1 of 2

৬৫. পেলোপোনেশীয় যুদ্ধ

অধ্যায় ৬৫ – পেলোপোনেশীয় যুদ্ধ

খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৮ থেকে ৪০৪ সালের মাঝে জারক্সিসের মৃত্যু হয়। অ্যাথেন্স ও স্পার্টা ৩০ বছরের শান্তির ঘোষণা দিলেও তা মাত্র ১৪ বছর স্থায়ী হয়।

নবগঠিত সমন্বিত গ্রিক সাম্রাজ্যে বড় সিদ্ধান্তের বিষয় হয়ে দাঁড়াল আইওনিয়ান শহরগুলোর ভাগ্যে কী আছে, তা নির্ধারণ করা।

যুদ্ধে হেরে গেলেও পারস্যের শক্তি নিঃশেষিত হয়নি। আইওনিয়ানদের ঠিক অপরপাশে, এশিয়ার বড় অংশজুড়ে তখনও পারস্যের উপস্থিতি ছিল।

অনেক তর্কবিতর্কের পর অ্যাথেন্স ও স্পার্টা একমত হল, আইওনিয়ার উপকূল থেকে পার্সিয়ানদের খেদাতে হবে। অনেকে তাদেরকে পার্সিয়ান বা পারসিকও বলে থাকেন।

যদিও স্পার্টা চেয়েছিল এসব অঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে, তবুও, হেলেনিক লিগের নেতৃত্ব ধরে রাখতে তারা এই অভিযানে অংশ নেয়। এতে নিশ্চিত হয় লিওনাইডাসের সেই ভাইপো ও প্লাশিয়া যুদ্ধের বিজেতা পাউসানিয়াসই এই জোটের সর্বাধিনায়ক পদে থাকছেন।

বাইজ্যানটিয়াম থেকে পারসিক সেনাদের বিদায় করতে পাউসানিয়াস তার নৌবহর নিয়ে রওনা হলেন।

অ্যাথেন্সের সেনারা তাদের নিজস্ব সেনাপতি জানথিপ্পাসের নেতৃত্বে আগাতে লাগলেন। তারা বসফরাসে পৌঁছে গেলেন। এই দুই পক্ষের সমন্বিত হামলায় ফল এল—বাইজ্যানটিয়াম আবারও গ্রিসের অংশ হল।

তবে সেবারই শেষবারের মতো অ্যাথেন্স ও স্পার্টা মিত্র হিসেবে যুদ্ধযাত্রা করে।

হেরোডোটাস এখানেই থেমে যান। মাইকালের যুদ্ধের পর তিনি আর কোনো ঘটনার বিবরণ লিখে যেতে পারেননি। এরপরের ঘটনা জানতে আমাদেরকে থুসিদিদেসের দ্বারস্থ হতে হবে, যিনি আরও ৭০ বছর পর থেকে ইতিহাস লেখা শুরু করেন। তার লেখা ‘লাইফ অব থেমিসতোক্লেস’ বই এ-বিষয়ে খানিকটা আলোকপাত করে।

বাইজ্যানটিয়ামে একযোগে হামলা চালালেও, নিজ দেশে অ্যাথেন্স ও স্পার্টার প্রতিনিধিরা ঝগড়া করছিলেন। প্লাশিয়ায় মারদোনিয়াসের পরাজয়ের পর থেমিসতোক্লিসের নেতৃত্বাধীন অ্যাথেনীয় সেনারা অ্যাথেন্সে ফিরে এল। কিন্তু শহরের আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। সব প্রাচীর ভেঙে দেওয়া হয়, অ্যাক্রোপোলিসের সব মন্দিরে লুটপাট করে সেগুলো আগুনে পোড়ানো হয় এবং অ্যাথেনার মন্দিরের পবিত্র জলপাই গাছটিকে কেটে ফেলে একে গোড়া থেকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

তবে অ্যাথেন্স তখনো জীবিত ছিল। ফিরে আসা অ্যাথেনীয়রা ধসে পড়া প্রাচীর ও অন্যান্য অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে নিয়োজিত হল।

এই খবর খুব শিগগির স্পার্টায় পৌঁছাল। কয়েকদিনের মধ্যেই স্পার্টা থেকে প্রতিনিধিদল অ্যাথেন্সে এসে দাবি করল, এই পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে এবং পেলোপোনেসাসের বাইরের শহরগুলোর বাকি প্রাচীরও ধ্বংস করে ফেলতে হবে।

পারস্যযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকেই গ্রিসের একক আধিপত্য দখলে নেওয়ার প্রচেষ্টায় ছিল স্পার্টা। এই দাবি তারই অংশ। তবে সে-মুহূর্তে স্পার্টার দাবি অগ্রাহ্য করার মতো অবস্থায় ছিল না। তাদের কোনো সুরক্ষাপ্রাচীর ছিল না, ছিল না অসংখ্য সেনা। তবে থেমিসতোক্লেস আবারও চাতুর্যের আশ্রয় নিলেন। তাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পার্টাকে কিছুই জানালেন না তিনি। বরং প্রস্তাব দিলেন, এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য অ্যাথেন্সের প্রতিনিধিদল নিয়ে তিনি স্পার্টায় আসবেন। তারপর তিনি স্পার্টার উদ্দেশে শামুকের গতিতে রওনা হলেন। মূলত তিনি সময় কিনে নিয়েছিলেন। তিনি অ্যাথেন্সের বাকি কর্মকর্তাদের বললেন রাতদিন কাজ করে হলেও অন্তত ছোট আকারের একটি প্রাচীর নির্মাণ করতে। তারপর সব অ্যাথেন্সবাসীকে বললেন যেখানে যে-ধরনের পাথর বা নির্মাণসামগ্রী পাওয়া যায়, তা নিয়ে কাজে লেগে পড়তে।

অপরদিকে থেমিসতোক্লেস স্পার্টায় বসে তার সহকর্মীদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। একপর্যায়ে প্রাচীরনির্মাণ শেষে তারা সেখানে এসে পৌঁছালেন। ফলে আত্মবিশ্বাসী থেমিসতোক্লেস স্পার্টার প্রতিনিধিদের বললেন, তারা তাদের নিজেদের কাজে স্পার্টার নাকগলানো একেবারেই বরদাশত করবেন না। গর্বভরে বললেন, অ্যাথেন্সের আবারও সুরক্ষাপ্রাচীর আছে। স্পার্টার জন্য ভালো হবে তাদেরকে না ঘাঁটানো।

অপরদিকে বাইজ্যানটিয়ামে আইওনিয়ানরা স্পার্টার অধীনে থাকতে চাইছিল না। তারা অ্যাথেন্সের কমান্ডার জানথিপাসের কাছে আসেন। তারা অভিযোগ করেন, স্পার্টার জেনারেল পাউসানিয়াস নিজেই একনায়কের মতো আচরণ করছেন। এবং তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ, তিনি গোপনে জারক্সিসের সঙ্গে দরকষাকষি চালাচ্ছিলেন। এ-ধরনের অভিযোগকে চাইলেও উপেক্ষা করা যায় না। যখন স্পার্টার অ্যাসেম্বলি এ ঘটনার আভাস পেল, তখন তারা পাউসানিয়াসকে বিচারের সম্মুখীন হওয়ার জন্য ডেকে পাঠাল। তার জায়গায় জানথিপাস সর্বময় নেতৃত্ব পেলেন। এটি ছিল অ্যাথেন্সের জন্য ইতিবাচক একটি বিষয়

স্পার্টায় পাউসানিয়াসকে দায়মুক্তি দেওয়া হল। কিন্তু ততদিনে তার কেরিয়ার ধ্বংস হয়ে গেছে। এক কেলেঙ্কারিতেই বিষয়টি এরকম হয়ে পড়ল। স্পার্টানরা তার পরিবর্তে নতুন এক কমান্ডারকে বাইজ্যানটিয়ামে পাঠালেও তার কর্তৃত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করল অ্যাথেন্সবাসী। অর্থাৎ, মিত্রবাহিনীর নেতৃত্বে থেকে গেল অ্যাথেন্স। এসব ঘটনায় শঙ্কিত হয়ে স্পার্টার প্রতিনিধিরা সেখান থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ি ফিরে গেল।

এটাই ছিল পুরনো হেলেনিক লিগে কফিনে শেষ পেরেক। অ্যাথেন্স নতুন এক জোট গঠনের ঘোষণা দিল। এর নাম ছিল দেলিয়ান লিগ, যার নেতৃত্বে রইল অ্যাথেন্স। অপরদিকে, স্পার্টা পেলোপোনেসীয় লিগের নেতৃত্ব গ্রহণের ঘোষণা দিল, যেখানে শুধু পেলোপোনেসিয়ার শহরগুলোই ছিল।

পাউসানিয়াস বুঝতে পারলেন, তাকে আবারও গ্রেপ্তার করা হবে এবং তাকে বিচারের আওতায় আনা হবে। তিনি স্পার্টার এক মন্দিরে আশ্রয় নিলেন। তবে খুব সহজেই তাকে খুঁজে পেল স্পার্টার কর্মকর্তারা। সেই মন্দিরেই তাকে চারদিক দিয়ে দেয়াল তুলে ঘিরে রাখা হল, আর মাথার ওপর থেকে ছাদ সরিয়ে ফেলা হল। এভাবেই অনাহারে, কষ্ট পেয়ে মারা গেলেন বীর যোদ্ধা পাউসানিয়াস। তিনি যাদেরকে বাঁচাতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন, তারা চেয়ে চেয়ে দেখল তার অন্তিম যাত্ৰা।

৬৫.১ গ্রিস ও পেলোপোনেসীয় যুদ্ধ

এখানেই বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়নি। অ্যাথেন্সে থেমিসতোক্লিস তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করেন। তিনি ছিলেন একজন প্র্যাগম্যাটিস্ট—সবসময় আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে হলেও নিজের স্বার্থের জন্য কাজ করতেন তিনি। যখন তার বিরুদ্ধে সমালোচনার তির ধেয়ে এল, তিনি বড় গলায় বলতে লাগলেন যে সমগ্র অ্যাথেন্সবাসীর তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত এবং তিনি যা বলবেন বা চাইবেন, তাদের সে অনুযায়ী কাজ করা উচিত।

একপর্যায়ে অ্যাথেন্সের মানুষ বিরক্ত হয়ে তাকে একঘরে করে দিল।

এভাবে গ্রিক সমাজে মহান ব্যক্তিত্বরা বেশি আত্মম্ভরি হয়ে উঠলে তাদেরকে একঘরে করে একধরনের শাস্তি দেওয়া হত। এটা ছিল গণতন্ত্রের ‘অন্ধকার দিক’। ম্যারাথন মিলতিয়াদেসকে বাঁচাতে পারেনি, পাউসানিয়াসের জন্য প্লাশিয়া কোনো উপকারে আসেনি, কিংবা সালামিসের চাতুর্যও থেমিসতোক্লেসের জন্য কোনো বাড়তি সুবিধা আনেনি।

তাকে একঘরে করার বিষয়টি স্পার্টার কানে পৌঁছালে তারাও সুযোগ বুঝে দাবি করে বসল, তাদের নিজস্ব তদন্তে জানা গেছে পাউসানিয়াসের বিরুদ্ধে যেমন অভিযোগ পাওয়া গেছে, তেমনি থেমিসতোক্লেসের বিরুদ্ধেও পারস্যের সঙ্গে গোপন বন্ধুত্বের প্রমাণ আছে তাদের হাতে। থেমিসতোক্লেসকে হত্যার জন্য আততায়ী পাঠানো হল। কিন্তু তিনি অনেক ঘুরপথ ধরে পারস্যে পালিয়ে গেলেন। অভিযোগকে সত্য প্রমাণ করে জারক্সিসের ‘গ্রিস বিষয়ক’ উপদেষ্টা হওয়ার প্রস্তাব দিলেন তিনি।

থেমিসতোক্লেসের এই দুঃসাহসিক প্রস্তাবে আমোদিত হলেন জারক্সিস- তাকে নিয়োগ দিলেন নিজের সভাসদ হিসেবে। তবে মজার বিষয় হল, থেমিসতোক্লেসের কাছ থেকে পারস্য তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য বা কৌশল জানতেই পারেনি। তিনি বরং পার্সিয়ানদের গ্রিসের পোশাক, সাহিত্য ও খাবার নিয়ে অনেক তথ্য দিলেন। এই নির্বাসিত অবস্থাতেই এই চতুর জেনারেলের মৃত্যু হয়। কথিত আছে, ৬৫ বছর বয়সে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর আর সইতে না পেরে বিষ খেয়ে নিজের জীবনাবসান ঘটান থেমিসতোক্লেস।

ইতোমধ্যে, অ্যাথেন্সের অধিনায়কদের নেতৃত্বে দেলিয়ান লিগের সেনারা পারস্যের কাছ থেকে বেশ কয়েকটি দ্বীপের দখল ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় আগালেন। পারস্যবাসীরা পাল্টা হামলা চালালেও সেটা তেমন তীব্র ছিল না।

ততদিনে পারস্য রাজত্বেও অভ্যন্তরীণ ফাটল দেখা দিয়েছে।

জারক্সিস আর আগের সেই দৌর্দণ্ডপ্রতাপশালী রাজা ছিলেন না। সারদিসের যুদ্ধে পরাজয় তিনি কখনোই মেনে নিতে পারেননি। যুদ্ধ, প্রতিরক্ষা বা সাম্রাজ্যবিস্তারে মন না দিয়ে তিনি মেতে উঠলেন যৌনতা ও অজাচারে। একাধিক সূত্রে জানা যায়, তিনি সুসায় তার নিজ রাজপ্রাসাদে এক সহবাস-উৎসবের আয়োজন করেছিলেন, যেখানে তিনি ও তার বন্ধুরা এক সপ্তাহ ধরে অবাধ যৌনতায় মেতে ছিলেন। উৎসব শেষে মদ্যপ জারক্সিস তার সবচেয়ে সুন্দরী ও প্রিয় স্ত্রীকে খবর পাঠিয়ে বললেন নগ্ন হয়ে তার বন্ধুদের সামনে উপস্থিত হয়ে তাদের মনোরঞ্জন করতে। স্বভাবতই, তার স্ত্রী এতে রাজি হলেন না। এতে ক্ষুধ হয়ে তিনি জানালেন, আর কখনোই স্ত্রীর সামনে যাবেন না। তিনি তার অধীনস্থ সব সাতরাপি থেকে সুন্দরী রমণী পাঠানোর নির্দেশ দিলেন—তাদের মধ্যে থেকে নিজের নতুন স্ত্রী বেছে নেবেন।

কিন্তু চোখের দেখায় থামলেন না তিনি—এই প্রগল্ভ রাজা কোনো সুন্দরীকেই ছাড় দিলেন না। সবাইকে পালাক্রমে তার বিছানার সঙ্গী হতে হল। কয়েক মাস ধরে চলল এই ধারা। হেরোডোটাসও জারক্সিসের যৌনতৃষ্ণা নিয়ে লিখেছেন। তার মতে, জারক্সিসের লালসা এড়াতে পারেননি তার নিজের ভাইয়ের স্ত্রী এবং সেই স্ত্রীর কন্যাসন্তানও।

অবশেষে একদিন জারক্সিসের শয়নকক্ষে এক সেনাপতি তার সেনাদের নিয়ে ঢুকে পড়লেন। বছরটি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৫ সাল। কয়েক মিনিটের মাঝে নিহত হলেন জারক্সিস। সেই সেনাপতির নাম ছিল আরতাবানোস।

কিন্তু এই ঘটনা ছিল একধরনের চক্রান্ত। যখন জারক্সিসের মরদেহ আবিষ্কৃত হল, আরতাবানোস নিহত রাজার বড়ছেলে দারিয়াসকে দায় দিলেন এবং তার ছোটছেলে আরতাজারক্সিসকে বললেন পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে। অনেক গোলযোগের পর দারিয়াসকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল।

এরপরের ঘটনাগুলো বেশ দ্রুত ঘটে যায়। দারিয়াসের অবর্তমানে আরতাজারক্সিসের কাছে সিংহাসন যাবে—এমনটাই ভাবলেন সবাই। তার মেজোভাই হিসতাপসেস তখন উত্তরের সাতরাপ বাত্রিয়ায় ছিলেন। তবে আরতাবানোস যখন টের পেলেন তার সামনে শুধু তরুণ আরতাজারক্সিস, তখন তিনি তার ওপর হামলা চালালেন। তবে তরুণ রাজপুত্র রুখে দাঁড়ালেন এবং আহত হলেও একপর্যায়ে বিশ্বাসঘাতক সেনাপতিকে হত্যা করলেন। ইতোমধ্যে বাষ্ট্রিয়ায় খবর পৌঁছাল। শুনে সিংহাসনের দাবি জানাতে ছুটে এলেন মেজোভাই হিসতাপসেস। এক বালিঝড়ের মাঝে দুই ভাই লড়লেন। আরতাজারক্সিস মেজোভাইকে হত্যা করতে সমর্থ হলেন।

স্বভাবতই, রাজপ্রাসাদে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব পুরো সাম্রাজ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিল। সবচেয়ে গুরুতর পরিস্থিতি দেখা দিল মিশরে, যেখানে জারক্সিসের মৃত্যুতে তৃতীয় সাম্মেতিকাসের এক জীবিত সন্তান ইনারোস (মধ্যবয়সি এই রাজপুত্র হেলিওপোলিসে বসবাস করছিলেন) তার উত্তরাধিকারের দাবি নিয়ে এগিয়ে এলেন। অ্যাথেন্সবাসী খুশি হয়ে তাকে মদদ দিতে সমর্থ হল।

এই সম্মিলিত গেরিলাবাহিনীকে পরাজিত করতে আরতাজারক্সিসের ১১ বছর সময় লেগেছিল।

ইনারোসকে আটক করার পর তাকে মৃত্যুদণ্ড দিলেন আরতাজারক্সিস।

গ্রিসেও গোলযোগ অব্যাহত ছিল। ৪৬০ সালে নাক্সোস জানাল, তারা আর দেলিয়ান লিগে থাকতে চায় না। এরপর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করল অ্যাথেন্স।

থুসিদিদেস জানান, ‘এটাই ছিল মিত্রদের মধ্যে প্রথম লড়াইর ঘটনা।’ তবে এটাই শেষ ছিল না।

দেলিয়ান লিগের অন্যান্য শহরগুলো অ্যাথেন্সের স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল এবং অ্যাথেন্স কঠোর হাতে বিষয়টির মোকাবিলা করল। থ্রেসে ঢুকে পড়ল অ্যাথেন্স। এইজিনা শহরের বিরুদ্ধে লড়ে ৭০টি জাহাজ দখল করল অ্যাথেন্স। এরপর পেলোপোনেশিয়ান লিগের সদস্য মেগারা যখন অপর সদস্য শহর কোরিন্থের বিরুদ্ধে সীমান্ত-বিরোধের অভিযোগ করল, তখন অ্যাথেন্স তাদেরকে সাদরে দেলিয়ান লিগের অন্তর্ভুক্ত করল। তারা মেগারাকে নতুন সুরক্ষাপ্রাচীর তৈরিতে সাহায্য করল এবং তাদের শহরে অ্যাথেনীয় বাহিনী মোতায়েন করল।

সব মিলিয়ে, স্পার্টার জায়গায় চলে গেল অ্যাথেন্স। এইজিয়ান অঞ্চলে ‘দাদাগিরি’ শুরু করল অ্যাথেন্স। দেলিয়ান লিগ নাম হলেও আদতে তা ‘অ্যাথেন্স লিগে’ পরিণত হল। সুন্দর শহরগুলো ধীরে ধীরে প্রাচীরঘেরা দুর্গে পরিণত হতে লাগল। জানথিপাসের ছেলে পেরিক্লেস সামরিক কমান্ড নিলেন, এবং প্রস্তাব দিলেন প্রায় আট মাইল অঞ্চলজুড়ে, অ্যাথেন্স থেকে শুরু করে পিরেয়াস বন্দর পর্যন্ত প্রাচীর নির্মাণ করা হোক। এই প্রাচীর নির্মিত হলে মালামাল ও সেনাদের কোনো ধরনের হামলার ভয় ছাড়াই সমুদ্রের কাছে নিয়ে যাওয়া যাবে। শিগগির এই প্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু হল।

এই প্রাচীর নির্মাণ শেষ হল ৪৫৭ সালে। সে-বছরই স্পার্টার সঙ্গে অ্যাথেন্সের সংঘাত শুরু হল। স্পার্টা-বাহিনী পদযাত্রা করে আত্তিকার উত্তর- পশ্চিমে অবস্থিত বোয়েশিয়া অঞ্চলে এসে হাজির হল। তারা দাবি করল, তাদেরকে আরও উত্তর-পশ্চিমের দোরিস অঞ্চলের মানুষ আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তাদের এই পদক্ষেপের পেছনে অ্যাথেন্সের একটি মহলের মদদ ছিল, যারা গণতন্ত্র ও এই সুবিশাল প্রাচীর, উভয়ের ধ্বংস চেয়েছিল।

অ্যাথেনীয়রা ১৪ হাজার সেনা নিয়ে বোয়েশিয়ায় উপস্থিত হল। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জয়ী হল স্পার্টা। তবে দুই মাস পর আবারও এ অঞ্চলের দখল নেয় অ্যাথেন্স।

দুইপক্ষের শক্তিমত্তা কাছাকাছি পর্যায়ের ছিল। পারস্যের সঙ্গে ব্যর্থ যুদ্ধে অ্যাথেন্স তার শক্তিমত্তা অনেকাংশে হারিয়ে ফেলে।

৪৪৬ সালে সন্ধিচুক্তির প্রস্তাব দেয় অ্যাথেন্স। এই চুক্তির নাম ছিল ‘৩০ বছরের চুক্তি’। ইতিহাসবিদদের মতে, অ্যাথেন্স চেয়েছিল ইস্থমাস অব করিন্থ-এর অধিকৃত কিছু ভূখণ্ড ছেড়ে দিয়ে হলেও স্পার্টার সঙ্গে শান্তি বজায় রাখতে। তবে এই চুক্তি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।

এই ঘটনার অল্প সময় পর ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস অ্যাথেন্স ছেড়ে চলে যান। তিনি নতুন এক প্যান-হেলেনিক উপনিবেশে চলে যান। অ্যাথেন্সের রাজনৈতিক কোন্দল তার কাছে অস্বাস্থ্যকর মনে হচ্ছিল। থুরি নামে নতুন এই উপনিবেশে গ্রিসের সব এলাকা থেকে অনেক মানুষের আগমন ঘটে।

তবে এতকিছু সত্ত্বেও অ্যাথেন্সের উন্নয়নের চাকা থেমে থাকেনি। পেরিসে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য সুনাম অর্জন করলেন। তিনি অ্যাক্রোপোলিসের চূড়ায় অ্যাথেনার নতুন এক মন্দির তৈরির কাজ তদারকি করলেন। পারথেনন নামের এই মন্দিরে অনেক সাজসজ্জার ব্যবস্থা করা হল। দেবতা জিউসের একটি উপবিষ্ট মূর্তি নির্মাণ করা হল, যার উচ্চতা ছিল ৪০ ফুট।

হাতের দাঁত দিয়ে নির্মিত মূর্তিটি অলিম্পিয়ার মন্দিরে রাখা হল।

এখানে দার্শনিক সক্রেটিস বক্তৃতা দিয়ে ও অনুসারীদের দীক্ষা দিয়ে লম্বা সময় পার করেছেন। বুদ্ধের মতো, তিনিও একধরনের দর্শনের প্রচার করতে লাগলেন, যার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। কিন্তু তিনি তার দীক্ষার একটি লাইনও লিপিবদ্ধ করেননি; পরবর্তীতে তার শিক্ষার্থীরা এই দায়িত্ব নেয়।

তৃতীয়বারের শান্তিচুক্তি ১৪ বছর স্থায়ী হল; আবারও স্পার্টা-অ্যাথেন্সের তিক্ততা প্রকাশ পেল।

৪৩৩ সালে স্পার্টার মিত্র শহর কোরিন্থ-এর সঙ্গে অ্যাথেন্স যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। করিন্থীয় শাসন থেকে কোরসাইরা নামে একটি শহর আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এ কাজের জন্য তারা অ্যাথেন্সের সহায়তা চায়।

মজার বিষয় হল, কোরসাইরা পেলোপোনেশিয়ান বা দেলিয়ান লিগের সদস্য ছিল না, যার ফলে কোনো ধরনের চুক্তি বা শান্তিভঙ্গ ছাড়াই অ্যাথেন্স তাদের সহায়তা করতে পারত। অন্তত, কাগজে-কলমে। কিন্তু কোরিন্থ ছিল স্পার্টার মিত্র। ফলে কোরিন্থ-এর বিরুদ্ধে অ্যাথেন্সের যুদ্ধে বিরক্ত হল স্পার্টা।

দুই দিনের বিতর্কের পর অ্যাথেন্সের অ্যাসেম্বলি কোরসাইরার সাহায্যে ১০টি জাহাজ পাঠাতে রাজি হল। এই ১০ জাহাজের ক্যাপ্টেনকে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হল, কোরিন্থ যতক্ষণ-না কোরসাইরার নিজস্ব জাহাজে হামলা চালাচ্ছে, ততক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে হবে।

করিন্থীয় জাহাজগুলো এসে সরাসরি কোরসাইরার নৌবহরে হামলা চালাল। অ্যাথেন্সের ক্যাপ্টেন নির্দেশ মেনে অপেক্ষা করতে লাগলেন। থুসিদিদেসের ভাষায়, তারা কোরসাইরার জনগণকে কসাইর মতো হত্যা করতে লাগল—তাদের কাউকে বন্দি করার তেমন অভিপ্রায় ছিল না। এই পর্যায়ে যুদ্ধে যোগ দিলেন সেই অ্যাথেনীয় ক্যাপ্টেন, এবং আরও জাহাজ পাঠানোর জন্য নিজ দেশে খবর পাঠালেন।

অর্থাৎ, অ্যাথেন্স, করিন্থ-এর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল, যা প্রকারান্তরে স্পার্টার সঙ্গে যুদ্ধের শামিল। ৩০ বছরের চুক্তির অবসান হল।

সাবোতার যুদ্ধ নামে পরিচিত এই যুদ্ধের মতো আরও বেশ কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধ হল পরবর্তী দেড় বছরে। পরিশেষে স্পার্টার মিত্র থেবেস শহর প্লাশিয়ায় হামলা চালাল। বোয়েশিয়ার এই জায়গাতেই পারস্যের সঙ্গে সেই বিখ্যাত যুদ্ধ হয়েছিল। এই জায়গা তখন অ্যাথেন্সের সুরক্ষা পাচ্ছিল।

এই উদ্যোগে ভঙ্গুর হতে থাকা শান্তিচুক্তি পুরোপুরি ভেস্তে যায় এবং অ্যাথেন্স যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। সঙ্গে স্পার্টা ও তার মিত্ররাও।

অ্যাথেন্স তাদের সেনাবাহিনীকে ইস্থমাসের সামনে মোতায়েন করল; আত্তিকায় পদযাত্রা করতে প্রস্তুত হল তারা। এর আগে, তারা তড়িঘড়ি করে মেসিডোনিয়ার সঙ্গে মৈত্রী তৈরি করে। মেসিডোনিয়ার রাজা ছিলেন অ্যামিনতাসের নাতি আর তার নাম ছিল দ্বিতীয় পেরদিক্কাস। পেরিক্লেস আত্তিকার লোকজনকে বললেন অ্যাথেন্সের প্রাচীরের ভেতরে এসে নিজেদের সুরক্ষা দিতে। তিনি তাদেরকে অ্যাথেন্সের সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে বললেন—তিনি তাদেরকে ‘অ্যাথেনীয় ধর্মে’ দীক্ষা দিলেন।

পেলোপোনেশীয় যুদ্ধের প্রথম দুই বছরে যারা মারা গেলেন, তাদের অনেকেই সম্মানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেননি। ৪৩০ সালে প্লেগে আক্রান্ত হল অ্যাথেন্স। থুসিদিদেস কোনোমতে পৈতৃক প্রাণ নিয়ে বেঁচে সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির বর্ণনা দেন।

তিনি বর্ণনা দিলেন, ‘সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষগুলোর মাথা অনেক গরম হয়ে গেল এবং তাদের চোখগুলো লাল হয়ে জ্বলতে লাগল। সাত থেকে আট দিনের মাথায় তাদের মৃত্যু হল।’

পরবর্তী কয়েক বছর প্লেগ আর যুদ্ধে একের পর এক প্রাণ হারাতে লাগলেন গ্রিকরা। অপরদিকে, ৪২৪ সালে পারস্যের রাজা আরতাজারক্সিস বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেলেন। তার শাসনামল খুব একটা ঘটনাবহুল ছিল না বললেই চলে। একই দিনে তার স্ত্রীও মারা গেলেন। বিষয়টা সন্দেহজনক মনে হলেও এ বিষয়ে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তাদের সন্তান দ্বিতীয় জারক্সিস মাত্র ৪৫ দিন রাজত্ব করতে পেরেছিলেন। কথিত আছে, একদিন রাতে চরম পরিমাণে মদ্যপ অবস্থায় ঘুমাতে গেলেন নতুন এই রাজা। সেই সুযোগে তার পিতার এক অবৈধ সন্তান ও তার সৎভাই এসে তাকে হত্যা করেন এবং নিজেকে রাজা হিসেবে দাবি করেন। এই সৎভাই ছিলেন হিংস্র, বদরাগী ও অজনপ্রিয়

তার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন প্রয়াত রাজার অপর এক অবৈধ সন্তান। এই দুই অবৈধর লড়াইয়ে জিতলেন অকাস, যিনি তার অপর ভাইয়ের মতো রাগী ছিলেন না। অকাসের ছিল প্রশাসনিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা। তিনি বেশ কিছুদিন এক সাতরাপের প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। উৎখাতকারীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তিনি নিজের জন্য এক রাজকীয় নাম নির্ধারণ করেন। দ্বিতীয় দারিউস হিসেবে সিংহাসনে বসলেন পারস্যের নতুন এই রাজা। বছরটি ছিল ৪২৪। একই বছরে : তার পিতা ও সৎভাই নিহত হয়েছিল। একই বছরে পারস্যে তিন রাজা আসলেন।

খ্রিস্টপূর্ব ৪২১ সালে এসেও অ্যাথেন্স ও স্পার্টা নিজেদেরকে একই অবস্থানে আবিষ্কার করলেন। ৩০ বছরের চুক্তি লঙ্ঘনের পর থেকে দুই পক্ষ ক্রমাগত সেনা ও জনবল হারাচ্ছিল। নিয়মিত প্লেগে আক্রান্ত হচ্ছিলেন তারা এবং চাষবাসের দিকেও ততটা মনোযোগ দিতে পারেননি তারা। কারও দৃষ্টিসীমায় সুনিশ্চিত বিজয় ছিল না। তাই আবারও তারা বাধ্য হয়েই সন্ধি করলেন। এবারের চুক্তির নাম ‘পিস অব নিসিয়াস’। অ্যাথেন্সের তৎকালীন নেতা নিসিয়াসের নামেই এই চুক্তি হল, যিনি এতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।

এবার ছয় বছর টিকেছিল শান্তি। তবে অ্যাথেন্সের আলসিবিয়াদেস চাইতেন না খুব বেশিদিন শান্তি বজায় থাকুক; তিনি চাইতেন সুখ্যাতি।

অ্যাথেন্সের জন্য তখন জরুরি ছিল স্পার্টার কথা ভুলে যেয়ে নতুন করে শক্তিমত্তা অর্জন করা। কিন্তু আলসিবিয়াদেস জানতেন যে এই কাজে দেশের উপকার হলেও তার নিজের কোনো উপকার হবে না। তিনি বীর সাজার চেষ্টা চালালেন।

আবারো সেই একই ঘটনা। সিসিলিতে অবস্থিত গ্রিক উপনিবেশ এগেস্তা থেকে এল সাহায্যের দাবি। সিসিলির অপর দুই গ্রিক শহর সেলিনাস ও সিরাকিউসের বিরুদ্ধে অ্যাথেন্সের নৌবাহিনীর সহায়তা চাইল এগেস্তা। মজার বিষয় হল, সিরাকিউস ছিল করিন্থের উপনিবেশ। স্বায়ত্তশাসিত শহর হলেও তারা করিন্থের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেনি। আর আমরা এতক্ষণে জেনে গেছি, করিন্থ যে স্পার্টার মিত্র।

আবারও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হল।

৬৫.২ সিসিলির যুদ্ধ

এক উদ্ভট ও অর্থহীন যুদ্ধ লড়তে রওনা হলেন অ্যাথেন্সের ২৫ হাজার সেনা, প্রায় ১৩০টিরও বেশি ট্রাইরেম জাহাজ ও সমসংখ্যক রসদভর্তি নৌকা। তবে যাত্রার ঠিক আগে বেশকিছু পবিত্র ছবিকে কে বা কারা বিকৃত করে। অ্যাথেন্সবাসী এ বিষয়টিকে মন্দভাগ্যের লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করে এই যাত্রা বন্ধের চেষ্টা চালায়। কিন্তু এই প্রয়াস ধোপে টেকেনি।

আলসিবিয়াদেস ও নিসিয়াস ছিলেন নেতৃত্বে। তাদের সঙ্গে অপর এক অভিজ্ঞ জেনারেলও ছিলেন। তিন নেতা শুরু থেকেই রণকৌশল নিয়ে ঝগড়ায় মেতে ওঠেন। তারপর তারা অ্যাথেন্স থেকে বার্তা পেলেন—আলসিবিয়াদেসের বিরুদ্ধে ‘পবিত্র ছবি’ বিকৃত করার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ এসেছে। অ্যাথেন্সবাসী তাকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রত্যাহার করে বিচারের মুখোমুখি হতে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এল।

অবস্থা বেগতিক দেখে আলসিবিয়াদেস একটি জাহাজ চুরি করে স্পার্টায় চলে গেলেন। খ্যাতির নেশায় পাগল হয়ে তিনি স্পার্টার পক্ষে যোগ দিলেন। তিনি আশ্বাস দিলেন, অ্যাথেন্সের সঙ্গে স্পার্টার সব ঝামেলা ‘মিটিয়ে দেবেন’।

সিসিলির তীরে নিসিয়াস আরও খানিকক্ষন অপেক্ষা করলেন। ততক্ষণে মিত্রদের কাছ থেকে বাড়তি সেনা পেয়ে যায় সিরাকিউস। জয় সম্ভব নয় বুঝতে পেরে তিনি অ্যাথেন্সে খবর পাঠিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার অনুমতি চাইলেন।

কিন্তু সে কথায় কান না দিয়ে নিসিয়াসের হাতে যত সেনা ছিল, ঠিক ততজন বাড়তি সেনা পাঠিয়ে দেওয়া হল তার কাছে।

নিসিয়াস ভাবলেন গোটা সেনাদলকেই নিয়েই ভেগে যাবেন। কিন্তু তার এই পরিকল্পনা টের পেয়ে পালানোর সব রাস্তা বন্ধ করে দিল সিরাকিউস। বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করলেন নিসিয়াস এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাকে হত্যা করা হল। অ্যাথেন্সের বন্দি সেনাদের পাথরের খনিতে কাজ করতে পাঠানো হল। সেখানে তারা তীব্র তাপ ও ময়লার মাঝে দুর্ভোগ পোহাতে পোহাতে মারা গেল।

যারা বেঁচে গেলেন, তারা দেশে ফিরে দেখলেন ইতোমধ্যে আলসিবিয়াদেসের সহায়তায় স্পার্টা আত্তিকায় হামলা চালিয়েছে।

কিন্তু আট বছর চেষ্টা চালিয়েও অ্যাথেন্সকে নতজানু করতে পারল না স্পার্টা। ততদিনে গ্রিসের বেশিরভাগ মানুষ স্পার্টানদের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে ক্লান্ত।

এই পর্যায়ে দৃশ্যপটে আবারও পার্সিয়ানদের আবির্ভাব হল।

এবং আর কেউ নয়, আমাদের অতিপরিচিত আলসিবিয়াদেস তাদেরকে নিয়ে আসলেন। বিশেষ কারণে স্পার্টা থেকে ‘লাথি খেয়েছিলেন’ আলসিবিয়াদেস। সেখানকার রাজা আগিসের অবর্তমানে তার স্ত্রীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়ান তিনি। তিনি বা আগিসের স্ত্রী, কেউই বিষয়টি লুকনোর চেষ্টা করেনি। এমনকি, একপর্যায়ে রাজার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বাও হয়ে পড়েন। আগিস ফিরে এসে ঘটনা শুনতে পারলেন। এরপর তার রুদ্ররোষ থেকে বাঁচতে পালিয়ে গেলেন আলসিবিয়াদেস।

তিনি এশিয়া মাইনরের সাতরাপ-প্রধান তিসাফেরনেসের কাছে যেয়ে ধৰ্মা দিলেন। আলসিবিয়াদেস বললেন, পারস্য যদি সময়মতো উদ্যোগ নেয়, তাহলে যুদ্ধরত অ্যাথেন্স ও স্পার্টা, উভয় শহরেরই পতন ঘটবে।

তিসাফেরনেস এই ষড়যন্ত্রে অংশ নেওয়ার আগে সুসায় অবস্থানরত রাজার সঙ্গে আলোচনা করেননি। তিসাফেরনেস স্পার্টার কাছে বার্তা পাঠালেন—পারস্য অ্যাথেন্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধের খরচ বহন করবে। বিনিময়ে, অ্যাথেন্সের পতনের পর স্পার্টা আইওনিয়ান শহরগুলো পারস্যকে দিয়ে দেবে। এই শর্তে রাজি হল স্পার্টা। কিন্তু এরপর থেকে শুরু হয় তিসাফেরনেসের খেলা। থুসিদিদেস বলেন, ‘তিসাফেরনেস তাদের নৌবাহিনীর বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছিলেন। তিনি সময়মতো অর্থ দিতেন না এবং দিলেও, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পুরো অর্থ দিতেন না।’

অপরদিকে আলসিবিয়াদেস অ্যাথেন্সকে প্রস্তাব দিলেন তার সঙ্গে যোগ দিতে, কারণ তার কাছে পারস্যের কাছ থেকে পাওয়া প্রচুর স্বর্ণ আছে। শর্ত ছিল, তাকে আগের পদমর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। মরিয়া অ্যাথেন্স এই শর্তেও রাজি হয়ে গেল।

পরিকল্পনাটা এমন ছিল, দুইপক্ষ এক বিশাল নৌযুদ্ধে এঁকে অপরের মুখোমুখি হবে, এবং উভয় পক্ষই ধ্বংস হয়ে যাবে।

আলসিবিয়াদেস ৪০৭ সালে অ্যাথেন্সে ফিরে এসেছিলেন, এবং তার হাতে যথেষ্ট স্বর্ণও ছিল। তিনি নৌবাহিনী পুনর্গঠন করে ১০০ জাহাজ নিয়ে স্পার্টার মুখোমুখি হতে গেলেন।

কিন্তু অপরপক্ষে ক্ষমতার পটে কিছু পরিবর্তন আসে। দ্বিতীয় দারিয়াস তিসাফেরনেসের এই চাতুর্য সম্পর্কে খবর পেয়ে যান। তিনি তিসাফেরনেসকে সুসায় ডেকে পাঠান এবং তার ছেলে সাইরাসকে বিশেষ নির্দেশ দিয়ে সারদিসে পাঠান। তিনি বললেন, পারস্য থেকে আসা বাড়তি সামরিক সম্পদগুলো যেন অবশ্যই স্পার্টার হাতে থাকে। তিনি স্পার্টার নৌবাহিনী প্রধান হিসেবে লিসানদার নামে নতুন এক অ্যাডমিরালকে নিয়োগ দিলেন।

৪০৭ থেকে ৪০৫ সালের মাঝে অ্যাথেন্সের সব জাহাজ ডুবে যায়, সেনারা আটক হন এবং নাবিকরা প্রাণ হারান। এর পেছনে মূল কারণ ছিল স্পার্টার অ্যাডমিরাল লিসানদারের নেতৃত্ব এবং সেনাবাহিনীর তুলনামূলকভাবে ভালো বেতন। আলসিবিয়াদেস অ্যাথেন্সের বাহিনীকে পেটে-ভাতে রেখেছিলেন, কিন্তু স্পার্টার বাহিনী ছিল অনুপ্রাণিত।

শেষ যুদ্ধে অ্যাথেন্সের নৌবহর একবারে ১৭১টি জাহাজ হারায়।

আলসিবিয়াদেস পালিয়ে যেয়ে ফ্রিজিয়া সাতরাপে উপস্থিত হন। সেখানে তাকে ‘সম্মানিত সভাসদের’ মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে খুব শিগগির তার এই সৌভাগ্য ফুরা। লিসানদারের নির্দেশে ঐ সাতরাপের প্রতিনিধিরা তাকে হত্যা করতে এগিয়ে যান।

আলসিবিয়াদেসের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি দ্রুত বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বর্শার আঘাতে নিহত হন।

লিসানদার অ্যাথেন্সের সব জাহাজ পুড়িয়ে দেন। অক্টোবরে শহরটিতে পৌঁছে লিসানদারের বাহিনী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। অ্যাথেন্সবাসী নিরুপায় হয়ে আত্মসমর্পণ করে। ইতিহাসবিদ জেনোফন বলেন, ‘তাদের ছিল না জাহাজ, ছিল না কোনো মিত্র কিংবা টেবিলে কোনো খাবার’। যুদ্ধ এভাবেই শেষ হল।

লিসানদারের নির্দেশে অ্যাথেন্সের সেই দীর্ঘ প্রাচীর ভেঙে ফেলা হয়। বাঁশির সংগীতের মাঝে এই কাজটি শেষ হয়।

অ্যাথেন্সকে বলা হয় ‘অ্যাথেন্স সাম্রাজ্যের’ বাকি সব শহর থেকে নিজেদের প্রভাব দূর করতে। তাদের জন্য এটা খুব বড় শাস্তি ছিল না, কারণ তাদের শহরের মূল প্রাচীর ধ্বংস হয়নি বা শহরে লুটপাটও করা হয়নি, এবং তাদেরকে নিজস্ব সরকার গঠনের স্বাধীনতাও দেওয়া হয়। তবে এ বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন অ্যাথেন্সবাসীরা।

বাধ্য হয়ে লিসানদার ফিরে এসে ৩০ জন অভিজাত ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি সামরিক জান্তা সরকার গঠন করতে বাধ্য হন। ‘দ্য থার্টি’ নামে পরিচিত এই শাসকগোষ্ঠী ছিল নির্দয়। যদি কেউ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে টু শব্দটিও করে, তাহলে তারা তাকে ফাঁসি দিতেন। লিসানদার প্রথমে অ্যাথেন্সকে উপেক্ষা করলেও পরবর্তীতে নতুন এই শাসকগোষ্ঠীকে সহায়তা করতে স্পার্টা থেকে পদাতিক বাহিনী পাঠিয়েছিলেন।

অ্যারিস্টটল বলেন, ‘যাকেই প্রতিপক্ষ মনে করতেন, তাকেই শেষ করে দিতেন সেই ত্রিশ ব্যক্তি।’

তারা জোর করে অন্যের সম্পদ দখল করতেন। অল্প সময়ের মাঝে এক হাজার ৫০০ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেন তারা।

মরিয়া হয়ে অ্যাথেন্সবাসী বিদ্রোহ করে বসল। তারা থেবেসের কাছ থেকে সাহায্য চাইল এবং সেই সাহায্য নিয়ে সেই ৩০ শাসক ও তাদেরকে সুরক্ষা দেওয়া স্পার্টার সেনাদের ওপর হামলা চালাল। এই ঘটনায় আবারও অ্যাথেন্স- স্পার্টা যুদ্ধ শুরু হতে পারত, কিন্তু স্পার্টার তৎকালীন রাজা দেখলেন এখানে অনেক ‘ঝামেলা’ আছে। তাই তিনি লিসানদারকে বরখাস্ত করে সেখান থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিলেন। দ্বিতীয় দারিয়াসের মাত্রই মৃত্যু হয়েছে এবং তার উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় আরতাজারক্সিসকে কেউ চিনতেন না। স্পার্টা সিদ্ধান্ত নিল, আর কখনো পারস্যের স্বর্ণের ওপর নির্ভর করবে না।

দ্য থার্টির যেসব সদস্য বেঁচে গেলেন, তারা বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে গেলেন। পরের বছরটি অ্যাথেন্সের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ৪০৩ সালে বহুবছর পর আবারও অ্যাথেন্সে গণতন্ত্র ফিরে আসে। কিন্তু ততদিনে অ্যাথেন্স কপর্দকশূন্য ও ভগ্ন অবস্থায় পৌঁছে গেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *