১
শিয়ালদা স্টেশন থেকে নেমে আসতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল আরশি। সামনের কয়েক ধাপ সিঁড়ির পরই জ্ঞানত প্রথমবার এই শহরে পা রাখতে চলেছে সে। ছোটবেলায় মা-বাবার সঙ্গে নাকি এসেছিল, যার কোনও স্মৃতিই নেই ওর মনে। বাবা মনে করানোর চেষ্টা করে, সোনাজ্যাঠার বাড়ি, চিড়িয়াখানা, মেট্রোরেল… ছবিগুলো সিনেমা, টিভি সিরিয়ালের রেফারেন্স থেকে আন্দাজ করে নিতে পারলেও, নিজের ছোটবেলাটা সেখানে খুঁজে পায় না আরশি।
‘‘দিদি, ট্যাক্সি লাগবে?’’ সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল একটা লোক। পাশে আর-একজন। দু’জনেরই যথেষ্ট বয়স, আরশিকে ‘দিদি’ সম্বোধন করার কথা নয়, বড়লোকি চেহারার জন্যই করল। মাথা নেড়ে ট্যাক্সির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আরশি নেমে এল নীচে। নাক বরাবর হাঁটতে থাকে। পিঠে ঢাউস রুকস্যাক, ট্যাক্সি তাকে নিতেই হবে। তার আগে ঠিক করতে হবে আপাতত যাবে কোথায়।
দুপুর দুটোয় গোলপার্কে যাওয়ার কথা আরশির। এখন সকাল আটটা। ট্রেন যদি লেট না করত, আরও আধঘণ্টা আগে পৌঁছে যেত শিয়ালদায়। এখানে তাকে রিসিভ করার কথা ছিল পূর্বার। আগামী সাতদিন ওদের বাড়িতেই থাকা ঠিক হয়েছিল। ফেরার ট্রেন ধরত ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে শিয়ালদায় এসে। সেই মতো রিজ়ার্ভেশন করা আছে টিকিট। আজ ভোরে ফোন এল পূর্বার! রিং-এর আওয়াজ ঘুম ভেঙেছিল আরশির। বার্থে শুয়ে ফোন ধরেছিল সে। ট্রেনের দুলুনি আর তন্দ্রাভাব উপভোগ করতে-করতে জড়ানো গলায় বলেছিল, ‘‘ঠিক আছি রে বাবা। ঘুমোচ্ছি। এখনও কিডন্যাপ্ড হইনি।’’
গতকাল ট্রেনে ওঠার পর থেকে বারছয়েক ফোন করে সতর্ক করেছে পূর্বা, ‘‘পার্স, মোবাইল সব সময় সঙ্গে রাখবি। টয়লেটে যাবি ট্রেন রানিং অবস্থায়। কেউ যেচে পড়ে আলাপ করতে এলে পাত্তা দিবি না…’’ এরকম আরও অনেক কিছু। কিন্তু ভোরের ফোনটা একেবারেই ওই গোত্রের ছিল না। ভীষণ উৎকণ্ঠায় পূর্বা বলে উঠেছিল, ‘‘বিরাট বিপদ হয়ে গিয়েছে রে বাড়িতে! মাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নার্সিংহোমে। হাউস ফিজ়িশিয়ান বলছে, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। তুই দু’-চারটে দিন অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা কর। তোর কোনও রিলেটিভের বাড়িতে। মায়ের ব্যাপারটা কন্ট্রোলে এলেই তোকে ডেকে নেব।’’
উত্তরে কী বলেছিল, এখন আর মনে নেই আরশির। অদ্ভুত একটা ঘোর-লাগা অনুভূতি। মনে হচ্ছিল, সে পড়ে রইল স্থির, ট্রেনটা তাকে ছেড়ে ছুটে যাচ্ছে। আপার বাঙ্কে তার বার্থ। উঠে বসেছিল আরশি। কান দুটো গরম হয়ে গিয়েছে। ধড়াসধড়াস করছে বুক। কলকাতার কিচ্ছু সে চেনে না। এখানকার কোনও আত্মীয়র সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই। আরশির ফেসবুকের কিছু বন্ধু অবশ্য আছে। কিন্তু তাদের তো হঠাৎ মেসেজ করে বলা যায় না, তোমার বাড়িতে থাকতে আসছি। ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডের উপর অতটা দাবি খাটানো যায় না। তা হলে কি শিয়ালদায় নেমেই বাড়ি ফেরার বন্দোবস্ত করবে? ট্রেনের রিজ়ার্ভেশন পাওয়া যাবে না কিছুতেই। উইদাউট রিজ়ার্ভেশনে জেনারেল কামরায় জলপাইগুড়ি অবধি যাওয়া প্রায় অসম্ভব। হাতে রইল ভলভো বাস। ধর্মতলা থেকে ছাড়ে সন্ধেরাতে। আরশি জানে না ধর্মতলা কোথায়। সে না হয় লোককে জিজ্ঞেস করে পৌঁছে যাবে। কিন্তু সেখানেও যদি সিট না পাওয়া যায়, রাতটা কোথায় কাটাবে আরশি? এসি কামরায় বসে ঘামছিল সে। এই সব ঝঞ্ঝাট থেকে বাঁচতে গেলে আরশির অবশ্যই যেটা করা উচিত, তা হল বাবাকে একটা ফোন। আর কিছু ভাবতে হবে না। বাবা আজই তার জলপাইগুড়ি ফেরার বন্দোবস্ত করে ফেলবে। অথবা আরশি যদি বলে আমি কলকাতার কাজ সেরেই ফিরব, বাবা জলপাইগুড়িতে বসেই তারও ব্যবস্থা করবে অনায়াসে। সে ক্ষেত্রে একটা সমস্যা হচ্ছে, বাবা যেখানে, মানে যাদের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করবে, তারা আরশির ব্যাপারে এতটাই খেয়াল রাখবে, কলকাতায় আসার মূল উদ্দেশ্যটা পণ্ড হবে। বাবা আসল উদ্দেশ্যটা জানে না। আরশি অন্য অজুহাত দিয়ে কলকাতায় এসেছে। বলেছে মাস কমিউনিকেশন নিয়ে কোথায় ভাল পড়ানো হয়, অ্যাডমিশন অনার্সের নাম্বার দেখে হয়, নাকি পরীক্ষা দিতে হবে, সব ভাল করে বুঝে আসতে চায়। কলকাতায় গিয়ে থাকবে পূর্বাদের বাড়িতে।
গোটা পরিকল্পনাটায় আপত্তি করেনি বাবা। খানিক দ্বিধা নিয়ে একবার শুধু বলেছিল, ‘‘আমি গিয়ে দিয়ে আসি পূর্বাদের বাড়ি? ফেরার দিন নিয়ে আসব।’’
‘‘কোনও দরকার নেই। অনার্সের ফাইনাল ইয়ার কমপ্লিট হয়েছে আমার, এখন আমি আর ছোট্টটি নই। পূর্বা আমাকে স্টেশন থেকে রিসিভ করবে, ফেরার দিন সি অফও করতে আসবে। শুধু ট্রেনজার্নিটুকু একা। পূর্বা তো হায়ার সেকেন্ডারির পর থেকেই একা যাতায়াত করত এই রুটে,’’ বলেছিল আরশি।
বাবা আর কোনও আপত্তি করেনি। পূর্বার মা-বাবার সঙ্গে আরশির কলকাতায় থাকার ব্যাপারে কথা বলে নিয়েছিল। পূর্বার সঙ্গেও কথা হয়েছে বাবার। কাল যখন আরশিকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিল বাবা, তখনও একবার পূর্বাকে ফোন করে জেনেছে। সে শিয়োর আসছে, নাকি আরশি ট্যাক্সি নিয়ে ওদের বাড়িতে যাবে?
‘আসছি’ বলে আশ্বস্ত করেছিল পূর্বা। তখন তো আর জানত না পরিস্থিতি এভাবে বদলে যাবে। পূর্বার কারণেই এত নিশ্চিন্ত মনে আরশিকে ছেড়েছে বাবা। জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চার বছর পড়েছে পূর্বা। লাস্ট দু’বছর আরশিদের বাড়ির পেয়িংগেস্ট ছিল। ফাঁকায় লেখাপড়া করতে পারবে বলে। পূর্বা আরশিদের বাড়ির লোকই হয়ে গিয়েছিল প্রায়। ওর বাবা-মা-ও মাঝে-মাঝে এসে থাকত। পূর্বারা আরশিদের কাছে আত্মীয়র চেয়ে কিছু কম নয়। পূর্বার মায়ের হার্ট অ্যাটাকটাই সমস্ত ব্যবস্থাটা ওলটপালট করে দিল। কাকিমার অসুস্থতার কথা শুনে মনখারাপ করছিল আরশির, তবে তেমন জোরালো কিছু নয়। এই মুহূর্তে নিজের কলকাতায় থাকা নিয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। বাবাকে ফোন করে ফিরে সে যেতেই পারে। কিন্তু যে লক্ষ্য নিয়ে চলেছে কলকাতায়, সেটা এবার হাতছাড়া হলে আর কখনও সুযোগ নাও আসতে পারে। চিন্তায় মাথা জট পাকিয়ে গিয়েছিল আরশির। বাঙ্ক থেকে নেমে ট্রেনের টয়লেটে যায়। ঘাড়ে-মুখে জল দিয়ে যখন ফিরে এল, ছুটন্ত ট্রেনের কাচের জানলার বাইরে তখন ভোর ফুটছে।
ওই আলোই যেন একটু সাহস জুগিয়েছিল আরশিকে। মনে হয়েছিল কলকাতায় ঘণ্টাখানেক ঘুরে দেখি না, কোথাও নিরাপদ কোনও থাকার ব্যবস্থা করা যায় কি না। না পেলে, বাবাকে সমস্যার কথা জানাবে। ভাবনা থামিয়ে ফের চাদর টেনে ঘুমের কোলে মাথা রেখেছিল আরশি। ট্রেনের দুলুনির ঘুম ভীষণ এনজয় করে আরশি। তার উপর এবার সে একা! এর মজাই আলাদা।
আবারও ঘুম ভেঙেছিল ফোনের রিংটোনের আওয়াজ। বাবার কল। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘পৌঁছলি?’’
ট্রেনের অ্যারাইভাল টাইম ধরে ফোন করেছিল বাবা। আরশি একেবারে স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, ‘‘না, পৌঁছয়নি এখনও। লেট রান করছে।’’
‘‘কত লেট?’’ জানতে চেয়েছিল বাবা।
আরশি বলেছিল, ‘‘খুব বেশি নয় মনে হয়। তেমন দেরি হলে কো-প্যাসেঞ্জাররা নিশ্চয়ই বলাবলি করত। তুমি চিন্তা কোরো না, ট্রেন থেকে নেমেই ফোন করে দেব।’’
সেই ফোন এখনও করা হয়নি। স্টেশন চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে আরশি। সামনে ওয়ানওয়ে রাস্তা। কলকাতার ভিড় সম্বন্ধে যা শুনেছিল, এখন তেমনটা দেখছে না। গাড়ির জ্যাম নেই, লোক চলাচল স্বাভাবিক। কাঁধের ভারী ব্যাগটার জন্য একটু ঝুঁকে গিয়েছে আরশি, স্টেশনে ঢোকার রাস্তা ছেড়ে উঠে পড়ে ফুটপাথে। লাগোয়া ওয়ানওয়ে রাস্তাটা গিয়েছে বাঁদিকে, ওপারেরটা ডান দিকে। গোলপার্কটা কোন দিকে? কাজটা যেহেতু ওইখানেই, ওখানকার কাছাকাছি কোনও হোটেলে থাকাই উচিত হবে। শুধু একটাই চিন্তার বিষয়, একুশ বছরের একটি মেয়েকে কি একা থাকতে দেবে কোনও হোটেল? ডান-বাঁয়ে তাকিয়ে এক ভদ্রলোককে বেছে নেয় আরশি, উনি কাছাকাছি এসে পড়তেই জিজ্ঞেস করে, ‘‘স্যার, গোলপার্ক যাব। কোথায় দাঁড়াব ট্যাক্সির জন্য?’’
আরশিকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে লোকটা বলল, ‘‘ওপারের রাস্তায় চলে যাও। ট্যাক্সি যদি রিফিউজ় করে ক্রসিং-এ দাঁড়ানো ট্রাফিক পুলিশকে বলবে। ওরাই অ্যারেঞ্জ করে দেবে ট্যাক্সি।’’
‘‘থ্যাঙ্ক ইউ,’’ বলে সৌজন্যের হাসি হাসল আরশি। হাসি বিনিময় করে এগিয়ে গেল লোকটা। সিগনাল না পেয়ে সমস্ত গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে। আরশি রাস্তা পার হয়। ওপারে পৌঁছে একটা হলুদ ট্যাক্সিকে হাত দেখাতেই দাঁড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, ‘‘কোথায়?’’
আরশি গন্তব্য বলে। ড্রাইভার বলল, ‘‘উঠে পড়ুন।’’
এখনও অবধি ঠিকঠাক আছে সব কিছু। শহরের মানুষগুলো বেশ কো-অপারেট করছে। এরপর কী হয় দেখা যাক! কলকাতার বদনাম তো কিছু কম নয়। কাঁধের ব্যাগ পাশে রেখে সিটে হেলান দিয়েছে আরশি। ট্যাক্সির ড্রাইভারের চেহারাটা ভদ্রসভ্য। এর থেকে কি গোলপার্ক সংলগ্ন কোনও ভাল হোটেলের রেফারেন্স চাওয়া যায়? ‘ভাল’ বলতে হাইফাই কিছু নয়। মধ্যবিত্তের জন্য নির্ভরযোগ্য হোটেল। আরশির সঙ্গে খুব বেশি টাকা নেই। হোটেলে থাকতে হতে পারে, দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। ডেবিট কার্ড অবশ্য আছে। অ্যাকাউন্ট তেমন হেলদি নয়। লাগে না তো বড় একটা। দামি হোটেলে থাকতে হলে বাবাকে বলতে হবে অ্যাকাউন্টে টাকা ফেলতে। বাবা জানতে চাইবে, হঠাৎ টাকার দরকার পড়ছে কেন? সত্যিটা বললে বাবা কিছুতেই একা হোটেলে থাকতে দেবে না। আর মিথ্যে বলতে গিয়ে এত কথা বানাতে হবে, পরে হয়তো নিজেরই সব মনে থাকবে না। অর্থাৎ নিজের ভাঁড়ারে যেটুকু টাকা আছে, তার সঙ্গে সংগতি রেখে বাছতে হবে হোটেল।
ইতিমধ্যে তিনটে ক্রসিং পার হল ট্যাক্সি। কোনওটাতেই বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হয়নি। এখন রাস্তা বেশ ফাঁকা, স্পিড তুলেছে ড্রাইভার। আরশি জিজ্ঞেস করে, ‘‘আচ্ছা দাদা, গোলপার্কে মাঝারি ভদ্রস্থ কোনও হোটেল…’’
কথা শেষ করতে পারে না আরশি, ফোন বাজছে তার। মনে হচ্ছে বাবার ফোন। আরশিরই করার কথা ছিল, ভুলে মেরে দিয়েছে। জিন্স থেকে ফোনসেট বার করল আরশি, ঠিক তাই। বাবার কল। কানে ফোন নিয়ে আরশি বলল, ‘‘হ্যাঁ, বাবা। নেমে পড়েছি। ট্যাক্সিতে আছি এখন।’’
‘‘পূর্বা এসেছে নিতে?’’ ও প্রান্ত থেকে জানতে চাইল বাবা।
আরশি বলল, ‘‘হ্যাঁ, আমার পাশেই বসে আছে। কথা বলবে? না, দাঁড়াও পরে কথা বোলো। ফোনে কাউকে কোনও মেসেজ পাঠাচ্ছে দেখছি।’’
‘‘ওকে, পরে কথা হবে। ওদের বাড়ি পৌঁছে সময় করে একবার ফোন করিস। রাখছি।’’
ফোন কাটল বাবা। আরশির এই মুহূর্তে ভীষণ টেনশন হচ্ছে। এত বড় মিথ্যে বলার জন্য নয়, মিথ্যেটা যখন বলছে, ড্রাইভার ঘাড় ঘুরিয়ে কড়া চোখে তাকিয়েছিল। ভেবেছে মেয়েটার নিশ্চয়ই কোনও বদ মতলব আছে। সঙ্গে কেউ নেই অথচ বাবাকে বলছে পাশে বসে আছে একজন। ড্রাইভারের যা এক্সপ্রেশন দেখল আরশি, হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে না বলে ওঠে, ‘নেমে যান।’
২
সাধারণত এত স্পিডে বাইক চালায় না শৌর্য। ফাঁকা হাইওয়ে পেলে বড়জোর ষাট। এখন চালাচ্ছে একশোর উপর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতায় ফিরতে হবে। বিকেলের দিকে একটা অ্যাসাইনমেন্ট আছে। পিঠোপিঠি দিনে দুটো কাজ নেওয়া ঠিক হয়নি। বিশেষ করে দুটো কাজের মাঝের দূরত্ব যেখানে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার। মহুলিয়াতে লোকেশন শুট করে এল শৌর্য। কলকাতায় ফিরে লুক টেস্টের ফোটো তুলতে হবে। দুটো কাজই সুমিতদার। সিনেমা এবং টিভি সিরিয়ালে স্টিল ফোটোগ্রাফির কাজ সুমিতদার হাত ধরেই শুরু করে শৌর্য। হিসেব মতো সুমিতদাকে ‘কাকা’ সম্বোধন করা উচিত। খুব ঘনিষ্ঠ না হলেও বাবার বন্ধু ছিল সুমিতদা। ক্লাসমেট। কিন্তু আর্টিস্ট পরিমণ্ডলে কাকা, মামা, জেঠা, পিসি চলে না। বড়রা যত বড়ই হোক সবাই দাদা-দিদি। শিল্পীদের ক্ষেত্রে এই বাড়তি সুবিধেটার যে কে বন্দোবস্ত করেছিল, কে জানে! তবে তিনিও যে একজন শিল্পী, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
হাইওয়ের দু’পাশে এখন জঙ্গল। দু’দণ্ড থামতে ইচ্ছে করছে শৌর্যর। উপায় নেই। চারটের মধ্যে কলকাতায় তাকে ফিরতে হবেই। তার আগে বাড়ি ঢুকে চান-খাওয়া সারলে মা মনে শান্তি পাবে, নিজেও ফ্রেশ মুডে লুকটেস্টের ছবিগুলো তুলতে পারবে। ডেলাইট থাকতে-থাকতে আউটডোর শুট সেরে নিতে হবে, সুমিতদার তেমনটাই নির্দেশ। বলেছিল তিনটের মধ্যে ঢুকে যেতে। ক’জন ক্যান্ডিডেট অডিশন দিতে আসছে, জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছে শৌর্য। অডিশনে সিলেক্ট হলে ফোটোশুট, তিনটের জায়গায় চারটেতে পৌঁছলে খুব লেট হবে বলে মনে হয় না। অত ঘড়ি ধরে চলে না টলিউড ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু দিনের আলো তো লেট করবে না। হাইওয়ের লাগোয়া এই জঙ্গলটায় যখন বিকেলের হলুদ আলো ছড়িয়ে পড়বে, শৌর্য তখন ইউনিটের একগাদা লোকজনের মাঝে অতি ব্যস্ততায় ফোটো তুলে যাবে সুমিতদার নতুন সিনেমার সম্ভাব্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের।
প্রকৃতির ছবি তুলবে বলেই ফোটোগ্রাফি শিখেছিল শৌর্য। এখন সেই প্রকৃতিকে ফেলে রেখে ছুটতে হচ্ছে রোজগারের ধান্দায়। এমনটাই বোধহয় বেশিরভাগ মানুষের জীবনে ঘটে। শৌর্যর বাবা হতে চেয়েছিল লেখক, অ্যাড এজেন্সির কপিরাইটার হিসেবে কাজ জুটল প্রথমে। তারপর সেই কোম্পানির প্রোডাকশন অ্যাসিস্ট্যান্ট। বড় অসময়ে চলে গেল বাবা, শৌর্য তখন সবে কলেজে ঢুকেছে। বাবা বলত, ‘‘জেনারেল কোর্সে কলেজে পড়ছিস পড়। রোজগার করবি সেই কাজ করে, যেটাতে আনন্দ পাবি। তার জন্য যদি অন্য ধরনের লেখাপড়া করতে হয়, করবি। জীবনভর অপছন্দের কাজ করে যাওয়া যে কী শাস্তির, তা আমি হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছি!’’
এই কথাটা শৌর্যর বেলায় খাটে না। যেহেতু ওর মাথার উপরের ছাদ যথেষ্ট পুরু। বাবা মোটা টাকার চাকরি করত, মা কলেজে পড়ায়। সংসারের প্রয়োজনে অপছন্দের রোজগারের রাস্তা বেছে না নিলেও চলবে। হাতে অনেকটাই সময় নিজের মতো কেরিয়ার গড়ার। ঘটনাচক্রে ছাব্বিশ বছরেই তা গড়ে উঠেছে। মা তাতে সন্তুষ্ট নয়। বলে, ‘‘যতই ইনকাম হোক, সেই তো ফোটোগ্রাফার। তোর বিয়ের জন্য ভদ্র-শিক্ষিত ঘরের মেয়ে পাওয়া যাবে না। এদিকে আবার প্রেম করার মুরোদও নেই। সে যেমন মেয়েই হোক, আমি বিয়েতে আপত্তি করতাম না।’’
মা খুবই খোলামনের মানুষ। জীবনকে দেখতে জানে পজিটিভ অ্যাঙ্গেলে। শৌর্যর বাবা ছিল সংশয়ী, দ্বিধাগ্রস্ত। মা বহুবার বলেছে, ‘‘চাকরি ছেড়ে লেখালিখিই করো তুমি। আমার যা চাকরি, তাতে স্বছন্দে একটা সংসার টানা যায়। যে কাজে আনন্দ পাচ্ছ না, কেন করছ সেটা? তুমি তো নিরুপায় নও।’’
বাবা বিভিন্ন সময় নানা ধরনের উত্তর দিত। তবে সুর একই। যেমন, ‘‘লেখালিখি করতে গিয়ে হয়তো এক পয়সাও রোজগার হবে না। কতটা কী লিখতে পারি, তাই তো জানি না। লিখতে ভালবাসি বললেই তো আর চলবে না। ভাল লিখতে হবে।’’
মা যুক্তি দিত, ‘‘কোনও স্রষ্টাই বুঝতে পারে না তার সৃষ্টি কতটা উৎকৃষ্ট। বিচার করে অন্যজনে। তুমি তো গল্প-কবিতা বেশ ভালই লিখতে। শুধু আমি নয়, বন্ধুবান্ধবরাও বলত।’’
বাবার উত্তর হত, ‘‘ওই প্রশংসা নিরপেক্ষ নয়। নিকট সম্পর্ক হওয়ার জন্যই অজান্তে বেশ খানিকটা প্রশ্রয় মিশে থাকে। নামীদামি পত্রিকা বা প্রকাশকের কাছে আমি হয়তো পাত্তাই পাব না।’’
মা বলত, ‘‘চেষ্টা করে দ্যাখো না, ছাপা হয় কি না। বহু নামী লেখক বেশি বয়সে লেখা শুরু করেছিলেন। তাঁরা কি জানতেন পাঠকদের মনের এত কাছে পৌঁছতে পারবেন?’’
বাবার মুখে তখন ব্যঙ্গের হাসি। বলত, ‘‘যেসব লেখককে মিন করে কথাটা বলছ, তাঁদের প্রতিভার কাছে আমি নস্যি। তবে একটা সময় অনেক অ্যাভারেজ লেখকও গল্প-উপন্যাস লিখে উপার্জন করেছে। এখন সেই বাজারটাও নেই। লোকে সাহিত্য এখন পড়ে কোথায়? হয় টিভি, নয়তো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এ ব্যস্ত। পাঠক যেখানে নেই, লিখে কী লাভ! ভাল না লাগলেও অ্যাড এজেন্সির কাজটাই আমায় করে যেতে হবে। আর কিছু না হোক টাকাটা তো আসছে। ভিত শক্ত হচ্ছে সংসারের। দু’জনের মধ্যে কে কতদিন কর্মক্ষম থাকব, কে বলতে পারে। বড় একটা অসুখ হলে বিশাল টাকাও সামান্য বলে মনে হবে।’’
মা এবার ক্ষান্ত দিত। একদিন বলেছিল, ‘‘ঠিক কত টাকা জমা হলে তোমার সংসার বিপন্মুক্ত হবে, হিসেব করে বলো তো আমাকে।’’
এর হিসেব যে মেলে না, বাবা ভাল করেই জানত। তবু বিরসমুখে টাকার জন্য চাকরি করে গিয়েছে। রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল বাবা। জমা টাকার এক পয়সাও খরচ হল না বাবার জন্য।
জঙ্গল শেষ হল। দু’পাশে রুক্ষ শুষ্ক জমি, দূরে গ্রামরেখা, টিলা… অসাধারণ সুন্দর প্রকৃতি! ঝড়ের গতিতে বাইক চললেও মাঠের মাঝে পলাশ-শিমুল চোখ এড়াচ্ছে না। ফুল আসা শুরু হয়েছে গাছগুলোয়। লোকেশনেও পলাশ-শিমুল দেখেছে শৌর্য। সুমিতদা যে সিনেমাটা ডিরেক্ট করতে চলেছে তাতে ওই ফুলগুলো দৃশ্য আবহের কাজ করবে। পলাশ-শিমুল ফুলের সময় চলে গেলে শুটিং স্থগিত রাখা হবে আগামী বসন্ত পর্যন্ত। ঠিক এই শর্ত তুলে সুমিতদা শৌর্যকে তাড়া দিয়ে পরপর দু’দিনে দুটো ভারী কাজ করাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার একটা ম্যাগাজ়িনে রান্নার ছবি শুট করছিল শৌর্য, ফোন এল সুমিতদার। বলল, ‘‘সামনের শনি-রবি কোনও অ্যাসাইনমেন্ট নিস না। আমার প্রোডাকশনের আর্জেন্ট দুটো কাজ আছে।’’
শৌর্য বিরক্ত হয়েছিল খুব। বলেছিল, ‘‘দু’দিন আগে কাজ আছে বললে হয় কখনও! একমাসের শিডিউল করা থাকে আমার এবং সেটা তুমি ভাল করেই জানো।’’
সুমিতদা বলল, ‘‘রবিবার আবার কীসের কাজ রে! স্টুডিয়োয় ছুটি, অফিসকাছারি বন্ধ। শনিবার কাজ থাকতে পারে, ওটা প্লিজ় অন্য কাউকে দিয়ে ম্যানেজ কর। আমার কাজটা না হলে প্রোডিউসর পালাবে। প্রোডিউসর পালানোর মানে জানিস তো? বউ পালালে ফিরে আসার একটা চান্স থাকে, প্রোডিউসরের বেলায় নো চান্স। কোনওদিন মুখোমুখি হতে চাইবে না লোকটা।’’
নামী পরিচালক ছাড়া প্রোডিউসর পাওয়া যে কী কঠিন, ভাল মতোই বোঝে শৌর্য। সুমিতদার ঝুলিতে একটা ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড থাকলেও আজও তেমন নামী হয়ে উঠতে পারেনি। দশটা ছবি করা হয়ে গেল। শৌর্য বলেছিল, ‘‘প্রোডিউসরের এত তাড়া কীসের? দু’দিনের নোটিশে কাজ ধরতে বলছ আমাকে?’’
উত্তরে যা বলেছিল সুমিতদা, তাতে শৌর্যর মনে হয়েছিল কাজটা করে দেওয়া জরুরি। অন্য কেউ রিকোয়েস্ট করলে ‘না’ বলে দিত। যতই হোক সুমিতদাই পছন্দমতো কাজের সুযোগ করে দিয়েছে শৌর্যকে। হ্যাঁ, এটা ঠিকই, অনেক ফরমায়েশি ছবি তুলতে হয়। তবে চাকরি যেহেতু নয়, শৌর্য ফ্রিল্যান্স ফোটোগ্রাফার, নিজের পছন্দমতো ছবি তুলতে পারে সময় বের করে।
যে সিনেমাটার জন্য এত তাড়াহুড়ো করছে সুমিতদা, তার প্রোডিউসরের সন্ধানে কাটিয়েছে দু’বছর। অনেকের সঙ্গেই কথা পাকা হতে-হতে কেঁচে গিয়েছে। এবারের প্রোডিউসর নাকি টাকা হাতে নিয়ে রেডি। সোনার ব্যবসায়ী, জীবনে প্রথম সিনেমায় টাকা ঢালছেন। সুমিতদার গল্পটা নাকি তাঁর ভারী পছন্দ হয়েছে। গল্প অবশ্য সুমিতদার লেখা নয়, উঠতি এক লেখকের। সুমিতদা রাইট কিনে রেখেছে দু’বছরের জন্য। সেই দু’বছর শেষ হতে চলল। রাইট ব্যাক করে যাবে লেখকের কাছে। তার উপর আবার গল্পের প্রেক্ষাপট বসন্তকাল। নাম ‘দখিন হাওয়া’। প্রোডিউসরের যেহেতু ভীষণ পছন্দ হয়েছে গল্পটা, বলেছেন, মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে শুটিং সেরে ফেলতে। নয়তো পরের বসন্তকাল। গল্পের আশিভাগই আউটডোরে, বাংলা-বিহারের রাঢ় অঞ্চল, আকাশ থাকবে মেঘহীন, পলাশ-শিমুলে ছেয়ে যাবে চারপাশ, লাল মাটির রাস্তায় ধুলো উড়বে, এসব না থাকলে গল্পের ফ্লেভারটাই আনা যাবে না সিনেমায়। তাই শুটিং করতে হবে বসন্তেই।
অগত্যা শৌর্যকে ছুটতে হল মহুলিয়াতে। লোকেশন অনেক আগেই দেখে রেখেছিল সুমিতদা। এখনকার ফোটো তুলে দেখাতে হবে প্রোডিউসরকে। ঘাটশিলা থেকেও তিন কিলোমিটার দূরে লোকেশন। টিলামতো একটা পাহাড়, তার আশপাশের লাল মাটির রাস্তা। আর দুটো পুরনো, জীর্ণ বাড়ি। একটা দোতলা, লোকজন থাকে। অন্যটা একেবারেই ভগ্নদশা। সেই ভেঙে পড়া বাড়িটা ছোটখাটো টিলার উপর। সমস্ত ডিটেলস দিয়ে শৌর্যকে ফোটো তুলতে পাঠিয়ে ছিল সুমিতদা। রবিবার, মানে আজ কোনও অ্যাসাইনমেন্ট ছিল না শৌর্যর। নিজের মতো ফোটো তুলতে বেরোত, অথবা আড্ডা মারতে যেত ফোটোগ্রাফি ক্লাবে। গতকাল একটা কাজ নেওয়া ছিল। ক্যালকাটা ক্লাবে একটা কোম্পানির দেওয়া পার্টির ফোটোশুট। কাজটা অর্ণবকে দিয়ে সুমিতদার কাজে বেরিয়ে পড়েছে শৌর্য। আউটডোরে শুট করতে ভালই লাগে শৌর্যর। লুক টেস্টটাই ভীষণ বোরিং, যেটা এখন করতে চলেছে।
আবার হাইওয়েকে ঘিরে ধরল জঙ্গল। হেলমেট থাকায় জঙ্গলের গন্ধ পাচ্ছে না শৌর্য। মাথা খোলা থাকলেও হয়তো পেত না, যা স্পিডে চালাচ্ছে বাইক! বহুক্ষণ হল তাকে কোনও গাড়ি ক্রস করে যায়নি, সামনের গাড়িগুলোকে ছুঁয়ে ফেলছে সে, আরও এগিয়ে যাচ্ছে। এই যে এত তৎপরতা, সব বিফলে না যায়। লোকেশন শুট করতে গিয়ে এরকম একটা আশঙ্কা ভর করেছিল শৌর্যর মনে। দু’বছর আগে যে দোতলা পোড়োবাড়িটা দেখে গিয়েছিল সুমিতদা, যেখানে বসবাস করে এক পরিবার। সে বাড়ির জীর্ণদশা আর নেই। সারিয়ে-টারিয়ে রং করা হয়েছে। এখন একেবারে পুরনো ডিজ়াইনের নতুন বাড়ি। আর ছোট টিলার উপর যে বাড়ি দেখেছিল সুমিতদা, তা প্রায় মাটিতে মিশে গিয়েছে। ‘দখিন হাওয়া’র গল্পটা সুমিতদার কাছ থেকে শুনেছে শৌর্য, বাড়ি দুটো ওভাবে পালটে গেলে, ওই লোকেশনে সিনেমাটা করা প্রায় অসম্ভব। ছবি তোলার আগে সুমিতদাকে ফোন করেছিল শৌর্য। জানাল বাড়ি দুটোর এখনকার চেহারা। তারপর জানতে চেয়েছিল, ‘‘কী করব? তুলব ছবি? মনে তো হচ্ছে তোমার কোনও কাজে লাগবে না।’’
সুমিতদা কতটা কী শুনতে পেল, কে জানে! ফোনের সিগনাল উইক ছিল। উত্তরে যা বলল, সেটাও স্পষ্ট কানে আসেনি শৌর্যর। যতটুকু বুঝেছে, সুমিতদা চাইছে, বাড়ি নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আপাতত ছবিটবি তুলে প্রোডিউসরকে দেখাতে হবে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রিপ্রোডাকশনের খরচ এবং মেন অ্যাকটর-অ্যাকট্রেসদের জন্য অ্যাডভান্স চেয়ে প্রোডিউসরের বেশ কিছু টাকা খসিয়ে দিতে হবে। তা হলে আর চট করে প্রোজেক্ট ফেলে পালাবে না। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে অদ্ভুত সব মজার ব্যাপার হয়। সুমিতদা যে বলছে প্রোডিউসরের টাকা খসিয়ে দিলে পালাবে না, এটা নিছকই সান্ত্বনা। ইন্ডাস্ট্রিতে এমন বহু ছবি পড়ে আছে, যার ষাট-সত্তর শতাংশ কাজের পর হাত গুটিয়ে নিয়েছে প্রোডিউসর। গোটা সিনেমা হয়ে আছে, রিলিজ়ের ব্যবস্থা হয়নি, এ ঘটনাও কিছু কম নেই। তবু যেসব মানুষ একবার সিনেমার জগতে এসে কাজ শুরু করেছে, জড়িয়ে পড়েছে অদ্ভুত মোহে। এত অনিশ্চয়তা এই ফিল্ডে, তবু একজন ট্রলিম্যানও এই কাজ ছেড়ে অন্য কাজে গিয়ে শান্তি পায় না। আগুনে ঝাঁপ দেওয়া পতঙ্গের মতো শুটিং-এর আলোর কাছে গিয়ে তারা ভিড় করে।
শৌর্য কিন্তু সিনেমা-সিরিয়ালের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা চালায়। ইনকামের জন্য ম্যাগাজ়িনের মডেল শুটিং বা প্রোডাক্ট ফোটোগ্রাফির উপর জোর দেয় বেশি। সিনেমার মোহ তাকে পেয়ে বসেনি। ফোটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার সময় সুমিতদার ইউনিটে কাজ করেছে, তারপর যতটুকু যা করেছে, অতি কাছের মানুষের অনুরোধে অথবা হাতে যখন অন্য কাজ নেই, স্রেফ টাকার জন্য। সাধারণ মানুষেরও সিনেমার কাজকর্ম নিয়ে অপার কৌতূহল। মহুলিয়ায় যে দোতলা বাড়ির ছবি তুলতে বলেছিল সুমিতদা, সেখানে এখন নতুন পরিবার থাকে। সুমিতদা যে সময় দেখে গিয়েছিল বাড়িটা তখনকার বাসিন্দা এখন নেই। তারা বাড়ি বিক্রি করে চলে গিয়েছে। ছবি তুলতে আসার আগে শৌর্য সুমিতদাকে বলেছিল, ‘‘বাড়ির ভিতরের ছবি তুলতে দেবে মালিক? তুমি যে আমাকে পাঠাচ্ছ, জানিয়ে রেখেছ?’’
সুমিতদা বলেছিল, ‘‘আরেঃ, বাড়ির মালিককে তো ফোনে পাচ্ছি না! নাম্বার পালটেছে বোধহয়। তুই যা না, ওরা লোক ভাল। তুলতে দেবে ছবি। দু’বছর আগে যখন রেইকি করতে গিয়েছিলাম, ওদের বলেছিলাম এ বাড়িতে শুটিং করব। শুনে ওদের কী আনন্দ! তুই শুধু আমার নামটা বলে শুটিং তাড়াতাড়ি শুরু হচ্ছে জানিয়ে দিবি। দেখবি ওদের উৎসাহ!’’ সেই ভরসায় ও বাড়ির কড়া নেড়েছিল শৌর্য। তার খানিক আগেই সুমিতদাকে ফোনে জানিয়েছে বাড়িটা রেনোভেশন হয়েছে। তা সত্ত্বেও ফোটো তুলতে বলেছে সুমিতদা। কড়া নাড়া শুনে বাড়ির দরজা খুললেন মাঝবয়সি এক ভদ্রলোক। শৌর্য সুমিতদার রেফারেন্স দিয়ে কী কাজে এসেছে বলেছিল। ভদ্রলোক জানালেন তিনি বাড়িটার নতুন মালিক। এখানে শুটিং হোক চান না। হোঁচট খেয়ে শৌর্য বলেছিল, শুটিং-এর জন্য ভাড়া বাবদ ওঁরা বেশ কিছু টাকা পাবেন।
টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্তটা স্পটে দাঁড়িয়ে নিয়েছিল শৌর্য। জানা নেই বাজেটে সুমিতদা ভাড়ার অঙ্ক ধরেছে কি না। ভদ্রলোক তাতেও রাজি হলেন না। শৌর্য তখন ভাবতে শুরু করেছিল আর কী বলে বাড়িওলাকে প্রলুদ্ধ করা যায়। পেয়েও গিয়েছিল একটা রাস্তা, তাড়াহুড়োতে বুঝতে পারেনি, ওটা রাস্তা নয়, একটা খাদ, শৌর্য বলেছিল, সিনেমাটাতে আপনারও একটা চরিত্র আছে। রোল ছোট, কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। সুমিতদা বলেছে বাড়িওয়ালাকে দিয়ে অভিনয়টা করাবে।
ভদ্রলোক বললেন, ‘‘সেটা হয়তো উনি আগের বাড়িওয়ালার সম্বন্ধে বলেছিলেন। যাঁর সঙ্গে ওঁর দেখা হয়েছিল। কাউকে না দেখে তো আর পার্ট দেওয়া যায় না। তা ছাড়া সিনেমায় অভিনয়ের কোনও ইচ্ছেও আমার নেই।’’
শৌর্য পড়েছিল মহাগাড্ডায়। কোনও প্রলোভনেই কাজ হচ্ছে না। এমন সময় পরদা সরিয়ে ঘরে এন্ট্রি নিয়েছিলেন ভদ্রলোকের স্ত্রী। পরদার আড়াল থেকে সব কথা শুনেছেন বোঝা গেল। বললেন, ‘‘হোক না বাড়িতে শুটিং। ক্ষতি কী! আমি কোনওদিন শুটিং দেখিনি।’’
ভদ্রলোক বললেন, ‘‘শুটিং-এর জন্য ক্ষতি হবে ছেলেমেয়ের লেখাপড়ায়। সে এক মহাযজ্ঞ, বড়-বড় লাইট স্ট্যান্ড, একগাদা লোকজন, হইচই… পুরো তছনছ করে দিয়ে যাবে ঘরের জিনিসপত্র।’’
গৃহিণী একথায় দমলেন না। বলেছিলেন, ‘‘সে সব আমি গুছিয়ে নেব। ছেলেমেয়ে ক’টা দিন শুটিং দেখবে। এখন তো পড়ার চাপ নেই। অনেক কিছু জানতে পারবে, শিখবে। সব কিছু থেকেই শেখার আছে।’’
স্ত্রীর উৎসাহে বাড়িওয়ালার অনড় অবস্থান বুঝি একটু আলগা হল। উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ততক্ষণে ঘরে ঢুকে পড়েছে বাড়ির দুই খুদে সদস্য। হয়তো লেখাপড়া ছেড়ে উঠে এসেছিল। ছেলেটির বয়স দশ-এগারো, মেয়েটি আরও একটু ছোট। দু’জনেই মায়ের কাছে জানতে চাইছিল তাদের বাড়িতে কী ঘটতে চলেছে, নতুন লোকটি এসেছে কেন?
সন্তানদের ছোট করে উত্তর দিয়ে ভদ্রমহিলা শৌর্যর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘আপনাদের সিনেমায় নায়ক, নায়িকা কোন দু’জন?’’
টলিউডের সবচেয়ে হিট জুটির নাম করে দিয়েছিল শৌর্য। ভদ্রমহিলা তো খুব খুশি। বলেছিলেন, ‘‘ওরে বাবা, ওদের সামনে থেকে দেখব, ভাবতেই পারছি না!’’
মহিলার ওরকম সরল উচ্ছ্বাস দেখে একটু হলেও অপরাধরোধে ভুগছিল শৌর্য। সুমিতদা লিড রোলে কাকে কাকে নিচ্ছে কিছুই জানে না সে। জীর্ণ বাড়ি নতুন হয়ে যাওয়ায় আদৌ এখানে শুটিং হবে কি না, তারও নিশ্চয়তা নেই। শৌর্য শুধু জানে, যে করে হোক এ বাড়ির ছবি তুলে নিয়ে যেতে হবে। প্রফেশনাল কাজের জগতে এ ধরনের মিথ্যাচরণ প্রায় নির্দোষ বলেই ধরা হয়। তবু খারাপ লাগছিল শৌর্যর।
নানা গল্পগাছায় শৌর্য যখন জমিয়ে নিয়েছে, বাড়িওয়ালা স্ত্রীকে বললেন, ‘‘অফিসের ভাত দাও। বেরোতে হবে তো।’’
‘‘এই রে, দেখেছ! আমি তো ভুলেই গিয়েছি, তুমি বেরোবে!’’ বলে ভিতর দিকে হুটতেপুটতে এগোলেন মহিলা। বাড়িওয়ালা তখন শৌর্যকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘শুধু এবাড়ির ছবি তুলবেন, নাকি আশপাশে আরও কোনও স্পটের?’’
শৌর্য বলেছিল, ‘‘এই এলাকার বেশ কিছু জায়গার ছবি তুলতে হবে। সিনেমায় আশি শতাংশ ঘটনা ঘটবে এখানে।’’
বাড়িওয়ালা আগের চেয়ে অনেকটাই নরম। বলেছিলেন, ‘‘তার মানে তো আপনার অনেকক্ষণের কাজ। দুপুরের খাবারটা আমাদের বাড়িতেই সেরে নেবেন’খন। গিন্নিকে বলে যাচ্ছি। অবশ্য আমি না বললেও ও আপনাকে ঠিক খাইয়ে ছাড়ত।’’
এত অল্প পরিচয়ে কারও বাড়িতে লাঞ্চ-ডিনার করার কথা ভাবতেই পারে না শৌর্য। কিন্তু ও বাড়ির মানুষজন, চারপাশের সহজ-স্বাভাবিক প্রকৃতির জন্যই শৌর্যর ‘না’ বলতে ইচ্ছে হয়নি। ও বাড়িতে চা খেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল আশপাশের ছবি তুলতে। ফিরে এসে বউদির বাড়ির ছবি তুলতে লাগল। মহিলাকে ‘বউদি’ সম্বোধনই করছিল। ও বাড়ির রান্নাঘর, দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, উঠোনের ছবি, তারপর ছাদের চতুর্দিক। দোতলার ঘরের জানলা থেকে উঠোন, মানে সুমিতদা যেমন-যেমন বলেছে, তেমনই ছবি তুলে গিয়েছে শৌর্য। ‘দখিন হাওয়া’র গল্পটাও যেহেতু জানে, শুটিং জ়োনগুলো আন্দাজ করতে পারছিল। এরকম একটা বাড়ি গল্পটার বড় চরিত্র।
দুপুরের স্নান হল ও বাড়িতেই। খাওয়ার সময় অনেক গল্প হল বউদি আর বাচ্চা দুটোর সঙ্গে। মেয়েটার নাম স্বর্ণতোয়া, কাছেই সুবর্ণরেখা নদী, তার সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছে। ছেলেটা তূণীর, আদিবাসীদের তির রাখার আধার। এলাকাটা আদিবাসী অধ্যূষিত। শনিবার বাচ্চা দুটোর স্কুল ছুটি। মলয়দা, মানে বাড়িওয়ালা গালুডির এক কারখানার অ্যাকাউন্টসের হেড। শনিবার হাফ ডে। ফিরে এলেন বিকেল শেষ হওয়ার আগে। শৌর্য ততক্ষণে দোতলার ঘরে গিয়ে ঘণ্টাদুয়েকের ছোট্ট ঘুম দিয়েছে। চারপাশ এত নির্জন, ঘুমটা সন্ধে গড়িয়ে যেতে পারত। মলয়দার বাইকের শব্দে ভাঙল ঘুম। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসেছিল শৌর্য। ওই আওয়াজে ঘুম না ভাঙলে এরা হয়তো ডাকতও না। সদ্য পরিচিতের বাড়িতে ওভাবে ঘুমিয়ে পড়াতে ভারী সংকোচ বোধ করছিল শৌর্য। ক্যামেরার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে আসছিল সিঁড়ি দিয়ে। মুখোমুখি হয়েছিল চন্দ্রাবউদির। জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘চা খাবেন তো? আপনার দাদা ফিরেছেন।’’
কুণ্ঠার সঙ্গে শৌর্য বলেছিল, ‘‘খাব। খেয়েই বেরিয়ে যাব। সরি, একেবারে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’’
‘‘তাতে অসুবিধে কী?’’ বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গিয়েছিলেন বউদি।
একবেলাতেই এরা কত আপন করে নিয়েছে শৌর্যকে! শহর হলে এটা হত না। ওখানে লোক বেশি, অবিশ্বাসও বেশি। বসার ঘরে ঢুকেতেই মলয়দা জানতে চাইলেন, ‘‘আজই ফিরবেন নাকি কলকাতায়?’’
শৌর্য বলেছিল, ‘‘না, অন্ধকারে হাইওয়েতে গাড়ি চালানো রিস্ক হয়ে যায়। আর একটু পরেই তো আলো পড়ে যাবে। কাল ভোরে বেরিয়ে যাব।’’
‘‘রাতটা তা হলে এ বাড়িতেই কাটিয়ে যান, আপনার সঙ্গে গল্প করার তো সময়ই পেলাম না…’’ বলেছিলেন মলয়দা।
প্রস্তাবটার জন্য প্রস্তুত ছিল না শৌর্য, বলে উঠেছিল, ‘‘না, না। ঘাটশিলায় আমার নামে হোটেলের রুম বুক করা আছে।’’
আবারও সিলি মিসটেক। মিথ্যেটা জমল না। মলয়দা এলাকার লোক। জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘ঘাটশিলার কোন হোটেল?’’
একটারও নাম জানে না শৌর্য। বুদ্ধি করে বলেছিল, ‘‘ঘাটশিলায় পৌঁছে প্রোডাকশানকে ফোন করে জেনে নেব।’’
মলয়দার সঙ্গে চা খেতে-খেতে একটা কৌতূহল মিটিয়ে নিয়েছিল শৌর্য। প্রশ্নটা অনেকক্ষণ ধরেই মনে উঁকি মারছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘আপনি এরকম একটা ফাঁকা-নির্জন জায়গায় বাড়ি কিনলেন কেন? অফিস তো গালুডিতে, ওখানেই থাকতে পারতেন।’’
‘‘গালুডিতেই ছিলাম, নিজের বাড়ি ছিল… ক্রমশ ব্যস্ত শহর হয়ে উঠছে জায়গাটা, তাই একটু দূরে চলে এলাম,’’ বলেছিলেন মলয়দা।
শৌর্য বলেছিল, ‘‘শহরের অনেক সুবিধেও তো আছে। বাচ্চাদের লেখাপড়া, হাতের কাছে ডাক্তার হাসপাতাল। এখান থেকে আপনার অফিস, বাচ্চাদের স্কুল যাতায়াতেই তো অনেকটা সময় খরচ হয়ে যায়। তারপর এত ফাঁকা জায়গায় আছেন, চুরি-ডাকাতির ভয়ও নিশ্চয়ই আছে।’’
‘‘চুরি-ডাকাতির মতো মূল্যবান কিছু আমার কাছে নেই। চোর-ডাকাতরাও নিশ্চয়ই সে খবর রাখে। তা ছাড়া চুরি-ডাকাতির ভয়ে গোটা জীবনটা শহরে বন্দি করে রাখার কোনও মানে হয় না। একটাই তো জীবন, এবং সেটাও খুব একটা বড় নয়। প্রকৃতিকে না দেখেই মরে যাব! এখানে কী অসাধারণ সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত হয়, আপনি ভাবতে পারবেন না। কখনও আবার দিগন্ত ঝাপসা করে দেওয়া অঝোর বৃষ্টি। দেখা যায় রাতের তারাভরা আকাশ। এগুলো তো আমার বাচ্চাদেরও দেখা দরকার। হাসপাতাল-ডাক্তার তো খুব দূরে নয়, বাইকে আধঘণ্টা। আর এখানে থাকলে ঘনঘন ডাক্তার-হাসপাতালে যেতে হয় না…’’ বলে নিজের খেয়ালে হাসছিলেন মলয়দা। বাবার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল শৌর্যর, প্রায়ই বলত, ‘‘বুঝলি বাবান, গ্রামের দিকে একটা বাড়ি করে রাখতে হবে। শহরে হাঁপিয়ে উঠলে ক’টা দিন আমরা ওখানে গিয়ে থেকে আসব। সেই বাড়ি লাগোয়া একটা টলটলে পুকুর থাকবে। মাছ ধরব সেখানে…’’ বলতে-বলতে বড় করে শ্বাস টানত বাবা। শহরের বাতাসই ঢুকত বুকে। গ্রামে বাড়ি হয়নি শৌর্যদের। ইচ্ছে থাকলেও অনেকের যেমন হয়ে ওঠে না। বাবা সময়ও পায়নি, জীবন ছেড়ে চলে যেতে হল তাড়াতাড়ি। জীবন সত্যিই বড় ছোট।
গতকাল সন্ধের মুখে ওদের বাড়ি থেকে যখন ঘাটশিলার হোটেলের উদ্দেশে বেরিয়ে আসছে শৌর্য, বাড়ির সবাই দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে বাইকে উঠে পড়েছিল শৌর্য। মনে-মনে ঠিক করে নেয়, এখানে যদি শুটিং নাও হয়, সে একাই আবার আসবে। কাটিয়ে যাবে দুটো দিন। দেখবে প্রকৃতির অপার বৈভব। ভাবতে-ভাবতেই বাইকের স্পিড কমাতে হল। রাস্তা ক্রস করছে ছাগল, সঙ্গে তিন সন্ততি। এরা ভীষণ দিশেহারা প্রকৃতির। গাড়ির শব্দ পেলে কে কোনদিকে দৌড়োবে, কোনও ঠিক নেই! রাস্তার দু’পাশের জঙ্গল অনেকক্ষণ উধাও হয়েছে। এখন ফসলভরতি মাঠ। ছাগলগুলোকে পাশ কাটিয়ে ফের স্পিড তুলল শৌর্য। হাইওয়ের মাইল ফলক জানাল কলকাতা এখনও একশো আশি কিলোমিটার দূরে। ঘাটশিলার হোটেল থেকে আরও খানিকটা আগে বেরোতে পারলে ভাল হত। বেশ সকালের দিকেই ঘুম ভেঙেছিল শৌর্যর, ব্রেকফাস্ট দিতে দেরি করল হোটেলের লোক। তারপর স্থানীয় অবরোধের জন্যও ওর বেরোতে বেশ খানিকটা বেলা হয়ে গিয়েছে। এখানে আসার আগে মা বলেছিল, ‘‘অতটা দূর যাচ্ছিস, গাড়িটা নিয়ে যা। হাইওয়েতে টানা চার-পাঁচ ঘণ্টা বাইক চালানো ঠিক হবে না।’’
বেরোনোর আগের রাতে খেতে বসে কথাগুলো বলেছিল মা। শৌর্য বলে, ‘‘লোকেশন গ্রামের কতটা ভিতরে জানি না। হয়তো গাড়ি যাওয়ার মতো রাস্তা নেই। বাইকের এটাই তো সুবিধে। যে-কোনও ধরনের রাস্তায় চালানো যায়।’’
মা বলেছিল, ‘‘আসল কথাটা বল, বাবার মতো তোরও গাড়ির প্রতি অনীহা। পারতপক্ষে চড়িস না। গাড়িটা এবার আমি বেচে দেব ভাবছি।’’
‘‘ফালতু সেন্টিমেন্টাল হচ্ছ। গাড়ি চালানো, রাস্তার ব্যাপারস্যাপার কিছু বোঝো?’’ মাকে খানিকটা ধমকই দিয়েছিল শৌর্য।
গুম মেরে গিয়েছিল মা। আর কিছু বলেনি। শৌর্যকে গাড়ি নিয়ে বেরোতে বলাটা মায়ের প্রায় মুদ্রাদোষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই এটা হয়েছে। মা কলেজ যাওয়াতের সুবিধের জন্য গাড়িটা কিনেছিল। কলেজ বরানগরে। যাদবপুর থেকে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাওয়া আসা মায়ের আর পোষাচ্ছিল না। কলেজে ছুটিছাটা থাকে অনেক, বাবার ছুটি সপ্তাহে একদিন। মায়ের যেদিন কলেজ থাকত না, বাবাকে বলত গাড়িটা নিয়ে অফিস যাও। মানিককাকা শৌর্যদের মাইনে করা ড্রাইভার। এখনও মানিককাকাই চালায়। বাবা গাড়ি নিয়ে যেতে চাইত না। বলত, ‘‘ধুর, গাড়িফাড়ির কী দরকার অফিস তো কাছেই ,পার্ক স্ট্রিট। বাসে ভিড় থাকলে ট্যাক্সি নিয়ে নেব।’’
‘‘কেন নেবে ট্যাক্সি? মানিক বসে-বসে মাইনে নেবে, ব্যাঙ্কে গাড়ির ইনস্টলমেন্ট শোধ করব, আর গাড়িটা গ্যারেজবন্দি হয়ে পড়ে থাকবে! তার উপর আবার ট্যাক্সিভাড়া! অযথা এভাবে টাকা অপচয়ের কোনও মানে হয়!’’ মাথা গরম করে বলে উঠত মা।
মশকরার হাসি হেসে বাবা বলত, ‘‘গাড়ি করে অফিস গেলে কাজের আগে ওয়ার্ম আপটা ঠিক হয় না। স্পিড আসতে দেরি হয় কাজে। রাস্তায় বেরিয়ে দৌড়ে বাস ধরব, ট্যাক্সি দাঁড় করাব ছুটে গিয়ে। এই যে একটা হন্তদন্ত ভাব, এটাতেই গা বেশ গরম হয়ে যায়।’’
বাবাকে একা গাড়ি ব্যবহার করতে বললেই, এরকম নিত্যনতুন ছুতোনাতা তুলত। মা একবার বাবাকে গাড়ি চালানো শিখে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে লাগল। তাতে যদি বাবার গাড়ি চড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মায়। বাবা কিছুতেই শিখবে না। অজুহাত দিল বয়সের। বলল, ‘‘এখন রিফ্লেক্স কমে গিয়েছে। বাইক-স্কুটার চালানোর অভিজ্ঞতাও নেই। আমার ড্রাইভিং-এ কারও যদি প্রাণ যায়, খুব বাজে ব্যাপার হবে। জেল খাটতে হতে পারে।’’
বাবার ওরকম নানা টালবাহানার মাঝে শৌর্য গাড়ি চালানো শিখে নিল মানিককাকার কাছে। তখন ক্লাস ইলেভেন। বাইক চালানো শিখল তারপরে। শৌর্যকে গাড়ি, বাইক চালাতে দেখলে বারণ করত না বাবা। নিজের বেলায় যত অস্বস্তি। বাবার গাড়ি এড়িয়ে যাওয়াটা বছরতিনেক সহ্য করার পর মা বিস্ফোরণ ঘটাল একদিন। বাবার পা মচকে ছিল আগের দিন, হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে, তবু বাস-ট্যক্সিতেই যাবে অফিস। টেবিলে তখন খেতে বসেছে বাবা, এরপর অফিস যাবে। মা বলল, ‘‘মানিককে ডাকছি। আজ গাড়িতে চলে যাও।’’
‘‘না, না, দরকার নেই, খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না,’’ বলেছিল বাবা।
মা বলল, ‘‘তোমার পায়ের ব্যথার চেয়ে বেশি সমস্যা ওই গাড়িটাতে অফিসে যাওয়া!’’
বাবা আন্দাজ করতে পেরেছিল মা কোনও কড়া কথা বলতে চলেছে। তাই রাগ কমাতে হাসিমুখ তুলে বলেছিস, ‘‘আচ্ছা, আমি কি তোমাদের সঙ্গে গাড়ি চেপে এদিক-ওদিক যাই না? বিয়ে বাড়ি, শপিং, এমনকী শট ট্রিপেও তো গিয়েছি।’’
মা বলল, ‘‘কিন্তু একা গাড়ি চড়াটা তুমি সব সময় এড়িয়েই গিয়েছ। কারণ, গাড়িটা আমি কিনেছি। বউয়ের গাড়িতে একা চাপতে তোমার লজ্জা হয়। পৌরুষে বাধে। অথচ নিজেকে উদারমনস্ক মানুষ প্রমাণ করার চেষ্টা করে যাও সর্বক্ষণ। লোকে তোমাকে তাই বলেই জানে। আসলে পুরোটা ভান।’’
খাওয়া থেমে গিয়েছিল বাবার। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল আহত বিস্ময়ে। কষ্টে চোখ-মুখ কুঁচকে যাচ্ছিল। বাবার এই এক্সপ্রেশন আজও চোখের সামনে ভাসে শৌর্যর। ওই দিন জানলার ধারে সোফায় বসে কাগজ পড়ছিল শৌর্য। মাকে এধরনের কড়া কথা আগে কোনও দিন বলতে শোনেনি। একটু সময় নিয়ে বাবা বলেছিল, ‘‘মানিককে ডাকো। গাড়িতেই যাব অফিস।’’
সেদিন মানিককাকা বাবাকে অফিসে দিয়ে এল, নিয়েও এল। শৌর্য সারাদিন ভেবে গেল, সত্যিই কি তাই? বাবা মায়ের রোজগারটাকে আলাদা করে দেখে? মায়ের উপার্জন নিজের জন্য ব্যবহার হোক, চায় না? তাই হলে যে শৌর্য এতদিন মনে করত তারা তিনজন একটাই ইউনিট, সেটা ভুল? অদৃশ্য একটা ভেদাভেদ আছে!
ভাবনাটা শৌর্যকে মানসিকভাবে অস্থির করে তুলছিল। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল সে। মনে হচ্ছিল একসঙ্গে থাকলেও, আসলে তারা তিনজনই একা। মা মুখ খোলার ফলে এতদিনে বিষয়টা প্রকাশ্যে এল।
ডিনারে বসার আগে বাবাকে খানিকক্ষণের জন্য একা পেয়েছিল শৌর্য। মা তখন কিচেনে। বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘সত্যি কি মা কিনেছে বলেই গাড়িতে তুমি উঠতে চাও না?’’
মাথা নেড়ে ‘না’ বুঝিয়ে ছিল বাবা। তারপর নিরাসক্ত গলায় বলতে শুরু করেছিল, ‘‘তোর মা কেন যে আমায় ভুল বুঝছে, মাথায় আসছে না। ও তো দেখেছে বৈভব আমি বরাবরই এড়িয়ে চলি। তুইও নিশ্চয়ই লক্ষ করেছিস বড়লোকি শখ-শৌখিনতার প্রতি আমার আগ্রহ কম।’’
কথা কেটে শৌর্য বলেছিল, ‘‘গাড়ি চড়াকে আজকাল আর বড়লোকি বলে ধরা হয় না বাবা। গাড়ি এখন প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে। মা ওটা শখ করে কেনেনি। দরকার পড়েছে বলেই কিনেছে।’’
‘‘কিন্তু আমার তো দরকার নেই! তোর মায়ের যাতায়াতে অসুবিধে হয়, চড়ুক গাড়ি… আমাকে কেন জোর করছে?’’ বলেছিল বাবা। শৌর্য বলেছিল, ‘‘তুমিও যদি এক-দু’দিন অফিসে নিয়ে যাও গাড়ি, সমস্যাটা কোথায়? যথেষ্ট উঁচু পোস্টে চাকরি করো। অফিসের লোক টোনটিটকিরি করবে, তা-ও তো নয়।’’
‘‘না, তা কেউ করবে না… কিন্তু আমার ভিতর থেকেই কে যেন দুয়ো দেয়! বলে, মানকুণ্ডু স্টেশন থেকে তোমাদের বাড়ির দূরত্ব ছিল আড়াই কিলোমিটার, তোমার বাবা রোজ পায়ে হেঁটে অফিসের ট্রেন ধরতে যেতেন, বাড়িতে একটাই সাইকেল, দূরে কোথাও যেতে হলে বাড়ির দুই ছেলে সেটা ব্যবহার করত… কত কষ্ট করে তোমাদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন বাবা! এমন নয় যে, ওরকম পরিবার এখন নেই, প্রচুর আছে, বাবারা ছেলেমেয়ের জন্য বাস-অটোর ভাড়া বাঁচিয়ে হেঁটে চলেছে, মা কম খেয়ে সন্তানদের পেট ভরাচ্ছেন, তুমি কলেজে ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতে… চাইতে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হোক… হয়নি, তুমি চলেছ গাড়ি চেপে অফিসে… ’’ আরও অনেক কথা বলে যাচ্ছিল বাবা। বেশ আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিল। শৌর্য বাবার লজিকগুলো ধরতে পারলেও অনুভূতিটা সেভাবে ছুঁতে পারছিল না। কেননা, সে অভাবের সংসারে বড় হয়নি। তখন কলেজেও ঢোকেনি, ধনতন্ত্র, সাম্যবাদ নিয়ে ছাত্ররা লেকচার দেয় কি না, জানে না। বাবার কথা শেষ হওয়ার পর বলেছিল, ‘‘তুমি আমাকে যা-যা বললে, মাকেও বলো। মা হয়তো তা হলে তোমাকে আর ভুল বুঝবে না।’’
‘‘ধর, তোর মা আমার ফিলিংসটা বুঝল। তারপর কী করবে জানিস? গাড়িটা বিক্রি করে আবার আগের মতো বাসে-অটোয় যাবে কলেজে, যা তোর মায়ের স্বাস্থ্যের পক্ষে ঠিক হবে না। আমার ভাবনাটাকে আদর্শ মনে করবে। মনের ভিতর থেকে শখ-শৌখিনতা করতে আমি যে বাধাটা পাই, সেটা পাবে না। কারণ, ওর জীবনটা কেটেছে স্বচ্ছলতায়। আমাকে কেন অনুসরণ করবে সে? আমি তো আদর্শ মানুষ হতে পারিনি।’’
বাবার ওই কথাগুলো থেকে শৌর্য এটুকু অন্তত বুঝেছিল, ইউনাইটেড বলে কিছু হয় না। ওটা একটা শৃঙ্খলাবিধি। প্রত্যেক মানুষই আলাদা। এক সংসারে থাকলেও প্রত্যেকে আলাদা। মায়ের আর জানা হল না বাবা কেন গাড়ি অ্যাভয়েড করত। শৌর্য বলতে যায়নি। মা এখনও মনে করে বাবা মেল শভিনিস্ট। বউয়ের গাড়িটাকে নিজের মনে করতে পারত না। বাবার মৃত্যুর কারণ সেটাই বলে মনে করে মা। বাস থেকে নামতেই একটা গাড়ি ধাক্কা মেরেছিল বাবাকে। হেড ইনজুরি, ইন্টারনাল হেমারেজ। সেদিন শৌর্যদের গাড়ি বাড়ির গ্যারেজেই পড়েছিল।
শৌর্য অনেকবার ভেবেছে বাবার সম্বন্ধে মায়ের ভুল ধারণাটা ভাঙিয়ে দেবে। পিছিয়ে এসেছে প্রতিবার। সব শুনে মা যদি বলে, ‘ওটাও একটা অজুহাত। সব মিথ্যে। তোকে বুঝিয়েছে, তুইও বুঝে গিয়েছিস। কলেজে তোর বাবা যে দলের ছাত্ররাজনীতি করত, তাদের নেতারা কি এখন গাড়ি চড়ে না? গাড়ি তো কোন ছার, তাদের বিপুল সম্পত্তি আর লাইফস্টাইল দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। এরাই এক সময় সাম্যবাদের কথা বলত!’
মায়ের যুক্তি খণ্ডাতে পারবে না শৌর্য। এদিকে বাবার দৃষ্টিভঙ্গি সে মনের কোণে সযত্নে রেখে দিয়েছে। কোনও ভাবেই অপমানিত হতে দেবে না সেই অনুভূতিটাকে।
দূরে হাইওয়ের উপর আড়াআড়ি একটা কালো রেখা দেখা যাচ্ছে! কী ব্যাপার! বাইক যত এগোচ্ছে স্পষ্ট হচ্ছে রেখাটা। সর্বনাশ করেছে, সার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে গাড়ি! কিছু ঘটেছে সামনে। কোনও গাড়িই এগোতে পারছে না। এখানে কতটা টাইম খাবে, কে জানে!
শৌর্য বাইক নিয়ে দাঁড়াল গাড়ির জটলার পাশে। সকলের দাঁড়িয়ে পড়ার কারণও বোঝা গেল। থেমে যাওয়াটা কাঙ্ক্ষিত না হলেও, কারণটা কিন্তু বেশ রোমাঞ্চকর! হাতির দল পার হচ্ছে রাস্তা। ঠিক পার হচ্ছে বলা যায় না, জুড়ে রেখেছে রাস্তা। ছোট-বড় মিলিয়ে অনেক হাতি। রাস্তার এক পাশে অনাবাদী পাথুরে জমি, ঝোপজঙ্গল। অন্য পাশে চাষের জমি। বোঝাই যাচ্ছে হাতির পাল এসেছে পাথুরে জমি ধরেই। দলমা রেঞ্জ খুব দূরে নয়। ওখানকারই বাসিন্দা এরা। বুনো হাতি আগে কখনও দেখেনি শৌর্য। মাথা থেকে হেলমেট খুলে ফেলে। বেশ স্বস্তি লাগছে। রোদ আছে, তেজ নেই। গাড়ি থামানোর ফলে হাওয়া শান্ত। বুক ভরে শ্বাস নেয় শৌর্য। এখন আর টেনশন করে লাভ নেই। হাতিরা না সরা অবধি কলকাতার দিকে এগোনো যাবে না। সার্কাস বা চিড়িয়াখানার হাতিদের তুলনায় এই হাতিগুলো ধুলোয় ধূসর। আকারে যেন অনেকটাই বড়। আর অদ্ভুত একটা ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব। কোনও গাড়ি হর্ন তো দিচ্ছেই না, এত লোক, তবু একটাও কথা নেই আশপাশে। সকলেই ভয়ে নিশ্চুপ। হাতির পাল যদি খেপে গিয়ে এগিয়ে আসে, গাড়ি রেখে পালানোই বাঁচার একমাত্র উপায়। হাতির পালের ওপ্রান্তেও পরের পর গাড়ি জমা হচ্ছে। শৌর্য পিঠের ব্যাগটা সামনে আনে। বুনো হাতির ছবি তোলার সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।
ব্যাগ থেকে ক্যামেরাটা বের করে জ়ুম লেন্সটা লাগাতে যাবে শৌর্য, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির জানলা থেকে এক মাঝবয়সি বলে উঠলেন, ‘‘ফোটো তোলার হলে এখান থেকেই তুলুন। এত লম্বা লেন্স নিয়ে হাতির কাছাকাছি যাওয়া ঠিক হবে না।’’
‘‘বন্দুক ভাবতে পারে বলে মনে করছেন?’’ ঠোঁটের কোণে হাসি এনে বলল শৌর্য।
দামি গাড়িতে বসে থাকা লোকটা মাথা নেড়ে সায় দিলেন। শৌর্য বলল, ‘‘মনে হয় না। ক্যামেরা এরা চেনে। মিডিয়া এত ছবি তোলে! দেখলেন হয়তো এগিয়ে এসে পোজ় দিল।’’
কথাটা বলে বাইক স্ট্যান্ড করে নেমে এল শৌর্য। গলায় ঝুলছে ক্যামেরা। ভদ্রলোকের দিকে আর তাকায়নি। আন্দাজ করতে পারছে ওঁর এক্সপ্রেশন।
হাইওয়ে থেকে পাথুরে জমিতে নেমে এসেছে শৌর্য। হাতির পালের দিকে এগিয়ে গেল খানিকটা। আর কী আশ্চর্য! হাতির পালের ভাল বাংলাটা এসে গেল মাথায়, ‘যূথবাহিনী’। এই অ্যাঙ্গল থেকে আর কোনও গাড়ি দেখা যাচ্ছে না। যেহেতু রাস্তা থেকে খানিকটা নীচে নেমে এসেছে শৌর্য, পূর্ণবয়স্ক হাতিগুলোকে পাহাড় সদৃশ লাগছে। ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রাখতেই মনে হল হাজার-হাজার বছর পিছিয়ে গেল সময়। যখন গোটা এলাকাটাই ছিল হাতি এবং অন্যান্য বন্য পশুর। মানুষের অনুপ্রবেশ ঘটেনি।
নানা অ্যাঙ্গল থেকে ছবি নিতে থাকল শৌর্য। অনেকদিন ফোটো পাঠানো হয়নি বিদেশের ফোটোগ্রাফি অ্যাসোসিয়েশনগুলোয়। ওরা খুব উৎসাহ দেয়। ইতিমধ্যে গোটাচারেক প্রাইজ় পেয়েছে শৌর্য। বিক্রিও হয়েছে ফোটো। তবে প্রথম উৎসাহটা এসেছিল সুমিতদার তরফ থেকে। বাবা মারা যাওয়ার দু’মাস পর সুমিতদা এসেছিল শৌর্যদের বাড়ি। তার আগে বাবার মুখে সুমিত ঘোষের নাম শুনেছিল শৌর্য। বাবা বলত, ‘‘কলেজে সুমিত খুবই কাছের বন্ধু ছিল আমার। ছায়ার মতো অনুসরণ করত আমাকে। সিনেমা-সিরিয়াল করতে গিয়ে এমনই ব্যস্ত হল, একটা ফোন পর্যন্ত করে না এখন!’’
বাবার কথায় রাগ নয়, বন্ধুর প্রতি অভিমানই প্রকাশ পেত। শৌর্যের কিন্তু রাগই হত লোকটার উপর, সুমিত ঘোষকে চিনেছিল কাগজ, টিভির ছবি থেকে। মনে হত লোকটা বাজে। বন্ধুত্বের মর্যাদা দেয় না। বিখ্যাত হয়ে ভুলে গিয়েছে পুরনো বন্ধুকে।
সুমিতদা প্রথম যেদিন বাড়িতে এল, দরজা খুলেছিল শৌর্য। দেখামাত্র চিনেছিল সুমিত ঘোষকে। আন্দাজ করেছিল, বাবার মৃত্যুর খবর জেনে সমবেদনা জানাতে এসেছেন। দু’মাস পর সময় হয়েছে এ বাড়িতে আসার।
শৌর্যর আন্দাজ মেলেনি। সুমিতদা হাসিমুখে বলেছিল, ‘‘তুমি নিশ্চয়ই শঙ্খর ছেলে। বাবা আছে বাড়িতে?’’
‘‘ভিতরে আসুন,’’ বলে সুমিতদাকে ঘরে ডেকে নিয়েছিল শৌর্য। কে এল, জানার জন্য বসার ঘরে এসে দাঁড়িয়ে ছিল মা। মা, সুমিতদা পরস্পরের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকল খানিকক্ষণ। মায়ের চেহারায় বদল বলতে, সিঁথিতে সিঁদুর নেই। সেটা যে খুব মোটা করে পরত, তা নয়। তবু বাবা যে আর নেই সেই শূন্যতাটা গোটা শরীরকে গ্রাস করেছিল।
নীরবতা ভেঙেছিল মা। বলেছিল, ‘‘বোসো সুমিত।’’
সোফাটার দিকে তাকিয়েছিল সুমিতদা। বসেনি। দেওয়ালে বাবার ফোটোর উপর দৃষ্টি রেখে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘কবে? কী হয়েছিল?’’
‘‘মাসদুয়েক হল, রোড অ্যাক্সিডেন্ট,’’ বলেছিল মা।
সুমিতদা আর দাঁড়ায়নি। ঘর থেকে সোজা বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। শৌর্য মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘কী ব্যাপার। এভাবে চলে গেলেন কেন?’’
মা বলেছিল, ‘‘তোর বাবাকে বড্ড ভালবাসত। খবরটা সহ্য করতে পারল না। তবে খুব তাড়াতাড়িই আবার আসবে। দেখে নিস।’’
মায়ের অনুমান পুরোপুরি মিলে গেল। দু’দিন বাদেই রাতের দিক করে শৌর্যদের বাড়ি এল সুমিতদা। সেদিন একেবারে অন্য মুড। হাসিখুশি, উচ্ছল। খুব তাড়াতাড়ি আলাপ জমিয়ে নিল শৌর্যর সঙ্গে। বাবার কলেজ জীবনের গল্প শোনাল। বাবা-মায়ের প্রেমের ঘটনাও বাদ রাখল না। মা দু’-তিন বার থামানোর চেষ্টা করল। তারপর উঠে চলে গিয়েছিল লজ্জায়। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সেদিনই মাকে একটু হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। হঠাৎ এতবছর পর শৌর্যদের বাড়িতে আগমনের কারণ হিসেবে সুমিতদা যা জানিয়েছিল, একটা চ্যানেল থেকে টেলিফিল্মের বরাত পেয়েছে। সেটার জন্য বেছেছে বাবার লেখা একটা গল্প। গল্পটা কোথাও ছাপা হয়েছে কি না, জানে না সুমিতদা। বাবা পড়ে শুনিয়েছিল। গল্পের নামটাও মনে নেই। স্টোরিলাইনটা কিন্তু ভোলেনি। মা আর শৌর্যকে গল্পের সারাংশটা শোনাল সুমিতদা। বাবার গোটাচারেক গল্প শৌর্য পড়েছে, তার মধ্যে ওই গল্পটা ছিল না। মা-ও গল্পটা পড়েনি। এদিকে নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে গল্পটা অসাধারণ! মা বলেছিল, ‘‘তুমি শিয়োর, এটা শঙ্খর লেখা গল্প? অন্য কারও গল্পের সঙ্গে গুলোচ্ছ না তো?’’
‘‘না রে বাবা, গল্পে যে কাঠচাঁপা গাছটার কথা আছে, ওরকমই একটা গাছ ওদের মানকুণ্ডুর বাড়িতে ছিল না? গেটের পাশে?’’ মাকে মনে করিয়েছিল সুমিতদা। গাছটার কথা মনে পড়েছিল মায়ের। যদিও মানকুণ্ডুর বাড়িতে বেশিবার যায়নি। যাদবপুরের বাড়িতেই সংসার পেতেছিল। বাবা-মা। মানকুণ্ডুর স্মৃতি শৌর্যর কাছেও ঝাপসা। ঠাকুরদা-ঠাকুমা যখন মারা গিয়েছেন, শৌর্য খুবই ছোট। ওঁরা দু’জন চলে যেতেই ওবাড়ি বিক্রি করে দেওয়া হয়।
সুমিতদার যুক্তিতে মা মেনে নিয়েছিল গল্পটা বাবারই লেখা। বলেছিল, ‘‘আমায় কেন পড়ায়নি বলো তো? এত ভাল গল্প!’’
সুমিতদা বলেছিল, ‘‘তুমি তো জানো ও কেমন চাপা প্রকৃতির ছেলে ছিল। কেন পড়ায়নি বোঝা খুব মুশকিল। হয়তো আমাকেই শুধু পড়িয়েছিল। গল্পের শেষের দিকে এসে কেঁদে ফেলেছিল। সেই কান্নাটা কাঁদতে চায়নি তোমার সামনে, লজ্জা পেয়েছে। কোথাও ছাপতে দিয়েছিল বলেও তো মনে হচ্ছে না। ছাপা হলে নিশ্চয়ই তোমাকে পড়তে দিত। তখন তো আর সামনে বসে কাঁদতে হত না।’’
মা বলল, ‘‘গল্পটা যখন তোমার মনে আছে, স্ক্রিপ্ট লিখে করে ফেলো টেলিফিল্ম। একটু এদিকওদিক হয়তো হবে।’’
প্রস্তাব তৎক্ষণাৎ উড়িয়ে দিয়েছিল সুমিতদা। বলেছিল, ‘‘গল্পটা শোনার পরমুহূর্তে আমি শঙ্খকে বলেছিলাম যদি কোনওদিন সুযোগ পাই, এই গল্পটা থেকে সিনেমা করব। এতদিনে সুযোগটা পেলাম। চ্যানেল বলেছে আমার পছন্দের গল্প বেছে নিতে। শঙ্খর গল্পটা নিয়ে টেলিফিল্ম করব, ও দেখতে পাবে না, কিছুতেই মানতে পারছি না এটা!’’
মা এ ব্যাপারে আর জোর করেনি সুমিতদাকে। সেদিন সুমিতদা চলে যাওয়ার পর মা আর শৌর্য তন্নতন্ন করে খুঁজেছিল বাবার সেই গল্প। কোনও পত্রিকায় ছাপা অবস্থায় কিংবা পাণ্ডুলিপি যদি পাওয়া যায়। গেল না। শৌর্য এখনও অপেক্ষা করে আছে গল্পটা ঠিক একদিন পেয়ে যাবে, যাদবপুরের বাড়ি থেকেই। বাবা এতটাই লুকিয়ে রাখতে চেয়েছে, মা-শৌর্যর নাগালের বাইরে রয়ে গিয়েছে।
যথেষ্ট ছবি তোলা হল হাতিদের। গ্রামের লোকজনও এসে দাঁড়িয়েছে দূরে আলের উপর। চোখের সামনে দেখছে তাদের ফসল খেয়ে নিচ্ছে হাতির দল। এখনও হাতি তাড়ানোয় আয়োজন শুরু করেনি ওরা। দূর থেকে পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে। গ্রামের হুলো পার্টি হাতি তাড়াতে গেলে রাস্তার গাড়িগুলোর কী অবস্থা হবে, কে জানে!
বাইকের কাছে ফিরে এল শৌর্য। অধৈর্য হয়ে অনেকেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। শৌর্যর চেয়ে একটু কমবয়সি একটা ছেলে কাছে এসে বলল, ‘‘দাদা নিশ্চয়ই প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফার?’’
ক্যামেরা ব্যাগে ঢোকাতে-ঢোকাতে এমন ভাবে হাসে শৌর্য, যার মানে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ দুটোই হয়। ছেলেটা মনে হয় ‘হ্যাঁ’ ধরে নিল। বলল, ‘‘দাদার নামটা যদি বলেন!’’
‘‘কেন?’’ অবাক হয়ে জানতে চায় শৌর্য।
ছেলেটি বলে, ‘‘নাম ধরে ফেসবুক সার্চ করতাম। নিশ্চয়ই এই ছবিগুলো আপনার ওয়ালে পোস্ট করবেন। আমার দেখা হয়ে যেত।’’
‘‘এই ধরনের ফোটো আমি ওয়ালে দিই না, বিক্রি করি অথবা এগজ়িবিশনে পাঠাই,’’ বলে বাইকে উঠে বসল শৌর্য।
ছেলেটা আর ঘেঁষল না, ফিরে গেল। মিথ্যে কিছু বলেনি শৌর্য। এফবির ওয়ালে ছবি দিলে বড্ড চুরি হয়ে যায়। ফোটোর নীচে নিজের নাম টাইপ করে দিলেও। ওই অংশটা ক্রপ করে নেয় ফেসবুকিয়ান চোর। ফোটোগ্রাফিতে উৎসাহ দেওয়ার সময় সুমিতদা বারবার বলে দিয়েছিল, ‘‘বিনা পয়সায় একদম ছবি তুলবি না। ফোটোগ্রাফিতে বিস্তর খরচ। গলায় দামি ক্যামেরা ঝুলছে দেখলেই মেয়ের সংখ্যা বাড়বে তোর পাশে। আজকাল অবশ্য ছেলেরাও কম যায় না। টাকার শর্তে ফোটো তুলে দিবি। নয়তো আরও দামি ক্যামেরা, লেন্সের জন্য মায়ের কাছে হাত পাততে হবে।’’
সুমিতদার কথা মোটামুটি মেনে চলে শৌর্য। বাবার লেখা গল্প নিয়ে কথা বলার পর কিছুদিনের তফাতে আবার বাড়িতে এসেছিল সুমিতদা। এমনিই গল্প করতে আসা, শৌর্যদের খোঁজখবর নেওয়া… মা সেদিন বলেছিল, ‘‘আজ সোমাকে সঙ্গে আনতে পারতে। অনেকদিন দেখিনি।’’
‘‘আমিও দেখিনি অপর্ণা। বছরচারেক হল মেয়েকে বগলদাবা করে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।’’
‘‘সে কী! কেন? আমরা তো কোনও খবর পাইনি! শঙ্খ কি জানত?’’ জিজ্ঞেস করেছিল মা।
সুমিতদা বলেছিল, ‘‘কারও কাছ থেকে জেনেছে কি না, জানি না। আমি বলিনি। ইনফ্যাক্ট ওই কারণেই আমি শঙ্খর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলাম না। তুমি তো জানো শঙ্খ কতটা পিউরিটান মনোভাবের। কিছুতেই আমাদের ডিভোর্স হতে দিত না। চোটপাট করত আমার উপর। কিন্তু সম্পর্ক তো একজনের দোষে ভাঙে না, অপরজনও দায়ী থাকে, কম অথবা বেশি।’’
‘‘তা হলে কি আবার বিয়ে করেছ?’’ জানতে চেয়েছিল মা। সুমিতদা বলল, ‘‘না, একটি মেয়ের সঙ্গে লিভ ইন করছি।’’
‘‘লিভ ইন কেন? মেয়েটি কি বিয়েতে রাজি নয়?’’ প্রশ্ন করেছিল মা।
উত্তর দেওয়ার আগে শৌর্যর দিকে তাকিয়ে ছিল সুমিতদা। বন্ধুর কলেজপড়ুয়া ছেলের সামনে বড়দের ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে বাধছিল বোধহয়। অস্বস্তি কাটিয়ে মাকে বলেছিল, ‘‘ঝুলন বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। আমিই রাজি হচ্ছি না।’’
‘‘কেন?’’ অবাক হয়ে জানতে চাইল মা।
সুমিতদা বলেছিল, ‘‘বিয়েটা করে ফেললেই আমার মেয়েটা পর হয়ে যাবে। আর আমাকে বাবা বলে মনে করবে না।’’
কথাটা শুনেই বোঝা গিয়েছিল সুমিতদা কতটা সেনসিটিভ মানুষ। আবার এটাও তো ঠিক, যার সঙ্গে লিভ ইন করছে, তাকে স্ত্রী-র মর্যাদাটা না দিতে চাওয়াটাও অন্যায়। এ ক্ষেত্রে নিজের রক্তের সম্পর্কের প্রতি পক্ষপাত দুষ্ট হয়ে পড়ছে। এদিকে বাবাকে বলছে পিউরিটান। নিজেও তো কিছু কম যায় না। অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ এড়াতে চেয়ে সুমিতদা শৌর্যর দিকে মন দিয়েছিল। বলেছিল, ‘‘বাবা তো গল্প-কবিতা লিখত। তোর এরকম কোনও আর্টিস্টিক শখ আছে নাকি?’’
দৃষ্টি নীচে রেখে মাথা নেড়ে ‘না’ বুঝিয়েছিল শৌর্য। মা বলল, ‘‘না গো সুমিত, ও খুব ভাল ছবি তোলে। আমরা বেড়াতে গেলে প্রচুর ফোটো তুলত। ছবিগুলো ভাল হচ্ছে দেখে শঙ্খ ওকে দামি ক্যামেরা কিনে দিয়েছে। এখন তো সেই ক্যামেরা নিয়ে একা-একাই বেরিয়ে যায় ছবি তুলতে।’’
মায়ের কথা শেষ হতেই সুমিতদা বলেছিল, ‘‘যা, ফোটোগুলো নিয়ে আয় দেখি।’’
বেছে-বেছে কিছু ফোটো নিয়ে এসেছিল শৌর্য। সেগুলো দেখতে-দেখতে স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ময় ফুটে উঠেছিল সুমিতদার মুখে। বলেছিল, ‘‘তুই তো দারুণ ছবি তুলিস! এই বয়সে এত সুন্দর কমপোজ়িশন, অ্যাঙ্গল, পারস্পেকটিভ… এত সব শিখলি কার থেকে?’’
‘‘বাবা খানিকটা দেখিয়ে দিয়েছে, আর ফোটোগ্রাফি সাইটের ছবিগুলো দেখি নেটে,’’ বলেছিল শৌর্য।
সুমিতদার মন্তব্য ছিল, ‘‘তোর বাবার তো ফোটোগ্রাফি সেন্স থাকবেই। অ্যাড এজেন্সিতে চাকরি করত। তোকে ফোটোগ্রাফির প্রাইমারি বিষয়গুলো ধরিয়ে দিয়েছে। তবু আমি বলব কলেজের পাশাপাশি কোনও ফোটোগ্রাফি শেখার ইনস্টিটিউশনে ভরতি হয়ে যা। সাবজেক্টটা হাতেকলমে শেখ। তোর মধ্যে বড় ফোটোগ্রাফার হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।’’
সুমিতদার কথায় মা-ও খানিকটা উৎসাহ পেয়েছিল। তবে একথাও শৌর্যকে বলেছিল, ‘‘দেখিস, ফোটোগ্রাফিটাকে প্রফেশন করে ফেলিস না যেন। হাতে গোনা দু’-একজনকে ছাড়া ফোটোগ্রাফারদের লোকে তেমন পাত্তা দেয় না।’’
শৌর্য বলেছিল, ‘‘আগে তো কাজটা ভাল করে শিখি। নামী ফোটোগ্রাফার হওয়া অনেক দূরের ব্যাপার।’’
দমদমের একটা ইনস্টিটিউশনে অ্যাডমিশন নিল শৌর্য। মা প্রয়োজন মতো অ্যাক্সেসরিজ় কিনে দিতে থাকল। শৌর্য তখন দেদার ছবি তুলে যাচ্ছে। স্ট্রিটফোটো, ল্যান্ডস্কেপ, চেনা পরিচিতদের পোর্ট্রেট, বিয়েবাড়ি… সুমিতদা কয়েকমাস বাদ দিয়ে এসেছিল বাড়িতে। সেদিন লিভ ইন পার্টনার ঝুলনদিকে এনেছিল। আলাপ করাল মায়ের সঙ্গে। শৌর্যর তোলা ফোটো দেখতে চাইল। ছবি দেখে ভীষণ খুশি। বলেছিল, ‘‘তুই তো আরও উন্নতি করেছিস। পোর্ট্রেট তুলছিস দারুণ। তোকে আমার কাজে লাগবে।’’
কাজে লাগাতে সময় লাগল প্রায় এক বছর। হঠাৎ একদিন সুমিতদার ফোন, ‘‘আমার ছবিতে স্টিল ফোটোগ্রাফি করতে হবে তোকে। আজকালের মধ্যে দেখা কর।’’
সিনেমায় স্টিল ফোটোগ্রাফারের কাজটা ঠিক কী, জানত না শৌর্য। স্টিল ফোটোগ্রাফারের নাম থাকে টাইটেল কার্ডে, সেটা দেখেছে। সুমিতদার কাছে গিয়ে জানা গেল কাজের ধরন। ছবির পাবলিসিটির জন্য স্টিল ফোটোর দরকার তো আছেই। আর আছে কন্টিনিউটি মেনটেনের প্রয়োজনে ছবি তোলা। যেমন, আজ কোনও সিনের শুটিং হল অর্ধেকটা, তিনদিন পর বাকিটা হবে। প্রথম অংশের সেট-সেটিং, অভিনেতা-অভিনেত্রীর সাজপোশাকের যে ছবি তুলে রাখবে স্টিল ফোটোগ্রাফার, দ্বিতীয় অংশের শুটিং-এর আগে সেসব মিলিয়ে নিতে হবে। যেন মনে না হয়, দুটো আলাদা দিনে শুট করা হয়েছে।
গোটা ব্যাপারটা বুঝে নেওয়ার পর শৌর্য সুমিতদাকে বলেছিল, ‘‘আমার কলেজের কী হবে! অ্যাবসেন্ট হয়ে যাব তো।’’
‘‘ছাড় তো কলেজ! কত বিখ্যাত লোক কলেজে নাম লিখিয়ে রেখে নিজের কেরিয়ার গড়েছে, পরীক্ষা দিয়ে পাশও করেছে সময়মতো,’’ বলেছিল সুমিতদা। আর তখনই সেই কথাটা বলেছিল, ‘‘বিনা পয়সায় কখনওই ফোটো তুলবি না। ফোটোগ্রাফিতে বিস্তর খরচ। সেটা নিজেকেই তুলতে হবে। তবেই প্রফেশনাল হতে পারবি।’’ ভাবনায় সুমিতদার প্রসঙ্গ এভাবে এসে পড়াতে, মানুষটার জন্য চিন্তা হতে থাকে শৌর্যর। সময়মতো পৌঁছতে না পারলে লুকটেস্ট ক্যানসেল হয়ে যাবে। কেটে যাবে প্রোডিউসর। কিন্তু হাতি রাস্তা জুড়ে থাকলে শৌর্য কী করে এগোবে? সুমিতদাকে একটা ফোন করবে কি? বলবে রাস্তার পরিস্থিতি। সুমিতদা অন্য কোনও ফোটোগ্রাফারকে ডেকে নিতে পারবে।
ট্রাউজ়ারস থেকে ফোন বের করতে গিয়ে থমকায় শৌর্য। হাতির পাল অনেকটাই নেমে গিয়েছে চাষের জমিতে। ফাঁকা হয়েছে ফালিমতো রাস্তা। বাইক বেরিয়ে যাবে। রিস্ক নেওয়া হয়ে যাবে কি? কোনও বাইকই যাচ্ছে বা আসছে না। চেহারা বড় হলে কী হবে, হাতিরা খুবই ক্ষিপ্র। কখন কী করবে ঠিক নেই। পিছন দিকে ঘাড় ফেরায় শৌর্য, যেহেতু রাস্তার ধারে আছে, পিছনে গাড়ি নেই। বাইক ব্যাক করিয়ে রাস্তার আরও ধার ধরে বেরিয়ে যেতে পারবে। হাতিরা ঘুরে পথ না আটকালেই হল। দুরন্ত গতিতে পেরিয়ে যেতে হবে ওদের করিডর। হেলমেট পরে নেয় শৌর্য, প্রায় অজান্তে কিক মারে বাইকে। আওয়াজ উঠতেই আশপাশের সবাই সভয়ে তাকাল শৌর্যর দিকে। পাত্তা না দিয়ে শৌর্য বাইক ব্যাক করাতে থাকে। একটা গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বছর তিরিশেকের এক মহিলা। পরনে আধুনিক পোশাক। শৌর্যর কাছে এসে ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন, ‘‘আপনি কি ওদের ক্রস করবেন?’’
হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে শৌর্য। মহিলা জিজ্ঞেস করেন, ‘‘আপনি কতদূর যাবেন?’’
‘‘কলকাতা,’’ বলল শৌর্য।
মহিলা বললেন, ‘‘প্লিজ়, আমাকে লিফ্ট দিন। না হলে ফ্লাইট মিস করব আমি।’’
‘‘হাতিদের পাশ দিয়ে যেতে আপনার ভয় করবে না?’’ মহিলাকে নিরস্ত করার জন্য বলল শৌর্য।
‘‘তা করবে। কিন্তু ফ্লাইটটা যে আমায় ধরতেই হবে। ভীষণ আর্জেন্ট। কোম্পানির অনেক টাকা লস হয়ে যাবে।’’
মহিলার কথা শেষ হতেই বাইকের অন্য পাশে এসে দাঁড়ালেন বছর পঞ্চান্নর এক ভদ্রলোক। বোঝাই যাচ্ছে গ্রামে বসবাস, গালে খোঁচা-খোঁচা সাদা কালো দাড়ি। বলতে থাকলেন, ‘‘আমার মেয়েটাকে কলকাতায় পৌঁছে দেবে বাবা? চাকরির পরীক্ষা। লিখিত পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে, আজ ইন্টারভিউ।’’
শৌর্য পড়ল মহাবিপদে। দু’জনকে একসঙ্গে নেওয়া যাবে না। আনস্টেডি হয়ে যাবে গাড়ি। মহিলার সঙ্গে আবার একটা লাগেজও আছে। বাবার পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে গ্রামের মেয়েটা। সালোয়ার-কামিজ, পিঠে ব্যাগ। মুখে আর্তি-মেশানো গভীর উৎকণ্ঠা। শৌর্য মেয়েটির বাবাকে জিজ্ঞেস করে, ‘‘আপনাদের গাড়ি কোথায়?’’
‘‘গাড়ি নয় বাবা, বাস,’’ বলে লোকটি আঙুল তুলে সবচেয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা বাসটিকে দেখালেন। শৌর্য লোকটিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে দেখে আধুনিকা আগ্রাসী ভূমিকা নিলেন, বাইকের সিটে উঠে আসার উদ্যোগ নিয়ে বলতে থাকলেন, ‘‘প্লিজ়, ব্রাদার ইটস সো আর্জেন্ট। লেটস্ গো।’’
‘‘দাঁড়ান, দাঁড়ান… আপনার হেলমেট আছে? আমার স্পেয়ার নেই, একটু বাদেই আটকাবে পুলিশ!’’ বলল শৌর্য।
থমকে গেলেন মহিলা। গ্রামের মেয়েটি প্রায় দৌড়ে এসে উঠে পড়ল বাইকে। শৌর্য তাকেও বলল, ‘‘হেলমেট?’’
‘‘কিনে নেব রাস্তায়। এখন তো চলুন।’’
শৌর্য বুঝল মেয়েটার চাকরি হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। উপস্থিত বুদ্ধি দারুণ! বাইক আরও খানিকটা পিছিয়ে নিতে-নিতে শৌর্য আধুনিকাকে বলল, ‘‘সরি ম্যাম, আপনার কোম্পানির লসের চেয়েও মেয়েটার চাকরি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’’
‘‘হাউ ডু ইউ নো দ্যাট শি ইজ় টেলিং ট্রুথ?’’ চেঁচিয়ে বলে উঠলেন মহিলা। কথাটা কানে নিয়েই রাস্তার ধার ঘেঁষে বাইক ছোটাল শৌর্য। মেয়েটিকে বলল, ‘‘আমার কাঁধটা ভাল করে চেপে ধরো। নড়াচড়া করবে না। হাত কেঁপে যাবে আমার।’’
মেয়েটা কোনও উত্তর করল না। কাঁধটা ধরল চেপে। শৌর্য ফের বলে, ‘‘স্টেডি থাকো। তেমন বুঝলে চোখ বন্ধ করে নাও।’’
এবার মেয়েটি বলে ওঠে, ‘‘আপনিই দেখছি বেশি ভয় পাচ্ছেন। কী হবে, বড়জোর সহমরণে যাব।’’
নিজের কথায় নিজেই হাসছে মেয়েটা। গ্রামের হলে কী হবে, বেশ ফিচেল আছে। পিছনে একজনকে নেওয়াতে ভয় একটু হচ্ছিলই শৌর্যর। সহযাত্রীর ইয়ারকিতে সেটা কেটে গেল। সজোরে এগিয়ে চলল হাতিদের ছেড়ে যাওয়া ওই একফালি রাস্তা লক্ষ করে।
৩
আয়নার কাঠের ফ্রেমে বেশ ক’টা সোয়েডের টিপ। সবচেয়ে নতুনটা তুলে নিল আরশি। হতে পারে এটা লাস্ট বোর্ডারের টিপ। সঙ্গে নিশ্চয়ই কোনও পুরুষ ছিল। কুমারী মেয়েরা সাধারণত এরকম লাল টিপ পরে না। পুরুষ সঙ্গীটির সঙ্গে মেয়েটির স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ধরে নিয়ে রিসেপশনের লোকটা এদের রুম দিয়েছিল। আরশি একা বলে কিছুতেই দিতে চায়নি। তখন আরশি বলেছিল, ‘‘আমি কি একটা পুরুষ মানুষ ভাড়া করে নিয়ে আসব? বলব, ‘এ আমার হাজ়ব্যান্ড’। তা হলে দেবেন তো রুম?’’
রিসেপশনের লোকটা মাথা নিচু করে বসেছিল। আরশি ফের বলে, ‘‘আর হ্যাঁ, শুধু পুরুষ মানুষ ভাড়া করলে হবে না। সিঁদুর, টিপ, শাঁখা-পলা, নোয়া সব লাগবে। ব্যস, তা হলেই প্রবলেম সল্ভড। পেয়ে যাব রুম। ঝুটো জিনিসপত্র দিয়ে ঘর পাওয়া যায়। সত্যি বললে রিফিউজ়! অদ্ভুত ব্যাপার!’’
লোকটা তখন বলেছিল, ‘‘কাপ্লকে দেখে সন্দেহ হলে আমরা ম্যারেজ সার্টিফিকেট দেখতে চাই।’’
এটা জানা ছিল না আরশির। তথ্যটা হজম করে নিয়ে বলেছিল, ‘‘সন্দেহ হলে তবে তো সার্টিফিকেট দেখার প্রশ্ন আসছে। এমন অ্যাক্টিং করবে আপনারা বুঝতেই পারবেন না। অথবা বুঝেও কিছু বলবেন না। আপনাদের ব্যাবসা দরকার। একটা রুম তো বুক হল। আই কার্ডের জেরক্স রেখে দেবেন। কার্ডটা নকল কি না, সেটাও খতিয়ে দেখবেন না। আর আমি অরিজিনাল আই কার্ড দিচ্ছি, কী কাজে এসেছি, বলেছি সেটাও। আপনি ভেরিফাই করে দেখতে পারেন সত্যি বলেছি কি না। সেসব না করে প্রথমেই বলে দিচ্ছেন একা মেয়েকে রুম দেবেন না। কোন যুগে পড়ে আছেন আপনি? মেয়েরা এখন সেল্ফ ডিপেনডেন্ট। একা-একা কত কাজ করে বাইরের।’’
রিসেপশনিস্ট তখনও চুপ। আসলে লোকটা একটু নিরীহ টাইপের। তেমন চালাক চতুর নয়। এই হোটেলে আসার আগে দুটো জায়গায় প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল আরশি। তারা বলেছে, রুম নেই। অর্থাৎ কিছু বলারও রইল না। এই হোটেলের লোকটি বলে বসল, ‘‘আমরা কোনও ইয়ং সিঙ্গল লেডিকে রুম দিই না।’’
ব্যস, তারপরই চেপে ধরার সুযোগ পেয়েছিল আরশি। লোকটা উত্তর দিতে পারছিল না। শেষে বলল, ‘‘আপনি থানা থেকে পারমিশন করিয়ে আসুন।’’
‘‘আমি কেন থানায় যাব! আইনে সেরকম কিছু লেখা আছে নাকি? লেখা থাকলে দেখান,’’ বলেছিল আরশি।
লোকটা আবারও চুপ। আরশি তখন বলে, ‘‘আচ্ছা, অনেক ধর্ম বা জাতিতে শাঁখা-সিঁদুর নেই। সেসব কাপ্লদের ক্ষেত্রে কী করেন? ম্যারেজ সার্টিফিকেট দেখতে চান? এটা তো উচিত নয়। হিন্দুদের বেলায় ছাড় আর তাদের বেলায় সন্দেহ?’’
লোকটার তখন পুরো নাজেহাল অবস্থা। শেষমেশ বলে উঠেছিল, ‘‘দেখুন ম্যাডাম, আপনাকে তা হলে আসল ঘটনাটা বলি। এক বছরও হয়নি, আপনার বয়সি একটি মেয়েকে আমরা রুম দিয়েছিলাম। সকালে দরজা খুলছে না দেখে ভেঙে ঢুকতে হয়। গলায় ওড়না জড়িয়ে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছিল।’’
কথাটা শুনে ভিতরটা একেবারে হি হি করে কেঁপে উঠেছিল আরশির, বাইরে সেটা প্রকাশ হতে দেয়নি। লোকটাকে বলেছিল, ‘‘ঠিক আছে, আমাকে দিনের বেলাটার জন্য একটা রুম দিন। কাজের জায়গায় গিয়ে দেখি কোনও ব্যবস্থা করা যায় কি না।’’
‘‘দেখি নয়, রাতের ব্যবস্থা আপনাকে করে নিতেই হবে, বুঝতেই পারছেন… আমি কর্মচারী, মালিক আমাকে যেমন ইনস্ট্রাকশন দিয়েছে, সেটাই মেনে চলতে হবে,’’ বলে হোটেলের রেজিস্টার খাতা এগিয়ে দিয়েছিল লোকটা। আরশির ভোটার কার্ড দেখে, ওখানেই স্ক্যান করে ফেরত দিল। তারপর সার্ভিস বয়কে ডেকে রুমের চাবি যখন দিতে যাচ্ছে, আরশি বলেছিল, ‘‘ওই ঘরটার চাবি দিচ্ছেন না তো?’’
হেসে মাথা নেড়েছিল লোকটা। বলেছিল, ‘‘সুইসাইডের ঘর মালিক বন্ধই রেখেছে। মনে করে অপয়া। আপনার মনেও তা হলে ভয়ডর আছে দেখছি। যেভাবে আর্গুমেন্ট করছিলেন, আমি ভাবছিলাম আপনি এসবের ঊর্ধ্বে।’’
হোটেলে ওঠার কারণ হিসেবে আরশি রিসেপশনিস্টকে বলেছে, অফিসের কাজে এসেছে। বন্ধুর বাড়িতে ওঠার কথা ছিল, বন্ধুর মা হাসপাতালে অ্যাডমিটেড জেনে ওখানে আর যায়নি। অর্থাৎ অর্ধসত্য বলেছে। তাতে সুবিধে কিছু হয়নি। প্রায় জোর করে ঘর নিতে হল। তাও দিনের বেলাটুকুর জন্য।
ট্যাক্সি ড্রাইভার লোকটি ভাল। অন্যের ব্যাপারে নাক গলায় না। শিয়ালদা থেকে আসার পথে শুনেছে বাবাকে মিথ্যে বলছে আরশি। তবু গোলপার্কে এসে একটা হোটেলের সামনেই দাঁড় করিয়েছিল গাড়ি। আরশি বলেছিল, ‘‘একটু ওয়েট করুন। রুম পাই কি না দেখি। না পেলে অন্য হোটেলে যেতে হবে।’’
দ্বিতীয় হোটেলে রিফিউজ়ড হওয়ার পর ড্রাইভার বলেছিল, ‘‘আর-একটা হোটেলে নিয়ে যাচ্ছি, তারপর আমায় ছেড়ে দেবেন।’’
ট্যাক্সি ছেড়ে দেওয়ার পর আরশির রোখ চেপে গিয়েছিল, এই হোটেলে জায়গা তাকে পেতেই হবে। দুপুর দুটোয় অ্যাপয়েন্টমেন্ট, পাঁচঘণ্টা এখন কোথায় ঘুরবে সে? আর যে কাজে যাবে, সেখানে ফ্রেশ হয়ে ঘণ্টা দু’-তিনেক রেস্ট নিয়ে যাওয়া উচিত। নয়তো আরশিকে দেখামাত্র বাতিল করে দেবে ওরা।
রুমে ঢুকেই বাবাকে ফোন করেছিল আরশি। বলেছে, ‘‘চলে এসেছি পূর্বাদের বাড়িতে। এবার স্নান করতে ঢুকব। রাতে ফোন করব আবার।’’
‘‘ঠিক আছে, আজকে আর কোথাও বেরোস না, রেস্ট নে…’’ বলে ফোন কেটেছিল বাবা।
আরশির খারাপ লাগছে বাবাকে এভাবে মিথ্যে বলতে। আগে কখনও এত বড় ধরনের মিথ্যে বলতে হয়নি। আরশি যে এরকম মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছে, বাবা যখন জানবে, আরশিই বলবে, প্রথমে তো বিশ্বাসই করবে না। বিশ্বাস হওয়ার পর বাবা অভিমান করবে খুব! অসুস্থ হয়ে পড়ারও আশঙ্কা আছে। আরশির নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না, তার মতো শান্ত এবং ভিতু প্রকৃতির মেয়ে, যে মেয়ে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কলকাতায় কখনও আসেনি, সে কলকাতা শহরে এসে একা একটা হোটেলে উঠেছে! অবশ্য ঝুঁকিটা সে যেচে নেয়নি, পরিস্থিতি বাধ্য করেছে।
হাতের লাল টিপটা কপালের মাঝে বসায় আরশি। অন্যের টিপ পরতে অস্বস্তি হচ্ছিল। তবু একবার দেখে নিল তাকে মায়ের মতো দেখতে লাগছে কি না। আয়না বলছে, লাগছে না। ঠিকই বলছে। সকলেই বলে আরশি পিতৃমুখী। আরশিও এ ব্যাপারে নিশ্চিত। মায়ের ছবির সঙ্গে নিজের মুখ মিলিয়ে দেখেছে, কোনও মিল নেই। যে কাজে এসেছে, তাতে মায়ের মুখের সঙ্গে মিল থাকা একেবারেই চলবে না। তাই টিপটা পরে আরও একবার নিশ্চিত হয়ে নিল।
সোয়েডের টিপটা যথাস্থানে সাঁটিয়ে আরশি এগোল জানলার দিকে। হোটেলটা মেন রোডের ধারে। আরশির ঘর তিনতলায়। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে রাস্তার লোক চলাচল। যানবাহন। এখানেও ওয়ানওয়ে রাস্তা। দু’ রাস্তার মাঝে বড়-বড় গাছ। সামনের গাছটার মাথা জানলার সমান-সমান। বেশ ক’টা পাখি গাছের ডাল বদল করছে। কিছুক্ষণ আগেও খানিক দূর থেকে কোকিলের ডাক ভেসে আসছিল। বাড়ির জন্য মন খারাপ করছিল আরশির। বছরের এই সময়ে তাদের জলপাইগুড়ির বাতাস কেঁপে ওঠে ঘনঘন কোকিলের ডাকে। লজ্জায় রাঙা হতে থাকে শিমুল-পলাশ। এসব কলকাতায় পাওয়া যাবে না বলেই ধরে নিয়েছিল আরশি। লোকমুখে শুনে, কাগজ-টিভি দেখে ধারণা হয়েছিল কলকাতা একেবারেই শুকনো জায়গা। মা এখানে এসে হারিয়ে গিয়েছে বলে শহরটাকে নির্দয়ও মনে হত। কিন্তু এ শহরে পা রাখার পর থেকে তেমনটা আর মনে হচ্ছে না। বিশেষ করে এই গোলপার্ক এলাকাটাকে তো জলপাইগুড়ির বড়লোক আত্মীয় মনে হচ্ছে। তবে উপর-উপর দেখা আর ভিতরে গিয়ে বোঝার মধ্যে বিস্তর ফারাক। আজ দুপুর দুটোয় গোলপার্কের ভিতরে প্রবেশ করবে আরশি। তারপর দেখা যাক যে কাজে এসেছে, সফল হয় কি না।
জানলার নীচে ফুটপাথের দিকে চোখ যায় আরশির। স্কুলড্রেস পরা বাচ্চা ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘাঘরা-কুর্তি পরা এক মহিলা। সম্ভ্রান্ত চেহারা দেখে আন্দাজ করা যায় বাচ্চাটির মা। স্কুলের পুলকারের অপেক্ষায় রয়েছে দু’জন। আরশির মনে পড়ে না তার মা তাকে কখনও স্কুলের গাড়িতে উঠিয়েছে কি না। ওঠানোর তো কথা। আরশি যখন কেজি পার করে ক্লাস ওয়ান, মা বাড়ি ছাড়ে। মায়ের আবছা কিছু স্মৃতি আরশির মনে ধরা আছে। যার মধ্যে স্কুলের বাসে তুলে দেওয়ার ছবি নেই। যেটুকু স্মৃতি আছে মায়ের, সেগুলোকেও আজকাল আর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। সন্দেহ হয়, এগুলো বুঝি নিজেরই মনগড়া।
মা না থাকাটা চেহারার কোনও খুঁতের মতোই মানিয়ে নিয়েছিল আরশি। যেমন, কারও-কারও মুখে হাতে বেমানান ভাবে তিল-জড়ুল থাকে। আত্মীয় পরিজনের ‘‘আহা রে, বাছা রে’’ শোনাও অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। মায়ের চরিত্র নিয়ে বিদ্রূপও কম শুনতে হয়নি। এখন অবশ্য মায়ের কথা আর কেউ তেমন তোলে না। সময় জলপাইগুড়ির বাতাস থেকে মুছে দিয়েছে মায়ের সমস্ত অস্তিত্ব। অল্প কিছু পড়ে আছে আরশিদের বাবুপাড়ার বাড়িতে। কয়েকটা ছবি, মায়ের পোশাকআশাক, হাতের লেখা, রেকর্ডারে গান-কবিতা। রাগে সবই ফেলে দিতে পারত বাবা। ফেলেনি। ভালবাসা থেকে নয় কিন্তু। আরশি একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘মায়ের এই জিনিসগুলো আগলে রেখে কী লাভ? যখন আমাদের ভুলে যেতে পেরেছে মা। আমরাই বা এসব রাখব কেন?’’
বাবা বলেছিল, ‘‘তুই যদি বলিস, ফেলে দেব। তোর জন্যই রেখেছি। উত্তরাধিকার সূত্রে এগুলো তো তোরও জিনিস।’’
কী ভেবে বাবাকে আর মায়ের স্মৃতিগুলো ফেলতে বলেনি আরশি। ওই স্মৃতিগুলোয় প্রাণ সঞ্চারিত করল বাড়ির ল্যান্ডফোনের রিং। বাবা সেদিন অফিসে, আরশির কলেজ ছুটি। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর ল্যাপটপে সিনেমা দেখছিল। বেজে যাচ্ছ ল্যান্ডসেট। ধরতে ইচ্ছে করে না, তুললেই ইন্সিয়োরেন্স গছানোর চেষ্টা করবে কলসেন্টার। পরিচিত জনের ফোন আজকাল ল্যান্ডলাইনে প্রায় আসেই না। সবাই মোবাইলেই করে। রিং কেটে গিয়ে আবার যখন বাজা শুরু হল, সিনেমায় পজ় দিয়ে ফোন ধরতে উঠেছিল আরশি। রিসিভার কানে নিয়ে ‘‘হ্যালো, হ্যালো’’ করে যাচ্ছ, ও প্রান্তে কোনও সাড়া নেই। ফোন কাটতে যাবে আরশি, ভেসে এল ‘‘ঝুমু বলছিস?’’ গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল আরশির। ভাঙাচোরা, হাহাকার মেশানো এই মহিলাকণ্ঠ কার? আরশির ডাকনাম ধরে ডাকলেন। যদিও এই নাম মামার বাড়িতেই চলত বেশি। প্রশ্নকর্ত্রীকে পালটা প্রশ্ন করেছিল আরশি, ‘‘কে বলছেন আপনি? কোথা থেকে বলছেন?’’
আবারও কোনও সাড়া নেই। আরশি আরও কয়েকবার একই প্রশ্ন করে। এক সময় কেটে যায় লাইন। আরশির কপালে ভাঁজ পড়েছিল। মা-ও ‘ঝুমু’ বলে ডাকত। ‘আরশি’ নামটা বাবার দেওয়া। চিরকালই ওই নামেই ডাকে। কাকা, জ্যাঠা, পিসিরাও তাই। মায়ের বাবুপাড়ার বাড়িতে না ফেরাটা যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, মামারবাড়ির তরফ থেকে কেউ আর আরশিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত না। তা হলে কে ফোন করল সেই কবেকার নাম ধরে?
নিজের বিছানায় ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল আরশি। সিনেমাটা আর দেখতে ইচ্ছে করেনি। খালি মনে হচ্ছিল ওটা মায়ের গলা। এতদিনে হয়তো মেয়ের জন্য মন খারাপ শুরু হয়েছে। ফোন না করে পারেনি। কিছু কি বলতে চেয়েছিল মা, অপরাধবোধ থেকে পারল না বলতে? পরক্ষণেই আরশির মনে হয়েছিল, মা নয়, অন্য কেউ। কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে হেঁয়ালিমার্কা ফোন করল। দীর্ঘ ষোলো বছর পর মা হঠাৎ ফোন করতে যাবে কেন? করার হলে অনেক আগেই করত। ষোলো বছরে দুনিয়ার কত কিছু পালটে যায়। দেখা না হওয়ার এই দীর্ঘ অবসরে মায়ামমতাও ফিকে হয়ে আসে।
বাবা অফিস থেকে ফিরতেই দুপুরের কলটার কথা বলেছিল আরশি। একটু ভেবে নিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘তোর কী মনে হচ্ছে, মা ফোন করেছিল?’’
‘‘শিয়োর নই, তবে হতেও তো পারে!’’ বলেছিল আরশি।
তক্ষুনি কোনও উত্তর দেয়নি বাবা। বাথরুমে ঢুকে মুখ হাত ধুয়ে, বাইরের পোশাক বদলে চা খেতে বসল আরশির সঙ্গে। সারাদিনের কাজের লোক মঙ্গলামাসি থাকলেও, সন্ধের চা-টা আরশিই করে। কেন যেন মনে হয়, তার হাতে করা চা বেশি পছন্দ করে বাবা। কাপে চুমুক দিয়ে বাবা বলেছিল, ‘‘তোর মাকে আমি যতটা চিনি, তাতে মনে হয় না ও ফোন করেছে। ভীষণ জেদি তোর মা। ভুল, ঠিক যাই হোক একবার যে সিদ্ধান্ত নেবে শোভা, তার থেকে পিছু হটবে না। তা ছাড়া মাঝে যখন এত বছর কেটে গিয়েছে, শোভার ফোন না ভাবাই ভাল।’’
‘‘তা হলে আর কার ফোন হতে পারে? বিশেষ করে ওই নামে ক’জনই বা আমাকে চেনে?’’ বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্নটা রেখেছিল আরশি।
বাবা বলল, ‘‘উড়োফোন কতরকমের হয়। কেউ হয়তো আমাদের সঙ্গে বদমাইশি করছে। ডিসটার্ব করতে চাইছে আমাদের।’’
‘‘মামার বাড়ির কেউ হতে পারে কি?’’ বাবার কাছে জানতে চেয়েছিল আরশি।
সন্দেহটা পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়নি বাবা। বলেছিল, ‘‘জানি না। হতেও পারে। তবে কোনও উদ্দেশ্য খুঁজে পাচ্ছি না। এতদিন চুপচাপ থেকে, হঠাৎ এরকম করবে কেন? দ্যাখ, আবার এরকম কল আসে কি না। আর কালই আমি ল্যান্ডফোনে সিএলআই মেশিন লাগাব, দেখা যাবে কোন নম্বর থেকে ফোন আসছে।’’
‘‘আজকের কলটা কোন নম্বর থেকে এসেছে, ফোন অফিসকে জিজ্ঞেস করলে হয় না?’’ বলেছিল আরশি।
মেয়ের উৎসাহ দেখেই বাবা ‘দেখছি’ বলল। নিজের কোনও আগ্রহ ছিল না।
কয়েকদিনের মধ্যেই ল্যান্ডফোনের সঙ্গে সিএলআই মেশিন ইনস্টল করে দিয়ে গেল টেলিফোন অফিসের লোক। বাবা ফোন করে বলে দিয়েছিল তাদের। অফিস থেকে ফিরে বাবা জিজ্ঞেস করল, ‘‘আর ওরকম কোনও কল এসেছিল?’’
আরশি বলল, ‘‘আসেনি,’’ তারপর জানতে চেয়েছিল, ‘‘ফোন এক্সচেঞ্জে খোঁজ নিয়েছিলে, কোন নম্বর থেকে এসেছিল কলটা?’’
‘‘নিয়েছি, কলকাতার একটা পাবলিক বুথ থেকে এসেছিল,’’ জানিয়েছিল বাবা।
আরশি বলেছিল, ‘‘মামার বাড়ি তো মালদায়। কলকাতা থেকে কে করবে ফোন? তোমার কি কোনও ভাবেই মনে হচ্ছে না, মা করতে পারে?’’
‘‘না, মনে হচ্ছে না। তোর মাকে তো অনেক বছর ধরে দেখেছি, ওর ধরনধারণ সব জানি। মায়ের অভাববোধ থেকেই তোর মনে হচ্ছে ওই কলটা তার। যে ওই কলটা করে তোকে ডিসটার্ব করছে, সে তোর মনের দুর্বলতার কথা জানে,’’ বলে থেমেছিল বাবা। মুখে একটু রাগ-রাগ ভাব। মায়ের উপর রাগ?
আরশি বলেছিল, ‘‘কে আমাকে ডিসটার্ব করতে চাইবে বলো তো? আমার সঙ্গে কারও তেমন ঝগড়াঝাঁটি নেই।’’
‘‘সেটাই হয়তো কোনও একজনের সহ্য হচ্ছে না। তোকে উত্ত্যক্ত করতে চাইছে ঈর্ষা থেকে। কেন ঈর্ষা জিজ্ঞেস করিস না। ঈর্ষার নির্দিষ্ট কোনও কারণ থাকে না। যে-কোনও ব্যাপারেই একে অপরকে ঈর্ষা করতে পারে মানুষ। ওটা মানুষের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য,’’ বলার পর আরও একটা পয়েন্ট মনে পড়ে যেতে বাবা বলেছিল, ‘‘আর হ্যাঁ, জলপাইগুড়ি কিংবা মালদা, মানে তোর মামার বাড়ির কেউ কলকাতা গিয়ে থাকলে এই কলটা করতেই পারে। কলকাতার কাউকে দিয়ে ফোনটা করানোও যেতে পারে।’’
‘‘কিন্তু আমাকে কেউ কেন এত ইম্পর্ট্যান্স দেবে? এত গুরুত্ব পাওয়ার মতো কী করেছি আমি?’’ বলেছিল আরশি। বাথরুমে ঢোকার আগে বাবা উত্তর দিয়েছিল, ‘‘আরও ক’বার এরকম কল আসুক, তখন দেখব কী করা যায়। এখনই এত উতলা হওয়ার কিছু নেই।’’
আর ওরকম কল আসেনি। কিছুদিন যেতে বাবা ভুলে গেল ওই ফোনটার কথা। আরশি ভোলেনি। বরং তার ধারণা দৃঢ় হতে থাকল, কলটা মায়েরই ছিল। হয়তো জলপাইগুড়ির বাড়ির কথা ভীষণভাবে মনে পড়ছে মায়ের। তাই ফোন না করে পারেনি। ল্যান্ডলাইন যেহেতু মায়ের আমলের, যোগাযোগের সূত্র ছিল ওটাই। হয়তো কিছুই বলার ছিল না মায়ের। শুধু এইটুকুই জানার ইচ্ছে ছিল, আরশিরা আগের বাড়িতেই আছে কি না। মেয়ের গলা শুনে নিজেকে বেঁধে রাখতে পারেনি মা, আদরের নাম ধরে ডেকে ফেলেছে। কিন্তু ডাকটায় এত কাতরতা কেন? মা কি খুব কষ্টে আছে? এতদিনে বুঝেছে, যা করেছিল তা অন্যায়? এখন অনুশোচনায় ভুগছে? অথবা মা এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে, এ বাড়ির সাহায্য দরকার। ফোন করেও কথাটা বলে উঠতে পারল না মা। নিজের অপরাধবোধ কণ্ঠ রোধ করে দিয়েছিল মায়ের।
এসবই সম্ভাবনার কথা। আরশি মায়ের দ্বিতীয় ফোনের প্রতীক্ষায় দিন পার করছিল। মাসদুয়েকও কাটেনি। মায়ের সঙ্গে যোগাযোগের একটা ক্ষীণ সুযোগ দেখা দিল সামনে। কলেজ শেষ। তবু সরস্বতী পুজোর দিন বন্ধুরা মিট করেছিল। কলেজ ক্যান্টিনে বসে লহমা বলল, ‘‘আমার পিসির ছেলে দীপনদা কাল ফোন করেছিল আমাকে। তোরা তো জানিস দীপনদা টিভির মেগা সিরিয়ালে কাজকর্ম করে। এখন একটা সিনেমার অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হয়েছে। শ্যুটিং শুরু হয়নি। কাস্টিং চলছে। সেকেন্ড লিড নায়িকার জন্য আমাদের বয়সি একটা মেয়ে চাই এবং সেই মেয়েটার চেহারায় মফস্সলের ছাপ থাকতে হবে। তোরা কি কেউ অডিশন দিতে চাস? দীপনদা আমাকে বলেছে, আমার চেনাজানা এমন কেউ থাকলে এবং অভিনয় করতে ইচ্ছুক হলে যেন দীপনদার মেল নম্বরে সে যেন ক’টা ফোটো পাঠায়।’’
তৎক্ষণাৎ পাঁচ-ছ’টা হাত উঠে গেল। লহমা বলেছিল, ‘‘তবে মনে রাখিস সিলেক্ট কিন্তু একজনই হবে। আবার দেখা গেল তোদের মধ্যে একজনেরও হল না। দীপনদা বা ওদের টিম শুধু আমাকে তো বলেনি খোঁজ করতে, আরও অনেককেই নিশ্চয়ই বলেছে। তোরা একটা চান্স নিয়ে দেখতে পারিস।’’
আরশি হাত তোলেনি। সিনেমায় অভিনয়ের কোনও ইচ্ছেই তার নেই। মা ওই নেশাতেই তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। সাধারণ কৌতূহলে লহমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘সিনেমাটার ডিরেক্টর কে? নামী কেউ?’’
‘‘সুমিত ঘোষ। নাম শুনেছিস নিশ্চয়ই। আর্ট ফিল্ম করে,’’ বলেছিল লহমা।
কানে তালা লেগে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল আরশির। এই সুমিত ঘোষ লোকটার উপর তার অসম্ভব রাগ। মা এই লোকটার ছবিতে অভিনয় করতে এসেছিল কলকাতায়। আর ফেরেনি।
নামটা শোনার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে আরশি লহমাকে বলেছিল, ‘‘আচ্ছা, আমি ফোটো পাঠাতে পারি?’’
‘‘না পাঠানোর কী আছে। আমি তো সকলকেই বললাম। তবে যা করবি, একটু তাড়াতাড়ি। ওরা হন্যে হয়ে ক্যারেক্টারের সঙ্গে মানানসই অভিনেত্রী খুঁজছে।’’
লহমার বলা শেষ হতেই এষা বলেছিল, ‘‘তুই পাঠাবি না ফোটো? তোর কানেকশন তো স্ট্রং। পিসতুতো দাদা অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর।’’
‘‘ওরে গাধা। আমাকে যদি ওই ক্যারেক্টারে মানাত, দীপনদা তো ডেকে পাঠাত অডিশনের জন্য। আমাকে বছরদুয়েক আগে দেখেছে। ফেসবুকে দেখছে লেটেস্ট ছবি,’’ বলেছিল লহমা।
আরশি তৎপর হয়ে ওঠে চান্সটা কাজে লাগানোর জন্য। সিনেমায় অভিনয়ের কথা ভেবে নয়, মায়ের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ নিতে। কোনওভাবে যদি তার ফোটো সিলেক্ট করে সুমিত ঘোষের টিম, লোকটার মুখোমুখি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকবে। আরশি সুমিত ঘোষকে জিজ্ঞেস করবে মায়ের এখনকার ঠিকানা। দেখা হওয়ামাত্র জানতে চাইলে হবে না। ঘুরিয়েফিরিয়ে কৌশল করে জানতে হবে। মা সিনেমায় অভিনয় করবে বলে তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে, এই তথ্য বড় হতে-হতে জেনেছিল আরশি। আরও পরে এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে কাকিমার থেকে জেনেছিল ডিরেক্টর সুমিত ঘোষের নাম। মা ওঁর প্রথম ছবিতে নায়িকার রোল পেয়ে বাড়ি ছেড়েছিল। সেই সিনেমা অবশ্য রিলিজ় করেনি। তারপর থেকে আর কোনও খোঁজ নেই মায়ের। সুমিত ঘোষের নামটা কাকিমার মুখে শোনার পর আরশি বাবাকে বলেছিল, ‘‘ওই ডিরেক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলে, যার ছবিতে অভিনয় করার পরই মা উধাও হল?’’
‘‘সুমিত ঘোষের কথা বলছিস তো? কলকাতায় গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। বললেন, ছবিতে অভিনয়ের পর তোর মা কিছুদিন ওঁর কাছে যাতায়াত করেছিল। তারপর হঠাৎই বন্ধ করে দেয়। উনিও শোভার কোনও খবর দিতে পারেনি। পুলিশও খুঁজে পেল না। এদিকে আমি যে খুঁজছি, সে খবর পেয়ে তোর মা একদিন ফোন করে রীতিমতো হুমকি দিল, ‘আমাকে খোঁজার চেষ্টা করে বিপদ ডেকো না নিজের। ফল ভাল হবে না।’ তারপর থেকে হাল ছেড়ে দিয়েছি।’’
সুমিত ঘোষের সঙ্গে দেখা করার ঘটনাটা ছাড়া, মাকে খোঁজার জন্য যা-যা করা হয়েছে, খানিকটা বাবা, বাকিটা আত্মীয়দের কাছে আগেই শুনেছিল আরশি। সুমিত ঘোষের পর্বটা শুনে মনে হয়েছিল, বাবা প্রায় সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকার সেরে এসেছে। লোকটাকে আরও চেপে ধরা উচিত ছিল। তাতেও যদি সন্ধান না পাওয়া যেত মায়ের, টালিগঞ্জের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অন্য লোকজনের কাছে খবর নিতে পারত বাবা। না নেওয়ার একটাই কারণ হতে পারে, সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া বউকে আর ঘরে তুলবে না। মা চলে যাওয়ার এক বছর পর থেকে আত্মীয়-বন্ধুরা বাবাকে বারবার বলেছে কোর্টে ডিভোর্সের মামলা করে নতুন করে বিয়ের প্রস্তুতি নিতে। আরশিকে তো মানুষ করতে হবে। এ সবই আরশি শুনেছে বড় হয়ে। বাবা ডিভোর্স এবং আবার বিয়ের দিকে পা বাড়ায়নি। বলেছে, ‘‘নতুন বউ এসে স্বাভাবিক চাহিদা থেকেই নিজের একটা ইসু চাইবে। তখন আরশির অযত্ন হবে। তার চেয়ে টাকা দিয়ে আরশির জন্য লোক রাখা ভাল। অযত্ন হলে জবাবদিহি করতে পারব।’’
বাবা বিয়ে না করাতে আরশি যেমন স্বস্তি পেয়েছে, খারাপও লাগত এই ভেবে তার জন্য বাবাকে জীবনে এতটা স্যাক্রিফাইজ় করতে হল। অনেকদিন ধরেই আরশি ভেবে রেখেছে, বড় হয়ে যখন চাকরিবাকরি করবে, নিজের উদ্যোগে খুঁজে বের করবে মাকে। জিজ্ঞেস করবে, ‘মেয়েকে বড় না করে কেন পালালে তুমি? কীসের টানে? খ্যাতি কি সন্তানের চেয়েও বড়?’
সেদিনের কলটা যদি মায়ের হয়, তেমনটাই বিশ্বাস করতে মন চেয়েছে আরশির, তা হলে বলতে হবে, মা এতদিনে বুঝেছে সন্তানের চেয়ে প্রিয় আর কিছু হয় না। তাই অমন কাতর গলায় ‘ঝুমু’ বলে ডেকে উঠেছিল। আরশির মনে হতে থাকে মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়াটা এখনই দরকার। ভাল নেই মা। গলা শুনে তেমনটাই বোধ হচ্ছিল। কিন্তু কী উপায়ে দেখা করবে? অত্যন্ত অপরিসর হলেও লহমা অজান্তে একটা রাস্তা এনে দিল সামনে। অপরিসর এই কারণে, আগে তো আরশির ছবি সিলেক্ট হতে হবে। তারপর ডাক পাবে অডিশনে। সেখানে গিয়েও সুমিত ঘোষের সামনে পৌঁছতে পারবে কিনা, কোনও ঠিক নেই। দেখা গেল অ্যাসিস্ট্যান্টরাই বাছাই করছে। তা করুক, ওইটুকু এন্ট্রি পেলেই মায়ের খোঁজ নেওয়া শুরু করবে আরশি। কাজটা একা-একা করা খুবই কঠিন। আরশি ঠিক করে রেখেছিল কোনওভাবে যদি ইন্ডাস্ট্রিতে সামান্য প্রবেশও করে উঠতে পারে, পূর্বাকে খুলে বলবে তার এখানে আসার আসল কারণ। তারপর পূর্বাকে সঙ্গে করে মাকে খোঁজার চেষ্টা চালাবে।
কিন্তু সব কিছুই নির্ভর করছে আরশির ফোটো সিলেক্ট হওয়ার উপর। কৌশিকদার স্টুডিয়োতে গিয়ে আরশি পোর্টফোলিয়োর ফোটোগুলো তুলিয়েছিল। কৌশিকদার হাত ভাল। বলেছিল, ‘‘তোকে তো কবে থেকেই বলছি একটা পোর্টফোলিয়ো বানা। এত ফোটোজেনিক তুই। এতদিনে মতি হল! কোথায় পাঠাবি?’’
‘‘একটা ম্যাগাজ়িনে… মডেল খুঁজছে ওরা,’’ বানিয়ে বলেছিল আরশি। গোটা ব্যাপারটা যতটা পারে গোপনে সারতে চায়। সেই কারণে পূর্বাকেও এখানে আসার আসল উদ্দেশ্যটা বলেনি। কৌশিকদার তোলা ফোটোগুলো লহমাকে মেল করে দিয়েছিল আরশি। দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ভেবেছিল, ‘এত প্ল্যান করছি, দেখা গেল ফোটোই সিলেক্ট হল না!’ গোটা ব্যাপারটা আরশি মাথা থেকে নামিয়ে রেখেছিল। হঠাৎ একদিন রাত ন’টা নাগাদ মোবাইলে নাম ভেসে উঠল লহমার। আরশির মন বলছিল ফোটো সিলেক্টেড। নয়তো এত রাতে ফোন করত না লহমা। কাল দিনের বেলায় কোনও এক সময় ফোন করে জানাত, ক্যানসেল্ড।
মোবাইল কানে নিয়ে আরশি চলে গিয়েছিল বারান্দায়। কারণ ড্রয়িং রুমে বসে বাবার সঙ্গে টিভি দেখছিল সে। অনুমান একেবারে সঠিক। বিপুল উচ্ছ্বাসে লহমা জানিয়েছিল, ‘‘তোর ছবি পছন্দ হয়েছে দীপনদাদের। দিনকুড়ি বাদেই অডিশন। আমি ওদের মেল এবং ফোন নম্বর হোয়াটসঅ্যাপ করে দিচ্ছি, কথা বলে নে।’’
আরশি বলেছিল, ‘‘তোকে একটা রিকোয়েস্ট করব?’’
‘‘কী? যাবি না তো অডিশন দিতে? সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম! গ্ল্যামার জগৎ নিয়ে তোর কোনও আগ্রহ নেই সে আমি দেখেছি, বরং ফোটো পাঠাতে দেখে বেশ অবাকই হয়েছিলাম! আসলে দেখে নিলি নিজের মার্কেটভ্যালু!’’ বলেছিল লহমা।
আরশি বলে, ‘‘দাঁড়া, আগে আমায় বলতে দে। অডিশন দিতে আমি যাব। কিন্তু গোটা ব্যাপারটা তোকে সিক্রেট রাখতে হবে। আমাদের গ্রুপের অন্য কাউকে বলেছিস কি, আমার ফোটো সিলেক্টেড হয়েছে?’’
‘‘না, বলিনি, যার খবর, তাকে তো আগে জানাব,’’ বলেছিল লহমা।
স্বস্তি পেয়েছিল আরশি। লহমাকে বলে, ‘‘প্লিজ়, তুই কাউকে কিছু জানাস না। বন্ধুরা রেজ়াল্ট জানতে চাইলে বলবি সবার ফোটো ক্যানসেল্ড। আমিও বাড়িতে বলব না অডিশন দিতে যাচ্ছি। বাবা যেতে দেবে না। কোনও একটা অজুহাত তৈরি করে কলকাতায় পূর্বাদের বাড়ি উঠব। ওখান থেকে দিতে যাব অডিশন। ওরা যদি আমাকে চরিত্রটার জন্য পছন্দ করে, তখন সবাইকে সুখবরটা জানাব। আগে থেকে বলে রাখলাম, পরে যদি চান্স না পাই, বড্ড বোকা-বোকা লাগবে।’’
‘‘ওকে বস! কাউকে বলছি না, তবে তোমার বাবা যদি নিজের থেকে এসে জানতে চান, সত্যিটা বলতেই হবে… গার্জেনের কাছে কথা লুকিয়ে ফাঁসতে চাই না আমি,’’ জানিয়ে দিয়েছিল লহমা।
আরশি বলে, ‘‘ঠিক আছে বাবাকেই শুধু বলিস। তবে মনে হয় না বলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে।’’
এরপরই সমস্ত পরিকল্পনা নিজের মতো সাজিয়ে নিয়েছিল আরশি। কিন্তু কোনও প্ল্যানই যে ফুলপ্রুফ হয় না, পাশাপাশি আর একটা রাস্তা রাখতে হয় এই শিক্ষাটা দিল পূর্বার মায়ের হার্টঅ্যাটাক।
এই হোটেলটায় ঢুকেই প্রথমে স্নান সেরে নিয়েছিল আরশি। তারপরই ফোন করেছিল পূর্বাকে, কাকিমার অবস্থা কেমন জানতে। তার সঙ্গে এই ভাবনাটাও ছিল, কাকিমার শরীর কন্ট্রোলে এসে গেলে, পূর্বা তাকে বাড়িতে ডেকে নেবে নিশ্চয়ই। তা হলে রাতের থাকাটা নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।
ফোন বেজে গেল। ধরল না পূর্বা। তার মানে এখনও মাকে নিয়ে ব্যস্ত। ক্রাইসিস পিরিয়ড কাটেনি। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল আরশির। বেল টিপে সার্ভিস বয়কে ডেকে ব্রেড-বাটার, ডিমসেদ্ধ আনিয়েছিল। চা-ও খেল। সার্ভিস বয়কে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘কাঁকুলিয়া রোড কীভাবে যাব বলো তো?’’
‘‘এই তো হোটেল থেকে নামবেন, কিছুটা এগোলেই গোলপার্ক, ওপারে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে কাঁকুলিয়া রোড…’’ বলার পর ছেলেটা জানতে চেয়েছিল, ‘‘দুপুরে কী খাবেন আর সেটা ক’টায় দেব?’’
‘‘মাছ-ভাত দিয়ো, একটা নাগাদ,’’ বলে সকালের খাবার সেরে ঘুমের প্রস্তুতি নিয়েছিল আরশি। জানলা বন্ধ করে অল্প স্পিডে পাখা চালিয়েছিল। ফেব্রুয়ারির শেষদিকটায় জলপাইগুড়িতে পাখা চালানোর কথা ভাবাই যায় না। এখানে কিন্তু গরম লাগছে।
ঘুম এল না কিছুতেই। মাথার মধ্যে নানা কথা ঘুরছে। একবার মনে হচ্ছে মায়ের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছি, এই শহরেই তো আছে। ফিল্মের লোকেদের সঙ্গে কথা বললেই খোঁজ পেয়ে যাব। পরক্ষণেই মাথায় আসছে বড় হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল। রাতে থাকার কী হবে? এর চেয়ে বরং বাবাকে ফোন করলেই হত। আসলে মায়ের কাছ থেকে অনেক কিছু জানার আছে আরশির। সত্যি কি মায়ের সংসারের প্রতি মন ছিল না? গয়নাগাঁটি, সাজগোজের দিকে ঝোঁক ছিল বেশি? গান-আবৃত্তি তো ছিলই, নাটকেও অভিনয় করত। দেখতে ছিল দারুণ। জলপাইগুড়ি বা মামার বাড়ি মালদা থেকে অভিনয়, গান-আবৃত্তির জন্য ডাক পেত প্রচুর। কলকাতা ডেকে নিল একবার। আর ফিরল না মা। কেমন ছিল মা, তার সবটাই আত্মীয়-পরিজনের থেকে শোনা আরশির। সবাই বলে মায়ের টাকার লোভ ছিল, বিরাট খ্যাতি হোক চাইত। তেমনটা তো নাও হতে পারে! মা হয়তো চাইত নিজের গুণের কদর হোক আরও বড় পরিসরে। মফস্সলের গণ্ডির মধ্যে নয়। সেই জন্যই চলে এসেছিল কলকাতায়। মায়ের মনোভাব কী ছিল, জানতে চায় আরশি। মা-ও নিশ্চয়ই আরশিকে কাছে পেতে চাইছে। তাই এতদিন পর ওভাবে ফোন করেছিল। একে অপরকে দেখতে চাইলে, দেখা হতে আর কতক্ষণ! আরশির মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়িই মায়ের মুখোমুখি হতে পারবে সে। তবে এগোতে হবে সাবধানে। সুমিত ঘোষের সঙ্গে দেখা হলেই মায়ের কথা তুলবে না। বাবাকে যেমন দায়সারা উত্তর দিয়েছিলেন, আরশিকে শুনতে হবে তেমনটাই। ক্যারেকটারের জন্য সিলেক্ট হোক বা না হোক, ইউনিটের লোকের সঙ্গে ভাল করে আলাপ করে নিতে হবে। তারপর ওদের কারও পরামর্শ অনুসারে খুঁজতে শুরু করবে মাকে।
ছোটবেলায় ঘুমের মধ্যে প্রায়ই মায়ের স্বপ্ন দেখত আরশি। বেশ কিছু বছর আর দ্যাখে না। স্বপ্নে দেখত মা অন্যের বাড়ির কর্ত্রী। কারও সঙ্গে সেই বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে আরশি। মা অতিথি আপ্যায়ন করছে। প্লেট এগিয়ে দিচ্ছে আরশির সামনে, এদিকে নিজের মেয়েকে চিনতে পারছে না! আরশি বলার চেষ্টা করছে, ‘মা! আমি ঝুমু। চিনতে পারছ না…’ গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না আরশির, ঘুম ভেঙে যেত। এ ছাড়াও স্বপ্নে মায়ের সঙ্গে রাস্তা-ঘাটে, দোকান-বাজারে দেখা হয়েছে। ধাওয়া করেছে আরশি, মাকে ছুঁতে পারেনি। চোখে জল নিয়ে ঘুম ভেঙেছে তার। বাবা জিজ্ঞেস করেছে, ‘‘চোখে জল কেন? স্বপ্ন দেখছিলি? কীসের স্বপ্ন?’’
আরশি এটা-সেটা বলে কাটিয়ে দিয়েছে। মায়ের স্বপ্ন দেখে উঠল, কখনওই বলেনি। কষ্ট পাবে বাবা। মায়ের অভাব বুঝতে না দেওয়ার জন্য প্রাণপাত করে। জলপাইগুড়ির আদরপাড়ায় আরশির ঠাকুরদার করা বাড়ি। জ্যাঠা-কাকার সংসার ওখানেই। ওবাড়িতে জায়গা কম পড়তে পারে বুঝে বাবা বিয়ের আগে বাবুপাড়ার বাড়িটা করে। অন্য ভাইদের তুলনায় বাবার আর্থিক অবস্থা উপরের দিকে, ব্যাঙ্ক অফিসার। দু’বাড়ির মধ্যে যোগাযোগ ভাল। মায়ের সময় নাকি ততটা সদ্ভাব ছিল না। মাকে পছন্দ করত না আদরপাড়ার বাড়ির লোক। মা-ও নাকি তাদের পাত্তা দিত না। মায়ের উপর রাগ থেকেই বোধহয় জ্যেঠু একদিন বাড়ি এসে বাবাকে বলল, ‘‘হ্যাঁরে রজত, বারো বছর তো পেরিয়ে গেল। শোভার কোনও খবর এল না। শাস্ত্রমতে এবার ওর শ্রাদ্ধটা সেরেই ফেলা যায়। তোর কী মত?’’
কথাটা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না বাবা। তারপর আবার মেয়ে বসে আছে কাছেই। তাকিয়েছিল আরশির মুখের দিকে। রাগে গনগন করছিল আরশির চোখ। মেয়ের মনোভাব বুঝে নিয়ে বাবা জেঠুকে বলেছিল, ‘‘শাস্ত্র আজকাল কে-ই বা মানে। তা ছাড়া ওইসব করে লাভই বা কী?’’
‘‘শাস্ত্র তো হেলাফেলার লোক তৈরি করেনি, করেছেন দার্শনিক, পণ্ডিত মানুষ! সব দিক ভাবনা-চিন্তা করে মানুষের মঙ্গলের কথা ভেবে শাস্ত্র বিধি বাঁধা হয়েছিল, শোভা চলে গিয়েছে সেই কবে, এখনও তোরা ওকে ভুলতে পারছিস না! শোভা হয়তো আর নেই, খবরটা পাসনি বলে শ্রাদ্ধশান্তি করছিস না, ওর অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে ইহলোকেই…’’ জেঠু আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল আরশি। সে তখন বারো ক্লাস। জানে তার অমতে বাবা মোটেই মায়ের শ্রাদ্ধ করবে না। সমস্যা হয়েছিল একটাই, জেঠুর কথাটা শোনার পর থেকে বেশ কয়েক রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছিল আরশি, মায়ের শ্রাদ্ধের কাজ হচ্ছে বাড়িতে। জোরে-জোরে মন্ত্রোচারণ করছেন পুরোহিতমশাই। ধুতি-চাদর পরে বাবা মায়ের ফোটোর সামনে বসে আছে। মা এসে দাঁড়িয়েছে বাড়ির দরজায়, মুখে অবাক ভাব। হঠাৎ ঘুরে গিয়ে হাঁটা দিল মা। এখন কী করবে আরশি?
রুমের বেল বেজে উঠল। চিন্তা ছিঁড়ে ধড়ফড় করে ওঠে বুক! জানলা থেকে সরে এল আরশি। কে বেল দিচ্ছে? কেন?
আস্তে করে দরজার ছিটকিনি নামায় আরশি। দরজা খুলে দেখে হোটেলের সেই সার্ভিস বয়। জিজ্ঞেস করল, ‘‘ম্যাডাম, লাঞ্চ কি রুমে দেব? নাকি ডাইনিং-এ আসবেন? একটা বাজে।’’
‘‘রুমেই দাও,’’ বলল আরশি।
খাওয়াদাওয়া সেরে, বাছাই করে রাখা জিন্স-কুর্তা পরে, কাঁধে ছোট পার্স নিয়ে আরশি যখন ক্রস করছে রিসেপশন কাউন্টার, রিসেপনশনিস্ট লোকটা বলে উঠল, ‘‘কী হল, আপনি লাগেজ নিলেন না?’’
‘‘এখনই কেন নেব? দিনের আলো তো নেভেনি।’’
একটু থমকাল লোকটা। একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘‘সন্ধের মধ্যেই ফিরবেন কিন্তু। নয়তো ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে রুম খুলে লাগেজ বাইরে রাখতে বাধ্য হব।’’
ব্যাগে রাখা রুমের চাবিটা বের করে কাউন্টারে রাখল আরশি। বলল, ‘‘ডুপ্লিকেট চাবির দরকার নেই। এটা দিয়েই খুলবেন রুম।’’
৪
চারটেই বাজল কাঁকুলিয়া রোডে ঢুকতে। সুমিতদার প্রোডাকশন অফিস খুব দূরে নয়। মোটরবাইকে মিনিট তিন। রাস্তা সরু, রিকশা চলছে, পথচারী, সব কাটিয়ে সাবধানে এগিয়ে চলেছে শৌর্য। মহুলিয়া থেকে ফিরে বাড়ি ঢুকে স্নান খাওয়ার সময় পেয়েছে। মা খুশি। গ্রামের মেয়েটিকে নামাতে হয়েছিল ল্যান্সডাউনের মোড়ে। মেয়েটি যখন ‘ধন্যবাদ’ দেওয়া শেষ করে উঠতে পারছিল না, শৌর্য বলেছিল, ‘‘সত্যিই ইন্টারভিউ তো? না কি অন্য কিছু?’’
মুহূর্তে আনন্দ উবে গিয়েছিল মেয়েটির মুখ থেকে। বলেছিল, ‘‘অন্য কিছু মানে?’’
‘‘না মানে, আজ তো রবিবার, আজকে ইন্টারভিউ ব্যাপারটা কেমন-কেমন লাগছে না!’’ মিচকি হেসে মন্তব্য করেছিল শৌর্য।
মেয়েটির চোখমুখ তখন সিরিয়াস। বলতে থাকল, ‘‘যে মহিলা ফ্লাইট মিস করবেন বলে আপনার সঙ্গে আসতে চাইছিলেন, উনিই আপনার মাথায় ঢুকিয়েছিলেন, আমি যে সত্যি বলছি প্রমাণ কী! এতই যদি সন্দেহ, ওঁকে নিয়েই আসতে পারতেন।’’
শৌর্য বলেছিল, ‘‘আরে রাগ করছ কেন? কথাটা আমার অনেক পরে মাথায় এসেছে। তবে তোমায় অবিশ্বাসও হয়নি। জাস্ট জানতে চাইছি, কী ধরনের কাজের ইন্টারভিউ? উত্তর না পেলেও চলবে।’’
মেয়েটি বলল, ‘‘হসপিটালের চাকরি। প্রাইভেট হসপিটাল। রোজ খোলা। বিশ্বাস হল? আপনার ফোন নম্বরটা দিন। চাকরিটা হলে জানিয়ে দেব।’’
‘‘শুধু জানাবে! খাওয়াবে না?’’ বলে পার্স থেকে নিজের কার্ড বের করে মেয়েটিকে দিয়েছিল শৌর্য।
মেয়েটির হাতে ধরা ছিল হাইওয়ের ধার থেকে কেনা হেলমেট। শৌর্যকে দিয়ে বলেছিল, ‘‘রেখে দিন।’’
‘‘সে কী, এটা তো তুমি কিনেছ! তোমার জিনিস, আমি কেন নেব?’’ বিস্ময় প্রকাশ করেছিল শৌর্য।
মেয়েটি বলে, ‘‘এটা হাতে নিয়ে আমি ইন্টারভিউ দেব? গ্রামে ফিরব বাসে, কোলে রাখব হেলমেট? তার চেয়ে থাক না আপনার কাছে। আবার নিশ্চয়ই দেখা হবে। তখন কাজে লাগবে।’’
মেয়েটা ভয়ংকর রকমের রোম্যান্টিক, শৌর্য আবার রোম্যান্টিক মেয়েদের মুখোমুখি হলে নার্ভাস ফিল করে। এরা ভীষণ আনপ্রেডিক্টবল। কখন কী বলবে, কী করতে চলেছে, আন্দাজ করা মুশকিল। হেলমেটটা নিয়েই বাড়ি ফিরেছিল শৌর্য।
সুমিতদার অফিসের সামনে ইউনিটের লোকজন ভরতি। শৌর্যকে দেখেই সাড়া পড়ে গেল। দু’-তিনজন দৌড়োল শৌর্য আসার খবরটা সুমিতদাকে দিতে। গেট পেরিয়ে বাইক স্ট্যান্ড করল শৌর্য। জিন্স থেকে মোবাইল বের করে দেখে ছ’টা মিসড কল। জানে সব কলই সুমিতদার ইউনিটের। তবু একবার দেখে নেয়, যা ভেবেছে, তাই। হাইওয়েতে গাড়ি চালানোর সময় সুমিতদা দু’বার ফোন করেছিল। শৌর্য তখনই বলে দিয়েছে, ‘‘চারটের মধ্যে ঢুকছি। হাতির দল নেমে এসেছিল রাস্তায়। ওখানেই ঘণ্টাখানেক লেট।’’ তারপর থেকে যতগুলো ফোন এসেছে, একটাও ধরেনি শৌর্য।
তিনতলা বাড়ির একতলার সামনের পোরশন অফিসের জন্য ভাড়া নিয়েছে সুমিতদা। ক্যামেরার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এগোতে যাবে শৌর্য, কাস্টিং ডিরেক্টর নিবেদিতা হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এল। বলল, ‘‘লোকেশনে চলো। লাইট দেখে নাও। মেয়েগুলোর মেকআপ হয়ে গিয়েছে।’’
‘‘ক্যান্ডিডেট ক’জন?’’ জানতে চায় শৌর্য।
‘‘ছ’টা মেয়ে অডিশনে সিলেক্ট হয়েছে, ধেড়িয়েছে দশজন… আলো থাকতে-থাকতে ছ’টা মেয়ের স্ন্যাপ নাও, তারপর আবার তাদের বাছতে বসতে হবে! যা চাপ যাচ্ছে না সকাল থেকে…’’ বলতে বলতে জিনস্-পরিহিত সামান্য ভারী চেহারার নিবেদিতা গেট পেরিয়ে গেল। শৌর্য মুখ তোলে আকাশের দিকে। আলোতে ময়েশ্চার নেই, ব্রাইট হবে ফোটো, লেন্সে ফিল্টার লাগাতে হবে। বাইকের সিটে ব্যাগ নামিয়ে ক্যামেরা বের করতে থাকে শৌর্য।
কাঁকুলিয়ার এই গলিতে শৌর্য আগেও শুট করেছে। এখানে অনেক বৈচিত্র্য, চালাঘরের বাড়ি, ছোটমন্দির, দুশো বছরের পুরনো ভেঙে পড়া একটা বাড়ি। যার সামনে অশ্বত্থ গাছ… চার নম্বর ক্যান্ডিডেট সাইকেল নিয়ে গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে, স্ন্যাপ নিচ্ছে শৌর্য, মেয়েটার সিলেক্টেড হওয়ার চান্স প্রচুর। গল্পের ক্যারেকটারের সঙ্গে চেহারাটা যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মেয়েটার এক্সপ্রেশন নিয়ে। নিবেদিতা যেমন ভাবে দাঁড়াতে বলছে, তাকাতে বলছে, সবই করছে মেয়েটা। শৌর্যর ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। নিবেদিতা কিন্তু ‘ওকে’ করে দিচ্ছে। ছ’টা স্ন্যাপ নেওয়া হয়ে গিয়েছে শৌর্যর, মুখে অসন্তুষ্টি। শৌর্যর অভিব্যক্তি পড়ে নিয়ে নিবেদিতা কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘‘এনি প্রবলেম? ঠিকঠাক যাচ্ছে না বলছ?’’
ঠোঁট উলটে শৌর্য বলে, ‘‘সামথিং মিসিং।’’
‘‘কী সেটা?’’ জানতে চাইল নিবেদিতা।
‘‘মেয়েটা আনমাইন্ডফুল হয়ে আছে, চোখের পাতা পড়ছে বেশি, অন্য কিছু ভাবতে-ভাবতে এক্সপ্রেশন দিচ্ছে… দাঁড়াও, একটু বুঝিয়ে বলি ওকে,’’ বলে মেয়েটার দিকে এগোয় শৌর্য। সামনে গিয়ে বলে, ‘‘কী ভাবছ? এত অন্যমনস্ক কেন?’’
‘‘কিছু ভাবছি না তো!’’ বলল মেয়েটা।
‘‘ক্যামেরার লেন্স কিন্তু তা বলছে না। সে তো শুধু তোমাকেই দেখছে। চারপাশের অন্য কিছু নয়। বুঝতে পারছি, তুমি শাড়ি পরে, চুল দু’ভাগ করে সামনে এনেও অন্য চরিত্র হতে পারোনি। তুমি আগের মেয়েটাই রয়ে গিয়েছ, যে এভাবে সাজে না। নিজেকে সম্পূর্ণ ভুলে যাও। নিজের নামটাও। কী নাম তোমার?’’
‘‘আরশি। আরশি সেনগুপ্ত।’’
‘‘নামটা আমি নিয়ে নিলাম!’’ বলে শূন্য হাত মুঠো করে টি-শার্টের পকেটে ঢোকায় শৌর্য। তারপর বলে, ‘‘তোমার নাম এখন রুম্পা। গ্রামের মেয়ে। একেবারে অজ-গাঁ নয়। এবার নিবেদিতা যেমন বলেছে, তেমন করে পোজ় দাও।’’
কথা শেষ করে আগের জায়গায় ফিরে যায় শৌর্য। ক্যামেরা চোখে তুলে দেখে মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসছে মেয়েটা। নিবেদিতা ওকে সিরিয়াস ভঙ্গিতে কিছু বোঝাচ্ছে। শৌর্য বুঝতে পারে, এবার ছবি ভাল হবে। মেয়েটা কিছু একটা নিয়ে চিন্তায় ছিল, মাথা থেকে নেমে গিয়েছে সেটা। নিবেদিতা বেরিয়ে গেল ফ্রেম থেকে। এখন অশ্বত্থর ডালপালার ফাঁক দিয়ে নেমে আসা রোদের মাঝে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে মেয়েটা, সে অবিকল ‘দখিন হাওয়া’ গল্পের রুম্পা।
সন্ধে নেমেছে সদ্য। ছ’জন মেয়ের ছবি তুলে ল্যাপটপে লোড করে দিয়েছে শৌর্য। যার মধ্যে চারজনকে বাদ দিয়ে দু’জনকে বাছল সুমিতদা। নিবেদিতাকে বলল, ‘‘বাকিদের চলে যেতে বল।’’
‘‘সে না হয় বললাম। কিন্তু আমাদের একজনকে দরকার। দু’জনকে থাকতে বলব কেন? একজনকে বেছে নাও, বাকি সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিই।’’
স্ক্রিনে দু’জনের ফোটো অলটারনেটিভলি দেখতে-দেখতে সুমিতদা নিবেদিতাকে বলল, ‘‘যা বললাম, সেটা আগে কর। তারপর আয়, বলছি কেন দু’জনকে বাছলাম।’’
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল নিবেদিতা। পাশের ঘরে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছে ছ’জন। সবাই অবশ্য প্রথম অডিশন দিচ্ছে না। কয়েকজনের স্মার্টনেস দেখে তেমনটাই মনে হচ্ছিল শৌর্যর। যে দু’জনের ছবি বেছেছে সুমিতদা, তার মধ্যে ওই মেয়েটা আছে, যাকে জ্ঞান দিতে হয়েছিল। তাকেই কেন সিলেক্ট করছে না সুমিতদা, কে জানে! কাস্টিং নিয়ে শৌর্যর নাক গলানো উচিত নয়। তার কাজ শেষ। লোকেশনের ছবিও দেখানো হয়ে গিয়েছে সুমিতদাকে। মন দিয়ে দেখেনি। আলগোছে বলল, ‘দারুণ! প্রোডিউসরের সঙ্গে বসে আর একবার দেখব।’
শৌর্যর এবার বাড়ি ফেরার পালা। প্রোডাকশন থেকে রোল আর কফি দিয়ে গিয়েছে, এটা শেষ করেই উঠবে।
ফিরে এল নিবেদিতা। বলল, ‘‘দু’জনকে রেখে দিলাম। দু’জনেই রেজ়াল্ট জানতে চাইছে তাড়াতাড়ি। সন্ধে হয়ে গেল। বাড়ি যাবে তো ওরা।’’
‘‘এই মেয়েটা তো সিলেক্টেড। অন্যটাকে নিয়েই সমস্যা! ল্যাপটপের স্ক্রিনে পরপর দু’জনের ছবি দেখিয়ে বলল সুমিতদা। যে মেয়েটাকে নিয়ে সমস্যা বলছে, সে-ই সিলেক্টেড হবে ভেবেছিল শৌর্য। তাই জিজ্ঞেস করে, ‘‘সমস্যাটা কী মেয়েটার? আমি তো ভাবলাম ওকেই পছন্দ হবে তোমার। ক্যারেকটারের সঙ্গে ভালই যায়।’’
‘‘না, যায় না। মেকআপ করেও মেয়েটার সফিসটিকেসি ঢাকা যাচ্ছে না। অন্য মেয়েটা কিন্তু পারফেক্ট।’’
নিবেদিতা বলল, ‘‘যে পারফেক্ট নয়, তাকে নিয়ে সমস্যাটা কী?’’
‘‘মেয়েটাকে আমি যেন কোথায় দেখেছি!’’ বলে রিভলভিং চেয়ারটায় পিঠ ছেড়ে শৌর্যদের দিকে ঘুরে বসল সুমিতদা। ল্যাপটপ রাখা টেবিল এখন পাশে। পা ছড়িয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে সুমিতদা বলল, ‘‘এত চেনা লাগছে। অথচ মনে করতে পারছি না। ডিমেনশিয়া হয়ে গেল নাকি? মনে পড়েও পড়ছে না, ব্যাপারটা বড় অস্বস্তিকর।’’
‘‘কখন বা কবে তোমার মনে পড়বে, তার উপর নির্ভর করে ওদের তো বসিয়ে রাখতে পারি না! কী বলতে হবে বলো?’’ জানতে চাইল নিবেদিতা। ছড়ানো পা নাচাতে-নাচাতে সুমিতদা বলল, ‘‘ওদের দু’জনকে বল কাল দুপুর নাগাদ আসতে। তখন ফাইনাল ডিসিশন বলা হবে। এখন বলে দিলে, যে রিজেক্টেড হল, আউট অব সাইট হয়ে যাবে। কাল অবধি ভাবি। মনে না পড়লে ওকেই জিজ্ঞেস করতে হবে। আর খচখচানি কাটানোর জন্য আজ রাতে দু’পাত্তর মাল বেশি খেতে হবে।’’
‘‘যা মনে করার কালকের মধ্যে কোরো… রিজেক্টেড মেয়েটার বাড়ি জলপাইগুড়ি, এখানে হয়তো কোনও আত্মীয়র বাড়িতে উঠেছে, নিশ্চয়ই বলে রেখেছে এক দু’রাত থাকবে… ওকে বেশি দিনের জন্য আটকে রাখলে মুশকিলে পড়ে যাবে বেচারি!’’ বলে নিবেদিতা আবার গেল পাশের ঘরে।
শৌর্য সুমিতদাকে বলল, ‘‘আমি তা হলে উঠি?’’
‘‘উঠবি? আচ্ছা তা হলে ওঠ!’’ বলার পর কী ভেবে আবার বলে সুমিতদা, ‘‘হ্যাঁরে, বাড়িটা ওরকম নতুন করে ফেলল! টিলার উপরের বাড়িটার তো কিছুই নেই। কী হবে এখন? ফোটো দেখে প্রোডিউসার যদি পিছিয়ে যায়!’’
কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে মগটা হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর রাখল শৌর্য। বলল, ‘‘আবার ওই অঞ্চলে যাও। নতুন বাড়ি দেখো।’’
‘‘তার সময়টা কোথায়? যতদিন শিমুল-পলাশ, ততদিন আশ। বসন্ত চলে গেলে প্রোডিউসরও রওনা দেবে। বলবে, সামনের বসন্তে আসবে। কিন্তু আমি জানি, আর আসবে না। এরা বসন্তের কোকিল নয়।’’
‘‘সে আমি আর কী করব বলো!’’ বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শৌর্য।
সুমিতদা অসহায় গলায় বলে, ‘‘কাল দুপুর নাগাদ একবার আয় না অফিসে। প্রোডিউসর আসবে। দু’জন মিলে মালটাকে নতুন বাড়ি আর গুঁড়িয়ে যাওয়া বাড়িই খাওয়াব। নিবেদিতাও থাকবে।’’
‘‘ঠিক আছে, প্রোডিউসার অন দ্য ওয়ে হলে ডেকে নিয়ো…’’ বলে ক্যামেরার ব্যাগ কাঁধে তোলে শৌর্য, ‘‘ও কে, চললাম তা হলে,’’ বলে দরজার দিকে এগোয়।
বাইরে এসে শৌর্য দেখে নিবেদিতা সিগারেট টানছে। একটু যেন ঘনঘন। তার মানে অস্থির হয়ে আছে মনটা। কাছে যায় শৌর্য, নিবেদিতা কাউন্টার এগিয়ে দেয়। সিগারেট কমই খায় শৌর্য। কোনও বন্ধু এভাবে এগিয়ে দিলে এড়ানো যায় না। নিবেদিতার সিগারেটে টান দিয়ে শৌর্য বলে, ‘‘কী ব্যাপার, টেনশনে আছ মনে হচ্ছে?’’
‘‘ধুর! সুমিতদার সঙ্গে আর কাজ করা যাবে না। দুটো মেয়েই জিজ্ঞেস করছে, ‘কাল শিয়োর জানতে পারব তো দিদি?’ কী বলি বলো তো? সুমিতদা হয়তো কালও বলবে ‘মনে পড়েনি।’ বাতিল হয়ে যাওয়া মেয়েটাকে মিছিমিছি আটকে রাখা হবে। মেয়েটার ব্যবহারটা ভারী মিষ্টি। কত কথা বলল আমার সঙ্গে। কোথায় থাকি, আমার কাজের ধরনটা কেমন, মেয়েটাকে পরে ‘না’ বলতে আমার খারাপই লাগবে। চান্স পাবে কি না, তা নিয়ে ঘুরিয়েও প্রশ্ন করেনি। বরং যে মেয়েটা সিলেক্টেড, বারবার জিজ্ঞেস করছিল, ‘হবে তো দিদি? একটু দেখবেন প্লিজ়!’ ’’
‘‘সিলেক্ট হওয়া মেয়েটা বোকা, তাই ওভাবে জানতে চাইছিল। অন্য মেয়েটা অনেক চালাক, গল্প করার ছলে তেল মারছিল তোমাকে। যাতে তোমার ভোট ওর দিকে যায়।’’
‘‘এতদিন এ লাইনে আছি, কোনটা তেল আর কোনটা ডিস্টিল ওয়াটার, ভাল করেই বুঝতে পারি। মেয়েটা তেল মারছে বলে মনে হয়নি।’’
হাতে থাকা সিগারেটের টুকরো ছুড়ে ফেলে শৌর্য বলল, ‘‘দ্যাখো, কী করবে। সুমিতদা তো আবার কাল আসতে বলল আমাকে। চেষ্টা করছি আসার। এখন বাই।’’
শৌর্য বাইকে গিয়ে বসল। সোজা বাড়ি ফিরবে। যথেষ্ট টায়ার্ড লাগছে। মাকেও একটু সঙ্গ দেওয়া হবে। মা প্রায়ই বলে, ‘‘রোববারটা অন্তত কোনও কাজ রাখিস না। অন্যদিন কতটুকু আর দেখা হয় তোর সঙ্গে! আমারও কলেজ থাকে।’’
কাঁকুলিয়া রোডের মুখে এসে দাঁড়াতে হল শৌর্যকে। মেন রোডে ট্রাফিকের ভিড়। একটু ফাঁকা না হলে এগোনো যাবে না। এপাশ-ওপাশ চোখ বোলাতে গিয়ে শৌর্যর দৃষ্টি স্থির হয় বাঁদিকের ফুটপাথে, বাতিল মেয়েটা না? এখনও দাঁড়িয়ে আছে। সেই কখন তো বেরিয়েছে সুমিতদার অফিস থেকে। মেয়েটাও এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কেমন যেন দিশেহারা ভাব। ওকে কি কারও নিতে আসার কথা ছিল? নিজেকে চেনানোর জন্য হেলমেট খোলে শৌর্য। মেয়েটার সঙ্গে চোখাচোখি হয়। শৌর্য হাতের ইশারায় জানতে চায়, ‘কী ব্যাপার! এখনও এখানে কেন?’
মেয়েটা শৌর্যর দিকে আঙুল তুলে কিছু একটা বোঝাতে চাইল। বুঝল না শৌর্য। হাত দেখিয়ে মেয়েটাকে অপেক্ষার ইঙ্গিত দিল। ফাঁকা হল মেন রোড। বাইক চালিয়ে বাঁদিকের মোড়ে ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়াল শৌর্য। মেয়েটা এগিয়ে এসেছে। পরনে এখন ওরিজিনাল ড্রেস, জিন্স, কুর্তা। কাঁধে ঝুলছে পার্স। শৌর্য জিজ্ঞেস করে, ‘‘কেউ নিতে আসবে?’’
মাথা নেড়ে ‘না’ বোঝাল মেয়েটা। শৌর্য বলে, ‘‘তা হলে এখানে দাঁড়িয়ে কেন?’’
‘‘আপনার জন্য।’’
মনের ভিতরে চমকায় শৌর্য। মেয়েটার মুখ দেখে ঠাট্টা মনে হচ্ছে না। চান্স পাবে কি না জানতে চাইছে কি? শৌর্য জিজ্ঞেস করল, ‘‘আমাকে কী জন্য দরকার?’’
‘‘আমার বাড়ি তো জলপাইগুড়িতে। এখানে হোটেলে উঠেছি। শুধু দিনের বেলার জন্য থাকতে দিয়েছে। রাতে দেবে না।’’
‘‘তা আমি কী করতে পারি? অন্য হোটেল দেখো।’’
‘‘আপনার চেনা কোনও হোটেল আছে কি?’’
‘‘এসব প্রোডাকশনের ছেলেদের বলতে হয়। তারা তো এতক্ষণে বেরিয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে। প্রবলেমটা আগে বললে না কেন?’’
‘‘কখন বলব? একটা ঘরে অতক্ষণ ধরে বসিয়ে রাখলেন। কাউকে বলার সুযোগ পেলাম কোথায়?’’
‘‘আমি বসিয়ে রাখিনি। অডিশন সিলেকশন প্রোডাকশন এসব টিমের কাজ। আমার কাজ শুধু ছবি তোলা। তা আমাকেই হোটেল খুঁজে দেওয়ার লোক বলে মনে হল তোমার?’’
‘‘তা ঠিক মনে হয়নি… জানি, নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে, কিন্তু হোটেলে উঠতে গেলে নিজের নামটা তো লাগবে! সেটা যে আপনার কাছেই রয়ে গিয়েছে!’’ বলল মেয়েটা এবং এক চিলতে না হেসে। একদম সিরিয়াস মুখে লেগপুলটা করল।
গ্রাম-মফস্সলের মেয়েরা হঠাৎই খুব স্মার্ট হয়ে উঠেছে। আজ যে মেয়েটা শৌর্যর বাইক চেপে ইন্টারভিউ দিতে এল, সে-ও ফাজলামিতে কিছু কম যায় না। শৌর্য টি-শার্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে শূন্য মুঠো বের করে এগিয়ে দিল মেয়েটার দিকে। বলল, ‘‘এই নাও তোমার নাম।’’
মেয়েটা নামটা নেওয়া এবং খুলে দেখার ভান করল। ভ্রূ কোঁচকানো মুখ তুলে বলল, ‘‘এমা, এটা কার নাম দিলেন! এটা তো আমার নয়। প্রচুর মেয়ের নাম পকেটে নিয়ে ঘোরেন দেখছি!’’
‘এ তো যন্তর মেয়ে’ কথাটা মনে-মনে আওড়াল শৌর্য। কপট গাম্ভীর্যে বলল, ‘‘তোমার নামটা কী? দেখি পকেটে আছে, না কি পড়ে গেল।’’
‘‘নামটা নেওয়ার সময় তো দেখেই নিলেন! ভুলে মেরে দিলেন এর মধ্যে!’’ বলে হাসতে লাগল মেয়েটি।
শৌর্য বলল, ‘‘অদ্ভুত মেয়ে! রাতে কোথায় থাকবে ঠিক নেই, উনি হাসছেন।’’
‘‘টেনশন কাটানোর জন্য একটু হাসাহাসি করে নিলাম আর কী। সত্যি, কী করি বলুন তো? আমি একা দেখে দুটো হোটেল রুম দেয়নি। এই হোটেলটা যদিও বা থাকতে দিল, সেটাও শুধু দিনের বেলাটুকুর জন্য। এতক্ষণে বোধহয় রুম থেকে আমার লাগেজ বের করে দিয়েছে। দু’বার ফোন করেছিল সন্ধে নামতেই। ধরিনি। রেজিস্টারে ফোন নাম্বারটা দেওয়াই ভুল হয়েছে।’’
‘‘না লিখলে, লিখিয়ে নিত। তা হোটেলটা কোথায়? কী নাম?’’ জিজ্ঞেস করে শৌর্য।
আরশি বলল, ‘‘হোটেলেটার নাম ‘পার্ক সেন্টার’। এখান থেকে কাছেই। কোন রাস্তা ধরে এলাম, বুঝে উঠতে পারছি না।’’
শৌর্য বুঝল, এখনই বাড়ি ফেরা হবে না। মেয়েটার একটা গতি করতে হবে। আরশিকে বলল, ‘‘উঠে এসো বাইকে। দেখি, লোকের থেকে খোঁজ নিই হোটেলটার।’’
ইন্টারভিউ দিতে আসা মেয়েটার হেলমেট ঝুলছে বাইকে, সেটাই এগিয়ে দেয় আরশিকে। অজান্তেই একজনের উপকার করে ফেলল গ্রামের মেয়েটা। ভদ্রতা করে ওর নামটা জানা উচিত ছিল। সৌজন্য ব্যাপারটা শৌর্যর বেশ কম।
একজনকে জিজ্ঞেস করেই ‘পার্ক সেন্টার’-এর সামনে পৌঁছে গেল শৌর্য। হোটেলটা গোলপার্ক থেকে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে ঢুকেই। বাইক থেকে নেমে আরশি বলে উঠল, ‘‘এ মা, এত সোজা! অথচ রাস্তাটা আমি খেয়াল করতে পারছিলাম না!’’
বাইক স্ট্যান্ড করে শৌর্য জিজ্ঞেস করে, ‘‘গোলপার্কে কি প্রথমবার?’’
‘‘কলকাতাতেই ফার্স্ট টাইম।’’
একটু অবাক হয় শৌর্য, জলপাইগুড়ি আর কতদূর! সচ্ছল বাড়ির মেয়ে, কলকাতায় আসেনি!
কাচের দরজা ঠেলে রিসেপশনে পৌঁছল শৌর্যরা। রিসেপশনিস্ট লোকটা শৌর্যর দিকে ভাল করে তাকালই না। আরশিকে বলল, ‘‘লাগেজ বের করে নিন। রুম অন্য পার্টিকে দিয়েছি। এখনই আসবে তারা।’’
‘‘সে কী, আপনি এখনও বের করে দেননি। আমি ভাবলাম এসে দেখব কাউন্টারের বাইরে ফেলে রেখেছেন লাগেজ!’’ বলল আরশি।
লোকটা বলল, ‘‘এখন এরকম বলছেন। তখন আবার বলতেন, ‘আমার লাগেজে হাত দিলেন কেন? অমুক জিনিসটা নেই দেখছি!’ ’’
‘‘আপনার কি মনে হয়, মেয়েটা এতটাই খারাপ? মিথ্যে অপবাদ দেবে? গতকাল পর্যন্ত একে তো আপনি চিনতেন না, কী করে ধরে নিচ্ছেন মেয়েটা সুবিধের নয়?’’ রিসেপশন কাউন্টারের উপর দু’হাত রেখে জানতে চাইল শৌর্য।
রিসেপশনিস্ট লোকটা অবাক হয়ে বলল, ‘‘আমি কোথায় বললাম উনি সুবিধের নন। যা বলার তো আপনিই বলছেন।’’
‘‘ও যদি ভাল মেয়ে হয়, তা হলে রাতে থাকতে দিচ্ছেন না কেন?’’
‘‘কেন দিতে পারছি না, সেটা তো ওঁকে বলেছি। উনি রাজিও হয়েছেন শুধু দিনের বেলা থাকার কন্ডিশনে। এরপর আর কী কথা থাকতে পারে!’’
‘‘কেন থাকতে দিতে পারছেন না, আমাকে বলুন। ও উপায় না দেখে তখন রাজি হয়ে গিয়েছিল।’’
‘‘আপনাকে বলতে আমি বাধ্য নই! আপনি আমাকে জোর করতে পারেন না,’’ বলার পর রিসেপশনিস্ট আরশিকে বলল, ‘‘প্লিজ়, রুমে গিয়ে লাগেজ বের করে নিন। লোকজন সঙ্গে এনে কোনও লাভ হবে না।’’
আরশি বুঝতে পারছে না কী করবে! একবার শৌর্যর দিকে তাকাচ্ছে পরের বার রিসেপশনের লোকটার দিকে। এক-এক করে সার্ভিস বয়রা এসে দাঁড়াচ্ছ কাউন্টারের পিছনে। কাউকে ডায়াল করে ফোন কানে নিয়েছে শৌর্য। বলে উঠল, ‘‘দাঁড়াও বলছি…’’ তারপর বেরিয়ে গেল কাচের দরজাটা ঠেলে। আরশি লক্ষ রাখে শৌর্যর গতিবিধি, হাল ছেড়ে দিয়ে যদি চলে যায় ফোটোগ্রাফার, তা হলেই কেলো!
শৌর্য ফোনে সুমিতদাকে ধরেছে। বলছে, ‘‘অডিশনের যে মেয়েটাকে চেনা-চেনা লাগছে তোমার, থাকে জলপাইগুড়ি। দিনের বেলা থাকার শর্তে হোটেল পেয়েছিল। রাতে থাকবে কোথায়? রিসেপশনে রিকোয়েস্ট করছি, রাজি হচ্ছে না।’’
‘‘তোরও কি মেয়েটাকে চেনা লেগেছ? তাই ওকে হেল্প করছিস?’’ ফোনের ওপার থেকে সত্যিকারের কৌতূহলে জানতে চাইল সুমিতদা।
শৌর্য বলল, ‘‘একটুও চেনা লাগেনি। মেয়েটাই আমার হেল্প চেয়েছে। আর মনে রেখো, সে এসেছে তোমার সিনেমার অডিশন দিতে। দায়িত্ব তোমার, আমার নয়।’’
‘‘ও কে, বুঝেছি। হোটেলের লোকেশনটা বল…’’
‘‘সাদার্ন অ্যাভিনিউ। হোটেলের নাম ‘পার্ক সেন্টার’।’’
‘‘ঠিক আছে, ব্যবস্থা করে দিচ্ছি… মেয়েটাকে চিন্তা করতে বারণ কর,’’ বলে ফোন কাটল সুমিতদা। শৌর্য জানে সুমিতদা পারবে ব্যবস্থা করতে, কানেকশন অনেক উপর অবধি। কাচের দরজা ঠেলে রিসেপশনে এল শৌর্য। লোকটাকে বলল, ‘‘আপনি কিন্তু সমস্যায় পড়ে যাবেন। ফোন আসছে। নিরীহ একটা মেয়েকে কোথায় হেল্প করবেন, তা নয়। হ্যারাস করছেন।’’
আরশি খেয়াল করে শৌর্যর কথায় ঘাবড়েছে লোকটা, ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে মুখ। কিন্তু ফোন সত্যি আসবে তো? ফাঁকা বুলি দিচ্ছে না তো শৌর্য? ছেলেটাকে একদিন দেখে, এত ভরসা করা কি ঠিক হচ্ছে?… ভাবনা শেষ হতে না হতেই কাউন্টারে রাখা হোটেলের ফোন বেজে উঠল। সামান্য চমকে ওঠে আরশি। রিসেপশনিস্ট তুলে নিল রিসিভার। ‘‘হ্যালো’’ বলার পর থেকে বিশেষ কিছু বলল না, ‘‘হ্যাঁ স্যার, ঠিক আছে স্যার, ওকে…’’ বলে নামিয়ে রাখল রিসিভার। শৌর্য জিজ্ঞেস করল, ‘‘এবার ঠিক আছে?’’
‘‘থানার সঙ্গে আপনার এত চেনাজানা আগে বললেই পারতেন! খামোকা ঝগড়া করে ফেললাম!’’
‘কেমন দিলাম’ টাইপের হাসি হাসছে শৌর্য। যদিও থানা থেকে ফোন আসাটা তেমন পছন্দ হয়নি, পুলিশের ডিজি বা কোনও মন্ত্রীর ফোন এলে আরও র্যালা নেওয়া যেত। রিসেপশনিস্ট আরশিকে বলছে, ‘‘যান ম্যাডাম, রুমে যান। আপনারা দু’জনেই যেতে পারেন। চা পাঠিয়ে দিচ্ছি…’’
‘‘কোনও দরকার নেই,’’ প্রস্তাব নাকচ করে শৌর্য আরশিকে বলল, ‘‘তুমি গিয়ে রেস্ট নাও। আজ তো অনেক চাপ গিয়েছে। কাল দুপুরেও আবার যেতে হবে রেজ়াল্ট জানতে, ক’টায় আসতে বলেছে নিবেদিতা?’’
‘‘দুপুর দুটো নাগাদ। আপনি থাকবেন?’’
‘‘ঠিক নেই, এখন চলি… গুডনাইট,’’ বলে বাইরেরর দরজার দিকে ঘুরতে যাবে শৌর্য, দাঁড়িয়ে পড়ে। পকেট থেকে পার্স বার করে, ভিজ়িটিং কার্ড তুলে এগিয়ে দেয় আরশির দিকে। বলে, ‘‘এতে ফোন নাম্বার আছে। দরকারে ফোন কোরো।’’
ঘাড় হেলিয়ে কার্ডটা নেয় আরশি। শৌর্যর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে-মনে বলে, ‘এর নির্ঘাত স্টেডি গার্লফ্রেন্ড আছে এবং তার প্রতি এতটাই কমিটেড, সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে ফাঁকা ঘরে চা খাওয়ার সুযোগটাও নিল না!’
রুমে যাওয়ার জন্যে ঘুরে গিয়ে পা বাড়াল আরশি, রিসেপশনিস্ট লোকটা মধুমাখানো সুরে বলল, ‘‘দিদিভাই, আপনার রুমের চাবি। রেখে গিয়েছিলেন।’’
কাউন্টার থেকে আরশি তুলে নেয় লোকটার রাখা চাবি। পুলিশের একটা ফোনে লোকটা ‘ম্যাডাম’ থেকে ‘দিদিভাই’ সম্বোধনে চলে এসেছে, কত আন্তরিক ব্যবহার!