1 of 2

৬৬. রোমে প্রথম লুটপাট

অধ্যায় ৬৬ – রোমে প্রথম লুটপাট

৪৯৫ থেকে ৩৯০ সালের মাঝে রোমে প্যাট্রিশিয়ান ও প্লেবিয়ানরা বিবাদে মেতে ওঠে এবং গলরা শহরটিকে পুড়িয়ে দেয়।

রোমের প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত একনায়কের দায়িত্ব ছিল হামলাকারীদের শহরের প্রাচীর থেকে দূর করা। তিনি তার কাজে সফল হয়েছিলেন। তবে তার এসব উদ্যোগে প্রকৃত শান্তি আসেনি। রোমের শহরতলিতে শান্তিও ছিল না, আবার যুদ্ধবিগ্রহও ছিল না। বরং উদীয়মান ও আগ্রাসী ক্ষমতার মাঝে চলছিল একধরনের দ্বন্দ্ব। আশেপাশের শহরগুলো নিশ্চিত ছিল না—রোমের বিরুদ্ধাচরণ করবে, না তাদেরকে উপেক্ষা করে নিজেদের মতো চলতে থাকবে।

এসকানরা গুরুতর কোনো উদ্বেগের কারণ না হলেও তারাও সিসিলির বিরুদ্ধে হামলার সময় অ্যাথেন্সের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল, এবং দুর্ভোগের শিকার হয়েছিল। রোমের নিজস্ব সমস্যা ছিল। লাইভি বলেন, ‘দেশটি নানা রাজনৈতিক মতামতে বিভাজিত ছিল।

রোম নিজেদের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরের দিকে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রচেষ্টা চালাতে যেয়ে পারস্য ও স্পার্টার মতো একই ধরনের সমস্যা পড়ল। মূল সমস্যাটি ছিল ক্ষমতাবান মূল জনগোষ্ঠীর (রোম) সঙ্গে দখলীকৃত, কম ক্ষমতাবান জনগোষ্ঠীর মেলবন্ধন সৃষ্টি এবং একটি সমন্বিত ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে তোলা।

স্পার্টায় দখলদারীদের নাম ছিল সিটিজেন আর দখলীকৃতদের বলা হত হেলোট। বিপরীতে রোমে ছিল প্যাট্রিশিয়ান (লাতিন শব্দ প্যাটার বা ‘ফাদার [পিতা] থেকে এসেছে), যারা রোমান উপদেষ্টা কাউন্সিল সদস্যদের বংশধর। তারা রাজার সেবায় নিয়োজিত ছিলেন।

বাকি সবাই ছিলেন প্লেবিয়ান। এই শব্দের প্রকৃত অর্থ বা তাদেরকে সংজ্ঞায়িত করা খুবই দুরূহ ছিল, কারণ এর শাব্দিক অর্থ ছিল “প্যাট্রিশিয়ান নয়”। প্লেবিয়ানদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন দুই ধরনের মানুষ। প্রথমত, যেসব শহর-অঞ্চলকে মূল রোমানরা পরাভূত করেছিলেন, তাদের অধিবাসীরা। আবার প্রাচীন রোমের দরিদ্ররাও এর অন্তর্ভুক্ত।

প্লেবিয়ানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকলেও প্যাট্রিশিয়ানদের হাতে ছিল অগাথ সম্পদ ও ভূমি। প্লেবিয়ানরা নিজেদের মধ্যে ভোটাভুটি করে নিয়মিত একজন নেতা বা কনসালের নিয়োগ দিতেন। কিন্তু রোমের ম্যাজিস্ট্রেট, সাধু-সন্ন্যাসী, জমিদার ও সেনাপতিদের প্রায় সবাই ছিলেন প্যাট্রিশিয়ান।

অ্যাথেন্সের মতো রোমেও ঋণের বোঝা বেশ গুরুতর সমস্যা ছিল। দেশে যখন দুর্ভিক্ষ চলত তখন তাদেরকে ধার করে চলতে হতো। আবার যখন তারা যুদ্ধে যেতেন, তখন তাদের পরিবারের খরচ চালানোর জন্যেও ঋণের দ্বারস্থ হতে হতো তাদেরকে। সেসময় আর কিছু না-থাকায় নিজেদেরকেই ‘বন্ধক’ রাখতে হতো। পরবর্তীতে সেই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সেই ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদস্যদের দাসত্ববরণ করতে হতো। এই প্রক্রিয়ায় প্যাট্রিশিয়ানরা শুধু ভূমি আর অর্থই পাচ্ছিলেন না, সঙ্গে রোমান নাগরিকদের ‘মালিকানাও’ পেয়ে যাচ্ছিলেন তারা, এবং এই হার দ্রুত বাড়ছিল। প্লেবিয়ানরা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেতেন একথা ভেবে যে, এই রোমকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে যুদ্ধে যেয়েও তাদেরকে এরকম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছিল।

৪৯৫ সালে তাদের দুঃখ-দুর্দশা বিক্ষোভে রূপ নেয়। সিনেটের সভা চলাকালীন হঠাৎ করে এক বৃদ্ধ বীরসেনা সেখানে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঢুকে পড়লেন। লাইভির বর্ণনায়, ‘তার সারা গা কাদামাটিতে মাখানো, ও তার পরনে ছিল নামমাত্র একটুকরো পোশাক। তার ভয়ানক ফ্যাকাশে এবং ক্ষীণ শরীর… তার এলোমেলো চুল আর দাড়ি… সে ছিল এক করুণ দৃশ্য।’

অনেকেই তাকে চিনতে পারলেন। তার বক্তব্য শোনার জন্য অনেক মানুষ সেখানে জমায়েত হতে লাগল। তিনি তার শার্ট ছিঁড়ে ফেলে সবাইকে দেখালেন—বুকে-পিঠে অসংখ্য তরবারির আঘাত। রোমের সেবা করতে যেয়ে তিনি এত ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। তার ধনী প্রভু তার পিঠে চাবুকের আঘাত করেন, সেটাও দেখালেন সবাইকে।

সেই বৃদ্ধ ব্যক্তি বললেন, ‘আমি যখন দেশের সেবা করছিলাম, যখন আমি স্যাবাইন যুদ্ধে অংশ নিলাম, তখন শত্রুর হামলায় আমার সব শস্য ধ্বংস হয়ে গেল। আমার কুঁড়েঘর পুড়িয়ে দেওয়া হল। আমার যা ছিল, সব কেড়ে নেওয়া হল। আমার গবাদি পশুগুলোও নিস্তার পেল না। তারপর, যখন আমি প্রায় সর্বস্বান্ত, তখন আমার কাছে কর চাওয়া হল, এবং সেই কর পরিশোধ করতে যেয়ে আমি দেনায় পড়লাম।’

তার এই মর্মান্তিক বর্ণনায় এ-ধরনের অসংখ্য ঋণ-দাস (যাদের অনেককে চেইন দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল) শহরের সড়কগুলোতে নেমে এলেন। তারা সিনেটের (সংসদ) কাছে দাবি জানালেন তাদেরকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে। সিনেটররা অবস্থা বেগতিক দেখে পালিয়ে রইলেন। তবে কনসালরা (প্লেবিয়ানদের জনপ্রতিনিধি) সিনেটরদের (প্যাট্রিশিয়ানদের প্রতিনিধি) খুঁজে বের করে আনলেন। সহিংসতা এড়াতে সিনেটে এই ঋণ-দাসদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হল। সিনেটে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা চলতে লাগল, আর সেই সময়টা দাসরা রেগে যেয়ে সিনেটের দরজা-জানালায় আঘাত করে তাদের অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করতে লাগলেন।

দৈবক্রমে এল এক সমাধান। খবর এল, প্রতিবেশী ভলস্কি গোত্র সেনা নিয়ে রোমে হামলা চালাতে আসছে। দক্ষিণের এই প্রতিবেশীর সহিংস উদ্যোগে সিনেটে তড়িঘড়ি করে আইন পাস হল—’যারা সেনাবাহিনীতে সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছে, তাদের কাউকে দাসত্ব বরণ করতে হবে না।’ একথা শুনে আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই এই যুদ্ধে যোগ দিল।

কিন্তু এটা কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান ছিল না।

রোমের প্লেবিয়ানদের একমাত্র সুবিধা ছিল তারা সংখ্যায় বেশি ছিলেন। ৪৯৪ সালে তারা পৃথিবীর লিপিবদ্ধ ইতিহাসের প্রথম ‘হরতাল’ বা ধর্মঘট পালন করেন। প্লেবিয়ানরা সব কাজকর্ম ফেলে শহর থেকে তিন মাইল দূরে একটি পবিত্র পর্বতের দিকে এগিয়ে গিয়ে সেখানে তাঁবু খাটিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে লাগল। এই ঘটনায় শহরের প্যাট্রিশিয়ান ও বাকি প্লেবিয়ানরা (যারা এই আন্দোলনে যোগ দেয়নি) আতঙ্কিত হল। কার্যত, দেশের পুরো কর্মীশ্রেণি তিরোহিত হয়েছিল। দৈনন্দিন কাজ থেমে গেল, শহরে প্রতিরক্ষার কোনো ব্যবস্থা রইল না।

অবশেষে সিনেট ও কনসালরা মিলে এক সমাধানের প্রস্তাব দিলেন। প্লেবিয়ানদেরকেও সরকারের অংশ করে নেওয়া হল। ট্রিবিউন নামে বিশেষ একধরনের ম্যাজিস্ট্রেটের পদ তৈরি করা হল, যারা সবসময় প্লেবিয়ানদের থেকে নির্বাচিত হবেন এবং প্রচলিত ‘আইনের ঊর্ধ্বে থাকবেন, অর্থাৎ সিনেট বা কনসালরা তাদের ওপর কোনো ধরনের চাপ দিতে পারবেন না। তখনো রোমে কোনো লিখিত আইনের প্রচলন হয়নি।

এই ট্রিবিউনদের কাজ হতো অন্যায়-অত্যাচার থেকে প্লেবিয়ানদের রক্ষা করা।

এটাই ছিল রোমের প্রথম আনুষ্ঠানিক কার্যালয়, যেখানে প্যাট্রিশিয়ানরা ব্রাত্য ছিলেন।

৪৯৪ সালে প্রথমবারে মতো দুইজন ট্রিবিউনের নিয়োগ দেওয়া হল। অবসান হল হরতালের। সাময়িকভাবে সংকট থেকে উত্তরণ হল।

পরবর্তী অর্ধশতকে কনসাল, সিনেটর, ধর্মীয় নেতা ও ট্রিবিউনদের মধ্যে রোমের ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব অব্যাহত রইল। প্লেবিয়ানদের স্বার্থরক্ষায় একটি লিখিত আইন খুব জরুরি হয়ে পড়ল।

ততদিনে রোম অনেক বড় শহরে পরিণত হয়েছে—লিখিত আইন তখন সময়ের দাবি। রোমান রাষ্ট্রদূতরা অ্যাথেন্স সফর থেকে ফিরে সোলোনের আইনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। অ্যাথেন্সের অ্যারিস্টোক্র্যাট আর ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে অস্বস্তি কমাতে এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল।

৪৫১ সালে ১০ জন আইনপ্রণেতার একটি বোর্ড গঠিত হল, যাদের নাম ছিল দেসেমভির। ৪৫০ সাল থেকে নিয়মিত রোমান কর্মকর্তাদের পরিবর্তে তারা কাজে লাগলেন। শুধু সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা নয়, তাদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল রোম শাসনের জন্য প্রয়োজনীয় আইনের প্রবর্তন করা। তবে তাদের এই নিয়োগ বিতর্কমুক্ত ছিল না। লাইভি জানান, এই দশজনের মধ্যে প্যাট্রিশিয়ান ছাড়া অন্য কাউকে স্থান দেওয়া হবে কি না, সেটা নিয়ে কিছুটা দ্বিমত দেখা দিয়েছিল। তবে তখনো রোমানরা প্লেবিয়ানদের সরকারি পদ দেওয়ার বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। দেসেমভিররা এক বছর ধরে আইন প্রণয়নে ব্যস্ত রইলেন, এরপর তারা সেগুলো জনসম্মুখে আলোচনার জন্য পেশ করলেন। তাদেরকে আরও কিছু আইন প্রণয়নের জন্য আরও এক বছর সময় দেওয়া হল।

এসব উদ্যোগ থেকে ‘১২টি টেবিলের’ উৎপত্তি হল, যেগুলোকে কাঠের উপর লিপিবদ্ধ করে ফোরামে বসানো হল, যাতে সবাই এগুলো দেখতে পায়। লাইভির মতে, আধুনিক রোমের আইনের মূল ভিত্তি হল এই ১২টি টেবিল। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই টেবিলগুলো হারিয়ে গেছে।

উল্লেখযোগ্য আইনের মধ্যে আছে টেবিল ৩। এখানে বলা হয়েছে, ঋণী ব্যক্তিরা ৩০ দিন সময় পাবেন তা পরিশোধ করতে। এরপর ঋণখেলাপীকে আদালতে নেওয়া যেতে পারে। যদি তার কোনো আয় বা গ্যারান্টি না থাকে, তাহলে তাকে কারাগারে আটক করা যেতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে অভিযোগকারীকে তার খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে (যা হয়তো ঋণের পরিমাণের চেয়ে বেশি)। টেবিল ১২ অনুযায়ী, কেউ যদি মিথ্যা দাবি করে, তাহলে তাকে ৩ জন বিচারকের সামনে আনা হবে এবং তারা যদি এ-বিষয়টির সত্যতা প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে বড় আকারে জরিমানা করা হবে। ৯ নং টেবিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এতে বলা হয়েছে ‘প্রিভিলেজিয়া নে ইররোগানাতো, অর্থাৎ, ‘কোনো ব্যক্তিগত আইন তৈরি করা যাবে না’। যার ফলে, প্যাট্রিশিয়ানরা চাইলেই তাদের খেয়ালখুশিমতো প্লেবিয়ানদের ওপর কোনো ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারতেন না।

এই সঙ্গে কাউকে আহত করা বা তার ক্ষতি করা প্রতিরোধে কিছু আইন তৈরি করা হয়, যেগুলো হাম্মুরাবির আইনের কথা মনে করিয়ে দেয়। যদি এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির হাড় ভেঙে দেন, তাহলে তাকে জরিমানা দিতে হয়। তবে দাসের ক্ষেত্রে এই জরিমানার পরিমাণ অর্ধেক। কোনো সন্তানকে তার পিতা যদি তিনবার দাস হিসেবে বিক্রি করে, তাহলে সেই সন্তান পিতাকে ‘ত্যাজ্য’ করতে পারে।

১২ নং টেবিলের আইন সঠিক পথের দিকে রোমকে নিয়ে গেলেও এর প্রচলনের পরেও অনেক অন্যায় ও অন্যায্য আচরণ অব্যাহত থাকে শহরটিতে। ৪ নং টেবিলে বলা হয়েছে, কোনো শিশু বিকলাঙ্গ হিসেবে জন্ম নিলে তাকে হত্যা করা হবে।

৫ নং টেবিলে বলা হল, নারীরা যেহেতু দুর্বল, তারা প্রাপ্তবয়স্ক হলেও তাদের দায়িত্ব নেবেন অভিভাবকরা।

৮ নং টেবিলে বলা হয়েছে ‘শহরে রাতের বেলায় কেউ বৈঠকের আয়োজন করতে পারবে না’। প্যাট্রিশিয়ানদের প্লেবিয়ান ছলচাতুরী থেকে বাঁচাতে এই আইন।

১১ নং টেবিলের বেশ কুখ্যাতি রয়েছে। এতে বলা হল, ‘প্যাট্রিশিয়ান ও প্লেবিয়ানের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ করা হল’। ৪৪৫ সালে সিনেটে এক উত্তপ্ত বিতর্কের পর এই আইনটি রদ করা হয়।

৬৬.১ গলদের আগ্ৰাসন

ট্রিবিউন ও টেবিলের মাধ্যমে রোমের অভ্যন্তরীণ কোন্দল পুরোপুরি নিরসন না হলেও এসব সংস্কারে অন্তত জাতি হিসেবে রোম সুসংহত হয়ে ওঠে এবং শাসকগোষ্ঠী সাম্রাজ্য বিস্তারের দিকে মন দিতে সক্ষম হয়। ৪৩৭ সালে রোম তাদের পুরনো শত্রু, তিবার নদীর ওপরের দিকে অবস্থিত ফিদেনাইদের বিরুদ্ধে লড়তে শুরু করে। সেই প্রাচীন আমলে, যখন রোমুলাস জীবিত ছিলেন, তখন ফিদেনাইর বিরুদ্ধে প্রথম হামলা চালানো হয়। এই লাতিন শহর ও এতরুসকান শহর ভেই, এই দুইটির বিরুদ্ধেই লড়েন রোমুলাস। কিন্তু একটি শহরও ধ্বংস করেননি তিনি। ফিদেনাইর সঙ্গে যুদ্ধ ৪২৬ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে।

পরবর্তী ২০ বছরে ছোট ছোট অনেকগুলো যুদ্ধ হয়। ৪০৫ সালে রোম ভেইর বিরুদ্ধে হামলা শুরু করে। ৫ বছরেও যুদ্ধের নিষ্পত্তি হল না। সেসময় খবর এল কেল্টরা দক্ষিণদিক থেকে এগিয়ে আসছে। তাদেরকে রোমানরা ‘গল’ হিসেবে চিনত।

কিন্তু রোমানরা এ বিষয়টিকে তেমন একটা পাত্তা দেয়নি। পরিশেষে ৩৯৬ সালে ভেইর পতন হল। এই যুদ্ধে উভয় পক্ষের অনেক ক্ষতি হল। ভেই ছিল এতরুসকান শহরের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ও সমৃদ্ধিশালী। এই যুদ্ধে রোম বেশ ভালোই দুর্বল হয়ে পড়ে। এবং শুধু এখানেই নয়, আরও বেশকিছু অঞ্চলে রোমান সেনারা আগ্রাসন চালাচ্ছিলেন সেসময়।

দীর্ঘ সময় ধরে ব্যস্ত থাকা রোমের সেনাবাহিনী যখন একদণ্ড বিশ্রাম নিচ্ছিল, তখন কেদিসিয়াস নামে এক প্লেবিয়ান ট্রিবিউনদের কাছে হুঁশিয়ারি নিয়ে এল। তিনি ‘রাতের নীরবতার মাঝে শুনেছেন’ এক অশরীরী কণ্ঠ বলছে, ‘সব ম্যাজিস্ট্রেটদের জানাও, গলরা আসছে’। তার এই হুঁশিয়ারিকে ‘হেসে উড়িয়ে দেওয়া হয়’, কারণ কেদিসিয়াস কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলেন না। রোম তখনও প্যাট্রিশিয়ান-নির্ভর সমাজ। সামান্য এক প্লেবিয়ানের বার্তাকে গুরুত্বসহকারে নেওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাননি তারা।

সমীহ-জাগানিয়া এতরুসকান রাজা লার্স পোরসেনার এককালের সামরিক ঘাঁটি, উত্তরের শহর ক্লুসিয়াম থেকে সেসময় আরেক বার্তা এল।

হাজারো কেল্ট (গল) হঠাৎ করেই শহরের তোরণে হাজির হয়েছিল। সবার হাতে ছিল অস্ত্র। কুসিয়ামের সঙ্গে রোমের কোনো আনুষ্ঠানিক মৈত্রী ছিল না। তবুও তারা সাহায্যের জন্য রোমের কাছেই বার্তা পাঠাল।

গলরা ছিল এমন এক পরাক্রমশালী শত্রু যে তাদের আগ্রাসনে সমগ্র উপদ্বীপের শহরগুলো সমন্বিত হয়। কিন্তু ৩০ বছরের যুদ্ধে রোমের বাহিনী ছিল ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত—চাইলেও সিনেট ক্লুসিয়ামের সহায়তায় কোনো সেনা পাঠাতে পারল না।

পরিবর্তে, রোম পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ নিরসনের আশায় কয়েকজন দূত পাঠাল গলদের কাছে। এটা খুবই সফল কৌশল হতে পারত। কিন্তু গলরা তাদের কথা শুনতে রাজি না-হওয়ায় আলোচনা চালিয়ে না যেয়ে বরং রাগ প্রকাশ করে বসলেন রোমান দূতরা। তারা অস্ত্র বের করে গলদের শাসাতে গেলে হিতে বিপরীত হল।

তারা তাদের স্বভাব অনুযায়ী, প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়ল এবং রোমের পথে রওনা হল। জোরে জোরে ‘রোমের দিকে এগিয়ে যাও! (টু রোম)’ বলে স্লোগান তুলতে লাগল গলের যোদ্ধারা।

রোমান কমান্ডাররা তড়িঘড়ি করে তিবার নদীর তীরে সেনাসমাবেশ করলেন। তবে সেনার সারি এতটাই হালকা ছিল যে গলরা থমকে দাঁড়াল। তারা ভাবল, সামনে হয়তো বড় কোনো ফাঁদ অপেক্ষা করছে। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারল, এটাই রোমের সেই ‘পরাক্রমশালী’ বাহিনী, তখন তারা এই অল্পসংখ্যক সেনার ওপর চড়াও হল এবং কচুকাটা হলেন রোমান বীররা। তাদের রক্তে রঞ্জিত হল তিবারের পানি।

আহত রোমান সেনারা তিবারে ডুবে মরতে লাগল—বর্মের ওজনে তারা পালাতেও পারল না। অর্ধেক সেনা ভেই শহরে পালিয়ে গেল, আর বাকিরা (যারা সংখ্যায় খুবই কম) রোমে ফিরতে পারল। এই অল্পসংখ্যক সেনা পুরো শহরের প্রতিরক্ষা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না। যার ফলে সমগ্র জনগোষ্ঠী নগরকেন্দ্র বা ক্যাপিটলে আশ্রয় নিল। বাকি শহর অরক্ষিত রইল।

গলরা বন্যার মতো শহরে ঢুকে পড়ল। যাকে সামনে পেল, তাকেই হত্যা করল এবং সব বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল হিংস্র গলরা। রোমানরা এই বর্বর শত্রুর নির্বিচার হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। তাদের সুপরিচিত সুন্দর শহরের রাস্তায় বর্বরদের চিৎকার, নারীর আর্তনাদ ও শিশুদের কান্নাকাটি, আগুনের লেলিহান শিখা, ভেঙে পড়া ইট-পাথর-সুরকি- এসবই তাদের কাছে ছিল নতুন দৃশ্য।

ক্যাপিটলের ভেতর থেকে নিরুপায় হয়ে এসব দেখা ছাড়া তাদের কিছু করার ছিল না। অপরদিকে, কেল্টিক যোদ্ধারাও নিচে থেকে তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছিল না। দীর্ঘসময় ধরে হামলা চালালে রোমবাসীরা না-খেয়ে মারা পড়তেন। কিন্তু গলরা জানত না রোমানদের কাছে কী পরিমাণ খাদ্য ও পানির মজুত রয়েছে। ক্যাপিটলের নিচে শহরের বাকি অংশে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি খারাপ দিকে মোড় নিতে শুরু করে। সেখানে খাবার ফুরিয়ে আসছিল আর খাওয়ার পানিও ছিল সীমিত।

একটি নিচু জায়গায় গলরা তাদের ঘাঁটি তৈরি করেছিল। সেখানে বাতাস কম ছিল। জ্বলন্ত রোমের আকাশে ধুলাবালি ও ছাইয়ের কারণে শ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ছিল। অল্প সময়ের মধ্যে কাশি ও ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত হতে লাগলেন গল যোদ্ধারা। অল্প জায়গায় অনেক সেনা অবস্থানের কারণে ছড়িয়ে পড়ল মহামারি। দশ-বিশ থেকে মৃতের সংখ্যা হাজারে ঠেকতে লাগল। একপর্যায়ে বহন করার সক্ষমতাকে ছাড়িয়ে গেল মরদেহের সংখ্যা। জীবিতরা মরদেহের বড়বড় স্তূপ তৈরি করে সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিল।

রোমানরা যখন তাদেরকে সন্ধির প্রস্তাব দিল, তারা খুশিমনেই তা মেনে নিল। রোমকে অপ্রত্যাশিতভাবে সহায়তা করতে এগিয়ে এল ইউরোপের দক্ষিণ উপকূলের প্রাচীন গ্রিক উপনিবেশ মাসালিয়ান। মাসালিয়ানরা গলদের যথেষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ দেওয়াতে তারা রোম ছেড়ে চলে গেল।

রোমানরা এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাল। গলরা আবার ফিরে আসতে পারে বা অন্য কোনো শত্রুর হামলা হতে পারে, এই আশঙ্কায় দ্রুত শহর পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ শুরু হল। সব কাজ তড়িঘড়ি করে আগাতে লাগল। ফলে পুরো বিষয়টিতে দেখা দিল পরিকল্পনাহীনতা।

এ কারণেই প্রাচীন আমলের অনেক শহরের তুলনায় রোম বেশ অগোছালোভাবে গড়ে উঠতে লাগল।

এভাবেই রোম প্রথমবারের মতো বর্বরদের হাতে লুটপাটের শিকার হল। এতে রোমের সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষে বাধা পড়ে এবং শহরবাসীর মনে স্থায়ী দাগ ফেলে দেয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *