৬
নবদ্বীপে শ্রীবাস পণ্ডিতের অন্তর্গৃহে যে কীর্তন আরম্ভ হয়েছিল, তা ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র বঙ্গদেশে। যেসব ভক্ত বঙ্গদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নবদ্বীপে এসে পৌঁছেছিলেন, তাঁরা নিজের অনুভবের সঙ্গে মহাপ্রভুর সঙ্গে মহাপ্রভুর অনুভব পৌঁছে দিয়েছিলেন নিজের নিজের দেশে। কিন্তু মহাপ্রভুর নিজের অনুভব-সিদ্ধি এতটাই যে, তা শুধু বঙ্গদেশের মধ্যে আবদ্ধ থাকার মতো নিশ্চল ছিল না। নিজের অন্তরের মধ্যে যে কৃষ্ণপ্রেম তিনি অনুভব করছিলেন, সে প্রেম-দীন-হীন সকল জনের মধ্যে সঞ্চারিত হোক, এমন এক উচ্ছল ভাব তাঁকে ঘরছাড়া করে দিল। নিমাই পণ্ডিত সন্ন্যাস নিয়ে সেই কৃষ্ণচৈতন্য হলেন—পুরুষোত্তম কৃষ্ণের সম্বন্ধে চৈতন্য জাগরণের জন্য।
সন্ন্যাস-গ্রহণের পর চৈতন্য যেমন-যেমন কাজ করেছেন, যেমন ভাবে চলেছেন এবং তাতে যত মানুষের হৃদয় পরিবর্তন ঘটেছে, তা আমার স্বাত্মানুভবে ব্যাখ্যা করতে গেলে বৃহৎ পরিসর লাগবে। তবু প্রভুর এই সন্ন্যাস-ধর্মের মধ্যেও অদ্ভুত যেসব বৈশিষ্ট্যগুলি আমার পরম্পরাগত অনুভবে ঋদ্ধ হয়ে আছে, তার কিছু বৈশিষ্ট্য এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। আসলে মহাপ্রভুর ধর্মটাই এমন যে, এখানে প্রচণ্ড ত্যাগ-বৈরাগ্যের মধ্যেও এক গভীর ভালোবাসাবাসির অবসর রয়ে গেছে এবং তা রয়ে গেছে হয়তো এই কারণেই যে, চৈতন্যধর্মের সাধ্য-সাধন সবটাই ভালোবাসা নিয়ে—অচিন্ত্য অদ্ভুত কৃষ্ণচৈতন্য বিহার। চিত্র ভাব, গুণ, চিত্র ব্যবহার।।
প্রভু যে সন্ন্যাস নিয়ে বেরিয়ে গেলেন, এই সন্ন্যাসের কথাও তাঁর দুই-তিন জন অন্তরঙ্গ ভক্ত ছাড়া কেউ জানল না। অদ্ভুত লাগে শুনলে— সন্ন্যাসী হওয়ার জন্য যখন তাঁর মাথা ন্যাড়া করা হচ্ছে, তখন সেই ন্যাড়া মাথা দেখেও মানুষ কাঁদছে। ভাবছে, এমন আজানুলম্বিত গৌরবর্ণ শরীরে চাঁচর কেশগুলি কাটা গেল—কী না জানি হয়ে গেল। সন্ন্যাসের পর প্রভুর কোনো বাহ্যজ্ঞান ছিল না। কৃষ্ণপ্রেমে তিনি এতই অধীর যে, বৃন্দাবনে কৃষ্ণের লীলাভূমি দেখবার জন্য তাঁর মন-প্রাণ আকুল হয়ে উঠেছে। পরপর তিন দিন তিনি আকুল হয়ে ছুটছেন—কাঁহা করো কাঁহা যাঙ কাঁহা গেলে কৃষ্ণ পাঙ। তাঁর সঙ্গে আছেন তাঁর বাল্যসঙ্গী মুকুন্দ দত্ত, চন্দ্রশেখর রায় এবং নিত্যানন্দ প্রভু। চৈতন্য একে-তাকে বৃন্দাবনের পথ জিজ্ঞাসা করছেন, কিন্তু কী অদ্ভুত বিচিত্র চৈতন্যসঙ্গীদের ভালোবাসার ব্যবহার—তাঁরা বুঝতে পারছেন যে, প্রভুর যে দশা তাতে এইরকম বাহ্যজ্ঞানশূন্য অবস্থায় বৃন্দাবনের পথ ধরলে কখন যে কী হবে কে জানে। নিত্যানন্দ প্রভু অদ্ভুত কৌশলে সন্ন্যাসী কৃষ্ণচৈতন্যকে পথ ভাঁড়িয়ে নিয়ে চলেছেন শান্তিপুরে অদ্বৈত আচার্যের বাস ভবনে। চন্দ্রশেখরকে আগে পাঠিয়ে দিলেন নিত্যানন্দ, যাতে অদ্বৈত নৌকা নিয়ে তৈরি থাকেন।
হঠাৎ অদ্বৈতকে দেখে মহাপ্রভু জিজ্ঞাসা করলেন— তুমি কোথায় যাচ্ছ? তিনি বললেন—এই তো তোমার সঙ্গে বৃন্দাবন যাব। কিন্তু বৃন্দাবন যাওয়ার পথে আগে তো যমুনা-দর্শন করতে হবে। বাহ্যজ্ঞানহীন চৈতন্য প্রবাহিণী ভাগীরথী-গঙ্গা দেখেই ভাবলেন বুঝি—সেই যমুনা প্রবাহিণী। অদ্বৈতের নৌকা যখন শান্তিপুরের পথ ধরল তারও বেশ খানিক পরে প্রভু বুঝলেন যে নিত্যানন্দ তাঁকে বঞ্চনা করে নিয়ে এসেছেন অদ্বৈতের ঘরে। অদ্বৈত বিনয় করে বলেছিলেন— এক মুষ্টি অন্ন রান্না হয়েছে বাড়িতে, সঙ্গে সামান্য শাক-শুক্তো-ডাল। এটুকু খেয়ে তুমি যাওয়ার জোগাড় কোরো। কিন্তু প্রভুকে এমন বঞ্চনার পিছনে তাঁর ভক্তদের ভাবনা ছিল আরও গভীর। নিত্যানন্দ চন্দ্রশেখরকে দিয়ে অদ্বৈতগৃহে খবর পাঠিয়ে তাঁকে চলে যেতে বলেছিলেন নবদ্বীপে, যাতে জননী শচীমাতা একবার তাঁর পুত্রকে দেখতে পান। গৃহিণী বিষ্ণুপ্রিয়ার কথা আসেনি, কেননা সন্ন্যাসের পর স্ত্রীকে আর দেখা চলে না।
অদ্বৈতও মিথ্যা বলেছেন—শাক-শুক্তোর জায়গায় যেমন আয়োজন হয়েছে, তাকে মহোৎসব বলাই ভালো এবং বৃদ্ধ অদ্বৈতের বায়না হল—তিনি নিজে পরিবেশন করে প্রভুকে খাওয়াবেন। আমি যে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের মহান তত্ত্বগুলি ছেড়ে এইসব সামান্য ঘটনার উল্লেখ করছি, তার কারণ এই ধর্মের মধ্যে প্রচণ্ড বৈরাগ্যের যে কী অদ্ভুত মমতা আছে, তা নিজে অনুভব করেছি বলেই এইসব ছোট্ট ঘটনা আমার কাছে অনেক বড়ো। আমার মনে আছে— একবার নবদ্বীপের হরিবোল কুটিরে নিষ্কিঞ্চন বাবাজি মুকুন্দ দাসজি আমাদের প্রসাদ পাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। মুকুন্দ দাসজি বিখ্যাত হরিদাস দাসের ছোটো ভাই। হরিদাস দাস সারা জীবন ধরে রূপ গোস্বামী এবং অন্যান্য তত্ত্ববেত্তাদের গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন এবং তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি গৌড়ীয় বৈষ্ণব অভিধান। আর মুকুন্দ দাসজি তাঁর দাদার সম্পাদিত গ্রন্থগুলি বিশাল ঝোলায় পুরে বিভিন্ন গ্রন্থাগার এবং বৈষ্ণব সুজনের কাছে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতেন। যতটুকু লাভ হত, তাই দিয়ে আবার গ্রন্থ ছাপা হত। শীর্ণদেহে ঝোলাবাহী মুকুন্দ দাসজি বলতেন—এই আমার সেবা। গুরুস্থানীয় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার গ্রন্থ প্রচার করা।
সেই মুকুন্দ দাসজি নিজে সারাদিন রান্না করে আমাদের যত ব্যঞ্জনে প্রসাদ খাইয়েছিলেন তা যদি জানতে পারতেন আপনারা, তাহলে অদ্বৈত আচার্যের এই সেবাধর্মটুকুও বুঝতে পারবেন। আপনারা ভাবতে পারবেন না—এই সেবাধর্মের মধ্যে অন্তরঙ্গতা এবং আবেগ এমন পর্যায়ে পৌঁছয়, যাতে ঝগড়া লেগে যাওয়াটাও অসম্ভব নয়। প্রভু বললেন—আরে সন্ন্যাসী হয়ে কেউ এত ব্যঞ্জনে যায় নাকি। অদ্বৈত বললেন— তোমার ওই সন্ন্যাসের ঢঙ রাখো। তোমার মতো সন্ন্যাসী আমি অনেক দেখেছি। তুমি খাও। মহাপ্রভুকে খেতে হল, কেননা না খেলে বৃদ্ধ অদ্বৈত আচার্য আত্মহত্যার ভয়ও দেখাতে পারেন। আসলে ভক্তের দিক থেকে এই অন্তরঙ্গতা এবং প্রভুর দিক থেকেও এই ভক্তবাৎসল্য —গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রাণটুকু এখানে—সন্ন্যাসীর ধর্ম শুধু এইখানেই অতিক্রান্ত হয়, অন্যত্র নয়। আচার্য অদ্বৈতের ঘরে সন্ধ্যায় কীর্তন আরম্ভ হল। মুকুন্দ দত্ত গান ধরলেন— কি কহব রে সখি আনন্দ-ওর। চিরদিন মাধব মন্দিরে মোর। প্রভু বাহ্যজ্ঞান হারালেন কৃষ্ণ-গীতি শুনে।
পরের দিন সকালে অদ্বৈত-গৃহে তখনও কীর্তন চলছে, জননী শচীদেবী উপস্থিত হলেন চন্দ্রশেখর আচার্যের তত্ত্বাবধানে। শচীর সঙ্গে—নদীয়া নগরের লোক স্ত্রী-বালক-বৃদ্ধ। আসলে নিত্যানন্দ প্রভুর প্রধান উদ্দেশ্য এই ছিল। তিনি বুঝেছিলেন—মহাপ্রভুকে আর ধরে রাখা যাবে না এবং যেভাবে তিনি সন্ন্যাস নিয়েছেন তাতে মায়ের মন পাগল হয়ে গেছে। তাঁর বড়োছেলে বিশ্বরূপ কবেই সংসার ছেড়ে চলে গেছে, এ ছেলেও গেল। তাছাড়া মহাপ্রভু এমনই আকস্মিক সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন, যাতে দুঃখিনী শচীদেবী পাগলপারা হয়ে গেছেন পুত্রশোকে। বলতে পারেন—সন্ন্যাসী হয়ে এত-শত ভাবার দরকার কী, মায়া-মমত্ব এসব তো সন্ন্যাসীর বর্জ্য বৃত্তি। আরও আশ্চর্য হল নিত্যানন্দ প্রভকুর স্বভাব। তিনি অবধূতবৃত্তি মানুষ, পরিধানের কাপড়টির ওপরেও তাঁর মমত্ব নেই। তিনি মহাপ্রভুর বৃন্দাবন-গমন উলটে দিয়ে তাঁকে নিয়ে এসেছেন নবদ্বীপের পাশের গাঁয়ে শান্তিপুরে। আমি এইসব ছোট্ট ছোট্ট ব্যবহার ব্যাখ্যা করার জন্যই এইসব প্রসঙ্গ তুলছি। মহাপ্রভু তো সন্ন্যাস নিয়েছেন, জগৎ-সংসারের প্রতি তাঁর কোনো আসক্তি নেই, তবু স্নেহময়ী জননীকে দেখামাত্র কোনো এক অদ্ভুত অপরাধ-বোধে দণ্ডবৎ কাঁদতে লাগলেন। মাথায় সেই লালিত চাঁচর কেশ নেই, মাথা ন্যাড়া দেখে জননীর বুক ফেটে গেল।
অনেক কাঁদলেন শচীদেবী। পুত্রের কাছে তাঁর একটাই আতুর নিবেদন—নিমাই যেন সন্ন্যাসী হয়ে জ্যেষ্ঠ পুত্র বিশ্বরূপের মতো একেবারে হারিয়ে না যান। মহাপ্রভু অদ্ভুত সুন্দর করে বললেন—এ শরীর আমার নয়, ‘তোমার পালিত দেহ জন্ম তোমা হৈতে ‘। আমি কখনও উদাসীন হব না তোমার প্রতি। তুমি আমাকে যেখানে থাকতে বলবে সেখানেই থাকব। শচীদেবীও তেমন এক জননী, তিনি সন্ন্যাসী পুত্রের অমর্যাদা করে নবদ্বীপে বা শান্তিপুরেই তাঁকে থাকতে বলবেন, এমন নয়। প্রভু নিজেও ভক্তদের ডেকে বললেন—তোমাদের ছেড়ে অথবা মাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। কিন্তু এও তো সন্ন্যাসীর ধর্ম নয় যে, জন্মস্থানে বাস করব। বরঞ্চ ‘সেই যুক্তি কর যাতে রহে দুই ধর্ম’। সমস্ত ভক্তদের সঙ্গে আলোচনা করে শচীমাতা বললেন—নিমাই নীলাচল পুরীতে বাস করুক—সেখানে সকলের যাতায়াত আছে, আমি ছেলের খবর পাব, তাতেই আমি বেঁচে থাকব। মহাপ্রভু মায়ের কথা মেনে নিয়েছেন।
পৃথিবীতে বোধহয় আর কোনো সন্ন্যাসীর মুখে এমন কথা শোনা যাবে না। মহাপ্রভু বলেছেন— আমি তোমাদের প্রতি উদাসীন হয়ে থাকতে পারব না। হয়তো একথা সন্ন্যাসীর কঠিন মমত্বহীন স্বভাবের সঙ্গে মেলে না, কিন্তু তাই বলে এটা ভাবারও কোনো কারণ নেই যে সন্ন্যাসীর আচার এতটাই কঠিনভাবে তিনি পালন করতেন যে, তাঁর অন্তরঙ্গ ভক্তেরা তাতে কষ্ট পেত মনে মনে। আবার এত কাঠিন্য সত্ত্বেও কোথাও কোথাও যে তিনি ছেড়ে দেন, সেখানে তাঁর নিজের থেকেও অন্য অন্তরঙ্গ জনের দুঃখ-কষ্ট-আনন্দের কারণটুকু তাঁর কাছে বড়ো হয়ে ওঠে। অন্য সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী হলে এমন পাগলপারা স্বভাবই তার হত না যে, তাকে ভুলিয়ে উলটো দিকে নিয়ে আসা যেত। কিংবা যদি বা তিনি আসতেন, হঠাৎই নিজের জননীকে দেখে তিনি বলে উঠতে পারতেন— কে কার পুত্র, কে কার জননী—কস্য ত্বং বা কুত আয়াতঃ।
চৈতন্যের ক্ষেত্রে তেমন হয়নি। আসলে তাঁর ধর্মের চরিত্রের মধ্যেই এমন এক অনন্ত মধুর মমত্ব আছে—যেখানে শাস্ত্র-পুস্তক-বাহিত আচারগুলি বড়ো গৌণ হয়ে যায়। একটা উদাহরণ দিই। কেশব ভারতীর কাছে সন্যাস গ্রহণের পর সন্ন্যাসীর চিহ্ন হিসেবে গুরুর কাছে থেকে তিনি ত্রিদণ্ড গ্রহণ করেছিলেন। শাস্ত্র বলে—শরীর, মন এবং বাক্য এই তিন ইন্দ্রিয়কে চরম সংযত রাখার জন্য সন্ন্যাসীকে ত্রিদণ্ডী হতে হয়। কিন্তু পুরী যাবার পথে আঠারো নালায় মহাপ্রভুর দণ্ড ভেঙে দিলেন নিত্যানন্দ। আসলে কৃষ্ণপ্রেমে যিনি মাঝে-মাঝেই বাহ্যজ্ঞানহীন হয়ে পড়েন, তাঁর পক্ষে সদা-সর্বদা এমন দণ্ড-ধারণ করে চলাটা কষ্টকর এবং তা মহাপ্রভুর শারীরিক বিপত্তি ঘটাতে পারে ভেবেই নিত্যানন্দ তিন খণ্ড করে ভেঙে ফেললেন সন্ন্যাসীর ত্রিদণ্ড। অন্যদিকে মহাপ্রভু সন্ন্যাসীর দণ্ডভঙ্গে নিত্যানন্দের ওপর বাইরে একটা রাগ দেখালেন বটে, কিন্তু সে রাগ জিইয়ে রাখতে পারলেন না অন্তরের মধ্যে। হয়তো স্মরণে এল ভাগবত পুরাণ-এর কথাও। ভাগবত বলেছে—বাক্যের দণ্ড মৌন, দেহের দণ্ড সকাম কর্মগুলি ত্যাগ করা এবং চিত্তের দণ্ড প্রাণায়াম—এই তিন দণ্ড যাঁর মনের মধ্যে নেই, তাঁর বাঁশের দণ্ড বেয়ে চললে কী লাভ হবে!
আসলে এটাও কথা নয়। গোস্বামী তাঁর সন্দর্ভ-গ্রন্থে বলেছেন—ভগবান, ভক্তি আর ভক্ত হচ্ছে ঘুড়ির মতো—সুতোর একদিক ধরে আছেন ভক্ত, ভগবান আছেন সুতোর ওপ্রান্তে ঘুড়ির মতো আর মাঝখানে আছে ভক্তির সুতোটি। ভক্তি বস্তুটাই এমন যেখানে একটা পারস্পরিক গ্রন্থি আছে—এখানে এক ভক্ত আর এক ভক্তকে বেঁধে রাখে, কেউ কাউকে ছাড়তে চায় না। যিনি কৃষ্ণপ্রেমের সাধনা করছেন তাঁর বৈরাগ্য তো ভালোবাসার বন্ধনহীন হতে পারে না। অতএব সব ত্যাগ করার পরেও মহাপ্রভু ভক্তের ভক্তি এবং ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গতা উপেক্ষা করতে পারেন না। সন্ন্যাসীর কাঠিন্য উল্লঙ্ঘন করেও মহাপ্রভু ভালোবাসার গ্রন্থিটুকু স্বীকার করেন। এর ফল হয় এইরকম— জননী যখন বলেন—যতদিন নিমাই অদ্বৈতের গৃহে থাকবে, আমি তাকে রেঁধে খাওয়াব। প্রভু জননীর বাৎসল্য স্বীকার করেন। আবার একবার বিদায় নেওয়ার মুহূর্তেও যদি অদ্বৈত আচার্য বলেন—’আর দিন দুই চারি রহ কৃপা তো করিয়া’—প্রভু সেটা ফেলতে পারেন না। তিনি অদ্বৈত-গৃহে থেকে যান আরও দু-চার দিন। যবন হরিদাস তাঁর কাছে বিনয় করে বললেন—তুমি নীলাচল শ্রীক্ষেত্রে থাকবে, সেখানে আমি কী করে যাব? প্রভু তাঁকেও ফেলতে পারেন না। বলেন—আমি জগন্নাথের কাছে প্রার্থনা করব তোমার জন্য, আমি যেখানে যাব, সেখানে তোমায় আমি নিয়ে যাব।
ভক্তির জগতের মধ্যে এই মাখামাখিটা আছেই। এখানে ত্যাগ-বৈরাগ্য অবশ্যই থাকতে হবে, সেটা সাধনের অঙ্গ। কিন্তু একই সাধনের অংশভাগী যাঁরা, তারা কেউ একে অপরের প্রতি মমত্বহীন নন। সমস্ত ভক্তদের কাছে শেষ বিদায় নিয়ে মহাপ্রভু ছত্রভোগের পথ দিয়ে নীলাচল যাত্রা করলেন। সঙ্গে রইলেন চার অন্তরঙ্গ ভক্ত—নিত্যানন্দ প্রভু স্বয়ং, আর জগদানন্দ পণ্ডিত, দামোদর পণ্ডিত এবং আবাল্য সঙ্গী মুকুন্দ।
প্রভু রেমুণায় এলেন ক্ষীরচোরা গোপীনাথের স্থানে—তাঁর পরমগুরু মাধবেন্দ্রপুরীর সেবিত বিগ্রহ দেখলেন প্রাণ ভরে। স্মরণে এল মাধবেন্দ্রপুরীর শেষকৃত শ্লোক—অয়ি দীন-দয়ার্দ্রনাথ—কৃষ্ণপ্রেমে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন চৈতন্যদেব। রেমুণা থেকে জাজপুর, সেখান থেকে কটক—যেখানে সাক্ষী গোপাল আছেন। সাক্ষীগোপালের বিচিত্র উপাখ্যান এখানে শোনানো গেল না। মনে দুঃখ রইল তার জন্য। গোপাল-দর্শন করে মহাপ্রভু ভুবনেশ্বর, আঠারো-নালা হয়ে পুরীতে পৌঁছলেন। জগন্নাথ দর্শন করার জন্য প্রভুর ধৈর্যচ্যুতি ঘটে গেছে ততক্ষণে—চার অনুসঙ্গী ভক্তদের পিছনে রেখে তিনি জগন্নাথের মন্দিরে প্রবেশ করলেন। দূর থেকে জগন্নাথকে দেখে কৃষ্ণপ্রাপ্তির বিভ্রম ঘটল তাঁর। একান্ত অনুভবের আনন্দে তিনি ছুটলেন দয়িত শ্যামল কিশোরকে আলিঙ্গন করার জন্য। কিন্তু সে বিগ্রহস্থান পর্যন্ত আর যাওয়া হল না। প্রভু মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন ভুঁয়ে।
আমার সহৃদয় পাঠককুল। মহাপ্রভুর এই প্রেমমূর্ছার ঘটনা বারবার যদি উচ্চারণ করি, তাহলে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। সবচেয়ে বড়ো কথা, মহাপ্রভুর এই কৃষ্ণপ্রেম-রসায়িত সাত্ত্বিক বিকারগুলি আপনাদের ভালো করে বোঝাতেও পারব না আমি। যদি হরিস্মরণে সরস না হয়ে ওঠে মন, যদি কৃষ্ণের দলিত-কলা-বিলাসে ভক্তিপূত আবেশ এবং কৌতূহল না থাকে, তবে কী করে বোঝাব মহাপ্রভুর এই ভাব। আপনারা ইতিহাস বুঝবেন, আপনারা এটা ভালো বুঝবেন যে, কীভাবে সংকীর্তনের ছত্রচ্ছায়ায় দীন-হীন-নীচ-ধনী একত্রে সম্মিলিত হয়, এমনকী আপনারা এটাও বুঝবেন যে, চৈতন্যের মতো ‘কালচারাল স্পেশালিস্ট’ বা ‘কালচারাল মিডিয়েটর’ একবার জন্মালে সমাজের মধ্যে এক বিরাট পরিবর্তন আসে; কিন্তু জগন্নাথ-দেবকে দেখে প্রভুর রাধিকা-মনের মধ্যে শ্যাম-কিশোরের আহ্বান আসে কী করে—এই মধুর ভাব আমি কী করে বোঝাব!
একবার রূপ গোস্বামীর কথা ভাবুন। তিনি বৃন্দাবনে গোবিন্দজীর বিগ্রহ-সেবা করতেন। শোনা যায়—আউরঙ্গজেবের আমলে রাজভয়ে সে মূর্তি রাতারাতি বৃন্দাবন থেকে জয়পুর নিয়ে যাওয়া হয়। আমি রাজস্থানে জয়পুরে নেমেই গোবিন্দজীর দর্শন করতে গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম— এক আধুনিকা বিবাহিতা সুন্দরী মহিলা, তিনি লাজ-লজ্জা ত্যাগ করে গোবিন্দজীর সামনে নৃত্য প্রদর্শন করছেন। এ কোনো মঞ্চনৃত্য নয়, গোবিন্দজীর আরতি হচ্ছে, অন্যেরা দর্শন করছে, কেউ ফুল ছুঁড়ছে, কেউ গোলাপ জল ছুঁড়ছে, আর ইনি সবার মধ্যে সামান্য একটু জায়গা বার করে, সুন্দর অঙ্গবিভ্রমে নৃত্য দেখাচ্ছেন—কাকে? না, গোবিন্দজীকে। রূপ গোস্বামী বলেছিলেন—সখা আমার! তোমার যদি সংসার-ধর্মে মতি থাকে, আত্মীয়স্বজন, স্ত্রী-পুত্রের ওপর প্রগাঢ় প্রীতি থাকে, তাহলে যেন আমার এই গোবিন্দজীর বিগ্রহ দেখতে এসো না। কেননা, তাঁকে দেখলেই ছুটে যাবে ঘর-সংসারের নেশা, ছুটে যাবে ইহজগতের সমস্ত তৃষা—মা প্রেক্ষিষ্ঠাস্তব যদি সখে বন্ধুসঙ্গে’স্তি রঙ্গঃ।
প্রস্তরময়ী গোবিন্দমূর্তির মধ্যে সৌন্দর্য-মাধুর্যের যে প্রাণ রূপ গোস্বামী দেখেছিলেন, সে প্রাণ, সেই মধুরা ভক্তি আমার আছে? নইলে, কই আমিও তো তাঁকে দেখে এলুম, আমার তো তেমন হল না। এমনকী তেমনও কি হল, যাতে লাজ-লজ্জা ভুলে স্ত্রী-সত্তায় প্রাণারাম শ্যামলসুন্দরকে নাচ দেখাতে পারি? আসলে আমরা এই ভাব-জগতের ধারে-কাছেও নেই, যাতে সেই রূপ গোস্বামীর রস-ভাব বুঝতে পারি, আর ঠিক সেই কারণেই শ্রীক্ষেত্রে জগন্নাথ দেখে বা রেমুণায় গোপীনাথ দেখে মহাপ্রভু যে কেন এমন বারবার মূর্ছা যান তা বুঝতে পারি না। কিন্তু যিনি বোঝেন, তিনি ঠিক বোঝেন। যেমন এই রূপ গোস্বামী—তিনি কিন্তু মহাপ্রভুর অন্তরের গূঢ় রসভাবটুকুও বোঝেন। বোঝেন, কেননা মহাপ্রভুর হৃদয়ে যে ভাব আছে, সে ভাব তাঁরও অন্তরে আছে বলেই সমান অনুভবে তিনি মহাপ্রভুকে বুঝতে পারেন, কিন্তু আমি পারি না বা আপনাদেরও তা বোঝাতে পারব না। তবু ভাব বোঝাবুঝির এই ব্যাপারটা যদি আপনাদের বোঝাতে পারি, তাহলে অন্তত বলতে পারব—কেন আমি আপনাদের বোঝাতে পারি না মহাপ্রভুর ভাব।
আমি এই প্রবন্ধের ছোট্ট পরিসরে কোথাও জানাতে পারলুম না, কীভাবে মহাপ্রভু হুসেন শাহর দরবার থেকে রূপ-সনাতনের মতো দুই রাজমন্ত্রীকে আপন ভাব-জগতে এনে স্থাপন করলেন, কিন্তু তার আগেই রূপের ভাব-গ্রন্থিমোচনের সংবাদ দিচ্ছি। ঘটনা হল—সেবারও জগন্নাথের রথোৎসব চলছে। গৌড়দেশ থেকে অগণিত ভক্ত এসেছেন সচল মহাপ্রভুর সঙ্গে অচল জগন্নাথ মহাপ্রভুর দর্শন করবেন বলে। ততদিনে রূপ-সনাতন রাজকার্য ছেড়ে চলে এসেছেন মহাপ্রভুর কাছে—তাঁরা বৃন্দাবনে চলে যাবেন কিছুদিন পরে। চলে এসেছেন যবন হরিদাস, নবদ্বীপ ছেড়ে। এখন তিনি পাকাপাকি নীলাচলবাসী। যাইহোক, উড়িয়া, গৌড়িয়া—প্রভুর যত ভক্ত আজ নেমে এসেছেন রথের সামনে। প্রভু জগন্নাথ রথোপরি স্থাপিত হয়েছেন, সমস্ত জনারণ্যের মাঝখানে শুধু জয়কার-ধ্বনি শোনা যাচ্ছে—জয় জগন্নাথ! জয় মহাপ্রভু নীলাচল নাথ!
আমি এক কথায় দুই কথা বলব। এক কথা হল—মহাপ্রভু জননী শচীদেবীর উপরোধে নীলাচল ক্ষেত্রে রয়ে গেলেন, পরে তিনি বৃন্দাবনে গেছেন বটে, কিন্তু স্থায়ী আবাস শ্রীক্ষেত্র। দ্বিতীয় কথা হল—পুরীতে থাকার ফলে তাঁর মধ্যে সেই চিরন্তন বিরহ-দশা রয়েই গেল। ভাবটা এই—জগন্নাথের মধ্যে সেই শ্যামল-সুন্দরকে পেলাম বটে, কিন্তু বৃন্দাবনের মধুর রমন-বসতিতে তাঁকে পেলাম না। যাইহোক, রথাগ্রে উড়িয়া-গৌড়িয়াদের সংকীর্তন চলছে। হঠাৎই চৈতন্যদেব একটি সংস্কৃত শ্লোক উচ্চারণ করলেন সকলের সামনে। বলে নেওয়া ভালো—মধুর যে ছন্দোময়ী বাণী মহাপ্রভুর মুখ থেকে নির্গত হল, তার ভাব-রস সবটাই একেবারে প্রাকৃত সাধারণ নায়ক-নায়িকার প্রেমের বিষয়। সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রের বিশিষ্ট ভাবুকেরা এই শ্লোক বারংবার উদাহরণ হিসেবে দিয়েছেন ব্যঞ্জনা-বৃত্তির সুষ্ঠু প্রয়োগ দেখানোর জন্য। সকলেই অবাক হয়ে গেল—মহাপ্রভু কৃষ্ণের কীর্তন অথবা তাঁর লীলাবিষয়ক মধুরালাপ বাদ দিয়ে কেন জগন্নাথের সামনে এমন এক জর্জর প্রাকৃত শ্লোক উচ্চারণ করলেন? এত কথার পর সেই শ্লোকের অর্থ না বললেই নয় এবং আরও বলা দরকার যে, এই শ্লোক লিখেছেন সংস্কৃতের এক বিখ্যাত মহিলা কবি।
প্রেমিকার সঙ্গে প্রেমিকের দেখা হয়েছে বহুকাল পরে, কিন্তু যেখানে দেখা হয়েছে, সে জায়গাটা প্রেমিকার ভালো লাগছে না—এমন একটা জায়গা যেখানে প্রেমের সার্থক উদ্দীপন ঘটে না। প্রেমিকা বলছে—সেই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হল। আমার প্রথম যৌবনে যিনি আমার কুমারীত্ব হরণ করেছিলেন, যিনি আমাকে অশেষে-বিশেষে কামনা করেছেন, আমার সেই কুমারীত্ব-হরণ-করা বর আমার সামনেই উপস্থিত, আছে সেই চৈত্রের রজনীও—বসন্ত রজনীর কোকিলালাপ-বাচাল যত উপকরণ, তাও ঠিকই আছে, সেই উন্মীলিত মালতীফুলের হাওয়া ভেসে আসছে প্রৌঢ়পুষ্প কদম্বের রেণু গায়ে মেখে। এমনকী আমিও তো সেই আমিই আছি। কিন্তু এ কেমন বুকের মধ্যে উথালি-পাথালি লাগে আমার—সেই যে সেই রেবা নদীর তীরে বেতসী-লতার কুঞ্জভবনে তাঁর সঙ্গে যে আমার দেখা হত, প্রেমের সেইসব প্রথম আকুলতার অভিসন্ধিগুলি আমার সেই লজ্জা-কুঞ্জে ফেলে এসেছি, সেই রেবার তীরে বেতস-গৃহখানির জন্য আমার মন কেমন করে। ইচ্ছে করে সেইখানে ফিরে যাই আবার।
জগন্নাথের রথের সামনে সমস্ত ভক্তদের মধ্যে যখন এক দৈবভাব উদ্দীপিত হচ্ছে, সেই সময়ে এমন এক প্রাকৃত নায়িকার প্রেমাকুল বর্ণনা সবাইকে অবাক করে দিল। একবার নয়, দুবার নয়—এই শ্লোক মহাপ্রভু পড়েন বারবার। কেউ যার অর্থ বুঝল না, অন্তত চৈতন্যদেব কেন এই সময়ে এমন শ্লোক পড়লেন, তার অন্তর্গূঢ় রহস্যটা একজনই মাত্র বুঝতে পারলেন। তিনি হলেন পুরীতে মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ সঙ্গী স্বরূপ-দামোদর। মহাপ্রভুর অন্তরের এই আর্তি কেন, সেটা স্বরূপ বুঝলেন বটে, কিন্তু কাউকে বললেন না। হুসেন শাহের মন্ত্রী দবির খাস রূপও কিন্তু সেবার পুরীতে এসেছিলেন মহাপ্রভুর কাছে। সেই রথযাত্রায় তিনিও ছিলেন প্রভুর কাছাকাছি। তিনিও শ্লোক শুনে স্বস্থানে ফিরে গেছেন।
রূপ, সনাতন আর যবন হরিদাস—এই তিনজন জগন্নাথের মন্দিরে প্রবেশ করতেন না। বহুকাল মুসলমান সুলতানদের রাজকর্ম করেছেন সেইজন্য রূপ-সনাতন নিজেদের বড়ো হীন এবং ম্লেচ্ছ বলে ভাবতেন, আর হরিদাসের দীনতা ছিল প্রশ্নাতীত। এঁরা জগন্নাথের মন্দিরে প্রবেশ করতেন না বলে মহাপ্রভু নিজেই এই তিনজনের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন প্রতিদিন। সেই রথযাত্রার পরের দিন জগন্নাথের প্রাতঃকালীন উপল-ভোগ দর্শন করে মহাপ্রভু এসেছেন ওই তিনজনের সঙ্গে দেখা করতে। এসে দেখলেন—রূপ গেছেন সমুদ্র-স্নান করতে। হঠাৎই ওপর দিকে নজর পড়তে শ্রীরূপের ঘরের চালের ওপর তালপাতায় লেখা একটি সংস্কৃত শ্লোক দেখতে পেলেন মহাপ্রভু। সে-যুগে বহু কসরত করে লেখার কালি তৈরি করতে হত এবং তালপাতায় লেখার পর তা শুকোতে দিতে হত। তা ঘরের চালে শ্লোক শুকোতে দিয়ে রূপ স্নানে গেছেন আর তখনই মহাপ্রভুর নজরে এল রূপের অপূর্ব হস্তাক্ষর—শ্রীরূপের অক্ষর যেন মুকুতার পাতি।
রূপের লেখা শ্লোক পড়ে মহাপ্রভু একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। তাঁর অন্তরের মধ্যে সেই কৃষ্ণপ্রেমের আকু%ল ভাব জাগল, তিনি আবিষ্ট হয়ে রইলেন। স্নানশেষে রূপ ফিরে এসেই দণ্ডবৎ প্রণাম করে লুটিয়ে পড়লেন মহাপ্রভুর পায়ে। প্রভু তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন—কেউ যে-কথা বুঝতে পারল না—মোর মনের কথা তুই জানিলি কেমনে? আনন্দে মহাপ্রভু সেই শ্লোক-পাতি নিয়ে চললেন স্বরূপ-দামোদরকে দেখানোর জন্য। রূপ যে শ্লোক লিখেছেন সেটাও এক রমণীর বয়ান, কিন্তু সেটা প্রেমময়ী রাধার কথা, কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে। পুরাণে প্রমাণ আছে—রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের একবার দেখা হয়েছিল কুরুক্ষেত্রে। কুরুক্ষেত্র ধর্মক্ষেত্র বটে, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রও বটে। যুদ্ধ লাগলেই দুই বিবাদী ক্ষত্রিয় শিবির এখানে উপস্থিত হতেন ভালো করে যুদ্ধ করার জন্য। বিখ্যাত পানিপথ—যেখানে অন্তত তিন-তিনটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ হয়েছে—সেই পানিপথও কিন্তু কুরুক্ষেত্রের পরিসরের মধ্যেই। তার মানে কুরুক্ষেত্র মানেই যুদ্ধ, কুরুক্ষেত্র মানেই যুযুৎসু ক্ষত্রিয়ের আনাগোনা। আর এই রকম একটা বিপরীত জায়গায় রাধার সঙ্গে দেখা হয়েছে কৃষ্ণের। রূপ গোস্বামীর সংস্কৃত অনুবাদে ব্যাপারটা রাধার আকুলতায় ধরা পড়েছে। তিনি সহচরী সখীদের বলছেন—
সেই প্রিয়তম কৃষ্ণের সঙ্গেই আমার দেখা হয়েছে, সখী! কিন্তু দেখা হল এই কুরুক্ষেত্রে। অথচ সেই কৃষ্ণ তো কৃষ্ণই আছেন, আমিও সেই আমিই আছি। এমনকী আমাদের মধ্যে যে সেই মধুর মিলন তাও ঘটেছে, এই কুরুক্ষেত্রে। কিন্তু তবু, তবু সেই যমুনা-পুলিন-বনে মধুর মুরলীর পঞ্চম তান যা আমার মনের মধ্যে হু-হু করে উঠত, সেই যমুনা-পুলিনে যদি কৃষ্ণের সঙ্গে মিলন হত আমার, তাঁর জন্যে অন্তরে আমার দুঃখ রয়ে গেল।
ধরে নেওয়া যাক, রূপকৃত এই শ্লোকটি পুরাতন এক প্রাকৃত শ্লোকের কৃষ্ণলীলায় রূপান্তর করা বৈষ্ণবীয় অনুবাদ। কিন্তু এখানে যেটা বড় হয়ে উঠেছে, সেটা হল হৃদয় বোঝার ব্যাপার। মহাপ্রভুর কৃষ্ণপ্রেমসিক্ত হৃদয়টি এমন করে কে বুঝতে পেরেছে। মহাপ্রভুর হৃদয় আচ্ছন্ন হয়ে আছে কৃষ্ণপ্রেমে, হৃদয়ের মধ্যেও সেই চিরবিরহকাতর রাধাভাব। অথচ মায়ের ইচ্ছার মূল্য দিতে গিয়ে সন্ন্যাসীর স্বাধীনতা গ্রহণ করে তিনি বৃন্দাবনে গিয়ে থাকতে পারলেন না। নীলাচলক্ষেত্রে জগন্নাথদেবের মধ্যেও তিনি তাঁর শ্যামল-কিশোরকে দেখতে পান বটে, কিন্তু তাত্ত্বিকতার দিক থেকে সেই দর্শনে ভেদ না থাকলেও কৃষ্ণের স্বপদ-রমণ বৃন্দাবনের মধ্যেই রাধা যেমন তাঁকে পেতে চান, মহাপ্রভুর ভাবও তেমনই। পুরীতে জগন্নাথকে যখনই দেখেন, প্রভু ভাবেন যেন কুরুক্ষেত্রে দেখা হয়েছে কৃষ্ণের সঙ্গে। কবিরাজ কৃষ্ণদাসের অনবদ্য পয়ারে ভাবটা এইরকম দাঁড়ায়—
সেই তুমি সেই আমি সে নব সঙ্গম।
তথাপি আমার মন হরে বৃন্দাবন।।
ইঁহা লোকারণ্য হাতী ঘোড়া রথধ্বনি।
তাঁহা পুষ্পবন ভৃঙ্গ পিক নাদ শুনি।।
ইঁহা রাজবেশ সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের গণ।
তাঁহা গোপগণ সঙ্গে মুরলীবদন।।
ব্রজে তোমার সঙ্গে যেই সুখ আস্বাদন।
সে সুখ সমুদ্রের ইঁহা নাহি এক কণ।।
আমরা এই প্রসঙ্গে এসেছিলাম ভাব বোঝাবুঝির প্রসঙ্গে। প্রভু এক-একটি জায়গায় যান, আর কৃষ্ণের বিগ্রহ দেখেই মূর্ছিত হয়ে পড়েন—সেই মূর্ছার কারণ বোঝাতে এত কথার অবতারণা। তবু জানি কিছুই বোঝাতে পারিনি। প্রথম বার জগন্নাথ দর্শনের পর চৈতন্য যখন মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন, তখন সেখানে তাঁর কাছের মানুষ কেউ ছিলেন না। তাঁর মূর্ছিত শরীরের ওপর প্রথম যাঁর নজর পড়ল, তিনি দিগ্বিজয়ী নৈয়ায়িক এবং মনে-প্রাণে অদ্বৈতবাদী সার্বভৌম ভট্টাচার্য। নবদ্বীপ থেকে বহুকাল আগে এসে তিনি এখানে বসতি করেছেন এবং ওড়িশার রাজা প্রতাপরুদ্রের পৃষ্ঠপোষকতা ভোগ করেন তিনি। সন্ন্যাসীকে মূর্ছিত দেখে তিনি তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন মহাপ্রভুকে। প্রথমে তিনি মহাপ্রভুকে অদ্বৈত-বেদান্ত বোঝানোর বিফল চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে এই তরুণ সন্ন্যাসীর ব্যক্তিত্ব তাঁকে মেনে নিতে হয় এবং তিনি সর্বথা মহাপ্রভুর ভাব স্বীকার করে নেন। শেষকালে সমস্ত বিদ্যার অহংকার ত্যাগ করে তিনি লেখেন—আমি সারা জীবন ন্যায়-মীমাংসা, সাংখ্য-যোগ-বেদান্ত নিয়ে অনেক তর্কযুক্তি সাজিয়েছি, কিন্তু সবার ওপরে, সবচেয়ে বেশি শক্তি দেখতে পেলাম সেই কৃষ্ণের মুরলী-ধ্বনির মধ্যে—কিন্তু স্ফুরণ-মাধুরী-ধারা কাচন নন্দনসূনুমুরলী মচ্চিত্তমাকর্ষতি।
প্রথমবার পুরীতে যাওয়ার পর বেশি দিন মহাপ্রভু সেখানে থাকেননি। তিনি দক্ষিণ ভ্রমণে বেরিয়ে ছিলেন। মুখে বলেছিলেন—জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বিশ্বরূপকে খোঁজার জন্য দক্ষিণ-দেশে যাবেন তিনি, কিন্তু প্রকৃত উদ্দেশ্য বোধহয় অন্য কিছু। হয়তো চিরাচরিত সন্ন্যাসীর মধু-মন্ত্র কানে বেজেছিল একবার—চলতে থাকো, চলতে থাকো, চলতে-চলতেই অমৃত-মধুর সন্ধান পাবে—চরন বৈ মধু বিন্দেত। হয়তো এটাও একটা খুব বড়ো কারণ—যেহেতু শাস্ত্রকারদের প্রবাদ আছে যে, দাক্ষিণাত্যেই ভক্তিধর্মের উদ্ভবস্থান। সুতরাং আপন অনুরাগময়ী ভক্তির তাত্ত্বিক অবস্থান বুঝে নিতে হয়তো দক্ষিণ-গমন একবার প্রত্যাশিত ছিল মহাপ্রভুর কাছে। আর বোধহয় ইচ্ছে ছিল একাকী হওয়ার। নবদ্বীপে যা ঘটেছে, পুরীতেও সেই অন্তরঙ্গ ভক্তেরা তাঁকে সদা সর্বদা ঘিরে রাখেন, তাঁদের ভক্তির বাঁধন, প্রভুর জন্য তাঁদের নিরন্তর দুশ্চিন্তার আন্তরিকতা প্রভু এড়াতে পারেন না। মাঘমাসের শুক্লপক্ষে তিনি সন্ন্যাস নিয়েছিলেন, ফাল্গুন-চৈত্র পুরীতেই কাটল, বৈশাখের প্রথমেই ভক্তদের কাছে প্রকাশ করলেন যে, তিনি দক্ষিণে যাবেন এবং একটু হুংকার দিয়েই বললেন—’একাকী যাইব কাহো সঙ্গে না লইব।’
কথাটা শুনে ভক্তদের মাথায় বাজ পড়ল। নিত্যানন্দ পালটা হুমকি দিয়ে বললেন—’ঐছে কৈছে হয়?’ তোমার একা যাওয়া হবে না। অন্তত দুই-এক জন যাক তোমার সঙ্গে, নইলে আমিই যাই—দক্ষিণ-দেশের আমি সব জায়গা চিনি। কিন্তু চৈতন্য এবার মানলেন না কারও কথা। ভক্তদের অন্তরঙ্গতা তিনি বোঝেন—কেউ তাঁর কষ্ট সহ্য করতে পারেন না। সন্ন্যাসীর বৈরাগ্যে তিনি দিনে তিনবার স্নান করবেন প্রখর শীতেও, একটুও ভালো-মন্দ খাবেন না, আবার কেউ তাঁর ওপরে শিক্ষাদণ্ডও ধরে আছেন, বলছেন—এটা কোরো না, ওটা কোরো না, এত ভালোবাসায় চৈতন্যের মন আঁকুপাঁকু করছে। তিনি একা যেতে চান। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল— কৃষ্ণদাস নামে এক ব্রাহ্মণ যুবক মহাপ্রভুর জন্য কৌপীন, বহির্বাস আর জলপাত্র বয়ে যাবেন তাঁর সঙ্গে, কেননা এটাও ঠিক যে মাঝে মাঝেই তাঁর জ্ঞান থাকে না। সঙ্গে একজন অন্তত না থাকলে প্রভুর জীবনহানির আশঙ্কা থেকে যায়।
মহাপ্রভুর দক্ষিণ ভ্রমণের বিবরণ এখানে দেব না, কেননা সে বিবরণ বিশদ, বিচিত্র এবং মধুর। এখানে একটা কথাই শুধু বলব যে—প্রভুর দক্ষিণ ভ্রমণের পরম প্রাপ্তি হলেন রামানন্দ রায়। রামানন্দ শূদ্র জাতি, রাজসেবা করেন, কিন্তু তাঁর তাত্ত্বিক জ্ঞান এবং প্রেমভক্তির কথা এতটাই প্রচারিত ছিল যে, সার্বভৌম ভট্টাচার্যের মতো বিদগ্ধ পণ্ডিতও তাঁকে মান্য করতেন। মহাপ্রভুকে তিনিই বলে দিয়েছিলেন যাতে এই ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকার অবশ্যই হয়। কেননা রমানন্দের মতো প্রেমী ভক্তের সঙ্গ পেলে মহাপ্রভুর আনন্দ হবে। রামানন্দ-মিলনে প্রভু এতটাই উৎফুল্ল হয়েছিলেন যে, রামানন্দ তাঁকে আরও দিন দশেক তাঁর বাড়িতে থেকে যেতে বললে, প্রভু বলেছিলেন—
দশ দিনের কা কথা যাবত আমি জীব।
তাবত তোমার সঙ্গ ছাড়িতে নারিব।।
নীলাচলে তুমি আমি থাকিব এক সঙ্গে।
সুখে গোঙাইব কাল কৃষ্ণকথারঙ্গে।।
চৈতন্যদেব আরও সুদূর দক্ষিণে যাত্রা করার পরেই রামানন্দ নীলাচলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ব্যক্তি হিসেবে রামানন্দ যেমন চৈতন্য-জীবনে পরম প্রাপ্তি, তেমনই বড় প্রাপ্তি দুখানি গ্রন্থ—এক, ব্রহ্মসংহিতা; দুই, লীলাশুক বিল্বমঙ্গলের কৃষ্ণকর্ণামৃত। এর আগে বঙ্গদেশে এই দুই গ্রন্থের তেমন পরিচয় জানা ছিল না। এই দুটি গ্রন্থ চৈতন্যের প্রেমভক্তি আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। মহাপ্রভু এই দুটি রসগ্রন্থ এনে রামানন্দের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, কেননা এই গ্রন্থ আস্বাদনের যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে রামানন্দ ছাড়া আর কাউকে তিনি ভাবতে পারেননি। শুধু রামানন্দের জন্য সুদীর্ঘ দক্ষিণ পথ ভ্রমণ করে আবারও তিনি রামানন্দের কাছে ফিরে এসেছিলেন। দক্ষিণাদেশের রাজকার্য ছেড়ে আসতে রামানন্দের কিছু সময় লেগেছিল। তাছাড়া এক রাজ্য ছেলে আর এক রাজ্যে প্রবেশ করতেও সেকালে অনুমতি লাগত। ওড়িশার রাজা প্রতাপরুদ্র মহাপ্রভুর নাম শোনামাত্রই অনুমতি-পত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন রামানন্দের কাছে। রামানন্দ চৈতন্যদেবকে আগে পাঠিয়ে দিলেন নীলাচলে, শেষে সর্বত্যাগ করে চলে এলেন মহাপ্রভুর কাছে।
অনেক ঘটনা ঘটেছে এর পরে। দুই বৎসর পুরীতে থাকার পর চৈতন্যদেব বৃন্দাবন যাওয়ার মন করেছেন এবং বৃন্দাবন গেছেন গৌড়দেশ হয়ে। সার্বভৌমকে প্রভু বলেছিলেন—গৌড়দেশে আমার দুটি আশ্রয় আছে—আমার মা এবং মা-গঙ্গা—গৌড়দেশে হয় মোর দুই সমাশ্রয়। জননী জাহ্নবী এই দুই দয়াময়। সবার সঙ্গেই দেখা হয়েছিল গৌড়দেশে, কিন্তু সেবারেও বৃন্দাবন যাওয়া হয়নি তাঁর, গেছেন তার পরের বছর। এই সমস্ত গমনাগমনের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ঘটনা হল, পাঁচজন বিরাট ব্যক্তিত্বের ওপর মহাপ্রভুর প্রসন্নতা। রূপ, সনাতন, রঘুনাথ ভট্ট, গোপাল ভট্ট এবং রঘুনাথ দাস—এই পাঁচ জনের সঙ্গে পরে জুটেছিলেন শ্রীজীব—সব মিলে বৃন্দাবনের এই ছয় গোস্বামী মহাপ্রভুর সম্পূর্ণ ভক্তি আন্দোলনের তাত্ত্বিক রূপ দিয়েছিলেন।
বারবার এই কথাই মনে হয়—চৈতন্যদেব নিজে এক ছত্র লিখলেন না। কিন্তু মর্মে মর্মে কৃষ্ণভক্তির যে রসগ্রন্থি তাঁর অন্তরের মধ্যে পাকিয়ে বসেছিল, কী ভীষণ ব্যক্তিত্ব থাকলে সেই রসগ্রন্থি দিয়ে অন্য সমস্ত মানুষকে একত্র বেঁধে ফেলা যায়! সেই ব্যক্তিত্ব শৌর্য-বীর্য, ধনুক-বাণ দিয়ে তৈরি হয়নি, তাঁর আপন অন্তরজাত প্রেমেই সে ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছিল। চব্বিশ বছরে তিনি সন্ন্যাস নিয়েছেন, সন্ন্যাসের পর ছয় বৎসর শুধু এই গমনাগমন চলেছে— নীলাচল, গৌড়, সেতুবন্ধ, বৃন্দাবন। এই ছয় বৎসরের প্রচারেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গাতে তাঁর প্রবর্তিত ভক্তির স্তম্ভ স্থাপিত হয়ে গেছে—বৃন্দাবনে ছয় গোস্বামী আর গৌড়ে নিত্যানন্দ, অদ্বৈত, গদাধর, শ্রীনিবাস। পুরীতে রইলেন তিনি নিজে।
শেষ আঠারো বছরের মধ্যেও শেষ বারো বছরের কথা আমি লিখে শেষ করতে পারব না। প্রভুর শেষ লীলার কথা মনে হলেই আমার সেই ধ্রুবপদ মনে আসে—’প্রভু কহে পঢ় শ্লোক।’ শেষ জীবন-সঙ্গী রামানন্দ রায় আর স্বরূপ দামোদর—তাঁদের কাছে প্রভুর দিনরাত দিব্যোন্মাদী বিরহ-বিলাপগুলি আমি কাকে বোঝাব, কেমন করেই বা বোঝাব! বিদ্বান মানুষ ‘ফিলসফি’ বোঝেন, বোঝান—চৈতন্যের অচিন্ত্যভেদাভেদ-বাদের সঙ্গে বিভিন্ন বৈষ্ণব আচার্যের মতবাদ প্রকট করেন—কিন্তু যেটা রসতত্ত্বের জায়গা সেখানে চৈতন্যের অখণ্ড বিলাপরাশির তাৎপর্য কেমন করে বোঝাব আমি! কেমন করে বোঝাব—একান্ত মধুর শৃঙ্গারের মধ্যেও দাস্যভাব কেমন করে আলোড়িত করে মহাভাবময়ী শ্রীরাধিকাকে অথবা মহাপ্রভুকে। অন্যজনে বলেছেন—এগুলি মহাপ্রভুর বিকার, কেউবা মৃগীরোগ বলেও বুঝিয়েছেন এইসব ভাব-বিকারকে। তবু দেখেছি, শিক্ষিত মানুষের চেয়েও অশিক্ষিত দীন-হীন মানুষই বোধহয় তাঁকে অনেক বেশি বোঝেন। তাঁর অদ্বয় জ্ঞান-তত্ত্ব বোঝেন না, রসরাজ-মহাভাবের স্বরূপ বোঝেন না, কিন্তু একত্রে প্রভুর কীর্তনরঙ্গ বোঝেন, অথবা একান্তে গৌড়ীয় ধারায় মহাপ্রভুর ভাববিলাসটুকু বুঝি তাঁরা মনের মধ্যে অনুভব করেন।
আসল কথা কী, মহাপ্রভুর সমাজ-সংস্কারকের ভূমিকাটা আপনাদের পক্ষে বোঝা অনেক সহজ, কেননা জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে এমন উদার আন্দোলন সাধারণের মধ্যে যেভাবে আস্থা জাগায়, সেটা ইতিহাস এবং সমাজনীতির ছকে সুন্দর ব্যাখ্যা করা যায়। আমার মতে—মহাপ্রভুর ভাবিত দর্শন ব্যাখ্যা করাও সহজ, কেননা পুরাতন বৈষ্ণব দর্শন যত—দ্বৈতবাদ, বিশুদ্ধাদ্বৈতবাদ—এগুলির পরম্পরায় মহাপ্রভুর দর্শন ব্যাখ্যা করা যায়—যদিও সেখানে চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রভাব এবং ক্ষমতা অনেক বেশি। কেননা সেকালে নিজস্ব সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার জন্য উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র এবং ভগবদগীতা-র ওপরে টীকা লিখতে হত। মহাপ্রভু নিজেও তা লেখেননি, অন্য পার্ষদ ভক্তদের ওপরেও তাঁর এই নির্দেশ ছিল না। ভাগবত পুরাণকেই তিনি গায়ত্রীর ভাষ্য বলে মনে করতেন, অতএব শুধু সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবৎকালে তিনি প্রস্থান-ত্রয়ের টীকা-ভাষ্য রচনার অসরস চেষ্টা করেননি। কিন্তু তাতে তাঁর দর্শন বোঝার অন্তরায় হয় না। তাঁর পার্ষদদের লেখা থেকেই তাঁর দার্শনিক অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যায়।
কিন্তু সবকিছুর ওপরে বুঝি চৈতন্যের রসতত্ত্বের ভাবনা। চিরন্তন ঐতিহ্যবাহী রসশাস্ত্র তাঁর আমলে পরিবর্তিত হয়ে গেল এবং সেই তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল সাধারণ মানুষের প্রাণের মধ্যে। দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য—ইত্যাদি যেসব রস মানুষের স্বভাব এবং বৃত্তির মধ্যে আছে, সেই রসকে কৃষ্ণভক্তির কেন্দ্রে স্থাপনা করে মহাপ্রভু মানুষের শাশ্বত রসবৃত্তিগুলিকেই এমনভাবে জাগ্রত করে দিয়েছেন, যাতে করে সাধারণ মানুষও পরম ইশ্বরকে ভালোবাসার গণ্ডির মধ্যে পেয়ে গেছে। মহাপ্রভুর এই রসতাত্ত্বিক জাগরণ যতটাই কঠিন, ততটাই সহজ—বিশ্বাসে তা সহজ, তর্কে বহু দূর। এই রস-ভাব বোঝার জন্য সমমনস্ক ভাবুক-রসিক দরকার। মহাপ্রভুর যেমন রামানন্দ রায়, স্বরূপ-দামোদর, তেমনই পরবর্তীকালেও যুগে যুগে এই সমমনস্কের পরম্পরা আছে। নরোত্তম দাস ঠাকুর তাঁর পদে লিখেছিলেন—
সে সব সঙ্গীর সঙ্গে যে কৈল বিলাস।
সে সঙ্গ না পাইয়া কাঁদে নরোত্তম দাস।।
অর্থাৎ যেমন ভাব যে বুঝতে গেলে তেমন সঙ্গী চাই। আমি বলেছিলাম—কেমন করে বোঝাব—মহাপ্রভুর সেই অন্ত্যলীলার রহস্যের কথা। কখনও নৃত্য, কখনও গীত, কখনও অশ্রু-কম্প-পুলকে মাটিতে পড়ে যাওয়া, আর কখনও—’স্বরূপ গায় বিদ্যাপতি গীতগোবিন্দের গীতি/শুনি প্রভুর জুড়াইল কাণ।’ এই তাঁর অন্ত্যলীলা। তাঁর তিরোভাব বা তথাকথিত অন্তর্ধান নিয়ে আমার এতটুকু ভাবনা নেই। কেউ বলেন—পাণ্ডারা তাঁকে মেরে ফেলেছে, কেউ জয়ানন্দের দোহাই দিয়ে বলেন—তাঁর সেপটিক হয়ে গিয়েছিল, কেউ বলেন— তিনি জগন্নাথে বিলীন হয়ে গেছেন। এই জায়গাটা গবেষণা আর তর্কে, প্রতিযুক্তিতে এতই জটিল হয়ে গেছে যে, আর বিচার করতেও ভালো লাগে না। আর তাঁর জীবনের শিক্ষা থেকে ভালো বলে যেটা বুঝেছিলাম, সেটাও এখন বিলুপ্তপ্রায়। খোল-করতাল-যোগে যে সংকীর্তন-ধ্বনি এককালে আমাদের মাতিয়ে রাখত, সেই কীর্তন ব্যাপারটাই তো নষ্ট হয়ে গেছে। যাঁরা এককালে রামদাস বাবাজির কীর্তন শুনেছেন, তাঁর পরম্পরায় হরিদাস-নির্যাণ শ্রবণ করেছেন, তাঁরা এখন কোথায়? এমনকী এদিনের নন্দকিশোর দাসের কীর্তন-ঘরানাও লুপ্ত হয়ে গেল। কী করে আর মহাপ্রভুর অন্ত্যজীবনের ভাব প্রকাশ করব ভাষায়!
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের কথা বলার শেষে আমার নিজের অনুভবের কথা কিছু বলতেই হবে। আপনারা বলবেন—এ তো বেশ মজার কথা, আপনি এক মহাজীবনের সত্য উদঘাটন করার প্রতিজ্ঞা করে শেষে নিজের কথা গাইতে আরম্ভ করলেন? সত্যিই দিনকাল বড়ো খারাপ পড়েছে, সুযোগ পেলেই মানুষ এখন নিজের কাঁসি-করতাল বাজায়। আমি বলি—দেখুন, আমি একটু অহংকারী মানুষই বটে, আমি অধিকারী-ভেদে বিশ্বাস করি। চৈতন্যের কথা বলার অধিকারটুকু আমার আছে কিনা সেটা আগে বিচার করে দেখুন, তবে তো আমার মুখে চৈতন্য-কথার সামান্য ফলশ্রুতি ঘটতে পারে। আপনারা বলবেন—এই তো সেই পুরাতন সংস্কার গরগর করছে তোমার ভিতরে। এই তো সেই গোষ্ঠীতন্ত্র, এই তো সেই সাম্প্রদায়িকতা— নইলে চৈতন্যের মতো সর্বজনীন দিব্য পুরুষের কথা শুনব, সেখানে আবার অধিকারীর প্রশ্ন আসে কেন? চৈতন্য তো সবার জন্য, তাঁর ধর্মমতও সর্বসাধারণের উপজীবন, তবে কেন এই অধিকারী-ভেদ, কেন এই সংরক্ষণশীলতা?
এসব কথায় আমার দুটি কথা থাক। আমি বলি—দেখুন, বামপন্থী মার্কসবাদও তো সবার জন্য। কিন্তু মার্কস-এঙ্গেলস পড়েই বা কজন, আর পড়তে পারেই বা কজন! কিন্তু অনেক বামপন্থী নেতাকেই আমি উজ্জীবিত হতে দেখেছি তত্ত্ববেত্তা মার্কসিস্টের সঙ্গলাভের মাধ্যমে। আবার কাউকে দেখেছি—তিনি তেমন তত্ত্ববাদী নন, মার্কস-এঙ্গেলস তেমন পড়েননি, কিন্তু ছাত্রাবস্থা থেকেই শুনে-শুনে, অনুভব করে, আন্দোলনে জড়িয়ে গিয়ে, অতঃপর খানিকটা পড়াশুনো করে, অবশেষে মহত্তর ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসে পুরোপুরি বামপন্থী নেতা হয়ে গেলেন। বাস্তব সমাজ শিক্ষার ক্ষেত্রে মার্কস-এঙ্গেলসের গ্রন্থগুলি যত উপকারী, এমনকী তত্ত্ববেত্তা তাত্ত্বিক নেতাও না যত উপকারী, তার থেকে অনেক বেশি উপযোগী কিন্তু ওই তৃণমূল স্তর থেকে উঠে-আসা অভিজ্ঞ, মানুষের দুঃখে সমদুঃখীর নেতা।
ব্যাপারটা আমার ক্ষেত্রেও একইরকম। চৈতন্য-জীবনের আকর গ্রন্থ চৈতন্যচরিতামৃত-এ বলা হয়েছে—’এক ভাগবত বড় ভাগবত-শাস্ত্র। আর ভাগবত ভক্ত ভক্তিরসপাত্র।।’ অনেকেই জানেন—ভাগবত পুরাণ চৈতন্যপন্থীর কাছে বেদ, ঠিক যেমন বামপন্থীর কাছে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। কিন্তু ভাগবত সকলে পড়েন না, পড়তে পারেনও না। তাহলে বিকল্প কী? বিকল্প—ভক্তিরসপাত্র, অর্থাৎ সেই রসের রসিক। ভক্তিরস যিনি বোঝেন, ভক্তি ব্যাপারটা তাঁর কাছে আর শুধুমাত্র নিয়ম-আচার-ব্রত নয়, ভক্তি তাঁর কাছে রস হয়ে উঠেছে। বিদ্যা, ধর্ম, সমাজনীতি এবং রাজনীতির আদর্শ বিশেষ পাত্র, বন্ধু, গুরুর মনন এবং উপদেশ-পরামর্শে রসায়িত হয়ে ওঠে। আমার মনে মধ্যে, আমার আশৈশব সমস্ত কর্মের মধ্যে এই রসায়ন ঘটেছে কত বার, কত রকম ভাবে, তা এই স্বল্পপরিসরে তেমন করে বোঝানো যাবে না। কিন্তু একটু-আধটু সেকথা না বললে আপনারা বুঝতেও পারবেন না যে, কেমন করে আমার অধিকার জন্মেছে চৈতন্যের জীবন নিয়ে কথা বলার।
আমার পিতাঠাকুর পরম বৈষ্ণব ছিলেন এবং সেই সূত্রেই হাজারো চৈতন্যপন্থী মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। পিতাঠাকুর নিজেও মানুষটা ছিলেন অদ্ভুত। সে-যুগে সাহেব-সুবো মাস্টারদের কাছে ইংরেজির সাম্মানিক স্নাতকতা লাভ করেও তিনি প্রথম যৌবনটা কাটিয়ে দিলেন গুরুসেবা করে; তারপর গ্রামের ইস্কুলে হেডমাস্টারি করে জীবিকা নির্বাহ করলেন জীবনের উত্তরকাল পর্যন্ত। গৃহস্থ যদি সন্ন্যাসী হয়, তাঁর ভাব ছিল সেইরকম। সকালবেলায় ঠাকুরঘরে নিত্যক্রিয়া চলার কালে তাঁর মুখে অজস্র সংস্কৃত শ্লোকের আবৃত্তি শুনতে পেতাম, যার মধ্যে চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্য রঘুনাথ দাস অথবা রূপ গোস্বামীর আর্তি ভেসে আসত কানে—স চৈতন্যঃ কিং মে পুনরপি দৃশোর্যাস্যতি পদম—’উৎকলপতি গজপতি-প্রতি, কৃপামৃতবর্ষী গৌরহরি। আর কি আপন, কমলচরণ, দেখাবেন মোরে করুণা করি?’ সারাদিন ইস্কুল, ভাই, জ্ঞাতি—শরিকদের ছেলেদের ইংরেজি পড়ানো চলত রাত্রির অন্ধকার পর্যন্ত, তারপর তাঁর হাতে উঠত ভাগবত-শাস্ত্র। কত রাত অবধি তাঁর পড়াশুনো চলত—ছোটোবেলায় তার ঠাহর পাইনি।
একথা অনস্বীকার্য যে, এই কঠিন পরিবেশের মধ্যে আমার প্রবেশ ছিল না; কিন্তু পূর্ববঙ্গের পাবনা থেকে কলকাতায় এসে স্থিত হওয়ার পর আমার সাত-আট বছর বয়স থেকে আমি প্রায়ই পিতাঠাকুরের সঙ্গ ছাড়তুম না। এর অন্যতম কারণ ছিল—মহাপ্রসাদ। বিভিন্ন মন্দির, আখড়া এবং গৃহস্থবাড়িতে তাঁর সঙ্গে যেতাম। দিন-রাত, এমনকী দিনের পর দিন, রাতের পর রাত সংকীর্তন চলত, আর সেই তখন থেকেই বিধি-নিয়ম-ক্লিষ্টা ভক্তিবৃত্তি আমার কাছে একটু একটু রসায়িত হয়ে উঠতে লাগল। মনে আছে—এক আশ্রমে একটি ছোট্ট ঘরের মধ্যে প্রায় জনা কুড়ি লোক ইধার-উধার ব্যাঁকা-ত্যাঁড়া হয়ে শুয়ে আছি, তার মধ্যে ঘুমোচ্ছিও। তেমনই এক রাতের গভীরে বেহাগের সুরে নাম-কীর্তন ভেসে এল কানে। তখনই উঠে গিয়ে কীর্তনে যোগ দিলাম। দেখলাম—পিতাঠাকুর বসে আছেন কীর্তনমঞ্চের বাইরে। তিনি কোনোদিন কীর্তন গাইতে পারতেন না, কিন্তু শুনতেন এমন নিরসলভাবে, সেটা অদ্ভুত লাগত। আর শুনবেনই না কেন! ভালো গাইয়েদের মুখে গভীর রাতের মৃদু মৃদঙ্গ-করতালের সঙ্গতে নিছক কৃষ্ণনামও যে কত মধুর হয়ে উঠতে পারে, তা যারা উপভোগ করেননি, তাঁরা বুঝবেন কী করে! উত্তর কলকাতায় ১ নং মোহনবাগান লেনে গোবিন্দদাস মোহান্তের আশ্রমের এই দিনগুলি আমাকে চৈতন্য মহাপ্রভুর কীর্তনমাধুর্য বুঝতে শিখিয়েছে। গোবিন্দদাস মোহান্তজি আজ স্বার্থপীড়িত মানুষের হাতে বিতাড়িত হয়ে অন্যত্র বাস করছেন। তাঁর আশ্রমটি এখনও আছে, কিন্তু সেই নবরাত্রি কীর্তনের আসর এখন আর বসে না।
পিতাঠাকুরের সঙ্গে, তাঁরই আত্মীয়তার আর এক প্রৌঢ়া জননীর সঙ্গে পরিচয় হল—সকলেই তাঁকে গোপালের মা বলে ডাকে। আগরপাড়ায় তাঁর গর্ভজাত সন্তান সুধীন-শিবনের নামে তাঁকে কেউ চিনত না, তিনি শুধুই গোপালের মা। তাঁর একটি বড়ো-সড়ো গোপালমূর্তি ছিল; যেখানেই তিনি যেতেন তাঁর কোলে গোপাল এবং হাতে গোপাল-সেবার সরঞ্জাম চলত সাথে-সাথে। আমার জীবনে অমন মধুর-চিকন গোপালমূর্তি আমি চোখে দেখিনি এবং যেটি আরও উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতেন ‘তাঁর মায়ের’ সেবায়। পিতাঠাকুর বলতেন—তাঁর যশোমতী-ভাব। আমার দিক থেকে গোপালের মায়ের কদর আরও বেশি ছিল এই কারণে যে মহাপ্রভুর সেবায় কীর্তনান্তে খিচুড়ি, ডাল-ভাত-লাবড়াই ছিল প্রধান প্রসাদ, কিন্তু ব্রজ-রাজকি নন্দন নীলমণি এসব খান না। তিনি ক্ষীর, সর, ছানা-ননী খেয়ে বড়ো হয়েছেন বলে গোপালের মা যেখানে তাঁর বিগ্রহ নিয়ে আসতেন, সেখানেই রীতিমতো গব্য আয়োজন ঘটত, গোপালের মাও বালকদের অতি প্রীতির চক্ষে দেখতেন।
তখন খাওয়া ছাড়া কিছু বুঝিনি, কিন্তু একটু বয়স হতে দেখেছি এবং বুঝেছি যে চৈতন্য-প্রবর্তিত বৈষ্ণব-ধর্মের বহিরঙ্গে আছে সর্বাশ্লেষী নামসংকীর্তন আর অন্তরঙ্গে আছে এই সেবাবৃত্তির আবেশ, যা এক-একটি মানুষকে মধুর-মধুরতর করে তুলেছে। নবদ্বীপে আমার সখা বুলবুল গোস্বামীর বাড়িতে তাঁর একান্ত সেবা ছিল। ঝুলনে, রাসে তাঁর রাধারানী আর অষ্টসখীর সঙ্গে নটরাজ কৃষ্ণের লীলাকীর্তনে রাতের পর রাত অতিবাহিত হয়েছে আমার। তা চৈতন্য প্রবর্তিত রাগানুগ ভক্তির মধুর আস্বাদন জাগাত আমার মনে। পিতাঠাকুরের আর এক আশ্রিত ছিলেন বেলঘরিয়ার যতীন দাস নগর কলোনির চন্দ্রনাথ ঘোষ। জাতিতে গোয়ালা, বাড়িতে উৎসব হলেও সারারাত জেগে দই ভরে নিয়ে আসতেন বাঁকে করে, হেঁটে। এই এক অদ্ভুত মানুষ—এঁর অভ্যাস ছিল ভোর চারটের সময় ঘুম থেকে উঠে তিনি পাড়ায় পাড়ায় কীর্তন করে টহল দিতেন। শীতকালের প্রখর হিমের সময় পিতাঠাকুর যদি প্রশ্রয় নিয়ে বলতেন—এই শীতে আর বাইরে যেও না, চন্দ্রনাথ, তিনি বলতেন—গুরুর আদেশ, সকলে তো সময় পায় না, তাই সকাল সকাল সবাইকে নাম শুনিয়ে আসি। উৎসবের বাজার করা থেকে আরম্ভ করে দু-মনি কড়াই মাজার কাজ, সকলের ভোজনান্তে পাত-কুড়োনোর কাজটি তিনি অন্য কাউকে করতে দিতেন না এবং করলে সেই মানুষটির সঙ্গে হাতাহাতি করতেও তিনি দ্বিধা করতেন না। জিজ্ঞাসা করলে বলতেন— এই আমার ভজন-সাধন। সন্ধ্যাবেলায় ভাগবত পাঠের আসরে সারাদিনের পরিশ্রমের পর তিনি বসে বসেই ঘুমিয়ে নিতেন, কিন্তু তাঁর রাত্রির কাজ শেষ হতে হতে বারোটা-একটা বেজে যেত, কিন্তু তাই বলে ভোর চারটেয় ওঠাটা বন্ধ হত না।
একদিকে এইসব সেবাব্রত আবিষ্ট সাধকদের দেখছি, আর একদিকে আছেন ড. রাধাগোবিন্দ নাথ, মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, বরাহনগরের কেদার পণ্ডিতমশাই। বিভিন্ন স্থানে এঁরা ভাগবত ইত্যাদি বৈষ্ণব-শাস্ত্র পাঠ করতেন। রাধাগোবিন্দ নাথ মশায় প্রধানত চৈতন্যলীলায় আবিষ্ট ছিলেন, কিন্তু ব্রহ্মচারীজি এবং কেদার পণ্ডিমশাই যে সম্মোহনী বাগ্মিতায় ভাগবত লীলা পরিবেশন করতেন, আমি সারা জীবনে তার তুলনা খুঁজে পাইনি। আর তাঁদের শেষ জীবনে দেখেছি দুই নন্দকিশোরকে। এক নন্দকিশোর কীর্তনীয়া। দ্বিতীয় নন্দকিশোর সত্তর বছর বয়সে ন্যায়শাস্ত্র শিখে যুক্তিতর্কে শান দিয়ে মহাপ্রভু চৈতন্যের ভক্তিরস স্থাপন করতেন শ্যামবাজারে।
তিনি কৃষ্ণদাস কবিরাজের গোবিন্দলীলামৃত পাঠ করতে গিয়ে—প্রতিদিন একটি শ্লোকের কলি উচ্চারণ করতেন—কুঞ্জে কুঞ্জে বিহরতি ন কেনাপি সংলক্ষ্যতে’সৌ—সেই একক শ্লোকপংক্তির ব্যাখ্যা চলত মাসের পর মাস—ওদিকে কেদার পণ্ডিতমশাই ভবানীপুরে পূর্ণ থিয়েটারের পিছনের একটি বাড়িতে ভাগবতের অবধূত শিক্ষা পাঠ করতেন বর্ষভোগ্য সরসতায়। আমি বলি—মহাপ্রভুর অন্ত্যলীলার গূঢ় রহস্য যদি বুঝতে হয়, তবে এইসব ভক্তিরসপাত্রের সঙ্গে দেখা হওয়ার প্রয়োজন ছিল। দেখা হয়েওছে কিন্তু
সে-সব সঙ্গীর সঙ্গ যে কৈল বিলাস।
সে-সঙ্গ না পাইয়া কাঁদে নরোত্তম দাস।।
আর সেই সব ‘মুহুরহো’ ভাবুক-রসিকদের সঙ্গহীন আমাকেও যদি আজ মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের অন্তর্গূঢ় অন্ত্যলীলা-রহস্য বোঝাতে হয় তবে আজই গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর চরণ-স্পর্শ করে বসতে হবে ভাগবত-পাঠের ব্যাসাসনে—যদি তাঁর কৃপায় তিনি স্ফূর্ত হন আমার মুখে। নইলে এমন ঢঙের প্রবন্ধ লিখে তাঁকে কিছুই প্রকাশ করা যায় না, যাবেও না।