সংসারে এক সন্ন্যাসী – উপন্যাস – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সকালবেলা ঘুম ভাঙার পরই মানবেন্দ্রর মনে পড়ল প্রজাপতিটার কথা। তিনি মাথা ঘুরিয়ে ডান পাশে তাকালেন। প্রজাপতিটা এখনও নিথর নিস্পন্দ হয়ে দেয়ালের গায়ে লেপটে আছে। গুণ্ডা টিকটিকিটা ধারেকাছে কোথাও নেই।
প্রজাপতি নয়, মথ। বেশ বড়, দুই ডানার বিস্তৃতি প্রায় তিন ইঞ্চি, গাঢ় বেগুনি ভেলভেটের মতো গা। প্রাণীটি বড়ই শান্ত এবং সুন্দর। প্রজাপতির চাঞ্চল্য মথের থাকে না। মথের কোনও প্রচলিত বাংলা নামও নেই। কাল রাতে মানবেন্দ্র কিছুক্ষণ শুয়ে চিন্তা করেছিলেন মথের বাংলা ডাকনাম কী হতে পারে। পছন্দমতো কিছু খুঁজে না পেয়ে এক সময় বিরক্ত হয়ে ভেবেছিলেন, আমাকে তো কেউ প্রতিশব্দ খোঁজার দায়িত্ব দেয়নি। আমার মাথা ঘামাবার দরকার কী! যদিও প্রজাপতির মতো মথেরও একটা সুন্দর নাম প্রাপ্য ছিল।
মানবেন্দ্র বিছানা থেকে উঠে এসে একটা জানলা খুলে দিলেন। কাল রাতে খুব শীত ছিল, সব জানলা বন্ধ রাখতে হয়েছিল। এখন টাটকা হাওয়া ঝলকে ঝলকে ঘরে আসে। এবং শরীরের মধ্যেও ঢুকে, মনে হয় যেন রক্ত, শিরা-উপশিরা ধুয়ে দিচ্ছে, পরিচ্ছন্ন করে তুলছে সকালবেলার মানুষকে। মানবেন্দ্র একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বাইরের দিকে। তার জানলার ঠিক নিচেই একটি চন্দ্রমল্লিকা ফুল গরবিনীর মতো ভুরু তুলে আছে। যেন সে মানবেন্দ্রর সঙ্গে কথা বলতে চায়।
মানবেন্দ্র চন্দ্রমল্লিকাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী, ভাল আছ?
হাওয়ায় দুলছে ফুলটি।
মানবেন্দ্র আবার বললেন, রাত্রে কেউ অভিসারে এসেছিল? কাল খুব জ্যোত্সা ছিল আমি জানি।
দরজায় টকটক শব্দ হল। মানবেন্দ্র জানলা থেকে সরে গিয়ে দরজা খুললেন। সাদা উর্দি পরা টুরিস্ট লজের বেয়ারা। সে বিনীত ভাবে জিজ্ঞেস করল, স্যার, বেড টি?
মানবেন্দ্র বললেন, নেহি রামচন্দ্ৰন, এক পট কফি লে আও।
ব্রেকফার্স্ট কেয়া।
কুছ নেই, নো ব্রেকফার্স্ট।
বেয়ারাটি তবু দু’এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে। খাওয়া-দাওয়ার প্রতি সাহেবদের এই অনিচ্ছা তার পছন্দ হয় না। মানবেন্দ্র প্রায়ই কিছু খেতে চান না। অনেক সময় সারাটা দিন ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে বসে থাকেন।
নিজে থেকে সে আর কিছু বলতে সাহস পেল না। একটুক্ষণ দাঁড়িয়েও কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে সে বেরিয়ে গেল।
দরজা ভেজিয়ে দিয়ে মানবেন্দ্র আবার এলেন জানলার কাছে। এই জানালাটি তার খুব প্রিয়। জানলার বাইরে বহু দূর পর্যন্ত শুন্য প্রান্তর, একটা গাছ পর্যন্ত নেই। এদিকে চাষবাস বিশেষ হয় না, রুক্ষ পাথুরেমাটি। কিছুই দেখার নেই, তবু এই বিশাল ব্যাপ্ত শূন্যতা চক্ষুভরায়। দিগন্তের কাছে আবছা পাহাড়ের রেখা। আজ আকাশ মেঘলা। হালকা মেঘের উপচ্ছায়ায় একটি ম্লান দিন সবুজকে ধূসর হতে ডাকে!
তিনি দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে বেগুনি ভেলভেটের মতো মথটিকে বললেন, তুই কেন চুপচাপ বসে আছিস রে?
মথটি কোনও উত্তর দেয় না।
মানবেন্দ্রর ইচ্ছে হয় মথটির ডানায় একবার আঙুল ছোঁয়াতে। ও এমন ভয়হীন ভাবে বসে আছে যে, মনে হয় উড়ে পালাবেনা। কিন্তু প্রজাপতি বা মথকে মানুষ একবার ছুঁলে তারা নাকি আর বাঁচে না। সুতরাং মানবেন্দ্র নিবৃত্ত হলেন।
মানবেন্দ্র আবার জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, তুই কি সারা দিন এখানে বসে থাকবি নাকি? তোর খিদে পায় না?
জানলার পাশ থেকে চন্দ্রমল্লিকা ফুলটি বলল, আমার সঙ্গে তোমার কথা কিন্তু শেষ হয়নি। তুমি চলে গেলে কেন?
মানবেন্দ্র সে-কথা শুনতে পেলেন না। মথটিকে নিয়ে এখন ব্যস্ত।
মানবেন্দ্র ঘাড় ঘুরিয়ে গুণ্ডা টিকটিকিটাকে খুঁজলেন। সেটাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কাল সেই টিকটিকিটা এই মথটিকে খাবার জন্য বহুক্ষণ তাক করে বসে ছিল।
এই ঘরে তিনটি টিকটিকি আছে। এই টুরিস্ট লজটি একটি ছোটখাটো টিলার ওপরে তৈরি। কাছাকাছি আর কোনও বাড়ি নেই। তবু এখানে টিকটিকি কী করে এল সে-সমস্যার সমাধান করা যবে না। মানবেন্দ্র যেহেতু বেশির ভাগ সময়েই ঘরের মধ্যে একা একা থাকেন এবং দেয়ালের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকা তার পুরনো স্বভাব, তাই টিকটিকিদের জীবন সম্পর্কে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ, একথা বলা যায়। তিনি জানেন, টিকটিকিদের মতো এমন যৌনকাতর প্রাণী আর আছে কি না। সন্দেহ। ওদের সমাজে স্নেহ-প্রেম-দয়া-মমতার কোনও অস্তিত্ব নেই, ওরা কেউ কারুর ভাই-বোন পিতা-মাতা, বন্ধু হয় না। দু’টি টিকটিকি কাছাকাছি এলেই পরস্পরকে আক্রমণ করে এবং পালায়। কখনও যে জয়ী হয় সে পরাজিতের টুঁটি কামড়ে ধরে দ্রুত যৌনমিলন সেরে নেয়।
এ ঘরের তিনটি টিকটিকির মধ্যে তিনি একটার নাম রেখেছেন তিনি মাফিয়া। সেটার চেহারা দুর্দান্ত গুণ্ডার মতো। পুরনো ঘিয়ের মতো রঙ, চওড়া বুক টেরাডাকটিলের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে হিংস্র ভাবে তাকায়। সেই টিকটিকিটাকে মানবেন্দ্র বেশ ভয় পান। যারা আরশোলা, টিকটিকি বা মাকড়শা দেখলে আঁতকে লাফিয়ে ওঠে, মানবেন্দ্র সেই জাতের মানুষ নন, তিনি জানেন, টিকটিকির কোনও ক্ষতি করার ক্ষমতা নেই। তবুওই মাফিয়া শুধু তার চেহারাতেই ভয় দেখায়।
অপর একটি টিকটিকির ছিমছাপ পরিচ্ছন্ন চেহারা, একটু দুঃখী দুঃখী ভাব, মানবেন্দ্র একে বেহুলা বলে ডাকেন। কোনও যুক্তি নেই, এমনি মনে পড়েছে নামটা।
তৃতীয় টিকটিকিটা বেরোয় খুব কম, ঘুলঘুলির আশ্রয় ছেড়ে সে কদাচিৎ আত্মপ্রকাশ করে, রোগা লম্বা মতো, এর নাম শাইলক। সর্দার মাফিয়া, বেহুলা এবং শাইলক, এই তিনটি চরিত্র নিয়ে নতুন কোনও কাব্য সৃষ্টি করা যায় কি না, সে-সম্পর্কে মানবেন্দ্র চিন্তা করেন এদের দেখে।
কাল রাত্রে মথটি বড় অদ্ভুত ভাবে এসেছিল। মানবেন্দ্র এক মুহূর্ত আগেও দেখেছিলেন সাদা দেওয়াল, পরের মুহূর্তেই দেখলেন দেয়ালে ডানা মেলে মথটি স্থির হয়ে বসে আছে। ও কখন ঘরে ঢুকল কে জানে। ঠিক যেন ম্যাজিক। মাফিয়াটি ওকে খাওয়ার জন্য তাক করে বসল। মাফিয়ার হাত থেকে ওর নিস্তার পাবার কোনও প্রশ্নই ওঠেনা। মথটি কিন্তু একবারও আর নড়েনি, জায়গা পালটায়নি, মহারানির মতো অভিজাত ভঙ্গিতে আর সব কিছু অগ্রাহ্য করে বসেছিল। তৎক্ষণাৎ তিনি ওর নাম দিলেন মহারানি। নাটকের চতুর্থ চরিত্র।
মানবেন্দ্র একবার ভেবেছিলেন মাফিয়ার সামনে একটা লাঠি নিয়ে নাড়াচাড়া করে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেবেন কিংবা একটু খোঁচা দিয়ে উড়িয়ে দেবেন মথটাকে। এমন একটা সুন্দর জিনিসকে ওই গুণ্ডাটা শেষ করবে, এটা তার পছন্দ হয়নি। পরে আবার ভেবেছিলেন, প্রকৃতির মধ্যে তো প্রতিনিয়ত এই খেলাই চলছে। তিনি সে-খেলা বদলাবার কে? তার চেয়ে দূর থেকে এই খেলার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা অনেক ভাল। হয়তো টিকটিকির খাদ্য হবার জন্যই মথটা উড়ে এসেছে এখানে।
মথটা যে সকালবেলাতেও বেঁচে আছে, সেটাই খুব আশ্চর্যের ব্যাপার। কাল রাতে অনেকক্ষণ ধরে খেলাটা দেখতে দেখতে মানবেন্দ্র কখন একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। মহারানির থেকে মাফিয়া ছিল প্রায় তিন হাত দূরে। অন্য দেয়ালে বেহুলা তখন চুপচাপ উদাসীন। মাফিয়া চুল চুল করে এগোচ্ছে, এই সময় ঘুলঘুলি থেকে বেরিয়ে এল শাইলক, সোজা ছুটে গেল বেহুলার দিকে। ঘাড় না ফিরিয়েও মাফিয়া তা দেখতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যকে ছেড়ে সে-ও তাড়া করে গেল ওই দু’জনের দিকে। ওদের লড়াই মানে তো শুধু ছুটোছুটি, অঙ্গ স্পর্শ খুব কম হয়। অন্য দু’জনকে ঘরের দুই প্রান্তে তাড়িয়ে মাফিয়া আবার মনঃসংযোগ করেছিল মহারানির প্রতি।
বেয়ারা কফি এনেছে। বাইরে কয়েকটি শিশুর কলকণ্ঠ ও ছোটাছুটির আওয়াজ। মানবেন্দ্রর মনে পড়ল, কাল মাঝরাত্রে একটি গাড়ি এসেছে, বিভিন্ন কণ্ঠস্বর শুনে মনে হয়েছিল, বেশ বড় একটি পরিবার। ব্যাপারটা মানবেন্দ্রর পছন্দ হয়নি। এই টুরিস্ট লজটি নতুন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এখনও জনপ্রিয় নয়, মানবেন্দ্র নির্জনতা আশা করেছিলেন।
বিল সই করতে করতে মানবেন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, রামচন্দ্ৰন, কাল কারা এসেছে?
রামচন্দ্রন উৎসাহ দেখিয়ে বলল, বাঙালি ফ্যামিলি, দো ঠো কামরা লিয়া।
বাঙালি শুনে মানবেন্দ্র আর একটু নিরাশ হলেন। জল যেমন জলকে টানে, তেমনি বাঙালি যায় বাঙালির কাছে। ওরা নিশ্চয় তার সঙ্গে আলাপ করতে আসবে।
ভুরু ও মুখ কুঁচকে একটুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন মানবেন্দ্র। তারপর ফস করে একটা চুরুট ধরালেন। আজ সকালে এইটি তাঁর প্রথম ভুল। ঘুম থেকে উঠে মুখ ধোয়ার আগেই চুরুট ধরালে সারা দিন মুখটা বিশ্বাদ হয়ে থাকে।
আড়াই কাপ কফি শেষ করার পর মানবেন্দ্র একটা বই (সোয়ানস ওয়ে, ২য় খণ্ড) নিয়ে আবার বিছানায় ফিরে গেলেন। তিনি নিজের কাছে প্রতিশ্রুতি দিলেন, আজ শুয়ে শুয়েই কাটাবেন সারাটা দিন। চুরুটের ছাই ফেলার অ্যাশট্রের জন্য একবার তাকালেন এ-দিক ও-দিক। অ্যাশট্রেটা রয়েছে একটু দূরে টেবিলের ওপর। আবার উঠে গিয়ে ওটা আনার কোনও মানে হয় না। তার চেয়ে মেঝেতে ছাই ফেলা ভাল। জমাদার আসবে এগারোটার সময়ে।
প্রুস্তের উপন্যাসটির বারো ভল্যুম তিনি কিনেছিলেন অনেক দিন আগে, যে-সময় তার যথেষ্ট টাকার টানাটানি ছিল, যে-সময় ট্রামে বাসে এক দিন টিকিট ফাঁকি দিলে আনন্দ হত। যে-সময় কোনও বন্ধুকে দু’টাকা ধার দিলেও সব সময় মনে থাকত সেই টাকাটার কথা। যাই হোক, অনেক কষ্টে টাকা সংগ্রহ করে বইগুলি কিনলেও পড়া হয়ে ওঠেনি। নিজের কেনা বই সম্পর্কে পড়ার আগ্রহ কম থাকে। অপরের কাছ থেকে চেয়ে আনা বই দ্রুত শেষ হয়ে যায়। প্রথম খণ্ডের বেশি এগোতে পারেননি। এবার ঠিক করেছেন শেষ করবেনই–বিক্রি করে দেবার আগে। আর দু’মাসের মধ্যে মানবেন্দ্র তার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি সব বিক্রি করে দেবেন ঠিক করা আছে।
আর মাত্র দু’মাস সময় আছে তার জীবনটা নিয়ে পরীক্ষা করার। তারপর একটা কিছু হেস্তনেস্ত তো করতেই হবে।
পড়ায় মন বসছে না। বাইরে শিশু, নারী ও পুরুষের নানা রকম কণ্ঠস্বর। বাংলা। টুকরো টুকরো কথা কানে আসে। এক জন কেউ গুন গুন করে দু-এক লাইন গান গেয়ে উঠছে। কোনও নারী। মানবেন্দ্র গানের কথাগুলি শোনার জন্য উৎকর্ণ হলেন।
…আজ কোকিলে গেয়েছে কুহু মুহুর মুহু
আজ কাননে ওই বাঁশি বাজে।
মান করে থাকা আজ কি সাজে।
আজ মধুরে মিশাবি মধু, পরানবঁধু
চাঁদের আলোয় ওই বিরাজে….
বইটা মুড়ে সরিয়ে রাখলেন মানবেন্দ্র। তার ঠোঁটে একটা পাতলা হাসি ফুটে উঠল। অকস্মাৎ আনন্দ পেলে এরকম হয়। কোকিলে গেয়েছে কুহুর পরই মুহু মুহু শব্দটা তো খুব ভালই লাগিয়েছে বুড়ো। এর মধ্যে একটা স্নিগ্ধ বুদ্ধির পরিচয় আছে। অবশ্য এর পরেই ‘আজ কাননে ওই বাঁশি বাজে’ অতি বাজে লাইন। এবং পর পর চার লানে ‘আজ’! কত কবিতায় আর কত গানে যে উনি বাঁশি বাজিয়েছেন, তার আর ইয়ত্তা নেই। আসলে প্রণয় কাব্য লিখতে গিয়ে উনি রাধাকৃষ্ণর ইমেজটা মন থেকে সরাতে পারেননি কখনও। যত মিলন, যত অভিসার, যত বিরহ, সবই রাধাকৃষ্ণ টাইপের।
মেয়েটির গানের গলা ভাল। কীরকম দেখতে? বিছানা থেকে উঠে দরজা খুললেই দেখা যায়। কিন্তু সেটুকু আলস্য কাটাতেও রাজি নন মানবেন্দ্র।
কণ্ঠস্বর শুনে মনে হয়, ওরা লনে চেয়ার পেতে বসেছে। একটি গভীর পুরুষকণ্ঠ শোনা গেল, আর এক কাপ চা হবে নাকি?
আর একটি তরল পুরুষকণ্ঠ :নিশ্চয়ই। চমৎকার ওয়েদার! চলল, এবার বেরোই।
মেয়েটির গান হঠাৎ থেমে গেল। মেয়েটি কারুকে শোনাবার জন্য নয়, আপন মনেই গাইছিল, কিন্তু দু’টি শিশু ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছে। তার পরই কান্না।
মানবেন্দ্র আবার বিরক্তিতে ভুরু কোচকালেন। এই বাচ্চাগুলো খুব জ্বালাবে। যে-নির্জন বিশ্রামের সন্ধানে মানবেন্দ্র এখানে এসেছিলেন, আজ থেকে তা গেল। মানবেন্দ্র বাচ্চাদের পছন্দ করেন না। বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা শহরতলিতে। খোকা ঘুমোলো, পাড়া জুড়োলা—- পরম সত্য এই অমর দুটি লাইন যে রচনা করেছে, সে মহাকবি।
বাইরে গোলমাল বেশি বাড়ছে। নারীকণ্ঠ একজনের নয়, দুজনের, এদের মধ্যে কে গান গাইছিল। ফরাসি সাহিত্যের বিখ্যাত রচনার চেয়েও এই সব কলকণ্ঠ মানবেন্দ্রর মনোযোগ কেড়ে রাখে।
মানবেন্দ্র একটুক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আবার যখন জেগে উঠলেন, তখন সমস্ত বাড়িটা নিস্তব্ধ। ওরা নিশ্চয়ই বেড়াতে গেছে। তার স্নান করার ইচ্ছে হল। শীতের আয়াসে গত দু’দিন স্নান করেননি। আজ শরীরে একটা আঠা-আঠা ভাব। স্নান টান করতে তার প্রায় আধ ঘণ্টা লাগল। বাথরুম থেকে তিনি বেরিয়ে এলেন উলঙ্গ হয়ে। একা বন্ধ ঘরে তিনি অনেক সময়ই উলঙ্গ হয়ে থাকেন। কিন্তু এখন বেশ শীত করছে। তিনি এক জোড়া নতুন কাচা পায়জামা আর পাঞ্জাবি পরে তার ওপর শালটা জড়িয়ে নিলেন। আঃ, এর মতন আরাম আর নেই। টেবিলের কাছে চেয়ারের ওপর পা গুটিয়ে বসে তিনি একটুক্ষণ এই আরামটুকু উপভোগ করলেন। সামান্য খিদেখিদে পাচ্ছে। এই খিদেটাও উপভোগ্য।
দেয়ালে মথটা সেই একভাবেই বসে আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী মহারানি, আজ কি প্রায়োপবেশন নাকি?
মহারানি একটুও বিচলিত হয় না।
না, এর একটা কিছু ব্যবস্থা করা দরকার। মানবেন্দ্র চেয়ার থেকে উঠে এসে মহারানির খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। এর কোনও ভয় পাবার লক্ষণ নেই। এ-রকম ভয়হীন সুন্দর সহজে দেখা যায় না। টিকটিকি তিনটিই আজ সকাল থেকে অদৃশ্য হয়ে আছে কেন কে জানে।
তিনি জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে চন্দ্রমল্লিকাকে বললেন, ভাই, তোমার গাছ থেকে একটা পাতা নিচ্ছি, কিছু মনে করো না।
পাতাটা ছিঁড়ে এনে তিনি মথটার মুখের সামনে দাঁড়ালেন। এই প্রথম সে একটা ডানার কম্পন দেখাল। তারপর বিরক্ত হয়ে স্থান ত্যাগ করে উড়ে বেড়াতে লাগল ঘরের মধ্যে। মানবেন্দ্র তাড়াতাড়ি বাকি দুটি জানলা ও দরজাও খুলে দিলেন, যাতে ও যে-কোনও জায়গা দিয়ে বেরুতে পারে। কিন্তু ওর মতিগতিই অদ্ভুত। এবার ও গিয়ে বসল বেশ উঁচুতে, ঘুলঘুলির পাশে। ওই ঘুলঘুলিতেই টিকটিকিগুলোর বাস। যে-কোনও সময় বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। মথটা কি বাইরে কোথাও যেতে পারত না! যাক, কী আর করা যাবে, ওর নিয়তি! দিনেরবেলা মথেরা কোথায় যায়, মানবেন্দ্র জানেন না।
ঘরে তালা দিয়ে মানবেন্দ্র বেরিয়ে পড়লেন। একতলা, অর্ধ-বৃত্তাকার বাড়ি। ভারি সুদৃশ্য। আটখানি ঘর। সামনে দিয়ে চওড়া বারান্দা। মাঝখানের বাগানটি এমন ভাবে তৈরি করা, যাতে প্রত্যেকটি ঘর থেকেই তার শোভা উপভোগ করা যায়। মানবেন্দ্র এখানে এসেছেন ছ’দিন আগে, এর মধ্যে আরও কিছু যাত্রী এসেছে, চলে গেছে। একটি ঘরে এক জোড়া ছেলে মেয়ে আছে তিন দিন ধরে, স্বামী-স্ত্রী যে নয় তা এক পলক দেখলেই বোঝা যায়, তারা অন্য কারুর সঙ্গে মেশে না। এ দু’দিনে মানবেন্দ্র সব মিলিয়ে দশ-বারোটার বেশি কথা বলেননি কোনও মানুষের সঙ্গে।
মানবেন্দ্রর এক বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তি পর্যটন দপ্তরের প্রায় এক জন কর্তাব্যক্তি। তিনিই মানবেন্দ্রকে এই জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কিছুদিন আগে মানবেন্দ্রর লিভারে বেশ গণ্ডগোল দেখা যায়। ডাক্তার ও বন্ধুরা বলেছিলেন, তার একটু বিশ্রাম দরকার। ছন্নছাড়া জীবনে লিভার আহত হয়।
পর্যটন দপ্তরের বন্ধুটি এখানে কী চিঠি পাঠিয়েছিলেন কে জানে, তার ফলে এখানকার ম্যানেজার বড্ড বেশি খাতির করে। যেটা অস্বস্তিকর। আবার ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে, যেমন, মানবেন্দ্র প্রথম দিন এসে এক বোতল মদ কিনতে চেয়েছিলেন, বেয়ারারা রাজি হয়নি, তাদের সাহেবের নাকি নিষেধ আছে! কোনও ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি তার পছন্দ হয় না। তিনি চান, তাকে নিয়ে কেউ যেন কোনও ব্যাপারে ব্যস্ত না হয়, তাকে নিজের মনে থাকতে দেয়। তিনি এই পৃথিবীতে, নিজের ছাড়া আর কারুর কখনও কোনও ক্ষতি করবেন না।
টুরিস্ট লজ থেকে বেরিয়ে মানবেন্দ্র বাঁ-দিকের সরু রাস্তাটা ধরে হাঁটতে লাগলেন। ডান দিকের রাস্তাটা গেছে শহরের দিকে। মাইল খানেক দূরে ছোট অকিঞ্চিৎকর শহর। বাঁ-দিকের সরু রাস্তাটা আধ মাইলের পরই নেমে গেছে ঢালু হয়ে মাঠের মধ্যে। সেখানে একটি বস্তি। তার ওপর দিকটায় পাহাড়ের মতো খাড়া পাথর। মানবেন্দ্র এসে সেই পাথরে বসলেন। এখানে বসলে যত ইচ্ছে আকাশ কিংবা দিগন্ত দেখা যায়। আবার নীচের দিকে তাকালেই দেখা যায় বস্তির মানুষদের বিভিন্ন সংসার। এদের ঘরে কোনও আব্রু নেই। ধর্মকাহিনি পড়লে যেমন মনে হয় ঈশ্বর ওপর থেকে পৃথিবীর সব মানুষের সংসারে দৃষ্টি রাখছেন, সেই রকম মানবেন্দ্রও এখানে একটি ছোটখাটো ঈশ্বরের ভূমিকা নিতে পারেন। যদিও এঁদের ভাল বা মন্দ কিছুই করার ক্ষমতা তার নেই।
এখানকার বিখ্যাত ঐতিহাসিক মন্দির এবং তার দেয়ালের কারুকার্য ও আদিরসাত্মক মূর্তি দেখার জন্যই ভ্রমণকারীরা আসে। এই কদিনের মধ্যে মানবেন্দ্র একবারও সেই মন্দিরের কাছে যাননি। তিনি তো মন্দির দেখতে আসেননি, এসেছেন বিশ্রামের জন্য। মন্দিরটা কোনও এক সময় দেখে নিলেই চলবে, ব্যস্ততার কিছু নেই। তার বদলে এই উঁচু পাথরটা মানবেন্দ্রর প্রিয় জায়গা।
চুরুটটা নিভে গিয়েছিল, মানবেন্দ্র আবার ধরালেন। হঠাৎ তার অনুভূতি হল, কেউ যেন তাকে লক্ষ্য করছে। তিনি ঘাড় ফিরিয়ে এ-দিক ওদিক তাকালেন। কাছাকাছি মানুষজন কেউ নেই। কিন্তু একটা কুকুর চুপচাপ এক দৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানবেন্দ্র একটু সতর্ক হলেন। অচেনা কুকুরকে সহজে বিশ্বাস করা যায় না। ল্যাজটা একটু বেশিঝুলে আছে মনে হচ্ছে না? ল্যাজটা ঠিক কী অবস্থায় থাকলে যেন পাগলা কুকুর চেনা যায়? দুর ছাই, দরকারের সময় এই সব তথ্য একেবারেই মনে পড়ে না।
মানবেন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, কী চাই?
কুকুরটা ছিপ ছিপ ছিপ ছিপ শব্দ করে আরও খানিকটা এগিয়ে এল। হঠাৎ আবার থমকে দাঁড়াল।
মানবেন্দ্র গলায় নকল গাম্ভীর্য ফুটিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন, কী চাই? এখানে কী চাই তোমার?
কুকুরটার চেহারা ভদ্রগোছের, গৃহপালিত ধরনের। তখন মানবেন্দ্রর মনে পড়ল, অনেক কুকুরই ইংরেজি ছাড়া আর কোনও ভাষা বোঝে না। তিনি বললেন, গো অ্যাওয়ে! গো!
কুকুরটা চঞ্চল ভাবে মাটিতে গন্ধ শুকল, তারপর ধপ করে বসে পড়ল সেখানে। এক একটা কুকুর হঠাৎ দৌড়োয়, কেন দাঁড়ায়, কেন যেখানে সেখানে বসে, তার কোনও যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনও দেখা গেছে, একটা কুকুর মাথা গুঁজে ঘুমোচ্ছ, হঠাৎ আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ ঘেউ ডাকতে শুরু করে। আশেপাশে আর কোনও মানুষ বা প্রাণী কিছুই নেই। ওরা কি স্বপ্ন দেখে, না অশরীরীদের দেখতে পায়?
কুকুরটার থেকে তার মনোযোগ সরে গেল একটি কান্নার আওয়াজে। তিনি দেখলেন একজন স্ত্রীলোক হন হন করে ঢালু রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বস্তির দিকে, তার থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটি আট বছরের মেয়ে। কাঁদছে ওই মেয়েটাই।
মানবেন্দ্র ওদের চিনতে পরলেন। স্ত্রীলোকটির নাম মুনিয়ার মা। সেই হিসেবে মেয়েটির নাম মুনিয়া। ওরা ডাকবাংলোয় আসে মাঝে মাঝে। মুনিয়ার কী অসুখ আছে। মানবেন্দ্র ক’দিনই দেখেছেন, মুনিয়ার মা তার মেয়েকে ওষুধ খাওয়াচ্ছে। ওপর থেকে ওদের ঘরের দৃশ্য স্পষ্ট দেখা যায়। তিনি দেখেছেন মুনিয়ার মা পক্ষীমাতার মতো স্নেহপ্রবণা এবং ব্যাকুল, মেয়েকে নিয়ে তার আদরযত্ন এবং আদিখ্যেতার শেষ নেই। মেয়েকে ওষুধ খাওয়াবার সময় তার মাথায় হাত বোলায় আর কল কল করে কত কথা যে বলে! এত দূর থেকে অবশ্য কথাগুলো বোঝা যায় না।
এক দিন মানবেন্দ্র একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছিলেন। একটি শিলে মুনিয়ার মা কয়েকটা শুকনো শিকড় বাটছিল। মেয়ের জন্য ওষুধ। এদিকে অ্যালোপ্যাথির তেমন চল হয়নি বোধহয়। অনেকক্ষণ ধরে বাটছিল শিকড়গুলো, তারপর বুকেরআঁচল সরিয়ে নিজের বাঁ-স্তনটা চেপে ধরল। টপটপ করে দুধ পড়তে লাগল শিলের ওপর।
মানবেন্দ্র তা দেখেই প্রথমে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। একটু পরেই তাকিয়েছিলেন আবার। মুনিয়ার মা তখন অন্য স্তনটা টিপে দুধ বার করছে। মানবেন্দ্রর প্রথম বিস্ময় ছিল এই যে, যার মেয়ের বয়েস ন’বছর, তার বুকে দুধ থাকে কী করে? ওর ঘরে আর তো ছোট বাচ্চা নেই। কিছুদিন আগেই একটা জন্মে মরেছে?
কবিরাজি বা হেকিমি ওষুধ সম্পর্কে মানবেন্দ্রর কোন ধারণা নেই। শিকড়বাটার সঙ্গে অনুপান হিসেবে দুধ মেশাবার ব্যবস্থা থাকে কিনা তিনি জানেন না। নিজের বুকের দুধ! কিংবা হয়তো এমনি দুধ মেশাতে বলেছিল, মুনিয়ার মা তা জোগাড় করতে পারেনি। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা অনৈসর্গিক কিছু আছে বলে মনে হয়। একাগ্র ভাবে দৃশ্যটি দেখতে দেখতে মানবেন্দ্র এক সময় লজ্জিত হয়ে উঠেছিলেন।
মুনিয়ার মায়ের স্বাস্থ্য ভাল। কারণ তাকে খেটে খেতে হয়। কোনও নারীকে নিজের হাতে তার স্তন ধরে থাকতে মানবেন্দ্র অনেক দিন দেখেননি। কিংবা কখনও দেখেছেন কি? হয়তো মেয়েরা আয়নার সামনে কিংবা বাথরুমে এ-রকম করে থাকে। মানবেন্দ্র ভাবছিলেন শহুরে মেয়েদের কথা, কিন্তু মুনিয়ার মার স্তনে কোনও নগর-সভ্যতা নেই। তার শরীরে একটা শিহরন জেগেছিল। দৃশ্যটা বাৎসল্যের, একটি জননী তার সন্তানের জন্য ওষুধ তৈরি করছে, তবু অন্য পুরুষের চোখ নিজস্ব আনন্দ খুঁজে নেয়।
পরদিনও সেই পাথরটার ওপরে এসে বসবার একটু পর মানবেন্দ্র নিজের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন হয়েছিলে। তিনি আবার এসেছেন কি ওই দৃশ্যটা আবার দেখার লোভে? লোভ? অল্প বয়েসে, কৈশোরে কোনও নারীর অনাবৃত বুকের একটু আভাস পেলেই শরীর ঝন ঝন করে উঠত। এই দৃশ্য পুরনো হয় না ঠিকই, কিন্তু এখন মানবেন্দ্র প্রায় চল্লিশে পা দিয়েছেন, এখনও শুধু ওইটুকু দৃশ্য দেখার জন্য তিনি এতটা রাস্তা হেঁটে আসবেন, তা হতে পারে না! কী, ঠিক বলছি তো? মানবেন্দ্র প্রশ্ন করলেন তার মনকে। মন বেশ দৃঢ়ভাবেই উত্তর দিল, ঠিক। তুমি ওই জন্যই আসোনি। লোভ নয়, তুমি এসেছ কৌতূহলে।
তবু একটু সংশয় থেকে গিয়েছিল। মানুষ কি সব সময় নিজের কাছেও সত্যি কথা বলে?
আজ তিনি দেখছেন আবার অন্য একটা দৃশ্য। মুনিয়ার মা হেঁটে যাচ্ছে হন হন করে, দুলছে তার ভারি শরীরটা, অর্থাৎ রাগ। পেছন ফিরে তাকাচ্ছেনা একবারও। আর মেয়েটা কাঁদছে অশ্রান্ত ভাবে, সে দৌড়ে এসে মাকে ধরছে না, সে আসছে আস্তে আস্তে।
বাচ্চাদের কান্না বিরক্তির। অনেক সময় রাগ ধরে যায়। কিন্তু মুনিয়ার কান্না মানবেন্দ্রর বুকে এসে লাগছিল। এই কান্নাটা তীব্র অভিমানের।
বাচ্চা ছেলে মেয়েরা অন্য সময় কাঁদে মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। কিন্তু মায়ের ওপরেই যখন রাগ কিংবা অভিমান, তখন আর কার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইবে? শিশুর কাছে তার মায়ের চেয়ে ঈশ্বরও অনেক ছোট। এই জন্যই শিশুর অন্য সময়ের কান্না আর নিজের মায়ের ওপর অভিমান করে কান্না –এই দুটো আওয়াজ সম্পূর্ণ আলাদা।
মুনিয়ার মায়েরই-বা এ কী ব্যবহার? যে অসুস্থ মেয়ের জন্য তার এত ব্যাকুলতা, এত মমতা, এখন তাকে এমন অবহেলা করে কেন সে হন হন করে হেঁটে যাচ্ছে? মুনিয়ার মা ডাকবাংলোতে তরকারি বেচতে আসে, সেই জন্যই মানবেন্দ্র দূর থেকে তার নামটা শুনেছেন। তিনি দেখেছেন, স্ত্রীলোকটির মধ্যে মাতৃত্বের ভাব বেশি। খুব সম্ভবওর স্বামী নেই, ওই মেয়েই ওর একমাত্র অবলম্বন। অথচ ওর বুকে দুধ থাকে কী করে? সে যাই হোক, কী দোষ করেছে ওর মেয়ে? কিংবা অসম্ভব কোনও আবদার? হয়তো চেয়েছে কোনও খেলনা কিংবা রঙিন ছিটের ফ্রক, তা-ই ওর মায়ের পক্ষে অসম্ভব। কত লোকের কাছে এটা নিতান্ত হেলাফেলার ব্যাপার।
মুনিয়ার মা একবারও পেছন ফিরে তাকাচ্ছেনা, এইবার সে ঢালু জায়গাটা দিয়ে নামবে। মেয়েটা থমকে দাঁড়িয়েছে, ডুকরে ডুকরে কান্নায় সে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করতে চাইছে।
এই হারামি! এই খানকির বাচ্চা! তোর বাপের মুখে লাথি মারি! আমি তোর মাকে–
মানবেন্দ্রর বুকে যেন কেউ একটা বর্শা বিঁধিয়ে দিল। তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। মুনিয়া মাটিতে বসে পা ছটফটিয়ে ওই সব গালাগালি দিচ্ছে। তার মায়ের উদ্দেশে। কী অসম্ভব সব খারাপ কথা। যদিও ওইটুকু মেয়ে নিশ্চয়ই এসবকথার মানে জানে না। বস্তিতে শুনে শুনে শিখেছে। হয়তো ওরই মায়ের মুখে– ।
মানবেন্দ্রর চোখটা কড় কড় করে উঠল। গভীর দুঃখে বুকটা ভারি হয়ে গেছে। কেন এই দৃশ্যটা দেখতে হল, কেন এই কথাগুলো শুনতে হল! তিনি ওপরের দিকে তাকালেন। কী বিশাল এই আকাশ। চতুর্দিকে মহিমার মতো রোদ্দুর। একঝাঁক তার মধ্য দিয়ে সুন্দরকে আরও সুন্দর করে চলে যায়। যত দূর দেখা যায় ছড়ানো প্রান্তর। এই সবকিছুর মধ্যেই অসীমতার সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে যেন। অথচ এরই মধ্যে এক শিশুর গলায় বীভৎস গালিগালাজ, এক জন মা এত নিষ্ঠুর, এমনকী ওই কুকুরটা হঠাৎ দৌড়ে এসে কেন বসে পড়ল –এ সবই যেন বিপুল রহস্যময়। এই বিশ্বসৃষ্টিতে কোনও কিছুর মধ্যেই আসলে হয়তো সঙ্গতি নেই।
মানবেন্দ্র বিমূঢ় হয়ে বসে রইলেন। পর্যায়ক্রমে তিনি তাকাতে লাগলেন মা, কুকুর ও বাচ্চা মেয়েটির দিকে। তার মনে হল, এ পৃথিবীকে তিনি কিছুই চেনেন না।
মুনিয়ার মা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, মর, মর, তুই মরিস না কেন? যমেও তোকে নেয় না?
মানবেন্দ্র উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে। তিনি একটা পাথর ছুঁড়ে মারলেন কুকুটার দিকে। কুকুরটা ভিতুর মতো ছুটে পালাল। তিনি ওপর থেকে দ্রুত নেমে আসতে লাগলেন মুনিয়াকে লক্ষ্য করে।
কিন্তু তিনি এসে পৌঁছবার আগেই মুনিয়া কাঁদতে কাঁদতে এবং সমানতালে গালাগাল করতে করতে ছুটে গেল তার মায়ের দিকে। অবিলম্বেই দু’জনে মিলিয়ে গেল ঢালু জমিতে।
মানবেন্দ্র আবার একটা পাথর তুলে নিয়ে একটা পাথরের গায়ে ঘষে ঘষে লিখতে লাগলেন কিছু। একটুক্ষণের মধ্যেই লেখাটা ফুটে উঠল :
না, এসব কিছুই সত্যি না—
.
০২.
আমার নাম অসীম রায়চৌধুরী। আমি বার্ড কোম্পানিতে আছি।
আমার নাম মানবেন্দ্র মজুমদার।
নিজের নাম বলে মানবেন্দ্র কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। আর দেখলেন অসীম রায়চৌধুরীর মুখ। না, সেখানে কোনও পরিবর্তন নেই। অসীম রায়চৌধুরী তার নাম শুনে চিনতে পারেনি।
খাবার ঘরে মানবেন্দ্র একেবারে কোণের দিকে একটা টেবিল নিয়ে বসেছিলেন। ইচ্ছে হলে তিনি নিজের ঘরেও খাবার আনিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু তখন এখানে কেউ ছিল না। একটু বাদেই বাঙালি পরিবারটি সদলবলে এসে ঢোকে। ওরা অনেক ঘোরাঘুরি করে এসেছে, খুবই ক্ষুধার্ত। রীতিমতো সোরগোল তুলে দু’টি টেবিল জোড়া দিয়ে ওরা বসল।
মানবেন্দ্র যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খাওয়া সেরে নিয়ে উঠে পড়বেন ভেবেছিলেন। কিন্তু সুপটা সাঙ্ঘাতিক গরম, জিভে ছোঁয়ানো যাচ্ছে না। তিনি সঙ্কুচিত ভাবে বসেছিলেন, যাতে তার উপস্থিতি কেউ গ্রাহ্য না করে।
কিন্তু তিনি একটি ভুল করেছিলেন। ওদের মধ্যে এক জনের হাতে ছিল একটা খবরের কাগজ। মানবেন্দ্র গত ছ’দিনের মধ্যে একবারও খবরের কাগজ পড়েননি, আগ্রহও হয়নি। কিন্তু দূরের খবরের কাগজের হেড লাইনের দিকে চোখ চলে যায়ই। কার যেন মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়েছে, কোনও বিরাট নেতার, নামটা দেখা যাচ্ছে না।
অসীম রায়চৌধুরী উঠে এসে বলেছিল, আপনি কাগজটা পড়বেন? এখানে বারোটার সময় কাগজ আসে। স্টেশনে গিয়েছিলাম তো।
এটা আলাপের ছুতো। যারা সামাজিক লোক তারা সমশ্রেণীর মানুষ দেখলে আলাপ না করে পারে না। সেটাই ভদ্রতার অঙ্গ। মানবেন্দ্রও অভদ্র হতে চাননা, তিনি মুখটা হাসিহাসি করে রাখলেন। কথা আর বিশেষ বললেন না। আপনি কবে এসেছেন, মন্দির দেখেছেন কিনা ইত্যাদি দু’একটা প্রশ্ন সেরে অসীম রায়চৌধুরী ফিরে গেল আপন টেবিলে। কাগজটা মানবেন্দ্রর হাতেই রইল। কিন্তু কাগজ পড়ার আগ্রহ তার একেবারেই চলে গেছে। কেন্দ্রের যে মন্ত্রী মারা গেছেন, তাঁর জীবিতকাল সম্পর্কেও মানবেন্দ্রর কোনও কৌতূহল ছিল না।
কাগজের আড়ালে তিনি তাকিয়ে রইলেন ওই দিকের জোড়া টেবিলে। তিন জন পুরুষ, দুজন মহিলা, তিনটি বাচ্চা। দুটি পরিবার না একই পরিবার, তা ঠিক বোঝা যায় না। নারী ও পুরুষেরা সকলেই প্রায় সমবয়সি, কেউই যৌবন পেরোয়নি। তিন জন পুরুষ কেন?
একটি নারীর মুখ তিনি দেখতে পাচ্ছেন। ধারালো নাক, টানা টানা চোখ, এই সব মেয়ের সাধারণত একটু অহঙ্কারী অথচ কোমল স্বভাবের হয়। মেয়েটি বহু লোকের কাছ থেকে এতবার শুনেছে সে সুন্দরী যে, এ বিষয়ে তার আর কোনও দ্বিধা নেই। বঙ্কিমচন্দ্র এই মেয়েটিকে দেখলে এর সৌন্দর্য বর্ণনায় নিশ্চয়ই পুরো এক পৃষ্ঠা ব্যয় করতেন। মানবেন্দ্র কিন্তু মেয়েটিকে তেমন পছন্দ করলেন না। তিনি আপন মনেই মাথা নাড়লে। যেন তিনি এক সম্রাট, তার এক পারিষদ ওই মেয়েটিকে নিয়ে এসেছে তাকে উপহার দেবার জন্য, তিনি প্রত্যাখ্যান করছেন।
অন্য নারীটি তার দিকে পিছন ফিরে বসে আছে। একবারও তাকায়নি। বহু দিনের অভিজ্ঞতায় মানবেন্দ্র জানেন যে, বসে-থাকা অবস্থায় কোনও নারীকে পেছন দিক থেকে দেখে তার রূপ বিচার করা যায় না। শুধু রূপ কেন? নারী মানেই কি রূপ? না, তা নয়। তবে, একথাও তো সত্যি প্রথমেই মনে হয়, ওকে দেখতে কেমন। দেখতে ভাল হলেও অনেককে ভাল লাগে না। এবং দেখতে খারাপ হলে তাকে ভাল লাগতে অনেকটা সময় দরকার। পুরুষ তিন জনের মধ্যে এক জনের চেহারা রীতিমতো চোখে পড়ার মতন। অসীম রায়চৌধুরী নয়। অন্য এক জন, পুরুষোচিত চেহারা যাকে বলে। এই পুরুষটি কোন মেয়েটির স্বামী? মানবেন্দ্র একটু হাসলেন, এটা জানা তার পক্ষে কি খুব দরকারি? তবু, এটা যেন একটা সরল অঙ্ক, না মিললে স্বস্তি নেই। দুটি নারী, তিনটি পুরুষ ও তিনটি বাচ্চা– এদের কার সঙ্গে কী সম্পর্ক সেটা যতক্ষণ না জানা যায়, ততক্ষণ প্রশ্নটা সব সময় মাথার মধ্যে ঘুরবেই।
মানবেন্দ্র নজর ফিরিয়ে দেখলেন, তার সুপ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। বিস্বাদ। ঠেলে সরিয়ে রাখলেন সেটা। এর পরবর্তী খাবারগুলো কোনওটাই ভাল করে খেলেন না তিনি। পেটে খিদে রেখেই উঠে পড়লেন।
আপনাদের কাগজটা।
অসীম রায়চৌধুরী কৃত্রিম ব্যস্ততার সঙ্গে বলল, ও, আচ্ছা, ঠিক আছে! আপনি কাগজটা এখন রাখতে পারেন, আমরা তো এখন পড়ছি না।
না, আমার হয়ে গেছে।
আপনি কি আজই চলে যাচ্ছেন?
মানবেন্দ্র একটু বিস্মিত হলেন। হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন! তার চেহারার মধ্যে কি কোনও রকম বিদায় নেবার ভাব আছে?
না, আমি আরও দিন পনেরো থাকব।
দিন পনেরো!
এই বিস্ময়ের উক্তি অসীম রায়চৌধুরীর নয়, অন্য সুদর্শন পুরুষটির। সে আবার বলল, আপনি এখানে আরও পনেরো দিন থাকবেন?
অর্থাৎ ওরা জানতে চায়, এখানে দেখবার মধ্যে আছে তো শুধু একটা মন্দির, অনেকে এবেলা এসেও-বেলা চলে যায়, কেউ কেউ এক রাত বা দু’রাত থাকে। কিন্তু পনেরো দিন?
আমি এমনিই সময় কাটাতে এসেছি। অনেকটা বিশ্রাম নেবার জন্য।
অসীম রায়চৌধুরী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আলাপ করিয়ে দিই, ইনি গৌতম ব্যানার্জি, ইনি হিরন্ময় বোস, আর ইনি অনুরাধা ব্যানার্জি, ইনি মানসী রায়চৌধুরী। আর ইনি হচ্ছেন মিস্টার মজুমদার, মানবেন্দ্র মজুমদার।
কাঁটা চামচ থাকা সত্ত্বেও মুর্গির ঝোল ও ভাত সকলে হাত দিয়েই খাচ্ছিল। এঁটো হাতে নমস্কার করা যায় না। তবু ওরই মধ্যে কেউ কেউ দু’হাতের মাঝখানে একটু দূরত্ব রেখে নমস্কারের ভঙ্গি করল।
মানবেন্দ্র একমাত্র লক্ষ্য করছিলেন সেই নারীটিকে, যার মুখ তিনি আগে দেখতে পাননি। এর নাম মানসী রায়চৌধুরী, হালকা হালকা শ্যামলা রঙ, পাতলা চেহারা, মুখখানা শান্ত ধরনের। মুখ দেখলেই বোঝা যায়, এই সব মেয়ে বাইরের লোকের সামনে কক্ষনও রাগে না।
পদবি শুনেই মানবেন্দ্র বুঝে নিয়েছেন কার সঙ্গে কী সম্পর্ক। এর মধ্যে হিরন্ময় বসুই আলাদা। সে এবার প্রশ্ন করল, মানবেন্দ্র মজুমদার? মানে আপনিই কি…
মানবেন্দ্র তৎক্ষণাৎ কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, আপনারা তো বোধহয় বেশি দিন থাকছেন না। তা হলে শুধু মন্দির দেখেই চলে যাবেন না, এখানে একটা চমৎকার ঝরনা আছে, সেটাও দেখবার মতো।
বাচ্চাদের মধ্যে এক জন একটা ঝোলের বাটি উলটে ফেলেছে। সব মনোযোগ সেই দিকে ঘুরে গেল। মানবেন্দ্র খবরের কাগজটা রেখে আর কোনও কথা না বলে সরে এলেন সেখান থেকে। আর একবার তাকিয়ে দেখলেন শ্যামলা ধরনের ছিপছিপে মেয়েটির দিকে। কীরকম যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে একে দেখে। এর বসে থাকার ভঙ্গি, তাকানো কিংবা টেবিলের ওপর বাঁ-হাতের পাতাটা মেলে রাখা–এ-সবই অন্য রকম। তিনি মনে মনে বললেন, এই মেয়েটি এসেছে তার শান্তি নষ্ট করতে। যদিও মেয়েটি তার দিকে দু’এক পলকের বেশি তাকায়নি।
খাবার ঘরের দরজার কাছে এসে মানবেন্দ্র আর একবার তাকালেন। মানসী নামের মেয়েটির মুখ অন্য দিকে ফেরানো, চোখাচোখি হল না। তবু মানবেন্দ্রর মনে হল, মেয়েটিকে যেন চেনা চেনা লাগছে। অথচ মুখটা একেবারেই চেনা নয়, কোনও মেয়ের মুখ মানবেন্দ্র একবার দেখলে আর ভোলেন না, কিন্তু এই মেয়েটির সবকিছু মিলিয়ে যেন একটা পূর্ব পরিচয়ের আভাস।
মানবেন্দ্র তালা খুলে ঢুকলেন নিজের ঘরে। জানলা খুলেই রেখে গিয়েছিলেন, তাই বন্ধ ঘরের ভ্যাপসা ভাবটা নেই। প্রথমেই তিনি খুঁজলেন মহারানিকে। মথটা কিন্তু তখনও ঘুলঘুলির পাশে ঠিক সেই রকম ভাবেই বসে আছে। মাফিয়া কিংবা শাইলককে দেখা যাচ্ছেনা, কিন্তু বেহুলা নিয়ন টিউবের ধার ঘেঁষে শুয়ে আছে চুপ করে। আশ্চর্য ব্যবহার তো মহরানির, তার কি ক্ষুধা-তৃষ্ণা নেই? শুধু নিজের সৌন্দর্যটুকু মেলে ধরে থাকাই তার কাজ? মানবেন্দ্র একটু বিরক্ত ভাবে বললেন, কী হচ্ছে কী? এই খুকি, একটু বাইরে থেকে ঘুরে এসো না।
মানবেন্দ্র এ-দিকও-দিক তাকিয়ে একটা খোলা খিল খুঁজে পেলেন। সেটা তুলে মথটার খুব কাছে গিয়ে ঠুকতে লাগলেন। মথটা আবার একবার উড়ে গিয়ে অন্য দেয়ালে বসল। হঠাৎ খুব মায়া হল মানবেন্দ্রর। তিনি বুঝতে পারলেন, এই মথটির মৃত্যু তাকে নিজের চোখে দেখে যেতে হবে।
মানবেন্দ্র আবার একটা চুরুট ধরালেন। চুরুটের স্বাদ তার একটুও ভাল লাগে না। মুখটা তেতো হয়ে থাকে। ইদানীং তিনি সিগারেট ছেড়ে স্বেচ্ছায় চুরুট ধরেছেন। আজকাল নানা ব্যাপারে নিজেকে কষ্ট দিতেই তার ভাল লাগে। একমাত্র এই উপায়েই তিনি তার অসুখটা সারাতে পারবেন।
মানবেন্দ্রর আসল অসুখটার নাম পাগলামি। এমনিতে তার শরীর যথেষ্ট সুস্থ। স্বাভাবিকতা ও পাগলামির মাঝখানে একটা সূক্ষ্ম সীমারেখা আছে, তিনি কিছু দিন হল সেই সীমারেখাটার ঠিক ওপরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, কখনও কখনও একটু ঝুঁকে যেতেন অন্য দিকে। হঠাৎ এমন এক একটা কাজ করে ফেলছিলেন, যে সম্পর্কে আগের মুহূর্তেও কিছু চিন্তা করেননি। কিংবা চোখে ভুল দৃশ্য দেখা। কোনও সুস্থ মানুষ এরকম করেনা, এমনকী শিল্পীরাও না। কোনও ডাক্তার বলেনি, মানবেন্দ্র নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন এটা। নিজেই নিজের চিকিৎসা করছেন।
প্রথম এই ব্যাপারটা টের পান মাস ছয়েক আগে। কলেজ স্ট্রিটে একটা বইয়ের দোকান বসে অনেকক্ষণ আড্ডা দিচ্ছিলেন। সন্ধের সময় হঠাৎ যেন একটা জরুরি কাজের কথা মনে পড়ায় ধড়মড় করে উঠে পড়লেন। কারুর কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই বেরিয়ে এলেন রাস্তায়। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল, ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। ট্রাম ও বাস বদলাবদলি করে চলে এলেন মানিকতলায়। ব্রিজ পেরিয়ে বাঁ-দিকের রাস্তা ধরে একটু হেঁটে ঢুকে পড়লেন একটা গলির মধ্যে। গলির শেষ বাড়িটার সদর দরজা খোলাইছিল। মানবেন্দ্র হন হন করে ঢুকে গিয়েছিলেন ভেতরে। মাঝখানে একটা উঠোন, তার ও-পাশে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ির পাশেই যে-ঘরটা, তার সামনে এসে মানবেন্দ্র পা থেকে চটি খুলে রাখলেন এক পাশে। তারপর দরজাটা ঠেললেন। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। দরজায় দুম দুম করে ধাক্কা দিয়ে ডেকেছিলেন –মা মা।
দরজা খোলেনি।
মানবেন্দ্র আরও জোরে ডেকেছিলেন।
সারা বাড়ি গম গম করে উঠেছিল তার মা মা ডাকে।
একটু বাদে দরজা খুলেছিল এক জন যুবতী, যেন সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসেছে। মানবেন্দ্র তাকে দেখেও বলেছিলেন, মা, এতক্ষণ দরজা খুলছিলে না কেন!
যুবতীটির চোখে এক পৃথিবীব্যাপী বিস্ময়। প্রথমটায় কথা বলতে পারেনি। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি কে?
মানবেন্দ্রর চোখে নিবিড় বিরক্তি। তিনি চিনতে পেরেছেন যে, এই মেয়েটি তার মা নয়। তবে এই মেয়েটি এখানে কেন? তিনি পালটা প্রশ্ন করছিলেন, আপনি কে? আমার মা কোথায়?
ততক্ষণে বাড়ির আরও অনেকগুলি ঘরের দরজা খুলে গেছে। কয়েক জন কৌতূহলী মানুষ এগিয়ে এসেছে কাছে। একজন জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথা থেকে এসেছেন? আপনার কী চাই এখানে?
মানবেন্দ্র বলেছিলেন, কী মুশকিল, আমরা তো এই ঘরের থাকি। আমার মা কোথায় গেল?
সেই সময় পায়জামা ও গেঞ্জি পরা রোগা মতো একজন লোক দো-তলা থেকে নেমে এসে বলল, আপনি, মানে চেনা চেনা লাগছে, তুই মানু না?
মানবেন্দ্র বললেন, জীবন!
সঙ্গে সঙ্গে তার ঘোর কেটে গেল। এ কী অসম্ভব একটা কাণ্ড করেছেন তিনি! এই বাড়িতে ছাব্বিশ বছর আগেভাড়া থাকতেন মানবেন্দ্ররা। তখন তিনি স্কুলের ছাত্র। সিঁড়ির পাশের এই ঘরটিতে থাকতেন তার মা। বছর তিনেক বাদেই এ বাড়ি ছেড়ে উঠে গিয়েছিলেন শোভাবাজারে। কুড়ি-বাইশ বছরের মধ্যে এ গলিতেও আর কখনও আসেননি। অথচ আজ ঠিক যেন নিজের বাড়িতে ফিরছেন, এইভাবে দরজার বাইরে চটি খুলে রেখে ভেতরে ঢুকতে চাইছিলেন। এই সময়-বিস্মৃতি কী করে হল?
এত দিনে সেই বাড়ির অধিকাংশ বাসিন্দাই পালটে গেছে। হয়তো সন্দেহের বশে লোকজনেরা তাকে মারধোরই করত, একমাত্র বাড়িওয়ালার ছেলে জীবন, তার বাল্যবন্ধু, কোনও ক্রমে চিনতে পেরেছে।
জীবন বলল, কী ব্যাপার রে, তুই এত দিন বাদে?
মানবেন্দ্র বিমূঢ় ভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, কী জানি, আমি তো জানি না, আমার সব ভুল হয়ে গেছে।
পকেট থেকে রুমাল বার করে চোখ দুটো ভাল করে মুছে ধাতস্থ হলেন। তারপর অচেনা যুবতীটির উদ্দেশে হাত জোড় করে বলেছিলেন, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।
মানবেন্দ্রর ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিটি এমনই বিনত ও কাতর ছিল যে যুবতীটি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিল, না না, ওতে আর কী হয়েছে।
যবুতীটির ডান চোখের পাশে একটা বড় তিল।
সেটা দেখে আবার কেঁপে উঠেছিলেন মানবেন্দ্র। ছাব্বিশ বছর আগে মানবেন্দ্র যখন এই ঘরটাতে থাকতেন, তখন তার মায়ের বয়স ছিল ওই যুবতীটিরই প্রায় সমান। একই ধরনের চেহারা, এবং মায়ের ডান চোখের পাশে ঠিক ওই রকমই একটা তিল।
মানবেন্দ্র অবশ্য এই ব্যাপারটার ওপর বেশি গুরুত্ব দিলেন না। তার মায়ের সঙ্গে ওই যুবতীটির চেহারার আপাত সাদৃশ্য কাকতালীয় গোছের। এ-রকম হতেই পারে। বাল্যবন্ধু জীবন তাকে নিয়ে গিয়ে বসাতে চায়, অনেক প্রশ্ন করতে চায়। কিন্তু মানবেন্দ্র এত লজ্জা পেয়েছিলেন যে আর এক মুহূর্তও থাকতে চাননি। কোনও রকমে সেখান থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলেন।
তারপর অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে যাচাই কবার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ওখানে গিয়েছিলেন কেন? বইয়ের দোকানের আড্ডা ছেড়ে হঠাৎ উঠে পড়ে ছাব্বিশ বছর আগেকার সময়ে ফিরে যাওয়ার মধ্যে কী যুক্তি থাকতে পারে? তিনি কোনও উত্তর খুঁজে পাননি।
দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটে এর কয়েক দিন পরেই। মানবেন্দ্র সন্ধেবেলা চৌরঙ্গিতে দাঁড়িয়েছিলেন, হঠাৎ একটা চলন্ত ট্যাক্সির দিকে তার চোখ পড়ল। তিনি দেখলেন, জানলার পাশে বসে আছে চঞ্চল। তিনি বিস্ময়ের হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ট্যাক্সিটা হুস করে বেরিয়ে গেল।
মানবেন্দ্রর মনটা আনন্দে ভরে গিয়েছিল। চঞ্চল তা হলে ফিরে এসেছে। বছর দশেক আগে চঞ্চল চলে গিয়েছিল আফ্রিকায়। চঞ্চল ছিল ছেলেবেলায় তার সব চেয়ে প্রিয় বন্ধু। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খ্যাতি-অখ্যাতি-সার্থকতা আসার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধু অনেক কমে গেছে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা সরে গেছে দূরে। টেনশানমুক্ত হয়ে কথা বলা যায়, এমন মানুষ প্রায় নেই-ই বলতে গেলে। একমাত্র চঞ্চল সম্পর্কেই এ প্রশ্ন আসে না। কিন্তু চঞ্চল সেই যে কিছু টাকা রোজগার করে ফিরে আসার ইচ্ছে নিয়ে চলে গেল নাইজিরিয়ায়, আর ফিরল না। তারপর থেকে নানা দেশে ঘুরছে। চিঠি লেখার স্বভাব চঞ্চলের কোনও কালেই নেই। কদাচিৎ দু’একটা পোস্টকার্ড লেখে। সেই চঞ্চল তা হলে ফিরেছে এতদিন পর!
মানবেন্দ্র আশা করেছিলেন সেইদিনই বা পরের দিন চঞ্চল তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। ট্যাক্সিতে চঞ্চলের পাসে একটি মেয়ে ছিল। বাঙালি মেয়ে। মানবেন্দ্র তার মুখটা ভাল করে দেখতে পাননি। সুতপা হতে পারে। সুতপার বিয়ে হয়ে গেছে। চঞ্চলও জানে সে-খবর। সুতপার বিয়েতে সে নাকি কোনও আপত্তিও করেনি। কিন্তু চঞ্চলকে দেখলে সুতপা যে সব কিছু অগ্রাহ্য করে আবার চলে আসবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অসম্ভব তীব্র ভালবাসা ওদের।
সেই সন্ধেবেলাই দু’জন পরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা হওয়ায় মানবেন্দ্র বলেছিলেন, জানো, চঞ্চল ফিরে এসেছে।
ওরাও উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল। চঞ্চলের অমলিন স্বভাবের জন্য সবাই তাকে ভালবাসে, সকলেই তাকে মনে রেখেছে।
কিন্তু দুদিনের মধ্যেও চঞ্চল তার খোঁজ করলনা। মানবেন্দ্র রীতিমত আহতও অবাক হয়েছিলেন। তবু তিনি নিজেই খোঁজ করতে চেয়েছিলেন চঞ্চলের। চঞ্চল কোথায় উঠেছে তিনি জানেন না। চঞ্চলের বাবা-মা এখন থাকেন এলাহাবাদে। চেনাশুনো লোকদের কাছে চঞ্চলের কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। কেউ এ পর্যন্ত চঞ্চলকে দেখেনি।
এরপর মানবেন্দ্র আর এক দিন দেখলেন, চঞ্চল ভবানীপুরে একটি সিনেমা হলে ঢুকছে। সঙ্গে একটি মেয়ে, সুতপারই মতো। সাহেবি কায়দায় চঞ্চল মেয়েটির কোমরে হাত দিয়ে আছে। চঞ্চল সব পারে। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রেখে চঞ্চল একবার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে একটি অচেনা মেয়েকে বলেছিল, তুমি যদি আমাকে একটা গান শোনও, আমি তোমাকে দশবার চুমু খেতে পারি। গান না শোনালে কিন্তু চুমু পাবে না, আগেই বলে দিচ্ছি!
মানবেন্দ্র রাস্তার ওপারে ছিলেন, এ-দিকে আসতে আসতেই চঞ্চল মেয়েটিকে নিয়ে সিনেমা হলে ঢুকে গেল। শো শুরু হয়ে গেছে। মানবেন্দ্র একবার ভাবলেন, খানিকটা ঘুরেফিরে এসে ঠিক শো ভাঙার সময় বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে চঞ্চলকে ধরবেন। কিন্তু যদি ফস্কে যায় এই ভয়ে মানবেন্দ্র একটা টিকিট কেটে নিজেও ঢুকে পড়লেন সেই সিনেমায়। অন্ধকারে তক্ষুনি খুঁজে পাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ইন্টারভ্যাল কিংবা ছবি শেষ হবার পরেও চঞ্চলকে আর দেখতে পাওয়া গেল না। সে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেছে। কিংবা চঞ্চল কি ইচ্ছে করেই মানবেন্দ্রকে এড়িয়ে বেড়াচ্ছে? সেরকম কোনও কারণই নেই, চঞ্চলের সঙ্গে তার কোনওদিন মন কষাকষি হয়নি। একমাত্র চঞ্চলই এখনও মানবেন্দ্রর ওপর হুকুম করে কথা বলতে পারে। তবু কলকাতায় এসে চঞ্চল তাঁর সঙ্গে দেখা করবে না, এ কী হতে পারে? মানবেন্দ্রর মনে একটা সূক্ষ্ম অভিমান জেগেছিল। শুধু শুধু তাকে একটা বাজে সিনেমা দেখতে হল।
চঞ্চলকে তিনি তৃতীয় বার দেখেছিলেন ওই সিনেমা হলের কাছেই বাস স্টপে। এবার মানবেন্দ্রই ট্যাক্সিতে যাচ্ছিলেন, অকস্মাৎ চঞ্চলের সঙ্গে তার চোখাচোখি হল, চঞ্চল হাসল পরিচিত ভঙ্গিতে। এখন সে একা, সঙ্গে সুতপা নেই।
মানবেন্দ্র চেঁচিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলেছিলেন, রোককে রোককে। ট্যাক্সি খানিকটা এগিয়ে থামল। মানবেন্দ্র ঝট করে দরজা খুলে নেমে দৌড়ে এলেন। দৈত্যের মতো একটা দোতলা বাস তার সামনে। এত কাছে মৃত্যু, মানবেন্দ্র আর কিছু চিন্তা করার বদলে শুধু ভাবলেন, মুখের ওপর দিয়ে চাকাগুলো চলে গেলে চঞ্চলও আর তাকে চিনতে পারবে না। হাত দিয়ে মুখটা আড়াল করে নিরুপায়ের মতো তাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। বাসটা মানবেন্দ্রকে দয়া করে চাপা দিল না, চলে গেল পাশ কাটিয়ে। চোখ থেকে হাত নামিয়ে মানবেন্দ্র দেখলেন চঞ্চল নেই। হয়তো ওই বাসেই চঞ্চল উঠে গেছে। চঞ্চল কি বুঝতে পারেনি যে মানবেন্দ্র ট্যাক্সি থামাবেন! এ কখনও হতে পারে?
কিন্তু পরিচিত ও বন্ধুবান্ধবরা এর মধ্যে বলতে শুরু কবেছে যে চঞ্চল কলকাতায় আসেনি। আর কেউ তাকে দেখেনি। কোথাও তার কথা শোনা যায়নি। চঞ্চলের মতো ছেলে কলকাতায় এলে এক দিনের মধ্যেই সেকথা রটে যেত। নিজেকে গোপন করার ক্ষমতা চঞ্চলের নেই। মানবেন্দ্র নিশ্চয়ই ভুল দেখেছেন।
একথা শুনে রীতিমতো চটে গিয়েছিলেন মানবেন্দ্র। তিনি কি নির্বোধ না ছেলেমানুষ যে, তিন তিনবার ভুল দেখবেন? চঞ্চলকে কি তিনি অন্য কারুর সঙ্গে ভুল করতে পারেন?
অনেকের কাছে খোঁজ নিতে নিতে শেষ পর্যন্ত তিনি গিয়েছিলেন সুতপার কাছে। তার মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকেছিল। এ-রকম কথা তিনি লোকের মুখে শুনেছেন বা বইতে পড়েছেন যে, দূর বিদেশে কোনও লোক যদি হঠাৎ মরে যায়, তাহলে ঠিক সেই সময়েই তার কোনও নিকট আত্মীয় বা বন্ধু দেখতে পায় তাকে। মানবেন্দ্র কোনও দিন এটা বিশ্বাস করেননি, তবু একটু ভয় ভয় করছিল।
সুতপা রেগে গিয়েছিল মানবেন্দ্রর ওপরে। ঝাঁজালো গলায় বলেছিল, আমি জানি, তুমি এত দিন পরে কেন এসেছ। তুমি এমনিতে কক্ষনও আমার বাড়িতে আসো না। আজ এসেছ চঞ্চলের খোঁজ নিতে। তুমি জানতে এসেছ ও আমাকে চিঠি লেখে কিনা! হ্যাঁ, আমার স্বীকার করতে কোনও লজ্জা নেই, ও আমাকে এখনও চিঠি লেখে। আমার স্বামীও সেকথা জানে। কিন্তু সে কখনও ওর চিঠি পড়ে দেখতে চায় না।
চঞ্চলের শেষ চিঠিটা আমাকে দেখাবি?
না!
মানবেন্দ্রর ইচ্ছে হয়েছিল উঠে গিয়ে সুতপারে সুন্দর মুখে ঠাস করে এক চড় মারেন। তখন তার মনের অবস্থা এই রকম।
তিনি হাতটা বাড়িয়ে গম্ভীর ভাবে বলেছিলেন, দে!
বলছি তো দেব না!
মানবেন্দ্র একটুখানি সময় নিলেন রাগ সামলাবার জন্য। তারপর ক্লান্তভাবে বলেছিলেন, সুতপা, কী করছিস কী! আমি চঞ্চলের একটা চিঠি পড়তে পাব না, আমি কি এতই দূরে সরে গেছি?
সুতপা মানবেন্দ্রর আপন মাসতুতো বোন। বাল্যকালে ওরা অনেক সময় এক খাটে শুয়ে ঘুমিয়েছে। মানবেন্দ্রর জীবনের প্রথম চুম্বন ওই সুতপাকেই।
সুতপা শেষ পর্যন্ত চিঠিখানা দিয়েছিল। কুয়েত থেকে লিখেছে চঞ্চল। দারুণ দামি কাগজ, সোনার জলে ওর নাম লেখা। অদ্ভুত সেই চিঠির ভাষা– সুতপা, আমার নতুন বান্ধবীর নাম ক্যারেন। নামটা মোটেই আমার পছন্দ নয়। লোকে আমাদের স্বামী-স্ত্রী বলে জানে, কিন্তু আমরা বিয়ে করিনি। ব্যাপারটা সামান্য বিপজ্জনক। যাই হোক, আমি কি ওকে সুতপা নামে ডাকতে পারি? তোমার অনুমতি চাই। শিগগিরই লিবিয়াতে ফিরব। মানুর খবর কী? তোমার চোখের ব্যথাটা কমেছে? ইতি তোমারই চঞ্চল।
মানবেন্দ্র চিঠিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। এক সময় তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। তিনি চঞ্চলের কথা ভাবছেন না, তিনি ভাবছেন নিজের কথা। চিঠির তারিখ মাত্র আট দিন আগের। মানবেন্দ্র তারও কয়েকদিন আগে চঞ্চলকে প্রথম কলকাতায় দেখেছেন। পুরো ব্যাপারটাই অবিশাস্য।
সুতপা মানবেন্দ্রর বাহুতে হাত রেখে আন্তরিক গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, এ কী, তুমি কাঁদছ কেন মানুদা! কী হয়েছে? চঞ্চল তোমার সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করেছে?
আমি কয়েকদিন আগে চঞ্চলকে দেখেছিলাম।
কোথায়?
স্বপ্নে নয়, রাস্তায়।
তুমি পাগল হয়েছ? চঞ্চল এসে থাকলে কারুর সঙ্গে দেখা না করে চলে যেতে পারে?
সুতপাই পাগল কথাটা প্রথম উচ্চারণ করেছিল। তারপর থেকে সেটা মানবেন্দ্রর মাথায় গেঁথে যায়। পুরো ব্যাপারটাই তার পাগলামি না চোখের ভুল? কিন্তু এরকম চোখের ভুল তার হবে কেন? আগে তো কখনও হয়নি।
মা, প্রিয় বন্ধু, তারপর ঈশ্বর। এরপর মানবেন্দ্র এক দিন ঈশ্বরকে দেখলেন। পৌত্তলিক হিন্দুধর্মের ঈশ্বর। সে-দিন মানবেন্দ্রকে একটা মিটিং-এ যেতে হয়েছিল চন্দ্ৰননগরে। বড্ড বেশি কথা বলতে হয়েছে। অসহ্য গরমের মধ্যে সারাটা দিন কেটেছে বেশ কষ্টে। রাত্তিরে অনেকক্ষণ ঘুম আসছিল না। মানবেন্দ্র নিজের ঘরে একা শুয়েছিলেন। আলো নেভানো, তবু রাস্তায় আলো এসে অন্ধকারকে আবছা করে দেয়।
মানবেন্দ্র দেখলেন, তার ঠিক চোখের সিধে দেয়ালের সামনে শঙ্খ-গদা-পদ্মধারী বিষ্ণু এসে দাঁড়িয়ে আছেন। একেবারে ছবির মতো। মানবেন্দ্রর ঘরে একটিমাত্র ক্যালেন্ডারে বিদেশি নিসর্গ। চোখের সামনে পূর্ণাঙ্গ বিষ্ণুমূর্তি দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরলেন। হাত বুলিয়ে খাটের তলা থেকে টেনে আনলেন সিগারেট-দেশলাই। অ্যাশট্রে নেই কাছাকাছি, তাতে কোনও ক্ষতি নেই, মেঝেতে ছাই ফেলা যায়। দেশলাইটা জ্বেলে আবার চিত হয়ে সেই আলোয় দেখলেন, বিষ্ণুর সর্বাঙ্গ চকচক করছে।
ভিশান্ দেখা মানবেন্দ্রর বহু দিনের অভ্যেস। এখনও যে-সব রাত্তিরে তিনি মদ্যপান করেন না, ঘুম আসতে একটু দেরি হয়, চোখ বুজলেই চোখের সামনে অনেক দৃশ্য ভেসে ওঠে। সাধারণত নানা রকম ডিজাইন অথবা যে-সব জায়গায় মানবেন্দ্র কখনও যাননি, যে-সব রাস্তা বাড়ি তিনি কক্ষনও চোখে দেখেননি, সেই সব দেখতে পান। দৃশগুলো পর পর বদলে যায়, অদ্ভুত আনন্দ পান তাতে মানবেন্দ্র। তিনটি গল্প এবং একটি উপন্যাসের কাহিনিও তিনি পেয়েছেন এইভাবে।
কিন্তু সে তো চোখ বুজে দেখা। সেই রাতে মানবেন্দ্র সম্পূর্ণ চোখ খুলে দেয়ালের সামনে বিষ্ণুকে দেখতে পেয়েছিলেন। পৌরাণিক কাহিনির সমস্ত বেশভূষা নিয়ে।
বাড়ির ছাদটা খারাপ। ছাদে বৃষ্টির জল জমলে ঘরের দেয়ালগুলিতেও চুঁইয়ে এসে নোনা ছাপ পড়ে। দেয়ালের সেই সব ছাপ কিংবা ফাটাফুটি থাকলে সেই দিকে চেয়ে চেয়ে অনেক রকম মূর্তি কল্পনা করা যায়।
মানবেন্দ্র উঠে আলো জ্বাললেন। হ্যাঁ, ঠিকই দেয়ালে নোনা ছাপ পড়েছে। নিতান্তই আঁকাবাঁকা দাগ, সেদিকে তাকিয়ে কোনও মানুষ বা জীবজন্তুর চেহারাও কল্পনা করা যায় না। মানবেন্দ্র হাত দিয়ে দেয়ালের সেই জায়গাটা ঘষে দিলেন। তারপর আবার আলো নিভিয়ে এসে শুয়ে পড়লেন বিছানায়।
এবারও দেখতে পেলেন বিষ্ণুমূর্তি। মানবেন্দ্র মাথা ঠাণ্ডা করে সিগারেট টানতে লাগলেন। হ্যাঁ, চোখের ভুল তো নিশ্চয়ই। কিন্তু বিষ্ণুমূর্তি কেন?
যৌবনের শুরু থেকেই মানবেন্দ্র ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন। তিনি কখনও সরবে নাস্তিকতা প্রচার করতেও যাননি অবশ্য। ব্যাপারটা সম্পর্কেই তিনি নির্লিপ্ত থাকতে চান। তবে তার পরিচিতদের মধ্যে যাঁরা কোনও রকম পুজোআচ্চা কিংবা নামাজ-প্রার্থনায় অংশ নেয়, তাদের সম্পর্কে তার মনের মধ্যে একটু করুণা বোধ আছে। তিনি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে নিজের চেষ্টায় ওপরে উঠে এসেছেন, কোনও দিন কারুর সাহায্য নেননি, ঠাকুর-দেবতাদেরও সাহায্য চান না। তিনি জানেন, এই জীবন একটাই। এবং মুক্তি সম্পর্কে তার কোনও আগ্রহ নেই।
তাহলে তার দৃষ্টিবিভ্রমে বিষ্ণুমূর্তি কেন? এর তো কোনও যুক্তি পাওয়া যায় না। তবু তিনি সিগারেটটা শেষ করার পর উঠে বসলেন। আবার ভাল করে তাকালেন। এখনও বড় স্পষ্ট।
ঘরে কোনও ভদ্রলোক এলে তাকে যেমন খাতির করা উচিত সেই রকম ভাবে হাত জোড় কবে মানবেন্দ্র বিনীত গলায় বললেন, নমস্কার। আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন?
কোনও উত্তর নেই।
মানবেন্দ্র প্রশ্নটা তিনবার করলেন।
তারপর তড়াক করে খাট থেকে নেমে এসে দেয়ালের গায়ে দুম করে এক লাথি মেরে বললেন, শালা, ইয়ার্কি করার আর জায়গা পাওনি।
লাথিটা বেশ জোরেই মেরেছিলেন। মানবেন্দ্রর পায়েই লেগেছিল খুব। হাঁটুটা চেপে ধরে তিনি ঘরের মেঝেতে কিছুক্ষণ বসেছিলেন গুম হয়ে। তিনি বার বার এ-রকম ভুল দেখছেন কেন? হঠাৎ নমস্কারই না করলেন কেন, লাথি মারতেই-বা গেলেন কেন? এই কি পাগলামির লক্ষণ?
মানবেন্দ্রর মুখটা কুঁকড়ে গিয়েছিল। চোখ দুটোতে কান্নার মতো জ্বালা। তিনি ভেবেছিলেন, না না, আমাকে পাগল হলে চলবে না। আমি নিজেই নিজেকে বাঁচাব।