1 of 2

৬৮. মেসিডোনিয়ার বিজেতারা

অধ্যায় ৬৮ – মেসিডোনিয়ার বিজেতারা

খ্রিস্টপূর্ব ৪০৪ থেকে ৩৩৬ সালের মাঝে ১০ হাজার গ্রিক পারস্য থেকে পালিয়ে যায় এবং গ্রিকদের মাঝে একাত্মতা সৃষ্টির উদ্যোগ নেন এক মেসিডোনীয়।

অ্যাথেন্স ও স্পার্টার যুদ্ধ শেষ। অ্যাথেন্সের অবস্থা ছিল করুণ। সর্বস্বান্ত হয়ে তারা রাগে দুঃখে ফুঁসছিল। সেই সুদীর্ঘ প্রাচীরগুলো ধ্বংস হয়েছে, অন্তত ৭০ হাজার অ্যাথেনীয় নাগরিক মহামারি, যুদ্ধ অথবা রাজনৈতিক কারণে প্রাণ হারিয়েছেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে কারও চিন্তাভাবনা ছিল না। শহরটা ভরে গেছিল বিধবা ও অবিবাহিত নারীতে, যাদের অদূর ভবিষ্যতে আর বিয়ে হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না—কারণ পুরুষরা সব মারা গেছে।

শহরের সমস্যা দূর করার অভিনব সব সমাধানের মধ্যে একটি ছিল, কোনো পুরুষ কোনো যুবতি নারীর শয্যাসঙ্গী হতে চাইলে তাকে প্রথমে একজন বয়স্কা নারীর সঙ্গে সহবাস করতে হবে। কেউ কেউ বললেন, অ্যাথেন্সের শাসনভার নারীদের হাতেই দিয়ে দেওয়া হোক। অ্যারিস্টোফেনেসের ‘দ্য অ্যাসেম্বলি ওম্যান’ নাটকে এসব বর্ণনা রয়েছে।

ন্যূনতম ব্যবধানে বিজয়ী স্পার্টার পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত ছিল। শস্য উৎপাদন ও গোলাঘরে ফসল তোলার মতো স্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলো পুরোই এলোমেলো হয়ে পড়ে।

চাষবাসের দিকে মনোযোগ না দিয়ে অসংখ্য স্পার্টান সেনা ভাড়াটে যোদ্ধার কাজ নিতে লাগলেন।

এদের অনেকেই পার্সি রাজপরিবারের পক্ষে যুদ্ধ করতে গেলেন।

৪০৪ সালে দ্বিতীয় আরতাজারক্সিস তার পিতা দ্বিতীয় দারিয়াসের কাছ থেকে সিংহাসন পেলেন।

পারস্যে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলেই কোন্দলের সৃষ্টি হয়—এটা নতুন কিছু নয়। দারিয়াসের ছোট ছেলে সাইরাস, যিনি সারদিসের সাতরাপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন—ক্ষমতার দখল নিতে চাইলেন।

সাইরাস তার সমর্থনকে বলিষ্ঠ করতে ‘বিভিন্ন শহরে মোতায়েন করা সেনাদের কাছে বার্তা পাঠালেন’। তিনি চাইলেন পেলোপোনেসের সেরা সেনারা তার পক্ষে যোগ দিক। জেনোফেন নামে এক তরুণ ভাড়াটে সেনা এতে সাড়া দিলেন।

সাইরাস তার বাহিনীকে নিয়ে ইউফ্রেতিসের দিকে আগাতে লাগলেন। নদী পেরিয়ে তিনি দক্ষিণে গেলেন এবং নদীকে ডানদিকে রেখে ব্যাবিলনের দিকে আগাতে লাগলেন। তিনি চেয়েছিলেন ব্যাবিলনকে ফ্রন্ট হিসেবে ব্যবহার করে পারস্যে হামলা চালাবেন। সেসময় পারস্যবাহিনীর বেশিরভাগ সদস্য একবাতানায় ছিলেন। ঘটনা টের পেয়ে দ্বিতীয় আরতাজারক্সিসকে তার পুরো সেনাবাহিনীকে সমন্বিত করতে অপ্রত্যাশিত লম্বা সময় লেগেছিল।

ব্যাবিলন থেকে প্রায় ৪০ মাইল উত্তরে কুনাক্সা নামে এক যুদ্ধক্ষেত্রে পারস্যবাহিনীর অগ্রভাগের দেখা পেল বিদ্রোহী বাহিনী।

পারস্যের বাহিনী ছিল আকারে বিশাল। তাদের ভারী বর্মে সজ্জিত প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাছে সাইরাসের বাহিনী কিছুই ছিল না। তারা সংখ্যাও কম ছিল এবং তাদের বর্মও অতটা শক্তিশালী ছিল না।

তা সত্ত্বেও সাইরাস সামনে এগিয়ে যেতে লাগলেন। একপর্যায়ে তার ভাইয়ের সঙ্গে মুখোমুখি হন সাইরাস। বুকে জ্যাভেলিনের আঘাত করে তাকে ধরাশায়ী করলেন সাইরাস। তবে এই আঘাতে মারা যাননি রাজা। তার চিকিৎসক তেসিয়াস আঘাতে ড্রেসিং করে দিলেন।

জয় হয়েছে ভেবে বীরদর্পে ফিরে যাচ্ছিলেন সাইরাস। এসময় দূর থেকে আসা একটি তিরে প্রাণ হারান তিনি।

পারস্যের সেনাবাহিনী হামলা ঠেকাতে সক্ষম হল। সাইরাসের মৃত্যুর মাধ্যমে বিদ্রোহের অবসান হল। গ্রিক অফিসারদের অনেকেই গ্রেপ্তার হলেন।

আরতাজারক্সিস দ্বিতীয় বেঁচে থাকা গ্রিক ভাড়াটে সেনাদের বললেন আত্মসমর্পণ করতে। কিন্তু তারা তাতে রাজি হল না। বাকি ১০ হাজার সেনা সংঘবদ্ধ হয়ে পিছু হটল। তরুণ জেনোফন তাদের অন্যতম নেতা হিসেবে নির্বাচিত হলেন।

৬৮.১ দশ হাজারের পদযাত্রা

খ্রিস্টপূর্ব ৪০১ সালের সেপ্টেম্বরে তাদের যাত্রা শুরু হল যা বেশ কয়েক মাস ধরে চলল। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, পেছন থেকে পারস্য বাহিনীর বিচ্ছিন্ন হামলা, আশেপাশের জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে হয়রানি—কিছুই তাদেরকে দমাতে পারেনি। তারা তাইগ্রিসের তীর ধরে এগিয়ে যেতে লাগল; উদ্দেশ্য, সেই উপকূলে পৌঁছানো, যেখান থেকে তারা গ্রিসে ফিরতে পারবেন।

প্রায় এক বছর পর জেনোফনের সেনাবাহিনীর সামনে দিক থেকে ‘সমুদ্র! সমুদ্র!’ উল্লাসধ্বনি শোনা গেল।

এই ১০ হাজার সেনাদের বড় একটি অংশ গ্রিসে ফিরে যেতে সক্ষম হয়, যা ছিল পারস্যের রাজা দ্বিতীয় আরতাজারক্সিসের জন্য বড় ব্যর্থতা। তার জন্য সাইরাসকে হত্যা করাই ছিল একমাত্র সাফল্য।

সব মিলিয়ে, দ্বিতীয় আরতাজারক্সিসের শাসন খুবই দুর্বল ছিল। তিনি মিশরের ওপরও নিয়ন্ত্রণ হারান। সাইরাসের এক অভিজাত মিশরীয় ব্যক্তি অ্যামিরশিয়াস নিজেকে ফারাও হিসেবে ঘোষণা দিলেন। এই পারস্যবাসী সাতরাপ-নেতা দ্বিতীয় আরতাজারক্সিসের কাছ থেকে অনেক মানুষকে নিজের পক্ষে নিয়ে এলেন।

অ্যামিরশিয়াস প্রথম মিশরীয় ‘স্বাধীনতাকামী’ মানুষ ছিলেন না, কিন্তু তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি যথেষ্ট পরিমাণ শক্তিমত্তা সঞ্চয় করে নিজেকে ২৮তম রাজবংশের প্রথম ফারাও হিসেবে ঘোষণা দিতে পেরেছিলেন। ২৬তম রাজবংশের শেষ ফারাও ছিলেন তৃতীয় সাম্মেটিকাস এবং ২৭তম রাজবংশের ফারাও হিসেবে পার্সিদের নথিবদ্ধ করেন ইতিহাসবিদ মানেথো।

অ্যামিরশিয়াসের রাজত্ব চার বছর স্থায়ী ছিল এবং তিনিই ২৮তম রাজবংশের একমাত্র ফারাও। তার রাজত্বের বিষয়ে তেমন কিছু জানা যায় না। অ্যামিরশিয়াসের মৃত্যুর পর প্রথম নেফেরিতেস নামে অপর এক বিদ্রোহী নেতা ক্ষমতা দখল করেন এবং নিজেকে ২৯তম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ঘোষণা দেন। ৬ বছর পর তাকে উৎখাত করেন আচোরিস।

তিন বছর পর তিনি নিজেকে মিশরের ফারাও হিসেবে ঘোষণা দেন। আচোরিস গ্রিসে দূত পাঠান। পারস্য যাতে তার দেশ আর দখল করতে না পারে, সেজন্য অ্যাথেন্সের সাহায্য চান তিনি।

অপরদিকে, গ্রিকরা আবারও নিজেদের মধ্যে বিবাদ শুরু করেছিল।

১০ হাজার সেনা ফিরে আসার এক বছর পর, ৩৯৯ সালে শহরটিতে দ্য থার্টির নানা উদ্যোগে কোন্দল চলছিল। সেসময় অ্যাথেন্সবাসী দার্শনিক সক্রেটিসকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। আলসিবিয়াদেস ও থার্টির সবচেয়ে নির্দয় সদস্য ক্রিটিয়াস, উভয়ের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল সক্রেটিসের I হেমলক বিষ খেয়ে নিজের মৃত্যুদণ্ড নিজেই কার্যকর করেন সক্রেটিস। তার মৃত্যুর বিষয়টি লিপিবদ্ধ করেন প্লেটো।

পেলোপোনেশীয় যুদ্ধ শেষে স্পার্টার সঙ্গে পারস্যের চুক্তি ছিল এমন যে, তারা আইওনিয়ান শহরগুলো পারস্যের হাতে তুলে দেবে আর বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে স্বর্ণ পাবে। কিন্তু তারা সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এই শহরগুলোর কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য নিজস্ব প্রতিনিধি পাঠাল। স্পার্টা থেকে আসা এই প্রতিনিধিদের দেখে বাকি গ্রিক শহরগুলো রাগান্বিত হল। মাত্রই ৩০ বছরের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। কিন্তু স্পার্টার এহেন স্পর্ধায় বসে থাকতে পারেনি অ্যাথেন্স, থেবেস, করিন্থ ও আরগোস। এই চার শহর মিলে তাদের অবশিষ্ট সেনাবাহিনীর সমন্বয় করে স্পার্টাকে শিক্ষা দিতে উদ্যত হল।

৩৯৫ সালে এই তথাকথিত করিন্থিয়ান যুদ্ধ শুরু হয়। ৩ বছরের অর্থহীন যুদ্ধ শেষে পিঠটান দিল স্পার্টা। তবে গ্রিকদের কাছে পরাজয় বরণ না করে বরং তারা পারস্যের কাছে প্রস্তাব পাঠাল আইওনিয়ান শহরের দখল তাদের হাতে তুলে দেওয়ার বিনিময়ে এই যুদ্ধে সহায়তা করার।

দ্বিতীয় আরতাজারক্সিস রাজি হলেন এবং পারস্য থেকে জাহাজ পাঠালেন। ফলে মিশরে আচোরিসকে সাহায্য করতে প্রণোদিত হল অ্যাথেন্স। মিশর- অ্যাথেন্সের এই জোট কি পারবে পারস্য-স্পার্টার জোটকে পরাভূত করতে? সেটাই ছিল সেসময়ে বড় প্ৰশ্ন।

কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে অ্যাথেন্স ও স্পার্টার যোদ্ধারা তেমন কিছু করতে পারল না। বহু বছরের যুদ্ধে তারা ভগ্নদশায় ছিল। ফলে ৩৮৭ সালে দ্বিতীয় আরতাজারক্সিস ঘোষণা দিলেন, অ্যাথেন্স ও স্পার্টা নিজেদের মধ্যে শান্তি বজায় রাখতে না পারলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে হামলা চালাবেন।

মিশরীয় জোট থেকে সরে এল অ্যাথেন্স। একা হয়ে পড়লেন আচোরিস। স্পার্টাও নিজ দেশে ফিরে গেল। কিছুদিনের জন্য সবাই যার-যার শহরগুলো পুনর্নির্মাণে মনোযোগ দিতে বাধ্য হল। এই তথাকথিত ‘রাজার শান্তি’ তখন পুরোপুরি কার্যকর

জেনোফনের বর্ণনায়, ‘অ্যাথেন্সের প্রাচীরগুলো ধসে পড়ার পর এবারই প্রথম এ অঞ্চলে পূর্ণাঙ্গ পর্যায়ের শান্তি নেমে এল।’

দ্বিতীয় আরতাজারক্সিসের শাসনামলে তেমন কোনো অর্জন না থাকলেও এশিয়া মাইনর আবারও দখল করতে পারা ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। মিশরীয় শিলালিপিতে দেখা গেছে, তিনি একপর্যায়ে আচোরিসকে শায়েস্তা করতে বাহিনী পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু গ্রিক ভাড়াটে সেনাদের সহায়তায় এই হামলা প্রতিহত করেন আচোরিস। পার্সিরা ফিরে যায় নিজেদের দেশ।

আচোরিসের মৃত্যুর পর মিশরে ক্ষমতা দখল করলেন অজ্ঞাত সেনা প্ৰথম নেকতানেবো। তিনিই ছিলেন ৩০তম মিশরীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। সেসময় দ্বিতীয় আরতাজারক্সিস আরও একবারের মতো মিশরের দখল ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চালান। তিনি এই উদ্দেশ্যে বিশেষ সুবিধা পেতে অ্যাথেন্স থেকে ভাড়াটে সেনা জোগাড় করলেন।

প্রথাগত পথে হামলা না চালিয়ে পশ্চিমদিক দিয়ে বদ্বীপে হামলা চালান তিনি। কিন্তু নেকতানেবো অসামান্য যুদ্ধকৌশলের মাধ্যমে এই হামলা প্রতিহত করেন। পরাজয় মেনে নিয়ে পারস্য ও অ্যাথেন্সের যৌথবাহিনী নিজ দেশে ফিরে গেল। এরপর টানা ১৮ বছর ক্ষমতায় ছিলেন নেতানেবো এবং এই পুরো সময়টা জুড়ে একবারও হামলা চালাননি দ্বিতীয় আরতাজারক্সিস।

গ্রিসের ধ্বংসযজ্ঞে অন্তত একজন অ্যাথেন্সবাসী অনুধাবন করলেন যে গ্রিসের শহরগুলোকে টিকে থাকতে হলে সবাইকে একটি সমন্বিত গ্রিক পতাকার নিচে আসতে হবে।

এই অ্যাথেন্সবাসীর নাম ছিল আইসোক্রেটিস। তিনি ছিলেন একজন বক্তা ও শিক্ষক। পেলোপনেশীয় যুদ্ধ শুরুর আগেই তার জন্ম হয়েছিল। তিনি বড় হতে হতে দেখেন কীভাবে শহরগুলো একের পর এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছিল। ‘রাজার শান্তির’ সাত বছর পর, ৩৮০ সালে তিনি পানেজাইরিকাস নামে একটি বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি সব গ্রিক শহরকে একতাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। আইসোক্রেটিস যুক্তি দেন, ‘অ্যাথেন্সকে এই উদ্যোগে নেতৃত্ব দিতে হবে, কারণ এই শহরের কারণে “গ্রিক” শুধু একটি শব্দ বা জনগোষ্ঠীর নাম নয়, বরং এটি একধরনের চিন্তাধারা। যাদেরকে গ্রিক বলা, তারা সবাই একই শিক্ষায় শিক্ষিত, শুধু জন্মসূত্রে গ্রিক হওয়া যায় না।’

এ-ধরনের চিন্তাধারা প্রথম দেখা গিয়েছিল পেরিক্লেসের মাঝে। তিনি চেয়েছিলেন অ্যাথেন্স ও স্পার্টাকে একতাবদ্ধ করতে, যাতে যেকোনো ধরনের গ্রিক হুমকির মোকাবিলা করা যায়। তবে পানেজাইরিকাসই প্রথম লিপিবদ্ধ আহ্বান। এ আহ্বান শুধু গ্রিসের একীভূতকরণের নয়, এটা ছিল “আরও বড় সেনাবাহিনী” গঠনের মাধ্যমে পারস্যের রাজা দ্বিতীয় আরতাজারক্সিসকে প্রতিহত করার আহ্বান।

৩৫৯ সালে আবারও এ অঞ্চলের ক্ষমতার পট-পরিবর্তন এল।

দ্বিতীয় আরতাজারক্সিসের জ্যেষ্ঠসন্তান দারিয়াস (এতক্ষণে পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছেন যে প্রাচীন আমলে একই নামে একাধিক মানুষের অস্তিত্ব খুবই স্বাভাবিক ঘটনা) তার পিতাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সন্দেহ করছিলেন, বাবা তার পরিবর্তে ছোটভাই অচাসকে উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচন করতে পারেন। তিনি এই ষড়যন্ত্র টের পেয়ে গেলেন। রাতে বাবাকে হত্যা করতে এসে হাতেনাতে ধরা পড়লেন দারিয়াস। তাকে গ্রেপ্তার করে শিরশ্ছেদ করা হল রাতারাতি।

অল্পদিনের মাঝেই বিরক্তিকর রাজা দ্বিতীয় আরতাজারক্সিসের বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করলেন। উল্লিখিত অচাস তার অন্যান্য ভাইদের বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করলেন এবং নির্ভয়ে ও নিশ্চিন্তে তৃতীয় আরতাজারক্সিস হিসেবে অভিষিক্ত হলেন।

একই বছরে মেসিডোনিয়ার রাজা হলেন দ্বিতীয় ফিলিপ। দারিয়াস দ্য গ্রেটের কাছে ১০০ বছর আতে আত্মসমর্পণ করেন প্রথম অ্যামিনতাস। তারপর ১৩তম রাজা হলেন এই ফিলিপ।

ফিলিপের বর্ষীয়ান পিতা চতুর্থ অ্যামিনতাস শেষ বয়সে তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট এক নারীকে বিয়ে করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল এক বৈধ উত্তরাধিকারীর জন্ম দেওয়া। এর আগে তার অন্তত তিনটি অবৈধ সন্তান ছিল, যারা সিংহাসনের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছিলেন। ইউরিদাইস নামে এই নারীর গর্ভে অ্যামিনতাসের তিন সন্তান জন্ম নেয়—আলেকজান্ডার দ্বিতীয়, পেরদিক্কাস ও ফিলিপ। তারপর তিনি মেসিডোনিয়ার রাজসভার এক সভাসদের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। টলেমি নামের এই সভাসদের সঙ্গে নিজ স্ত্রীকে একবার তার বিছানায় আবিষ্কার করলেন রাজা ফিলিপ। তবে নিজের বয়স ৮০ ছিল বলেই হয়তো এই ‘দুর্ঘটনা’ নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করেননি রাজা অ্যামিনতাস।

যখন প্রাচীন অ্যামিনতাস মারা গেলেন, আলেকজান্ডার রাজা হলেন। দেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে ইলিরীয় গোত্রগুলো হামলা করার হুমকি দিচ্ছিল। পারস্যের সঙ্গে মেসিডোনিয়ার জোটের কারণে উত্তর ও দক্ষিণে শত্রুর কাছ থেকে এ অঞ্চল সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের শাসনামলে আগের মতো শক্তিশালী ছিল না পারস্য। তৃতীয় শতাব্দীর ইতিহাসবিদ জাস্টিন আমাদেরকে জানান, যুদ্ধ এড়াতে দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ইলিরিয়ানদের ঘুস দিয়ে সন্তুষ্ট করেছিলেন। সঙ্গে তার ছোটভাই ফিলিপকে (১০) ইলিরিয়ায় জিম্মি হিসেবে পাঠাতে বাধ্য হন তিনি।

পরবর্তীতে ফিলিপ ফিরে আসার অনুমতি পেয়েছিলেন। তবে ততদিনে তার বড়ভাইয়ের কপাল পুড়েছে। আলেকজান্ডারের মা নিজেই তাকে হত্যা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যাতে তার প্রেমিক টলেমি ক্ষমতা দখল করতে পারে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আলেকজান্ডারের মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টলেমি নিজেকে বৈধ উত্তরাধিকারী ও দ্বিতীয় ছেলে পেরদিক্কাসের রিজেন্ট (রাজপ্রতিনিধি) হিসেবে নিজের নাম ঘোষণা দিলেন। ততদিনে ফিলিপের বয়স ১৫ হয়েছে। তাকে আবারও জিম্মি হিসেবে দক্ষিণের গ্রিক শহর থেবেসে পাঠানো হল। তারাও মেসিডোনিয়ায় হামলা চালানোর হুমকি দিচ্ছিল।

পেরদিক্কাস বোকা ছিলেন না। সিংহাসনে আরোহণের বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন তিনি। এরপর, মেসিডোনিয়ার অভিজাত মহলে যারা টলেমিকে দেখতে পারত না, তাদের সহায়তায় মায়ের প্রেমিকের শিরশ্ছেদ করানোর ব্যবস্থা নিলেন তিনি। তার মা ইউরিডাইসের শেষ পরিণতি কী ছিল, তা জানা যায় না। তারপর তিনি নিজে সিংহাসনে আরোহণ করে থেবেস থেকে ফিলিপকে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা নিলেন। বিয়ে করে এক সন্তানের পিতাও হলেন পেরদিক্কাস। এরপর তিনি মনোযোগ দিলেন ইলিরিয়ানদের দমনে।

তার রাজত্বের ষষ্ঠ বছরে তিনি তার ছোটভাই ফিলিপকে নিজের সন্তানের রিজেন্ট বানালেন। এরপর মেসিডোনিয়ার সেনাবাহিনীকে ইলিরিয়ানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিলেন। কিন্তু এই যুদ্ধের পরিণাম ছিল ভয়াবহ। হাজারো মেসিডোনীয় সেনার সঙ্গে পেরদিক্কাসও নিহত হলেন। উত্তর-পশ্চিম থেকে আসা এই হুমকির মোকাবিলা করার দায়িত্ব পড়ল ২৪ বছর বয়সি ফিলিপের ওপর। তিনি মেজোভাইয়ের সন্তানের রাজপ্রতিনিধি হিসেবে প্রতিরক্ষা শুরু করলেও, জাস্টিনের মতে, “বাধ্য হয়ে তিনি সেই শিশু-রাজার বদলে” নিজেই ক্ষমতা গ্রহণ করলেন। তবে এক্ষেত্রে ফিলিপের নেতৃত্ব জরুরি ছিল। ইলিরিয়ানরাই একমাত্র হুমকি ছিল না। অ্যাথেন্সও চাইছিল মেসিডোনিয়ায় তাদের পছন্দের কাউকে ক্ষমতায় বসাতে, যিনি এই শহরকে অ্যাথেন্সের সঙ্গে যুক্ত করবেন।

এক্ষেত্রে কূটনীতির আশ্রয় নিলেন ফিলিপ। অ্যাথেন্সের হুমকির বিপরীতে তিনি সীমান্তবর্তী একটি শহরের কর্তৃত্ব তাদের হাতে তুলে দিলেন। এরপর নিজের সেনাবাহিনীকে সুসংহত করার দিকে নজর দিলেন তিনি। অপ্রশিক্ষিত ও অপেশাদার মেসিডোনীয় সেনাদের তিনি গ্রিক ফ্যালাংক্স ফর্মেশন শেখালেন, যা তিনি থেবেসে থাকাকালীন সময়ে শিখে এসেছিলেন। পরবর্তী বছর, ইলিরীয়দের পরাজিত করল মেসিডোনিয়া।

ততদিন অ্যাথেন্সের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে মেসিডোনিয়া। প্রতিরক্ষা নয়, বরং সাম্রাজ্যবিস্তারে মন দিলেন ফিলিপ। তিনি যুদ্ধ করলেন, পাঁচ-পাঁচটি বিয়ে করলেন এবং থারমাইক উপসাগর, মেসিডোনিয়া ও থ্রেসের সীমান্ত, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত—এসব জায়গায় সাম্রাজ্য বিস্তার করলেন। তার তৃতীয় স্ত্রী অলিম্পিয়াস (১৭) ছিলেন এপিরাসের রাজার মেয়ে।

প্রাচীন ইতিহাসের বর্ণনায়, অলিম্পিয়াস ছিলেন অনিন্দ্যসুন্দরী। তবে মাঝে মাঝেই প্রচণ্ড রেগে যেতেন তিনি এবং তার ছিল এক উদ্ভট শখ। তিনি বড় বড় অজগর সাপ পালতেন এবং প্রায়ই সেগুলোকে তার শয়নকক্ষে অবাধে ঘুরে বেড়াতে দিতেন।

তার বাবা ভেবেছিলেন মেয়ের বিয়ে দিয়ে তিনি এপিরাসকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করছেন। কিন্তু রাজকন্যাকে পেয়ে রাজত্বও দখল করে নেন ফিলিপ।

৩৫৬ সালে অলিম্পিয়াসের গর্ভে জন্ম নিল ফিলিপের প্রথম পুত্রসন্তান ও তার উত্তরাধিকারী। মৃত ভাইয়ের নামে এই সন্তানের নাম রাখা হল আলেকজান্ডার।

ততদিনে ফিলিপ দক্ষিণের দিকে নজর দিলেন। গ্রিক শহর ফেরাই, থ্রেস ও অ্যাথেন্সের কাছে হারানো সেই শহর—সবগুলোই একে একে ফিরে এল তার কাছে। আরও দক্ষিণে ও পূর্বে সাম্রাজ্য বিস্তারের মাঝে একটি তির এসে তার ডান চোখ ভেদ করে। ‘এক-চোখা’ ফিলিপের বেশকিছু মূর্তি পরবর্তীতে খুঁজে পাওয়া গেছে।

মেসিডোনিয়ার এই আগ্রাসনের তেমন কোনো জবাব দিতে পারেনি অ্যাথেন্স ও স্পার্টা। দুই দেশই মহামারি ও অন্যান্য সমস্যা-ভারাক্রান্ত ছিল।

তিনি গ্রিস দখল করার চেয়ে বরং নিজের সাম্রাজ্যের সঙ্গে গ্রিসকে এক করে নেওয়াতে বেশি মনোযোগী ছিলেন।

তার নিজের পদাতিক ও ঘোড়সওয়ার বাহিনীতে ছিল গ্রিক সেনার ছড়াছড়ি। তিনি নিজেও থেসালি থেকে আনা একটি গ্রিক ঘোড়ায় চড়তেন। এই ঘোড়ার নাম ছিল বিউসেফালেস। পরবর্তীতে তার সন্তান আলেকজান্ডারের চৌকশ বুদ্ধিমত্তাকে সবার সামনে আনতে এই ঘোড়া বড় ভূমিকা রাখে।

প্লুটার্ক আমাদের জানান, ফিলিপ এই ঘোড়াটি সংগ্রহ করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেছিলেন। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তিনি অনেক চেষ্টা করেও একে বাগে আনতে পারছিলেন না। বিরক্ত হয়ে ঘোড়াটিকে তার মালিকের কাছে ফেরত পাঠাতে বললেন রাজা ফিলিপ। কিন্তু এতে প্রতিবাদ জানালেন তরুণ আলেকজান্ডার।

তিনি খেয়াল করলেন, ঘোড়া তার নিজের প্রতিচ্ছায়া দেখে ভয় পাচ্ছে। ঘোড়ার মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে খুব সহজেই তার ওপর চড়ে বসলেন আলেকজান্ডার। এই ঘটনা মেসিডোনিয়া ও পুরো গ্রিসজুড়ে তার নাম আলোচনায় নিয়ে আসে। তরুণ বয়স থেকেই তিনি ছিলেন কৌশলী। এ ঘটনা তারই প্রমাণ।

আলেকজান্ডার ছাড়া ফিলিপের আর কোনো বৈধ পুত্রসন্তান ছিল না। তারই এক রক্ষিতার গর্ভে আরেক সন্তান জন্ম নেয়, যার নাম ছিল ফিলিপ। কথিত আছে, আলেকজান্ডারের মা অলিম্পিয়াস এই শিশুকে ছোটবেলা থেকে নেশাজাতীয় দ্রব্যে আসক্ত করে তোলেন, যার ফলে সে নির্বোধ হিসেবে বড় হয়। তবে এই দাবির সপক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ নেই।

সব মিলিয়ে, আলেকজান্ডারকে নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে বড় করেন ফিলিপ। ৩৪৩ সালে দার্শনিক অ্যারিস্টটলকে নিযুক্ত করেন আলেকজান্ডারের শিক্ষক হিসেবে। মোটা বেতনের এই চাকরি খুশিমনেই গ্রহণ করেন অ্যারিস্টটল।

৩৪০ সালে অ্যাথেন্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ফিলিপ।

সমগ্র গ্রিকবাসীকে একত্রিত হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন যিনি, সেই গ্রিক দার্শনিক আইসোক্রেটিসের বয়স ততদিনে ৯০ হয়েছে। তিনি পানেজাইরিকাসের পর আরেকটি বক্তৃতা দেন, যার শিরোনাম ছিল ‘ফিলিপের প্রতি। তিনি মেসিডোনিয়ার রাজা ফিলিপকে আহ্বান জানান গ্রিসকে একই কাতারে নিয়ে আসার। কিছুটা মেসিডোনিয়ার শক্তিমত্তা, খানিকটা আইসোক্রেটিসের বক্তৃতা- সব মিলিয়ে গ্রিসের তেমন কোনো শহরই আর যুদ্ধে জড়াতে চাইছিল না।

গ্রিক শহরগুলোর সংগঠন আইসোক্রেটিসের উপদেশ মেনে ফিলিপকে গ্রিসে স্বাগত জানাল। অ্যাথেন্স, স্পার্টার কাছে সামরিক সহায়তা চাইলেও তারা তাতে কর্ণপাত করেনি। যখন ফিলিপের বাহিনী অ্যাথেন্স এল, তখন তাদের সঙ্গে থেবেস ও বোয়েশিয়ার মিত্ররা ছাড়া আর কেউই ছিল না।

শাইরোনিয়ার সমতলভূমিতে ৩৩৮ সালের গ্রীষ্মে দুই বাহিনীর যুদ্ধ হল। দুই পক্ষের শক্তিতে অনেক তারতম্য থাকলেও যুদ্ধক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অ্যাথেনীয়রা বেশ ভালো করছিল।

ফিলিপ নিজে বাহিনীর একাংশে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আর সদ্য প্রাপ্তবয়স্কের তকমা পাওয়া আলেকজান্ডার আরেক অংশের। যদিও বাহিনীতে অনেক অভিজ্ঞ ও চৌকশ সেনাপতি ছিলেন, তাও রাজা ও রাজপুত্রের এই যুদ্ধযাত্রা অনন্য।

রক্তাক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে কোনো পক্ষই বিশেষ সুবিধা পাচ্ছিল না।

অবশেষে, বাবার কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে দুঃসাহসী আলেকজান্ডার এগিয়ে গেলেন। শত্রুপক্ষের সেনাদের কচুকাটা করতে করতে একেবারে শত্রুবাহিনীর মাঝের অংশে চলে এলেন এই তরুণ বীর।

শাইরোনিয়ার যুদ্ধে খুব অল্পসংখ্যক সেনা নিহত হন। মাত্র এক হাজার অ্যাথেনীয় প্রাণ হারান। দুই কারণে এই যুদ্ধ অনন্য। এটাই ছিল আলেকজান্ডারের প্রথম বড় আকারে সামরিক নেতৃত্ব দেওয়ার ঘটনা। আর দ্বিতীয়ত, এই যুদ্ধের মাধ্যমে এক যুগের অবসান ঘটে। গ্রিক শহরগুলো আর কখনোই একে অপরের বিরুদ্ধে লড়েনি—সব শহর বড় এক সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়।

ফিলিপ বুঝতে পেরেছিলেন যে বাকি শহরগুলোকে তিনি পরাভূত করতে পারবেন না। তিনি অ্যাথেন্সকে বিশেষ সম্মান দিলেন। কয়েদিদের মুক্তি দিলেন, বিশেষ মর্যাদায় সেনা প্রহরা দিয়ে নিহতদের মরদেহ ফেরত পাঠালেন অ্যাথেন্সে। ফিলিপকে ‘বন্ধু’ হিসেবে মেনে নেওয়া ছাড়া তেমন কোনো বিকল্প ছিল না অ্যাথেনীয়দের হাতে।

পরের বছর করিন্থে বক্তৃতা দেন ফিলিপ। তিনি দাবি করেন, তার শাসন সমগ্র গ্রিসের জন্য উপকারী হবে। স্পার্টা তখনো এই বক্তব্য মেনে নিতে প্রস্তুত না হলেও বাকি গ্রিক শহরগুলো একমত হল। অবশ্যই, ফিলিপের সুবিশাল সেনাবাহিনী তাদেরকে প্রণোদিত(!) করেছিল। করিন্থিয়ান লিগ নামে এক জোট সৃষ্টি হলো, যা খানিকটা অ্যাথেন্সের পুরনো ডেলিয়ান লিগের মতো ছিল। এই জোটের সর্বাধিনায়ক হলেন মেসিডোনিয়ার রাজা এবং এটি গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল পারস্যের বিরুদ্ধে হামলা চালানো।

পারস্য বেশ ভঙ্গুর ও দুর্বল অবস্থায় ছিল। তৃতীয় আরতাজারক্সিস ১৯ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিলেন এবং তার বড় সাফল্য ছিল ৩৪৩ সালে (ছয় বছর আগে) মিশরের সর্বশেষ স্থানীয় ফারাও দ্বিতীয় নেকতানেবোকে পরাজিত করা। মানেথোর ভাষায়, আবারও মিশর পারস্যের একটি সাতরাপে পরিণত হয়েছিল। তিনি পারস্যের রাজার অধীনে এই শাসনামলকে ৩৩তম রাজবংশ বলে অভিহিত করেন।

তবে শাইরোনিয়ার যুদ্ধের বছরেই এই আরতাজারক্সিস পরলোক গমন করেন। আরতাজারক্সিসের অন্যতম অধিনায়ক ছিলেন বাগোয়াস নামের এক খোজা। ধারণা করা হয়, তিনিই বিষপ্রয়োগে তার রাজাকে হত্যা করেন।

তৃতীয় আরতাজারক্সিসের প্রয়াণের পর উপদেষ্টা হিসেবে দেশ শাসন করতে লাগলেন বাগোয়াস। অপ্রত্যাশিতভাবে দুই রাজপুত্র মারা গেলেন। বাগোয়াস তাদেরকে পানীয় পরিবেশনা করেছিলেন। আরসেস নামে অপর এক রাজপুত্র তখনো বেঁচে ছিলেন।

বাগোয়াস এই আরসেসকে সামনে পুতুল-রাজ হিসেবে রেখে নিজেই সব কলকাঠি নাড়তে লাগলেন। যে মুহূর্তে আরসেস একটু স্বাধীন মত প্রকাশ করতে গেলেন, তখনই তাকেও বিষ খাওয়ালেন বাগোয়াস।

ফিলিপ এই পুরুষাঙ্গহীন রাজার অধীনস্থ পারস্যে হামলা চালাতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। কিন্তু তখন তার জীবনে নেমে আসে বিপর্যয় এবং তা তিনি নিজেই ডেকে আনেন। করিন্থের বৈঠকের ঠিক পরেই, ৩৩৭ সালে ফিলিপ আবারও বিয়ে করতে উদ্যত হলেন। কিন্তু এই বিয়েতে ছিল না কোনো রাজনৈতিক সুবিধা

মেসিডোনিয়ার এক সুন্দরী নারীর প্রেমে মজলেন তিনি। তার পিতা ছিলেন সভাসদ আত্তালাস। বিয়ের অনুষ্ঠানে সবাই মদ খেয়ে চুর হলেন। মেসিডোনিয়ার সব উৎসবের এটা ছিল সাধারণ নীতি। সেসময় আত্তালাস মদের গ্লাস উঁচিয়ে ঘোষণা দিলেন, বিধাতা এবয়ার মেসিডোনিয়াকে সিংহাসনের জন্য বৈধ উত্তরাধিকারী পাঠাবে।

আলেকজান্ডার অবশ্যই বৈধ সন্তান ছিলেন। কিন্তু তার মা গ্রিক হওয়ায় তিনি ছিলেন অর্ধ-মেসিডোনীয়। আত্তালাসের এই ঘোষণা তার উত্তরাধিকারের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছিল।

আলেকজান্ডারও মদ্যপ ছিলেন। তিনি তার পিতার নতুন শ্বশুরকে ‘নর্দমার কীট’ বলে সংবর্ধনা জানিয়ে তার দিকে একটি কাপ ছুড়ে মারলেন। এতে ফিলিপ তরবারি হাতে নিজের ছেলের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সম্ভবত বাকি সবার চেয়ে তিনি বেশি মাতাল অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু কিছু করার আগেই নিজেই জ্ঞান হারিয়ে ছেলের সামনে পড়ে গেলেন ফিলিপ

আলেকজান্ডার ঘৃণাভরে বাবার দুরবস্থা নিয়ে রসিকতা করলেন। ‘এই সেই লোক যে ইউরোপ পেরিয়ে এশিয়া দখল করতে যেতে উদ্যত হয়েছিলেন। কিন্তু এখন এক চেয়ার থেকে আরেক চেয়ারের দিকে আগাতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাচ্ছেন’, বললেন তিনি।

তবে ঘটনা এখানে শেষ নয়।

৩৩৬ সালে ফিলিপ বড় এক উৎসবের আয়োজন করলেন। পারস্যে যুদ্ধযাত্রা উপলক্ষে আয়োজিত এই উৎসবের মাঝে শোভাযাত্রায় বের হলেন ফিলিপ ও তার কাছের মানুষেরা। এর মাঝে তারই এক সাবেক প্রেমিক (যার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছিল) পাউসিনিয়াস পেছন থেকে এসে তাকে ছুরিকাঘাত করেন। রাজার পাঁজরে ছুরি বিধিয়ে দেন তিনি। দৌড়ে পালানোর সময় পাউসিনিয়াস আছাড় খেয়ে পড়ে যান। রাজার দেহরক্ষীরা সেখানেই তাকে হত্যা করে। তবে ততক্ষণে রাজারও ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে।

অনেকেই সন্দেহ করেন, এই ঘটনায় আলেকজান্ডারের যোগসাজশ রয়েছে, যিনি তার পিতাকে ঘৃণা করতেন। তবে তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ ছিল না, এবং কেউ সেই অভিযোগ আনার সাহসও পাননি। সেনাবাহিনীতে জনপ্রিয় ছিলেন আলেকজান্ডার এবং পরের দিনই তারা তাকে নতুন রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সে আমলেও সেনাবাহিনীর সমর্থনই দেশশাসকের সবচেয়ে বড় শক্তিমত্তা ছিল।

প্লুটার্ক বলেন, তিনি এমন এক রাজত্বের শাসক হলেন, যার ‘চারপাশে ঘৃণা, অপছন্দ ও বিপদ’ লুকিয়ে ছিল। উত্তরের অধিকৃত অঞ্চলগুলো মেসিডোনীয় শাসনে খুশি ছিল না। দক্ষিণের গ্রিকরা করিন্থিয়ান লিগের সদস্যপদ নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিল না। আলেকজান্ডারের নেতৃত্ব দক্ষতা নিয়েও তারা ছিলেন সন্দিহান। আর পারস্য মেসিডোনিয়ার হামলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।

কিন্তু অন্য কিছুতে হাত দেওয়ার আগে আলেকজান্ডারের চিন্তায় ছিল বড় একটি দায়িত্ব। প্রয়াত রাজা ফিলিপ তার শ্বশুরকে এশিয়া মাইনরে পাঠিয়েছিলেন। তার দায়িত্ব ছিল মেসিডোনীয় বাহিনীর জন্য রাস্তা পরিষ্কার করে রাখা, যাতে তারা সহজে পারস্যের দিকে আগাতে পারে। আলেকজান্ডার কখনো অপমান ভুলতে জানতেন না। তিনি এক আততায়ীকে পাঠালেন আত্তালাসকে হত্যা করতে, যিনি তার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করলেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *