১. শেষের দিন

শেষের দিন

সমুদ্র, কিন্তু হ্রদের মতো নিস্তরঙ্গ। আর খালের মতো সংকীর্ণ। দু-দিকে স্লেটপাথরের উপর ঘেরাও-করা পোড়ো জমি। দু-দিকের জমি যেখানে এক হয়েছে সেখানে একটি অতি প্রাচীন দুর্গ, নর্ম্যান যুগের হবে! দুর্গের পাশ দিয়ে গ্রামের লোকে ঘোড়ায়-টানা কার্ট নিয়ে সমুদ্রের কূলে আসে, কার্টে বালি বোঝাই করে ফিরে যায়। তাদের বাদ দিলে জনমানব নেই। শুধু জলপক্ষীরা বিহার করছে।

পেগি উচ্ছ্বাস দমন করবার চেষ্টা করে বলল, ‘মনের মতো। না, তার বেশি। ইংল্যাণ্ডের সমুদ্রকূলে এত নির্জন জায়গা কখনো সম্ভব?’

সেই দেশবৎসলাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হল যে এটা দক্ষিণ ওয়েলস—ইংল্যাণ্ড নয়।

পেগি একটুও অপ্রতিভ হল না। বলল, ‘একই কথা। কিন্তু দেখো দেখো, এর উপরে জল এল কেমন করে? সমুদ্রের ঢেউয়ের অবশেষ?’

প্রকৃতি-মিলিত স্লেটপাথরের বাঁধ, তারই উপর পা ছড়িয়ে দিয়ে বসেছিল পেগি আর সোম। পা দুলিয়ে দিয়েও।

সোম বলল, ‘না গো, এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। সবটা জল গড়িয়ে পড়বার পথ পায়নি।’

‘বটে? আমি ভাবতেই পারিনি। তুমি কেমন করে পারলে?’

‘এ আর শক্ত কী! এত উঁচুতে কখনো ঢেউ উঠতে পারে—এক, ঝড়ের সময় ছাড়া? আর বৃষ্টির জল ছোটো ছোটো গর্ত থেকে কোন পথ দিয়ে গড়িয়ে পড়বে শুনি?’

‘তুমি বাস্তবিক চতুর।’

‘তোমার মুখে এই প্রথম প্রশংসার বাণী শুনলুম, পেগি।’

‘ওটা তোমার স্মরণশক্তির ভুল, সোম।’

‘আমার স্মরণশক্তির দোষ থাকলে ইংল্যাণ্ড অবধি আসা হয়ে উঠত না এ জন্মে। মেধাবী ছাত্র বলে সাধ্যাতীতকেও সাধন করতে পারলুম।’

‘ইস, কী অহংকার!’

‘মেয়েমানুষে খোঁচা দিলে পুরুষের অহংকার কেশর ফোলায়।’

‘ও মা, কী বিপদ! সিংহের মুখে পড়েছি।’

সোম হেসে বলল, ‘সিংহটি ভালো। তার মুখের কাছে নির্ভয়ে মুখ আনতে পারো।’

‘না, মশাই, অত দুঃসাহসী হয়ে কাজ নেই আমার।’

‘আমার আছে। আমার ক্ষুধা পেয়েছে!’

(কৃত্রিম ভয়ের ভঙ্গি করে) ‘আমাকে খাবে নাকি!’

‘যদি খাই, কে ঠেকাবে?’

‘চেঁচাব।’

‘কার্টওয়ালারা কখন চলে গেছে। চেঁচানি শুনে সুন্দর পাখিগুলোই শুধু উড়ে পালাবে।’

‘সমুদ্রে লাফ দিয়ে পড়ব।’

‘ডাঙার বাঘ জলের কুমিরও হতে পারে।’

(খিল খিল করে হেসে) ‘তা হলে কী করব বলো না, ‘ডারলিং, আকাশে উড়ে যাব?’

‘বলো, ‘হার মানলুম’। ছেড়ে দেব।’

‘কখনো না।’

‘কোনটা ‘কখনো না’? হার মানাটা, না, ছাড়া পাওয়াটা?’

‘দুটোই।’

‘জানি। মেয়েদের স্বভাব ওই।’

পেগি ওকথায় কান না দিয়ে সমুদ্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘দেখেছ! O Gee!’ (আবিষ্কারের আহ্লাদে)।

ছোটো ছোটো গুহা কতকগুলো!

সোম তখন তার ক্ষুধার কথাই ভাবছিল। বলল, ‘আরেকটু বড়ো গুহা হলে আমরা বাসা বাঁধতুম।’

‘সিংহ আর হরিণ?’

‘সিংহ আর সিংহী।’

‘তবু এতক্ষণে একটা শ্রদ্ধার বাণী শোনালে।’

‘ওটা তোমার স্মরণশক্তির ভুল, পেগ।’

‘উঃ, কী ভয়ানক স্মরণশক্তি তোমার!’

‘এই নিয়ে তুমি দু-বার আমাকে প্রশংসা করলে।’

‘পাঁচ দিনে দু-বারই অনেক। নইলে পুরুষমানুষেও বড্ড বাড় বাড়ে।’

‘আর মেয়েদের?’

‘মেয়েরা তো দু-বেলা প্রশংসা লুটছে। ওটা ওদের খোরাক। যতক্ষণ জোটে ততক্ষণ সহজভাবে নেয়; না জুটলেই ফ্যাসাদ।’

‘দাঁড়াও, আমি তোমার খোরাক বন্ধ করে দিচ্ছি।’

‘দোহাই, সোম, যতক্ষণ লণ্ডনে ফিরে না গেছি ততক্ষণ ভাতে মেরো না।’ (কপট ভয়ের সুরে)।

সোম বলল, ‘লণ্ডনে ফিরতে তোমার ইচ্ছে করে, পেগ?’

‘এমন জায়গা ফেলে’? কিন্তু কী করব, তোমার মতো প্রচুর ছুটি কিংবা রুটি তো আমার নেই। খেটে খেতে হয়।’

‘বিয়ে কর না কেন?’

‘কাকে? তোমাকে?’

‘আমাকে।’

‘ঠাট্টা করছ?’

‘সিরিয়াসলি বলছি।’

‘পাগল!’

‘পাগল নই, সিরিয়াস।’

‘অন্য কথা পাড়ো।’

‘তুমি জান না আমি কীরকম জেদি। আমার দেশে বলে ‘বাঙালের গোঁ।’

‘জান, তোমার সঙ্গে আমার পাঁচ দিনের আলাপ?’

‘এক দিনের আলাপকেও কেউ কেউ এক যুগের মনে করে।’

‘আবার এক যুগের আলাপকেও এক দিনে ভুলে যায়।’

‘আমি তেমন নই।’

‘এখনও তার প্রমাণ পাবার দেরি আছে।’

‘বোকা মেয়ে। বর পাচ্ছিলে, ঘর পাচ্ছিলে, খাটুনির থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছিলে—একটা তুচ্ছ কারণে হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেললে।’

‘একজনের কাছে যা তুচ্ছ অন্য জনের কাছে তা উচ্চ।’

‘তুমি মরো। আমার সব স্বপ্ন ভেঙে দিলে। ভেবেছিলুম লণ্ডনে যখন ফিরব তখন বউ নিয়ে ফিরব। তখন দু-জনে মিলে একটি ছোটো ফ্ল্যাট নেব, তুমি রাঁধবে আমি খাব, তুমি ঘরকন্না করবে আমি কলেজ করব। টাকার ভাবনা? আমি যা স্কলারশিপ পাই তাতে দু-জনের শাক-ভাত খেয়ে চলে যাবে!’

‘প্রথমত আমি শাক-ভাত খেতে চাইনে, দ্বিতীয়ত যা খাই তা নিজের পয়সায় খেতে ভালোবাসি।’

‘আমার হৃদয় যদি তোমার হয়, পেগ, আমার পয়সা কী অপরাধ করল?’

‘না, না, ওটা আমাদের একেলে মেয়েদের প্রিন্সিপল। স্বামীর টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজতে যেমন ঘেন্না করে স্বামীর টাকা দিয়ে নিজের অভাব মেটাতেও ঠিক তেমনি।

‘তোমরা একেলে মেয়েরা মরো। পৃথিবীতে সত্য যুগ ফিরে আসুক।’

(খিল খিল করে হেসে) ‘আমরা ম’লে তোমাদের বংশে বাতি জ্বলবে না গো।’ (একটু ভেবে) ‘না, তোমরা সেকেলে কুমারীদের বিয়ে করবে।’

‘ধেৎ!’

‘কেন, অসাধারণ কী করবে? আমি জানি আজকালকার অনেক যুবক মা-কাকিমার সমবয়সিদের বিয়ে করে শান্তি পায়। সেই সঙ্গে কিছু টাকাও।’

সোম বলল, ‘কটা বেজেছে সে খেয়াল আছে? না, আজ তোমার খাবার ইচ্ছে নেই?’

পেগি বলল, ‘এখান থেকে আমার উঠতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও, গ্রামে হোটেল নিশ্চয়ই আছে, আজকের মতো ঘর নাও।’

‘আর তুমি এই আকাশতলায় হাওয়ায় ভেসে-আসতে-থাকা ফেনা খেয়ে থাকবে?’

‘কেন, তুমি খাবার বয়ে দিয়ে যেতে পারবে না?’

‘আর শোবার? বিছানাও বয়ে দিয়ে যেতে হবে।’

‘উঃ, কী ভয়ানক তার্কিক!’

অগত্যা সোম বাসার আশায় একা চলল। গ্রামের খানিকটা সমুদ্রের কূলে যাবার সময় অতিক্রম করেছিল। গ্রামের ভিতর দিয়েই তো পথ। স্টেশন থেকে দুর্গ পর্যন্ত তার বিস্তার।

‘গুডমর্নিং, স্যার।’

‘মর্নিং। তুমি এই গ্রামের ফলওয়ালা?’

‘আজ্ঞে না, আমি পেমব্রোকের লোক। রোজ এগ্রামে মোটরে করে ফল বেচতে আসি।’

তার ভাঙা সেকেণ্ডহ্যাণ্ড মালবাহী মোটরখানার উপর আপেল, কমলালেবু, কলা ইত্যাদি সাজানো। সোম ভাবল, ভাব করবার সহজ উপায় পেগির জন্যে কিছু আপেল কেনা। আপেল খেতে ভালোবাসে বলেই বুঝি তার গাল দু-টিতে আপেলের রং।

‘বেশ, বেশ, চমৎকার গাড়িখানা। ফলের বাজার কেমন?’

‘ভয়ংকর মন্দা যাচ্ছে, স্যার। লোকে টিনে বন্ধ ফল কিনছে, বলছে টাটকা ফলের চাইতে খারাপ কীসে? টাটকা ফল তো দু-তিন সপ্তাহের পুরোনো। জাহাজে করে স্পেন থেকে, জ্যামাইকা থেকে আমদানি। নামেই টাটকা।’

সোম সহানুভূতি দেখিয়ে বলল, ‘আরে, লোকের কি ছাই বুদ্ধিসুদ্ধি আছে। ঠাকুমা-ঠাকুর্দাদের সেই সত্যযুগ আর নেই।’

‘ঠিকই বলেছেন, স্যার। তেমন সস্তার যুগ আর ফিরবে না। দোকানদারগুলো যেন ডাকাত হয়েছে। শুনলে বিশ্বাস করবেন না স্যার, একটা আপেলের দাম নিয়েছে তিন তিনটে পেনি।’

‘আমি তোমাকে তার বেশি দিতে রাজি আছি যে—কী তোমার নাম?’

‘বিল। বিল টমসন।’

‘বেশ নাম। দাও দেখি আমাকে ভালো দেখে চারটে আপেল।’ (তার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি ক্ষেপণ করে) ‘আমার গার্লের জন্যে কিনা।’

বিল কার্পণ্য করল না। ক্ষিপ্রতার সঙ্গে বাছা বাছা চারটে আপেল দিয়ে বলল, ‘আর কিছু চাই, স্যার?’

‘দাও, গোটা ছয়েক কমলা লেবু। আমার প্রিয় ফল!’

‘হবেই তো, হবেই তো। আপনি যে স্পেনদেশের লোক সে কি আমি জানিনে? হ্যাঁ, দেশ বটে স্পেন।’ (কমলা লেবু দিতে দিতে) ‘গেছলুম স্পেনের গা ঘেঁষে জিব্রালটার দিয়ে—মহাযুদ্ধের সময়। তখন আপনি খোকাবয়সি।’ (দিয়ে) ‘কিন্তু এখন তো আর খোকা নন। এখন আপনার গার্ল হয়েছে। আহা গার্ল!’ (সুর নামিয়ে) ‘অভয় দেন তো একটা কথা বলি। স্পেনের গার্লের মতো গার্ল আর হয় না’ (জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করতে লাগল, যেন ‘গার্ল’ মানে ‘রসগোল্লা’ বা ‘চকোলেট’!) ‘আর আমাদের ওয়েলসের মেয়ে। রাম, রাম! গায়ে যেন গরম রক্ত নেই, বরফ জল। কী বলে ওই যে ওই তারগুলোকে!’

‘টেলিগ্রাফের তার।’

‘না, স্যার, ওর ভিতরে আগুনের স্রোতের মতো যা বইছে—কী বলে ওকে?’

‘ইলেকট্রিসিটি।’

‘ইলেকট্রিসিটি। স্পেনের গার্লের ছোঁয়া লাগলে তিড়িং করে উঠতে হয়।’ (প্রদর্শন।) ‘আহা, সে দিনকাল গেছে, স্যার! যুদ্ধটুদ্ধও আর বাধে না।’

সোম বলল, ‘আচ্ছা বলতে পার, বিল, কাছে কোনো হোটেল পাওয়া যায়?’

‘হোটেল? এ গ্রামে হোটেল কবে হল? একটা inn আছে বটে। কী নাম—মনে পড়েছে, ‘The Elephant’! আপনাকে নড়তে হবে না স্যার, আমি নিজেই গিয়ে খবর দিচ্ছি।’ এই বলে সে সোমের জিম্মায় তার ফল (ও মাছ) ফেলে রেখে অত্যন্ত কাজের লোকের মতো দৃঢ় পদক্ষেপে অদৃশ্য হয়ে গেল।

গ্রামের পথটিও জনমানবশূন্য। ছোটো ছোটো মেয়েরা গল্প করতে করতে চলেছে। সোমকে দেখে তাদের কলরব মৃদু হয়ে গেল। তারা কৌতূহলী হয়ে একবার ফিরে তাকায়, একবার মুখ ফিরিয়ে নেয়। সোমের সঙ্গে চোখাচোখি হলে কী তাদের হাবেভাবে সংকোচ আর মনে মনে ফুর্তি। দুটি ছোটো ছেলে কী নিয়ে ঝগড়া করছিল, সোমকে দূরে পায়চারি করতে দেখে একেবারে বিস্ময়সূচক চিহ্ন।

বিল-এর সঙ্গে একটি ব্রাউন সুট-পরা ছোকরা এসে bow করে দাঁড়াল। সোম বলল, ‘এই যে, তোমাদের ওখানে ঘর খালি আছে?’

‘আজ্ঞে, সবে হোটেল খুলছি। একটা হোটেলের বড়ো অভাব ছিল এ গ্রামে। কিন্তু এখনও সব ক-টা ঘর সাজিয়ে তোলা হয়নি। সাজানো ঘর একটিমাত্র আছে।’

একটিমাত্র আছে! দু-তিন দিন আগে হলে পেগি ভারি আপত্তি করত। হলই বা দুই স্বতন্ত্র বিছানা। তবু পুরুষ মানুষের সঙ্গে এক ঘরে শোয়া? মা গো!

কিন্তু ঘটনাচক্রে দুই-বিছানাওয়ালা ঘরে তাকে শুতে হয়েছে কাল পরশু। তার ফলে তার কিছু পয়সাও বেঁচেছে। ধর্ম যে যায়নি তার সাক্ষী স্বয়ং ধর্ম।

সোম বলল, ‘উত্তম। তুমি দু-জনের আহারের আয়োজন করো। আমরা সন্ধ্যা করে আসব।’

কে যেন বলেছেন উচ্চ ভাবনা ভাবতে ভাবতে মানুষ উচ্চ হয়। সেই কথাটিকে জপমন্ত্র করেই বুঝি হোটেলওয়ালা একখানি খুদে বাড়ি সম্বল করে হোটেলের নাম রেখেছে, ‘Lion Hotel.’ অথবা প্রতিবেশী ‘Elephant’-এর সঙ্গে প্রতিযোগিতাবশত।

একটি রক্তমসি-অঙ্কিত সিংহকে পিছনের দুই পায়ের উপর দাঁড়িয়ে উদবাহু হয়ে থাকতে দেখে সোম বলল, ‘চিনতে পেরেছ?’

পেগি বলল, ‘পেরেছি। এইটেই Lion Hotel?’

‘না, গো। এই সেই সিংহের বিবর, যে সিংহ আজ ক্ষুধা বোধ করছিল।’

‘কী ভয়ানক চক্রান্ত! নিরীহ প্রাণী আমি, আমাকে আহার করবে বলে এ কোন অপরূপ হোটেলে এনে তুললে?’

ম্যানেজার বল মালিক বল সেই ব্রাউন রঙের সুট-পরা অল্পবয়স্ক যুবকটি দরজা খুলে দিল। এবং হ্যাট ও ওভারকোট খুলে নিল। তার সঙ্গে ছিল সেই ঝগড়াটে ছেলেদের থেকে একটা। এখন সে অত্যন্ত লক্ষ্মী ছেলেটি—বাপকে ভদ্রতা করতে সাহায্য করছে। তার মা-র উঁকি মারতে দেরি হল না এবং স্বামীর ডাক শুনে সে নেমে এল পেগির হুকুমের অপেক্ষা করতে।

মিস্টার ও মিসেস হিল। বাচ্চাটির নাম, বব।

‘আপনাদের ঘরে পৌঁছে দেব?’

‘না, আমরা লাউঞ্জ-এ বসব। লাউঞ্জ আশা করি আছে?’

‘আছে। কিন্তু তৈরি নেই, স্যার। আপাতত খাবার ঘরটাতে যদি বসেন।’

‘কী বল পেগি?’

‘তাই করি চলো।’

গদিওয়ালা চেয়ারের অভাবে বসে আরাম হচ্ছিল না। সোম বলল, ‘পেগ, এ হোটেলে এনে তোমাকে কষ্ট দিলুম। আর কোথাও যাবে?’

‘খেপেছ? আমরা কি এই ভেবে বেরোইনি যে যত অসুবিধেই ঘটুক কিছুতেই খিটখিট করব না?’

‘হিসেব যদি কর, অসুবিধে কি কম ঘটেছে এই পাঁচ দিনে? ভগবান! কবে লণ্ডনে ফিরে যাব, আরাম করে বাঁচব।’

‘কে তোমাকে ধরে রাখছে, সোম? আজই চলো না?’

‘সত্যি?’

‘সত্যি।’

‘তুমি একটি ছোটো মিথ্যুক।’

‘অমন কথা বললে নিজ মূর্তি ধারণ করব, সোম।’

‘ছিঃ। এই নিয়ে রাগ করে?’

‘না, তুমি যা-তা বলে ঠাট্টা করতে পারবে না আমাকে। মিথ্যুকের বাড়া গাল নেই।’

‘তুমিও আমাকে যা-তা বলো না? শোধবোধ হয়ে যাক।’

পেগির চোখে জল চক চক করছিল। সে তার উপর হাসির কিরণ ফুটিয়ে সোমের আরও কাছে সরে এসে বলল, ‘আচ্ছা, আমার উপর আর তোমার শ্রদ্ধা নেই?’

‘দুষ্টু পেগ!’

‘না, না, সত্যি বলো। তোমার কাছে আমি খুব সুলভ হয়ে গেছি, না?’

‘কীসে তোমাকে এমন কথা ভাবাল?’

‘আমি ছেলেমানুষ নই।’

‘কিন্তু ছেলেমানুষের মতো আবোল-তাবোল বকছ যে?’

‘ডারলিং সোম, সত্যি করো বলো তোমার চোখে আমি কতখানি নেমে গেছি।’

‘বলব?’

‘বলো।’

‘বলো।’

‘বলব?’

‘বলো।’

‘আমার উপর তোমার একান্ত নির্ভরতা আর আমার প্রতি তোমার একান্ত বিশ্বাসপরায়ণতা আমাকে তোমার চির-কেনা করেছে, পেগ ডারলিং।’

পেগি এইবার সশব্দ হাসি হেসে বলল, ‘ওসব নাটুকে কথা একেলে ছেলেদের মুখে মিথ্যে শোনায়, সোম। হয়তো তোমাদের ওরিয়েন্টাল মেয়েরা শুনে সত্য ভাবতে পারে।’

‘তবে তুমি কী শুনলে সন্তুষ্ট হবে, পেগ?’

‘এই দেখো, তুমি নিজ মুখেই স্বীকার করলে যে আমাকে সন্তুষ্ট করতে তুমি ব্যগ্র, সত্য কথা বলতে ব্যগ্র নও!’

‘তোমার আজ হয়েছে কী, পেগ? এত বিরূপ কেন? সোজা কথারও বাঁকা অর্থ করছ যে।’

‘তাতে তোমার ভারি তো আসে যায়!’

সোম সন্ধি করবার উপায় দেখল সকাল সকাল খেতে বসা। হিলকে ডেকে বলল, ‘আমরা তৈরি। অপর পক্ষ তৈরি কি না।’

হিল রসিকতাটা আঁচতে না পেরে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, ‘অপর পক্ষ কে, স্যার?’

‘আমরা খাদক, আমরা তৈরি। অপর পক্ষ খাদ্য, অপর পক্ষ তৈরি কি না?’

‘ওঃ হো হো—মাপ করবেন ম্যাডাম।’ সে হাসি চেপে বেরিয়ে গেল।

পেগি হাসতে হাসতে বলল, ‘কত রঙ্গ জান।’

সোম ভেবেছিল ক্ষুৎপিপাসার শান্তি হলে পেগির চিত্তশান্তি হবে। কিন্তু সে-গুড়ে বালি।

পেগি আরম্ভ করল, ‘তুমি আমার ইস্টারের ছুটিটা মাটি করলে। তোমাকে সঙ্গী করা আমার ভুল হয়েছে।’

সোম যথার্থ আহত হয়ে বলল, ‘তবে আমাকে যে দন্ড দেবে আমি সেই দন্ড নিতে প্রস্তুত আছি, পেগ।’

‘প্রাণদন্ড?’

‘দিলে নেব তাও।’

‘আবার সেই নাটুকে মিথ্যে। আমি দু-চক্ষে দেখতে পারিনে এই ভন্ডামি। সোজা বলো ‘না ওইটি পারব না।’ আমি খুশি হয়ে তোমাকে চুম্বন-দন্ড দেব।’

‘কিন্তু ও যে আমার হৃদয়ের পক্ষে সত্য।’

‘তবু তোমার জিজীবিষার পক্ষে অসত্য। ভরা যৌবনে কেউ মরতে চাইলেও তার প্রকৃতি তাকে মরতে দিতে চায় না।’

‘এই যে এত যুবক যুদ্ধে প্রাণ বিলিয়ে দিতে ছুটে গেল।’

‘ওটা একটা দারুণ অত্যুক্তি। পরের প্রাণ লুট করতেও গেছিল ওরা। শুধু মরতে নয়, মারতেও।’

‘তবু মরতেও তো?’

‘মারবার কথা মনে আনলে মরবার কথা তলিয়ে যায়। অন্তত দুই ঘুলিয়ে যায়। তোমাকে যে প্রাণদন্ড দিতে যাচ্ছিলুম সে যেন কোর্ট-মার্শালের হুকুমে দেয়ালের গায়ে পিঠ রেখে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বুকের মধ্যিখানে গুলি খাওয়া।’

সোম হেসে বলল, ‘দিতে যাচ্ছিলে? দিলে না তবে? আঃ, নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলুম।’

‘Live and let live-এর চেয়ে বড়ো ধর্মমত কী হতে পারে? তবু প্রতিদিন মানুষ এই তত্ত্বকে পদদলিত করছে।’

সোম কপট আক্ষেপের সুরে বলে, ‘সত্যি। মানুষের ভবিষ্যৎ ভেবে আমি হতাশ হয়ে পড়েছি, পেগি। বিশ লাখ বছর পরে পৃথিবী যদি বরফ হয়ে যায় আর এই মানুষ জাতটা যদি fossil হয়ে যায় তবে আমার ভাবনা যায়।’

পেগি কৌতুকবোধ করে বলল, ‘কত রঙ্গ জান! তোমার মতো লোকের রঙ্গমঞ্চে যাওয়া উচিত।’

‘তুমি যাও তো আমি যাই।’

‘তুমি আমার কী জান? রঙ্গমঞ্চে আমি দু-বছর কাটিয়েছি।’

‘ছেড়ে দিলে কেন?’

‘তোমারি মতো মানুষের জ্বালায়। তিন-শো পঁয়ষট্টি দিন তিন-শো পঁয়ষট্টি জন গায়ে পড়ে বলে, ‘‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমাকে বিয়ে করো।’’ শোনো একবার কথা। ভালোবেসেছেন তো মাথা কিনেছেন। সেই আহ্লাদে বিয়ে করে গলায় দড়ি দিই!’

‘এতক্ষণে জানলুম তোমার হৃৎপিন্ডটা নেই, কারুর কারুর যেমন ফুসফুস থাকে না।’

‘আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি তোমাকে। তুমি তো আমাকে বিয়ে করবার আবদার ধরেছ। কাল যদি ডাক্তার দেখে বলে, ‘‘এ মেয়ের একটা ফুসফুস নেই’’, তবে তোমার প্রেম কোথায় থাকবে?’

সোম উত্তর দিতে পারল না।

তাকে অপ্রস্তুত দেখে পেগির ফুর্তি বাড়ল। বলল, ‘এই তো পুরুষের—না, না, মানুষের—প্রেম। তোমার ফুসফুস না-থাকা তো দূরের কথা, তোমার একটা কান নেই দেখলে আমি তোমার ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করতুম।’

‘জলজ্যান্ত দু-দুটো কান দেখেও তো কান দিচ্ছ না প্রস্তাবে।’

‘দিচ্ছি নে? এইবার দিই। তুমি বলে যাও যা বলবার। বলো, ‘‘তোমাকে আমি প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি, মর্ত্যের চেয়ে, স্বর্গের চেয়ে, সম্মানের চেয়ে, এমনকী কমলা লেবুর চেয়ে’’।’

সোম পেগির দুই গালে দু-টি ঠোনা মেরে বলল, ‘আপেলের চেয়ে।’

‘বলো, ‘‘তুমি হেলেনের চেয়েও সুন্দর, তোমার জন্যে আমি ট্রয়ের যুদ্ধ জিততে পারি, হারকিউলিস-এর মতো বারো বার অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারি। কী না করতে পারি! কী না করতে পারি! তোমার ব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে সরে পড়তেও পারি’’।’

সোম আহত হয়ে বলল, ‘পেগি!’

‘মনে কষ্টবোধ করছ? কিন্তু এক পুরুষের পাপের ফল অন্য পুরুষকে ভুগতে হবে। সে হতভাগাকে তল্লাস করে পাইনি, তোমাকে পেয়েছি, তার প্রাপ্য শাস্তি তোমাকে দেব।’

‘হবুচন্দ্রের বিচার। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে।’

‘জীবনে তাই হয়ে থাকে। যে লোকটা আমার ব্যাগের উপর হস্তকৌশল দেখাল তার উপর দিয়ে হয়তো ডাকাতি হয়ে গেছে।’

‘ধন্য, ধন্য পেগি। আমি তোমাকে সামান্য তরুণী ভেবেছিলুম। তুমি জ্ঞানবৃদ্ধা। চাই কী দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক হতে পার।’

পেগি সোল্লাসে বলল, ‘তবে? বিয়ে করে আমার ভবিষ্যৎ মাটি করব? আমার ইচ্ছে আছে তোমার মতো কলেজে পড়াব। অবিশ্যি অবস্থার উন্নতি হলে।’

‘পেগ, আমি মত বদলাতে রাজি আছি। অর্ধং ত্যজতি পন্ডিতঃ। তুমি আর আমি দু-জনেই কলেজে যাব, ফ্ল্যাট নেওয়া নাই-বা হল, আমার ল্যাণ্ডলেডি তোমারও ল্যাণ্ডলেডি হবে।’

‘তোমার বয়স কত?’

‘তেইশ।’

‘এই বয়সে বিয়ের ভাবনা ভাব কেন?’

‘সকলেই ভাবে।’

‘অন্যায়। তিরিশ পর্যন্ত অ্যাডভেঞ্চার করতে হয়, তারপর বিয়ে।’

‘বিয়েটাও কি একটা অ্যাডভেঞ্চার নয়?’

‘যারা ও-কথা বলে তাদের বিয়ে করতে আমি চাইনে। বিয়ে আমার কাছে সেকরেড। একবার করলে শেষবারের মতো করলুম।’

‘তুমি রোমান ক্যাথলিক?’

‘আমি ননকনফরমিস্ট।’

‘তবে তোমার এ গোঁড়ামি কেন?’

‘গোঁড়া হলে তো আজকেই তোমাকে বিয়ে করতুম গো। নই বলে আরও আট বছর অ্যাডভেঞ্চারে কাটাব।’

সোম বলল, ‘তুমি মরো। আট বছর কেন আট মাসও আমার ধৈর্য থাকবে না। হয় কাল আমরা বিয়ে করব নয় কোনো দিন না।’

‘কাল তো আমরা লণ্ডনে ফিরছি। সারাদিন ট্রেনে।’

‘তবে পরশু লণ্ডনে।’

‘লণ্ডনে আমার ঠিকানা পাবে কোথায়? স্টেশনে আমাদের প্রথম দেখা, স্টেশনে হবে শেষ দেখা। ভিড়ের মধ্যে মাছের মতো তলিয়ে যাব।’

‘তা হলে আজকেই আমাদের বিয়ে।’

‘সে কী।’

‘আজ তোমাকে আমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে?’

‘বলপ্রয়োগ করবে নাকি?’

‘আমার ট্যাকটিক্স আমি ফাঁস করে দেব কেন?’

‘ট্যাকটিক্স আমারও আছে। এ-রকম লোকের হাতে এই প্রথম পড়িনি।’

‘বেশ। আমি বসে বসে আমার প্ল্যান কষি। তুমি বসে বসে তোমার অতীতকালের ব্রহ্মাস্ত্রে শান দাও।’

‘তা হলে কফির ফরমাশ করো। যুদ্ধে মরব কি বাঁচব জানিনে। তবু বল সংগ্রহ করে নিই।’

সোম টেবিল বাজাল। হিল ছুটে এল। ‘ইয়েস, স্যার?’

‘দু-পেয়ালা কফি। তোমার আর কিছু চাই?’

পেগি বলল, ‘আমার ওই যথেষ্ট। তোমার দরকার হয় তো আরও কিছু চাও।’

কফি খাওয়া চলতে থাকুক। ইত্যবসরে আমরা পাঠককে তার আগের দিনের ব্যাপার জানিয়ে রাখি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *