২
গবেষকেরা অনুমানে বলেন—মাধবেন্দ্র পুরী যখন গৌড়বঙ্গে এসেছিলেন, তখন নেহাতই শিশু ছিলেন চৈতন্যদেব। চরিতামৃতের কবি চৈতন্যদেবের অবতার-স্বরূপ বর্ণনায় চৈতন্যের পিতা-মাতা এবং পিতৃস্থানীয়দের জন্মসূত্র রচনা করবার কালে চৈতন্যের পিতা জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতা শচীদেবীর সঙ্গে মাধবেন্দ্র পুরী, ঈশ্বরপুরী এবং অদ্বৈত আচার্যকে একত্র স্থান দিয়েছেন। বলেছেন—এঁরা সব একসঙ্গে এই ধরাধামে এসেছিলেন— মাধব-ঈশ্বরপুরী শচী-জগন্নাথ। অদ্বৈত আচার্য প্রকট হইলা সেই সাথ। বস্তুত মাধবেন্দ্র পুরী চৈতন্যের প্রপিতামহের বয়সি, ঈশ্বরপুরী এবং অদ্বৈত আচার্যের চেয়েও তিনি বয়সে অনেক বড়ো। মাধবেন্দ্র পুরী সন্ন্যাসী হয়েছিলেন অনেক বুড়ো বয়সে এবং অদ্বৈত আচার্যও তাঁর কাছে যখন দীক্ষিত হয়েছিলেন, তখন তিনি নিজেই বয়সে প্রবীণ। ফলে চৈতন্য মাধবেন্দ্র পুরীকে দেখেছিলেন একেবারেই শিশুকালে, অথবা দেখেনইনি।
চৈতন্যদেবের শৈশব এবং বালক-বয়সের ক্রিয়াকর্মগুলি চরিতকারেরা যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তার মধ্যে ভবিষ্যতের চৈতন্যপ্রভুর কোনো আভাস ছিল না। অধিকাংশ দুষ্ট প্রকৃতির বালক যেভাবে উচ্ছন্নে যাবার সম্ভাবনা নিয়ে দিন কাটায়, বালক বয়সে চৈতন্যেরও দিন কেটেছে সেইভাবে। অবশ্য তখন তাঁর নাম চৈতন্য ছিল না। পিতা-মাতা তাঁর নাম রেখেছিলেন বিশ্বম্ভর, ডাক নাম নিমাই। বালক-বয়সের যত দুষ্টুমি এবং অসভ্যতা হতে পারে, তা সবই চরিতকারেরা বিশেষত ‘চৈতন্যলীলার ব্যাস’ বৃন্দাবন দাস বর্ণনা করেছেন দ্বিধাহীন ভাবে। এই বর্ণনার সত্যাসত্য বিচার করার দায় আমার নেই, কিন্তু গবেষক-জনের ভাবনা থেকে বলা যায় যে, এই বর্ণনার মধ্যে চরিতকারের কতগুলি অভিপ্রায় কাজ করে। অবশ্য চৈতন্যপ্রভুর বাল্যলীলা-সূত্রগুলি একটুও উচ্চারণ না করে সেই অভিপ্রায় বোঝানো খুব মুশকিল।
চৈতন্যের শৈশব-ক্রীড়ার বর্ণনা যেমনটি চৈতন্য-ভাগবত-এ আছে, তাতে চরিতকারের কতকগুলি অভিপ্রায় প্রকট হয়। প্রথমত জানিয়ে রাখা ভালো যে, চৈতন্য-ভাগবত-এর স্রষ্টা বৃন্দাবন দাস স্বচক্ষে চৈতন্যমহাপ্রভুকে দেখেননি। তাঁর মা নারায়ণী দেবী চৈতন্যের অতি প্রিয় পার্ষদ শ্রীবাস পণ্ডিতের ভাই কিংবা দাদা নলিন পণ্ডিতের মেয়ে। নারায়ণীর গর্ভাবস্থাতেই তাঁর স্বামী মারা যান, কিন্তু নারায়ণী স্বচক্ষে চৈতন্য মহাপ্রভুর দেখা পেয়েছিলেন এবং সেটা চরিতকার বৃন্দাবন দাসের কাছে গর্বের বস্তু ছিল। বৃন্দাবন দাস অবশ্য চৈতন্যের নবদ্বীপ-লীলার সহচর নিত্যানন্দপ্রভুর সাক্ষাৎ-কৃপা পেয়েছিলেন। সেই পরম্পরা তথা শ্রীবাস পণ্ডিতের কুলপরম্পরার কারণে তিনি অনেকটাই শুনে এবং অনেকটাই দেখে চৈতন্যের বাল্যলীলার গান করেছেন। এটা অবশ্যই মানতে হবে যে, চৈতন্যের মতো অবতার-প্রমাণ পুরুষের পরম অভ্যুদয় যখন ঘটে, তখন তাঁর জীবন-বর্ণনার মধ্যে অলৌকিক বিভূতির কথা কিছু থাকবেই। সেগুলি বিশ্বাস করলে চৈতন্যের অভ্যুদয় কোনো বাড়তি গৌরব লাভ করে না, আবার অবিশ্বাস করলেও সে অভ্যুদয় কিছুমাত্র খণ্ডিত হয় না।
চৈতন্যের শৈশব এবং বাল্য জীবন বর্ণনায় বৃন্দাবন দাস দুটি অভিপ্রায় সফল করেছেন। প্রথম কাহিনিতে এক পরিব্রাজক ব্রাহ্মণ চৈতন্যের পিতা জগন্নাথ মিশ্রের বাড়িতে এসেছিলেন। তিনি বালগোপাল সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন, গোপালের সেবা করেন। তখন এরকমই ছিল, পরিব্রাজক সন্ন্যাসী বাড়িতে এলে গৃহস্থ তাঁকে রান্নার সজ্জা করে দিতেন। রান্না করতেন সন্ন্যাসী নিজেই। মিশ্র জগন্নাথ চাল-ডাল, কাঁচা তরকারি সজ্জা করে দিয়েছেন। ব্রাহ্মণ রান্না করে ভোগ লাগিয়েছেন গোপালের, শিশু নিমাই সেই ভোগনিবেদন শেষ হতে দেননি, তিনি নিজে খেয়ে উচ্ছিষ্ট করে দিয়েছেন অন্নব্যঞ্জন। পরিব্রাজক হায়-হায় করে উঠেছেন। মিশ্র জগন্নাথ আবারও রান্নার ব্যবস্থা করেছেন। কড়া পাহারা সত্ত্বেও আবারও একই ঘটনা ঘটল এবং শিশু নিমাইকে জিজ্ঞাসা করলে, সে উত্তর দিচ্ছিল—আমার কি দোষ বিপ্র ডাকিলা আপনে। ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসী তিন-তিন বার রান্না করেছিলেন এবং প্রত্যেকবারই বালগোপালের ভোগমন্ত্র স্মরণের সঙ্গে সঙ্গে নিমাইয়ের দিগম্বর শিশু-মূর্তির আবির্ভাব ঘটেছে ব্রাহ্মণের সামনে। অবশেষে রাত্রি দ্বিপ্রহরে আবারও যখন ভোগ লাগল, তখন তাঁর করুণাঘন বক্তব্য উচ্চারিত হয়েছে একান্তে—মোর মন্ত্র জপ মোরে করহ আহ্বান। রহিতে না পারি আমি আসি তোমা স্থান।।
অবতার-স্বরূপের এই যে বিপরিবর্তন, বালগোপাল-মূর্তির সঙ্গে গৌরগোপাল মূর্তির বিপরিবর্তন—ধুলাময় সর্ব অঙ্গ মূর্তি দিগম্বর। অরুণ-নয়ন কর-চরণ সুন্দর।।— এইখানেই চৈতন্যচরিতকার তাঁর প্রথম অভিপ্রায় সিদ্ধ করে নিয়েছেন। অর্থাৎ এর পরে যতই ঘটনা ঘটুক, চৈতন্যের জীবনে যতই মনুষ্যত্বের অভিসন্ধি রচিত হোক, বৃন্দাবন দাস চৈতন্য-স্বরূপ বর্ণনা করেছেন কৃষ্ণের বাল্যলীলার স্বরূপে। সেখানে তাঁর বাল্য-জীবনের কাহিনিগুলি এমনই, যা এই বঙ্গদেশের সামাজিক অবস্থানে ঘটতেই পারে। এখানে মহাকাব্যিক কাল কোনো দূরত্ব তৈরি করে না, মহাভারতের মতো বিরাট গম্ভীর কোনো পরিবেশও এখানে বাল্যলীলার রসহানি ঘটায় না। নবদ্বীপের সমাজ এবং নিতান্ত লোকস্তরে যা ঘটতে পারে চৈতন্যের বাল্যজীবনে সেগুলির মধ্যেই মিশে গেছে কৃষ্ণের বাল্যলীলার সূত্রগুলি। বৃন্দাবন দাস সংস্কৃতে ভাগবত পুরাণ লিখছেন না, তিনি ‘অ্যাড্রেস’ করছেন পঞ্চদশ/ষোড়শ খ্রিস্টাব্দের আপামর সাধারণ মানুষকে। ফলত ভাগবত পুরাণ-এ বর্ণিত কৃষ্ণের বাল্যলীলা গৌড়বঙ্গের সমাজ এবং সংস্কারের মধ্যে বিপরিবর্তিত হয়েছে। নবদ্বীপে সাপের ভয় ছিল প্রচুর এবং সেই সাপের কামড়ে এক সময়ে বিশ্বম্ভর-নিমাইয়ের প্রথমা পত্নী লক্ষ্মীপ্রিয়া মৃত্যু বরণ করবেন, কিন্তু চৈতন্যের বাল্যলীলায় তিনি কুণ্ডলীকৃত ফণীন্দ্রের ওপর বসে থাকেন নির্ভয়ে। চরিতকার পরিষ্কার করে বলেন না, কিন্তু এই মুহূর্তে অনন্তশায়ী বিষ্ণুর কথা আমাদের মনে আসে। মনে আসে কালীয়-দমন লীলাও। বুঝতে পারি—চৈতন্যচরিতকার চৈতন্যকে কৃষ্ণের আদলে গড়তে চাইছেন।
এই গড়ে তোলার মধ্যে চরিতকারের অভিনবত্বও আছে। শিশু নিমাই কেঁদে সারা হলে সমবেত রমণীকুলের মুখে হরিধ্বনি শুনলে কাঁদা বন্ধ করেন অথবা তাঁর চূড়াকরণ-হাতেখড়ি হতেই দুই-তিন দিনের মধ্যে তিনি সমস্ত বর্ণমালা, যুক্তাক্ষর সহ লিখে ফেলছেন—এইসব সংবাদের মধ্যে আমি তাঁর মহামহিম ক্ষমতা কিছু দেখতে পাই না। কেন না ঈশ্বরপ্রকৃতির অভ্যুদয় প্রমাণের জন্য এগুলি কোনো নতুন সংবাদ নয়। এমনকী দুই চোর স্বর্ণালংকারের লোভে শিশু নিমাইকে হরণ করে নিয়ে গিয়ে নিজেদের পথ ভুলে গেল এবং দিশা হারিয়ে আবারও ফিরে এল মিশ্র জগন্নাথের ঠিকানায়—এই সংবাদের মধ্যে মহাপ্রভুর অলৌকিকতার চেয়েও আমাদের কাছে যেটা আরও বেশি কৌতুকপ্রদ লাগে, সেটা হল—সেই সময়ের নবদ্বীপেও ছেলেধরা ছিল এবং সম্পন্ন ঘর থেকে শিশু-অপহরণের ঘটনাও ঘটত। চৈতন্যের বাল্যজীবনের মধ্যে চরম দুষ্টুমির ঘটনাগুলি বৃন্দাবন দাস লিপিবদ্ধ করেছেন এবং সেখানেও হয়তো নবনীত-চৌর কৃষ্ণের বাল্যলীলা চাপল্যের সমস্ত সূত্রগুলি খেটে যাবে, কিন্তু তবু এখানে চরিতকারের মুনশিয়ানা আছে। পঞ্চদশ/ষোড়শ শতকে নবদ্বীপের মতো বর্ধিষ্ণু গ্রাম-শহরে অনেকগুলি গঙ্গার ঘাট ছিল। সেই ঘাটগুলিতে অল্পবয়সি দামাল ছেলেরা যে অসীম দুষ্টুমি করে বেড়াত, বৃন্দাবন দাস সেই দুষ্টুমির চেহারা দেখেছেন বালক বিশ্বম্ভরের মধ্যে।
কিছু দৃশ্যের বাস্তব পট-পরিবর্তন ঘটেছে। যমুনা-পুলিন নেই, স্থান নিয়েছে সুরধনী গঙ্গা। এখানে শ্রীদাম-সুদামের মতো সখারাও নেই, বিশ্বম্ভর নিমাইয়ের সখারা তেমন নির্দিষ্ট কেউ নন, গঙ্গার ঘাটে বাচ্চা ছেলেরা এক জায়গায় হলে যে দুষ্টুমি শুরু হয়, তার সূচনা করার জন্য বৃন্দাবন দাসকে লিখতে হয়েছে— সংহতি-চপল যত দ্বিজের কোঙর—অর্থাৎ এক জায়গায় মিললেই তারা অন্যের যন্ত্রণা তৈরি করে। বৃন্দাবন দাস চৈতন্যের বালচাপল্যের যে নমুনা দিয়েছেন, সে চপলতা বড়োই ভূমিজ অর্থাৎ চরিতকার নিজে যেমনটি স্বচক্ষে দেখেছেন, তার সঙ্গে নিমাইয়ের নাম যুক্ত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা—এই চপলতার আড়াল থেকেই নবদ্বীপের তৎকালীন সমাজের ছোট্ট ছোট্ট অভ্যাস, ছোট্ট ছোট্ট সংস্কারগুলি এমন বাস্তবভাবে প্রকট হয়ে ওঠে, যাতে পরবর্তীকালে চৈতন্যদেবের উদার আন্দোলন অনেক সপ্রমাণ হয়ে উঠবে।
বৃন্দাবন দাসের বয়ান থেকে বোঝা যায় যে, সেকালের দিনের মানুষের মধ্যে খুব বেশি না হলেও ছোঁয়াছুঁয়ির বাতিক ছিল কিছু। কারণ বিশ্বম্ভর তাঁর স্নানের চাপল্যে মাঝে-মাঝেই স্নান করে ওঠা মানুষকে ছুঁয়ে দিয়ে তাঁদের বারবার স্নান করাতেন, অথবা স্নানরত মানুষের গায়ে কুলকুচি করে জল ফেলতেন—
পুনঃ পুনঃ সবারে করায় প্রভু স্নান।
কারে ছোঁয় কারো অঙ্গে কুল্লোল প্রদান।।
গঙ্গার তীরে কেউ নিবিষ্ট মনে ধ্যান করতে বসলেও নিমাইয়ের হাত থেকে তাঁর রক্ষা নেই। তিনি তাঁর গায়ে জল দিয়ে ধ্যান ভাঙাবেন। যাঁরা মৃন্ময় শিবলিঙ্গ তৈরি করে শিবনেত্রে শিবের কথা চিন্তা করছেন, তাঁদের শিবলিঙ্গ চুরি যেত। চুরি যেত বিষ্ণুপূজার সজ্জা—পুষ্প, দূর্বা, নৈবেদ্য, চন্দন অথবা পাঠ করবার গীতা, পূজার নৈবেদ্য খেয়ে ফেলা, ব্রাহ্মণের উত্তরীয় বসনখানি ঘাড়ের ওপর থেকে নিয়ে যাওয়া, ডুব সাঁতার কেটে অলক্ষ্যে জলের নীচে পা ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া, তীরে রাখা পূজার ডালি, ধুতি অন্যত্র রেখে দেওয়া, মেয়েদের চুলের মধ্যে ওকড়ার বিচি দিয়ে চুল জড়িয়ে দেওয়া—এসব নিমাইয়ের নিত্যকর্মের মধ্যে পড়ত। বেলা দুই প্রহরের আগে তিনি জল থেকে উঠতেন না।
এই অনন্ত দুষ্টুমির তালিকা আমাদের কাছে খুব বড় কথা নয়, বড় নয় এই সংবাদও যে সেইসব দুষ্টুমির জন্য সামাজিক ব্রাহ্মণেরা এবং নবদ্বীপের মেয়েরা পৃথকভাবে মিশ্র জগন্নাথ এবং শচীদেবীর কাছে নালিশ করেছেন। কারণ এই ধরনের নালিশ বৃন্দাবনের নন্দরাজ এবং মাতা যশোমতীও শুনেছেন। যেটা বড় কথা, সেটা হল—তখনকার সাধারণ ব্রাহ্মণ সমাজের মধ্যে—অবশ্যই প্রগাঢ় পণ্ডিত এবং তত্ত্বজ্ঞানীদের বাদ দিয়ে কথাটা বলছি—একেবারে সাধারণ ব্রাহ্মণদের মধ্যে স্মৃতিশাস্ত্রের সাধারণ আচারগুলি দৃঢ় প্রোথিত ছিল। বহুবার যে নিজেই স্নান করছে সেই বালক এক স্নাত ব্রাহ্মণকে ছুঁয়ে দিলে আবারও তাকে স্নান করতে হচ্ছে—এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, কোনো তত্ত্ব নয়, কোনো দর্শন নয়, শুধু স্নানের মহিমায় নিজেকে পৃথক এক শুদ্ধসত্ত্ব বলে প্রমাণ করার একটা স্মার্ত তাড়না তখনও লোকসমাজে কাজ করছে। গঙ্গাস্নানের পুণ্য ছাড়াও শিবপূজা, বিষ্ণুপূজাটা গঙ্গার তীরেই সমাধা হয়ে যাচ্ছে, তাও দেখতে পাচ্ছি। এতে পুজোর ঝামেলাটা বাড়িতে এড়িয়ে যাওয়াই মুখ্য উদ্দেশ্য, নাকি গঙ্গাতীরে শিবপূজা, বিষ্ণুপূজার ফল বেশি, সেটা বোঝাও কঠিন হয়ে পড়ে। তবে গবেষণার অন্যান্য সূত্র থেকে এটাও প্রমাণ করা যাবে যে, তৎকালীন বামুন বাড়িতে বিষ্ণু-নারায়ণের নিত্যপূজা হত না—এটা প্রায় আমার কথা—কারণ স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতেই বিষ্ণুপূজার মাহাত্ম্য খুব বেশি মাত্রায় প্রচারিত, কিন্তু এই বিষ্ণুপূজার মধ্যে যে একটা যান্ত্রিকতা কাজ করত, তা এখনও পর্যন্ত জ্ঞাতি-শরিকদের মধ্যে পূজা ভাগ করে নেওয়া বা পূজার পালা সমাধা করার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখানে অবশ্য জমিজিরেত এবং দেবত্র সম্পত্তির ফলভোগের বিষয়টাও পূজার শর্তের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং তাতে যান্ত্রিকতার তত্ত্ব আরও বেশি সপ্রমাণ হয়ে ওঠে।
গবেষকেরা যদিও অনেক সময়েই অতিবৃহৎ এবং লোকোত্তর চরিত্রের মনের মর্ম বোঝেন না, তবুও তাঁদের নৈর্ব্যক্তিক এবং নিরপেক্ষ গবেষণার ভাবনাটুকু যেহেতু অসার নয়, তাই চৈতন্যের বাল্যলীলা সূত্রের মধ্যে তাঁদের হস্তাবলেপটুকু মেনে নিতেই হবে। গবেষকের ভাবনা থেকে একথা বলাই যেতে পারে যে, চৈতন্যচরিতকারেরা প্রধানত যেহেতু কবি, অতএব তাঁর এই বাল্যচাপল্যের ব্যাখ্যাও অন্যরকম হতে পারে। বারবার এটা দেখা গেছে যে, বিরাট এবং লোকোত্তর জীবনের বর্ণনায় একটা ‘ট্রান্সফর্মেশন’-এর ঘটনা কাজ করে এবং সেখানে ভবিষ্যতের মহত্তম ভাবের প্রতি তুলনায় তাঁর বাল্যজীবনটুকু এমন ভয়ংকর ছন্নছাড়া তথা বিপরীত তুচ্ছতায় তৈরি হয়। গঙ্গার ঘাটে বয়োঃজ্যেষ্ঠ মানুষের গায়ে জল ছেটানো, ঠাকুরের নৈবেদ্য খেয়ে নেওয়া বা শিবলিঙ্গ উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা-পরম্পরাকে আমরা কেউ অসভ্যতাও বলতে পারব না, বড়জোর গ্রাম্য দুষ্টুমি বলতে পারি, কারণ চৈতন্য তখন নিছকই বালক। এমনকী এইসব ঘটনা খানিকটা মনুষ্যোচিতভাবেই বাস্তব হতে পারে, কেননা এই সেদিন স্বামী বিবেকানন্দের পূর্বজীবনে আমরা অনুরূপ চাপল্য দেখেছি। অতএব চৈতন্যচরিতকারের সমস্ত বর্ণনাটাই অতিরঞ্জন বলব না। বরঞ্চ বলব—ভবিষ্যতের ভাবগম্ভীর জীবনের ছায়ামাত্র চৈতন্যের পূর্বজীবনে ছিল না এবং ‘ট্রান্সফর্মেশন’-এর তত্ত্বটা সেইখানে বেশ ভালোই খেটে যায়।
বাল্য বয়সে চৈতন্যের মধ্যে যে চপলতা এবং দুষ্ট স্বভাব দেখা গেছে, চরিত-গ্রন্থগুলিতে তারই সচেতন বিস্তার ঘটেছে চৈতন্যের যৌবনসন্ধি পর্যন্ত, তাঁর ছাত্র এবং অধ্যাপনার কাল পর্যন্ত। পরবর্তী জীবনে যিনি তৃণাদপি সুনীচ এবং তরুর মতো সহিষ্ণুতার চরম উপদেশ দেবেন, তিনিই কৈশোর-যৌবন অবধি যে অসহিষ্ণুতা এবং অহংকারের পরিচয় দিয়েছেন, সেটাকেও কিন্তু তাঁর ভাবী মহত্তমতার বিপরীত কোটিতে স্থাপন করা যায় এবং হয়তো সেটার মধ্যেও খানিকটা বাস্তবতা আছে। এই জীবনের বৃহদংশ অথবা কিয়দংশ নিশ্চয়ই চরিতকারদের অনুভববেদ্য প্রমাণ, কেননা পূর্ব যৌবনের অহংকার এবং আত্মস্ফীতির বিপরীতে তাঁর উত্তর-যৌবনের দৈন্যবোধ, নম্রতা এবং প্রেমভক্তির ভাবোল্লাস আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বলেই হয়তো চরিত-গ্রন্থগুলিতে এমন বিপ্রতীপ ঘোষণা। চৈতন্য-চরিতামৃত-এর কবির কথামতো যদি একটু ‘তটস্থ’ হয়ে বিচার করি, তবে এটা বলতেই হবে যে, সন্ন্যাস-পূর্ব জীবনে বিশ্বম্ভর-নিমাইয়ের অধ্যয়ন-অধ্যাপনার প্রকৃত অবস্থা বুঝতে গেলে তৎকালীন নবদ্বীপের সামগ্রিক বিদ্যাচর্চার বাস্তব প্রবণতাগুলি আগে বুঝতে হবে এবং সেই আলোকে বিশ্বম্ভরের অধ্যয়ন-অধ্যাপনার বিদ্যা-বিলাসটুকুও বুঝে নিতে হবে।
বৃন্দাবন দাসের ভণিতা মান্য করে এটা আমরা মেনেই নিয়েছি যে, বিশ্বম্ভর বাল্যকালে অত্যন্ত দুষ্টু ছিলেন এবং সে দুষ্টুমি অনেকটাই সভ্যতাবিগর্হিত। একইরকমভাবে তাঁর অধ্যয়ন-কালটাও যদি বিচার করে দেখি, তবে সেটাও তাঁর দুষ্টুমির মতোই উপভোগ্য বস্তু। আজকেও যে ছেলে স্কুল পালিয়ে ক্রিকেট খেলতে যায়, তার সঙ্গে বালক বিশ্বম্ভরের কোনো পার্থক্য ছিল না। পড়াশোনার সঙ্গে গঙ্গার ঘাটে দুষ্টুমি যুগপৎ চলছিল। বাবা-মাকে তেমন কিছু ভয় পান না তিনি, শুধু অগ্রজ বিশ্বরূপকে দেখলে তিনি একটু নিয়ন্ত্রিত থাকেন। দাদা বিশ্বরূপের প্রকৃতি কিছু গম্ভীর ছিল। তিনি শাস্ত্রচর্চা নিয়ে থাকতেন এবং সংসারে খানিকটা নির্বিণ্ণ। বিশ্বরূপ অদ্বৈত আচার্যের গৃহে যেতেন এবং গীতা-ভাগবতাদি শাস্ত্রের ভক্তিপর ব্যাখ্যা শোনাতেন অদ্বৈত-গৃহে সমবেত মানুষজনকে। চৈতন্য সেখানে মাঝে-মাঝে যেতেন দাদাকে ডেকে আনার জন্য। তখন তাঁকে একটু নম্র দেখায়। আচার্য অদ্বৈত বিশ্বম্ভরের অতুলনীয় চেহারা দেখে মোহিত হতেন, যদিও তখনও তিনি নিতান্তই বালক। অগ্রজ বিশ্বরূপ সন্ন্যাস গ্রহণ করে ‘শঙ্করারণ্য’ নামে পরিচিত হলেন, কিন্তু এই সন্ন্যাসের ফলে জগন্নাথ মিশ্রের বাড়িতে যে প্রতিক্রিয়া হল, সেটা একদিকে যেমন কুমার বিশ্বম্ভর-নিমাইকেও প্রভাবিত করল, তেমনই তা পিতা জগন্নাথ মিশ্রকেও একইভাবে আকুল করে তুলল।
ঘরের মধ্যে যে ছেলে নিত্য বিচরণ করত, সে সংসার ত্যাগ করে বৈরাগী হয়ে গেছে—এই দুঃখ স্নেহময় পিতা-মাতাকে এতটাই বিমর্ষ করে তুলেছিল যে, অতিচপল অনুজ বিশ্বম্ভর পর্যন্ত সাময়িকভাবে স্তব্ধ হয়ে ঘরে থাকতে আরম্ভ করলেন। লেখাপড়াতেও যেন তাঁর অধিক মন বসল এবং যতটা পারেন, তিনি তখন জনক-জননীর কাছে থেকে তাঁদের স্নেহপোষণ করেন। দুষ্টতা এবং চাপল্যের পরিবর্ত হিসেবেই লেখাপড়ায় যতটুকু মনোযোগ দিলেন তিনি, তাতেই একদিন মিশ্র জগন্নাথ ভয় পেলেন এবং স্ত্রী শচীদেবীর সামনে স্বামী জনোচিতভাবে আদেশ জারি করে বললেন—আমি আমার বড় ছেলেকেও পড়াশোনা করতে দেখেছি। শাস্ত্রচর্চা তাকে সংসারবিরাগী সন্ন্যাসীতে পরিণত করেছে। শেষে শাস্ত্রচর্চা করে আমার এই ছোট ছেলেটিও যদি বিবাগি হয়ে যায়, তার চেয়ে এই ভালো—এ ছেলের পড়াশোনা করার কোনো দরকার নেই। মূর্খ হয়ে থাকুক, তবু ঘরে থাকুক এই ছেলে—মূর্খ হই পুত্র মোর রহুমাত্র ঘরে। স্নেহবিদ্ধ পিতা সমাজ, সংস্কার এবং পরম্পরা—কিছুই চিন্তা করলেন না। পুত্র বিশ্বম্ভরকে ডেকে তিনি মানা করে দিলেন—আজ থেকে তোমার পড়াশোনা বন্ধ। ঠিক এইরকম একটা জায়গায় তৎকালীন নবদ্বীপে বিদ্যাচর্চা তথা সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং সেখানে একটি গৃহবধূ পর্যন্ত কতটা সচেতন ছিলেন, সেকথাটা বলে নিতেই হবে।
একথা তো ছোটবেলা থেকেই সকলে পড়েছে এবং আমিও পড়েছি। চৈতন্যদেবের কথা, কী মধ্যযুগীয় গৌড়বঙ্গের ইতিহাস উচ্চারিত হলেই সেই এক কথা—সেকালের নবদ্বীপ বিদ্যাশিক্ষার একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। ছাত্র এবং শিক্ষক শুধু এইটুকু মাত্র জানে, কিন্তু এই বিদ্যাচর্চার বহর যে কতটা ছিল, সেটা অনেকের ধারণার বাইরে। আমার দুঃখ হয়—বঙ্গদেশের বিদ্যাচর্চার ধারা নিয়ে এখনও পর্যন্ত তেমন গ্রন্থ লেখা হয়নি। বঙ্গদেশের যত প্রাচীন পুঁথি ছিল, সংরক্ষণের অভাবে এবং পণ্ডিত ঘরের মূর্খ ছেলের কল্যাণে সেসব পুঁথির অন্তর্জলি যাত্রাও সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। এরই মধ্যে পণ্ডিত-গবেষকেরা—যেমন দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, সুরেশচন্দ্র ব্যানার্জি, রাধাকুমুদ মুখার্জিরা—এঁরা যথোচিত চেষ্টা করে গেছেন, তাই দুটো কথা এখনও বলতে পারছি।
বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গৌরাঙ্গের জন্মভূমি নবদ্বীপ চরম জায়গায় ওঠে রঘুনাথ শিরোমণির সময়ে। নব্যনারায়ণচর্চার ক্ষেত্রে এমন ধুরন্ধর পণ্ডিত তখন দ্বিতীয় ছিলেন না। কিন্তু ঘটনা হল—রঘুনাথ শিরোমণি চৈতন্যদেবের বেশ কিছু আগে জন্মেছেন; বরঞ্চ বলা যায়—রঘুনাথ শিরোমণি যখন মৈথিল পক্ষধরের পক্ষশাতন করে নদিয়ার গুরু-গৌরবে প্রতিষ্ঠিত, তখনও পর্যন্ত চৈতন্যের শৈশবকাল অতিক্রান্ত হয়নি। অনেক মহলে এমন প্রবাদ চালু আছে যে, চৈতন্যদেব, নৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি এবং স্মার্ত রঘুনন্দন তিনজনেই নবদ্বীপের বিখ্যাত অধ্যাপক বাসুদেব সার্বভৌমের শিষ্য ছিলেন। এই প্রবাদের প্রধান জনক ছিলেন বিখ্যাত নুলো পঞ্চানন, যিনি অবশ্য ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের পূর্ববর্তী মানুষ নন কোনো ভাবেই। নুলো পঞ্চানন তাঁর বিখ্যাত বাংলা পদ্যে লিখেছেন—’বাসুদেবের তিন শিষ্য চৈয়ে রঘোদ্বয়’। ‘চৈয়ে’ মানে চৈতন্যদেব, তৎকালীন শতাব্দীর মৌখিকতায় তিনি ‘চৈয়ে’, আর ‘রঘোদ্বয়’ হলেন রঘুনাথ শিরোমণি এবং স্মার্ত রঘুনন্দন। সংস্কৃতজ্ঞ কোলব্রুক সাহেব আবার এই তিনজনের সঙ্গে তান্ত্রিক-শিরোমণি কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকেও বাসুদেব সার্বভৌমের ছাত্র হিসেবে কল্পনা করেছেন। বস্তুত এই চারজনের মধ্যে একমাত্র রঘুনাথ শিরোমণি ছাড়া আর কেউই যে বাসুদেব সার্বভৌমের ছাত্র ছিলেন না, এ কথা দীনেশ ভট্টাচার্যের গবেষণায় সম্পূর্ণ প্রমাণ হয়ে গেছে।
চৈতন্য যখন নিতান্ত শিশু, তখন রঘুনাথ শিরোমণি নবদ্বীপের সারস্বত সমাজে সূর্যের মতো কিরণ বিকিরণ করছেন। চৈতন্যের চরিতগ্রন্থকারেরা কেমন করে এই সারস্বত-সাধনার ধারা উপেক্ষা করেই গ্রন্থ শেষ করেছেন—এই তর্ক উঠলে আমার মতো অধমের বারবার একথা মনে হয়—এই অদ্ভুত ক্ষমতা চৈতন্যপন্থীদের আছে—তাঁরা চৈতন্য-কথাতেই এতটা আকুল ছিলেন, যাতে নব্যন্যায়ের কূট তর্কধারার গৌরব উপেক্ষা করাটা তাঁদের পক্ষে আশ্চর্য নয়। চরিতকারেরা চৈতন্যের ছাত্রভাব বর্ণনা করবার সময় তাঁর বিদ্যাকুশলতার যতই গৌরব করে থাকুন, বালক বিশ্বম্ভরও এই কঠিন কূট বিদ্যাচর্চার মধ্যে প্রবেশ করেননি। তার কারণ নিশ্চয়ই এই নয় যে, এই বিশেষ বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে তাঁর অক্ষমতা ছিল, বরঞ্চ কারণ হয়তো এই যে, অত পড়াশোনা করতে তাঁর ভালো লাগত না। চরিতকারদের বয়ানেও যেমনটি আছে, তাতে ছাত্রাবস্থায় চৈতন্যের বিদ্যাচর্চার যত অভিনিবেশ দেখা যাচ্ছে, তার চেয়ে কোনো মতে পড়াশোনা শেষ করে গঙ্গার ঘাটে এসে সমবয়সিদের সঙ্গে কোন্দল করাটা অনেক বেশি প্রিয় মনে হচ্ছে—এবং সেটা কার ‘মাস্টার’ কত ভালো এই বিষয়ের বিবাদ।
প্রথম বয়সে প্রভু স্বভাব চপল।
পড়ুয়াগণের সহ করেন কোন্দল।।
কেহ বোলে তোর গুরু কোন বুদ্ধি তার।
কেহ বোলে এই দেখ আমি শিষ্য যার।।
এইমত অল্পে অল্পে হয় গালাগালি।
তবে জল ফেলাফেলি তবে দেয় বালি।।
তবে হয় মারামারি যে যাহারে পারে।
কর্দম ফেলিয়া কারো গায়ে কেহ মারে।।
অথচ নবদ্বীপে পড়াশোনার অবস্থাটা তখন এমন ছিল না মোটেই। একথা সঠিক প্রমাণ দিয়েই বলা যাবে যে, চৈতন্যের আবির্ভাবের একশো বছর আগে থেকে নবদ্বীপে ভীষণ রকমের বিদ্যাচর্চা আরম্ভ হয়েছিল। চৈতন্যের জন্মস্থান থেকে খুব দূরে নয় সেই নবদ্বীপে বিদ্যানগর জায়গাটা এখনও আছে। পোড়ামা-তলা পিছনে রেখে বুড়ো শিবতলা ছাড়িয়ে আরও খানিকটা গেলেই বিদ্যানগর গ্রাম এবং সেটা নবদ্বীপের মধ্যেই। এই গ্রামে থাকতেন বিষ্ণুদাস বিদ্যাবাচস্পতি—তিনি বাসুদেব সার্বভৌমের ছোট ভাই। দুই ভাই-ই ন্যায়শাস্ত্রের চরম পণ্ডিত। তত্ত্বচিন্তামণি গ্রন্থের ওপর টীকা লিখে দুই ভাই-ই ন্যায়শাস্ত্রের চরম পণ্ডিত। তত্ত্বচিন্তামণি গ্রন্থের ওপর টীকা লিখে দুই ভাই-ই তখন ভারত বিখ্যাত। এঁদের মধ্যে বাসুদেব সার্বভৌম চৈতন্যজন্মের আগে অথবা তাঁর শিশু অবস্থায় নীলাচল পুরীতে গিয়ে উৎকলাধিপতি প্রতাপরুদ্রের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। কিন্তু বিষ্ণুদাস বিদ্যাবাচস্পতি নবদ্বীপে থেকে যান। পণ্ডিতেরা বলেন—চৈতন্যজন্মের পূর্বে, তখনও যখন হুসেন শাহ বাংলার মসনদে বসেননি, সেই সময়ে হাবশি-অধিকারের ডামাডোল চলছিল। নবদ্বীপে ‘রাজভয়’ উপস্থিত হওয়ায় বাসুদেব সার্বভৌমের সমস্ত বাড়িটাই গোলেমালে পড়ে যায়। সার্বভৌমের পিতা মহাপণ্ডিত নরহরি বিশারদ নবদ্বীপের আবাস ছেড়ে বৃদ্ধ বয়সে কাশী চলে যান এবং বাসুদেব সার্বভৌম পুরীতে। কিন্তু সার্বভৌমের ছোট ভাই গৌড়ে থেকে যান এবং নবদ্বীপেই থেকে যান আরও দুই ভাই কৃষ্ণানন্দ বিদ্যাবিরিঞ্চি এবং চণ্ডীদাস বিদ্যানন্দ। এসব কথার প্রমাণ মিলবে জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল থেকে।
নবদ্বীপে ‘রাজভয়’ কথাটা অতীব সত্য, তার প্রমাণ ইতিহাস থেকেই দেওয়া যাবে, কিন্তু অনেক গবেষকই মনে করেন যে, বাসুদেবের অন্য তিন ভাই ‘রাজভয়’ থাকা সত্ত্বেও নবদ্বীপে থেকে গেলেন, অথচ চার ভাইয়ের মধ্যে বিদ্যাবিত্তম বাসুদেব সার্বভৌম পুরীতে চলে গেলেন কেন? গবেষকদের ধারণা—হুসেন শাহর পূর্বকালে ‘রাজভয়’ কিছু অসম্ভব বস্তু নয়, কিন্তু সার্বভৌমের পুরী গমনের কারণটা হয়তো তাঁর শিষ্য রঘুনাথ শিরোমণির উত্থান। রঘুনাথ তাঁর শিষ্য হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ন্যায়শাস্ত্রের গ্রন্থে বহু জায়গায় গুরু সার্বভৌমের মত খণ্ডন করেছিলেন এবং এসব খণ্ডন-দূষণ হয়তো মৌখিকভাবে বহুত্রই চলছিল নবদ্বীপের বিদ্যাকেন্দ্রগুলিতে। নিজের গৌরবকালেই হঠাৎ নিজের শিষ্যের সারস্বত উত্থান তাঁকে স্বস্তি দিতে পারেনি, ফলে পুরীধামে গজপতি প্রতাপরুদ্রের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে সার্বভৌম নবদ্বীপ ত্যাগ করেন।
আমাদের বক্তব্য—নবদ্বীপে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণির উত্থানে নব্যন্যায়চর্চার ক্ষেত্রে যে জোয়ার এসেছিল, এই জোয়ারও কিন্তু পড়ুয়া চৈতন্যকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। অগ্রজ বিশ্বরূপের সন্ন্যাসগ্রহণের পর গৃহের নির্বিণ্ণ পরিবেশে জগন্নাথ মিশ্র তাঁকে পড়াশোনা করতে দিতে চাননি, এতে অবশ্যই বালক বিশ্বম্ভরের খুব জেদ চেপেছিল—তিনি পড়বেনই এবং নবদ্বীপের বিদ্যাচর্চার পরিবেশে পড়াশোনার এই আগ্রহও খুব স্বাভাবিক ছিল। বৃন্দাবন দাস ন্যায়চর্চা নিয়ে বিশেষ মাথা না ঘামালেও একথা স্পষ্ট লিখেছেন যে, যত বিদ্বানই হোন না কেন, যিনি নবদ্বীপে পড়েননি, তিনি বিদ্যার সরসতাই বোঝেন না—নবদ্বীপে পড়িলে সেই বিদ্যারস পায়। পরিবেশটা এমনই ছিল যে, পুত্র বিশ্বরূপ সন্ন্যাসী হওয়ায় বিষণ্ণ জগন্নাথ মিশ্র যখন বালক বিশ্বম্ভরের লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন, তখন সমান বিধ্বস্তা এক গৃহবধূ হিসেবে জননী শচীমাতা পর্যন্ত প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁর যুক্তিটা ছিল সাংঘাতিক। তিনি বলেছিলেন—ছেলে যদি মূর্খ হয়, তবে তার বিয়ের জন্য নবদ্বীপে কেউ মেয়ে দেবে না এবং পড়াশোনা না করলে মূর্খ পুত্রের জীবন তো বিড়ম্বনা—শচী বোলে মূর্খ হইলে জীবেক কেমনে। মূর্খেরে তো কন্যাও না দিবে কোন জনে।।
বাংলার ইতিহাসের মধ্যযুগে একজন গ্রাম্য কুলবধূর মুখে এই কথাবার্তা বুঝিয়ে দেয় যে, নবদ্বীপে বিদ্যাচর্চার প্রগতি কতদূর পৌঁছেছিল। শচীমাতার এই আর্ত ক্রন্দন অবশ্য সাময়িকভাবে জগন্নাথ মিশ্রের বিষণ্ণতা প্রশমিত করতে পারেনি। জ্যেষ্ঠ পুত্রের সন্ন্যাসে তিনি এতটাই আঘাত পেয়েছিলেন যে, তাঁর বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গিয়েছিল—অতিরিক্ত পড়াশোনা এবং শাস্ত্রচর্চা আরও একটা সন্ন্যাসের ঘটনা ঘটাবে তাঁর ঘরে। কুমার বিশ্বম্ভর পড়াশোনা যা করেছিলেন, তার মধ্যে অতিনিবেশ কতটা ছিল তা তিনিই জানেন, কিন্তু পিতার আদেশে লেখাপড়া বন্ধ হওয়ায় তাঁর জেদ চেপে গেল। তাঁর দুষ্টুমি এবং অভব্যতা চরমে পৌঁছল—অন্তরে দুঃখিত প্রভু বিদ্যারসভঙ্গে। পুনঃ প্রভু উদ্ধত হইলা শিশু সঙ্গে।। নিজের বাড়িতে এবং পরের বাড়িতে নানান অভব্যতা এবং অপচয় ঘটিয়ে তিনি এর প্রতিবাদ করতে লাগলেন। রাত হয়ে গেলেও তিনি বাড়ি ফেরার নাম করেন না। অতিস্নেহে পিতা-মাতাও তাঁর সমস্ত উপদ্রব সহ্য করে যেতে লাগলেন। কিন্তু সমস্ত কথায়, সমস্ত অপকর্মের মধ্যে বালক বিশ্বম্ভর তাঁর অন্তরের এই জেদটুকু প্রকাশ করতে লাগলেন যে, লেখাপড়া করতে না দেওয়ার কারণেই তাঁর মাথাটি দিনে দিনে শয়তানের কারখানা হয়ে উঠেছে।
সেকালের অনেক বামুন-বাড়িতেই নিত্যদিন মাটির হাঁড়িতে ভাত রান্না হত। একদিনের হাঁড়ি অন্যদিন ব্যবহার হত না এবং ব্যবহৃত হাঁড়িটি উচ্ছিষ্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় নিতান্তই বর্জ্য বলে গণ্য হত। স্মার্ত পণ্ডিতদের তাড়নাই হোক অথবা রাঢ় এবং গৌড়বঙ্গের লোকাচারই হোক, পাক করা ভাতের উচ্ছিষ্টমাখা হাঁড়ি চরম বর্জ্য এবং সেই কারণেই নিতান্ত অস্পৃশ্য বলে গণ্য হত। বিশ্বম্ভর-নিমাই একদিন এই বর্জ্য হাঁড়ির স্তূপে গিয়ে জায়গা নিলেন। শচীমাতা তাঁকে বলে কয়ে কিছুই করতে পারলেন না এবং শুদ্ধাশুদ্ধের বিবেকবুদ্ধি জাগানোর চেষ্টা করলে, তাঁর অকাট্য যুক্তি ছিল—তোমরা আমায় পড়াশোনা করতে দিচ্ছ না, আমার এত শুদ্ধাশুদ্ধের জ্ঞান হবে কী করে—প্রভু বোলে তোরা মারে না দিস পড়িতে। ভদ্রাভদ্র মূর্খ-বিপ্রে জানিবে কেমতে।।
পড়াশোনা করার চরম ফল যে এই ছোঁয়াছুঁয়ির জ্ঞান নয় এবং এটা নিতান্তই প্রসঙ্গত উল্লেখমাত্র, সেটা সেই অসামান্য গৃহবধূটিও বুঝেছিলেন, যার ফলে স্বামীর কাছে তিনি পুনরায় অনুযোগ করে বলেছিলেন—পড়িতে না পায় পুত্র মনে ভাবে ব্যথা। পাড়াপড়শিরাও স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে শচীদেবীর পক্ষ নিলেন এবং সর্বকালের চিরন্তন মানসিকতায় বললেন—আমাদের ঘরের ছেলেরা কেউ পড়তেই চায় না, সেখানে ‘ভাগ্যে সে বালক চাহে আপনে পড়িতে।’ জগন্নাথ মিশ্র ঘরে-বাইরে এই চাপ এড়াতে পারলেন না। তিনি ছেলেকে নিয়ে গঙ্গাদাস পণ্ডিতের কাছে গেলেন। এর মধ্যে অবশ্য বিশ্বম্ভর-নিমাইয়ের পইতে হয়ে গেল এবং উপনয়নের পরেই গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে ছাত্র হিসেবে দেখা গেল নিমাইকে।
চৈতন্য-ভাগবত-এ গঙ্গাদাস পণ্ডিতের যতই বহুমানন থাক, নবদ্বীপের বিদ্যাচর্চার ইতিহাস বিচার করলে দেখা যাবে যে, সেখানে একেবারে পড়াশোনার প্রাথমিক পাঠ দেওয়া হত। বৃন্দাবন দাসের বয়ান থেকেই বোঝা যায়—এটা ব্যাকরণ পড়ার জায়গা, আর ব্যাকরণ মানেই প্রথম পাঠ। সেকালের বঙ্গদেশে বিদ্যাচর্চার কী বিচিত্র পরিবেশ দেখুন—উত্তর-মধ্য-দক্ষিণ ভারতের সর্বত্র প্রায় ঐতিহ্যবাহী পাণিনি-ব্যাকরণ পড়ানো হত, কিন্তু সর্ববিষয়েই ব্যতিক্রমী বঙ্গদেশে পাণিনি-পতঞ্জলির তত সমাদর ছিল না, এখানে কলাপ-ব্যাকরণ পড়ানো হত। পাণিনির তুলনায় কলাপ-ব্যাকরণ কিছু অন্য ধরনের এবং পাণিনি-ব্যাকরণের পরিবর্ত হিসেবে সৃষ্ট হয়েছিল বলেই এই ব্যাকরণের কূটকাচালি কিছু কম ছিল না এবং নবদ্বীপে এই ব্যাকরণের ভালোই চর্চা হত। নবদ্বীপের তৎকালীন প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িকেরাও যেমন এই ব্যাকরণের সমাদর করতেন, তেমনই কলাপ-ব্যাকরণের পণ্ডিতেরাও অনেকেই নৈয়ায়িকদের গোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন। ফলে ব্যাকরণের চর্চাটা বেশ ভালোই হত। কিন্তু যত ভালোই হোক— ব্যাকরণ হল সমস্ত শাস্ত্রাগমের প্রথম পাঠ। বিশ্বম্ভর-নিমাইকে আমরা গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে বেশ কিছুদিন ব্যাকরণ পড়তে দেখেছি এবং বৃন্দাবন দাসের বয়ানে তিনি যথেষ্ট মেধাবী ছাত্র ছিলেন। গুরু যা শিক্ষা দিচ্ছেন, বিশ্বম্ভর তা মুহূর্তের মধ্যে বুঝে ফেলছেন—এই আলোকসামান্য মেধাবিত্বে আমাদের বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই, কিন্তু এই মেধাবিত্বও পড়ুয়া বিশ্বম্ভরকে কোনো স্থিরতা দেয়নি, বিদ্যা তাঁকে অনেকটাই অহংকারী করে তুলেছে।
সংস্কৃতের বিভিন্ন শাস্ত্রপাঠে তর্কযুক্তির একটা জায়গা আছে বরাবর। ব্যাকরণ, অলংকারশাস্ত্র এবং সাংখ্য-যোগ-বেদান্ত তথা ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনের সর্বত্রই এক ধরনের বাকবিতণ্ডা চলতে পারে। একজন পণ্ডিত যে ব্যাখ্যা করছেন, তার মধ্যে দোষ বার করে পণ্ডিতকে নিষ্প্রমান করে দিয়ে অন্য যুক্তি দিয়ে নিজের যুক্তি স্থাপন করা অথবা নিজের যুক্তি নিজেই কেটে দিয়ে অন্য যুক্তিতে নিজেকে পুনঃস্থাপন করা—এগুলি শাস্ত্রের বিতণ্ডায় সুবিদিত পন্থা। কিন্তু বিশ্বম্ভর-নিমাইকে দেখছি—তিনি তাঁর গুরু গঙ্গাদাস পণ্ডিতের প্রতিপক্ষতা করে তর্ক-যুক্তির মাধ্যমে তাঁর মত খণ্ডন করছেন এবং আবারও সেটা পুনঃস্থাপন করছেন। বেশ বোঝা যায়—চৈতন্যচরিতকার ছাত্র বিশ্বম্ভরের অসাধারণ মেধা প্রকট করার জন্য গুরু গঙ্গাদাসকে একটু খাটো করে ফেলেছেন—
গুরুর যতেক ব্যাখ্যা করেন খণ্ডন।
পুনর্বার সেই ব্যাখ্যা করেন স্থাপন।।
কিন্তু চরিতকারের এই ভাবনা কিছু আশ্চর্য নয়। আশ্চর্য হল, বিশ্বম্ভরের চরিত্র। তিনি তাঁর ব্যাকরণের তর্ক-যুক্তি দিয়ে তাঁর সমস্ত সতীর্থকে অস্থির করে তুলেছেন। নিজেকে অপ্রতিরোধ্য প্রতিপন্ন করার জন্য তাঁর শেষ আশ্রয় কিন্তু সেই গঙ্গার ঘাট। টোলের পড়া শেষ হলেই তিনি গঙ্গার ঘাটে যাবেন। সমবয়সি অন্য গুরুর ছাত্রদের সঙ্গে তিনি তর্ক জুড়বেন এবং যাচ্ছেতাই ভাবে তাঁদের হেনস্থা করবেন। সেই সঙ্গে গঙ্গাস্নানের অসভ্য ব্যবহারটুকুও কিন্তু বাদ যাচ্ছে না। এত হুলাহুলি করে পড়ুয়া সকল। বালি কাদাময় সব হয় গঙ্গাজল তাঁর পাণ্ডিত্যের দুষ্টুমিও একটি মাত্র গঙ্গার ঘাটে আবদ্ধ থাকত না। তিনি সাঁতার দিয়ে-দিয়ে বিভিন্ন মধ্যাহ্ন-স্নানের ঘাটে গিয়ে উপস্থিত হতেন এবং তটস্থ স্নানার্থী ছাত্রদের বিদ্যা পরীক্ষা করে দেখতেন, জিজ্ঞাসা করতেন বৃত্তি-পঞ্জী-টীকার শুদ্ধি। না পারলে বলতেন—আমাকেই জিজ্ঞাসা কর—জিজ্ঞাসা করহ বুঝি কার কোন বুদ্ধি! বৃত্তি-পঞ্জী-টীকার কে জানি দেখি শুদ্ধি।।
পয়ারের ওই তিনটি শব্দ—বৃত্তি-পঞ্জী-টীকা—এগুলি সাধারণের জানা থাকার কথা নয়। শ্লোক বা কারিকার আকারে শাস্ত্রবিশেষের সংক্ষিপ্ত বিস্তারকে বলে বৃত্তি। কারিকার পদ ভেঙে আলোচনাকে বলে পঞ্জী বা পঞ্জিকা আর টীকা হল বিস্তারিত আলোচনা—টীকা নিরন্তর ব্যাখ্যা পঞ্জিকা পদভঞ্জিকা—বলেছেন হেমচন্দ্র। নবদ্বীপে চৈতন্যের সময়ে যে কলাপ-ব্যাকরণের প্রসার হয়েছিল, তা এই শব্দগুলি থেকে আরও প্রমাণ হয়। চৈতন্য মহাপ্রভুর পূর্বকালেই পুণ্ডরীকাক্ষ বিদ্যাসাগর নামে কলাপ-ব্যাকরণের এক ধুরন্ধর পণ্ডিত নবদ্বীপের বিদ্যাস্থানগুলি উল্লেখ করে দিয়ে গেছেন; এমনকী বিশারদ সার্বভৌম ভট্টাচার্যের মতো নৈয়ায়িকের বাড়িতেও কলাপ-ব্যাকরণের ভালোরকম চর্চা ছিল। এই পরম্পরা চৈতন্য মহাপ্রভুর সময় পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল এবং তিনি কলাপ-ব্যাকরণের বৃত্তি-পাঁজি-টীকা ভালোরকম রপ্ত করেছিলেন বলেই মনে করি।
অবশ্য ব্যাকরণের এই বিদ্যাটুকু পড়ুয়া চৈতন্যকে যতটুকু অভিনিবিষ্ট করেছিল তার চেয়ে বেশি তাঁকে চঞ্চল এবং অহংকারী করে তুলেছিল, নইলে চরিতকার বৃন্দাবন দাস একথা বলতেন না যে—সবারে চালেন প্রভু ফাঁকি জিজ্ঞাসিয়া। ‘চালেন’ কথাটা এখনকার ভাষায় বলা যায় ‘চ্যালেঞ্জ’ করা। আর কুমার বিশ্বম্ভর সকলকে ‘চ্যালেঞ্জ’ করতেন ‘ফাঁকি’ জিজ্ঞাসা করে। এই শব্দটাও সাধারণের অজানা। আমার প্রথম বয়সে যখন এদিকে-ওদিকে প্রচুর সংস্কৃত পুঁথি ঘেঁটেছি এবং তা নবদ্বীপেও প্রচুর ঘেঁটেছি—তখন মাঝে মাঝে এই ধরনের পুঁথি হাতে পড়ত—যার ওপরে কোনো বিশিষ্ট পণ্ডিতের নাম লেখা থাকত—’অমুক দেবশর্মার ফক্বিকা’। পুঁথির অজ্ঞতায় ‘ফক্কিকা’ দেখেও যখন আনন্দ লাভ করছি, তখন একদিন আমার পুঁথিপাঠের গুরু প্রবাল সেন বললেন—ওসব হল গিয়ে ফাঁকি, এসব পুঁথির কোনো অভিনবত্ব নেই, মৌলিকতাও নেই। জিজ্ঞাসা করলুম—তাহলে কী এগুলো? যত্ন করে তো এসব পুঁথি ঘরে পুষেছেন পণ্ডিতেরা। তিনি বললেন—এগুলো হল লোকঠকানো প্রশ্ন এবং তার নিজস্ব সমাধান। বাক-বিতণ্ডায় পরপক্ষকে ধূলিসাৎ করার জন্য অনেক পণ্ডিতই ঘরে বসে নিবিষ্ট মনে ‘ফাঁকি’ তৈরি করতেন।
‘ফাঁকি’ শব্দটা অদ্ভুত। ভাবতে অবাক লাগে, এই শব্দের উৎপত্তি হয়েছে চৈতন্য মহাপ্রভুর সময়ে। আমাদের তো ধারণা—এই শব্দ বাংলাতেই ছিল মুখেমুখে, সেই শব্দের সংস্কৃতায়ন ঘটানো হয়েছে ‘ফক্কিকা’ শব্দের প্রয়োগ করে। কে জানে—ফক্কিকা এবং ফক্কর, ফাঁকি এবং ফাঁকের মধ্যে নিশ্চয়ই যথেষ্ট সম্বন্ধ আছে। পুঁথি ঘাঁটার সময় দেখেছি ন্যায়, ব্যাকরণ, বেদান্ত, এমনকী স্মৃতিশাস্ত্রের আলোচনাতেও প্রতিপক্ষ-শাতনের জন্য ‘ফাঁকি’ তৈরি হয়েছে পণ্ডিত মহলে। কিন্তু শ্রীমনমহাপ্রভু বৃত্তি-পঞ্জী-টীকা-রচনার গম্ভীর পথ পরিত্যাগ করে সমবয়সি ছাত্রদের শুধু ঠকিয়ে দেওয়ার জন্য ‘ফাঁকি’ জিজ্ঞাসা করছেন—এটা তাঁর যৌবন-গন্ধী বয়সের বৈশিষ্ট্য স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিশ্বম্ভর-নিমাইয়ের বালকোচিত দৌরাত্মের সঙ্গে বিদ্যার অহংকার আমাদের কাছে কোনো আশ্চর্যের ঘটনা নয়। এমনকী অধ্যাপনার সময়েও তাঁর যে মূর্তি এবং স্বরূপ চরিতকারেরা বর্ণনা করেছেন, তাও খুব আশ্চর্য নয়। খুব লৌকিকভাবে যদি দেখি, তবে এ কথা মানতেই হবে যে, উপনয়ন সংস্কারের পরপরই চৈতন্যের পিতৃবিয়োগ ঘটে এবং এই পিতৃহীন পুত্রটির সমস্ত অত্যাচার তাঁর জননী শচীদেবী মুখ বুজে সয়েছেন। ঘরের শাসন বিশ্বম্ভর নিমাইয়ের ওপর ক্রিয়া করেনি। অধ্যয়নের সঙ্গে চাঞ্চল্য এবং দৌরাত্ম্যের সমানাধিকরণ ঘটে যাওয়ায় তৎকালীন চতুরতায় অন্যের বিদ্যবত্তার ফাঁকিটুকু তিনি সহজে বুঝতেন, কিন্তু বিদ্যার অভিনিবেশ তাঁকে ব্যাকরণশাস্ত্রের বাইরে নিয়ে আসেনি এবং সমসাময়িক কালের বিদ্যার চরম উৎকর্ষ ন্যায়শাস্ত্রের অধ্যয়ন— সে দিকেও তিনি পদসংক্রমণ করলেন না। মাঝে-মাঝে তাঁর গুরু গঙ্গাদাস পণ্ডিতের মুখে এই উচ্ছ্বাস শুনেছি যে, বিশ্বম্ভর বড়ো ভালো ছাত্র, ইচ্ছে করলেই তিনি ‘ভট্টাচার্য’ হতে পারেন—
গুরু বোলে বাপ তুমি মন দিয়া পড়।
ভট্টাচার্য্য হৈবা তুমি বলিলাঙ দৃঢ়।।
সেকালের নবদ্বীপে ভট্টাচার্য উপাধি লাভ করাটা ন্যায়শাস্ত্রের বিদ্যাবত্তার ওপরেই নির্ভর করত। মহাপ্রভু ন্যায়শাস্ত্র পড়েননি এবং পড়ার আগ্রহও প্রকাশ করেননি কখনও। গুরু গঙ্গাদাস যে উচ্ছ্বাস এবং আক্ষেপ একইসঙ্গে প্রকাশ করেছেন, তাতে তাঁর শিষ্যের বুদ্ধিমত্তার ওপর বিশ্বাসটা প্রকাশ পায়, কিন্তু বিশ্বম্ভর সে পথে যাননি। আপন গুরু ছাড়াও অন্য সাধারণ মানুষদেরও বিশ্বম্ভরের ওপর এই আস্থা ছিল যে, তিনি এক সময় ন্যায়শাস্ত্রের দিকপাল পণ্ডিত হবেন, তাঁদের এই আস্থার কথাও বৃন্দাবন দাস বর্ণনা করেছেন—
কেহ বোলে এ ব্রাহ্মণ যদি ন্যায় পড়ে।
ভট্টাচার্য হয় তবে তখন না নড়ে।।
কিন্তু এত পড়াশোনা, এত কূট তর্কজাল বিশ্বম্ভর-নিমাই পছন্দ করতে পারেননি। এত পড়াশোনা তাঁর ভালো লাগেনি। এর জন্য তাঁকে কথাও শুনতে হয়েছে অনেক। অন্য পণ্ডিতেরা তর্কারম্ভেই তাঁকে এই কথাটা শুনিয়ে নিতেন। ন্যায়-বৈশেষিক, পূর্বোত্তর মীমাংসা দর্শনের তুলনায় ব্যাকরণ যে নেহাতই ‘শিশুশাস্ত্র’ অথবা ‘বাল্যশাস্ত্র’— এ কথা অধ্যাপক বিশ্বম্ভরকে শুনতে হয়েচে বহুবার—
ব্যাকরণ পড়াহ নিমাই পণ্ডিত তোমার নাম।
বাল্যশাস্ত্রে লোকে তোমার কহে গুণগ্রাম।।
ব্যাকরণ মধ্যে জানি পড়াহ কলাপ।
শুনিল ফাঁকিতে তোমার শিষ্যের সংলাপ।।
নৈয়ায়িক, বৈদান্তিক পণ্ডিতের মুখে কলাপী বৈয়াকরণকে যে এসব কথা শুনতে হবে, সেটা তৎকালীন নবদ্বীপের বিদ্যাচর্চার নিরিখে খুব স্বাভাবিক, কিন্তু বিদ্যাচর্চার এই বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র তাঁর পছন্দ হয়নি। ‘ভট্টাচার্য’ হয়ে ওঠার মধ্যে পদে পদে যে হেতুবাদিতা কাজ করে, নিরন্তর যে তর্কস্রোত— পাত্রাধার তৈল কিংবা তৈলাধার পাত্র— এগুলি তাঁর আবেগস্ফুরিত হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি। পণ্ডিত দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাপ্রভুর ন্যায়চর্চা সম্ভাবনা নিয়ে লিখেছেন— ‘মহাপ্রভুর লৌকিক শিক্ষা ব্যাকরণ শাস্ত্র অতিক্রম করিয়া যায় নাই এবং তিনি ন্যায়শাস্ত্র পড়েন নাই, বৃন্দাবন দাস স্পষ্টাক্ষরেই তাহা লিখিয়াছেন। বৃন্দাবন দাস তদানীন্তন অধ্যাপক মণ্ডলীর শীর্ষ স্থানীয় ‘ভট্টাচার্য’ সম্প্রদায়ের মর্যাদার চিত্র প্রসঙ্গক্রমে যেটুকু অঙ্কিত করিয়াছেন, তাহাতেই বুঝা যায়, তাঁহারা স্বতন্ত্র পথের যাত্রী— তাঁহাদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যুক্তিজালাবৃত তর্ককর্কশ চিত্তে মহাপ্রভুর কীর্তনধ্বনি প্রবেশ করে নাই।’
মহাপণ্ডিত দীনেশচন্দ্রের এই বক্তব্যের মধ্যে ‘ভট্টাচার্য’-দের প্রতি স্তুতি ব্যক্ত হল, নাকি মহাপ্রভুর স্তুতি ব্যক্ত হল— সে কথা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। কিন্তু স্বতন্ত্র পথের যাত্রী কারা? যেখানে বুদ্ধিমান ব্যক্তিমাত্রেই ভট্টাচার্য হওয়ার দিকে ঝুঁকছেন, সেখানে প্রখর বুদ্ধিমত্তা সত্ত্বেও শুধু কলাপ-ব্যাকরণ পড়ে নির্মোহে বসে থাকাটাই তো স্বতন্ত্রতা। বৃন্দাবন দাস নবদ্বীপের বিদ্যাসমাজের উল্লেখ করতে গিয়ে এই গড্ডালিকার চিত্র এঁকেছেন—
যদ্যপিহ নবদ্বীপে পণ্ডিত সমাজ।
কোট্যর্বুদ অধ্যাপক নানাশাস্ত্ররাজ।।
ভট্টাচার্য চক্রবর্তী মিশ্র বা আচার্য।
অধ্যাপনা বিনা কারো আর নাহি কার্য্য।।
যদ্যপিহ সবেই স্বতন্ত্র সবার জয়।
শাস্ত্রচর্চা হৈলে ব্রহ্মারেহ নাহি সয়।।
ভট্টাচার্য-চক্রবর্তীদের এই মহাসমারোহে বিশ্বম্ভর-নিমাই শামিল হননি। তিনি ‘শিশুশাস্ত্র’ ব্যাকরণ পড়েই যথাসাধ্য পাণ্ডিত্য বিকিরণ করবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে বুঝেছেন— পাণ্ডিত্যের পথ তাঁর জন্য সৃষ্ট হয়নি। উলটো করে বলতে গেলে— মহাপ্রভুই স্বতন্ত্র পথের যাত্রী। তাঁর হৃদয়ের অনন্ত আনন্দধারার মধ্যে ভট্টাচার্য-চক্রবর্তীদের তর্ককর্কশ সূক্ষ্ম যুক্তিজাল প্রবেশ লাভ করেনি। তিনি নিজস্ব এবং স্বতন্ত্র পথে যাত্রা করেছেন। অধ্যাপনা-কালের শেষ পর্বেই তাঁর হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটে গেছে। অধ্যয়নকালে তাঁর মধ্যে যে দৌরাত্ম্য দেখেছি, অধ্যাপনার প্রথম পর্বে সেই দৌরাত্ম্যই বিস্তারিত হয়েছিল। সতীর্থ এবং সমবয়সিদের তিনি তিষ্ঠোতে দেননি। তাঁর ব্যক্তিত্বটাই এমন তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে, চেনাশোনা লোকেও তাঁকে দেখলেই প্রশ্ন-জিজ্ঞাসার ভয়ে পালিয়ে যেতেন। কথায় কথায় এমনভাবেই তাঁদের আটকে রাখতেন, যেন তিনি শুল্কগ্রাহক, যেন অন্যেরা শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার দায়ে ধরা পড়েছেন বিশ্বম্ভর-নিমাইয়ের হাতে—
সবেই বোলেন ভাই উহারে দেখিয়া।
ফাঁকি জিজ্ঞাসার ভয়ে যাই পলাইয়া।।
কেহ বোলে দেখা হৈলা না দেখ এড়িয়া।
মহাদানী প্রায় যেন রাখেন ধরিয়া।।
আমাদের মতে এগুলি বিশ্বম্ভর-নিমাইয়ের পূর্বস্থিত বাল্যচাপল্যের যৌবনগর্বী বিস্তার। চাপল্যের সঙ্গে এই গর্বমত্ততার কোনো তফাত নেই, যার জন্য সতীর্থ সমবয়সি, এমনকী অন্যমতবাহকদের সঙ্গে ও তাঁর সভ্যতা বিগর্হিত আচরণ। তখনও তিনি এতটাই অস্থির যে নিজের পথটি তিনি তখনও খুঁজে পাননি। এই আচরণের একটাই ব্যাখ্যা আছে আমাদের কাছে, যা কবিকুলগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মহামতি বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে এবং কী আশ্চর্য, সেখানে তিনি কী অদ্ভুত ক্রান্তদর্শিতায় চৈতন্যের কথাও বলেছেন। চারিত্রপূজায় বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন—
‘পাঁচ-ছয় বৎসর বয়সের সময় যখন গ্রামের পাঠশালায় পড়িতে যাইতেন তখন প্রতিবেশী মথুর মণ্ডলের স্ত্রীকে রাগাইয়া দিবার জন্য যে-প্রকার সভ্যতাবিগর্হিত উপদ্রব তিনি করিতেন, বর্ণপরিচয়ের সর্বজননিন্দিত রাখাল বেচারাও বোধ করি এমন কাজ কখনো করে নাই।
নিরীহ বাংলাদেশে গোপালের মতো সুবোধ ছেলের অভাব নেই। এই ক্ষীণতেজ দেশে রাখাল এবং তাহার জীবনীলেখক ঈশ্বরচন্দ্রের মতো দুর্দান্ত ছেলের প্রাদুর্ভাব হইলে বাঙালি জাতির শীর্ণ চরিত্রের অপবাদ ঘুচিয়া যাইতে পারে। সুবোধ ছেলেগুলি পাস করিয়া ভালো চাকরি-বাকরি ও বিবাহকালে প্রচুর পণ লাভ করে সন্দেহ নাই, কিন্তু দুষ্ট অবাধ্য অশান্ত ছেলেগুলির কাছে স্বদেশের জন্য অনেক আশা করা যায়। বহুকাল পূর্বে একদা নবদ্বীপের শচীমাতার এক প্রবল দুরন্ত ছেলে এই আশা পূর্ণ করিয়াছিলেন।’
চরিতকার বৃন্দাবন দাস নবদ্বীপের এই সুবোধ গোপাল ছেলেদের কথা জানতেন না, তা নয়। ভট্টাচার্য-চক্রবর্তী, আচার্য-মিশ্রদের উচ্চাশার পরিমাণ তাঁর জানা ছিল। জানা ছিল এইসব উপাধির শেষ গম্য স্থান, যার ফলে উচ্চারিত হয়েছে সাধারণের প্রত্যাশিত সেই উচ্চাশী ঘোষণা—তারে বলি সুকৃতি যে দোলা-ঘোড়া চড়ে অথবা যিনি পণ্ডিত, তাঁর উপাঙ্গ সজ্জা—
হস্তী ঘোড়া দোলা লোক অনেক সংহতি।
সম্প্রতি আসিয়া হৈলা নবদ্বীপে স্থিতি।।
বিশ্বম্ভর-নিমাই এপথে হাঁটলেন না। তৎকালীন নবদ্বীপের চূড়ান্ত বিদ্যাগুলি তিনি হেলায় পরিহার করে গেলেন। পড়লেন না বেদান্ত, পড়লেন না ন্যায়, শুধু ‘শিবশাস্ত্র’ ব্যাকরণ পড়ে লোকের পরিবাদ গ্রহণ করে গেলেন। আধুনিক গবেষকেরাও এমন পরিবাদ দেন—তিনি ন্যায়-বেদান্ত পড়েননি, কেন না তাঁর পড়বার ক্ষমতা ছিল না। আমরা বলতে পারব না, তাঁর ক্ষমতা কতটুকু ছিল অথবা ছিল না, কিন্তু এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি চৈতন্যদেব ভট্টাচার্য-চক্রবর্তী হলে বড়জোর আর একটা রঘুনাথ শিরোমণি কিংবা সার্বভৌম ভট্টাচার্য তৈরি হতেন, কিন্তু যে মানুষটার জন্য সংস্কৃত বাংলার সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি হল, যে মানুষটার জন্য বাংলার জাতি-বর্ণ-দীর্ণ সমাজ কয়েকশো বছরের আগাম সংস্কার লাভ করেছিল, তিনি ভট্টাচার্য-চক্রবর্তীদের মাথায় বসে গেছেন—পণ্ডিত থেকে আপামর জনসাধারণ তাঁকে মনে রেখেছে, ভট্টাচার্য-চক্রবর্তীরা পড়ে আছেন কালজীর্ণ পুস্তকের পাতায়, অস্মরণে অমননে।