২. মেহেরজান

০২.

আমি মেহেরজান বলছি। নাম শুনে তো আপনারা আনন্দিত ও পুলকিত হবেন কারণ ভাববেন আমি গওহরজান বা নগরজানের ঘরানার কেউ। দুঃখিত, তাদের সঙ্গে এ জীবনে আমার যোগাযোগের কোনও সূত্র ঘটে নি, তবে ঘটলেও আশ্চর্য হবার কিছু ছিল না। জীবনটা তো সরল সমান্তরালরেখায় সাজানো নয়। এর অধিকারী আমি সন্দেহ নেই, কিন্তু গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করেন –কি বললেন আল্লাহ্, পাগল হয়েছেন। বাঙালি মেয়ের জীবন পরিচালিত হবে আল্লাহর নির্দেশে! তাহলে এদেশের মৌলবী মওলানারা তো বেকার হয়ে থাকবেন, আর রাজনীতিবিদরাই-বা চেঁচাবেন কি উপলক্ষ করে? না এসব আমার নিজস্ব মতামত, অভিযোগের বাধা আটি নয়।

আমি নিজে সচেতন ও দৃঢ় বিশ্বাসী যে আমি একজন বীরাঙ্গনা। আমার রাষ্ট্র আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, আমার পিতামাতা হাত বাড়িয়ে আমাকে বুকে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সমাজের জুলুমবাজির ভয়ে আমি তাদের ঘরে যেতে পারি নি। তবে আপনারা বিশ্বাস করতে পারেন আপনাদের দৃষ্টিতে আমি বীরাঙ্গনা না হলেও নিঃসন্দেহে বারাঙ্গনা নই। এ কথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি যে সব কিছুর ওপরে আমি একজন অঙ্গনা। পুরুষের লালাসিক্ত জান্তব দৃষ্টি আমি দেখেছি, ভর্ৎসনা অত্যাচার সয়েছি আর তাতেই জীবনের দীর্ঘ আটমাস আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেছি, উপলব্ধি করেছি, আমি অঙ্গনা এই-বা কম কি? নারীজন্ম তো কম কথা নয়, আমরা জীবন সৃষ্টি করতে পারি, স্তন্য দানের ক্ষমতা আমাদের আছে! দশমাস গর্ভে ধারণের পরও লালন পালনের দায়িত্ব আমাদের। আমিও তাই এক সন্তানের জননী। নাই-বা পেলাম স্বামীর সোহাগ, সুখের সংসার তবুও তো নিজের পায়ে সম্মানের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি।

যেভাবে এখন আপনাদের কাছে কথা বলছি আমি কিন্তু ওরকম অহংকারী নই। আসলে নিজেকে তো প্রকাশ করবার সুযোগ সুবিধা পাই নি, মাথাটা নিচু করেই সবার দৃষ্টি বাঁচিয়ে সংসারে ন্যূনতম স্থান অধিকার করেই কোনও মতে টিকে ছিলাম। কিন্তু আমার মাতৃতুল্য এক মহিলার মুখে শুনলাম আমি একজন মহিয়সী নারী। জোয়ান অব আর্কের মতো দেহে না দিলেও আমার শ্রেষ্ঠ সম্পদ নারীত্ব আমি দেশের জন্য উৎসর্গ করেছি। তবুও কোনো মিনারে আমাদের নাম কেউ খোদাই করেনি। সম্ভবত লজ্জায়। কারণ রক্ষা তো করতে পারে নি আমাকে সর্বনাশের হাত থেকে, হাততালি দেবে কোন মুখে? আমার অবস্থানের জন্য আমি উপেক্ষিত হয়েছি নির্মম নিষ্ঠুরভাবে কিন্তু জানি না কোন ঐশ্বরিক শক্তির বলে আমিও কখনও মাথা নোয়াই নি।

আমার জন্মস্থান ঢাকা শহরের কাছেই কাঁপাসিয়া গ্রামে। বাংলার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঐ গ্রামেরই বীর সন্তান তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী। এ কারণে ওই গ্রামের সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ঘোরর সমর্থক। স্কুলে-পথে-ঘাটে আমাদের সবার মুখে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ কিন্তু জয়ের এ জোয়ার বেশিদিন স্থায়ী হলো না। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বিনামেঘে বজ্রপাত। হঠাৎ নরসিংদী বাজারে প্লেন থেকে গুলিবর্ষণ করে সমস্ত বাজারে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো। আমার বাবার ছোট্ট একটি দোকান ছিল ওই বাজারে। বাবা দর্জির কাজ করতেন। সঙ্গে ছিলেন দু’জন সহকর্মী! মোটামুটি যে আয় হতো তাতে আমাদের সংসার ভালোভাবেই চলে যাচ্ছিল এবং আমরা চার ভাইবোন সকলেই পড়াশোনা করছিলাম। এক ভাই কলেজে পড়ে, থাকে নরসিংদীতে বাবার সঙ্গে। আমি, মা, আমার ছোট দু’ভাই থাকতাম কাঁপাসিয়ায়! ধীরে ধীরে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠতে লাগলো। আহত এবং পলাতক ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা এ বাড়ি ও বাড়ি আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। সম্ভবত এ সংবাদ গোপন ছিল না। তখনও প্রকাশ্যে রাজাকার বাহিনী আত্মপ্রকাশ করে নি। গোপনে সংবাদ আদান প্রদান চলছিল। একদিন হঠাৎ বিকেলের দিকে গ্রামে চিৎকার উঠলো মিলিটারি আসছে, মিলিটারি! মানুষজন দিশেহারা। সবাই নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে দৌড়োতে লাগলো। দেখতে দেখতে মনে হলো গ্রামের চারিদিকে আগুনে ছেয়ে গেছে। মাঝে মাঝে গুলির শব্দ। বাবা ও বড়ভাই নরসিংদীতে ওই আধপোড়া দোকানের মেরামতের কাজে ব্যস্ত। বাড়িতে আমি, মা ও ছোট দুই ভাই লালু আর মিলু। লালু গিয়েছে স্কুলের মাঠে ফুটবলখেলা দেখতে, এখনও ফেরে নি। মা ঘর বার করছেন।

এমন সময় একটা জলপাই রঙ-এর জিপ এসে বাড়ির সামনে বিকট আওয়াজ করে থামলো। মিলুকে বুকে জড়িয়ে ধরে আর আমার হাত ধরে মা শোবার ঘরে ঢুকলেন। কে যেন বাংলা বলছে, হ সাব, এইডাই মেহেরজানগো বাড়ি, বহুত খুব সুরত লেকী। আমার দেহ অবশ হয়ে আসছে। এমন সময় দরজায় লাথি। দ্বিতীয় লাথিতেই দরজা ভেঙে পড়লো। কয়েকজন লোক লুঙ্গিপরা ওদের সামনে। আমাদের টেনে বাইরে নিয়ে এল। ক্ষীণদেহে যথাসাধ্য বাধা দিতে চেষ্টা করলাম। চুল ধরে আমাকে জিপে তোলা হলো। মা আর্তনাদ করতেই মাকে ও মিনুকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করলো শয়তানরা। আমাকে যখন টানা হেঁচড়া করছে দেখলাম মায়ের দেহটা তখনও থরথর করে কাঁপছে। গাড়ি স্টার্ট দেবার পর দেখলাম মিলুর মাথাটা হঠাৎ কাত হয়ে একদিকে ঢলে পড়লো। বুঝলাম মা ও মিলু চলে গেল। হঠাৎ করে আর্তনাদ করে উঠতেই ধমক খেলাম। ‘চোপ খানকী’ বোবা হয়ে গেলাম। আমাকে ঐ সম্বোধন করলো কি করে? আমি ভদ্রঘরের মেয়ে, অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। হঠাৎ কেমন যেন শক্ত কঠিন হয়ে গেলাম। আমার এই মানসিক স্থবিরতা কেটেছে অনেক দিন পরে। সেখান থেকে হাত ও জায়গা বদল হয়ে কখনও একা কখনও আরও মেয়েদের সঙ্গে ঘুরতে লাগলাম। মাঝখানে মনে হতো বাবা আর বড়ভাই বেঁচে আছে কি? লালু? লালু কি পালাতে পেরেছিল? আবার ভাবতাম কে বাবা, কে ভাই, লালুই বা কে আর আমিই-বা কে? নিজেকে একটা অশরীরী কঙ্কালসার পেত্নী বলে মনে হতো। কিন্তু তবুও এ দেহটার অব্যাহতি নেই! মাস দুই পর ওদের এদের নিজেদের প্রয়োজনে আমাদের গোসল করতে দিতো। পরনের জন্য পেতাম লুঙ্গি আর সার্ট কিম্বা গেঞ্জি, শাড়ি দেওয়া হতো না। ভাবতাম বাঙালির শাড়িকে ঘৃণা করলে আমাদের তো সালোয়ার কামিজ দিতে পারে। ময়মনসিংহ কলেজের এক আপাও ছিলেন আমাদের সঙ্গে। বললেন তা নয় শাড়ি বা দোপাত্তা জড়িয়ে নাকি কিছু বন্দি মেয়ে আত্মহত্যা করেছে তাই ও দুটোর কোনোটাই দেওয়া হবে না। তাছাড়া আমরা তো পোষা প্রাণী। ইচ্ছে হলে একদিন হয়ত এ লুঙ্গি সার্টও দেবে না। আপা নির্বিকার ভাবে কথাগুলো বললেন। দৃষ্টি উপরের দিকে অর্থাৎ ছাদের দিকে। উনি বেশির ভাগ সময়ই একা একা উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। মনে হতো যেন বাইরের আলো দেখবার জন্য ছিদ্র খুঁজছেন। কদিন পর আপা অসুস্থ হলো। সুয়ে থাকতো, ওকে শাড়ি পরিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো ডাক্তার দেখাবার জন্য। আপা আর ফিরলো না। ভাবলাম আপা বুঝি মুক্তি পেয়েছেন, অথবা হাসপাতালে আছেন। কিন্তু না, আমাদের এখানে এক বুড়ি মতো জমাদারণী ছিল, বললো, আপা গর্ভবতী হয়েছিল তাই ওকে মেরে ফেলা হয়েছে। ভয়ে সমস্ত দেহটা কাঠ হয়ে গেল। এতে আপার অপরাধ কোথায়? আল্লাহ্ একি মুসিবতে তুমি আমাদের ফেললে। কি অপরাধ করেছি আমরা? কেন এই জানটা তুমি নিয়ে নিচ্ছো না? এখানেই চিন্তা থেমে যেতো।

কেন জানি না মরবার কথা ভাবতাম না। ভাবতাম দেশ স্বাধীন হবে আবার বাড়ি ফিরে যাবো। বাবা মা বড়ভাই লালু মিলু আবার আমরা সবো খেলবো গল্প করবো। কিন্তু আমি যে মাকে আর মিলুকে মরতে দেখে এসেছি। কিন্তু এমনও তো হতে পারে মিলিটারী গ্রাম থেকে চলে গেলে মাকে আর মিলুকে গ্রামের লোক বাঁচিয়ে তুলেছে, বাবাকে খবর দিয়েছে। হতেও তো পারে! ভাবনার আদি অন্ত ছিল না। দিন-রাতের ব্যবধানও ছিল শুধু শারীরিক অবস্থা ভেদে। প্রথম রাত্রি যেতো পশুদের অত্যাচারে, বাকি রাত দুঃখ কষ্ট মর্মপীড়া, দেহের যন্ত্রণা এ সব নিয়ে কতো ডেকেছি আল্লাহকে, হয়তো সে ডাক তিনি শুনেছেন, না হলে আজও বেঁচে আছি কি করে?

মাঝে মাঝে কারও ব্যাধি মৃত্যু বা শারীরিক লাঞ্ছনা, ছাড়া দিন এমনি করেই গড়িয়ে যাচ্ছিল। বন্দিদের ভেতরে নানা বয়সের ও স্বভাবের মেয়ে ছিল। চৌদ্দ পনেরো বছরের মেয়ে থেকে চল্লিশ বছরের যৌবনোত্তীর্ণ মহিলাও ছিলেন। কেউ প্রায় সব সময়েই কাঁদতো, কখনও নিরবে কখনো সুর করে, তবে জোরে না। আওয়াজ বাইরে গেলে কঠোর শাস্তি পেতে হতো। কেউ না কেঁদে শুধুই চুপ করে থাকতো। মনে হতো বোবা হয়ে গেছে। কেউ কেউ গল্প করতো, হাসাতেও। নিস্তরঙ্গ জীবনে এমনি মৃদু কম্পন কখনও কখনও অনুভূত হতো।

খাবার আসতো টিনের বাসনে। বেশির ভাগ সময়েই ডাল-রুটি অথবা তরকারি নামের ঘ্যাট-রুটির সঙ্গে দেওয়া হতো। ভাত কখনও দেয় নি। যে মেয়েলোকটা খাবার দিতো সে বলতো কার কি জাত, তাই গোশতো দেওয়া হয়না। মনে মনে হাসলাম কারণ শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত তো পড়ে ফেলেছি। বিশ বছর ঘর করা সহজ কিন্তু হেঁসেলে ঢুকতে দেওয়া বড় কঠিন কাজ। তাই বিছানায় নিতে বাধা নেই কিন্তু গোমাংসে বোধ হয় বাধা আছে। না, পাকিস্তানিদের যতোটা হৃদয়হীন ভাবতাম ওরা প্রকৃতপক্ষে তা নয়। নইলে এমন করে জাত বাঁচাবার মহানুভবতা দেখানো কি সোজা কথা? যাক যার যা জাত তা অন্তরে রেখে দাও। দেহ তো মহাজনের ভোগে উৎসর্গ হয়েছে।

প্রথম প্রথম বাইরের কোনও খবর পাই নি। কিন্তু এ জায়গাটায় এসে এমন একটা জমাদারণী পেলাম যে ফিসফিস করে অনেক খবর আমাদের বলতে। প্রথমে জানলাম জায়গাটার নাম ময়মনসিংহ। কাছেই কমলগঞ্জ নাকি এক গঞ্জে খুব যুদ্ধ। হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। যুদ্ধ যে হচ্ছে সেটা টের পেলাম এই শয়তানদের কথাবার্তা থেকে। আমরা যারা প্রথম দিকে একসঙ্গে ছিলাম তারা কিন্তু একসঙ্গে নেই। একেক সময় একজন অথবা একাধিক জনকে বেছে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতো। জানতামও না কে কোথায় যাচ্ছি, কেনই-বা যাচ্ছি। তবে আজকাল আমাদের ক্যাম্পের থেকেই গোলাগুলির শব্দ শোনা যেতো। ভাবতাম এদিক ওদিক হয় একটা হয়ে গেলেই হয়। হয় বাঁচবো না হয় মরবো, এমনভাবে মরে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলেই বাঁচি।

একদিন হঠাৎ করে ভোররাতে সব কিছু ফেলে আমাদের জিপে করে কোথায় যেন নিয়ে গেল। যেখানে এলাম সেখানে কিছু তবু আর আমাদের জন্য কাঁচা বাঁশ ও দরজার বেড়া দেওয়া একটা বড় ঘর ও সঙ্গে টয়লেট। তবে বেড়ার ফাঁক দিয়ে বেশ আলো দেখা যায়। দিন-রাত বোঝা যায়। চারিদিকে নিঝুম মনে হয়, দিনের বেলা দিনের বেলা এখানে লোকজন প্রায় থাকেই না। কিন্তু রাঁধুনিটা বললো ওসব কথা মাথায় এনে পালাবার চেষ্টা করো না। জান খোয়া যাবে। ওরা একটু দূরেই গাছপালা দিয়ে ঝোঁপের মতো করে এখানেই থাকে। ওখান থেকেই তোপ দাগে। ভাবলাম তাহলে কি ওই হেডকোয়ার্টার মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে গেছে? আল্লাহ তাই যেন হয়। এখন সকাল-বিকাল বেশ শীত শীত করে, রাতে কম্বল পায়ে দিতে হয়। কখনও কখনও দিনেও ঠাণ্ডা লাগে। তাতে মনে হয় নভেম্বর বা ডিসেম্বর মাস হবে। ইস কতোদিন হয়ে গেল। এসেছি মে মাসে, আর আজ বছরের শেষ। আর কতো?

গোলাগুলির শব্দ প্রায় বন্ধ। রোজই রাতে ভারী ট্যাঙ্কের শব্দ পাই। মনে হয় এখান থেকেও জিনিসপত্র সরাচ্ছে। তাহলে যাচ্ছে কোথায়? কিন্তু না, সব আশা ব্যর্থ করে দিয়ে আবার আকাশ থেকে বোমা পড়ার শব্দ! কারা বোমা ফেলেছে? এ তো যুদ্ধ নয়, এক পক্ষই বোমা ফেলে চলেছে।

কোনও কথা কোথাও গোপন থাকে না। ফিসফিসানীর মাধ্যমে জানলাম ভারতীয়রা বোমা ফেলছে। কিন্তু ওরা কেন? আমরা আবার কার হাতে গিয়ে পড়বো? এ ক্যাম্পে একজন বয়স্ক হাবিলদার ছিল। প্রায় ষাটের কাছে বয়স। জাতিতে পাঠান হলেও লোকটার মনে মায়া মমতা আছে। আমার সঙ্গে কেন জানি না ভালো ব্যবহার করতো। আমি ভোগ্যপণ্য হলেও এতোদিন আমার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। কিন্তু আজ তিনদিন ওকে খুবই গম্ভীর ও ভারাক্রান্ত দেখছি। সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, খান সাহেব তোমার কি হয়েছে? বললো, পিয়ারী যুদ্ধ শেষ হয়ে এসেছে। খুশি হয়ে বললাম, এবার তাহলে তোমরা দেশে ফিরে যাবে? খুব আনন্দ হচ্ছে না? কিন্তু আমাকে কোথায় ফেলে যাবে? লায়েক খান মাথা নেড়ে জবাব দিলো, না বেগম, দেশে ফিরে যাবো না। তোমার দেশেই আমার কবর হবে। আমরা হেরে গেছি। কয়েক দিনের ভেতর হয় আমাদের মেরে ফেলবে, না হয় বন্দি কবে। মুক্তির হাতে পড়লে বাঁচবার কোনো আশা নেই। আনন্দে উত্তেজিত হলেও বুদ্ধিহারা হলাম না। বললাম, সায়েব আমাকে শাদি করো, আমি তোমাকে মুক্তির হাত থেকে বাঁচাবো। লায়েক খান বোকা নয়, মাথা নেড়ে বললো, তা হবে না বিবি। ওরা আমাদের একজনকেও রাখবে না। পাঠান পুত্র বিষাদভরা কণ্ঠে বললো, তাছাড়া তুমি বেঁচে যাবে। দেশওয়ালার সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে, ঘর বসাবে, সুখে থাকবে। তুমি খুব ভালো মেয়ে। দেখো আমার কথা সত্যি হবে।

এবার জিদ ধরলাম, মা তোমার আমাকে বিয়ে করতে হবে। কারণ জানতাম, এ না হলে আবার না জানি কাদের হাতে গিয়ে পড়বো। আমার সমাজ আমাকে নেবে না এ আমি জানি। কারণ যেদিন ধরে এনেছিল সেদিন যখন কেউ এগিয়ে আসে নি আজও কেউ হাত ধরে নিয়ে যাবে না। কিন্তু বাবা, বড় ভাইয়া, লালু ওরা আসবে না। হঠাৎ দেখি আমার দু’গাল বেয়ে চোখের জলে বন্যা নেমেছে আর পিতৃস্নেহে লায়েক খান আমাকে কাছে নিয়ে চোখের জল মুছে দিচ্ছে। কাছে নিয়ে বললো, ঠিক আছে, এখন তো যুদ্ধ শেষ। ক্যাম্পের মৌলবী সাহেবকে বলে দেখি যদি রাজি হয়। আর কেউ জানবে না, শুধু তুমি আমি আর মৌলবী সাহেব।

ঠিক সন্ধ্যার আগে মৌলবী সাহেব নিকাহ পড়িয়ে দিলেন। তিনি এদেশীয় মনে হলো। বেশি কিছু পাওয়ায় খুব খুশি হয়েছেন। বললেন, ভালোই হলো তোর জন্যে, খান সাহেব ভালোমানুষ, তোকে ফেলবে না। পরদিনই ছোটাছুটি, চেঁচামেচি কিছু গুলির শব্দ। এদিক ওদিক লোকজন দৌড়োচ্ছে কিন্তু সিপাহীরা যার যার হাতিয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। আমি আমার স্বামীর কোমর ধরে ঝুলছি। কিন্তু কি আশ্চর্য! মানুষটা আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল না। কে যেন লাউড স্পীকারে হুকুম দিলো, ওরা সব হাতিয়ার ফেলে দিলো যার যার পায়ের কাছে। কিছু মুক্তি বাহিনীর লোক, কিছু বিদেশী সিপাই মনে হলো। কারণ ওরা হিন্দিতে হুকুম করছিল। জানালো বন্দি মেয়েরা মুক্ত। ওদের অভিজ্ঞতা আছে তাই কিছু শাড়ি সঙ্গে এনেছে। সবাই পরে পরে যে যেদিকে পারলো ছুটলো।

আমি শাড়ি পরলাম কিন্তু লায়েক খানের হাত ছাড়লাম না। এতোক্ষণে বুঝলাম হিন্দী ভাষীরা ভারতীয় সৈন্য। একজন বললো, মা, তোমার ভয় নেই, তুমি বললে তোমাকে তোমার ঘরে পৌঁছে দেবো। আমার স্বামী করুণ নয়নে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম আমার কোনো ঘর নেই, ইনি আমার স্বামী। আমাদের ধর্মমতে বিয়ে হয়েছে। একে যেখানে নেবেন আমিও সেখানে যাবো। সেপাই হাসলো, পাকিস্তানি জওয়ানদের সঙ্গে আমাকেও বন্দি হিসেবে নিয়ে ট্রাকে তুললো। অফিসার একজনও ছিল না। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সব পালিয়েছে। অবশ্য পরে শুনেছি পথে অনেকেই মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে তাদের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করেছে। তারা এই পশুদের কাছ থেকে যে অত্যাচার পেয়েছে তার প্রতিশোধ নিয়েছে নিমর্মভাবে। তবে ভারতীয় সৈন্যরা পেলে বন্দি করেছে, মারে নি কারণ যুদ্ধ যখন শেষ হয়ে গেছে, বন্দিকে ওরা মারবে না। এটা নাকি যুদ্ধের নীতি বিরুদ্ধ। জানি না সবই খানের কাছ থেকে শোনা কথা।

এবার আমাদের গন্তব্যস্থান সোজা ঢাকা সেনানিবাস। পথে আরও ট্রাক, জিপ চললো আমাদের সঙ্গে সঙ্গে। ঢাকায় ব্যারাকে পৌঁছোলাম। ওদের অফিসাররা সুন্দর সব বাড়িতেই আছে। আমাদের ব্যারাকেই রাখলো। কিন্তু হাবিলদার একটি আলাদা কামরা পেলো তার জরুর জন্য। আমি বেঁচে গেলাম। কেমন করে তাই ভাবছি।

লায়েক খানের শোকরানা নামাজ পড়া বেড়ে গেল কারণ ও ভাবতেও পারে নি যে জানে বাঁচবে। শুধু বার বার বলে আমার তকদীরে ও বেঁচে আছে। আর বেঁচে যখন আছে তখন দেশে একদিন না একদিন ফিরবেই আর বিবি বাচ্চার সঙ্গে দেখা হবেই। সব শুনে থেকে থেকে বুকটা কেঁপে ওঠে তাহলে আমাকে কোথাও ফেলে দেবে। ও আমাকে আশ্বাস দিলে মোসলমানের বাচ্চা যখন হাত ধরেছে তখন ফেলবে না। এটা তর্কের সময় নয়, কারণ উপস্থিত আমার সমূহ বিপদ। নইলে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল এ পর্যন্ত তোমরা কতজনের হাত ধরেছে আর ছুঁড়ে ফেলেছে। কিন্তু জিভ, ওই সব আমার এখন বন্ধ।

আমরা পৌঁছোবার পরদিনই আমাদের নাম-ঠিকানা লিখে নিয়ে গেল। আমাদের সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ময়মনসিংহ কলেজের দু’জন উচ্চ শিক্ষিত মহিলা ছিলেন। এখানে প্রায় ত্রিশজন আমরা সব সময়েই একসঙ্গে থাকতাম ও শলাপরামর্শ করতাম। আপারা বললেন, নাম-ঠিকানা সব ঠিকঠাক মতো দিতে, দেশের লোক জানুক এ পশুরা আমাদের কি করেছে।

চারদিনের দিন বাবা এসে হাজির। আমাকে ডেকে নিয়ে একটা ঘরে বসালো। বাবা এলেন, একি চেহারা হয়েছে বাবার। জীর্ণ-শীর্ণ দেই। এই ক’মাসে অর্ধেক মাথা শাদা হয়ে গেছে। কয়েক সেকেন্ড দুজনেই নীরব রইলাম তারপর ছোটবেলার মতো দৌড়ে বাবার কোলে আছড়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ দু’জনেই শুধু কাঁদলাম। তারপর বাবার কাছে শুনলাম আমাকে নিয়ে যাবার প্রায় ঘন্টা দুই পরে বাবা আসেন। বড়ভাই আর আসে নি, ওখান থেকেই মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে চলে যায়। বাবা এসে লালুকে পাগলের মতো কাঁদতে দেখেন। মা ও মিলুকে হাসপাতালে নিয়ে যান। খোদার রহমতে মিলু ধীরে ধীরে ভালো হয়ে ওঠে কিন্তু মা হাসপাতালেই মারা যান। চোখ মুছে শোক ভুলে বাবাকে উঠে দাঁড়াতে হয়। অন্নের যোগাড় করতে নরসিংদীতে আসতে হয় দোকান চালাতে। শেষের দিকে দোকান প্রায়ই বন্ধ থাকতো। আমার কথা বলে অনেকে সহানুভূতি দেখাতো, অনেকে টিটকারী দিতো, আমি নাকি ইচ্ছে করে লাফিয়ে জিপে উঠেছি। যারা আমার সন্ধান দিয়েছিল তারাই বাবাকে বেশি নির্যাতন করেছে। কিন্তু ১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যেই সব পালিয়েছে। বড়ভাই পাগলের মতো ওদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে আবার কি ঘটায় কে জানে। আমার দুচোখের পানিতে তখন আমার বুকের শাড়ি ভিজে গেছে।

বাবা বললেন, চল মা তোর নিজের ঘরে ফিরে চল। বড় দুর্বল হয়ে পড়লাম। মনে হলো বাবার সঙ্গে ছুটে যাই আমাদের সেই আনন্দময় গৃহে, যেখানে লালু, মিলু, বড় ভাই আজও আমার পথ চেয়ে আছে। কিন্তু না, এই মানুষটিকে আর আঘাত দিতে আমার মন চাইলো না। বাবাকে বললাম, তুমি ফিরে যাও, আমি এদের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলে দেখি। ওরা আমাদের জন্য কি ব্যবস্থা করবে। বাবা নাছোড়বান্দা। বললেন, আমি কারও কোনো অনুগ্রহ চাই না, তুই আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকবি। যেমন এতো বছর ছিলি। অনেক কষ্টে সেদিন বাবাকে ফিরিয়েছিলাম। আমরা একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, শুধু পাকিস্তানি দস্যু নয়, নিজেদের দুর্বৃত্তদেরও চিনেছি এ দুর্দিনে। যারা আমাদের জায়গা দেবে তাদের অবস্থা কি দাঁড়াবে? নিজেরা তো মরেছি, ওরা তো এমনি মরে আছে, ওদের আর মেরে লাভ কি?

তবুও বাড়ি ফেরার লোভটাকে কিছুতেই ছাড়তে পারছিলাম না। সেই শোবার ঘরের কোণের শিউলী গাছটী, মা রোজ সকালে ওজু করে এক বদনা পানি ওর গোড়ায় ঢালতেন। ডিসেম্বর মাস, না ফুল এখনও শেষ হয় নি। পাড়ার মেয়েরা হেনা, রাবু সব আসতো ফুল কুড়াতে। বাবাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম ওরা কি আছে না আমার মতো হারিয়ে গেছে? আর কখনও ওই ফুল ছুঁয়ে দেখবো না। আমি তো আজ সবার কাছে অপবিত্র, অস্পৃশ্য! মনে পড়লো রান্না ঘরের মেঝেতে পিড়ি পেতে রাতে সবাই একসঙ্গে খেতে বসতাম। মা সবাইকে দিয়ে পরে নিজে খেতেন। আমার খাওয়া হলে উঠে যেতাম পড়াশোনার তাগিদে। মা খেতেন। বাবা বসে বসে মায়ের সঙ্গে গল্প করতেন। কুপির আলো মায়ের মুখের একপাশে এসে পড়তো, আলোর শিখাটা কাঁপতে মায়ের মুখও, যেন কেঁপে কেঁপে উঠতো। হঠাৎ ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম, মা, মাগো। সঙ্গীরা সান্ত্বনা দিতো। তবুও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সীমা ছিল না।

তারপর একদিন তিনজন আপা এলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে! খুঁটে খুঁটে সব শুনে বললেন, কেন তোমরা পাকিস্তানে চলে যাচ্ছো? দেশ তোমাদের দায়িত্ব নেবে। প্রধানমন্ত্রী তোমাদের বীরাঙ্গনা খেতাব দিয়েছেন শোনোনি? নীরা আপা, সবচেয়ে শিক্ষিত, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। তিনি আপাদের সঙ্গে যথেষ্ট তর্ক বিতর্ক করলেন। ইতিমধ্যে আগত তিন আপার নাম জেনেছি নওশাবা, শরীফা আর নীলিমা। এরা এসেছে আমাদের ফিরিয়ে নিতে। হঠাৎ করে ঐদিন আবার বাবাও এসে উপস্থিত হয়েছেন। আমাদের ভেতর অধিকাংশই বিবাহিত ছিলেন, তাঁদের স্বামী এসেছে, কথা বলেছেন, কেউ কেউ শাড়ি উপহার দিয়ে গেছেন, কিন্তু ফিরিয়ে নিতে পারবেন না একথা অসংকোচে জানিয়ে গেছেন। কারণ তাদের সমাজ আছে, সমাজে আর পাঁচজন আছে। তাদের ভেতর তো এ ভ্ৰষ্টা কলঙ্কিনীদের নিয়ে তোলা যাবে না। স্বামীর ইচ্ছা আছে তবে উপায় নেই। এসব মন্তব্য থেকে আমরাও আমাদের অবস্থান জেনে নিয়েছিলাম! স্বামী যখন ঠাই দিতে পারে না, তখন কোন রাজপুত্র আমাদের যেচে এসে ঘরে নেবে। সুতরাং না, আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অটল। আমার বয়স ছিল সবচেয়ে ম। আমি বললাম- আপনারা যে আমাকে থাকতে বলছেন আমি কোথায় থাকবো?

এক আপা বললেন, কেন, তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে এসেছেন, বললাম বাবার ঘাড়ের বোঝা হবো না। এক আপা বললেন, বেশ তো তুমি আমার কাছেই থাকবে। হঠাৎ কেন জানি না আমি জ্বলে উঠলাম, আপনার কাছে থাকবোর প্রতিদিন চিড়িয়াখানার জীবের মতো আমাদের দেখার জন্য আপনার বাড়ির দরজায় দর্শনার্থীর ভীড় হবে। আপনি গর্বিত মুখে আমাকে দেখাবেন কিন্তু তারপর আমার ভবিষ্যৎ কি হবে? ঐ আপা আমার আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, পাকিস্তানে যেতে চাও? ওখানে কি পাবে। ওখানে তো তোমাকে নিয়ে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেবে এরা। তাতে তোমার কোনো সুবিধা হবে? সুবিধা এই হবে আপা ওখানে পতিতাবৃত্তিই করি আর রাস্তাই ঝাড় দেই লোকে আমাকে চিনবে না, স্বামী সন্তান অন্তত সামনে দাঁড়িয়ে টিটকারী দেবে না। ওরা ক্ষুব্ধ হয়ে চোখ মুছে চলে গেলেন। শুনেছি কলকাতা থাকতেই নীরা আপাকে তার ভাইয়েরা ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। জানি না, তিনি কোথায় কতোটা সুখ ও সম্মানের জীবন যাপন করছেন।

বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন। চারদিকে স্বাধীনতার উৎসব। শুধু অন্ধকার গুহায় সর্বস্বান্ত আমরা ক’জন বন্দিনী নিঃস্ব রিক্ত। আজ নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দেবার সম্বলটুকুও আমরা খুইয়ে বসে আছি। কেন এমন হলো? শুধু আমরা নারী বলেই অপবিত্র আর রাজাকার আল-বদরেরা পাপ করেও আজ সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। এ তোমার কেমন বিচার আল্লাহ? তবে তোমার কাছে নাকি সব সমান? আল্লাহর কানে শুধু পুরুষের বক্তব্যই পৌঁছোয়, দুর্বল ভীরু নারীর কণ্ঠ সেখানে নীরব।

যাক শেষ পর্যন্ত ভারত হয়ে পাকিস্তানে এসে পৌঁছোলাম। এখন লায়েক খানের একমাসের ছুটি। এরপর সে জানতে পারবে কোথায় সে থাকবে। ইতোমধ্যে আমি বুঝতে পেরেছি আমি সন্তান সম্ভবা। আমার স্বামীও বুঝেছেন। আমাকে অভয় দিয়ে বললেন তার প্রথম স্ত্রী কখনও গাঁয়ের বাইরে আসবে না। তাই ও আমাকে সাথেই কর্মস্থলে রাখতে পারবে। এতোদিন ছিল নিজের চিন্তা এখন এই ক্ষুদ্র জীবের অস্তিত্ব আমাকে চঞ্চল করে তুললো। আমরা রাওয়ালপিন্ডিতে লায়েকের এক দোস্তের বাড়িতে উঠলাম। ওরা লোক খুব ভালো। আমাকে বেশ আদর করেই গ্রহণ করলেন। কোনও জিজ্ঞাসা কোনও সন্দেহ বা ইতস্ততভাব ওদের ভেতর দেখলাম না। লায়েক খান ওদের কাছে আমাকে দিন পনেরোর জন্যে রেখে দেশে গেল বিবি বাচ্চাকে দেখতে। আমি মনে মনে প্রমাদ গুণলাম। কিন্তু লাল খানের স্ত্রী আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন-লায়েক খান অত্যন্ত পরহেজগার মানুষ। তাকে অবিশ্বাস করবার কোনও কারণ নেই। তাছাড়া পাঠানেরা কথার খেলাপ খুব কমই করে। ভাষা বুঝি না কারণ ভাঙা ভাঙা উর্দু বুঝলেও পোশতু আমার বোধগম্য হতো না তখন। ইশারা ইঙ্গিতে লাল খানের স্ত্রীর সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। প্রথম দর্শনেই ও বুঝতে পেরেছে আমি মা হতে চলেছি। বললো, আল্লাহ্ করুক, তোমার একটা মেয়ে হোক। দেখোনা, আমার দুটো ছেলে আমার কাছেও আসে না। বাপের সঙ্গে সঙ্গে অফিসে বাজারে গাঁয়ের খেতি খেলায় সব জায়গায় যায়। একটা মেয়ে থাকলে আমাকে ঘর গেরস্থালির কাজে কতো সাহায্য করতে পারতো, আমার সঙ্গে সঙ্গে তো ফিরতো। ভাবলাম নারীর দুর্ভাগ্যের কথা ও জানে না, তাই ও মেয়ে চায়। মেয়ে হলে আমি হয়ত গলা টিপেই মেরে ফেলবো। লায়েক খানের মুখেও শুধু মেয়ে মেয়ে। অবশ্য মেয়ের বিয়েতে ওরা টাকা পয়সা পায়, আর ওদের দেশে মেয়ের সংখ্যা কম তাই এতো কন্যাপ্রীতি।

ঠিক সময় মতো লায়েক খান ফিরে এলো এবং তদ্বির করেই তার পোস্টিং যোগাড় করলো। থাকতে হবে করাচীতে। লায়েকের কোনও চিন্তা নেই ওখানেও ওর অনেক পেশোয়ারী দোস্ত আছে। দেখলাম ও বেশ বন্ধুবৎসল। লাল খানের বউকে একটা রূপার হার উপহার দিলো, অবশ্য বন্ধুর হাত দিয়ে। এরা পরস্পরকে ভাইবোনের মতো দেখে, দরজার আড়ালে থেকে কথাও বলে তবে সামনে আসে না। গলাগলি করে হেসে কেঁদে বিদায় নিলাম।

অতঃপর এলাম করাচীতে। লায়েক খান দেশ থেকে বেশ খোশ মেজাজেই ফিরে এসেছে। বউয়ের কথা অবশ্য আমাকে কিছু বলে নি, কারণ জানে আমার শুনতে ভালো লাগবে না। ওর দুই ছেলে বড় জনের বয়স ১৭ বছর। আর তার পরের ছেলের বয়স ১৪ বছর। মেয়ে সবচেয়ে ছোট। তার নাম ফাতিমা। এই মেয়ের গল্পই সে সব চেয়ে বেশি করে। আমিও জিজ্ঞেস করি, সেও উত্তর দিয়ে খুশি হয় এবং তার কথাবার্তায় বুঝলাম আমার কথা বিবিজান এখনও জানেন না, জানাবার মতো সাহস এবৃদ্ধের নেই। মাঝে মাঝে আমারও ভয় হয়, কে জানে জানতে পারলে আমার গলা কাটবে কিনা, তবে ভরসা বিবিজান গাঁয়ের বাইরে আসেন না। শেষ পর্যন্ত ছেলে হলো আমার। দিব্যি স্বাস্থ্যবান আর বাপের মতোই সুপুরুষ। মেয়ে হয় নি বলে খোদার কাছে শুকরিয়া জানালাম। যাক দুর্দিন এলে ছেলেকে বুকে নিয়ে গাছতলাতেও পড়ে থাকতে পারবো।

ধীরে ধীরে আশে পাশের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ হলো। লায়েক খানকে সামরিক বাহিনী থেকে পেনসন দেওয়া হলো। ও করাচীতে একজন সামরিক অফিসারের বাড়িতে নাইট গার্ডের চাকুরি নিলো। বড়বাড়ি। আউট হাউজের এক পাশে ছোট একটা ঘর, পাকের ঘর, গোসলখানা তাদের জন্য বরাদ্দ হলো। বাড়িতে আরও নোকর নোকরানী আছে, তাদের সব থাকবার ব্যবস্থা স্বতন্ত্র। স্বামীর কাছে জানতে পারলাম বাড়ির মালকীন বাংলাদেশের মেয়ে। লায়েক খানের কাছ থেকে সব শুনে তিনি আমাকে দেখতে চেয়েছেন। একদিন সাহস সঞ্চয় করে স্বামীর সঙ্গে গেলাম তাঁকে সালাম জানাতে। স্বামী বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো, আমি ভেতরে ঢুকলাম। সুন্দর অমায়িক ব্যবহারে সালমা বেগম আমাকে অতি সহজেই আপন করে নিলেন। বাড়িঘরের কথা, বাবা-মার কথা সব জিজ্ঞেস করলেন। ওদের চিঠি লিখতে বললেন তার ঠিকানায়। কতো কথা যে তার অন্তরে জমেছিল তাই ভাবি। শেষ পর্যন্ত আমি ওঁর ঘরে কাজ নিলাম। আমি ওঁর কাজ করবো। ওদের সন্তানাদি নেই। জামা-কাপড় ধোয়া, ইব্রিরি করা, বিছানা করা, ঘর গোছানো, পার্টি হলে তার ব্যবস্থা করা এমন কি মাঝে মাঝে বাংলাদেশের মতো মাছ-তরকারিও আমি তাকে রান্না করে দিতাম। ওঁর কাছে বাংলা বইও ছিল অনেক। সেগুলোও মাঝে মাঝে চেয়ে নিতাম। আমার জীবনে এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে গেল।

সালমা বেগমের উৎসাহে ও সাহসে দেশে আব্বাকে চিঠি লিখলাম সব কিছু জানিয়ে এবং তাঁদের খবরা খবরও জানতে চাইলাম। ঠিকানা সালমা বেগমের। এক মাসের ভেতর বাবার চিঠির উত্তর পেলাম। তারা ভালো আছেন। নাতিকে দোয়া জানিয়েছেন। দেখতে না পারার জন্য দুঃখ করেছেন। ব্যবসা বড়ভাই ও সালু চালাচ্ছে। আব্বা আর দোকানে যান না। যা জমি-জিরাত আছে তাই তদারকি করেন। মিলু এবার ম্যাট্রিক দেবে। এ বছর বড়ভাই বিয়ে করেছেন। তখন আমার ঠিকানা জানলে আমাকে নিশ্চয়ই দাওয়াত পাঠাতেন। তার শরীর ভালো না। তিনি আম্মার কাছে যাবার প্রতীক্ষায় আছেন। সমস্ত চিঠিতে কেমন যেন একটা ক্লান্তি ও শুনতার সুর। আমি থাকলে বাবাকে মায়ের জন্য এতো কাতর হতে দিতাম না। কিন্তু কি আশ্চর্য বাবা আমাকে একবারের জন্যও যেতে লেখেন নি। ভালো লাগলো দেশের লোকেরা এখনও পাকিস্তানিদের জঘন্য অত্যাচারের কথা মনে রেখেছে ভেবে। আজ অবস্থার প্রেক্ষিতে আমি বৃদ্ধ অশিক্ষিত লায়েক খানের গৃহিনী কিন্তু যদি সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশে থাকতাম তাহলে সম্ভবত একটা ভদ্র পরিবারে থাকতে পেতাম। না হয় অর্থ-সম্পদ নাই পেতাম। তারপর সমুদ্রে ডুবে যাই আমি। তবুও এই বাঙালি মহিলাকে পেয়ে আমি যেনো নতুন আলো পেয়েছি জীবনের।

আমি আবদার ধরলাম ছেলের নামকরণ করবো আমি। স্বামী রাজি হলেন। আকিকায় ছেলের নাম রাখা হলো তাজ খান। সবাই খুশি সুন্দর নাম আর আমি মনে মনে স্মরণ করলাম এক পরম সাহসী মহান বাঙালি বীর যোদ্ধাকে। যিনি যুদ্ধজয় করেও, জয়ের গৌরব থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কে জানে বিধির বিধান বুঝতে পারি না।

দিন দ্রুত কেটে যাচ্ছে। এর ভেতর আমি সেলাই শেখার কেন্দ্র থেকে নানা রকম সুচিশিল্প শিখে ফেলেছি। ঘরে বসেই কাজ করি, বেশ ভালো আয় হয়। সালমা বেগম আমাকে তার পরিচিত মহলে কাজ করবার সুযোগ করে দিলেন। লায়েক খান মনে হয় খুশিই হলো কিন্তু কোনও দিন আমার কাছ থেকে একটি পয়সাও নেয় নি। দিতে গেলে বলেছে তোমার খাওয়া পরার দায়িত্ব আমার। আমি তোমাকে কিছুই দিতে পারি নি। এখন তো ঘাড়ের উপর দু’সংসার। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে তোমার জীবনটা আমি বরবাদ করে দিয়েছি। আমি ওর মুখ চেপে ধরতাম, বলতাম তুমি আমাকে উদ্ধার না করলে আমি ভেসে যেতাম। তোমার জন্য আমি স্বামী পেয়েছি, সংসার পেয়েছি, তাজের মতো বুক জুড়ানো সন্তান পেয়েছি। সালমা বেগমের জন্য আমি অর্থ পেয়েছি বাইরে ইজ্জত পেয়েছি। একটা মেয়ে আর কি চায়। তবুও আমার স্বামী একটা কথাই বলতো, তোকে নিয়ে আমি ঘর বসাতে পারলাম না অর্থাৎ নিজের দেশে নিজের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলো না। আমি ভাবতাম এ আমার শাপে বর হয়েছে। ঘর বসালে তোমার জীবনে ক্ষেতির কাজ আর গম পিষতে পিষতে আমার জীবনটা শেষ হয়ে যেতো। এ তো ভালোই আছি একরকম। তাজের বয়স যখন পাঁচ, স্বামী আবদার জুড়ালো ওকে একবার দেশে নিয়ে যাবেন। সালমা বেগমের পরামর্শ চাইলাম, উনি বললেন যেতে দে, কি আর হবে? ছেলেই তো, মেয়ে হলে ভয়ের কথা ছিল। দু’সপ্তাহের জন্য তাজ বাপের হাত ধরে মাথায় জরির টুপি পরে সেজে গুঁজে চলে গেল তার নিজের ঠিকানায়। মনকে সান্ত্বনা দিলাম আজ না হলেও দশ বছর পরে তো লায়েক চলে যাবে। তখন তাজ তো, সগর্বে বলবে আমি আগে পাঠান পরে পাকিস্তানি। যেমন একদিন আমরাও সগর্বে বলেছিলাম, আমরা আগে বাঙালি পরে মুসলমান, পাকিস্তানি আর সব। মনে হলো লায়েক খানের আমানত যা আমি গর্ভে ধারণ করেছিলাম, এ পাঁচ বছর প্রতি মুহূর্তের স্নেহ দিয়ে বড় করেছি তাকে আজ তার হাতেই ফিরিয়ে দিলাম। কেমন যেন সব কিছুই আমার কাছে শূন্য হয়ে গেল।

আমার সব কথাই সালমা বেগমকে বলতাম কারণ তারও তো ভেতরে একটা গভীর ক্ষত আছে। যার রক্তক্ষরণ শুধু আমিই উপলব্ধি করি, তার বংশ নেই। অন্য সময় তো তিনি হাসি-খুশি পতি পরায়ন স্ত্রী, সন্তান না পাবার দুঃখ সম্পর্কে বলতেন, মেহের আমার খুব বেশি দুঃখ নেইরে, কি হতো সন্তান থাকলে? ওরা তো আমার হতো না, আমার পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ কতো, লুকিয়ে থাকতো। ওর এক ভাইয়ের ছেলেকে কাছে রেখেছিলাম। পেটের ছেলে কেমন হয় জানি না কিন্তু সোহেল আমার বুক জুড়ে ছিল। একদিন টাকা পয়সার কি ব্যাপার নিয়ে দু’ভাইয়ে মনোমালিন্য হলো। আমার জা আর দেওর এসে ছেলেকে কেড়ে নিয়ে গেল। মেহের, যাবার সময় তার আর্ত চিৎকার আম্মি আম্মি আমার আজও কানে বাজে। এখন সে আমেরিকায় পড়াশুনা করে। চিঠি লেখে। কিন্তু যে বাধন ছিঁড়ে গেছে তাকে আর আমি জোড়া লাগাতে চাই না। হঠাৎ এমন হলো কেন বেগম সাহেবা? মুচকি হাসলেন সালমা বেগম। মেহের, দুনিয়াটা বড় রুক্ষ্ম বড় শুকনো। আমি অথবা ওর চাচা মরে গেলে আমাদের সব সম্পত্তিই সোহেল পেতো তেমন ব্যবস্থা সাহেব করবেন বলেছিলাম। কিন্তু আমার দেওর হঠাৎ একদিন এসে বললো, তোমার পিণ্ডির বাড়িটা সোহেলকে দিয়ে দাও। বাড়িটায় একটা ভালো হোটেল চলছে, ভাড়াও অনেক পাই আমরা। উনি বললেন, হঠাৎ এ কথা কেন? দেওর বললেন, খোদা না খাস্তা তোমার কিছু হলে ভাবিকে বিশ্বাস কি? বাংলা মুলুকের মেয়ে ওর ঈমানের ঠিক আছে? আমার স্বামী হঠাৎ প্রচণ্ড রকম রেগে গেলেন। মানুষটা খুবই শান্ত ও ধীর স্বভাবের। কিন্তু কঠোর ভাষায় ভাইকে বকাবকি করলেন! ওকে বোবা বানিয়ে দিয়ে ছেলের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। ভেতরে এসে আমার হাতটা ধরে বললেন, সালমা, ধৈর্য ধরো, দুঃখ করো না, আমার ঘরে সন্তান নেই। যদি বুক দিয়ে আমরা ভালোবাসতে পারি, তবে সারা পৃথিবীর এতিম আমাদের সন্তান। করাচীর দুতিনটা এতিম খানায় এরপর থেকে উনি নিয়মিত অর্থ সাহায্য করেন। আমি বললাম, বেগম সাহেবা ঈদের দিনে অনেক লোক আসে বাচ্চা নিয়ে ওরা কারা? আরে ওরাই তো এতিমখানার বাচ্চার। ঈদের সময় তিনদিন পালা করে এদের খাওয়াই। কাপড় জামা কিনে দিই। ওটাই আমার সারা জীবনের সব চেয়ে বড় উৎসব। এখন কিন্তু আমার খারাপ লাগে না। মেহের তোকে বলে রাখি এমনি করে লায়েক খানও একদিন ওর বাচ্চাকে টেনে নিয়ে যাবে। ওরা সব কিছুর ওপর ওদের কওমের মর্যাদা দেয়। মাথা নিচু করে বললাম, তবুও বেগম সাহেবা আমি অন্তত ওকে লেখাপড়া করাবার চেষ্টা করবো আর আশা করি তাজের আব্বারও ওতে আপত্তি হবে না। না হলেই ভালো, জবাব দিলেন সালমা বেগম।

একদিন কথা প্রসঙ্গে সালমা বেগমকে বললাম, এখানে তো কতো হাউজিং আছে। আমার মতো গরীবরা মাস মাস টাকা দিয়ে ঘর নেয়। আমাকে যদি একটা ব্যবস্থা করে দিতেন কারণ আমি জানি লায়েক খান আর খুব বেশিদিন থাকতে চাইবে না। তখন আমার কি উপায় হবে। আমার তো বেশ কিছু টাকা জমেছে। দরকার হলে আমি আরও বেশি করে কাজ করবো। সালমা বেগম চেষ্টা করবেন বললেন এবং মাসখানেক পর সত্যিই খবর আনলেন একটা হাউজিং-এর দু’কামরার ঘর, সঙ্গে ডাইনিং ও ড্রইংরুম এবং পাকঘর ও বাথরুম। প্রথমে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হবে। পরে কিস্তিতে শোধ দিলে হবে। মোট দাম পড়বে আড়াই লাখ টাকা।

সালমা বেগমের কাছে আমি টাকা জমাই। সেখানে চল্লিশ হাজার টাকা জমেছে। আমি ভাবতেও পারি নি আমার এতো টাকা হয়েছে। বললেন, বাড়ি তুমি দেখে এসো, টাকার দায়িত্ব আমি নেবো। তবে একটা কথা এ বাড়ি নেওয়ার ব্যাপারে তুমি লায়েক খানকে কিছু জানিও না। পুরুষ বড় লোভী আর স্বার্থপর জাত। তাছাড়া ওরা পাঠান, রাগলে না পারে এমন কাজ নেই। সব টুকুই তোমাকে গোপনে করতে হবে। এখন বাড়ি নিয়ে ভাড়া দিয়ে দিও, তার থেকেই তোমার বাকি দেনা শোধ হয়ে যাবে। কাটা আমার মনে ধরলো। আমি সালমা বেগমের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে বাড়ি দেখে এলাম। আমার জন্য যথেষ্ট। আর বস্তির মতো নয়। বেশির ভাগই গরীব কেরানি, মাস্টার, সুতরাং পরিবেশ খারাপ নয়। সালমা বেগম দলিল তৈরি, লেখাপড়া, রেজিস্ট্রি ও পরের সব কাজই ওঁর সায়েবের অফিসের একজন বিশ্বাসী লোক দিয়ে করিয়ে দিলেন। আমি শুধু সঙ্গে সঙ্গে রইলাম এই পর্যন্ত। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি বাড়িটুকু নিয়ে আমার মনে হলো আমি শক্ত হয়ে দাঁড়াবার মতো এক টুকরো জমি পেয়েছি। লায়েক খান আজকাল বেশ ঘন ঘন দেশে যায়। বলে শরীর এখন আর নোক্রী করবার মতো নেই। সায়েবকে বলে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। বললাম, আমার তাজের কি অবস্থা হবে? নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলো লায়েক খান, আমি বেগম সায়েবাকে বলে যাবো তোমাকে এখানেই রাখবেন আমি মাস মাস তোমার খোরাকি পাঠাবো। আর তাজ আমার ছেলে ওদের ভাইদের সঙ্গে বড় হবে। তাছাড়া ওর আম্মি ওকে খুবই পেয়ার করে। ওর জন্যে ভেবো না। কতো সহজে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। কিন্তু আমি তাকে ছেড়ে থাকবো কি করে? তোমাকে থাকতেই হবে কারণ ওকে তো ওর বেরাদারীর সবাইকে জানতে হবে, চিনতে হবে। আমি ওকে কারও বাড়িতে নোকরী করতে দেবো না।

মৃদু কণ্ঠে বললাম, যাবে কবে? এখনও ঠিক করি নি দু’চার ছমাস আরও দেখবো তারপর যাবো। কিন্তু তাজের স্কুলের কি হবে? বলেছি না, ওর ভাইয়েরা আছে, ওর জিম্মাদরি নেবার লোকের অভাব হবে না। আমি পাথর হয়ে গেলাম। ঐ শিশুকে আমার বুক থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে আর আমার খোরাকি পাঠিয়ে নিজেকে দায়মুক্ত করবে। আমার সাহস থাকলেও প্রকাশের ক্ষমতা নেই। এ বিদেশ বিভুঁইয়ে আমি একটা বাঙালি মেয়ে। বয়স কম, সুতরাং উদ্ধত আচরণ করার শক্তি কোথায়? সালমা বেগম অবশ্য এমনি একটা ঘটনার আভাস আমাকে বার বার দিয়েছেন। উনি দীর্ঘদিন আছেন। এদের আচার ব্যবহার রুচি তার তো কিছুই অজানা নেই। স্বামীর কর্তৃত্ব আমার দেশেও আছে, কিন্তু এমন ভয়ানকভাবে নয়। একটা পয়সার জিনিস কিনতে হলে স্বামীর অনুমতি লাগবে, ঘর থেকে এক পা বেরুতে হলে স্বামীর হুকুম আবশ্যক। দাসী আর কাকে বলে। নিজেকে সামলাতে দু’একদিন লাগলো। তারপর সালমা বেগমের কাছে গিয়ে একেবারে ভেঙে পড়লাম। উনি স্বান্ত্বনা দিয়ে বললেন, এমন যে হবে তা আমি তোমাকে আগেই বলেছি। ওর বয়স হয়েছে, এখন বউয়ের সেবা যত্ন চায়। তাছাড়া তুমি ওরটা যতোই করো ওরও একটা পারিবারিক নিয়ম কানুন আছে। তোমার কাছে ও একেবারে খোলামেলা হতে পারে না। ও ভুলতে পারে না তোমার সঙ্গে ওর ব্যবধানটা। সুতরাং শক্ত হও, নিজেকে বাঁচাবার কথা ভাবো। ধীরে ধীরে আমার মানসিক উত্তেজনা কমে এলো। সালমা বেগমের কথার সত্যতা উপলব্ধি করলাম। সত্যিই তো আমার কি হবে? ভেবে আর কি করবো, যা হবার তাই তো হবে। জীবনে তো চড়াই উত্রাই কম হলো না। কষ্ট পেয়েছি কিন্তু যেভাবেই হোক প্রতিরোধ করতেও তো সক্ষম হয়েছি।

এরপর স্বামী চুপচাপ। যে যার কাজকর্ম করে চলেছি। দিন দেখতে দেখতে যায়। আজ দশ বছরে পড়লো। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে। স্কুলের বাস এলে ও যখন ওঠে, আমি এক দৃষ্টে চেয়ে থাকি। লায়েক খান কি ভাবে জানি না, তবে আমি তো জানি যে ও আমারই সন্তান। গৌরবর্ণ সুঠাম দেহের বালক রীতিমতো বাড়ন্ত গড়ন দেখে মনে হয় তেরো চৌদ্দ বছর বয়স। লেখাপড়াতেও বেশ ভালো। আমি ওকে পুরোপুরি সাহায্য করতে পারি না। কারণ ও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে, তবে যতটুক পারি করি। ও নিজেই খুব মনোযোগী ছাত্র। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ও এখনই কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পারে। বুকটা কেঁপে ওঠে, যখন ভাবি এসব ফেলে প্রচণ্ড রোদে ও ফসলের ক্ষেতে কাজ করছে। মনটা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে কিন্তু আমার আর উপায় কি? একদিন হঠাৎ তাজের আব্বা বললো, আগামী সপ্তাহে শুক্রবার আমরা যাবো। তাজকে তৈরি করে দিও। আমি মুখে কাপড় চাপা দিয়ে দৌড়ে পাশের ঘরে গেলাম। কানে এলো লায়েক খানের কণ্ঠ, কেঁদে কোনও লাভ নেই, শেরের বাচ্চা, শেরই হবে, কুকুর বিড়াল হবে না। কথাটা আমার অন্তরে কোথায় যে বিধলো ওই মূর্খ তা জানে না। বেশ বুঝলাম আজ নিরাপদ আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে ও আমার বাপ ভাইদের গালাগালি দিলো। একবার ভাবলো না, আমি ইচ্ছে করলে ওকে শিয়াল কুকুর দিয়ে খাওয়াতে পারতাম। বুঝলাম মানুষের জন্মভূমির টান বড় গভীর, তাকে ভুলে থাকলেও ভোলা যায় না। আজ আমার ও লায়েক খানের মধ্যে সেই শেকড়ের দ্বন্দ্ব বেড়েছে। কিন্তু তাজ? দুই নদীর মোহনায় দাঁড়িয়ে সে কি করবে?

তাজ স্কুল থেকে ফিরলে আমি ধীরে ধীরে তাকে সব কথা বললাম। তার আব্বা তাকে আগেই বলেছে সে বয়স্ক মানুষের মতো ভ্রূ কুঁচকালো, কোনও শব্দ করলো না। যাবার আগের দিনে চোখের জলে আমি যখন তার জিনিসপত্র গোছাতে গেছি, তাজ রক্তচক্ষু করে আমাকে নির্দেশ দিলো-আমার কোনও জিনিস ধরবে না। ওর কাছ থেকে এই আমার প্রথম ধমক। থমকে গেলাম, তারপর আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। যাবার দিন তাজ যথারীতি তৈরি হলো স্কুলে যাবার জন্য, দেশে নয়। ওর আব্বা কি যেন বললো, ছেলে উত্তর দিলো আমার পরীক্ষার পর যখন আমাদের স্কুল বন্ধ হবে তখন যাবো। বড় আম্মাকে আমার সালাম পৌঁছে দিও। তারপর জানি না কি দিলো বাপকে, বললো, ফাতিমা বাহিনজিকে আমার কথা বলে দিও, আর আমার সালাম জানিও। লায়েক খান একটা কথাও বললো না, সত্যিই শেরকা বাচ্চা শের আমি সেটুকুই বুঝলাম। লায়েক খান চলে গেল। আমাকে শুধু বললো, তোমার বেটা লায়েক হয়েছে সাবধানে রেখো। তুমিও সাবধানে থেকো। ওর স্কুল বন্ধ হলে চিঠি লিখতে বলো, আমি এসে ওকে নিয়ে যাবো। চোখের জলে তাকে বিদায় দিলাম। আমি চাই নি সে যাক, কিন্তু তার প্রথম জীবনের প্রেম, বয়স্ক দুই ছেলে, অতি আদরের ফাতিমা–এদের ফেলে সে আর থাকতে পারছিল না, তার সত্যিই কষ্ট হচ্ছিল।

এরপর সালমা বেগমকে জিজ্ঞেস করলাম আমি কি করবো? তিনি পরামর্শ দিলেন আমার নিজের বাড়িতে চলে যেতে। কারণ তাদের নতুন লোককে তো ওই কোয়ার্টার ছেড়ে দিতে হবে। সালমা বেগমই সব বন্দোবস্ত করে দিলেন। তাজ মহাখুশি, তার মায়ের নিজের বাড়ি এ-কথা তো সে ভাবতেই পারে নি। তাজ মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, আম্মু, আজ আর আমরা কারও বাড়ির নোকরের ঘরের বাসিন্দা নই। আমরা আমাদের নিজেদের মাকানে থাকি, কোয়া নয়। আমার চোখের পানি বাধা মানলো না। বললাম, আলু, এসবই করেছি তোমার জন্য। তোমাকে ও যদি জোর করে নিয়ে যেতো, আমি পাগল হয়ে যেতাম। হয়তো পথে পথে ঘুরতাম। মা ছেলের চোখের জল এক হয়ে মিশে গেল। সে আনন্দঘন মুহূর্তটির কথা আমি এখনও ভুলতে পারি না।

দিন যায় কিন্তু সব সময়ে যাবার গতি ও রীতি এক হয় না। কখনও দ্রুত লয়ে, কখনও মন্দাক্রান্ত তালে। মার দিন কিন্তু দ্রুতলয়ে কখনও যায় নি। আমার আশ্রয়দাতা স্বামী আমাকে একা ফেলে চলে যাবার পর থেকে কেন যেন একটা আত্ম প্রত্যয় আমাকে ভর করেছে। ভাবলাম আমি যদি সত্যিই লায়েক খানের স্বাভাবিক বিবাহিত স্ত্রী হতাম, তাহলে কি আমাকে এভাবে ফেলে যেতে পারতো? না, সে আমায় বিয়ে করে নি, আমি বোঝা হয়ে ঘাড়ে চেপেছিলাম। এতোদিন যে সে আমাকে আশ্রয় দিয়েছে, বিবাহিতা স্ত্রীর সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে সেই তো যথেষ্ট। সবার ওপরে তাজের পিতৃত্ব গ্রহণ করে আমাকে সত্যিই বীরাঙ্গনা করেছে, সব চেয়ে আশ্চর্য এই লম্বাচওড়া বয়স্ক পাঠানের মনে কখনও কোনও সন্দেহ উঁকি দেয় নি। অথচ ভয়ে শংকায় আমি দশমাস কতো বিনিদ্র রজনী যাপন করেছি। কিন্তু তাজ ভূমিষ্ঠ হবার পর আমার দ্বিধা দ্বন্দ্ব সব মুছে গেছে। একেবারে লায়েক খানের নাল নকশা।

তাজ লাফিয়ে লাফিয়ে স্কুলের সিঁড়ি ডিঙিয়ে গেল। আমিও সালমা বেগমের সহায়তায় প্রাইভেট পড়ে কলেজে ভর্তি হয়ে ক্লাশ না করেও বিএ পাশ করে ফেললাম। এদিকে বাড়িতে ছোটখাটো সেলাইয়ের একটা শিক্ষাকেন্দ্র খুলেছিলাম। পরে সেখানে থেকে নানা পোশাক-এমব্রয়ডারী, জরির কাজ, লেসের কাজ ইত্যাদি করাই প্রায় দশজন মেয়েকে নিয়ে। ওরা মাসে প্রায় পাঁচশ টাকা করে উপার্জন করে আর আমার পাঁচ সাত হাজার হয়।

তাজ যখন আইএসসি পরীক্ষা দেবে, সেবারের ছুটিতে ওর বাপ এলো না। চিঠি এলো বাপের তবিয়ত খারাপ। তাজ যেন যায়। তাজ বড়মার জন্য কাপড়-জামা, বোনের জন্য পোশাক সব আমাকে দিয়ে কেনালো। আমি ওর বাবাকে একটা কুর্তা আর নিজ হাতে কাজ করা টুপি দিলাম। ছেলে দু’সপ্তাহ থেকে এলো। খুব খুশি। বড়মা কি কি খাইয়েছে, ভাইয়েরা কোথায় কোথায় নিয়ে গেছে, বোন কত আদর করেছে ওর মুখের কথা যেন আর শেষ হয় না। সব শেষে বললো কুর্তা আর টুপি পেয়ে ওর আব্বা খুব খুশি হয়েছে কিন্তু শরীর খুব খারাপ। বললো, আর হয়তো একা করাচী আসতে পারবে না, তোমার সঙ্গে দেখাও হবে না। তোমার কাছে মাফ চেয়েছে। দেখলাম চোখে পানি। ঠিক বুঝলাম না। শুধু আমাকে বললো বেটা, তোমাকে ফৌজী অফিসার হতে হবে। আমি তো আনপড়া বলে সিপাহী হয়েই জিন্দেগী পার করলাম। কিন্তু তোমাকে বড় হতে হবে। তাজও চোখ মুছল।

দু’মাসের ভেতরেই লায়েক খান চলে গেল। বড় ছেলে এসে তাজকে নিয়ে গেল। আমি পাথর হয়ে গেলাম। শুধু আমাকে বললো, বড়মা বলেছে আপনি আব্বাকে মাফ করে দেবেন। না হলে তার গোর আজাব হবে। আমি মনে হয় ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম। তাজ জড়িয়ে ধরলো আমাকে, বড় ছেলেও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ছেলেকে বললাম, তোমার আম্মা আমার বড়বোন, তাকে আমার সালাম জানিও। যখনই ইচ্ছে হয়, করাচী বেড়াতে আমার কাছে এসো। ওরা চলে গেল।

লায়েক খান আমাকে চিরমুক্তি দিয়ে গেল। কিন্তু মুক্তি চাইলে কি মুক্তি পাওয়া যায়? ওই যে ওপরে একজন বসে আছেন স্টিয়ারিং হুইল ধরে, তিনি বান্দার জীবনের গতি যে দিকে নিয়ন্ত্রণ করবেন, সেদিকেই যেতে হবে।

বাপের কৃত করে তাজ ফিরে এলো। মনে হয় রাতারাতি ওর বয়স অনেক বেড়ে গেছে। আগে রাতদিন ধরে কতো গল্প করতো, কথা যেন আর শেষ হতে চাইতো না। এবার চুপ করে বসে থাকে, আমাকেও তেমন কিছু বলে না। মনে হয় ওর বাপের মৃত্যু ওর আর আমার মাঝখানের ব্যক্তিত্বের ব্যবধান সৃষ্টি করে গেছে। ও ওর শেকড় খুঁজে পেয়েছে।

আজকাল আমার একবার দেশে যেতে খুব ইচ্ছে করে। বাবা নেই, বড় ভাই বিয়ে করেছে। ছোটটাও করবে শীগগির। ও আমাকে লিখেছে, আগে থাকতে জানাবে আমি যেন ওর বিয়েতে যাই। আমার কোনো অসুবিধা হবে না। আমাদের এখন দোতলা দালান বাড়ি। নরসিংদীর দোকান এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। নদীর ওপর পুল হয়েছে। আধা ঘণ্টায় ঢাকা যাওয়া যায়। কল্পনার চোখ মেলে শীতলক্ষ্যাকে দেখি, নরসিংদীর গাছপালা, নদী, নৌকা, বড় বড় মাছ সবই তো তেমন আছে শুধু আমি নেই। আমিতো হারিয়ে গেছি, সবাই ভুলে গেছে। কিন্তু আমি ভুলতে পারি না কেন? কেন আমার মাটি আমাকে এমন করে টানে। না, ভাইয়ের বিয়ে নয়, তার আগেই আমাকে একবার যেতেই হবে। অবশ্য তাজের সঙ্গে পরামর্শ করেই যাবো।

তাজ ফৌজীতে যোগ দিলো। ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে। আইএসসিতে ভালোই ফল করেছিলো। সহজেই সুযোগ পেয়ে গেল। ট্রেনিং থেকে ছুটিতে যখন আসতো ওর সুন্দর সুঠাম দেহে ইউনিফর্ম পরা ওকে দেখলে সত্যিই লায়েক খানের জন্য আমার দুঃখ হতো। ভঙ্গীও পাকিস্তানিদের মতো দুর্বিনীত। আমার বার বার একাত্তরের কথা মনে হতো, প্রয়োজনে আমার ছেলেও কি অমন বন্য জানোয়ার হবে? না, না, ওর দেহে তো আমার রক্তও আছে, আর ওর বাবা তো সত্যিই পশু প্রকৃতির ছিল না, তাহলে আমাকে ঠাই দিয়েছিল কেমন করে? না, আজকে আমি যে তাজের নামে উৎসর্গ করেছি। ও যেন দেশ ও দশের জন্য নিজেকে উৎসর্গীত করতে পারে।

একদিন কথা প্রসঙ্গে আমি ওকে বাংলাদেশ যাবার ইচ্ছার কথা জানালাম। আশ্চর্য, ও খুব খুশি। বললো, তুমি যাও ঘুরে এসো আমাকে তো এখন যেতে অনুমতি দেবে না। চাকুরিতে যোগ দেবার পর আমি নিশ্চয়ই চেষ্টা করবো। তুমি ঘুরে এসো। একান্ত সহযোগিতা ও সহমর্মিতার স্পর্শ পেলাম ছেলের কথায়। ভাবতে লাগলাম কেমন করে কি করবো।

এমন সময় সুযোগ জুটে গেল। হঠাৎ সালমা বেগম ফোন করলেন। মেহের, দুপুরের পর একবার আসতে পারো? বাংলাদেশ থেকে একটি মহিলা প্রতিনিধি দল এসেছে এখানে একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে। আমি সাত-আট জনকে রাতে খেতে বলেছি। তুমি এলে…। আমি কথা শেষ করতে দিলাম না। আমি নিশ্চয়ই আসবে আপা। উনি বললেন, একটা কাজ করো, বাড়িতে ব্যবস্থা করে এসো যেন রাতে ফিরতে না হয়। তাই-ই হলো। আমি মনে হয় পাখির মতো উড়ে গেলাম। কারা আসছেন জিজ্ঞেস করেও লাভ নেই। আমি ঢাকায় শুধু সুফিয়া কামালের নাম শুনেছি তবে চোখে দেখি নি। আমি সুন্দর করে আমাদের প্রিয় মাছ রান্না করলাম। আমরা তো মাছ ভালোবাসি। আমি এতো দুঃখেও, এক টুকরো মাছ না হলে, ভাত খেতে পারি না।

ওঁরা এলেন ছ’জন আর এখানকার চারজন মোট দশজন। সালমা বেগম আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন ওর ছোট বোন বলে। প্রতিবাদ করবার সুযোগ পেলাম না। বললেন, কুটির শিল্পের ওপর খুব ভালো কাজ করছি। দশ-বারোজন মেয়ের রুটি জি আমার ওখান থেকে হচ্ছে। সবাই সম্ভমের দৃষ্টিতে আমাকে দেখলেন। কিন্তু আমার দৃষ্টি আটকে গেল সেই আপার দিকে, যিনি ঢাকা ছাড়বার আগের দিন আমাকে হাতে ধরে বলেছিলেন, তুমি যেয়ো না, আমি রাখবো তোমাকে। সেই স্নেহময় কণ্ঠ আর মিনতিভরা দৃষ্টি আমি আজও ভুলতে পারি নি। এখন বয়স হয়ে গেছে। চুল অনেক শাদা হয়ে গেছে, কিন্তু সেই সৌম্য মুখশ্রী ঠিক তেমনই কোমল ও সতেজ। উনিও বার বার আমার দিকে দেখছেন। হঠাৎ দ্রুত আমার কাছে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, আপনি মেহেরুন্নেসা? হেসে মাথা নিচু করে বললাম, আপা, সেদিন কিন্তু আদর করে কাছে নিয়ে তুমি সম্বোধন করেছিলেন। বললেন, তোমার সঙ্গে কথা না বলে আমি পাকিস্তান ছাড়বো না। সালমা বেগমের উনি নাকি শিক্ষক, তাই এতো সমাদর। সালমা বেগম আমার কাছে একটা সুতির কাজ করা শাড়িও চেয়েছেন সন্ধেবেলা। তাহলে সেটা কি ওই আপার জন্য?

খাওয়া দাওয়া পর্ব চুকলো। কফি খেয়ে প্রায় সাড়ে বারোটায় সবাই হোটেলে ফিরে গেলেন। সালমা বেগমের সঙ্গে আপার কি আলাপ হলো জানি না, উনিও আমাকে খোদা হাফেজ’ বলে সবার মতোই বিদায় জানিয়ে গেলেন। সালমা বেগমের স্বামী হংকং গেছেন কি একটা ব্যবসায়ের কাজে। আমি রাতে ওঁর ঘরের নিচেই শুলাম। উনি অনেক টানাটানি করলেন ওর সঙ্গে খাটে শোবার জন্য। কিন্তু উনি উদারতা দেখালেও আমার তো সীমা লঙ্ঘন করা উচিত নয়। বললেন, কাল। সকালে আপা পারলো না, দুপুরে আমাদের সঙ্গে খাবেন আর তোমার সঙ্গে কথা বলবেন, ওঁদের সমিতির মেয়েদের তোমার কাছে এসে কাজের ট্রেনিং নিতে পাঠানো যায় কিনা। সবই বুঝলাম। উনি জানতে চান, আমি আত্মপরিচয়ে বেঁচে আছি না মুখোশ পরে চলছি।

পরদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আমি আপার কাছে সব কাহিনী বললাম। উনি থেকে থেকে আমার হাত দুটো চেপে ধরছিলেন। যখন আমার বলা শেষ হলো তখন দু’জনের চোখেই জল। বললেন, মেহের সেদিন তোমার জন্য দুঃখ পেয়েছিলাম। কিন্তু আজ আমি দায়মুক্ত যে বাংলাদেশের মাটিতে আমি তোমার কবর রচনা করি নি। কারণ যুদ্ধে আঘাতপ্রাপ্ত বা লাঞ্ছিত কোনও মেয়েকে আমরা প্রকাশ্যে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি নি। জানো মেহের ১৯৭৩ সালে ফ্রান্স থেকে একজন মহিলা স্থপতি এসেছিলেন ঢাকায়। আমার সঙ্গে দীর্ঘ সময় আলাপ করেন। ওদের বিগত মহাসমরে উনি জার্মান সৈন্যদের হাতে বন্দি হন এবং ওঁর ওপর যে পাশবিক অত্যাচার চলে তার ফলে তিনি মা হবার ক্ষমতাও হারান। পরবর্তীতে অবশ্য উনি বিয়ে করেছেন। স্বামী স্থপতি কিন্তু সব হারানো মেয়েদের দুঃখ ও বেদনা উনি জানেন। তাই আমার দেশের এ ধরনের মেয়েদের কোনও রকম সাহায্য সহযোগিতা করতে পারলে উনি খুশি হবেন। এতো বছর পর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েও মাতৃত্বের বঞ্চনায় তিনি মলিন ও বেদনার্ত। কিন্তু আমার দেশে তো প্রকাশ্যে মাথা উঁচু করে তেমন সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় সম্মানের অধিকারী হয়ে কেউ বেঁচে নেই খুব খুশি হলাম তোমাকে দেখে আর তোমার ভেতরের শক্তির পরিচয় পেয়ে। তুমি ঢাকায় এসো, আমি বিশেষ প্রতিনিধি দলে ভোমাকে অন্তর্ভুক্ত করবার জন্যে সালমাকে বলে গেলাম। আপা চলে গেলেন। আমার নিজ হাতে করা একখানী শাড়ি ওঁর হোটেলের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম। উনি ফোনে ধন্যবাদ দিলেন।

চারমাস পর আমাদের যাবার সুযোগ এলো। বড় ভাইকে লিখলাম। উনি খুব খুশি। দিন তারিখ ফ্লাইট নম্বর জানালে উনি এয়ারপোর্টে থাকবেন। না, বিস্তারিত কিছুই আমি ওঁকে জানাই নি।

কিন্তু যাবার আগে আরেক লাঞ্ছিত রমণীর সাক্ষাৎ আমি পেলাম। জানি না আমরা কি শুধু বঞ্চনা সইতেই পৃথিবীতে এসেছি? যাবার দুদিন আগে সালমা বেগম আমাকে ডেকে পাঠালেন। মুখখানা খুব ম্লান। বললেন, বোন মেহের! ভীত সন্ত্রস্ত কণ্ঠে বললাম, কি হয়েছে আপা? ম্লান হেসে বললেন, কিছু না। বসো, তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে। ইতস্তত করলেন, ঘরের ভেতর কিছুক্ষণ অস্থিরভাবে পায়চারি করে থেমে বললেন, মেহের তোমাকে আমি আজ কিছু কথা বলবো, সম্ভব হলে কারও কাছে প্রকাশ করো না। আমি নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। আমার পাশে এসে বসলেন, পিঠে হাত রাখলেন, অনুভব করলাম দুর্বল কোমল হাতখানার মৃদু কম্পন। বললেন, মেহের তোমাকে আমি বিমা স্বার্থে বাংলায় পাঠাচিছ না। তোমাকে আমি একটা ঠিকানা ও ফোন নম্বর দেবো এক ভদ্রলোকের। তুমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই প্যাকেটটা তাকে দেবে। আর কিছু বললে শুনে আসবে। পারবে? আমি আবেগে কেঁদে ফেললাম, আপা এটা কি কোনও কঠিন কাজ? মেহের, ওই যুবক আমার ছেলে-আনন্দ। আমার বয়স যখন ১৭/১৮, কলেজে পড়ি, আনন্দের বাবার সঙ্গে খুব ধুমধাম করে আমার বিয়ে হয়। আমার বাবা ছিলেন জেলা জজ, মধ্যবিত্ত বিবেকবান মানুষ, আর ওরা ছিল ধনী ব্যবসায়ী। বাবা এ বিয়েতে রাজি ছিলেন না কিন্তু ঐশ্বর্যে মেয়ে সুখে থাকবে এটা আমার মাকে প্রচণ্ডভাবে উৎসাহিত করে তুলেছিল। ফলে বিয়ে হয়ে গেল। স্বামী রূপবান, ধনী, মার্জিত রুচি। সুতরাং আমার সুখী হবার পথে তিলমাত্র বাধা ছিল না। বছরখানেক সুখেই কাটলো। আনন্দকে আমি গর্ভে ধারণ করলাম। আমার স্বামী এটা পছন্দ করলেন না। প্রথমে মৃদু তারপর বেশ কঠিন ভাবেই গর্ভপাত করানোর জন্য জিদ করতে লাগলেন এবং আমার প্রতি নিরব তাচ্ছিল্য ও উদাসীনতা প্রকাশ পেতে লাগলো। আমি নিরুপায় হয়ে আমার শাশুড়িকে জানালাম। তিনি কঠোর ভাষায় ছেলেকে ভর্ৎসনা করলেন। ফল হলো বিপরীত। এক বছরেই স্বামী সোহাগিনীর পাট আমার চুকলো। আনন্দকে বুকে নিয়ে একদিকে মাতৃকর্তব্য অন্যদিকে নিজের পড়াশোনায় মনোযোগী হলাম। এতোদিনে এ সত্য বুঝেছি যে জীবনে আমাকে একা চলার প্রস্তুতি নিতে হবে।

হায়দার সাহেব ছিলেন আমার স্বামীর ব্যবসায়ের বড় অংশীদার, তাই উনি প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন এবং ক্রমে সবই জানতে পারলেন। তিনি ওকে বোঝাতে অনেক চেষ্টা করেন। আমার স্বামী তখন বহুভোগের সন্ধান পেয়েছেন। তারপর ১৯৭০ সালের এক রাতে আনন্দকে আমার শাশুড়ির বিছানায় রেখে আমি হায়দারের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানে আসি। হায়দার আমাকে তার বড় বোনের বাড়িতে নিয়ে তোলে। সম্ভবত আগেই তাদের ভেতর কথাবার্তা হয়েছে। আমি এখান থেকেই আমার স্বামীর কাছে তালাক প্রার্থনা করলে আশাতীত দ্রুততার সঙ্গে তালাকনামা এসে যায়। তখন সংগ্রাম তুঙ্গে। হায়দারও আগে থেকেই ব্যবসা গুটিয়ে এনেছিল। সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল। ছ’মাস বাদে আমাদের বিয়ে হয় কিন্তু সন্তান হলো না। ১৯৮২ সালে আমি লোক মারফত আনন্দের একটি চিঠি পাই। সম্বোধন ‘মা’। চিঠিখানা এনেছিলেন হায়দারের এক বাঙালি বন্ধু। এরপর থেকে তার মাধ্যমে আমাদের চিঠিপত্র ফটো সব আসে। ঘুরে গিয়ে সামনের টিপয় থেকে এক সুন্দর সুঠাম দেহী যুবকের ফটো তিনি আমাকে দেখালেন। এই আনন্দ। একবারে মায়ের মুখ।

না, ওর বাপ আর বিয়ে করে নি। তার প্রয়োজনও ছিল না। তিনি বেঁচে গেলেন। আমার কলঙ্কে তাঁর সমাজ ছেয়ে গেল। অবশ্য পিতৃকুলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। বাবা নেই, এ ধাক্কা সামলাতে পারেন নি। কিন্তু ভাই-বোনেরা সবাই আমার কাছে আসা যাওয়া করেন। আসে নি শুধু আনন্দ। সে নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে আসবে না। ব্যবসা সে করবে না। মাস্টারি অথবা অন্য কোনও চাকুরি করবে, মাকে নিবিড়ভাবে কাছে পেতে চায়।

ভাবছি আমার সান্ত্বনা আমার বীরাঙ্গনার প্রশংসাপত্র। কিন্তু এই রূপবতী গুণবতী, বিদূষী মহিলার জীবনে কি আছে? হায়দারের প্রেম ও আনন্দের কল্পলোক ছাড়া। হায়দার সম্পর্কে সালমা বেগম বলেন, আমি আমার দুঃখের বোঝা দিয়ে তার জীবন বরবাদ করেছি। মেহের, একি কখনও আমাকে ভালোবেসেছে? ও দিয়েছে আমাকে করুণা, সহানুভূতি। তবে আমি ওকে ভালোবেসেছি। আজ বলতে কোনও দ্বিধা নেই, ওই আমার জীবনে প্রথম ও শেষ ভালোবাসার পুরুষ।

প্যাকেটে কাজ করা একটি মুগার পাঞ্জাবী আর সালমা বেগমের নিজের হাতে বোনা জরদা ও গোলাপী রং মেশানো একটি গরম পুলওভার। গত একমাস ধরে আমি তাকে এটা অত্যন্ত যত্নে বুনতে দেখেছি। আমি চোখ মুছে তাঁর দেওয়া প্যাকেটটা নিয়ে এলাম।

ঢাকা বিমানবন্দরে পা রাখলাম। এখানে এই আমার প্রথম আসা। বন্দি হিসেবে গিয়েছিলাম বেনাপোলের পথে ট্রাকে করে। অভ্যর্থনা জানাতে মহিলারা বিমানবন্দরে এসেছেন রজনীগন্ধা নিয়ে।

উঠলাম হোটেল শেরাটনে। রুমে গিয়েই বড়ভাইকে ফোন করলাম ওঁর নরসিংদীর দোকানে। পেয়েও গেলাম। উত্তেজনায় আমার গলা কাঁপছিল। বললাম এখানে দু’দিনের অনুষ্ঠান আছে। তুমি বৃহস্পতিবার সকালে এসো আমি তোমার সঙ্গেই বাড়ি যাবো। শেষ পর্যন্ত গলা কেঁপে মনে হয় কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেল। মা নেই, বাবা নেই, এ কোন শূন্যপুরীতে সে যাবার পরিকল্পনা করেছে। সেমিনার হল, রিসেপশন হল, বিভিন্ন বাড়িতে ডিনার খাওয়া হলো! আপার সঙ্গে বার বার দেখা হলো, খুশিতে ভঁর বার্ধক্যের মুখখানা যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ভাবখানা অন্তত একটি মেয়েতো জয়ী হয়েছে। সে যেভাবেই হোক। তার বীরাঙ্গনা নাম কি সার্থক করতে পারেনি? অবশ্যই পেরেছে। যেখানেই যাই সবার কাছে বলেন, আমার ছাত্রীর ছোট বোন। এতে সমাদর আমার ভাগ্যে ছিল আমি কখনও ভাবি নি। কিন্তু সেই বড় কাটাটা যেন আমার মর্মমূলে বিদ্ধ হয়ে নিয়ত আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে, তার থেকে তো আমার মুক্তি কোনও দিনই ঘটবে না। সে আমার ওই পাসপোর্ট খানা, ওয়াইফ অফ লায়েক খান, জাতীয়ত-পাকিস্তানি। না, না, আর ভাবতে পারি না। আল্লাহ্ আমি না চাইতে তুমি আমাকে সব কিছু দিয়েছে, কিন্তু যা হারিয়েছি তার কি হবে। আত্মরক্ষার জন্য ছলনা গ্রহণের এই আমার আজীবনের শাস্তি।

পরদিন সকালে আনন্দ এলো। পা ছুঁয়ে সালাম করতেই আমি ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলাম। এ তো আমার তাজ! কতো স্বপ্ন ও আগামী মাসে আমেরিকার কেম্বিজে যাচ্ছে অর্থনীতিতে পিএইচডি করতে। ভালো কাজ পেলে মাকে এবং হায়দার আঙ্কেলকে নিয়ে যাবে। আন্টি, আঙ্কেলকে বলবেন আমি তাকে খুব ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি, কারণ তিনি আমার মাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কার্ডিগানটা মায়ের হাতের করা শুনে বার বার হাত বোলালো। আমিও ওর জন্যে একটা গলা উঁচু পাঞ্জাবী এনেছিলাম। তাজও এগুলো খুব ভালোবাসে, খুব পছন্দ হলো আনন্দের। বললো, আন্টি আপনি যাবার দিন আমি এয়ারপোর্টে দেখা করবো। না, না করতেই আমার হাত চেপে ধরলো, কিছু খেলো না, আমাকে খুশি করবার জন্য একটা আপেল তুলে নিয়ে গেল।

নির্ধারিত দিনে বড়ভাই এলো। সেই লুঙ্গি-শার্ট পরা বড়ভাই নয়। সুন্দর সাফারী পরা, হাতে সদ্য খোলা রোদ চশমা। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম তারপর দু’জন দুজনকে ধরে কান্নার বেগ সামলাতে পারলাম না। আমি ঠিক করেছিলাম সোজা গাড়ি নিয়ে যাবো, কিন্তু বড়ভাই ওর জিপগাড়ি নিয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে সবই স্বপ্ন দেখছি। সকাল ৯টায় বেরুলাম। কি জনাকীর্ণ রাস্তা, বাস, ট্রাক, রিকশা, প্রাইভেট কার, বেবী ট্যাক্সির ভো ভো শব্দে কান ঝালাপালা। কতো দ্রুত এগিয়ে এলাম। শীতলক্ষ্যার বিরাট ব্রিজ। মুহূর্তে নদী পার হয়ে এলাম। নামলাম গিয়ে বাড়ির সামনে। লালু, মিলু এবং সঙ্গে ভাবি ও তার বাচ্চা মেয়ে সবাই গেটের কাছে দাঁড়ানো। সে ঘর দুয়ার কিছুই নেই। সুন্দর দোতলা বাড়ি, ছিমছাম, গোছানো। মনে হয় বউ বেশ সংসারী। ঘরে ঢুকে সময় লাগলো স্বাভাবিক হতে। বাবা, মার কথা বলতে পারলাম না। যে জায়গাটায় মা পড়েছিলেন তা আজ বাড়ির নিচে। হঠাৎ দেখা গেল শিউলীগাছটা নেই। বললাম লালু ওই কোণের শিউলীগাছটা কইরে? ঝড়ে পড়ে গেছে আপা, অপরাধী কণ্ঠে জবাব দিলো লালু। মনে হলো ওরা কেটে ফেলেছে তাই এই কুণ্ঠা। গাছটা আমার খুব প্রিয় ছিল সে কথা মিলুও জানে। ভাইয়ের মেয়েটা খুবই। সুন্দর হয়েছে। সবাই বললো দেখতে অনেকটা আমার মতো হয়েছে। ওর জন্য এবং ভাবির জন্য শাড়ি এবং তিন ভাইয়ের জন্য পাঞ্জাবী এনেছিলাম। বের করে দিলাম। পাড়া-পড়শী কারও কথাই আমি জিজ্ঞেস করলাম না, ওরাও গায়ে পড়ে কিছু বললো না। সারাদিনই গেট এবং সামনের ঘরের দরজা বন্ধ রইল। মানে আমার আসবার কথা এরা কাউকে বলে নি। শান্ত, সুন্দর জীবনে কেই-বা শুধু শুধু যন্ত্রণার দায় আনতে চায়! লালু, মিলুকে পাকিস্তান যাবার দাওয়াত দিলাম। সন্ধ্যায় বেরুবো। ওরা আমাকে একটা রাত থাকবার জন্য অনুরোধ করেছিল কিন্তু আমি পারলাম না। আমার নিশ্বাস আটকে আসছে। শুধু ভাবছি কেন এলাম এ শ্মশানে, শূন্য ভিটায় নিজের কঙ্কাল দেখতে।

আসবার আগে বড়ভাই আমাকে একটি ছোট্ট লাল রঙের ভেলভেটের বাক্স দিলো। বাবা তাজের জন্য হার রেখে গেছেন। ওটা হাত পেতে নিয়ে মাথায় ছোঁয়ালাম। তারপর দ্রুত হেঁটে এসে জীপে উঠলাম। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। আমি এতোক্ষণে স্বস্তি বোধ করলাম, বুঝলাম এ মাটিতে মুখ দেখাবার মতো শক্তি আমার নেই। আমি জীবনের সব পেয়েছি কিন্তু মাটি হারিয়েছি। মনে মনে বললাম, আর কখনও আসবো না। হে আমার জন্মভূমি, আমাকে ক্ষমা করো। মরতে পারার সৎসাহসের অভাব, জীবনের প্রলোভনের বিনিময়ে আমি তোমাকে হারিয়েছি। এ আমার অপরাধ। তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাইবো না কারণ ক্ষমা আমি পাবো না। আমি নামহীন গোত্রহীন ভেসে আসা একটি দুস্থ, লাঞ্ছিত রমণী।

হোটেলে ফিরে এসে প্রচুর পানিতে গোসল করে স্থির হলাম। বড়ভাই চোখের জলে বিদায় নিলেন। ভাবি আসবার সময় একটা দামি শাড়ি দিলেন।

কাল সকালে চলে যাবো। এসেছিলাম প্রচণ্ড উত্তেজনা নিয়ে, ফিরে যাচ্ছি শান্ত সমাহিত হৃদয়ে। মনে হচ্ছে যেন জন্মভূমির সঙ্গে দেনা-পাওনা আমার চুকে গেছে। এয়ারপোর্টে আনন্দ এলো। আমার হাতে দুটো প্যাকেট দিলো ওপরে লেখা মা। বললো খালাম্মা, মাকে বলবেন এ ঢাকাই শাড়ি আমার নিজের উপার্জনের টাকায় কেনা, একথাটা বলতে ভুলবেন না। দেখা হবে করাটীতে, পা ছুঁয়ে সালাম করে দ্রুত চলে গেল। মনে হলো কিছুটা নিজেকে সামলাতে পারলাম। আমি তাকিয়ে রইলাম ওই নিঃস্ব, মাতৃহারা, সব হারানো মানুষটার দিকে।

ফিরে এলাম নিজস্ব বৃত্তে। এই আমার কর্মস্থল, আশ্রয়। তাজ হার পেয়ে মহাখুশি, গলায় পরে বসলো। বললো, নানার সঙ্গে সব সময় আমার কোলাকুলি হবে। এর জন্য আনা পাঞ্জাবী ওকে দিলাম। শুধু শুনতে চায় গল্প কিন্তু আমার সব কথা তো ফুরিয়ে গেছে। সালমা বেগম খুশিতে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। হায়দার সাহেবের চোখও শুকনো ছিল না। আমি এখন ছোটবোনের মতো ওঁর সামনে বের হই। মনে হলো এঁদের জন্যে আমার যাওয়াটা সার্থক হয়েছে।

নাই-বা পেলাম জাতীয় পতাকা, নাই-বা পেলাম আমার সোনার বাংলা, কিন্তু আমি জাতির পিতার স্বপ্ন সফল করেছি। একজন যুদ্ধজয়ী বীরাঙ্গনা রূপে বাংলাদেশ ছুঁয়ে এসেছি। এটুকুই আমার জয়, আমার গর্ব, আমার সকল পাওয়ার বড় পাওয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *