1 of 2

৬২. দায়িত্ববোধ, ক্ষমতা ও ‘আর্ট অব ওয়ার’

অধ্যায় ৬২ – দায়িত্ববোধ, ক্ষমতা ও ‘আর্ট অব ওয়ার’

খ্রিস্টপূর্ব ৫৫১ থেকে ৪৭৫ সালের মাঝে এক সেনাপতি ও দার্শনিক সে-আমলের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের অর্থ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চালান।

পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে ঝৌ শাসন আবারও শুরু হয়। ঝৌকে ঘিরে রাখা চার শক্তিশালী রাজ্য—জিন, কি, চু, চিনের পাশাপাশি ইউয়েহ নামে পঞ্চম এক রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। পরবর্তীতে ইতিহাসবিদরা এ সময়টিকে পাঁচ হেজিমনের (স্বৈরশাসক) আমল বলে অভিহিত করেন। তবে লু, উ, চেং ও সুং নামে আরও ৪টি অপেক্ষাকৃত ছোট, কিন্তু শক্তিশালী রাজ্যের নামও শোনা যায়।

ঝৌ রাজ্যটি বাকি সব রাজ্যের কেন্দ্রে অবস্থিত ছিল। কাগজে-কলমে অন্য সব ভূখণ্ডের শাসক হলেও তাদের সেরকম কোনো শক্তিমত্তা ছিল না। প্রতিটি রাজ্য শাসন করত তাদের ডিউকরা। ডিউকের অধীনস্থ সেনাবাহিনী সীমান্ত এলাকা থেকে শত্রু বিনাশ করত। জিন রাজ্য সারাক্ষণই উত্তরের বর্বর গোত্র তি’র সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এই যুদ্ধ দশকের পর দশক চলতে থাকে। ফলে ক্রমশ জিন রাজ্যের পরিধি উত্তরদিক দিয়ে আরও বাড়তে থাকে।

কিছুদিনের জন্য এই দেশটিতে শান্তি বিরাজ করছিল।

একপর্যায়ে রাজা হিয়াং নিহত হন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে রাজ্যপ্রধানের আলংকারিক দায়িত্বটি পালন করছিলেন। তার পুত্র ও নাতি যথাক্রমে ৬ ও ৭ বছর রাজত্ব করেন। নাতির কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না। তার ছোটভাই তিং ৬০৬ সালে সিংহাসনে বসেন।

এসব অল্পবয়সি রাজার রাজত্বের মাঝে রাজধানীতে দুর্বলতার আভাস পান চু’র ডিউক।

খুব অল্প সময়ের মাঝেই রাজা তিং-এর ঝৌ ভূখণ্ডে হামলা চালান চু’র ডিউক। তিনি সরাসরি রাজপ্রাসাদে হামলা চালাননি। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল জুং সম্প্রদায়।

সিমা কিয়ান বর্ণনা করেন, ‘রাজা তিং-এর শাসনের প্রথম বছর চু’র রাজা জুংদের ওপর হামলা চালায়। এটাই চীনের ঝৌ রাজ্যের শাসক ব্যতীত অন্য কোনো শাসক বা ডিউককে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘রাজা হিসেবে অভিহিত করার প্রথম ঘটনা। এর আগে এ-ধরনের নজির নেই, এবং খুব সম্ভবত অন্যদের রাজা বলা ‘অবৈধ’ ছিল। কিন্তু এই অনিয়ম বা অনাচারের প্রতিবাদ জানানোর মতো পরিস্থিতিতে ছিলেন না কমবয়সি ঝৌ রাজা তিং।

ইতোমধ্যে তিং রাজার তিরোধানের পর তার ছেলে, নাতি ও পুতি একে একে রাজা হলেন। পুতি (গ্রেট-গ্র্যান্ডসান) চিং খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৪ সালে সিংহাসনে বসেন। এরপর তিনি প্রায় ২৫ বছর রাজত্ব করেন তেমন কোনো অঘটন ছাড়াই। তিনি তার পছন্দের সন্তানকে পরবর্তী রাজা হিসেবে মনোনয়ন দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার আগেই তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন। বছরটি ছিল ৫২১।

তাৎক্ষণিকভাবে চিং-এর বড়ছেলে সিংহাসনের দখল নিয়ে নেয়। প্রয়াত বাবা যাকে সিংহাসনের জন্য পছন্দ করে রেখেছিলেন, সেই অপর সন্তান স্বভাবতই এতে খুশি হতে পারেনি। বয়সে তরুণ হলেও সে তার বড়ভাইকে হত্যা করতে সমর্থ হয়, এবং ‘রাজা তাও’ হিসেবে ক্ষমতা দখল করে নেয়। বাকি ভাইয়েরা ভয়ে লেজ তুলে রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যায়।

তাও-এর এক ভাইয়ের নাম ছিল কাই। তিনি উত্তরের জিন রাজ্যে পৌঁছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। জিনের ডিউক তাকে সাহায্য করতে সম্মত হলেন। তিনি এক অভিষেক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কাইকে নির্বাসিত, কিন্তু বৈধ রাজা হিসেবে ঘোষণা দেন। কাই নিজের নাম নির্ধারণ করেন ‘দ্বিতীয় চিং’। জিন সেনাবাহিনী সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রাচীরে ঘেরা ঝৌ শহর পুনর্দখল করতে গেলেন।

তিন বছর ধরে রাজা তাও ও চিং দ্বিতীয় যুদ্ধ করে গেলেন। চতুর্থ বছরে চিং দ্বিতীয় রাজধানীতে অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হলেন। তিনি তার ভাইকে পরাভূত করলেন।

ততদিনে ঝৌ রাজ্যের আধিপত্য পুরোপুরি তিরোহিত হয়েছে। অরাজকতা ও রক্তপাতের মাঝে পুরো অঞ্চলে গোলযোগ দেখা যায়।

এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের দাবি মেটাতেই যেন লু রাজ্যে এক সংস্কারকের জন্ম হল। তার নাম ছিল কং ফুজি। কয়েক হাজার বছর ধরে তার রেখে যাওয়া শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকে তার অনুসারীরা। দুই হাজার বছর পর চীনে আসে জেসুইট মিশনারিরা। তারা কং ফুজির নামের বানান ইংরেজিতে এমনভাবে লেখেন, যা শুনে মনে হয় ‘কনফুসিয়াস’। তার নামের এই ল্যাটিন সংস্করণেই সারাবিশ্বে পরিচিতি পান তিনি।

তার সমসাময়িক ভারতীয় দার্শনিকদের মতো কনফুসিয়াসও অভিজাত বংশের সন্তান ছিলেন। তিনি সর্বশেষ শ্যাং রাজার সৎভাইয়ের বংশধর ছিলেন। তবে তার শৈশব কেটেছিল দারিদ্র্যে।

২১ বছর বয়সে তিনি বিবাহিত ও এক সন্তানের পিতা ছিলেন। তিনি সরকারি চাকরি করতেন। তার কাজ ছিল শস্যের চালানের হিসেব রাখা। এই চাকরিতে মনঃসংযোগ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। তরুণ কনফুসিয়াসের মাঝে শিশুকাল থেকেই এই গুণের কোনো কমতি ছিল না। তিনি সবসময় নিয়ম মেনে চলতেন। পূর্বপুরুষদের প্রতি সম্মান জানানোর ধর্মীয় আচার ও সবধরনের ঐশ্বরিক বিষয়ে তার ছিল অগাধ আগ্রহ।

প্রায় ১০ বছর কনফুসিয়াস সরকারি হিসাবরক্ষকের চাকরি করেন।

বিভিন্ন ধর্মীয় আচারের সময় যেসব কবিতা ও গান পরিবেশন করা হত, সেগুলো কনফুসিয়াস আত্মস্থ করেছিলেন। তার ছিল দুর্দান্ত স্মৃতিশক্তি, যার ফলে খুব সহজেই তিনি এটি করতে পেরেছিলেন।

যখন তার বয়স ৩০-এর কোঠায়, তখন লু’র ডিউক নিয়মিত তার সঙ্গে শলাপরামর্শ করতেন। একপর্যায়ে তাকে হিসাবরক্ষকের চাকরি থেকে ‘ভাগিয়ে নিয়ে’ যান এক উচ্চপদস্থ লু কর্মকর্তা—তার সন্তানদের গৃহশিক্ষকের চাকরি দিয়ে। নতুন পেশায় যোগ দেওয়ার অল্পদিনের মাঝেই ঝৌ ভূখণ্ডে গৃহযুদ্ধের দাবানল দেখা দেয়।

কনফুসিয়াস ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে সবচেয়ে বেশি দাম দিতেন। তিনি তার শিক্ষার্থীদের এ-বিষয়গুলো সম্পর্কে দীক্ষা দিলেন।

তার শিক্ষায় অতীতের সবচেয়ে ভালো বিষয়গুলো রক্ষার চেষ্টা করলেন তিনি—অন্তত তিনি যে-অতীতের কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, সেই অতীত। তিনি চীনের সবচেয়ে পুরনো কবিতা ও গানগুলো সংগ্রহ করে ‘শি জিং’ কবিতায় অন্তর্ভুক্ত করলেন। ভবিষ্যতের মানুষের জন্য এটা ছিল একধরনের ধ্রুপদি কবিতার সংগ্রহ। কনফুসিয়াসের মন্তব্য, ‘আমাদের কাছ থেকে আপনার পিতা ও রাজপুত্রের সেবা করার দায়িত্ব সম্পর্কে জানতে পারবেন’। তিনি আরেকটি বইয়ে ধর্মীয় আচার ও অনুষ্ঠানের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন, যার নাম ছিল ‘লি ছিং’। কীভাবে শোক প্রকাশ করতে হবে, কীভাবে নিয়মিত মাসিক কাজগুলো করতে হবে এবং আরও অনেক কাজের আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো তিনি লিখেছেন এখানে। পরবর্তীতে তার অনুসারীরা ‘লুন ইউ’ নামে তৃতীয় একটি সংকলন তৈরি করে।

যে পৃথিবীতে অস্ত্রের শক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রকে অখণ্ড রাখতে হত, সেখানে কনফুসিয়াস তার পারিপার্শ্বিকতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার বিকল্প একটি পন্থা সবার সামনে তুলে ধরলেন। তিনি জানালেন : যে ব্যক্তি অন্যদের প্রতি তার দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত, এবং সে অনুযায়ী কাজ করে যেতে পারেন—তিনিই হয়ে ওঠেন একটি দেশের প্রকৃত নেতা।

লু রাজ্যের ডিউককে তার এক প্রতিপক্ষ উৎখাত করলে কনফুসিয়াসকে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে হয়। তখন তার বয়স ছিল ৪০। তিনি নির্বাসিত, সাবেক লু নেতার সঙ্গে পাশের রাজ্য কি’তে উপস্থিত হন। সেখানে তাদের ভাগ্যের নিয়ন্তা হয়ে ওঠেন কি’র ডিউক, যিনি প্রকৃতপক্ষে লু’র প্রতি অতটা সদয় ছিলেন না।

তবে কি’র ডিউক কোনো ঝামেলা না করে লু’র ডিউক আর কনফুসিয়াসকে নিজ দরবারে স্বাগত জানালেন। তবে কি’র ডিউকের অন্যান্য সভাসদরা কনফুসিয়াসের আগমনকে ভালোভাবে নিলেন না। তারা একজোট হয়ে তাকে কি’র ডিউকের দরবার থেকে বিদায় করার প্রচেষ্টা চালালেন। কনফুসিয়াস কি রাজ্যে কোনো কাজ খুঁজে না পেয়ে আবার লু রাজ্যে ফিরে গেলেন। সেখানে যেয়ে তিনি সবার কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার করলেন—তার রাজনীতিতে কোনো আগ্রহ নেই এবং এর সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট থাকতে চান না।

সেসময় লু রাজ্যে তিন প্রধান পরিবারের মাঝে চলছিল ব্যাপক কোন্দল। এই ঝামেলায় না জড়িয়ে বেশ ভালো একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কনফুসিয়াস। অল্প সময়ের জন্য সরকারি চাকরিতে ফিরলেও, পরিশেষে তার জীবনের শেষ বছরগুলো তিনি কাটান লু রাজ্যের ইতিহাস লিখে, যা আজকের দিনে ‘দ্য স্প্রিং অ্যান্ড অটাম অ্যানালস’ নামে পরিচিত।

সেসময় ঝৌর রাজপ্রাসাদের দখল ছিল রাজা দ্বিতীয় চিং-এর হাতে। তার তথাকথিত ‘পরাভূত’ ভাই, এককালের রাজা তাও প্রায় ১২ বছর চুপচাপ ছিলেন। এরপর তিনি তার অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তাও আবারও রাজধানীতে হামলা করে বসলেন এবং তার ভাইকে উৎখাত করলেন। দ্বিতীয় চিং জিন রাজ্যে ফিরে যেয়ে আবারও সেখানকার ডিউকের সহায়তা চাইলেন। জিন সেনাবাহিনী পরের বছর আবারও দ্বিতীয় চিংকে ঝৌ রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে এল।

এটাই ছিল জিনদের শেষ, বড় বিজয়। অল্পদিনের মাঝেই জিনের ডিউক নিজেকে নানা সমস্যার মাঝে জড়িয়ে পড়তে দেখলেন। যাযাবরদের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযান চালিয়ে জিনের বেশ কয়েকটি পরিবার বেশ ধনী হয়ে পড়ে। এরকম এক পরিবার সেনাবাহিনীর দখল চেয়ে বসে। অপর এক পরিবার যাযাবরদের অনেক জমির দখল নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তারা তাদের সঙ্গে জোটও গঠন করে। সবগুলো শক্তিশালী পরিবারের এক অপরের বিরুদ্ধে ক্ষমতার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। ৫০৫ সাল নাগাদ রাজ্যটিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এত বেড়ে যায় যে-এর জের ধরে বর্বরদের বিরুদ্ধে তাদের এক সমন্বিত হামলা ব্যর্থ হয়।

৪৯৩ সালে চেং ও জিন একে অপরের বিরুদ্ধে অল্প সময়ের জন্য, কিন্তু সহিংসতায় ভরপুর এক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই যুদ্ধে কি, লু ও ওয়েই রাজ্যও বিভিন্ন সক্ষমতায় যোগ দেয়।

এ পর্যায়ে এসে লু, জিন ও ঝৌ—এই তিন রাজত্বেই চলছিল বিভেদ, এবং তিনটি রাজ্যই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় এক শতাব্দী শক্তিমত্তা বজায় রাখলেও চু সেসময় দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে উ ও ইউয়েহ’র সঙ্গে লড়ছিল। এভাবে দীর্ঘসময় ধরে পাঁচ রাজ্য একে অপরের বিরুদ্ধে লড়তেই থাকে।

যুদ্ধের বছরগুলোতে অপর এক দার্শনিক চীনকে একতাবদ্ধ হওয়ার জন্য একধরনের ফর্মুলা খুঁজে বের করলেন।

উ’র ডিউকের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন সেনাপতি সান জু। যুদ্ধ সম্পর্কে তার কোনো ভ্রান্ত ধারণা ছিল না। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা যুদ্ধ থেকে কোনো দেশ কখনোই উপকৃত হতে পারে না।’ ‘আর্ট অব ওয়ার’ বইয়ের মূল বিষয়বস্তু হল যত কম সম্ভব যুদ্ধে জড়িয়ে প্রতিপক্ষদের ঘায়েল করার কৌশল।

কনফুসিয়াসের মতবাদের চেয়ে সান জু’র মতাদর্শ কোনোদিক দিয়েই কম কার্যকরী ছিল না। বরং এটি জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে কনফুসিয়াসের মতবাদকে ছাড়িয়ে যায়।

তৎকালীন চীন সাম্রাজ্যের প্রতিটি আনাচে-কানাচে ছিল সামরিক শাসক—তাদের প্রত্যেকেই সর্বক্ষণ একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ে নিজ নিজ ভূখণ্ডের দখল ধরে রাখার চেষ্টা করে। যুদ্ধ ছাড়া তাদের কোনো অস্তিত্বই অটুট থাকেনি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *