৫.৩ স্লোগানেই কেল্লা জয়
সুলতান মাহমূদ যখন মহারাজা গোবিন্দকে পরাস্ত করে গযনী ফিরে আসেন, তখন তার সাথে ছিল যুদ্ধ লব্ধ সম্পদ হিসাবে প্রায় ছয়শ জঙ্গি হাতি, আড়াই হাজার ঘোড়া আর সাত হাজার হিন্দু বন্দি। গযনীর অধিবাসীরা বিজয়ী সুলতান ও সেনাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে ঘর ছেড়ে অনেক পথ এগিয়ে গিয়ে ছিল। উল্লসিত জনতার তাকবীর ও স্লোগানে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠছিল। রণ ক্লান্ত দীর্ঘ সফরে শ্রান্ত সৈনিকদের চেহারাও জনতার উল্লাসে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বন্দিদের দীর্ঘ সারি যখন জনতাকে অতিক্রম করছিল তখন জনতার গগন বিদারী শ্লোগানে যমীন কাঁপতে লাগল।
মুগ্ধ আনন্দিত জনতা হিন্দু বন্দিদের উদ্দেশ্যে নানা ধরনের তিরস্কার করছিল। কেউ কেউ বলছিল– গযনীতে তোমরা আসল খোদার দেখা পাবে। এসব খোদাকে প্রণাম করবে, তাহলে তোমরা মাফ পেয়ে যাবে। কিন্তু গযনীবাসীর এসব তিরস্কার ছিল ফারসী ভাষায়। হিন্দুরা ফারসী বুঝতো না। ফলে জনতার উল্লাস ধ্বনি ও অঙ্গভঙ্গি দেখে বন্দি হিন্দুদের কেউ কেউ অবাক বিস্ময়ে তাকাচ্ছিল, আবার কেউ পরাজিতের শুষ্ক হাসি হাসছিল আবার কারো চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু।
দর্শকদের মধ্যে চারজন লোক কিছুটা ভিন্নভাবে দাঁড়িয়ে তাদের সামনে দিয়ে অতিক্রমকারী সুলতানকে গভীর ভাবে দেখছিল। তাদের কণ্ঠে কোন শ্লোগান ছিল ন। তারা ছিল সম্পূর্ণ নীরব ও গম্ভীর।
সুলতান যখন তাদের অতিক্রম করলেন তখন তারা গযনী সেনাদের তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখছিল। মহারাজা গোবিন্দ মোকাবেলা না করার কারণে গযনী বাহিনীর কোন সৈনিকের প্রাণহানি ঘটেনি। ফলে মনে হচ্ছিল, গযনী থেকে যে পরিমাণ সৈন্য গিয়েছিল, ফিরে আসছিল তার চেয়েও বেশী। অবশ্য সুলতান মাহমুদ কনৌজ ও লাহোরে কিছু সৈন্য রেখে এসেছিলেন। ওই দু’টি এলাকার শাসকরা তার বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল।
লড়াই না করেই ফিরে এসেছে সুলতান। দেখা যাচ্ছে ব্যাপক লুটপাট করে এসেছে– বললো নীরব দর্শক চারজনের একজন।
লড়াই না করলে যুদ্ধ বন্দি এলো কোত্থেকে? এতোগুলো হাতি ঘোড়া আর যুদ্ধ সরঞ্জামই বা কোথায় পেতো? বললো অপর একজন।
এতো লোকের মধ্যে আমি যদি সুলতানকে তীর ছুঁড়ে জনতার ভিড়ের মধ্যে বিশে যাই তাহলে আমাকে কেউ ধরতে পারবে না। সুলতানের লোভী জীবন এখানেই সাঙ্গ হয়ে যাবে– বললো এদেরই আরেক সঙ্গী ।
আরে রাখো! শুধু শুধু একা সুলতানকে হত্যা করলে তার রাজ্য আমাদের দখলে এসে যাবে না। তার যুবক একটি ছেলে আছে। সেও বাবার মতোই যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী। সুলতানকে হত্যা করে কিছু অর্জন হবে না আমাদের। বললো এদেরই আরেকজন।
খুন খারাবীর কথা রাখো। আমাদেরকে সুলতানের সেনাবাহিনীর অবস্থা দেখার জন্য পাঠানো হয়েছে। হিন্দুস্তান থেকে কি পরিমাণ সৈন্য নিয়ে ফিরে এসেছে, তাদের অবস্থা কি, তাই জানা আমাদের কাজ। কারণ ইসরাঈল সেলজুকী ধোকায় পড়ে একবার পরাজিত হয়েছে, আমাদের অনেক লোক নিহত হয়েছে। এমন ভুল সে আর করতে চায় না। বললো– চারজনের দল নেতা।
নিজেকে ধোকায় ফেলো না বন্ধু! গযনী সেনাদের শক্তি নিশ্চয়ই আমাদের চেয়ে অনেক বেশী বললো তাদের অপর একজন।
ধুর, এসব বাজে কথা। একজন সেলজুকী গযনীর পাঁচজন সৈনিকের চেয়েও বেশী শক্তি রাখে। আমি তো আগেই বলেছি, শুধু সুলতানকে যদি খুন করে ফেলা যায়, দেখবে গোটা গযনী বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যাবে। গযনী বাহিনীর অবস্থা তখন এই ভিক্ষুকের মতোই হয়ে যাবে ।
একথা বলে লোকটি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভিক্ষুককে ডাকলো। এই ভিক্ষুক! তোমার সুলতানকে বলো না, যে ধনসম্পদ হিন্দুস্তান থেকে লুট করে এনেছে, এ থেকে তোমাকে কিছু দিয়ে দিক।
পাকা দাড়ি, ছেঁড়া ফাটা ধুলি মলিন কাপড় পরা লোকটি ছিল যথার্থ অর্থেই একজন ভিক্ষুকের প্রতীক। তার এক হাতে একটি পুরনো ক্ষয়ে যাওয়া লাঠি, আর এক হাতে ভিক্ষার ঝুলি। ভিক্ষুক জনতা থেকে কিছুটা ব্যবধানে দাঁড়িয়ে থাকা এই চারজনের পাশেই দাঁড়িয়ে ভিক্ষার আশায় সমবেত জনতার দিকে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে ছিল। ডাক পেয়ে সে পৃথকভাবে দাঁড়িয়ে থাকা এই চার দর্শনার্থীর কাছে চলে এলো এবং বললো
আমি গয়নবী নই, একজন সেলজুকী। গযনীর লোকেরা সেলজুকী ফকীরদের ভিক্ষা দেয় না।
আরে তোমার দেহে সেলজুকী রক্ত থাকলে তুমি নদীতে ডুবে মরতে; কিন্তু ভিক্ষা করতে না–তিরস্কার মাখা কণ্ঠে বললো দর্শনার্থীদের একজন। যাও, চলে যাও এখান থেকে। ইসরাঈল সেলজুকীর ওখানে চলে যাও। সেখানে কোন ভিখারী নেই, সবাই রাজা।
আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম আপনারা সেলজুকী। এজন্যই আপনাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলাম।
কিন্তু আমরা তোমাকে ভিক্ষা দেবো না। তোমার এই বদ অভ্যাসকে আমরা সমর্থন করতে পারি না বললো এক সেলজুকী।
এরপর ভিক্ষুক ও চার সেলজুকী দর্শনার্থীর মধ্যে আর কথা এগুলো না । সেনাবাহিনী সেই জায়গা অতিক্রম করার পর দর্শনার্থীরাও যে যার মতো করে চলে গেলো। এরাও জায়গা ত্যাগ করে শহরের পথ ধরলো। কিন্তু ভিক্ষুক তাদের পিছু ছাড়লো না। নিরাপদ দূরত্বে থেকে এই চার সেলজুকীর গতিবিধির উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখলো।
* * *
রাজধানীতে ফিরে সুলতান মাহমূদ ঘরে না গিয়ে তার দফতরেই খাবার খেলেন। খাবার খেতে খেতেই তিনি তার অবর্তমানে দায়িত্ব পালনকারী উজিরের কাছ থেকে জেনে নিলেন গযনীর সার্বিক অবস্থা।
উজির সুলতানকে জানালেন– অবস্থা ভালো নয়। সেলজুকীরা আমাদের জন্যে মারাত্মক বিপদ হয়ে উঠছে। ইসরাঈল সেলজুকী বিরাট শক্তি সঞ্চয় করেছে। বুখারা ও আশেপাশের সব লোক তার সঙ্গী হয়ে গেছে। ইসরাঈল সেলজুকীর মধ্যে মানুষকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা আছে। সে বুখারার ক্ষমতালোভী নেতাদেরকে তার পক্ষে নিয়ে এসেছে। সে গোটা সেলজুকী জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করে গাদ্দার আলাফতোগীনকে সাথে নিয়ে গযনী আক্রমণের চক্রান্ত করছে।
শুধু এখানেই নয়, সেলজুকী সমস্যা তো এবার আমার সঙ্গেই গিয়েছিল। আল্লাহর রহমতে কমান্ডার উমর ইয়াজদানীর স্ত্রীর অসম সাহসিকতার কারণে আমরা বেঁচে গেছি। যুদ্ধের আগের রাতে এরা রাজা গোবিন্দকে আমাদের যুদ্ধ প্রস্তুতি ও সেনাদের অবস্থান জানানোর জন্যে রওয়ানা হয়ে গিয়েছিল। পরিচয় গোপনকারী দুই কোচওয়ানের ধরা পড়ার ব্যাপারটি সবিস্তারে উজিরকে জানালেন সুলতান।
সেলজুকীরা গয়নীতেই আপনাকে হত্যা করার অপচেষ্টা করছে। আজ চারজন সেলজুকীকে আমাদের গোয়েন্দারা গ্রেফতার করেছে- সুলতানকে জানালেন উজির ।
এরা কি স্বীকার করেছে আমাকে খুন করার জন্যে এসেছিল? কোথায় এরা?
জী হ্যাঁ, তারা যে মন্দ ইচ্ছায় এসেছিল তা তাদের কাছ থেকে বের করা হয়েছে। কাছেই আছে। আপনি চাইলে তাদের এখানে হাজির করা হবে।
ধৃত চারজনকে সুলতানের সামনে হাজির করা হলো। তাদের পায়ে বেড়ী, মাথা দোলছিল। তাদের কেউই ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছিল না। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তাদের উপর যথেষ্ট দখল গেছে। উজীর একজনের নাম উচ্চারণ করে প্রহরীকে বললেন– অমুককে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।
একটু পরে সুলতানের কক্ষে প্রবেশ করল একজন ভিক্ষুক। তার পরনে ছেঁড়া ফাটা ধুলোমলিন কাপড়। মাথায় উষ্ণু খুফু লম্বা চুল, দীর্ঘ চুল আর ময়লা মিলে অনেকটাই জটের রূপ নিয়েছে। তার হাতে লাঠি আর কাঁধে ভিক্ষার ঝুলি।
সম্মানিত সুলতান! এই লোক হলো সেই ভিক্ষুক, যে এদের কথা কাছে থেকে শুনেছে এবং এদের গতিবিধির উপর দৃষ্টি রেখে এদের আস্তানা থেকে সময় মতোএদেরকে ধরিয়ে দিয়েছে। এরা যার বাড়ীতে ছিল সেখানকার তল্লাশী নিয়ে জানা গেছে, লোকটি সন্দেহজনক। এই ভিক্ষুক আসলে গোয়েন্দা বিভাগের একজন দক্ষ কর্মকর্তা।
আমরা যখন দেখলাম আপনাকে স্বাগত জানানোর জন্যে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছে, তখন ভীড়ের মধ্যে গোয়েন্দাদের ছড়িয়ে দিয়েছিলাম, যাতে কোন নাশকতা কিংবা অনাকাঙ্খিত ঘটনার উদ্ভব না ঘটতে পারে। এই গোয়েন্দা আপনাকে জানাবে কিভাবে সে এদের পাকড়াও করেছে। ভিক্ষুক বেশধারী গোয়েন্দা কর্মকর্তা সুলতানকে জানালো–
মাননীয় সুলতান! আমি দেখলাম, আপনার অভূতপূর্ব বিজয়ে লোকজন আনন্দে আত্মহারা হয়ে লাফালাফি করছে। আনন্দে নাচছে, গাইছে, শ্লোগান দিচ্ছে এবং এলোপাথাড়ী হয়ে ছুটাছুটি করছে, ধাক্কাধাক্কি করছে। কিন্তু এরা চারজন জটলা থেকে কিছুটা দূরে নির্বিকার দাঁড়ানো। দেখে মনে হচ্ছিল, তারা জটিল কিছু ভাবছে এবং এই বিজয় উল্লাসে তারা মোটেও খুশি হতে পারছে না। বরং মানুষের এই উল্লাসে তারা বিরক্ত। আমি তখন ধীরে ধীরে তাদের কাছে গিয়ে তাদের কথাবার্তা শুনতে চেষ্টা করলাম।
সেলজুকীদের পারস্পরিক কথাবার্তা এবং তার সাথে সেলজুকীদের কথাবার্তার বিস্তারিত সুলতানকে শোনালো গোয়েন্দা।
সব শুনে সুলতান অভিযুক্ত সেলজুকীদের উদ্দেশ্যে বললেন –তোমরা কি তোমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমার কাছে কিছু বলবে? আমি শুনতে পেলাম, তোমরা আমাকে হত্যা করতে এসেছিলে?
না সুলতান! আমরা আপনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে আসিনি– বললো এক সেলজুকী। অবশ্য আমাদের একজন আপনাকে হত্যা করার কথা বলেছিল। কিন্তু হত্যার উদ্দেশ্য তার ছিল না। ধরা পড়ে যাওয়ার পর আমরা সবই বলে দিয়েছি। আমাদের উপর এতো জুলুম করার দরকার ছিল না। আমরা কিন্তু ধরা পড়ার সাথে সাথেই পরিস্কার করে সব বলে দিয়েছি। আমরা সেলজুকী। সেলজুকীরা মিথ্যা বলে না। আমরা আপনাকে শত্রু মনে করি। আপনি চালাকি করে একবার
আমাদের বহু লোককে হত্যা করেছেন।
আমরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছি। আমরা সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবো। আমরা হিন্দুস্তানের মূর্তিপূজক নই, মুসলমান। কিন্তু মুসলমান হলেও আমাদের কোন দেশ নেই, রাজ্য নেই। আল্লাহর যমীনে এমন কোন জায়গা নেই, যাকে আমরা আমাদের দেশ বলতে পারি। আমরা দীর্ঘ দিন ধরে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমরা চাই আমাদের একটা দেশ হোক। এই দেশের জন্যই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। যেখানে সেলজুকীরাই হবে বাদশা। একটা সেলজুকী রাষ্ট্র হবে।
তোমাদের কথা হয়তো ঠিক। কিন্তু তোমাদের রাষ্ট্র গঠনের জন্যে আমার সালতানাতের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি কেন? যে কোন দুর্বল একটা রাজ্য দখল করে নিলেই পারো।
দুর্বলের কাছ থেকে কিছু কেড়ে নেয়া বীরত্বের ব্যাপার নয়। আপনি আমাদের চেয়ে বেশী শক্তিশালী। আমরা চাচ্ছি আপনার অধীনস্থ কোন রাজ্যে আমাদের রাষ্ট্র গঠন করতে। বিশ্বাস করুন, আপনাকে হত্যা করার কোন ইচ্ছা আমাদের আদৌ ছিল না। আমরা চাচ্ছিলাম, আপনার সামরিক শক্তি দুর্বল করে দিয়ে যুদ্ধের ময়দানে আপনাকে পরাজিত করতে।
ধন্যবাদ তোমাদেরকে। আমার কাছে ভালো লাগছে যে, মৃত্যুমুখেও তোমরা বীরের মতো অকপটে তা-ই বলছো, যে কথা তোমরা বিশ্বাস করো এবং মনে পোষণ করো– বললেন সুলতান। আমিও তোমাদের সাথে বীর জাতির নেতার মতোই আচরণ করবো। আমার বিরুদ্ধে এবং মুসলিম সালতানাতের বিরুদ্ধে অন্যায় চক্রান্তকারী হলেও আমি তোমাদের হত্যা করবো না এবং জেলে ঢোকাবো না। তোমাদেরকে আমি শাহী মেহমানের মতোই মর্যাদা দেবো। সুলতান একজন প্রহরীকে ডেকে বললেন– এদের বেড়ী খুলে দাও।
ডান্ডা-বেড়ী খুলতে খুলতে সুলতান বললেন, গমনী বাহিনী সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কি?
খুব শক্তিশালী বাহিনী–বললো এক সেলজুকী। আমাদের ধারণা ছিল হিন্দুস্তান থেকে আপনার সৈন্যরা দুর্বল ও রণক্লান্ত হয়ে গযনী ফিরবে। কিন্তু যা দেখলাম, নতুন হাতি, ঘোড়া, সাজ সরঞ্জাম নিয়ে আপনার বাহিনী আগের চেয়ে আরো শক্তিশালী হয়ে ফিরেছে।
তোমাদের নেতা ইসরাঈল সেলজুকী কি আমাদের সাথে এখনও যুদ্ধ করবে? জানতে চাইলেন সুলতান।
এ কথার জবাব সেই দিতে পারবে, আমরা এর জবাব দিতে পারবো না। আমাদের কাছে আমাদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে পারেন– বললো এক সেলজুকী।
না, আমি আর কিছুই তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করবো না বললেন সুলতান। আমি তোমাদের কয়েকটি কথা বলে দিতে চাই। ফিরে গিয়ে তোমরা তোমাদের নেতা ইসরাঈল সেলজুকীকে আমার সালাম দিয়ে বলবে আমি তোমাদেরকে পাহাড়ের উপত্যকা ছেড়ে ঝিঝান নদীর তীরবর্তী বিশাল এলাকায় বসবাস করতে দেবো এবং সেখানে তোমরা নিজের মতো করে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে পারবে। তাকে বলবে, একই ধর্মের অনুসারী দু’টি জনগোষ্ঠী যদি একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাতে উভয় গোষ্ঠীই দুর্বল হয়ে পড়বে শক্তিশালী হবে ইহুদী নাসারা গোষ্ঠী। যারা আদিকাল থেকেই মুসলমানদের শত্রু। ইহুদী খৃষ্টানরা আমার যেমন শত্রু তোমাদেরও বন্ধু নয়। সুযোগ পেলে তারা আমাদের সবাইকে ধ্বংস করে দেবে।
তাকে আরো বলবে, জন্ম মৃত্যু আল্লাহর হাতে। তদ্রূপ জয় পরাজয়ও আল্লাহ হাতে। তোমরা আমার সেনাদের মধ্যে তোমাদের চর ঢুকিয়ে দিয়ে হিন্দু রাজাদেরকে আমার যুদ্ধ কৌশল ও সেনাদের স্থানের খবর দিয়ে আমাকে পরাজিত করতে চেয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তোমাদের বন্ধুগোষ্ঠী এলিকখানী এক তরুণীর দ্বারাই তোমাদের সকল চক্রান্ত্র ফাঁস করে দিয়েছেন। তোমরা যদি বাহাদুর জাতিই হবে তাহলে নারী দিয়ে এই চক্রান্ত করতে গেলে কেন? যুদ্ধতে পুরুষের কাজ। হিন্দুদের সাথে মৈত্রী করে তোমরা আমাকে থোকা দিতে চাচ্ছিলে। কিন্তু তোমরা কি জানো না, কোন কিছুই প্রকৃত মুসলমানের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। তোমাদের নেতাকে বলবে, সে যার হাতে আমাকে পরাজিত করার চক্রান্ত করেছিল, সে আমাকে এতোটাই ভয় পেয়ে গেছে যে, লড়াই করা ছাড়াই হাতি ঘোড়া ফেলে রণাঙ্গণ থেকে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেছে। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ। তোমাদেরকেও বলবো, আল্লাহর সামনে নিজেদেরকে পেশ করো।
ইসরাঈলকে বলবে, সে যেনো নির্দ্বিধায় আমার সাথে সাক্ষাত করে। সে যদি না আসতে চায়, তবে আমাকে ডাকলে আমি তার কাছে চলে যাবো। আমার এই কথাগুলো হুবহু তাকে বলবে। যাও, তোমরা মুক্ত।
এই গল্পেই আমরা আগে বলে এসেছি বুখারা ও সমরকন্দের পাহাড়ী এলাকায় ঈঝ নামের একটি উপজাতি বসবাস করতো। এদের কোন নির্দিষ্ট এলাকা ছিল না। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে এরা। ঈঝ গোত্রের এক নেতার নাম ছিল লুকমান। লোকটি ছিল যেমন সাহসী তেমনই বুদ্ধিমান ও সুপুরুষ। সে নিজেকে সেলজুকী বলতো। লুকমান ঈ উপজাতিদের মধ্যে ধীরে ধীরে এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, সে নিজের পছন্দের নামে একটি স্বতন্ত্র গোত্র করে, গোত্রের নাম দেয় সেলজুকী। ঈঝ গোত্রের অধিকাংশ লোক লুকমানের নেতৃত্ব মেনে নেয় এবং নিজেদেরকে সেলজুকী বলে পরিচয় দিতে শুরু করে। সেলজুকী গোত্র ছিল স্বাধীন। তারা কোন নিয়মতান্ত্রিক শাসকের অধীনে ছিল না। গোত্রপতিই ছিল তাদের শাসক।
সেলজুকী গোত্রের জীবন ধারণের প্রধান উপায় ছিল পশুচারণ। এক পর্যায়ে এরা অন্যান্য লোকদের পশু ছিনতাই এবং লোকজনের কাফেলায় ডাকাতি ও লুটতরাজ করতে শুরু করে। এরা খুবই সঙ্গবদ্ধ হয়ে পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় থাকতো। তাই কেউ এদের মোকাবেলার চিন্তা করতো না। পরবর্তীতে এরা সুন্দরী মেয়েদেরও অপহরণ করতে থাকে। কিন্তু মেয়েদের অপহরণ করে এরা তাদের উপর কোন জুলুম করতো না। বরং পরম যত্নে তাদের নেতাদের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতো। ফলে অপহৃত মেয়েরা তাদের এখানে পরম সুখেই কালাতিপাত করতো।
সেলজুকীরা উপজাতি হলেও তাদের জীবন-যাপন, চলা ফেরা এমন আকর্ষণীয় ছিল যে, অন্যান্য গোত্রের উপজাতি লোকেরাও সেলজুকীদের সাথে মিশতে থাকে এবং নিজেদের সেলজুকী পরিচয় দিতে থাকে। দেখতে দেখতে ষাট সত্তর বছরে এই সেলজুকী গোত্রের পরিধি বিরাট আকার ধারণ করে। ইতোমধ্যে আরো ভিন্ন গোত্রের লোক এসে সেলজুকী গোত্রে যোগ দেয়, মূল। গোত্রের লোকদেরও সন্তান সন্ততি বেড়ে লোক সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
সেলজুকীরা লড়াকু ও দুঃসাহসী হওয়ার কারণে ছোট ও দুর্বল রাজ্যের শাসকরা তাদেরকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লাগিয়ে দিতো। কারণ সেলজুকীরা রীতিমতো একটি সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। তাদের গোত্রে ছিল অনেক যুদ্ধ পারদর্শী সক্ষম যুবক।
তুর্কি ও সামানীদের মধ্যে বিরোধ ছিল দীর্ঘ দিনের। সামানী শাসকরা এক পর্যায়ে সেলজুকীদেরকে তুর্কিদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধে ব্যবহার করে। এরপর সুলতান মাহমূদের কাছে পরাজিত আলাফতোগীন গযনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে সেলজুকীদের সাথে একটি সামরিক চুক্তি করে। এই সামরিক চুক্তির প্রধান কারণ ছিল লকুমান সেলজুকীর মৃত্যুর পর গোত্রের নেতা হয় তার ছেলে ইসরাঈল সেলজুকী। ইসরাঈল সেলজুকী সুলতানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসে শোচনীয় পরাজয়ের শিকার হয়।
সুলতান মাহমূদ হিন্দুস্তান থেকে লড়াই ছাড়াই বিজয়ী বেশে ফিরে আসার পর তার উজীর তাকে জানালেন, ইসরাঈল সেলজুকী এখন গযনীর জন্যে মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে। এখনই এই আপদ দমন না করলে আমাদের বহু মূল্য দিতে হতে পারে। সেলজুকী হুমকির প্রমাণ সুলতান গযনীতে পা দিয়ে নিজের চোখেই দেখলেন। কিন্তু নিজের প্রাণঘাতি দুশনদের প্রতি খড়গহস্ত না হয়ে তিনি পরম ধৈর্যধারণ করে ধৃত চার সেলজুকীকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে ইসরাঈল সেলজুকীর কাছে মৈত্রী পয়গাম পাঠালেন।
যে ব্যক্তি আপনাকে হত্যার চক্রান্তে লিপ্ত, যে আপনার সালতানাতের জন্যে বিরাট হুকমী হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার সাথে আপনি সৌজন্য সাক্ষাতের প্রস্তাব করলেন সুলতান! সুলতানের পয়গাম শুনে অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন উজীর।
হ্যাঁ, আমি তাকে দোস্ত বানাতে চেষ্টা করবো। ইসরাঈল সেলজুকী নামের মুসলমান হলেও নিজেকে তো সে মুসলমান বলে দাবী করে। কোন মুসলমানের # রক্ত ঝরাতে চাই না আমি। নিজ ভূমি থেকে বহু দূরের দেশ হিন্দুস্তানের পেটের ৪ মধ্যে আমি চলে যাওয়ার মতো দুঃসাহসী অভিযান পরিচালনা করি। সেখানকার ৪, মাটি, বাতাস, তরু-লতা পর্যন্ত আমার শত্রু। এটা যেমন এক ধরনের দুঃসাহস, ও নিজের চিহ্নিত শত্রুদের অপরাধ ক্ষমা করে তাদের কাছে বন্ধুত্বের প্রস্তাব করাও ও এক ধরনের দুঃসাহস।
অবশ্য এটা আমার ও আমার সঙ্গীদের জন্যে চরম দুঃখের বিষয় যে, আমাকে একই সাথে দুটি শক্তির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এক দিকে মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিজিত হিন্দুস্তানের বিস্তৃত এলাকা, যা মুসলমানদের কাছ থেকে হিন্দুরা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। দারুল ইসলামকে হিন্দুরা দারুল কুফরে পরিণত করেছে, আমি বিন কাসিমের সেই বিজিত এলাকাকে পুনরুদ্ধার করে সেখানে ইসলামের পুনর্জাগরণ করতে চাই এবং ক্রমবর্ধমান পৌত্তলিক অপশক্তির কোমর ভেঙে দিতে চাই।
কারণ, হিন্দু শক্তিকে খতম করতে না পারলে এরা শুধু হিন্দুস্তানের মুসলমানদের জন্যই নয়, গোটা মুসলিম বিশ্বের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। অপর দিকে আছে ইহুদী খৃস্টান অপশক্তি। এই দুই অপশক্তির দ্বারা আমরা বেষ্টিত। আমরা কেন, যে কোন সময় মুসলমানরাই এই দুই অপশক্তির ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়বে কিংবা তাদের ফাঁদে পা দেবে, মুসলমানরা আত্মকলহে জড়িয়ে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে।
আর স্বজাতিও স্বধর্মের ক্ষমতা লোভীরা তো আমার জঘন্য শক্র। ক্ষমতার মোহ আর রাজত্বের লালসা এদেরকে আমার বিরুদ্ধে লাগিয়ে রেখেছে।
ইসরাঈল সেলজুকী বাস্তবেই একটা সামরিক শক্তি হয়ে উঠেছে। আমি ইচ্ছা করলে এই শক্তি শেষ করে দিতে পারি। বেঈমানরা তাই চায়। কিন্তু আমি কাফের বেঈমানদের আকাঙ্খা পূরণ করতে চাই না। আমি ইসরাঈল সেলজুকীকে আর শর্ত মানাতে চেষ্টা করবো। প্রয়োজনে আমি একটা এলাকা তাকে দিয়ে দেবো।
* * *
এই ঘটনার বিশ বাইশ দিন পর পাহাড়ের পাদদেশের একটি মনোরম জায়গায় ইসরাঈল সেলজুকী বসেছিল। তার পাশে স্ত্রী মারয়াম এবং অর্ধ বয়স্ক দু’জন লোক। তা ছাড়া যে চার সেলজুকী গযনীতে সুলতান মাহমূদকে হত্যা ষড়যন্ত্রে গ্রেফতার হয়েছিল তারাও ছিল। তারা সেলজুকী নেতা ইসরাঈলকে তাদের গ্রেফতার ও মুক্তি পাওয়ার ঘটনা সবিস্তারে জানালো। তারা এও জানালো, সুলতান মাহমূদ তাদের কি বলে মুক্তি দিয়েছেন এবং ইসরাঈলের কাছে কি পয়গাম পৌঁছাতে বলেছেন।
তোমরা বলছে, সুলতান মাহমূদ আমাদেরকে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য একটা এলাকা দিয়ে দিতে চায়- বললো ইসরাঈল। আচ্ছা! একথা কি সে সত্যিকার অর্থেই বলেছে? না তোমাদের প্রতি এই বলে তিরস্কার করেছে? একথা বলার সময় তার ভাবভঙ্গি কেমন ছিল? সে কি গর্ব অহংকারে আমাদের প্রতি তাচ্ছিল্য করে একথা বলেছে?
না সর্দার! জবাব দিল এক সেলজুকী। সে অহংকার নিয়ে একথা বলেনি। যদি তার মনে আমাদের প্রতি ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের ভাব থাকতো তাহলে একথা বলতো না। আপনি চাইলে সে আপনার সাক্ষাতে এখানেও চলে আসতে পারে।
এ থেকে বুঝা যাচ্ছে সেলজুকীরা এখন এমন শক্তি অর্জন করেছে যে, তারা যে কাউকে তাদের শর্ত মানতে বাধ্য করতে পারে—বললো মারয়াম।
মারয়ামের কথা আগেই বলা হয়েছে। সুলতান মাহমূদের আজীবন শত্রু এলিক খানের ভাতিজী এই সুন্দরী তরুণীর চিন্তা ভাবনা ও মন মানসিকতা ছিল এলিক খানের মতোই ইসলাম বিরোধী। সে বিয়ের আগেই ইসরাঈলকে বলেছিল– সুলতান মাহমূদকে যে হত্যা করতে পারবে, তার জন্যে আমি জীবন যৌবন সব কিছু কুরবান করে দিতে প্রস্তুত। ইসরাঈল সেলজুকী সুলতান মাহমূদকে চক্রান্ত করে হত্যা করবে, এই প্রত্যাশায়ই এলিক খান মারয়ামকে ইসরাঈলের কাছে বিয়ে দেয় এবং মারয়ামও এই নেশায়ই ইসরাঈলকে বিয়ে করে যে, ইসরাঈল মাহমূদকে হত্যা করে গযনীর রাজা হবে। আর মারয়াম হবে রাজ রাণী।
কিন্তু মারয়াম এখন বুঝতে পারছিল, ইসরাঈল সেলজুকী সুলতান মাহমুদের প্রস্তাব নিয়ে কিছু একটা ভাবছে। একটি স্বাধীন এলাকা পেয়ে গেলে সে এখন সুলতান মাহমূদের সাথে বিবাদে জড়াতে চাচ্ছে না।
এক পর্যায়ে ইসরাঈল সেলজুকী গয়নী থেকে ফিরে আসা চার সেলজুকী ও অর্ধবয়স্ক দুই বিদেশী লোককে বিদায় দিয়ে দিল। তারা চলে গেলে তার কাছে থাকল শুধু স্ত্রী মারয়াম। এই সুযোগে স্বামীর উদ্দেশে মারয়াম বললো–
আমি একথা শুনতে চাই না যে, আপনি সুলতান মাহমূদের সাথে কোন বিষয় নিয়ে সমঝোতা করেছেন। আপনার রাজিত হওয়ার ব্যাপারটি ছিল একটা দুর্ঘটনা। এখন আপনার এমন শক্তি আছে যে, আপনার কাউকে ভয় করার দরকার নেই। আপনার গোত্রের লোকেরা ছাড়াও আলাফতোগীন আছে আপনার সাথে, তোগাখানও আপনার সহযোগী। এখন আপনার কারো টোপ গেলার দরকার নেই। আপনি ইচ্ছা করলেই যে কারো কাছ থেকে রাজত্ব ছিনিয়ে নিয়ে স্বাধীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
শোন মারয়াম! আমি জানি, সুলতান মাহমূদকে তোমার ঘৃণা করার কারণ। তোমার রাজ রাণী হওয়ার স্বপ্ন পূরণে সে প্রধান বাধা। আমি তোমার রাজরাণী হওয়ার স্বপ্ন ঠিকই পূরণ করে দেবো। কিন্তু সংঘাতে যাওয়ার আগে আমাদের একটা নিজস্ব ঠিকানা দরকার, যে ঠিকানাটিকে আমরা আমাদের দেশ বলতে পারবো। একটি দেশ হলে আমরা সেখানে নিয়মিত একটি সেনাবাহিনী গঠন করতে পারবো, তাদের প্রশিক্ষণ দিতে পারবো। সেখানে আমাদের একটা মজবুত দুর্গ থাকবে। এখন তো আমাদের অবস্থা এমন যে, আমাদেরকে কেউ তাড়া করলে আমাদের আত্মরক্ষার কোন জায়গা নেই। আমাদেরকে লোকেরা জংলী যাযাবর, ছিন্নমূল ইত্যাদি বলে ডাকে। এজন্য মাহমূদের কাছ থেকে কিছু একটা আদায় করার সুযোগ দাও আমাকে।
ইসরাঈল সেলজুকীর কথার মর্ম বুঝতে পেরেছিল মারয়াম। কিন্তু তাদের কাছে বসা বিদেশী দুই লোক চাচ্ছিল না মারয়াম ইসরাঈলের কথার মর্ম উপলব্ধি করুক।
রাতের বেলা এই বিদেশী দু’জন লোক একটি দেয়ালের মতো জায়গার আড়ালে বসেছিল। তাদের কাছে ছিল ইসরাঈলের স্ত্রী মারয়াম। মারয়াম দুই বিদেশীকে বলছিল, সুলতান মাহমূদকে হত্যা করার শর্তে আমি তাকে বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সে গয়নী শাসকের ফাঁদে পা দেবে। সে আমাকে বলেছে, তাকে যেনো আমি মাহমূদের কাছ থেকে একটা অঞ্চল হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ দেই। কিন্তু তার নিয়তের ব্যাপারেই এখন আমার সন্দেহ দেখা দিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, সে মাহমূদের কেনা গোলামে পরিণত হবে।
ইসরাঈল ছাড়া তোমার দৃষ্টিতে নেতৃত্ব দানের মতো এই গোত্রে কি দ্বিতীয় কেউ আছে? মারয়ামকে জিজ্ঞেস করল একজন।
হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। আর সে হলো তোগাখান। দরকার হলে তাকে আমি বিয়ে করে নেবো।
আরে! সে আমার জন্যে এতাটাই পাগল যে, যখন শুনলো আমি ইসরাঈলকে বিয়ে করেছি তখন বিষ খেয়ে মরে যেতে চাচ্ছিল। একথা জানতে পেরে আমি তার সাথে সাক্ষাত করি। তখন তার অনেকটা পাগলের মতো অবস্থা। অথচ সে ছিল তার বাবার একমাত্র স্থলাভিষিক্ত হওয়ার যোগ্য। কিছু দিন পরেই তার বাবা মারা গেল। সে হলো তার বাবার স্থলাভিষিক্ত। কিন্তু তার মাথা ঠিক ছিল না। তার এই অবস্থা হোক সেটি আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলাম না। ফলে তাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক করার জন্যে আমি ইসরাঈল সেলজুকীর স্ত্রী হওয়ার পরও চুরি করে তোগা খানের সাথে সাক্ষাত করেছি । তাকে সঙ্গ দিয়েছি।
গোপনে গোপনে তার সাথেও আমার স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা আজ পর্যন্ত চালু আছে। এখন আমার মনে হচ্ছে ইসরাঈলের মৃত্যুই হবে আমাদের জন্যে উপকারী। তোগাখানই আমাদের আশা পূরণের যোগ্য ব্যক্তি।
এরা তিনজন চাঁদনী রাতের আলো আধারীর মধ্যে যে জায়গাটায় বসে কথা বলছিল, হঠাৎ সেই জায়গায় একটা ছায়ার মতো দেখা গেল এবং ধীরে ধীরে ছায়াটি দূরে সরে গেল। বিদেশী দু’জনই সেই ছায়া দেখে দাঁড়িয়ে গেল। তারা দেখতে পেল, আকাশের যেখানে চাঁদটা ভাসছে এর নীচ দিয়ে একটা ছায়ার মতো কি জানি সরে যাচ্ছে।
কি হয়েছে? অনুচ্চ স্বরে জিজ্ঞেস করলো মারয়াম।
আমার মনে হয় চাঁদের উপর দিয়ে মেঘ ভেসে গেছে। এজন্য ছায়া পড়েছে-বললো একজন বিদেশী।
* * *
পরের দিনের ঘটনা। তখন সকাল বেলার সূর্য উঠে গেছে। মিষ্টি রোদ ছড়িয়ে পড়েছে সব দিকে। পাহাড়ের সবুজ বৃক্ষ-লতায় ভোরের আলো পড়ে ঝিকমিক করছে। তিন দিকে দেয়ালের মতো পাহাড় ঘেরা একটি ফাঁকা জায়গা। মাঝখানটা সমতল। সমতলের ঠিক মাঝখানে পাশাপাশি তিনটি বড় গাছ। ভারি সুন্দর জায়গা। মাঝখানের গাছটির সাথে যেন পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মারয়াম। তার হাত পেছন মোড়া করে বাধা। আর তার পা ও শরীর একটি রশি দিয়ে গাছের সাথে পাচানো। তার ডান ও বাম পাশে মারয়ামের গত রাতের গল্পের সঙ্গী দুই বিদেশীও একইভাবে গাছের সাথে বাধা। তাদের সামনের ফাঁকা জায়গাটায় ইসরাঈল সেলজুকী পায়চারী করছে। আর তাদের সোজা সামনে দশ বারো গজ দূরে তিন জন তীরন্দাজ ধনুকে তীর ভরে তাদের প্রতি ধনুক তাক করে রেখেছে।
আমি জানতাম তোমরা ইহুদী, তোমরা মুলমানদেরকে পরস্পর যুদ্ধে জড়িয়ে দিতে পটু। দুই বিদেশীর উদ্দেশ্যে বললো ইসরাঈল। কিন্তু আমি তা জেনেও কয়েকজন মেয়ে ও কয়েকজন পুরুষকে সুলতান মাহমূদের সৈন্যদের মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টির জন্যে প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজ দিয়ে ছিলাম। তোমরা সেই কাজে মনোযোগী না হয়ে অবশেষে আমাকেই হত্যার নীল নকশা করছে। অবশ্য আমাকে একজন বলেছিল, ইহুদীরা সাপের মতো। এরা নিজ প্রভুকেই ছোবল মেরে বসে। আর এই কাল নাগিনীটাকে দেখো, তার স্ত্রী মারয়ামের প্রতি ইশারা করে বললো ইসরাঈল। এক সাথে সে দু’জনের স্ত্রী হিসেবে কাজ করছে। বিদ্রুপের একটা হাসি দিয়ে মারয়ামের উদ্দেশ্যে বললো–তুমি রাজরানী হতে চাচ্ছিলে? একবারও চিন্তা করলে না, তুমি কার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছো?
আমি তোমাকে শেষ বারের মতো বলছি– সুলতান মাহমূদের ফাঁদে পা দিয়ো না। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো মারয়াম।
হ্যাঁ, যা বলার শেষ বারের মতো বলে ফেলল। আমিও তোমাকে শেষ বারের মতো বলে দিচ্ছি– তুমি আমাকে ধোকা দেয়ার পরও আমি তোগা খানের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখবো। সেই সাথে সুলতান মাহমুদের সাথেও আমার শত্রুতা বজায় থাকবে। একদিন মানুষ গযনী সালতানাতের কথা ভুলে যাবে। সেলজুকী সালতানাতই তাদের কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে উঠবে।
ইসরাঈল বুক টান করে মাথা উঁচিয়ে উদ্যত কণ্ঠে বললো– আমি অবশ্যই সুলতান মাহমূদের কাছ থেকে একটা এলাকা নিয়ে নেবো এবং সেই এলাকাই হবে গযনীর সেনাবাহিনী, সুলতান মাহমূদ এবং গযনী সালতানাতের কবর রচনার উৎস।
তোমার মতো উগ্র, মূর্খ উপজাতি লোকেরা শত্রুর জন্যে গর্ত খুঁড়ে নিজেরাই সেই গর্তে পতিত হয় বললো এক ইহুদী। শোন ইসরাঈল! তোমার নাম ইসরাঈল রাখা হয়েছে। তোমার গায়ে ইহুদী রক্ত রয়েছে বলে। এই ইহুদী রক্তের মান রাখার জন্যে আমি তোমাকে খুব মূল্যবান একটা কথা বলছি। মনোযোগ দিয়ে শোন।
তুমি ঠিকই বলেছো, আমরা দুজনই ইহুদী। কিন্তু আমরা দুজনই আমাদের পোষাক-আশাক মুসলমানদের মতো করে রেখেছি। আমরা তোমাদের ইসলাম সম্পর্কে এতোটুকু জানি, যা তোমাদের ইমাম ও আলেমরাও জানে না। আমরা তোমাদের ঈমান বিনষ্ট করে দিতে পটু।
দুর্ভাগ্যবশতঃ আজ আমরা তোমার হাতে বন্দি। ঘটনা যা ঘটেছে তাহলো, তোমার কোন লোক আমাদের গোপন কথাবার্তা শুনে ফেলেছিল। নয়তো যে চমৎকার কৌশল ও নৈপূন্যের সাথে আমরা তোমার স্ত্রীর হাতে তোমাকে খুন করাতে যাচ্ছিলাম তুমি এর প্রশংসা না করে পারবে না। এটাও দেখেছো, কিভাবে আমরা সুলতান মাহমূদের সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রায় ভাঙ্গন ধরিয়ে ছিলাম এবং মাহমূদের বিরুদ্ধে তোমাদের ক্ষেপিয়ে তুলতে সফল হয়েছিলাম।
শোন ইসরাঈল! শেষ কথা তোমাকে বলে দিচ্ছি? তুমি যতোই চেষ্টা করো কেন, সুলতমান মাহমূদকে তুমি পরাজিত কিংবা খুন কিছুই করত পারবে না। অচিরেই এক মারাত্মক পরিণতির শিকার হবে তুমি। কারণ মাহমূদ পাক্কা ঈমানদার লোক যাদের ঈমান দুর্বল তারা পাক্কা ঈমানদারদের মোকাবেলায় পরাজিত হতে বাধ্য। কার ঈমান পাকা আর কার ঈমান কাঁচা এ নিয়ে আমাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। আমাদের কাজ হলো, দুর্বল সবল সকল মুসলমানদেরকে পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত রেখে মুসলিম শক্তি ও ঐক্যকে দুর্বল করে রাখা। সাধারণ সংঘর্ষে দুর্বল ঈমানদারদের পরা জত হতে হয়, কিন্তু আমরা তাদেরকেই বলি, তোমরাই পাক্কা ঈমানদার। লেগে থাকো বিজয় তোমাদেরই হবে।
অভিশপ্ত ইহুদী। দাঁতে দাঁত পিষে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো ইিসরাঈল। আমার সামনে মৃত্যু মুখে দাঁড়িয়েও আমাকে অপমান করছো? যাও, জাহান্নামে পাঠিয়ে দেব তোমাদেরকে। কথা শেষ করে দ্রুত এক দিকে সরে গেল ইসরাঈল এবং ধনুক তাক করে থাকা তিনজনকে ইঙ্গিত দিল। মুহূর্তের মধ্যে তিনটি তীর তিনজনের বুকে বিদ্ধ হলো।
আর্তচিৎকার দিয়ে উঠলো মারয়াম। ব্যথায় ঝাঁকিয়ে উঠলো ইহুদী দু’জন। কিন্তু কেউ বাঁচার জন্যে আকুতি করলো না। কারণ তারা জানে, খুনের চক্রান্তে জড়িত লোকদেরকে ইসরাঈলের মতো লোক কিছুতেই ক্ষমা করবে না। অতএব ক্ষমা ভিক্ষা অর্থহীন।
অতি লোভ আর মারয়ামের রাণী হওয়ার আকাঙ্খর এখানেই সমাপ্তি ঘটলো। সমাপ্তি ঘটলো মারয়াম অধ্যায়ের।
* * *
এরপর কেটে গেল কয়েক মাস। হঠাৎ এক দিন হিন্দুস্তান থেকে গযনী বাহিনীর এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা সুলতানের কাছে খবর নিয়ে এলো। এই খবর পাঠিয়েছেন কনৌজে নিয়োজিত গভর্ণর সেনাপতি আব্দুল কাদের সেলজুকী।
গোয়েন্দা সুলতানকে জানালো, কনৌজের গভর্ণর গোয়ালিয়র ও কালাঞ্জরে বহু গোয়েন্দা নিয়োজিত করেছিলো যখন কালাঞ্জরে মহারাজা গোবিন্দ পালিয়ে গেলেন। বিশেষ করে আমি রাজা গোবিন্দের রাজধানী কালাঞ্জরে পৌঁছার সাথে সাথেই ঋষীর বেশ ধরে সেখানে পৌঁছি। আমি গিয়ে মন্দিরের পুরোহিতদের আস্তানায় ঠাই নিই।
তখন গোটা রাজধানী ছিল ভয় আতংকে কম্পমান। লোকদের মধ্যে এতোটাই আতংক ছড়িয়ে পড়ে ছিল যে, কেউ ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস করতো না। মন্দিরের শিংগা ও ঘণ্টাগুলো অবিরত ঘণ্টা বাজিয়ে এই আতংককে আরো ভয়াবহ করে তুলেছিল। আমি দেখিনি, আমাকে জানানো হয়েছে, রাজা গোবিন্দ রাজধানীতে পৌঁছে দুই দিন মন্দিরে ছিলেন। রাজ প্রাসাদে তাকে দেখা যায়নি। কিন্তু দু’ দিন পর রাজার অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে যায়। তিনি পূর্ণ স্বাভাবিকতা ফিরে পান এবং কেন এমনটি হলো এর কারণ উদঘাটন করতে শুরু করেন।
একদিন ঋষির বেশে আমি শহরের একটি গলি দিয়ে হাটছিলাম। একটি বাড়ির আঙিনায় এক যুবতী মহিলাকে মাটিতে পড়ে কাঁদতে দেখে তাকে জিজ্ঞেস করলাম- মা! কাদছো কেন?
সে দাঁতে দাঁত পিষে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো- তুমি সন্যাসী সেজেছো? আমার বাচ্চাকে ফিরিয়ে দাও। তার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, মন্দিরের পুরোহিতরা রাজার এই অবস্থা দেখে পরামর্শ দিয়েছে, তিনটি পাঁচ ছয় মাসের শিশু বলি দিতে হবে।
যেই কথা সেই কাজ। রাজার নির্দেশে শহরে খোঁজ খবর নিয়ে তিন মায়ের কোল খালি করে তিনটি শিশুকে নিয়ে বলি দিয়ে তাদের রক্ত দিয়ে রাজাকে গোসল করানো হয়।
আহা! মহিলাটি কেঁদে কেঁদে আমাকে বলছিল, আমার নিষ্পাপ বাচ্চাটিকে যারা খুন করেছে, তাদের একদিন না একদিন শাস্তি হবেই হবে।
সেই গোয়েন্দা বললো- আমি বেশীর ভাগ সময় মন্দিরেই কাটিয়েছি। পুরোহিতদের সাথে আমার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠলো। ফলে আমার পক্ষে রাজ মহলের অভ্যন্তরীণ খবরাখবরও জানার সুযোগ হয়েছিল। সুলতান!
আবেদীন! একথা ভুলে যাও, আমি কোন গযনীর সুলতান বা আদৌ সুলতান কি না। তুমি আমাকে সেই সব না বলা কথা শোনাও, যা কোন বন্ধু একান্ত বন্ধুকে শুনিয়ে থাকে।
জী সুলতান! আমি বলছিলাম, হিন্দুদের মন্দিরের রহস্যজনক, জটিল ও প্রতারণাপূর্ণ কর্মকাণ্ড দেখলে মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। হিন্দু ধর্মে নারীর প্রভাব যথেষ্ট।
অন্ধকার গুহার মধ্যে চামচিকারা যেভাবে ঝাঁকে ঝাকে থাকে ওখানকার পথে ঘাটে এভাবেই গিজগিজ করে যুবতী নারীরা। একদিন আমি একটি বাড়ীর অন্ধকার আঙিনা পেরিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ আমার সাথে একটি মেয়ের ধাক্কা লাগল। কাঁদছিল। আমাকে পেয়ে সে অনুরোধ করতে লাগল, দয়া করে এখান থেকে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। আমি আজীবন আপনার দাসী হয়ে থাকবো। আমি মরতে চাই না। রাজার জন্যে আমি জীবন বিলিয়ে দিতে চাই না।
সে ছিল তরুণী। ভয়ে কাঁপছিল সে। আমাকে জড়িয়ে ধরলো। জীবন বাঁচানোর জন্যে আমাকে হাতে পায়ে ধরে অনুনয় বিনয় করতে লাগল। তার কথা শুনে আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না, এই তরুণী কারো না কারো কুমারী কন্যা। মন্দিরের পুরোহিতরা তাকে বলী দেয়ার জন্যে তুলে নিয়ে এসেছে।
আমাকে ক্ষমা করবেন সুলতান! তরুণীর অনুরোধে আমি আমার কর্তব্য ভুলে গেলাম। মূলত আমার সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল রাজা গোবিন্দের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা। কিন্তু একটা নিরপরাধ মানুষের জীবন এভাবে নষ্ট হতে দেখে আমার মধ্যে মানবিক দায়বোধ সৃষ্টি হলো। আমি মেয়েটিকে যথাসম্ভব আশ্বস্ত করতে বললাম- ঠিক আছে, তুমি শান্ত হও। দেখি তোমার জন্য আমি কি করতে পারি।
আমি মনে মনে আল্লাহর কাছে নিবেদন করলাম, হে আল্লাহ! মানুষের জন্যে এখানে মানুষকে জবাই করা হয়। আমি এই অনর্থক জবাই হওয়া থেকে তোমার এক নগন্য বান্দিকে বাঁচাতে চাই, এর বদৌলতে তুমি আমার এখানে আসার উদ্দেশ্য সফল করে দাও।
অন্ধকার আঙিনায় হঠাৎ আমি একটু আশার আলো দেখতে পেলাম। মেয়েটি আমাকে তাগাদা দিচ্ছিল আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন। যেখানে ইচ্ছা সেখানে নিয়ে যান। তাড়াতাড়ি করুন। আমি মন্দিরের বদ্ধ কক্ষ থেকে পালিয়ে এসেছি। মন্দিরের পুরোহিতরা হয়তো আমাকে খুঁজছে।
মেয়েটি তখন থরথর করে কাঁপছিল।
এমন সময় আমার কানে কারো দৌড়ানোর শব্দ ভেসে এলো। আমি মেয়েটিকে বললাম- তোমাকে নিয়ে তো আমি বিপদে পড়বো। মনকে শক্ত করে এখন কান্না থামাও। এরপর মেয়েটিকে এক হাতে ধরে তাকে নিয়ে একটি দেয়ালের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে একটি পরিত্যক্ত ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম।
আমরা ঘরের ভেতরে ঢুকতেই বাইরে থেকে কানে ভেসে এলো, এ ঘরে ঢুকে দেখো। এতো অল্প সময়ের মধ্যে যাবে কোথায়?
সন্ন্যাসীর পোষাকের ভেতরে আমি খঞ্জর লুকিয়ে রেখেছিলাম। সেটি বের করে প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। বাইরে হয়তো দু’জন লোক ছিল। ভাঙ্গা দেয়াল দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল একজন। আমি তখন দরজাবিহীন খালি জায়গাটায় দেয়ালের আড়ালে ওৎপেতে রইলাম। লোকটি ঘরের দরজায় এসেই হাঁক দিল। কে এখানে? ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে লোকটিকে ভূতের মতো একটা ছায়া মনে হচ্ছিল। আমি তাকে খঞ্জরের আঘাত না করে এক ঝাঁপটায় তার ঘাড় পেঁচিয়ে ধরলাম এবং আমার বাহুতে আটকে ফেললাম। তার পক্ষে কোন কথা বলা সম্ভব হলো না।
বাইরে থেকে আওয়াজ এলো- ভেতরে কেউ আছে, না নেই?
আমি বললাম- নেই। তোমরা সামনে দৌড়াও।
মুহূর্তের মধ্যে আমার কানে এলো দৌড়ানোর শব্দ। এদিকে আমি যার গলা আটকে রেখে ছিলাম এমনভাবে তার গলায় চাপ দিলাম যে, সে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে কয়েকটা ঝাঁকুনি দিয়ে নেতিয়ে পড়ল। মৃত্যু নিশ্চিত হলে আমি তাকে ফেলে দিয়ে দ্রুত তার শরীরের কাপড় খুলে মেয়েটিকে পরিয়ে দিলাম। তরুণীর চুলছিল খোলা? এলোমেলো। তা ছাড়া তার চেহারাও বেশ সুন্দর। আমি মেঝেতে হাত দিয়ে ধুলোবালি হাতে নিয়ে তার চেহারায় মাখলাম এবং কাপড় দিয়ে তার মাথা পেঁচিয়ে ফেললাম। আর মৃত পুরোহিতের গলার মালাটি তার গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে তার লেবাস সূরত সম্পূর্ণ বদলে ফেললাম।
এরপর তাকে নিয়ে সদর রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। আলোকিত প্রশস্ত রাস্তা দিয়েই আমি তাকে নিয়ে প্রধান মন্দিরের একটি পরিত্যক্ত জায়গায় চলে এলাম। এই জায়গাটিতে ময়লা ও শেওলা পরে সবুজ আঁঠার মতো হয়েছিল। আমি এই আঁঠালো ময়লা হাতে নিয়ে মেয়েটির চেহারায় ও চুলে মেখে তাকে পুরোদস্তুর সন্ন্যাসীনীর রূপ দিলাম।
এদিকে মন্দিরের ভেতরে বাইরে তরুণীর খোঁজে দৌড় ঝাঁপ শুরু হয়ে গেলো। পুরোহিত ও তাদের চেলারা এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছিল। আমাদের পাশ দিয়েও অনেকে ছুটাছুটি করেছিলো কিন্তু আমাদের প্রতি কেউ সন্দেহ করেনি এবং সন্যাসী বেশের তরুণীকে কেউ চিনতে পারেনি। এরপর আমি মেয়েটিকে মন্দিরের চৌহদ্দি থেকে বের করে শহরের কাছাকাছি একটি জঙ্গলে নিয়ে গেলাম।
মন্দির থেকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছলে মেয়েটি আমাকে জানালো, আর দু’এক দিনের মধ্যেই আমাকে বলি দেয়া হতো। মেয়েটি আমাকে আরো জানালো, তার বাবা কিছুতেই তার বলিদানে সম্মত ছিল না । কিন্তু রাজার একান্ত সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও পুরোহিতরা তাকেও হত্যার এবং তার উভয় মেয়েকেই তুলে নেয়ার হুমকী দেয়। সেই সাথে তাকে সরকারী চাকুরী থেকেও বরখাস্ত করে কঠিন শাস্তি দেয়ার হুমকী দেয়া হয়।
মেয়েটিকে নিয়ে রাতটি আমি জঙ্গলেই কাটালাম এবং দিনের বেলায় তাকে একটি নিরাপদ আস্তানায় রেখে সন্ধ্যার পর তার বাবার সাথে সাক্ষাত করলাম। সাক্ষাতে মেয়েটির বাবাকে জানালাম, তার মেয়ে এখন একটি নিরাপদ আস্তানায় আছে। লোকটি খুবই আতংকিত ছিল। সে আমাকে জানালো, ইতিমধ্যে তার ঘরে তল্লাশী চালানো হয়েছে। তাকে রাজার লোকেরা হুমকী দিয়ে গেছে। যদি তার মেয়েকে খোঁজে না পাওয়া যায় তাহলে তার অন্য মেয়েটিকে তুলে নেয়া হবে। সে আরো জানালো, আমার পক্ষে কোন অবস্থাতেই মেয়েটিকে ঘরে জায়গা দেয়া সম্ভব নয়। কারণ, পালিয়ে আসা মেয়েকে বাড়ীতে পেলে রাজার লোকেরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করবে।
লোকটি আমাকে দেখে খুবই অবাক হলো। কেননা, আমার লেবাস সূরত ছিল সন্ন্যাসীর। একজন সন্ন্যাসী কি করে মন্দিরে বলিদানের জন্যে আটক তরুণীকে পালানোর ব্যাপারে সহায়তা করতে পারে?
আমি তাকে বললাম, আসলে আমি সন্ন্যাসী নই। তবে আমার আসল পরিচয় তাকে তখনো জানাইনি। আমি তাকে বললাম, আপনি যদি অন্য মেয়েটিকে নিয়েও শংকাবোধ করেন তাহলে তাকেও আমি নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দিতে পারি।
লোকটি পড়ে গেল দোদুল্যমান অবস্থায়। একদিকে তার দুই সন্তানের জীবন, অপর দিকে তার নিজের অস্তিত্ব। এক পর্যায়ে সে বললো, আমরা সবাই যদি এখান থেকে চলে যেতে চাই তবে তুমি কোথায় নিয়ে যাবে?
আমি বললাম, আমি ইচ্ছা করলে আপনাদেরকে কনৌজ দুর্গে পৌঁছে দিতে পারি।
এক পর্যায়ে লোকটি তার অপর মেয়ে ও স্ত্রীসহ কনৌজ চলে যেতে রাজি হলো। সে ছিল একজন উচ্চ পদস্থ রাজ কর্মচারী। ফলে কনৌজ যাওয়ার জন্যে একটি ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা সে করে ফেললো। পরে আমি তার দুই মেয়েকেই সন্ন্যাসীর বেশে সাজিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে সওয়ার হয়ে শহরের বাইরের জঙ্গল থেকে রওয়ানা হলাম। আর মেয়েদের বাবা পৃথক ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে আমাদের অনুসরণ করলো।
সাধারণত হিন্দুদের স্বভাব হলো, বিপদে পড়লে তারা তাদের স্ত্রী-কন্যাদের ফেলে নিজেদের জীবন নিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু এই লোকটি ছিল ব্যতিক্রম। সে তার মেয়ে দুটোকে প্রাণাধিক ভালোবাসতো। মেয়েদের জীবন রক্ষার্থে সে তার নিজের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে কুণ্ঠাবোধ করেনি।
পথিমধ্যে একবার বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় বিরতির আগেই আমরা রাজা গোন্ডার এলাকা অতিক্রম করতে সক্ষম হলাম। তখন মেয়েদের বাবাও আমাদের সাথে মিলিত হলো এবং আমাকে বললো, আমার মেয়ে দুটোর জীবন বাঁচানোর জন্যে সে আমাকে পুরস্কৃত করতে চায়। এজন্য সে তার বাড়ী থেকে প্রচুর সোনা দানা নিয়ে এসেছে। আমি তাকে জানালাম, আমার এসবের দরকার নেই এবং সোনা দানার প্রতি আমার কোন আগ্রহও নেই। কারণ, আমি মুসলমান। আমি কালাঞ্জরে ছদ্মবেশে অবস্থান করছিলাম রাজা গোবিন্দের অবস্থা ও তার যুদ্ধ প্রস্তুতির ব্যাপারে তথ্য সগ্রহ করার জন্য। এটিই আমার মূল কর্তব্য।
একথা শোনে লোকটি খুশী হয়ে বললো, আরে মহারাজার সব খবরতো তোমাকে আমিই দিতে পারি। কারণ, গুরুত্বপূর্ণ রাজ কর্মচারী ছিলাম আমি। মহারাজা ও রাজপ্রাসাদের সব অভ্যন্তরীণ বিষয় আমার নখদর্পণে। রাজমহলের সদর অন্দর সব খবরই আমি জানি। আমি তোমাকে সবই বলতে পারবো। সে জানালো–
মহারাজা গোবিন্দ রণাঙ্গন থেকে মারাত্মক এক আতংক নিয়ে ফিরে এলেন। কিন্তু এই ভয়ের কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন না। তুমি যেহেতু হিন্দুস্তানে থাক, তাই তুমি হয়তো জানো, আমাদের সাধু সন্ন্যাসী ও যোগী ঠাকুররা এমন কিছু বিষয় জানে, তারা ইচ্ছা করলে যে কারো মাথা খারাপ করে দিতে পারে।
কিছু কিছু যোগী হিমালয়ের শৃঙ্গে চলে যায়। সেখানকার বরফ কখনো গলে । সেখানে তারা উলঙ্গ অবস্থায় থেকে সাধনা করে। এরা এমন শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হয় যে, দূরে থেকেও তারা যে কারো উপর যাদুর খেলা চালাতে পারে।
আসলে মহারাজা গোবিন্দ এতোটা হীনবল ছিলেন না যে, তিনি তিনগুণ সৈন্য থাকার পরও গযনী বাহিনীর মোকাবেলা না করেই রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে আসবেন। কিন্তু তারপরও যখন মহারাজা পালিয়ে গেলেন, তখন কালাঞ্জরে এতোটাই আতংক ছড়িয়ে পড়েছিল যে, লোকজন বাড়ীঘর ছেড়ে শহর থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে পড়েছিল। তখন বাতাসে খবর ছড়িয়ে পড়েছিল, মানুষ খেকো গযনীর সেনারা এ দিকে ধেয়ে আসছে।
এ অবস্থায় এক যোগী বললো, মহারাজাকে কেউ যাদু করেছে। সে যাদুর প্রভাব মুক্ত করার কাজে লেগে গেল। তিনটি দুগ্ধপোষ্য শিশুকে বলি দিয়ে সেই রক্ত পানির সাথে মিশিয়ে মহারাজাকে গোসল করানো হলো।
এক পর্যায়ে যাদুর প্রভাব কেটে গেল। মহারাজা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পেল। জানা গেল, রাজারই এক রাণী তার ছেলেকে রাজার স্থলাভিষিক্ত করার জন্যে এই যাদু করিয়েছিল। কারণ রাজা সেই রাণীর পুত্রকে তার স্থলাভিষিক্ত না করে অন্য রাণীর পুত্রকে স্থলাভিষিক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিল। ফলে রাণী প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে রাজার উপর যাদু চালায়।
রাণীর যাদুর ব্যাপারটি জানতে পেরে রাজা গোবিন্দ অভিযুক্ত রাণীও তার ছেলের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। রাণী মৃত্যুদণ্ডের কথা শুনে রাজার কাছে আবেদন করে, অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ তাকে মৃত্যু দণ্ড দিলেও তার নিরপরাধ পুত্রকে যেন রাজা ক্ষমা করে দেন। রাজা শর্ত দিলেন, যে যোগী এই যাদু করেছে তার পরিচয় বললে তোমার আবেদন মঞ্জুর করা হবে। রাণী বললো, যে সন্ন্যাসী এখন আপনাকে সুস্থ করেছে সেই সন্ন্যাসীই যাদু করেছিল। বিষয়টি জানার পর রাজা তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। রাজা এই রাণীর সাথে তার পুত্রকেও হত্যা করে এবং সেই যোগী সন্ন্যাসীকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়।
এর পর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রাজাকে বললো- আপনার আশু বিপদ মুক্তির জন্য একটি কুমারী তরুণীকে বলিদান করতে হবে। তারা তরুণীর গুণাবলী বললো, এবং আমার ছোট মেয়েকে নির্বাচন করলো।
অবশ্য আমি আমার মেয়েকে নির্বাচন করার কারণ বুঝতে পেরেছিলাম। পণ্ডিতেরা একবার আমার বড় মেয়েকেও বলি দেয়ার প্রস্তাব করেছিলো। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।
তুমি মুসলিম। তোমরা তো বুঝবে না দেবতাদের অসন্তুষ্ট করলে আমাদের সবকিছুই বরবাদ হয়ে যায়। পণ্ডিতেরা যদি কোন কারণে ক্ষুব্ধ হয় তাহলে আমাদের মাথার উপর আসমান ভেঙে পড়ে। কারণ পুরোহিত আর পণ্ডিতদের সন্তুষ্টি অসন্তুষ্টি আর চাওয়া পাওয়াই আমাদের ধর্মের মূলভিত্তি।
মাননীয় সুলতান! এরপর লোকটি আমাকে জানালো, মাথা ঠিক হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে রাজা গোবিন্দ সকল সৈন্যদের একত্রিত করে তাদের বলল, আমার উপর এক যোগী যাদু করেছিল। যাদুর প্রভাবে আমার মাথা ঠিকমতো কাজ করছিল না। আমরা রণাঙ্গণ ছেড়ে আসায় মুসলমানরা হয়তো আনন্দে আত্মহারা যে, তারা বিনা যুদ্ধে বিশাল এক জয় পেয়ে গেছে। এবার আমি নতুন করে গয়নী বাহিনীকে যুদ্ধের আহ্বান করবো। দেখবে? বিজয়ের নেশায় এবার তারা পঙ্গপালের মতো উড়ে আসবে। আর তোমরা ওদের ধরে ধরে বলি দেবে। তোমাদের ঘোড়া ও গরুর গাড়ী ও ঠেলাগাড়ির সামনে দলে দলে ওদের জুড়ে দেবে। ওরা তোমাদের গাড়িগুলোকে গলির মধ্য দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে। হরি হরিদেব আমাকে ইশারা দিয়েছেন, এবার গয়নীর মুসলমানরা এখানে ধ্বংস হতেই আসবে।
রাজা গোবিন্দ অসুস্থতা থেকে ওঠে এমন জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিল যে, তার সেনাদের মধ্যে নতুন করে যুদ্ধ উন্মাদনা দেখা দিল। শুধু সৈন্যরাই নয় সাধারন জনতাও সৈন্যদের সাথে এসে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো।
এরপর রাজা গোবিন্দ গোয়ালিয়রে রাজা অর্জুনের কাছে চলে গেল। কয়েক দিন সেখানে কাটিয়ে এসে বলল, গোয়ালিয়রের সৈন্যদের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে এসেছেন তিনি। গোয়ালিয়র থেকে ফিরে সে লাহোর গেলেন। কিন্তু মহারাজা তরলোচনপাল তাকে হতাশ করল। তরলোচন তাকে সামরিক সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানালো। তবে তাকে বহু সংখ্যক সৈন্য যুদ্ধ সরঞ্জাম, অর্থ সম্পদ দিয়ে বিদায় করল। সেই সাথে আরো আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস দিল।
সুলতানে আলি মাকাম! সেই হিন্দু কর্মকর্তা আমাকে জানিয়েছে, লাহোরের সৈন্যরা গঙ্গা যমুনার মিলনস্থলে পৌঁছে গেছে। তাদের গন্তব্য কালাঞ্জর।
মহারাজা গোবিন্দ বলেছেন, এবার তিনি মুসলিম বাহিনীকে পরাজিত করে গোটা হিন্দুস্তানে ছড়িয়ে পড়বেন এবং হিন্দুস্তানের মাটিতে কোন মসজিদের অস্তিত্ব রাখবেন না এবং কোন মুসলমানকে বেঁচে থাকার সুযোগ দেবেন না।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, রাজা গোবিন্দ কি ফাঁকা বুলি আওড়াচ্ছে, না যা বলছে তা তার করার সামর্থ আছে?
সে বললো, তা করার সামর্থ তার আছে। সে এতোটাই শক্তি অর্জন করেছে যে, রাজা অর্জুনকে সাথে নিয়ে সে লাহোরও দখল করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কনৌজ, রাড়ী, মহাবন, মথুরা, নগরকোট, মুলতান ও বেড়ায় যে সামান্য সংখ্যক গযনীর সৈন্য রয়েছে তাদেরকে দ্রুত নিঃশেষ করে দেয়া হবে। তোমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। এখন তার প্রস্তুতি খুব ব্যাপক। এই অঞ্চলের প্রতিটি নারীও এখন যুদ্ধে শরীক হতে প্রস্তুত।
* * *
এই গোয়েন্দার নাম আবেদনী। গোয়েন্দা আবেদীন সুলতান মাহমূদকে জানালো, সেই হিন্দু রাজ কর্মকর্তাকে তার দুই মেয়েসহ কনৌজ পৌঁছে দেয়া হলো এবং কনৌজে তার সাথে খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার করা হলো। সে গভর্নর ও সেনাপতি আব্দুল কাদের সেলজুকীকে বহু সোনা দানা উপহার দিয়ে বললো, আমি শুধু এতটুকুই আপনার কাছে আশা করি যেন আমার মেয়েদের কেউ হয়রানী না করে। সেনাপতি তার সোনাদানা কিছুই গ্রহণ করেননি। তিনি তার পরিবার নিয়ে সম্মানজনকভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করে দিলেন।
কিছুদিন কনৌজে থাকার পর সে মুসলমানদের আচার-আচরণ ও জীবনাচার দেখে এতোটাই মুগ্ধ হলো যে, কনৌজ দুর্গের প্রধান ইমামের নিকট গিয়ে সে তার দুই মেয়েসহ ইসলামে দীক্ষা নিল।
গোয়েন্দা আবেদীন সুলতানকে জানালো, সম্মানিত সুলতান! আমরা সেই হিন্দুর সব কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু তার কথা যাচাই করার জন্য আমরা সেইসব জায়গায় খোঁজ নিয়ে দেখেছি, সে যা বলেছিল তার সবই সত্য।
গোয়ালিয়রে আমাদের যে ব্যক্তি দায়িত্বপালন করছে, সে জানিয়েছে গোয়ালিয়রে জোরদার যুদ্ধপ্রস্তুতি চলছে। সে আরো জানিয়েছে, হিন্দুরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের প্রথম টার্গেট হবে বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প করে থাকা গযনী বাহিনীর সৈন্যরা। এরপর হিন্দুস্তানে বসবাসকারী ছেলে বুড়ো, শিশু মহিলা নির্বিশেষে সকল মুসলমান হবে তাদের পরবর্তী টার্গেট। এরপর সারা হিন্দুস্তানের সৈন্যরা গযনীর দিকে অভিযান চালাবে। গোয়েন্দা আরো জানালো, হিন্দুদের মধ্যে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। মন্দিরগুলোতে পণ্ডিতেরা মুসলমান হত্যাকে পূণ্যের কাজ বলে প্রচার করছে।
তুমি কি বলতে পারো, তাদের যুদ্ধপ্রস্তুতি কোন পর্যায়ে আছে? জানতে চাইলেন সুলতান।
অবশ্যই বলতে পারি সুলতান! বললো গোয়েন্দা আবেদীন। হিন্দু রাজাদের যুদ্ধপ্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে গেছে। যে সব লোক সেনাবাহিনীতে নতুন যোগ দিয়েছে তারা ততোটা গড়ে উঠতে পারেনি। তবে তারা অশ্বারোহণ, তরবারী চালনা ও তীরন্দাজী জানে। কিন্তু নিয়মিত সেনাদের মতো তারা রণাঙ্গনে মুখোমুখী যুদ্ধের উপযোগী হয়নি। এখনো তাদের প্রশিক্ষণ চলছে।
সেনাপতি আব্দুল কাদের সেলজুকী ও অন্যান্য ক্যাম্পে থাকা কমান্ডারগণ আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন, আমি যেন আপনাকে দ্রুত সেনাভিযানের জন্য অনুরোধ করি। তাহলে হিন্দুদের প্রস্তুতি পর্বেই আমরা কাবু করে ফেলতে পারবো। ওখানকার মুসলমানরা আতংকে আছে, হিন্দুরা না আবার মুসলিম হত্যায় মেতে ওঠে। আমাদের সেনারা তো লড়াই করে প্রাণ দিবে যেহেতু তারা শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত কিন্তু নিরপরাধ একজন মুসলমানের উপর আঘাত এলেও তা হবে আমাদের জন্যে অসহ্যকর।
মাননীয় সুলতান! সাধারণ মুসলমান ও মসজিদগুলোকে আমাদের অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। হিন্দুরা যদি আক্রমণ করে তাহলে মুসলমান মেয়েদেরকে প্রথম সুযোগেই অপহরণ করবে। এমনটি ঘটলে কেয়ামত পর্যন্ত লোকেরা আমাদের ঘৃণাভরে স্মরণ করবে এবং অভিশাপ দেবে।
হ্যাঁ, বুঝেছি। এবার লাহোরে আমাদেরকে অবশ্যই হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং খুব দ্রুত অভিযান চালাতে হবে- বললেন সুলতান।
* * *
সুলতান মাহমূদ তখনই সকল সেনাপতি ও কমান্ডারদের ডেকে ভারতের অবস্থা জানিয়ে দ্রুত সেনাভিযানের প্রস্তুতি নিতে বললেন। এও বললেন, অভিযান হবে খুব দ্রুত এবং সফরে খুব কম যাত্রা বিরতি দেয়া হবে। চলার মধ্যেই আমাদেরকে খাওয়া দাওয়া সেরে নিতে হবে। আমাদের প্রথম টার্গেট হবে কালা র দুর্গ। আমরা প্রথমেই কালাঞ্জর দুর্গ অবরোধ করবো। অবরোধ আরোপের পর সৈন্যরা কিছুটা বিশ্রাম সেরে নিতে পারবে। সুলতান সেনাপতিদেরকে যাত্রাপথ ও যাত্রা বিরতির জায়গাগুলো ভৌগোলিক মানচিত্রের সাহায্যে দেখিয়ে দিলেন।
সুলতান মাহমূদ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের দিক নির্দেশনা দিয়ে শেষ করতেই ইসরাঈল সেলজুকীর পয়গামবাহী দূত এসে হাজির। ইসরাঈল সেলজুকীর পয়গামবাহী মৌখিক পয়গামে জানালো, সেলজুকী নেতা বলেছে সুলতান যদি আমাদের সামরিক শক্তির প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমাদেরকে রাষ্ট্রগঠনের জন্যে জায়গা দিতে রাজী হয়ে থাকেন, তাহলে আমি তার জমি গ্রহণ করতে রাজি।
আর যদি তিনি তার সামরিক শক্তির গর্বে গর্বিত হয়ে থাকেন এবং আমাকে ভিখারী মনে করে ভিক্ষা হিসাবে এই প্রস্তাব দিয়ে থাকনে, তাহলে আমি তার এই প্রস্তাব মানতে রাজি নই। আমি আমার জাতির জন্যে একটি ভূখণ্ড অর্জন করার ক্ষমতা রাখি। আমাকে পরিষ্কার করে বলতে হবে, সুলতান কেন আমার প্রতি এই অনুগ্রহ দেখাচ্ছেন? সুলতানকে মনে রাখতে হবে, গয়নী বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার মতো সৈন্যবল আমার আছে।
ইসরাঈল সেলজুকীর বার্তা শুনে সুলতান হেসে বললেন- আমি বিশ্বাস করি, ইসরাঈল সেলজুকীর শক্তি ও সাহস উভয়টিই আছে। কিন্তু বুদ্ধি কিছুটা কম মনে হচ্ছে। তিনি দূতের উদ্দেশ্যে বললেন, তুমি গিয়ে ইসরাঈল সেলজুকীকে বলবে, আমি তাকেও দুর্বল ভাবছি না, নিজেকেও দুর্বল মনে করছি না। আমি আসলে এই অঞ্চলে একটা শান্তিময় স্থিতিশীল পরিবেশ চাই। কারণ আমাদের পারস্পরিক লড়াইয়ে কাফের ও বেঈমানেরাই শক্তিশালী হবে।
ইসরাঈল সেলজুকীকে আমার সালাম জানাবে এবং বলবে, এখন আমি হিন্দুস্তান যাচ্ছি। সে যেন আমার আসার জন্যে অপেক্ষা করে। আমি তাকে তার এলাকায় সবচেয়ে প্রভাবশালী বলেই মনে করি। তবে আমার অবর্তমানে যেন গযনীর বিরুদ্ধে কোন তৎপরতা না চালানো হয়।
এ পর্যায়ে সুলতান মাহমূদ শংকাবোধ করছিলেন, ইসরাঈল সেলজুকী না আবার তার অবর্তমানে গযনী আক্রমণ করে বসে। কারণ? তিনি জানতেন, সেলজুকীরা এমন শক্তি অর্জন করেছে, তারা ইচ্ছা করলে যে কোন ছোট রাজ্যের শাসককে তরবারী দেখিয়ে শর্ত মানতে বাধ্য করার ক্ষমতা রাখে।
এই প্রেক্ষিতে সুলতান মাহমূদ ইসরাঈল সেলজুকীর দূতকে একটি সবুজ-শ্যামল এলাকা দেখিয়ে বললেন, এই এলাকাটি সেলজুকীদের দেয়া হবে এবং সেলজুকীদের সব শর্তই মানা হবে।
ইসরাঈল সেলজুকীর দূত ফিরে গিয়ে সেলজুকীকে সুলতানের বক্তব্য জানালে সে সুলতানের ফিরে আসার জন্যে অপেক্ষা করতে সম্মতি প্রকাশ করলো।
* * *
১০২৩ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। সুলতান মাহমূদ এমন ক্ষিপ্রগতিতে ভারতে প্রবেশ করলেন যে, আজো তার সেনাদের গতির ব্যাপারটি নিয়ে সামরিক বিশেষজ্ঞগণ বিস্ময় প্রকাশ করেন। গযনী বাহিনী যে গতিতে কালাঞ্জরে পৌঁছেছিল, তখনকার পথ-ঘাট, গযনী থেকে কালাঞ্জরের দূরত্ব বিবেচনায় তা অসম্ভব মনে হয়। ৪ তখনকার সেনাবাহিনীর গঠন ও পথঘাটের অবস্থা বিবেচনায় যেকোন সফর ৪ ছিলো কঠিন ও দুর্গম। এছাড়াও পথিমধ্যে নদী-পাহাড়-জঙ্গল আরো কত শত 3 বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে গোয়ালিয়র হয়ে যে বিদ্যুৎগতিতে সুলতান মাহমূদ কালারে পৌঁছেন তা ছিল এক অপার বিস্ময়।
গযনী থেকে গোয়ালিয়র যেতে ছোট নদীগুলো বাদ দিলেও অন্তত পাঁচটি বড় নদী তাকে পার হতে হয়েছে। তন্মধ্যে সিন্ধু, ঝিলম, চন্নাব, রাবী, সালাজ, গঙ্গা, যমুনা এবং গাম্বল নদী ছিল উল্লেখযোগ্য।
গোয়ালিয়রের রাজা অর্জুন ছিলেন কালাঞ্জরের রাজা গোবিন্দের পরম মিত্র। গোয়ালিয়র দুর্গ আজো কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। সেই যুগে গোয়ালিয়র দুর্গ ছিল কিংবদন্তিতুল্য। দুর্গটি ছিল অত্যন্ত মজবুত শক্ত কাঠামো এবং সমতল থেকে উঁচু জায়গায় অবস্থিত ‘ চতুর্দিকে গভীর খাদের মতো খাল থাকার কারণে গোয়ালিয়র দুর্গ ছিল যে কোন শত্রু আক্রমণে অজেয়।
সুলতান মাহমূদ যখন গোয়ালিয়র দুর্গ অবরোধ সম্পন্ন করে ফেলেছেন, তখন রাজা অর্জুন টের পেলেন গযনী বাহিনী এসে গেছে। অবশ্য একটা মোক্ষম সময়ে সুলতান হিন্দুস্তানে পৌঁছাতে সক্ষম হন। দু’দিনের মধ্যে গোয়ালিয়র ও কালাঞ্জরের সৈন্য একত্রিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা তখনো অবস্থান করছিল নিজ নিজ রাজধানীতে। তখনো তাদের রণপ্রস্তুতি সম্পন্ন হয়নি।
অবরোধ আরোপ শেষ হতেই সুলতান মাহমূদ বুঝতে পারলেন, এই দুর্গকে কজা করা কঠিন। কারণ দুর্গ প্রাচীরের বাইরে যে ঢালু এবং ভোলা এলাকা রয়েছে সেখানে কারো পক্ষে শক্ত হয়ে দাঁড়ানোই কষ্টকর। তারপরও সুলতান মাহমূদ সৈন্যদের দুর্গ প্রাচীর ও দুর্গ ফটকে আঘাত হানার নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেন, সবাই সম্মিলিত কণ্ঠে উচ্চ আওয়াজে তকবীর ধ্বনি দিতে থাকো।
দুর্গ প্রাচীরের উপর থেকে গযনী সেনাদের লক্ষ্য করে তীর বর্ষণ শুরু হলো। কিন্তু তা দিয়ে মোটেও দমাতে পারলো না গযনী বাহিনীকে। তারা দল বেঁধে একসাথে আঘাত করে দুর্গ ফটক ভাঙতে চেষ্টা করলো। দুটি হাতিকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে এদের কাঁধে দীর্ঘ মোটা একটি গাছের কাণ্ড ঝুলিয়ে দিয়ে হাতিকে দুর্গ প্রাচীরের দিকে দৌড়াতো, হাতি ফটকের দিকে এগিয়ে সজোরে ধাক্কা দিতো, কিন্তু তাতেও দুর্গ ফটক ভাঙা সম্ভব হচ্ছিল না। এর পাশাপাশি গযনীর তীরন্দাজরা দুর্গ প্রাচীরের উপরে থাকা তীরন্দাজদের প্রতি তীর ছুঁড়ে ফটকে হামলাকারীদের সহায়তা দিচ্ছিল।
সকল গযনী যোদ্ধাদের সমস্বরে উচ্চারিত ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠছিল। এভাবে হামলা অব্যাহত থাকল চারদিন। পঞ্চম দিনের সূর্য উদয় হতেই দেখা গেল দুর্গে সাদা পতাকা উড়ছে। সাদা পতাকা দেখে সুলতান মাহমূদ লড়াই বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। এদিন দুর্গ প্রাচীরের উপর থেকে গযনী সেনাদের দিকে কোন তীর নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল না। দুর্গের প্রধান ফটক খোলা ছিল। এ সময় ফটক পেরিয়ে বাইরে এসে থামল একটি পালকি। পালকিটি বয়ে এনেছিল চারজন সেনা। পালকিটি সুলতান মাহমূদের সামনে এনে রাখা হলো। পালকির ভেতর থেকে বের হলো একজন রাজকীয় পোষাক পরিহিত লোক। সে রাজার দূত। রাজা মৈত্রীর বার্তা দিয়ে পাঠিয়েছেন। রাজা অর্জুন যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন ইতিহাসে সেই বার্তার কথা এভাবে লিখিত হয়েছে–
গযনীর সুলতান মাহমূদ গোয়ালিয়র দুর্গ অবরোধ করে টানা চারদিন এমন জোরদার আক্রমণ চালান যে, চারদিন পর পঞ্চম দিনে মহারাজা অর্জুন পালকীতে করে সুলতান মাহমুদের কাছে একজন শান্তি দূত পাঠান।
দূত এসে সুলতানের কাছে জানতে চাইলো, আপনি কি চান এবং আপনার আক্রমণের উদ্দেশ্য কি?
সুলতান বললেন, আমি মুসলমান। আমি আপনাদের আহ্বান করছি মূর্তিপূজা ত্যাগ করে আমরা যে একক সত্তা আল্লাহর ইবাদত করি আপনারাও তার ইবাদত করুন। আপনারা আমাদের মতো ইবাদত করুন এবং গরুকে পূজা না করে গরুকে একটি ভক্ষণযোগ্য পশু মনে করে এর গোশত আহার করুন।
দূত বললো, আমাদের পক্ষে গরুর গোশত খাওয়া সম্ভব নয়। তবে আপনি আপনার কোন পণ্ডিতকে দুর্গে পাঠান, যিনি আপনাদের ধর্মের ব্যাপারটি আমাদের কাছে উপস্থাপন করবেন যদি আপনাদের ধর্ম আমাদের ধর্ম থেকে আরো উত্তম হয়, তাহলে আমরা তা মেনে নেবো।
সুলতান সেনাবাহিনীর একজন ইমামকে একজন দুভাষীসহ দুর্গে পাঠিয়ে দিলেন। ইমাম রাজা অর্জুনের সাথে কথা বলে বিকেলে ফিরে এসে জানালেন, রাজা বলেছেন, আপনাদের ধর্ম মেনে নিতে পারবো না, তবে আমরা আপনাদেরকে তিনশ হাতি এবং বিশ মণ রুপা উপঢৌকন দিচ্ছি। এর বিপরীতে আপনারা অবরোধ তুলে নিন।
সুলতান মাহমূদ একথা শুনে পুনরায় রাজা অর্জুনের কাছে বার্তা পাঠালেন, আপনার প্রস্তাব আমরা মানতে রাজি। তবে আমাদের পোষাক পরিধান করে, আমাদের দেয়া তরবারী কোমরে ঝুলিয়ে আপনার বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙুলের উধ্বাংশ কেটে আমাদের কাছে অর্পণ করতে হবে। কারণ এটি আপনাদের রীতি। এটা করলেই আমরা মনে করবো আপনি পরাজয় মেনে নিয়েছেন। আমরা নিশ্চিত হতে চাই আপনি এরপর আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন করবেন না।
ইতিহাসে পরিষ্কার লেখা আছে, এই সংবাদ নিয়ে যখন সুলতানের দূত রাজা অর্জুনের কাছে গেল, তখন অর্জুন একটি রূপার কুরসীতে সমাসীন ছিলেন। দূত বর্ণনা করল, আমি দেখলাম সুদর্শন একটি যুবককে রুপার কুরসীতে সমাসীন। আমি তাকে বললাম, আপনার জন্যে আমি পোষাক নিয়ে এসেছি তা পরিধান করে আঙুল কেটে দিতে হবে।
তিনি বললেন, আপনি গিয়ে বলুন এই কাপড় পরেই আঙুল কাটা হয়েছে।
আমি দুঃখিত। আমি সুলতানকে প্রতারিত করতে পারবো না। আমাদের পোষাকই পরতে হবে।
রাজা অর্জুন অনিচ্ছা সত্ত্বেও পোষাক পরে নিলেন এবং কোমরে গযনী বাহিনীর দেয়া তরবারী ঝুলিয়ে নিলেন। আমি তার এই করুণ অবস্থা দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। তখন আর তাকে আঙুল কাটার কথা বলতে পারলাম না। তিনি নিজেই একজনকে ডেকে বললেন, ছুরি নিয়ে এসো। ছুরি আনা হলে তিনি খুবই স্বাভাবিকভাবে ছুরিটি হাতে নিয়ে নিজের হাতেই বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙুলের অগ্রভাগ এক ঝটকায় কেটে ফেললেন এবং একটি কাপড়ে মুড়িয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। সেই সাথে তার কর্তিত আঙুলে ওষুধ মাখা পট্টি বেধে নিলেন। এ সময় প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হলেও তার চেহারা ছিল সম্পূর্ণ ভাবান্তরহীন।
তিনি হিন্দুস্তানের রীতি অনুযায়ী আমাকে দামী কাপড়, রৌপ্য ও দুটি ঘোড়া উপহার দিতে বললেন।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনুল জওযী অনুরূপ ঘটনা লিখে আরো যোগ করেছেন, সুলতান মাহমুদের কাছে এমন কনিষ্ঠ আঙুলের বহু অংশ সংরক্ষিত ছিলো। কারণ হিন্দুস্তানের বহু রাজা মহারাজা তার কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে অবশেষে তাদেরই রীতি অনুযায়ী বাম হাতের কনিষ্ঠা আঙুল কেটে দিয়েছিলেন।
* * *
সুলতান মাহমূদ গোয়ালিয়রের রাজা অর্জুনকে তার বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করলেন এবং আনুগত্যের অঙ্গীকার নিয়ে কালাঞ্জরের দিকে রওয়ানা হলেন। কালাঞ্জর দুর্গের আয়তন ছিল বিশাল। বলা হয়ে থাকে প্রায় লাখ খানেক লোক, বিশ হাজার গবাদি পশু এবং পাঁচশ হাতি সেখানে থাকতো। সুলতান মাহমুদের কাছে এই বিশাল এলাকাকে আক্ষরিক অর্থে অবরোধ করার মতো বিপুল সংখ্যক সৈন্যের অভাব থাকায় তিনি দুর্গে প্রবেশের সবগুলো প্রবেশ পথ বন্ধ করে দিয়ে কার্যত দুর্গবাসীকে অবরুদ্ধ করলেন। আসলে কালাঞ্জরের দুর্গকে সাধারণ দুর্গ না বলে মজবুত প্রাচীর ঘেরা একটি মহানগর বলাই সঙ্গত।
সুলতান মাহমূদ অবরোধ আরোপ করার পর মহারাজা গোবিন্দের কাছে পয়গাম পাঠালেন। পয়গামবাহী গযনী বাহিনীর বিশেষ ধরনের পোষাকে সজ্জিত হয়ে প্রধান ফটকের কাছে গিয়ে উচ্চ আওয়াজে রাজার উদ্দেশে বললো, ‘গযনীর সুলতানের পক্ষ থেকে কালাঞ্জরের রাজা গোবিন্দকে হুশিয়ার করা হচ্ছে। গযনী বাহিনী দুর্গে প্রবেশ করলে কাউকে জীবিত রাখবে না। নিজ প্রজাদের গণহত্যা না করিয়ে রাজা ইসলাম গ্রহণ করতে পারেন নয়তো আমাদের শর্ত মেনে নিয়ে পরাজয় স্বীকার করে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ ও কর আদায় করে আক্রমণ থেকে বাঁচতে পারেন।’
কয়েক দিন এভাবেই চলে গেল। রাজা গোবিন্দ বশ্যতা স্বীকার করে নিতে চাচ্ছিলেন না কিন্তু গযনীর সৈন্যরা যখন আক্রমণ শুরু করলো, তখন কয়েকদিনের মধ্যে তার মনোবল ভেঙে গেল। দুর্গের হাজার হাজার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির জন্ম দিল। ফলে ইসলাম গ্রহণে সম্মত না হয়ে রাজা গোবিন্দ মৈত্রী চুক্তির জন্য পয়গাম পাঠালেন এবং ক্ষতিপূরণ ও বার্ষিক চাঁদা দেয়ার অঙ্গীকার করে একটি আপোস চুক্তিতে আবদ্ধ হলেন। বশ্যতা স্বীকারের প্রমাণস্বরূপ রাজা গোবিন্দও আঙুলের অগ্রভাগ কেটে সুলতানের কাছে পাঠালেন।
কিন্তু গোবিন্দ গযনী সুলতানের সাথে একটি নির্মম রসিকতাও করলেন। তিনি তিনশ হাতি উপহার হিসেবে দেয়ার কথা বলে সেগুলোকে দুর্গের বাইরে মাহুত ছাড়াই ছেড়ে দিয়ে সুলতানের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনার সৈন্যরা যদি সত্যিকার অর্থে সাহসী হয়ে থাকে তাহলে এগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে বলুন। সুলতান এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন।
গয়নী বাহিনীতে তাতারী বা তুর্কী ইউনিট বলে একটি বিশেষ সেনা ইউনিট ছিল। এরা ছিল অত্যন্ত সাহসী, দৈহিক গঠনে বিশাল এবং লড়াক। সুলতান তাতারী ও তুর্কী সৈন্যদের আহ্বান জানালেন, কারা আছে যে, এই হাতিগুলোকে কজা করতে পার?
হাতিগুলোকে মদ খাইয়ে মাতাল করে দুর্গের বাইরে এনে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। মাতাল হাতিগুলো বাঁধনমুক্ত হয়ে গযনী বাহিনীর উপর কেয়ামত বয়ে আনলো। তাঁবু, রসদসহ সবকিছু তছনছ করতে শুরু করলো।
সৈন্যদের মধ্যেও দেখা দিল আতঙ্ক। এ অবস্থায় তাতারী বা তুর্কী ইউনিটের যযাদ্ধারা তাকবীর দিয়ে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে হাতি নিয়ন্ত্রণে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং বহু কষ্টে সব কটা হাতিকেই তারা কজা করতে সমর্থ হলো। অবশ্য সুতলতান তাদেরকে নিদের্শ দিয়েছিলেন, তীর-বল্লম, তরবারী যেভাবে পারো এগুলোর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে সেনা শিবির হেফাযত করো। কিন্তু অসীম সাহসী যোদ্ধারা মাতাল হাতিগুলোর একটিকেও হত্যা না করে কাবু করতে সক্ষম হল। দুর্গ প্রাচীরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে কালাঞ্জরের হিন্দু অধিবাসীরা গয়নী সেনাদের সাহসিকতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে চিৎকার করতে থাকে- বলতে থাকে সাবাশ গযনীর যোদ্ধারা! সত্যিই তোমরা অজেয়, তোমরা সাহসী, তোমরা বীরের জাতি। আমরা তোমাদের প্রণাম করি। নমস্কার জানাই।
মহারাজা গোবিন্দের আত্মসমর্পণের পর সুলতান মাহমূদ গযনী বাহিনীকে লাহোরে নিয়ে গেলেন। সুলতানের লাহোর আগমনের খবর পেয়ে লাহোরের বর্তমান রাজা তরলোচনপাল লাহোর ছেড়ে আজমীর চলে গেল। সুলতান মাহমুদ পুনর্বার লাহোরে প্রবেশ করে লাহোরকে গযনী সালতানাতের অঙ্গ ঘোষণা করলেন এবং তার অত্যন্ত প্রিয় গোলাম ও সঙ্গী আয়াযকে সেখানকার গভর্নর নিযুক্ত করলেন। আয়ায ছিলেন সুলতান মাহমূদের একান্ত ভৃত্য। ভৃত্য হলেও সুলতান তাকে বন্ধুর মতোই সম্মান ও মর্যাদা দিতেন। অস্বাভাবিক মেধা, বুদ্ধি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার অধিকারী আয়াযের নাম সুলতান মাহমূদের সাথে সাথেই উচ্চারিত হয়।
লাহোরে বিপুল সংখ্যক সেনা রেখে সুলতান মাহমূদ ১০২৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ এপ্রিলের দিকে গযনী ফিরে এলেন। এদিকে গযনীর বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর শক্তি নিয়ে অপেক্ষা করছিল ইসরাঈল সেলজুকী।