০৬.
আমার পরিচয়? না, দেবার মতো আমার কোনও পরিচয় আজ আর অবশিষ্ট নেই। পাড়ার ছেলে মেয়েরা আদর করে ডাকে ফতি পাগলী। সত্যি কথা বলতে কি আমি কিন্তু পাগল নই। যারা আমাকে পাগল বলে আসলে তারাই পাগল। এ সত্যি কথাটা ওরা জানে না।
বাবা-মা নাম রেখেছিলেন ফাতেমা। আমি প্রথম কন্যা সন্তান আমার জনকের। দাদি আদর করে বলেছিলেন দেখিস এ মেয়ে আমার বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। হযরতের কন্যা তো বিবি ফাতেমা। একটু বড় হয়ে নিজের নামের মাহাত্ম বুঝতে শিখেছি, একটু গর্বও ছিল সেজন্য। আমাদের বাড়ি ছিল খুলনা শহরের উপকণ্ঠে বর্তমান শিল্প শহর খালিশপুরের কাছে সোনাডাঙ্গায়। অবশ্য পাকা দালান নয়, কিছুটা ইট গাথা টিনের চাল। বেশ কয়েকটা আম, একটা কাঁঠাল, একটা চালতা আর একটা আমড়াগাছ ছিল। সেগুলোর জায়গা আমি এখনও দেখিয়ে দিতে পারি। কি যে বলি, এখানে তো এখন কয়েকতলা উঁচু বাড়ি। যাই হোক। বাড়িতেই লাউ, কুমড়া, শিম, পুঁই শাক সবই হতো। বাবা ছিলেন চাষী কিন্তু অন্যের ক্ষেতে কাজ করতেন না। তার নিজের জমির ধানেই পরিবার চলে যেতো। জমি ছিল শহর থেকে ৫/৬ মাইল দূরে। বাবা খুব পরিশ্রমী ছিলেন। জমির কাজে মজুর রাখতেন আর নিজে প্রতি হাটবার শাক সবজি, তরকারি এলাকা থেকে সস্তায় কিনে শনিবার আর মঙ্গলবার শহরের হাটে বিক্রি করতেন। তাতে যা লাভ হতো তা থেকেই ঐ হাট থেকে তিনি সপ্তাহের লবণ, মরিচ, সাবান, তেল ইত্যাদি কিনে আনতেন।
আমরা ছিলাম পাঁচ ভাই বোন। আমি বড়, তারপর তিন ভাই, সব ছোট একটি বোন, সবাই ডাকতো আদুরী। কারণ ভাইদের কোলে কোলে ও বড় হয়েছে। আর ছিলেন সবার মাথার উপর দাদি। দাদাকে আমি দেখি নি। তিনি আমার জন্মের আগেই মারা গেছেন। বাবা একমাত্র ছেলে, তার আর কোনও ভাই-বোন নেই। একটি ছিমছাম সুখী পরিবার। আদুরী ছাড়া আমরা সবাই স্কুলে যেতাম। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সবাই দুধভাত খেতাম, তারপর ছুটতাম খেলতে। পাড়ার মেয়েরা মিলে দৌড় ঝাঁপ করতাম। ছুটির দিনে পুকুরে বাজি ধরে এপার ওপার করতাম সবাই। ওঃ আমার চোখে পানি ও সব কথা ভাবলে পানি যে আপনিই আসে আপারা, বাঁধ মানে না। মাঝে মাঝে বাবা আমাদের শহরে নিয়ে যেতেন সিনেমা দেখাতে। উল্লাসিনী সিনেমা, পিকচার প্যালেস ওঃ সে সব কি বই দেখেছি।
এভাবেই চলছিল জীবন। আমি যে বছরে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবো সে বছরে শুরু হলো গোলমাল। আমরা মেতে গেলাম। পাকিস্তানিদের গোলামি আর করবো না। আমাদের দেশ থেকে দস্যুরা সব কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের পাট বিক্রি করা পয়সা দিয়ে ওরা ইসলামাবাদে স্বর্গপুরী গড়ে তুলেছে আর আমরা দিন দিন গরীব হয়ে যাচ্ছি। এসব কথা বলবার জন্য শেখ মুজিবকে জেলে ধরে নিয়ে গেল সঙ্গে আরো মিলিটারী বাঙালি অফিসার ও রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করলো। বললো, শেখ মুজিব ভারতের সঙ্গে যোগসাজসে পাকিস্তান ধ্বংস করতে চেয়েছিলো। মামলার নাম হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। বাব্বা সে কি মিটিং, মিছিল, বক্তৃতা, শ্লোগান। সবাই ভুলে গেলাম। বাবা পর্যন্ত মাঝে মাঝে হাটবারে তরকারি বেচতে যেতেন না। বলতেন ফাতেমার মা, শেখ মুজিবের যদি ফাঁসি হয় তাহলে আমাদের বেঁচে থেকে লাভ কি? ঢাকায় ছাত্ররা সব কিছু ওলট-পালট করে ফেলেছে। তারপর একদিন-উঃ সে কি আনন্দ শেখ মুজিব ছাড়া পেয়েছেন। সবাই তার গলায় ফুলের মালা পরিয়েছে। খুলনা শহরেও সে কি আনন্দ উৎসব। পুলিশ সব দূরে দাঁড়িয়ে দেখলো, কাছে এলো না। মনে হলো ওরাও খুশি।
পাড়ার দুচারজন মুরুব্বি গোছের লোক বলতেন ফাতেমা একটু রয়ে সয়ে চলো। মেয়ে মানুষের এতো বাড়াবাড়ি ভালো না। যেদিন পুলিশ মিলিটারী ধরবে, সেদিন বুঝবে। দু’হাতের দুটো বুড়া আঙুল দেখিয়ে বলতাম, বিবি ফাতেমাকে ধরা অতো সোজা না, আপনারা ঠিক থাকবেন, তাহলেই হবে। আমার পরের ভাইর নাম সোনা মিঞা। ওর বয়স চৌদ্দ বছর। তারপর মনা, আর সব শেষে পোনা। ওরা দু’বছর পর পর। ওরাও আমাদের মতোই ক্লাস আর করে না। সোনা আর মোনা বড় বড় ছেলেদের পেছনে নিশান হাতে দৌড়োয়। তারপর আস্তে আস্তে সব শান্ত হলো। আবার আমরা পড়াশুনা শুরু করলাম। কিন্তু আমরা একটু অস্বস্তিতে ছিলাম। কাছেই খালিশপুরে বিহারী ভর্তি। ওরা সব সময়েই কেমন যেন দাম্ভিক ব্যবহার করতো। বড় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতো। একবার তো রায়ট লেগে গেল, মরেছিলও অনেক লোক। রায়টটা হয়েছিল শ্রমিকদের ভেতর। তাই আমাদের একটু সাবধানে থাকতে হতো। এবার এলো নির্বাচনের পালা। সে কি আনন্দ, সব ভোট বঙ্গবন্ধুর। তখন আর তিনি শেখ মুজিব নন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মিটিং করতে খুলনা এসেছিলেন, এক নজর দেখবার জন্য আমরা সব ভেঙে পড়েছিলাম। গান্ধী পার্কে দেয়ালের ওপর চড়ে এক নজর দেখেছিলাম তাকে। উঃ সে আমি ভুলতে পারবো না। চারদিক থেকে গেছো মেয়ে, গুণ্ডা মেয়ে করে চেঁচাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছি তবুও বঙ্গবন্ধুকে না দেখে নামছি না। আর নামলেই-বা কি? লাফ দিলেই তো কারও না কারও ঘাড়ে পড়বো। উঃ সে কি উত্তেজনা। মনে আছে মা বল্লো, কি হলো, আজ যে ভাত খেলি না। হেসে বললাম- মা আমার পেট ভরে গেছে খুশিতে। তোমার জন্য দুঃখ হচ্ছে মা, তুমি বঙ্গবন্ধুকে দেখলে না। আর কি চোখ মা…। থাক হয়েছে, ওঠ এবার।
হয়ে গেল নির্বাচন। বঙ্গবন্ধু হবেন এবারের সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ইঃ দেখবো এবার এই বিহারীর বাচ্চাদের। ওই নাসির কথায় কথায় বলে বাঙালি কুত্তা। দেখবো কে কাদের কুত্তা। কিন্তু এখন তো আর সবুর সইবে না, কিছুই ভালো লাগছে না। পরীক্ষাটাও আবার সামনে। আমি জানি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হলে এ বছর আর পরীক্ষা দেবো না শুধু আনন্দ আর ফুর্তি। পার্লামেন্ট বসছে না। ভুট্টো ঘোরাচ্ছে। পরিস্থিতি ভালো না। বেশ কয়েক জায়গায় গুলি চলেছে। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করলেন। সব বন্ধ। হাসপাতাল, পানি, বিদ্যুৎ ব্যাংক ছাড়া সব বন্ধ। বঙ্গবন্ধু বলেছেন ওদের আমরা ভাতে মারবো, পানিতে মারবো। ভুট্টো সাহেব এলেন সদলবলে, মিটিং করলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে, তারপর ছেড়ে গেলেন পূর্ব পাকিস্তান চিরকালের জন্য।
২৫ মার্চ পাকিস্তানের সকল বন্দুক, কামান, ট্যাঙ্ক, গর্জে উঠলো বাঙালি হত্যার। জন্য। যতোক্ষণ ঢাকার সঙ্গে টেলিফোন যোগাযোগ ছিল সব জানা গেল। তারপর শুধু গুজব আর গুজব। পরে জানলাম, যা ঘটেছে গুজব সেখানে তুচ্ছ। বঙ্গবন্ধু বন্দি হলেন। তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেল বিচার হবে। দাঁত কিড় মিড় করে ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণ দিল। বিহারীরা গর্জে উঠলো। আমরা সব বাড়িঘর ছেড়ে পালাবো ঠিক করলাম। কলেজ হোস্টেলের ছাত্ররা সব চলে গেল। কেউ কেউ ওদের হাতে পড়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো। মিলিটারি আসছে। বিহারীরা স্লোগান দিচ্ছে, নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর। সামনে যা পেলাম নিয়ে সবাই গ্রামমুখী হলাম। কিন্তু নাসির আলীর হাত থেকে মুক্তি পেলাম না আমি আর পোনা। পোনাকে কোলে নিয়ে, আমি দৌড়োচ্ছিলাম, তাই সবার পেছনে পড়েছিলাম। ধরে ফেললো আমাকে, আমার গায়ের জোরও কম না। ওর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছি দেখে হঠাৎ পোনাকে তুলে একটা আছাড় দিলো। ওর মাথা ফেটে মগজ বেরিয়ে গেল। আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। নাসির আরও দু’তিন জনকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চললো ওদের বাড়ির দিকে। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাসা দেখছে। বাহাবা দিচ্ছে কেউ কেউ। আমি শুধু বোবা চোখে তাকিয়ে দেখছি। অবশ্য এদের মধ্যে বাঙালি ছিল কিনা আমি দেখি নি তবে আজ মনে হয় নিশ্চয়ই ছিল, তা না হলে আমাদের
আপা, ফাতেমা মরলো, ওই দিনই, ওই বস্তিতেই। বাপ ছেলে একই মেয়ের ওপর বলাক্কার করেছে শুনেছেন আপনারা? ওই পিশাচরা তাও করেছে। আমি একা নই আমাদের সোনাডাঙ্গা গ্রাম থেকে মা মেয়েকে এনেছে এক সঙ্গে, দু’জনকে পরস্পরের সামনে ধর্ষণ করেছে। হায়রে পাকিস্তানি সেনারা, কোথায় ছিল তখন তারা। তারা যখন আমাদের পেয়েছে আমরা তখন সবাই উচ্ছিষ্ট। চার-পাঁচদিন পর আমাদের একটা খোলা ট্রাকে করে যশোর নিয়ে এলো। আমরা দুহাতে মুখ ঢেকে বসেছিলাম। জনতা হর্ষধ্বনি দিচ্ছিলো। চোখে দেখি নি, কিন্তু মেয়ে মানুষের গলাও শুনেছি। জানি আপনারা বিশ্বাস করবেন না। কি করে করবেন? নিজেরা অমন বিপদে পড়েননি? আমার গা টা কেঁপে উঠলো। সত্যিই তো এমন বিপদের মুখোমুখি তো ছিলাম তবুও কিন্তু আল্লাহু বাঁচিয়েছেন? কি বললেন আপা, আল্লাহ্ বাঁচিয়েছেন। একটু তীর্যক হেসে ফাতেমা বললো, আল্লাহ্ কিন্তু বড় লোকের ডাক খুব শোনেন, গরীবের দিকে কান দেবার সময় কোথায়? ওর ম্লান হাসি দেখে মনে পড়লো একাত্তরে অসহযোগ আন্দোলনের সময় মীরপুরের বিহারীরা কিছু ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলো। আমার একটি ছোট নাতনি তার বাবা-মার সঙ্গে দ্বিতীয় রাজধানীতে ছিল। আমাকে ফোন করে ভয়ে কাঁদছিল। আমি বললাম, নানু আল্লাহকে ডাকো। ও আরো জোরে কেঁদে উঠে বললো, নানু আল্লাহ্ বাংলা বোঝেন না। কতো ডাকছি শোনে না। মনে হলো লীনার অসহায় শিশুকণ্ঠ আমি আবার শুনলাম। আপা সারাদিন রাত আল্লাহকে ডেকেছি, কি লাভ হয়েছে? আজ আমার খেতাব ফতি পাগলী। যশোরে নামমাত্র মূল্যে আমরা বিক্রি হলাম। অর্থাৎ নাসির আলী হয়তো কারো হাতের পিঠ চাপড়ানো পেয়েছিল। দৈহিক নির্যাতন সয়ে এসেছি। পাকিস্তানি সৈন্য দেখলে ভয় করতো কিন্তু ওদের ভেতর ভালোমন্দ ছিল। কিন্তু নাসির আলীরা সত্যিই বেঈমান, কুত্তার বাচ্চা। অবশ্য জানেন আপা, সোনা আর তার সঙ্গের মুক্তিযোদ্ধারা নাসিরকে টুকরো টুকরো করেছে, কিন্তু ওদের দুঃখ কুকুর ধরে এনেছিল কিন্তু কুকুর ওর গোশত খায় নি। আপা, কুকুরেরও একটা জাত বিচার আছে। ওরা তো মানুষ না, তাই রক্ষা।
এখানে খাওয়া দিতো। ডাল, রুটি, ভাজি, রুটি আর সকালে চা-ও রুটি খেতাম। জানেন, মায়ের দেওয়া দুধ ভাত ফেলে দিয়েছি। কিন্তু শত্রুর দেওয়া জঘন্য খাবার পেট পুরে খেয়েছি। কারণ আমি ঠিক করেছিলাম আমি বাঁচবো, আমাকে বাঁচতে হবে এবং পোনার হত্যার প্রতিশোধ আমি নেবো। আমার তো সবই গেছে, আছে শুধু জানটুকু। এটুকুই আমি পোনার জন্য জিইয়ে রাখবো। যদি কখনও ছাড়া পাই ওই নাসিরকে আমি দেখে নেবো। তবে আমার কেন জানি না বিশ্বাস ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হবে, বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবেন। কিন্তু যখন ভাবতাম আমি আর ওদের মাঝে ফিরে যাবো না, বিজয়ী বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পারবো না তখন চোখ ফেটে পানি আসতো, বুক ভেঙে যেতে চাইতো। কিন্তু আপা, আমি পেয়েছি। ঢাকায় সোনা আমাকে দূর থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখিয়ে এনেছে কিন্তু তখন কেন যেন আমার মনে হলো বঙ্গবন্ধুর চোখের আগুন অনেকটা নিভে এসেছে। হয়তো-বা দেশ স্বাধীন হয়েছে এখন সর্বত্রই শান্তি দরকার। সোনা সেনাবাহিনীতে কাজ পেলো, মনা কলেজে ভর্তি হলো। কিন্তু আমি?
যশোরে আমাদের একটা ব্যারাক মতো লম্বা ঘরে রাখলো। অনেক মেয়ে ২০/২৫ জনের কম না। সবাই কিন্তু খুলনার না! বরিশাল, ফরিদপুর, যশোর এসব জায়গারও ছিল। তবে বেশির ভাগই আমার চেয়ে বয়সে বড়। একটাই মাত্র ১৪/১৫ বছরের বাচ্চা মেয়ে ছিল। খুব ফিস ফিস করে কথা বলতে হতো। দু’পাশের দরজাতেই পাহারাদার, আর শকুনীর মতো জমাদারণীগুলো তো ছিলই। তবুও মনে হতো এরা নাসির আলীর চেয়ে ভালো। নাসিরের লোকজন আমাকে সমানে পিটিয়েছে, দেখে দাঁত বের করে হেসেছে। পানি পানি করে চিৎকার করলে মুখে প্রস্রাব করে দিয়েছে। আমি কখনো ভাবতেও পারি নি মানুষ নামের জীব এমন জঘন্য হতে পারে। পরে অবশ্য বুঝেছি আগুন থেকে তপ্ত কড়াইয়ে পড়েছি। একটা নারীদেহ যে এমন বীভৎসভাবে বিকৃত উপভোগ্য হতে পারে তা বোধ হয় মনোবিজ্ঞানীরাও জানে না। অতগুলো মেয়ে এক সঙ্গে। শেষে মনে হতো আমরা সবাই ঘৃণা, লজ্জা, ভয়কে জয় করে ফেলেছি। একদিন এমন একটা কুৎসিত ঘটনা ঘটলো যা আপনাকে আমি কি করে বলবো ভেবে পাচ্ছি না। তবুও বলতে হবে, কারণ মানুষ না হলে জানবে না এই ফতি পাগলী তার দেশের জন্যে কি নির্যাতন সহ্য করেছে। একটা হিংস্র সিপাই ছিলো, সবার সঙ্গেই খারাপ ব্যবহার করতো। আমার সঙ্গে অতিরিক্ত দুর্ব্যবহার করতো। কারণ আমি জানি না। হয়তো-বা আমার দৃষ্টিতে ঘৃণা থাকতো বা অন্য কিছু। পাশ দিয়ে গেলেই একটা লাথি ছুঁড়ে দিলো। অখবা মাথায় একটা চাটি মারতো। চুপ করে সইতে হতো কারণ এর তো কোনও প্রতিকার নেই।
লোকটা একদিন মনে হলো নেশা করে এসেছে, ইসলামে নাকি মদ্যপান নিষিদ্ধ ও সব আইন কানুন এই মেনীমুখো বাঙালি মুসলমানদের জন্যই প্রযোজ্য। ওদের অনেককেই আমি মাতাল অবস্থায় দেখেছি। অফিসাররা তো নিয়মিত ক্লাবে বাড়িতে সর্বত্রই মদ খেতো। সিপাইরা আলাপ করতো।
একদিন পাড় মাতাল হয়ে এসে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমাকে উলঙ্গ করে কামড়ে খামচেও ওর তৃপ্তি হলো না, ওর পুরুষাঙ্গটা জোর করে আমার মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিলো। আমি নিরুপায় হয়ে আমার সব কটা দাঁত বসিয়ে দিলাম। লোকটা যন্ত্রণায় পশুর মতো একটা বীভৎস চিৎকার করে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দিলো। আমি জানি আজই আমার শেষ দিন। আমাকে টেনে নিয়ে আমার পরনের লুঙ্গিটা দিয়ে আমার চুলের ঝুটি বেঁধে চেয়ারের ওপরে দাঁড়িয়ে পাখার সঙ্গে লটকে দিয়ে সুইচ অন করে দিলো। কয়েক মুহূর্ত চিৎকার করেছিলাম। তারপর আর জানি না, অন্য মেয়েরা বলেছে প্রথমে জানোয়ারগুলো হেসে উঠেছিল কিন্তু ভয়ে মরিয়া হয়ে মেয়েগুলো চিৎকার করায় বাইরে থেকে এক সুবেদার এসে পাখা বন্ধ করে দেয় ও আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ঘটনাটা জানাজানি হয়ে যায়। ওই পটার কোর্ট মার্শাল হয়, তারপর আর ওকে দেখি নি। ৩/৪ দিন হাসপাতালে ছিলাম মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে। কিন্তু জ্বর ছেড়ে দিতেই আমাকে আবার ওই ব্যারাকে পাঠিয়ে দিলো। অবশ্য কয়েকদিন আমার উপর কোনও নির্যাতন করে নি ওই পশুরা। কিন্তু আবার যথাপূর্বম তথা পরম।
বাইরের কোনও খবর পেতাম না। কিচেন থেকে একটা ছোকরা আমাদের খাবার দিয়ে যেতো। বয়স বছর কুড়ি হবে। বলতো, আপামণি কয়টাদিন একটু সয়ে থাকেন যা মাইর খাচ্ছে এরা বেশি দিন টিকবে না। কিন্তু ভয়ে বিশেষ কিছু বলতে পারতো না। এই লাঞ্ছিত মেয়েগুলোও কূটনামীতে কম যেতো না। এমনি করে একটা জমাদারণীর নামে লাগিয়েছিল একটা মাগুরার মেয়ে। জমাদারণীটাকে নাকি শেষ পর্যন্ত মেরেই ফেলেছিল। ওই মেয়েটার সঙ্গে আমরা কেউ কথা বলতাম না, কিন্তু খুব ভয় পেতাম যদি বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলে। কিছুদিন পর ওকে অন্য কোথাও নিয়ে গেল। আমরা কিছুটা ভয়মুক্ত হলাম। কতোদিন হবে জানি না তবে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে। ভোররাতের দিকে কম্বল পায়ে দিই। আশ্বিন মাসে হবে বোধ হয়। একদিন আমাদের দুজনকে নিয়ে গেল। আমার কেন জানি না মনে হলো। যশোর থেকে কিছু লোকজন সরিয়ে ফেলবে। কারণ এটা তো ভারতের সীমান্ত। আগে কলকাতা যাবার সময় দেখেছি একটা বাশ টানা দিয়ে দুদেশ ভাগ করা। কে জানে কি হচ্ছে বাইরে? আমাদের রাতে নিয়ে এলো তাও চোখ বেঁধে। যেখানে এলাম মনে হয় শহরতলীতে, লোকজন গাড়ি ঘোড়ার আওয়াজ নেই। অবশ্য সেটা বোধ হয় ভোররাত ছিল। সকালে দেখলাম গ্রামের মতো। ঘরে চারটে জানালা ছিল। কিন্তু অনেক ওপরে। ওগুলো দিয়ে আলো বাতাস আসে, কিন্তু বাইরের জগৎ দেখা যায় না। তবুও আলো আসে, দিন হয়, রাত কাটে। এটুকু তো অন্তত বোঝা যায়। লোকজনগুলোও অপেক্ষাকৃত কম হিংস্র এবং এখানে রোজ রাতেই তারা আমাদের উপর হামলা করতো না। মনে হলো এটা কোনও মধ্যবর্তী স্টেশন মতো! এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় যাবার পথে ওরা এখানে নামে এবং প্রায়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে খাওয়া দাওয়া বিশ্রাম করে। হঠাৎ করে হৈ চৈ হয় আবার সব শান্ত হয়ে যায়। এক এক দিন সদলবলে হামলা করে। পৈশাচিক তাণ্ডবলীলা হয় আমাদের নিয়ে। তারপর আধমরা করে ফেলে রেখে আবার চলে যায়। এখনে আমরা নিচু গলায় কথা বলতে পারি কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে মন খুলে কথা বলার সাহস পাই না। জানি না তো কে কেমন, কার মনে কি আছে? যদি আবার লাগিয়ে দেয়। তবুও খাটো মতো একটা মেয়ে ছিল বরিশালের, নাম চাপা। সম্ভবত হিন্দু মেয়ে। ও দেয়ালে কান পেতে পেতে অনেক কথা শুনতো আর আমাকে বলতো। ও প্রায় সব সময়ই জানালার নিচে চুপ করে একা একা দাঁড়িয়ে থাকতো। একদিন বললো, আমাদের এখানে অনেক লোক আসছে। শীঘই ইন্ডিয়া যশোর আক্রমণ করবে। যশোরে যেসব অস্ত্র আছে তা দিয়ে ওদের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তাই যশোর আক্রান্ত হলেই ওরা আত্মসমর্পণ করবে। এজন্য যাতে বেশি লোকক্ষয় না হয় সেজন্য ওদের একটু ভেতরে রাখবে। আত্মসমর্পণের পর তো আর অন্তত জানে মারবে না। আমার শেষের দিকে মনে হতো এসব কথা চাপা শোনে নি, কারণ অতো পুরু দেয়াল ভেদ করে শোনা কঠিন কাজ। তার উপর এসব কথা কি আর ওরা অতো জোরে জোরে বলবে। মনে হলো দিন রাত এসব কথা ভেবে ও নিজের মনেই এমন সব সিদ্ধান্তে এসেছে। শেষের দিকে আমার ভয় ভয় করতো, ও পাগল হয়ে যাবে নাকি। একেই আমার নিজের মাথায় যন্ত্রণা তার ওপর চাপার ওই সব আজগুবি কাহিনী আমাকে অস্থির করে তুললো। কিন্তু একদিন চাপা উত্তেজিতভাবে আমাকে এসে বললো, ফাতেমাদি, অনেক সোলজার এসেছে। আমি ক্রমাগত ট্রাকের শব্দ পাচ্ছি। খানিকক্ষণ কান পেতে থেকে আমিও শুনলাম সত্যি সত্যি ট্রাকের চাকার শব্দ। একটু পরেই ভেতরে অনেক লোকের চলাফেরা ধুপধাপ শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু আগের মতো হট্টগোল নেই। সবাই যেন বেশ সংযত আচরণ করছে।
আমি চাপাকে জিজ্ঞেস করলাম, চাপা তুমি এতো সব জানো কি করে? চাঁপা হাসলো, জানি কি করে? আমি বরিশালের মেয়ে। আমাদের দেশের মুকুন্দদাসের নাম শুনেছো? বললাম, স্বদেশী যাত্রা তো? কয়েকটা গানও আমি জানি। চাঁপার মুখও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, জানো? অশ্বিনী দত্তের নাম শুনেছো? বললাম, শুনেছি কিন্তু ওর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। আসলে আমি তেমন শিক্ষিত ঘরের মেয়ে নই চাপা। তাই অতো কিছু জানি না। চাপা একটু চুপ করে থেকে বললো, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এই যুদ্ধ পর্যন্ত আমার বাবা ৮/৯ বছর জেলে ছিলেন। এখন কোথায়? আমি প্রশ্ন করলাম। চাঁপা মুখ তুলে ওপরের দিকে দেখালো, বাবা স্বর্গে গেছেন। যাকে বলে শহীদ হয়েছেন। বাবা, মা ও আমার ছোট ভাইকে মেরে আমাকে টেনে নিয়ে এসেছে। বড় তিন ভাই আছে, জানি না তারা মুক্তিবাহিনীতে আছে, না তারাও শহীদ হয়েছে। তাড়াতাড়ি ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে বললাম, না, না, ওরা আছেন। তুমি ফিরে গিয়ে ওদের পাবে। উত্তরে চাপা বললো, মিথ্যে সান্ত্বনা দিও না ফাতেমাদি। আমি হিন্দু ঘরের মেয়ে। আমাকে যখন স্পর্শ করেছে তাও আবার পাকিস্তানি সৈন্য, আমি কিভাবে ঘরে ফিরে যাব? তাহলে তুমি কি করবে? করবো একটা কিছু ভবে মরবো না। আমি হেরে যাবো না ফাতেমাদি। স্বাধীন বাংলাদেশে আমি স্বাধীন ভাবেই বাঁচবো। আশ্চর্য! রাত হলো, খাবার এলো কিন্তু রাতের অতিথিরা কেউ এলো না। চাপাকে জড়িয়ে ধরলাম। চাপা সুখবর তোমার কথাই ঠিক, জানোয়াররা গর্তে ঢুকেছে। নিঃশব্দে রাত পার হল। ফাতেমার মনে হলো দূরে বহুদূরে সে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। যুদ্ধের কামানের বন্দুকের আওয়াজ আসিছে। সেও কি চাপার মতো মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে গেলো? চাপাও শুনেছে ওই শব্দ। সামনে একজন অফিসার এসে বললো, তোমাদের ছুটি দিয়ে দিলাম। তোমরা চলে যেতে পারো। চাপা রুখে দাঁড়ালো, আপনারা ছুটি দিলেই তো ছুটি নিতে পারি না স্যার। আমরা কোথায়, বাড়িঘর থেকে কতো দূরে কিছুই জানি না। তাছাড়া বিপদের দিনে আপনারা আমাদের জায়গা দিয়েছেন এখনও এক সঙ্গেই থাকবো। ভাগ্যে যা আছে সবার একরকমই হবে। ওর স্বচ্ছন্দ বাচনভঙ্গি আর ইংরেজি ও উর্দু ভাষার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। দু’জন অফিসার কি যেন কানে কানে ফিস ফিস করে বললো। শেষ পর্যন্ত বললো, ঠিক আছে তোমরা থাকো। তিন-চারজন যাবার জন্যে খুব চেঁচামেচি শুরু করলো। চাপা তাদের বললো, বোনেরা ধৈর্য ধরুন। এখন আপনারা বাইরে বেরুলে শক্রর গুপ্তচর মনে করে আপনাদের গুলি করে মারবে মুক্তিবাহিনীরা। তাছাড়া আপনাদের দেখলে ওরা এদেরও খোঁজ পাবে। এখানে যুদ্ধ হবে। তার চেয়ে এরা যখন আত্মসমর্পণ করবে আমরা ওদের সাহায্য চাইবো, ওরা আমাদের বাড়ি-ঘরে পৌঁছে দেবে। যশোর থেকে গাড়ি এলো, মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর। এরা হাত তুলে গাড়িতে গিয়ে উঠলো। ভারতীয় বাহিনীর একজন অফিসার আমাদের আলাদা একখানা ট্রাকে করে নিয়ে গেল। চাপা আর আমি জড়াজড়ি করে বসলাম-চাপা তোকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবো, যাবি? আমরা কিন্তু মুসলমান। চাপা বললো, আমার কোনো জাত নেই ফাতেমাদি। আমি তো মৃত। এই আমি চাঁপার লাশ। যে আমাকে জায়গা দেবে আমি তারই কাছে যাবো আমাদের সোজা খুলনায় নিয়ে এলো। তারপর সব নাম ঠিকানা নিয়ে বললো টাকা পয়সা দিলে যেতে পারবো কিনা। বললাম পারবো, আর ঠাপাও আমার সঙ্গে যাবে।
একশ টাকার একখানা নোট হাতে করে রিকশা চেপে সোজা এসে উঠলাম সোনাডাঙ্গায় আমাদের বাড়িতে। বাবা আছেন। আমাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বললাম, বাবা পোনাকে বাঁচাতে পারি নি তার বদলে তোমার জন্যে আরেক মেয়ে এনেছি। চাঁপা বাবার পায়ে হাত দিতেই বাবা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমরা দু’জনে গোসল করে কাপড় বদলে মুড়ি আর গুড় নিয়ে বসলাম। বাবা বললেন, মাকে আনতে গেছে সোনা, তারা এসে পড়লো বলে। সোনা কাল ফিরেছে। অনেক রাতে। বাবা, মনা কেমন আছে? ভালো, কিন্তু সেও তো ছিল না। সে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিল। ও ফিরেছে ৪/৫ দিন আগে। শরীর এক এক জনের যা হয়েছে দেখলে চিনতে পারবি না মা। তোমার শরীর এমন করে ভেঙে গেছে কেন বাবা? তোর কথা ভেবে আমি আর তোর মা এক মিনিটও সুস্থির থাকতে পারি নি মা। নাসের আলী এখানে নানা কথা রটিয়েছে। আমরা অবশ্য দিনের বেলা আর এ বাড়িতে আসি নি। কখনও কখনও মনা রাতের বেলা এসে ঘুরে যেতো, ওর বন্ধু বান্ধবরাই বলেছে তুই নেই, তোকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে, মেরে ফেলেছে এইসব। সব মিথ্যে কথা বাবা, ওদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আমি দূরে একটী গ্রামে চলে গিয়েছিলাম। সেখানেই তো ছিলাম। দেখো ভালোই আছি। বাবা আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন কিন্তু বুঝলাম আমার কোনও কথাই বিশ্বাস করলেন না। চাপাকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেন, ওকে অভয় দিলেন। সোনা, মনা ফিরে এলে ওর ভাইদের খবর এনে দেবে। ও অবশ্য ভাইদের কথা কিছুই বলে নি। এর ভেতর মা এসে পড়লেন। মাকে দেখে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম মায়ের গায়ের রঙ যেন পুড়ে কালো হয়ে গেছে, কখানা হাড়, চামড়া দিয়ে ঢাকা, আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ছেলে মেয়ে দুজনের জন্যেই কেঁদে আকুল হলেন। সোনার খবর তারা আগেই পেয়েছিলেন।
পেটের জ্বালা বড় ভয়ঙ্কর। মা উঠলেন, যাই হোক ডাল ভাত আলু সেদ্ধ করে সবাইকে খাওয়ালেন, নিজেও বোধহয় দশ মাস পর ভাত মুখে দিলেন। কিছুটা ভাত পাতের পাশে ঠেলে রাখলেন, মনে হলো পোনার ভাগটা সরিয়ে রাখলেন। আপা এ সর্বনাশ যার পরিবারে হয়েছে সেই শুধু এ বেদনার গভীরতা বোঝে। অন্যদের ক্ষমতা নেই এ দুঃসহ জ্বালা যন্ত্রণা উপলব্ধি করবার। আস্তে আস্তে সবই স্বাভাবিক হতে লাগলো। বাবা ক্ষেত-খামারে যান, আগের মতো বাজার হাটও করেন, ভাইয়ারাও কলেজে যায়, কিন্তু আমার কথা কেউ কিছু বলে না। একদিন বাবাকে বললাম, বাবা আমি কলেজে যাবো না? বাবা মাথা নিচু করে রইলেন। বললাম, কি হলো? কথা বলছো না যে, আমাকে আর পড়াবেনা? বাবা চাপাকে দেখিয়ে বললেন, তুই কলেজে গেলে ওই মেয়েটির কি উপায় হবে? কেন ওকেও স্কুলে ভর্তি করে দাও। বাবা বললেন, সেখানে তো ওর পরিচয়, ওর বাবার নাম সবই লাগবে দেখি কি করি। পরদিন সকালে বাবা গেলেন মতীন উকিলের বাড়ি। তাঁকে সব খুলে বললেন পার কথা এবং পরামর্শ চাইলেন। সতীশ বাবু রাজনীতি করেন। সকলে তাকে মান্যগণ্যও করে। চাপার বাবার পরিচয় পেয়ে তিনি অবাক হয়ে গেলেন।
বললেন, আমাকে দিন সাতেকের সময় দিন আমি ওর একটা উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দেবো। শেষ পর্যন্ত চাঁপার ব্যবস্থা হলো। ঢাকায় নার্সিং এ চাপা ভর্তি হলো। এখন সামান্য টাকা পাবে অবশ্য তাতে ওর হয়ে যাবে। তারপর ট্রেনিং শেষ হলে ভালো মাইনে পাবে। চোখের জলে বুক ভিজিয়ে চাপা চলে গেল। তবে আজও চাপা ছুটি হলেই আমাদের বাড়িতে আসে। এ বিয়ে করেছে একজন মুসলিম ডাক্তারকে। ওর দুটি মেয়ে। চাকুরি ছাড়ে নি। মোটামুটি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আপা, পরের আশ্রিত আশ্রয় পেলো কিন্তু আমার কোনও গতি হলো না। কলেজে আর গেলাম না, প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাশ করলাম। তারপর কত জায়গায় গেলাম চাকুরির আশায়, কিন্তু না, বীরাঙ্গনাকে জায়গা দিয়ে কেউ ঝাট ভোগ করতে রাজি না। স্কুলে চাকরি হবে না। মেয়েদের সামনে একজন চরিত্রহীন নষ্টা মেয়েকে আদর্শ রাখা যায় না। আমি পাগল হবার মতো অবস্থায় এলাম আপা। শেষ পর্যন্ত বাবা ঠিক করলেন আমার বিয়ে দেবেন। শুরু হলো পাত্র খোঁজা। অবশ্য যেখানেই বাবা কথা বলেছেন সবই খুলে বলেছেন। শেষ পর্যন্ত এক জায়গায় বাবার সবকিছু মন মতো হলো কিন্তু ছেলে ম্যাট্রিক পাশ। মা বললেন, সে কি করে হবে? আমার মেয়ে বিএ পাশ, বিয়ে দেবো ম্যাট্রিক পাশের সাথে। লোকে হাসবে না? তুমি আরেকটু দেখো ততোদিনে বাবারও ধৈর্যচ্যুতি হতে বসেছে। না, ছেলের স্বাস্থ্য, চেহারা ভালো, যথেষ্ট। জমিজমা আছে, খাওয়া পরার অভাব হবে না। তিন ভাই, এটিই সবচেয়ে ছোট। বড়রা কেউ লেখাপড়া করে নি। এই ছোট ছেলেই করেছিল। তারপর ব্যবসায় ঢুকে যায় ফলে আর পড়াশুনা করা হয়ে ওঠে নি।
শুভদিন শুভক্ষণে বিয়ে হয়ে গেল। ফাতেমা সত্যিই সুখী হলো। তাহের বেশ উঁচু মনের ছেলে। ফাতেমা নিজের কথা বলতেই তাহের তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। ও সব বলো না ফাতেমা, আমরা তোমাদের রক্ষা করতে পারি নি। আমরা আমাদের কর্তব্য করি নি। আর সেজন্য শাস্তি দেবো তোমাদের, তা হয় না। তুমি আমাদের ঘরের লক্ষ্মী, আমরা তোমাকে মাথায় করে রাখবো। মিথ্যে কথা বলে নি তাহের। সে ফাতেমাকে মাথায় করেই রেখেছিল। মুক্তিযুদ্ধের ওপর বই বেরুলেই ফাতেমাকে কিনে এনে দিতো। তাহের বুঝেছিল একখানা শাড়ির চেয়ে ফাতেমার কাছে একখানা বই অনেক বড়। ফাতেমার শ্বশুরও বেশ বর্ধিষ্ণুগৃহস্থ। একদিন এসে খবর দিলেন ফাতেমাকে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াবার জন্য পাড়ার লোকেরা তাকে ধরেছে। ফাতেমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে তিনি ওদের বলবেন। ফাতেমার ইচ্ছা পূর্ণ হলো। তার স্কুলে চাকুরিও হয়ে গেল। শ্বশুর মাইনে নিতে না করে দিলেন। ফাতেমা কিন্তু তাতে রাজি হয় নি।
সকাল সকাল ভাত খেয়ে স্কুলে চলে যায় ফিরে আসে বিকালে দুটোর সময়। শাশুড়ি সন্তুষ্ট না, ফাতেমা বোঝে। নানা রকম ভাবে তাকে খুশি করতে চেষ্টা করে কিন্তু তিনি গাল ফুলিয়েই থাকেন, ছেলের কাছে নানা কথা বলেন। তাহের একদিন বললো, ফাতেমা, আম্মা যখন চান না, তখন তুমি কাজটা না হয় ছেড়েই দাও। এক সময় ফাতেমা অন্তঃসত্ত্বা হলো। শাশুড়ি আরো ক্ষেপে গেলেন। পাঁচ-ছ’মাসের গর্ভাবস্থায় তাকে চাকুরি ছাড়তে হলো। শাশুড়ি তার দৈহিক অবস্থা নিয়ে নানা কটু কথা বলতে আরম্ভ করলেন। তাহেরের ব্যবসারও বেশ উন্নতি হচ্ছে। সে নিত্য নতুন জিনিস এনে ঘর সাজিয়ে তুলছে। ফাতেমা বাপের বাড়িতে খুব কম যায়। নেহায়েৎ বাবা নিতে এলে তাকে ফেরায় না, না হলে যেতে চায় না। দায় মুক্ত হবার জন্য যে তার বাবা একটি অশিক্ষিত পাত্রের হাতে তাকে সমর্পণ করেছেন এটা ফাতেমা ভুলতে পারে না। মনা ভালো চাকুরি করে। এখন ক্যাপ্টেন। বিএ পাশ মেয়ে বিয়ে করেছে। যদিও ওরা সবাই ওকে ও তাহেরকে খুবই মান মর্যাদা দেয় তবু ফাতেমার কোথায় যেন একটা অসম স্তরের কাঁটা ফুটে থাকে, সে তেমন করে সহজ হতে পারে না। বাবা-মা ভাবেন, নিজের অনেক বড় ঘর সংসার ফেলে সে কেমন করে থাকবে। অন্য জায়েরা নিজের বাড়িতে থাকে। বুড়ো শ্বশুর শাশুড়িকে তারই দেখতে হয়।
একটি সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে হলো ফাতেমার। নাম রাখলো চাপা। খবর পেয়ে চাপা এলো দেখতে। কতো কিছু এনেছে ফাতেমার মেয়ের জন্য। ওর স্বামী ডঃ করিম আসতে পারেন নি, ছুটি পান নি। চাঁপার একটি ছেলে দু’বছর বয়স। শাশুড়ির কাছে রেখে এসেছে। ফাতেমা খুব রাগ করলো এমন ভাবে বাচ্চাকে ও দুলাভাইকে রেখে আসবার জন্য। মুখের আদল কিন্তু অনেকটা চাঁপার মতোই। ও পেটে থাকতে ফাতেমা দিন-রাত ঠাপাকেই ভেবেছে। এ নিয়ে দু’বন্ধুর কতো গল্প কতো হাসাহাসি। তাহের যত্নের ত্রুটি করে নি। দামি একটি শাড়িও এনে দিয়েছে ফাতেমার হাতে চাপাকে দেবার জন্যে। চাপা খুব খুশি হয়ে বললো, ভাই, আমার পিছুলে কেউ নেই। আপনি হইলেন আমার ভাই। না, চাপার ভায়েরা কোনও যোগাযোগ রাখতে রাজি হয় নি। তাই শেষ পর্যন্ত চাপা দেশের ছেলে ডঃ করিমকে বিয়ে করেছে। ভালোই করেছে, নইলে কোথায় ভেসে যেতো তার কি ঠিক ছিল। আজ যদি ফাতেমার বাবা-মা না থাকতেন তাহলে সোনা, মনা, কি তার জন্যে এতোটা করতো। কখনই না। বাপ-মায়ের কাছ থেকে যা পাওয়া যায় ভাইদের পক্ষ থেকে কি তা আশা করা যায়, না আশা করা উচিত? চলে গেল চাপা। ফাতেমার দিন আর কাটে না। চাপা তো তার শাশুড়ির কাছেই থাকে সর্বক্ষণ শুধু কাদলে ওর কাছে নিয়ে আসেন খিদে মেটাবার জন্য। ফাতেমা বিরক্ত হয় আবার ভাবে ও বৃদ্ধ মহিলা কি নিয়ে থাকবেন। পেয়েছেন একটা খেলনা, সারাদিন তাই নিয়ে খেলেন। ওকে তেল মাখান, কাজল পরান, গান গেয়ে ঘুম পাড়ান। উনি একটা পরিপূর্ণ জীবন পেয়েছেন। এবার ফাতেমা তাহেরকে ধরে বসলো শ্বশুরকে বলে তার আগের চাকুরিটা পাইয়ে দেবার জন্য! তাহের এই কথায় রাজি হলো না। বললো, তুমি এখন ঘরের গিন্নি। সংসার তোমার মাথায়। মা তো অষ্টপ্রহর চাপাকে নিয়েই আছেন, তুমি কেন নিজেকে সুখী ভাবতে পারো না ফাতেমা। আমি তো তোমাকে পেয়ে বেহেশতে বাস করছি। ফাতেমা বলে, তাহের তুমি দেখলে না চাপাকে? ইচ্ছে হলো হুট করে দেখতে এলো। আমি যেতে পারবো ওভাবে ওর ছেলেকে দেখতে? কেন পারবে না? আমি তোমাকে নিয়ে যাবো। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে জানি কিন্তু আমি নিজের থেকে নিজের ইচ্ছায় কিছু করতে পারবো না কেন? জানো, চাপা নিজে উপার্জন করে, স্বাবলম্বী, তাই ইচ্ছেমতো চলাফেরাই শুধু নয় কাজ কর্মও করতে পারে। দেখো আমি যদি কাল মাকে দেখতে যেতে চাই তাহলে তোমার মায়ের অনুমতি নিতে হবে, কেন? কে বলেছে অনুমতি নিতে হবে ফাতেমা? এসব কি তোমার মাথায় ঢুকছে? মা কি কখনও কোনোদিন তোমাকে ও বাড়িতে যেতে বারণ করেছেন? ফাতেমা মুখ নিচু করে বসে থাকে। আজকাল তাহেরেরও সব সময় ফাতেমার এই অকারণ আপত্তি আর জিদ ভালো লাগে না। অথচ মা তাকে খুবই ভালোবাসেন, বৌ অন্ত প্রাণ। ফাতেমাও মাকে নিজের মায়ের চেয়ে কম ভালোবাসে না, তাহলে কেন এই জটিলতা?
ফাতেমা আজকাল প্রায়ই বলে ওর মাথায় একটা যন্ত্রণা হয়। ঝাঁকিয়ে কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে যায়। মা বার বার বলছেন, তাহের বউকে ভালো ডাক্তার দেখা। ডাক্তার দেখানো হলো। মাথার এক্স-রে হলো। কিন্তু রোগের প্রকৃত ইতিহাস ফাতেমা কাউকে বলতে পারলো না। শুধু বললো পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছে। ডাক্তার খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেন। বললেন-ঢাকায় নিয়ে গিয়ে একজন বড় ডাক্তার দেখিয়ে আনেন। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। ফাতেমার বড় বড় চোখ থেকে মুক্তোদানার মতো চোখের জল ঝরে পড়ে। মনে হয় ওর সব সৌভাগ্য বুঝি ধুয়ে গেল। ফাতেমা আবার সন্তানসম্ভবা। চাপার বয়স মাত্র দু’বছর। শশুর-শাশুড়ির খুশির সীমা নেই, বউকে কতো যে যত্ন করেন, ফাতেমার চাকুরি করবার পাগলামীও কিছুটা কমেছে, সম্ভবত পরিস্থিতি উপলব্ধি করে। এর ভেতর একটা দুঃসংবাদ পেলো ফাতেমা চাপার চিঠিতে। ফাতেমাদি, আমি এখন স্বাধীন বাংলার স্বাধীন নাগরিক। করিম আমাকে তালাক দিয়েছে। অবশ্য বাবলুকে আমি রেখে দিয়েছি। ওর বয়স এখন পাঁচ, আমার শাশুড়ি আমার জন্য খুব কান্নাকাটি করেছেন। মনে হয় বাবলুকে ছেড়ে উনি বাঁচবেন না। আমি মাঝে মাঝে বাবলুকে ওর কাছে দিয়ে আসি। কিন্তু এভাবে তো আর বেশিদিন চলবে না। করিম এখানকার এক লেডী ডাক্তারকে বিয়ে করবে ঠিক করেছে। মহিলার রুচি দেখে আমি অবাক হলাম। আমি কিছুদিন আগে ঢাকায় পাঁচকাঠা জমি কিনেছিলাম। করিম হঠাৎ ওর নামে লিখে দেবার জন্য খুব পীড়াপীড়ি শুরু করে। ও ওখানে চেম্বার করবে। কিন্তু জমি আমার নামে থাকলে ক্ষতি কি? রোজ রোজ এক কথা নিয়ে ঝগড়া ঝাটি আমার ভালো লাগে না। আমি ব্যবস্থা করবার জন্য উকিলের কাছে গেলাম। উনি জমির কাগজপত্র সাবধানে রাখতে বললেন এবং পরিষ্কার বললেন, আপনার স্বামীর কোনও কুমতলব আছে আপনি। সাবধানে থাকবেন। শেষে সত্যিই একদিন বলে বসলো জমি ওকে লিখে না দিলে ও আমাকে তালাক দেবে এবং দিলোও তাই। আমি প্রতিবাদ করি নি। কারণ সে একটা হৃদয়হীন লম্পট এ আমি আগেই বুঝেছিলাম। তাই নিঃশব্দে সরে এসেছি। আমার জন্য কষ্ট পেয়ো না। ফাতেমাদি, এতো দুঃখ পার হয়ে যখন এসেছি তখন নিশ্চয়ই বাবলুকে বড় করতে পারবো! তাহের ভাইকে বলো সময় ও সুযোগ পেলে তোমাদের কাছে থেকে বেরিয়ে আসবো।’ চিঠি পড়ে তাহের অবাক হয়ে গেল। বললো, আমরা। অশিক্ষিত মূর্খ, ভাইসাহেব শিক্ষিত, একজন ডাক্তার এমন কাজ করলেন কি করে? তাহের বললো, চিঠির উত্তর আমি দেবো। তুমি আর এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না লক্ষ্মীটি। ফাতেমা এখন আর তর্ক বিতর্ক ঝগড়াঝাটি করে না? সব সময়ই প্রায় চুপ চাপ থাকে না হয় বইপত্র পড়ে। তাহের লক্ষ্য করে, তার বিদ্যায় যতোটুকু কুলায় সে বই পছন্দ করে কিনে নিয়ে আসে। তাহেরের বাবা-মা দু’জনেরই বয়স হয়েছে, ফাতেমা চেষ্টা করে ওদের সেবাযত্ন করতে। কিন্তু ওর অসুস্থতার জন্য শাশুড়ি ওকে কিছু করতে দেয় না। একটা কাজের বুয়া রেখেছেন। এখন ও নিজেই সব দেখাশুনা করেন।
ছেলে হয় ফাতেমার। একেবারে তাহেরের মুখ। সবাই খুব খুশি। ফাতেমাও খুশি, কিন্তু মাসখানেকের ভেতর আবার সেই মাথার যন্ত্রণাটা বাড়লো। সারারাত বসে থাকে, ঘুমায় না। তাহেরকে বলে, চুপ, শোনো, ওই যে বুটের শব্দ। ট্রাকের শব্দ পাচ্ছোনা ওঃ বাবা আমার মাথা ছিঁড়ে গেল আমায় ছেড়ে দাও। তাহের বুঝতে পারে কি অমানুষিক অত্যাচারের ভেতর দিয়ে ওর দিন কাটছে। এক এক সময় ওকে বুকে নিয়ে তাহের কাঁদে, ভাবে কি করবে ওকে নিয়ে। একদিন বাড়ির কাজের ছেলেটা হাঁপাতে হাঁপাতে দোকানে এসে হাজির। ভাবি বাড়িতে নেই, কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে গেছে। দাদি আম্মা কাঁদছে। তাহের ছুটে বেরিয়ে গেল। ওর বাপের বাড়িতেই আগে গেল। ওরা বললো, কয়েকদিন আগে একব্বার এসেছিল কিন্তু আজ তো আসে নি। তাহেরের মাথায় বজ্রপাত হলো। আল্লাহ এ তুমি আমার জীবনে কি অঘটন ঘটালে। ফাতেমার মতো একটা সহজ সরল, নিষ্পাপ মেয়ের ভাগ্য এমনিই বিড়ম্বনায় ভরে যাবে? তাহের আর দেরি না করে বিহারী কলোনীর দিকে ছুটলো তার হুণ্ডা নিয়ে। রাস্তায় মনার এক বন্ধু হাত উঁচু করে তাকে থামিয়ে বললো, বুবু বিহারী। কলোনীর দিকে গেছে। আমি অনেক সাধলাম। তাহের ছুটে গিয়ে দেখলো খুব ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছে ফাতেমা আর নিজের মনে বিড় বিড় করছে। তাহের ওর সামনে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে আস্তে ওর কাঁধে হাত দিতেই ও চমকে উঠলো, তারপর তাহেরকে জড়িয়ে ধরে হাত জোড় করে কেঁদে উঠলো, তুমি তুমি এসেছো? এই যে এইখানে, আমার ছোট ভাই পোনাকে নাসির আলি আছড়ে মেরেছিল। জানি, আমি সবজানি, ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো তাহের। ফাতেমা বাড়ি চলো। বাচ্চারা কাঁদছে। অতি সহজে সে তাহেরের হোল্ডার পেছনে উঠে বসলো এবং স্বাভাবিক ভাবেই বাড়িতে এলো। যেন কিছুই হয় নি। শাশুড়িকে দেখে ছুটে এসে তার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, আম্মাগো, আমার বড় কষ্ট গো আম্মা। জানিরে মা, আমি সব জানি। আমার বুকে আয়, তোর মন শান্ত হবে। তাহের, ওর আব্বা কারও চোখই আর শুকনো ছিল না। বাচ্চা দুটোও কাঁদতে শুরু করেছে। এবার তাহের মরিয়া হলো ওর চিকিৎসার জন্য। চাপা লিখেছে ও ফাতেমাকে নিয়ে কলকাতা যাবে। ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তাহের যেন ফাতেমার পাসপোর্ট নিয়ে ঢাকায় আসে। সম্ভব হলে যেন হাজার কুড়ির মতো টাকার যোগাড় করে, আর সম্ভব না হলে যেভাবেই হোক চাপা টাকার যোগাড় করবে।
তাহেরের অবস্থা বেশ ভালো। জমির আয় ছাড়া এখন ও ধান চালের ব্যবসাও করে। নির্দিষ্ট সময় তাহের ফাতেমাকে নিয়ে ঢাকায় গেল। তবে যাবার সময় চাপা আর খোকনের জন্য বেশ মন খারাপ করলো। শাশুড়িকে বার বার সাবধানে থাকতে বললো, শ্বশুরের পা ধরে সালাম করে ওর বুকে মুখ রেখে কেঁদে বললো, আব্বা আমার জন্য দোয়া করবেন। যেন ভালো হয়ে ফিরে এসে আপনার ও আম্মার সেবা করতে পারি। শ্বশুর তো শিশুর মতো হাউ মাউ করে কাঁদলেন। তাহেরের হাতে হাত ধরে বললেন, বাপ, আমার মায়ের অযত্ন করিস না। চাপা সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। ভিসা নিতে একদিন সময় লাগলো।
যে ডাক্তারের কাছে চাঁপা ফাতেমাকে নিয়ে গেল তিনি চাপার বাবার খুব অনুগত রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। সুতরাং ফাতেমার যত্নের অভাব হলো না। সব দেখে শুনে তিনি বললেন, ওর মাথায় একটা অপারেশন করতে হবে। আশা করি ও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে। যে কথা তাহের জানে না সেই কথাই চাঁপা ডাক্তারকে বললো। সে নির্মম কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে সে নিজেও কেঁদে উঠলো। ডাক্তার নিচু হয়ে চাপাকে প্রণাম করলো। দিদি, আপনারা প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আশ্চর্য এতো ত্যাগ স্বীকার করে দেশ স্বাধীন করলো বাঙালিরা, আর মা-বোনের দেয়া ত্যাগের মূল্য দিতে পারলো না। দুর্ভাগ্য সে দেশের!
ঠিক মতো অপারেশন হলো। সব সুদ্ধ দশদিন থাকতে হলো ডাক্তারের ক্লিনিকে। ঔষধ পত্রের দাম ছাড়া ডাক্তার একটি পয়সাও নিলেন না। তাহের বোকা বনে গেল। তাহের চাপাকে বললো, দিদি, আপনি একটা ব্যবস্থা করুন। চাপা পাঁচ হাজার টাকা ডাক্তার চৌধুরীকে দিয়ে বললো, টাকা জমা রাখেন ডাক্তার সাহেব। আমাদের মতো কোনও হতভাগিনীর যদি প্রয়োজন পড়ে তাহলে খরচ করবেন। আর ডাক্তারের বউকে একটা দামি শাড়ি, ফল, মিষ্টি, নিয়ে দু’জনে বাড়িতে দেখা করতে গেল। যে সম্মান তারা সেদিন করেছিল ফাতেমা তা কখনও ভুলবে না। ঢাকা ফিরে এলো। তাহের কলকাতা থেকে আব্বাকে ফোনে দুদিন পর পরই খবর জানিয়েছে। ঢাকা ফিরেই ফোন করে জানালো, ফাতেমা খুব ক্লান্ত। চাপার ওখানে দুদিন থেকে ফিরে আসবে। আল্লাহর রহমতে ওরা সবাই ভালো আছে। আসলে তাহেরের বড় ইচ্ছা চাপা আর ফাতেমাকে নিয়ে ঢাকায় একটু ঘোরাফেরা করে। ফাতেমা কলকাতা থেকেই চাপার জন্য শাড়ি, বাবলুর জন্য জামা কাপড় খেলনা, নিজের ছেলেমেয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ি সবার জন্য প্রাণভরে জিনিসপত্র এনেছে। ঢাকায় খুব ঘুরে বেড়ালো। সাভার শহীদ স্মৃতিসৌধ দেখতে নিয়ে তাহেরকে বললো ফাতেমা, শহীদ হলে এখানেই তো থাকতাম। তাহের সহজ হেসে বললো, আমাকে পেতে কোথায়? ফাতেমা কৃতজ্ঞতায় চোখ নামিয়ে নেয়। মীরপুর গেল, রায়ের বাজার গেল শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে চাপাকে নিয়ে বত্রিশ নম্বরে গেল বঙ্গবন্ধুর বাড়ি দেখতে। আশ্চর্য চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে বঙ্গবন্ধু ওপরে ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, ওর মাথার দিকে। হাসছেন, বললেন, আমি তোদের বীরাঙ্গনা বলে ডেকেছি। তোরা কি ব্যর্থ হতে পারিস। কখনোই না। আমার আশীর্বাদ রইলো তোদের ওপর। সেন্ট্রি ঢুকতে দিতে চায় না। ভেতর থেকে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন সব শুনে ওদের নিয়ে ভেতরে গেলেন। সামনে বঙ্গবন্ধুর বিশাল প্রতিকৃতি। ওখানে সালাম করে ফাতেমা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো। পথে পা দিয়ে আফসোস করলো, খেয়াল নেই কিছু ফুল থাকলে ভালো হতো। অবশ্য আগে তো বুঝতে পারি নি যে ভেতরে যাবার সৌভাগ্য আমার হবে। আনন্দ উল্লাসের ভেতর দিয়ে ফিরে এলো ওরা। চাপাকে শুধু ফাতেমা বললো, তুই আমাকে জীবন দিলি, আমি তো তোকে কিছুই দিতে পারলাম না। চাঁপা ওকে জড়িয়ে ধরে বললো, ফাতেমাদি, তুমি তো নিজেকেই আমায় দিয়ে দিয়েছে। আমি আর কি চাইবো বলো? তবে যখন মন চাইবে তোমার শান্তির সংসারে গিয়ে কয়টা দিন থেকে আসবো।
একেবারে প্রথম জীবনে উচ্ছলতা নিয়ে ফিরে এলো ফাতেমা। শ্বশুর-শাশুড়ি আনন্দে আত্মহারা। ফাতেমা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদরে আদরে ভরে দিলো। কারণ ও মনে করতে পারে না চাপাকে কখনও কোলে নিয়েছে কিনা। গাল ফুলিয়ে খোকন দাঁড়িয়ে আছে দাদির হাত ধরে। কোলে নিতে গেলে ছোট দুটো হাত দিয়ে ঠেলে দিলো। সবাই হেসে উঠলো। খোকন লজ্জায় দাদির শাড়িতে মুখ লুকালো।
অনেক দিন আগের কথা, তেইশ বছর পার হয়ে গেছে। ১৯৭৩ সালে আমি খুলনা গেছি। দৌলতপুর কলেজে আমার কয়েকজন ছাত্র ছিল। ইচ্ছা ওদের একটু খোঁজ খবর নেয়া, কে কেমন আছে, দেশের খবর নেয়া ইত্যাদি। দেখলাম এক মহিলা কলেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, কি চাও তুমি? রক্তচোখ মেলে বললো, কলেজে পড়বো। বুঝলাম মেয়েটি স্বাভাবিক নয়। বললাম, তোমার নাম কি? নাম? ফতি পাগলী, হয়েছে। এবার যান। একজন ছাত্রকে জিজ্ঞেস করায় বললো, উনি একজন বীরাঙ্গনা। উনি অসুস্থ, প্রায়ই আসেন। ঘুরে ঘুরে চলে যান। বাড়ি কাছেই, সোনাডাঙা। আমার সঙ্গে গাড়ি ছিলো। অনেক বুঝিয়ে ওকে নিয়ে গেলাম ওদের বাড়িতে, ওই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। ওর বাবা-মা ও দু’ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। কাহিনী শুনলাম। বললাম ঢাকা পূণর্বাসন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন। আমরা চিকিৎসা করাবো। ওরা শুনলেন কিন্তু তাৎক্ষণিক কোনও জবাব দিলেন না, ওদের ঠিকানা নিলাম। ওর ভাই দু’বার ঢাকায় এসে ওর খবর আমাকে দিয়ে গেছে। তারপর চাপা এসেছে, যোগাযোগ করেছে। ওর বিয়েতেও গিয়েছিলাম। এই হচ্ছে আমার বিবি ফাতেমার সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র।
আমি যে ক’জন বীরাঙ্গনার সাক্ষাৎ পেয়েছি তাদের মধ্যে সর্বাধিক নির্যাতিত এই ফাতেমা। হয়তো তার নামের রক্ষাকবচ তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আজ তাহের একজন প্রতিষ্ঠিত ধনী ব্যবসায়ী। ফাতেমার মেয়ে চাপা আইএসসি পড়ে। সে তার খালাম্মা অর্থাৎ চাপার মতো ডাক্তার হবে। খোকন হতে চায় সাংবাদিক। ফাতেমা অনেক সমাজ কল্যাণমূলক কাজ করে। সে আজ সত্যিই মহিয়সী গরিয়সী ফাতেমা, আর বঙ্গবন্ধুর মানসকাম্য বাংলার বীরাঙ্গনা।