৬. গু বউমা

০৬.

ও কি আমার গু বউমা?

 আপনার নয় তো আবার কার? বাড়িটা যে নরক বানিয়ে ফেলেছেন! এখন কে এসব পরিষ্কার করে বলুন তো! হাঁটতে তো একটু আধটু পারেন, আর উঠোনটুকু পেরোলেই তো পায়খানা। শয়তানি বুদ্ধি থাকলে কে আর কষ্ট করতে যায়, তাই না?

বুড়ি খুব দুশ্চিন্তা মুখ নিয়ে বলে, এ তো মনে হয় বেড়ালটার কাণ্ড বউমা।

বেড়ালের আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই, আপনার ঘরে হাগতে এসেছে। লোক ডেকে পরিষ্কার করাতে পয়সা লাগে, বুঝলেন? ঘরভরা তো আর দাসি চাকর নেই। ছিঃ ছিঃ!

বুড়ি আজকাল বড় ভয় পায়। সারাটা দিন মনে ধ ভয় আর ভয়। কখন বয়সের দোষে কোন অকাজটা করে ফেলে তার ঠিক কী? এরা কেউ ছাড়বার পাত্রপাত্রী তো নয়। বাক্যে একেবারে পুড়িয়ে দেয়।

বড় নাতনি নাচুনি এসে মাটির হাঁড়ির ভাঙা দুটো চারা আর এক খাবলা ছাই দরজার পাশে রেখে বলল, ও ঠাকমা, গুটা তুলে পিছনের কচুবনে ফেলে দিয়ে এসো।

বুড়ি নাতনির দিকে চেয়ে বলে, এই যে যাই।

উঠোনে দাঁড়িয়ে বড় বউ পুতুল পাড়া জানান দিয়ে চেঁচাচ্ছে তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, তবু কি নোলা বাবা। এটা দাও, সেটা দাও। গুচ্ছের খাবে আর ঘরদোর নোংরা করবে। সামলাতে যখন পারো না তখন খাওয়া কেন বাপু? কাল এই এককাঁড়ি কলমি শাক গিলল। তখনই বুঝেছিলুম ঠিক পেট ছাড়বে।

বুড়ি মন দিয়ে শুনছিল। গতকাল কলমি শাকই খেয়েছিল বটে। কিন্তু বুড়ির গলায় তত জোর নেই যে পাল্টা চেঁচিয়ে সবাইকে জানাবে, কলমি শাক ছাড়া আর কোনও পদই তাকে দেওয়া হয়নি।

নাচুনি চাপা গলায় বলে, তাড়াতাড়ি করো ঠাকমা, দেরি করলে আরও কবে।

এই যে যাই।

 মাথাটা আজ বশে নেই। কেমন যেন পাক খাচ্ছে। শরীর কিছুতেই খাড়া হতে চায় না। বুড়ি চৌকি থেকে নেমে নোংরাটার সামনে উবু হয়ে বসল। তারপর নাতনির দিকে চেয়ে বলে, এটা বেড়ালের কাণ্ড নয়, তুই-ই বল তো!

বেড়ালগুলোকে ঢুকতে দাও কেন?

ঢুকবে না কেন বাবা, কোন আগল দিয়ে আটকাব! এ যে খোলা ঘর।

বুড়ি নোংরাটা চেঁছে মাটির সরায় তুলল। কচুকনটা যে কত দূর বলে মনে হয়। খিল ধরা হাঁটু আর টলমলে মাথা নিয়ে অতদূর যাওয়া মানে যেন তেপান্তর পার হওয়া।

মেলা পাপ জমেছে বাবা। পাপের পাহাড়। সব ক্ষয় করে যেতে হবে তো…

উঠোন পেরিয়ে পুকুরের ধারে সেই কচুকন যেন এক অফুরান মরুভূমি। বয়সকালে বুড়ি এই উঠোনেই উদূখলে সর্ষে গুঁড়ো করত, টেকিঘরে পাড় দিত, পাঁজা পাঁজা বাসন মেজে নিয়ে আসত ঘাট থেকে। সেই শরীরই তো এইটে। সেই উঠোন। কিন্তু আজ আর বনিবনা নেই কারও। শরীরের সঙ্গে না, উঠোনের সঙ্গে না, কচুবনের সঙ্গে না।

ঢেঁকিঘর উঠে গেছে। উদূখল বিদেয় হয়েছে। ঘরবাড়িতে ধরেছে ক্ষয়। দুই বউয়ের তিন সংসার। তারা পালা করে পোষে। না পুষলে পাড়ায় নিলে হবে বলেই বোধহয় পোষে। নইলে গু-মুত, মরা ইঁদুর, আবর্জনার মতো তাকেও ফেলে দিত আস্তাকুঁড়ে।

বড় বউ মাঝে মাঝে মুখের সামনে হাত নেড়ে নেড়ে বলে, এখন তো রস মজে বটুমি হয়েছেন, যখন বিয়ে হয়ে নতুন বউ এসেছিলুম তখন কম ঝাল ঝেড়েছেন? উঠতে খোঁটা, বসতে খোঁটা। আর কী মুখ বাবা, কী অন্তরটিপ্পনী। চোখের জলে বিছানা ভিজত আমার। সংসারে একতরফা কিছু হয় না, বুঝলেন! এখন দান উল্টে গেছে।

উঠোনটা পেরোতে পারল কী করে তা জামগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে ভেবে পাচ্ছিল না বুড়ি। বুকটা এত ধড়াস ধড়াস কাঁপছে যে, এখনই না আবার মূর্ছা হয়। চোখে এই দিনের আলোতেও কেমন আঁধার ঘনিয়ে এল যে। কুঁজো হয়ে হাঁটার বড় কষ্ট। মাজার ব্যথায় কতকাল সোজা করতে পারেনি শরীরটাকে।

এমন হাঁফ ধরে গেছে যে জামতলার আগাছার মধ্যেই বুড়ি ধপ করে বসে পড়ে। গাছের গায়ে হেলান দিয়ে চোখটা বোজে। হাতে মাটির চারায় নিঘিন্নে মল। তবে বুড়ি আর ঘেন্না পায় না। দিন রাত এসব নিয়ে মাখামাখি, ঘেন্না করবে কাকে?

আজকাল বেশিক্ষণ চোখ বুজে থাকলে একটা ভয় হয়, মরে গেলাম নাকি? ঘুমোনোর সময় মনে হয়, আর যদি না উঠি? মরার পর কেমন সব হবে তার চিন্তাও পেয়ে বসে বুড়িকে। যমদূতরী এসে তো ধরবে সব গাজি গাজি করে। অপর টানতে টানতে বৈতরণী পার করাবে। নিয়ে গিয়ে হাজির করবে যমরাজার সামনে। তাইবুড়ি পড়বে বিপদে। কী জিজ্ঞেস করে না করে কে জানে বাবা। এ দিকে ছেলেরা যে এতিটা তলরেকরবে এমন ভরসা হয় না। শ্রাদ্ধশান্তি ঠিকমতো না হলে আত্মাটা বড় খাবি খাবে।

বুড়ি গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে চোখ বুজে কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছিল। খানিক অন্ধকার, খানিক আবহু, নিক হিজিবিজি, ঝালকালি, কী সব যেন চোখের সামনে। মাথায় আজকাল অবাক অবাক চিন্তা আসে, ছবি আসে।

বুড়ি একটু বাদে চোখ খুলে চাইল। চোখের পাতাটা খুলতেও যেন কষ্ট, বাকি পথটা আর দাঁড়ানোর চেষ্টা করল না বুড়ি। গুঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে কচুবনের কাছে এসে নোংরাটা ফেলল।

কতকাল যেমন করেন বোল নেই। আজকাল কেউ তো আর চান করিয়ে দেয় না। কুয়ো থেকে জল তুলে চান করবে তার সব্যি কী?সামনে পুকুরটা দেখে বড় লোভ হল, একটু ডুব দিয়ে নিলে হয় না?

 কিন্তু পারবে কি? তাদের বানো ঘাটে, পা ঠিক রাখা মুশকিল। আর এ পুকুরের ধারেই ডুবজল। বুড়ি ভাবে, সাঁতার সে জনতৃম, কিন্তু সে জানা কি আর কাজে দেবে? আজকাল বড় ভয় করে। সব কিছুকে বড় করে।

বুড়ি বসে আর একটু জিরোলো। গলাটা শুকিয়ে আছে তেষ্টায়। কিন্তু ফিরে তাকালেই আবার তেপান্তরের মাঠ মনে হয় উঠানটাকে। কত দূরে সব সরে যাচ্ছে! ঘর, মানুষজন, ছেলেমেয়ে। বুড়ি চোখ বোজ। হাজারো শখের বৃষ্টি মাথায় ঝরে পড়তে থাকে।

ও ঠাকমা, জঙ্গলে বসে কীছ তখন থেকে? ও ঠাকমা…

এই একটা মাত্র নাতনি নাচুনিই তার যা একটু খোঁজখবর নেয়। কাছে বেশি আসে না, এলে মা বকবে। তবু একটু টান আছে, একটু মায়া।

বুড়ি কথা বলতে গিয়ে দেখল, গলায় কেন যেন স্বর নেই। কিছুতেই একটাও কথা গলায় তুলে আনতে পারল না বুড়ি।

ও ঠাকমা, অমন করছ কেন? ঘরে যাও।

 বুড়ি চোখ বুজে ভাবল মরে গেছি নাকি? ছেলেরা ঠিকমতো শ্রাদ্ধটা করবে তো! শ্রাদ্ধ করে বড় ছেলে। তা বুড়ির বড় ছেলে হল বিটু। তাকে কি খবরটা ঠিকমতো দেবে এরা? মুখাগ্নি তো সে আর পেরে উঠবে না। অতটা রাস্তা, খবর পেয়ে আসতে আসতে মড়া বাসি হবে। নাঃ, বাঁচাটা যেমন ভাল ছিল না, মরাটাও তেমন ভাল হল না বুড়ির।

ও ঠাকমা?

 কাকে ডাক ছুড়িটা? মরে পড়ে আছি এখানে, দেখতে পায় না নাকি? কানে ঝিঁঝি ডাকছে। হাত পা সব ঠাণ্ডা মেরে গেছে। বুকখানা যেন পাথর। আর মাথাটা অন্ধকার।

ও ঠাকমা। ঠাকমা গো! ওঠো না। বলে গায়ে ধাক্কা দেয় নাচুনি।

বুড়ি দেখল, না, এখনও মরেনি সে। ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল, একখানা কাঁকলাস হাত বাড়িয়ে মাটিতে রাখল।

একটা শ্বাসও পড়ল ফোঁস করে।

 ও ঠাকমা! তোমার কী হয়েছে?

বুড়ি নাতনির দিকে চেয়ে মুখখানা মায়া ভরে দেখল। কত কাছে, কিন্তু কত দূর! বলল, একটু ধন্দ লেগেছিল রে। এখন ঠিক আছি।

ধরে তুলব তোমায়?

ঘেন্না পাবি না তো!

বাঃ, তোমাকে আবার ঘেন্না কীসের? মা বকবে বলে, নইলে তোমার ঘর তো রোজ আমিই পরিষ্কার করতে পারি।

অত জুড়িয়ে দেওয়া কথা বলিসনি রে, ওতে মায়া বাড়ে।

এখন আমাকে শক্ত করে ধরো তো! তোমাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসি।

 নাচুনি ধরে ধরে ঘর অবধি নিয়ে এল। একটা ভেজা ন্যাতা এনে দিল ছুটে গিয়ে, ও ঠাকমা, গুয়ের জায়গাটা লেপে দাও। নইলে বকুনি খাবে।

দিই। বলে বুড়ি উবু হয়ে বসল। মনটা বড় চঞ্চল হয়েছে। মুখাগ্নি কে করবে, শ্রাদ্ধটা হবে কি না, এ সব ভেবে বড্ড উচাটন লাগছে। বিষ্ণু যদি সময়মতো খবর না পায়, তা হলে কী হবে? এদের মোটে গা নেই যে!

উঠোনের রোদে বাচ্চারা খেলছে। তারই মধ্যে কে একজন চটি ফটফটিয়ে উঠে এল দাওয়ায়। বুড়ির মেজো ছেলে কৃষ্ণপদ।

আজও ঘরে হেগে ফেলেছ শুনলাম!

বুড়ি সভয়ে চেয়ে থাকে ছেলের দিকে। এদের মুখচোখের চেহারা মোটেই ভাল নয়। কেমন যেন রাগ রাগ ভাব। কখন যে বকাঝকা করবে তার কোনও ঠিক নেই।

না বাবা, সে একটা বেড়ালের কাণ্ড।

 কৃষ্ণপদ মহা বিরক্ত গলায় বলে, এ বাড়িতে বাস করাই যে কঠিন করে তুললে! এরকম হলে তো মুশকিল দেখছি।

বুড়ির বুক গুড়গুড় করতে থাকে। কী বলবে তা ভেবে পায় না। কথার বড় ফের থাকে। কখন কোন কথাটায় লোকে দোষ ধরে তার কিছু ঠিক নেই।

এরকম চললে আর দাওয়ার কিন্তু জায়গা হবে না। গোয়ালঘরটা খালি পড়ে থাকে, ওটায় গোবর দিয়ে দেবখন। ওটাতেই থেকে গিয়ে।

বুড়ি তেমনি চেয়ে থাকে। গোয়াল আর এর চেয়ে কি খারাপ হবে? বুড়ি মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল।

কৃষ্ণপদ ঘরে গেল। বুড়ি বিছানায় উঠে একখানা কাঁথা টেনে গায়ে দিয়ে বসল। কখন শীত করে, কখন হাঁসফাঁস করে ভেতরটা তার কিছু ঠিক নেই। আজ কী দিয়ে ভাত দেবে এরা? মুখে বড্ড অরুচি কিন্তু পেটে খিদে থাকে। একটু লেবু হলে দুটি খাওয়া যেত।

বেড়ালটা ঘরে এসে একখানা ডন দিয়ে লাফিয়ে বিছানায় উঠল। রোজই ওঠে। তাড়ালেও যায় না। তা ওঠে উঠুক। একটা প্রাণ তো৷ কাছাকাছি আর একখানা বুকও ধুকধুক করছে জানলে কেমন যেন একটু ভরসা হয়।

বেড়ালটার দিকে চেয়ে বুড়ি বলে, আজ বড় জ্বালিয়েছিস মুখপুড়ি।

বেড়ালটা চোখ মিটমিট করে ফের কাঁথাখানির মধ্যে আরামে পুঁটুলি পাকিয়ে চোখ বুঝল। বড় মায়া।

নাতজামাই পাঁচটা টাকা প্রতিবারই হাতে গুঁজে দিয়ে যায়। বুড়ি সেই টাকাটা পরে আর খুঁজে পায় না কিছুতেই। বালিশের তলায় না, তোশকের তলায় না, চাদরের তলায় না, আঁচলে বাঁধা না। কাউকে জিজ্ঞেস করা মহাপাপ। জিজ্ঞেস করলেই বলবে, চুরি করেছি নাকি?

পরশু না কবে যেন এসেছিল নাতজামাই। টাকাটা সেই থেকে খুঁজছে বুড়ি। পাচ্ছে না। পাবে না, জানা কথা। টাকা দিয়ে কিছু করেও উঠতে পারবে না সে। তবে ঘাটখরচার অভাবে গরিবগুরবোরা যেমন মড়া না পুড়িয়ে মুখাগ্নি করে জলে ফেলে দেয় তার বেলাতেও যেন ছেলেরা অমনিধারা না করে তার জন্যই কেষ্ট আর হরির হাতে টাকাগুলো দেওয়ার ইচ্ছে ছিল বুড়ির। হল না। ঘাটখরচাটা পেলে আর মড়া নিয়ে হেলাফেলা করত না।

দুপুরবেলা বুড়ি ঘুমোচ্ছিল, নাচুনি এসে চাপা গলায় ডাকল, ঠাকমা! ও ঠাকমা!

কে রে!

 তোমাকে গোয়ালঘরে পার করবে বলে গোয়াল পরিষ্কার হচ্ছে যে! রাখাল ছেলেটা ঝাঁটপাট দিচ্ছে।

বুড়ি নাতনির দিকে চায়, তোর কি তাতে কষ্ট হবে রে ভাই!

গোয়ালে তুমি একা থাকতে পারবে? ভয় করবে না?

যেখানে ফেলে রাখবে সেখানেই পড়ে থাকব মা। আর কদিনই বা। কিন্তু তোর কি মনে কষ্ট হবে না তাতে? বল না।

কষ্ট হবে না? গোয়ালঘর সেই কত দূরে! রান্নাঘরের পিছনে। ওখানে আমগাছটায় ভূত থাকে যে।

 কত ভূত এ বাড়িতে। আমি রোজ দেখি।

বল কী গো!

 ওই লেবুতলায়। রোজ নিশুতরাতে ভূত আসে। তোর দাদু, জ্যাঠাদাদু, আরও কত।

 ওম্মা গো!

 ভয় পাসনি। ভয়ের কী? যখন বুড়ো হবি তখন দেখবি, তুই ভূতের দলেরই হয়ে গেছিস।

গোয়ালঘরে কিন্তু কাঁকড়াবিছে আছে। আর মশা।

সে জানি। আমাকে কম হুল দিয়েছে বিছে? তখন একটা গোরু ছিল, রোজ পরিষ্কার করতে যেতুম তো।

বড় কাকার সঙ্গে বাবার খুব ঝগড়া হল দুপুরের খাওয়ার সময়। বাবা গোয়ালঘরের টিন আর খুঁটি বিক্রি করবে বলে ঠিক করে রেখেছিল, তুমি থাকলে তো আর তা হবে না। তাই রেগে গেছে।

তাই বুঝি? কোন ভাবে যে রাখবে আমাকে তার ঠিক পাচ্ছে না। এ বাড়ি আমার শ্বশুরদের তিন চার পুরুষের ভিটে ছিল। এখনও নিশুত রাতে তারাই আসে। দেখে যায় আমার কেমন হেনস্থা হচ্ছে।

তোমার কান্না পাচ্ছে না ঠাকমা?

কান্না? না, আজকাল আর কেন কান্না আসে না বল তো! চোখে এক ফোঁটা জল নেই। শুধু কেবল সারাদিন ভয়-ভয় করে। কেবল ভয়। আগে তো কত কাঁদতুম! চোখে কত জল ছিল তখন। আজকাল পোড়া চোখে জলও নেই।

নাচুনি চলে যাওয়ার পর বুড়ি ভাবতে বসল, গোয়ালঘর কি এর চেয়ে কিছু খারাপ হবে? না বাবা, গোয়ালঘরই তো ভাল মনে হচ্ছে। অন্তত একটু চোখের আড়াল হয়ে তো থাকতে পারবে। বেড়াগুলো এতদিনে আর বুঝি আস্ত নেই। চালের টিনেও ফুটো ছিল। তা হোক বাবা, বাক্যের বিষ যদি তাতে কিছু কমে।

গোয়ালের কথা ভাবতে ভাবতেই বেলাটা গেল আজ।

 নিশুত রাতে রোজই ঘুম ভাঙে। আজও বুড়ি উঠে বসল। মেটে হাঁড়িতে পেচ্ছাপ করতে বসে খোলা জায়গাটা দিয়ে চোখ গেল, লেবুতলাটার দিকে। বুকটা কেঁপে উঠল হঠাৎ। ভুল দেখছে নাকি? লেবুতলা থেকে একটা ছায়ামূর্তি যে উঠে এল বারান্দায়! এদিকেই আসছে।

বুড়ি বুঝল এবার ডাক এসে গেছে। ওই নিতে এসে গেছে তাকে।

বুড়ি কাঁপা গলায় বলে উঠল, খাবি বাবা যমদূত? খাবি আমায়? দাঁড়া বাবা, এরা সব কী করতে কী করবে তার ঠিক নেই। ও হরি, ও কেষ্ট, তোরা একটু বিধুকে খবর পাঠাবি তো! মুখাগ্নি না হলে যে আত্মা বড় কষ্ট পায়। শ্রদ্ধও তো সে ছাড়া কেউ করতে পারবে না। বলি ও হরি…

মা।

এ ডাক গত একশো বছরেও যেন শুনতে পায়নি বুড়ি। খানিক হাঁ করে থেকে বলে, ভুল হয়নি তো বাবা! মা বলে ডাকছ

মা! আমি বিষ্টু।

 আবার বোধহয় স্বপ্নই দেখছে। আজকাল হিজিবিজি কত কী দেখে।

 কে বললি? সত্যিই বিষ্টু তো!

হ্যাঁ মা।

তোকে ওরা খবর পাঠিয়েছে নাকি? আমি তবে কখন মরলুম বল তো! অনেকক্ষণ মরেছি নাকি? মড়া বাসি হয়নি তো!

বিষ্ণুপদ একটু চুপ করে থেকে বলে, তুমি মরোনি মা। বুড়ো বয়সে ওরকম ভীমরতি হয়।

একটা টর্চের ফোকাস মেরে চারদিকটা দেখে বিষ্ণুপদ বলল, তা হলে এইখানেই থাকতে হচ্ছে আজকাল।

বুড়ি একটু ধাতস্থ হল এইবার। কাঁপা গলায় বলে, ও বিষ্টু, হঠাৎ এই মাঝরাতে এলি কেন বাবা! খারাপ খবর নেই তো!

না মা। বাসেই তো উঠলুম বিকেলের পর। নাটাগড়ে বাস বদলাতে হল। তার ওপর আবার সেই বাসের চাকা খারাপ হল মাঝরাস্তায়। এই এসে নামলাম।

ও বিষ্টু, কোথায় বসাব তোকে বাবা। এসব হাগামোতা বিছানা, এখানে তো বসতে পারবি না বাবা। ওদের সব ডেকে তুলি?

না মা। তোমাকে তো ঘরের বার করেছে দেখছি। আমার সঙ্গেই কি আর ভাল ব্যবহার করবে? ওদের কাছে তো আসা নয়, তোমার কাছেই আসা। বিছানাতেই বেশ বসতে পারব।

প্রবৃত্তি হলে তাই বোস বাবা। বুড়ো বয়সে আর কিছু ধরে রাখতে পারি না। বাহ্যে-পেচ্ছাপ হয়ে যায় আপনা থেকেই। কত কথা সতে হয় সেজন্য। তা এবার ভাল ব্যবস্থা হয়েছে। গোয়ালঘরে গিয়ে শান্তিতে থাকব।

এরপর গোয়ালঘরও আছে মা! তোমার ভোগান্তি দেখছি শেষ হয়নি!

 টর্চখানা তোর মুখের দিকে একটু তুলে ধর তো! দেখি মুখখানা! কতকাল দেখিনি, ভাল করে মনেও পড়ে না।

এ মুখ কি দেখাতে আছে মা! কত পাপ করেছি।

 খুব বুনো হয়ে গেছিস না কি বাবা? কী সুন্দর রাজপুত্তুরের মতো চেহারা ছিল তোর।

ও কথা আর বোলো না মা। নলে গা যেন রীরী করে। শুনলুম, গোবিন্দ তোমার কাছে খুব আসেটাসে।

খুব আসে। সোনার চাঁদ ছেলে। বুক ভরা মায়াদয়া।

 বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, হ্যাঁ মা, খুব ভাল।

বুড়ির একখানা কঙ্কালসার হাত বিষ্ণুপদর পিঠে মাকড়সার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিষ্ণুপদ দু হাতে মুখখানা ঢাকে।

ও বিষ্ণু, কথা কইছিস না যে? আমার যেকথা শুনতে বড় ভাল লাগে। নিঃসাড়ে পড়ে থেকে কতবার মনে হয়, মরে গেছি বুঝি!

তোমার কাছটিতে যদি বাকি জীবনটা থাকি মা, তা হলে কেমন হয়?

বিশ্বাস হওয়ার মতো কথাইনয়। বুড়ি থরথর করে কেঁপে উঠে বলে, মানিক আমার! সোনা আমার। ভোলাচ্ছিস বুঝি! নইলে ঠিক আমি স্বপ্নই দেখছি।

বিষ্ণুপদ ফিসফিস করে বলে, বড় ইচ্ছে করে মা।

যখন ছোটটি ছিলি, যখন শুধু মায়ের ন ছিলি, তখন মায়ের বুকেই জায়গা হয়ে যেত। এখন তো কত কী হয়েছিস বাছা। বউয়ের স্বামী, ছেলেপুলের বাবা, জামাইয়ের শ্বশুর। কেমনধারা সব হয়ে যায় বল তো!

বিষ্ণুপদ টর্চ জ্বেলে জেলে ঘরখানা দেখে। কুসুমপুরে তার পাকা ঘরবাড়ি, খেতখামার, টাকা পয়সা। টর্চের আলোয় সে তার সব ঐশ্বর্যের অর্থহীনতা দেখতে পায় যে, একটা কুকুর দরজায় এসে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে গেল। এদিকটায় বেড়া নেই, দরজার ঝাঁপ নেই। বিষ্ণুপদ টর্চটা নিবিয়ে আর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

মা, তুমি শুয়ে পড়ো! আমি কাছটিতে বসে থাকি।

ঘুম কি আসে বাবা! কতবার ঘুম ভেঙে উঠে উঠে দেখি। ওই লেবুঝোপের দিকটায় নিশুতরাতে তোর বাবা আসে, জ্যাঠা আসে, আরও কারা সব আসে যেনা ও বিষ্ণু, একটু মা বলে ডাক তো!

মা! মাগো! এবার শুয়ে একটু ঘুমোও।

তুই কী করবি? কিছু খাসনি তো! খিদে পায়নি?

না মা। বাস থেকে নেমে হোটেলে খেয়ে নিয়েছি নাটাগড়ে।

তুমি এবার ঘুমোও।

পালাবি না তো ঘুমোলে? ও বিষ্টু!

পালাব না।

আজ বড় ঘুম জড়িয়ে আসে কেন চোখে? বুড়ি ভাল করে বালিশে মাথা না রাখতেই রাজ্যের ঘুম নেমে আসে চোখে। শরীরটা মুড়ে একটুখানি হয়ে বুড়ি আজ ঘুমোয়। বুকটা ঠাণ্ডা লাগে বড়। বিষ্ণু এসে গেছে। বুড়ির তবে মুখাগ্নি হবে, শ্রাদ্ধ হবে। যমরাজের কাছে গিয়ে আর হেনস্থা হতে হবে না।

বিষ্ণুপদ টর্চ জ্বেলে দেখতে পেল, তার মায়ের মুখে ব্যথা বেদনার অনেক আঁকিবুকি, গভীর সব রেখা। তবু ঠোঁটে একখানা কী সুন্দর ফোকলা হাসি ফুটে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *