০৪.
পাগলটাকে আজ বেধড়ক পিটিয়েছে ছানু। একেবারে অমিতাভ বচ্চনের কায়দায়। সে একা নয়, তাদের শীতলা মাতা স্পোর্টিং ক্লাবের ছেলেরাও ছিল। তবে তারা বেশি মারেনি। ছানুরই রাগটা বেশি চড়ে গিয়েছিল। ঘরজামাই রাখবে! ঘরজামাই রাখবে বলে চেঁচিয়ে পাড়া মাত করলে কার না রাগ হয়।জামাইবাবু যেতে বসেছে সবে, এমন সময় কোথা থেকে পাগলাটা এসে হল্লা জুড়ে দিল। তার বাবা ঘর জামাই ছিল বলে একটু চাপা কানাকানি হাসি মশকরা বরাবরই শুনে আসছে ছানু। আজকের কড়াবাড়িটা তাই সহ্য হয়নি।
কিন্তু মারটা একটু বেশি হয়ে গেছে। নাক দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছিল, একটা চোখ কালশিটে পড়ে বুজে গেছে, কাঁকালেও জোর লেগেছে। কোঁকাতে কোঁকাতে অজ্ঞান মতো হয়ে গিয়েছিল।
খাওয়া ফেলে গোবিন্দই এসে জাপটে ধরল তাকে, করছটা কী? মেরে ফেলবে নাকি?
ছানু তখনও রাগে ফুঁসছে, কত বড় সাহস দেখলেন। বাবাকে অপমান!
গোবিন্দ ঠাণ্ডা গলায় বলল, নিজেদের ঘাড়ে নিচ্ছ কেন? পাগলরা কত কিছু করে, তার কি কিছু ঠিক আছে? এ, এর যে খুব খারাপ অবস্থা!
ক্লাবের ছেলেরাই দৌড়ে জল নিয়ে এল। বহুক্ষণ জলের ঝাপটাতেও কাজ হল না।
গোবিন্দ গম্ভীর মুখ করে বলল, ভিক্ষে করে খায়, কখনও তাও জোটে না, ওর কি এত মার খাওয়ার মতো ক্ষমতা আছে শরীরে? দেখছ না কেমন হাড়-বেরকরা চেহারা, দুর্বল!
ছানু একটু ভয় খেয়ে গিয়েছিল তখন। যদি মরে টরে যায় তা হলে কী হবে? সে একটু কাঁপা গলায় বলল, ওরকম না বললে কি মারতুম?
গোবিন্দ শালার দিকে কঠিন চোখে চেয়ে বলল, পাগল আর দুর্বল বলেই মারতে পেরেছ, নইলে কি পারতে?
গোবিন্দ গিয়ে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে কৃষ্ণকান্তের নাকে অনেকক্ষণ ধোঁয়া দিল। কাজ হল না তাতে।
পাগলটা বড্ড টানা মারছে শরীরটাতে। খিচুনির মতো।
এ গাঁয়ে ডাক্তার নেই? গিরীন না কে একজন ছিল না?
ক্লাবের একটা ছেলে বলে, হ্যাঁ, আমার কাকা। কাকা তো বেলপুকুর গেছে।
গোবিন্দ গম্ভীর হয়ে খানিকক্ষণ ভেবে বলল, রাস্তায় ফেলে রাখা ঠিক হবে না। তোমরা ধরো ওকে। দাওয়ায় তুলে শুইয়ে দাও। এ বোধহয় আজ খায়নি, পেটটা খোঁদল হয়ে আছে।
ক্লাবের ছেলেরা ধরাধরি করে, চণ্ডীমণ্ডপে তুলে শোয়াল কৃষ্ণকান্তকে। কে একটা পাখা নিয়ে এসে মাথায় বাতাস করতে লাগল।
ছানুকে ভিতর বাড়িতে নিয়ে গেল তার দিদি, এই তোকে মা ডাকছে।
পাপিয়া–অর্থাৎ ছানুর মা ছেলের দিকে চেয়ে বলে, খুন করেছিস নাকি পাগলটাকে?
তুমিই তো আমাকে ডেকে বললে পাগলটা কী সব অসভ্য কথা বলছে, গিয়ে দেখতে।
তা বলে অমন মারবি?
বেশি মারিনি। বেকায়দায় লেগে গেছে।
জামাই তোকে কী বলছিল? বকছিল নাকি?
জামাইবাবু মনে হয় রেগে গেছে।
এ কথায় তার দিদি আর মায়ের মুখ শুকোল।
পাপিয়া চোখের জল মুছে বলে, বিয়ের পর দু মাসও কাটেনি, এর মধ্যে জামাইকে কে যে ওষুধ করল কে জানে, বিষ নজরে দেখে আমাদের। মেয়েকে নেওয়ার নামটিও করে না। কেমন যেন রোখা-চোখা রাগ রাগ ভাব। সাতবার খবর পাঠিয়ে আনিয়েছি, এ নিয়ে কথা বলব বলে। দিলি সব ভণ্ডুল করে। জামাই আরও রেগে রইল। এখন কী হবে?
কী হবে তার ছানু কী জানে? তবে গোবিন্দদা যে তাদের বিশেষ পছন্দ করে না এটা সে টের পায়। কিন্তু মাথা ঘামায় না। সংসারের সম্পর্ক টম্পর্ক নিয়ে মাথা ঘামাতে তার ভাল লাগে না।
পাপিয়া চোখের জল মুছে বলে, সব অশান্তির মূলে ওই একটা লোক। লোভী, স্বার্থপর, অন্ধ। বিয়ের পরই আমি পই পই করে বলেছিলাম, ওগো, বাবার সম্পত্তি আঁকড়ে পড়ে থেকো না, নিজের পায়ে দাঁড়াও। চলো আমরা অন্য কোথাও চলে যাই। মতিচ্ছন্ন হলে কি কেউ ভাল কথা কানে নেয়? বাবার পিছনে পিছনে চাকরবাকরের মতো ঘুরত। গাঁয়ে কত হাসাহাসি হয়েছে তাই নিয়ে, গ্রাহ্যও করত না।
মেয়ে মুক্তি বলল, ওসব কথা থাক তো এখন। চণ্ডীমণ্ডপে ভীষণ ভিড় জমে গেছে। আমার ভয় করছে।
পাপিয়া আর একবার চোখে আঁচল-চাপা দিয়ে কাঁদল। তারপর মুক্তিকে বলল, কিছু টাকা বার করে ক্লাবের ছেলেদের হাতে দে। নাটাগড়ের হাসপাতালে ওকে নিয়ে যাক। মরলে সেইখানেই মরুক, এখানে যেন না মরে।
মুক্তি চলে গেলে ছানুর দিকে চেয়ে পাপিয়া বলে, জামাই যখনই আসে অমনি ওরা এসে জোটে।
কারা মা?
তোর মামাতো দিদি আর বোনেরা। ওরাও মাথাটা খাচ্ছে। মুক্তির দিকে ফিরেও চায় না। শালিদের সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা করে ফিরে যায়।
বিরক্ত হয়ে ছানু বললে, এখন একটা বিপদের সময় কেন যে জামাই নিয়ে পড়লে!
বিপদ তো তুই-ই বাঁধিয়েছিস মুখপোড়া। সংসারের কত রকম বিপদ আছে তা জানিস?
ছানু রাগে দুঃখে ঠোঁট কামড়ায়। বুকে বড় ভয়ও তার। মাথাটা কেমন করছে যেন। সে ক্যারাটে মারার কায়দায় একখানা লাথিও কষিয়েছিল পাঁজরে। সত্যিই মরে যাবে নাকি পাগলটা?
সে ঘুরে সদর দরজার কাছে এসে দুর থেকে ভিড়টা দেখতে পেল। তার দিদি মুক্তি গোবিন্দদার সঙ্গে কী যেন কথা বলছে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে। গোবিন্দদার মুখটা লাল টকটক করছে। খুব রাগের সঙ্গে কী যেন বলছে। মুক্তি বোধহয় কাঁদছে। বারবার আঁচল তুলছে চোখে।
মরে গেল নাকি?
আজ বাজারে একটা সিনেমা দেখানো হবে। শিবা। দারুণ ঝাড়পিটের ছবি। ফিটা দেখবে বলে কতদিন ধরে শানিয়ে রেখেছিল ছানু। অবস্থা যা দেখছে তাতে ফিলম দেখা লাটে উঠল।
এ একটা অদ্ভুত ব্যাপার। পাগলটার জন্য দরদ উথলে উঠবে মানুষের। অথচ লোকটা যে খেয়ে না খেয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে রোজ মরতে মরতে বেঁচে ছিল তখন দরদটা ছিল কোথায়? যে কোনও দিন বাঁকা নদীর পোলের ওপর থেকেও তো পড়ে মরতে পারে। রোজ রেলিং-এর ওপর উঠে এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো পায়চারি করে।
ভিড়ের ভিতর থেকে একটা চেঁচামেচি ক্রমে জোরালো হয়ে উঠছে, কে মেরেছে রে? বাপের জমিদারি পেয়েছে নাকি? যা তো বলাগড় থানায় গিয়ে একটা খবর দিয়ে আয় তো, কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাক।
আর একজন খুব তেজের গলায় বলে, ঘর-জামাই রাখার কথায় বাবুদের খুব আঁতে লেগেছে বোধহয়। সাতে পাঁচে নেই পাগলটা, পোলের নীচে পড়ে থাকত। ইস, একেবারে খুন করে ফেলেছে!
ধরে দে না ঘা কতক ছোঁড়াটাকে টেনে এনে। পালাল কোথায়?
ছানু কী করবে বুঝতে পারছে না। তার বীরত্বও উবে গেছে।
মাথাটা কেমন কেমন লাগছে।
গোবিন্দকে দেখতে পেল ছানু, ভিড় সরিয়ে চণ্ডীপণ্ডপে উঠে গেল। গোলমালটা একটু কম। সবাই খুব মন দিয়ে নিচু হয়ে কী যেন দেখছে। ভগবান! মরে যাচ্ছে নাকি? এবারকার মতো বাঁচিয়ে দাও ভগবান! জীবনে আর কারও গায়ে হাত তুলব না।
ছানু বিহ্বল হয়ে অবশ শরীরে শুয়ে পড়ল বারান্দায়।
কতক্ষণ শুয়ে আছে তার খেয়াল ছিল না। হঠাৎ দেখতে পেল তার দিদি মুক্তি এক গ্লাস গরম দুধ আঁচলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে দ্রুত পায়ে।
চোখ মেলেছে! চোখ মেলেছে! চিৎকার উঠল একটা।
ভগবান! বলে ডেকে কেঁদে ফেলে ছানু। পাঁচ সিকে মানত করে ফেলে শীতলা মায়ের কাছে। একটা শোরগোল উঠল চণ্ডীমণ্ডপে।
কেষ্ট পাগলা উঠে বসেছে। দুধ খাওয়ানো হচ্ছে তাকে। একরকম জড়িয়ে ধরে আছে তাকে গোবিন্দ। দুধ খাওয়াচ্ছে।
মারমুখো ভিড়টাকে শেষ অবধি সামলে নিল গোবিন্দই। উঠে দাঁড়িয়ে জোরালো গলায় ধমকের সুরে বলল, যে যার বাড়ি যান। এখানে ভিড় করে লাভ নেই। কৃষ্ণকান্তর দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। এখন হাওয়া বাতাস খেলতে দিন।
ভিড়টা পাতলা হতে লাগল। শেষ অবধি রইল গোবিন্দ, মুক্তি আর ক্লাবের দুটো ছেলে, যারা ছানুর বন্ধু।
গোবিন্দ হাতছানি দিয়ে ডাকল ছানুকে। ছানু দুর্বল পায়ে গিয়ে দাঁড়াল চণ্ডীমণ্ডপের কাছটিতে। কখন একটা শতরঞ্চি পেতে বালিশে শোয়ানো হয়েছে কৃষ্ণকান্তকে। চোখ মিটমিট করছে। ঠোঁটে একটু ভ্যাবলাকান্ত হাসি। পাগল বলে কথা, সে কি আর মারধোর অপমানের কথা মনে রাখে। গোবিন্দ ছানুর দিকে চেয়ে বলে, কেসটা খুব খারাপ করে ফেলেছিলে।
ছানু শুকনো গলায় বলে, আর হবে না।
খুব ভয় পেয়েছ না!
ছানু চুপ করে থাকে।
আর ভয়ের কিছু নেই। কৃষ্ণকান্ত মনে হচ্ছে, টিকে যাবে। গাঁয়ের লোক বলাবলি করছিল, ও নাকি আগে এই চণ্ডীমণ্ডপেই থাকত।
মুক্তি বলে, হ্যাঁ থাকত। নোংরা করে রাখে বলে বাবা তাড়িয়ে দিয়েছিল।
তোমাদের চণ্ডীমণ্ডপ, তোমরা যা ভাল বুঝেছ করেছ। কিন্তু লোকে ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখেনি। হরপ্রসন্নবাবু নিজেই থাকতে দিয়েছিলেন ওকে। একধারে পড়ে থাকত। কী এমন ক্ষতি হচ্ছিল তাতে?
তার দিদি মুক্তির সঙ্গে জামাইবাবু গোবিন্দর যে তেমন বনিবনা হচ্ছে না, এটা ছানুও জানে। তার দিদি বোধহয় এ কথার জবাবে একটা বাঁকা কথা বলে বসত। সম্পর্কটা এভাবেই খাট্টা হয়ে যায়। ছানু ছলছল চোখে বলল, না, ক্ষতি কীসের? আমি বাবাকে রাজি করিয়ে ওকে রেখে দেব।
দেখো চেষ্টা করে। হরপ্রসন্নবাবুর মায়াদয়ার শরীর ছিল। অনেকে আশ্রয়দাতা ছিলেন। লোকে খো এখনও বলে। সব জায়গা থেকে তাড়া খেয়ে এখন পোলের নীচে থাকে।
এতক্ষণ ছেলে দুটো কোনও কথা বলেনি। এবার তাদের একজন বলল, পোলের নীচেও তো দুপাশ খোলা। ঝড় জল হলে ভেজে।
প্রাণেশ বলল, রেলিঙের ওপর উঠে রোজ হাঁটে। কবে যে পড়ে মরবে।
গোবিন্দ একটু গভীর চিন্তান্বিত মুখে বলে, হরপ্রসন্নবাবুর বিষয়বুদ্ধিও ছিল, মহত্বও ছিল। তার বিষয়বুদ্ধিটুকু শুধু নিলাম, মহত্ত্বটা নিলাম না এটা ভাল নয়।
খোঁচটা কাকে তা টের পেল ছানু। কান একটু গরম হল।
মুক্তি বলল, এভাবে বলছ কেন? দাদু দাদুর মতোই ছিল, তা বলে সবাই তার মতো হবে নাকি?
সেই কথাটাই তো বলছি। সবাই কি আর ওরকম হয়? অনেকে শাঁসালো স্বল্প পেয়ে মাবাপকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসে। যাকগে, একে একটু দেখো। আমার ফেরার বাসের সময় হয়েছে। আমি এবার উঠব। মুক্তির মুখ রাগে অভিমানে ফেটে পড়ছে। গোবিন্দকে খবর দিয়ে না আনলে সেও আসতে চায় না। এলেও রাতে থাকে না। ছানু বোঝে, কোথায় একটা কিছু গণ্ডগোল পাকিয়ে উঠছে। গোবিন্দদা বাবাকে একদম দেখতে পারে না। আর দিদি বাবাকে ভীষণ ভালবাসে। তাই কি ওদের ঝগড়া।