৬. শেষের দিনের শেষ

শেষের দিনের শেষ

কফি খাওয়া আর ফুরোয় না। একবার চুমুক দেয় তো দশ মিনিট ভাবে। থেকে থেকে মুচকি হাসি হাসে। যেন শক্ত চাল চেলেছে। তবু কোনো চালেই কিস্তিমাত হয় না। নতুন করে চাল চালতে হয়।

এমনি করে সময় যায়! কফিও জুড়িয়ে কাদা। দু-জনের ধ্যান ভাঙিয়ে দিয়ে হিল ঘরে ঢুকে বলে, ‘আরও কিছু দিয়ে যেতে হবে, ম্যাডাম?’

পেগি ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানায়।

‘স্যার?’

সোম বলে, ‘না, ধন্যবাদ।’

তখন কফির ভুক্তাবশেষ স্থানান্তরিত করে হিল বলে, ‘তবে কি আমরা বিশ্রাম করতে যেতে পারি?’

সোম পেগির মুখে তাকায়!

পেগি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। কথা বললে যদি তার ভাবনার খেই হারিয়ে যায়।

হিল bow করে বলে, ‘গুড নাইট, ম্যাডাম। গুড নাইট, স্যার।’

অগত্যা পেগিকেও বলতে হয়, ‘গুড নাইট, মিস্টার হিল।’ সোম তো বলেই।

বাড়ির সকলে ঘুমোতে গেল। পাড়ার সকলে ঘুমিয়ে। এগারোটা বেজে গেছে। ছোটো গ্রামের পক্ষে সেটা অনেক রাত। চারিদিক নিঝুম।

সামনে যে ছোটো টেবিলটা ছিল তার উপর দুই হাতে মুখ ঢেকে পেগি নিদ্রার আয়োজন করল। তার চোখ দু-টি ঢুলুঢুলু, তবু হাসি হাসি। তার চুলগুলি আলুথালু, গালের উপর মুখের উপর পড়েছে। ডান হাত দিয়ে বাম বাহুকে ও বাম-হাত দিয়ে ডান বাহুকে জড়িয়ে ধরে পেগি মাথা গুঁজল।

এই তার রণকৌশল। এই তার ব্যুহরচনা। সোমের সাধ্য কী যে তাকে স্থানচ্যুত করে!

যে চেয়ারে বসেছিল সেই চেয়ারের সামনে দুটো পায়াকে পেগি দুই পা দিয়ে লতার মতো করে জড়াল। সোম যদি তার হাত ধরে টানাটানি করে কৃতকার্য হয় তবু চেয়ারকে উলটে না ফেলে বিকট আওয়াজ না করে কার্পেটে আঁচড় না লাগিয়ে তাকে নড়াতে পারবে না। তার আগে হিল-দম্পতির ঘুম ভাঙবে, বাড়িতে চোর পড়েছে ভেবে তারা পাড়ার লোককে ডাক দিয়ে জাগাবে, সোমের অবস্থা হবে সঙিন এবং পেগির মুখ হবে রঙিন। তখন যা হয় একটা মিথ্যে ঘটনা বানিয়ে বলা যাবে।

পেগির তন্দ্রা লেগে আসছে এমন সময় সোম আচমকা উঠে দাঁড়াল এবং পেগির উদ্দেশে ‘গুড নাইট’ বলে লঘু পদপাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

উপরতলায় তাদের ঘর। সোম মোমবাতিটা জ্বেলে দিয়ে ম্যান্টলপিসের উপর রাখল। এসব অঞ্চলে ইলেকট্রিকের চলন হয়নি।

হঠাৎ বিছানার দিকে চেয়ে তার চক্ষু চড়কগাছ। একটিমাত্র খাট—তাতে দু-জনের চারটে বালিশ। দুপুর বেলা ঘর দেখতে এসে সোম হিলকে বলেছিল, ‘এই বড়ো খাটটা বের করে নিয়ে এর জায়গায় দুটো ছোটো খাট পেতে দিতে পারবে?’ হিল বলেছিল, ‘এত বড়ো খাটকে দরজা দিয়ে বের করা যায় না, স্যার। মিস্ত্রি ডেকে পায়াগুলো খোলাতে হবে।’ সোম বলেছিল, ‘তা হলে এই সোফাটাকে সরিয়ে এর জায়গায় একটা ছোটো খাট পাততে হবে।’

হিল কথা রাখেনি। হিলের বউ দু-জনের বিছানা একসঙ্গে করা সোজা এবং স্বাভাবিক বলে তাই করে রেখেছে। সোম অতি কষ্টে বিরক্তি দমন করে সোফার উপর গোটা দুই বালিশ ও একখানা চাদর সহযোগে নিজের জন্যে স্বতন্ত্র শয্যা রচনা করল। নতুবা পেগির কাছে মুখ দেখানো যায় না। পেগি ভাববে, বিশ্বাসঘাতক! কুচক্রী!

সোম কাপড় ছেড়ে মুখ ও মাথা ধুয়ে চুলে ব্রাশ দিয়ে সংকীর্ণ সোফাটিতে কায়ক্লেশে গা এলিয়ে দিল। মোমবাতিটি নিভিয়ে দিল না। যদি পেগি এসে অন্ধকারে দেশলাই না খুঁজে পায়।

সোমের ঘুম আসছিল না। তার দেহমন পেগির আসার অপেক্ষা করছিল এবং পেগির দেহমনকে আয়ত্তের মধ্যে পাবার উপায় উদ্ভাবন করছিল। তার কামনা বাগ মানছিল না, তবু তার আত্মসম্মানবোধ তীব্রতর হয়েছিল। পেগিকে সে আততায়ীর মতো আক্রমণ করবে না, বাঞ্ছিতের মতো অধিকার করবে—এই তার মনস্কামনা। কিন্তু পেগি এত বিমুখ কেন? আনন্দটা কি পেগির ভাগে কিছু কম পড়বে? কিংবা পেগি একটু খোশামোদ চায়, হাতে-পায়ে ধরে রাজি করানো, আত্মহত্যার ভয় দেখানো—সাধারণ কামুকদের যত কিছু উপচার?

সিঁড়িতে কার পায়ের শব্দ? পেগির? সোম চট করে চোখ বুজল, গভীর নিদ্রার অভিনয় করতে হবে, পেগি জানুক যে সোম তার জন্যে কেয়ার করে না, পেশাদার প্রেমিকের মতো জাগে না।

পেগি কপাটে দু-বার টোকা মারল। সাড়া না পেয়ে ঘরে ঢুকল, জানালাটাতে ফাঁক ছিল, সযত্নে বন্ধ করে দিল। তখনও মোমবাতি মিটমিট করছিল। তার নির্বাণোন্মুখ অবস্থা। তারই আলোয় দেখল সোম সোফায় শুয়ে। খাটের দিকে চেয়ে দেখে বিরাট খাট। তাতে অনায়াসে দু-জনকে ধরে। এত বড়ো প্রলোভনকে উপেক্ষা করে সোম সোফায় কোনোমতে আড়ষ্ট হয়ে ঘুমিয়ে।

ঠিক ঘুমিয়ে তো? পেগি দুষ্টুমি করে মোমবাতিটি সোমের মুখের উপর তুলে ধরল। এক ফোঁটা গলানো মোম সোমের কপালের উপর টলে পড়ল, সোম একটুও ‘উঁহু’ করে উঠল না। কেবল ঈষৎ ভ্রূকুঞ্চিত করল। পেগি সযত্নে ও সখেদে ওটুকু জমাট মোম সোমের কপাল থেকে নখ দিয়ে খুঁটে নিল।

বাতি যথাস্থানে রেখে সে সসংকোচে কাপড় ছাড়তে লাগল। তার ভয় হচ্ছিল পাছে সোম খসখস শব্দ শুনে চোখ মেলে চায়, দেখে ফেলে।

সোম দু-বার খক খক করে কাশল। পেগি ত্রস্ত হয়ে এক ফুঁয়ে বাতিটি নিভিয়ে দিল। সোম পাশ ফিরল। তার ঘুম ভাঙবার মুখে। পেগি শশব্যস্ত হয়ে কাপড় ছাড়া শেষ করল।

সোম সহজ সুরে বলল, ‘বাতিটা নিবিয়ে ভালো করনি, পেগ। আমার চোখ তোমাকে দেখছে, তোমার চোখ টের পাচ্ছে না।’

পেগি লজ্জায় মরে গিয়ে বলল, ‘তুমি ঘুমোওনি?’

‘না।’

‘আমি যখন এলুম জানতে পেরেছিলে?’

‘নিশ্চয়।’

‘তবে তোমার কপালে মোমের ফোঁটা পড়ে যাওয়াও অনুভব করেছ?’

‘ভাবছিলুম তুমি ইচ্ছে করে ফেলেছ।’

‘না গো, সত্যি বলছি, ইচ্ছে করে ফেলিনি।’

‘ইচ্ছে করে ফেলেছ ভেবে আমি কত খুশি হয়েছিলুম পেগ। আমার দেশে বোনেরা ভাইদের কপালে ফোঁটা দিয়ে যমের দুয়ারে কাঁটা দেয়। আমার যদি এদেশে একটি বোন থাকত।’

‘বেশ তো! আমিই তোমার বোন হব।’

‘কখনো না।’

‘তবে কী হব?’

‘স্ত্রী।’

‘এখনও তোমার সেই খেয়াল আছে?’

‘প্রবলভাবে আছে, পেগ।’

পেগি এতক্ষণে বিছানায় আরাম করে শুয়েছিল। লেপটা বুক পর্যন্ত টেনে নিয়ে সোমকে বলল, ‘বেচারা সোম। তোমার জন্যে আমার দুঃখ হচ্ছে।’

সোম বলল, ‘হঠাৎ?’

‘তুমি সোফায় শুয়ে কষ্ট পাচ্ছ। একটা মোটা কম্বলও নেই গায়ে দেবার। শীতে কাঁপবে।’

‘তা বলে তুমি তো তোমার সুখশয্যায় ঠাঁই দেবে না।’

‘দিতুম, যদি ভাই হতে।’

‘চাইনে ঠাঁই, যদি ভাই হতে হয়।’

‘সারারাত কষ্ট পাবে?’

‘সারারাত কষ্ট পাব আর ভাবব মিথ্যা সম্বন্ধ পাতিয়ে সত্য সম্বন্ধের পথ রুদ্ধ করিনি।’

‘একটা রাতের জন্যে এত সত্যসন্ধ হবে? কাল এতক্ষণে তুমি কোথায় আর আমি কোথায়, সোম?’

‘ভগবান জানেন। আমি আশা ছাড়ব না।’

‘নিজেকে ভোলাতে চাও তো ভোলাও। কিন্তু নির্বোধ তুমি, এমন গরম এবং নরম বিছানা হারালে!’

সোম কথা কইল না।

পেগি বলল, ‘ঘুমোলে?’

‘না।’

‘আমারও ঘুম আসছে না।’

‘আমার ভয়ে? আমি অভয় দিচ্ছি পেগ, নিদ্রিতা নারীকে আমি আক্রমণ করব না।’

‘সোম।’

‘কী?’

‘আমার মাথার কাছে বোসো এসে।’

‘হঠাৎ?’

‘এমনি।’

‘পূর্বরাগ বুঝি?’

‘দূর।’

‘তবে আমি যাব না।’

‘এসো, লক্ষ্মীটি।’

সোম সোফা ছেড়ে পেগির শিয়রে বসল। পেগি তার একটি হাত টেনে নিয়ে মুখে ছোঁয়াল। বলল, ‘ডারলিং।’ কিছুক্ষণ কেটে গেল। তখন পেগি বলল, ‘একটা কথা জিজ্ঞাসা করব, সত্যি বলবে?’

‘তোমার কাছে মিথ্যা বলতে পারি?’

‘বলো আমার ওপরে তোমার শ্রদ্ধার কণামাত্র বাকি আছে?’

‘কেন ওকথা জিজ্ঞাসা করলে?’

‘তুমি বলো আগে।’

‘তুমি আগে বলো।’

‘এই ধরো তুমি আমাকে কাপড় ছাড়তে দেখলে। (লজ্জায় মুখ ঢেকে) ছি ছি ছি।’

‘তার জন্যে যদি অশ্রদ্ধা করতে হয় তবে বলতে হয় কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে শ্রদ্ধা করে না।’

‘করে না, সে তো জানা কথা।’

‘আমি এমন অনেক স্বামীর নাম করতে পারি যারা তাদের স্ত্রীদের দেবতার মতো ভক্তি করে।’

‘তা হলে বলতে হবে তারা এক ঘরে রাত কাটায়নি।’

‘Silly! তাদের ছেলেপুলে আছে।’

‘তা হলে দেবতার মতো ভক্তি করাটা লোক দেখানো।’

‘না গো, তা নয়। সমুদ্রে আমরা সাঁতার কাটি বলে, সমুদ্রকে কম ভক্তি করি নে। দেহও সমুদ্রের মতো প্রাকৃতিক বিস্ময়। তাকে দেখে আনন্দ, স্পর্শ করে আনন্দ, সর্বাঙ্গে অনুভব করে আনন্দ।’

‘আমার বিশ্বাস হয় না। ধরো আজ যদি আমি নিজেকে দিই কাল তুমি ভাববে ওর মধ্যে রহস্য কী আছে! রহস্য না থাকে তো শ্রদ্ধা করবে কেন?’

‘এক দিনে কি একজনকে নিঃশেষ করতে পারা যায়?’

‘এক দিনে না হোক দশ দিনে, বিশ দিনে, এক বছরে, দু-বছরে?’

‘দু-বছর আমার ভক্তি পেয়েও তোমার তৃপ্তি হবে না, পেগ?’

‘না, সোম। আমার দাবি সারাজীবন।’

‘দু-বছর পরে দেখবে আমার ভক্তি পাও বা না পাও তাতে তোমার কিছু আসে যায় না। তখন তোমার অন্য কোনো ভক্ত পাওয়া গেছে যার ভক্তি পেয়ে স্বর্গসুখ, না পেলে যন্ত্রণা।’

‘তবু আমি জীবনে একবারমাত্র বিয়ে করব, দু-বছর অন্তর একবার না।’

‘ওটা তোমার জেদ। যুক্তিসহ নয়।’

‘কিন্তু থাক, এ নিয়ে তর্ক করব না। তুমি যখন সেই মানুষ নও যে আমাকে চিরকালের মতো বিয়ে করবে ও শ্রদ্ধা করবে তখন আমি সেই মানুষের খাতিরে আজ তোমার হাত থেকে আত্মরক্ষা করব।’

সোম এতক্ষণ পেগির চুলগুলি নিয়ে খেলা করছিল। কঠিন হয়ে বললে, ‘এই তোমার মনের কথা?’

‘এই আমার মনের কথা।’

‘আমার মনের কথা তোমাকে বলি। আমি গভীরভাবে প্রগাঢ়ভাবে সত্য করে ভালোবাসতেও পারি, এবং ভালোবাসার ধনকে ভক্তি না করে পারিনে। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখেছি দু-বছর পরে না থাকে গভীরতা না থাকে গাঢ়তা। ভক্তি থাকে, মমতা থাকে, শুভকামনা থাকে। আমার ভূতপূর্ব প্রেমিকারা প্রত্যেকে আমার প্রিয় বন্ধু।

‘কখনো কারুকে সর্বস্ব দিয়েছ?’

‘দিতে চেয়েছি।’

‘দেওয়া এবং দিতে চাওয়া এক জিনিস নয়, সোম। যদি দিতে তবে দেখতে জীবনে যেমন একবারমাত্র প্রাণ দেওয়া যায় তেমনি একবারমাত্র প্রেম দেওয়া যায়। দিয়ে বড়ো কিছু বাকি থাকে না সোম, যে দু-বার করে দেবে।’

সোম পেগির গালের উপর গাল রাখল। বলল, ‘এ তত্ত্ব ঠেকে শেখা না দেখে শেখা?’

‘দেখে শেখা নিশ্চয়ই নয়। কেননা সংসারে প্রাণ যদিও দিতে পারে লাখ জন, প্রেম দিতে পারে—সর্বস্ব দিতে পারে—লাখে এক জন। ঠেকে শেখাও নয়। এখনও আমার জীবনের পরম লগ্ন আসেনি।’

‘কখনো কাউকে ভালোবাসোনি, পেগ?’

‘কতবার কতজনকে ভালোবেসেছি। এই যেমন তোমাকে আজ ভালোবেসেছি। কিন্তু কখনো এমন প্রেরণা পাইনি যে ভালোবাসার জন্যে সর্বস্ব বিলিয়ে দেব—ভালোবাসার জনের কাছে সাড়া পাই বা না পাই। আজ যেমন তোমার কাছে শ্রদ্ধা পাবার কথাটাই বড়ো হয়ে মনে জাগছে এমনি কিছু-না-কিছু একটা পাবার কথাই প্রত্যেক বার বড়ো হয়ে মনে জেগেছে, সোম।’

সোমের কামনা ইতিমধ্যে মন্দ হয়ে এসেছিল। সে অভিভূত হয়ে পেগির মনের কথা শুনছিল। বলল, ‘প্রার্থনা করি পেগ, তোমার জীবনে সেই পরম লগ্নটি যেন আসে। আমরা তোমার অকালের প্রেমিকরা তোমাকে তালিম করে রেখে গেলুম, যিনি যথাকালে আসবেন তিনি তৈরি জিনিসটি পাবেন।’

পেগি বলল, ‘এখন থেকে তা হলে ভাই হবে?’

সোম বলল, ‘এখন থেকে তা হলে ভাই হব।’

পেগি সোমের গালে ঠোনা মেরে বলল, ‘ওঠো, যাও, বালিশ দুটো সোফা থেকে নিয়ে এসো।’

এক বিছানায় শোওয়ার উত্তেজনায় দু-জনের কারুরই ঘুম আসছিল না। বারংবার পাশ ফেরা, উশখুশ করা। একজন লেপটাকে পা অবধি নামাতে চায়, অন্যজন বুক অবধি উঠোতে চায়। সোম বলে, ‘বড়ো গরম।’ পেগি বলে, ‘বড়ো শীত।’ আসল কারণ অবশ্য সোমের হৃদয়ের তাপাধিক্য, পেগির নারীসুলভ লজ্জা।

পেগি বলল, ‘সোম ডিয়ার, তোমার মনে কি বড়ো কষ্ট হয়েছে?’

সোম বলল, ‘অত্যন্ত। তুমি তো জানতে না, ডারলিং, আমার মনের আকাশে কত কত কুসুম ফুটিয়েছিলে। জীবনে আমি কারুকে প্রাণ ভরে পাইনি, পেগ, তোমাকেও পেলুম না!’

পেগি সোমের গোঁফের উপর হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘বেচারা সোম!’

সোম বলল, ‘শুনে রাগ কোরো না, পেগ। তোমার স্পর্শ এখন বিষের মতো লাগছে। যদিও তুমি আমার বোন।’

পেগি হাত সরিয়ে নিল না। আরও নরম সুরে বলল, ‘দু-একদিন বিষের মতো লাগবেই, সোম। কিন্তু তারপর থেকে সহজ লাগবে। তোমাকে আমি রান্না করে খাওয়াব, বনভোজনে নিয়ে যাব, তোমার বাসায় এসে তোমার ঘর সাজিয়ে দেব, জিনিস গুছিয়ে দেব। তুমি আমাকে থিয়েটারে নিয়ে যাবে, তোমার টাকাকড়ির হিসাব দেবে, তোমার জীবনের আশা আকাঙ্ক্ষা শোনাবে।’

সোম বলল, ‘স্ত্রীর সাধ বোনে মেটে না। বোন তো আমার কিছু না হোক বিশটি আছে।’

(সাশ্চর্যে) ‘বিশটি!’

(সহাস্যে) ‘সহোদরা গুটি তিনেক। তোমরা যাকে কাজিন বল আমরা তাকে সহোদরার সামিল জ্ঞান করি। তেমন বোন ডজন খানেক। তারপর পাতানো বোন রাশি রাশি। তাদের মধ্যে বাছা বাছা জন পাঁচেক সহোদরার মতো প্রিয়।’

‘তবে আমি তোমার একবিংশতমা। তোমার ষষ্ঠী নই।’ এই বলে পেগি হাসল।

‘ষষ্ঠী হলে তোমার সপত্নী থাকত না, অদ্বিতীয়া হতে। একবিংশতমা হয়ে অন্য বিশজনের চেয়ে একটুও বেশি পাবে না স্নেহ।’

এই বলে সোম গলাটা পরিষ্কার করল।

পেগি বলল, ‘ঘুম তো আজ হবে না, সোম। তোমার পঞ্চকন্যার কাহিনি বলো।’

সোম বলল, ‘তাহলে সত্যি সত্যি রাত পোহাবে।’

‘পোহাক। এই রাতটি সারাজীবন তোমার মনে থাকবে, আমারও। এই নিয়ে একদিন তুমি একটা গল্প লিখতেও পার।’

‘গল্প আমি লিখতে ভালোবসি নে, পেগ, live করতে ভালোবাসি। আমি জীবনশিল্পী, অপরে আমার জীবনীকার হোক।’

‘আবার সেই অহংকার?’

‘অহংকার যার নেই সে হয় ভন্ড, নয় ক্লীব। তবে অহংকারকে মেরুদন্ডের মতো ঢাকা দিতে হয়। নইলে কঙ্কালসার দেখায়।’

পেগি সোমের বুকের পরে মাথা রেখে বলল, ‘এবার তোমার গল্প বলো।…লাগছে?’

সোম বলল, ‘লাগবে না? হাড় যে। তোমাদের মতো মাংস নয় তো।’

পেগি লজ্জায় শিউরে উঠে একটি বালিশ নিয়ে নিজের মাথার নীচে ও সোমের বুকের উপরে রাখল। বলল, ‘এখন কেমন লাগছে?’

‘এখন লাগছে রামমূর্তি পালোয়ানের মতো।’

‘বেশ এবার বলো তোমার প্রথম প্রেমের গল্প।’

‘কোনটা যে প্রথম প্রেম তা ঠিক বলতে পারব না, পেগ। কেননা প্রথম প্রেম মানুষের অনেকগুলোই হয়ে থাকে। পাঁচ বছর বয়সেও আমার একটি প্রেমিকা ছিল। freud না পড়লে জানতুম না যে ও আমার প্রেমিকা।’

পেগি বলল, ‘Freud একজন দৈবজ্ঞ বুঝি? তোমার হাত দেখে বলে দিলেন ও তোমার প্রেমিকা।’

সোম তার কান মলে দিয়ে বলল, ‘মুখখু! Freud-এর নাম শোননি।’

পেগি বলল, ‘আমি যে বিদুষী নই সে তো বলেইছি। লণ্ডনে গিয়ে তোমার ছাত্রী হব। কী বল?’

সোম বলল, ‘গল্পটা বলতে দাও। পাঁচ থেকে পনেরো বছর বয়স আমার জীবনের প্রাগৈতিহাসিক যুগ। ও-যুগের প্রেমগুলো গবেষণার বিষয়। আমার জীবনীকারের জন্য তোলা রইল। প্রেম করেছি এই যথেষ্ট, তাকে মনে রাখবার মতো অধ্যবসায় আমার নেই। যে প্রেমিকাটিকে অনায়াসে মনে পড়ছে তাকে ছোটোবেলায় অজস্র মার দিয়েছি, তাকে নিয়ে শখের মাস্টারি করেছিলুম কিন্তু সে যখন বারোয় পড়ল তখন আমাদের গরম দেশের প্রকৃতির চক্রান্তে সেই হয়ে উঠল অপূর্ব লোভনীয়।’

পেগি বলল, ‘ওমা, বারো বছর বয়সে?’

সোম বলল, ‘গরম দেশের দস্তুর ওই। ও দেশের হাওয়াতে মদ, আকাশে জাদু। তুমি আমি এক বিছানায় শুয়েও নিষ্পাপ আছি একথা যদি ওদেশের কাউকে বলি সে বলবে, ‘আমাকে গাঁজাখোর ঠাওরেছ?’

পেগি বলল, ‘অকারণে নিজেদের দেশের নিন্দা কোরো না, সোম। এদেশেও ঠিক ওই কথাই বলবে। নেহাত অন্যায়ও বলবে না, কেননা তোমার মতো ক-টা পুরুষ এদেশে আছে যে তোমার মতো জিতেন্দ্রিয়? এদেশের পুরুষগুলো সুন্দরী নারী দেখলে ভারি অনুগত হয়ে পড়ে, সোম। এত অনুগত হয়ে পড়ে যে যতক্ষণ না মিষ্টান্নের মতো মুখে পুরছে ততক্ষণ ছাড়ে না। অবশ্য এও মানতে হবে যে ভদ্রতার খাতিরে বিয়ে করেও বিয়ে করবার পরে বুনো না হওয়া অবধি অবিশ্বাসীও হয় না।’ তার শেষ কথাগুলিতে শ্লেষের আমেজ ছিল। সোম হাসল।

সোম বলল, ‘তোমার পাঁঠা তুমি যেমন করেই কাট, আমি কিছু বলব না। তোমার দেশ সম্বন্ধে তোমার মত হয়তো ঠিক। কিন্তু আমার সম্বন্ধে তোমার ওই ধারণাটা ভুল যে আমি স্বভাবত জিতেন্দ্রিয়। আমার চতুর্থ প্রেমের গল্পটা আগে বলব কি?’

‘না, না, না, পরে বোলো।’

‘তবে আমার সেই দ্বাদশবর্ষীয়া প্রিয়ার কথা বলে শেষ করি। সে যখন লোভনীয়রকম সুন্দরী হয়ে উঠল তখন আমার কাছে আসা ছেড়ে দিল। সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের স্বভাবত ভয় আছে বলেই হোক কিংবা দূরত্বের দরুনই হোক আমি যখন তাকে মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে তার বন্ধুনির বাড়ি যাওয়া-আসা করতে দেখতুম তখন আমার প্রথম বয়সের দুষ্টু ক্ষুধা বোবা হয়ে থাকত, আমি তার সঙ্গে কথা কইবার সাহস খুঁজে পেতুম না, পাছে কী বলতে কী বলে ফেলি।’

পেগি রঙ্গ করে বলল, ‘এদিকে আমার সঙ্গে তো তর্কপঞ্চানন বাক্যবারিধি।’

সোম বলল, ‘কতবার রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি, তার অপেক্ষায়। ভেবেছি আজ সে যখন তার সইয়ের বাড়ি থেকে ফিরবে, আমি বলব, ‘একদিন আমার সঙ্গে দেখা করবে?’ কিন্তু সে পাশ দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেছে, আমি পাষাণের মতো নির্বাক। তারপরে ঘরে ফিরে এসে পরদিনের বক্তৃতা তৈরি করে রেখেছি।’

পেগি বলল, ‘আমার জন্যে তৈরি করেছ?’

সোম বলল, ‘করেছি বই কী। যে-দিন প্রথম দেখা হয় সে-দিন। কিন্তু গল্পটা শোনো। একদিন আমি কপাল ঠুকে প্রতিজ্ঞা করে ফেললুম যে আজ তাকে মনের কথা বলবই। সেদিন সত্যি সত্যিই সে মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে আমার বক্তৃতা শুনল। বললুম, ‘তুমি সকলের চেয়ে সুন্দর। আমার বোনগুলো তোমার তুলনায় পেতনির মতো দেখতে।’ (পেগির হাস্য) এখন, তার সঙ্গে আমার বোনদের রেষারেষির ভাব স্বভাবতই ছিল। আমার একটি বোন তো আক্ষেপ করে বলতই, ‘দাদা নিজের বোনদের দেখতে পারে না, পরের বোনদের আদর করে।’ (পেগির হেসে গড়িয়ে পড়া) যাক, নির্দিষ্ট দিনে ও নির্দিষ্ট স্থানে মেয়েটি আমার সঙ্গে দেখা করল। একটু যদি ধৈর্য ধারণ করতুম তবে সেদিনকার ঘটনা ও আমার জীবন অন্যরকম হত। কিন্তু সৌভাগ্যে অস্থির হয়ে তাকে যেই বুকে টেনে এনেছি সে ভাবল আমি তাকে কাতুকুতু দিতে যাচ্ছি। সে ‘মা গো’ বলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দিল এক দৌড়।’

পেগি হাসির চোটে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘ও ডিয়ার!’ তার চোখের কোণে জল জমে উঠেছিল।

সোম বলল, ‘তার পরে আমি প্রেমে পড়া ছেড়ে দিয়ে বই পড়া নিয়ে খেপে গেলুম। ও বয়সে মানুষের হাজারো দিকে আকর্ষণ। ভাঙা হৃদয় ও ভাঙা হাড় দু-দিনে জোড়া লাগে। আর ওটা তো হৃদয়গত ব্যাপার ছিল না, ছিল শৌখিন দেহগত। (থেমে) দেহগত বলে এখন মনে হচ্ছে বটে, কিন্তু তখন কি তাই ছিল? কী জানি। অতীতকাল সম্বন্ধে আমরা অসংকোচে অবিচার করে থাকি, পেগ।’

পেগি বলল, ‘আমার তো অতীতকালই নেই। আমার কাল নিত্য প্রবৃত্ত বর্তমান।’

‘তুমি তাহলে একটা গোরু কি গাধা।’

‘অমন কথা বললে তো তোমাকে আস্ত খেয়ে ফেলব।’

‘কী দিয়ে খাবে? দাঁত দিয়ে তো? তোমার ওগুলো আসল দাঁত, না বাঁধানো দাঁত?’

‘কয়েকটা বাঁধানো। সত্যি, সোম, তোমার দাঁতের মতো দাঁত এদেশে হয় না। প্রথম দিনেই তোমার দাঁত দেখে আকৃষ্ট হয়েছি।’

‘কিন্তু এমন একসময় ছিল যখন আমার দাঁতে ব্যথা হয়েছিল। চুল পড়ে যাচ্ছিল, দু-একটা পাকা চুলও দেখা দিয়েছিল। চোখে জ্যোতি ছিল না, দেহ ছিল অবসাদগ্রস্ত। সেই সময় আমার জীবনে এলেন আমার দ্বিতীয় বাঞ্ছিতা। দেহে এতটা শক্তি ছিল না যে তাঁকে দেহ দিয়ে কামনা করব। তাই স্বভাবত আমি হলুম অশরীরী প্রেমিক—যাকে পন্ডিতেরা বলেন platonic lover, তা-ছাড়া উনিশ-কুড়ি বছর বয়সের ছেলেরা কেন কী জানি দেহের নাম শুনলে কানে আঙুল দেয়।’

পেগি রঙ্গ করে বলল, ‘তাই নাকি?’

‘হাঁ গো, তাই। কোন এক কাল্পনিক মানসীর পায়ে তাদের জীবন-মরণ বাঁধা। আমার মানসী একদিন তাঁর মার সঙ্গে আমাদের বাড়ি এলেন। তাঁরও তেমনি মুমূর্ষুর চেহারা! রোগের পান্ডুরতাকে আমি মনে করলুম অন্তরের আভা। পরিচয়ের ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমি তাঁর সঙ্গে Rossetti-র কবিতা Blessed Damozel পড়লুম! জান কবিতাটা?’

‘আমি কবিতা ভালোবাসি নে।’

‘কিন্তু আমার দ্বিতীয় প্রিয়া ভালোবাসতেন। স্বয়ং মিসেস ব্রাউনিঙের মতো চেহারা তাঁর। নিজেও কিছু ছাইপাঁশ লিখেছিলেন। কাজেই কাব্যচর্চাটা মন্দ জমল না। তারপরে তিনি চলে গেলেন আমাকে বেকার করে দিয়ে। আমার চিঠির জবাবে যেদিন তিনি আমার মাকে চিঠি লিখলেন আমার উল্লেখ করে সেদিন আমার সাধ গেল সে চিঠিখানাকে ছবির মতো বাঁধিয়ে রাখি। পরে তিনি আমাকে পোস্টকার্ড লিখে দাঁতের ব্যথায় সহানুভূতি জানিয়েছিলেন, তাই নিয়ে আমি এত উত্তেজিত হয়েছিলুম যে পাছে চিঠিতে জানালে তাঁর আত্মীয়দের হাতে পড়বে তাই মাসিকপত্রে কবিতায় জানালুম। সে কবিতা তাঁর চোখে পড়ল কি না জানিনে, মনে অশরীরী উন্মাদনা সঞ্চার করল কি না তাও জানিনে। কিন্তু একথা জানি তাই পড়ে আরেকটি মেয়ে আমার প্রেমে পড়ে গেল।’

পেগি বলল, ‘কী রোমান্টিক! কিন্তু সত্যি তো?’

সোম বলল, ‘সত্যি। মেয়েটি আমাকে চিঠি লিখে এমন শ্রদ্ধা জানাল যেমনটি আমাকে কেউ কোনোদিন জানায়নি। শ্রদ্ধা দাঁড়াল প্রেমে। চেহারা না দেখে প্রেম—তবু যেন সে আমাকে জন্মজন্মান্তরে দেখে এসেছে। আমি যত জানাই আমার রং কালো, আমার শরীর জীর্ণ, আমার দাঁত কনকন করে, আমার টাক পড়তে আরম্ভ করেছে, তার প্রেম তত উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। সে ভাবে কী বিনয়, কী মহত্ত্ব, দেহের প্রতি কবি-তপস্বীর কী অনাস্থাভাব! আমি যতই বলি আমার হৃদয় আমার মানসীকে দেওয়া, আমার সেই চোখে দেখা মুমূর্ষু মানসীকে, ততই আমার তৃতীয় প্রিয়া আমাকে রূপ দিয়ে জয় করতে বদ্ধপরিকর হয়। তার ফোটো আসতে লাগল প্রত্যেক ডাকে। রূপসি বটে। কিন্তু আমি কি দেহের রূপে ভুলি? আমি বলি ‘আর কাউকে দেহ দান করো, আমাকে ধ্যানভ্রষ্ট কোরো না।’ তার উত্তরে সে তার প্রতিজ্ঞা জানায়। ‘তোমাকেই দেব, অপরকে না’।’

পেগি রুদ্ধনিঃশ্বাসে বলল, ‘তার পরে?’

‘তারপরে এই আলোছায়ার খেলা চলল প্রতিদিনের ডাকে। আমি পালাই, সে পিছু নেয়। আমি ঘৃণা করি, সে শ্রদ্ধার বরাদ্দ বাড়িয়ে দেয়। সে এক মজার খেলা, তার তুলনায় ফুটবল হকি টেনিস কিছু নয়। আমার যেটুকু শারীরিক সামর্থ্য ছিল সেটুকু গেল। আমি একজনের উদ্দেশে লিখি কাঁদুনি-কবিতা, অপরজনকে লিখি উপদেশাত্মক চিঠি। ক্লাস পালিয়ে অপথে বেড়াই, রোজ রাত্রে ফুল তুলে বিছানায় ছড়াই, রামধনু রঙের পোশাক পরি, বাবরি চুল রাখি। বন্ধুদের সঙ্গে মিশি নে, সবাইকে ভাবি ঘোরতর সংসারী, শেলির পক্ষ নিয়ে ওয়ার্ডসওয়ার্থের ভক্তদের সঙ্গে লড়াই করি। সে এক বয়স গেছে!’—এই বলে সোম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।

পেগি বলল, ‘বেশি দিন আগে তো নয়, মাত্র কয়েক বছর আগে।’

সোম বলল, ‘মাত্র কয়েক বছর? যুগান্তর! এক একটি মাসে এক একটি বছর বাড়ে। সেই দু-টি বছরের আমি নিজেকে ক্রমে ক্রমে সকলের সমবয়সি ভেবেছি—যুবকের, প্রৌঢ়ের, বর্ষীয়ানের। সকলের সম্বন্ধে ভেবেছি—রবীন্দ্রনাথের, গ্যেটের, শেক্সপিয়রের। হয়তো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বছর সেই দু-টি। তোমার তেমন কোনো বছর নেই?’

‘আমার শ্রেষ্ঠ বছর প্রতিবছর, শ্রেষ্ঠ দিন প্রতিদিন।’

সোম বলল, ‘পাখিদের জিজ্ঞাসা করলে তারাও সেই কথা বলত। তুমি একটা নাইটিংগেল কি লার্ক।’

পেগি পুলকিত হয়ে বললে, ‘যাও!’

সোম বলল, ‘গোরু কি গাধা বললে রাগ কর, নাইটিংগেল কি লার্ক বললে খুশি হয়ে ওঠ—পশুর চেয়ে পাখি বড়ো হল কীসে? পন্ডিতেরা বলেন পাখিদের তুলনায় পশুরা আমাদের নিকটতর কুটুম্ব।’

‘তা বলুন। পশুদের মধ্যে কুকুরই যা মানুষের মতো, সিংহকেও শ্রদ্ধা হয়, বাকিগুলো নিতান্তই জানোয়ার।’

‘তোমাকে কুকুর বললে তুমি খুশি হবে?’

‘যদি বল ‘terrier’ কি ‘greyhound’ কি ‘sheep dog’ তা হলে খুশি হব। এমনকী যদি ‘pekinese’ বল তাহলেও কিছু মনে করব না, যদিও অত ছোটো কুকুর আমার পছন্দ হয় না। যে কুকুর বল সেই কুকুর হতে রাজি আছি কিন্তু পুরুষ কুকুর। মেয়ে কুকুর না।’

‘স্বজাতির প্রতি এত অবজ্ঞা?’

‘লুকিয়ে কী হবে বল? পুরুষরা আমাদের মধ্যে যে সৌন্দর্য যে মহিমা যে সুধা দেখে আমাদের তা নেই। বরঞ্চ পুরুষদের মধ্যে তা থাকতে পারে।’

‘আমার মধ্যেও?’

‘তুমি কারুর চেয়ে ছোটো নও, সোম।’

‘তবু তো তুমি আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে।’

‘তা নিয়ে মন খারাপ কোরো না, লক্ষ্মীটি। আমি তোমার সব লোকসান পুষিয়ে দেব, এদেশে যতদিন থাকবে তোমার সঙ্গিনী হব, ঘরনি হব, সোম। তুমি আমাদের বাড়ি উঠে এসো এবার, তোমার ওই ল্যাণ্ডলেডিকে ইস্তফা দিয়ে! মা তোমাকে পেয়ে খুশিই হবেন।’

‘তোমার বাবা নেই?’

‘না। যুদ্ধে মারা যান।’

‘ভাই নেই?’

‘না। যুদ্ধে মারা যায়।’

‘তোমার মনকেমন করে না?’

‘বছর বারো আগের কথা। তখন আমার বয়স মোটে দশ। মনে থাকলে তো মনকেমন করবে?’

‘বোন আছে?’

‘না।’

‘Poor darling!’

‘Poor কীসের, সোম? আমার স্বাস্থ্য আছে, চেহারাও নেহাত বিশ্রী নয় বোধ হয়, হলে তুমি প্রেমে পড়তে না। আমার চাকরিটাও ভালো, উন্নতির আশা আছে—’

‘কী চাকরি, পেগ?’

‘Selfridgeদের খেলনা বিভাগে কাজ করি। একদিন ওই বিভাগের ম্যানেজার হব। যেয়ো একদিন, তোমাকে দেশে পাঠাবার মতো পুতুল কিনিয়ে দেব। Gamageদের সঙ্গে আমাদের জোর প্রতিযোগিতা চলছে।…কিন্তু কোন কথার থেকে কোন কথায় এলুম? তোমার গল্পের খেই হারিয়ে গেল যে?’

সোম বলল, ‘থামো, ভেবে দেখি।…আমার তৃতীয়ার কাহিনি শুরু করেছি কি? করেছি? তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের বর্ণনা দিয়েছি কি?…দিইনি? তাই শোনো। যেদিন তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ সেদিন যাঁর সঙ্গে গেছিলুম তিনি তাঁর ও আমার উভয়েরই প্রিয় বন্ধু। আমার প্রিয়তম বন্ধু। দেখা হবার পর একটি ঘণ্টা আমরা পরস্পরের সঙ্গে কইবার মতো কথা খুঁজে পেলুম না, তিনিও বন্ধুর সঙ্গে কথা কয়ে সংকোচ কাটান, আমিও বন্ধুর সঙ্গে কথা কয়ে সংকোচ কাটিয়ে উঠি। এমনি করে সংকোচ যখন কতকটা কাটল তখন বন্ধুও ছিলেন চতুর, বললেন, আমি একটু কাজে বাইরে যাচ্ছি, খানিক পরে আসব।’ একটি ঘরে দু-টি মানুষ, আট ন-মাস ধরে তারা চিঠিপত্রে পরস্পরের অন্তরাত্মা পর্যন্ত দেখেছে, দু-জনের জীবনের সকল কথা দু-জনে জানে—বুঝতে পারছ, পেগ? তারা অপরিচিত নয় যে প্রথম দেখায় স্বভাবত সংকোচ বোধ করবে। চিঠিতে একজন আরেকজনকে ‘প্রিয়তম’ বলে সম্বোধন করে আসছে! তবু মুখোমুখি ‘আপনি’ বলবে, না ‘তুমি’ বলবে ঠিক করতে পারছে না। অদ্ভুত নয়?’

‘ভাগ্যিস আমাদের ভাষায় ‘আপনি-তুমি’র ভেদ নেই। নইলে পর্থকওলের সেই সকালটিতে দ্বিধায় পড়া যেত।’

‘সত্যিই!…আমাদের প্রথম কথাগুলি আমার মনে পড়ছে না। কিন্তু সেই সন্ধ্যাটি আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমরা একখানি তক্তপোষের উপর খুব কাছে কাছে বসেছিলুম। অন্ধকার হল। ঝি বলল, ‘আলো দিয়ে যাব?’ সে বলল, ‘না।’ আমি বললুম, ‘হ্যাঁ।’ বেশ মনে পড়ে সে আমাকে ছোটো ছেলেটির মতন করে খেজুর খাইয়ে দিয়েছিল। তেমন খেজুর তোমরা ইংল্যাণ্ডে পাও না, পেগ।’

‘যদি কোনোদিন পাই তোমাকে তেমনি করে খাইয়ে দেব, সোম।’

‘দিয়ো। কিন্তু সে আনন্দ আর ফিরে পাব না। তাকে যে প্রথম দর্শনেই কামনা করেছিলুম স্ত্রীর মতো করে। আর মজা এই যে প্রথম দর্শনেই সে আমাকে স্বামীর মতো করে কামনা করা ছাড়ল। তার রূপ আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিল, আমার কুরূপ তার কল্পনাকে ধূলিসাৎ করল। তারপর থেকে আমাদের সম্বন্ধ গেল উলটে। সে পালায়, আমি ধরতে ছুটে যাই। সে আলোছায়ার খেলা। কিন্তু যে ছিল আলো সে হল ছায়া, যে ছিল ছায়া সে হল আলো। আমি বলি, ‘প্রিয়তমা’; সে বলে, ‘বন্ধু’। অভিমানে আমার দেহ থেকে প্রাণ চলে যায়। আমি তার দেহ দাবি করি, সে আমারই শেখানো platonism আওড়ায়। বলে, মনের মিলনই হচ্ছে স্থায়ী মিলন, দেহের মিলনে কেবল গ্লানি ও অবসাদ।’

পেগি বলল, ‘কেমন জব্দ?’

সোম বলল, ‘আমারই শিল আমারই নোড়া, আমারই ভাঙে দাঁতের গোড়া। আমার মানসী হয়ে আমার কবিতার নায়িকা হতে চায়, আমার বনিতা হয়ে আমার শুষ্ক জীবন মুঞ্জরিত করতে বললে কান দেয় না। আমার স্তুতি তার ভালো লেগেছে, আমার স্পর্শ তাকে উদ্দীপিত করেনি। আমার কাব্যে অমর হবার লোভ আছে, আমার বংশকে অমর করবার বাঞ্ছা নেই। এ খেলা ক-দিন চালানো যায় বল? আমি ক্ষান্তি দিলুম।’

‘সে কী ভাবল?’

‘কাঁদল। মুক্তি দিতে অনিচ্ছুক হল। তার নেশা লেগেছিল।’

‘সে নেশা ভাঙিয়ে ভালোই করলে। ফ্লার্ট করা আমি দু-চক্ষে দেখতে পারি নে।’

‘আমি কিন্তু ফ্লার্ট করাকে একটা আর্ট মনে করে থাকি। আজকাল তো আমি কাব্য লেখা ছেড়ে দিয়ে তার বদলে ফ্লার্ট করা অভ্যাস করেছি।’

‘আমি ও-অভ্যাস ছাড়াব।’

‘সে দেখা যাবে। কিন্তু আমার চতুর্থ প্রেমের কাহিনিটা একবার শোনো। আমার উপর তোমার ঘৃণা হয় কি না বলো।’

‘ঘৃণা তোমার উপর যদি হয় তবে আমি তোমার কেমনতরো বোন? না, ঘৃণা হবে না।’

‘আচ্ছা গো আচ্ছা। আগে শোনো। তৃতীয়কে যখন ত্যাগ করলুম তখন আমার চেতনা হয়েছে যে শরীরের সামর্থ্য থাকাটা প্রেমের বেশ একটা বড়ো উপাদান। আমরা মুখে যাই বলি না কেন কায়মনে সম্ভোগপিপাসু। মশারা যেমন রক্তপিপাসু। এ বিষয়ে আমি স্পষ্টবাদী হতে শিখেছি অনেক দুঃখে, পেগ। ছিলুম গোঁড়া নিরাকারবাদী, এখন যে গোঁড়া সাকারবাদী হয়েছি তা নয়, এখন আমি উদারতম সমন্বয়বাদী।’

পেগ মাথা নেড়ে বলল, ‘ওসব আমার মাথায় ঢুকবে না, সোম।’

সোম তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘তোমাকে আমি বিদুষী করে তুলব, পেগ। কিন্তু ইংল্যাণ্ডে আমার মেয়াদ আর একটি বছর।’

‘মোটে?’

‘দুঃখ কী পেগ? আবার আমি আসব। হয়তো আবার ওই হোটেলে এসে এই ঘরে শোব।’

‘ভবিতব্যই জানে।’

‘ভবিতব্যকে আমরাই হওয়াই। ভগবানের প্রতিভূ আমরা।’

‘ভগবান আছেন কি না তাই ভালো জানিনে।’

‘তা হলে তোমার সঙ্গে তর্ক করব না, পেগ। ভগবান আছেন কি না এ নিয়ে অন্তত আড়াই হাজার বছর ধরে পন্ডিতেরা কথা কাটাকাটি করে আসছে। অতএব ভালোবাসার গল্পই চলুক যদিও রাত এখন তিনটে।’

‘তিনটে!’

‘তিনটে! এখন ঘুমোলে কাল ট্রেন পাবে না।’

‘গল্পই চলুক। কিন্তু ঘুম যা পাচ্ছে তোমাকে কী বলব!’

‘তুমি ঘুমোও, আমি জাগি।’

‘সে হয় না, ডিয়ার।’

‘এখনও অবিশ্বাস?’

‘ছি। তোমাকে অবিশ্বাস করতে পারি?’

‘এই দেখ, প্রমাণ হয়ে গেল যে আমার নখ দন্ত নেই, প্রত্যেক পুরুষসিংহের যা থাকা আবশ্যক। পুরুষকে নারী বিশ্বাস করবে এইটেই তো প্রকৃতির ইচ্ছাবিরুদ্ধ। স্ত্রীপুরুষের মধ্যে প্রকৃত সম্বন্ধ হচ্ছে শত্রুতার। বিকৃত সম্বন্ধ হচ্ছে বন্ধুতার।’

‘তর্ক রাখো। তর্ক করলে আমি সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ব। গল্প করে আমাকে জাগিয়ে রাখো, সোম।’

‘আচ্ছা তবে আমার দেহতন্ত্র প্রেমের গল্প বলি। কিন্তু আগেই তোমাকে সতর্ক করে দিই, প্রেম কথাটা এই ক্ষেত্রে কাম কথাটার সমর্থক। একটি মেয়ে আমাকে seduce করল। মেয়েমানুষে কখনো seduce করে শুনেছ?’

‘অমন মেয়ে এদেশে অগণ্য আছে।’

‘কিন্তু আমি এত ছেলেমানুষ ছিলুম যে একজন প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে তাই নিয়ে হাতাহাতি করেছি, বাক্যালাপ বন্ধ করেছি। তাকে বলেছি মিথ্যাবাদী, নারীদ্বেষী। তার অপরাধ সে বলেছিল যে পুরুষদের প্রস্তাবে মেয়েদের সায় থাকে বলেই আমাদের দেশে এত নারীহরণ হয়।’

‘এদেশে হয় পুরুষহরণ। তোমাকে কেউ একদিন পকেটে পুরবে, সাবধানে থেকো।’

‘আমি তো তা হলে কৃতার্থ হয়ে যাই। তবে নেহাত বেশ্যা-টেশ্যা হলে আমি নারাজ। ইংল্যাণ্ডে অবশ্য পুলিশের ভয়ে হাত ধরে টানে না, কিন্তু কন্টিনেন্টে ধস্তাধস্তি করেছে, তবু সায় দিইনি।’

‘সে তুমি বলে পারলে।’

‘আবার প্রমাণ হল যে আমার নখ-দন্ত নেই। আমি কাপুরুষ।’

‘ও ক্ষেত্রে কাপুরুষতাই পৌরুষ।’

‘যাক, আমার গল্পটা কতদূরে ফেলে এলুম। …যে আমাকে seduce করেছিল সে রূপসি ছিল না বলে তখন তার উপর রাগ করেছি। চরিত্রটি গেল, অথচ aesthetic আনন্দও পেলুম না—এ আমার জীবনের ছোটোখাটো একটা ট্র্যাজেডি।’

‘চরিত্রটি গেল, সোম!’ পেগি কাতর সুরে বলল।

‘যাবে না? তবে seduce করা বলতে কি তুমি একটা নিরামিষ ব্যাপার বুঝেছিলে?’

‘ছি ছি ছি ছি।’—পেগি সোমের কাছ থেকে সরে গেল।

সোম কাষ্ঠ হাসি হেসে বলল, ‘ঘৃণা করলে তো?’

পেগি কাতর সুরে বলল, ‘তুচ্ছ একটা মুহূর্তের শখ, তারই জন্যে বিলিয়ে দিলে নিজেকে?’

‘নিজেকে নয়, পেগ। নিজেকে বিলোনো যায় না। আমার স্বাস্থ্যের প্রয়োজন ছিল, অভিজ্ঞতার প্রয়োজন ছিল। তা ছাড়া সত্যিকারের চরিত্র কখনো ক্ষুধা মেটালে যায় না। ভূরিভোজন করলে যায়, তা মানি। আবার অনশন করলেও যায়। লোকে বলে সংযম করো। কিন্তু অনশনে তো সংযম নেই, সংযম ভোজনে। অসম্ভোগে তো সংযমের কথা উঠতে পারে না, সংযম সম্ভোগে। একথা লোকেও মানে, কিন্তু মন্ত্রপড়া স্ত্রী-পুরুষের বেলা। যারা মন্ত্র পড়েনি তাদের প্রতি ব্যবস্থা নিরম্বু একাদশী। অথচ একবার মন্ত্র পড়লে বাপ-মা বলেন, ‘নাতি চাই, নইলে মরতে পারছি নে।’ পাড়াপড়শিরা অন্নপ্রাশনের দিন গুনতে থাকে বিয়ের পরদিন থেকে, তারা চায় আরেক দফা ভোজ। Population ঠিক মতো বাড়ছে না বলে তোমার নিজের দেশের মাতব্বররা কেমন অধৈর্য হয়ে পড়ছেন, খবর রাখ?’

পেগি বালিশে মুখ গুঁজে বোধ করি চোখের জল ঠেকিয়ে রাখছিল। উত্তর দিল না। সোমের ইচ্ছা করছিল তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেয়—কিন্তু তাকে স্পর্শ করলে সে যদি আরও দূরে সরে যায়? সোম তাহলে কী উপায় করবে? যুক্তিতথ্য দিয়ে তো পেগির অশ্রু রোধ করা যায় না।

সোম প্রসঙ্গটাকে করুণ করে তুলল। অশ্রু দিয়ে অশ্রু রোধ করবে।

বলল, ‘সতী মেয়েদের দ্বার আমার কাছে চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে গেল, পেগ। একে আমি একটা ছোটো খাটো ট্র্যাজেডি বলে উপহাস করেছি একটু আগে, কিন্তু এই আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ট্র্যাজেডি।’

পেগির ভাব দেখে মনে হল সে কুতূহলী। কিন্তু সে তেমনি নীরব রইল।

সোম বলল, ‘আমার দেশে আমার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে অনেকবার। আমার দেশের বিবাহ-প্রথা তোমার দেশের মতো নয়। বিবাহযোগ্যা মেয়ের বাবা বিবাহযোগ্য ছেলের বাবাকে আবেদন জানান। ছেলের বাবা ছেলের মত জিজ্ঞাসা করেন। ছেলে একবার মাত্র মেয়েটিকে দেখে কিংবা একবারও না দেখে ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ বলে।’

পেগি ক্রমে ক্রমে আগের মতো সোমের কাছটিতে সরে আসছিল। তেমনি করে সোমের বুকের ওপরে বালিশ ও বালিশের ওপরে মাথা রেখে বলল, ‘দক্ষিণ সমুদ্রের অসভ্যদের মধ্যে অমন প্রথা আছে শুনেছিলুম।’

সোম বলল, ‘তোমার দেশের সুসভ্য রাজবংশেও অমন প্রথা ছিল, পেগ। ইউরোপে যখন আভিজাত্যের যুগ ছিল তখন ওই প্রথাই ছিল, অসভ্যতার নয়, আভিজাত্যের লক্ষণ।’

পেগি বলল, ‘মেয়ের বাবা মেয়ের মত জিজ্ঞাসা করেন?’

সোম বলল, ‘মেয়ে সাধারণত নাবালিকা। তার মত চাইলে সে লজ্জায় ‘না’ বলবেই তো। ও বয়সে ‘না’ মানে ‘হ্যাঁ।’ বাপ জোর করে বিয়ে দিয়ে দেন, জোর করে ওষুধ খাওয়ানোর মতো। ফলে মেয়ের শরীর মন ভালো থাকে, যদি না দুর্ভাগ্যক্রমে অল্পকালের মধ্যে বারংবার সন্তান হয়।’

পেগি বলল, ‘মা গো, আমি যদি তোমার ভারতবর্ষীয়া বোন হয়ে থাকতুম এতদিনে আমার তিন চারটি খোকা-খুকি হয়ে থাকত! ইস!’

‘হয়তো একটিও হবার আগে তুমি বিধবা হতে। বিধবার বিয়ে আমরা দিই নে, দিতে চাইলেও বর পাওয়া যায় না, সারাজীবন নিঃসন্তান হতে।’

‘এও কি আভিজাত্যের লক্ষণ, সোম? না নির্জলা অসভ্যতার?’

‘না গো, ওটা হল আধ্যাত্মিকতার লক্ষণ। কিন্তু ওকথা আজ থাক। কেননা তুমি খুব সম্ভব তর্ক করতে, ‘এক তরফা আধ্যাত্মিকতার মূল্য কী। বিপত্নীকরা তো নিঃসন্তান থাকেন না।’…বলছিলুম আমার দেশে সকলের বউ জুটবে, আমার কোনোদিন জুটবে না!’

‘কেন, সোম?’

‘আরও স্পষ্ট করে বলতে হবে? যাদের বিয়ে হয় তারা বিয়ের আগে প্রাণ খুলে কথা কইবার সুযোগ পায় না। তারা বড়ো জোর একবার চোখে দেখে পরস্পরকে; বাক্যালাপ যা করে তা বহু লোকের উপস্থিতিতে। কাজেই আমার জীবনের সকল কথা বিয়ের পরে বলতে হয়। তখন যদি আমার স্ত্রী বলেন, ‘‘কেন তুমি আমাকে false pretence-এ বিয়ে করলে। কোনো সতী মেয়েকে বিয়ে না করাই তোমার উচিত ছিল’’ আমি তার উত্তরে কী বলে আত্মসমর্থন করব? কাপুরুষের মতো বলব, ‘‘রানি আমার’’ একটা পাপ করে ফেলেছি বলে অনুতাপে আমার হৃদয় পুড়ে যাচ্ছে, তোমার ক্ষমাসলিল সেচনে শীতল করো?’ কখনো না। আমি অন্যায় করিনি যে অনুতপ্ত হব। যা করেছি on principle করেছি।’

আবার পেগি বালিশে মুখ গুঁজল। কিন্তু এবার সোমের বুকের উপরকার বালিশে।

সোম বলে চলল, ‘নিজের উপর যার কিছুমাত্র শ্রদ্ধা আছে সে বড়োজোর বলে, ‘একটা ভুলচাল দিয়েছি’ কিন্তু অনুতাপ করে মরে আত্মনিন্দুক আত্মঘাতীরা। আমার গায়ের চামড়ায় হাত দিয়ে দেখতে পার, পেগ, গণ্ডারের মতো মোটা। লোকনিন্দা আমার গায়ে লাগবে না। কিন্তু তা বলে নিজের নিরীহ স্ত্রীটিকে আমি ঠকাতে পারব না। ওইটেই আসল দুর্নীতি। স্ত্রীকে ঠকিয়ে তার দেহ-মন গ্রহণ করাটাই প্রকৃত ব্যাভিচার।’

পেগ মুখ তুলে বলল, ‘যাক, তা হলে বিয়ে তুমি করছ না কোনোদিন?’

সোম হেসে বলল, ‘ওকথা কি আমি বলেছি পেগ? আমি বলেছি সতী মেয়েরা আমাকে বিয়ে করবে না জেনে-শুনে। কিন্তু অসতী মেয়েরা প্রায়ই অনুদার হয় না। প্রায়ই বললুম—কারণ সন্ন্যাসীদের উপর অসতীদের পক্ষপাত আমি অনেক স্থলে লক্ষ করেছি।’

পেগির হৃৎস্পন্দন রহিত হয়েছিল বুঝি-বা। সোমটা যে এমন সর্বনেশে ছেলে, তাকে উদ্ধার করবার যে একেবারে আশা নেই, পেগি বোধ করি সেই কথা ভেবে মুহ্যমান হয়েছিল। সব মেয়ের মতো পেগির প্রচ্ছন্ন অভিলাষ ছিল যে সে কোনো একজন বা একাধিক পুরুষের Guardian Angel হবে। ফ্লার্ট করা একটা নিরীহ অপরাধ, সোম তা যত খুশি করুক। কিন্তু সেই অনুচ্চারণীয় পাপটা! ছি ছি ছি!

সোম কতকটা অনুমান করে বলল, ‘ভয় নেই, পেগ। আমার মন পাবার মতো অসতীও এত বড়ো পৃথিবীতে দুর্লভ। আর মন যাকে দিতে পারব না দেহও যে তাকে দেব না এও আমার পণ। ব্যতিক্রম হয়েছিল সেই মেয়েটির বেলা, কিন্তু তখনকার সেটা ছিল প্রতিক্রিয়ামূলক—Platonic love-এর অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া। তখন যদি অমনটি না ঘটত তবে আজকে রাত্রে এমনটি ঘটত না, পেগ। তোমার সতীত্বকে আমার আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছে সেই অসতী মেয়েটা।’

পেগি বলল, ‘তাকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।’

সোম বলল, ‘এবার আমার পঞ্চম প্রেমের বৃত্তান্ত বলে শেষ করি। পাঁচটা বাজে। একটু পরে হিলরা উঠবে!’

পেগি কান পেতে রইল।

সোম বলল, ‘তাঁর সঙ্গে লণ্ডনে সাক্ষাৎ। এক বন্ধুনির বাড়িতে। সেদিন আমি ভারতীয় পরিচ্ছদ পরে আগুন পোহাচ্ছি, কেননা ভারতীয় পরিচ্ছদ শীতের দেশের উপযুক্ত নয়।’

পেগি কুতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘সে কেমন দেখতে?’

সোম বলল, ‘দেখাব তোমাকে একদিন। কিন্তু দেখে মূর্ছা যেয়ো না। তাতে শরীরে সবটা ভালো করে ঢাকে না।’

পেগি বলল, ‘না ঢাকে তো ভারি আসে যায়।’

সোম বলল, ‘আগুন পোহাচ্ছি এমন সময় তিনি এসে আমাদের কাছে একটি কবিতা পড়ে শোনালেন, কবিতাটি একটি খুব অল্পবয়সি গরিবের মেয়ের লেখা, তার বাপ তার মাকে কি তার মা তার বাপকে ছেড়ে গেছে আমার মনে নেই। কবিতাটি বাস্তবিকই প্রতিভার পরিচয় দিচ্ছিল। কিন্তু কবিতাটির চেয়ে আমাকে আকৃষ্ট করছিল কবিতার পাঠিকাটি স্বয়ং। তাঁর চোখের চাউনি এ সংসারের নয়, তাঁর গলার সুর অন্য জগতের। তিনি যখন টুপিটা খুলে একপাশে রেখে দিলেন তখন দেখলুম তাঁর কেশ অবিন্যস্ত। তিনি যখন তাঁর কোট খুলে ফেললেন তখন দেখলুম তাঁর বেশ বিস্রস্ত। আমি বিস্মিত হচ্ছিলুম, কিন্তু সাহস করে ভাবতে পারছিলুম না যে তিনি হয় একটি জিনিয়াস নয় একটি পাগল; ওঘর থেকে অন্যেরা চলে গেলে পরে তিনি আমার কাছে সরে এসে আগুন পোহাতে লাগলেন। বললেন, ‘আপনি ইংরেজি কবিতা পছন্দ করেন কি?’ আমি বললুম ‘এক-শো বার’। বললেন, ‘আপনাদের Tagore-কে আমার ভালো লাগে। আচ্ছা Tagore-এর সঙ্গে আমার দেখা হয় না?’ বললুম, ‘হয় বই কী। যদি কখনো ভারতবর্ষে যান। কিংবা Tagore এদেশে কবে আসবেন সে খবর রাখেন।’ তিনি যে কেন Tagore-এর সঙ্গে দেখা করতে ব্যগ্র আমি আন্দাজ করতে পারিনি। তিনি বললেন, ‘কেউ না বুঝুক Tagore নিশ্চয়ই বুঝবেন। আমি ভগবানের খোঁজ পেয়েছি বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক উপায়ে।’ আমি বললুম, ‘সে কীরকম?’ তখন তিনি কাগজ পেনসিল নিয়ে Chart এঁকে অতি প্রাঞ্জল করে বোঝাতে লাগলেন এ যুগের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। বললেন, ‘লিখে উঠতে পারছি নে। লিখে উঠলে আপনাকে পড়তে দেব, দেখবেন অতীব সরল। অথচ এই নিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে এত চিন্তা এত অন্বেষণ এত তর্ক এত রক্তপাত!’ তারপরে সংবাদ পেলুম তিনি কিছুদিন পাগলাগারদে ছিলেন, তার আগে তাঁর fiance মারা যান, তার আগে তাঁর মা-বাবা। কবি যশ তাঁর ভাগ্যে জুটেছিল, কিন্তু কাব্যে মন দিতে পারেননি, একখানাও দর্শন, বিজ্ঞানের বই না পড়ে বৈজ্ঞানিক উপায়ে ভগবানকে আবিষ্কার করে চলেছেন। সেদিন যখন তিনি বিদায় নিলেন লক্ষ করলুম তাঁর কাপড় খুলে পড়ছে, সে দিকে লক্ষ নেই।’

পেগি বলল, ‘এমন ভোলা মানুষকে গারদ থেকে ছেড়ে দেওয়াই ওদের অন্যায় হয়েছিল।’

সোম বলল, ‘তার কারণ গারদের লোক তাঁর উপর অতিশয় প্রসন্ন ছিল। পাগলের মতো তাঁর স্বভাবে রাগ ছিল না, তিনি জিনিসপত্র ভাঙতেন না। কথাবার্তা কইতেন প্রকৃতিস্থ মানুষের মতো, তাঁর ভাব দেখে বোধ হত অতবড়ো যুক্তিশীল মানুষটার উপর সমাজ অবিচার করে পাগলত্ব আরোপ করেছে।’

পেগি বলল, ‘সে-কথা যাক। তোমার সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ কতদূর গড়াল?’

সোম বলল, ‘আমি দিন কয়েক বাস্তবিক ভেবেছিলুম তাঁর ভার নেব কি না। প্রেম পেলে ও দিলে তাঁর পাগলামি সারত, তিনি আবার আগের মতো কাব্যচর্চা করতেন, তাঁর chartখানা আমি পুড়িয়ে ফেলতুম। কিন্তু দিন কয়েক পরে কী ঘটল জান? তিনি তাঁর উপরতলার ঘরের জানালা দিয়ে গলে পড়লেন নীচের বাগানে। তখন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল প্রথমে হাসপাতালে ও পরে পাগলাগারদে। কাজেই আমার প্রেমের হল অকালমৃত্যু। গভীর আঘাত পেলুম, কিন্তু তা বলে নিত্যকার ফ্লার্ট করা বন্ধ রইল না।’

পেগি বলল, ‘তুমি খুব বেঁচে গেছ। পাগলের সঙ্গে থেকে পাগল হয়ে যেতে। আগুন নিয়ে খেলা করতে নেই সোম।’

সোম বলল, ‘কিন্তু পেগ, প্রেম মাত্রেই আগুন নিয়ে খেলা। সে আগুন স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানলে দাঁড়াতে পারে যেকোনো মানুষের জীবনে। ধন, মান, কুলমর্যাদা, পারিবারিক সামঞ্জস্য, জীবনের কাজ, সকলই সে পুড়িয়ে ছারখার করতে পারে। কিন্তু হাজার পুড়লেও যা সোনার মতো ঝকঝক করে তা আমাদের আত্মা। কোনো যুগে কোনো দেশে কোনো মানুষের প্রেম তার আত্মাকে ক্ষুদ্র করেনি, পেগ—হোক না কেন সে জিনিস প্রেম নামের অযোগ্য পাশবিক কাম।’

পেগি শান্তভাবে সোমের চোখে চোখ রাখল। দুই হাতে সে সোমের বুকের উপরকার বালিশটাকে জড়িয়েছে। তার সোনালি চুল, তার শুভ্র মুখখানি সচিত্র করেছে। তার চোখের কোলে অনিদ্রার চিহ্ন।

তখন ভোরের প্রথম আলো দেওয়ালজোড়া কাচের জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছে।

সোম পেগির চুলগুলিকে হাত দিয়ে ব্রাশ করে দিল। পেগি চোখ বুজে সোহাগ সহ্য করল। সোম হাত সরিয়ে নিলে আবার চোখ মেলল।

সোম হেসে বলল, ‘আর মায়া বাড়িয়ে কী হবে? তুমি আমার নও। আমার কালকের সন্ধ্যার সব চাল বেচাল হল, তুমিই জিতলে। এসো আমরা জানালার কাছে বসে ভোর হওয়া দেখি।’

আলস্য ভাঙতে পেগির খানিকক্ষণ লাগল। সে নৈশ পরিচ্ছদটাকে সম্বৃত করে চুলের ক্লিপদুটোকে খুলে ও এঁটে চোখে আঙুল বুলোতে বুলোতে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, জানালার স্ক্রিন তুলে দিল এবং জানালার কাচে বাতাসের পথ করে দিল।

সোম বলল, ‘বুকে মাথা রেখে ব্যথা ধরিয়ে দিয়েছ। বাইরে ব্যথা, ভিতরে ব্যথা, যেন একটা অপরটার সিম্বল!’

পেগি কথা বলল না। আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।

তখন পুব আকাশে রং ধরবার দেরি আছে। ছবি আঁকবার আগে ছবিকার তাঁর ক্যানভাসকে যেমন নির্বর্ণ করেন আকাশের দেবতা আকাশকে করেছেন তেমনি।

পেগি আনমনে সোমের একটি হাতকে নিজের কোলের উপর অতি ধীরে ধীরে টেনে নিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *