এক মগ চাল – খাজা আহমদ আব্বাস
সাপের মতো এঁকেবেঁকে, পিঁপড়ের মতো বিড়বিড় করে গুঁড়ি মেরে মেরে, মৌমাছির ঝাঁকের মতো ভনভন করতে করতে দুটি লম্বা লাইন সরকারি রেশনের দোকানের দিকে এগিয়ে চলে। একটি পুরুষের, একটি স্ত্রীলোকের। স্ত্রীলোকের লাইনটা পুরুষের লাইনের চেয়েও লম্বা, প্রায় এক ফার্লং। তার শেষ প্রান্ত রাস্তার মোড় দিয়ে ঘুরে একটি সরু মতো গলিতে গিয়ে ঢুকেছে। যেসব স্ত্রীলোকের আসতে দেরি হচ্ছে, তারা একে অন্যের পেছনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। রেশনের দোকানটা যে দূর থেকে এক ঝলক দেখে নেবে তারা, তা-ও পারছে না। চোখে পড়ছে শুধু যারা সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাদের মাথা।
কয়েকশো স্ত্রীলোক হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, পারসি এবং ইহুদি; মুসলমান মেয়েরা কেউ বোরকা পরে এসেছে, কেউ-বা বোরকা ছাড়াই। চিকন কালো মেছুনিরা এসেছে চুলে ফুল গুঁজে। তাদের কাপড়ের আঁশ-গন্ধের সঙ্গে মিশে সেই ফুলের সুগন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। এসেছে ফ্রক-পরা, হাঁটু-আলগা, চটি পায়ে গরিব দেশের খ্রিস্টান গোয়ানিজ মেয়েরা। এসেছে সস্তা পেন্ট, পাউডার ও সেন্টে চুবড়ানো আর নকল সিল্কের মোজা এবং উঁচু হিলওয়ালা জুতো পরা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে। ফুল-কাটা রেশমি শাল কাঁধে ফেলে এসেছে গৌরাঙ্গি, কৃষ্ণকেশী ইহুদি মেয়েরা। আরো এসেছে সুডোল-দেহ মারাঠি এবং অত্যন্ত কৃশাঙ্গি বা ধুমসো গুজরাটি মেয়ের দল, আর কেরানি, মজুর, সাধারণ শ্রেণির দোকানদার এবং ট্যাকসি-ড্রাইভারের বউয়েরা। কেউ বিয়ে করা বউ। কেউ-বা অবিবাহিত বউ। চারদিকে মোতিয়ার কলি আর আঁউরানো ফুল, পেন্ট আর ঘাম এবং মাছ আর নারকেল তেলের গন্ধ। দুপুরের রোদে এই রকমারি সুগন্ধ আর দুর্গন্ধ মিলে ওপর দিকে বাষ্প ঠেলে উঠছে। মারাঠি, গুজরাটি, হিন্দুস্তানি এবং ইংরেজি ভাষার কথাবার্তার একটা অবোধ্য কোলাহল শোনা যাচ্ছে। যেন লাখখানেক মৌমাছি গুঞ্জন করছে। এদিকে চলে অপেক্ষা। ষাট সেকেন্ডে এক মিনিট…ষাট মিনিটে এক ঘণ্টা… এক ঘণ্টা… দু’ ঘণ্টা… তিন ঘণ্টা… সাপের মতো আঁকাবাঁকা, পিঁপড়ের মতো মন্থরগতি মেয়েদের লম্বা লাইনটা ক্রমে আরো বেড়ে চলে। একজন যতক্ষণে লাইনের মাথা থেকে রেশন নিয়ে বিদায় নেয়, ততক্ষণে আরো দুজন পেছনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। দুশো আড়াইশো, তিনশো, সাড়ে তিনশো– ক্রমে আরো স্ত্রীলোক এসে দাঁড়ায়। ধৈর্য, সাধুতা আর বিশ্বাসের অদ্ভুত দৃশ্য। যেন পূজার্থিনীর দল মন্দিরের দরজা খোলার প্রতীক্ষায় রয়েছে। এ এক নতুন মন্দির, যেখানে হিন্দু, মুসলমান, পারসি, ইহুদি– সব একসাথে পূজা দিতে এসেছে। প্রত্যেকের একই চিন্তা, একই কামনা, একই সাধ– এক মগ চাল।
দুর্গা এসে মেয়েদের লাইনের একেবারে পেছনে দাঁড়িয়ে যায়। সকাল থেকে মাথা, গা এবং পেটে অসহ্য বেদনা হওয়ায় এখানে আসতে তার দেরি হয়ে গেছে। আজ তার শরীরের অবস্থা এমন নয় যে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখানে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু কী করবে! না-এসেও উপায় নেই। ঘরে যে কটি চাল ছিল, সবই শেষ হয়ে গেছে। দুই বেলা বাজার থেকে খাবার কিনে খেয়েছে। কয়েকদিন পর দোকান খুলেছে আজ। চাল যদি সে না নিতে পারে, তাহলে কবে যে বাড়ির খাবার ভাগ্যে জুটবে, কে জানে। আর, এই সময়ের মধ্যে যদি দিন পূর্ণ হয়ে যায় এবং সেই প্রতীক্ষিত লগ্নটি এসে পড়ে, তাহলে তো আরোই মুশকিলে পড়তে হবে।
দুর্গার স্বামী এক কারখানায় কাজ করে। ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে সাঁঝ দেওয়ার পর একসময়। তা-ও আবার সমস্ত দিন মেশিনের মতো হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে। বাজার থেকে সওদা-পত্তর সব দুর্গাকে আনতে হয়। সে মজুর মেয়ে। কাজ করতে তার না আছে কোনো আপত্তি, না আছে সময়-অসময়ের প্রশ্ন। যদ্দিন গাঁয়ে বাপ-মায়ের কাছে ছিল, চাষের কাজে সাহায্য করত, চরকা কাটত, চাকি চালাত, বাপ-ভাইয়ের জন্য রুটি তৈরি করে মাঠে নিয়ে যেত, গরু-বলদের জন্য বিচালি কাটাত, দুধ দু’তো, রাতে শোওয়ার আগে গরুগুলো ডেকে-ডুকে এনে বেঁধে রাখত, এমনি কত কী করেছে। বিয়ের পর শহরে এসে তার নন্দ’র মতো সে-ও কারখানায় কাজ করত। প্রতিদিন দশ ঘণ্টা কাজ করতে হত কারখানায়। তারপর বাড়ি ফিরে আবার চুলোয় ফুঁ পাড়ত। কিন্তু কখনো তার একথা মনে হয়নি যে, সে খুব পরিশ্রম করছে। তার নন্দ’র জন্য সে সবকিছু করতে প্রস্তুত। নন্দ কত ভালো মানুষ। দুর্গাকে বোম্বাই নিয়ে এসে সে কত বেড়িয়ে এনেছে চিড়িয়াখানা, চৌপাটি আর অ্যাপোলো বন্দর থেকে। কয়েকবার সিনেমায়ও নিয়ে গেছে। এমন সব জিনিস দুর্গা গ্রামে দেখতে পেত কী করে? নন্দ তার দিকে খুব খেয়াল রাখে। অন্যান্য শ্রমিকের মতো সে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে না বা বউকে মারধোর করে না। এদিকে, ছয় মাসও যখন পূর্ণ হয়নি, তখন দুর্গার কারখানায় যাওয়া সে বন্ধ করে দিয়েছে।
: তোর এখন বাড়িতে বিশ্রাম করা দরকার। তুই এবার আমার ছেলের মা হতে চলেছিস না?– নন্দ হেসে বলেছিল, দেখ, ছেলে চাই, মেয়ের দরকার নেই আমার।
সাপের মতো এঁকেবেঁকে, পিঁপড়ের গতিতে বিড়বিড় করে মেয়েদের দীর্ঘ লাইনটা রেশনের দোকানের দিকে এগিয়ে চলেছে। এখন দুর্গার পেছনেও আট-দশজন স্ত্রীলোক এসে দাঁড়িয়েছে লাইনে। কোথাও কোথাও পরস্পরের মধ্যে আলোচনা চলছে। একটি পারসি স্ত্রীলোক বাজারে দর বেড়ে যাওয়ার বিশদ বর্ণনা দিচ্ছে। একটা খোঁজা মেয়েছেলে চালের ঘাটতির জন্য কংগ্রেসের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। একজন খ্রিস্টান স্ত্রীলোকের ধারণা এসব মহাত্মা গান্ধীর দোষ। তিনি যদি সরকারের সঙ্গে যেচে হাঙ্গামা না-বাধাতেন, তাহলে সরকারও ভারতীয়দের শাস্তি দেওয়ার জন্য চালের ওপর কন্ট্রোল বসাত না।
একটি গুজরাটি স্ত্রীলোক বলে, কংগ্রেস আর মহাত্মা গান্ধীর দোষ দিচ্ছ কেন? জান না, গরমেন্ট লাখো লাখো মণ গম ইরান, ইরাক আর মিশরে রপ্তানি করেছে!
: অ্যাঁ, গরমেন্ট খাবার বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে?– একজন মারাঠি স্ত্রীলোক বিস্মিত হয়ে বলে, কিন্তু আমরা হিন্দুস্তানিরাই-বা কবে নির্দোষ হলাম। ব্যবসায়ী আর আড়তদাররাই কি বাড়িতে কিছু কম চাল ভরে রেখেছে!
: তা নয় তো কী! আমরা এক মগ চালের জন্য পাঁচ-ছয় ঘণ্টা রোদ্দুরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকি, আর ওদিকে ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার মণ চাল লুকিয়ে রেখে দুই গুণ তিন গুণ দামে বিক্রি করছে!
: এরকম লোকদের ফাঁসি দেওয়া উচিত।
: সে অন্য দেশে হয়। আমাদের দেশে তো এদের রায় বাহাদুর, খান বাহাদুর খেতাব দেওয়া হয়, যুদ্ধের কাজের কনট্রাকটরি দেওয়া হয়। এটা হল হিন্দুস্তান।
আর একদিকে যুদ্ধের খবরের ব্যাখ্যা চলছে।
: আরে, তুমি জানো না, জার্মান আর জাপান একই কম্বলের লোম– জাপান সুযোগ পেলে রাশিয়ার ওপর হামলা না-করে ছাড়বে না।
: তাহলে, বাবা, ধরে নাও, তার বিপদই ঘনিয়ে এসেছে। এ বার্মা আর ফিলিপাইন নয় যে, গিলে ফেললে ঢেকুরটাও উঠবে না। এ হল গিয়ে রাশিয়া।— এটি কোনো সাংবাদিকের বউ, যার স্বামী হয়তো স্বপ্নেও খবরের কাগজের হেডিং পড়ে।
রুশ! রৌদ্রে দুর্গার মাথা ঘুরছিল। কিন্তু তার মনে হল, এই ‘রুশ’ শব্দটি সে কোথায় যেন শুনেছে। হ্যাঁ, তার মনে পড়েছে। নন্দ একবার তাকে সঙ্গে করে একটা সভায় নিয়ে গিয়েছিল। শ্রমিকদের সেই সভায় প্রায় পঁচিশ-তিরিশ হাজার শ্রমিক উপস্থিত ছিল। মেয়েছেলেই তো ছিল কয়েক হাজার। চারদিকে লাল লাল ঝাণ্ডা। মাঝখানে একটি উঁচু জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়ে লোকে বক্তৃতা দিচ্ছিল। দুর্গা দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল– বক্তৃতা হচ্ছে অত দূরে উঁচু জায়গাটায়, কিন্তু আওয়াজ আসছে কাছেরই একটা থামে বাঁধা একটি কালো চোঙা থেকে। অদ্ভুত আওয়াজ। যেন কেউ কুয়োর মধ্যে মুখ বাড়িয়ে কথা বলছে। এই আওয়াজটায় শোনা গেল, ভাই সব, হিটলারের খুনি নেকড়েরা রুশিয়ার ওপর হামলা করেছে। রুশিয়া শ্রমিকদের নিজের দেশ। রুশিয়া শ্রমিকদের নিজেদের সরকার।… পৃথিবীর সমস্ত শ্রমিকের কর্তব্য রুশিয়ার সাহায্যের জন্য তৈরি থাকা।… তারপর, হাজার হাজার গলা থেকে এমনভাবে ধ্বনি বেরুল যে, মনে হল, বুঝি-বা আকাশ ফেটে পড়বে।
কতক্ষণ হয়ে গেল দুর্গার দাঁড়িয়ে থাকা! পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে, ষোল-সতেরো জনের মতো স্ত্রীলোক রয়েছে তার পেছনে। লাইনের সঙ্গে এগোতে এগোতে এবার সে রাস্তার মোড়ে এসে পৌঁছেছে। ঘাড় বার করলে রেশনের দোকানের লাল লাল লেখাওয়ালা সাইনবোর্ডটাও দেখতে পাচ্ছে সে। কিন্তু এখনো কমপক্ষে শ’খানেক স্ত্রীলোক পার হলে তবে সে এক মগ চাল পাবে। একটি ক্লান্ত পা থেকে অন্য ক্লান্ত পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে দুর্গা মনে মনে বলে, দোকানদারটা এত দেরি করছে কেন, বুঝতে পারছিনে তো।– অন্য স্ত্রীলোকরাও কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে পড়েছে। গরম আর নীরবতায় গোটা লাইনটি কাবু হয়ে পড়েছে এখন। নীল উর্দি পরা একটা সেপাই সামনের গাছতলায় ঝিমোচ্ছিল। তাকে ঝিমোতে দেখে দুর্গার সমস্ত ক্লান্তি, পায়ের ব্যথা, পেটের বেদনা– সব তার চোখে এসে জড় হয়। রাস্তার ট্রাম-লাইনে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে তার। পা দুখানা টলে উঠতেই সামনের স্ত্রীলোকটিকে ধরে দাঁড়ায় সে। বুড়ি মতো লোকটি বলে, ও বোন, একটু নিজের পায়েই দাঁড়াও!– বুড়ির কথায় রাগ বা জ্বালা নেই। কিন্তু দুর্গা লজ্জিত হয়ে একটু যেন বিমূঢ় হয়ে পড়ে। অন্যমনস্কভাবে পিছু হটতে গিয়ে এবারে প্রচণ্ড ধমক খায়, কানী, আমার পা-খানা মাড়িয়ে দিল!– এই স্ত্রীলোকটি দুর্গার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য যন্ত্র-চালিতের মতো পিছু হটতেই লাইনের শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষায় গালাগালি আর অভিশাপের উচ্চ রোল ওঠে।
দুর্গা লজ্জায় মরতে মরতে একেবারে মরে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নিয়ে সে দৃষ্টিটা মাটিতে বিঁধিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একবার তার ইচ্ছা হয়, এক মগ চালের আশা ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে, নন্দ সন্ধ্যার সময় শান্ত, ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে কী খাবে? তার বড়-ভালো-মানুষ নন্দ তার জন্য প্রত্যেকদিন কয়েক ঘণ্টা ওভারটাইম করে। আর এখন তো দোকানের কাছেই এসে গেছে। কোনোরকমে এক ঘণ্টা, আধ ঘণ্টা কেটে গেলে তো সে চাল নিয়েই বাড়ি ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু পেটে এত বেদনা হচ্ছে কেন? আর, কোন মানুষ যেন চিৎকার করছে! ব্যথায় ঘেমে নেয়ে ওঠে দুর্গা। মাথাটা আবার ঘুরতে থাকে। পেটের মধ্যে ব্যথার ঢেউ উঠছে, জোয়ার-ভাটা চলছে। মনে হচ্ছে, কোন শত্রু যেন বারবার বর্শা দিয়ে আক্রমণ করছে। একটি আঘাতের জখম সেরে উঠতে না- উঠতেই আবার আঘাত করছে। দিন কি পুরো হয়ে গেল? এতদিন থেকে সে যে দিনটির অপেক্ষা করছে, সেই দিনটি কি এসে গেল? না, তা কী করে হয়! সবেমাত্র তিন দিন হল, দাই বলেছে, এখনো দশ-পনেরো দিন বাকি আছে। এটা হয়তো অন্য কোনো বেদনা।
ব্যথা আর কষ্টের মধ্যে দুর্গা কেমন করে জানি পুরো লাইনের সঙ্গে সঙ্গে আপনা থেকেই দোকানের দরজা পর্যন্ত এসে পৌঁছয়। এখন শুধুমাত্র একটি স্ত্রীলোক রয়েছে তার সামনে। এই স্ত্রীলোকটিও যখন দোকানের ভেতরে চলে যায়, তখন দুর্গা দেখে, তাকে ও সিঁড়ি ভেঙে ভেতরে ঢুকতে হবে। এক ফুট উঁচু উঁচু দুটো ধাপ তার কাছে মনে হয়, তাদের গাঁয়ের সেই মন্দিরের টিলার মতো, যার উপরে পৌঁছতে হলে একশোর ওপর ধাপ পার হয়ে উঠতে হয়। ভগবান! এই নড়বড়ে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে সে কী করে যাবে?
তার সামনের স্ত্রীলোকটি থলেয় এক মগ চাল নিয়ে স্মিতমুখে ঘাম মুছতে মুছতে দোকান থেকে বেরিয়ে আসে। পেছনের স্ত্রীলোকটি দুর্গাকে ধাক্কা দিয়ে বলে, যাও বাপু, যাও। ঘুমোচ্ছ নাকি?
দোকানদারও তার দিকে তাকিয়ে বলে, এস গো, দেরি করছ কেন?– কিন্তু সে দেখে না যে, দুর্গার মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। সিঁড়ি ভাঙবার কথা মনে আসতেই তার পা দুটি থরথর করে কাঁপছে।
: আমাকে… আমাকে… আমাকে এখান থেকেই দিয়ে দাও, ভাই।– দুর্গার ঠোঁট দুটি শুকিয়ে গেছে। কথাও বের হয় কষ্টে।
: তোমার এত গুমর কিসের? নিতে যদি হয়, ভেতরে এসে নাও!
: যাচ্ছ-না কেন?
: না-নিতে হলে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে অন্য লোককে আসতে দাও!
প্রতি পদক্ষেপে দুর্গার মনে হয়, সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। কিন্তু নিজের দেহটাকে কোনোরকমে টেনেহিঁচড়ে দোকানের মধ্যে পৌঁছে দেয় সে; তারপর কম্পিত হাতে থলেটা দোকানদারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে দামটা সামনে রেখে দেয়। পয়সাগুলো চারঘণ্টা ধরে তার হাতের মুঠোয় থেকে থেকে ঘামে ভিজে গেছে। দোকানদার মাপের মগ উঠিয়ে চাল ভরে দুর্গার থলেয় ঢেলে দেয়। তারপর দুর্গার মনে হয়, মোটা দোকানদারটি যেন আপনা-আপনিই ঘুরছে। মাপের মগটাও। চালের থলেও। গোটা দোকানটা ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে গোটা দোকান– চালের বস্তা, ঘিয়ের পিঁপে, দেয়ালে টাঙানো হনুমানজির ছবি– দুর্গার গায়ে ধাক্কা খায়। সে তীব্র আর্তনাদ করে ওঠে।
তারপর দুর্গার মনে হয়, সে যেন চালের স্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু তার গাঁয়ের উপর থেকে চাল আপনা-আপনিই সরে যায়। হনুমানজি সেই চাল মাপের মগে ভরে ভরে সমস্ত স্ত্রীলোককে বিতরণ করছে– এই নাও এক মগ চাল, এই নাও এক মগ চাল। আনন্দে হনুমানজির লেজটা নামছে। কিন্তু লেজ তো নয়। এ তো সাপ। দুর্গাকে যে গাল দিয়েছিল, সাপটির মুখখানা সেই স্ত্রীলোকটির মুখের মতো। নিশ্বাস টেনে টেনে সাপটি ফুলছে আর বাড়ছে। তারপর দোকান থেকে বেরিয়ে এঁকেবেঁকে গলির মোড় পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছয়। ফোঁস ফোঁস করতে করতে এবার সে দুর্গার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। যে-কোনো মুহূর্তে দুর্গাকে গিলে ফেলবে সে। সাপ নিশ্বাস টানে, দুর্গা ছিটকে তার পেটের মধ্যে চলে যায়।
কিন্তু এটা সাপের পেট নয়, অন্ধকার ঘর। অন্ধকার এবং গরম। বাতাস স্তব্ধ। দুর্গার দম বন্ধ হয়ে আসে। অন্ধকার গহন থেকে কার যেন কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ‘এটা হিন্দুস্তান, হিন্দুস্তান।’ অন্ধকারের মধ্যেই আবার দূর থেকে দুটি লাল আলো ঝলমল করতে থাকে। দুর্গার মনে হয়, কোনো সাপের চোখ জ্বলছে। কিন্তু কাছে এলে দেখে, দুটি লাল পতাকা। ঝাণ্ডা দুটি আপনা-আপনিই হাওয়ায় উড়ছে। এবার চারদিক আলোকিত হয়ে যায়। সহস্র সহস্র, লক্ষ লক্ষ শ্রমিক অদ্ভুত ধরনের কী এক ভাষায় গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চলেছে। একটি কুয়োর ভেতর থেকে আওয়াজ ভেসে আসে। তারপর হঠাৎ মেঘ ঘনিয়ে আসে এবং বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে। দূর থেকে মেঘ গর্জনের আওয়াজ আসে। কিন্তু না, মেঘের গর্জন তো নয়, কামান চলেছে, গোলাবর্ষণ হচ্ছে। যেরকম দুর্গা একদিন সিনেমায় দেখেছিল। একটা বোমা একেবারে তার পাশে এসে পড়ে, টুকরো টুকরো হয়ে বাতাসে উড়ে যায়।
এবার দুর্গার মনে হয়, সে উলঙ্গ হয়ে পড়ে রয়েছে। একেবারে উলঙ্গ। লজ্জায় সে লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু উঠে দাঁড়াবার আগেই একটা ভীষণাকার দৈত্য এসে করাত দিয়ে তার পেট চিরতে শুরু করে। ভালো করে দেখবার পর কিন্তু দুর্গার বিস্ময়ের সীমা থাকে না। এ স্বয়ং তার স্বামী নন্দ। উচ্ছলভাবে সে দুর্গার পেট কাটছে, আর বলছে, ছেলে চাই না, ছেলেমেয়ের দরকার নেই আমার।
চারদিকে হাজার হাজার লোক জমা হয়ে যায়। দুর্গার এই অবস্থা দেখে তারা হাসতে থাকে। একজন বলে, হিন্দুস্তান, হিন্দুস্তান।
এ কথায় ধুমসো গুজরাটি স্ত্রীলোকটি বলে, গান্ধীজিকে কেন দোষ দাও। স্বয়ং ইংরেজরাই তো এদের ক্ষিধেয় মারছে।…
সব লোক অদৃশ্য হয়ে যায়। এবার দুর্গা দেখে, সে মোটা হয়ে গেছে। ওই দোকানদারটার চেয়েও মোটা। আর, একটা হাঁড়ির সমান ভুঁড়ি বেরিয়েছে তার। কে যেন ভুঁড়ির মধ্যে একটা কাঠি ঢুকিয়ে দিয়েছে। পেট থেকে এবার রক্ত বেরোতে থাকে। এত রক্ত বের হয় যে, তার সমস্ত কাপড় ও শরীর রক্তে ভেসে যায়, আর পেটটা সঙ্কুচিত হয়ে কোমরের সঙ্গে লেগে যায়। দুর্গা আবছা চেতনার দুয়ারে কে যেন নাড়া দিতে থাকে। কয়েকজন লোক গল্প-গুজব করছে। দোকানটা ঘুরতে ঘুরতে সংজ্ঞাহীনতার মেঘলোক থেকে বেরিয়ে আসছে। ঘুরতে ঘুরতে আস্তে আস্তে দোকানটা স্থির হয়ে দাঁড়ায়। সামনে হনুমানজির ছবি টাঙানো।
দুর্বলতার জন্য দুর্গা ঘাড়টাও ফেরাতে পারে না। তার মনে হয় দোকানটা যেন মানুষে ভর্তি। তাদের কথার আওয়াজ বেশ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কোনো কোনো শব্দ বোঝা যাচ্ছে না।
: বেচারি… বোধহয়, এই-ই প্রথম…
: কোন মজদুরের… জানিনে, কোথায়…
: যাও, সরো… মুক্তি… বেরিয়ে যাও…
দুর্গার পেট ভীষণ খালি বোধহয়। হাত নাড়বার চেষ্টা করে দেখে, যেন সমস্ত কাপড় জলে না, রক্তে ভিজে সপসপ করছে। হঠাৎ তার মনের মধ্যে একটি ভয়ঙ্কর কথা বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠে– আমি এখানে– সারা দুনিয়ার সামনে ছেলের জন্ম দিলাম? হায় ভগবান, এই বেশরমের কাণ্ডটা কি আমারই কপালে লিখে রেখেছিলে? সাধ্যে কুলোলে সে এখানেই মাটিতে মিশে যেত। এমন অপমানের চেয়ে যে মরণই ভালো ছিল। দুর্বলতার একটি ধাক্কায় চোখ দুটি বন্ধ করে ফেলে সে। মনে মনে বলে, এখান থেকে যাব কী করে এখন? লোকের কাছে মুখ দেখাব কেমন করে? সারা দুনিয়া যে আমার দিকে ইশারা করতে থাকবে!…
কয়েক মিনিট এমনি লজ্জার সমুদ্রে ডুবে থাকে দুর্গা। আবার দুর্বলতা আর সংজ্ঞাহীনতার ধাক্কা আসছিল। ইতোমধ্যে শোনা যায়, ট্যা-অ্যা-অ্যা-
একটি শিশুর কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। একটি শিশু। দুর্গার– নন্দ’র। ছোট্ট আওয়াজটি সমাজের বানানো লজ্জার মধ্যে পবিত্রতার দোলা জাগিয়ে দেয়। দুর্গার মন থেকে দুর্বলতা আর চেতনাহীনতার মেঘ কেটে যায়। কষ্টের ভয় না-করে সে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে, খানকয়েক ময়লা ন্যাকড়ার মধ্যে লাল চাদরের মতো একটি শিশু ছোট্ট মুখটি হাঁ করে কাঁদছে। শিশুটির ক্ষিধে পেয়েছে ভেবে, তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বডিসের ফিতে খুলতে থাকে দুর্গা।
মমতার মান মানুষের কৌতূহলকে ছাপিয়ে ওঠে। সমস্ত লোক মুচকি হাসি হেসে দোকান থেকে বেরিয়ে আসে।
কিছুক্ষণ পর দুর্গা দেওয়াল ধরে ওঠে দাঁড়ায়। তারপর টলতে টলতে কিন্তু বিজয়িনীর ভঙ্গিতে বাইরে চলে আসে। এক হাতে সে নিজের ছেলেকে কোলে করেছে। আর এক হাতে থলে। থলের মধ্যে এক মগ চাল।
অনুবাদ : মিলি হোসেন