৫. হিন্দুদের এত দেবদেবী

হিন্দুদের এত দেবদেবী, কোনও একজনকে বেছে নিয়ে কিছু চাওয়া বেশ ঝামেলার ব্যাপার। কার কতটা পাওয়ার, সে ব্যাপারেও স্পষ্ট ধারণা নেই আরশির। সে আপাতত নিজেদের বাবুপাড়ার কালীমন্দিরের মাকে স্মরণ করে বলছে, ‘মা আমাকে সিনেমায় চান্সটা পাইয়ে দাও। না পেলে নিজের মাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে।’ আজ অডিশন দিতে গিয়ে ইউনিটের লোকজনের সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা করছিল আরশি, কেউ তেমন পাত্তা দিচ্ছিল না। সবাই ভাবছে সিলেক্ট হওয়ার জন্য ভাব জমাচ্ছে। বাছাই করে শেষের দিকে যখন দু’জন ক্যান্ডিডেট দাঁড়াল, নিবেদিতাদি একটু কথাবার্তা বলছিল। তাও আরশি যখন ফোন নম্বর চাইল নিবেদিতাদির, সে বলেছিল, ‘এখন নিস না ভাই। ফোন ধরে-ধরে আমার কান দুটোর অবস্থা খুবই খারাপ। সিলেক্টেড হলে নিস।’

অর্থাৎ তুমি যদি চরিত্রের জন্য পছন্দ না হও, ইন্ডাস্ট্রির বাইরে থেকে গেলে। অন্য ক্যান্ডিডেটও খুব স্ট্রং। টাফ কম্পিটিশন। তাই তো ওরা আজ ডিসিশন নিতে পারল না। অন্য মেয়েটির নাম শতরূপা। দেখতে খুবই সুন্দর। কলকাতার নাটকের দলে অভিনয় করে। থাকে টালিগঞ্জে। ও বারবার বলছিল, ‘‘তুমিই সিলেক্ট হবে আরশি। দেখে নিয়ো। তুমি আমার চেয়ে অনেক সুন্দর দেখতে।’’

কথা উড়িয়ে দিয়ে আরশি বলেছে, ‘‘আরে ধুর, আমি তো মেন জায়গাটাতেই উইক। তোমার মতো অভিনয় পারি না। তা ছাড়া তুমিও কিছু কম সুন্দরী নও!’’

‘‘তোমার মধ্যে একটা স্পনটেনিয়াস ব্যাপার আছে, খুবই সপ্রতিভ তুমি… এখানকার সবার সঙ্গে কী তাড়াতাড়ি আলাপ করে নিচ্ছ! কোনও জড়তা নেই, টেনশন নেই, একেবারে ফ্রেশ লুক! নায়িকা হিসেবে নতুন মুখের জন্য এরা এই ধরনের লুকই খোঁজে…’’ শতরূপা নিজের ব্যাপারে প্রায় হাল ছেড়ে কথাগুলো বলেছিল। আরশি কম্পিটিশন পছন্দ করে না। জীবনে ফার্স্ট-সেকেন্ড খুব কমই হয়েছে। এবার কিন্তু সে জিততে চায়। কী হয় দেখা যাক। এখন বাবুপাড়ার কালীমায়ের উপর ভরসা।

আরশির কেন জানি মনে হচ্ছে মা কালী অলরেডি তাকে ফেভার করে যাচ্ছেন। কলকাতায় আসার জন্য আরশি যখন লাগেজ প্যাক করছিল, কাজের লোক মঙ্গলামাসি কাগজ মোড়া কী একটা এনে বলল, ‘‘এটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নাও।’’

‘‘কী এটা?’’ জানতে চেয়েছিল আরশি। খুলতে যাচ্ছিল মোড়কটা। মঙ্গলামাসি বলেছিল, ‘‘খুলে দেখার কিছু নেই। বাবুপাড়া কালীমায়ের ফুল। রেখে দাও সঙ্গে। পথে বিপদআপদ হলে, উনি রক্ষা করবেন।’’

রাতে এই হোটেলেই থাকতে পারাটা তো একটা বিরাট রক্ষা পাওয়া। তারপরও বেঁচেছে একটুর জন্য, রুমে ঢুকতেই ফোন এল পূর্বার। বলল, ‘‘দু’বার কল হয়ে গেল, তুললি না। আমি ভাবলাম কী ব্যাপার! এখনই কাকাবাবুকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম।’’

‘‘রাস্তায় ছিলাম রে, ফোনের আওয়াজ শুনতে পাইনি!’’ বলার পর আরশি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘কাকিমা এখন আছে কেমন? এটা জানার জন্য একবার কল করেছিলাম তোকে।’’

পূর্বা বলেছিল, ‘‘হ্যাঁ, মিস্ড কল দেখেছি, তখন এমন ব্যস্ত ছিলাম মাকে নিয়ে… সিচুয়েশন আপাতত আন্ডার কন্ট্রোল। আইসিসিইউতে আছে মা। ডাক্তাররা অবশ্য এখনও বলেনি পেশেন্ট আউট অব ডেঞ্জার।’’

আরশি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘তুই এখন কোথায়, বাড়ি না হাসপাতালে?’’

‘‘বাড়ি ফিরলাম খানিকক্ষণ হল… ওরা রাতে একজনের বেশি পেশেন্ট পার্টি অ্যালাউ করে না, মামা আছে হাসপাতালে,’’ বলার পর পূর্বা জানাতে চাইল, ‘‘তুই উঠলি কোথায়?’’

‘‘পিসির বাড়ি, নিজের পিসি নয়, দূর সম্পর্কের,’’ বলেছিল আরশি।

পূর্বা জিজ্ঞেস করল, ‘‘জায়গাটা কোথায়?’’

‘‘গোলপার্কের কাছে,’’ বলেছে আরশি। কারণ এর চেয়ে বেশি কলকাতা সে চেনে না। ফের আরশিই জানতে চায়, ‘‘কাকিমাকে কোন হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে রে? কাউকে সঙ্গে পেলেই একবার দেখতে যাব।’’

হাসপাতালের নাম ঠিকানা বলেছে পূর্বা। নামটা আর মনে নেই। রাস্তার নামটা মনে আছে, ক্যামাক স্ট্রিট। এরপর বাবাকে ফোনে ধরেছিল আরশি। বাবা বলল, ‘‘কী ব্যাপার, এত তাড়াতাড়ি ফোন করলি! রাতের দিকে করবি বলেছিলি তো।’’

‘‘করে নিলাম… পরে দুই বন্ধু গল্প করতে-করতে যদি ভুলে যাই!’’ বলেছিল আরশি।

বাবা খুশি-খুশি গলায় মন্তব্য করল, ‘‘মনে হচ্ছে তুই ওখানে পূর্বার সঙ্গে আড্ডা মারতেই গিয়েছিস। মাস কমিউনিকেশনের খোঁজ নেওয়াটা ছুতো।’’

‘‘মোটেই না। তবে একটা কথা শুনে রাখো, আমি নিয়ম করে সকাল-রাত্তির ফোন করতে পারব না। এক-দু’বার মিস হয়ে যেতে পারে। একদম টেনশন করবে না। আর কখনও যদি আমাকে ফোনে না পাও, পূর্বাদের কল করতে যাবে না। এদের সামনে আমি এমব্যারাসড ফিল করব। একটু ধৈর্য ধরবে। আমি ঠিক ফোন করব তোমাকে।’’

বাবার ফোন আসাটা কমাতে চেয়ে কথাটা বলেছিল আরশি। যত ফোন আসবে, তত মিথ্যে বলতে হবে। কন্ডিশন মেনে নিয়েছে বাবা। বাবা আর পূর্বার মধ্যে একবার কথা হয়ে গেলেই আরশির অভিযান বন্ধ।

বাবার সঙ্গে কথা শেষ হতেই রুমে চা-স্ন্যাকস নিয়ে ঢুকেছিল সার্ভিস বয়। চা খেয়ে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে মোবাইলে ফেসবুক খুলল। ওকে অনলাইন দেখে ধেয়ে এল বন্ধুদের চ্যাট। শুধু লহমারই চ্যাটের উত্তর দিল আরশি। লহমা লিখেছে, ‘‘কেমন হল অডিশন?’’

আরশি লিখল, ‘‘ভালই। তবে রেজ়াল্ট এখনও জানায়নি। দু’জনকে বেছে রেখেছে, যার মধ্যে একজন আমি। কাল ফাইনাল ডিসিশন জানাবে। কিন্তু তোর দীপনদাকে দেখলাম না তো!’’

‘‘ছিল, পরিচয় দেয়নি তোকে, নিজের লোক পেয়ে যদি লুজ় দিয়ে দিস কম্পিটিশনে! ধরে নিতে পারিস ভিতরে আমার লোক আছে, হয়ে যাবে…’’ এখানে এসে কিছুক্ষণ থেমে ছিল লহমা। ফের টাইপ শুরু করে, ‘‘দীপনদা বলছে তোর সিলেক্টেড হওয়ার চান্সই বেশি। ইউনিটের সবাই বলছে। অবশ্য পুরোটাই ডিরেক্টরের উপর ডিপেন্ড করছে। এখন দেখা যাক, হোপ ফর দ্য বেস্ট।’’

আরশি লিখল, ‘‘ঠাকুরকে ডাক যেন হয়ে যায়।’’

‘‘হবেই, ফিরে এসে পার্টি দিতে হবে কিন্তু!’’ লিখল লহমা।

আরশি লিখেছে, ‘‘পার্টি তো হবেই। তোর জন্য কলকাতা থেকে কী নিয়ে যাব বল?’’

‘‘একটা হ্যান্ডসাম ছেলে।’’

লেখার পর বেশ ক’টা স্মাইলি পাঠিয়েছিল লহমা। তারপর দুই বন্ধু নানা ইমোজি বিনিময় করে শেষ করেছিল চ্যাট। কিছুই করার নেই দেখে ঘরের টিভিটা চালাল আরশি। একটা হিন্দি সিনেমার মাঝখান থেকে দেখা শুরু করল। মন বসে গেল তাড়াতাড়ি। রাজস্থানের এক গ্রামের পটভূমিকায় ছবি। এক বিধবা যুবতীকে নিয়ে গল্প। যার স্বামী সৈনিক, মারা গিয়েছে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে। আচ্ছা, ওই গ্রামের প্রেক্ষাপটে যারা অভিনয় করছে, তারা প্রায় সকলেই শহরের মানুষ, কী সুন্দর মানিয়ে গিয়েছে গ্রামে। শৌর্যর কথামতো এরা সকলেই নিজের নাম-ধাম ভুলে গিয়ে অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছে। মা-ও অভিনয় করতে গিয়ে সেই যে ভুলে গিয়েছিল নিজের পরিচয়! ষোলো বছর পর মনে পড়ল? আরশি জানে, এটা আবেগের ভাবনা। বাস্তব অনেক কঠিন। ফোনের গলা শুনে বোঝা যাচ্ছিল যে মা নিজের পছন্দ করা জীবনে হেরে গিয়েছে। ফিরতে চাইছে, পুরনো সংসারে। অথবা মা আর বেঁচেই নেই। ফোনটা করেছে অন্য কেউ। কোনও বদ মতলব আছে তার। মতলবটা কী হতে পারে? এসবই ঘুরিয়েফিরিয়ে ভেবে যাচ্ছে আরশি। মাঝে ডিনার নিয়ে এসেছিল সেই ছেলেটা যে আরশির রুমে সার্ভিস দিচ্ছে। খাবারের প্লেট পালটে গিয়েছে। একদম নতুন। আইটেম লাঞ্চের চেয়ে ভাল। এসব জুটছে শৌর্যের কল্যাণে। ছেলেটা খুবই দায়িত্বশীল, ওর উপর চোখ বুজে নির্ভর করা যায়। তবে আরশি যা জ্বালিয়েছে, মনে হয় না আর দেখা করবে। শৌর্য বলেই দিয়েছে, প্রোডাকশনের ও কেউ নয়। সিলেকশনের জন্য ফোটো তোলাটা শুধু ওর কাজ।

খাবার দেওয়ার পর সার্ভিস বয় বলেছিল, ‘‘থালা-বাটিগুলো দরজার বাইরে রেখে দেবেন। সকালে নিয়ে নেব।’’

‘‘সকালে নেবে কেন? এখনই ঘুমিয়ে পড়বে নাকি?’’ জিজ্ঞেস করেছিল আরশি।

ছেলেটা বলল, ‘‘না, বাড়ি যাব। কাছেই বাড়ি। আবার সকালে চলে আসব।’’

প্রমাদ গুনেছিল আরশি। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘অন্য সার্ভিস বয়রা নিশ্চয়ই থাকবে?’’

‘‘কেউ থাকবে না ম্যাডাম, সবার বাড়িই আশপাশে…’’ বলেছিল ছেলেটা।

আরশি বলে, ‘‘সে কী, রাতে যদি কিছু দরকার পড়ে, কাকে ডাকব?’’

ছেলেটা বলল, ‘‘ম্যানেজারদা আছে। নীচের ঘরে থাকবে। কোনও দরকার পড়লে এ রুমের বেল টিপবেন।’’

আরশি জানতে চায়, ‘‘ম্যানেজারদাটা আবার কে?’’

‘‘ওই যে, যিনি কাউন্টারে ছিলেন, উনিই হোটেলের ম্যানেজার,’’ বলার পর চলে যাচ্ছিল সার্ভিস বয়। আরশি ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘শোনো না ভাই, হোটেলে ক’টা রুমে বোর্ডার আছে?’’

‘‘আপনাকে নিয়ে দুটো রুম। বাকি সব খালি।’’

বুকটাই খালি হয়ে গিয়েছিল আরশির। চলে গিয়েছিল সার্ভিস বয়। তবু ভাল কলকাতার রাস্তায় অনেক রাত অবধি গাড়ি ঘোড়া চলে। আওয়াজগুলোই মনে জোর দিচ্ছিল। খাওয়াদাওয়া সেরে রাস্তার দিকের জানলা বন্ধ করে শুতে এল। ঠান্ডা হাওয়া আসছিল জানলা দিয়ে। ঘুম কিন্তু এল না। হোটেল তো নিস্তব্ধই। যত রাত বাড়ল বাইরের গাড়ির আওয়াজ আর আসছিল না। অজানা অচেনা জায়গায় এত রাতে একা কোনওদিন থাকেনি আরশি। বুক ধকধক করে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ হল চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা চালাচ্ছে আরশি, আসছে না ঘুম। এই পরিবেশের কারণেই হয়তো মাথায় একটা নেগেটিভ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, মা হয়তো বেঁচে নেই। হয় সুইসাইড করেছে, নয়তো খুন করেছে কেউ। সিনেমার জগতে এরকম ঘটনার কথা প্রায়ই শোনা যায়। ভুলভাল চিন্তার চাপে দমবন্ধ অবস্থা আরশির, উঠে বসে বিছানায়। টিভিটা একবার চালাবে কি? তাতে যদি একা ভাবটা কাটে। বিছানায় রিমোটটা খুঁজতে থাকে, পায় না। কোথায় যে রাখল! বন্ধ দরজার বাইরে কীসের যেন আওয়াজ… পায়ের আওয়াজ মনে হচ্ছে। কে দরজার সামনে ঘুরঘুর করছে এত রাতে! অন্য যে রুমে বোর্ডার আছে, তাদের কি কেউ? এখনই টোকা মারবে দরজায়? বুক ছ্যাঁৎ করে ওঠে আরশির। না, ভয় পেলে চলবে না। ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে লাঠি জাতীয় কিছু খোঁজে। না, সেরকম কিছু নেই। গ্রাউন্ড ফ্লোরের ঘরে আদৌ ম্যানেজার আছে তো? নাকি সে-ও চলে গিয়েছে নিজের বাড়িতে শুতে? সার্ভিস বয় মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে গেল! ম্যানেজার না থাকলে অন্য ঘরের বোর্ডার যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে যদি, তারপর আরশি শুধুই খবরের কাগজের খবর। কোমর থেকে শরীরের নীচটা কেমন অবশ-অবশ লাগছে আরশির, কিন্তু এভাবে বসে থাকলও তো চলবে না, নিজেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

বিছানা থেকে নেমে পা টিপে-টিপে জানলার কাছে যায় আরশি। ছিটকিনি খোলে জানলার। আওয়াজটা বড্ড জোরে হল। কোনও শব্দ করা চলবে না। দরজার বাইরের লোকটা হয়তো ঠাহর করতে উঠতে পারছে না, কোনটা আরশির রুম। লোকেট করে ফেললে এতক্ষণে দরজায় টোকা পড়ে যেত।

জানলা খুলে কোনও লাভ হল না। রাস্তার আলো ঝিমিয়ে পড়েছে কুয়াশায়। নীচ থেকে কুকুরের ডাক ভেসে এল। ডাক নয়, কান্না। একটানা। জানলা থেকে সরে আসে আরশি। ঘরের বাইরে আওয়াজটা এখন আর নেই। এগিয়ে বন্ধ দরজায় কান রাখে। রুমের মধ্যে ডেকে ওঠে টিকটিকি। আরশির গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। দরজার ওপারে আওয়াজটা শোনা যাচ্ছে আবার। পায়চারি করছে কেউ। পায়ের শব্দ দূরে গিয়ে ফিরে আসছে। ভারী পা নয়, কোনও মহিলার পদচারণ বলেই মনে হচ্ছে। চটি আছে মহিলার পায়ে। রাস্তায় পড়ে থাকা শুকনো পাতায় হাওয়া লেগে সরে যাওয়ার মতো শব্দ আসছে। মহিলা বোধহয় দূরে চলে গেলেন। সন্তর্পণে ছিটকিনি নামিয়ে দরজার পাল্লা সামান্য ফাঁক করে আরশি, অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে, গলায় ফাঁসটানা সাদা ওড়না সমেত করিডর ধরে হেঁটে যাচ্ছে একটি মেয়ে। পিছনটা দেখতে পাচ্ছে আরশি। ফাঁস ছাড়া বাকি ওড়না লুটোচ্ছে মাটিতে। কে মেয়েটা? এই হোটেলে সুইসাইড করেছিল যে? সারাদিন ঘরে আটকে থেকে ঘুরতে বেরিয়েছে রাতে। পাল্লা বন্ধ করে ফ্লোরে বসে পড়েছে আরশি। সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে, কী ভীষণ শীত করছে! মা-ও হয়তো কোনও হোটেলের রুমে সুইসাইড করেছিল! অথবা মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল…

রিংটোনটা দারুণ! অনুষ্কাশঙ্করের সেতার। রাগ পিলু। পাতলা ঘুমে কী ভাল যে লাগছে শুনতে! শৌর্য আবার তলিয়ে যাচ্ছে ঘুমে। হঠাৎ খেয়াল হল, ‘আরে, এটা তো আমার ফোনের রিংটোন! মাঝরাতে কে ফোন করল? কোনও খারাপ খবর কি?’ বালিশের পাশ থেকে ফোনসেট নিল শৌর্য, স্ক্রিনে অচেনা নাম্বার। তবে বিদেশের নয়। আজকাল নাকি বিদেশ থেকে জালিয়াতির কল আসছে হামেশাই। কল রিসিভ করে শৌর্য ‘‘হ্যালো’’ বলতেই, এ প্রান্ত থেকে ভেসে এল কোনও এক মেয়ের আর্তস্বর, ‘‘প্লিজ়, এখনই আমাকে এই হোটেল থেকে নিয়ে যান। ভীষণ ভয় করছে আমার।’’

‘‘কে আপনি? রং নম্বর ডায়াল করেছেন মনে হচ্ছে। কাকে চাইছেন?’’ পরপর বলে গেল শৌর্য।

ও প্রান্ত কান্নাভেজা গলা বলে উঠল, ‘‘আপনাকেই চাইছি। প্লিজ় বাইকটা নিয়ে তাড়াতাড়ি আসুন।’’

এতক্ষণে গলাটা চিনতে পারল শৌর্য। বলল, ‘‘আরশি বলছ তো? প্রবলেমটা কী?’’

‘‘ভূত! ফাঁকা হোটেল… বেল টিপছি… কেউ আসছে না। আমি আর এক মুহূর্তও থাকতে পারব না এখানে। হয়তো মরেই যাব।’’

‘‘কুল, আরশি। ফাঁকা হোটেল বলেই এসব কথা মাথায় আসছে। রুমের দরজা ভাল করে লক করে শুরু পড়ো। কাল সকালে আমি দেখা করছি।’’

‘‘দেখা হয়তো হবে না। এই হোটেলে একটা মেয়ে সুইসাইড করেছিল। এখন আমার রুমের বাইরে পায়চারি করছে। সুইসাইডের ভূত আর একজনকে সুইসাইড করতে ডাকে।’’

‘‘তোমার মাথা পুরোটাই গিয়েছে! দাঁড়াও, আসছি…’’ বলে বিছানা থেকে নামল শৌর্য। মনে-মনে বলল, ‘মেয়েটা তো জ্বালিয়ে মারল! ’দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ যায়, সাড়ে চারটে। মাঝরাত নয় তা হলে! বাথরুমের দিকে এগোয় শৌর্য।

লাস্ট কবে এত ভোরে কলকাতার রাস্তায় বাইক চালিয়েছে, মনে পড়ে না শৌর্যর। তাও আবার শীতবিদায়ী ভোর। এখনও আলো ফোটেনি, ভোর আদৌ বলা যায় কি?

বেরোনোর আগে মাকে ঘুম থেকে তুলতেই হল। বাড়ির মেন দরজায় ইন্টারলক সিস্টেম। মায়ের ঘুম না ভাঙিয়েই বেরিয়ে পড়া যেত। খানিক বাদে যদি ঘুম ভাঙত মায়ের, শৌর্যকে ঘরে না দেখলে চিন্তা করত খুব।

হাত দিয়ে ঠেলে তুলতেই, ধড়মড় করে উঠে বসতে যাচ্ছিল মা। ঘাবড়ানো গলায় জানতে চাইল, ‘‘কী রে, কী হয়েছে?’’

‘‘তেমন কিছু না। তুমি শুয়ে থাকো। আমি দরজা লাগিয়ে বেরোচ্ছি। চিন্তা করবে, তাই জানিয়ে গেলাম।’’

মা বলল, ‘‘এত রাতে যাচ্ছিস কোথায়?’’

‘‘রাত নয়, একটু পরেই ভোর হবে… এক বন্ধুর ফোন এসেছিল, একটু প্রবলেমে পড়েছে,’’ বলে মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল শৌর্য, উদ্বেগের গলায় মা জানতে চেয়েছিল, ‘‘কোন বন্ধু, কী প্রবলেম?’’

‘‘আমার সব বন্ধুকে তুমি চেনো?’’ বলে বাড়ির মেন দরজার দিকে এগোল শৌর্য।

গ্যারেজ থেকে বাইক নিয়ে রাস্তায় এসেই মনে হল জ্যাকেটটা চাপিয়ে নিলে হত। শুধু টি-শার্টে বেশ শীত-শীত করছে। ‘পার্ক সেন্টার’ হোটেলে গিয়ে এখন কী পরিস্থিতিতে পড়বে শৌর্য, আন্দাজ করতে পারছে না। মেয়েটা কি অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকবে? নিয়ে যেতে হবে হাসপাতাল? ফালতু ঝামেলা ঘাড়ে এসে পড়েছে। এর জন্য সুমিতদাই দায়ী। মেয়েটাকে যখন পছন্দ নয়, না বলে দিলেই পারত। তা না, মেয়েটাকে তার ‘চেনা চেনা’ লাগছে! চোখের বাইরে চলে গেলে মনেই পড়বে না কোথায় দেখেছে! প্রবল অস্বস্তিতে ভুগবে!

ভুগতে হচ্ছে তো, শৌর্যকে। সুমিতদার আর কী? সিলেক্টেড নয় জেনে গেলে আরশি হয়তো রাতের ট্রেন ধরে নিত। সেই মতো রিজ়ার্ভেশন করা ছিল নিশ্চয়ই। চান্স পাবেই ধরে নিয়ে কেউ তো আর একেবারের জন্য চলে আসে না। ফেরার ব্যবস্থা রাখে। এই মেয়েটা আবার কলকাতায় প্রথম। কোনও আত্মীয়স্বজন নেই। অথবা আছে, সদ্ভাব নেই। বোঝাই যাচ্ছে, ওই হোটেলে আর থাকবে না আরশি। শৌর্য ওকে নিয়ে কোথায় যাবে? তার চেয়েও একটা বড় দুশ্চিন্তা মনের কোণে উঁকি মারছে, মেয়েটাকে গিয়ে যদি অজ্ঞানের থেকেও খারাপ অবস্থায় পাই, বিচ্ছিরিভাবে ফেঁসে যাব। থানা-পুলিশ, খবরের কাগজ, টিভি… কিছুই বাদ থাকবে না!

ঢাকুরিয়া ব্রিজের উপর উঠে পড়ল শৌর্য। একবার মনে হল, হোটেলটায় যাওয়ার দরকার নেই। গোলপার্ক আইল্যান্ডটা পাক দিয়ে আবার ব্রিজে চলে আসবে, ফিরে যাবে বাড়ি। যেচে বিপদে পড়ার কোনও মানে হয় না। পরক্ষণেই চিন্তা অন্য খাতে বইতে থাকে, মনের চোখে ভেসে ওঠে আরশির অসহায় মুখ। মেয়েটা যেমন দুষ্টু, ততটাই ভিতু। এখনও যেন কিশোরী বয়স পার করেনি। মা-বাবাকে ছেড়ে একা এতদূরে এসেছে, নিজের লোক বলতে এ শহরে কেউ নেই। মা-বাবা অদ্ভুত, কোন আক্কেলে একা ছেড়েছে মেয়েটাকে! রীতিমতো সুন্দরী মেয়ে সে… চিন্তাগুলোই ‘পার্ক সেন্টার’ হোটেলের সামনে এনে ফেলল শৌর্যকে।

নাঃ, বড় অঘটন কিছু ঘটেনি। হোটেলের কাচের দরজায় দু’হাতের তালু রেখে দাঁড়িয়ে আছে আরশি। দরজার লক খুলে দেওয়ার মতো কাউকে পায়নি। কাচের দরজার আগে কোল্যাপসিব‌্ল গেট। তাতেও তালা।

বাইক স্ট্যান্ড করে দরজার সামনে যায় শৌর্য। যা ভেবেছিল তাই, পিঠে রুকস্যাকসহ আরশি ইশারায় দেখাচ্ছে লক খুলে দেওয়ার কেউ নেই। আঙুল তুলছে রিসেপশন কাউন্টারের পাশে বন্ধ দরজার দিকে। তারপর হাত আর মুখের ভঙ্গিতে বোঝাল ওই ঘরে কেউ ঘুমোচ্ছে, যার কাছে চাবি আছে। কাচের বন্ধ দরজার বাইরে কথা আসবে না, তাই ইশারাই সম্বল।

হাত তুলে আরশিকে শান্ত থাকার নির্দেশ দিল শৌর্য। ট্র্যাকসুটের লোয়ার থেকে বের করল মোবাইল, কাচের দরজায় বড় করে লেখা হোটেলের নাম, ফোন নম্বর। নম্বরটা দেখে মোবাইল থেকে কল করল। বেজে উঠল রিসেপশন কাউন্টারের ফোন। শৌর্য শুনতে পাচ্ছে নিজের ফোনে। আরশি ঘুরে তাকাল কাউন্টারের দিকে। বেজে যাচ্ছে ফোন। অবশেষে খুলে গেল আরশির দেখানো সেই রুমটার দরজা। ঘুমচোখে বেরিয়ে এল রিসেপশনের লোকটা, পরনে গেঞ্জি আর লুঙ্গি। কাউন্টার থেকে তুলে নিল ফোনের রিসিভার, ‘‘গুড মর্নিং, হোটেল পার্ক সেন্টার।’’

কথার ধরন দেখে কল্পনাই করা যাবে না, লোকটা লুঙ্গি পরে আছে! শৌর্য বলে, ‘‘ভেরি গুডমর্নিং। গেটটা খুলুন।’’

লোকটা দরজার দিকে তাকায়। অবাক হলেও তাড়াতাড়ি সামলে নেয় নিজেকে। হাতের ইশারায় জানায় আসছে। ফিরে যায় নিজের রুমে। কাচের ওপারে নানা অঙ্গভঙ্গি করছে আরশি, মানেটা দাঁড়াচ্ছে এই রকম, ‘আশ্চর্য লোক! আমি কত ডাকলাম, কিছুতেই উঠল না।’

হাতে চাবি নিয়ে ফিরে এল লোকটা। প্রথমে কাচের দরজার তালাটা খুলল, তারপর কোল্যাপসিব‌্ল গেটের।

ভিতরে পা রেখেই মেজাজ দেখানো শুরু করল শৌর্য, ‘‘কী ব্যাপার, বোর্ডার এত করে ডাকছে, দরজা খোলেননি কেন? যেই ফোন করলাম, কাস্টমার আসবে ভেবে উঠে এলেন। খালি বিজ়নেসের চিন্তা, তাই না?’’

লোকটা একটু কাঁচুমাচু হল বটে, তবে উত্তর দিতে থাকল স্পষ্টভাবে। বলল, ‘‘ওঁর ডাক আমি শুনেছি। দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলছিলেন, ‘গেট খুলে দিন। আমি বেরিয়ে যাব। আমার ভীষণ ভয় লাগছে।’ ভয় লাগার কী আছে, কিছুই বুঝলাম না। মনে হচ্ছিল দিদিভাই একটু অন্যরকমের, বড়লোকের খেয়ালি ধরনের মেয়ে। রাত শেষ হয়নি, গেট খুলে দিই যদি, কোথায় গিয়ে কোন বিপদে পড়বে, দোষ হবে আমার।’’

লোকটা বিবেচনার কাজ করেছে, শৌর্য তাই কিছু বলতে পারে না। আরশি লোকটাকে বলে, ‘‘আমি যে রুম থেকে বারবার বেল টিপে যাচ্ছিলাম, তখন কেন আসেননি? এলে ভয় একটু কাটত। চলে যাওয়ার কথা বলতাম না।’’

‘‘বেলটা খারাপ হয়ে আছে দিদিভাই। ইলেকট্রিশিয়ানকে কবে থেকে ডাকছি, আসছেই না।’’

‘‘বেলটা খারাপ হয়ে নেই, খারাপ করে রেখেছেন, যাতে ঘুমের ডিসটার্ব না হয়!’’ বলার পর আরশি কাঁধের ব্যাগ সামনে এনে কাউন্টার গিয়ে রাখে। ব্যাগের চেন খুলতে-খুলতে বলে, ‘‘যাক, ওসব ছাড়ুন। বিল কত হয়েছে বলুন তাড়াতাড়ি।’’

লোকটা কাউন্টারের পিছনে যায়। কম্পিউটার অন করে চোখ বোলায় হিসেবে। কি বোর্ডের সুইচ টেপে। প্রিন্টার থেকে বেরিয়ে আসে বিল। সেটা আরশির হাতে দিয়ে বলে, ‘‘ভয়টা কী নিয়ে পেলেন বলুন তো?’’

পার্স থেকে টাকা বের করতে-করতে আরশি বলতে থাকে, ‘‘যে মেয়েটা সুইসাইড করেছিল আপনাদের হোটেলে, একটু খরচা হলেও তার শ্রাদ্ধশান্তি করুন। রাত হলে হোটেলের বারান্দায় ঘুরে বেড়ায় সে।’’

টাকা হাতে নিয়ে আরশির দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল লোকটা। তাতে আরশির ভ্রূক্ষেপ নেই। ব্যাগ পিঠে নিয়ে শৌর্যকে বলে, ‘‘চলুন। বাজে হোটেল একটা। এই ভুতুড়ে হোটেলের নাম লিখে ফেসবুকে স্টেটাস দেব আমি। লোকে যেন না ওঠে এখানে।’’

বাইরে চোখের পাতা সামান্য খুলেছে কলকাতা। না খুলে উপায় আছে! পাখিদের যা চেঁচামেচি! কিছু মানুষ ইতিমধ্যেই বেরিয়ে পড়েছে মর্নিংওয়াকে। পার্কের পাশে খুলে গিয়েছে চায়ের দোকান। গাছের নীচে সেই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে শৌর্য আর আরশি। দুটো চায়ের অর্ডার করে শৌর্য আরশিকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘‘এবার কোথায় উঠবে?’’

মাথা নিচু করে ভেবে চলেছে আরশি। ডান হাতের বুড়ো আঙুল দাঁতে। শৌর্য ফের বলে, ‘‘কী হল, কোথায় উঠবে এখন?’’

‘‘মাথায় আসছে না তো। তেমন কোনও জায়গা থাকলে কি হোটেলে উঠতাম?’’

‘‘তার মানে আবার একটা হোটেলেই উঠতে হবে এবং তোমাকে বাইকে বসিয়ে সেটা খুঁজতে হবে আমায়!’’ বলল শৌর্য।

আরশি বলে, ‘‘এখন আবার সব হোটেলের দরজা বন্ধ। ডেকে তোলো, রুম পাওয়া যাবে কি না জিজ্ঞেস করো, হাজার ঝামেলা।’’

‘‘লিজিয়ে আপলোগো কা চায়ে,’’ বলল দোকানদার। ফের জিজ্ঞেস করল, ‘‘বিস্কিট লেঙ্গে?’’

‘‘আমার লাগবে না,’’ বলল শৌর্য। আরশি বলল, ‘‘আমারও না।’’

দু’জনেই চায়ের ভাঁড় নিয়েছে হাতে। চুমুক মেরে আরশি বলে, ‘‘দারুণ করেছে চা-টা! এই সময়ে খেতে যা লাগছে না, টেরিফিক!’’

হোটেলের লোকটা ঘুরিয়ে উচিত কথাই বলেছে, মাথায় ছিট আছে মেয়েটার। কোথায় উঠবে ঠিক নেই, চায়ের আমেজ নিচ্ছে! শৌর্যকেই ঠিক করতে হবে কোথায় নিয়ে যাবে একে। অন্য কোনও হোটেল দেখতে হবে। নিবেদিতাকে বলে দেখা যেতে পারত, আরশিকে রাখবে কি না। মেয়েটাকে পছন্দ হয়েছে ওর। কিন্তু নিবেদিতা ন’টার আগে ঘুম থেকে ওঠে না। ফোন খোলে তারও পরে। পেয়িংগেস্ট হিসেবে থাকে এক বাড়িতে। সেখানে মেয়েটাকে রাখার অনুমতি পাবে কি না, কে জানে!

দু’জনেরই চা শেষ। ভাঁড়ও ফেলা হয়ে গিয়েছে। দাম মেটাল আরশি। শৌর্য বলল, ‘‘হোটেল ছাড়া আর কোনও গতি নেই দেখছি। চলো, এখন হোটেল খুঁজতে থাকি।’’

‘‘চট করে পাওয়া যাবে না। আমি তো দেখলাম, একলা মেয়েকে থাকতে দিতে চায় না হোটেলগুলো। তার চেয়ে একটা সিম্পল সলিউশন বলি?’’

‘‘বলো।’’

‘‘আমাকে আপনার বাড়িতে নিয়ে চলুন।’’

রীতিমতো হোঁচট খায় শৌর্য। বলে, ‘‘আমাকে চেনো না, জানো না, আমার বাড়িতে গিয়ে উঠবে? মনে এতটুকু ভয় নেই তোমার!’’

‘‘আপনাকে তো কাল থেকে দেখছি। দেখা হওয়ার পর থেকে সাহায্য চেয়ে জ্বালিয়ে মারছি। একবারও মুখ ঘুরিয়ে নেননি। কোন দুঃখে আপনাকে ভয় পাব? তবে হ্যাঁ, আপনি যদি বিয়ে করে থাকেন, আপনার স্ত্রী হয়তো আমাকে থাকতে দিতে রাজি হবেন না। তবে মনে হয় না বিয়ে হয়েছে আপনার। এত অল্প বয়সে কোনও বুদ্ধিমান ছেলে বিয়ে করে না। আপনাকে আমার বোকা মনে হয়নি।’’

‘‘ধন্যবাদ, বোকা না ভাবার জন্য। কিন্তু আমার মা তো আপত্তি জানাতে পারে তোমার থাকার ব্যাপারে। বাড়িটা মায়েরও।’’

‘‘আমার মনে হয় না আপত্তি করবেন আপনার বাবা-মা। যাঁরা নিজের ছেলেকে এরকম সুশিক্ষায় মানুষ করেছেন, যে-ছেলে পরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাঁরা কেন আমার সমস্যা বুঝবেন না!’’

শৌর্যর বুঝতে অসুবিধে হয় না আরশির তোষামুদি। আবার কথাগুলো যে একেবারে যুক্তিহীন, তাও বলা যায় না। বাবার কথাটা এনে ফেলল বলে মনটা নরম হল শৌর্যর। হোটেলে না তুলে আরশিকে বাড়ি নিয়ে গেলে খুশিই হত বাবা। এক্ষেত্র মা-ও আপত্তি তুলবে না। তবে ট্যাক্টফুলি বুঝে নেবে আরশির অসহায়তা কতটা জেনুইন!

‘‘এত চিন্তা করছেন কেন? রাতে তো থাকছি না। দুপুরে রেজ়াল্ট জানার পর প্রথম ভলভো বাসটা ধরে ফিরে যাব। যদি সিলেক্টেডও হই, শুটিং তো আর কাল থেকেই শুরু হয়ে যাবে না। গার্লফ্রেন্ডের কাছে জবাবদিহি করতে হবে না আপনাকে।’’

‘‘হঠাৎ গার্লফ্রেন্ডের কথা এল কেন এখানে?’’ সবিস্ময়ে জানতে চায় শৌর্য।

আরশি বলল, ‘‘এত কম চেনা একটা মেয়েকে বাড়িতে নাইট স্টে করতে দিলে আপনার গার্লফ্রেন্ড রাগ করতেই পারে। আমি হলেও করতাম।’’

কপট উচ্ছ্বাসে শৌর্য বলে ওঠে, ‘‘গুড আইডিয়া! চলো গার্লফ্রেন্ডের বাড়িতেই নিয়ে যাই তোমাকে।’’

শৌর্য হাত বাড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিল আরশির কনুই, আরশি পিছিয়ে যেতে-যেতে বলল, ‘‘অ্যাই, না না। আপনার গার্লফ্রেন্ডের বাড়িতে উঠব না আমি। সেটা ঠিক হবে না। প্রচুর জেরার মুখে পড়তে হবে আমাকে।’’

‘‘আরেঃ, যাইয়ে না, কুছ নেহি হোগা!’’ মজা পেয়ে বলে উঠল চা-ওয়ালা। কথাগুলো শুনে বলল, নাকি না শুনে, বোঝা গেল না। শৌর্য ততক্ষণে ধরে নিয়েছে আরশির কনুই, বাইকের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘‘যাবে তো চলো। না হলে দাঁড়িয়ে থাকো এখানেই।’’

এখন চারপাশ অনেকটাই পরিষ্কার। আরশি চলেছে শৌর্যের বাইকে। হাওয়ায় চোরা শীত। দু’জনের মাথাতেই হেলমেট নেই। আরশি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘হেলমেট পরতে হবে না?’’ শৌর্য বলল, ‘‘এত ভোরে ট্র্যাফিক রুল অনেক লুজ় থাকে। তা ছাড়া আমি সাবধানেই চালাই। তুমি পরতেই পারো।’’

‘‘ধুর, হেলমেট আমার একেবারে যাচ্ছেতাই লাগে! মাথায় যেন ব্যান্ডেজ বাঁধা… আশপাশটা ভাল করে দেখা যায় না,’’ বলেছিল আরশি। শৌর্য কিন্তু সত্যিই সাবধানে চালাচ্ছে বাইক। রাস্তা ফাঁকা তবু স্পিড তুলছে না। খানিক আশঙ্কার গলায় আরশি জানতে চায়, ‘‘আপনি কি সত্যিই আমাকে প্রেমিকার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন?’’

‘‘তাই তো বললাম।’’

‘‘আপনার প্রেমিকা যদি আমাকে না থাকতে দেয়?’’

‘‘তখন পারমিশন চাইব, তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার।’’

শৌর্যর দু’কাঁধ ধরে বসেছে আরশি, এক কাঁধে আলতো কিল মেরে বলে, ‘‘এবার বুঝেছি, আপনি ইয়ারকি মারছেন!’’

শৌর্য মিচকি হাসে। আরশি পিছনে বসেও শৌর্যর হাসিমুখটা কল্পনা করতে পারে। এগিয়ে চলেছে বাইক। আরশি বলে ওঠে, ‘‘আপনি কী পারফিউম মেখেছেন? দারুণ গন্ধ!’’

‘‘ভোরবেলা পারফিউম মেখে বেরিয়েছি, তাও আবার একটা মেয়েকে ভূতে ধরেছে শুনে!’’ হাসতে-হাসতে বলে ওঠে শৌর্য।

আরশি বলে, ‘‘অ্যাই, না। আমি কিন্তু সিরিয়াস! গন্ধটা আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই পাচ্ছি। আর একটা ব্যাপার। গন্ধটা কেমন যেন চেনা-চেনাও লাগছে।’’

‘‘চেনা!’’ বলে চুপ করে গেল শৌর্য। একটু ভেবে নিয়ে বলে, ‘‘এখন পাচ্ছ?’’

‘‘না, এই মুহূর্তে পাচ্ছি না। একটু আগেও পেয়েছিলাম। আসলে গাড়ি চালাচ্ছেন তো, হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে গন্ধ।’’

‘‘যখন আমরা চা খাচ্ছিলাম, তখন সবচেয়ে বেশি করে পেয়েছিলে, তাই না?’’

‘‘হ্যাঁ, আপনি কী করে বুঝলেন?’’

‘‘ওটা আমের মুকুলের গন্ধ। চা-ওয়ালার পিছনে পার্কে একটা আমগাছ ছিল। রাস্তাতেও অনেক আম গাছের পাশ দিয়ে এসেছি আমরা। এখন মুকুল এসেছে গাছগুলোয়।’’

‘‘ঠিক বলেছেন তো! তাই এত চেনা লাগছিল গন্ধটা। আমার মামার বাড়ি মালদায়। ছোটবেলায় খুব যেতাম। স্মৃতিগুলো যদিও ঝাপসা, গন্ধটা মনে আছে। আমাদের কলেজের পিছনেও আছে, দুটো ঝাঁকালো আমগাছ। এই গন্ধটা পেয়েছি। তবে এটা যে আমের মুকুলের গন্ধ, তা জানতাম না।’’

সুলেখা স্টপ পেরিয়ে গেল শৌর্য, এরপরই তাদের পাড়ায় ঢোকার রাস্তা। মানে যাদবপুরের সেন্ট্রাল পার্ক। শৌর্যদের পাড়াতেও আছে বেশ ক’টা আমগাছ। শৌর্যর ছোটবেলায় আরও ছিল। গন্ধটা তাই ভাল করেই চেনে।

বাড়ির গেটে বাইক থামাল শৌর্য। আরশিকে বলল, ‘‘নামো, আমাদের বাড়িতেই নিয়ে এলাম। দ্যাখো, কপালে কী আছে তোমার!’’

‘‘আমি শিয়োর, কপালে ভাল কিছুই লেখা আছে!’’ বাইক থেকে নেমে এসে বলল আরশি।

গেট খুলে বাইক ঢোকায় শৌর্য, বাগানেই স্ট্যান্ড করে রাখে। গ্যারেজে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। দশটা নাগাদ তো বেরোতেই হবে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে রূপরেখা অ্যাড এজেন্সিতে।

ডোরবেল বাজায় শৌর্য। দরজা খোলে মা, ভীষণ অবাক হয়েছে আরশিকে দেখ। শৌর্য বলে, ‘‘এই হল আমার বন্ধু। বেশি দিনের নয় সদ্যই আলাপ। এর জন্যই বেরিয়েছিলাম। বাকিটা ওর থেকে শুনো। ঘুম কমপ্লিট হয়নি আমার। শুতে যাচ্ছি। নিজে থেকে না ওঠা অবধি ডেকো না।’’

আরশি এগিয়ে গিয়ে অপর্ণার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলে, ‘‘আমার নাম আরশি। জলপাইগুড়িতে বাড়ি। এখানে…’’

‘‘এসো, বাকিটা ভিতরে বসে শুনব…’’ আরশির কথা কেটে ডেকে নেন অপর্ণা। মেয়েটাকে ঝড়ে পড়া পাখির মতো লাগে তাঁর।

বেশ একটা জমাট ঘুম হল শৌর্যর। উঠে বসে বিছানায়। চোখ গেল দেওয়ালঘড়িতে। খুব বেশি তো ঘুমোয়নি। আটটা বাজে, মানে মাত্র দেড়ঘণ্টা। তাতেও মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ হল ঘুম। আরশি কী করছে, কে জানে! ও-ও নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছে। ওর তো আর ঘুম হয়নি রাতে।

বিছানার পাশে মেঝেতে রাখা জলের বোতল তুলে নিল শৌর্য। জল খেয়ে বোতল নামিয়ে রাখতে গিয়ে একটা আইডিয়া এল মাথায়, আরশিকে লুকটেস্টের রেজাল্ট জানিয়ে দেবে। সুমিতদার ভুলভাল খেয়ালের জন্য ওকে আটকে রাখার কোনও মানে হয় না। দিনের দিন যদি কোনও ট্রেনের রিজ়ার্ভেশন পাওয়া যায়, তো ভালই। নয়তো ভলভো বাসে যাবে পছন্দমতো সিট বুক করে। যত বেলা হবে, ভাল সিট পাবে না। গোটা ব্যবস্থাটাই অনলাইনে করে দেবে শৌর্য। সুমিতদা এক সময় হয়তো জানতে পারবে, শৌর্য মেয়েটার বাড়ি ফেরার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল। তখন যদি কিছু বলে সুমিতদা, শৌর্য জানিয়ে দেবে কী-কী ঝামেলায় পড়েছিল আরশিকে নিয়ে। সমস্যা একটাই, মেয়েটা কত আশা করে বসে আছে, সিনেমায় চান্স পাবে, পায়নি শোনার পর ভেঙে পড়বে খুব। সান্ত্বনা দিতে হবে শৌর্যকে। এই সান্ত্বনা দেওয়াটা যথেষ্ট কঠিন কাজ। জীবন অভিজ্ঞ মানুষরাই এসব সামলাতে পারে। এর জন্য কিছু নির্দিষ্ট ডায়ালগ এবং বিশেষ স্বরক্ষেপণ লাগে, যা শৌর্যের আয়ত্তের বাইরে। মাকে দিতে হবে দায়িত্বটা।

বিছানা থেকে নেমে আসে শৌর্য। বাথরুম যাবে বলে ঘর থেকে বেরোয়। কানে আসে আরশির গলা, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছে। কার সঙ্গে? সাধারণ কৌতূহলে ড্রয়িং লাগোয়া বারান্দার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় শৌর্য, আরশি এখান দিয়েই গিয়েছে বারান্দায়, খোলা আছে দরজা। ফোনের অপরপ্রান্তকে আরশি বলছে, ‘‘খুব বেশি খবর নেওয়ার তো নেই। ভাল পড়ানোর জায়গা তো মোটে চারটে। মনে হচ্ছে যেদিন ফেরার কথা, তার আগেই ফিরে যেতে পারব। … কী বলছ? রিজ়ার্ভেশন পাব না? …তা হলে ভলভো ধরে নেব। … না, না, পূর্বা অফিস নিয়ে একটু প্রবলেমে আছে। আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর মতো সময় ওর নেই। একটু বোধহয় আপসেটও আছে গোটা বাড়ি। এখানে বেশিদিন থাকা ঠিক হবে না। আমি বাসেই চলে যাব। … কী বলছ? ফ্লাইট? কী দরকার অত টাকা খরচ করার! আমি শুনেছি ভলভো বাসে কোনও কষ্ট হয় না। তুমি আবার পূর্বাকে অফিস নিয়ে কিছু বলতে যেয়ো না। এতটাই ডিসটার্বড আছে, উত্তর দিতে ভাল লাগবে না ওর…’’ দরজার পাশ থেকে সরে আসে শৌর্য। মেয়েটা তো সাংঘাতিক মিথ্যুক! যার সঙ্গে কথা বলছে, তাকে তো মিথ্যে বলছেই, শৌর্যকেও সব সত্যি বলেনি। অথচ এমন অ্যাক্টিং করছে, যেন কত সহজ সরল মেয়ে। ইউনিটের কারা যেন বলছিল আরশি অন্য মেয়েটার থেকে অভিনয়ে পিছিয়ে! সম্পূর্ণ ভুল। মারাত্মক অভিনেত্রী আরশি। অস্কার ওর জীবনে বাঁধা।

বিশ্বাস করে কেউ যদি ঠকে যায়, যে মানুষটা ঠকিয়েছে তার উপর ভীষণ রাগ হয়। কিন্তু বাড়িতে রাগ দেখালে চলবে না। চেঁচামেচি করে যদি আরশিকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় শৌর্য, মা ঘাবড়ে যাবে। ছেলের বুদ্ধি-বিবেচনার উপর থেকে উঠে যাবে ভরসা। মায়ের কাছে আরশিকে রেখে বেরোনোও ঠিক হবে না। এ মেয়ে এখন শৌর্যর কাছে অচেনা। ফোনের কথা শুনে মনে হচ্ছিল বাবা অথবা মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। স্থানীয় কোনও অভিভাবকও হতে পারেন। তাঁকে বলে আসেনি যে অডিশন দিতে এসেছে। অন্য অজুহাত দেখিয়েছে। যে হাসতে-হাসতে নিজের গার্জেনকে এতবড় মিথ্যে বলতে পারে, পরের মাকে পট্টি পরাতে তার বাধবে না। মাকে মিথ্যে বলে ঠিক কী ধরনের ক্ষতি করবে, আন্দাজ করা যাচ্ছে না। আজ ভোরে শৌর্যকে সে সত্যিটা বললেই পারত। রেজ়াল্ট জানার পর চলে তো যাবেই। গত সন্ধেয় যদি বলত বাড়িতে না জানিয়ে অডিশন দিতে এসেছে, শৌর্য অবশ্যই বলত, ‘এক্ষুনি বাড়িতে ফোন করে আসল উদ্দেশ্যটা জানাও। নয়তো হোটেলে দিয়ে আসব না আমি। কোনও অঘটন ঘটলে দায় চাপবে আমার উপর…’ রাতটা যখন ভালমন্দ মিশিয়ে কেটে গেল, ভোরবেলা অত মিষ্টি-মিষ্টি কথাগুলো বলার কী দরকার ছিল? আসল কথাটা প্রথমেই বলে নিলে হত। না, এ মেয়েকে যত তাড়াতাড়ি বিদায় দেওয়া যায়, ততই মঙ্গল।

বাথরুম থেকে ঘুরে এসে রোজকার মতো ডাইনিং টেবিলে বসেছে শৌর্য। খবরের কাগজ ওলটাচ্ছে। এখনই চা নিয়ে আসবে মা। নিজের জন্যও আনবে।

‘‘আপনার চা!’’ আরশির গলা।

সামনে থেকে কাগজ সরায় শৌর্য। আরশির হাসি-হাসি মুখটা দেখে রাগ হয়ে যায় ভীষণ। তবে এখনই, মানে বাড়িতে চোটপাট করলে চলবে না। সিন করবে আরশি। এতই বিশ্বস্ত অভিনয়, মা ওর পক্ষ নিয়ে নেবে। শৌর্য বলে, ‘‘মা কোথায়?’’

‘‘মাসিমা কিচেনে… আমাকে বললেন চা-টা দিয়ে আসতে, আমরা খেয়ে নিয়েছি চা,’’ বলে মুখোমুখি চেয়ারে বসল আরশি। চায়ের মগে চুমুক দিয়ে শৌর্য বলল, ‘‘পারফেক্ট বাংলা টিভি সিরিয়ালের দৃশ্য। ভোরবেলা প্রায় অচেনা মেয়েকে এনে তুললাম বাড়িতে। মায়ের মন জয় করে নিল সে। ভাবী বউমা বলে গণ্য করে মা তার হাত দিয়ে চা পাঠাল!’’

‘‘দারুণ বলেছ তো! মাসিমার সত্যিই আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। কত গল্প করলেন। পিছনের বাগানে ফুল তুললাম দু’জনে। কিন্তু এরপরই যে সিরিয়ালে দেড়-দু’মাস জুড়ে ভাবী শ্বশুরবাড়ির লোক নানা বায়নাক্কা করবে। কষ্ট দেবে নায়িকাকে। সেগুলোও কি চলবে?’’

‘‘অত লম্বা অপেক্ষা তোমায় করতে হবে না, যা ঘটার, খুব তাড়াতাড়িই ঘটে যাবে!’’ বলে ফের চায়ে চুমুক দিল শৌর্য।

‘‘কী ঘটবে গো? এত তাড়াতাড়িই বা কীসের?’’ প্রগল্ভতার আড়ালে সংশয় রেখে জানতে চাইল আরশি।

‘‘তাড়াতাড়ি হবে না? তোমারও তো গোটা দিনও লাগল না ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নামতে।’’

লজ্জা পেল আরশি। সবটাই অবশ্য ভান। বলে ওঠে, ‘‘আচ্ছা, তোমার বাবা নেই, একবারও তো বলোনি!’’

‘‘বলার মতো প্রসঙ্গ তো আসেনি। তা ছাড়া আমার বাবা নেই জেনে তোমার সুবিধে বা অসুবিধেটা কী হবে?’’

‘‘মাসিমার মুখ থেকে শুনতে ভীষণ খারাপ লাগছিল আমার। কীভাবে চলে গেলেন সেটাও শুনলাম। খুবই প্যাথেটিক। মেসোমশাইয়ের ফোটো দেখলাম, তোমার মুখের সঙ্গে ভীষণ মিল।’’

কোনও উত্তর দেয় না শৌর্য। চা খেতে থাকে। সমবেদনা দেখিয়ে এ বাড়ির দুই মেম্বারের আস্থা অর্জন করতে চাইছে মেয়েটা। ফের আরশি বলে, ‘‘আমারও মা নেই জানো।’’

‘কীভাবে মারা গিয়েছেন’ জানার কোনও ইচ্ছে নেই শৌর্যর। সত্যিই মা নেই, নাকি এটাও মিথ্যে, তাই বা কী করে বুঝবে? একবার কারও উপর থেকে বিশ্বাস চলে গেলে, তা আর ফেরে না। শৌর্য সরাসরি অন্য প্রসঙ্গে যায়। বলে, ‘‘রেডি হয়ে নিয়ো, দশটা নাগাদ বেরোব। এখনই সাড়ে আটটা।’’

‘‘আমি এত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে কী করব! প্রোডাকশন থেকে আসতে বলেছে তো দুপুর দুটোয়। তোমার যদি অন্য কাজ থাকে বেরিয়ে পড়তে পারো। তোমাদের বাড়ি থেকে সময় মতো বেরিয়ে আমি ট্যাক্সি ধরে নেব। ট্যাক্সিওলাকে গোলপার্ক বললেই তো হবে। তারপর আমি চিনে নিতে পারব।’’

‘‘না, আমার সঙ্গেই বেরোতে হবে তোমাকে। কাজ আছে।’’

‘‘কী কাজ?’’ জানতে চায় আরশি।

শৌর্য উত্তর না দিয়ে কাগজটা তুলে পড়ার ভান করে। আরশি একটু অভিমানী গলায় বলল, ‘‘বুঝেছি। কেন তুমি আমায় সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইছ।’’

‘‘কেন?’’ শৌর্যর স্বরে কৌতূহল।

আরশি বলে, ‘‘মাসিমাও তো সাড়ে দশটা নাগাদ বেরিয়ে যাবে কলেজে। তখন বাড়িতে আমি একা। যদি আলমারি ফাঁকা করে পালাই। এটাই ভাবছ তুমি।’’

সেন্টিমেন্টের খেলা খেলছে আরশি। বেশি এগোতে দেওয়া যাবে না। শৌর্য বলে ওঠে, ‘‘কেন উলটোপালটা বকছ! তোমার ট্রেনের রিজ়ার্ভেশনের জন্য বেরোব। রেলের বড় এক অফিসারের সঙ্গে চেনাজানা আছে আমার। ভিআইপি কোটায় টিকিট বার করে দিতে পারবেন। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলে টিকিটটা কত জরুরি, সেটা বোঝানো সহজ হবে।’’

আরশির বোধহয় প্রস্তাবটা পছন্দ হল না। উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে। শৌর্যর ফাঁকা চায়ের মগটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘‘দেখি, মাসিমা কী বলেন!’’

ছেলেটার উপর এবার একটু সন্দেহ হচ্ছে আরশির। ছেলেটা বলতে শৌর্য আর সন্দেহ মানে যে সব সময় খারাপ কিছু ঘটবে, তা নয়। কিছু একটা ঘটতে চলেছে, সেটা একদম নিশ্চিত। কথা ছিল শৌর্য টিকিটের জন্য রেলের এক অফিসারের কাছে নিয়ে যাবে। যেহেতু আজ উইকডে, অফিসারকে অফিসেই পাওয়ার কথা। শৌর্য এখনও রেলের কোনও অফিসে নিয়ে যায়নি। আরশিকে বাইকে বসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল অ্যাড এজেন্সির অফিসে। সেখানে শৌর্যর নিজের কী একটা কাজ ছিল, আরশি বসেছিল ভিজিটার্স এরিয়ায়। একঘণ্টার মধ্যে কাজ সেরে শৌর্য আরশিকে বাইকে বসিয়ে নিয়ে এসেছে প্রিন্সেপ ঘাটে। বাইকটা রেখেছে বাইরে, পার্কিং লটে। এই ঘাটের নাম আগে শুনেছে আরশি। বাংলা সিনেমা বা মিউজ়িক ভিডিয়োতেও দেখেছে। কিন্তু চোখের সামনে দেখাটা একেবারে অন্য অনুভূতি! দেখার অবশ্য বিশেষ কিছু নেই, স্থাপত্য তেমন জাঁকজমকপূর্ণ নয়। সুন্দর বাগানের মাঝে রহস্যময় এক বারান্দা। খানিক দূরে সেকেন্ড হুগলি ব্রিজটাকে যেন বড় উদ্ধত মনে হচ্ছে।

শৌর্য কিন্তু প্রিন্সেপ ঘাটে ঢোকার সময়ও বলেনি জায়গাটার নাম। বোর্ড থেকে জেনে নিতে হয়েছে আরশিকে। বারান্দা-বাগান ঘুরে নিয়ে আরশিরা এখন বসছে ঘাটের সিঁড়িতে। আরশি নিজের সিদ্ধান্তে কিছু করছে না, অনুসরণ করে যাচ্ছে শৌর্যকে। দ্বিতীয় দফার ঘুম সেরে ওঠার পর থেকেই শৌর্য কেমন যেন বদলে গিয়েছে। ট্যারাবাঁকা কথা শোনাচ্ছিল বাড়িতে। আরশিকে বিদেয় করতে পারলেই যেন বাঁচে। কিন্তু আরশির তো এত তাড়াতাড়ি বিদেয় হওয়ার ইচ্ছে নেই। এক-দুটো দিন থেকে মাকে খোঁজার কাজটা এগিয়ে রাখতে পারলে ভাল হত। সিনেমার জন্য যদি সিলেক্ট না হয়, খোঁজার এই সুযোগটুকুও হারাবে। শৌর্যর মা তাকে থেকে যেতে বলবেন ভেবে, আরশি গিয়েছিল ওঁর কাছে। বলল শৌর্য তাকে দশটার সময় বেরোতে বলছে। কেন বলছে, সেটাও জানাল। আরশির প্রত্যাশামতো মাসিমা বললেন না ‘আজই যাওয়ার কী দরকার? একটু রেস্ট নিয়ে কাল-পরশু যেয়ো।’ বদলে ছেলেকেই সমর্থন করলেন। বলেছিলেন, ‘‘শৌর্যর যখন তুমি গেলে টিকিট পেতে সুবিধে হবে, তা হলে যাওয়াই ভাল। দুপুরে এসে স্নানখাওয়া সেরে রেজ়াল্ট জানতে যেয়ো।’’

মাসিমার কথা অনুযায়ী লাগেজ না নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছিল আরশি। শৌর্য তখন গেটের কাছে বাইকে বসে পড়েছে। খানিক ধমকের সুরে আরশিকে বলল, ‘‘কী হল, ব্যাগ নিলে না! যাও নিয়ে এসো।’’

মাসিমার দিকে তাকিয়েছিল আরশি। উনিই লাগেজ না নেওয়ার কারণটা বললেন। শৌর্য বলল, ‘‘না, না, ওর জিনিসপত্র সব নিয়ে বেরিয়ে পড়ুক। টিকিট পেতে কতক্ষণ লাগবে, বোঝা যাচ্ছে না। তারপর অডিশনের রেজ়াল্ট জানতে আসতে হবে। বিকেলের ট্রেনের যদি টিকিট হয়, এ বাড়িতে আসার সময় হবে না।’’

অগত্যা পিঠে ভারী ব্যাগটা চাপিয়ে ঘুরতে হচ্ছে আরশিকে। রেলের অফিসে না গিয়ে গঙ্গার ঘাটে আসার কারণটাও এখনও অবধি স্পষ্ট হল না। এত গুম মেরে আছে শৌর্য, কিছু জিজ্ঞেস করতে ভয় করছে। সিঁড়িতে বসে সিগারেট খেতে-খেতে এমনভাবে দ্বিতীয় হুগলি সেতুটাকে দেখছে শৌর্য, যেন সরকার থেকে তাকে নির্মাণের ত্রুটি দেখতে পাঠানো হয়েছে। গলা ঝাঁকি দিয়ে আরশি বলেই ফেলে, ‘‘আমরা এখানে এলাম কেন?’’

আরশির দিকে মুখ ফেরায় শৌর্য। বলে, ‘‘তোমার কী মনে হয়?’’

‘‘দুটো সম্ভাবনা মাথায় আসছে। প্রথমটা হল, আজ তো ফিরেই যাব, ট্রেনে অথবা বাসে। যাওয়ায় আগে কলকাতার একটা দ্রষ্টব্যস্থান দেখাতে নিয়ে এসেছ। জায়গাটা নিশ্চয়ই তোমার খুব প্রিয়।’’

থামল আরশি।

শৌর্য জিজ্ঞেস করে, ‘‘দ্বিতীয় কারণটা?’’

‘‘সেটা মিলবে বলে মনে হচ্ছে না। তবু বলি, তুমি বিশেষ কিছু একটা বলতে চাও আমাকে। যার জন্য এখানে আসতে হয়েছে।’’

‘‘বিশেষ কী বলতে পারি বলে মনে হচ্ছে তোমার?’’

‘‘লাভ প্রোপোজ়াল… এরকম সুন্দর পরিবেশে প্রোপোজ় না করলে, রিফিউজ়ড হওয়ার চান্স থাকে,’’ থেমে গিয়ে নীচের ঠোঁট উলটে আরশি বলে, ‘‘প্রোপোজ় তুমি করবে না জানি। সকাল থেকে যা মেজাজ দেখাচ্ছ! কিন্তু একটা ব্যাপার মাথায় ঢুকছে না, টিকিটের ব্যবস্থা করার বদলে তুমি আমায় নিয়ে ঘুরছ কেন? ব্যবস্থা কি হয়ে গিয়েছে ফোনের মাধ্যমে?’’

উত্তর না দিয়ে গঙ্গার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল শৌর্য। শেষ হয়ে আসা সিগারেটের টুকরো ফেলে দিয়ে বলল, ‘‘কলেজে এখন তোমার কোন ইয়ার?’’

‘‘অনার্স ফাইনাল হয়ে গিয়েছে, কেন জিজ্ঞেস করছ?’’ কৌতূহল প্রকাশ করল আরশি।

শৌর্য বলল, ‘‘পরে বলছি। আগে আমার কথাগুলোর উত্তর দাও। তুমি স্টুডেন্ট কেমন?’’

‘‘মাঝারির থেকে একটু ভাল। মাস্টার্স করার মতো নাম্বার থাকবে অনার্সে।’’

‘‘সিনেমায় চান্স পেলে এবং পরের পর অফার আসতে থাকলে, মাস্টার্স তো করা হবে না।’’

‘‘চেষ্টা করব করার। ডিসট্যান্স থেকে হলেও। একান্ত যদি না পারি, তা হলে আর কী করা যাবে। তা ছাড়া এখনই অতদূর অবধি ভাবার কোনও মানে হয় না। আগে চান্সটা পাই।’’

‘‘তার মানে লেখাপড়ার চেয়েও সিনেমায় অভিনয় করাটাকে গুরুত্ব দিচ্ছ বেশি। কেন দিচ্ছ? তোমার তো অভিনয়ে কোনও প্রশিক্ষণ নেই। দেখতে সুন্দর বলে নায়িকা হতে চাইছ?’’

‘‘‘দেখতে সুন্দর’ কথাটা এভাবে কেউ বলে, রাগ-রাগ গলায়? যাই হোক কমপ্লিমেন্ট পেয়ে ভাল লাগল। আর সিনেমার নায়িকা হতে কে না চায়!’’

‘‘না, সকলেই চায় না। নায়িকাদের চেয়েও অনেক সুন্দর দেখতে মেয়ে চাকরিবাকরি, ঘর-সংসার করছে। এমনকী অনেকের অভিনয়ে দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও নায়িকা হওয়ার পিছনে ছোটেনি। এদিকে তুমি নায়িকা হবে বলে এতটাই মরিয়া, তোমার গার্জেনকে মিথ্যে বুঝিয়ে কলকাতায় চলে এসেছ। তিনি জানেন পূর্বাদের বাড়িতে আছ তুমি। পূর্বাও নিশ্চয়ই চায় না, তুমি সিনেমায় অভিনয় করো, তাই ওদের বাড়িতে ওঠোনি।’’

আরশি অবাক হয়ে বলে, ‘‘পূর্বাকে তুমি চেনো?’’

প্রশ্ন এড়িয়ে শৌর্য বলল, ‘‘তোমাকে ট্রেনে তুলে দিতেও এখন ভয় করছে আমার। ধরা যাক সুমিতদার সিনেমায় সিলেক্ট হলে না তুমি। উঠিয়ে দিলাম ফেরার ট্রেনে। দেখা গেল পরের স্টেশনে নেমে পড়ে আবার চলে এলে কলকাতায়। কারণ নায়িকা তোমায় হতেই হবে! ভূত চেপেছে মাথায়। আমার কাছে ফেরার মুখ থাকবে না তোমার। তখন কোন গাড্ডায় গিয়ে পড়বে, কে জানে! বাড়ি থেকে ফোন এলে হয়তো ধরবে না। তাঁদের চোখে নিখোঁজ হয়ে যাবে তুমি।’’

‘‘এবার বুঝেছি। বাবার সঙ্গে ফোনে যখন কথা বলছিলাম, তুমি আড়াল থেকে শুনেছ।’’

‘‘ভাগ্যিস শুনেছিলাম। নয়তো তোমার স্বরূপ জানতে দেরি হয়ে যেত। গরিব ঘরের অল্পশিক্ষিত স্বপ্নবিলাসী ছেলে-মেয়েরা সিনেমার নায়ক-নায়িকা হওয়ার জন্য এরকম ঝুঁকি নেয়। জেনারেলি ছেলেরাই নেয় বেশি। তুমি সচ্ছল পরিবারের শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এই কাজটা করলে! তোমার বাবাকে, আমাকে, আমার মাকে দেদার মিথ্যে বলে চলেছ! যশ-খ্যাতির প্রতি এতটাই লোভ তোমার?’’

‘‘সিনেমায় নামার কোনও ইচ্ছে নেই আমার! আমি আমার মাকে খুঁজতে এসেছি কলকাতায়!’’ একটু চেঁচিয়েই বলে ওঠে আরশি, যা খানিকটা আর্তনাদের মতো শোনায়।

থতমত খেয়ে যায় শৌর্য। বলে, ‘‘মানে?’’

মাঝগঙ্গায় যে মাছ ধরার নৌকোটা ভাসছিল শৌর্য-আরশির সরাসরি, সেটা এখন সেকেন্ড ব্রিজের নীচ দিয়ে চলে গিয়েছে দূরে। ঘাটের পিছনে রেল লাইনে যাতায়াত করেছে দুটো সারকুলার ট্রেন। অনেক পাখিই ডাকতে-ডাকতে উড়ে গিয়েছে আকাশপথ ধরে। মায়ের ব্যাপারটা বলা হয়ে গিয়েছে আরশির। সব শোনার পর খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে শৌর্য। এখন বলে উঠল, ‘‘সেই জন্যই তোমাকে চেনা চেনা লাগছে সুমিতদার!’’

‘‘বুঝলাম না,’’ বলে আরশি।

শৌর্য বলল, ‘‘তা হলে শোনো, তুমি লুকটেস্টে সিলেক্টেড হওনি। সুমিতদাই ক্যানসেল করেছে। তোমাকে রেখে দিয়েছে কোন সূত্রে চেনা লাগছে সেটা মনে করার জন্য। যদি না মনে পড়ে আজ দুপুর অবধি, তখন তোমার সঙ্গে কথা বলে সূত্রটা জোড়া লাগানোর চেষ্টা করবে।’’

‘‘অর্থাৎ মায়ের সঙ্গে আমার মিল খুঁজে পাচ্ছেন সুমিত ঘোষ। যেহেতু বহু বছর আগের কথা, তাই মনে করে উঠতে পারছেন না। কিন্তু মায়ের সঙ্গে তো আমার কোনও মিল নেই। আমি বাবার গড়ন পেয়েছি। বলার পর জিন্‌সের পকেট থেকে মোবাইল বের করে আরশি। স্ক্রিনে আঙুল বুলিয়ে নিয়ে আসে মায়ের ফোটো। বলে, ‘‘তুমিই দ্যাখো, পুরনো একটা ছবি কপি করে রেখেছি মোবাইলে।’’

আরশির ফোন নিয়ে ফোটোটা দ্যাখে শৌর্য। তারপর আরশির মুখের দিকে তাকায়। বারকয়েক এরকম করার পর বলে, ‘‘অ্যাপারেন্টলি তো কোনও মিল পাচ্ছি না। সুমিতদা তোমার মাকে ফেস করেছে, ডিরেকশন দিয়েছে গোটা ফিল্ম জুড়ে। সে হয়তো কোথাও একটা মিল পাচ্ছে। ডিরেক্টরের চোখ তো আর পাঁচজনের মতো নয়।’’

‘‘সুমিত ঘোষকে কি তা হলে মায়ের কথাটা বলব? সন্ধান দিতে পারবেন বলে মনে হয় তোমার? বাবা যখন খোঁজ নিতে এসেছিল, এড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেভাবে অবশ্য চেপেও ধরেনি বাবা।’’

‘‘তুমি যেমনটা মিন করেছে, সুমিতদা কিন্তু তেমন মানুষ নয়। তোমার মায়ের নিরুদ্দেশের পিছনে সুমিতদার হাত নেই বলেই আমার বিশ্বাস। সুমিতদাকে অনেকদিন ধরেই কাছ থেকে দেখছি। আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। তবে হ্যাঁ, তোমার মায়ের উধাও হওয়ার পিছনে যদি কোনও ক্রাইমের ব্যাপার থাকে, যা হয়তো চাপা পড়ে আছে, সুমিতদা চাইবে না সেটা প্রকাশ্যে আসুক। উধাও ষড়যন্ত্রে সুমিতদা ইনভল্ভড না থাকলেও, পুলিশ তাকে ডেকে পাঠাবে, যেহেতু তার ছবি করার পর থেকে তোমার মা নিরুদ্দেশ। পুলিশি ঝামেলা এড়াতে চেয়ে তোমার মায়ের সম্বন্ধে আমাদের কাছে মুখ খুলবে না সুমিতদা। আপাতত সুমিতদাকে কিছু না জানানোই ভাল। অন্য রাস্তায় খোঁজ করতে হবে।’’

‘‘কোন রাস্তায়?’’ জিজ্ঞেস করে আরশি।

‘‘ভাবতে দাও!’’ বলে শৌর্য আরশির মোবাইল ফেরত দিল।

গঙ্গার জল টইটম্বুর। স্রোত ধীরগামী, ঢেউ একেবারই চঞ্চল নয়। শৌর্যকে সব বলতে পেরে আরশির মনের অবস্থা এখন এই নদীর মতোই স্থিতধী। তার আগে আরশির মন ছিল উত্তরবঙ্গের নদীর অনুসারী, কখনও খরস্রোতা, কখনও বা পাথরের মাঝে ক্ষীণতোয়া। শৌর্য ফোন বের করে কাউকে ডায়াল করছে। কানে নিল ফোন। ওপ্রান্তের কথা শুনে নিয়ে বলল, ‘‘ভালই আছি, বিন্দাস! তুমি? … আমাকে একটা ব্যাপারে হেল্‌প করবে প্লিজ়… প্রায় ষোলো বছর আগে এক মহিলা অভিনয় করতে এসেছিলেন কলকাতায়, একটা ছবিতে নায়িকাও হন, সে ছবি রিলিজ় করেনি… তারপর থেকে মহিলার আর খোঁজ নেই! ইন্ডাস্ট্রির কোন লোকের কাছে গেলে ওঁর খবর জানা যেতে পারে, বলতে পারো? মানে এই লাইনের পুরনো অভিজ্ঞ লোকের কথা বলছি… কী নাম? কোথায় গেলে পাব? …বাড়ি যেতে হবে? ফোন নাম্বার আছে? ঠিক আছে, এইটুকুই যথেষ্ট, আমি দেখে নিচ্ছি… থ্যাঙ্ক ইউ গৌতমদা, পরে আবার কথা হবে…’’ ফোন কাটল শৌর্য।

আরশি জিজ্ঞেস করে, ‘‘কাকে ফোন করলে?’’

‘‘আর-একজন ডিরেক্টর। ইন্ডাস্ট্রির অনেক খবরাখবর রাখে। বলছে এই ধরনের খবর মেকআপ আটিস্টরাই সবচেয়ে ভাল দিতে পারবে। নায়িকাদের কাছাকাছি থাকে তারা। মনের কথা আদানপ্রদান হয়। পুরনো এক মেকআপ আর্টিস্টের কাছে খোঁজ নিতে বলল। নবদা, নবকৃষ্ণ কুণ্ডু। আমি চিনি না। বেহালায় থাকে। আবছা মতো একটা অ্যাড্রেস দিল গৌতমদা। সেখানে গিয়ে একটু খোঁজাখুঁজি করতে হবে। ভদ্রলোক এখন আর মেকআপের কাজ করেন না। বাড়িতে বসা, বয়স হয়েছে। ওঁর কন্ট্যাক্ট নম্বর নেই গৌতমদার কাছে…’’ কথাগুলো বলতে-বলতে উঠে দাঁড়িয়েছে শৌর্য। দেখাদেখি আরশিও। শৌর্য বলল, ‘‘চলো, যাওয়া যাক নবকৃষ্ণদার বাড়ি।’’

ঘাট থেকে উঠে রেললাইন ক্রস করার আগে ট্রেন আসার আওয়াজ পেল আরশি। শৌর্য এগিয়ে যাচ্ছে দেখে ধরে নিল ওর হাত। আরশির ঝঞ্ঝাট সামলাতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে বেচারা। ট্রেনের আওয়াজ পায়নি। ক্রসিং-এর কাছে এসে হুইস্‌ল দিতে থাকল ট্রেন। সামনে দিয়ে পাস করে যাচ্ছে। শৌর্য-আরশিকে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কী যে আমোদ হল কিছু চ্যাংড়া ছেলের, নিজেদের কামরা থেকে নানা অঙ্গভঙ্গি, চিৎকার, সিটি দিতে থাকল। এই প্রথম কলকাতাকে বড় কুৎসিত লাগল আরশির।

বেহালার অনেক ভিতরের দিকে নবকৃষ্ণ কুণ্ডুর বাড়ি। বারিকপাড়া। পাড়ার লোক এক ডাকে চেনে। গলির শেষমাথায় প্লাস্টার না হওয়া একতলা জীর্ণ-পুরনো বাড়ি। শৌর্যরা সে বাড়ির সামনের ঘরে বসেছে। শৌর্য কাঠের চেয়ারে, আরশি বিছানায়, নবকৃষ্ণ কুণ্ডুর পাশে। নবকৃষ্ণের হাতে আরশির মোবাইল। মায়ের ফোটো স্ক্রিনে এনে দিয়েছে আরশি। নবকৃষ্ণদার বয়স আন্দাজ করা কঠিন, সত্তরের বেশিই মনে হচ্ছে শৌর্যর। সেটা দারিদ্র্যের জন্যও হতে পারে। ঘোলাটে চশমাপরা নবকৃষ্ণদা কপালে অনেক ভাঁজ ফেলে আরশির মায়ের ফোটোটা দেখছেন। মোবাইল ধরা হাতটা কাঁপছে। স্ক্রিনের আলো নিভে যাচ্ছিল, টোকা মেরে জ্বালিয়ে দিল আরশি। জিজ্ঞেস করে, ‘‘কী, চিনতে পারলেন?’’

মাথা নাড়ছেন নবকৃষ্ণ। বললেন, ‘‘এই ফোনটার মতোই হচ্ছে। মনে পড়তে-পড়তে ফের তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। তোমরা তো আবার সিনেমার নামটাও বলতে পারছ না। পরিচালককে জিজ্ঞেস করছ না কেন? সুমিত ছবিটার নামও বলে দেবে, সন্ধানও দিতে পারে এঁর।’’

‘‘ইন্ডাস্ট্রির লোকজনকে এখনই কিছু জানাতে চাইছি না। ব্যাপারটা জানাজানি হলে ভদ্রমহিলা যদি আত্মগোপন করে থাকেন, আরও আড়ালে চলে যাবেন। আপনিও দয়া করে আমাদের খোঁজ নিতে আসাটা কাউকে জানাবেন না,’’ বলল শৌর্য।

নবকৃষ্ণ বললেন, ‘‘বুঝলাম। ব্যাপারটার মধ্যে একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। তা এই মহিলা কে হয় তোমাদের?’’

‘‘আমার মা,’’ বলে নবকৃষ্ণর হাত থেকে মোবাইলটা নিল আরশি।

সামান্য হোঁচট খেয়েছেন নবকৃষ্ণ। বললেন, ‘‘চশমাটা কি আর চলবে না তা হলে? তোমার মুখের সঙ্গে তো কোনও মিল পাচ্ছি না।’’

‘‘পাওয়ার বেড়েছে মনে হচ্ছে, ডাক্তার দেখিয়ে নিন,’’ বলল শৌর্য।

নবকৃষ্ণ বললেন, ‘‘ডাক্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু চশমার যা দাম আজকাল, হাজারের নীচে তো কথাই বলছে না। বাড়িতে বসে গিয়েছি, এখন এত টাকা পাই কোথায় বলো তো! ছেলে একার হাতে সংসার টানছে।’’

শৌর্য অনুমান করে, ঘুরিয়ে টাকা চাইছেন নবকৃষ্ণ। তখন হয়তো কিছু খোঁজ দেবেন। তাই বলে, ‘‘যদি কিছু না মনে করেন, চশমার টাকাটা আমরা দিতেই পারি।’’

‘‘দিয়ে যাও তা হলে, তবে যদি কোনও খোঁজ না দিতে পারি, চশমাটা আবার খুলে নিয়ে যেয়ো না যেন!’’ বলে হাসতে লাগলেন নবকৃষ্ণ, হাসিতে মজার বদলে বিষণ্ণতাই বেশি। পার্স থেকে দুটো পাঁচশোর নোট বের করে ফেলেছে শৌর্য, নবকৃষ্ণর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘‘আপনি মনে করার চেষ্টা করুন। ইন্ডাস্ট্রিতে খোঁজ খবর নিন গোপনে। আমাদের কথা ভুলেও তুলবেন না। ধরে নিন আপাতত এটাই আপনার কাজ। যার বদলে টাকাও দেব আমরা। এই টাকাটা অ্যাডভান্স।’’

নোট দুটো লুঙ্গির ট্যাঁকে গুঁজে নিয়ে নবকৃষ্ণ বললেন, ‘‘নাম তো বললে শোভা সেনগুপ্ত। ছবিটা আবার রিলিজ় করেনি। একটা খবর অন্তত বের করো সুমিতের থেকে, কথার প্যাঁচ জেনে নাও ওর প্রথম ছবির কতটা অংশ স্টুডিয়োতে শুট হয়েছে এবং কোন স্টুডিয়োয়। এই খবরটুকু পেলে কাজের সুবিধে হবে আমার।’’

‘‘আপনাদের একটু চা দিই?’’ ভিতর দরজার পরদা সরিয়ে জানতে চাইলেন এক মহিলা।

শৌর্য কিছু বলার আগেই নবকৃষ্ণ বলে উঠলেন, ‘‘দুপুরে আর চা খাইয়ো না বউমা। অন্য যেদিন আসবে, ভাল চা এনে রাখব, তখন দিয়ো।’’

মহিলা পরদার আড়ালে চলে গেলেন। শৌর্য নবকৃষ্ণকে বলল, ‘‘আপনার ফোন নম্বরটা দিন।’’

‘‘ও হ্যাঁ, ভাল মনে করিয়েছ! তোমাদের নম্বরটাও দাও,’’ বলে নিজের নম্বর বলতে থাকলেন নবকৃষ্ণ। আরশি-শৌর্য যে যার ফোনে সেভ করে নিল। শৌর্য ভিজ়িটিং কার্ড বের করে এগিয়ে দেয় নবকৃষ্ণকে। বলে, ‘‘এতে আমার নম্বর আছে। আমাকে ফোন করলেই চলবে।’’

শৌর্যর বাড়ানো কার্ড নিয়ে নিল আরশি। বলল, ‘‘আমার নাম্বারটাও দিয়ে রাখি। যদি কোনও কারণে তোমাকে না পান।’’

‘‘ঠিক বলেছ,’’ বললেন নবকৃষ্ণ।

ব্যাগ থেকে পেন বের করে শৌর্যর কার্ডের পিছনে নিজের নম্বর লিখতে থাকে আরশি।

নবকৃষ্ণ কুণ্ডুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল দু’জনে। শৌর্য বাইকের স্ট্যান্ড তুলে উঠে বসতে যাবে, আরশি বলল, ‘‘টাকা তো আমার কাছেও ছিল, তুমি হঠাৎ বের করে দিলে কেন?’’

‘‘তোমার বের করতে সময় লাগত বলে,’’ বলল শৌর্য।

আরশি বলল, ‘‘না মশাই, না। তুমি এখন থেকে আমায় নিজের মনে করতে শুরু করেছ। সাইকোলজির তো কিছুই বোঝো না দেখছি!’’

‘‘সব বুঝি… টাকাটা মেরে দেওয়ার চেষ্টা করছ, সেটাও বুঝতে পারছি! পরে কিন্তু আমি পাই পয়সা চেয়ে নেব,’’ বলল শৌর্য।

আরশি বলে, ‘‘অবশ্যই। পরে কেন, আমি এখনই দিতে পারি।’’

‘‘নাঃ, পরেই নেব… বাইকের তেলের দামটাও তো ধরতে হবে! হিসেব করতে হবে ধীরে সুস্থে,’’ বলে মাথায় হেলমেট চাপায় শৌর্য। কপট রাগে শৌর্যকে দু’হাত দিয়ে ঠেলা মারে আরশি। বলে, ‘‘বদমাইশ কোথাকার!’’

গলি শেষ হয়ে এল, বড় রাস্তায় পড়বে বাইক, শৌর্যর ফোন এল। গলি থেকে বেরিয়ে রাস্তার ধারে বাইক থামাল শৌর্য। মোবাইল বের করে দেখে শুধুই নম্বর। কে করছে ফোন? হেলমেট নামিয়ে ফোন কানে নেয় শৌর্য। ‘হ্যালো’ বলার পর ও প্রান্ত থেকে মহিলাকণ্ঠ বলে ওঠে, ‘‘আমার হেলমেটটা অন্য কেউ পরছে না তো?’’

একচান্সে মেয়েটাকে চিনতে পারে শৌর্য। হেসে ফেলে বলে, ‘‘হঠাৎ হেলমেটের খোঁজ?’’

‘‘কেন বলুন তো? আন্দাজ করতে পারছেন কিছু?’’

‘‘আই গেস, চাকরিটা হয়ে গিয়েছে তোমার।’’

‘‘আরে, আপনি তো দারুণ ইনটেলিজেন্ট! ভাল মানুষরা সাধারণত এতটা বুদ্ধিমান হয় না।’’

‘‘থ্যাঙ্কস ফর দ্য কমপ্লিমেন্ট। এবার থেকে কি কলকাতায় থাকতে হবে?’’

‘‘একদিন অফ পাব, সেদিন বাড়ি যাব। আর একটা ইচ্ছেও আছে, কী সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।’’

‘‘পারছি। কিন্তু আমার যে কোনও ছুটি নেই!’’

‘‘আমি শুনবই না সে কথা। আমাকে নিয়ে বেরোতেই হবে। ওই জার্নিটাতে এখনও আমি আছি। চোখ বুজলেই দেখতে পাই বাড়ি-ঘর, গাছ-পালা, নালা-নদী সজোরে পিছিয়ে যাচ্ছে। রোদ্দুর পর্যন্ত ভয় পাচ্ছে তার নাগালের বাইরে না চলে যাই। আমি পরম নির্ভরতায় হাত রেখেছি রাজকুমারের দু’কাঁধে। আর মাতাল হয়ে যাচ্ছি সেই আশ্চর্য পুরুষের গন্ধে, যাকে আমি জন্মেরও আগে থেকে চেয়েছিলাম।’’

‘‘হাসপাতালের চাকরিতে এত কবিত্ব থাকবে?’’

‘‘থাকবে। সেদিন যখন ইন্টারভিউ দেওয়ার অপেক্ষায় বসে ছিলাম লাউঞ্জে, কাচের দরজার বাইরে সিঁড়িতে পড়েছিল একফালি রোদ, মনে হচ্ছিল দাঁড়িয়ে রয়েছেন আপনি। আমাকে ভরসা দেওয়ার জন্য। ইন্টারভিউটা যাতে ভাল হয়। সত্যিই হয়েছিল। আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা এল বাড়িতে। বাবা-মা, বাড়ির লোক সবাই আপনার গুণগান করছে, আশীর্বাদ করছে। অচেনা কোনও মানুষ এতটা উপকার করতে পারে, ভাবতেই পারছে না। আমি তো আর বলতে পারছি না, আপনি আমার চেনা। বহু-বহু বছর আগের থেকেই চেনা।’’

আবার নার্ভাস লাগতে শুরু করেছে শৌর্যর। মেয়েদের রোম্যান্টিক কথাবার্তার সঙ্গে তাল রাখতে পারে না সে। কথা খুঁজে পায় না। এই মেয়েটা তো আবার হাইভোল্টেজ রোম্যান্টিক। আবার ও প্রান্ত থেকে ভেসে আসে, ‘‘সরি, আপনি কোথায় আছেন, কতটা ফ্রি আছেন, না জেনেই বকে যাচ্ছি। গাড়ি-ঘোড়ার আওয়াজ আসছে। তার মানে আপনি রাস্তায়। এখন ছাড়ছি। পরে আবার জ্বালাব।’’

কেটে দিল ফোন। দুটো জিনিস জানা হল না, মেয়েটার আর হাসপাতালের নাম। বলছে বটে হাসপাতালে চাকরি পেয়েছি, এর তো মেন্টাল অ্যাসাইলামে থাকার কথা। পুরো পাগলি!

মোবাইল পকেটে রেখে বাইক স্টার্ট করতে যাবে শৌর্য, গাড়িটা কেমন যেন হালকা লাগে। মুহূর্তে পিছনে ঘাড় ফেরায়, ফাঁকা হয়ে যায় বুক, আরশি নেই। গেল কোথায়? বেশি চিন্তা করতে হল না। সামনে রাস্তার বাঁদিক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হেলমেট খুলে ফেলেছে মাথা থেকে। শৌর্য জানতে চায়, ‘‘কী হল, গাড়ি থেকে নেমে গেলে কেন?’’

এগিয়ে আসে আরশি বলে, ‘‘ফোনের সব কথাই প্রায় শুনতে পাচ্ছিলাম। কারও ব্যক্তিগত কথা তো শোনা উচিত নয়, তাই দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।’’

‘‘ভাল করেছ, এবার উঠে এসো,’’ বলল শৌর্য।

আরশি জানতে চাইল, ‘‘আচ্ছা, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?’’

‘‘লাঞ্চ সারব কোনও রেস্তরাঁয়। ভীষণ খিদে পেয়েছে। তোমার পায়নি?’’

‘‘ভীষণ নয়, তবে পেয়েছে,’’ বলার পর কী একটু ভেবে নিয়ে আরশি বলে, ‘‘আচ্ছা, আমরা তো বাড়ি গিয়েই খেতে পারি। আই মিন তোমাদের বাড়ি। খেয়েদেয়ে টানা রেস্ট নেব। রেজ়াল্ট তো জানা হয়েই গিয়েছে, প্রোডাকশন অফিসে যাওয়ার দরকার নেই। নবকৃষ্ণবাবু মাকে খোঁজার কাজে নেমে পড়েছেন, সুমিত ঘোষকেও এই মুহূর্তে প্রয়োজন নেই আমার।’’

‘‘কথাটা অবশ্য খারাপ বলোনি। তবে বাড়িতে বোধহয় স্যাড মেনু। মাকে যদি বলতাম দুপুরে খাব, এক দুটো আইটেম বানিয়ে রাখত। এখন ফ্রিজে যা আছে, সবই কাল সন্ধেবেলায় রান্না। রেঁধে গিয়েছে রান্নার লোক স্বপ্নাদি। ওই একই আইটেম আর রিপিট করতে ইচ্ছে করছে না।’’

‘‘ঠিক আছে, তা হলে তাই হোক,’’ বলে বাইকে উঠে বসল আরশি।

আরশিরা এখন যেখানে লাঞ্চ করতে এসেছে, সেটা নাকি পৃথিবীবিখ্যাত। বলেছে শৌর্য। জায়গাটার নাম পার্ক সার্কাস। হোটেলের নামটাও আরশির শোনা। নিয়মিত কলকাতায় আসা বন্ধুদের থেকেই শুনেছে। এখানকার বিরিয়ানি লা জবাব! বিরিয়ানির সঙ্গে আরও কী সব অর্ডার দিল শৌর্য। আস্তে করে গান বাজছে, এসিও চালানো আছে ঠান্ডা কম রেখে। শৌর্য বসেছে আরশির মুখোমুখি। অন্যমনস্ক হয়ে কিছু একটা ভাবছে। ওয়েটারের দিয়ে যাওয়া জলের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে মাঝে-মাঝে। আরশির চোখ চলে যাচ্ছে কাচের দেওয়াল ভেদ করে রাস্তায় এবং তার আশপাশে। সেখানকার দৃশ্য এই হোটেলের সঙ্গে মানানসই নয়। বরং বিপরীত। বড় অপরিচ্ছন্ন, ধুলোমলিন এক কলকাতা। ফুটপাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে ময়লা পোশাকের দু’-চারটে ভবঘুরে মানুষ, ফাটা জামা, খালি পায়ের কয়েকজন কিশোর নিজেদের মধ্যে খেলছে, পাশ দিয়ে বাবু শ্রেণির লোক গেলেই ভিক্ষে চাইছে। দু’জন মহিলাকেও ভিক্ষে করতে দেখা গেল। কোনও চার চাকা থামলেই ছুটে যাচ্ছে। এক মহিলার কোলে বাচ্চা। খানিক আগে বাচ্চা কোলে মা তাকিয়ে ছিল কাচঘেরা এই খাবার জায়গাটার দিকে। আরশির আশঙ্কা হচ্ছে এই দৃশ্য সামনে রেখে সে ঠিক মতো খেতে পারবে কি না। শৌর্যকে বলে, ‘‘আমরা সিট পালটাপালটি করি?’’

‘‘কেন, কী হল?’’ অবাক হয়ে জানতে চায় শৌর্য।

চেয়ার ছেড়ে উঠতে-উঠতে আরশি বলে, ‘‘রাস্তায় ভবঘুরে-ভিখিরি মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাল-ভাল খাবার খেতে অস্বস্তি হবে আমার।’’

‘‘আমার হবে না,’’ বলে শৌর্য নিজের সিট ছেড়ে আরশির জায়গায় গিয়ে বসল। তারপর বলল, ‘‘বালিতে মুখ গুঁজে সত্যকে তো এড়ানো যাবে না। নিদারুণ আর্থিক বৈষম্য তো আছেই আমাদের দেশে। এর মধ্যে থাকতে-থাকতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি আমরা। তবে তুমি যাদের দেখে সিট চেঞ্জ করলে, সকলেই ভিখিরি নয়, পাতাখোরও আছে।’’

‘‘পাতাখোরটা কী ব্যাপার?’’ জানতে চায় আরশি। শব্দটা আগেও শুনেছে, মানে বোঝেনি।

‘‘হেরোইনখোর। রাংতা পাতার উপর রেখে খাওয়ার জন্য ওই নামটা হয়েছে, নাকি হেরোইন তৈরিতে আফিম গাছের রোল আছে বলে, ঠিক জানি না। আর ওই বাচ্চাগুলোর বোধহয় অ্যাডহেসিভের নেশা। দেদার বিকোচ্ছে দোকানে। গন্ধ শুঁকে কিংবা খেয়ে নেশা করে। খরচ কম।’’

শৌর্যর বলা শেষ হতেই টেবিলে স্যালাডের প্লেট এনে রাখল ওয়েটার। অ্যাডহেসিভের নেশার ব্যাপারটা প্রথম শুনল আরশি। আপাতত বিশদে জানার ইচ্ছে করছে না। শৌর্যর কাছে অন্য একটা জরুরি বিষয় জানার আছে। স্যালাডের প্লেট থেকে শশার টুকরো তুলে নিয়ে কামড়ায় আরশি। জিজ্ঞেস করে, ‘‘আমি যে হেলমেটটা পরছি, সেটা তোমার গার্লফ্রেন্ডের?’’

‘‘হ্যাঁ, তুমি কী করে জানলে?’’ নিরাসক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল শৌর্য।

আরশি বলল, ‘‘ফোনের ওইটুকু কথা শুনেই নেমে গিয়েছিলাম বাইক থেকে। গার্লফ্রেন্ডের নাম কী, কী করে?’’

‘‘শুনে তোমার কী লাভ?’’

‘‘কিছুই না, জাস্ট কৌতূহল। বন্ধু হিসেবে জিজ্ঞেস করছি।’’

‘‘আমি কি একবারও তোমায় জিজ্ঞেস করেছি, তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে কি না?’’

‘‘সে তো আমার ব্যাপারে তোমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই বলেই জিজ্ঞেস করোনি।’’

সতর্ক হয় শৌর্য, কথার প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করছে আরশি। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে শৌর্য বলে, ‘‘ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলাম, তোমার বাবাকে কিন্তু এবার জানানো উচিত তুমি কোথায় আছ এবং কী কারণে এসেছ কলকাতায়।’’

‘‘কে জানাবে? তুমি? তোমার কাছে তো বাবার ফোন নম্বর নেই।’’

‘‘তুমি জানাবে। জানানোটা ভীষণ দরকার। অন্যের মুখ থেকে যদি জানতে পারেন, দোষারোপ করবেন আমাকে। আমাদের বাড়িতে হয়তো পুলিশ পাঠাবেন।’’

‘‘বাবা জানবে কী করে? আর যদি জেনেও যায়, পরিষ্কার বলে দেব, আমি সাবালিকা, আঠারো পেরিয়ে গিয়েছি। নিজের ইচ্ছেমতো যেখানে খুশি যেতে পারি।’’

‘‘তোমার ডায়লগ শুনে পুলিশ মাথা নিচু করে থানায় ফিরে যাবে, ব্যাপারটা এত সহজ নয়। তোমার বাবা আমার নামে মেয়েকে ইলোপ করা ছাড়াও, আরও নানাবিধ চার্জ আনতে পারেন। তখন থানা-কোর্ট ঘুরে মরতে হবে আমাকে। ঝামেলাটা কেন ঘাড়ে নেব আমি? তার উপর মায়ের দিকটাও দেখতে হবে, এই সব ঘটনায় মায়ের মনের অবস্থা কী হবে বলো তো?’’

‘‘তা ঠিক,’’ বলে চুপ করে ভাবতে থাকে আরশি।

টেবিলে খাবার নিয়ে এল ওয়েটার। দুটো প্লেটে সার্ভ করে দিচ্ছে। আরশি শৌর্যকে বলে, ‘‘এক-দুটো দিন তোমাদের বাড়িতে থাকতে দাও, বাবাকে যদি ফোন করি, এক সেকেন্ড সময় নষ্ট না করে নিতে চলে আসবে। মাকে আর খোঁজা হবে না আমার।’’

ওয়েটার খাবার সার্ভ করে চলে গেল। শৌর্য বলল, ‘‘তোমার বাবা কি চান না, মা ফিরে আসুন?’’

‘‘কেন চাইবে বলো? মা তো স্বেচ্ছায় সংসার ফেলে চলে গিয়েছে। অভিমান হবে না বাবার? তাও তো বাবা প্রথম দিকে খোঁজখবর করছিল। মা ফোনে হুমকি দিয়ে খুঁজতে বারণ করেছে।’’

‘‘দোষ যখন মায়ের, তা হলে তুমি কেন তাঁকে খুঁজছ?’’ জিজ্ঞেস করে খাওয়া শুরু করল শৌর্য।

আরশি বলে, ‘‘মা-মেয়ের সম্পর্কটা তো মান-অভিমানের নয়। একেবারে নাড়ির টান। মাকে আমি ভীষণ মিস করি। মা বেঁচে থাকতে কেন আমি তার সঙ্গ পাব না? মা-ও ইদানীং আমায় মিস করছে। তাই তো ফোন করেছিল।’’

দু’জন খাওয়ায় মন দেয়। আরশি খাবার মুখে থাকা অবস্থায় জড়ানো উচ্চারণে বলে, ‘‘সত্যি, এত ভাল বিরিয়ানি আমি কখনও খাইনি। যাকে বলে অসাম! ভাগ্যিস সিটটা চেঞ্জ করলাম, রাস্তার দিকে চোখ গেলে এই টেস্টটা বোধহয় পেতাম না। এখন বালিতে মুখ গুঁজে খেয়ে যাচ্ছি।’’

নিজের রসিকতায় নিজেই হাসছে আরশি। শৌর্য যোগ দিল না মজায়। মাথায় সিরিয়াস ভাবনা চলছে। বলে ওঠে, ‘‘আমাদের বাড়িতে দু’দিন থাকাটাও রিস্ক হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। তবু ধরে নিলাম, থাকলে দুটো দিন। তারপর কী করবে?’’

‘‘এর মাঝে ফোন করব পূর্বাকে। ততদিনে নিশ্চয়ই কাকিমা অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠবেন। পূর্বা আমাকে ডেকে নেবে ওদের বাড়িতে। তখন আর বাবাকে নিয়ে চিন্তা থাকবে না। বাবাকে বলব পূর্বার অফিসের ক্রাইসিস কেটে গিয়েছে। যে দিন ফেরার টিকিট আছে আমার, ওই দিনই ফিরব।’’

থামতে হল আরশিকে, ফোন এসেছে শৌর্যর। টেবিলে রাখা ফোনের স্ক্রিন দেখে শৌর্য বলল, ‘‘সুমিতদার ফোন। এখনই চলে আসতে বলবে। প্রোডিউসরের সঙ্গে মিটিং।’’

কলটা ধরল না শৌর্য। বলল, ‘‘হ্যাঁ, বলো। কী বলছিলে যেন?’’

আরশি শুরু করে, ‘‘পূর্বাকে অবশ্য এবার আমায় সত্যিটা বলতে হবে। জানাতে হবে মাকে খুঁজতে এসেছি। কারণ এখন আমি যেটুকু ঘোরাঘুরি করব, সবটাই মায়ের জন্য। পূর্বা আমাকে সঙ্গ দেবে ওর সময়-সুবিধে মতো। ওকে বলব, এখনই বাবাকে কিছু জানাস না।’’

আবার ফোন বাজছে শৌর্যর। ঝুঁকে পড়ে স্ক্রিন দেখে বলল, ‘‘এ তো মহা মুশকিল, সুমিতদাই করছে আবার। কীসের এত তাড়া?’’

বাঁ হাতে কল রিসিভ করে স্পিকার অন করে শৌর্য। বলে, ‘‘কী বলছ?’’

অপর প্রান্ত থেকে অধৈর্য গলায় সুমিতদা বলে, ‘‘আরে, আসবি কখন? প্রোডিউসর এসে বসে আছে।’’

‘‘যেতেই হবে? একটা মিটিং-এ আছি যে।’’

‘‘ঢপ মারিস না। মিটিং-এর ব্যাকগ্রাউন্ডে বুঝি গান বাজে?’’

‘‘প্রোডিউসরের সঙ্গে আমার কী কাজ?

‘‘যাঃ শালা! ভুলে গেলি? মহুলিয়ায় পাঠালাম পুরনো বাড়ির ছবি তুলে আনতে, নিয়ে এলি রং করা ঝকঝকে বাড়ির ছবি। প্রোডিউসর চাইছে না ও বাড়িতে শুটিং হোক।’’

‘‘বাড়িটাকে আমি রং করাইনি এবং ছবি তোলার আগে বাড়ির কন্ডিশন তোমায় জানিয়েছিলাম।’’

‘‘আরে ভাই, সে কথা কি আমি অস্বীকার করছি! কিন্তু মালটাকে এ বাড়িটা কিছুতেই খাওয়াতে পারছি না। শালা গোঁ ধরে বসে আছে। আমি, নিবেদিতা দু’জনেই ফেল করে গিয়েছি। তুই ভাই একবারটি আয়।’’

‘‘আমি গেলে সুবিধেটা কী হবে শুনি?’’

‘‘তুই বলবি, লোকেশন শ্যুট করতে গিয়ে আরও দু’-একটা পুরনো বাড়ি দেখেছিস। এই গল্পের সঙ্গে সেই বাড়িগুলো দিব্যি মানিয়ে যায়।’’

‘‘সেরকম কোনও বাড়ি তো আমি দেখিনি আশপাশে।’’

‘‘কতটুকু জায়গা আর ঘুরেছিস? আবার আমি রেইকি করতে যাব। খুঁজে নেব মানানসই বাড়ি। তুই আপাতত মিথ্যেটুকু বলে যা। নয়তো মালটাকে ধরে রাখা যাবে না। হড়কে যাবে।’’

‘‘ঠিক আছে, একঘণ্টার মধ্যে যাচ্ছি।’’

‘‘অত দেরি করিস না বাবু। আর কত আটভাট বকব মালটার সঙ্গে। এ ব্যাটা আবার দিনের বেলা মদ খায় না। প্লিজ়, জলদি আয়।’’

ফোন কাটল সুমিতদা। শৌর্য আরশিকে বলে, ‘‘শুনলে তো সব।’’

‘‘শুনলাম। আমার কথা তো কিছু জিজ্ঞেস করলেন না! আমারও তো যাওয়ার কথা ওঁর অফিসে। উনি ভাল করেই জানেন তোমার সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। পার্ক সেন্টার হোটেলে ওঁকে বলে তুমিই আমাকে রাতে থাকার ব্যবস্থা করেছ।’’

‘‘প্রোডিউসর বেঁকে বসলে, পরিচালক নিজের বাবার নামও এক চান্সে মনে করে উঠতে পারে না। সেখানে তুমি তো কোন ছার!’’

‘‘মাকে খোঁজার স্বার্থে তোমার সঙ্গে আমারও কি যাওয়া উচিত প্রোডাকশন অফিসে?’’

‘‘না, আপাতত যাওয়ার দরকার নেই। তোমার কথা যেমন ভুলে আছে, থাক। তোমাকে দেখলে হঠাৎ যদি প্রথম নায়িকাকে মনে পড়ে যায় এবং তাঁর সম্বন্ধে কিছু কথা গোপন করার থাকে, তখন আর সুমিতদার মুখ থেকে কোনও তথ্যই বের করা যাবে না। তার চেয়ে বরং নবকৃষ্ণদার পরামর্শ মতো আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সুমিতদার থেকে জেনে নেব রিলিজ় না হওয়া সিনেমার নাম, কোন স্টুডিয়োতে কতটা অংশ শুট হয়েছিল সিনেমাটার, আরও টুকটাক খবর।’’

এবার বাকি খাবার তাড়াতাড়ি খেতে থাকে শৌর্য। ইশারায় ওয়েটারকে বিল আনতে বলে।

বিল এবং হাত ধোয়ার গরম জলের বাটি দিয়ে গেল ওয়েটার। হাত ধুতে-ধুতে শৌর্য বলল, ‘‘তোমাকে বাড়িতে রেখে সুমিতদার কাছে যাব।’’

আরশির হাত ধোয়া হয়ে গিয়েছে। ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে যাচ্ছিল, শৌর্য ততক্ষণ ক্রেডিট কার্ড রেখে দিয়েছে বিলের ফোল্ডারে। আরশি বলে, ‘‘তোমার কাছে ধার বাড়ছে আমার। সব অর্থে।’’

শৌর্যর চোখ যায় আরশির প্লেটে। বলে, ‘‘অনেকটাই তো ফেলে রাখলে। এদিকে বলছিলে অসাম টেস্ট। ডায়েট করছ?’’

‘‘আমার খাওয়া চিরকালই কম। জোর করে খাওয়ানোর তো কেউ ছিল না… মায়েরা যেমন করে খাওয়ায়… আমার ডায়েট হল বাই ডিফল্ট।’’

শৌর্যর ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ। বিছানা ছাড়তে মন চাইছে না। কাল বেশ রাত করে বাড়ি ফিরেছে। সুমিতদার অফিসেই দেরি হয়ে গেল। প্রোডিউসরকে যেমন-তেমন করে বোঝানো গিয়েছে। এক সপ্তাহ সময় চাওয়া হয়েছে অন্য বাড়ির ছবি দেখানোর জন্য। প্রোডিউসর ফিরে যাওয়ার পর সুমিতদা শৌর্য-নিবেদিতাকে নিয়ে মিটিং-এ বসল। বলল, ‘‘প্ল্যান দে কী করে ওই লোকেশনে পুরনো বাড়ি পাওয়া যায়। আমি আগের বার অনেকটা এলাকা ঘুরে দেখেছি, ওরকম বাড়ি আর একটাও নেই।’’

‘‘লোকেশন পালটাও, রাঁচি-হাজারিবাগের দিকে খোঁজ করে দেখা যেতে পারে,’’ বলেছিল নিবেদিতা।

আলমারি খুলে স্কচের বোতল বের করেছিল সুমিতদা। লকারে থাকে বোতল, চাবি সুমিতদার কাছে। তিনজনের জন্য গ্লাসে ঢেলে এক সিপ মেরে বলেছিল, ‘‘রাঁচি-হাজারিবাগে গিয়ে হয়তো বাড়ি পাব, তখন যদি প্রোডিউসরের লোকেশন পছন্দ না হয়। এর মাঝামাঝি একটা রাস্তা বার করতে হবে।’’

প্যাকেট ছিঁড়ে চানাচুর, চিপস ঢেলে নিবেদিতা বলেছিল, ‘‘উপায় আছে, দু’জায়গায় শুট করতে হবে। বাড়ির জন্য হাজারিবাগ, নেচার মহুলিয়ার। তাতে খরচাও বাড়বে। দেখো, তোমার প্রোডিউসর তাতে রাজি হয় কি না।’’

সুমিতদা বলেছিল, ‘‘হবে না। বাজেট ফিক্সড হয়ে গিয়েছে। যা করার ওই টাকার মধ্যেই করতে হবে। উনিশবিশ হতে পারে। বড় অ্যামাউন্ট কিছুতেই দেবে না।’’

শৌর্য বলেছিল, ‘‘তোমরা তো ধরেই নিচ্ছ হাজারিবাগে প্রোডিউসরের পছন্দমতো এবং সিনেমাটার উপযোগী বাড়ি পাবে। আগে দেখো, পাও কি না। তারপর তো বাজেটের কথা।’’

গ্লাস শেষ করে উঠে পড়েছিল নিবেদিতা। দু’পেগের বেশি খায় না। বলেছিল, ‘‘আমি চলি। বেশি রাত করলে ঘরে ঢুকতে দেবে না মালকিন। আর এই প্রবলেম আজকের মধ্যে সল্ভড হওয়ারও নয়।’’

অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে থমকে দাঁড়িয়েছিল নিবেদিতা। শৌর্যকে বলেছিল, ‘‘জলপাইগুড়ির মেয়েটা রেজ়াল্ট জানতে এল না। কেন বলো তো? সিনেমায় চান্স পাওয়ার জন্য পাবলিক হেদিয়ে মরে। এই মেয়েটার কী হল?’’

‘‘আমি কী করে জানব!’’ আশ্চর্য হওয়ার ভান করেছিল শৌর্য। একই সঙ্গে প্রমাদ গুনেছিল, আরশির কথা এতক্ষণ মাথায় ছিল না সুমিতদার। প্রসঙ্গটা এসে পড়ায় যদি মনে পড়ে। তার সঙ্গে হয়তো মনে পড়ে গেল নিজের প্রথম সিনেমার নায়িকার কথা। তখন আরশির অডিশন দিতে আসার ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে পড়বে। উধাও হয়ে যাওয়া সেই নায়িকার ব্যাপারে মুখ খুলবে না। সেরকম কিছু ঘটেনি অবশ্য। সুমিতদা নিবেদিতাকে বলেছিল, ‘‘শৌর্যই মেয়েটাকে বলে দিয়েছে, সিলেক্ট হয়নি। মেয়েটাকে হোটেলে রাখতে গিয়েছিল শৌর্য। সিলেক্টেড হয়নি জানার পর কেন সে আর এখানে আসবে! বাড়ি ফিরে গিয়েছে।’’

কথা বাড়াতে না চেয়ে চুপ করেছিল শৌর্য। নিবেদিতা বলতে লাগল, ‘‘মেয়েটাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল। টিভি সিরিয়ালে কাস্টিং করতাম। কন্ট্যাক্ট নম্বর অবশ্য আছে। কথা বলে দেখি।’’

নিবেদিতা চলে যাওয়ার পর সুমিতদা বলতে শুরু করল, ‘‘হ্যাঁরে, এই প্রোডিউসরটাও পালাবে তা হলে! কিছুই কি করা যায় না? কবে থেকে কাজ না করে বসে আছি বল তো! আবার কি সেই ম্যান্তামারা টিভি সিরিয়ালে ডিরেকশন দিতে হবে?’’

নেশা হয়ে গিয়েছিল সুমিতদার। ততক্ষণে হয়তো পাঁচ-ছ’ পেগ চাপিয়ে ফেলেছে। শৌর্য দুইয়েতেই আটকে। মদ তার প্রিয় জিনিস নয়। কাউকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য খায় অল্প। সুমিতদার নেশা হয়ে যাওয়াটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছিল শৌর্য। বলেছিল, ‘‘এত ভেঙে পড়ছ কেন? জীবনের প্রথম সিনেমাটার কথা ভাবো। নিশ্চয়ই অনেক বাধাবিপত্তির মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলে। সেই সব দিনের কথা ভেবে সাহস আনো মনে।’’

‘‘আর বলিস না! সে যা দিন গিয়েছিল, ভাবতে পারবি না তোরা,’’ বলে গ্লাস শেষ করে নতুন করে ভরে নিয়ে জীবনে প্রথম সিনেমা বানানোর গল্প বলে গিয়েছিল সুমিতদা। ফাঁকে-ফাঁকে প্রশ্ন করে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো জেনে নিচ্ছিল শৌর্য। আরশির মায়ের ব্যাপারে বেশ কিছু কথা জানা গেল। ছবির নাম, কোন স্টুডিয়োয় কতটা অংশ শুট হয়েছিল, সবটাই জেনে নিয়েছে শৌর্য। প্রথম সিনেমার নায়িকার কথা বলতে গিয়ে একবারও আরশির কথা মনে আসেনি সুমিতদার। তা হলে কেন ওকে চেনা মনে হয়েছিল, সেটা এখনও স্পষ্ট হচ্ছে না।

শৌর্য বাড়ি ফিরল রাত বারোটা নাগাদ। মাকে বলাই আছে, দশটার বেশি ওর জন্য অপেক্ষা যেন না করে। খেয়ে নিয়ে শুতে চলে যাবে। চাবি তো ওর কাছে একটা আছেই।

মা শুয়ে পড়লেও আরশি জেগেছিল। শৌর্য ইন্টারলক খুলে ভিতরে ঢুকে জুতো ছাড়ছে, ক্যামেরায় ব্যাগ নিতে এগিয়ে এসেছিল আরশি। বলল, ‘‘এত দেরি হল?’’

ব্যাগটা আরশির হাতে দিয়ে খানিক সৌজন্যের গলায় শৌর্য বলেছিল, ‘‘আমাদের লাইনে এরকম দেরি হয়েই থাকে।’’

কথার ঢঙে বোধ হয় সন্দেহ হয়েছিল আরশির, আরও কাছে এসে শিয়োর হয়ে নিয়ে বলেছিল, ‘‘মদও খাও তুমি! কোনও নেশাই তো বাকি রাখোনি দেখছি!’’

‘‘মদ আর সিগারেট ছাড়া আর কিছু খাই না, তাও খুব কম… আর আজকের ড্রিঙ্ক করাটা সম্পূর্ণ তোমার জন্য! সেই তুমিই কিনা হ্যাটা করছ!’’ নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে-যেতে বলেছিল শৌর্য। একই সঙ্গে টের পাচ্ছিল সুমিতদার স্কচটা বেশ খানদানি। আলতো করে অ্যারেস্ট করে নিয়েছে।

আরশি বলেছিল, ‘‘কী! আমার জন্য ড্রিঙ্ক করতে হল? কেন, কী করেছি আমি?’’

ঘরে ঢুকে এসেছিল আরশি, শৌর্য বলেছিল, ‘‘প্লিজ় বাইরে যাও। জামা-কাপড় ছাড়ব। খাবার যদি গরম করতে পারো তো করো, নয়তো আসছি আমি।’’

‘‘তবু ভাল, ড্রিঙ্ক করে এসে বাড়িতে খাব বলছ! মাতালরা তো বলে না,’’ খোঁচা মেরে চলে গিয়েছিল আরশি।

ডাইনিং-এ এসে শৌর্য দেখেছিল আরশি খাবার সাজিয়েছে টেবিলে। দু’জনের খাবার। শৌর্যর অপেক্ষায় ততক্ষণ অবধি খায়নি মেয়েটা। ড্রেস চেঞ্জ করার পর চোখেমুখে জল দিয়েছিল শৌর্য, ঘোর কেটে গিয়ে তখন মোটামুটি ফ্রেশ। ডাইনিং-এর চেয়ারে বসতে-বসতে বলেছিল, ‘‘অনেক খবর এনেছি তোমার মায়ের।’’

সুমিতদার থেকে সংগ্রহ করা সমস্ত তথ্য এক-এক করে আরশিকে বলেছিল শৌর্য। তথ্যগুলো জোগাড় করাটাকে সাফল্য হিসেবে ধরাই যায়। কিন্তু সেগুলো যে আনন্দের ছিল না। গভীর বিষাদের। আরশির মুখে ছায়া জমা হয়েছিল রাজ্যের।

আজ সকালে স্বমহিমায় ফিরে গিয়েছে আরশি। মায়ের সঙ্গে খোশমেজাজে গল্প করছে। কথাগুলো ধরতে না পারলেও, বিছানায় শুয়ে দু’জনের গলা কানে আসছে শৌর্যর। ভাল লাগছে বেশ। অন্য দিন এসময় বাড়ি থাকে নিস্তব্ধ। মাঝে-মাঝে পাখির ডাক। যা নিস্তব্ধতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। মা আরশিকে ঠিক কী চোখে দেখছে বোঝা যাচ্ছে না। ভাবী বউমা বলে ধরে নিল নাকি, কে জানে! শৌর্যকে তো এখনও কিছু জিজ্ঞেস করেনি।

বাড়ির ডোরবেল বেজে উঠল পরপর দু’বার। এ সময় কে এল? চেনাজানা কেউ এভাবে বেল বাজায় না। দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। তারপর এক পুরুষকণ্ঠ। ধমকের সুরে কী যেন বলছেন। বিছানা থেকে লাফিয়ে নামে শৌর্য।

ড্রয়িং-এ গিয়ে দেখে, সদর পেরিয়ে দাঁড়িয়ে দুই সুবেশ ভদ্রলোক। একজন মেজাজের সঙ্গে মাকে বলছে, ‘‘ছেলেকে ডেকে দিন এক্ষুনি।’’

ভদ্রলোকের পরিচয় আন্দাজ করতে পারছে শৌর্য। এর মেয়ে এখনও সিনে নেই কেন? ভয়ে লুকিয়ে পড়ল নাকি? এগিয়ে গিয়ে শৌর্য বলে, ‘‘কী ব্যাপার, এভাবে কথা বলছেন কেন?’’

শৌর্যর হাইট ছয়ের কাছাকাছি। পেটানো চেহারা। বারমুডা টি-শার্ট পরে থাকায় শরীর এখন অনেকটাই অনাবৃত। একটু বুঝি ধস খেলেন ভদ্রলোক। বললেন, ‘‘তুমি, মানে আপনি শৌর্য চৌধুরী?’’

‘‘হ্যাঁ, আপনি?’’

ঘরে ঢুকল আরশি। বলে উঠল, ‘‘বাবা তুমি! কাকুও এসেছেন! চিনলে কী করে এ বাড়ি? কাকুরও তো বাড়িটা চেনার কথা নয়।’’

‘‘তা হলে ভেবে দ্যাখ, কী অবস্থা গিয়েছে আমাদের! ওঁর স্ত্রী হাসপাতালে। উনি আমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছেন তোকে খুঁজতে।’’

‘‘ভেরি সরি কাকু। কাকিমা এখন কেমন?’’

‘‘আগের থেকে অনেক ভাল, কাল-পরশু রিলিজ় করে দেবে মনে হচ্ছে,’’ আরশির বাবার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি উত্তর দিলেন। পরিচয় আন্দাজ করতে পারে শৌর্য, আরশির বান্ধবী পূর্বার বাবা। ফের আরশি বলে, ‘‘বাবা, তুমি এদেরকে উলটোপালটা কিছু বলোনি তো? পিছনের বাগানে ছিলাম আমি, আসতে দেরি হয়ে গেল।’’

‘‘উনি চোটপাট শুরু করেছিলেন। একটু দেরি করে এন্ট্রি নিলে তুমি।আমি তো ভাবলাম পাঁচিল ডিঙিয়ে পালিয়েছ।’’

শৌর্যর কথায় কর্ণপাত করল না আরশি। বলল, ‘‘বাবা, আমি কিন্তু স্বেচ্ছায় এঁদের বাড়িতে উঠেছি। বা বলা ভাল এঁরা আশ্রয় দিয়েছেন আমাকে।’’

‘‘ও সব শেখানো বুলি আমায় শুনিয়ো না। ব্যাগ নাও, বেরিয়ে এসো। কেন এখানে উঠতে হল, সেটা পরে আমি জেনে নেব।’’

‘‘প্রথমবার এলেন, এসেই চলে যাবেন? একটু চা অন্তত খেয়ে যান,’’ বললেন অপর্ণা। শৌর্য মায়ের সৌজন্য দেখে অবাক হয়। থতমত খেয়ে গিয়েছেন দুই ভদ্রলোক। ফের অপর্ণা বলে ওঠেন, ‘‘আপনারা যে পুলিশ নিয়ে আসেননি, এ জন্য আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ। আপনার মেয়েকে কেন আমার বাড়িতে উঠতে হল, সেটা খুব পরিষ্কার করে জানা নেই আমার। আপনাকে এভাবে আসতে দেখে, কৌতূহল আরও বাড়ল। প্লিজ়, আপনারা বসুন। চা খেতে-খেতে সব কথা শুনব।’’

কলেজ পড়ায় মা, পার্সোনালিটি অন্যমাত্রার! দুই ভদ্রলোক বসলেন সোফায়। শৌর্য ভদ্রস্থ জামাকাপড় পরতে গেল।

বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে শৌর্য ফিরল একটু দেরিতে। ড্রইং-এ তখন তর্ক-বিতর্ক তুঙ্গে। বাবার উপর চোটপাট করছে আরশি। শৌর্যকে দেখে সোফা ছাড়ল মা। বলল, ‘‘তুই বোস। আমি তোর চা নিয়ে আসছি।’’

শৌর্য বসল মায়ের জায়গায়। আরশি বসেনি। বাবার মুখোমুখি দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বলছে, ‘‘তুমি আমাকে জানাওনি মা সিনেমায় ‘রায়া সেন’ নাম নিয়েছিল। সিনেমাটার নামও চেপে গিয়েছ। আরও হয়তো অনেক কিছুই গোপন করেছ যাতে মায়ের কাছে পৌঁছতে না পারি। কেন বলোনি এসব কথা? আমার কি জানার অধিকার নেই?’’

‘‘আছে, কিন্তু সেসব শুনে কি মায়ের জন্য গর্ব হত তোর? মন খারাপ হত! সত্যিই তোকে আমি অনেক কিছু বলিনি… চেয়েছি শোভার ওই সব কীর্তি থেকে তোকে দূরে রাখতে, শিশুমনে প্রভাব পড়তে পারে ভেবে,’’ বললেন আরশির বাবা রজত সেনগুপ্ত।

আরশি বলে, ‘‘আমার মনে হয় না এটাই একমাত্র কারণ। আরও অনেক ব্যাপার আছে।’’

‘‘সেগুলো কী?’’ জানতে চাইলেন আরশির বাবা।

পূর্বার বাবা একটু উসখুস করছিলেন, অস্বস্তি হচ্ছিল পারিবারিক গোপন কথাবার্তার সামনে বসে থাকতে। আরশির বাবার উদ্দেশে বললেন, ‘‘রজতবাবু, আমি উঠি। হাসপাতালের খোঁজখবরগুলো নিই। বাড়িতে কেউ না-কেউ থাকবেই, আরশিকে নিয়ে চলে আসবেন।’’

‘‘ঠিক আছে, তাই হবে… আপনাকে অনেক ট্রাবল দিচ্ছি!’’ বললেন রজতবাবু।

‘‘না না, ট্রাবলের কী আছে! আমি তো আপনার পরিবারের লোক,’’ বলে সোফা ছেড়ে উঠলেন পূর্বার বাবা। মা চা নিয়ে এল। শৌর্য মায়ের হাত থেকে চায়ের মগ নেয়। মা পূর্বার বাবাকে বলে, ‘‘চলে যাচ্ছেন? আবার আসবেন কিন্তু।’’

‘‘আসব, দেখা হবে…’’ বলে জোড়হাত করে নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন পূর্বার বাবা।

মা বড় সোফাটায় বসল। দু’হাত তফাতে আরশির বাবা। আরশি এতটাই উত্তেজিত, পূর্বার বাবার ছেড়ে যাওয়া সোফাতে বসছে না। দাঁড়িয়েই রইল। বাবার উদ্দেশে বলে ওঠে, ‘‘মায়ের খোঁজে তুমি কোনওদিনই সুমিত ঘোষের কাছে যাওনি। সুমিত ঘোষ নিজে বলেছেন শৌর্যকে।’’

‘‘উনি মিথ্যে বলছেন। আমি গিয়েছিলাম এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে। আমাদের সঙ্গে ভাল করে কথাই বলেননি সুমিতবাবু।’’

‘‘তোমার সেই বন্ধু এখন কোথায়?’’

‘‘কেন? তুমি কি তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে আমরা সুমিত ঘোষের কাছে গিয়েছিলাম কিনা? বাবার উপর হঠাৎ এত অবিশ্বাসের কারণ?’’

‘‘তুমি যদি বলতে তোমার সেই বন্ধু মারা গিয়েছে, মিটে যেত। কারণটা যখন জানতেই চাইছ, বলি। মা একটা সিনেমায় চান্স পাওয়ার পর আর পাচ্ছিল না। পরিচালকদের দোরে-দোরে ঘুরেছে। ফ্রাস্ট্রেশনে মদ খাওয়া ধরেছিল মা। তোমার কানে সেটা গিয়েছে, তাই আর সেভাবে মায়ের খোঁজ করোনি। পাছে নষ্ট বউকে ঘরে তুলতে হয়।’’

মাথা নিচু করে নিয়েছেন আরশির বাবা। মেয়ে এখন যে খবরগুলো দিচ্ছে, তার অনেকটাই সত্যি। সুমিতদার থেকে সব শুনে আরশিকে কাল রাতে বলেছিল শৌর্য। সুমিতদা বলেছে, ‘‘শোভা সেনগুপ্তর হাজ়ব্যান্ড তার কাছে কোনও দিনই আসেনি। বরং শোভাদেবী সুমিতদার কাছে এসে বলতেন, ‘বর আর ঘরে নেবে না বলেছে। আমাকে ছোটখাটো যে-কোনও পার্ট দিন।’’’

রজতবাবু সত্যিই কি সংসারে ফেরাতে চাননি স্ত্রীকে, নাকি শোভাদেবী কথাগুলো বলতেন করুণা আদায়ের জন্য, সে ব্যাপারে তো নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। এই সংশয়ের কথা আরশিকে বলেছিল শৌর্য, সে কানে নেয়নি। মায়ের পক্ষ নিয়ে বসে আছে। মেয়ের চোটপাটে বিধ্বস্ত অবস্থা রজতবাবুর। এতটা অপমান বোধহয় ওঁর প্রাপ্য নয়।

শৌর্য বলে ওঠে, ‘‘সুমিতদার সব কথা ধ্রুবসত্য বলে ধরে নেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। হয়তো রজতবাবুরা গিয়েছিলেন সুমিতদার কাছে। কোনও কাজ ব্যস্ত ছিল সুমিতদা। তাই বেশি কথাবার্তার সুযোগ হয়নি। মাঝে দীর্ঘ ষোলো বছর কেটে গিয়েছে, রজতবাবুর সঙ্গে দেখা হওয়াটা ভুলে গিয়েছে সুমিতদা।’’

অপর্ণা বলে উঠলেন, ‘‘আমি একটা কথা বুঝে উঠতে পারছি না, যে সময়টা চলে গিয়েছে, তাকে নিয়ে এত কাটাছেঁড়া হচ্ছে কেন? অতীত সব সময়ই মৃত। বর্তমানে কী করা উচিত তা নিয়েই ভাবা দরকার।’’

‘‘আমার মা তো মৃত নয়! ফোন করেছিল আমাকে! এখন কোথায় আছে, কে জানে!’’ বলল আরশি।

অপর্ণা বলেন, ‘‘সোফাটায় বোসো আরশি। মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবো এখন কী করা উচিত। ভাবার ক্ষমতাটাও তোমার বাবার তৈরি করে দেওয়া। তিনি তোমার প্রতি কোনও অবহেলা করেননি।’’

আরশি বসল পূর্বার বাবার ছেড়ে যাওয়া সোফাটায়। খানিকটা সমর্থন পেয়ে মাথা তুলেছেন রজতবাবু। ফের অপর্ণা বলেন, ‘‘অতীতকে আমরা নিজের পছন্দমতো নির্মাণ করি। প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে যার অনেকটাই ফারাক থেকে যায়। ফোনটা যে শোভাদেবীই করেছিলেন, সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ফোনের কথা যদি আমি ছেড়েও দিই, শোভাদেবী এখন কোথায় আছেন, কী অবস্থায় আছেন, আদৌ আছেন কিনা, এগুলো জানার ইচ্ছে আরশির হতেই পারে। আফটার অল শোভাদেবী ওর মা। মায়ের প্রভাব থেকে বাঁচাতে গিয়ে রজতবাবু মায়ের অভাব তৈরি করে ফেলেছেন আরশির মনে। যে কারণে ও এত ঝুঁকি নিয়ে মাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে।’’

ঘরের চারজনই এখন চুপ। শৌর্য অবাক হয় দেখে, মা কী সুন্দর ভাবে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলল। আরশিদের ব্যাপারে অনেক কিছুই জেনে গিয়েছে মা, যেমন আরশির মায়ের ফোন আসাটা। শৌর্য যখন ড্রেস চেঞ্জ করতে গিয়েছিল, তখনই হয়তো এসব কথা উঠেছে। রজতবাবু কী করে শৌর্যদের বাড়িতে পৌঁছলেন সেটাও।

কথা শুরু করলেন রজতবাবু, ‘‘হ্যাঁ। এটা হয়তো ঠিক, আমি আমার প্রতি উপেক্ষা, অপমানকে গুরুত্ব দিয়েছি বেশি। শোভাকে যতটা উদ্যোগ নিয়ে খোঁজা উচিত ছিল, খুঁজিনি। এবার শোভার ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। সে যদি বেঁচে নাও থাকে, সেটা জানাও জরুরি। বেঁচে থাকলে কোথায়, কী অবস্থায় আছে, দেখাটা আমার কর্তব্য। আমি বিভিন্নভাবে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা চালাব। আপাতত আরশি বাড়ি চলুক।’’

আরশি বলল, ‘‘না, এখনই জলপাইগুড়ি ফিরব না আমি। এই ক’দিনে মায়ের ব্যাপারে অনেকটাই জানতে পেরেছি। লোক লাগিয়েছি মাকে খুঁজতে। এখন তো কলেজ নেই। মাকে খোঁজার কাজটা চালিয়ে যাব।’’

‘‘ঠিক আছে, তাই হবে। আপাতত পূর্বাদের বাড়িতে চল। এঁদের এভাবে বিরক্ত করার তো কোনও মানে হয় না। এঁরা ভাল মানুষ বলেই তোর মতো অচেনা একজনকে আশ্রয় দিয়েছেন।’’

বাবার কথা পছন্দ হয়নি আরশির। বলল, ‘‘পূর্বাদের বাড়ি যাব না এখন। আমি আর শৌর্য মিলে মায়ের খোঁজ নিচ্ছি, এ বাড়িতে থেকেই কাজ করতে সুবিধে হবে আমাদের।’’

‘‘তা হয় না আরশি, সেটা ভাল দেখায় না!’’ বললেন রজত।

আরশি বলে, ‘‘মন্দ দেখানোর কী আছে! তুমি জিজ্ঞেস করো মাসিমাকে, আমি বিরক্ত করি কি না,’’ কথা শেষ করে অপর্ণার দিকে তাকায় আরশি। জিজ্ঞেস করে, ‘‘কী মাসিমা, আমি এ বাড়িতে থাকলে সমস্যা হবে আপনার?’’

‘‘তা হবে না, তবু সমাজ বা আত্মীয়স্বজনের কথাও তো খেয়াল রাখতে হবে!’’ বললেন অপর্ণা।

আরশি বলে, ‘‘এখানে হঠাৎ সমাজ, রিলেটিভদের কথা চলে এল কেন? আমি কোথায় থাকব, তা নিয়ে তাদের কী যায় আসে!’’

শৌর্য বলল, ‘‘তাদের নয়, তোমার ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সদ্য পরিচিত অনাত্মীয়র বাড়িতে, যে বাড়ির ছেলে অবিবাহিত, সেখানে বেশিদিন কাটালে অনেক প্রশ্ন উঠবে। প্রশ্নগুলো একের পর-এক বিয়ের সম্বন্ধ ভাঙবে তোমার।’’

আরশি বলল, ‘‘সম্বন্ধ করে বিয়ে করবই না আমি। ভীষণ বোকা-বোকা ব্যাপার।’’

‘‘আমার সে সব ছুঁৎমার্গ নেই, সম্বন্ধ করে বিয়ে করতে আমি রাজি, তোমাকে এবাড়িতে থাকতে দিয়ে বিয়ের বাজারে নিজের নাম খারাপ করতে চাই না…’’ কপট গাম্ভীর্যে বলল শৌর্য।

আরশি অপর্ণাকে বলে, ‘‘দেখছেন মাসিমা, কীরকম ইয়ারকি মারছে।’’

‘‘না, আমি সিরিয়াস। পুরুষ বলে কি চরিত্রের কোনও দাম নেই? কেন দাগ লাগতে দেব সেখানে?’’

শৌর্যর কথায় অপর্ণা, রজত দু’জনেই হাসছেন। আরশির মুখ ভার। অপর্ণা তাকে বোঝান, ‘‘পূর্বারা দুঃখ পাবে তুমি যদি ওঁদের বাড়িতে না থাকো। ওঁরা তো তোমার অনেকদিনের চেনা।’’

‘‘যেতেই হবে? যাই তা হলে…’’ বলে ব্যাজার মুখে সোফা ছাড়ল আরশি। ভিতর ঘরের দিকে গেল লাগেজ আনতে। বরাবরের জন্য ঘাড় থেকে নেমে গেল কি? গেলে ভাল হয় না খারাপ, বুঝে উঠতে পারে না শৌর্য। একটু যেন ফাঁকা-ফাঁকা লাগে মনটা।

পূর্বাদের বাড়িতে দুটো দিন কেটে গেল আরশির। জায়গাটা সল্টলেক। বাবা জলপাইগুড়িতে ফিরে গিয়েছে পরের দিনই। যে বদনামের ভয়ে আরশিকে আনা হল পূর্বাদের বাড়ি, তা রোখা যায়নি। কাকিমা ধরেই নিয়েছেন শৌর্যর সঙ্গে তার স্পেশ্যাল রিলেশনশিপ আছে। গতকাল এ বাড়িতে এসেছিল শৌর্য। সুমিত ঘোষ আরশিকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এতদিনে তিনি আবিষ্কার করেছেন আরশিকে চেনা মনে হওয়ার কারণ। শৌর্যকে বলেছেন, ‘‘ভেবেছিলি নেশার ঘোরে আমি বুঝতে পারব না কেন খোঁজ নিচ্ছিস আমার প্রথম ছবির। ঠিক সেই মুহূর্তে তোর উদ্দেশ্যটা ধরতে না পারলেও, তুই চলে যাওয়ার পরই মানসচোখে ভেসে উঠল শোভার চেহারাটা। ওর হাঁটাচলা, কথা বলা… ওকে যে হাতে করে তৈরি করেছি, নাম দিয়েছি নতুন, তুই-ই ওর স্মৃতিটা উসকে দিয়ে গেলি। তাই আর বেশিক্ষণ সময় লাগেনি জলপাইগুড়ির মেয়েটার সঙ্গে মিলে খুঁজে পেতে। মা-মেয়ের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, কথা বলার ধরনে ভীষণ মিল।’’ বলার পর সুমিত ঘোষ শৌর্যর কাছে জানতে চান, মেয়েটা কি এখন জলপাইগুড়িতে? শৌর্য ‘এখানেই আছে।’ বলাতে সুমিত ঘোষ বলেছেন, ‘একবার নিয়ে আসতে পারবি? আগের দিন ভাল করে আলাপই হল না।’ সুমিত ঘোষের ইচ্ছেটা শৌর্য ফোন করে জানিয়েছিল আরশিকে। আরশি বলেছিল, ‘চিনে যখন ফেলেছেন, দেখাটা সেরেই আসি। হয়তো মায়ের ব্যাপারে আরও কিছু জানা যাবে। যেগুলো আমাকে বলার উপযুক্ত, তোমাকে নয়। তাই বলেননি।’

জানা গেল নতুন কিছু তথ্য। যার একটা হয়তো শৌর্যকেও বলেছিলেন, আরশির কাছে কথাটা চেপে গিয়েছে সে। বলতে বেধেছে শৌর্যর। সুমিত ঘোষের কথা অনুযায়ী মা দুই প্রযোজকের কাছে বছর দু’-তিনেক করে থেকেছে। তাদের অনুগ্রহেই গোটা তিনেক ছবিতে অভিনয় করেছে ছোট রোলে। মা রক্ষিতা ছিল, এ কথাটা সম্ভবত আরশির কাছে বলে উঠতে পারেনি শৌর্য। সুমিত ঘোষ আরও বলেছেন, মা অনেকদিন পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল। গুরুর মতো সম্মান করত। অভিনয়ের খুঁটিনাটি শিখেছিল সুমিত ঘোষের থেকে। শুধুমাত্র পার্ট চাইতে আসত না মা, নিজের কষ্টের কথাও শেয়ার করত। সুমিত ঘোষ বহুবার বলেছিলেন, তুমি বাড়ি ফিরে যাও। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বড় কঠিন ঠাঁই। একা লড়া যায় না। মা শোনেনি। বলত, ‘আর ফেরার মুখ নেই আমার। শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ি কোথাও না।’

মা বেশ কয়েকবার মদের টাকাও নিয়েছে সুমিত ঘোষের কাছ থেকে। এত কথা বললেন সুমিত ঘোষ, বাবার দেখা করতে আসার ঘটনাটা বললেন না! আরশি একবার জিজ্ঞেস করল, বললেন, ‘‘না, না, শোভার স্বামীর পরিচয় দিয়ে কেউ কখনও আমার কাছে আসেনি।’’

বাবা কি তা হলে অন্য পরিচয়ে এসেছিল, না কি আসেইনি? তবে মাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নেওয়া বাবার কাছে ন্যায্য কারণেই অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। ক্রমশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল মা। একজন স্বামী কেন সেটা মেনে নেবে? নষ্ট হলেও মা আরশির কাছে মা হয়েই থাকবে। সম্পর্কটা পালটাবে না। নিজের শিশু সন্তানকে যখন কোনও মা ফেলে দিয়ে যায়, লোকে তাকে নিষ্ঠুর বলে। তেমনি কোনও সন্তান যদি ‘নষ্ট’ আখ্যা দিয়ে কোনও মাকে এড়িয়ে যায়, সেটা কি নিষ্ঠুরতা নয়? মায়ের কাছে পৌঁছবেই আরশি। বলবে, ‘বাবার কাছে হলেও, তুমি তো আমায় ফেলেই গিয়েছিল। কেন? কোন অনিবার্য কারণে? নাকি শুধুই নাম-যশের লোভ?’

গল্পগাছার মাঝেই সুমিত ঘোষ অফার দিয়েছেন, ‘দখিন হাওয়া’ সিনেমাটার একটা ছোট রোলের। যে রোলটার জন্য অডিশন দিয়েছিল আরশি, তার বন্ধুর চরিত্রে। সুমিত ঘোষ বলেছেন, ‘‘তোমার মা আমার ছবিতে অভিনয় শুরু করেছিল, তুমিও করবে। দুই প্রজন্মকে ডিরেকশন দেওয়াটা আমার কাছে বেশ একটা গর্বের হবে। এবং কথা দিচ্ছি, এ ছবি রিলিজ় করবেই। এখন তো আমি আর নতুন নই ইন্ডাস্ট্রিতে।’’

‘‘এমন হবে না তো মা-মেয়ের কমন জিনের জন্য তোমার এ ছবিও আটকে গেল!’’ ফাঁক বুঝে ফুট কেটেছিল শৌর্য। সুমিত ঘোষ বলেছিলেন, ‘‘তুই তো জানিস, আমার মধ্যে ওসব ফালতু সংস্কার নেই।’’

নিবেদিতাদি আর এক প্রস্তাব যোগ করল। সিরিয়ালে লিড রোলে অভিনয় করাবে আরশিকে। সেটার লুকটেস্ট হবে দিন পনেরো বাদে। নিবেদিতাদির স্থির বিশ্বাস, লুকটেস্টে সিলেক্ট হবেই আরশি…

বাইকে করে শৌর্য যখন আরশিকে দিতে আসছিল পূর্বাদের বাড়ি, বলেছিল, ‘‘তোমার তো কপাল খুলে গেল দেখছি! আর ক’দিন পরেই একেবারে সেলেব্রিটি!’’

আরশি তখন বলে, ‘‘সেলেব্রিটির নিকুচি করেছে। মাকে খুঁজে পেলেই সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরব। এরা যদি আমাকে সিনেমা-সিরিয়ালের অফার না দিয়ে মাকে এনে দিত, উপকার হত বেশি।’’

পূর্বাদের বাড়ির সামনে নামিয়ে কাল যখন চলে যাচ্ছে শৌর্য, আরশি বলেছিল, ‘‘এদের সঙ্গে একটু কথা বলে যাও না। তোমার ব্যাপারে শুনেছে, আলাপ করতে আগ্রহী। আজ যখন নিতে এসেছিলে, সুযোগই পেলাম না তোমার সঙ্গে দেখা করাবার।’’

আরশির অনুরোধ রেখেছিল শৌর্য। মিনিট কুড়ি ছিল পূর্বাদের বাড়ি। চা-টা খেল। কাকিমা এখনও বেডরিড্ন, শৌর্য বিছানার কাছে গিয়ে আলাপ সেরে এল। ও চলে যেতেই পূর্বা বলেছিল, ‘‘এ যদি তোর বয়ফ্রেন্ড না হত, আমি জান লড়িয়ে দিতাম ওকে পেতে। কী হ্যান্ডসাম মাইরি!’’

কাকিমা আবার বিষণ্ণ ভাবে বললেন, ‘‘আমার মেয়েটার যে কী হবে! তুই তো নিজের জন্য একটা হিল্লে করে নিলি। কী ভাল ছেলে! যেমন দেখতে, তেমন ব্যবহার!’’

এ বাড়িতে এসে লাভটা তা হলে কী হল? আরশির সঙ্গে সেই তো জড়িয়ে গেল শৌর্যর নাম। যা নিয়ে ভয় পাচ্ছিল বাবা, শৌর্যর মা।

‘‘কী রে, এখনও এল না?’’

পূর্বার ডাকে সংবিৎ ফিবল আরশির। মুখের সামনে থেকে খবরের কাগজ সরিয়ে রিস্টওয়াচ দেখল। বলল, ‘‘সেই তো দ্যাখ না, বলল ন’টায় আসছি। এখনও পাত্তা নেই!’’

‘‘আমি বেরোলাম। একটু দেরিই করলাম তোর বয়ফ্রেন্ডকে একবারটি দেখার জন্য। এর বেশি দেরি করলে চাকরি যাবে আমার। চলি।’’

হাত নেড়ে অফিস বেরিয়ে গেল পূর্বা। শৌর্যর দেরি হচ্ছে কেন বোঝা যাচ্ছে না। মেকআপ আর্টিস্ট নবকৃষ্ণ কুণ্ডু দেখা করতে বলেছেন আজ। দশটা নাগাদ, টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের সামনে থাকবেন। খবর দেবেন কিছু। সুমিত ঘোষ যে তথ্যগুলো দিয়েছেন, ফোনে নবকৃষ্ণবাবুকে সবই জানানো হয়েছে। উনি নতুন খবর সংযোজন করবেন। বেরোনোর জন্য আরশি যখন ড্রেস করছিল, পূর্বা বলেছিল, ‘‘আসছে মনে হচ্ছে সে! কোথায় যাবি?’’

গন্তব্য বলেছিল আরশি। পূর্বা বলল, ‘‘সে তো এখান থেকে অনেক দূর…’’

দূরত্ব যদি অনেকটাই, তা হলে এখনও কেন এল না শৌর্য? কোনও কাজে আটকে গেল কি? তাই যদি হয়, এতক্ষণে নিশ্চয়ই একটা ফোন করত। ভেবে আরশি মোবাইল বের করে শৌর্যকে কল করতে যাবে, বাড়ির সামনে বাইকের হর্ন। সোফা থেকে তড়াক করে উঠে পড়ে আরশি। ভিতর বাড়ির উদ্দেশে গলা তুলে বলে, ‘‘কাকিমা বেরোচ্ছি। টেনে দিয়ে যাচ্ছি দরজা।’’

উত্তরের অপেক্ষা করে না আরশি। এদেরও ইন্টারলক, দরজা টেনে বেরিয়ে যায়।

রাস্তায় কিছু দূর অন্তর সিগনাল। প্রত্যেকটায় দাঁড়াতে হচ্ছে। ঘড়িতে দশটা বেজে দশ। আরশি আন্দাজ করতে পারছে না টালিগঞ্জ আর কতটা দূরে। অপেক্ষায় আছেন নবকৃষ্ণবাবু। কতক্ষণ আর থাকবেন! হয়তো এক্ষুনি ফোন করে জানাবেন, ‘আমি চললুম।’

বাইকে ওঠার আগে আরশি শৌর্যকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘এত দেরি হল!’’

‘‘আর বোলো না! আসার সময় দারুণ একটা সাবজেক্ট পেয়ে গেলাম, ছবি তুলতে গিয়ে লেট হয়ে গেল!’’ বাইক চালাতে-চালাতে বলেছিল শৌর্য।

আরশি জানতে চেয়েছিল, ‘‘কী সাবজেক্টটা পেলে?’’

‘‘শ্যামবাজার মোড় পার হওয়ার পর দেখি একটা গারমেন্টস শপের বাইরে সার দিয়ে দাঁড় করানো বেশ কিছু জামা-কাপড়হীন ম্যানিকুইন। দোকান পরিষ্কার হচ্ছিল, ম্যানিকুইনগুলোর নীচে বসে সস্তার ড্রেস মেটেরিয়াল বিক্রি করছে এক দোকানি। এই সাবজেক্ট কি ছাড়া যায়? মনে হচ্ছিল, ম্যানিকুইনগুলো বড় দোকানের দাসত্ব অস্বীকার করে নিরাবরণ হয়েছে। রাস্তায় বসা দোকানির হয়ে প্রমোশন করছে ওই অবস্থায়!’’ এক্সসাইটেড গলায় বলেছিল শৌর্য। আরশি বুঝেছিল বিষয়টা বেশ ভারী, মানেটা তার কাছে পুরোপুরি পরিষ্কার হয়নি। এই আলোকচিত্রী নিয়ে এখন বেশ চিন্তায় পড়েছে আরশি। মাকে খোঁজার ব্যাপরে ওকে সব সময় পাওয়া যাবে তো? নাকি তেমন কোনও সাবজেক্ট পেলে ভুলে যাবে সব কিছু?

‘‘এসে পড়লাম, ওই যে দেখা যাচ্ছে দাঁড়িয়ে আছে নবকৃষ্ণদা,’’ বলল শৌর্য।

আরশি ভদ্রলোককে দেখতে পাওয়ার আগেই শৌর্যর বাইক পৌঁছে গেল তার সামনে। সিট থেকে নেমে এল আরশি। তাড়াতাড়ি হেলমেটটা খোলে, অনেকক্ষণ ধরে পরে আছে। বাইকে বসেই শৌর্য নবকৃষ্ণবাবুকে বলল, ‘‘কথাগুলো এখানে দাঁড়িয়েই বলবেন, নাকি বসব কোথায়?’’

‘‘না, না, বসার দরকার নেই, ছোট খবর, এখনই বলা হয়ে যাবে,’’ বললেন নবকৃষ্ণবাবু।

শৌর্য আর বাইক থেকে নামল না। শুধু হেলমেটটা খুলে ফেলল। নবকৃষ্ণবাবুর পরনে পুরনো ঢলঢলে প্যান্টশার্ট, পায়ে ততধিক পুরনো চামড়ার চটি। শার্টের পকেট থেকে একটা চিরকুট বার করে শৌর্যকে দিলেন। বললেন, ‘‘এটা হচ্ছে একটা নেশা ছাড়ানো প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা। এখানে রাখা হয়েছিল রায়া সেনকে।’’

কাগজটায় চোখ বুলিয়ে শৌর্য এগিয়ে দেয় আরশির দিকে। ঠিকানাটা পড়ল আরশি। যেহেতু কলকাতার রাস্তাঘাট চেনে না, বুঝল না জায়গাটা কোথায়। নবকৃষ্ণ বলছেন, ‘‘রায়া সেন ওখানে এখন নেই। কোথায় আছে তার খোঁজ চালাচ্ছি। উমেশবাবুকে চেনো?’’

শৌর্য দু’পাশে মাথা নাড়ে। অর্থাৎ চেনে না। নবকৃষ্ণ বললেন, ‘‘নাম নিশ্চয়ই শুনেছ। তুমি সিনেমা লাইনের লোক, না শোনার কথা নয়। যাই হোক, উমেশবাবু বিরাট একজন প্রোডিউসর, ডিস্ট্রিবিউটর। নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে রায়া সেন ওঁর কাছেই ছিল। উমেশবাবুর বাড়িতে নয়। আলাদা একটা ফ্ল্যাটে। রায়া তখন মদের নেশায় ডুবে গিয়েছে। ঘুম থেকে উঠে রাত অবধি নেশা করে যাচ্ছে। উমেশবাবু ওকে নেশা ছাড়ানোর প্রতিষ্ঠানে রেখে আসেন। সেখানে কিছুদিন ছিল, নেশা আদৌ ছাড়তে পেরেছিল কি না, জানতে পারিনি।’’

‘‘ওই সেন্টারে গেলেই তো জানা যাবে!’’ বলল শৌর্য।

নবকৃষ্ণ বললেন, ‘‘জানা যাবেই, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না, মনে রাখতে হবে রায়া ছিল উমেশবাবুর পাঠানো পেশেন্ট। উমেশবাবুর বিরাট প্রতিপত্তি। সিনেমা ছাড়াও আর অনেক কিছুর ব্যাবসা আছে। মন্ত্রীদের সঙ্গে নিয়মিত ওঠা বসা। উনি যদি ওই প্রতিষ্ঠানে বলে রাখেন, ‘রায়ার ব্যাপারে কেউ কিছু জানতে এলে মুখ খুলবে না’, ওরা সেটা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করবে। তোমরা একবার গিয়ে কথা বলে দেখতে পারো। তবে কিনা খুবই সাবধানে। রায়ার খোঁজ নেওয়া মানে উমেশবাবুর গোপন জীবনে উঁকি দেওয়া।’’

শৌর্য বলে, ‘‘উমেশবাবুর যে ফ্ল্যাটে রায়া সেন থাকতেন, সেটার ঠিকানাটা জেনেছেন? হতে পারে রিহ্যাব সেন্টারে সুস্থ হয়ে উঠে উনি ওই ফ্ল্যাটেই চলে গিয়েছেন।’’

‘‘হতেই পারে। ওই ফ্ল্যাটের খোঁজ চালাচ্ছি। আসলে অনেক বছর হয়ে গেল তো, কিছু খবর পাচ্ছি, কিছু পাচ্ছি না। কেউ তো আর রায়া সেনকে ফলো করে বসে ছিল না। কত অভিনেতা-অভিনেত্রী ইন্ডাস্ট্রিতে আসে-যায়, কে কার খবর রাখে! কার অত সময়! রায়া সেন নেহাত উমেশবাবুর কনুইয়ে হাত গলিয়ে পার্টিতে ঘুরত, তাই এই খবরগুলো পাওয়া গিয়েছে!’’ বললেন নবকৃষ্ণ। শৌর্য জিজ্ঞেস করে, ‘‘খবরগুলো আপনাকে দিচ্ছে কে?’’

নবকৃষ্ণ বললেন, ‘‘ইন্ডাস্ট্রির লোক। তাই জন্যই তো দু’দিন ধরে স্টুডিয়ো পাড়ায় ঘুরছি। অনেক খরচ হয়ে যাচ্ছে। বিনে পয়সায় তো কেউ খবর দেবে না। চপ-কাটলেট খাওয়াতে হচ্ছে। আগে যা দিয়ে গিয়েছিলে সব টাকা শেষ।’’

শৌর্য বলল, ‘‘টাকা যে শেষ, আপনার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছি। চশমাটা এখনও পালটাননি।’’

নবকৃষ্ণবাবুর মুখের দিকে ভাল করে তাকায় আরশি, শৌর্য ঠিকই বলছে। তার কেন প্রথমে চোখে পড়ল না! নবকৃষ্ণ বলছেন, ‘‘আর চশমা! তোমরা চলে যাওয়ার পরই বউমা পুরো টাকাটাই কেড়ে নিয়েছিল। বললাম, ‘পাঁচশো দাও, নয়তো ওদের কাজটা করব কী করে?’ দিল পাঁচশো। তাই খবরগুলো দিতে পারলাম। টাকার দরকার বলেই তোমাদের ডেকে পাঠালাম এখানে। নয়তো সব খবর ফোনেই দেওয়া যেত। বাড়িতে ডাকতে সাহস হল না। ফের যদি ছিনতাই হয়ে যায় টাকা!’’

‘‘ছিনতাই কেন বলছেন! ওই টাকাটা তো আপনার বউমা সংসারের জন্যই নিয়েছেন,’’ বলল আরশি। আসলে যাচাই করতে চাইল নবকৃষ্ণবাবুর বউমাটিকে।

নবকৃষ্ণ বললেন, ‘‘হ্যাঁ, সংসারেই খরচ করবে। তবে কিনা টাকাকে আকাশ থেকে পড়া বলে ধরে নিলে চলবে না। তাতে স্বভাব নষ্ট হবে। প্রতিটি টাকার পিছনে উপার্জনের হিসেব থাকা উচিত। তোমাদের কাজটার পর আমি হিসেব নিয়ে বসব। কতটা লোকের পিছনে খরচ হয়েছে, আমার পারিশ্রমিক কত হওয়া উচিত।’’

কথার মাঝেই পার্স বের করে কিছু পাঁচশোর নোট হাতে নিয়েছে শৌর্য। আরশি বলে ওঠে, ‘‘আবার তুমি দিচ্ছ!’’

হাতের ইশারায় আরশিকে থামিয়ে শৌর্য নবকৃষ্ণ কুণ্ডুকে বলে, ‘‘চার হাজার দিচ্ছি। বাড়ি গিয়ে প্রথমেই বউমার হাতে পাঁচশো দেবেন। চশমার দোকানে যাবেন সময় করে। পরের দেখায় চোখে যেন নতুন চশমা দেখতে পাই। বাকি টাকা দিয়ে আপনি খবর সংগ্রহ করতে থাকুন। টাকা ফুরোলেই জানাবেন। আপনি আমাদের জন্য যা করছেন, টাকা দিয়ে এর ঋণ শোধ হয় না। তাই কাজটার পর হিসেব নিয়ে বসতে হবে না আপনাকে।’’

শৌর্যর দেওয়া টাকা প্যান্টের পকেটে ঢোকালেন নবকৃষ্ণবাবু। অন্য পকেটটা থেকে বের করলেন রুমাল। চশমা খুলছেন।

আরশি আন্দাজ করে উনি চোখ মুছবেন। সেটাই স্বাভাবিক। শৌর্যর কথায় আরশির চোখেও জল এসে গিয়েছে। কিন্তু আন্দাজ যে মিলল না। চোখ না মুছে চশমার কাচ মুছছেন নবকৃষ্ণ। মোছা শেষ করে পরে নিলেন চশমা। বললেন, ‘‘ঠিকই আছে। এখনই পালটানোর দরকার নেই। এই তো স্পষ্ট দেখছি তোমাদের। কী পরিষ্কার! আসলে বেশির ভাগ মানুষই আজকাল এত ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে, নতুন চশমা পরেও কোন লাভ হবে না।’’

শৌর্যর গা থেকে সিগারেটের কড়া গন্ধ আসছে। গা বলতে টি-শার্ট। বাইকে শৌর্যর পিছনে বসে গন্ধটা সহ্য করতে হচ্ছে আরশিকে। ইদানীং আর আমমুকুলের গন্ধটাও পাচ্ছে না কলকাতায়। কী করে পাবে! মায়ের সম্বন্ধে একের পর-এক যে সব খবর পাচ্ছে, সুবাস গ্রহণ করার স্নায়ুটা অকেজো হয়ে পড়েছে মনে হয়। নবকৃষ্ণবাবুর সঙ্গে কথা হওয়ার পর ফেরার রাস্তা ধরেছিল শৌর্য। হঠাৎই একটা চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল। বলল, ‘‘মাথাটা জ্যাম হয়ে গিয়েছে। চা-বিড়ি না খেলেই নয়।’’

‘‘বিড়ি!’’ চমকে উঠে বলেছিল আরশি।

শৌর্য বলল, ‘‘আরে বাবা, সিগারেটকে আদর করে মাঝে-মাঝে ওই নামে ডাকা হয়। যেমন ধরো, ফুটফুটে ছেলে দেখে নাম রাখা হল কার্তিক। তার আদরের নাম অবধারিতভাবে কেতো হয়ে যাবে।’’

‘‘তোমার আদরের নাম, মানে ডাকনাম কী?’’ শৌর্যর কাছে জানতে চেয়েছিল আরশি।

শৌর্য বলল, ‘‘বাবান।’’

‘‘মাসিমার মুখে এই নামটা তো একবারও শুনলাম না!’’ বিস্ময় প্রকাশ করেছিল আরশি।

মুচকি হেসে শৌর্য বলল, ‘‘ডাকে। প্রাইভেটলি। বাবা ডাকত বেশি।’’

আরশির ডাকনাম নিয়ে চলে গিয়েছে মা। শৌর্য কথা প্রসঙ্গে সেটা জেনেছে। নতুন করে আর বলল না আরশি। দু’ভাঁড় চায়ের অর্ডার দিয়েছিল শৌর্য, আরশি খাবে কি না জিজ্ঞেস না করেই। খেল আরশি। চা শেষ করে শৌর্য দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনে ধরাল। ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে গুছিয়ে নিল ভাবনা। বলল, ‘‘চলো, আজই রিহ্যাব সেন্টারটায় যাই। দেখি, আমাদের জন্য কী খবর অপেক্ষা করছে।’’

‘‘হুট করে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? নবকৃষ্ণবাবু বলেছেন সাবধানে এগোতে…’’ আশঙ্কার গলায় বলেছিল আরশি।

শৌর্য বলল, ‘‘উমেশবাবুর কথা ভেবে সাবধান করেছেন নবকৃষ্ণদা। ওই সেন্টারে প্রভাব আছে ওঁর। আমি ঠিক এই কানেকশনটা কাজে লাগাব। এখন কানেকশনের যুগ। যদি দেরি করি এবং উমেশবাবুর কানে পৌঁছে যায় আমরা রায়া সেনের খোঁজ করছি, সেন্টারকে কিছু বলতে বারণ করে দেবেন।’’

‘‘উমেশবাবুর কানে কে তুলবে আমরা মায়ের খোঁজ করছি?’’ অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল আরশি।

শৌর্য বলল, ‘‘ইন্ডাস্ট্রির লোকগুলোই বলবে, যারা নবকৃষ্ণদাকে খবরগুলো দিচ্ছে। রায়া সেনের খবরের দাম আছে, বুঝে গিয়েছে ওরা। কাস্টমার পেলেই বিক্রি করবে। কোনও বাছাবাছিতে যাবে না। আর কাস্টমার হিসেবে উমেশবাবু অনেক দামি। ইন্ডাস্ট্রির একটা স্তম্ভ, ওরা উমেশবাবুকে ফেভার করবে বেশি।’’

এত মাথা খাটানোর ক্ষমতা আরশির নেই। তাই শৌর্যর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। দু’জনে এখন চলেছে রিহ্যাব সেন্টারে। নবকৃষ্ণদার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী সেন্টারটা সিঁথিতে। জায়গাটা কতদূর, জিজ্ঞেস করাতে শৌর্য বলেছে, ‘‘অনেকটাই দূর। পিছনে বসে ঘুমিয়ে পোড়ো না যেন! গাড়ির ব্যালেন্স রাখতে পারব না।’’

ঘুম যে পাচ্ছে না, তা নয়। কতক্ষণে পৌঁছবে, আরশি সেই চিন্তাই করছে। শৌর্য কীভাবে কাজ উদ্ধার করবে, তারও কোনও আন্দাজ পাচ্ছে না। শৌর্য বলছে কানেকশনের কথা। সেটা কার সঙ্গে, কোন প্রক্রিয়ায় কাজে লাগায় দেখা যাক। একটা কথা অবশ্য ঠিক বলেছে শৌর্য, এটা কানেকশনের যুগ। তার হাতে গরম প্রমাণ ক’দিন আগেই পেয়েছে আরশি। বাবা কত সহজে এবং অল্প সময়ে পৌঁছে গিয়েছিল শৌর্যদের বাড়ি। আরশি বারবার পূর্বার সঙ্গে কথা বলাচ্ছে না দেখে মনে কু ডেকেছিল বাবার। তাই সরাসরি পূর্বাকেই ফোন করে। পূর্বা আরশির থেকে যা শুনেছিল, সেটাই বলে। গোলপার্কে দূর সম্পর্কের পিসির বাড়িতে আছে আরশি। বাবা বুঝতে পারে মিথ্যে বলেছে মেয়ে। জলপাইগুড়ি পুলিশের সাহায্য চায় বাবা। কলকাতা না চেনা আরশি যেহেতু গোলপার্কের নাম করেছে, পুলিশ সেখান থেকেই শুরু করে খোঁজ। জলপাইগুড়ি থানা লেক থানার সঙ্গে যোগাযোগ করে। বাবার দেওয়া আরশির ফোটো মেল করে পাঠায়। লেক থানার পুলিশ প্রথমে সেই ফোটো পাঠায় আশপাশের হোটেল। তাতে সন্ধান না পেলে, আরও বড় এলাকা জুড়ে, অন্যভাবে খোঁজা হত। পুলিশকে বেশি খাটতে হল না। পার্ক সেন্টার হোটেল আরশির ফোটো পেয়ে জানায়, সেখানেই ছিল মেয়েটি। পুলিশের কথা মতোই তাকে রাতে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। লেক থানার পুলিশ বের করে ফেলল, কোন ব্যক্তি আরশির জন্য সুপারিশ করেছিল। সুমিত ঘোষের নাম পাওয়া গেল। শৌর্যর সুমিতদাকে অন্তর্ধানের ব্যাপারে কিছু বলেনি পুলিশ, যেহেতু সুমিত ঘোষ আরশির থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন, তিনিই আবার পালানোরও রাস্তা দেখিয়ে দিতে পারেন। সুমিত ঘোষের সঙ্গে কথা বলে শৌর্যর নাম-ঠিকানা পেয়ে গেল পুলিশ। বাবা তখন অত্যন্ত বিচক্ষণতার কাজ করেছিল। মেয়ের বদনামের কথা ভেবে লোক জানাজানি, হইচইয়ের মধ্যে যায়নি। পুলিশকে বলেছিল, ‘‘প্রথমে আমি ওই ঠিকানায় যাই। হতে পারে ওরা মেয়ের পূর্ব পরিচিত। হঠাৎ পুলিশ নিয়ে চড়াও হলে ওঁরা বিব্রত হবেন। মেয়েরও সেটা ভাল লাগবে না।’’ তারপরই বাবা ফোন করে পূর্বার বাবাকে। ফ্লাইট ধরে চলে আসে কলকাতায়। কাকুকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে যায় শৌর্যদের বাড়ি। আরশির বাবার মুখ থেকে শৌর্য এই বৃত্তান্ত শোনেনি। শৌর্যদের বাড়িতে বসে বাবা যখন কথাগুলো মাসিমাকে বলছিল, শৌর্য ছিল না ঘরে। ড্রেস চেঞ্জ করতে গিয়েছিল। পরে মাসিমা ওকে সব বলেন। যখন বলছেন, আরশি মাসিমার পাশেই ছিল। সমস্তটা শুনে শৌর্য বলেছিল, এই হল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি। দশ বছর আগেও এতটা ছিল না।

আরশি উপলব্ধি করে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না থাকার জন্যই মায়ের হারিয়ে যেতে সুবিধে হয়েছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থার কি ততটাই উন্নতি হয়েছে, বহুদিন আগের নিখোঁজ মানুষকে খুঁজে দেবে?

রি-হ্যাব সেন্টারটার নাম ‘প্রেরণা’। বাগানসমেত পুরনো দোতলা বাড়ি। খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বাগানে একটা গাছের পাতাও পড়ে থাকতে দেখা যায়নি। ব্যাপারটা একটু অতিরিক্তই মনে হচ্ছিল। বাড়াবাড়ি আর একটা জায়গাতেও, বাউন্ডারি পাঁচিলের গেটে তো বটেই, বারান্দার কোল্যাপসেব্‌ল গেটেও ভিতর থেকে বড় সাইজ়ের তালা মারা। মূল গেটের পিলারে ডোরবেলের সুইচ। সেটা টেপার পর বারমুডা-স্যান্ডো গেঞ্জি পরা বছর বাইশের একটি ছেলে বারান্দায় এল। দূর থেকেই জরিপ করল আরশিদের। তারপর এক-এক করে বারান্দা আর গেটের তালা খুলল। অত্যন্ত নিস্পৃহ গলায় জানতে চাইল, বলুন, ‘‘কী ব্যাপার?’’

শৌর্য বলেছিল, ‘‘একজন পেশেন্টকে এখানে রাখতে চাই। সেটার জন্য খোঁজ নিতে এসেছি।’’

‘‘ভিতরে আসুন,’’ বলে ডেকে নিয়েছিল ছেলেটি।

একতলার সামনের ঘরটাই এদের অফিস। এখন যেখানে বসে রয়েছে আরশিরা। ম্যানেজারের সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা হয়ে গিয়েছে শৌর্যর। লোকটি শৌর্যর থেকে একটু বড়, ইয়ং ছেলেই বলা যায়। ম্যানেজার এখন সিটে নেই। শৌর্যকে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের ব্রোশিওর দেখতে দিয়ে ভিতরে গিয়েছে।

শৌর্য যে কানেকশনের কথা বলেছিল, সেটা যে এতটাই ভিত্তিহীন, কল্পনাও করতে পারেনি আরশি। অফিসে ঢুকে সপ্রতিভভাবে ম্যানেজার সঙ্গে হ্যান্ডশেক সারল শৌর্য। নিজের কার্ড দিল ম্যানেজারকে। বলল, ‘‘প্রোডিউসার উমেশবাবুর মুখে আপনাদের সেন্টারের কথা শুনেছিলাম।’’

একদম ম্যাজিকের মতো কাজ করল রেফারেন্সটা। ম্যানেজার ছেলেটি খাতিরের গলায় বলল, ‘‘ও আচ্ছা, আচ্ছা। বসুন।’’

শৌর্য, আরশি চেয়ারে পাশাপাশি বসল। শৌর্য বলল, ‘‘সিনেমায় স্টিল ফোটো করি তো, সেই সূত্রেই উমেশবাবুর সঙ্গে আলাপ।’’

‘‘হ্যাঁ, সে তো আপনার কার্ড দেখেই বুঝেছি, বলুন, আপনাদের জন্য কী করতে পারি?’’ বলেছিল ছেলেটি।

শৌর্য বলল, ‘‘আমাদের এক কমনফ্রেন্ড মদের নেশায় আসক্ত। কিছুতেই নেশা ছাড়ানো যাচ্ছে না। এক পার্টিতে উমেশবাবু কাকে যেন বলছিলেন আপনাদের সেন্টারের কথা। সেই লোকটির চেনা কেউ মদের নেশায় অ্যাডিক্টেড। পাশে ছিলাম আমি। উমেশবাবু বললেন, মদের নেশা ছাড়ানোর জন্য আপনাদের সেন্টার আদর্শ জায়গা। ওঁর কোনও এক আত্মীয়কে এখানেই রেখেছিলেন।’’

‘‘হ্যাঁ, ঠিক… তবে ওঁর মদের নেশা ছিল না, মাদকের নেশা, হেরোইন…’’ বলেছিল ম্যানেজার। আরশি হকচকিয়ে গিয়েছিল। ম্যানেজার আরও বলছিল, ‘‘এই ধরনের ড্রাগ অ্যাডিক্টরাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’’

‘‘মানে, মদের নেশার চেয়েও খারাপ? পেশেন্টকে সুস্থ করা কঠিন?’’ জানতে চেয়েছিল শৌর্য।

ম্যানেজার বলল, ‘‘সব নেশাই খারাপ। মদ ছাড়ানো বরং বেশি কঠিন। যেহেতু মার্কেটে ইজ়িলি অ্যাভেলেবল। ড্রাগ অ্যাডিক্টদের নিয়ে সমস্যা একটাই, নেশার ক্যারেক্টারটা এমনই, আসক্ত মানুষটিকে ক্রমশ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কারও সঙ্গে মিশতে চায় না। টাকার জোগান না থাকলে চুরি-ছিনতাই কিংবা ভিক্ষে করতেও পিছপা হয় না সে। নেশা করার পর নিজের জগতে বুঁদ হয়ে যায়। সেই জগৎটা এতটাই আনরিয়েল, পেশেন্টকে মূলস্রোতে মেশানো মুশকিল হয়ে যায়।’’

ভিক্ষার অনুষঙ্গে আরশির মনে পড়ে যায় পার্ক সার্কাসের হোটেলের বাইরে দুই মহিলা ভিখারির কথা। শৌর্য বলেছিল ‘‘ওরা সবাই আসল ভিখারি নয়। নেশার টাকা জোগাড়ের জন্য ভিক্ষে করে।’’ মা কি ওদেরই মতো হয়ে গিয়েছে?

ম্যানেজার আরও বলে যাচ্ছিল, ‘‘হেরোইন বা ওই জাতীয় নেশা থেকে রোগীকে যদি একবার সু্স্থ করা যায়, ফেরানো যায় বাস্তব জীবনে, তার প্রতি যত্ন এবং গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখলে, নতুন করে নেশার কবলে পড়ার চান্স কম থাকে। যেহেতু নেশার বস্তুগুলো চোরাপথে সংগ্রহ করতে হয়। বাড়ি বয়ে দিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নেয় না ড্রাগ পেডলাররা। মদের বেলায় উলটো, আশপাশে হামেশাই চলছে মদের আসর। রোগী সুস্থ হওয়ার পরও জড়িয়ে পড়ার চান্স থাকে। অথচ হেরোইনের নেশাটাকে লোকে বেশি ভয়ংকর মনে করে।’’

শৌর্য জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘আপনারা কী পদ্ধতিতে নেশা ছাড়ান?’’

ম্যানেজার বলেছিল, ‘‘প্রথমে তো পেশেন্টকে মেডিসিন দিয়ে ডিটক্সিফিকেশন করতে হয়। অনেক সময় হাসপাতাল থেকে করিয়ে নিয়ে আসে পেশেন্ট পার্টি। ডিটক্সিফিকেশন হচ্ছে ডিঅ্যাডিকশনের একটা পার্ট। উইথড্রল সিস্টেমের কষ্টটা হয় না। রোগী যখন ধাতস্থ হয়ে আসে আমরা তার সুস্থ জীবনচর্যার ব্যবস্থা করি।’’

আরশি জানতে চায়, ব্যবস্থাটা কীরকম।

‘‘এই যেমন ধরুন, নেশা-আসক্তরা নিজের কাজ, নিজেরা করতে চায় না। ড্রাগ অ্যাডিক্টরা তো হাতে করে খাবারটুকু খেতে আলস্য বোধ করে। বাড়ির লোকই প্রথমে তাদের অভ্যেসটা নষ্ট করে দেয়। স্নান করতে চায় না যে-কোনও নেশা-আসক্তই। আমরা তাদের বুঝিয়ে, বকে-ধমকে জীবন অভ্যেস ফেরানোর চেষ্টা করি। যেহেতু নেশার উপকরণ হাতের কাছে নেই, উপায় নেই নেশা করার, ওরা ধীরে-ধীরে আমাদের নির্দেশে সাড়া দেয়। নিয়মিত ক্লাস নিই আমরা, মনীষীদের বাণী, জীবনী পড়ে শোনাই। হোমের চৌহদ্দির মধ্যেই ইনডোর, আউটডোর গেমস-এ ওদের ইনভল্ভ করি। ওরাই গোটা হোমটা ঝাঁট দিয়ে ধুয়ে মুছে রাখে।’’

ম্যানেজারের এই কথায় আরশি বুঝতে পারে, সেন্টারটা কেন এত পরিষ্কার। শৌর্য জিজ্ঞেস করে, ‘‘পেশেন্টের জন্য কত দিতে হবে আপনাদের? মানে চার্জ কেমন?’’

‘‘এটা তো একটু লং প্রসেস, তাই চার্জটা আমরা মান্থলি হিসেবে ধরি। দশ হাজার ধরা আছে, সবাই তো দিতে পারে না। প্রত্যেকের বাড়ির অবস্থা সমান নয়। কিন্তু আমাদের কাছে সমস্ত রোগীই সমান। পরিবারের আর্থিক দিকটা বিচার করে চার্জ কমাতে হয়। তিন-চার হাজার টাকার চার্জে এখানে অনেক পেশেন্টই আছে। যতই হোক এটা তো একটা সেবা প্রতিষ্ঠান। প্রফিট ওরিয়েন্টেড বিজ়নেস নয়।’’

শৌর্য জিজ্ঞেস করল, ‘‘সেবার টাকাটা আসে কোথা থেকে? আপনি যে চার্জটার কথা বললেন, এটাতে একজন পেশেন্টের ভরণপোষণ সম্ভব নয়, তারপর তো আপনাদের খরচও আছে।’’

‘‘উমেশবাবুর মতো কিছু মানুষজন আছেন, তাঁরা সাহায্য করেন। এক প্রকার এনজিও বলেই মনে করতে পারেন আমাদের। সরকারি সাহায্য এখনও পাই না। পেলে চার্জ আরও কমাতে পারব। তবে কিছু খরচ থেকে আমরা রেহাই পাই। ঝাড়াই-বাছাই তো শুনলেন, এখানকার আবাসিকরা করে। রান্না-বান্না, কাপড়কাচা, বাজার দোকান, সব এরাই সামলায়। যারা অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে, তাদের দিয়েই একমাত্র বাইরে কেনাকাটির কাজগুলো করাই। অসুস্থ অবস্থায় পেশেন্টরা পালানোর চেষ্টা করে। তাই গোটা হোম তালা দিয়ে রাখতে হয়। চাবি থাকে আমাদের মতো রিকভার করা পেশেন্টের কাছে।’’

তালার রহস্য খুলে গেলেও অন্য একটা ধাঁধা চলে এল সামনে। আরশি সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘আপনিও পেশেন্ট ছিলেন?’’

নির্মল হাসি উপহার দিয়ে ম্যানেজার বলল, ‘‘এখানকার সমস্ত কর্মচারীই এক সময় কোনও না-কোনও নেশায় অ্যাডিক্টেড ছিল। এই ধরনের হোমে তারা সুস্থ হয়েছে। এমনকী যিনি আমাদের হেড, তিনিও নেশামুক্ত হন এভাবেই। রোগীকে সুস্থ জীবনে ফেরানো যে সম্ভব, এটা আমরাই সবচেয়ে ভাল বুঝি। যেহেতু ওই অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমরা গিয়েছি।’’

‘‘আপনাদের হেড কে? তিনি কি এখানেই থাকেন?’’ শৌর্যর প্রশ্ন শেষ হতে না-হতেই এক মহিলার চিৎকার ভেসে এসেছিল। বুক কাঁপিয়ে দেওয়া শব্দ। সিট ছেড়ে উঠে পড়ল ম্যানেজার। কাঁচুমাচু মুখে বলেছিল, ‘‘একটু বসতে হবে কিন্তু। মেয়েদের সেক্টরে লোক কম। আমাকেই দেখতে হবে কী হয়েছে। ইনি নতুন পেশেন্ট, দিনচারেক হল এসেছেন।’’

শৌর্য বলল, ‘‘আওয়াজটা দোতলা থেকে এল মনে হল…’’

‘‘হ্যাঁ, দোতলাটা ফিমেল সেক্টর, একদম সেপারেট… আপনি ততক্ষণ আমাদের ব্রোশিওরটা দেখুন, আরও অনেক কিছু জানতে পারবেন, আমি আসছি ঘুরে…’’ বলে সেই গিয়েছে ম্যানেজার, আধঘণ্টা বোধহয় হল, ফেরার নাম নেই। শৌর্য মন দিয়ে ব্রোশিওরটা পড়ে যাচ্ছে। সংসার ছেড়ে যাওয়ার পর মা এখানে কিছুদিন ছিল, এটা ভেবেই কেমন যেন রোমাঞ্চ বোধ করছে আরশি। ইচ্ছে করছে দোতলাটায় যেতে। ওখানে নিশ্চয়ই এমন জানলা আছে, যার সামনে দাঁড়িয়ে মা আরশি, না, না, ঝুমুর কথা ভাবত। এখান থেকে আবার কোথায় যে চলে গেল!

ফিরে এল ম্যানেজার। হাসিমুখে শৌর্যকে বলল, ‘‘পড়লেন ব্রোশিওরটা?’’

‘‘হ্যাঁ, এ তো বিরাট ব্যাপার। শুধু এই হোম নয়, এর সঙ্গে আরও অনেক রিহ্যাব সেন্টার জড়িয়ে আছে। প্রত্যেক মাসে একটা করে মিট হয় আপনাদের। নেশামুক্তির পর কে কেমন আছে, কী করছে, অ্যাডিক্টেডদের জন্য আর কী করা যায়, এই সব নিয়ে আলোচনা হয়। খাওয়াদাওয়া হয় সকলে মিলে। আপনাদের হোমের ডিরেক্টর তো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বড় পোস্টে আছেন। নেশার কারণে চাকরি থেকে সাসপেন্ড হয়েছিলেন। এরকমই একটা রিহ্যাবে থেকে সুস্থ হন। কোম্পানি ফের চাকরিতে বহাল করে। নিজের জীবন অভিজ্ঞতা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই হোমটা গড়ার পরিকল্পনা করেন।’’

গর্বের হাসি হাসছে ম্যানেজার। শৌর্যর নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছে এবার উঠবে। বলে ওঠে, ‘‘ঠিক আছে, আমরা তো গোটা ব্যাপারটা বুঝে নিলাম, বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আলোচনা করি। দেখি, ওর গার্জেনরা কী ডিসিশন নেয়।’’

‘‘হ্যাঁ, দেখুন…’’ বলার পর কিছু একটা মনে পড়ল ম্যানেজারের, বলল, ‘‘আর-একটা কথা বলে রাখি, নেশা-আসক্তরা বেশির ভাগই হোমে আসতে চায় না। জোর করে নিয়ে আসার লোক আমাদের আছে। মানে মাস‌্‌লম্যান টাইপের। যদিও অনেক গার্জেনই চায় না তাদের সন্তানকে ওভাবে নিয়ে যাওয়া হোক। পাড়ার লোক দেখবে। এটা তাদের কাছে লজ্জার। সন্তান নেশা করে সেটা লজ্জার নয়, দুর্ভাগ্যের। সে যাই হোক, গার্জেন যদি চায় আমরা মাঝরাতে লোক পাঠিয়ে ঘুমন্ত পেশেন্টকে তুলে আনতে পারি। প্রয়োজনে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে নেব। পেশেন্টের ঘুম ভাঙবে অচেনা পরিবেশে, মানে আমাদের এখানে। চেঁচামেচি করতে পারে পেশেন্ট, আমরা ঠিক সামলে নেব। ও নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। লিফটিং-এর খরচাটা কিন্তু আলাদা দিতে হবে।’’

‘‘ওকে, ফাইন! এবার উঠি তা হলে?’’ বলেও উঠল না শৌর্য। টেবিলের উপর সামান্য ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘‘ছোট্ট একটা কৌতূহল আছে।’’

‘‘বলুন না, হেজ়িটেট করছেন কেন?’’ বলল ম্যানেজার, শৌর্য বলে, ‘‘যতদূর শুনেছি উমেশবাবুর পেশেন্ট অভিনেত্রী রায়া সেন এখানে ছিলেন। উনি কি সু্স্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন? পরে কিন্তু আর কোনও সিনেমায় দেখা যায়নি!’’

আরশি কান খাড়া করে রাখে উত্তরের জন্য। ম্যানেজার বলে, ‘‘ওঁর ব্যাপারটা এই হোমের একটা বিরাট শিক্ষা। আমি অবশ্য তখন ম্যানেজার ছিলাম না। এমনকী পেশেন্ট হিসেবেও অ্যাডমিটেড হইনি। ঘটনাটা শুনেছি আগের ম্যানেজারের থেকে। রায়া সেন এখানে এসে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠেন। হোমের লোকেদের অন্তত তাই মনে হয়েছিল। সকলের সঙ্গে দারুণ ভাব। হোমের সব কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া, অন্য পেশেন্টের খেয়াল রাখা, এই সব দেখে ম্যানেজার ওঁর হাতে গেটের চাবি তুলে দেন। তখন ছেলেদের সেক্টরেও রায়া সেনের অবাধ যাতায়াত। একদিন ভোরবেলা দুটো গেটের তালা লাগিয়ে উধাও হয়ে গেলেন। তালা মারার কারণ, যাতে চট করে বেরিয়ে পড়তে না পারে হোমের কর্মচারীরা। থানায় ফোন করা হল। পুলিশ এসে তালা ভাঙল, রায়া সেনের ডিটেলস নিয়ে খোঁজ শুরু করল পুলিশ। রায়া সেন ততক্ষণে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এটাই মাদকাসক্তদের নিয়ে সমস্যা, বাইরে থেকে সহজে বোঝা যায় না কতটা সুস্থ হয়েছে।’’

‘‘ভাল করে খুঁজে ছিল তো পুলিশ?’’ বলে ফেলেই আরশি বুঝল ভুল হয়ে গেল। রায়া সেনের ব্যাপারে বাড়তি কৌতূহল দেখে মনে সন্দেহ জাগতে পারে ম্যানেজারের। শৌর্য দ্রুত সামাল দিল পরিস্থিতি। বলল, ‘‘উনি অত কিছু কী করে জানবেন? তখন তো এই হোমে আসেনইনি! সবটাই শুনেছেন অন্যের মুখে।’’

চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল শৌর্য। দেখাদেখি আরশিও। শৌর্য দু’হাত দিয়ে ম্যানেজারের হাত ধরে বলল, ‘‘আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। অনেকটা সময় দিলেন আমাদের। আশা করছি আবার দেখা হবে।’’

‘‘ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই, এটাই আমাদের কাজ… আমরা চাই আপনারাও আমাদের পাশে থাকুন,’’ হাত ফেরত নিতে-নিতে বলল ম্যানেজার।

দরজার দিকে ঘুরতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল শৌর্য। বলে ওঠে, ‘‘বাই দ্য ওয়ে, আপনার নাম তো জানা হল না।’’

‘‘রাজপুত্র গোস্বামী।’’

থমকাল শৌর্য। আরশিও হোঁচট খেয়েছে। শৌর্য বলে, ‘‘সত্যিই এটা আপনার নাম, নাকি ছদ্মনাম?’’

‘‘এটাই নাম। বাবা দিয়েছিল। অনেকেই বাবাকে প্রশ্ন করত, ‘কেন এমন অদ্ভুত নাম রাখলে ছেলের?’ বাবা হাসতে-হাসতে বলত, ‘রাজা তো হতে পারব না কোনওদিন, তাই ছেলের ওই নাম রেখে রাজা হয়ে গেলাম!’ আসলে বাবা আমাকে রাজার ধনের মতোই আগলে রাখত। নেশা করে বাবাকে নিঃস্ব করলাম আমি। আমার সুস্থ হয়ে ওঠাটা দেখে যেতে পারেনি বাবা। তার আগেই চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে।’’

‘‘আই অ্যাম সো সরি! প্রশ্নটা না করলেই হত,’’ বলল শৌর্য।

ম্যানেজার বলে,‘‘ না, না, তাতে কী আছে! তবে রাজপুত্র নামটা তেমন চালু নয়। রাজু নামেই সকলে চেনে। আপনারা ‘রাজু’ নামটাই মনে রাখবেন।’’

হোম থেকে বেরিয়ে এসেছে আরশিরা। বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ, আরশির মন মেঘলা। মা কেন সুস্থ হওয়ার পথ ছেড়ে পালাল? এদিকে ম্যানেজার সুস্থ হয়েও অনুতাপের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। নেশা কী পরিমাণ ধ্বংসাত্মক এখানে এসে টের পেল আরশি।

শৌর্য বাইকে উঠতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা অ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে এই রাস্তায়। আওয়াজ করে নয়, নিঃশব্দে। আরশি বলে, ‘‘কী হল, দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? রাস্তা তো চওড়া, পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যাবে।’’

‘‘অ্যাম্বুলেন্সটা মনে হচ্ছে এই সেন্টারেই আসছে।’’

‘‘কী করে বুঝলে?’’

‘‘মনে হচ্ছে হসপিটাল থেকে ডিটক্সিফিকেশন করে পেশেন্টকে এখানে রাখতে আসছে। যেহেতু সিরিয়াস পেশেন্ট নয়, সাইরেন বাজাচ্ছে না।’’

শৌর্যর কথা শেষ হওয়ার আগেই সেন্টারের গেট থেকে একটু এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল অ্যাম্বুলেন্স। খুলে গেল পিছনের দরজা। শৌর্যর অনুমান সঠিক প্রমাণ করে নেমে আসছে তিনজন। মাঝেরজন ইয়ং, ড্রাউজ়ি অবস্থায় রয়েছে। বাকি দু’জন ধরে আছে তাকে। ঝিমিয়ে থাকা ছেলেটিই যে পেশেন্ট, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। ড্রাইভার কেবিনের বাঁদিকের দরজা খুলে নামল একটি মেয়ে। পরনে নার্সের পোশাক। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ডোরবেলের সুইচ টিপল মেয়েটি। বাইকের কাছে দাঁড়ানো শৌর্য মেয়েটির উদ্দেশে গলা তোলে, ‘‘আরে, তুমি!’’

ঘুরে তাকাল মেয়েটা। শৌর্যকে দেখে অবাক! একমুখ হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুখে। গেট খুলে দিয়েছে সেন্টারের ছেলেটা। পেশেন্ট নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে দু’জন। মেয়েটা শৌর্যর সামনে এসে বলল, ‘‘জানতাম এভাবেই দেখা হবে। তা এখানে কেন?’’

‘‘এক বন্ধুকে অ্যাডমিট করব, তাই খবর নিতে এসেছি। তুমি মনে হচ্ছে ভরতি করাতে এলে পেশেন্টকে?’’

ধাতস্থ হয়ে মেয়েটি বলল, ‘‘হ্যাঁ, হাসপাতাল থেকে পাঠাল আমাকে দায়িত্ব দিয়ে। আগেও এসেছি।’’

‘‘যাবে না ভিতরে?’’

‘‘একটু পরে গেলেও চলবে। কয়েকটা জায়গা সই করতে হবে শুধু।’’

কথা শেষ করার পর মেয়েটির চোখ গেল আরশির দিকে।

শৌর্য বলল, ‘‘আমার বন্ধু, আরশি।’’

হাত নেড়ে ‘হাই’ বলল আরশি। মেয়েটি বলল, ‘‘হ্যালো, আমি নবমী।’’

আরশি কিছু বলতে যাবে, নবমী মুখ ঘুরিয়ে নিল শৌর্যর দিকে। গাঢ় গলায় বলল, ‘‘আমার জার্নির কী হল? কবে বেরোবে?’’

‘‘খুব তাড়াতাড়িই একবার ওই পথে যেতে হতে পারে মনে হচ্ছে। আগের বারের ফোটো কাজে লাগেনি। নতুন করে তুলতে হবে।’’

‘‘কবে যাবে বোলো প্লিজ়। আমি ঠিক ছুটি ম্যানেজ করে ফেলব। আমাদের বাড়িতেও নিয়ে যাব তোমাকে। বাড়ির লোক অবাক হবে খুব।’’

‘‘যাব, যাব। শেডিউল তৈরি হোক, ডেটটা জানাব।’’

‘‘যদি না জানিয়ে চলে যাও, তখন দেখবে কী করি।’’

‘‘কী করবে? তোমার সঙ্গে তো আমার দেখাই হয় না!’’

‘‘কে বলেছে হয় না! হামেশাই দেখা হয়ে যায়। বাসস্টপে, হাসপাতালের করিডরে, নাইট ডিউটির রাতে চোখ বুজে এলে তোমার সঙ্গে কথা বলে ঘুম তাড়াই। তোমার ভুলো মন, তাই কিছু খেয়াল থাকে না।’’

‘‘বুঝেছি। তুমি ভুলেও এই সেন্টারে ঢুকো না। ভরতি করে নেবে।’’

‘‘সারাতে পারবে না। আমি এমন একজনের নেশায় বুঁদ, আরোগ্যের কোনও রাস্তা নেই।’’

হেসে ফেলে শৌর্য। বলে, ‘‘সত্যি নেই।’’

বাইকে উঠে পড়েছে শৌর্য। আরশি পিছনে গিয়ে বসে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ‘চলি’ বলে শৌর্য এগিয়ে যায়, ওরা চোখের বাইরে যাওয়া অবধি তাকিয়ে থাকে নবমী, মুখ ঘুরিয়ে সেন্টারে ঢুকতে যাবে, দেখে, পাঁচিলের উপর রাখা একটা হেলমেট। চিনতে পারে নবমী। হেলমেটটা যে তারই কেনা। একটা সরল হাসি ফুটে ওঠে মুখে। মনে-মনে বলে, ‘সো সুইট!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *