অধ্যায় ৬৭ – চি’ইনের জাগরণ
চি’ইন বা চীন জাতি ৪০৩ থেকে ৩২৫ সালের মাঝে চীনে আধিপত্য স্থাপন করে। কয়েক দশক ধরে প্রতিবেশী, বর্বর ও নিজস্ব অভিজাতদের বিরুদ্ধে লড়ে চীনের উত্তরাঞ্চলের রাজত্ব জিন অবশেষে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। সিমা কিয়ান বলেন, ‘রাজা ওয়েই-লিয়েহর শাসনামলের ২৪তম বছরে (খ্রিস্টপূর্ব ৪০৩) হ্যান, ওয়েই ও চাও গোত্রপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পান।
জিন ভূখণ্ডের পুরো অংশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় হান, ওয়েই ও চাও পরিবার। তারা পূর্বের ঝৌ সম্রাটের কাছ থেকে সে অনুযায়ী স্বীকৃতি নিয়ে নিলেন
জিন রাজ্যের অস্তিত্ব ততদিনে বিলীন হয়ে গেছে। চতুর্থ শতাব্দীর চীনের মানচিত্রে দেখা যায়, ১৩ রাজ্য ৯ রাজ্যে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। ঝৌ ভূখণ্ড সবকিছুর কেন্দ্রে থাকলেও তাদের কার্যত তেমন কোনো ক্ষমতা ছিল না।
সব মিলিয়ে বিজয়ীর বেশে আবির্ভূত হয় চীন। এই রাজ্যের আকার চার গুণ বেড়ে যায়। একপর্যায়ে হুয়াংহো নদী থেকে একেবারে ইয়াংজি পর্যন্ত চীনের বিস্তার ঘটে।
এই ৯ রাজ্য একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখে। খ্রিস্টপূর্ব ৪০৩ থেকে ৩৬১ পর্যন্ত এই লড়াই চলে।
৬৭.১ যুদ্ধরত রাজ্যগুলো
সব মিলিয়ে ‘কি’ রাজ্য ছিল সবচেয়ে প্রগতিশীল। তবে ৩৬১ সালে এই পরিস্থিতি বদলে যায়। শাং ইয়াং নামে এক ব্যক্তি চিনের লর্ডের দরবারে এসে উপস্থিত হন। তিনি চীনকে একটি বৃহত্তর শক্তিতে উন্নীত করার প্রস্তাব দেন।
শাং ইয়াং-এর চিন্তাধারায় মুগ্ধ হলেন ডিউক হিয়াও। তিনি তাকে তার পছন্দমতো কাজ করার সুযোগ দিলেন। এই সুযোগে শাং ইয়াং নতুন কিছু আইন করলেন, যার মধ্যে ছিল রাজদ্রোহ ও কোন্দলের বিরুদ্ধে বড় আকারের শাস্তি। এমনকি, ব্যক্তিগত পর্যায়ের ঝগড়া-বিবাদও হয়ে পড়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব বিধি বাস্তবায়নের জন্য তিনি চীনকে ছোট ছোট বর্গক্ষেত্রে ভাগ করে নিলেন—প্রতিটি বর্গক্ষেত্রে অনধিক ১০টি পরিবার রইল। প্রত্যেক পরিবারকে বলা হল অন্যদের আইনভঙ্গের বিষয়টি সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে জানাতে
শাং হুয়াংয়ের জীবনী মতে, চীনের সব মানুষ এঁকে অপরের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলেন এবং তারা নিজেরাই নিজেদের শাস্তির কারণ হতে লাগল। এসব অঞ্চল থেকে পালানোর উপায় ছিল না, বা বাইরে থেকেও কেউ এখানে আসতে পারতেন না। সরাইখানার মালিকরা ‘অনুমতিপত্র’বিহীন কাউকে খাদ্য, পানি বা থাকার জায়গা দিতে পারতেন না।
অল্প সময়ের মধ্যে অনেক ধরনের সংস্কার করলেন শাং ইয়াং। তার আমলেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে জমির মালিকানা পাওয়ার সুযোগ পেলেন প্রাচীন চীনবাসীরা।
৩৪৪ সাল নাগাদ চি’ইন (চীন) বেশ শক্তিশালী হয়ে পড়ল। তখন ডিউক হিয়াও তার হেজেমনের ক্ষমতা ব্যবহার করে অন্যান্য গোত্রপ্রধানদের ডেকে পাঠালেন। ৩৪৩ সালে ডিউক হিয়াও লর্ড হলেন।
৩৪০ সাল নাগাদ চীনের সেনাবাহিনী বেশ শক্তিশালী হয়ে দাঁড়াল। তখন থেকে ভূখণ্ড বিস্তারে উদ্যোগ নিলেন শাং ইয়াং ও লর্ড হিয়াও।
শুরুতেই শাং ইয়াং ওয়েই রাজ্য দখল করে নিলেন। কিন্তু এটাই ছিল শাং ইয়াংয়ের শেষ বিজয়। ডিউক হিয়াও মারা গেলেন এবং তার ছেলে হুইওয়ে ক্ষমতা পেলেন। ২০ বছর আগে শাং ইয়াং-এর ইশারায় তরুণ ডিউক-পুত্রের সব শিক্ষকদের হত্যা ও বিকলাঙ্গ করা হয়েছিল। সেই রাগ এতদিন পুষে রেখেছিলেন তিনি। ক্ষমতা পেয়েই শাং ইয়াংকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিলেন তিনি।
তিনি ছদ্মবেশ ধারণ করে পালালেন। কিন্তু কোনো সরাইখানায় জায়গা পেলেন না তিনি।
আইন অনুযায়ী, তার কাছে কোনো অনুমতিপত্র ছিল না।
এভাবে নিজের তৈরি করা আইনের ফাঁদে নিজেই ধরা পড়লেন শাং ইয়াং। লুকানোর জায়গা না পেয়ে একপর্যায়ে হুইওয়েনের লোকদের হাতে ধরা পরলেন তিনি। তারা তাকে চীনের রাজধানীতে ফিরিয়ে নিল।
তার শেষ পরিণতি বেশ মর্মান্তিক ছিল। চারটি ঘোড়ায়-টানা রথের সঙ্গে তার দুই হাত ও দুই পা বেঁধে সেগুলোকে চারদিকে ছুটানো হল। ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে মারা পড়লেন সংস্কারবাদী শাং ইয়াং।
তবে শাং ইয়াং-এর বিরক্তিকর উপস্থিতি দূর হলেও, তার বানানো আইনগুলো থেকে গেল। যেহেতু এসব আইনের কারণেই চীন এত শক্তিশালী হতে পেরেছে, বুদ্ধিমান হুইওয়েন সেগুলোকে অবিকৃত রেখে দিলেন। ৩২৫ সালে তিনি নিজেকে রাজা হিসেবে ঘোষণা দিলেন
বাকি সব গোত্রপ্রধানরাও একই প্রতিক্রিয়া দেখাল। যুদ্ধরত রাজ্যগুলোতে যুদ্ধ থামল না, তবে আগের ডিউক বনাম ডিউক লড়াই রূপান্তরিত হল রাজাদের লড়াইয়ে।
এই গোলযোগের মাঝেও দার্শনিকরা তাদের দর্শনতত্ত্বের প্রচার থামাননি। কনফুসিয়াসের সবচেয়ে বিখ্যাত শিক্ষার্থী মেনসিয়াস বা মেংজি বিশেষ নজর দিয়েছিলেন শাসক ও শাসিতদের মাঝের সম্পর্কের ওপর।
এই বছরগুলোতে মেনসিয়াসের দর্শন থেকে বেশ ভিন্ন একধরনের নতুন দর্শনের প্রচলন দেখা যায়।
এই দর্শনের লিখিত রূপ হল তাও-তেহ-চিং বা তাও : দ্য ওয়ে। তাওবাদীরা বিশ্বাস করেন শান্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে ‘যা যেভাবে হচ্ছে, সেটাই মেনে নেওয়া’।
স্বভাবতই, প্রাচীন চীনের গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে, এই নিরন্তর যুদ্ধবিগ্রহের মাঝে তাওবাদকে অনেকেই আলিঙ্গন করে নেন।