র বলে যেটা নিয়ে আপনি কাজ করাতে পারেন। শিখুন, লক্ষ্য করুন। সুইচ বোর্ডটি খুঁজে বের করুন। সঠিক সুইচটি স্পর্শ করুন।

ক্ষমতার সেটাই পথ।

কার্নেগীর লেখা ‘প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ’ বইটির যেকোন একটা পাতা খুলুন। এটা নিশ্চিত যে এমন কিছু আপনি সেখানে পাবেন যা আগে জানতেন না। খুবই সরল কিছু, অথচ যা আপনি সারা জীবন ধরেই করে আসছিলেন।

আপনি আপনার নিজের ব্যবহারকে একটা নতুন আলোয় পরিস্ফুট হতে দেখবেন। আপনি অপরের উপর এর প্রতিক্রিয়া আশ্চর্যজনক ভাবেই দেখতে পাবেন। আপনি সব পরিষ্কার দেখতে পাবেন। আপনার বোধোদয় ঘটবে। আপনি সব কিছু করতে দারুণ আনন্দিত বোধ করবেন…সব কিছু সঠিক পথে করতে। এর কারণ কি জানেন? কারণ কার্নেগীর নির্দেশিত পথ বারবার সঠিক বলেই প্রমাণিত হয়েছে। এগুলো এতবার সঠিক বলে জানা গেছে যে এটাই সেরা পথ সন্দেহ নেই।

কার্নেগী আর অন্যান্য সমস্ত অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা তাদের হাজার হাজার অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতিতেই কাজ করার আসল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আর নিয়ম আপনাদের জানাতে পেরেছেন।

মানবিক সম্পর্কের ব্যাপারই আপনাকে, যে গোপন শক্তি লাভে আপনি উৎসুক তারই সব কিছু এনে দেয়। একেই বলা হয় সেই সুইচবোর্ড। সারি সারি সুইচ সাজানো। এবার আপনার কাজ হলো সেই সুইচ টিপে দেওয়া।

কার্নেগী যা বলে গেছেন তার সবকিছু আমি অবশ্য এখানে বলতে আসিনি। সেটা কার্নেগীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে না। আপনারা তার বই পড়ে নিন।

আমি যা বলতে ইচ্ছুক তা হলো বিশেষ করে, তিনি কোন মানুষকে তার ধ্যান-ধারণা পাল্টানোর জন্য যে উপদেশগুলো দিয়ে গেছেন, তাই।

বাস্তব জীবনে, আপনি হয়তো জানেন, মানুষ হয়তো বা তার অঙ্গহানিও সহ্য করতে পারে (চিংড়ি মাছের মত বলতে পারেন) কিন্তু পরিবর্তে কিছুতেই তার নিজস্ব সেই ধারণা বা অভ্যাসকে ত্যাগ করবে না।

সেলসম্যানরা কথাটা জানেন আর সেই কারণেই তারা হতাশায় প্রায় ভেঙে পড়তে চায় মাঝে মাঝে।

তাদের মনোভাব হলো ঠিক এই রকম : ‘অদ্ভুত কঠিন লোক। কিছুতেই বাগানো যায় না : কোন আশা নেই একে নিয়ে!’

তারা নানা ভাবেই নানা কৌশল কাজে লাগিয়েছে। কোনটাতেই কাজ হয়নি, এখন নতুন কিছু যদি মেলে তবেই আশা।

কিন্তু মনে রাখবেন, কার্নেগীর অভিজ্ঞতাগুলি অমূল্য। তিনি অনেক বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করেছেন আর শেষ পর্যন্ত তার ভাগ্যে জুটেছে সর্বোচ্চ সম্মান। কার্নেগী কি বলেছেন দেখুন এবার : ভালোভাবে শুরু করুন, এই হলো তার মত।

অপর ব্যক্তির কাছে তার মতামতের মূল্য আছে, অধিকার আছে। সেটা প্রকাশ করতে দিন। এটা আপনিই করতে পারেন। সেই ভাবেই তাকে বলুন। এটা হলো প্রকৃত বুদ্ধির কাজ।

কাজ সম্পন্ন করার জন্যই কখনও কোন রকম তর্ক জুড়তে চাইবেন না। তর্কের ব্যাপারে জয়লাভ করুন, খেলায় হারুন তাতে ক্ষতি নেই।

নিজের ব্যাপার ভুলে যান। চেষ্টা করুন অপর ব্যক্তি হয়ে উঠতে।

আপনার কাজ যদি কিছু বিক্রি করা হয় তাহলে বিক্রির কথা না বলে কেনার বিষয়ে আলোচনা শুরু করে দিন। কেন আপনি কিনবেন, এখনই কেনা কেন সবচেয়ে ভালো হতে পারে ইত্যাদি।

কথাবার্তা যতদূর সম্ভব কম বলুন। অপর ব্যক্তিকেই বেশি বলার সুযোগ দিন।

তাকে সঠিক মেজাজে থাকতে দিন, সমস্ত সাক্ষাৎকারের মধ্যে এটাই হলো পরিবর্তন ঘটানোর কজা।

এমনভাবে প্রস্তাবনা রাখুন যাতে তিনি বলতে বাধ্য হন : হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি সব সময়েই তাই বলি। এটা আমারও মনের কথা।

যত কম বাধা দেবেন ততই ভালো।

খুঁজে পেতে চেষ্টা করুন সবচেয়ে ভালো যুক্তিগুলো : যা করতে বলছেন সেটা কেন করা উচিত তার পক্ষে সবসেরা যুক্তি।

এই ভাবেই একটা প্রতিযোগিতার বাতাবরণ তৈরি করে তাকে কাজে নামতে বাধ্য করুন।

.

ষোলো. অপরকে প্রভাবিত করা সম্পর্কে শোয়াব

ব্যবসাক্ষেত্র বা সব জায়গাতেই আপনি প্রত্যেক দিনই মানুষের নানা রকম বিচিত্র ধ্যান ধারণা, অভ্যাস, সংস্কার ইত্যাদির সংস্পর্শে আসেন। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আপনার কাজ পণ্ড হতে পারে যদি না অপর ব্যক্তিদের আপনার নিজের মতে অনুবর্তী না করতে পারেন।

যে বা যিনিই এধরণের কৌশল কাজে লাগিয়েছেন, তিনি শপথ করেই বলতে পারবেন এ হলো একটা দারুণ কৌশল–যাতে চমৎকার কাজ হতে বাধ্য।

মানসিক অভিজ্ঞদের বেলায় এ হলো একটা দারুণ পরীক্ষা–মানব চরিত্র আর সম্পর্কের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা।

তারা এমন ধরনের ভুরি ভুরি বিষয় রোজই প্রত্যক্ষ করেন। তারা ব্যবসায়ী, পেশায় নিযুক্ত মানুষ, জীবনের সর্বক্ষেত্রের মানুষকে আহবান করে তাদের জীবনের বাধা-বিপত্তি, অসুবিধা, পদ্ধতি এসব ব্যাপারে প্রকাশ করতে বলেন।

তারা সমস্ত সমাধানের চেষ্টা করে থাকেন–কী করে মতামত গঠন করতে হয়, কি করে প্রকৃত অনুভূতি গড়ে তুলতে হয়, ইত্যাদি।

তারা চান কাজের উপযুক্ত আর বাস্তবসম্মত হয়ে উঠতে।

তারা মনে করেন মন সম্বন্ধে জানা ব্যাপারটা হলো সবচেয়ে জরুরী কাজ। আরও সুখী আর পরিচ্ছন্ন জীবন কাটাতে এটা একান্ত জরুরী।

এখন, যে সব মানুষকে কিছুতেই জয় করা যায় না তেমন মানুষদের পরীক্ষার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়ে তারা স্বীকার করেছেন যে বিশেষ কোন পরিস্থিতিতে কঠিন পাথরও গলতে বাধ্য হয়।

ক্যাসন, কার্নেগী, নেপোলিয়ান হিল, রয় শেরউড, এনেভার, ক্লীমার এবং আরও অনেকেই একমত হয়ে কথাগুলো বলেছেন।

আসলে দোষ আমাদেরই। আমরা বড় বেশি রকম রগচটা মানুষ। এছাড়াও এমনকি আমরা আবার মাঝে মাঝে অত্যন্ত মোটাবুদ্ধির কাজও করি। দেখা যায় আমাদের সাধারণ বুদ্ধিরও অভাব ঘটে যায়। আমরা একভাবে না চলে বড় সহজ পথই বেছে নিতে চাই। পাথর গলানো কাজটা বড় ধীর গতির ব্যাপার।

তবে এটা জেনে রাখা দরকার কোথাও কোন এক জায়গায় গলন কিছু আছেই। তবে আমাদের সেখানে পৌঁছতে হবে।

কোন ব্যাপারই আশাপ্রদ হওয়ার মত নয়। আমরা আমাদের কোন সুযোগ দিতে চাই না। আসল ব্যাপার হলো এটাই।

ইস্পাত দুনিয়ার বিখ্যাততম নাম হলো চার্লস্ শোয়ব। এই মানুষটি মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন চরিত্র আর জঘন্যতম মানুষকেও প্রভাবিত করেছেন–তিনি চিরজীবন ধরেই প্রশংসার চমৎকার গলনের ক্ষমতার কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে গেছেন।

কোন মানুষ প্রশংসায় বিগলিত না হয়ে পারে না। শোয়ব করতেন প্রকৃত, অকৃত্রিম প্রশংসা।

প্রত্যেক মানুষই প্রশংসাকে প্রশংসা করে। এ হলো আলোকময় কিছু। এতে মানুষ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এই প্রশংসা তাকে উজ্জীবিত করে তোলে। আর তার ফলে তার মধ্যে পাহাড় টলিয়ে দেওয়ারও বাসনা জাগে।

শোয়াব তাই বলেছেন : মন খুলে অপরের প্রশংসা করুন। এই ভাবেই সুরু করতে হয়।

এরপর আস্তে আস্তে বলার চেষ্টা করবেন কি কি আপনার ভালো লাগে না। কোন কোন বিষয়ে আপনার দ্বিমত আছে।

এবার যত খুশি প্রশ্ন করতে থাকুন।

ভবিষ্যতের বাধা বিপত্তি সম্বন্ধে হেসে উড়িয়ে দিন। সে সবকে তুচ্ছ, হাস্যকর বলে বুঝিয়ে দিতে থাকুন।

এরপর আপনার নিজের অসুবিধা আর ব্যর্থতার কাহিনী বলুন।

যদি দেখা যায় অপর ব্যক্তি কোন মারাত্মক ভুল করেছেন তাহলে এর ফলে তার মুখ রক্ষা করার সুযোগ থাকবে।

কোনভাবেই তার ক্রটি দেখাতে চাইবেন না। এতে কেবলমাত্র ক্ষতিকর একটা অবস্থাই সৃষ্টি হয়। এতে সে গুটিয়ে যেতে পারে।

ক্যাসন বলেন কেনার ব্যাপারই হলো আসল খেলা, বিক্রি নয়।

আসুন ক্রেতার সঙ্গে স্থান বদল করে নেওয়া যাক জিনিসগুলো একবার পরীক্ষা করুন। এগুলো কেনার মানে কিছু আছে? ক্রেতার কাছে এর প্রয়োজন আছে? আপনি কিভাবে তার অনুভূতি জাগাতে পারবেন? এগুলো কি উন্নত ধরণের? এতে কি সময় আর অর্থের সাশ্রয় হয়? ক্রেতা কি আপনার সম্বন্ধে আর আপনার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করেন?

ক্যাসন বিক্রির কাজকে কোন আন্দাজের উপর নির্ভর রাখতে চান না। এ হলো একজন পুরুষের কাজ–এই বিক্রি ব্যাপারটি।

এ কাজে তিনটে বিষয় জানা প্রয়োজন : ক্রেতার চাহিদা, বিক্রির কাজে সব রকম কৌশল রপ্ত হওয়া, আর জেনে রাখা মানুষ কেন কেনে।

বিক্রির মধ্যে নিজস্ব একটা মসৃন ধারা আছে। কিন্তু শুধু এতেই কোন বিক্রয়কারীর সন্তুষ্ট হলে চলবে।

বহু হতাশাময় বিষয় থাকে, এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের সহজে সন্তুষ্ট করতে পারা যায় না, তারা হয় অত্যন্ত বদ স্বভাবের। পাকা, দক্ষ বিক্রি কর্তারা তাদের বাগে আনেন। তার কাজই হলো ঐ সব মানুষকে জয় করা।

প্রথমেই তাই একটা ভালো ছাপ রাখার ব্যবস্থা করুন আর কখনই হতাশ হবেন না। প্রশ্ন করতে থাকুন। সাক্ষাৎকারকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন। চেষ্টা করুন অপর ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ হতে। প্রশংসা আদায় করে বায়না সংগ্রহ করুন; এটাই হলো কোন বিক্রয়কারীর জীবনের লক্ষ্য। এই সবকিছুর বিবরণ ক্যাসনের বইয়ে আছে। আজই সেটা দেখে নিন। যাকে টলানো যায় না তাকে টলানোর কৌশল রপ্ত করুন। ক্যাসন তার বইয়ে আপনাকে শিক্ষাদান করতে চান।

.

আটারো. ক্রেতার দৃষ্টিকোণ

আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই কিছু না কিছু বিক্রি করে থাকি।

পেশাদার মানুষেরা দেন তাদের জ্ঞান, বিবেচনা আর দক্ষতার অংশ। ব্যবসাদাররা দিয়ে যান তাঁদের উৎপন্ন দ্রব্য, জিনিসপত্র আর সেবা। প্রত্যেক জীবিত মানুষই দিতে চান কোন না কোন কাজের সেবা। আমরা সবাই কিছু সেবা দিতে চাই। আর তার পরিবর্তে চাই সবচেয়ে ভালো পাল্টা কিছু।

কিন্তু এ বিষয়ে আমরা কি করছি?

আমরা কি এই লেনদেনের কাজকে যতদূর সম্ভব ততটাই লাভজনক করে তুলতে পারছি…আপাতত বা ভবিষ্যতের জন্যেও!

হ্যাঁ, অবশ্য সেরকম কিছুই আমরা করি : শুধু আমাদের নিজেদের কাজ কি সে বিষয়ে যদি জ্ঞান না থাকে, তবে নয়।

আমাদের ক্ষমতা যাই হোক না কেন, এটা সর্বোচ্চ মূল্যেই চাই। যে কোন লেনদেনের কাজে দুটি পক্ষ দরকার। একজন দাতা অপরজন গ্রহীতা।

গ্রহীতাকেই দাতার কাছে আসতে হবে। তিনি লক্ষ লক্ষ অন্যান্য দাতার কাছে উপস্থিত হতে পারেন, তাহলে কেন তিনি বিশেষ একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে আসবেন?

কথাটা ঠিকই। আপনি বলবেন : ‘ওই ভদ্রলোকে বেশ সহযোগী। অথবা উনি বেশি দাম নেন না। বা তিনি খুব তাড়াতাড়ি জোগান দিতে পারেন। তাছাড়া আপনি তার উপর নির্ভর করতে পারেন।‘

আপনি যদি বুদ্ধিমান মানুষ হন, তাহলে অপরের মধ্যে সামান্যতম গুণের ব্যাপারটাও বলার চেষ্টা করবেন।

যেভাবেই হোক তার আত্ম-সম্মানে আঘাত দেবেন না। সব সময় তার মতামতকে শ্রদ্ধা করবেন।

আপনি যদি তাকে সুখী করতে পারেন, যদি তাকে সহজ হতে দিতে পারেন, আর দ্বিমত হতে বাধাও দিতে সক্ষম হন যেহেতু তিনি ততক্ষণে আপনার একজন ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছেন। তাহলে দেখবেন

আপনি যা বলছেন তার সারবত্তা মেনে নিতে আর দেরি হবে না।

.

সতেরো. বিক্রির শিল্পকলা

বিক্রি করা ব্যাপারটি একটি দক্ষতার খেলা।

যে সমস্ত মানুষের কাজ হলো বিক্রি করা তাদের এই বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতেই হয়। এ-কাজ করতে অবশ্যই কারো কারো সারা জীবন কিংবা তার চেয়েও বেশি সময় লেগে যায়।

সেলসম্যানেরা তাই অন্য সকলের চেয়ে ভালো করে জানেন বিক্রি কাজটা কতখানি কঠিন। মানুষকে কিছু কেনার মতাদর্শী করে তোলা অসম্ভব শক্ত কাজ।

আপনি সেলসম্যান হন চাই না হন, মানুষের চরিত্র সম্পর্কে আপনি যত বেশি জ্ঞান অর্জন করতে পারেন ততই ভালো। এতে জীবন অনেক সহজ আর আনন্দময় হয়ে ওঠে। আপনি এর মধ্য দিয়ে সমস্ত বাধা দূর করে প্রতিরোধও কাটাতে পারেন। আপনি আরও পারবেন হতাশা, ক্ষতি আর ব্যর্থতা দূর করতে। আপনি স্থির গতিতে এগিয়ে চলতে পারবেন।

এই কারণেই ক্যাসনের লেখা দক্ষ সেলসম্যানের জন্য পঞ্চাশটি সূত্র বইটির এত দাম।

বইটি লেখার পরিকল্পনা নেওয়া হয় বিক্রির হার বাড়ানোর জন্যই।

ক্যাসন বিশ্বাস করেন বড় মাপের বিক্রির মানেই হলো আরও বেশি মাত্রায় কেনার কাজ, আর কেনা ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভাবেই ব্যক্তিগত কাজ।

ধরা যাক কোন কারণে ক্রেতা সন্তুষ্ট নন, আর তার ফলে তিনি আদৌ কিনতে চাইবেন না।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিনি হয়তো ভাবলেন তাকে যথাযোগ্য সম্মান দান করা হচ্ছে না। বা, তিনি হয়তো জিনিসটি সম্পর্কে তেমন নিশ্চিত নন। আসল ব্যাপার হলো অপর ব্যক্তি তাকে কিছু বিক্রির চেষ্টা করছেন। বিক্রেতা কিছুতেই ক্রেতার মনোভাবের সঙ্গে একাত্ম নন…ক্রেতা কি ভাবেন সেটা তার মাথাব্যথা নয়। এক্ষেত্রে তাহলে করণীয় বিষয় কি হওয়া উচিত?

আসুন, ক্যাসনের সূত্র এ ব্যাপারে কি বলে দেখা যাক। এগুলো হলো আমেরিকার প্রথম শ্রেণীর দক্ষ একজন সেলসম্যানের সূত্র।

ক্যাসন আমেরিকা আর ইংলণ্ডের বিশাল সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকে কাজ করে সব দেখেছেন! সে কাজ তিনি করেছিলেন সবচেয়ে ভালো আর অত্যন্ত খারাপ সময়ে থেকেও। ব্যবসার ব্যাপারটাতে তার সবকিছুই জানা আছে–সব খুঁটিনাটি বিষয়ে। তিনি জানেন ব্যবসাতে কিভাবে উন্নতি করতে হয়। তিনি হলেন একজন ব্যবসা অভিজ্ঞ, পরামর্শদাতা, বা উন্নতির বা দক্ষতার ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ মানুষ।

বিক্রি পদ্ধতি সম্বন্ধে তিনি বিশেষ এক কৌশলের জন্মদান করেছেন। তিনি এছাড়াও পৃথিবীতে এমন সব সেলসম্যান তৈরি করে দিয়েছেন যারা তাদের কাজ কি সেটা চমৎকার জানেন।

ক্রেতার মনোভাব সম্বন্ধে তিনি নতুন অনেক তথ্য দিতে পেরেছেন। মানুষ যে বিশেষ ধরণের ব্যবহার বা কাজ করে তার বিষয়ে ক্যাসনের অনেক কিছুই বলার আছে।

এগুলোই হলো বড় বড় ব্যবসার কয়েকটা কারণ। তবে সব সময় এটাই প্রধান কারণ নয়।

আপনি বা আমি কোন সচল প্রতিষ্ঠানই পছন্দ করি। জনসাধারণ সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়তে চায়। তারা স্বপ্নেও অন্য জায়গায় কেনার কথা ভাববে না। তারাও ওখানে ব্যবসা করে আনন্দ পায়।

এক্ষেত্রে মিঃ জনতার বক্তব্য হলো এই রকম : ‘কাজ করার পক্ষে তারা বেশ ভালো মানুষ। তারা আপনাকে এত খাতির করে থাকেন। ওরকম জায়গায় কেনা কাটা করা মোটেই অস্বস্তিকর কাজ নয়। ভারি আনন্দেরই কাজ। সেখানে ঢোকার শুরু থেকে ওখানকার সকলেই আপনার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করতে থাকেন…চিরকালই তাই করেন। তারা সবাই প্রায় পুরনো বন্ধুদের মতই-তাদের দেখলেও ভালো লাগে। অন্য কোন জায়গায় গেলে হয়তো কিছু টাকা বাঁচানো যায়, তবে আমার ওদের ভালো লাগে।’

অনেক কাল আগে ব্যবসার ব্যাপারটায় অতি কাজের চাপ আর বাজে বাজে ব্যবহার জড়ানো ছিলো।

সে সময় ক্রেতাকে এই রকমই বলা হতো : ‘ওই জিনিসটা আপনার চাই? আর এর জন্য এই রকম দাম দিতে চান, তাই না? আপনার দামে কেউ বিক্রি করতে পারে? আকাট মূর্খ ছাড়া আর কারও সাধ্য নেই! আসলে আপনি তাই। আপনি উৎপাদন খরচ, বিজ্ঞাপনের খরচ, বাড়তি খরচ, ইত্যাদি সম্বন্ধে কি জানেন? দেখুন, আপনি নিজেকে একজন নেহাতই বোকা প্রমাণ করছেন। আমরাই ঠিক, আপনারই ভুল হচ্ছে। অতএব নিতে হয় নিন বা ছেড়ে দিন।‘

মিঃ জনতা দোমনা হয়ে থাকেন।

এবার অন্য জায়গার কথা শুনুন। সে জায়গায় দাম একটু বেশি (এখানে সবই উল্টো), জিনিসের গুণও তেমন নয় (অবশ্য এটা শোনা কথা)।

তবে সীমা ছাড়াবেন না কারণ শেষ সীমা (এটা তার অর্থাৎ ক্রেতার মনের কথা)। যে টাকা তিনি খরচ করছেন সেটা তার নিজের টাকা। তার কথাটাই তাই মনে রাখতে হবে। কাউন্টারের দিকে যে উপবিষ্ট, তার নয়। তার স্বার্থই তাই আগে দেখতে হবে (অতি সত্য কথা)। তারা গ্রাহ্য করবে না? ব্যাপারটা তাদের তাহলে উনিই বুঝিয়ে দেবেন। উৎপাদন খরচের ব্যাপার তিনি বোঝেন না? তারা কি তাকে তুচ্ছ করতে চায়?

মিঃ জনতা কিছুই বললেন না। তিনি মালও নিলেন না। তিনি তাদের চিরকালের জন্যই ত্যাগ করলেন।

এতেই বোঝা যাচ্ছে এমন অনেক কিছুই আছে যা আসলে করা হয় না। অপর ব্যক্তি, যিনি কেনার কথা ভাবেন তিনি কিছুতেই এটা সহ্য করবেন না।

আজকের দিনে কেনার ব্যাপারই সব। বিক্রি ব্যাপারটি আসছে পরে, এটি স্বার্থের সঙ্গে জড়িত তাই পিছনেই পড়ে থাকে। কেনার ধারণার সঙ্গে জড়িত থাকে অর্থ। ক্রেতাই এখানে আসল। তিনি কেন কিনবেন সেটাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যবসা। আমাদের কাজ হলো তাকে কেনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলা।

কোন কারণে তিনি যদি আমাদের সঙ্গে শীতল ব্যবহার করেন, তাহলে ক্ষতি আমাদেরই, তার নয়। আসল কথা হলো টাকা পয়সা খরচ করবেন তিনিই, অতএব তার সুবিধাই আসছে আগে। এতেই আমাদের জীবন বাঁচে।

আসুন তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তুলি। আসুন, তাকে অনেক বড় ভাবার সুযোগ দিই। আসুন, প্রথমেই তার পছন্দ, অপছন্দের ব্যাপার, তাঁর মন মেজাজ ইত্যাদি–জেনে নিই। তাঁকে বুঝিয়ে দিই আসুন, আমরা তাকে পছন্দ করি।

আজকের ব্যবসায়িক দুনিয়ার চেহারা এই রকমই।

এটাও আনন্দের বিষয় যে জনসাধারণও এতে জড়িয়ে পড়েছে। তার জন্যই সকলের মুখে হাসিও ফুটেছে আজ।

আজকে এটাই সকলে স্বীকার করেছেন যে কেনা ব্যাপারটি আসছে বিক্রির আগে।

ক্রেতাই সব সময়ে ঠিক। ব্যবসাদারদের কাজই হলো ক্রেতার প্রয়োজন আর অনুভূতির খবর রাখা। খবর রাখা দরকার তার কোটা আগে পছন্দ, কোনটিই বা অপছন্দ…আর এ কাজ দ্রুত সেরে ফেলা চাই। বিক্রেতাকে ক্রেতার পছন্দের তালিকায় রেখে দিতে হবে। এক্ষেত্রে তর্ক করে লাভ নেই-তর্ক করার অর্থ চরম বোকামি। এতে বন্ধুত্ব অর্জন করা যায় না।

ক্রেতাকে বুঝিয়ে দিতে হবে তিনি যা চান তাই পাচ্ছেন…যে দাম তার পছন্দ সেই দামেই। তাকে অনুভব করতে দিতে হবে কাউন্টারের ওপারে বসা লোকটি তাকে বুঝতে পেরেছে, মানুষের কাছে বিক্রি কাজটি পাপ। ক্রেতা তার কাছে এসে তাকে কৃতার্থ করেছেন আর তাকে স্বাগত না জানালে ক্রেতার কোন ক্ষতি নেই।

আজকের ব্যবসা জগতে এই পরিবর্তিত অবস্থাই এসেছে।

আজকের ব্যবসার মূল মন্ত্র হলো অপর ব্যক্তিকে খুশি করে বন্ধু করে তোলার অর্থ হলো আরও ফলাও ব্যবসার প্রতিশ্রুতি।

তাকে সাদর আপ্যায়ন করুন। তাকে সম্মান দেখান। কোন তর্ক করবেন না। সব সময় হাসিমুখে থাকবেন, ভ্রু কুঞ্চিত করবেন না। আপনার ব্যবসা নির্ভর করছে তিনি কি চান তারই উপর। তিনি যা চান

তা কখনই কিনবেন না।

আপনার কর্তব্য হলো এই :

তাকে কিনতে দেবেন এই অর্থেই যে তিনি যা চাইছেন আপনি সেটাই বিক্রি করছেন। তাকে অনুভব করতে দিন আপনার সঙ্গে কারবারে আনন্দ আছে, কারণ (এটা সত্যিই) যে আপনি তার প্রকৃত বন্ধু, কখনই তাকে প্রতারণা করবেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *