সে-দিন বিকেলবেলা অসীম তাকে ডাকতে এল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল, আমরা চা খাচ্ছি। আপনি আসবেন নাকি!
মানবেন্দ্র শুকনো ভাবে বললেন, আমি একটু আগে চা খেয়েছি।
অসীম তৎক্ষণাৎ বলল, ও। আমি কি আপনাকে ডিসটার্ব করলাম? আপনি কি লিখছিলেন?
না, কিছুই করছিলাম না।
আপনাকে সারা দিন ঘর থেকে বেরুতেই দেখিনি।
এমনিই, বই-টই পড়ছিলাম।
অসীমের পাশে এসে মানসী দাঁড়াল। মানসী একটা ঝলমলে ছাপা সিল্কের শাড়ি পরেছে, তার ছিপছিপে শরীরটাকে দেখাচ্ছে মোমবাতির আলোর মতো।
মানসী বলল, আমরা ঝরনা দেখতে যাচ্ছি। আপনি যাবেন?
মানবেন্দ্র বললেন, আমি তো ঝরনাটা আগেই দেখেছি।
মানসী হেসে ফেলল। তার হাসিমুখটা একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবির মতো হয়ে গেল মানবেন্দ্রর চোখে।
হাসতে হাসতেই মানসী বলল, ঝরনা বুঝি একবার দেখলে আর দুবার দেখা যায় না? চলুন না আমাদের সঙ্গে।
অসীম তার স্ত্রীকে বলল, না না, শুধু শুধু ওনাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছ কেন? ওঁর দেখা আছে যখন…।
মানসী বলল, আর একবার গেলে কী হয়েছে?
মানবেন্দ্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মানসী যা বলছে, তা তো অনুরোধ নয়। হুকুম। এ অগ্রাহ্য করার উপায় আছে নাকি তার? মানসী এত জোর পেল কোথা থেকে?
মানবেন্দ্র বললেন, আচ্ছা চলুন, আমিও ঘুরে আসি। আমি এক্ষুনি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।
আমরা বাগানে বসে ততক্ষণে চা-টা খেয়ে নিচ্ছিা।
ওরা দুজনে চলে যাবার পরই মানবেন্দ্র সুটকেসটা খুলে জামাকাপড় বার করতে গেলেন। সব কিছু ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলেন ব্যস্তভাবে। ছেলেমানুষের মতো কোনও জামাকাপড়ই তার পছন্দ হচ্ছে না। মানসী নিজে থেকে তাকে ডেকেছে, বিশেষ পোশাকে যেতে হবে না? ইস, ভাল কিছু জামা টামা আনাই হয়নি।
শেষ পর্যন্ত মানবেন্দ্র এক জোড়া কাচা প্যান্ট-শার্ট পরে নিলেন, তার ওপর একটা বুক-খোলা সোয়েটার। অনেক দিন বাদে মোজার সঙ্গে শু পায়ে দিলেন। তারপর নবীন যুবকের মতো হালকা পায়ে বেরিয়ে এলেন বাইরে। অসীমদের সঙ্গে তার বয়েসের তফাত বেশি না, ছসাত বছর হবে, কিন্তু ওরা তাকে বেশি সম্ভ্রম দেখিয়ে ভারিক্কি করে তুলছে।
বাগানে বাচ্চারা একটা রবারের বল নিয়ে খেলছিল, এখন বড়রাও মেতে উঠেছে এই খেলায়। অসীম, গৌতম, হিরন্ময় এমনকী অনুরাধা এবং মানসীও শাড়ির আঁচল কোমরে জড়িয়ে হুড়োহুড়ি করছে সারা মাঠ জুড়ে। অসীম বলটাকে নিয়ে বিদ্যুৎবেগে ছোটাচ্ছে এ-দিক ও-দিক, সহজে কেউ ধরতে পারছে না। সবাই চ্যাঁচাচ্ছে, এই আমাকে দাও, আমাকে দাও!
একটি সুন্দর প্রাণবন্ত যৌবনের ছবি। যে-পৃথিবীতে দারিদ্র আছে, ক্ষুধা আছে, নোংরামি আছে, তার সঙ্গে এই মাঠের ছবিটির কোনও মিল নেই। এমনকী, মায়ের কোলে শিশু, আর্ত-আতুরের পাশে সেবাপরায়ণা নারী, প্রেমিকের কণ্ঠলগ্ন প্রেমিকা কিংবা ডানামেলা পাখি প্রভৃতি প্রথাগত সুন্দর দৃশের চেয়েও এই যৌবনের ছবিটি বেশি সুন্দর।
কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে দেখে মানবেন্দ্র ঠিক করলেন, তিনিও খেলায় যোগ দেবেন। অনেক দিন ছুটোছুটি করা হয়নি। শরীর থেকে ঘাম ঝরলে বেশ একটা আনন্দ পাওয়া যায়।
তিনি বারান্দা ছেড়ে বাগানে পা দিতেই খেলা থেমে গেল। হিরন্ময় চেঁচিয়ে বলল, এই চলো চলো, আর খেলা না। এখন না বেরুলে দেরি হয়ে যাবে। উনি এসে গেছেন।
মানবেন্দ্র একটু দুঃখিত হলেন। ওরা তাকে খেলায় নিল না।
গৌতম এ-দিকে সোজা হেঁটে এসে জিজ্ঞেস করল, আমরা কি হেঁটেই যাব, না গাড়ি নিতে হবে?
মানবেন্দ্র বললেন, হেঁটে যাওয়াই তো ভাল। গাড়ি তো শেষ পর্যন্ত যাবেও না।
আপনাকে বোধহয় জোর করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
না না, আমিই আজ আপনাদের পথ-প্রদর্শকহতে চাই।
বাচ্চাদের সামলে জিনিসপত্তর গোছগাছ করে নিতে আরও মিনিট পাঁচেকসময় লাগল। তারপর বেরিয়ে এল টুরিস্ট লজের বাইরে।
সেখানে মুনিয়ার মা হল্লা লাগিয়ে দিয়েছে। মাথায় একটা খালি টুকরি, মুনিয়ার মা যুদ্ধং দেহি ভাবে দাঁড়িয়ে, সঙ্গে মুনিয়া নেই। তাকে ঘিরে দুতিন জন বেয়ারা তার সঙ্গে মশকরা করছে।
মুনিয়ারমা সকালবেলা টম্যাটো দিয়ে গেছে, দুটাকা ছআনা তার প্রাপ্য। সকালবেলা তাকে বলা হয়েছিল, খুচরো পয়সা নেই, দামটা পরে নিতে। বিকেলবেলাও তাকে বলা হচ্ছে দশ টাকার খুচরো নেই, এখন দাম দেওয়া যাবেনা। এ কী-রকম ব্যবহার! সে কি শেঠদের মতো কারবার করে যে, দশ টাকার নোট ভাঙিয়ে দিতে পারবে? দুটাকা ছআনা না পেলে সে চাল কিনবে কী করে? তার ন্যায্য পয়সা এক্ষুনি চাই।
বেয়ারারা ক্ষেপাচ্ছে তাকে। তাদের নিজস্ব ভাষায় বলছে, আরে, আমরা কি পয়সা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি নাকি? পয়সা তোমার ঠিকই পাবে।
মুনিয়ার মা বলছে, না, আমার পয়সা আজই দিয়ে দাও। কাল পর্যন্ত বাঁচি কি মরি তার ঠিক কী? আজ না খেতে পেলে কাল বাঁচব কী করে? গভর্নমেন্টের হোটেলকে কোনও বিশ্বাস নেই।
মুনিয়ার মা এত জোরে চিৎকার করে কথা বলছিল যে, সেদিকে না তাকিয়ে উপায় নেই। ওরা একটুক্ষণ সেখানে দাঁড়াল, তারপর এগিয়ে গেল। বেশ কিছুটা দূর আসার পরও মুনিয়ার মায়ের গলা শোনা যাচ্ছে।
অসীম ছিল মানবেন্দ্রর পাশেই, সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর বলল, আমার কাছে খুচরো টাকা আছে, ওকে দিয়ে আসি, পরে বিল থেকে বাদ দিলেই হবে। ওই মেয়েটির বোধহয় পয়সাটার খুবই দরকার।
অসীম হনহন করে ফিরে গেল টুরিস্ট লজের দিকে। মানবেন্দ্র অন্য কথা চিন্তা করছিলেন বলে মুনিয়ার মায়ের ব্যাপারটাতে তিনি গুরুত্ব দেননি।
তিনি সপ্রশংস ভাবে তাকিয়ে রইলেন অসীমের চলে যাওয়ার দিকে। মানবজাতির মধ্যে এই শ্রেণীর মনুষ্য খুবই বিরল, যারা যে-কোনও ব্যাপারেই চট করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মানুষের স্বভাবই হচ্ছে সব কাজই একটু পিছিয়ে দেওয়া, আচ্ছা আজ থাক, কাল এটা করব– এই রকম। একমাত্র নিজের মৃত্যুভয়ের সামনে ছাড়া। মানবেন্দ্রর জীবনেও পথেঘাটে এমন অনেক ছোটখাটো ঘটনা ঘটেছে–যখন তার মনে হয়েছিল একটা কিছু করা উচিত, সামান্য কিছু–কিন্তু ভাবতে ভাবতেই আসল সময়টা পেরিয়ে গেছে, কিছুই করা হয়নি। মুনিয়ার মায়ের ব্যাপারটা নিয়েই হয়তো তিনি রাত্তিরবেলা শুয়ে শুয়ে ভাবতেন, ইস, ওকে কেন দুটাকা ছআনা নিজের পকেট থেকে দিলাম না। এই ধরনের অনুশোচনায় বিবেক খুব আদর খায়!
অসীম ফিরে আসা পর্যন্ত তিনি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলেন। এবং এইটুকু ঘটনার জন্য তিনি তার মনের মধ্যে অসীমকে একটা বিশিষ্ট জায়গা দিলেন।
তিন মাইল রাস্তা বিকেলে বেড়াবার পক্ষে খুব কম নয়। শহরের বিপরীত দিকে বেশকিছুটা লাল সুরকির রাস্তা, তারপর হালকা জঙ্গল। বনবিভাগ থেকে নতুন ইউক্যালিপটাস ও শালগাছ লাগানো হয়েছে। পর পর অনেক গাছ, কিন্তু একে ঠিক বনও বলা যায় না, বাগানও বলা যায় না।
অসীম জিজ্ঞেস করল, আপনি এই জায়গাটার সন্ধান পেলেন কী করে?
মানবেন্দ্র বললেন, ডাকবাংলোর বেয়ারাদের কাছে শুনে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছিলাম।
আপনি অনেক জায়গা ঘুরেছেন, না?
কিছু জায়গা ঘুরেছি, আরও বহু জায়গা দেখা বাকি আছে।
আপনাদের তো সারা বছরই ঘুরে বেড়াতে হয়?
কেন, ঘুরে বেড়াতে হবে কেন?
লেখার মেটিরিয়াল সংগ্রহ করার জন্য।
মানবেন্দ্র সামান্য হেসে বললেন, ওষুধ কোম্পানির এজেন্টদের যেমন অর্ডার সংগ্রহের জন্য ঘুরে বেড়াতে হয়, আমাদের অবশ্য সেরকমভাবে ঘুরে বেড়াবার কোনও দরকার নেই। লেখার মেটিরিয়াল নিজের ঘরে বসেও পাওয়া যায়।
অদূরে হিরন্ময় অনুরাধা আর মানসীকে হাত পা নেড়ে কী যেন বোঝাচ্ছে। আর হাসিতে এ-ওর গায়ে ঢলে পড়ছে দুই নারী। গৌতম সামলাচ্ছে বাচ্চাদের। সেই দিকে তাকিয়ে মানবেন্দ্র ভাবলেন, মানুষের কোনও ভূমিকাটাই সঠিক নয়।
বনের মধ্যে এক জায়গায় বড় বড় পাথরের চাই। পাথর নয়, কেউ যেন ভীমাকৃতি পাথরগুলো এলোমেলো ভাবে ছুঁড়ে ফেলে গেছে এখানে। তারই মাঝখান দিয়ে মাটি খুঁড়ে উঠেছে ঝরনাটা। ঝরনার উৎস মুখটা দেখা যায় না ঠিক, সেটা চাপা পড়েছে বিরাট একটা পাথরের তলায়। কিন্তু সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই, মাটি থেকে বেরুবার খানিকটা পরেই সেটা বেশ চওড়া হয়ে গেছে, অন্তত বারো চোদ্দো ফুট, বেশ তেজ আছে স্রোতের। এক জায়গায় খানিকটা প্রপাতের মতোও সৃষ্টি হয়েছে।
জায়গাটা অত্যন্ত নির্জন। অসংখ্য ফড়িং ওড়াওড়ি করছে মাথার ওপরে। ঝরনার শব্দ শুনলেই ফড়িঙেরা ভাবে, ওখানে বুঝি আরও ফড়িঙের ঝাঁক আছে। এইভাবে তারা সবাই এসে জড়ো হয়।
হিরন্ময় হাততালি দিয়ে বলল, গ্র্যান্ড, গ্র্যান্ড জায়গাটা! আমরা তো দুপুরে এখানে এসে পিকনিক করতে পারতাম।
মানবেন্দ্র মনে মনে বললেন, না, পারতে না। আমি তোমাদের বাধা দিতাম।
অনুরাধা মানবেন্দ্রর পাশে এসে বলল, অনেক নামকরা জায়গার চেয়েও এই জায়গাটা ভাল।
মানবেন্দ্র শুধু হাসলেন।
অনুরাধা আবার বলল, এ-রকম নির্জন জায়গা দেখলে মনে হয়, সারা জীবন এখানে একা একা থাকি। কেউ ডিসটার্ব করবে না।
মানবেন্দ্র মনে মনে বললেন, আমি আগের দিন এসে দেখেছি রাখালরা এখানকার জলে তাদের মোষগুলোকে চান করাচ্ছে। সেই দৃশ্য দেখলে আপনার একটুও ভাল লাগত না।
মানবেন্দ্র মুখে বললেন, আপনি এই পাথরটার ওপরে বসুন, পা দুটো ডুবিয়ে দিন জলে, আপনাকে খুব সুন্দর মানাবে।
মানবেন্দ্র যেন মানসীর হুকুমে অনুরাধাকে খুশি করার জন্য বলছেন এইসব কথা।
অনুরাধা খুশিই হল। কুন্দফুলের মতো দাঁতের পাটি দিয়ে নিচের ঠোঁটের ভেতরটা একবার কামড়াল। এটা তার মুদ্রাদোষ। কিংবা এই সময় তাকে আরও সুন্দর দেখায়, সে জানে। সে বলল, আপনিও আসুন না, আপনিও বসবেন আমার সঙ্গে।
আমি? না, আপনি একা বসুন, তারপর ওদের কারুকে বলুন আপনার একটা ছবি তুলতে।
সে হবে এখন। আপনি আসুন, আপনার সঙ্গে বসতেই আমার ইচ্ছে করছে।
অপ্রাসঙ্গিক ভাবে মানবেন্দ্রর মনে পড়ে গেল সোয়ানস ওয়ের দুটো লাইন। কানট ইউ সি হাউ ম্যাচ অফ ইয়োর অ্যাট্রাকশন ইউ থ্রো অ্যাওয়ে হোয়েন ইউ স্টুপ টু লাইং? কথাটা সোয়ান বলেছিল ওদেতকে, আজ দুপুরেই মানবেন্দ্র পড়েছেন।
মানবেন্দ্র দেখলেন, মানসী অনেক দূরে। গৌতমের কাছ থেকে বাচ্চাদের ভার নিয়ে নিয়েছে, বাচ্চাদের নিয়ে সে এখন জলের ধারে। গৌতম, অসীম ও হিরন্ময় আর একটা বড় পাথরের ওপর বসে সিগারেট ধরিয়েছে। মানবেন্দ্র লক্ষ্য করেছেন গৌতম তার স্ত্রীর কাছাকাছি থাকেনা।
মানবেন্দ্র অনুরাধাকে বললেন, আসুন।
পাথরটার ওপরে ওঠা সহজ। তবু অনুরাধা কৃত্রিম ভয়ে টল টল করছে। যেন সে আশা করেছিল, মানবেন্দ্র তার হাতে ধরবেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মানবেন্দ্র যে-হাতে মানসীকে ছুঁয়েছে আজই সকালে, সেই হাতে আর অনুরাধাকে ছুঁতে চান না। মানবেন্দ্রর দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল অনুরাধা, সেই হাতটা শূন্যেই রইল। যাই হোক, কোনও রকমে সে বসল জলের ধারের ঢালু দিকটায়। জলে পা দিয়েই চেঁচিয়ে উঠল, উরেঃ বাবা, কী ঠাণ্ডা!
শীতকালে ঝরনার জল তো ঠাণ্ডা হবেই। অনুরাধা যদি মানবেন্দ্রর বান্ধবী বা বন্ধুপত্নী হত, তাহলে মানবেন্দ্র ওকে জোর করে জলে নামিয়ে দিতেন এখন। কিন্তু মাত্র দুদিনের পরিচয়, এমন কৌতুক করা যায় না।
অনুরাধা চটি জোড়া খুলে রেখেছিল পাশে, তারই হাতের ধাক্কায় একটা চটি পড়ে গেল জলে। স্রোতে ভাসতে লাগল। অনুরাধা চেঁচিয়ে উঠল, এই যাঃ, চটি পড়ে গেল যে। হিরন্ময়, এই হিরন্ময়, দেখো না–
মানবেন্দ্র বেশ মজা পেলেন। চটি জলে পড়ে গেলে অনুরাধা তার স্বামীকে ডাকে না, সে ডাকে অপর পুরুষকে।
গৌতমই কিন্তু দৌড়ে এল এ-দিকে।
সে এসে পৌঁছবার আগেই মানবেন্দ্র ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে চটিটা ধরে ফেলেছেন।
গৌতম এসে অনুরাধাকে বলল, এ কী, জলের এত কাছে বসেছ কেন? তুমি নিজেই পড়ে যাবে যে!
অনুরাধা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে উদাসীন গলায় বলল, পড়ে গেলেই-বা কী আর হবে তাতে!
অর্থাৎ দুপুরবেলা স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়া মিটিয়ে নেবার এই তো উপযুক্ত স্থান। মানবেন্দ্র বুঝলেন, তার আর এখানে থাকা উচিত নয়।
তিনি উঠে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে পা বাড়িয়ে গৌতমকে বললেন, এখানে কোথাও ডুব-জল নেই। হঠাৎ পড়ে গেলেও ভয়ের কিছু নেই তাতে।
গৌতম বলল, ওইদিকের পাথরটা বেশ পরিষ্কার আছে, আসুন সবাই মিলে এক জায়গায় বসি।
অনুরাধা উঠল না।
গৌতম বলল, এসো।
অনুরাধা আবার গম্ভীর ভাবে বলল, আমার এখানে বসতেই ভাল লাগছে। আমি এখানে ওঁর সঙ্গে থাকব।
এই বলে সে মানবেন্দ্রর বাহুতে হাত ছোঁয়াল। তারপর হেসে আবার বলল, আমি জলে পড়ে গেলে আপনি আমাকে ধরবেন না?
মানবেন্দ্র বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলেন।
আর কিছু না বলে ওদের দুজনকে সেখানে কথা কাটাকাটির জন্য রেখে মানবেন্দ্র পাথরটা থেকে নেমে এলেন। হঠাৎ একটু বোকা বোকা লাগছে তার। এদের মধ্যে তার কোনও জায়গা নেই। তিনি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছেন না।
অনুরাধার ব্যাপারটা তিনি বুঝতে পেরেছেন। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বলেই সে মানবেন্দ্রকে তার পাশে এসে বসবার জন্য এত করে বলছিল। সেই জন্যই ডাকছিল হিরন্ময়কে। এটা পুরনো কায়দা। গৌতম ছেলেটি অন্য ধরনের, তাকে এইভাবে উত্তেজিত করা যায় না বোধহয়। অনুরাধা তার স্বামীকে ঠিক চেনে না।
অনেক দিন আগে একটি মেয়ে মানবেন্দ্রর কাছে প্রায়ই আসত। মেয়েটির নাম ছিল সুস্মিতা। সুস্মিতাই তো? হ্যাঁ। খুব অল্পবয়সে বিয়ে হয়েছিল তার। সে তার নিজের কথা বলতে ভালবাসত খুব। অর্থাৎ তার নিজস্ব কিছু দুঃখের কথা কোনও এক জনের কাছে মন খুলে বলার দরকার ছিল। সেরকম মানুষ পায়নি, তাই এসেছিল এক জন লেখকের কাছে।
সুস্মিতার কথা শুনে মনে হত, তার স্বামী একটি বিচিত্র চরিত্রের মানুষ। তার প্রধান শখ, রাত্তিরবেলা স্ত্রীর পাশে শুয়ে গল্প বলা, জীবনে এ পর্যন্ত কটি মেয়েকে সে ভালবেসেছে এবং তাদের জন্য তার কতখানি কষ্ট হয়। লোকটিকে চাকরির জন্য ঘুরে বেড়াতে হয়, মাসের অর্ধেক দিন বাইরে থাকে, সেই সব সময় দুএকটি নারী সমন্বিত রাত্রি কাটানো অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু স্ত্রীর কাছে সেই সবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেওয়াতেই ওর বেশি আনন্দ। সুস্মিতা কাঁদলে সে হো-হো করে হাসে। সুস্মিতা না কেঁদে শান্তভাবে ব্যাপারটা গ্রহণ করলে সে গালাগালির ঝড় তুলতে শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত একটা চাবুক নিয়ে মারে। সুস্মিতার কোনও বাপের বাড়ি নেই। নিজের এবং ছেলের ভরণপোষণের কথা চিন্তা করেই সে দরকার মতো কাঁদে কিংবা অন্যের কাছে দুঃখের কথা জানাতে হয়।
মানবেন্দ্রর বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি যে, লোকটি একটি সেডিস্ট। সমাজ এদের কোনও শাস্তি দিতে পারে না। যে লোক তার স্ত্রীকে দুবেলা খেতে-পরতে দেয়, সে তার শয়নকক্ষে স্ত্রীকে অপমান করছে কিংবা চাবুক মারছে কি না সমাজ তা জানতে চায় না। আদালত কোনও নির্দেশ দিতে পারে বটে, কিন্তু সেখানে চাবুকের দাগ প্রমাণ করতে হবে। অপমানের কোনও দাগও থাকেনা।
কিছু একটু বলতে হবে বলেই মানবেন্দ্র বলেছিলেন, ভারি অদ্ভুত তো!
সুস্মিতা বলেছিল, দিনেরবেলা ওকে দেখলে কিন্তু কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। এমন ভদ্র ব্যবহার, লেখাপড়া জানে, সববিষয়ে কথা বলতে পারে, আপনার বই-টইও পড়ে। আপনারা সাহিত্যিকরা এই সব লোককে বদলে দিতে পারেন না?
মানবেন্দ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। এক জন লেখকের কোনও ক্ষমতাই নেই। সে ডাক্তার নয়, বিচারক নয়, মন্ত্রী নয়। সে বড় জোর মানুষের দুঃখের সঙ্গী হতে পারে, আর কিছু না।
মানবেন্দ্র বলেছিলেন, আমি আমার নিজের জীবনের কোনও সমস্যারই সমাধান করতে পারিনি।
এই সুস্মিতা সপ্তাহের পর সপ্তাহ এসে ঝুলোঝুলি করেছে। নিজেই তারিখ ঠিক করে গেছে, মানবেন্দ্র যাননি, পরে এসে সুস্মিতা জানিয়েছে যে, তার খাবার নষ্ট হয়েছে। সে চায়, মানবেন্দ্র একবার অন্তত তার স্বামীকে দেখুক। ডাক্তার দেখাবার বদলে এক জন লেখককে ধরেছে।
শেষ পর্যন্ত মানবেন্দ্রকে এক দিন যেতেই হয়েছিল। সুস্মিতা আগে থেকেই একটা দিন বলে গিয়েছিল, সেই দিনটাতে সে মানবেন্দ্রকে দুপুরবেলা টেলিফোন করে বলেছিল, আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছি, আপনি তা-ও আসবেন না? তাহলে কিন্তু আমরা ট্যাক্সি করে গিয়ে আপনাকে ধরে নিয়ে আসব।
সুস্মিতাদের বাড়ি টালিগঞ্জে। মানবেন্দ্র সেখানে পৌঁছে দেখলেন বাড়িতে সুস্মিতা একা। তিনি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার স্বামী কোথায়?
সুস্মিতা অদ্ভুত ভাবে হেসে বলেছিল, আমি জানি, আপনি অচেনা লোকের সঙ্গে আলাপ করা পছন্দ করেন না। ও দুদিন আগে পাটনায় গেছে।
বেশ একটা পরিকল্পনা করেই সুস্মিতা মানবেন্দ্রকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। এমনকী ছেলেকেও পাঠিয়ে দিয়েছে এক বান্ধবীর বাড়িতে। শোবার ঘরে ডেকে এনে পরিপাটি বিছানাটা দেখিয়ে মানবেন্দ্রকে বলল, বসুন।
মানবেন্দ্রর চরিত্রে বিন্দুমাত্র নীতিবাতিক নেই। তিনি মনে করেন, স্বয়মাগতা কোনও নারীকে ভোগ করার মধ্যে অন্যায় কিছু থাকতে পারে না। সুস্মিতার চেহারাও খুব খারাপ নয়। একটুক্ষণের জন্য মানবেন্দ্র প্রলুব্ধও হয়েছিলেন। কিন্তু জুতো খুলে বিছানার ওপর পা তুলে বসতে গিয়ে তার একটু খটকা লাগে। তিনি তখন সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ, তাই অন্যদের ব্যবহারের সামান্য অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করার ক্ষমতাও ছিল খুব বেশি। তার মনে হয়েছিল, শুধু সুস্মিতার স্বামী নয়, সুস্মিতার নিজের চরিত্রেও খানিকটা পাগলামি আছে। সে মানবেন্দ্রকে শুধু শারীরিক আনন্দের জন্যই ডেকে আনেনি। পাগলদের সংসর্গে এলেই গা-টা কীরকম ছম ছম করে। সুস্মিতা যখন তাকে প্রথম চুম্বনটি দিতে আসে, তখন তার মনে হয়েছিল বিষকন্যাদের কথা। তিনি তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে জুতো পায়ে দিয়েছিলেন। রীতিমতো ভয়ে বুক কাঁপছিল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই সুস্মিতার স্বামী এসে পড়েছিল। সুস্মিতা দারুণ অবাক ও ভয় পাবার ভাব দেখিয়েছিল। মানবেন্দ্র বুঝতে পেরেছিলেন, এটাও ওর ভান। ও জানত ঠিকই।
সুস্মিতার স্বামী মানবেন্দ্রকে এমন খাতির করতে শুরু করে যে, মানবেন্দ্রর মনে হয়েছিল, লোকটি তাকে ব্যঙ্গ করছে। এরা স্বামী-স্ত্রীতে মিলে তার ব্যক্তিত্বটাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চাইছে।
মানবেন্দ্রর প্রতি সুস্মিতার কোনও ভালবাসা বা টান ছিল না, ছিল শুধু একটা উদ্দেশ্য। তাকে ডেকে এনে স্বামীর মনে ঈর্ষা জাগানোর চেষ্টা। নিজের ওপরেই ঘেন্না হচ্ছিল তার। এই উদ্দেশ্যে সুস্মিতা তাকে এত দূর টেনে এনেছে। কেন, পাড়ার বেকার ছোকরার কি অভাব? তাদের যে-কোনও এক জনকে প্রেম করতে ডাকলে ছুটে আসত না? সুস্মিতা হয়তো ভেবেছে, বেকার ছোকরা ডেকে আনলে বিপদ হতে পারে, সে যদি তার স্বামীর সঙ্গে মারামারি শুরু করে? এক জন লেখকই হচ্ছে সব চেয়ে নিরীহ মানুষ।
মানবেন্দ্র এত রেগে গিয়েছিলেন যে, পকেট থেকে একটা পিস্তল বার করে তৎক্ষণাৎ সুস্মিতা আর তার স্বামীকে খুন করে ফেললেন। মনে মনে।
মানবেন্দ্র এবারও পিস্তল তুলে নিশানা করতে গেলেন অনুরাধার দিকে। তিনি দেখলেন, গৌতম তখনও অনুরাধাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। মানবেন্দ্র সত্যিই হাতের আঙুলটা পিস্তলের ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন, কিন্তু এখন গুলি করতে গেলে গৌতমের গায়েও লাগবে। কিন্তু গৌতমের ওপরে তার কোনও রাগ নেই। তিনি একটু সরে গিয়ে অনুরাধাকে আলাদা ভাবে দেখবার চেষ্টা করলেন।
পাশে সরতে গিয়ে মানবেন্দ্র দেখলেন, তার সামনে একটা দাগ কাটা। কে যেন চুন দিয়ে একটা অর্ধবৃত্ত এঁকে দিয়ে গেছে। আগে কি এই দাগটা ছিল?
মানবেন্দ্র সেই দাগটা পার হবার জন্য পা তুলতে গিয়ে অনুভব করলেন, তাঁর পা পাথরের মতো ভারি। কে যেন তাকে ওই দাগটা পার হতে নিষেধ করছে। তাছাড়া চেষ্টা করলেও তিনি পারবেন না, তাঁর পা এত ভারি হয়ে গেছে।
এ কী অসম্ভব ব্যাপার! তিনি একটা দাগ পার হতে পারছেন না। অনুরাধার দিকে অস্ত্র তুলেছিলেন বলেই কি এই গণ্ডি? অস্ত্রটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে মানবেন্দ্র সেই গণ্ডিটা লাফিয়ে পার হবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার ইচ্ছাশক্তি শরীরকে নড়াতে পারছে না।
মানবেন্দ্র পেছনে ফিরলেন। ওই দিক দিয়ে চলে যাবেন। কিন্তু তিনি ভুল দেখেছিলেন। দাগটা তো অর্ধবৃত্তাকার নয়, পুরো বৃত্ত। কেউ তাকে একটা গণ্ডির মধ্যে বন্দি করে গেছে। এখান থেকে তার বেরুবার উপায় নেই।
শীতের মধ্যেও তার কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম দেখা দিল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ওরা কেউ জানেনা, তিনি বন্দি। তিনি অসহায় ভাবে তাকালেন, দূরেক বড় পাথরটার ওপরে আস্তে আস্তে সবই জমা হচ্ছে, গৌতম অনুরাধাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ও-দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, মানসী পা ধুচ্ছে ঝরনার জলে, হিরন্ময় লাইটারটা ফটাস ফটাস করে টিপছে, সিগারেট ধরাতে পারছে না, এত হাওয়া। ফড়িংগুলো দুই দুই খেলা খেলছে জলের সঙ্গে। প্রাক্-সন্ধ্যার আকাশ লাল হয়ে এসেছে, তার ছায়া খেলছে জলের সঙ্গে। প্রাক সন্ধ্যার আকাশ লাল হয়ে এসেছে, তার ছায়া পড়েছে জলে। চারিদিকে এত সুন্দর, অথচ মানবেন্দ্র একটা ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে বন্দি। এটা তুচ্ছ করে বেরিয়ে আসার সামর্থ্য তার নেই।
তার হচ্ছে হল, চিৎকার করে অন্য মানুষকে ডাকেন। তোমরা আমাকে বাঁচাও। তোমরা আমাকে বাঁচাও। মানসী, তুমি এসে আমাকে উদ্ধার করো।
কিন্তু তার গলা দিয়ে স্বর বেরুলো না। বেরুবেই-বা কেন, তিনি তো কারুকে কখনও উদ্ধার করেননি। তিনি স্বার্থপর। দারুণ স্বার্থপর!
মানবেন্দ্র সেখানেই মাটিতে বসে পড়তে যাচ্ছিলেন। তাছাড়া আর কোনও উপায় নেই। এই সময় দেখতে পেলেন একটা বাচ্চা ছেলেকে। অনুরাধার ছেলে। তার দুহাতে দুটো ললি পপ। লোভীর মতো মানবেন্দ্রর মনে হল, ও কি আমাকে একটা দেবে? ওর তো দুটো আছে!
মানবেন্দ্রকে নিথর ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শিশুটি বোধহয় একটু অবাক হল। সে পা দুটো কেষ্টঠাকুরের মতো করে দাঁড়াল সামনে।
মানবেন্দ্র তাকে ডাকলেন, এই শোনো।
ছেলেটি দুপা এগিয়ে এসে বলল, কী?
মানবেন্দ্র তার মাথাটা ছুঁয়ে ফেললেন।
অমনি তার শরীর ঝিম ঝিম করে উঠল। যেন হঠাৎ জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে। মানবেন্দ্র তাকিয়ে দেখলেন, গণ্ডি-ফণ্ডি কিছুই নেই। তিনি আবার দৃষ্টিবিভ্রম অসুখে ভুগছিলেন। ছেলেটির হাত ধরে তিনি কয়েক পা এগিয়ে গেলেন।
অনুরাধা ও গৌতমের ছেলে তাকে গণ্ডি থেকে মুক্ত করে দিয়ে গেল।
মানবেন্দ্রর ভয়টা কাটেনি। আজ সারা দিন তিনি সুস্থ ছিলেন। কোনও ব্যবহারে ভুল হয়নি। হঠাৎ এ আবার কী হল! যেন কোনও মন্ত্রে তার পা মাটির সঙ্গে আটকে গিয়েছিল। অনুরাধাকে খুন করতে চেয়েছিলেন বলেই কি?
শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। ওদের কিছু টের পেতে দেওয়া ঠিক হবে না। আচার-ব্যবহারে যদি কোনও অসঙ্গতি বেরিয়ে পড়ে। তিনি ওদের থেকে উলটো দিকে হাঁটতে লাগলেন। একটু বাদেই চলে গেলেন বড় পাথরটার আড়ালে। কেউ বোধহয় তার নাম ধরে ডাকছে। তিনি গ্রাহ্য করলেন না।
আরও খানিকটা দূরে, ঝরনার উৎস যে জায়গাটায়, তার কাছাকাছি মানবেন্দ্র বসে পড়লেন। এখান থেকে ওরা তাঁকে দেখতে পাবে না। পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরাতে গেলেন। দেশলাই জ্বালাতে গিয়ে স্পষ্ট বুঝতে পারলেন তার হাত কাঁপছে। এই হাত কাঁপার লক্ষণটা ভাল নয়। কোনও কালে তো তার স্নায়ুর অসুখ ছিল না।
জলের ধারে একটা ছোট চারা গাছ। সেই গাছ ও পাথরের মধ্যে জাল বিস্তার করে একটা মাঝারি-আকারের মাকড়শা বসে আছে। মানবেন্দ্র দেখলেন, মাকড়শাটা ঠিক তাকিয়ে আছে তার দিকেই। আশ্চর্য, মাকড়শার মুখ কি অবিকল মানুষের মতো দেখতে হয়।
মানবেন্দ্র মাকড়শাটার দিকে ভুরু নাচালেন।
মাকড়শার দৃষ্টি স্থির, অবিচল।
মানবেন্দ্র বললেন, আমার সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়নি, আমার নাম মানবেন্দ্র মজুমদার। আমি এক জন ব্যর্থ মানুষ। হেরে যাওয়া মানুষ।
মাকড়শাটা জায়গা ছেড়ে একটুও নড়ল না।
মানবেন্দ্র আবার বললেন, আমার যখন এগারো কি বারো বছর বয়েস, তখন আমি একটা মাকড়শা মেরেছিলাম। আমি মাকড়শা জাতটাকেই ঘৃণা করতাম। এখন আর করি না। আপনার ভয় নেই।
কোনও উত্তর না পেয়ে মানবেন্দ্র বিরক্ত হলেন। মাকড়শাটার এই ভারিকি প্রশান্ত ভাব তার সহ্য হল না। মাকড়শাটা তো আর প্রজাপতি কিংবা মথের মতো সুন্দর নয় যে, উত্তর না দেবার অধিকার থাকবে।
তিনি একটা শুকনো ডাল তুলে মাকড়শাটাকে খোঁচা মারতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় তার কানে ভেসে এল মানসীর গান। মানসী একটু আগে থেকেই গাইছে, মানবেন্দ্র এইমাত্র খেয়াল করলেন।
হাতের কাঠিটার দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবলেন, আমি এ কী ছেলেমানুষী করতে যাচ্ছিলাম, শুধু শুধু মাকড়শাকে খোঁচা মারা? আমার কি বয়েস বারো? একটু আগে অনুরাধার ছেলের হাতে ললি পপ দেখে আমার খেতে ইচ্ছে হয়েছিল। সত্যি কি পাগল হয়ে গেলাম নাকি?
তার বদলে মানসীর গানের দিকে মন দেওয়া যাক। দুদিন ধরে বিভিন্ন সময় মানসীর গলার টুকরো টুকরো গান শুনে তিনি গানের কথাগুলো নতুন ভাবে যাচাই করছেন। এতে অন্য দিকে মন ফেরে।
ওগো কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ,
আরো কি তোমার চাই
ওগো ভিখারি আমার ভিখারি
চলেছ কী কাতর গান গাই।
প্রতিদিন প্রাতে নব নব ধনে
তুষিব তোমারে সাধ ছিল মনে–
ভিখারি আমার ভিখারি…
মানবেন্দ্রর ডান হাতখানা মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল। তিনি আপন মনে বললেন, কোনও শুয়োরের বাচ্চার সাধ্য নেই, এ-রকম গান লেখে। ভিখারি আমার ভিখারি –এই জায়গাতেই দারুণ ভাবে মেরে দিয়েছে বুড়ো। দুজনেই ভিখারি। এক জন সব দিয়েছে, এক জন সব পেয়েছে, তবু দুজনেই ভিখারি। রবীন্দ্রনাথের মতো অত বড় প্রেমিক তো আর এক জনকেও দেখলাম না।
এ-ও কি শরীর ছাড়া প্রণয়? কী জানি, হতেও পারে। আমি তার স্বাদ পেলাম না। রয়ে গেলাম নিচুতেই। হায়, আরো যদি চাও মোরে কিছু দাও, ফিরে আমি দিব তাই– পৃথিবীর এই সর্বশ্রেষ্ঠ দেওয়া-নেওয়ার কথা আমার কখনও মনে পড়েনি। আমি শুধু চেয়েছি, কিছু দিইনি, দেবার মতো কিছু নেই ভেবে। ভিখারি আমার ভিখারি গানের মাঝখানে হঠাৎ এই জায়গাটা শুনলেই কান্না পেয়ে যায়।
কখন গান শেষ হয়ে গেছে, অন্য গান শুরু হয়েছে, তা-ও থেমেছে একসময়, মানবেন্দ্রর খেয়াল নেই। তিনি ভিখারি আমার ভিখারি–এই সামান্য শব্দকটা নিয়ে ঝিম হয়ে বসে আছেন। কিংবা যেন ধ্যান করছেন।
আপনি এখানে একা একা বসে আছেন কেন?
মানবেন্দ্র চমকে মুখ তুলে তাকালেন। মানসী এসেছে। আজ বিকেলে বাইরে বেরুবার পর মানসী এতক্ষণ তার সঙ্গে একটাও কথা বলেনি। অথছ সেই তো ডেকে এনেছিল মানবেন্দ্রকে। এখন মানসী একা এসেছে এখানে, এর নিশ্চয়ই কোনও মানে আছে।
মানসী আবার বলল, আমি তখন আপনাকে ডাকলাম।
ধরা-পড়া চোরের মতো মানবেন্দ্র অসহায় কাতর চোখে তাকালেন।
মানসী সামান্য হেসে বলল, আপনি আমার গান না শুনে চলে এসেছেন, তাতে আমি কিছু মনে করিনি।
মানবেন্দ্র বলতে চাইলেন, আমি এর আগে রবীন্দ্রসঙ্গীত এ-রকম মন দিয়ে কখনও শুনিনি। সত্যিই শুনিনি।
কথাটা উচ্চারণ করলেন না লাজুক ভাবে তাকিয়ে রইলেন মানসীর মুখের দিকে। সন্ধ্যার লাল আলোয় মানসীকেও অরুণবর্ণ দেখাচ্ছে। তার ছিপছিপে শরীরটা মানবেন্দ্রর চোখ থেকে আড়াল করেছে দিগন্তকে। মানসীর কাঁধ থেকে ঝুলছে একটা চামড়ার ব্যাগ। তার স্ট্র্যাপটা চলে এসেছে মানসীর বুকের ওপর দিয়ে। সেদিকে তাকিয়ে মানবেন্দ্র যেন শিউরে উঠলেন। এই রূপ, আমি এর পূজা করব। মানসী তুমি দাঁড়াও, আমি তোমার পায়ের কাছে পুরোহিতের মতো বসি।
মানসী একটু কাছে এগিয়ে এসে বলল, এবার ফেরার সময় হল, ওরা আপনাকে ডাকছে। আপনি কি আরও থাকবেন? কী করবেন এখানে একলা একলা!
তুমি একটু দাঁড়াও।
আপনি তো একা একা নিজের মনে কথা বলছিলেন।
তাই নাকি?
আমি দেখলাম তো দুর থেকে ভেবেছিলাম আপনাকে বিরক্ত করব না।
ওটা আমার পুরনো স্বভাব। ও এমন কিছু না।
চারা গাছটার দিকে তাকিয়ে মানসী বলল, বাঃ এই গাছটা বেশ সুন্দর তো।
মানবেন্দ্র শুকনো ডালটা তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি মাকড়শাটাকে তাড়িয়ে দিলেন, যাতে মানসী ওটাকে দেখে ভয় না পায়।
মানবেন্দ্র টের পেলেন, তাঁর মাথাটা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ লাগছে। মানসীকে দেখলেই এরকম হয়।
মানসী গাছটাকে দেখবার জন্য নিচু হয়ে বলল, দেখেছেন, এ জায়গাটায় বালির রঙও খুব সুন্দর। সোনার মতো ঝকঝকে। এই বালিতে সোনা মেশানো নেই তো!
কী জানি।
কোনও কোনও নদীর ধারের বালিতে থাকে শুনেছি। যেমন সুবর্ণরেখায়।
তারপর মুখ তুলে মানসী অপ্রত্যাশিত ভাবে বলল, পায়ের নিচে শুকনোবালি, একটু খুঁড়লে জল, গভীরে যাও, গভীরে যাও —
মানবেন্দ্র স্তম্ভিত ভাবে বললেন, এ কী?
চিনতে পারছেন না?
না।
আমি যখন কলেজে পড়ি, তখন আপনার এই কবিতাটা বেরিয়েছিল দেশ পত্রিকায়।
মানবেন্দ্র তীব্র চোখে তাকালেন মানসীর দিকে। যেন এক্ষুনি এই রমণীকে তিনি ভস্ম করে ফেলবেন।
মানসী বলল, নিজের লেখাও চিনতে পারেন না? একী, আপনার চোখ-মুখের চেহারা এরকম হয়েছে কেন? আপনার শরীর খারাপ নাকি?
মানবেন্দ্র স্পষ্ট ধীর গলায় বললেন, আমি এইমাত্র নোবেল প্রাইজ পেয়েছি।
ঝরনার জলের মতো শব্দ করে হাসল মানসী। বড় পরিচ্ছন্ন সরলতা রয়েছে তার মধ্যে। এবং মানসীর চোখে সবসময়েই একটা বিস্ময়ের ভাব। অর্থাৎ এ পৃথিবীর কিছুই পুরনো হয়ে যায়নি তার কাছে।
হাসিটা অসম্পূর্ণ রেখে সে বলল, এত সামান্যতেই খুশি হন আপনারা?
মানবেন্দ্র ধমক দিয়ে বললেন, তুমি আমার সঙ্গে বহুবচনে কথা বলবে না!
তার মানে? ও। প্রত্যেক লেখকই বুঝি আলাদা?
হ্যাঁ।
আমি কী করে জানব। আমি তো আর কারুকে দেখিনি।
তুমি ওই কথাটা আমাকে আর একবার বলো।
কোন কথাটা?
একটু আগে যেটা বললে।
আবার বলতে হবে কেন?
আমি শুনতে চাই।
মানসী একটু ভেবে নিয়ে বলল, এত সামান্যতেই খুশি হন আপনি?
মানবেন্দ্র ডান হাতটা মানসীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, দাও!
কী?
ওই সামান্যর চেয়ে যা বেশি।
আমি কী দেব আপনাকে?
ওই সামান্যর চেয়ে যা বেশি। তুমি পারো।
আমি আপনাদের কথা বুঝতে পারি না।
আবার আপনাদের!
আমি আপনার কথা বুঝতে পারিনা।
ওসব শুনতে চাইনা, তুমি আমাকে দাও।
মানসী এবার একটা উদাসীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, জানি না, আপনাকে দেবার মতো আমার কী আছে। আপনি তো অনেক দেশ ঘুরেছেন, অনেক মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, অনেক মেয়ের সঙ্গেও আপনার আলাপ-পরিচয় হয়েছে। আমি এমনিই একটি সাধারণ মেয়ে, আপনাকে আমি কী দিতে পারি?
মানবেন্দ্র একবার চোখ তুলে সন্ধ্যা আবছা হয়ে আসা দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, আঃ আমি একে কী ভাবে বোঝাব। সেই ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। ভাষা কত দীন! আমি এই দীন ভাষারও সবটুকু জানি না।
মানসী বলল, চলুন, এবার যেতে হবে। ওরা ভাবছে।
মানবেন্দ্রর মুখখানা আক্রমণোদ্যত সিংহের মতো হিংস্র হয়ে এল। তার ভেতরের পশুটা ফুঁসে উঠছে। তিনি এক্ষুনি যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে এই রমণীর টুঁটি চেপে ধরবেন। অতি প্রিয় জিনিস হাতছাড়া হয়ে যাবার মুহূর্তে যেমন তাকে ধ্বংস করে দেবার ইচ্ছে জাগে।
মানসী কয়েক পা এগিয়ে গেল। মানবেন্দ্র মনে মনে বললেন, যাক না, কত দূরে যাবে, আমি ওকে ঠিক ধরব।
মানসী বড় পাথরটার গায়ে হাত রেখে বলল, আপনার সামনে এলেই আমার কীরকম যেন ভয় করে। কেন জানেন তো?
উত্তরের অপেক্ষা না করেই মানসী আবার বলল, আমাদের সবারই তো কিছু কিছু গোপন কথা আছে।
আপনার চোখ দেখলে মনে হয়, আপনি বুঝি সব বুঝে ফেলছেন। লেখকেরা এমন ভাবে মেয়েদের মনের কথা লিখে দেয়।
এটা একটা অন্য দিক। এর মধ্যে লুকোনো গল্পের ইঙ্গিত আছে। মানবেন্দ্র নিজের চিন্তা ভুলে গিয়ে এই ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠলেন।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, গোপন কথা মানে কী? দুঃখ?
দুঃখ?
মানসী যেন দুঃখ কথাটা নিয়ে মনে মনে কয়েক বার খেলা করল, তারপর বলল, কী জানি।
হঠাৎ হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটাবার অত ক্ষমতা আছে মেয়েদের। মানসী পরক্ষণেই বলল, আপনার বাড়িতে আর কে কে আছে?
মানবেন্দ্র আকস্মিক প্রশ্নের প্রথম ধাক্কাটা সামলে উত্তর দিলেন, ও কথা থাক। আমার কোনও অতীত নেই।
আপনি বুঝি ব্যক্তিগত কথা পছন্দ করেন না।
না, সেজন্য নয়। আমি যদি বলি, পৃথিবীতে আমি সম্পূর্ণ একা, তাহলে কথাটা একটু বোকা বোকা শোনাবে। আসলে আমি একাই থাকি, আমি বিয়ে করব বলে তিনবার প্রায় ঠিক করে ফেলেছিলাম, শেষ পর্যন্ত আর হয়ে ওঠেনি।
আমি বাইরের লোকের সঙ্গে চট করে মিশতে পারি না। সেই জন্যই যদি কিছু উলটো-পালটা কথা বলে ফেলি– ।
দূর থেকে একটি বাচ্চার গলায় মা ডাক শোনা যাচ্ছে। মানবেন্দ্র বুঝতে পারলেন, আর সময় নেই। তিনি মানসীর খুব কাছে গিয়ে চট করে তার হাত চেপে ধরে বললেন, আমি তো তোমার অচেনা নই।
নিজের ঘরে আজই সকালে মানবেন্দ্র যখন মানসীর হাত ধরেছিলেন, তখন মানসী বিন্দুমাত্র বিকার দেখায়নি। কিন্তু এবার চট করে সরে গিয়ে দুঃখিত গলায় বলল, আপনি যে আমায় তুমি তুমি করে বলেন, এতে আমার খুব অস্বস্তি লাগে।
মানবেন্দ্রর এইটুকু কাণ্ডজ্ঞান আছে এবং তিনি বোঝেন যে, মাত্র দু-এক দিনের আলাপের পর কোনও মেয়ের, বিশেষত কোনও বিবাহিত নারীর হাত ছোঁয়া যায় না। স্পর্শ করার জন্য একটা অধিকার চাই। অন্তত লম্পট হিসেবে একটা অখ্যাতি থাকলেও চলে। তবু মানসী দ্বিতীয় বার এই কথা বলায় মানবেন্দ্র খুবই দুঃখিত বোধ করলেন। যুক্তি নেই, কোনও যুক্তি নেই এরকম দুঃখ পাওয়ার। তাহলেও বুকের মধ্যে গঙ্গার মতো একটা ঢেউ ওঠে। তিনি হাতজোড় করে সত্যিকারের নম্র ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে বললেন, আচ্ছা বলবনা, আর কখনও বলবনা!
মানসীর মুখ থেকে দুঃখের ভাবটা মিলিয়ে গেল। আবার সে দুচোখে বিস্ময় এবং মুখে সরল হাসি ফুটিয়ে বলল, আপনাকে কিন্তু সত্যিই আমার অনেক দিনের চেনা মনে হয়। তাছাড়া, আপনি তো আমাকে তুমি বলতেই পারেন।
অর্থাৎ মানসী বলতে চাইছে, তুমি বলে সম্বোধন করলেই গায়ে হাত ছোঁয়ানো যায় না। বিশেষত এই নির্জনে।
মানবেন্দ্র সব বুঝতে পেরে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন।
মানসী আর দাঁড়াল না। তরতর করে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, আমি চললাম, আপনি আসবেন তো আসুন।
মানবেন্দ্র বললেন, আমি এখন যাবনা! তিনি বড় পাথরটায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েই রইলেন। ওদের সঙ্গে এসেছেন যখন আজ ওদের সঙ্গেই ফেরা উচিত, একথা মানবেন্দ্র ভালভাবেই জানেন। তবু তিনি গেলেন না। জ্ঞানপাপী কিনা।
মানবেন্দ্র পাথরটার গায়ে হাত বুলোতে বুলোত বললেন, পাথর, কলক্ষ বছর ঘুমিয়ে আছ? এবার জাগো। এইমাত্র মানসী তোমাকে ছুঁয়েছিল, তুমি টের পেলে না? তোমাকে আমি অহল্যা বলতে চাই না। তোমাকে দেখে পুরুষ মনে হয়। মাটি স্ত্রীলিঙ্গ হতে পারে, কিন্তু পাথর পুরুষ। কেমন লাগল মানসীর স্পর্শ? তুমি দেখলে তো, ও আমাকে অবহেলা করে চলে গেল।
মানবেন্দ্র আর একটা সিগারেট ধরিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশ এখনও প্রত্যক্ষ, কিন্তু তরুণ শালবনের ওপর ঝুপ ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসছে। দূরের আকাশে এখনও খানিকটা এলোমেলো লাল রঙ ঠিক যেন রুয়োর একটি অসমাপ্ত ছবি।
আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে মানবেন্দ্র দেখলেন, অপস্রিয়মাণ শালবন, দেখলেন ঝরনার জলের অন্য রকম রং, দেখলেন পাথরের চাঙড়ের গম্ভীর অবস্থান, দেখলেন শেষ সন্ধ্যা ও আসন্ন রাত্রিকে। কিন্তু সব কিছুর চেয়ে বেশি সুন্দর একটি নারী। যে এই মাত্র ছিল, এখন নেই। পৃথিবীতে এর চেয়ে অনেক বেশি রূপসী নারী আছে, অনেক, কিন্তু মানবেন্দ্র এর গোপন সৌন্দর্য দেখছেন। যৌবনের মাঝামাঝি এসেও এই নারীকে দেখে তার হাত কাঁপে, বুকের মধ্যে টিপ টিপ শব্দ হয়। এই রূপের প্রচণ্ড ঝাপটায় তার মন অবশ হয়ে আসছে।
মানবেন্দ্র বললেন, হে আকাশ, হে বিশ্বপ্রকৃতি, হে বালুকণা, হে দারিদ্র, হে সামাজিক বৈষম্য, হে রাজনীতি, হে বিশ্বশান্তি, তোমাদের চেয়েও একটি নারীর রূপ আমার কাছে বেশি জরুরি মনে হচ্ছে এখন। আমাকে দোষ দিয়ো না। আমি এই নারীর রূপের পূজা করতে চাই। এই নারী বিবাহিতা, তবু, হে সমাজ, আমাকে শাস্তি দিয়ো না। আমি তো একে কেড়ে নিচ্ছি না। ফুলের গন্ধ শুকলে কি বাগানের মালিকের কোনও ক্ষতি হয়? তাছাড়া আমি পাগল-ছাগল লোক, আমার কথা বাদ দাও! আমার কি কারওর কোনও ক্ষতি করার ক্ষমতা আছে!
মি. মজুমদার, আপনি যাবেন না?
পাথরটার ওপরে এসে দাঁড়িয়ে অসীম বলছে এই কথা।
মানবেন্দ্র ওপরের দিকে তাকালেন।
এই পরিবেশে মি. মজুমদার বলে সম্বোধন করে অসীম একটু ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু মানবেন্দ্র তাতে একটুও বিরক্ত হলেন না। তিনি অসীমকে খুবই পছন্দ করে ফেলেছেন। অসীম এবং গৌতম এরা দুজনেই ভারি চমৎকার মানুষ। ভাল চাকরির মোহে অসীমের বাবা-মা ওকে আগাগোড়া সাহেবি স্কুলের শিক্ষা দিয়েছেন, তাই ও মাতৃভাষাটা ভাল শেখেনি এবং দেশীয় সহবৎ ভাল জানে না, কিন্তু সেজন্য ওর চরিত্র মলিন হয়নি। যে-কোনও নিপীড়িত শ্রমিকের চেয়ে অসীমের কম সমবেদনা পাবার কোনও যুক্তি নেই।
মানবেন্দ্র হাসিমুখে বললেন, আপনারা যান। আমার তো কোনও কাজ নেই। আমি এত তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে আর কী করব! আমি আর একটু থাকি!
অসীম বলল, জায়গাটা সত্যি খুব ভাল। আমরা আর একটু থাকতাম, কিন্তু বাচ্চারা যে বড্ড জ্বালাতন করছে। তাছাড়া ওদের আবার খাওয়া-দাওয়া আছে।
সে তো বটেই। আপনারা এগিয়ে যান, আমি একটু বাদেই আসছি।
রাস্তা চিনতে পারবেন তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, এ আর কী!
অসীম চলে যাবার পর মানবেন্দ্র কান পেতে রইলেন। বনপথে তিনি শুনতে লাগলেন পদশব্দ। তিনি পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে। যেন একজন পলাতক। আস্তে আস্তে সেই শব্দ দূরে মিলিয়ে গেল।
মানবেন্দ্র আবার চোখ তুললেন। তিনি দেখলেন, আকাশ শালবন, ঝরনা, পাথর-কিছুই আর সুন্দর নয়। সব জায়গায় কালি, শুধুকালি। হঠাৎ যেন ঘোর অন্ধকার নেনে এসেছে!
মানবেন্দ্র বুঝতে পারলেন, মানসী তার পাগলামি সারাবার জন্য আসেনি। মানসী এসেছে তাকে আরও বেশি পাগল করতে।
.
০৬.
নিজের ঘরে ফিরে এসে মানবেন্দ্র ষড়যন্ত্র করতে বসলেন। এই মেয়েটিকে তার চাই। যে-কোনও উপায়ে পেতেই হবে।
তার আগে দেখতে হবে মেয়েটি আসলে কে। এক জন বিবাহিতা নারী, যার রূপের একটা আকর্ষণ আছে, কিন্তু আহামরি কিছু না। তার ব্যবহারের মধ্যে আছে একটা খেয়ালিপনা, সেটাই বেশি আকর্ষণীয়। আজ সন্ধেবেলাতেই মানবেন্দ্র জানতে পেরেছেন যে তিনটি বাচ্চার মধ্যে মানসীরই দুটি। দুটি সন্তানের জননী হয়েও এ-রকম আকর্ষণীয় থাকা কোনও নারীর পক্ষে যথেষ্ট কৃতিত্ব নিশ্চয়ই। সে কিছুটা সাহিত্য পড়েছে, ঠিক সময় মানবেন্দ্ররই কবিতার লাইন উচ্চারণ করে অভিভূত করে দিয়েছে এই পাগল লেখককে। কিন্তু সেই জন্যই কি এত টান? না, এর চেয়ে বেশি কিছু আছে।
মানসীকে পেতেই হবে। কিন্তু তার স্বামী আছে। অসীম চমৎকার মানুষ। তার মনে দুঃখ দেওয়া সম্ভব নয়। দরকার হলে মানবেন্দ্র অসীমের কাছ থেকে মানসীকে একটুখানি চেয়ে নেবেনে। তিনি বলবেন, অসীম, তোমার স্ত্রীকে নিশ্চিন্তে আমার কাছে দাও। অসামান্যা নারীদের কোনও কিছুই ক্ষয় হয় না, ব্রহ্মা কিংবা অমৃতের মতো তারা উচ্ছিষ্ট হয় না। যখন তুমি ফিরে পাবে, তখন সম্পূর্ণই পাবে। ওকে পেলে আমি ধন্য হবো কিন্তু তুমি একটুও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
কী করে পাওয়া যায় মানসীকে? এর আগে মানবেন্দ্র যে-সব রমণীদের চেয়েছেন, তাদের পাবার একমাত্র উপায় ছিল প্রতীক্ষা। ঠিকমতো আহ্বান জানালে প্রতীক্ষার পর ঠিকই পাওয়া যায়। উনিশ কুড়ি বছর বয়সে প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে বকুল গাছের নিচে তিনি প্রতীক্ষা করতেন সুনন্দার জন্য। একদিন, দুদিন, তিন দিন সুনন্দা আসেনি। তিনি তখন ঠিক করেছিলেন, সুনন্দা যদি সত্যিই না আসে, তাহলে তিনি কলেজের লাইব্রেরিতে আগুন ধরিয়ে দেবেন। অন্যান্য প্রতিশোধের চেয়ে লাইব্রেরিতে আগুন ধরানোর ব্যাপারটাই তার বেশি মনঃপূত হয়েছিল। তখন মনীষা ভয় পেয়ে সুনন্দাকে পাঠিয়েছিল তার কাছে। সুনন্দাকে সাড়ে তিনশো চুম্বনের পর মানবেন্দ্র ভেবেছিলেন, সুনন্দাকে পাবার জন্য আমি শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ, টয়েনবি, হ্যারল্ড ল্যাস্কি প্রভৃতির কাছেও ঋণী। এবং বকুল গাছটারকাছেও কিছুটা ঋণী।
কিন্তু মানসীকে পাবার জন্য তো প্রতীক্ষার সময় নেই। ওরা কাল সকালেই চলে যাবে। এক্ষুনি একটা কিছু ব্যবস্থা করা দরকার। মানবেন্দ্রর মুখখানা খাঁটি ষড়যন্ত্রকারীর মতো হয়ে এল।
তিনি ঘরের মধ্যে ছটফট করতে লাগলেন। বুদ্ধিতে একটু শান দেওয়া দরকার। তিনি পকেট থেকে এক গাদা খুচরো পয়সা বার করে ছড়িয়ে ফেললেন মেঝেতে। তারপর বেল বাজিয়ে ডাকলেন বেয়ারাকে।
রামচন্দ্রন আসতেই তিনি ঝাঁজের সঙ্গে বললেন, ঘরটা ভাল করে পরিষ্কার করো না? এক্ষুনি সাফা করে দাও।
রামচন্দ্রন একটা লম্বা বুরুশ এনে ভেতরে এসে বলল, সাব, বহুত পয়সা গিরা যায়।
মানবেন্দ্র জানলার কাছে একটা বই খুলে দাঁড়িয়ে অবহেলার সঙ্গে বললেন, সাফা করা, সব সাফা করো।
ঘর পরিষ্কার করার পরেও রামচন্দ্রন প্রায় দু-তিন টাকার মতো খুচরো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানবেন্দ্র আবার তাকে ধমক দিয়ে বললেন, ঠিক আছে। দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও।
এ-রকম ধমকেও খুশি হয় না এমন পরিচারক ভূ-ভারতে নেই। সে হাসিমুখে সেলাম করে চলে যাচ্ছিল, দরজার কাছে যেতেই মানবেন্দ্র তাকে বললেন, দাঁড়াও! পকেট থেকে তিনটে দশ টাকার নোট দিয়ে বললেন, একটা জিনের পাঁইট নিয়ে এসো।
রামচন্দ্রন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার উপরে স্পষ্ট নির্দেশআ ছে, সে মানবেন্দ্রর জন্য কক্ষনও মদ কিনে দেবে না। তার মুখে ফুটে উঠল দারুণ দ্বিধা।
মানবেন্দ্র আবার হুকুমের সুরে বললেন, যাও!
জিনের শিশিটা আসবার পর মানবেন্দ্র ফেরত খুচরোটা সবটাই বকশিস দিলেন তাকে। তার বদলে সে লুকিয়ে এনে দিল অনেকগুলো লেবুর টুকরো ও বরফ। মানবেন্দ্র জিনের গেলাসে মস্ত বড় একটু চুমুক দিয়ে বললেন, আঃ!
তারপর ভাবলেন, পাগল যদি হতেই হয়, একটি মেয়ের জন্যই পুরোপুরি পাগল হওয়া ভাল।
আমি মানসীকে পুজো করব। তার পায়ের কাছে বসে বলব, তুমি এক জন সামান্য নারী, মনে কোনও অহঙ্কার এনো না। আমিও এক জন অতি সাধারণ মানুষ। আমার মধ্যে ঈর্ষা আছে, লোভ আছে, রাগ আছে। কিন্তু তোমাকে যখন দেখি, তখন তো আর কিছুই মনে পড়ে না। আমার হাত কাঁপে। আমার বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করে, আমার চল্লিশ বছর বয়েসের কঠিন বুক। তোমাকে মনে হয় এই বিশ্বপ্রকৃতির চেয়েও বেশি সুন্দর। এই যে মোহ, এর চেয়ে চমৎকার আর কিছু নেই। আমি এই মোহকে বন্দনা করি। তুমি দেবী হও।
আমি তোমাকে শুধু পুজো করব না, আমি আদরও করব। আমি তোমার ওষ্ঠ থেকে নেব সেই সবটুকু, নারীর ওষ্ঠ যতখানি দিতে পারে। আমার জিভ তোমার জিভের সঙ্গে খেলা করবে। আমি শিশুর মতো তোমার স্তনে দাঁত ছোঁয়াব। আমি তোমার ঊরুতে চেপে ধরব আমার মুখ। আমি দুর্দান্ত পাগল হয়ে উঠব। আমার পুজো এই রকম। আমি নির্লোভ হতে পারি না। শরীর না ছুঁয়ে আমি নারীর কোনও ভাষাই বুঝতে পারি না।
আমি তোমাকে লোভ করেছি। কিন্তু তোমাকে পেলেই আমার লোভ চলে যায়, তখন পূজা হয়ে ওঠে। অর্থাৎ লোভ আমাকে মহত্ত্বের রাস্তা দেখায়।
তোমার কাছ থেকে আমি পাব। সাম্রাজ্যের চেয়েও ঢের বেশি। কিন্তু এর বদলে আমি কিছু দিতে পারব না। কাগজ-কলমে অক্ষরের সারি সাজানো ছাড়া আমার আর কিছু দেবার সাধ্য নেই। শুধু, কখনও কখনও হয়তো তোমার মনে পড়বে, একজন শুধু তোমাকে চায়নি, তোমাকে পুজো করেছিল। সেইটুকুর কি কোনওই দাম নেই?
এখানে, আমার খাটে, এই পবিত্র বেদিতে, মানসী, আমি তোমাকে পুজো করতে চাই। সময় বেশি নেই, মানসী, তুমি চলে এসো।
জিনের শিশিটা অর্ধেক মাত্র শেষ হয়েছে, এই সময দরজার বাইরে থেকে গৌতম বলল, আপনি কি ব্যস্ত আছেন? আসতে পারি?
মানবেন্দ্র বসে আছেন চেয়ারে। টেবিলের ওপর মদের গ্লাস। অন্য কারুকে দেখে গ্লাস লুকোবার অভ্যেস তার নেই। তিনি বললেন, আসুন!
গৌতম ঘরের মধ্যে এসে কোথায় বসবে ভাবছে, মানবেন্দ্র তাকে খাটটা দেখিয়ে দিলেন। অন্য আর একটি মাত্র চেয়ার ছিল, সেটাতে বইপত্র স্তূপাকার।
মানবেন্দ্র বললেন, আমি একটু জিন খাচ্ছি। আপনার চলবে?
গৌতম একটু চিন্তা করে বলল, আচ্ছা, অল্প একটু
সে ভাবছিল, মানবেন্দ্রর কাছে বেশি নেই, এর থেকে সে ভাগ বসাবে কি না। কিন্তু সে কথাটা উচ্চারণ করা ঠিক ভদ্রতা নয়। নিজেই সে গেলাস-টেলাস এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করল।
আপনারা তো কালই চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ। ভোরেই বেরিয়ে পড়ব।
এরপর কোথায়?
আমার কাজের জায়গায়। ছুটি বেশি নেই। আপনাকে একটা কথা বলতে এলাম। নর্থ বেঙ্গলে, আমি একটা চা বাগানে কাজ করি, আমি ওখানকার ম্যানেজার।
বাঃ, আমি কখনও কোনও চা বাগানের ম্যানেজারকে স্বচক্ষে দেখিনি। আগে তো সাহেবরাই হত।
হ্যাঁ, মানে, বাগানটা আগে আমাদের পরিবারের ছিল, বিক্রি হয়ে গেছে, এখন আমি ওখানে কাজ করি। আমি বলছিলাম, আমাদের বাংলোতে অনেক জায়গা আছে, আপনি তো এখানে বিশ্রামের জন্য এসেছেন। যদি আমাদের সঙ্গে ওখানে যান, তাহলে আপনার খুব ভাল লাগবে। আমাদেরও খুব ভাল লাগবে।
আপনাদের সঙ্গে?
অসীমরাও যাবে আমাদের সঙ্গে। হিরন্ময় এখান থেকেই ফিরতে চাইছে, আমরা ওকে আটকাবার চেষ্টা করছি অবশ্য। গাড়িতে জায়গার অসুবিধে নেই, আপনার একটু কষ্ট হবে হয়তো।
এত লোভনীয় প্রস্তাব যে, মানবেন্দ্রর মুখ চোখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠার কথা ছিল। একেই তো বলে সুবর্ণ সুযোগ। তিনি মানসীকে কাছাকাছি পাবেন আরও কয়েকদিন। প্রতীক্ষা আরও বিস্তারিত হতে পারবে।
কিন্তু মানবেন্দ্রর ভেতরে থেকে কে যেন চিৎকার করে বলল, না। বড় দীর্ঘ সেই না, প্রতিধ্বনি তুলে গুমরোতে লাগল বুকের মধ্যে। হঠাৎ এইভাবে কেউ নেমন্তন্ন করলে তিনি তো কখনও কোথাও যাননি। অচেনা কারুর আতিথ্য গ্রহণ করতে তার অত্যন্ত অস্বস্তি হয়। এখন, এমনকী মানসীর কথা ভেবেও তিনি রাজি হতে পারছেন না।
মানবেন্দ্র যদি ঠিক এই রকম একটি গল্প লিখতেন, অর্থাৎ নিজেই হতেন একটি গল্পের চরিত্র, তাহলে এই রকম জায়গায় ঠিক এই রকম কোনও ঘটনা ঘটত না। কেউ এসে তাকে অনুরোধ করত না চা-বাগানে আতিথ্য নেবার জন্য।
বাস্তবে অনেক উদ্ভট ব্যাপার ঘটে। এক নজর দেখেই একটি ছেলে বা মেয়ে পরস্পরের দিকে আকৃষ্ট হতে পারে। কিন্তু গল্পের মধ্যে এর জন্য অনেক প্রস্তুতির দরকার হয়। এখানে বাস্তবের এই উদ্ভট পরিস্থিতিকে মানবেন্দ্র যুক্তিতে প্রত্যাখ্যান করলেন।
তিনি বললেন, আপনাদের সঙ্গে যেতে পারলে তো খুবই ভাল লাগত, কিন্তু আমি এখানে বেশ কিছুদিন চুপচাপ থাকব বলেই এসেছি।
গৌতম বলল, আমাদের ওখানেও কিন্তু আপনার বিশ্রামের কোনও ব্যাঘাত হবে না। আপনি গেলেই বুঝতে পারতেন, খুব শান্ত জায়গা, আপনার থাকার জায়গা একদম আলাদা হবে। যদি ইচ্ছে মতে বেড়াতে চান, জিপ গাড়ি আছে।
মানবেন্দ্রর ঠোঁটের পাশে একটা চাপা হাসি দেখা দিল। এরা আমাকে এত খাতির করছে কেন? এরা কি জানে, আমার মনের মধ্যে একটা শয়তান লুকিয়ে আছে? আমি স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই চিন্তা করিনি। আমি যদি তোমাদের সংসারে অশান্তি এনে দিই?
মানবেন্দ্র বললেন, আচ্ছা, জানা রইল, পরে কোনও এক সময়– ।
কেন, এখনই চলুন না।
মানবেন্দ্রর ইচ্ছে হল, গর্জন করে বলে ওঠেন, তুমি জানো, আমি পাগল! আমি কখন কী করে ফেলব তার ঠিক নেই। আমি উপযুক্ত নই তোমাদের সমাজের। আমি পতিত।
তার বদলে তিনি দুবার ঘাড় হেলিয়ে বললেন, না, থাক।
গেলে কিন্তু আপনার ভাল লাগত। আমাদেরও খুব ভাল লাগত। আপনার সঙ্গে দেখা হল, অথচ ভাল করে গল্প করা হল না। পাঠকদের তো অনেক কৌতূহল থাকে লেখকদের সম্পর্কে।
আবার বহুবচন।
মানবেন্দ্র বললেন, আমাকে যারা চেনেনা, আমি তাদের সঙ্গে মিশইে ভালবাসি। বেশি লোকজনের মধ্যে আমি কীরকম যেন গুটিয়ে যাই।
অনুরাধা আপনার সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী।
সুন্দরী মেয়েদের সংস্পর্শ আমার খুবই ভাল লাগে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কী, তাদের প্রত্যেকেরই আগে থেকে স্বামী কিংবা প্রেমিক আছে।
গৌতম হো-হো করে হেসে উঠল। তারপর বলল, লেখকরা বুঝি প্রেমিক বা স্বামী হয় না? তারা অন্য কিছু হয়?
মানবেন্দ্র এক চুমুকে নিজের গেলাসটা শেষ করে চুপচাপ বসে রইলেন। বোতলটাও শূন্য।
গৌতম বলল, আমি এক্ষুনি আসছি।
অবিলম্বে সে ফিরে এল আর একটা জিনের বোতল হাতে নিয়ে। বিনীত ভাবে বলল, আমার কাছে সামান্য কিছু ছিল।
অসম্ভব ভদ্র ও বিনীত এই যুবকটি। চা-বাগানের কুলিকামিন বা অফিসের কেরানিদের সঙ্গেও কি সে ঠিক এই রকম ব্যবহার করে? নাকি তখন অন্য একটা মুখোশ পরে নেয়? মানবেন্দ্রকে যদি ও লেখক হিসেবে না চিনত, তাহলে কীরকম ব্যবহার হত ওর? চা বাগানের ম্যানেজারের বই-টই পড়ার সময় হয় কী করে? ও, বুঝেছি, ওর নিজেরই তো এক সময় লেখার বাতিক ছিল।
মানবেন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, আপনি নিজে এখন আর কিছু লেখেন না?
আগের দিনের মতো গৌতম এখন আর তেমন লজ্জা পেল না। নতুন গেলাসে চুমুক দিয়ে সে পরিষ্কার ভাবে বলল, লেখক হবার সাধ্য আমার নেই, এটা আমি জেনে গেছি। এক সময় শখ ছিল। তবে, এখনও আমি লিখি, একটাই গল্প, বার বার লিখি, প্রতি বছর নতুন করে লিখে যাই। কোনও দিন সেটা ছাপা হবে না, কেউ সেটা পড়বে না, মানে আমি কারুকে পড়াতেও চাইনা–
তবে লেখেন কেন?
নিজের আনন্দের জন্য!
মানবেন্দ্র ভাবলেন, বাঃ, এটা বেশ একটা শাশ্বত উত্তর। মানুষ লেখে কেন? আনন্দের জন্য। কিন্তু সবসময় এটা ঠিক নয়। ডস্টয়েভস্কি অনেকগুলো লিখেছেন শুধু পয়সার জন্য। কেউ লেখে আদর্শবাদ প্রচারের জন্য। অনেক সময় একদম লিখতে ইচ্ছে করে না, তবু লিখতে হয়। তিনি প্রথম যৌবনে লিখতে শুরু করেছিলেন শুধু অন্য কয়েকজনকে বোঝাবার জন্য, দ্যাখ, আমিও লিখতে পারি। এটা কি আনন্দ না আত্মশ্লাঘা?
বাঃ, আমাদের বাদ দিয়ে?
দরজার কাছ থেকে গৌতমকে এই কথা বলল হিরন্ময়। সঙ্গে অসীমও এসেছে।
মানবেন্দ্র বললেন, আসুন, ভেতরে আসুন।
ওরা দুজনে খাটে এসে বসল। অসীম বলল, উঃ, কী দারুণ ঠাণ্ডা পড়েছে আজ। হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে একেবারে।
হিরন্ময় গৌতমকে জিজ্ঞেস করল, কী খাচ্ছিস রে? জিন? এই ঠাণ্ডায় ব্র্যান্ডি হলে জমত।
গৌতম বলল, ব্রান্ডি আছে তো, নিয়ে আয়। অসীম, তোর ঘরেই তো আছে।
অসীম উঠে গেল আনতে।
হিরন্ময় বলল, আপনার সঙ্গে পরিচয় হবার পর আমরা একটু লুকিয়ে-চুরিয়ে খাচ্ছিলাম, যদি আপনি কিছু মনে করেন। আমি অবশ্য ওদের বলেছিলাম, অনেক রাইটারই ড্রিঙ্ক করে। কী, ঠিক বলিনি? রবীন্দ্রনাথ ড্রিঙ্ক করতেন না?
মানবেন্দ্র বললেন, তাতে কিছু আসে যায় না।
গৌতম বলল, রবীন্দ্রনাথ কক্ষনও ড্রিঙ্ক করেননি।
হিরন্ময় বলল, তুই কী করে জানলি? অতবড় জমিদার ফ্যামিলি –।
রবীন্দ্রনাথ সব ব্যাপারেই আলাদা ছিলেন।
তোরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করিস। ড্রিংক করলেই বা দোষের কী আছে! সব লেখককেই ড্রিঙ্ক করতে হয়, কিংবা কোনও একটা নেশা, ওদের নার্ভকে রিলাক্স করাবার জন্য।
হিরন্ময় হঠাৎ নিজের কথা থামিয়ে মানবেন্দ্রকে সাক্ষ্য মেনে জিজ্ঞেস করল, আপনি বলুন না, রবীন্দ্রনাথ ড্রিংক করতেন না? শরৎবাবু ড্রিংক করতেন না?
মানবেন্দ্র বললেন, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সেরকম কিছু জানা যায় না। ওঁর বাড়ির প্রাইভেট টিউটর লরেন্সকে উনি নিজের বাড়ি থেকে এক বোতল মদ পাঠিয়েছেন বটে, কিন্তু নিজে কখনও খেতেন কি না তার উল্লেখ নেই। তার আগে বঙ্কিমচন্দ্র খেতেন। বঙ্কিমচন্দ্র তার নৈহাটির বাড়িতে মাঝে মাঝে মদের আসর বসাতেন, যেখানে আসতেন নবীন সেন ইত্যাদি। শরৎচন্দ্রও দিশি মদ খেতে ভালবাসতেন। তার পরের আমলেও অনেকে যদিও খেতেন-টেতেন, কিন্তু লেখার মধ্যে সেটা গোপন করে গেছেন, মানিকবাবু ছাড়া।
আবার আমি এমন অনেক লেখককে জানি, যাঁরা এ জিনিস কখনও স্পর্শ করেন না। তাতে কিছু যায় আসে না। লেখার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্কই নেই। লেখকরাও তো অনেকটা মানুষের মতোই এক ধরনের প্রাণী। মানুষ যেমন নানা রকম হয়, লেখকরাও সে-রকম হতে পারে।
গৌতম বলল, তবু আমার মনে হয়, লেখক-শিল্পীরা ঠিক সামাজিক মানুষের মতো হতে পারে না। এমন একটা কাজে তারা নিজেদের জীবনীশক্তি ব্যয় করে, যার বিনিময়ে কী পাবে তারা জানেনা। তাছাড়া লেখার সময় অত্যন্ত বেশি মনঃসংযোগ করতে হয় বলেই অন্য সময় তাদের মনটা খুব ছটফটে থাকে, নিয়মকানুনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে না। কি, আমি ঠিক বলছি?
মানবেন্দ্র অন্য মনস্ক ভাবে উত্তর দিলেন, কী জানি!
হিরন্ময় বলল, আচ্ছা, আজকালকার অন্য সব লেখকের সঙ্গে আপনার আলাপ আছে?
মুখ চেনা আছে।
লেখকদের মধ্যে আপনার বন্ধু কেউ নেই?
এক সময় ছিল।
লেখকদের কাছে আমাদের একটা প্রশ্ন আছে। দেশের এই যে অবস্থা, কিছু শকুন দেশের অধিকাংশ মানুষকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে, চারদিকে শুধু কালোবাজার আর কালো টাকার খেলা, মানে আমি বলতে চাইছি, দেশটা একেবারে উচ্ছন্নে যাচ্ছে, একটা টোটাল অরাজকতা। এই সম্পর্কে আপনারা লিখতে পারেন না? আপনারা যদি চাবুক মেরে জাগিয়ে তোলেন এই পচা-গলা সমাজটাকে, কিন্তু তার বদলে আপনার শুধু প্রেমের গল্প লেখেন কিংবা অ্যাডভেঞ্চার।
মানবেন্দ্র দুঃখিত ভাবে তাকালেন হিরন্ময়ের দিকে। এই সব কথা যদি একটা স্কুলে বা কলেজের ছেলে বলত, তাহলে মানাত। অল্প বয়সে আদর্শবাদটা আন্তরিক থাকে, মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা ভেবে সত্যিই কষ্ট হয়। কিন্তু সাহেবি কোম্পানিতে ভাল চাকরি করে যে-লোক, ডাকবাংলোয় বসে মদের গেলাস হাতে নিয়ে তার মুখে এই সব কথা যে অত্যন্ত অশ্লীল শোনায়, সে জ্ঞান এর নেই। অধিকাংশ মানুষেরই ঔচিত্যবোধ থাকে না। সাধে কী আর এর নাম ভিলেজ ইডিয়ট দিয়েছিলেন।
মানবেন্দ্ৰ হাত জোড় করে বললেন, এই দেশের দুঃখ-দুর্দশা ঘোচাবার কাজে আমি কিছুই করতে পারিনি, সেজন্য আমাকে ক্ষমা করুন।
মানবেন্দ্রর কণ্ঠস্বর এমন তীব্র যে হিরন্ময় একটু হকচকিয়ে গেল। তারপর বলল, না না, আপনি ক্ষমা চাইছেন কেন? আমি সেভাবে বলিনি।
আপনি একটা অভিযোগ করেছেন, সেই জন্যই আমি ক্ষমা চাইছি। আমি পারিনি, কী করব বলুন। এ-জন্য আমাকে যদি কিছু শাস্তি পেতে হয়–
হিরন্ময় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, গৌতম তাকে বাধা দিয়ে বলল, লেখকদের কাছ থেকে এ রকম দাবি করা যায় কি না, সে সম্পর্কে কিন্তু আমার সন্দেহ আছে। কোনও কোনও লেখক বা কোনও কোনও বই সমাজ পরিবর্তনে কিছু সাহায্য করেছে বটে, কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের কাছ থেকে আমরা আনন্দই পেতে চাই। শুধু বড় বড় সামাজিক আদর্শের কথা মনে রেখে যেগুলো লেখা হয়, সেগুলো বেশির ভাগই অপাঠ্য। সেগুলো শিল্পও হয় না, আবার তা দিয়ে সমাজের উপকারও হয় না।
হিরম্ময় বলল, অধিকাংশ মানুষের জীবনেই যদি কোনও আনন্দ না থাকে, তাহলে আর্ট থেকে আনন্দ পাবে কী করে?
তা-ও পেতে পারে।
তুই বলতে চাস, লোকে যখন খেতে পাচ্ছে না– ।
তখন সে বইও পড়বে না। কোনও বই-ই মানুষকে খেতে দিতে পারবে না।
পৃথিবীতে এমন অনেক বই লেখা হয়েছে, যা দিয়ে
বই আর সাহিত্য এক নয়। যেমন রাইটার্স বিল্ডিং কথাটার মানে সাহিত্যিকদের বাড়ি নয়। যে কোনও লেখা আর সাহিত্য এ দুটো আলাদা ব্যাপার কথা হচ্ছে, আমরা যাকে সাহিত্য বলি, তার কাছ থেকে কী আশা করি? আমার সোজা কথা, যে-বই পড়ে আমি আনন্দ পাবনা, সে বই আমি পড়তে চাইব না। জোর করে কি কারুকে বই পড়ানো যায়?
মানবেন্দ্রর সর্বাঙ্গে যেন অজস্ৰ সঁচ ফুটছে। জীবনে অন্তত হাজার বার তিনি এই ধরনের তর্ক বা আলোচনার মধ্যে পড়েছেন। তিনি জানেন, এর কোনও মীমাংসা নেই। এখানেও তিনি এই আলোচনা একটুও চান না, এখানে তিনি নির্জন মনকে শান্ত করার জন্য এসেছিলেন।
অসীম আগাগোড়া চুপচাপ বসে আছে। সে বই-টই বিশেষ পড়ে না। সে বুদ্ধিমান বলেই, যে সম্পর্কে জানে না, সে-সম্পর্কে কথাও বলতে চায় না।
অসীম তার বন্ধুদের বলল, তোরাই তো শুধু কথা বলছিস, ওনাকে কিছু বলতে দে।
মানবেন্দ্র অসীমের দিকে তাকিয়ে বললেন, না না, ঠিক আছে। সাহিত্য কীরকম হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে সাহিত্যিকরা কিছু জানে না, অন্যরাই ভাল জানে।
গৌতমের তর্কের নেশা লেগে গেছে, সে গলা চড়িয়ে হিরন্ময়কে বলল, ওসব বাজে কথা রাখ। আমি একটা উদাহরণ দিচ্ছি–ঘরেও নহে, পারেও নহে, যেজন আছে মাঝখানে, সন্ধ্যাবেলা কে ডেকে নেয় তারে–এই লাইনটার অন্য আর কী মূল্য আছে। এরকম লাইন মানুষের দুঃখ-দারিদ্র ঘোচায় না, কিন্তু শুনলেই মনের মধ্যে যে একটা অদ্ভুত ভাব জেগে ওঠে, সেটাই এর আসল মূল্য।
গৌতম তার উৎসাহিত উজ্জ্বল মুখখানা ঘোরাল মানবেন্দ্রর দিকে।
মানবেন্দ্র বললেন, স্বীকার করতেই হবে। চা-বাগানের ম্যানেজার হিসেবে আপনি এক্সেপশনাল।
গৌতম লজ্জা পেয়ে গেল এ কথায়। মিনিট খানেক চুপ করে রইল সবাই। এক-এক সময় হয় এ-রকম, যখন ঘরের সবাই হঠাৎ একসঙ্গে চুপ করে যায়, শুধু শোনা যায় ঘড়ির টিকটিক শব্দ।
সে নিস্তব্ধতা ভাঙার আগেই এসে পড়ল অনুরাধা। সে দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, বাঃ, তোমরা এখানে আড্ডা জমিয়ে বসেছ, আমাদের ডাকোনি যে?
অসীম বলল, তোমরা তো বাচ্চাদের ঘুম পাড়াচ্ছিলে।
বেড়াতে এসেও আমরাই বাচ্চাদের সামলাব, আর তোমরা আড্ডা মারবে!
ঠিক আছে, এবার তোমরা আড্ডায় বসো, আমরা বাচ্চাদের দেখতে যাচ্ছি।
বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে।
মানসী কোথায়?
কী জানি, বাচ্চাদের সঙ্গে সঙ্গে ও নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল কিনা!
মানবেন্দ্র অনুরাধাকে বললেন, আপনি ভেতরে আসুন।
অনুরাধা ঘরে ঢুকে চারদিকটা একবার দেখে নিল। তারপর বলল, আপনার ঘরটায় ব্যাচিলার ব্যাচিলার গন্ধ।
মেয়েদের ঘ্রাণশক্তি বিখ্যাত। কোনও কোনও নারীর আরও বেশি থাকে। মানবেন্দ্র তাকালেন অনুরাধার দিকে। তীক্ষ্ণনাসা নারী। ভুরু দুটো আরও সুদৃশ্য। মানবেন্দ্র লক্ষ্য করলেন, তারহাত কাঁপছে না, বুকের মধ্যেও ঢিপ ঢিপ করছেনা। তিনি নিশ্চিন্ত হলেন।
গৌতম বলল, আমি মানসীকে ডেকে আনি। ও বেচারা একা একা রয়েছে।
অনুরাধা বিচিত্র ভাবে তাকাল স্বামীর দিকে। কিন্তু গৌতমের সঙ্গে তার চোখাচোখি হল না। গৌতম বেরিয়ে গেল।
অনুরাধা বিছানায় বসতে দ্বিধা করছে বোধহয়। অনাত্মীয় পুরুষের বিছানায় মেয়েরা সহজে বসে না, এ ব্যাপারে তাদের একটা কুসংস্কার আছে।
মানবেন্দ্র তাড়াতাড়ি নিজের চেয়ারটা ছেড়ে দিয়ে বললেন, আপনি এখানে বসুন।
অনুরাধা সেখানে বসে বলল, আপনি ওদের অনেক গল্প শোনালেন বুঝি? আমাকে একটা বলুন।
আমি নিজেই ওদের গল্প শুনছিলাম।
ওদের আবার গল্প কী?
প্রত্যেক মানুষের জীবনেই তো একটা করে গল্প থাকে?
থাকে বুঝি? আমার গল্পটা কী বলুন তো?
আমি তো জ্যোতিষী নই। আপনিই বলুন।
আমারও একটা গল্প আছে ঠিকই, কিন্তু আমি তো সাহিত্যিক নই, কী করে বলতে হয় জানি না।
মুখে মুখে গল্প বলার জন্য সাহিত্যিক হওয়ার দরকার হয় না। আপনি বলুন। আমরা উদগ্রীব।
শুনবেন? একটি মেয়ের যখন চোদ্দো বছর বয়েস, তখন সে একসঙ্গে দুটি ছেলের প্রেমে পড়ে। এক জন তার মাসতুতো ভাইয়ের বন্ধু আর এক জন বাবার বন্ধুর ছেলে। দুজনেই খুব হ্যান্ডসাম। দুজনেই লেখাপড়ায় ভাল। মেয়েটি যখন উনিশ বছর বয়েস হল, তখন প্রশ্ন জাগল যে, এই দুজনের মধ্যে কাকে সে বিয়ে করবে। দুজনের এক জনকে বেছে নেওয়া খুবই শক্ত। একটি মেয়ে তো এক সঙ্গে দুজনকেই বিয়ে করতে পারে না।
কথা বলতে বলতে অনুরাধা বার বার তাকাচ্ছে দরজার দিকে। পা দুটো দোলাচ্ছে। তার মুখে একটু যেন বেশি উত্তেজনা। গল্পের মাঝখানে বাধা দিয়ে মানবেন্দ্র বললেন, একসঙ্গে দুজনকে বিয়ে করার ব্যাপারটাও কিন্তু মন্দ না। আবার চালু করে দিলেই হয়!
অনুরাধা বলল, সে যাই হোক, এই মেয়েটির বেলায় তো আর তা হয়নি! এক জনকেই বিয়ে করতে হল। এবং বিয়ের পরদিন সে বুঝতে পারল, ভুল করেছে। অন্য ছেলেটিকে পেলেই সে সুখী হতে পারত।
অসীম বলল, মেয়েটি যদি প্রথম ছেলেটির বদলে দ্বিতীয় ছেলেটিকে বিয়ে করত, তাহলেও হয়তো তার ওই একই কথা মনে হত। এ-রকম হয়।
অনুরাধা বলল, মোটেইনা। মানুষ শুধু এক জনকেই ভালবাসতে পারে, দুজনকে না!
মানবেন্দ্র বললেন, আমি জ্যোতিষী নই। কিন্তু আমি এটুকু অন্তত বুঝতে পারি, এটা আপনার জীবনের গল্প নয়।
অসীম বলল, এ দুজন ছেলের মধ্যে এক জন রয়ে গেল প্রেমিক, আর একজন স্বামী। স্বামীদের তুলনায় প্রেমিকরা সব সময়েই জিতে যায়। তাই না! কী রে হিরন্ময়, তুই কী বলিস।
আমি কী করে জানব?
তুই তো স্বামী হোসনি এখনও।
অনুরাধা বলল, উনি তো প্রেমিকও হননি।
হিরন্ময় অবাক হবার ভান করে বলল, সে কী? আমাকে এতই অযোগ্য মনে হয়?
আপনাকে দেখলেই কী-রকম যেন ভাই ভাই মনে হয়।
কী সাংঘাতিক কথা, আমার তাহলে কোনও চান্স নেই?
অনুরাধা মানবেন্দ্রর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আপনি নিশ্চয়ই অনেক প্রেম করেছেন? মেয়েদের ভালভাবে না জানলে তাদের সম্পর্কে লিখবেন কী করে?
মানবেন্দ্র বললেন, আমি অনেক মেয়ের প্রেমে পড়লেও মেয়েরা কেউ আমার প্রেমে পড়েনি। ঘন্টায় ষাট মাইল স্পিডে গাড়ি যাচ্ছে, তার মধ্যে বসে থাকা একটি মেয়েকে এক পলকের জন্য দেখেই এত প্রেমে পড়েছিলাম তার যে, সাত দিন ভাল করে খেতে পারিনি।
আহা, মেয়েটা যদি জানতে পারত!
এই সময় গৌতম ফিরে আসতেই অনুরাধা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ভাগ্যিস তুমি ফিরতে দেরি করলে, তাই এর ফাঁকে আমি ওঁকে একটা গল্প শুনিয়ে দিলাম।
গৌতম বলল, দেরি করিনি তো। মানসী আসতে চাইল না। ও বলছে, ওর খুব খিদে পেয়েছে।
গেলাসে ব্রান্ডি ঢেলে গৌতম দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে সেটা জল-টল না মিশিয়েই শেষ করল এক চুমুকে। তারপর তাকাল আবার এ-দিকে। তার মুখের চামড়ায় অতিরিক্ত রক্তের ঝলক।
অনুরাধার ঠোঁটে লুকোনো হাসি, সে স্বামীর দিকে চেয়ে আছে একদৃষ্টে। গৌতম বলল, শোনো, উনি কিন্তু আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হচ্ছেন না।
অনুরাধা মানবেন্দ্রকে বলল, আপনি যাবেন না আমাদের সঙ্গে?
না।
কেন? চলুন না। অনেক গল্পের খোরাক পাবেন।
আমার এখানে কাজ এখনও বাকি আছে।
কাজ? আপনি কি এখানে কাজ করতে এসেছিলেন নাকি?
এখানে আকাশ আর বাতাসের সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। এখনও সেটা শেষ হয়নি।
অনুরাধা নিচের ঠোঁটটা কামড়ে মধুর ভাবে তাকাল। মানবেন্দ্র একটু লজ্জা পেয়েছেন। তিনি একটু সাজিয়ে কথা বলছেন এদের সঙ্গে। এ-রকম আর্ট করে কথা বলা তার একদম স্বভাব নয়।
অনুরাধা বলল, দাঁড়ান, মানসীকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ও আপনাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাবে।
অনুরাধা কী করে বুঝল, মানসীই একমাত্র জোর করে মানবেন্দ্রর ওপরে। কিংবা মানবেন্দ্র ওর কথা অবহেলা করতে পারবেন না।
মানবেন্দ্র বললেন, নেমন্তন্ন তো রইলই, অন্য কোনও সময় —
অসীম এমনিতেই কম কথা বলে। সে প্রায় চুপ করেই বসে ছিল। কিন্তু তার গ্লাসই ঘন ঘন শেষ হচ্ছে। মনে হয়, এদের মধ্যে তারই মদের নেশা বেশি। যদিও সে কোনও রকম মাতলামি করে না, উত্তেজনা দেখায় না। কিন্তু তার চোখ দুটি লালচে হয়ে এসেছে, মাথার চুলগুলো খাড়া খাড়া।
অনুরাধাই অসীমকে এক সময় ধমক দিয়ে বলল, এই, তুমি এত বেশি খাচ্ছ কেন?
অনুরাধা তার স্বামীর মদ্যপান সম্পর্কে তেমন আপত্তি না জানিয়ে বকছে অসীমকে। সাধারণত উলটোটাই হয়। তবে, গৌতম বোধহয় কখনও মাত্রা ছাড়ায় না, এবং তার স্ত্রী সেকথা জানে।
অসীম অনুরাধার বকুনি গ্রাহ্য না করে আবার গেলাসে ঢালল অনেকখানি। অনুরাধা কেড়ে নিল গেলাসটা। অসীম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ও কী করছ, দাও! বেশ পা টলছে অসীমের।
মানবেন্দ্র ওদের দিকে সহাস্য মুখে তাকিয়ে রইলেন। সামান্য ব্যাপার, বাইরে বেড়াতে এসে এ রকম হয়ই। মানসী এখানে থাকলেও কি অসীম এতটা মদ্যপান করত?
একটু পরেই গৌতম বলল, চলল, এখন খেয়ে নেওয়া যাক। পরে আবার আড্ডা দেওয়া যাবে।
সবাই উঠে দাঁড়াল। মানবেন্দ্র বললেন, আপনারা যান, আমি একটু পরে আসছি।
মানবেন্দ্র ঠিক করেই ফেলেছেন, রাত্রে কিছু খাবেন না। ব্রান্ডির স্বাদটা জিভে চমৎকার লাগছে, খাদ্যদ্রব্যের মতো আজেবাজে জিনিস দিয়ে এটা নষ্ট করা উচিত নয়।
মানসী এ ঘরে আসেনি বলে মানবেন্দ্র একটুও দুঃখিত হননি। বরং মনে মনে একটু মজা পাচ্ছেন। সবাই যখন এই ঘরে, তখন মানসীর আলাদা ভাবে একা একা থাকার একটা তাৎপর্য আছে। তুমি ঠিকই করেছ। তোমাকে তো আমি ভিড়ের মধ্যে চাই না।
মানবেন্দ্র দেখলেন, গৌতমদের রেখে যাওয়া ব্র্যান্ডির বোতলে এখনও কিছুটা রয়েছে। তিনি উঠে গিয়ে গেলাসে আর একটু ঢাললেন। একটা ব্যাপার অন্তত বিস্ময়কর। মানবেন্দ্র এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। কোনও রকম অসংবদ্ধতা নেই চিন্তায়। শরীরে ছটফটানি নেই। এটা কি অনেকখানি বাদে মদ্যপানের ফল? ব্যাপারটা খুব বিপজ্জনক তাহলে। পাগলের পক্ষে কোনও রকম উত্তেজক পদার্থ গ্রহণ করা একেবারে নিষিদ্ধ। আজকের সুস্থতা তাকে আরও কোনও ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে টানছে।
একটা ঠকঠক শব্দে মানবেন্দ্র চমকে তাকালেন। ঠিক যেন দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু এ রকম গোপন সংকেতে কে তাকে ডাকবে? দরজা খুলে কারুকে দেখতে না পেয়েও মানবেন্দ্র অবাক হলেন না। মানসী এ-ভাবে আসবে না।
আবার সেই রকম শব্দে হতেই মুখ ফিরিয়ে তিনি দেয়ালের দিকে তাকালেন। প্রায় ঘুলঘুলির কাছে মাফিয়া টিকটিকিটা মথটাকে ধরে ফেলেছে। অত বড় মথটাকে মারবার জন্য সে দেয়ালের গায়ে ঠুকছে বার বার। এ-রকম করে ওরা। মথটাকে শেষ পর্যন্ত মরতে দেখে তিনি নিশ্চিত হলেন। ও তো মরতেই এসেছিল। কোনও সুন্দর জিনিসই বেশিক্ষণ থাকে না। অন্য দিকে শাইলক আর বেহুলা খুব কাছাকাছি। ওদের প্রণয় আসন্ন।
মানবেন্দ্র দেশলাইটা ছুঁড়ে মারলেন মাফিয়ার দিকে। ওর গায়ে লাগল না অবশ্য। মাফিয়া তার ভাঁটার মতো চোখে কটমট করে তাকাল মানবেন্দ্রর দিকে। তারপর বীরদর্পে সরে গেল খানিকটা। ফুলের পাপড়ির মতো মথটার ডানা টুকরো টুকরো করে খসে পড়ছে।
মানবেন্দ্র তাড়াতাড়ি টেবিলের কাছে গিয়ে প্যাড খুলে বড় বড় অক্ষরে লিখলেন, মহারানির মৃত্যু। যেন এই নামে তিনি এক্ষুনি একটা রচনা শুরু করলেন। শিরোনামের তলায় কলমটা ঘষলেন কয়েকবার। তারপর লিখলেন, আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।
লাইনটা লিখেই তার ভুরু কুঁচকে গেল। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের লাইন লিখলেন কেন? তার নিজের চিন্তা প্রকাশ করার জন্যও কি রবীন্দ্রনাথের ভাষা দরকার? তার নিজস্ব ক্ষমতা কি শেষ হয়ে গেছে? চেষ্টা করেও মানবেন্দ্র একটাও নতুন লাইন ভাবতে পারলেন না?
কলমটা ছুরির মতো হাতে ধরে মানবেন্দ্র ভাবলেন, এই কি সেই মুহূর্ত? রথের চাকা বসে যাচ্ছে মাটিতে, আমি সব মন্ত্র ভুলে গেছি? ।
মানবেন্দ্র বিড় বিড় করলেন, আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।
তারপর বললেন, না, এসর্বনাশ পুরুষের নয়, নারীর। আমার নয়। আমি তো সর্বনাশের আশা নিয়ে কখনও বসে থাকব না, নিজেই নিজের সর্বনাশ করে যাব।
পাতাটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে দিলেন জানলা দিয়ে। পরমুহূর্তেই তিনি নিজেকে ভীষণ একাকি বোধ করলেন। শীতের চেয়েও এই একাকিত্ব যেন বেশি শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
সমস্ত ব্রান্ডিটা শেষ করে মানবেন্দ্র বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। দ্রুত খাবারের ঘরের দিকে এসে দেখলেন, ওদের খাওয়া সদ্য শেষ হয়েছে, ওরা বেসিনের কাছে জড়ো হয়েছে হাত ধোওয়ার জন্য। অসীমের কণ্ঠস্বর বেশ জড়ানো। কী যেন বলছে তাকে মানসী।
মানবেন্দ্র আর সেখানে ঢুকলেন না। তিনি টুরিস্ট লজ থেকে বেরিয়ে এসে হাঁটতে লাগলেন হন হন করে। কোন দিকে যাচ্ছেন খেয়াল নেই। পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বার করে মুঠো পাকিয়ে ধরে আছেন ডান হাতে।
ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে মানবেন্দ্র হোঁচট খেতে খেতে এগোচ্ছেন। খানিকটা বাদে পৌঁছে গেলেন পাথুরে এবড়োখেবড়ো জায়গাটায়। যার পর থেকে জমিটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। সেই ঢালু জমিতেও খানিকটা নেমে মানবেন্দ্র দশ টাকার নোটটা বস্তির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, মুনিয়ার মা, তোমার মেয়েকে দুধ কিনে খাইও।
কথাটা বললেন বেশ চেঁচিয়ে নিজের গলার আওয়াজটা কানে আসতেই তিনি সজ্ঞানে এলেন। একটু চমকে ওঠার পর বোধ করলেন খানিকটা স্বস্তি ও আনন্দ। যাক, পাগলামির ধাতটা ব্র্যান্ডিতে সম্পূর্ণ যায়নি। বদ্ধ পাগল ছাড়া কেউ এ-রকম ভাবে টাকা দিতে আসে না। টাকাটা ছুঁড়ে দেওয়ার চেয়েও বড় কথা এই সময় এই ঝোঁক চাপা। সন্ধেবেলার কোনও ঘটনার সঙ্গে তো এর যোগ নেই। সাধারণ মাতালরাও এ-রকম করে না।
পকেট থেকে দেশলাই বার করে জ্বেলে মানবেন্দ্র খুঁজতে লাগলেন টাকাটা। এ-রকম ভাবে খেয়ালের বশে টাকা ছুঁড়ে ফেলা তাকে মানায় না। তিনি গরিবের ছেলে। এখন অবস্থা সচ্ছল হলেও টাকার মর্ম বোঝেন।
টাকাটা খুঁজে পেয়ে মানবেন্দ্র ফিরতে লাগলেন আবার। এবার গতি অত্যন্ত ধীর। বিষম শ্রান্ত লাগছে। মুখখানা খুব বিষণ্ন হয়ে গেছে। কিছুই করার নেই এক জন মানুষের।
টুরিস্ট লজে ফিরে মানবেন্দ্র দেখলেন সব ঘরের আলো নিবে গেছে। সারা রাত জেগে আড্ডা দেবার পরিকল্পনাটা পরিত্যক্ত। অসীমের বেশি নেশা হয়ে গেছে বলেই বোধহয় তাকে ঘুম পাড়ানো দরকার। কিংবা ওরা মানবেন্দ্রর খোঁজ করে পায়নি। মানবেন্দ্র বুঝলেন, আজ আর বেশিক্ষণ জেগে থাকার ক্ষমতা নেই তার।
পা থেকে জুতোও খুললেন না, ঝুপ করে এসে পড়লেন বিছানায়। এবং বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলেন।