৩.১ এলিখ খান

ভারত অভিযান (মাহমূদ গজনবীর ভারত অভিযান) (তৃতীয় খণ্ড) / এনায়েতুল্লাহ আলতামাস / অনুবাদ – শহীদুল ইসলাম
সুলতান মাহমুদ গজনবীর ঐতিহাসিক সিরিজ উপন্যাস

.

উৎসর্গ

তাকিয়া তাবাসসুম (যীবা) গল্প উপন্যাস তার পড়া হয়ে ওঠে না কিন্তু আব্বর নতুন বই এলেই দখলে নেয়ার জন্যে মরিয়া।

……………আর অভিযোগ কেন যে আমি ছোট হলাম! ছোট না হলে আব্দুর ছদ্মনাম আবুশিফা না হয়ে আবুযীবা হতো। সত্যি, অনিষ্পন্ন অভিযোগ। অতএব, এ উৎসর্গ তার নামে। বইপ্রিয়তা তাকে আলোকিত মানুষ করুক, এই দু’আ।

–অনুবাদক

.

প্রকাশকের কথা

আলহামদুলিল্লাহ! এদারায়ে কুরআন’ কর্তৃক প্রকাশিত সুলতান মাহমূদ এর ভারত অভিযান সিরিজের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড পাঠক মহলে সাড়া জাগিয়েছে। এজন্য আমরা মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি এবং পাঠক মহলকে জানাচ্ছি মোবারকবাদ। নিয়মিত বিরতি দিয়ে এর প্রতিটি খণ্ড প্রকাশের ব্যাপারে আমাদের চেষ্টার কোন ক্রটি ছিল না কিন্তু দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও মুদ্রণ সামগ্রির উচ্চমূল্য আমাদের টুটি চেপে ধরেছে। ফলে কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে এই সিরিজের প্রকাশনা।

আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে রবিউল আউয়াল ‘০৮ এর বইমেলা উপলক্ষে এই সিরিজের তৃতীয় খণ্ডটি পাঠকের হাতে তুলে দিতে পেরে সুখানুভব করছি।

নানাবিধ সীমাবদ্ধতার পরও আমরা এ খণ্ডটি আগেরগুলোর চেয়ে আরো সুন্দর করার চেষ্টা করেছি। তবুও মুদ্রণ প্রমাদ ভুল-ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। বিজ্ঞমহলের কাছে যে কোন ক্রটি সম্পর্কে আমাদের অবহিত করার বিনীত অনুরোধ রইল।

প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডের মতো তৃতীয় খণ্ডটিও পাঠক-পাঠিকা মহলে আদৃত হলে আমাদের সার্বিক প্রয়াস সার্থক হবে।

–প্রকাশক

.

লেখকের কথা

“মাহমূদ গজনবীর ভারত অভিযান” সিরিজের এটি তৃতীয় খণ্ড। উপমহাদেশের ইতিহাসে সুলতান মাহমুদ গজনবী সতের বার ভারত অভিযান পরিচালনাকারী মহানায়ক হিসেবে খ্যাত। সুলতান মাহমূদকে আরো খ্যাতি দিয়েছে পৌত্তলিক ভারতের অন্যতম দু ঐতিহাসিক মন্দির সোমনাথ ও থানেশ্বরীতে আক্রমণকারী হিসেবে। ঐসব মন্দিরের মূর্তিগুলোকে টুকরো টুকরো করে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিলেন মাহমুদ। কিন্তু উপমহাদেশের পাঠ্যপুস্তকে এবং ইতিহাসে মাহমূদের কীর্তির চেয়ে দুষ্কৃতির চিত্ৰই বেশী লিখিত হয়েছে। হিন্দু ও ইংরেজদের রচিত এসব ইতিহাসে এই মহানায়কের চরিত্র যেভাবে চিত্রিত হয়েছে তাতে তার সুখ্যাতি চাপা পড়ে গেছে। মুসলিম বিদ্বেষের ভাবাদর্শে রচিত ইতিহাস এবং পরবর্তীতে সেইসব অপইতিহাসের ভিত্তিতে প্রণীত মুসলিম লেখকরাও মাহমূদের জীবনকর্ম যেভাবে উল্লেখ করেছেন তা থেকে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের বোঝার উপায় নেই, তিনি যে প্রকৃতই একজন নিবেদিতপ্রাণ ইসলামের সৈনিক ছিলেন, ইসলামের বিধি-বিধান তিনি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। জাতিশত্রুদের প্রতিহত করে খাঁটি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও দৃঢ় করণের জন্যেই নিবেদিত ছিল তার সকল প্রয়াস। অপলেখকদের রচিত ইতিহাস পড়লে মনে হয়, সুলতান মাহমূদ ছিলেন লুটেরা, আগ্রাসী ও হিংস্র। বারবার তিনি ভারতের মন্দিরগুলোতে আক্রমণ করে সোনা-দানা, মণি-মুক্তা লুট করে গজনী নিয়ে যেতেন। ভারতের মানুষের উন্নতি কিংবা ভারত কেন্দ্রিক মুসলিম সালতানাত প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা তার কখনো ছিলো না। যদি তকালীন ভারতের নির্যাতিত মুসলমানদের সাহায্য করা এবং পৌত্তলিকতা দূর করে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেয়ার একান্তই ইচ্ছা তার থাকতো, তবে তিনি কেন মোগলদের মতো ভারতে বসতি গেড়ে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতেন না? ইত্যাকার বহু কলঙ্ক এঁটে তার চরিত্রকে কলুষিত করা হয়েছে।

মাহমূদ কেন বার বার ভারতে অভিযান চালাতেন মন্দিরগুলো কেন তার টার্গেট ছিল? সফল বিজয়ের পড়ও কেন তাকে বার বার ফিরে যেতে হতো গজনী? ইত্যাদি বহু প্রশ্নের জবাব; ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ সৈনিক সুলতান মাহমূদকে তুলে ধরার জন্যে আমার এই প্রয়াস। নির্ভরযোগ্য দলিলাদি ও বিশুদ্ধ ইতিহাস ঘেটে আমি এই বইয়ে মাহমূদের প্রকৃত জীবন চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। প্রকৃত পক্ষে সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর মতোই মাহমূদকেও স্বজাতির গাদ্দার এবং বিধর্মী পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে একই সাথে লড়াই করতে হয়েছে। যতো বার তিনি ভারত অভিযান চালিয়েছেন, অভিযান শেষ হতে না হতেই খবর আসতো, সুযোগ সন্ধানী সাম্রাজ্যলোভী প্রতিবেশী মুসলিম শাসকরা গজনী আক্রমণ করছে। কেন্দ্রের অস্তিত্ব রক্ষার্থে বাধ্য হয়েই মাহমূদকে গজনী ফিরে যেতে হতো। একপেশে ইতিহাসে লেখা হয়েছে, সুলতান মাহমুদ সতের বার ভারত অভিযান চালিয়েছিলেন, কিন্তু একথা বলা হয়নি, হিন্দু রাজা-মহারাজারা মাহমূদকে উৎখাত করার জন্যে কতো শত বার গজনীর দিকে আগ্রাসন চালিয়ে ছিল।

সুলতান মাহমূদের বারবার ভারত অভিযান ছিল মূলত শক্রদের দমিয়ে রাখার এক কৌশল। তিনি যদি এদের দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হতেন, তবে হিন্দুস্তানের পৌত্তলিকতাবাদ সাগর পাড়ি দিয়ে আরব পর্যন্ত বিস্তৃত হতো।

মাহমূদের পিতা সুবক্তগীন তাকে অসীয়ত করে গিয়েছিলেন, “বেটা! ভারতের রাজাদের কখনও স্বস্তিতে থাকতে দিবে না। এরা গজনী সালাতানাতকে উৎখাত করে পৌত্তলিকতার সয়লাবে কাবাকেও ভাসাতে চায়। মুহাম্মদ বিন কাসিমের সময়ের মত ভারতীয় মুসলমানদেরকে হিন্দুরা জোর জবরদস্তি হিন্দু বানাচ্ছে। এদের ঈমান রক্ষার্থে তোমাকে পৌত্তলিকতার দুর্গ গুঁড়িয়ে দিতে হবে। ভারতের অগণিত নির্যাতিত বনি আদমকে আষাদ করতে হবে, তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে হবে।”

আলবিরুনী, ফিরিশতা, গাদিজী, উতবী, বাইহাকীর মতো বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদগণ লিখেছেন, সুলতান মাহমূদ তৎকালীন সবচেয়ে বড় বুযুর্গ ও ওলী শাইখ আবুল হাসান কিরখানীর মুরীদ ছিলেন। তিনি বিজয়ী এলাকায় তার হেদায়েত মতো পুরোপুরি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

তিনি নিজে কিরখানীর দরবারে যেতেন। কখনও তিনি তার পীরকে তার দরবারে ডেকে পাঠাননি। উপরন্তু তিনি ছদ্মবেশে পীর সাহেবের দরবারে গিয়ে ইসলাহ ও পরামর্শ গ্রহণ করতেন। তিনি আত্মপরিচয় গোপন করে কখনও নিজেকে সুলতানের দূত হিসেবে পরিচয় দিতেন। একবার তো আবুল হাসান কিরখানী মজলিসে বলেই ফেললেন, “আমার একথা ভাবতে ভালো লাগে যে, গজনীর সুলতানের দূত সুলতান নিজেই হয়ে থাকেন। এটা প্রকৃতই মুসলমানের আলামত।”

মাহমূদ কুরআন, হাদীস ও দীনি ইলম প্রচারে খুবই যত্নবান ছিলেন। তার দরবারে আলেমদের যথাযথ মর্যাদা ছিল। সব সময় তার বাহিনীতে শত্রু পক্ষের চেয়ে সৈন্যবল কম হতো কিন্তু তিনি সব সময়ই বিজয়ী হতেন! বহুবার এমন হয়েছে যে, তার পরাজয় প্রায় নিশ্চিত। তখন তিনি ঘোড়া থেকে নেমে ময়দানে দু’রাকাত নামায আদায় করে মোনাজাত করতেন এবং চিৎকার করে বলতেন, “আমি বিজয়ের আশ্বাস পেয়েছি, বিজয় আমাদেরই হবে।” বাস্তবেও তাই হয়েছে।

অনেকেই সালাহ উদ্দীন আইয়ুবী আর সুলতান মাহমূদকে একই চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের বীর সেনানী মনে করেন। অবশ্য তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য একই ছিল। তাদের মাঝে শুধু ক্ষেত্র ও প্রতিপক্ষের পার্থক্য ছিল। আইয়ুবীর প্রতিপক্ষ ছিল ইহুদী ও খৃস্টশক্তি আর মাহমূদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল হিন্দু পৌত্তলিক রাজন্যবর্গ। ইহুদী ও খৃষ্টানরা সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর সেনাদের ঘায়েল করতে প্রশিক্ষিত সুন্দরী রমণী ব্যবহার করে নারী গোয়েন্দা দিয়ে আর এর বিপরীতে সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে এরা ব্যবহার করতে শয়তানী যাদু। তবে ইহুদী-খৃষ্টানদের চেয়ে হিন্দুদের গোয়েন্দা তৎপরতা ছিল দুর্বল কিন্তু সুলতানের গোয়েন্দারা ছিল তৎপর ও চৌকস।

তবে একথা বলতেই হবে, সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর গোয়েন্দারা যেমন দৃঢ়চিত্ত ও লক্ষ্য অর্জনে অবিচল ছিল, মাহমূদের গোয়েন্দারা ছিল নৈতিক দিক দিয়ে ততোটাই দুর্বল। এদের অনেকেই হিন্দু নারী ও যাদুর ফাঁদে আটতে যেতো। অথবা হিন্দুস্তানের মুসলিম নামের কুলাঙ্গররা এদের ধরিয়ে দিতো। তারপরও সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর চেয়ে সুলতান মাহমূদের গোয়েন্দা কার্যক্রম ছিল বেশি ফলদায়ক।

ইতিহাসকে পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য, বিশেষ করে তরুণদের কাছে হৃদয়গ্রাহী করে পরিবেশনের জন্যে গল্পের মতো করে রচনা করা হয়েছে এই গ্রন্থ। বাস্তবে এর সবটুকুই সত্যিকার ইতিহাসের নির্যাস। আশা করি আমাদের নতুন প্রজন্ম ও তরুণরা এই সিরিজ পড়ে শত্রু-মিত্রের পার্থক্য, এদের আচরণ ও স্বভাব জেনে এবং আত্মপরিচয়ে বলীয়ান হয়ে পূর্বসূরীদের পথে চলার দিশা পাবে।

এনায়েতুল্লাহ
লাহোর।

.

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

প্রতিবেশী মুসলিম শাসকদের মধ্যে এলিখ খান ছিলো সুলতানের জঘন্যতম শত্রু। সুলতানের অনুপস্থিতির সুযোগে একবার সে গজনী দখলের উদ্দেশে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে আগ্রাসন চালিয়েছিলো। কিন্তু তাকে গজনী বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে জীবন নিয়ে পালাতে হয়েছিলো। হিন্দুস্তান থেকে সংবাদ পেয়ে বিদ্যুৎগতিতে গজনী ফিরে এসে সুলতান নিজে এলিখ খানকে প্রতিরোধ করেছিলেন। এলিখ খান সুলতানের শাসনাধীন খোরাসান অঞ্চল দখল করে নিতে তৎপর ছিলো।

“মাননীয় সুলতান! এলিখ খান একটি বিষধর সাপ । ও যতদিন বেঁচে থাকবে, ততোদিন সুযোগ পেলেই আমাদের দংশন করতে থাকবে।” বলছিলেন সুলতান মাহমুদের কাছে আগত দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তার একজন। এদের একজন সুলতানের নির্দেশে এলিখ খানের সেনাবাহিনীর মধ্যেই কাজ করতো। তারা জানালো, এবার আপনার অনুপস্থিতিতে এলিখ খান তার ভাই তোগা খান ও কাদের খানকে প্ররোচিত করছিলো তারা যেনো আপনার বিরুদ্ধে সামরিক সংঘাতে তাকে সহযোগিতা করে। তারা তিনজন মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে সকল সেনাবাহিনী নিয়ে গজনী আক্রমণ করে দখল করে নিতে চাচ্ছিলো। কিন্তু তোগা ও কাদের খান আপনার ভয়ে এলিখ খানের সহযোগী হতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে এলিখ খান তার ভাই তোগা খানের বাদশাহী দখল করার জন্য সেনা অভিযান চালায়। কিন্তু উজগন্দ নামক স্থানে পৌঁছার পর তাদের উপর প্রচণ্ড তুষারপাত ও ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়। ফলে এলিখ খানের সৈন্যদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। বিপুলসংখ্যক সওয়ারী ও সৈন্য প্রচণ্ড তুষারপাতের কবলে পড়ে মারা যায়। প্রাকৃতিক প্রতিরোধের মুখে বড় ধরনের ক্ষতি সাধিত হয়। বাধ্য হয়েই এলিখ খান সেনাভিযান পরিহার করে আপন রাজধানীতে ফিরে আসে।

“তোগা খান কী করতে চায়?” জানতে চাইলেন সুলতান।

তিনি আপনার সহযোগী। আমাদের যে সহকর্মী তোগা খানের সেনাবাহিনীতে কর্মরত, সে খবর দিয়েছে, এলিখ খানের অভিযান প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যর্থ হওয়ার পর তাকে হুঁশিয়ার করে পয়গাম পাঠায়, যদি পুনর্বার সে তার রাজ্যের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালায়, তাহলে তিনি সুলতানের সাথে মৈত্রী গড়ে তুলবেন।”

“তোগা খানকে কি বিশ্বাস করা যায়?”

“মাননীয় সুলতান! কারো মনের কথা তো আর বলা যায় না। কিন্তু বাহ্যিক দৃষ্টিতে যা বোঝা যায়, তাতে তোগা খান আপনার সাথে মৈত্রী স্থাপনে আগ্রহী।”

“এর অর্থ হলো, এলিখ খানের মতো একজন হিংসুটে ক্ষমতালি আগ্রাসীর দুস্কৃতি থেকে নিজের রাজ্য ও শাসনের নিরাপত্তার জন্য তোগা খান আমাদের সাথে মৈত্রী গড়তে আগ্রহী।” ব্যাখ্যা করলেন সুলতান। “ঠিক আছে, আমি তার সাথে মৈত্রী স্থাপনে অস্বীকৃতি জানাবো না। তবে তোগা খানের সাথে আমার একবার সাক্ষাৎ হওয়া দরকার। এসব ক্ষমতালোভী মুসলিম শাসক আমাদের জন্য পায়ের বেড়িতে পরিণত হয়েছে।… তোমরা তোগা খানকে খুবই গোপনে একথা জানিয়ে দাও যে, আমি শীঘ্রই তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছি। সাক্ষাতের জন্য তাকে আমার কাছে আসতে হবে না, আমিও তার কাছে যাবো না। গজনীর বাইরে যতো দূরেই থোক সেখানে চলে আসলে আমি নিজে গিয়ে সেখানে তার সাথে সাক্ষাৎ করবো।”

এসব কারণে বিজয়ের উল্লাসে শরীক হতে পারেননি সুলতান। অভ্যন্তরীণ হিংসা আর স্বজাতির ক্ষমতলিন্দু শাসকদের প্রতিহিংসায় গৃহযুদ্ধের খড়গ সবসময় সুলতানের মাথার উপর ঝুলন্ত ছিলো। তিনি এ পর্যায়ে এসে অনুভব করলেন, ঘরের ভেতরের এই বিষধর সাপগুলোর মাথা পিষে ফেলা এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অত্যন্ত সংগোপনে সুলতানের গোয়েন্দারা তোগা খানের কাছে তার পয়গাম নিয়ে গেলে সাক্ষাতের ব্যাপারে তিনি কোন আপত্তি করেননি। তিনি গজনী থেকে নিরাপদ দূরত্বে একটি জায়গার কথা বলে দিলেন। চারদিন পর সেই জায়গায় দুই শাসকের সাক্ষাতের সময় নির্ধারিত হলো।

সময়মতো ঠিক জায়গায় তোগা খান পৌঁছে গেলো। জায়গাটি ছিলো প্রাকৃতিক নিসর্গে ভরপুর মনোরম। একটি খরস্রোতা নদীর পাশে ঘন গাছগাছালী আর বনফুলের সমাহারে সবুজ-শ্যামল জায়গায় তোগা খান ও সুলতানের সাক্ষাৎ হলো। সুলতান তোগা খানকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।

“এ কথা কি সত্য যে, আপনি আমার সাথে মৈত্রী স্থাপন করতে চান? আমি আপনার কাছে পয়গাম দিয়ে দূত পাঠানোর কথা ভাবছিলাম, ঠিক সেই সময় আপনার পয়গাম পেয়ে আপনার ডাকে সাড়া দিলাম। আমি আপনার সাথে মৈত্রী চুক্তি করতে আগ্রহী।” বললেন তোগা খান।

“আপনার এই মৈত্রী স্থাপনের উদ্দেশ্য কি আপনার রাজত্বের নিরাপত্তার জন্য, নাকি মুসলমানরা পরস্পর মিলেমিশে থাকা আল্লাহর নির্দেশ- এ জন্য? আপনি যদি রাজত্বের নিরাপত্তার জন্য মৈত্রী স্থাপনে আগ্রহী হয়ে থাকেন, তাহলে সেই মৈত্ৰীতে আমার কোন আগ্রহ নেই। আমি শুধু বাগদাদ খেলাফতের অধীনে মৈত্রী স্থাপন করতে পারি। আমি চাই স্বাধীন মুসলিম রাজ্যগুলোর অস্তিত্ব থাকুক, সবাই খেলাফতে বাগদাদকেই মুসলমানদের কেন্দ্র বলে স্বীকার করে নিক। ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে সকল মুসলিম শাসকের খেলাফতের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই।” সুলতান বললেন।

সুলতান মাহমুদের কথা শুনে তোগা খানের ঠোঁটের কোণে একটা বিরক্তিকর হাসির ভাব ফুটে উঠলো। তিনি বললেন, “সুলতান মাহমূদকে আমি খুবই দূরদর্শী ও জ্ঞানী মনে করতাম। কিন্তু বুঝতে পারছি, আপনার মধ্যে রণকৌশল ও যুদ্ধজয়ের যেমন পারদর্শিতা আছে।… বোঝা যাচ্ছে, আপনার মধ্যে ধর্মীয় ভাবাবেগ প্রবল। বলা চলে আপনি ধর্মের ব্যাপারে অতি মাত্রায় আবেগপ্রবণ।”

“আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছে পরিষ্কার করে বলুন।” সুলতান বললেন।

“আপনি যে খলীফাকে ইসলামের সেবক ও কেন্দ্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে রেখেছেন, তিনি এতোটাই ক্ষমতা ও সাম্রাজ্যলিন্দু, যেমনটা ক্ষমতালি আমার ভাই ও আপনার প্রতিবেশী মুসলিম শাসকবৃন্দ। এরা আপনার কাছ থেকে গজনী ও খোরাসান ছিনিয়ে নেয়ার জন্য সবসময়ই চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে।” তোগা খান বললেন।

“আপনি কি বাগদাদের খলীফা কাদের বিল্লাহ আব্বাসীর কথা বলছেন?” জিজ্ঞেস করলেন সুলতান।

“আমি জানি, আমার কথা আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না।” বললেন তোগা খান। বেশ কিছুদিন আগেই এ ব্যাপারে আমি আপনাকে অবহিত করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার ভাই এলিখ খানের কারণে আমি বিড়ম্বনা বাড়াতে চাইনি। সেই সাথে আমার মধ্যে এই আশংকাও বিরাজ করছিলো যে, আপনার কাছে আমার কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। আপনি আমার ব্যাপারে বেশি সন্দেহপরায়ণ হয়ে যেতে পারেন। আমিও আপনার মতোই কেন্দ্রীয় খেলাফতের প্রত্যাশী। কিন্তু সেই খলিফাঁকে আমি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত ভাবতে রাজি নই, যে একটি এলাকার শাসক হওয়ার পরও নিজের রাজ্যবিস্তারে চক্রান্তের আশ্রয় নেয়।”

“তোগা খান! ক্ষমতাসীন খলিফার বিরুদ্ধে অপপ্রচারের আগে ভেবে নাও যদি এ অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তাহলে আমি সেনা অভিযান পরিচালনা করে তোমার রাজত্বের সাধ মিটিয়ে দেবো।” রাগে-ক্ষোভে ফুঁসে উঠলেন সুলতান।

হাসলেন তোগা খান। সেই হাসিতে কিছুটা রহস্যময়তা এনে বললেন, “মানুষের মধ্যে যখন শক্তির অহংকার দেখা দেয়, তখন নিজের ভুলগুলোকেও দূরদর্শিতা মনে করে এবং নিজের উপলব্ধির ব্যতিক্রম কোন কথা শুনতে পছন্দ করে না। সুলতান নিজেকে সামরিক শক্তির গর্ব থেকে মুক্ত করুন। আমি খলিফার বিরুদ্ধাচরণ করে আপনার কাছ থেকে কী সার্থ অর্জন করতে পারবোর বাস্তবতা অনুধাবন করতে চেষ্টা করুন। দেখুন, আপনার বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের এমন কোন শাসক নেই, যে চক্রান্তে শরীক হয়নি। শুধু আমি আর কাদের খান ছাড়া আর সবাই আপনার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানও করেছে। আপনার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযানে শরীক না হওয়ার অর্থ এই নয় যে, আমরা সামরিক দিক থেকে দুর্বল ছিলাম। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আপনার বিরুদ্ধে মহাশক্তি হয়ে দাঁড়াতে পারতাম। কিন্তু আমি ও কাদের খান সবসময় গৃহযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলাম এবং আপনার ভারত অভিযান সাফল্য লাভের প্রত্যাশী ছিলাম। আপনার হয়তো জানা নেই, এলিখ খান আমাকে আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে শরীক হওয়ার জন্য শুধু উস্কানিই দেয়নি, তার কথায় সাড়া না দেয়ার অপরাধে আমার বিরুদ্ধে…।”

“আপনার বিরুদ্ধে সেনাভিযানও করেছে। তোগা খানের মুখের অনুচ্চারিত কথা পূর্ণ করে দিলেন সুলতান। “কুদরতি তুফান ও তুষারপাত তার সেই অভিযান ব্যর্থ করে দেয়। এ ছাড়াও আপনার নিজের ব্যাপারেও কোন কথা জানতে চাইলে আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন তোগা খান।

“আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে যদি আপনার কাছে খবর থেকে থাকে, তাহলে আমার ইচ্ছা ও বলার মধ্যে আপনার কোন ধরনের সংশয় থাকা উচিত নয়। তারপরও যদি আমার ব্যাপারে আপনার সংশয় দূর না হয়, তাহলে বুঝতে হবে আমার এখানে নিয়োজিত আপনার গোয়েন্দা কোন কাজই করছে না। শুধু শুধুই বেতন-ভাতা নিচ্ছে।” বললেন তোগা খান।

“বলুন, কী বলতে চান আপনি?” তোগা খানের উদ্দেশে বললেন সুলতান।

“বর্তমান খলীফা কাদের বিল্লাহ আব্বাসী ক্ষমতালিন্দু এবং সাম্রাজ্য বিস্তারে প্রয়াসী।” বললেন তোগা খান। “আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, খোরাসানের অর্ধেকটা শাসন করছেন খলীফা আর অর্ধেকটা আপনার নিয়ন্ত্রণে।… খলীফা আপনার শাসনাধীন অংশও কজা করতে উদগ্রীব। এ লক্ষ্যে তিনি ক্ষমতালি এলিখ খানকে ব্যবহার করছেন। খলীফা এলিখ খানকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সে যদি আপনার বিরুদ্ধে সেনাভিযান চালায়, তাহলে তিনি সৈন্যবল দিয়ে প্রকাশ্য সহযোগিতা না করলেও গোপনে পরিবহন, অস্ত্রশস্ত্র ও আর্থিক সুবিধা দিয়ে সহযোগিতা করবেন। খলীফা যদি মুসলমানদের ঐক্য, সংহতি ও এককেন্দ্রিকতার প্রত্যাশী হতেন তাহলে তো তার উচিত ছিলো, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী এলিখ খানের বিরুদ্ধে তিনি সেনাভিযান করতেন। তিনি দৃশ্যত হিন্দুস্তান অভিযানে আপনাকে বাহবা দিচ্ছেন আর পর্দার অন্তরালে চাচ্ছেন আপনি যেনো হিন্দুস্তানে ব্যস্ত থাকেন। আর ওখানে আপনার সামরিক শক্তি ক্ষয় হতে থাকুক, যাতে আপনি সামরিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়েন। খলীফা সেই দিনের প্রত্যাশায় প্রহর গুণছেন, যেদিন তিনি খবর পাবেন আপনি হিন্দুস্তানে পরাজিত হয়েছেন, নয়তো সম্মুখসমরে মারা গেছেন। আমীর আবুল মুলক, দারা বিন কাবুস, আবুল কাসেমকে আপনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছেন খলীফা কাদের বিল্লাহ আব্বাসী। এই অঞ্চলে গৃহযুদ্ধের পেছনে খলীফার চক্রান্ত সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।”

তোগা খানের কথা শুনে ক্ষোভে-দুঃখে সুলতানের চোখ লাল হয়ে যায়। তিনি যে খলীফাকে মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পবিত্র আসনে সমাসীন ভাবতেন, আজ তাকেই তার শত্রুতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কথা শুনে তিনি হতবাক হয়ে পড়েন।

“আপনি এসব কথার প্রমাণ চাইলে আমি আপনাকে প্রমাণ দেখাবো।” বললেন তোগা খান। “সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, আমি আপনার সহযোগী, প্রয়োজনে আমার সৈন্যরা আপনার সহযোগিতা করবে, আমার দূত যাবে আপনার কাছে। আমার সামরিক শক্তি কম হতে পারে, তবে ঈমানের দিক থেকে আমি দুর্বল নই। এলিখ খান যখন আমার বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালাতে এসেছিলো, তখন খোদায়ী তুষারপাত ও ঝড় তাকে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটতে বাধ্য করেছিলো। সে একজন ঈমান বিক্রেতা।”

“যে জাতির কেন্দ্রীয় নেতা ঈমান বিক্রেতা হয়ে যায়, সেই জাতি সর্বাংশেই লুটেরা আর ডাকাতদের আখড়ায় পরিণত হয়।” দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললেন সুলতান।

খ্যাতিমান ঐতিহাসিক কাসিম ফারিশতা ও আলবিরুনী লিখেছেন, সুলতান মাহমূদকে কখনো এমন বিমর্ষ হতে দেখা যায়নি। তোগা খানের সাথে সাক্ষাতের পর তিনি যখন গজনীতে ফিরে এলেন, তখন তার চেহারা ছিলো বিধ্বস্ত। তিনি কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না। অস্থিরতায় তার দু’হাত নিসপিশ করছিলো। উজির তাকে জিজ্ঞেস করলেও তোগা খানের সাথে কী কথা হয়েছিলো, তা বলেননি।

সুলতান মাহমূদ ছিলেন সমকালীন বিখ্যাত বুযুর্গ আবুল হাসান খিরকানীর ভাবশিষ্য। খিরকানী গজনী থেকে প্রায় দু’দিনের দূরত্বে বসবাস করতেন। সুলতান মাহমূদ মাঝে-মধ্যে আধ্যাত্মিক গুরু আবুল হাসান খিরকানীর সান্নিধ্যে যেতেন। গুরুর কাছে গেলে তিনি মানসিক প্রশান্তি অনুভব করতেন। তার মনের বোঝা খিরকানীর সাথে যে কোনো সমস্যা নিয়ে আলাপের দ্বারা হাল্কা হয়ে যেতো।

তোগা খানের সাথে সাক্ষাতের পর বাগদাদের খলীফা সম্পর্কে অনাকাঙ্খিত খবরাখবর শুনে তিনি এতোটাই কষ্ট পেলেন যে, তার চিন্তাশক্তি স্থবির হয়ে গেলো। কারণ, খলীফাকে তিনি বিশ্বের ইসলামী চেতনার কেন্দ্রবিন্দু মনে করতেন। তিনি ভাবতেন, বাগদাদই ইসলাম ও মুসলমানদের ইজ্জত, মর্যাদা ও উজ্জীবনের প্রাণশক্তি। কিন্তু খলীফা কাদের বিল্লাহ আব্বাসী ছিলো ইসলামী সালতানাতের কলঙ্ক। তিনি মনে মনে কখনো তোগা খানের প্রতি ক্ষুব্ধ হচ্ছিলেন, আবার কখনো খলীফার প্রতি তার ক্ষোভ-ঘৃণা সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে বেরিয়ে পড়তে চাচ্ছিলো। তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিলো যে, তোগা খান তাকে বিভ্রান্ত করতে অসত্য কোনো তথ্য দেয়নি। এ খবর তার চিত্তকে অস্থির করে তুলেছিলো। এমতাবস্থায় বারবার তার আধ্যাত্মিক গুরু আবুল হাসান খিরকানীর কথা মনে পড়ছিলো।

সেই দিনই তিনি আবুল হাসান খিরকানীর সাথে সাক্ষাতের জন্য রওনা হলেন। ভোরে রওনা হয়ে পরদিন সন্ধ্যায় তিনি গন্তব্যে পৌঁছে গেলেন। গুরুর সকাশে পৌঁছে তাঁর হাতে চুমু দিয়ে সুলতান মাহমূদ বললেন, “আমার বিশ্বাসের পরিপন্থী একটা সংবাদ আমাকে মানসিকভাবে চরম হতাশাগ্রস্ত করে ফেলেছে। দারুণ যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছি আমি। আমাকে স্বস্তির কোনো পথ বাতলে দিন গুরু।”

“কী হয়েছে? হিন্দুস্তান থেকে কি পরাজিত হয়ে এসেছো?” জিজ্ঞেস করলেন খিরকানী।

“আপনাদের দুআয় হিন্দুস্তানের মুশরিকদের কাছে আমি কখনো পরাজিত হবো না। বিজয়ী কোনো সুলতান তখনই পরাজিত হয় যখন স্বজাতীয় কোন ভাই তার পিঠে আঘাত হানে।” সুলতান বললেন।

“আমি সেইসব আত্মঘাতী ভাইদের ব্যাপারে মোটেও বেখবর নই সুলতান। কিন্তু ভুলে যেও না আল্লাহ সত্যের পক্ষে আছেন। আল্লাহ তোমাকে মদদ করবেন, তোমার হতাশ হওয়ার কোনোই কারণ নেই।” বললেন খিরকানী।

“আপনি হয়তো জানেন। কিন্তু এ কথাও কি আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে যে, খলীফা আল-কাদের বিল্লাহ আমার বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে প্ররোচনা a দিচ্ছে। আমাকে একথা বলেছে এলিখ খানের ভাই তোগা খান।” সুলতান বললেন।

খিরকানী স্মিত হেসে বললেন, “আমি এটাও জানি। খলীফার অসৎ ধারণা সম্পর্কে আমি যখন প্রথম জানতে পারি, তখন তুমি হিন্দুস্তানে। তুমি আজ না ও আসলে আমিই তোমাকে এ ব্যাপারে অবহিত করতে খবর পাঠাতাম।”

“তাহলে কি আমি তোগা খানের সংবাদকে সত্য বলেই বিশ্বাস করবো? আমি কি এতোদিন আত্মপ্রবঞ্চনায় ছিলাম যে খলীফাতুল মুসলিমীন আল্লাহর রসূলের প্রতিনিধি?” সুলতান বললেন।

“যারা সত্যিকার অর্থে রাসূলের প্রতিনিধি ছিলেন, তারা গত হয়ে গেছেন।” বললেন খিরকানী। “তাদের পর যারা এসেছে এবং ভবিষ্যতে যারা আসবে, তারা প্রবৃত্তির পূজারী খলীফা হবে। বর্তমান খলীফা একটি রাজ্য শাসন করে। সমরকন্দের শাসকও তিনি। তিনি যে কোনো মূল্যে তার মসনদ আঁকড়ে থাকতে তৎপর। রাজত্বই তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খেলাফতের সকল রীতি পদদলিত করে বর্তমান খলীফা তার প্রত্যক্ষ রাজত্বের পরিধিকে সম্প্রসারিত করতে শক্তিশালী ও দুর্নীতিপরায়ণ শাসকদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছেন। তুমি কি জানো না, তোমার পিতার শাসনামলে কারামাতীদের সাথে বর্তমান খলীফা কাদের বিল্লাহ আব্বাসী গোপনে মৈত্রী গড়ে তুলেছিলেন? আর তখন কারামাতীরা অজেয় শক্তিতে পরিণত হয়েছিলো। এরপর তুমি যখন আপসহীনভাবে নিজের দৃঢ়তা ও সাহসিকতার উপর ভর করে সামরিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে হিন্দুদের দুটি গজনী আক্রমণ প্রতিহত করে ওদের দেশের ভেতরে গিয়ে হিন্দুদের পরাজিত করে হিন্দু অঞ্চল নিজের কজায় আনতে শুরু করলে এবং কারামাতীদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে ওদের ভণ্ডামী ও ভ্ৰষ্টামী নির্মূল করতে সক্ষম হলে, তখনই খলীফা তোমাকে আমীমুল মিল্লাত ও আমীনুদ্দৌলা’ খেতাবে ভূষিত করেন। তোমাকে তার বিশ্বস্ত ও অনুগত করে নেন। হিন্দুস্তানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পৌত্তলিকতা দূর করে সেখানে ইসলামের সত্যের বাণী প্রচার করা আর বিন কাসিমের বিজিত রাজ্যগুলোর নিগৃহীত মুসলমানদেরকে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের নাগপাশ থেকে মুক্তির ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই। বরং তোমার ক্রমবর্ধমান শক্তিতে সে শংকিত। এ আশংকা থেকেই তিনি প্রকাশ্যে তোমাকে বাহবা দিচ্ছেন আর নেপথ্যে তোমার শত্রুদেরকে উস্কানি দিয়ে তোমার শক্তি খর্ব করতে তৎপর রয়েছেন।”

“একজন কেন্দ্রীয় খলীফার এ ধরনের তৎপরতায় লিপ্ত হওয়া কি সমীচীন?” বললেন সুলতান।

“তুমি তাকে খলীফাতুল মুসলিমীন বলছো? আমি তাকে কখনো মুসলিম বিশ্বের অভিভাবক মনে করি না। শরীয়তের দৃষ্টিতে তার খলীফার মসনদে আসীন হওয়ার কোনোই যোগ্যতা নেই। খলীফা হওয়ার জন্য তাকওয়া ও ইসলামী আদর্শের অনুসারী হওয়া অপরিহার্য। সেই সাথে মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ ও বিশৃঙ্খলার পরিবর্তে ঐক্য ও সংহতি স্থাপন তার একান্ত কর্তব্য। তার মধ্যে কোনো ধরনের বৈষয়িক লালসা থাকা মোটেই উচিত নয়। এসব বিচারে সে মোটেও খলীফা হওয়ার উপযুক্ত নয়। যে খলীফা প্রত্যক্ষ রাজ্য শাসন করে, সে দুর্নীতিমুক্ত থাকতে পারে না।” খিরকানী বললেন।

“আমরা কি এমন খলীফাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারি না?” বললেন সুলতান মাহমূদ।

“না। কারণ, খেলাফত এখন পারিবারিক ও গোষ্ঠীগত সম্পদে পরিণত হয়েছে। খেলাফত এখন ইসলামের প্রতীক হওয়ার পরিবর্তে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত ক্ষমতার মসনদে পরিণত হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রধান কারণ খেলাফতের বিকৃতি সাধন। খেলাফত এখন শক্তি, ক্ষমতা ও ব্যক্তি শাসনের প্রতাঁকে পরিণত হয়েছে। এখন যাকেই খলীফা বানানো হোক, সে-ই এমন হবে। ধীরে ধীরে মুসলিম উম্মাহ আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। উম্মাহর ঐক্য, সংহতি, সম্মান ও মর্যাদা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। টুকরো টুকরো হয়ে পড়বে মুসলিম সালতানাত। ভবিষ্যতে এমন হবে যে, হাতে কুরআন শরীফ নিয়ে খলীফারা নিজেদেরকে ইসলামের সেবক ঘোষণা করবে; কিন্তু ইসলামের শত্রুদেরকে বন্ধু আর বন্ধুদের শত্রু বানাবে। তারা হবে মুসলিম উম্মাহর জন্য জলজ্যান্ত ধোকা। তারা নিজেদের চারপাশে তোষামোদকারী ও অনুগত ভৃত্যের জাল তৈরি করবে। মুসলিম উম্মাহ আরবী, আজমী, মিশরী, তুর্কি নানা আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে যাবে। ইসলামের ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যেই সৃষ্টি হবে সংশয়। শাসন ক্ষমতায় যারাই অধিষ্ঠিত হবে, তারা হবে স্বৈরাচারী।” খিরকানী বললেন।

“এ প্রেক্ষিতে আমার কী করা উচিত?” বললেন সুলতান। “আমি খলীফাকে তোষামোদ করতে পারবো না।”

“খলীফাকে তুমি বুঝিয়ে দাও, তার চক্রান্তের ব্যাপারে তুমি অবগত।” বললেন খিরকানী। “মাহমূদ! মুসলমান যখন ঈমান নিয়ে বাণিজ্য করে, তখন বস্তুনিষ্ঠতার অধিকারী সত্যপন্থী ঈমানদানদের বোকা ও মিথ্যাবাদী মনে করতে থাকে। তুমি হিন্দুস্তানে যেসব লোকের হাতে ঐসব এলাকার শাসনভার ন্যস্ত করেছো, আমার ভয় হয়, ওরা না আবার প্রবৃত্তির ধোকায় পড়ে যায়। মুসলমানদেরকে দুটি জিনিস বড় বেশী ঘায়েল করে ফেলে- একটি প্রবৃত্তির খায়েশ আর অপরটি সম্পদ ও ক্ষমতার মোহ। হিন্দুস্তান ধোকা ও প্রতারণার উর্বর ভূমি। তোমার নিযুক্ত শাসকরা ঈমান বিক্রেতা হয়ে যায় কিনা এ বিষয়টি আমাকে খুব ভাবায়। ভবিষ্যতে তোমার সমূহ বিপদ ও কঠিন পরীক্ষা অপেক্ষা করছে, তাতে তুমি ঘাবড়ে যেয়ো না।”

“তাহলে কি আমি খলীফাকে বিষয়টি জানিয়ে দেবো?” সুলতান বললেন।

“সত্য কথা বলতে দ্বিধা করা উচিত নয়। আমিও খলীফাকে বিষয়টি জানাতে চেষ্টা করবো।” খিরকানী বললেন।

আধ্যাত্মিক গুরু আবুল হাসান খিরকানীর সান্নিধ্য থেকে গজনী ফিরে সুলতান মাহমূদ বাগদাদের খলীফা কাদের বিল্লাহ আব্বাসীর কাছে এই বলে পয়গাম পাঠালেন যে- “গজনী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত খোরাসানের অধিকাংশ এলাকা আপনি দখল করে রেখেছেন। আপনাকে আমি আমাদের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এলাকার একটি মানচিত্র এঁকে দিচ্ছি। যেসব এলাকা আমি চিহ্নিত করে দেবো, সেসব অঞ্চল থেকে আপনি আপনার আমলা ও সেনাদের প্রত্যাহার করে নিবেন। খলীফার কোনো এলাকারই প্রত্যক্ষ শাসক হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমি জানি, আপনি আমার প্রস্তাব মানতে সম্মত হবেন না। এতোদিন আমি খেলাফতের সম্মানে নীরব ছিলাম; কিন্তু আমার আজীবন লালিত ধারণা এখন ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আশা করি, আপনি নির্বিবাদে আমার চিহ্নিত এলাকাগুলো আমাদের ফেরত দেবেন। আশা করি, নিজের মর্যাদা ও সম্মানের দিকে লক্ষ্য রেখে আপনি কোনো ধরনের প্রতারণার আশ্রয় না নিয়ে আমার আবেদনে সাড়া দেবেন।”

ঐতিহাসিক ফারিশতা, আলবিরুনী ও গরদিজী প্রমুখ লিখেছেন, সুলতান মাহমূদের সামরিক শক্তি সম্পর্কে খলীফা কাদের বিল্লাহ পুরোপুরি জ্ঞাত ছিলেন। তিনি এটাও জানতেন যে, সুলতান যা ইচ্ছা করেন এবং বলেন, তা বাস্তবে প্রতিফলন না ঘটিয়ে ক্ষান্ত হন না। খলীফা এটাও জানতেন, গজনী অঞ্চলের সকল অধিবাসী সুলতানের অনুগত। তাই সুলতানের পয়গাম পাওয়ার পর কোনো ধরনের টালবাহানা না করে খোরাসান রাজ্যের যে অংশটুকু গজনী সালতানাতের অংশ ছিলো, তা থেকে সেনাবাহিনী ও আমলাদের প্রত্যাহার করে সুলতানের নিয়ন্ত্রণে হস্তান্তর করলেন।

খলীফার এই কাজে সুলতান আরো ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, এতো তাড়াতাড়ি খলীফার রণেভঙ্গ দেয়ার অর্থ হলো তার মধ্যে আসলে ধর্মীয় চেতনা অনুপস্থিত। সে ক্ষমতালি ও ধুরন্ধর। এরপর সুলতান মাহমূদ এই বলে আবার বাগদাদে দূত পাঠালেন যে, সমরকন্দের উপর আপনার দখলদারিত্ব বৈধ নয়। এই শহরটিও আমার অধীনে হস্তান্তর করুন। সুলতানের সমরকন্দ চাওয়ার পয়গামের জবাবে খলীফা এই বলে তার এক বিশেষ দূতকে সুলতানের কাছে পাঠালেন যে, “খলীফা কোনো অবস্থাতেই সমরকন্দের দখল হস্তান্তর করবেন না। খলীফা এও বলেছেন, আপনি যদি এই দাবী আদায়ে শক্তি প্রয়োগ করেন, তাহলে খলীফা গোটা জাতির সম্মুখে আপনাকে অপমানিত করবেন।”

জবাবে সুলতান মাহমূদ দূতকে বললেন, “তুমি বাগদাদে গিয়ে খলীফাকে জিজ্ঞেস করো, সে কী চায়। আমি এক হাজার জঙ্গী হস্তি নিয়ে বাগদাদ আসবো।” রাগে-ক্ষোভে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, “খলীফাকে বলবে, আমাকে যদি বাগদাদ আসতেই হয়, তাহলে আমি বাগদাদের রাজপ্রাসাদের প্রতিটি ইট খুলে ফেলবো আর প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ হাতির পিঠে বোঝাই করে গজনী নিয়ে আসবো।”

এক ইংরেজ ঐতিহাসিক এইচ এইচ হোয়াৰ্থ অন্যান্য মুসলিম ঐতিহাসিকদের উদ্ধৃত করে লিখেছেন, সুলতান মাহমূদের এই হুমকিতে খলীফা কাদের বিল্লাহ আব্বাসী রীতিমতো ভড়কে যান। তিনি এমন এক মহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন যে, ইচ্ছা করে নিজের পদকে অবলম্বন করে তিনি সুলতান মাহমূদকে ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশ দিতে পারতেন। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবনাচার এতোই কদর্য ছিলো যে, তিনি নিজ অবস্থানের চেয়ে অত্যন্ত নমনীয়ভাবে সুলতান মাহমুদের ক্ষোভের জবাব দিলেন। যার ফলে সুলতান মাহমূদ সেনাভিযান পরিচালনা করে সমরকন্দকে নিজের শাসনের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন।

এক হাজার বারো খৃস্টাব্দের প্রায় অর্ধেক বছর চলে গেছে। সুলতান মাহমূদ ভারতের বিজিত রাজ্যগুলোর ব্যাপারে অনেকটা নিশ্চিতই ছিলেন। পা বের রাজা আনন্দ পাল তখনো জীবিত থাকলেও তার শক্তি-সামর্থ নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো। তিনি সুলতান মাহমূদের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছিলেন। গোয়েন্দাদের মাধ্যমে হিন্দুস্তানের রাজা-মহারাজাদের তৎপরতার খবরাখবর তিনি রীতিমতো পাচ্ছিলেন। তার কাছে একদিন খবর এলো, রাজা আনন্দ পাল মারা গেছেন। তার ছেলে তরুণ চন্দ্রপাল এখন পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে।

থানেশ্বর মন্দিরের সর্বপ্রাচীন ও সর্ববৃহৎ বিষ্ণুদেবীর মূর্তি সুলতান মাহমুদ গজনী নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সেখানে নিয়ে বিষ্ণুমূর্তিকে খুবই অপমানজনকভাবে ধ্বংস করা হয়েছিলো। হিন্দুদের কাছে বিষ্ণুমূর্তির অমর্যাদা যতোটুকু না ছিলো গ্লানির, তার চেয়ে বেশি ছিলো আতংকের। হিন্দুরা বিষ্ণুমূর্তির অমর্যাদার কারণে দেবদেবীদের অভিশাপে নিপতিত হওয়ার আশংকায় ভীতসন্ত্রস্ত ছিলো। পণ্ডিতরা দেবালয়ে মূর্তির সামনে বসে ভয়ে থর থর করে কাঁপতো। তাদের ধারণা ছিলো, বিষ্ণমূর্তি পৃথিবীতে মানুষের আগমনের সাথে সাথেই সৃষ্টি হয়েছিলো। পৃথিবীর প্রথম মানুষটিও বিষ্ণুমূর্তিকেই পূজা করতো। সেই পুরনো দেবমূর্তির এহেন অমর্যাদায় হিন্দুরা গঙ্গার পানিতে নেমে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দেবতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতো। সাধারণ একটু বাতাস এলে কিংবা আকাশের গর্জন শুনলেই হিন্দুরা দু’হাত জোড় করে বিড় বিড় করে ভগবানের কাছে ক্ষমাভিক্ষা চাইতো।

জয়পালের মৃত্যুর পর আনন্দ পাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বেশ জাকজমক নিয়ে কয়েকটি যুদ্ধে সুলতান মাহমূদকে হুমকি দিয়েছিলো। কিন্তু প্রত্যেকটি যুদ্ধেই সুলতান মাহমূদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় আনন্দ পাল। অবশেষে সে সুলতানের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এরপরও সুলতানকে ফাঁকি দিয়ে জব্দ করার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয় আনন্দ পাল।

ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, ক্রমাগত পরাজয়ে আনন্দপাল হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলো। বিশেষ করে সুলতান মাহমূদ থানেশ্বর মন্দির কজা করে নেয়ার পর এর শোক সইতে না পেরে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে রাজা আনন্দ পাল । অবশেষে তার মৃত্যুর পর পুত্র তরুণ চন্দ্রপাল ক্ষমতাসীন হয়।

রাজা আনন্দ পালের মৃত্যুর খবর শুনে হিন্দুস্তানের ছোট-বড় সকল রাজা-মহারাজা ও রায়গণ এসে লাহোরে জমায়েত হয় আনন্দ পালের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে। আনন্দ পালের মরদেহ যখন চিতায় জ্বলছিলো, তখন কনৌজের রাজা, সমবেত হিন্দু শাসকদের উদ্দেশে উচ্চ আওয়াজে বললো, “আজ আমরা এমন এক মহান পুরুষের চিতার পাশে দাঁড়িয়েছি, যিনি সারাজীবন মন্দিরের হেফাযতের জন্য মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করে কাটিয়েছেন। হিন্দুস্তানের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র শাসক, যিনি নিজের সীমানা পেরিয়ে গিয়ে সুলতান মাহমূদকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। আমাদের গাদ্দারী ও কাপুরুষতার কারণে আজ হিন্দুস্তানের ঐতিহাসিক মন্দিরগুলো থেকে মুসলমানদের আযান ধ্বনিত হচ্ছে। আসুন, বীরপুরুষ রাজা আনন্দ পালের জ্বলন্ত চিতার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা শপথ নিই, আমরা সবাই মিলে মন্দিরের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবো এবং হৃত মন্দিরগুলো ফিরিয়ে এনে মসজিদগুলোকে মন্দিরে পরিণত করবো।”

“আমি এই অঙ্গীকার করছি বিষ্ণুদেবীর প্রতিশোধ নিতে। আমি গজনীর প্রতিটি ইট খুলে ফেলবো।” বললো কনৌজের রাজা।

সমবেত প্রত্যেক রাজা-মহারাজা, ঋষি ও পুরোহিত আনন্দ পালের জ্বলন্ত চিতার তপ্ত আগুনের তাপে উত্তপ্ত হয়ে প্রতিজ্ঞা করলো, তারা ভারতে ইসলামের ক্রমবর্ধমান বিস্তৃতি লাশের বাঁধ দিয়ে হলেও রোধ করবে। প্রত্যেকেই শপথ করলো, তারা মুসলমানদের মসজিদগুলোকে মন্দির, মুসলমানদেরকে হিন্দু এবং গজনীকে মহাভারতের রাজধানীতে রূপান্তরিত করবে। আনন্দ পালের উত্তরাধিকারী তরুণ চন্দ্রপাল সমবেত রাজাদের সারিতে দাঁড়িয়ে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিলো।

“রাজকুমার তরুণ চন্দ্রপালেরও এ সমাবেশে কিছু বলা উচিত। তিনিই তো এখন ক্ষমতাসীন রাজা।” বললো এক পুরোহিত। “শোক-তাপ এখন ভুলে যাওয়া উচিত। রাজপুতরা অশ্রু নয়, বুকের তাজা রক্ত দিয়ে শোককে শক্তিতে পরিণত করে।”

যুবক তরুণ চন্দ্রপাল সারি ঠেলে আরো সামনে এগিয়ে এলো। বাবার জ্বলন্ত চিতার দিকে তাকিয়ে সমবেত রাজা-মহারাজাদের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো, “আপনারা সবাই তো কঠিন সব অঙ্গীকারবাণী উচ্চারণ করলেন। কিন্তু বলুন তো, আপনাদের মধ্যে এমন ক’জন আছেন, যিনি কৃত অঙ্গীকার পূরণ করবেন? ইসলামের স্রোতের সামনে লাশের বাঁধ এতোদিন পর্যন্ত কেন আপনারা দিতে পারেননি। মুসলমানরা যখন থানেশ্বরের দিকে যাত্রা করেছিলো, তখন আপনাদের এই শক্তি ও দাপট কোথায় ছিলো। এখানকার মসজিদগুলোকে মন্দির এবং মুসলমানদেরকে হিন্দু বানানো খুব কঠিন কাজ নয়, রাজপুতরা রক্তের সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়াকে ভয় করে না। আপনার। আমার বাবার খুব প্রশংসা করেছেন; কিন্তু বাবা তার এলাকায় প্রত্যেকটি যুদ্ধ। মোকাবেলা করেছেন। আপনাদের মধ্যে অনেকেই আমাদের কাছে এ জন্য কিছু সৈন্য দিয়েছিলেন, যাতে আমরা মুসলমানদেরকে পেশোয়ারে ঠেকিয়ে রাখি। আপনারা কথায় যেমন সাহসিকতা দেখান, কাজে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। আপনারা চান, সুলতান মাহমূদের অগ্রযাত্রা আমরা এখানেই বাধাগ্রস্ত করে রাখি আর আপনারা নির্বিবাদে রাজত্ব করবেন।”

“মহারাজ! আপনি আসলে কী বলতে চাচ্ছেন?” তরুণ চন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলো এক রাজা।

“আমি পরিষ্কার বলে দিতে চাই, আমার রাজ্যকে নিরাপদ রাখার জন্য আমি মুসলমানদেরকে বন্ধু হিসেবে বরণ করে নেবো। সুলতান মাহমূদ আমার রাজ্যে আক্রমণ করলে আমি মোকাবেলা করবো। কিন্তু এখানকার নিরপরাধ মুসলমানদের উপর আমি হাত উঠাবো না।” বললো তরুণ চন্দ্রপাল।

“তাহলে আপনি কি মাহমূদের মিত্র ও আনুগত্য মেনে নিচ্ছেন?” প্রশ্ন করলো কনৌজের রাজা।

“হ্যাঁ, আমি মাহমূদকে কর দেব এবং তার আনুগত্য মেনে চলতেই চেষ্টা করবো।”

“আপনি কি জানেন না, এখানকার মুসলমানরা হিন্দুস্তানে বসবাস করলেও গজনী সুলতানেরই আনুগত্য করে?” বললো অপর এক রাজা।

“আপনার কি একথা জানা নেই যে, গজনীতেই বহু হিন্দু বসবাস করে, আর গজনী বাহিনীতে পৃথক একটি হিন্দু ইউনিট পর্যন্ত রয়েছে। কিন্তু তাদের থেকে কি কেউ বিদ্রোহ করে সেখান থেকে এখানে এসেছে। ওদের কজায় আছে সেনাবাহিনীর চৌকস ঘোড়া, জঙ্গী হাতি, আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র। তারা সেখানে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারছে। তাদের কেউ এ পর্যন্ত কেনো হিন্দুস্তানে পালিয়ে এলো না? এখানকার সব মুসলমান আমাদের শত্রু নয়। অনেকেই আমাদের খুবই বিশ্বস্ত।” বললো তরুণ চন্দ্রপাল।

হঠাৎ মহিলাদের ভিড় ঠেলে এক সুন্দরী তরুণী রাজা-মহারাজাদের সারিতে দাঁড়ানো তরুণচন্দ্রের পাশে এসে দাঁড়ালো। সে তরুণচন্দ্রের হাত থেকে তরবারী কেড়ে নিয়ে উঁচিয়ে ধরে বললো, “আপনারা সবাই জানেন, আমি এই ব্যক্তির স্ত্রী। তাকে বলুন, সে আমাকে বাবার জ্বলন্ত চিতায় ফেলে কিংবা এই তরবারী দিয়ে হত্যা করুক। আমি পরিষ্কার ঘোষণা করছি, আমি রাজপুতের কন্যা। আমার বাবা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি আমার ধর্ম অবমাননার প্রতিশোধ নেবো, আমার বাবার রক্তের বদলা নেবো। আজ থেকে আমি আমার স্বামীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করছি। সে একটা কাপুরুষ। যে ব্যক্তি গজনী সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়, তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।”

তরুণচন্দ্র তরুণীর প্রতি ধেয়ে এলো। কিন্তু ততোক্ষণে তাদের দুজনের মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে গেলো আরেক যুবক এবং দ্রুত সে তরুণীর হাতের তরবারী কেড়ে নিলো। এই তরুণ ভীমপাল। আনন্দ পালের দ্বিতীয় পুত্র এবং তরুণচন্দ্রের ছোট ভাই। ঐতিহাসিকরা তাকে ভীমপাল বাহাদুর নামে উল্লেখ করেছেন। ভীমপাল ছিলো খুবই ডানপিঠে ও দুঃসাহসী। ভীমপাল তরুণপালকে বাধা দিয়ে বললো, “খবরদার তরুণপাল! এখানে এমন কেউ নেই, যে তোমার সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে। এই মহিলার গায়ে তুমি হাত তুললে তুমি যে আমার ভাই এবং ওর স্বামী আমি সেকথা ভুলে যাবো। এখন থেকে আমিই হবো আমার বাবার সিংহাসনের অধিকারী। বাবার সিংহাসনের সে-ই স্থলাভিষিক্ত হতে পারে, যে তার অপমানের প্রতিশোধ নিতে সক্ষম।”

ভীমচন্দ্র সমবেত লোকদের দিকে তাকিয়ে তরবারী উঁচিয়ে বললো, “আমি যদি গজনী সুলতানের বশ্যতা অস্বীকার করি এবং বিষ্ণুদেবীর অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার অঙ্গীকার করি, তাহলে কি আপনারা আমাকে বাবার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে মেনে নেবেন?”

“হ্যাঁ, তুমিই মহারাজা জয়পাল ও মহারাজা আনন্দ পালের যোগ্য উত্তরসূরী।” ঘোষণা করলো প্রধান পুরোহিত।

এরপরই সমাবেশ থেকে আওয়াজ উঠলল, “তরুণচন্দ্র পালকে বসিয়ে দাও, তরুণচন্দ্রের কাছ থেকে তরবারী ছিনিয়ে নাও। ভীমপাল মহারাজের জয় হোক।”

দেখতে দেখতে ভীমপালের জয়ধ্বনি উচ্চকিত হলো। এর সাথে পাল্লা দিয়ে উঁচু হয়ে উঠলো আনন্দ পালের চিতার আগুন। চিতার লেলিহান অগ্নি শিখার সাঁই সাঁই শব্দ আর ভীমপালের জয়ধ্বনিতে তলিয়ে গেলো তরুণচন্দ্রের বাস্তববাদিতার অস্তিত্ব। কিছুক্ষণের মধ্যে আনন্দ পালের দূরদর্শী বড় ছেলে ব্রাহ্মণ্যবাদী উগ্রতার কাছে পরাজিত হয়ে সাধারণ রাজকুমারে পরিণত হলো। তার জায়গায় আনন্দ পালের উগ্র ও অদূরদর্শী দ্বিতীয় পুত্র ভীমপাল রাজা-মহারাজা ও পুরোহিতদের সমর্থনে সিংহাসনে স্থলাভিষিক্ত হলো। পাঞ্জাবের মহারাজায় অভিষিক্ত হলো ভীমপাল।

***

দিন শেষে সেই রাতেই আনন্দ পালের রেখে যাওয়া রাজপ্রাসাদে হিন্দুস্তানের রাজা-মহারাজা ও পুরোহিতদের কনফারেন্স বসে। সমাবেশের সভাপতির আসন অলংকৃত করলো আনন্দ পালের দ্বিতীয় পুত্র ভীমপাল। মসনদ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রাসাদ থেকে গায়েব হয়ে গেলো তরুণচন্দ্র পাল। শুরু হলো ভীমপালের নেতৃত্বে মুসলিম উৎখাতের চিন্তা-ভাবনা।

সবচেয়ে প্রবীণ পুরোহিত প্রস্তাব করলো, “হিন্দুস্তানের সবগুলো মসজিদ গুঁড়িয়ে দিতে হবে এবং এখানকার মুসলমানদের বাধ্য করা হবে- হয় তারা গজনী চলে যাবে, নয়তো সনাতন ধর্ম গ্রহণ করবে।”

“এ ব্যাপারে আমি দাদা তরুণচন্দ্রের কথা সমর্থন করি। নিরপরাধ মুসলমানদের উপর আমরা কেনো হাত তুলতে যাবো?” বললো ভীমপাল। “আমরা শত্রুর সংখ্যা বাড়াতে চাই না, বন্ধুর সংখ্যা বাড়াতে চাই। এখানকার সবগুলো মসজিদ ধ্বংস করে দিলেও মুসলমানদের কিছু যায়-আসে না। মুসলমানরা যেখানেই নামায পড়তে দাঁড়ায়, সে জায়গায়ই মসজিদে পরিণত হয়। এসব ছায়ার পেছনে আমাদের দৌড়ে কোনো লাভ হবে না। সুলতান মাহমূদের মতো মহাশক্তির বিরুদ্ধে হবে আমাদের লড়াই। আমি হিন্দুস্তানের ইতিহাসে আমার নামের সাথে এ কাহিনী রেখে যেতে চাই না, ভীমপাল গজনীর সুলতানের কাছে পরাজিত হয়ে নিরপরাধ মুসলমানদের হত্যা করে প্রতিশোধ নিয়েছে।”

“আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মুসলমানরা শুধু আমাদের মন্দিরগুলো ধ্বংস করে দেয়নি; মন্দির দখল হয়ে যাওয়ার কারণে বিপুল হিন্দু ইসলামের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে।” বললো এক বিচক্ষণ পুরোহিত। “লোকজন দেবদেবীর অভিশাপ ভয় পাচ্ছে; কিন্তু এখনো দেবদেবীদের কোন অভিশাপে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়নি। দেবতাদের অভিশাপ বর্ষণের আগেই আমাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাণ্ডব হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আমাদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে, মুসলমানরা যেগুলোকে ভূত বলে সেগুলোই আমাদের দেবতা। দেবতাদের অসম্মানকারী কোনো মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।”

“যেসব দুর্গ মুসলমানদের দখলে রয়েছে, সেগুলো অবরোধ করা হোক।” প্রস্তাব করলো এক রাজা। কিন্তু সাথে সাথেই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলো কয়েকজন। তারা বললো, “মুসলিম দখলকৃত কোনো দুর্গ অবরুদ্ধ হওয়ার খবর পেলে পূর্ণ শক্তি নিয়ে চলে আসবে মাহমূদ। যে কোনো সামরিক পদক্ষেপের আগে আমাদের প্রস্তুতি নেয়া দরকার। আর প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজন সময়। সময় নিয়ে পূর্ণ প্রস্তুতির পর আমরা ইচ্ছা করলে মাহমুদকে হিন্দুস্তানের কোনো সুবিধামতো এলাকায় টেনে নিয়ে ফাঁদে ফেলা সম্ভব হবে।”

“এ সময়ের মধ্যে রেরা, মুলতান ও থানেশ্বরে যেসব মুসলিম কর্মকর্তা রয়েছে তাদেরকে আমাদের হাত করে নেয়ার চেষ্টা করা দরকার, যাতে তারা মাহমূদের সহযোগিতা না করে। প্রস্তাব করলো ভীমপালের উজির। ভীমপালের উজির ছিলো অত্যন্ত অভিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান। সে আরো বললো, “মুসলমান কর্মকর্তাদের বাগে আনার কৌশল আমাদের জানা আছে। সে কৌশল প্রয়োগ করে আমরা এদের অকার্যকর করে দিতে পারি।”

“মুসলমান কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি খুবই সতর্ক ও নিষ্ঠাবান।” বললো ভীমপাল। “তবুও আমার মনে হয়, আপনার কোনো কৌশল এসব সেনাপতি ও কর্তাব্যক্তিদের বাগে আনতে সফল হবে।”

উজির স্মিত হেসে বললো, “মুসলমানরাও মানুষ। সাধারণ মানুষরা অবতার ও পয়গাম্বরের গুণবিশিষ্ট হয় না। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই একটা দুর্বলতা এবং একটা চাহিদা থাকে। যারা এই দুর্বলতা ও চাহিদাকে দমিয়ে রাখতে পারে, তারাই হয় মুনি-ঋষি কিংবা পীর-বুযুর্গ। আমরা মানুষের মধ্যে থাকা সহজাত দুর্বলতা ও চাহিদাকে উস্কে দিয়ে তাদেরকে সেই উচ্চাসন থেকে নিচে নামিয়ে দিতে পারি। তাদের মধ্যে ভোগবাদের স্বপ্ন জাগিয়ে দিতে পারলে তারা কর্তব্যপরায়ণতা ভুলে যাবে।… আমরা থানেশ্বর থেকেই এ কাজ শুরু করতে পারি।”

রাজা-মহারাজাদের কনফারেন্সে আরো সিদ্ধান্ত হলো, এখন থেকে ভারতের সকল রাজা-মহারাজা সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত আক্রমণের পূর্ণ প্রস্তুতি শুরু করবে। সেই সাথে মুসলমান সেনাধ্যক্ষ ও কর্মকর্তাদের পক্ষে নিয়ে আসার পূর্ণ চেষ্টাও অব্যাহত থাকবে। এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর আনন্দ পালের দ্বিতীয় পুত্রকে সুলতান মাহমুদের কাছে এই বলে বার্তা পাঠানোর কথা বলা হলো যে, তিনি আর সুলতান মাহমূদের করদাতা নন। রাজা আনন্দপাল যে মৈত্রী চুক্তি করেছিলেন, তা প্রত্যাখ্যান করা হলো।

হিন্দুস্তান থেকে ফেরার সময় সুলতান মাহমূদ তার অভিজ্ঞ সেনাধ্যক্ষ আবদুল্লাহ আল তাঈ, আলতানতুশ এবং আরসালান জায়েবকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, সেখানকার সমস্যা ছিলো খুবই কঠিন। হিন্দুস্তানের অভিযানে অনেক অভিজ্ঞ জেনারেল ছিলেন। কিন্তু তারা উল্লেখিত তিন জেনারেলের মতো দূরদর্শী ছিলেন না। সুলতান সেসব সেনাধ্যক্ষকেই বিজিত এলাকার আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ সার্বিক প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োগ করেছিলেন।

থানেশ্বর রাজ্যের সেনাধ্যক্ষ ছিলেন বাহরাম গৌড় আর শহরের গভর্নর প্রশাসক ছিলেন কুতুব গোজাক। কুতুব গোজাক এ-ই প্রথম হিন্দুস্তানে এসেছিলেন। এখানকার প্রতিটি জিনিসই তার মনে বিস্ময় সৃষ্টি করতো। তিনি যখন দেখলেন, দুটি মেয়েকে দু’টি আসনে বসিয়ে সেই আসনগুলোকে মানুষশূন্য করে ফেলা হলো এবং কিছুক্ষণ পর সেই জায়গায় আবার সেই তরুণীদেরকেই গায়েব থেকে হাজির করা হলো, তাতে তিনি খুবই বিস্মিত হলেন। গজনীর নারীরাও রূপ-সৌন্দর্যে কম ছিলো না কিন্তু তার কাছে হিন্দুস্তানের নারীদের রূপ-লাবণ্য দারুণ আকর্ষণীয় মনে হলো। তাকে জানানো হলো, হিন্দুস্তান আসলেই কারামত ও জাদুর দেশ। এখানে নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল কোষ্টা সত্যিকার কারামত আর কোন্‌টা জাদু। কুতুব গোজাকের কাছে সবচেয়ে বেশি আশ্চর্যজনক লাগলো, এখানকার লোকজন সাপপূজা করে এবং নারীরা তাদের দুধ সাপকেও পান করায়।

একদিন সাত-আটজনের একটি মুসাফির সন্ন্যাসীদল চার-পাঁচজন তরুণী নিয়ে থানেশ্বর মন্দিরে পূজা দিতে এলো। সন্নাসীদের সবার গলা থেকে পায়ের টাখনু পর্যন্ত সাদা কাপড়ে আবৃত। তরুণীরাও সাদা কাপড়ে আবৃতা। কিন্তু খুব হাল্কা ওড়না দিয়ে তাদের মাথা ঢাকা। সব কজন তরুণীরই চুল হাল্কা বাদামী, চোখ নীলাভ, গায়ের রঙ শ্যামল-রাঙা মিশেল। সবার গড়ন ও চালচলন এক ধরনের। পুরুষদের সবারই দাড়ি আছে, তবে মাত্র একজনের দাড়ি সাদা।

সন্ধ্যার পর এই অভিযাত্রীদল যখন থানেশ্বর দুর্গে প্রবেশ করছিলো, তখন তাদের সবাইকে দেখে অতি ধর্মপরায়ণ সাধু-সন্ন্যাসী ও সংসার বৈরাগীই মনে হচ্ছিলো। তারা দুর্গের ফটকে এসে দুর্গপতির সাথে সাক্ষাতের আবেদন করলো। তারা আবেদনে জানালো, তাদের সাথে কয়েকজন তরুণী আছে। এ জন্য তারা সরাইখানায় থাকতে ভয় পাচ্ছে। তারা দুর্গপতির সাথে সাক্ষাত করে একটা নিরাপদ জায়গায় রাতযাপনের অনুমতি চায়। তাদের আবেদন মানবিক বিবেচনা করে দুর্গপতির সাথে সাক্ষাতের অনুমতি দেয়া হলো। মুসাফিরদল দুর্গপতির কাছে যেতে দেখে সেনাধ্যক্ষ বাহরাম ও তার ডেপুটিও তাদের দেখার জন্য দুর্গপতির দফতরের দিকে রওনা হলেন।

এ লোকগুলোর পোশাক-পরিচ্ছদ তেমন আশ্চর্যকর ছিলো না। আশ্চর্যের বিষয় ছিলো, এই দলের পুরুষরা যেমন ছিলো সুন্দর, তার চেয়েও বেশি সুন্দর ছিলো তরুণীরা। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিলো পুরুষদের মধ্যে সাদা দাড়িওয়ালা লোকটির গলায় একটি সাপ পেঁচানো ছিলো। সাপটি ফণা তুলে কখনো লোকটির মাথার উপর, কখনো চেহারায় উঁকি-ঝুঁকি মারছিলো। পুরুষদের সবার কাছেই ছিলো একটি করে সুন্দর লাঠি। প্রত্যেক লাঠির মাথায় ছিলো একটি করে ফণাদার সাপের মূর্তি। তরুণীদের গলায় সুন্দর কারুকার্যময় সুতার তৈরি দড়ি পেঁচানো ছিলো। সেসব দড়িতে ছোট ছোট ঘুঙুর বাঁধা ছিলো। তরুণীদের হাঁটার তালে তালে ছোট ঘুঙুরগুলো এক ধরনের বাজনা সৃষ্টি করছিলা, যেনো কোনো ঝরনার পানি পাথরে আঘাত খেয়ে খেয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে।

দুর্গশাসক কুতুব গোজাক অভিযাত্রীদলকে সসম্মানে বসালেন। কারণ, তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে তার কাছে সম্মানি শ্রেণীর লোক মনে হচ্ছিলো।

.

“আমরা আপনার কাছে আসবার সাহস করতাম না; কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি, আপনি একটি ভ্রান্ত ধর্মের বিরোধী। বাতিল নির্মূলে আপনাদের প্রয়াসের জন্য আমরা আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনি নিশ্চয়ই অনেক বড় মাপের ও অভিজাত বংশের লোক।” বললো সাদা দাড়িওয়ালা সন্ন্যাসী।

“আপনাদের ধর্ম কী?” সেনাধ্যক্ষ বাহরাম জিজ্ঞেস করলেন।

“আমরা সাপের পূজারী।” বললো সাদা দাড়িওয়ালা। “অবশ্য সাপের পূজা করলেও আমরা এক আল্লাহতে বিশ্বাস করি। আমার পূর্বপুরুষ ছিলেন সেই সব লোক, যারা বাদশাহ সিকান্দরের সাথে মহাভারতে এসেছিলেন। তাদের সম্পর্কে এই জনশ্রুতি আছে যে, তারা একটি বিশাল নাগকে খোঁজ করতেন, যে নাগের দেখা তারা ভারতের বাইরে কোথাও পাননি। কিন্তু হিন্দুস্তানে এসে তারা কাঙ্ক্ষিত নাগের দেখা পান। ফলে তারা সেকান্দরের সেনাবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং শীর্ষ নাগের পেছনে দৌড়াতে থাকেন। বলা হয়ে থাকে, প্রভু তাদেরকে মুকুটধারী সেই নাগ দিয়েছিলেন। সেই নাগের রঙ ছিলো লাল-সসানালী। তার মাথায় ছিলো টুপির মতো ফুল এবং একটি কালো নাগের উপরে সেই নাগটি আরোহণ করেছিলো।… মুকুটধারী নাগ দৌড়ে পালাতে থাকলে আমাদের পূর্বপুরুষদের কয়েকজন নাগের পিছু ছুটতে থাকলো। এক পর্যায়ে নাগ এমন দুর্গম এলাকায় চলে গেলো, যেখানে কোনো মানুষের পক্ষে পৌঁছা সম্ভব ছিলো না। গঙ্গা নদীর একটি শাখা নদী প্রবাহিত হচ্ছিলো এই এলাকা দিয়ে। নদীর উপরে একটি প্রাকৃতিক পুল ছিলো। বস্তুত সেটি ছিলো নদী প্রস্তের সমান বড় একটি পাথর। কিন্তু পাথরটি ছিলো খুব সরু এবং ধারালো। সেই পাথরের নিচ দিয়ে প্রবাহিত পাহাড়ি নদীটি ছিলো খুবই স্রোতস্বিনী এবং গভীর। নাগ সেই পুলের উপর দিয়ে চলে গেলো। চার অনুসরণকারীও তার পিছু নিলো। তন্মধ্যে দু’জন পা পিচলে পড়ে গেলে তারা খরস্রোতা নদীর স্রোতে ভেসে গেলো আর দু’জন তীরে পৌঁছতে সক্ষম হলো। নদীর এপারটি ছিলো নাগদের বসতি। খুবই সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর এলাকা। আমাদের দুই পূর্বপুরুষ সেখানেই পরবর্তীতে বসতি স্থাপন করেন। সেখান থেকেই এসেছি আমরা। সাপদের সাথেই আমাদের বসবাস। সাপই আমাদের ধ্যান-জ্ঞান।”

“সাপকে কি আপনারা উপাস্য মনে করেন?” জিজ্ঞেস করলেন প্রশাসক।

“না, আমরা প্রভুকেই প্রভু মানি। কিন্তু সাপকে আমরা এ জন্য পূজা করি যে, এই সাপ আমাদের ও প্রভুর মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করে। সাপ যেমন শয়তানি করতে পারে, দ্রুপ ফেরেশতার কাজও করতে পারে। লোহা ও পাথরকে সাপ স্বর্ণে পরিণত করতে পারে। কোনো সাপের যদি একশ’ বছর বয়স হয়ে যায় তাহলে তার শরীরে এমন একটি টুকরো তৈরি হয়, যা হীরার মতো চমকাতে থাকে। কেউ সেটিকে বলে মনসা, কেউ বলে মণি। সাপ সেটিকে সবসময় মুখের ভেতর রাখে। অনেক সময় নাগ সাপ সেই মনসা কিংবা মণিকে নিয়ে খেলা করে, বাতাসে উড়িয়ে দেয় আবার ঝাঁপ দিয়ে ধরে ফেলে। সেই মণিকে যদি আপনি লোহার টুকরোয় স্পর্শ করেন, তাহলে লোহাও সোনা হয়ে যাবে। সেটি যদি আপনার তরবারীতে স্পর্শ করা যায়, তাহলে তরবারীও সোনায় পরিণত হবে। কিন্তু কোনো মানুষ আজো সেই সর্পমণি অর্জন করতে পারেনি। মণি মুখে নিয়ে সাপ রাতে ঘুমোত পারে না। সাপ মণিটি মুখ থেকে বের করে মাটিতে রেখে ঢেকে দিয়ে তারপর ঘুমোয়। শত বছরে এ ধরনের মণিওয়ালা সাপ দু’একটি জন্মে। কিন্তু শোনা গেলেও এ পর্যন্ত কেউ মণিওয়ালা সাপের দেখা পায়নি। সেই সাথে সাপের মণিও কেউ অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। হিন্দুস্তানে একথা প্রচলিত আছে যে, যে সেই সাপের মণি অর্জন করতে পারবে, সে সারা হিন্দুস্তানের রাজত্ব লাভ করবে। শীর্ষ নাগও তার আনুগত্য স্বীকার করবে। তখন তার রাজমহল, তার রাজদুর্গ সব সাপে পাহারা দেবে। তখন সে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় শাসক হিসেবে অভিহিত হবে।”

“আপনি কিংবা আপনার পূর্বপুরুষদের কেউ কি সেই নাগের সর্পমণি দেখেছেন?” জিজ্ঞেস করলো সেনাধ্যক্ষ বাহরাম।

“না, দেখিনি। আমাদের এলাকায় মণিওয়ালা সাপ আছে; সে কিন্তু যেখানে থাকে সেখানে আমাদের কারো যাওয়ার অনুমতি নেই। কেউ সেখানে যাওয়ার দুঃসাহস করে না। সাপ কোথায় থাকে, সেই জায়গাটি আমরা চিনি; কিন্তু সেখানে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদেরকে বলা হয়েছে, ওখানে বিক্ষিপ্তভাবে স্বর্ণ পড়ে রয়েছে। হীরা, মোতি, পান্নার স্তূপ সেখানে। আমাদের পুরোহিত বলেছেন, ওখানকার মেয়েদেরকে দেখে কেউ বিশ্বাসই করবে না এরা মর্তের কোনো মানুষ। সেইসব সুন্দরী রমণীদের কথা জগতের অনেকেই জানে; কিন্তু তারা বিশ্বাস করে ওখানকার রমণীরা নাগিনী, মানুষ নয়। আসলে সে কথা ঠিক নয়। আসলে এরা আমাদেরই বংশজাত। কিন্তু এরা অত্যধিক সুন্দরী হলেও খুবই দুর্ভাগা। জীবনের একটা সময় পর্যন্ত তারা খুবই উচ্ছল থাকে বটে; কিন্তু এক পর্যায়ে নির্জীব হয়ে যায়। কারণ, তারা জীবনে কখনো পুরুষের সান্নিধ্য পায় না।”

সাদা দাড়িওয়ালা লোকটি এমনই জাদুময় ভঙ্গিতে স্বপ্নপুরী নাগের কথা বলছিলো যে, দুর্গপতি কুতুব গোজাক, সেনাধ্যক্ষ বাহরাম ও তার ডেপুটি রুদ্ধশ্বাসে তা শুনতে লাগলো এবং বিস্ময়ে তাদের গায়ের পশম খাড়া হয়ে গেলো। তাদের সামনেই উপবিষ্ট ছিলো চার তরুণী। তাদের ঠোঁটে ছিলো স্মিত হাসির আভা। গজনীর এই শাসকরা তরুণীদের রূপ-সৌন্দর্য দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো। তারা ভেবেই পাচ্ছিলো না, এদের চেয়েও আরো সুন্দরী কোনো মানুষ হতে পারে! তারা মেহমানদের খুবই খাতির-যত্ন করলো এবং তাদের জন্য রাজকীয় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করলো।

এক পর্যায়ে সবাই ঘুমোনোর জন্য চলে গেলো। কিন্তু সাদা দাড়িওয়ালাকে দুর্গশাসক কুতুব গোজাক তার কাছে বসিয়ে রাখলো। সে বৃদ্ধ থেকে সেই নাগের রাজ্যের গোপন রহস্য জানতে চেষ্টা করতে লাগলো। সাদা দাড়িওয়ালা কুতুব গোজাককে বললো, “সারা হিন্দুস্তানের রাজত্বের ভেদ লুকিয়ে রয়েছে নাগের দেশে। যেখানে অপরিচিত কারো পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয় এবং কেউ যাওয়ার দুঃসাহসও দেখাতে পারে না।”

“আচ্ছা, কারো পক্ষে কি সেখানে পৌঁছা সম্ভব নয়?” খুব মনোযোগ দিয়ে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলো কুতুব। “আমার ধন-দৌলতের কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি দেখতেই পাচ্ছেন, আমি বুড়ো হয়ে গেছি। আমি শুনেছি, হিন্দুস্তানের পাহাড়ী অঞ্চলে এমন গাছ-গাছড়া রয়েছে, যা সেবন করলে…।”

“হ্যাঁ, যা বার্ধক্যকে প্রতিরোধ করে…।” কুতুব গোজাকের অসমাপ্ত কথা বলে দিলো সন্নাসীরূপী সাদা দাড়িওয়ালা। “আমাকে দেখুন, আমার দাড়ি সাদা হয়ে গেছে, বয়সও একশ’ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আমার শরীরে হাত দিয়ে দেখুন, এখনো কেমন শক্তি-সামর্থ রয়েছে। আপনি ঠিকই শুনেছেন। আমাদের এলাকায় এমন গাছ-গাছড়া রয়েছে, যেগুলোতে সাপের বিষ মিশ্রিত রয়েছে, যেগুলো বার্ধক্যকে প্রতিরোধ করে। সেইসব গাছ আমরা চিনি। সেগুলোতে এমন সব গুণ রয়েছে, যে শুধু বার্ধক্যকেই রোধ করে না, জীবনকেও দীর্ঘস্থায়ী করে।”

কুতুব গোজাক ভাবছিলো, এ লোকের কাছ থেকে সে একাই রহস্য উদঘাটন করছে। কিন্তু এদিকে যুবক সামর্থবান সেনাধ্যক্ষ বাহরাম সেই দলের একজন পুরুষ ও একজন তরুণীকে তার কক্ষে নিয়ে জানতে চাচ্ছিলো, তারা কি তাদের সেই বিস্ময়কর এলাকায় তাকে নিয়ে যেতে পারে? কিন্তু দলের পুরুষ লোকটি তাকে বলছিলো, তারা তাদের দলের সাথে এবং এলাকার গোপন রহস্য ফাঁস করে দেয়ার মতো গাদ্দারী করতে পারে না। পুরুষ লোকটি কথা বলতে বলতে একটা অজুহাত খাড়া করে সেনাধ্যক্ষের কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলো। তরুণী একাকী সেনাপতির কক্ষে রয়ে গেলো। তরুণী মনোহরী ভঙ্গিতে হাসছিলো। সেনাপতি তার সাথেও আলাপ জুড়ে দিলো। তরুণী সেনাপতিকে বললো, “জীবনে আপনার মতো এমন সুদর্শন সুপুরুষ আমি কখনো দেখিনি।”

“তুমি তো বেহেশতে থাকো।” তরুণীকে বললো সেনাপতি বাহরাম।

“সেটি জান্নাত নয়, জাহান্নাম। সেখানে নারীর আবেগের কোনো মূল্য নেই। যৌবনকে যেখানে গলা টিপে হত্যা করতে হয়, তা জাহান্নাম বৈ আর কি। আমাদের জীবন তো ওইসব সন্ন্যাসীদের সাথেই কাটাতে হয়, যাদের কোনো প্রাণ-মন বলতে কিছু নেই। আমাদের তো নারীত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।” তরুণী বললো।

তাদের কথাবার্তা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে শেষ হলো, যেখানে দুটি ভিন্ন সত্তা থাকলেও মনোদৈহিক দিক থেকে একাত্ম হয়ে যায়। তরুণী যখন সেনাপতির প্রতি আবেগপূর্ণ প্রেম-ভালোবাসা প্রদর্শন করলো, তখন সেনাপতি বাহরাম তাকে বললো, “আচ্ছা বলো তো, সাপের মণির কাহিনী কতটুকু সত্য?” তরুণী তাকে বললো, “আমার পক্ষে আপনাকে সঙ্গ দিয়ে ওখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়; কিন্তু আমি আপনাকে পথের অবস্থা বলে দিতে পারি।” বস্তুত তরুণী সেনাপতিকে পথের দিক-নির্দেশনা দিচ্ছিলো আর সেনাপতি বাহরাম খান একটি কাগজে সাপের দেশের নকশা এঁকে নিচ্ছিলো।

“আপনার কাছে বিপুল পরিমাণ তীর থাকতে হবে। কারণ, এই পথে সাপের খুব উৎপাত। বিপদ দেখলেই যাতে তীর দিয়ে আপনি সাপ মেরে ফেলতে পারেন। আমি আপনাকে যে সুড়ং পথের কথা বলছি, সেটির উপরে একটি বিশাল অজগর কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে থাকে। সেটির মাথায় তীর ঐ লাগলেই মরে যাবে। কিন্তু শরীরে তীর লাগলে আপনার পক্ষে প্রাণ নিয়ে বেঁচে ৪ আসা মুশকিল হবে। সুড়ং পথটি খুবই দীর্ঘ। আপনি সেটি অতিক্রম করলে # একটি সুন্দর ঝর্না দেখতে পাবেন। সেই ঝর্নার তীরেই আপনি ওই সাপের দেখা পাবেন। সেখানে সর্পরাজ মণি নিয়ে খেলা করতে থাকে। সেটি আপনি তীর দিয়ে মেরে ফেললেই মণি আপনার হাতের মুঠোয় এসে যাবে।”

“তখন তোমাকে আমি কোথায় পাবো?”

“আমাকে পেয়ে যাবেন।” চোখে চোখ রেখে ভুবনমোহিনী হাসি দিয়ে বললো তরুণী।

পরদিন প্রত্যূষেই নাগেশ্বরের কাহিনী রচনাকারী সন্ন্যাসীদল থানেশ্বর দুর্গ থেকে চলে গেলো। তারা রেখে গেলো নাগরাজ্যের বিস্ময়কর আখ্যান।

সকালে কুতুব গোজাক তার একান্ত নিরাপত্তারক্ষীদের থেকে দু’জনকে ডেকে পাঠালেন। এই দু’জন ছিলো তার দৃষ্টিতে সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং দুঃসাহসী বীরযোদ্ধা। তাদের ডেকে তিনি বললেন, “শোনো! শাসক হিসেবে আমি তোমাদের ডেকে পাঠাইনি, একান্ত বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে তোমাদের ডেকেছি আমি। তোমরা যদি আমাকে একটি কাজ করে দিতে পারো, তাহলে তোমাদেরকে আমি পদোন্নতি দিয়ে গজনী পাঠিয়ে দেবো। আর তোমরা যদি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিতে চাও, তাহলে অবসর দিয়ে দেবো। তবে তোমাদেরকে এখান থেকে বিদায় করার সময় এমন সোনাদানা-কড়ি দিয়ে দেবো যে, তোমাদের সাত পুরুষ সুখে-শান্তিতে আরাম-আয়েশে জীবন কাটাতে পারবে। তবে শর্ত হলো, তোমাদেরকে আমি এমন এক জায়গায় পাঠাচ্ছি, যেখানকার রহস্যের কথা পৃথিবীর কাউকে জানাতে পারবে না। আমি তোমাদেরকে বিশেষ এক পোশাকে একটি বিশেষ জায়গায় পাঠাবো।”

উভয়েই প্রতিশ্রুতি দিলো, তারা তাদের মিশনের খবর কাউকে জানাবে । কুতুব গোজাক তাদের সামনে একটি চিত্র রেখে তাদের গতিপথ বোঝাতে লাগলো। সৈন্য দু’জন যতোই রাস্তার ভয়াবহতার কথা শুনতে লাগলো, বিস্ময় ও আশ্চর্যে তাদের চেহারা ফ্যাকাশে হতে লাগলো।

“গত রাতে সাদা চাদর পরিহিত সন্ন্যাসীরূপী একদল মুসাফিরকে আমার দফতরে হয়তো আসতে দেখেছো। ওই পথ দিয়ে পাহাড়ী নদী অতিক্রম করলেই সেই দলের সাদা দাড়িওয়ালা লোকটির দেখা পাবে তোমরা। তাকে পেয়ে গেলে তোমাদের কাজ সহজ হয়ে যাবে। সে তোমাদেরকে একটি গাছের শিকড় এবং প্রচুর সোনাদানা দেবে। সেগুলো নিয়ে তোমরা সোজা আমার কাছে চলে আসবে। গাছের শিকড়টা আমাকে দিয়ে দিবে আর সোনাদানা তোমরা নিয়ে নিবে।”

“সেই গাছের শিকড়টি কেমন?” জানতে চাইলো এক সৈনিক।

“সেটি এমন এক গাছের শিকড়, তা খেতে পারলে তুমি শত বছরেরও বেশি বাঁচতে পারবে এবং মৃত্যু পর্যন্ত শরীর থাকবে শক্ত-সামর্থ, টগবগে যুবকের মতো।”

সৈনিক দু’জন এ কথা শুনে পরস্পর চোখাচোখি করলো। ভাবখানা এমন যে, সোনাদানার চেয়ে এই শিকড়ের প্রতিই তাদের বেশি আগ্রহ।

“আমার নিজেরই যাওয়ার কথা ছিলো। সেই সন্ন্যাসী আমাকেই যেতে বলেছিলো। কিন্তু তোমরা তো জানো, দুর্গশাসকের পক্ষে এতো দীর্ঘ সময় দুর্গের বাইরে থাকা উচিত নয়। কিন্তু আমার এই ক্ষমতা আছে, তোমাদের দু’জনকে যতো সময়ের জন্য ইচ্ছা বাইরে পাঠাতে পারি।”

গত রাতে সেনাপতির কক্ষে তরুণী যখন নাগের দেশে যাওয়ার পথের কথা বলছিলো, তখন সাদা দাড়িওয়ালা সন্ন্যাসীরূপী লোকটি দুর্গশাসককে পথনির্দেশ দিচ্ছিলো এবং তাকে সশরীরে যাওয়ার প্রস্তাব করছিলো। সাদা দাড়িওয়ালা কুতুব গোজাককে এ কথাও বলেছিলো, আপনি আমাকে যে ইজ্জত ও সম্মান করেছেন, এর পরিবর্তে আপনাকেও চির যুবক থাকার ওষুধ ও সোনাদানা উপঢৌকন দেবো।

* * *

সৰ্পনাগের পূজারীরা চলে যাওয়ার পর সেনাপতি বাহরাম তার ডেপুটিকে বললো, “তুমি যদি না যাও, তবে আমি নিজেই যাবো। আমরা দু’জনের মধ্যে যে কোনো একজন বাইরে থাকলেও এ কথা বলা যাবে যে, বাইরে সেনাচৌকিগুলো দেখার জন্য গেছে। মেয়েটি আমাকে পথ বলে দিয়েছে। তুমি ভাবতে পারো, আমরা যদি সেখানে যেতে পারি, তাহলে আমাদের অবস্থান কোথা থেকে কোথায় চলে যাবে। এ কাজে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা দরকার। হয় তুমি যাও, নয়তো আমি যাবো। চার-পাঁচজন চৌকস সৈন্য সাথে নিতে হবে।”

“মাননীয় সেনাপতি! আপনি কি দৃঢ় বিশ্বাস করে ফেলেছেন যে, ওই লোকটি যা বলেছে তা সর্বৈব সত্য?” সন্দেহ প্রকাশ করলো ডেপুটি সেনাপতি। “আপনি কি ভেবেছেন, মেয়েটি এমন কঠিন রহস্যের কথা কেননা আপনার কাছে প্রকাশ করে দেবে?”

“হ্যাঁ, ভেবেছি। ভেদ বলে দেয়ার কারণ হলো, আমাকে দেখে তার এতোটাই ভালো লেগেছে যে, নিজের উপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই। সে আমাকে পাওয়ার জন্য আত্মভোলা হয়ে গেছে। সে একান্তভাবে চায় আমি তাদের রহস্য ভেদ করে সোনাদানা কজা করে নিই এবং তাকে নিয়ে ঘর-সংসার করি।”

“কিন্তু আমার সন্দেহ হয় লোকগুলো তাদের তরুণী মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য রাত কাটানোর জন্য এসব উদ্ভট গল্প ফেঁদেছিলো।” বললো ডেপুটি সেনাপতি। “এরা আপনাদের ধোঁকা দিয়ে নির্বিবাদে রাত কাটিয়ে চলে গেছে।”

“তুমি আমায় সঙ্গ দেবে কিনা তাই বলো?” বললো সেনাপতি। “তোমাকে আমি অধীনস্ত মনে করে নয়, বন্ধু মনে করে আমার একান্ত বিষয়ে তোমাকে অংশীদার করেছিলাম। ওখান থেকে আমি যদি কিছু নিয়ে আসতে পারি, তাতে তোমারও অর্ধেক থাকবে। আচ্ছা বলো তো, ঘরবাড়ি আপনজন থেকে দূরদেশে হত্যা আর খুনাখুনিতেই জীবনটা শেষ করে দেয়াই কি আমাদের বিধিলিপি? এসব হচ্ছে রাজা-মহারাজা ও সুলতানদের ঝগড়া। যুদ্ধ করে যেসব ধন-রত্ন পাওয়া যায়, তাতে তাদের আরাম-আয়েশ বাড়ে। তারা যুদ্ধে আমাদের জীবন বিপন্ন করে আমাদের রক্তের বিনিময়ে রাজা-বাদশাহ হচ্ছে। মৃত্যু-বিভীষিকা থেকে নিজের জীবনটাকে উদ্ধার করে কিছুটা আরাম-আয়েশ করার অধিকার কি আমাদের থাকতে পারে না?”

সেনাপতি বাহরাম যখন তরুণীদের রূপ-সৌন্দর্যের কথা শুরু করলো, তখন ডেপুটি সেনাপতিরও চোখ চমকে উঠলো। সেনাপতি ডেপুটিকে বললো, “তুমি চিন্তা করো না। তুমি না গেলে আমিই যাবো। আমি হয়তো আমার জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছি। আমার অনুপস্থিতিতে তোমার প্রধান কাজ হবে আমার অনুপস্থিতির কারণ গোপন রাখা। তুমি আমার অনুপস্থিতির ব্যাপারে বলবে, দূরে অবস্থিত আমাদের বিভিন্ন সেনাচৌকিগুলো পরিদর্শন করে সেগুলোকে আরো কার্যকর করার জন্য আমি পরিদর্শনে বেরিয়েছি। প্রশাসক আমার এ কাজে কোনো বাধা দেবে না। তোমার দ্বিতীয় কাজ হবে, দৃশ্যত আমাদের উপর আক্রমণ হওয়ার আশংকা নেই, তবুও নিশ্চিন্তে থাকা উচিত নয়। কারণ, আমরা শক্ৰবেষ্টিত অবস্থায় রয়েছি। শক্র থেকে কখনো নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। যদি কোন কারণে শত্রুরা দুর্গ আক্রমণ করে, তাহলে দুর্গ রক্ষার জন্য তুমি জীবন বাজি রাখবে। তাহলে সৈন্যরা আর আমার অনুপস্থিতির ঘাটতি অনুভব করবে না।”

ডেপুটি সেনাপতি সেনাপতি বাহরামের প্ররোচনায় সায় দিয়ে দিলো। সে এই গোপন রহস্য গোপন রাখার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলো। তার সামনে এখন সমস্যা হয়ে দেখা দিলো সেনাপতির ক’জন সহচর নির্বাচন। কারণ, সোনা-রুপার লোভে যে কোনো সিপাহী এ অভিযানে যেতে এবং বিষয়টি গোপন রাখতে রাজি হবে; কিন্তু বিপুল ধন-রত্ন হাতিয়ে নিতে এরাই আবার স্বয়ং সেনাপতিকেই হত্যা করে বসতে পারে। এমনও হতে পারে, তারা নিজেরাও খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়বে। নানা কারণে সেনাপতির জন্য চারজন সফরসঙ্গী নির্বাচনে ডেপুটিকে খুবই চিন্তায় ফেলে দিলো। অনেক ভেবে-চিন্তে তার বিশেষ ঝটিকা বাহিনী থেকে চার সিপাহীকে নির্বাচন করলো ডেপুটি সেনাপতি।

তারা মনে করেছিলো, তারা দুজন ছাড়া এই গোপন রহস্যের ব্যাপারটি আর কেউ জানে না এবং সেই সর্পরাজ্যে যাওয়ার পথও জানা নেই আর কারো। এদিকে সাদা দাড়িওয়ালা ব্যক্তি দুর্গশাসককেও সর্পরাজ্যে যাওয়ার পথের কথা বলে গিয়েছিলো। হৃতযৌবন ফিরে পাওয়ার ওষুধের জন্য দুর্গশাসক দু’জন বিশ্বস্ত সেনাকে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। তার কাছেও বিষয়টি গোপন রাখাই ছিলো প্রধান সমস্যা। সেও এই আত্মপ্রবঞ্চনায় মুগ্ধ ছিলো যে, সে ছাড়া আর কেউ এই গোপন রহস্যের কথা জানে না ।

সাদা দাড়িওয়ালা সন্ন্যাসী তার দলবল নিয়ে অতি প্রত্যূষে দুর্গ ত্যাগ করে চলে যায়। তরুণীদের বহনের জন্য হাওদাওয়ালা উট ছিলো। আর কাফেলার পুরুষরা সফর করছিলো ঘোড়াগাড়ীতে। সন্ন্যাসীদের কাফেলা যখন শহর অতিক্রম করছিলো, তখন তাদের দেখার জন্য পথে পথে বহু লোক জমায়েত হতে শুরু করছিলো। এক পর্যায়ে দর্শনার্থীদের ভিড় ঠেলে থানেশ্বর শহর পেরিয়ে গেলো সন্ন্যাসীদল। শহর ছেড়ে সন্ন্যাসীদের দলনেতা গাড়িচালকদের বললো, ফেরার পথেও মুসলমানদের সেনাচৌকির দিকে নজর রেখো। কোনো চৌকির ধারে-কাছে যেয়ো না। তুমি তো জানো, ওদের চৌকি কোন্ কোন্ জায়গায় রয়েছে।

দুপুরের দিকে সন্ন্যাসী কাফেলা একটি জঙ্গলময় বিরান ভূমিতে পৌঁছলো। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত সেখানে কোনো লোকালয় ছিলো না। তাছাড়া এলাকাটি ছিলো খুবই দুর্গম। মাঝে-মধ্যে টিলা, ঝোঁপঝাড় আর উঁচু-নিচু। একটি সুবিধা মতো জায়গা দেখে সন্ন্যাসীদের দলনেতা যাত্রা বিরতি দিয়ে বিশ্রামের জন্য থেমে গেলো। তরুণীরা উটের উপরের হাওদা থেকে নেমে এলো। ঘোড়াগুলোর বাঁধন খুলে দেয়া হলো। মাটির উপর মাদুর পেতে সবাই বসলো। কাফেলার সবাই ছিলো খুবই খুশি। তরুণীরা তো উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছিলো । দলের অন্যরা তরুণীদের উস-আনন্দ দেখে হাসছিলো।

“আচ্ছা, আমরা যে শিকার বধ করতে পেরেছি, তা কীভাবে বোঝা যাবে?” দলপতির কাছে জানতে চাইলো এক তরুণী।

“থানেশ্বরে আমাদের লোকজন আছে। দুর্গের ভেতরেও আছে আমাদের গোয়েন্দা।” বললো দলনেতা সাদা দাড়িওয়ালা সন্ন্যাসী। “দুর্গশাসক ও সেনাপতি যদি আমাদের বাতানো পথে অগ্রসর হয়, তাহলে আমাদের লোকেরা তাদের অনুসরণ করবে। তারা যদি নিশ্চিত হয় যে, এরা আমাদের বলা পথেই অগ্রসর হচ্ছে, তাহলে কোন্ কোন্ জায়গায় খবর পৌঁছাতে হবে, সে ব্যাপারে তারা জানে।”

“যে সেনাপতির কাছে আমাকে পাঠানো হয়েছিলো, সে তো আমার কথা শুনে অভিভূত হয়ে পড়েছিলো।” বললো এক তরুণী।

“ওরা কী করবে সে নিয়ে তোমাদের দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। ওরা যা-ই করুক, সেটি হবে আমাদের জন্য সহায়ক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, থানেশ্বর মন্দির অচিরেই আমাদের হাতে ফেরত আসবে।”

হঠাৎ করে কাফেলার একজন উর্ণ হয়ে বললো, “মনে হয় আমার কানে ঘোড়া দৌড়ের আওয়াজ ভেসে আসছে।”

“এখানে কে আসবে; আমাদের ঘোড়াগুলোরই আওয়াজ হবে হয়তো।” সান্ত্বনা দিলো একজন।

এ ব্যাপারে আর কেউ মনোযোগ দিলো না। অথচ তা তাদের ঘোড়ার আওয়াজ ছিলো না। সন্ন্যাসী কাফেলাটি থানেশ্বর পেরিয়ে বিজন ময়দানে প্রবেশ করলে একটি ঝোঁপের আড়াল থেকে তাদের পর্যবেক্ষণ করছিলো এক বালক। তখন উটের হাওদাগুলোর পর্দা উঠানো ছিলো। ফলে ভেতরে বসা তরুণীদের স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলো বালকটি। বালক ঘোড়াগাড়ীতে আরোহীদেরও গভীর দৃষ্টিতে দেখে বুঝতে পারলো এই অভিযাত্রী দল অত্যন্ত দামী। সে বিপরীত দিকে দৌড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলো।

দশ-বারোজনের একটি অপেক্ষমান কাফেলার কাছে গিয়ে থামলো বালকটি। কাফেলার লোকেরা তখন মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি দিয়ে আরাম করছিলো। অদূরেই তাদের ঘোড়াগুলো বাধা ছিলো। বালকটি গিয়ে তার দেখা কাফেলার কথা বললো এবং জানালো কাফেলাটি কোন্‌দিকে যাচ্ছে। তাদের মধ্য থেকে এক যুবক বালকটিকে সাথে নিয়ে কাফেলার অবস্থা জানার জন্য অগ্রসর হলো। তারা পাহাড়ী টিলা ও ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে আড়ালে এগিয়ে কাফেলা দেখে বালকের পিঠ চাপড়িয়ে ফিরে এলো। সে এসে অন্যদের বললো, “শিকার খুবই মূল্যবান। তাদের কেউ কেউ বললো, “কাফেলা কোনদিকে যায়, তা দেখে ওদের পিছু পিছু অগ্রসর হও। রাতের বেলায় ওদের উপর হামলা করো।” আরেকজন বললো, “রাত-দিন বাদ দাও। আমাদের জন্য সবই সমান। শুধু খেয়াল রাখো, আশপাশে যেনো কোনো সেনাচৌকি না থাকে। কোনো সেনাচৌকিতে আওয়াজ চলে গেলে সৈন্যরা এসে আমাদের সবাইকে হত্যা করবে; কারো পালানোর সুযোগ থাকবে না।”

“হতভাগা মুসলমান সৈন্যরা তো আমাদের জীবন বিপন্ন করে ফেলেছে।” দলনেতা বললো। “এ জন্য আমরা হিন্দু রাজা-মহারাজাদের শাসনই বেশি পছন্দ করি। তারা রাজধানীর বাইরের লোকদের কোনো পরোয়াই করে না। অথচ গজনীর লোকেরা তো জঙ্গলেও শাসন জারি করেছে। আগে জঙ্গল ছিলো সম্পূর্ণ আমাদের নিয়ন্ত্রণে। যাক, চলো এখনই কাফেলাকে লুটে নিই। আশপাশে কোনো সেনাচৌকি নেই।”

আসলেও তাদের ধারে-কাছে কোনো সেনাচৌকি ছিলো না। কিন্তু গজনী বাহিনীর সাত-আটজন সৈনিক দূরবর্তী একটি চৌকি থেকে থানেশ্বর ফিরে যাচ্ছিলো। তারা ছিলো অশ্বারোহী। খুব নিশ্চিন্তে গল্প-স্বল্প করে তারা ধীর-স্থিরভাবে পথ অতিক্রম করছিলো।

সৰ্পপূজারী সন্ন্যাসীদের কাফেলা একটি জায়গায় যাত্রা বিরতি করে আহারাদি সেরে শুয়ে-বসে বিশ্রাম করছিলো। পথে দস্যুদের একটি ঘোড়া হ্রেষাব করছিলো বটে; কিন্তু তাদের কেউ সেদিকে খেয়াল করেনি। দস্যুরা তাদের ঘোড়াগুলোকে কাফেলার অবস্থান থেকে কিছুটা দূরে বেঁধে রেখে হেঁটে কাফেলার দিকে অগ্রসর হলো। অগ্রসর হয়েই দস্যুদল ঘিরে ফেললো কাফেলা।

দস্যুদলের নিক্ষিপ্ত একটি তীর কাফেলার এক লোকের বুকে এসে বিদ্ধ হলো। সবাই আতঙ্কিত হয়ে চতুর্দিকে দেখতে লাগলো। ঠিক সেই মুহূর্তে তাদের কানে ভেসে এলো, “সবাই দাঁড়িয়ে যাও, কোনো চেঁচামেচি করবে না এবং কেউ পালানোর চেষ্টা করবে না।”

কাফেলার লোকজন দেখতে পেলো, ঝোঁপের আড়াল থেকে দশ-বারজন লোক বেরিয়ে এসেছে। ওদের সবার চেহারা ঢাকা। মাথা কালো কাপড়ে আবৃত। শুধু চোখ দুটো খোলা। এরা ডাকাত। দস্যুতাই এদের পেশা। ডাকাত দলকে এগিয়ে আসতে দেখে সন্ন্যাসীরূপী কাফেলার পুরুষরা তাদের ঢিলেটালা পোশাকের আড়াল থেকে খঞ্জরের চেয়ে বড় তরবারীর চেয়ে ছোট এক ধরনের অস্ত্র বের করে মোকাবেলার জন্য তৈরি হয়ে গেলে। ডাকাতদল যাদের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে সন্ন্যাসী মনে করেছিলো, মুহূর্তের মধ্যে তাদের কায়া বদলে গেলো। তারা এখন তরবারী নিয়ে রীতিমতো ডাকাতদলের মোকাবেলায় দাঁড়িয়ে গেলো। সন্ন্যাসীরা দুই তরুণীকে আগলে রেখে মোকাবেলা করছিলো আর ডাকাতদল তাদের বেষ্টনী ভেঙ্গে তরুণীদের কজা করার চেষ্টা করছিলো।

ডাকাতদল ভেবেছিলো, সন্ন্যাসীরূপী এই লোকগুলোকে ধমক দিয়েই কাবু করে ফেলবে। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। তারা মনে করেছিলো, ধমকি দিয়েই সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেবে এবং সুন্দরী তরুণীদের অপহরণ করে নিয়ে যাবে। কিন্তু তাদেরকে কঠোর প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হলো। সন্ন্যাসীরূপী লোকগুলোও নিয়মিত সৈন্যের মতো লড়াইয়ে প্রবৃত্ত হলো। অবশ্য সন্ন্যাসীদের হাতিয়ারগুলো যুৎসই ছিলো না। লম্বা তরবারী দিয়ে ডাকাতরা তাদের কাবু করে ফেললো এবং কয়েকজনকে হত্যা করে ফেললো। তরুণীরাও এমন সাহসিকতার পরিচয় দিলো যে, মৃতদের ছোট্ট তরবারীগুলো হাতে নিয়ে তারাও আত্মরক্ষায় প্রবৃত্ত হলো। এক পর্যায়ে তরুণীরা ডাকাতদের হুমকি দিলো, তোমরা রাজপুত কন্যাদের গায়ে হাত দিতে পারবে না। আমরা মৃত্যুবরণ করব; তবু তোমাদের লালসার শিকার হবে না’। কাফেলার জোরদার আক্রমণে দু’তিন ডাকাতও মারা গেলো।

গজনীর সৈন্যরা ওদের কাছ দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলো। হঠাৎ তাদের কানে ভেসে এলো নারীকণ্ঠের আর্তনাদ। তারা থেমে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলো, কাছেই দশ-বারটি ঘোড়া বাঁধা। তারা পূর্ব থেকেই জানতো হিন্দুস্তানের বিজন এলাকায় ডাকাত ও পথদস্যুদের আখড়া থাকে। রাজা-মহারাজারা এই দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে কখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অথচ সুলতান মাহমূদ বিজিত এলাকার প্রশাসকদের কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন তারা যেনো শহর অঞ্চলের বাইরেও যেসব সেনাচৌকি থাকে, তাদেরকে নির্দেশ দেয় এলাকায় রীতিমতো টহল দিতে, যাতে নিরাপদে মুসাফিরগণ যাতায়াত করতে পারে এবং পথদস্যুদের যেনো সৈন্যরা নির্মূল করতে চেষ্টা করে।

সৈন্যদল তাদের গতিপথ বদল করে তাদের অশ্বগুলোকে তাড়া করলো। মুহূর্তের মধ্যে ঘোড়াগুলোর কাছে পৌঁছে দেখতে পেলো, একদল দুবৃত্ত অদূরে কয়েকজন তরুণীকে তুলে নেয়ার জন্য চেষ্টা করছে। সৈন্যরা ওদের হুমকি দিলো। সৈন্যদের উপস্থিতি দেখে ডাকাতদল তরুণীদের ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু তারা ওদের ঘোড়া পর্যন্ত পৌঁছার আগেই সৈন্যরা তাদের পাকড়াও করে ফেললো।

এরপুর অকুস্থলে এসে দেখলো দু’তরুণী ছাড়া আর বাকি সবাই নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে সাদা দাড়িওয়ালা একজনের দেহে তখনো প্রাণ আছে বলে মনে হলো। সৈন্যরা তার চেহারায় পানির ঝাঁপটা দিয়ে তাকে ঘোড়াগাড়ীতে তুলে নিলো আর তরুণীদের অভয় দিয়ে বললো, তোমাদের আর কোনো ভয় নেই, তোমরা নিশ্চিন্ত হতে পারো। ধৃত ডাকাতদের হাত-পা বেঁধে ওদের ঘোড়ার সাথেই হেঁটে যেতে বাধ্য করলো। তরুণী দু’জনকে একটি ঘোড়াগাড়ীতে সওয়ার হতে অনুরোধ করলো। অতঃপর সবাই রওনা হলো থানেশ্বরের পথে।

গজনীর সৈন্যরা এতোগুলো ঘোড়া, কয়েকজন বন্দি আর শেষ রাতে বিদায় হওয়া সন্ন্যাসী কাফেলার উট ও ঘোড়াগাড়ী নিয়ে থানেশ্বর দুর্গে যখন প্রবেশ করলো, তখন বেলা ডুবে গেছে।

ডাকাতদলের গ্রেফতারি এবং লুণ্ঠিত কাফেলার কথা দুর্গশাসক কুতুব গোজাক ও সেনাপতি বাহরামের কানে পৌঁছামাত্রই তারা উভয়ে দৌড়ে এলেন। তাদেরকে জানানো হলো, এই ডাকাতদল সন্ন্যাসীদের কাফেলা আক্রমণ করে দু’তরুণী ও অন্যান্য সব পুরুষকে হত্যা করেছে। সৈন্যরা জানতো না, এরা শেষ রাতে এ দুর্গ থেকেই রওনা হয়েছিলো।

দুর্গশাসক সাদা দাড়িওয়ালা সন্ন্যাসীর জীবন বাঁচানোর জন্য চিকিৎসকদের সম্ভাব্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। দুর্গশাসক তার হৃতযৌবন ফিরে পাওয়া এবং দীর্ঘ জীবন লাভের জন্য সন্ন্যাসীকে বাঁচানোর প্রতি মনোযোগী হলেন। এদিকে দুই তরুণী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলো। তাদের মুখে কথা বের হচ্ছিলো না। একটি পৃথক কক্ষে তাদের থাকতে দেয়া হলো। তাদের সেবা-যত্নের জন্য দু’জন মহিলাকে নিযুক্ত করা হলো। দুর্গশাসক ও সেনাপতি তাদের সান্ত্বনা দিলো, তোমাদের আর কোনো শংকা নেই; সৈন্যদের দিয়ে তোমাদেরকে নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

সাদা দাড়িওয়ালা সন্ন্যাসী অচেতন ছিলো। রাতভর চিকিসকরা তার চিকিৎসা অব্যাহত রাখলো। দুর্গশাসক নিজে চিকিৎসা তদারকি করলেন। পরদিন দুপুরে সে হুঁশ ফিরে পেলো। চোখ খুলেই সে ক্ষীণকণ্ঠে জানতে চাইলো সে এখন কাথায়? তাকে জানানো হলো, সে এখন থানেশ্বর দুর্গে। দুর্গশাসক নিজে তার চিকিৎসার তদারকি করছেন। তাকে আরো জানানো হলো, তার কাফেলার দু’জন তরুণী অক্ষত অবস্থায় বেঁচে আছে। তাদেরকে সৈন্যরা সযত্নে এনে এখানে রেখেছে। সে তরুণী দু’জনকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাদের ডেকে পাঠানো হলো।

তরুণীদ্বয় এসে তাকে জানালো, গজনী সৈন্যরা তাদেরকে উদ্ধার করে এনেছে এবং আপনাকে জীবিত দেখে সৈন্যরা এখানে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। তারা এ কথাও জানালো যে, দুর্গশাসক ও সেনাপতি নিজে তাদের সার্বিক দেখাশোনা করছেন। এমনকি তাদের সেবা-যত্নের জন্য দু’জন মহিলাকেও নিয়োগ করা হয়েছে।

গজনীর সৈন্যদের এই মহানুভবতার কথা শুনে সন্ন্যাসীর চোখে পানি চলে এলো। সে আবেগপ্রবণ হয়ে তরুণীদের বললো, “আমি আর এই লোকদের ধোঁকা দিবো না। দুর্গশাসকের হয়তো আমার প্রতি যত্নবান হওয়ার ব্যক্তিস্বার্থ থাকতে পারে। কিন্তু থানেশ্বর অভিমুখী গজনী সৈন্যদের তো আমার প্রতি যত্নবান হওয়ায় কোনো স্বার্থ ছিলো না। তোমাদের মতো সুন্দরী তরুণীদের এরা পরম সম্মানে আদর-যত্নে এখানে নিয়ে এসেছে। অথচ তোমরা ছিলে একেবারেই অসহায়। ওরা তোমাদের যা ইচ্ছা, তাই করতে পারতো; কিন্তু বিন্দুমাত্র কদর্যতা তোমাদের স্পর্শ করেনি। বরং তোমাদের এখানে এনে পরম আদর-যত্নে রেখেছে। এরা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। আমি আর এদের ধোকা দিতে পারি না।”

সে দুর্গশাসকের সাথে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করলে দুর্গশাসককে খবর দেয়া হলো। দুর্গশাসক তখনই চলে এলো এবং তরুণীরা তাদের কক্ষে চলে গেলো ।

“আমি আপনার সৈন্যদের এই মহানুভবতার প্রতিদান দিতে চাই।” ক্ষীণকণ্ঠে বললো সন্ন্যাসী।

“আপনি একে অনুগ্রহ মনে করবেন না।” বললো দুর্গশাসক। “আপনি আগে সুস্থ হয়ে নিন। আমি দুজনকে প্রস্তুত করে রেখেছি, যারা আপনাকে নিয়ে যাবে। আপনি জানেন, আমি আপনার কাছে কী প্রত্যাশা করি। আর ওই সৈন্যদের কথা বলছেন, যারা আপনাকে ডাকাতদের হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে। আপনি সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে গেলে ওদের জন্য কিছু সোনাদানা দিয়ে দিলেই চলবে।”

“আসলে আমার কাছে না আছে কোনো সোনাদানা, না আছে কোনো বিস্ময়কর ওষুধী গাছ।” দৃঢ়কণ্ঠে বললো সন্ন্যাসী। “আপনার সেবা ও যত্নের প্রতিদান আমি সোনাদানা আর যৌবন ফিরে পাওয়ার কথিত ওষুধ দিয়ে দিতে চাই না। আমি আপনার ও সৈন্যদের উপকারের প্রতিদান একটি কঠিন সত্য উচ্চারণ করে দিতে চাই। প্রকৃতপক্ষে আমি আপনাকে চির যৌবনপ্রাপ্ত হওয়ার ওষুধী গাছের কথা এবং সর্পমণি ও সোনাদানা এবং নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা যে মনোরম জগতের কথা বলেছিলাম, তা সবই অসত্য ও কাল্পনিক। জগতে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। এ কারণে আপনি ইচ্ছা করলে দেয়ালের উপর থেকে ফেলে দিয়ে আমাকে হত্যা করতে পারেন এবং এই তরুণীদেরকে উপভোগ করেও প্রতিশোধ নিতে পারেন। তারপরও আমি বলবো, প্রকৃত সত্য বলে দিয়ে আমি আপনার বড়ই উপকার করছি। আপনি দুজনকে ওষুধী গাছ আনার জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা ইতিমধ্যে করে ফেলেছেন। যদি এদেরকে কাল্পনিক ঠিকানার সন্ধানে পাঠিয়ে দিতেন, তাহলে তারা জীবনেও সেই অবাস্তব গন্তব্যের খোঁজ পেতো না। বরং ঠিকানাবিহীন পথে ঘুরে ঘুরে জীবন বিপন্ন করতো। আপনার দুই সেনাকর্মকর্তাও আমার এক তরুণীর ধোঁকায় পড়ে সর্পমণি আর সোনাদানা কজা করার নেশায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলো। তারাও হয়তো কথিত সর্পমণি ও সোনাদানার স্বর্গীয় রাজ্যের তালাশে বেরিয়ে পড়তো।”

সন্ন্যাসীর মুখে পূর্ব কথার সম্পূর্ণ বিপরীত কথা শুনে দুর্গশাসকের মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। কয়েকবার তার চেহারার রং বদল হলো। তিনি দাঁতে দাঁত পিষতে শুরু করলেন।

“আপনি বিস্মিত হবেন না।” দুর্গশাসকের উদ্দেশে বললো সন্ন্যাসী। আমি এই পরিস্থিতিতেও আপনাকে ধোকায় রাখতে পারতাম এবং আপনার সেবা-যত্নে আমি নিশ্চিন্তে সুস্থতা লাভ করতে পারতাম। কিন্তু আমি কল্পনাও করতে পারিনি আপনার সেনাবাহিনীর সাধারণ সিপাহীরাও এতো উঁচুমানের সততা ও চরিত্রের অধিকারী। আসলে আপনাদের উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মূল কারণ আপনাদের ধর্মের বস্তুনিষ্ঠতা ও সত্যতা। বাস্তবে আমরা লাহোর থেকে এসেছিলাম। রাজা আনন্দ পালের দ্বিতীয় পুত্র ভীমপাল এখন সিংহাসনে সমাসীন। রাজা ভীমপালের অভিজ্ঞ সেনাপতি তার একটি চক্রান্তের অংশ হিসেবে আমাদের পাঠিয়েছে। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো আপনাকে ও আপনার সেনাপতিকে স্বপ্নিল জগতের লোভ দেখিয়ে এবং প্রচুর সোনাদানা, চিরযৌবন ও রাজত্বের মোহে ফেলে বিভ্রান্ত করা। আপনাকে দুর্গের বাইরে নিয়ে যাওয়া এবং প্রয়োজনে আপনাকে গায়েব করে ফেলার পরিকল্পনাও আমাদের ছিলো।”

“আমরা আপনার কথায় বিভ্রান্ত হয়ে যাবো কিসের ভিত্তিতে আপনি এ বিশ্বাস করলেন।” সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞেস করলো কুতুব গোজাক।

“আপনি তো একজন মানুষ, ফেরেশতা নন। মানুষ যতোই ন্যায়নিষ্ঠ হোক কেননা আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসিতার বাসনা সবার মধ্যে কাজ করে। এই বাসনাকে আপনি দমিয়ে রাখতে পারেন; কিন্তু তা নির্মূল করতে পারবেন না। ধন-সম্পদ ও সুন্দরী নারী ভোগ-বিলাসিতার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপকরণ। আমরা মানুষের মানবিক দুর্বলতাগুলো বুঝি। যে কোনো মানুষের মধ্যে যৌবনকে দীর্ঘদিন ধরে রাখার আকাঙ্ক্ষা থাকে। আপনার দৈহিক গড়ন ও বার্ধক্যের টান দেখে আমি আপনার পড়ন্ত যৌবনকে উস্কে দেয়ার কথা বলে আপনাকে আমার প্রতি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আপনি আমার কথায় আকৃষ্ট হয়ে বলেছিলেন, সোনাদানার চেয়ে আপনার কাছে যৌবন ফিরে পাওয়ার ওষুধী গাছটিই বেশি কাঙ্খিত।”

সন্ন্যাসীরূপী লোকের কথায় কুতুব গোজাকের চেহারায় লজ্জার আভাস ভেসে উঠলো।

“আপনি পেরেশান হবেন না।” বললো সন্ন্যাসী। “আপনার জায়গায় অন্য কোনো ব্যক্তি হলেও আমাদের ফাঁদে পা দিতো। আমি তরুণীদেরকে নিয়ে এসেছিলাম আপনার মধ্যে যৌবনের ভাটার টান অনুভূত করানো জন্য। দুনিয়াটাকে আমি খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। বহু মানুষকে আমি ঘেঁটেছি। আমি মানুষের স্বভাবজাত প্রবণতা নিয়ে গভীর নিরীক্ষা করেছি। দীর্ঘ অভিজ্ঞতাকে আমি আপনার মধ্যে প্রয়োগ করেছি। মনের বাসনা পূরণের জন্য এবং জীবন ও জগতকে উপভোগ করার লোভে মানুষ বিবেককে চাপা দিয়ে আবেগের দাসত্ব করতে শুরু করে। তখন কর্তব্যপরায়ণ মানুষও আপন কর্তব্য ও দায়িত্ব ভুলে যায়। অধঃপতনের দিকে ধাবমান লোকটিও তখন নিজের অধঃগতি অনুধাবন করতে পারে না। তখন অনেকেই বুঝতে পারে না হৃতযৌবন ফিরে আসে না এবং সোনাদানা ধন-সম্পদের দ্বারা এবং দৈহিক ভোগবাদিতার দ্বারা আত্মার প্রকৃত প্রশান্তি পাওয়া যায় না। জাগতিক ধোকা ও প্রবৃত্তির প্ররোচনাকে যারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তারাই হয় সাধু-সন্ন্যাসী বা পীর-বুযুর্গ। যে মানুষের মধ্যে আত্মার নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে যায়, সে শত শক্ত দুর্গেও পরাজয়বরণ করে। শত্রুরা তার পিঠে চড়ে বসে। আপনি আপনার মিশন থেকে বিচ্যুৎ হয়ে গিয়েছিলেন আর আমাদের কর্তব্য ছিলো আমাদের মিশনকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ।… কিন্তু এই পড়ন্ত জীবনে আমি কায়মনোবাক্যে আপনাকে একটি রূঢ় বাস্তব উপদেশ দিতে চাই। যে দুই তরুণী ডাকাতদের হাত থেকে বেঁচে গেছে এদেরকে আপনারা আটকে রাখবেন না। এদেরকে আটকে রাখলে এরা আপনার সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ফেলবে, আপনাদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা জন্ম দেবে। অবশ্যম্ভাবী নৈতিক ও বাহ্যিক উভয় ধরনের পরাজয় থেকে রক্ষা পেতে হলে নিজের প্রবৃত্তিকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।”

সাদা দাড়িওয়ালা সন্ন্যাসীর ক্ষত শুকাতে প্রায় মাসখানিক সময় লেগে গেলো। এই সময়ের মধ্যে সেনাপতি বাহরাম জেনে গেলো সাপ ও মানুষ একই সাথে বসবাস করে পৃথিবীতে এমন কোনো রাজ্য নেই। সেই সাথে দুর্গে নিয়ে আসা তরুণীদ্বয়ও তাকে জানিয়ে দিলো আসলে সর্পরাজ্য সর্পমণি বলতে বাস্তবে কিছুই নেই।

এসব রূঢ় বাস্তবতা প্রকাশ করার পরও কুতুব গোজাক যথারীতি পরম যত্নে সন্ন্যাসীর চিকিৎসা তদারকি অব্যাহত রাখলেন। তরুণী দুজনকে সসম্মানে দুর্গেই রাখা হলো। এক পর্যায়ে তাদের বিদায়ের সময় হলো।

“আপনি শত্রুতার বিষাক্ত মনোভাব নিয়ে এখানে এসেছিলেন আর এখন আপনাকে আমরা বন্ধুর মতোই বিদায় জানাচ্ছি। আমাদের আচার-ব্যবহার যদি আপনার ভালোই লেগে থাকে, তাহলে যাওয়ার সময় অন্তত এতোটুকু বলুন, আসলে আপনাদের রাজা-মহারাজাদের উদ্দেশ্য কী?” সন্ন্যাসীর উদ্দেশে বললেন দুর্গশাসক। “সে কি আমাদের সুলতানের প্রতি আনুগত্য বহাল রাখবে, তার বাবার পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবে?”

“আমরা আপনাদের ঈমান ও কর্তব্য বিনষ্টের জন্য যে কঠিন আক্রমণ পরিচালনা করেছিলাম, এটাই প্রমাণ করে আমাদের নতুন মহারাজা ভীমপাল আপনাদের সুলতানের আনুগত্য করবে না বরং তাকে চ্যালেঞ্জ করবে।” বললো সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসী আরো বললো, “রাজা ভীমপাল নতুন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে করদরাজা থাকবে না। আপনাদের অধীনস্ত দুর্গশাসক ও সেনাপতিদেরকে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করার মিশন হিসেবেই আমরা আপনার কাছে এসেছিলাম। তাকে নিশ্চিত করা হয়েছে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে গজনী বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়বে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, গজনীর সুলতানকে তাড়িয়ে একটি দুর্গম ও কঠিন জায়গায় নিয়ে গিয়ে তার উপর সমৰিত আক্রমণ করা হবে। সেই সাথে তাকে কর দিতে অস্বীকার করবে নতুন রাজা ভীমপাল।”

রাজা ভীমপালের কাছে খবর পৌঁছে গেলো সন্ন্যাসীর বেশে থানেশ্বর দুর্গে যে গোয়েন্দাদেরকে মিশনে পাঠানো হয়েছিলো, তা অকার্যকর হয়ে গেছে। কিন্তু তাকে এ কথা জানানো হয়নি যে, শুধু মিশনই ব্যর্থ হয়নি, বরং তারা যে পরিকল্পনা করেছিলো, তাও ফাঁস হয়ে গেছে। অবশ্য ভীমপাল এসব চক্রান্তে বিশ্বাসীও ছিলো না। নিজের সাহসিকতা ও সামরিক কার্যক্রমের প্রতি ভীমপালের বেশি আস্থা ছিলো। সে পুরো উদ্যমে যুদ্ধপ্রস্তুতি করতে লাগলো এবং কোন্ দুর্গম ও কঠিন জায়গায় সুলতানকে পরাজিত করা যায়, তা জায়গা নির্বাচনের প্রতি বেশি মনোযোগী হলো।

ঝিলম থেকে রাওয়ালপিণ্ডি পর্যন্ত একের পর এক পাহাড় অবস্থিত। বর্তমানে পাহাড়ের ভেতর ও পাদদেশ দিয়ে চলে গেছে মহাসড়ক ও রেলপথ। পূর্বে এসব জায়গার পথ ছিলো গুহার মতো। ঝিলম পাহাড়ী এলাকায় বুগীরটিলা নামে একটি জায়গা ছিলো। সেখানকার অধিবাসীদের জাদু-টোনা ছিলো সারা ভারতবর্ষে বিখ্যাত। সুলতান মাহমুদের সময়ে এই এলাকাটি ছিলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ এবং খুবই দুর্গম। ভীমপাল সুলতান মাহমূদের সাথে মোকাবেলার জন্য ঝিলম ও রাওয়ালপিন্ডির মাঝামাঝি দুর্গম এই স্থানটিকে বেছে নিলো। সে তার সেনাবাহিনী সেই দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় স্থানান্তরের নির্দেশ দিলো। সেই সাথে সেনাপতিদের বললো, তারা যেনো পাহাড়ী এলাকায় যুদ্ধ করার জন্য সেনাদেরকে বিশেষভাবে তৈরি করে। গজনী বাহিনীকে লাহোরে যাওয়ার জন্য এই দুর্গম ও সংকীর্ণ পথ অবলম্বন করতে হতো। এই সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য ভীমপাল জায়গায় জায়গায় ফাঁদ তৈরি করলো এবং পাহাড়ের উপরে তীরন্দাজ ইউনিট নিযুক্ত করলো। তীরন্দাজের উপরই বেশি গুরুত্ব দিলো ভীমপাল। আক্রমণের পর পাহাড়ী এলাকায় গজনী বাহিনী বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলে তাদের পরাস্ত করার জন্য বিশেষ অশ্বারোহী ও হস্তি বাহিনীকেও প্রস্তুত করলো। হস্তি বাহিনীকে অতি সংকীর্ণ পথে আক্রমণ এবং বিস্তৃত ময়দানে মোকাবেলার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দিলো।

একদিন ভীমপালের কাছে খবর এলো, থানেশ্বর দুর্গ শাসকের পক্ষ থেকে এক দূত মহারাজার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছে। ভীমপাল তাদেরকে রাজ দরবারে নিয়ে আসার নির্দেশ দিলো। থানেশ্বর দুর্গশাসকের দূতের সাথে ছিলো ভীমপালের পাঠানো সাদা দাড়িওয়ালা সেই সন্ন্যাসী ও তার সহযোগী দুই তরুণী। থানেশ্বর দুর্গের ডেপুটি সেনাপতি দূত হিসেবে বারজন নিরাপত্তা রক্ষী নিয়ে ভীমপালের রাজদরবারে এসেছিলো।

দূত রাজা ভীমপালের মুখোমুখি হয়ে বললো, “মহারাজ! আমরা আপনার আমানতকে ফেরত দিতে এসেছি। আপনার পাঠানো অন্যান্য সন্ন্যাসী ও তরুণীরা হিন্দু ডাকাতদের আক্রমণে নিহত হয়েছে বিধায় আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। এদেরকেও গুরুতর আহত অবস্থায় আমাদের সৈন্যরা উদ্ধার করে এনেছিলো। আমরা তাদেরকে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করেছি। আমরা তাদেরকে আরো আগেই ফেরত পাঠাতে পারতাম; কিন্তু এই বয়স্ক সন্ন্যাসীর আঘাত ছিলো মারাত্মক; তার সুস্থ হতে সময় লেগেছে। আপনি এই তরুণীদের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারেন, আমরা আপনার আমানতের কোনো খেয়ানত করেছি কিনা। তাদের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারেন, তাদের দলের কোনো সদস্য আমাদের হাতে মৃত্যুবরণ করেছে কিনা।”

সমকালীন ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, ভীমপালের মতো দুঃসাহসী ও অত্যাচারী রাজাও সন্ন্যাসীর ব্যর্থতার কোনো প্রতিশোধ নিতে পারেনি। বরং ব্যর্থ সন্ন্যাসী ও দূতকে সসম্মানেই বিদায় করেছে। এর ফলে ডেপুটি সেনাপতি সাহসিকতার সাথেই রাজদরবারে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি রাজার উদ্দেশে বলেন, “মাননীয় মহারাজ! আপনি আমাদের করদাতা। চুক্তি অনুযায়ী আপনি ও আমাদের মধ্যে কেউ কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি নেবে না। কিন্তু আপনি ইতিমধ্যেই বেশকিছু তৎপরতা চালিয়েছেন, যা চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং এটাও প্রমাণিত হয়েছে, হিন্দু রাজপুতরা সাপের চেয়েও ভয়ংকর।”

রাজা ভীমপাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দূতের দিকে তাকিয়ে বললো, “করদাতা অর্থ এই নয় যে, তোমরা আমাদের রাজদরবারে এসে যাচ্ছে তাই কথা বলবে।”

রাজার মনোভাব দেখে দরবারীদের কেউ কেউ তরবারীর বাঁটে হাত রেখে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে দূতের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। দূতরূপী ডেপুটি সেনাপতি চকিতে একবার রাজদরবারের চতুর্দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মুচকি হাসলেন এবং বললেন, “দুর্ভেদ্য রাজদরবারের ভেতরে নিরস্ত্র এক দূতের বিরুদ্ধে এতোজন লোক রণপ্রস্তুতি নিলেন, ভাবতেও অবাক লাগে। আমাদের সুলতানের দরবারে কোনো নিরস্ত্র দূতের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে যদি কোনো শাহজাদাও তরবারীর বাটে হাত রাখতো, তাহলে সুলতান তার হাত কেটে ফেলতেন। তরবারীর পরাকাষ্ঠা যুদ্ধ ময়দানে দেখাতে হয়। তোমরা যদি তরবারী চালনায় এতোটাই সিদ্ধহস্ত হতে, তাহলে এই বৃদ্ধ ও তরুণীদেরকে আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে না। এরা তো তোমাদেরই বোন-কন্যা। এদের সম্ভ্রমকে তোমরা যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারলে?”

কোনো কোনো ঐতিহাসিক লিখেছেন, সেদিন ভীমপালের রাজদরবারে যে ব্যক্তি দোভাষীর কাজ করছিলো, সে থানেশ্বর দুর্গশাসকের বিশেষ দূত গজনী বাহিনীর একজন তুখোড় যোদ্ধা ডেপুটি সেনাপতির তিরষ্কারমূলক বক্তব্য হুবহু এর বেশী আমার কোনো চাভাষান্তরিত করে রাজাকে শোনাচ্ছিলো না। দূতের কঠোর ও কড়া তিরষ্কার ও অবমাননামূলক শব্দগুলোকে অনেকটাই সাদামাটা ও সহজ ভাষায় রাজার কাছে পেশ করছিলো। অবস্থা দেখে দূত রাজার দোভাষীর উদ্দেশে বললেন, “আমি জানি না, তুমি আমার কথাগুলো হুবহু ভাষান্তরিত করে রাজার কাছে উপস্থাপন করছে কিনা। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি, আমার আবেগ ও উচ্ছ্বাসকে হুবহু তুমি রাজার কাছে পেশ করছে না। আমি যেভাবে বলছি, হুবহু সেভাবে আমার কথাগুলো তোমাদের রাজার কাছে উপস্থাপন করো।”

এ পর্যায়ে এ কথাটিও দোভাষী রাজাকে শোনালো।

“সম্মানিত দূত, শুনুন! আমার বাবা ছিলেন আপনাদের করদাতা। তিনি মারা গেছেন। এখন আমাকে এই সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে, আমি কর দেবো কিনা। অবশ্য এ অবস্থায়ও আমাদের মৈত্রী বহাল আছে এবং থাকবে।” বললো রাজা।

“আমি আপনার কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করা এ মুহূর্তে কর্তব্য মনে করছি।” বললো দূতরূপী ডেপুটি সেনাপতি। “আপনার দাদা আমাদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। আপনার বাবাও কোননা ক্ষেত্রেই জয়লাভ করতে পারেননি। এখন আপনার পালা। আপনি ইতিমধ্যে কয়েক তরুণীকে বলি দিয়ে দিয়েছেন। আপনি পাথরের মূর্তির সামনে বসে আরাধনা করে কী পাচ্ছেন? পরাজয় ছাড়া এতে কি কোনো উপকার হয়েছে। আপনার কি এখনো বুঝে আসেনি, আপনাদের ধর্ম একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস? সেই অদ্বিতীয় নিরাকার প্রভুই আপনাদেরকে একের পর এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি করছেন। কারণ, তিনিই একমাত্র প্রভু। শাস্তি ও পুরস্কার দেয়ার ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই আছে। আপনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করুন মহারাজ।”

“কারো রাজদরবারে এসে কোনো দূত কারো ধর্মকে অবমাননা করুক এমন দুঃসাহস আমরা কোনো দূতকে দিই না।” বললো রাজা। “আমার রাজ দরবারে এসে আমার সামনে আমার ধর্মকে অবমাননা করে আপনি আমাদের সাথে মৈত্রীচুক্তির ব্যাপারে ভাবতে বাধ্য করছেন। ঠিক আছে, আপনি এখন আসতে পারেন।”

দূত রাজদরবার ত্যাগ চলে এলেন। সাদা দাড়িওয়ালা সন্ন্যাসী এবং দুই ও তরুণী অধোমুখে তখনো রাজদরবারে দাঁড়ানো।

“ওদের এখান থেকে নিয়ে যাও।” হুংকার দিয়ে নির্দেশ দিলো ভীমপাল। “এই বৃদ্ধ আর মেয়েগুলো আমার জীবনের কলঙ্ক হয়ে থাকবে। আমার দৃষ্টি থেকে এদের সরিয়ে দাও। এসব আমি কখনো ব্যবহার করতে প্রস্তুত নই। আমি সম্মুখযুদ্ধে মোকাবেলা করেই মাহমূদকে বন্দী করে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করবো, এখন বলো কার ধর্ম সঠিক!”

ঝিলম তীরের পাহাড়ী এলাকা সেনা শিবিরে পরিণত হলো। সেখানে বিপুল সংখ্যক সৈন্য পাঠালো রাজা ভীমপাল। এদিকে মন্দিরে মন্দিরে হিন্দু পুরোহিতরা আবারও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে শুরু করলো। ফলে পূর্বের মতো বেসামরিক লোকজন ঢাল-তলোয়ার ও তীর-ধনুক নিয়ে লাহোরে জমায়েত হতে শুরু করেছে। হিন্দু জনসাধারণ রাজা ভীমপালের কোষাগারে অর্থ-সম্পদ জমা করতে শুরু করলো। হিন্দু নারীরা তাদের গায়ের অলংকার খুলে ভীমপালের যুদ্ধভাণ্ডারে দান করতে লাগলো। প্রত্যেক হিন্দুর মধ্যে যুদ্ধ-উন্মাদনা জন্ম নিলো। যেসব হিন্দু যুবক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে হিন্দুস্তানের বিভিন্ন এলাকা থেকে লাহোর পৌঁছলো, তাদেরকে ঝিলম তীরবর্তী পাহাড়ী এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া হলো।

সুলতান মাহমূদের কাছে খবরাখবর আসছিলো। কিন্তু তার পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি যে, ভীমপাল তার বিরুদ্ধে আক্রমণ করার চক্রান্ত করছে এবং আক্রমণের জন্য প্ররোচনা দিচ্ছে। এমতাবস্থায় ১০১২ খৃস্টাব্দ চলে গেলো। ১০১৩ খৃস্টাব্দের শেষভাগে নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর এলো, ভীমপাল সুলতানের সাথে তার বাবার মৈত্রীচুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছে এবং কর দিতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সুলতানের গোয়েন্দারা এ খবরও পাঠালো যে, রাজা ভীমপাল ঝিলম নদীর তীরবর্তী পাহাড়ী এলাকায় তার সৈন্যদের ছড়িয়ে রেখেছে এবং জায়গায় জায়গায় ফাঁদ তৈরি করেছে। সমকালীন হিন্দু জনতা ভীমপালকে বীর উপাধিতে ভূষিত করেছিলো। আর এদিকে শত্রু নির্মূলে সুলতান মাহমূদ ছিলেন অধৈর্যশীল। বেঈমানদের বিরুদ্ধে তিনি সব সময়ই ক্ষিপ্ত থাকতেন। তার এক পা সর্বদাই ঘোড়র পাদানিতে থাকতো। ভীমপালের রণপ্রস্তুতির কথা শুনে সুলতান ক্ষোভে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন। ইতিমধ্যে তার সৈন্যরাও কিছুটা বিশ্রাম নেয়ার অবকাশ পেয়েছিলো এবং তার সৈন্যঘাটতিও এ সময়ে পূরণ হয়ে গিয়েছিলো। ভীমপাল ভেবেছিলো, সুলতান মাহমূদ হয়তো আরো কিছুদিন পরে এদিকে অভিযান করবেন এবং লাহোর পর্যন্ত পৌঁছুতে তার বাহিনীর অন্তত ছয় মাস সময় লাগবে। ততদিনে শীতকাল শেষ হয়ে গ্রীষ্মকাল শুরু হয়ে যাবে। আর তখন হিন্দুস্তানীদের জন্য সময়টা যুদ্ধের উপযোগী হবে। কিন্তু ভীমপালের এ ধারণা ছিলো নিতান্তই ভুল।

ভীমপাল জায়গায় জায়গায় তার সৈন্য মোতায়েন করে ফাঁদ তৈরি করে নিশ্চিন্তে লাহোরে অবস্থান করছিলো আর ভাবছিলো, সুলতানের বাহিনী মারগালা অঞ্চলের পাহাড়ী এলাকা অতিক্রম করলেই তার গোয়েন্দারা তাকে খবর দেবে। রাওয়ালপিন্ডি অঞ্চলের একটি জায়গার নাম মারগালা। ভীমপাল সুলতানের ক্ষিপ্রগতি সম্পর্কে জানতো না। তাই সে রাজকীয় চালে ধীরগতিতে অগ্রসর হয়ে লাহোর থেকে বালনাথ নামক পাহাড়ী উপত্যকায় পৌঁছলো। এদিকে সুলতান মাহমূদ মারগালা এসে গতি থামিয়ে দিলেন। সারা রাত তিনি সেখানে অবস্থান করলেন। তিনি এখানে যাত্রাবিরতি করে তাঁর গোয়েন্দাদের মাধ্যমে জানতে চেষ্টা করেন, শত্রু বাহিনীর অবস্থান কোথায়, তাদের বিস্তৃতি কোন্ পর্যন্ত এবং তাদের রণকৌশল কী ধরনের হতে পারে। ইত্যবসরে ভীমপাল বালনাথ নামক স্থানে পৌঁছায়। জায়গাটি ছিলো পাহাড়-টিলা ও খানা-খন্দকে ভরা। ভীমপাল জায়গাটিকে নিজের সুবিধা অনুযায়ী দুর্গের মতো ব্যবহার করার পরিকল্পনা করে অবস্থান গ্রহণ করে।

প্রত্যূষেই সুলতান মাহমূদ ভীমপালের অবস্থান এবং সেখানকার ভৌগোলিক পরিস্থিতির সামগ্রিক তথ্য পেয়ে যান। সুলতানকে আরো জানানো হলো, ঝিলমের টিলা ও পাহাড়ের চূড়ায় ভীমপালের তীরন্দাজ বাহিনী অবস্থান নিয়েছে এবং জায়গায় জায়গায় ওঁৎ পেতেছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি জেনে সুলতান সেনাকমান্ডারদের ডেকে বললেন, তিনি লাহোর যাবেন না এবং ঝিলমের পাহাড়ী পথেও তিনি অগ্রসর হবেন না। তিনি কমান্ডারদের প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিয়ে অগ্রবর্তী সেনাদেরকে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে পাঠিয়ে দিলেন।

ভীমপালের সৈন্যবল সুলতানের সৈন্যবলের চেয়ে অনেক বেশি ছিলো। অবস্থানগত দিক থেকেও ভীমপাল ছিলো সুবিধাজনক স্থানে। সুলতান মাহমূদের সৈন্যরা আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলো। সাধারণ বাংকারে অবস্থানকারী কোনো বাহিনীকে আক্রমণ করতে হলে বেশি সৈন্যের প্রয়োজন হয়। কারণ, এমন আক্রমণে আক্রমণকারীদের জনবল বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় কিন্তু এক্ষেত্রে সুলতানের সৈন্যসংখ্যা বেশি ছিলো না। এ ক্ষেত্রে ঝটিকা বাহিনীকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সুলতানকে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে হলো। সাধারণত গুপ্ত হামলা ও ঝটিকা আক্রমণের সাফল্য নির্ভর করে সৈন্যদের বীরত্ব ও সাহসিকতার উপর। রাতের অন্ধকারে লক্ষ্যস্থলে না গিয়েই যদি ফিরে এসে কোনো সৈন্যদল কর্তা ব্যক্তিদেরকে মিথ্যা তথ্য দেয়, তা নিরূপণ করার মতো বিকল্প কোনো সূত্র থাকে না।

এক্ষেত্রে সুলতান মাহমুদের গুপ্ত আক্রমণকারীদের নির্বাচন করা হতো সৈন্যদের দৈহিক ও মানসিক দৃঢ়তা এবং ধর্মীয় আবেগের ভিত্তিতে। ঝটিকা বাহিনীর সদস্যের সাথে সুলতান মাহমূদ আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতেন। সুলতান মাহমূদের ঝটিকা বাহিনীর সদস্যদের অবস্থা এমন হতো যে, তাদের জীবন-মরণে কবরস্থ হওয়া এবং কাফন দাফন হওয়ার সম্ভাবনাও থাকতো না।

পরদিন রাতের বেলায় সুলতান মাহমূদের সৈন্যরা পাহাড়ী অঞ্চলে পৌঁছে গেলো। ঝটিকা বাহিনীর সদস্যরা রাতের অন্ধকারে আরো এগিয়ে গেলো । প্রত্যেক দলে ছিলো দশ-বারজন দুর্ধর্ষ সৈন্য আর তাদের সাথে থাকতো একজন করে স্থানীয় গাইড। প্রত্যেক দলের টার্গেট ছিলো সেই পাহাড় চূড়া, যেখানে ভীমপাল অবস্থান করছে। সময়টা ছিলো ডিসেম্বরের শুরু এবং শীতের প্রচণ্ডতা। এমন বরফশীতল রাতে শত্রুপক্ষ থেকেও কোনো জঙ্গী তৎপরতার সম্ভাবনা নেই মনে করে ভীমপালের সৈন্যরা বাংকারে বাংকারে মাথা গুঁজে শুয়ে ছিলো।

সুলতানের ঝটিকা বাহিনী পা টিপে টিপে বরফশীতল রাতের অন্ধকারে পাহাড়ে ও টিলার চূড়ায় উঠে গেলো। হিন্দু তীরন্দাজ সৈন্যরা তখন বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। প্রতি বাংকারে মাত্র একজন করে প্রহরী পাহারা দিচ্ছিলো। এই একজন পাহারাদারের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা তেমন কঠিন হলো না। কয়েকটি চৌকিতে হিন্দু সৈন্যরা জাগ্রত থাকার কারণে প্রচণ্ড যুদ্ধ হলো আর অধিকাংশ চৌকিতেই সুলতানের বাহিনী ঘুমন্ত সৈন্যদেরকে নিঃশেষ করে দিলো। জাগ্রত সৈন্যদের সাথে কঠিন মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হওয়ার কারণে চতুর্দিকে শোরগোল পড়ে গেলো। শোরগোলের আওয়াজ ভীমপালের কানে পৌঁছুলে পরিস্থিতি জানার জন্য ভীমপাল লোক পাঠালো। কিন্তু সংবাদ সংগ্রহ করে কেউই আর ফিরে এলো না।

রাত শেষে প্রত্যূষেই সুলতান মাহমুদ তার গেরিলা দলের সাফল্যের সংবাদ পেলেন। অতঃপর তার সৈন্যদের একটি অংশকে তিনি চুপিসারে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। ভীমপালের রণকৌশল সুলতান মাহমুদের বুঝতে মোটেও বেগ পেতে হলো না। ভীমপাল ভেবেছিলো, সুলতানের বাহিনী পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে অতিক্রম করবে। এ জন্য সে পাহাড়ের পাদদেশে সৈন্যদের ছড়িয়ে দিয়েছিলো।

দুপুরের আগেই সুলতানের সৈন্যরা ক্ষুধার্ত সিংহের মতো গর্জন দিয়ে আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে পাহাড়ের উপর থেকে নীচের দিকে তুফানের মতো ধেয়ে এলো। ভীমপালের সৈন্যরা আকস্মিক এই আক্রমণে প্রতিরোধের অবকাশই পেলো না। ওঁৎ পেতে ফাঁদ তৈরি করে রাখা হিন্দু সৈন্যরাই ফাঁদে আটকে গেলো। অবস্থা বেগতিক দেখে দাদা জয়পালের মতো ভীমপালও নিজের জীবন নিয়ে পালিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে সে নির্দেশ দিলো, সকল সৈন্য বাংকার থেকে বেরিয়ে লাহোর রক্ষার চেষ্টা করো।

ভীমপালের ভাগ্য প্রসন্ন ছিলো যে, সে পালাতে সক্ষম হয়েছিলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই শত্রুবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ড নিঃশেষ হয়ে গেলো। হিন্দু বাহিনীর পতাকাও গায়েব হয়ে গেলো। পতাকা গায়েব ও কেন্দ্রীয় কমান্ড না থাকায় হিন্দু বাহিনী দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে শুরু করলো আর সুনিয়ন্ত্রিত ও লক্ষ্যভেদী গজনী বাহিনীর সৈন্যরা অল্প সময়ের মধ্যেই গোটা এলাকা শত্রুমুক্ত করে ফেললো।

যুদ্ধ শেষে গজনী বাহিনীর হাতে হিন্দু যুদ্ধবন্দিরা জানিয়েছে, রাজা ভীমপাল পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কাশ্মীরের দিকে পালিয়ে গেছে। সুলতান মাহমুদ ভীমপালের প্রতি এতোটাই ক্ষুব্ধ ছিলেন যে, তিনি একটি সেনা ইউনিট নিয়ে ভীমপালের পশ্চাদ্ধাবন করলেন। কাশ্মীরে ঝিলাম নদীর তীরে অবস্থানরত হিন্দু সৈন্যরা সুলতানের অগ্রবর্তী দলকে ঘেরাও করে সবাইকে হত্যা করে। এই সাফল্যে হিন্দু বাহিনীর সেনাপতি সামনে অগ্রসর হয়ে সুলতানের বাহিনীর উপর আক্রমণ করে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে তারা বুঝতে পারে, জীবনের সবচেয়ে ভুল কাজটিই তারা করেছে। কিছুক্ষণ ব্যর্থ মোকাবেলা করে অবশেষে তাদের সবাইকে সুলতানের কাছে পরাজয়বরণ করতে হয়।

বিজয়ের পর সুলতান মাহমূদ ঘোষণা করলেন, এখানকার সকল অধিবাসী যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করে, তাহলে সকল বসতি উজাড় করে দেয়া হবে। সুলতানের ঘোষণায় লোকজন দলে দলে ইসলামে দীক্ষা নিতে লাগলো। সেখানকার যুগিরটিলা নামক স্থানের একটি মন্দিরে একটি মূর্তি ছিলো খুবই পুরনো। হিন্দুরা বিশ্বাস করতো, চল্লিশ হাজার বছরের পুরনো এই মূর্তিটি। সুলতান মাহমূদ পুরনো মূর্তিকে গুঁড়িয়ে দিয়ে মন্দিরটি সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে ফেললেন। ১১১৪ সালের জুলাই মাসে বিজয়ীবেশে সুলতান মাহমূদ পুনরায় গজনীতে ফিরে এলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *