সেয়ানে সেয়ানে
এবার দারোগার কথা।
গৌর দারোগা নিছক এক রঙা মানুষ নয়। ধপধপে সাদা বা কুচকুচে কালো রঙ দিয়ে তার চরিত্র আঁকা যাবেনা নিছক সত্যের খাতিরেই।
সচরাচর মফঃস্বলের মাঝবয়েসি দারোগাদের মত গৌরহালদারের পেটমোটা চেহারা নয়, বেশ লম্বা বলশালী শরীর, গায়ের রঙ শ্যামলা, মুখটা অনেকটা মঙ্গোলীয় ধরনের, চোখ ছোট এবং কম কথা বলা স্বভাব। থানার বাইরে বেরোতে না হলে তিনি ধুতির ওপর হাফশার্ট পরে থাকেন।
কেউ বলে, ওরে বাপ রে, এমন চশমখোর লোক আর হয় না। সেই যে যতীন ঘোষাল দারোগা ছিল কাঁচারক্তখেকো দেবতা, বছর দশেক আগে যার ভয়ে এ তল্লাটের মানুষ ভয়ে কাঁপত, সবাই ভেবেছিল এমন নিষ্ঠুর মানুষ আর হয় না। এই গৌর হালদার যেন তাকেও ছাড়িয়ে যেতে চায়। আবার কেউ বলে, গৌর দারোগা যেন ঝুনো ডাব, বাইরে শক্ত কিন্তু ভেতরে দয়া-মায়া আছে। কেউ বলে, পয়সা চেনে বটে গৌর দারোগা। পিঁপড়ের পেছন টিপে মধু বার করতে জানে। আবার কেউ বলে, শুধুহাতে থানায় গেলাম, বড়বাবুকথা শুনলেন, ঠারেঠোরেও পয়সা চাইলেন না। অথচ কাজ হাসিল হয়ে গেল। এমনটি আগে কখনও দেখিওনি, শুনিওনি।
একই মানুষ সম্পর্কে এমন পরস্পর-বিরোধী কথা শোনা যায় কী করে? এ কোন রহস্য?
রহস্যটি আসলে সরল।
এই বাদা অঞ্চলে মোটমাট চার রকমের মানুষ। বন কেটে বসতির সময় এক দল এসেছে উড়িষ্যা থেকে, একদল মেদিনীপুর থেকে। পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা আগেও এসেছে, পরেও এসেছে, আর এসেছে মুসলমান। এই চার রকমের মানুষ এত দিনেও এক সঙ্গে মিশে যায়নি, এদের আলাদা পাড়া ও আলাদা অস্তিত্ব আছে। উড়িষ্যার লোকেরা সবাই এখন খাঁটি বাংলায় কথা বললেও নিজস্ব সামাজিক পরিচয় মুছে ফেলেনি। আর মুসলমানদের সবাইকেই এখানে অন্যরা বলে মোল্লা।
গৌরহালদারের পক্ষপাতিত্ব আছে বিশেষ একসম্প্রদায়ের প্রতি। ইনিও পার্টিশানের পরে আসা রিফিউজি। যাদবপুরের কলোনিতে জলকাদা, নোংরা, মশা-মাছি, লাঞ্ছনা, অপমান ও দারিদ্রের মধ্যে কেটেছে শৈশব ও কৈশোর। তারপর ভাগ্যচক্রে পুলিশে কাজ পেয়েছেন। এবার তিনি প্রতিশোধ নিতে চান। তিনি যে শুধু ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ঘোর সাপোর্টার, তাই নন। পশ্চিমবঙ্গীয় হিন্দুদের তিনি অন্তর থেকে ঘৃণা করেন। যাদবপুরে থাকার সময় ছাত্রাবস্থায় খেলার মাঠে তিনি মোহনবাগানের দর্শক গ্যালারির দিকে নিয়মিত ইট মারতেন, হাত-বোমাও ছুঁড়েছেন কয়েক বার।
গৌর হালদার শুধু বাঙাল নন। বাঙালদের মধ্যেও সূক্ষ্ম ভেদাভেদ মানেন তিনি। তাঁর জন্ম টাঙ্গাইলে, তিনি মনে করেন টাঙ্গাইল, মৈমনসিং, ঢাকা, কুমিল্লা, রাজশাহি নিয়ে যে একটি বৃত্ত, এখানকার মানুষই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি। ফরিদপুর-যশোর-খুলনার বাঙালরাও ঠিক বাঙাল হিসেবে ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কারণ পশ্চিমবঙ্গের সংস্পর্শে আগে থেকেই ওদের খানিকটা চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে। তবে হ্যাঁ, নিছক বাঙাল নামের জন্যই ওরা খানিকটা সহানুভূতি পাবার যোগ্য।
ওড়িয়া, মুসলমান এবং কিছু কিছু সাঁওতালও যে আছে বাদা অঞ্চলে, তাদের প্রতি গৌরহালদারের কোনও বিদ্বেষ নেই, তারা বিপদে পড়লে তিনি সাধ্য মতো সাহায্য করেন। তাঁর সমস্ত রাগ শুধু পশ্চিমবঙ্গীয় হিন্দুদের ওপর। বিশেষত কলকাতা শহর থেকে যেসব জমির মালিক বা ভেড়ির মালিক মাঝে মাঝে এখানে আসে টাকা নিয়ে যাবার জন্য, তাদের কোনওক্রমে বাগে পেলে গৌর হালদার একেবারে ছিঁড়ে খুঁড়ে খেয়ে ফেলেন। অনেক সময় আইনের পরোয়া না করে বে-আইনি ভাবেও তাদের নির্যাতন বা হয়রান করেন কিংবা অর্থদণ্ড ঘটান। টাঙ্গাইলের ছোট্ট ছিমছাম বাড়ি, পুকুর, ধান জমি সব ছেড়ে অসহায় ভাবে চলে এসেছেন এক সময়, তবু পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আতিথেয়তার হাত বাড়িয়ে দেয়নি। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-উপহাস করেছে, যাদবপুরের জলাভূমিতে শুয়োরের খোঁয়াড়ের মতো ঘরে থাকতে দিয়েছে। সে-রাগ তিনি কখনও ভুলতে পারেন না। অর্থাৎ তিনি প্রায় একটি গুপ্ত-উন্মাদ।
মরিচঝাঁপির দ্বীপ থেকে যখন বাঙালখেদা অভিযান হয়, সেবার শোকে-দুঃখে রাগে-অভিমানে গৌর হালদার তিন মাসের ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে অসহায় ভাবে হাত কামড়েছেন। তারপর আবার কাজে যোগ দিয়েই তিনি অ-বাঙাল হিন্দুদের ওপর বাড়িয়ে দিয়েছেন অত্যচারের মাত্রা। অবশ্য, এসবই গৌর হালদারের মনে মনে। বাইবে কিছু প্রকাশ করেন না। গৌরহালদারের ছেলে-মেয়েরা, যারা জীবনে কখনও পূর্ব বাংলায় যায়নি, তারাও যদি বাড়িতে কখনও বাঙালভাষা না বলে ঘটি ভাষায় কথা বলে ফেলে, অমনি গৌর হালদার কানচাপাটি বিরাশি শিকা থাবড়া মারেন তাদের। বাইরে যত ইচ্ছে ঘটিভাষা বলুক, বাড়িতে চলবেনা।
নাজনেখালির বাঘে-খাওয়া মনোরঞ্জনের বৃত্তান্ত ইতিমধ্যেই কানে এসেছে গৌর হালদারের। জয়মণিপুবে সব ব্যাপারে নাক গলানো ইস্কুল মাস্টারনিটির হাতে লেখা একটি দরখাস্তও তার কাছে এসেছে, তিনি চুপচাপ চেপে বসে আছেন। ওরা ভেবেছে একখানা কাগজ পাঠিয়ে দিলেই হয়ে যাবে। গৌরহালদারের সঙ্গে একটি বার দেখা করারও দরকার নেই, না? আচ্ছা?
নিতাইচাঁদ গৌর হালদারের কাছে এসে সুবিধে করতে পারল না। দারোগাবাবুর মন ভেজানোর জন্য সে অনেক রকম কাঁদুনি গাইল। সবকথা শুনে ডায়েরি না লিখেই হাঁকিয়ে দিলেন নিতাইচাঁদকে। ছেলের বউকে শ্বশুর বাড়ির লোকেরা নিজেদের কাছে রাখতে চায়, এতে আবার নারী-হরণ কী? বেয়াইতে বেয়াইতে কোঁদল, এর মধ্যে পুলিশ নাক গলাতে যাবে কেন? নৌকো ডুবিয়ে দিয়েছে? তা সে নৌকোর মাঝি কোথায়? তাকে ডাকো, কেস লেখাতে হয় সে লেখাবে।
ভাড়া নৌকোর মাঝির বয়েই গেছে থানায় আসতে। সুখে থাকতে সাধ করে কে ভূতের কিল খেতে যাবে।
নিতাইচাঁদ আরও অনেক ভাবে ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করল বাসনাকে। দু-চারটে লোক লাগাল। যদি হাটবারে ভিড়ে গণ্ডগোলে কোনও রকমে ফুসলে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু নাজনেখালির জয়হিন্দক্লাবের সদস্যদের কড়া পাহারায় তা হবার উপায় নেই। থানাতে ঘোরাঘুরি করেও কোনও সুরাহা হল না। শেষ পর্যন্ত নিতাইচাহাল ছেড়ে দিল।
এরপর এক দিন এল সাধুচরণ। পরিমল মাস্টার পাঠিয়েছে। এই সাধুচরণকে গৌর হালদারই জেলে পাঠিয়েছিলেন। তার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে গৌর হালদার বললেন, কী রে, আবার জেলের ভাত খাবার শখ হয়েছে বুঝি? ধান কাটার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা কর, আবার তোকে পাঠাব।
সাধুচরণ বলল, মাস্টারমশাই বললেন…।
তোদের মাস্টারমশাই কোন লাট সাহেব? নিজে আসতে পারে না?
বাসনার সই পাবার পর ইনসিওরেন্সের ব্যবস্থাটা অনেকটা পাকা হয়ে গেছে। চিঠি লেখালেখি হয়েছে সরকারের সঙ্গে। এখন দরকার শুধু থানার রিপোর্ট।
অতএব পরিমল মাস্টারকেই সশরীরে আসতে হল এক দিন।
গৌর হালদার সসম্ৰমে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন, আসুন, মাস্টারমশাই আসুন। ওরে, একটা চেয়ার দে। চা খাবেন তো? নাকি ডাব খাবেন? আমাদের থানার কম্পাউন্ডে বড় বড় পাঁচটা নারকোল গাছ।
শুধু মাস্টারমশাই তো নন, সোস্যাল ওয়ার্কার, অনেক টাকার প্রজেক্ট চালাচ্ছেন, এঁদের একটু খাতির দেখাতেই হয়। দু-চারজন মন্ত্রী-টন্ত্রীর সঙ্গে চেনা থাকে এঁদের। হুটহাট করে হোম সেক্রেটারি কিংবা চিফমিনিস্টারের পিএ বেড়াতে আসেন এঁদের কাছে।
গৌর হালদার নিজে একটা চেয়ারের ধুলো ঝেড়ে বসতে দিলেন পরিমল মাস্টারকে। একই সঙ্গে চা আনাবার জন্য এবং ডাব পাড়বার জন্য হাঁকডাক করতে লাগলেন জমাদারদের। বিশিষ্ট অতিথিরসম্মান জানাতে গৌর হালদারের যেন কোনও কার্পণ্য নেই।
টেবিলের দু’পাশে দু’জন মুখোমুখি বসবার পর গৌর হালদার তার ছোট ছোট চোখ দু’টির তীব্র দৃষ্টি স্থাপন করলেন। এই পরিমল মাস্টারের মতো লোকরাও তার এক নম্বরের শত্রু। শহরের লোক। নেহাত ভাগ্যগুণে পশ্চিমবঙ্গে জন্মেছে বলেই সারা জীবন পাকাবাড়িতে থেকেছে, ছেলেবেলায় ঠিকঠাক শিক্ষা পেয়েছে, হাত-খরচের পয়সায় সিনেমা-থিয়েটার দেখেছে, পার্কে কিংবা গড়ের মাঠে প্রেম করেছে মার্জিত, শিক্ষিত পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে, আর কোনও না-কোনও দিন মুখ বেঁকিয়ে বলেছে নিশ্চয়ই, এই রিফিউজিগুলোর জন্যই এমন সুন্দর কলকাতা শহরটা দেখতে দেখতে একেবারে যা-তা হয়ে গেল!
অথচ গৌরহালদারও তো প্রায় একইরকম পরিবারের সন্তান, তাদেরও পাকা বাড়ি ছিল, গোয়ালে গরু, পুকুরে মাছ আর জমিতে ধান ছিল। সেসব কিছু থেকে বিতাড়িত হয়ে এসে থাকতে হয়েছে শহরতলির বস্তিতে। ক্যাশ ডোলের জন্য সরকারি অফিসারদের পা ধরতে হয়েছে, ঘুষ দিতে হয়েছে, এমন ইস্কুলে পড়তে হয়েছে, যেখানে পড়াশুনো কিছু হয় না, কলেজে পরীক্ষার সময় ফি জোগাড় করতে না পেরে ভিক্ষে করতে হয়েছে বড়লোকদের কাছে, অভাবের তাড়নায় বাড়ির একটা মেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে বেশ্যা হয়েছে। এসব কার দোষে?
তা গৌরবাবু, কেমন আছেন? ভাল আছেন তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার মাঝে খুব জ্বর হয়েছিল শুনলাম।
সেখবরও পেয়েছেন! আপনারা পুলিশের লোক, সব খবর রাখেন।
আপনি বিখ্যাত লোক, আপনার সব খবর এ তল্লাটে ছড়িয়ে পড়ে। আপনার ছেলে ডাক্তারিতে ভর্তি হয়েছে?
এখনও সিলেকশান হয়নি। তা গৌরবাবু, এসেছিলুম একটা বিশেষ কাজে।
কাজ ছাড়া আর কেন আসবেন। আমাদের যত চোরাছ্যাঁচোড় নিয়ে কারবার, আপনাদের মতো মানী লোকের পায়ের ধুলো তো সহজে পড়ে না। আপনাদের ওখানে অ্যানুয়াল ফাংশান কবে হচ্ছে এবারে?
সামনের মাসে। আপনাদের যেতে হবে কিন্তু।
যাব, নিশ্চয়ই যাব।
আপনার কাছে এসেছিলুম একটা দরকারে একটা ক্লেইম কেসের ব্যাপারে।
বলুন! আপনি নিজে এলেন কেন, লোক পাঠালেই হত।
নাজনেখালির মনোরঞ্জন খাঁড়া নামে একটি ছেলে…।
গৌর হালদার উঠে গিয়ে পাশের টেবিলে খোঁজাখুঁজি করে একটা ফাইল নিয়ে এলেন, সেটা খুলে মনোযোগ দিয়ে পড়বার ভান করলেন, যেন তিনি কিছুই জানেন না।
একবার মুখ তুলে বললেন, নিন, চা খান, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। ডাবের জল আসছে। তারপর একটু বাদে তিনি আবার বললেন, হ্যাঁ, আপনার স্ত্রীর পাঠানো একটা দরখাস্ত রয়েছে দেখছি।
ফরচুনেটলি, বুঝলেন গৌরবাবু, ওদের নামে গ্রুপ ইনসিওরেন্স করানো ছিল, ওর বাড়ির লোক…।
বাঃ, তবে তো ভালই।
সরকারও এই সব কেসে কিছু টাকা দেবে বলে ঘোষণা করেছে।
হ্যাঁ, আমার কাছে সাকুলার এসেছে।
এখন আপনার কাছ থেকে একটা রিপোর্ট পেলেই…।
কোন ফরেস্ট গিয়েছিল বললেন?
তিন নম্বর ব্লকে।
আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন?
দুজনে চোখাচোখি হল। বুদ্ধির লড়াই এবার আসন্ন।
পরিমল মাস্টার জানে, এক সঙ্গে অনেকগুলো কাজে হাত দিলে কোনওটাই ঠিক মতো হয় না। স্থানীয় ওসি যদি ঘুষখোর হয়, ফরেস্টবাবু যদি হয় অত্যাচারী, কোনও ব্যবসায়ী হয় অসাধু, এদের সবাইকে সরিয়ে দেওয়া কিংবা সব অভিযোগের প্রতিকার করার সাধ্য তার নেই। মাত্র কাছাকাছি দশখানা গ্রাম নিয়ে তাদের প্রজেক্ট। ভূমিহীন কিংবা সামান্য জমির মালিক চাষিদের স্বাবলম্বী করে তোলা এবং তাদের অধিকারবোধ সম্বন্ধে সচেতন করাই আপাতত তার কাজ। এইটুকু হলেই যথেষ্ট। এইটুকু নয়, এটাই বিরাট ব্যাপার।
ওসি গৌর হালদারের ভাল আর মন্দ, দু’রকম ব্যবহারের কথাই শুনেছে পরিমল। লোকটির চরিত্রে বৈপরীত্যের ব্যাপারটা সে বুঝেছে, যদিও আসল কারণটা জানে না। এবং এ লোকটিকে সে ঘাঁটাতেও চায়নি, তার কাজে বাধা না দিলেই হল।
ফরেস্টের জয়নন্দনবাবু ঘুরে এসে রিপোর্ট দিয়েছেন।
কোথায় ঘুরে এসেছেন? সে রিপোর্টের কোনও কপি তো আমি পাইনি?
উনি তিন নম্বর ব্লকে গিয়েছিলেন। রাইটার্স বিল্ডিংসে নোট পাঠিয়েছেন শুনেছি।
রাইটার্স বিল্ডিংস? ও? তিনি তিন নম্বর ব্লক ঘরে কী দেখলেন? সেখানে বাঘ আছে, না নেই? সেখানে বাঘের কোনও প্রমাণ পেয়েছেন?
না, বাঘের কোনও প্রমাণ পাননি। তারপর ক’টা জোয়ার ভাটা গেছে, বৃষ্টিও পড়েছে।
জয়নন্দনবাবু তিন নম্বর ব্লকে বাঘের কোনও প্রমাণ দেখতে পেলেন না, পাবার কথাও নয়। সেখানে বাঘ কেন, একটা শেয়ালও নেই, আর সেখানে একটা তাগড়া লোক বাঘের পেটে চলে গেল?
দয়াপুরে যে বাঘ এসেছিল, কোনও দিন কি কেউ ভেবেছে যে দয়াপুরে বাঘ আসতে পারে?
না, কেউ ভাবেনি। যেখানে বাঘ নেই, সেখানে বাঘ এসেছে শুনলেই লোকে বিশ্বাস করবে কেন? তবে দয়াপুরের বাঘটিকে অনেক লোক চোখে দেখেছে, একটি ছোট মেয়েকে বাঘটা মেরেছে, আমি গিয়ে সেই মেয়েটির লাশ দেখেছি, তারপর বিশ্বাস করেছি।
ওখানেও অনেকে দেখেছে।
আপনি নিজে লাশ দেখেছেন?
না।
জয়নন্দন ঘোষাল বা অন্য কেউ সে লাশ দেখেছে?
তা ঠিক জানি না। বোধহয় লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
লাশটা কোথায় গেল? আমি তো যত দূর জানি, বাঘ যাকে ধরে, তার সবটা খায় না, দেহের বিশেষ বিশেষ জায়গার মাংস খেয়ে চলে যায়। লোকটার জামাকাপড়ই-বা গেল কোথায়?
গেঞ্জিটা পাওয়া গেছে।
বটে? শুধু গেঞ্জি?
তাই তো শুনেছি।
সেটা ফরেনসিক টেস্টের জন্য পাঠাতে হবে না? আমি তো দেখিনি সে গেঞ্জি।
তা হলে গেঞ্জিটা চেয়ে পাঠাতে হয়। আবার অনেক দেরি হয়ে যাবে।
দেরি? হ্যাঁ, তা দেরি তো হবে। মনোরঞ্জন খাঁড়ার বাড়িতে কে কে আছে? তার বউ আছে না?
হ্যাঁ, একেবারে কচি মেয়ে, সবে মাত্র বিয়ে হয়েছে।
তাকে আনা হয়নি?
তাকে কি থানায় আনার খুব দরকার? এখন শোকের সময়।
ছেলেটার বাপ কোথায়? সে-ও আসেনি। শুধু আপনি এসেছেন তদ্বির করতে? বুঝলাম।
আপনার রিপোর্টের ওপরই সব নির্ভর করছে। আপনি ফেভারেবল রিপোর্ট দিলে বিধবা মেয়েটা, ওই ছেলেটোর বাপ-মা টাকা পেতে পারে।
অর্থাৎ আর বুদ্ধির খেলা নয়, এবার হৃদয়ের কাছে আবেদন।
একটা সিগারেট টানার জন্য মুখ শুল শুল করছে পরিমলমাস্টারের। চারদিন একটাও সিগারেট খায়নি, তবু নেশাটা কিছুতে ছাড়ে না। এই রকম সময় খুব বেশি প্রয়োজন হয়।
গৌরহালদার বিড়ি-সিগারেট কিছু খান না। পাশের টেবিলে সাব-ইন্সপেকটর অবিনাশ ফুঁক ফুঁক করে একটা সিগারেট টানছে। সেই ধোঁয়াতেই আরও আনচান করছে পরিমল মাস্টারের মন। অথচ মুখ ফুটে চাওয়াও যায় না। অবিনাশের সামনের চেয়ারে বসে আছে দুটি বাইরের ছোকরা। ওরা বন বাণী নামে চার পৃষ্ঠার একটি নিউজ প্রিন্টে ছাপা পত্রিকা বার করে। কান খাড়া করে ওরা শুনছে সব কথা।
ঘটনাটা ঘটল কবে যেন, আট তারিখে? আর আমার কাছে একখানা শুধু দরখাস্ত পৌঁছল সতেরো তারিখে। অথচ এর মধ্যে থানায় একটা রিপোর্ট নয়, কিছু না। আমাকে সঙ্গে সঙ্গে খবর দিলে আমি সরেজমিনে দেখে আসতে পারতাম না?
সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে পরিমল মাস্টার এবার বিনীত ভাবে বলল, সত্যিই, আপনাকে আরও অনেক আগেই খবর দেওয়া উচিত ছিল। এটা ভুল হয়ে গেছে খুবই, আর একটা ব্যাপার হল কি জানেন, আমিও তখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলুম।
গৌর হালদার আবার চোখ কুচকোলেন। অর্থাৎ পরিমল মাস্টার বলতে চায়, ওর অসুখ না থাকলেই ওসব ব্যবস্থা ঠিকঠাক করে দিত। সব দায়িত্ব ওর, ও একাই সব গরিবদের মহান মুক্তিদাতা, কত দরদ! মরিচঝাঁপির অসহায় লোকগুলোর ঘর জ্বালিয়ে যখন মেরে তাড়ানো হল, তখন এই দরদ কোথায় ছিল পরিমলমাস্টারের? এরা শুধু নিজের লোকদের স্বার্থ দেখে।
আচ্ছা ধরুন মাস্টারমশাই, কোনও লোক যদি বলে, সে মনোরঞ্জন খাঁড়াকে বসিরহাট বাজারে দেখেছে।
একটু অন্য মনস্ক হয়ে গিয়েছিল পরিমল, চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, কী বললেন?
ধরুন, কেউ যদি বলে ওই ছেলেটাকে কেউ বসিরহাট বাজারে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে, তা হলে কী হবে? জঙ্গলে যাবার নাম করে কেউ যদি কিছু দিনের জন্য অন্য কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে, আর তার স্যাঙাতরা রটিয়ে দেয় যে তাকে বাঘে নিয়ে গেছে? আমি লাশ দেখলাম না, কিছুনা, টাইগার-ভিকটিম বলে রিপোর্ট দিয়ে দিলাম, তারপর সে লোক সত্যি না মরলে আমার চাকরি থাকবে?
পরিমল মাস্টার স্তম্ভিত ভাবে বলল, তা কখনও হয়?
বন-বাণী পত্রিকার সম্পাদকদ্বয় গৌর হালদারের এই শেষের যুক্তিটা লুফে নিল। অবিকল সেই কথাগুলিই ছাপা হল তাদের কাগজে। লোকে বলাবলি করতে লাগল, মনোরঞ্জন খাঁড়াকে নাকি বসিরহাট বাজারে দেখা গেছে? কে দেখেছে? দেখেছে নিশ্চয়ই কেউ, নইলে দারোগাবাবু ও কথা বলবেন কেন?
থানার রিপোর্ট না পেয়ে ইনসিওরেন্স দফতর বেগডবাঁই করতে লাগল। সরকারি বিভাগও চুপচাপ। অনেক চেষ্টা করেও ওসি গৌর হালদারকে নড়ানো গেল না। পরিমল মাস্টারও মনে মনে একটু দুর্বল হয়ে আছে। সে জানে, তিন নম্বর ব্লক আর সাত নম্বর ব্লক জঙ্গলের তফাত। সত্যি কথাটা বলে দেওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষেও।
গৌর হালদারের সঙ্গে তর্ক করার মতো জোরালো যুক্তি তার মনে পড়ল না একটাও।
.
কয়েক দিন পরেই আর একটি চমকপ্রদ কাণ্ড হল।
রায়মঙ্গল নদীতে একসঙ্গে বাপ আর ছেলেকে আক্রমণ করেছে বাঘ। তীর থেকে বেশ খানিকটা দূরে নৌকো বেঁধে রাত্রে ঘুমোচ্ছিল ওরা। বাঘ এসেছে সাঁতরে। অন্তত সাত বছরের মধ্যেও ও তল্লাটে বাঘের এমন উপদ্রব হয়নি। বাঘ প্রথমে এসে ধরেছিল ছেলেকে, হঠাৎ ছেলের আর্তনাদ শুনে বাপ ঘুম থেকে উঠেই দিকবিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে বাঘের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঘ মাত্র একটি থাবার আঘাতেই তার ঘাড় ভেঙে দিয়েছে। তারপর দুজনেরই দুটি উরুর রাং বেশ পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে সেই বাঘ।
বাপ-ছেলের লাশ নিয়ে আসা হয়েছে গোসাবায়। হাজার লোক ভেঙে পড়েছে তাদের দেখতে। কলকাতা থেকে এসেছে রিপোর্টাররা। পুলিশ ও বনের কর্তারা খুব ব্যস্ত। সেই রোমহর্ষক কাহিনি ছাপা হল সব কাগজে, তাই নিয়েই সর্বত্র আলোচনা। গত বছর বাঘের পেটে নিহত মানুষের সংখ্যা ছিল তেইশ, এ বছর সে-সংখ্যা এর মধ্যেই চব্বিশ ছাড়িয়ে গেল।
চোখের সামনে টাটকা লাশ, তাজা রোমাঞ্চকর গল্প, তারপর আর মনোরঞ্জন খাঁড়ার নিরামিষ কাহিনি কে মনে রাখতে যায়। প্রমাণের অভাবে নাজনেখালির কেস চাপা পড়ে গেল একেবারে।
দৈবক্রমে, রায়মঙ্গল নদীতে নিহত লোক দুটিই পূর্ববঙ্গীয়। তাদের লাশের সামনে নিথর হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন ওসি গৌর হালদার। মনে মনে তিনি বলে চলেছেন, জানি, শুধু আমাদেরই বাঘে খায়। আমরাই সব জায়গায় মার খাই। কই, এখন তো কোনও পরিমল মাস্টার এল না এদের জন্য দরদ দেখাতে? জানি, জানি, সব জানি, আচ্ছা আমিও দেখে নেব।
.
মাঝ রাতে এক বিবাগি
এমন হয় না কোনও দিন মাধবের।
দেবীপুরের খাঁড়িতে ভাল মাছ পাওয়া যাচ্ছে শুনে সে চলে এসেছিল সে-দিকে। কদিন ধরে সংসারে বড় টান যাচ্ছে। শুধু গায়ের জোর আর মনের জোর দিয়ে সে আর সব দিক সামাল দিতে পারছে না।
কোথায় মাছ, সবলবডঙ্কা। সবাই মিলে জাল ফেলে ফেলে নদী একেবারে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে, সামান্য গেঁড়ি-গুগলিও আর ওঠে না। ভাল করে বর্ষা না নামলে আর মাছের কোনও আশা নেই। সেই যে কথায় বলে না, পরের সোনা না দিও কানে, কান যাবেতার হ্যাঁচকা টানে। এ হল সে-রকম। কে বলল দেবীপুরের কাঁড়িতে মাছ, অমনি সে চলে এল হেদিয়ে। এবার বোঝ ঠ্যালা! ভাটার সময় ফিরতে ফিরতে দেড় দিনের ধাক্কা।
সারা দিন জাল ফেলে ফেলে, কিছুই না পেয়ে, ক্লান্তি ও মনের দুঃখ নিয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল মাধব। নৌকো বাঁধার কথাও খেয়াল হয়নি। মাঝ রাতে টিপি টিপি বৃষ্টি পড়ায় সে জেগে উঠল ধড়মড়িয়ে।
তার দৃষ্টিবিভ্রম হল। সে কোথায়? নদীর দু’ধারের মিশমিশে জঙ্গল, এ তো দেবীপুরের খাঁড়ি নয়। আকাশে যেন কেমন ধারা ছানা কাটা মেঘ, ফ্যাকাশে মতো ভুতুড়ে আলো, নদীর জল উঁচু-নিচু, এ কোন নদী? মাধবের মনে হল সবকিছুই অচেনা।
ছাড়া নৌকো জোয়ারের টানে ভাসতে ভাসতে কোথায় চলে এসেছে, তার ঠিক নেই। শহুরে ফিরিওয়ালো যেমন কখনও রাস্তা-গলিঘুঁজি ভুল করেনা, মাধব মাঝিও সেইরকম এ-দিককার সমস্ত নদীর নাড়ি-নক্ষত্র জানে। কিন্তু সারা দিনের উপোসি পেট ও আধ-ভাঙা ঘুমে সে যেন আজ সব কিছুই ভুলে গেছে। তার মনে হল, এই নদীতে সে আগে কখনও আসেনি, দু’ধারেই সমান জঙ্গল এমন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, এত উঁচু উঁচু গাছ? সুন্দরবনের গাছ তো এত লম্বা হয় না, তবে ওই আকাশঝাড়ু গাছের জঙ্গল কোথা থেকে এল? শোনা যাচ্ছে না তো সেই পরিচিত জলতরঙ্গ পাখির ডাক?
নদী ও জঙ্গল একেবারে নিঃসাড়, কোথাও কোনও আলোর বিন্দু নেই, আর কোনও নৌকোর চিহ্ন নেই, মাধব সম্পূর্ণ একা। মাঝে মাঝে নৌকোয় উঠে দাঁড়িয়ে সে চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখে ঠাহর করবার চেষ্টা করছে। নৌকোটা আপন মনে এগিয়ে যাচ্ছে তরতরিয়ে। হাল ধরার কথাও তার মনে নেই। এ যেন ভরা কোটালের বান।
ভয় পাবার পাত্র নয় মাধব মাঝি, বরং একটা চাপা আনন্দ ছড়িয়ে পড়ছে তার শরীরে সে যেন নতুন একটা নদীপথ আবিষ্কার করেছে, নতুন একটা দেশ, এখানে তার আগে আর কেউ আসেনি।
ও কী, মাধব মাঝি কি পাগল হয়ে গেল? হঠাৎ খ্যাপলা জাল বাঁ কনুইতে বাগিয়ে ধরে সে ছুঁড়ে দিল প্রাণপণ শক্তিতে। মাঝ-নদীতে এইভাবে কেউ জাল ফেলে? তার মতো অভিজ্ঞ লোক কি জানে না যে জালের কাঠি মাটি না ছুঁলে সেখানে জাল ফেলে কোনও লাভ নেই? জোয়ারের সময় নদীর মাঝখানে খুব রকম করেও দশ-মানুষ জল হবে!
সে-সব কথা চিন্তাই করছে না মাধব, এমন কী জাল তোলার পর সে দেখছেও না মাছ উঠল কি না। একবার তুলে পরের বার সে ছুঁড়ছে আরও জোরে, আর কী যেন বলছে বিড় বিড় করে। যেন এই নদীর মাঝখানে কোথাও আছে অতুল সম্পদ। আর কেউ টের পায়নি, মাধব ঠিক তা তুলে নেবে।
মাঝে মাঝে জাল ফেলার ঝপ ঝপ শব্দ। অনৈসর্গিক আলো মেশানো অন্ধকারের মধ্যে এক খ্যাপা জেলে ছুঁতে চাইছে নদীর হৃৎপিণ্ড।
দৈত্যরাও তো ক্লান্ত হয় কখনও কখনও। মাধবমাঝিই-বা কতক্ষণ পারবে। একসময় সে নৌকোর ওপর জাল ছড়িয়ে রেখে বসে পড়ল। তার হাঁটু কখনও এত দুর্বল হয়নি। সে আর দাঁড়াতে পারছে না। হাঁটু দু’টি হাতে জড়িয়ে ধরে সে মাথা গুঁজল। তারপর কাঁদতে শুরু করল একটু পরে।
সংসার যুদ্ধে পর্যদস্ত কোনও বয়স্ক সেনাপতির কান্নার মতো এমন উপযুক্ত, নির্জন জায়গা আর হয় না।
সেইভাবেই সে বসে রইল অনেকক্ষণ। তারপর এক সময় ভোর হয়ে গেল। তখন চোখ তুলে মাধব আবার তাকাল তীরের দিকে। দিনের আলো বড় নির্মম, সব কিছু চিনিয়ে দেয়। মাধব বলল, ও হরি, এ যে দেখি রানি ধোপানির চক। আর দুটো ট্যাঁক ঘুরলেই সেই সাত নম্বর ব্লকের নিষিদ্ধ জঙ্গল।
একটু দূরেই আর একটি নৌকো। আপন মনে ঘুরছে। প্রথমে মনে হল, সে নৌকোতে কোনও মানুষ নেই, কেউ দাঁড় ধরেনি, কেউ হাল ধরেনি! এ কী! মাধব মাঝি স্তম্ভিত!
তারপর ভাল করে চোখ রগড়ে দেখল, নৌকোর ঠিক মাঝখানে হাঁটু গেড়ে বসে আছে এক বৃদ্ধ। মাথার চুল ধপধপে সাদা, মুখে সেই রকম দাড়ি। জানুর ওপর দুটি হাত, চক্ষু দুটি বোজা।
এ লোকটা কে? মাধব মাঝি তো রিফিউজি নয়। সে এসেছে পার্টিশানের আগে। বাদা অঞ্চলের কোন মাঝিকে সে না চেনে? হঠাৎ গা-টা ছম ছম করে উঠল তার।
কিছুক্ষণ লোকটিকে দেখার পর মাধব মাঝি হেঁকে জিজ্ঞেস করল, ও মিঞা সাহেব, আপনি কোনখানে যাবেন?
বৃদ্ধ চোখ মেলে শান্তভাবে মাধবের দিকে তাকালেন। তারপর বলল, আমি কোনওখানে যাব না রে ভাই! তুমি যেখানে যাবে যাও!
আপনি এখানে কী করতাছেন? এ জায়গা তো ভাল না।
শব্দ কোরো না রে ভাই, শব্দ কোরো না। এ সময় আকাশ পরিষ্কার থাকে, মন পরিষ্কার থাকে, এ সময় আল্লাতাল্লা আমার সঙ্গে কথা কন। তুমি যেখানে যাচ্ছ যাও।
মাধব মাঝি আর কথা না বলে কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল অন্য নৌকোটির দিকে। সেটি যেন নিজে নিজেই চলছে। মাধব মাঝির নৌকো স্থির, তবু ওই নৌকোটা যাচ্ছে কী কবে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে কপালে হাত ছোঁয়াল।
তার নিয়তি তাকে এখানে টেনে এনেছে? দেখা যাক তাহলে! নিয়তি ঠাকুরানির সঙ্গে একবার মুখোমুখি হতে চায় মাধব।
জোয়ার স্তিমিত হওয়ায় নৌকোটা থেমে গেছে। মাধব এবার দাঁড় ধরল। প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টা সে মুখে একদানা অন্ন দেয়নি। মাটির হাঁড়িতে কয়েক মুঠো চাল আছে, কিন্তু এখন ভাত ফুটিয়ে নেবার ইচ্ছেও তার নেই। খানিকটা কাঁচা চালই মুখে দিয়ে চিবোতে লাগল। সে ওই সাত নম্বর ব্লকেই যাবে।
ডাঙার কাছে এসে সে সাবধানে অপেক্ষা করল একটুক্ষণ। হাওয়ায় গন্ধ শোঁকে। পাখির কিচির মিচির ছাড়া কোনও শব্দ নেই। যত দূর চোখ যায়, কোথাও কোনও ঝোপঝাড় পড়ে না। বাঁদরের পাল এ-দিকে আসেনি। হঠাৎ দূরে বেশ জোরালো গলায় শোনা গেল কোঁকর কোঁ, কোঁকর কোঁ কোঁ! বন-মোরগ! বন-বিবিকে মানত করে লোকে দেশি মুরগি ছেড়ে দিয়ে যায়, সেগুলোই এক সময় বন মুরগি হয়ে যায়।
ভাটার সময় কাদা-জলে নোঙর ফেলে মাধব নামল নৌকো থেকে। খোলের ভেতর থেকে একটা কুড়ুল সে বার করে নিয়েছে হাতে। শূল বাঁচিয়ে, কাদায় পা টেনে টেনে সে উঠল পাড়ে। প্রথমেই সামনের হেঁতাল-ঝোপটার ওপর মারল কুড়ুলের এক কোপ। কিছুই নেই সেখানে।
তারপর কুডুলটা পাশে নামিয়ে রেখে সে হাঁটু গেড়ে বসল মাটিতে। হাত জোড় করে মন্ত্র পড়তে লাগল। সে বন-আটক করবে। এক মাইলের মধ্যে কোনও দক্ষিণরায়ের বাহন থাকলে সে আর নড়াচড়া করতে পারবে না।
প্রথমে সে বিড় বিড় করে উচ্চারণ করল তার গুরুর শেখানো বীজমন্ত্র। তারপর সে চিৎকার করে বলতে লাগল বাঘ-বাঁধনের ছড়া–
এই আঁচির বন্ধন, পাচির বন্ধন, বন্ধন বাঘের পা–
আর শালার বাঘ চলতে পারবে না।
এই আঁচির বন্ধন, পাঁচির বন্ধন, বন্ধন বাঘের চোখ–
এইবার বেটা অন্ধ হোক।
এই হুঁকোর জল, কেঁচোর মাটি
লাগবে বাঘের দাঁত কপাটি।
ছাঁচি কুমড়ো বেড়াল পোড়া
ভাঙরে বাঘের দাঁতের গোড়া।
যদি রে বাঘ নড়িস চড়িস
খ্যাঁকশেয়ালির দিব্যি তোকে।
এনার কাঠি বেনার বোঝা
আমার নাম মাধব ওঝা!
মন্ত্র পড়া শেষ হলে মাধব প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে পরম নির্ভয়ে আতিপাতি করে খুঁজে দেখতে লাগল জঙ্গল। একটা বাঘ আসুক, মাধব একবার মুখোমুখি দেখতে চায় তাকে। সামনাসামনি বাঘকে দেখলে সে বলবে, না শালা নে, পারিস তো আমার জ্বালা যন্তোন্না জুড়াইয়া দে এক্কেবারে। তোরও প্যাটে ক্ষুধা, আমারও প্যাটে ক্ষুধা, হয় তুই মরবি, নয় আমি মরুম।
সাত নম্বর ব্লকের বাঘ চলে গেছে অনেক দূরে। অথবা মাধবকে দেখে ভয়ে কাছে এল না। এ ঘোর জঙ্গলে এক জন একলা মানুষকে জঙ্গলে ঘুরতে দেখলে বাঘেরও ভয় পাবার কথা। সে জানোয়ারেরও তো প্রাণের ভয় আছে।
মাধবের আর একটা উদ্দেশ্য ছিল, মনোরঞ্জনের লাশের কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া। যদিও তার অভিজ্ঞতা থেকে মনে মনে জানে, ঘটনার একুশ দিন পর লাশের চিহ্ন চোখে পড়া খুবই অস্বাভাবিক। বাঘ সবটা খায় না ঠিকই, কিন্তু জোয়ারে এই জঙ্গলের অর্ধেকটা ডুবে যায়। ভাটার সময় যা পায়, নদী টেনে নিয়ে চলে যায়। বাঘ তো বেশি দূর লাশ টেনে নিয়ে যাবে না। খিদের জ্বালায় মারার পরই কাছাকাছি বসে খাবে।
অনেকখানি বন তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মাধব বাঘ কিংবা লাশের কোনও চিহ্ন খুঁজে পেল না। তখন সে খুব মন দিয়ে একটা বড় গরাণ গাছ কাটতে লাগল। একা পুরো গাছটা কেটে, খণ্ড খণ্ড করে ডালপালা ছাড়িয়ে নিতেও তার কম সময় লাগল না। তার মন একেবারে শান্ত, বাঘ কিংবা বনরক্ষী কিংবা পুলিশের কোনও রকম আশঙ্কাই সে করছে না।
কাঠগুলো নৌকোয় তুলতে গিয়ে এক সময় সে দেখতে পেল, কাদার মধ্যে গাঁথা সাদা পাথরের মতো কী একটা জিনিস। গোটা সুন্দরবনে পাথরের কোনও অস্তিত্ব নেই। কৌতূহলী হয়ে সে জিনিসটাকে টেনে তুলতে গেল।
সেটি একটি নর-করোটি। মাংস-চামড়া চুল সমস্ত উঠে গিয়ে খুলিটা সাদা হয়ে গেছে। এই কি মনোরঞ্জন? হতেও পারে। না হতেও পারে। না হওয়াই সম্ভব, মনে হয় আরও বেশি দিনের পুরনো।
তবু মাধব ধরে নিল, এটা মনোরঞ্জনের খুলি। সে অনেকখানি স্বস্তি পেল। এবার সে গাছের একটা সরু ডাল পুঁতে দিল মাটিতে। নৌকো থেকে তার গামছাটা এনে, তার আধখানা ছিঁড়ে পতাকার মতো বেঁধে দিল সেই ডালে এবং মন্ত্র পড়ে দিল মনোরঞ্জনের নামে। সে গুণিন, অকুস্থলে সে নিহত ব্যক্তির আত্মার উদ্দেশে যদি একটা ধ্বজা পুঁতে দিতে না পারে, তা হলে তার ধর্মের হানি হয়! তবে কি তার গুরু শিবচন্দ্র হাজরাই এই উদ্দেশ্যে নিয়তির ছদ্মবেশ ধরে নৌকোটা টেনে এনেছেন এই সাত নম্বর ব্লকে?
কাঠগুলো নৌকোতে বোঝাই করে মাথার খুলিটাও মাধব নিয়ে নিল নিজের সঙ্গে। পুলিশের দারোগাই বলল, আর গবর্নমেন্টই বলল, কেউ এই খুলিটা দেখে বিশ্বাস করবে না যে, মনোরঞ্জন খাঁড়াকে বাঘে খেয়েছে। এই তার প্রমাণ। এর আগেও কত লোককে বাঘে খেয়েছে। তাছাড়া নদীতে ভাসতে ভাসতে কত মড়া আসে, ভাটার সময় কাদায় আটকে যায়। এরকম মাথার খুলি গণ্ডায় গণ্ডায় পাওয়া যেতে পারে। তবু একা অনেক দূরের পথ ফিরতে হবে, এই খুলিটাই মাধবের সঙ্গী।
বেলা গড়িয়ে এসেছে, আকাশটা লালে লাল। পাখির ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে নদীর এপার থেকে ও-পারে। পৃথিবীটাকে এই সময় কী সুন্দর, শান্তিময় মনে হয়।
আশ্চর্য, এখনও এই নদীতে আর একটা নৌকোও কিংবা পেট্রোলের লঞ্চ দেখা গেল না। প্রায় দু-আড়াই দিন হয়ে গেল, মাধব কারুর সঙ্গে একটিও মন খুলে কথা বলেনি।
শুকনো লকড়ি, পাতা কিছু জড়ো করে এনেছিল মাধব, তাই দিয়ে তোলা উনুনে আগুন জ্বালাল। মিষ্টি জল নেই সঙ্গে, নদীর নোনা জল এত নোনা যে তা মুখে ভোলা যায় না, বমি আসে। এই জল দিয়ে ভাত রাঁধলেও কেমন যেন অখাদ্য হয়। তবু কী আর করা যাবে। দু’মুঠো ভাত না খেয়ে মাধব আর পারছে না।
জোয়ার আর ভাটার ঠিক মাঝামাঝি সময়টায় নদী যেন একেবারে থেমে থাকে। এই সময় আর নৌকো চালাবার মতো তাগদ মাধবের নেই। অত্যন্ত নোতা আর হড়হড়ে খানিকটা ভাত খেয়ে তার শরীরটা আরও অবসন্ন লাগছে। শুধু হালটা ধরে সে বসে রইল। অন্ধকার নেমে এসেছে অনেকক্ষণ। নদীর দু’ধারের দৃশ্য আবার অচেনা। শেষ বিকেলে যে অত রঙ ছিল আকাশে, সেসব কোথায় গেল? এখন শুধু ময়লা ময়লা মেঘ। তবে আজ ডান পাশের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে একটা জলতরঙ্গ পাখির ডাক। ট-র-র-র, ট-র-র-রাট-র-র-র।
ঝুপসি অন্ধকারের মধ্যে, থেমে থাকা নৌকোয় অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকবার পর মাধব কথা বলতে শুরু করল।
অ মনো, মনো রে! তুই শুনতে পাস আমার কথা?
সাদা রঙের মাথার খুলিটা ঠিক মাধবের সামনে পাটাতনের ওপর বসানো চোখ দুটোর জায়গায় দুটো কালো গর্ত। তবু যেন সে মাধবের দিকেই তাকিয়ে আছে।
অ মনো, চাইয়া দ্যাখ, আমি মাধবদা। অমন সোন্দর মুখখান আছিল তোর, কার্তিক ঠাকুরের মত টানা টানা চক্ষু। হায় রে, সব কোথায় গেল। মরলে সব মানুষই সমান, আমি মরলে আমার মাথাডাও এই রকমই হইয়া যাবে। আমার মাথার খুলি, তোর মাথার খুলি, মাইয়া মানুষের খুলি, সবই এক। ক্যান তুই আইলি আমাগো সাথে। ঘরে নতুন বিয়া করা বউ।
ফিন ফিন করে বাতাস বইছে। আজ আবার একটু পরেই বোধহয় বৃষ্টি আসবে।
হ্যামলেট নামের প্রসিদ্ধ নাটকটির কথা তো কিছুই জানে না মাধব। জানলে বোধহয় সে সেই অর্ধোম্মাদ রাজকুমারের অনুকরণ করত না।
সইত্য কথা ক তো, মনো তোর প্রাণডা কি পেরথম ঝটকাতেই ব্যায়রাইয়া গেছিল? কষ্ট পাসনাই তো? নাকি লড়ছিলি? অইন্তত একখান কোপও মারছিলি সে সুম্বুন্ধির ভাইডার মাথায়? তোরে আমরা অনেক বিছরাইছিলাম, বিশ্বাস কর মনো, খোঁজার আর কিছু বাকি রাখি নাই, তোরে একেবারে ঝড়ে উড়াইয়া নিয়া গেল? সে সুম্বুন্ধির ভাইরে একবার সামনে পাইলে…। বিড়ি খাবি, মনো? আমি একটা খাই? আর দুই খান মাত্তর বিড়ি আছে, কত দূরের পথ।
উনুনের আঁচ এখনও নেবেনি, দেশলাই খরচ না করে সেখান থেকেই বিড়িটা ধরাল মাধব। কাল রাতে বৃষ্টি ভেজায় বিড়িটা স্যাঁতসেতে হয়ে গেছে। এই রকম স্যাঁতসেতে বিড় টানার যে কী যন্তোন্না, তা শুধু ভুক্তভুগীই বুঝবে! হে ভগবান, এইটুকু সুখও কি দেবে না।
অ মনো, কথা কস না কেন? অমন দম ফাটাইন্যা গলার আওয়াজ আছিল তোর! ‘বঙ্গে বর্গী’ পালায় ভাস্কর পণ্ডিত তুই বড় ভাল করছিল, জয়হিন্দ ক্লাব এবার একেবারে কানা। অশ্বিনী চাইল্যা গেল, তুইও গেলি। দূর শালা।
বিরক্ত হয়ে নিবে যাওয়া বিড়িটা মাধব ছুঁড়ে ফেলে দিল জলে। তারপর সে একটি উন্মাদের মতো কাণ্ড করল।
মাথার খুলিটা হাতে নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর সেই জনমানবশূন্য নদী ও জঙ্গলের মধ্যে গলা ফাটিয়ে চ্যাঁচাতে লাগল, শোনো, শুইন্যা রাখো তোমরা, আমি মাধব দাসমজুমদার, আমার বাপে আমারে খেদাইয়া দিছিল। মায়রে চোক্ষে দেখি নাই, তবুও আমি এ-জন্মে কক্ষনও চুরি করি নাই, ডাকাতি করি নাই, কাউর কোনও ক্ষতি করি নাই। নিজের বউ ছাওয়ালপানগো দুই মুঠা ভাত দেবার জইন্যে রোজ মাথার ঘাম পায়ে ফেলি। তাই তোমরা আমারে একটা বিড়ি পর্যন্ত মনের সুখে টাইনতে দেবা না? তোমরা ভাবছ কী? আমি মাধব দাসমজুমদার, আইজও মরি নাই। আমি মরব না। আমি হাজার বছর বাঁইচ্যা থাকম, আমারে মারতে পারবা না। আমারে এই রকম সাদা ফ্যাকফ্যাকে খুলি বানাইতে পারবা না। আমি লইড়া যামু। আয়, কে আসবি আয়। কে কোথায় আছোস আয়।
জোয়ার-ভাটা, ঢেউ ও ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে যুঝে মাধব মাঝি ছোট মোল্লাখালি এসে পৌঁছল তৃতীয় দিন সন্ধ্যায়। সারা শরীর জলকাদা মাখা। পেটটা যেন ঠেকে গেছেপিঠে। শুধু জ্বল জ্বল করছে দুটি চোখ।
এ-দিকে ছোট মোল্লাখালিতে দারুণ হই চই, প্রচুর হ্যাজাক ও লণ্ঠনের আলো, তিনখানা লঞ্চ ও গোটা বিশেক নৌকো ভিড়ে আছে ঘাটে। পুলিশ ও বন-বিভাগের লঞ্চ একনজরে দেখেই চিনেছে মাধব, একবার সে ভাবল, সরে পড়বে এখান থেকে। কিন্তু তার শরীর আর বইছে না। লোকালয় দেখার পর আর সে একলা একলা জলে ভাসতে পারবে না। যা হয় হোক।
নৌকো বেঁধে ওপরে উঠে আসবার পর সে দেখল, ব্যাপার একেবারে অন্য রকম।
নদী সাঁতরে এপারে চলে এসেছে এক বাঘিনি। আজু শেখের বাড়িতে এসে একটা গোরু মেরেছে। কিন্তু পালাতে পারেনি শিকার নিয়ে। অতিরিক্ত দুঃসাহসের জন্যই হোক বা খিদের জ্বালাতেই হোক, বাঘ সেখানেই গোরুটাকে খেতে শুরু করেছিল। লোকজন উঠে পড়ায় সকলের তাড়া খেয়ে সে রান্নাঘরে ঢুকে বসে আছে।
সকাল থেকে প্রায় হাজার খানেক লোক ঘিরে রেখেছে আজু শেখের বাড়ি। নরখাদক বাঘই আবার সব চেয়ে বেশি ভয় পায় মানুষকেই। সেই বাঘিনি আর কিছুতেই বেরুচ্ছেনা রান্নাঘর থেকে দূর দূর গ্রাম থেকে লোকজন ছুটে এসেছে বাঘ দেখতে। কারুর প্রাণে যেন ভয়-ডর নেই। সবাই চায় বাঘ বাইরে বেরিয়ে আসুক, দু’চোখ ভরে, প্রাণ ভরে দেখে নেওয়া যাক। সুন্দরবনের মানুষ প্রার কেউই কখনও জীবন্ত বাঘ দেখেনি। যে-দেখেছে, সে সচরাচর ফিরে আসে না সে-ঘটনা বলার জন্য।
খবর পেয়ে তড়িঘড়ি পুলিশ ও বনবিভাগের লোকও চলে এসেছে। বাঘটাকে রান্নাঘর থেকে কিছুতেই বার করতে পাবছে না কেউ। দর্শকরা মাঝে মধ্যে ইট-কাঠ ছুঁড়ে মারে, পটকাও ফাটানো হয়েছে দুটো, তাতে বাঘ আরও ভয় পেয়ে গেছে। এ পর্যন্ত টুঁ শব্দটি করেনি। কিন্তু সেটা যে রান্নাঘরের মধ্যে রয়েছে, তা বোঝা যায়। চ্যাঁচার বেড়ার ফাঁক দিয়ে একটু একটু দেখা যায় কালো-হলুদ ডোরাকাটার ঝিলিক।
বাঘকে মারার হুকুম নেই। গোসাবা বাঘ প্রকল্পে খবর গেছে। সেখান থেকে তাদের দ্রুতগামী স্পিড বোটে আসছে ঘুমের ওষুধের টোটা। সেই টোটা দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে বাঘকে নিয়ে যাওয়া হবে খাতির করে।
ওসি গৌর হালদার একবার এসে ঘুরে গেছেন। বনবিভাগ এবং টাইগার প্রজেক্ট যখন ভার নিয়েছে, তখন আর তাঁর করবার কিছু নেই। বাঘের বদলে যদি ডাকাত পড়ত আজু শেখের বাড়িতে, তাহলে তিনিই হতেন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। বাঘে গোরু মেরেছে। মানুষ তো মারেনি, সুতরাং কিছু রিপোর্টও দেবার নেই তার।
ভিড়ের ফাঁক-ফোকর গলে একেবারে সামনে দিকে এসে দাঁড়িয়েছে মাধব মাঝি। অপরিচ্ছন্ন, ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, জলে ভেজা শরীর, তবু উত্তেজনায় ধক ধক করছে তার বুক। এই বাঘিনিটাই কি মেরেছে মনোরঞ্জনকে? না, তা হতে পারে না, সেই সাত নম্বর ব্লক থেকে এত দূর ছোট মোল্লাখালিতে বাঘ আসবে কী করে? তবু বাঘ তো।
সাধুচরণ, নিরাপদ, বিদ্যুৎরা এসেছে কি না খুঁজবার চেষ্টা কবল সে একবার। কিন্তু এই ভিড়ের মধ্যে কিছু বুঝবার উপায় নেই। হঠাৎ তার মনে হল, মনোরঞ্জন যেন দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে। এক মাস আগে হলেও, এমন খবর পেলে মনোরঞ্জন ঠিক ছুটে চলে আসত দেখবার জন্য। এখনও সে আসবে না? শরীরে একটা তরঙ্গ খেলে গেল মাধবের।
ঘুমের টোটা এসে পৌঁছবার আগেই ঘটনার গতি গেল অন্য দিকে। ছোট মোল্লাখালির এক দল লোক দাবি তুলল, তারা বাঘকে নিয়ে যেতে দেবে না কিছুতেই। বাঘ এসে তাদের গাঁয়ের মানুষ মারবে, গোরু মারবে আর বাবুরা এসে সেই বাঘকে ঘুম পাড়িয়ে আদর করে নিয়ে যাবে? পুলিশ ও ফরেস্ট গার্ডদের ঘিরে ফেলে তার বলল, হয় বাঘ মারো, নয় আমাদের মারো। বনবিভাগের নিরীহ বড়বাবু জয়নন্দন ঘোষাল হ্যাঁ কিংবা না কোনওটাই বলতে পারলেন না, মুখ আমসি করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
তখন উত্তেজিত জনতা জয়নন্দন ঘোষালকে বেঁধে ফেলল একটা খুঁটির সঙ্গে। বাঘ মারা নাহলে তাঁকে ছাড়া হবে না। পুলিশ ও ফরেস্ট গার্ডরা বুঝল যে ব্যাপার বে-গতিক, বাঘের বদলে মানুষ মারার ঝুঁকি তারা নিতে পারে না। এদিকে লোকজন যা খেপে উঠেছে, এরপর তাদের প্রাণ নিয়েই টানাটানি।
পুলিশ ও ফরেস্ট গার্ডদের মোট তিনটি বন্দুক, বিশেষ এক জনের ওপর যাতে দায়িত্ব না পড়ে সেই জন্য তিন জনই এক সঙ্গে বন্দুক উঁচিয়ে ধরল আজু শেখের রান্নাঘরের দিকে। কোনও রকম লড়াই দেবার চেষ্টা করল না বাঘটা, ভিতুর ডিম হয়ে নিঃশব্দে বসে আছে রান্নাঘরে।
গুড়ুম। গুড়ুম। গুড়ুম। আঃ কী মিষ্টি আওয়াজ।
দ্বিতীয় গুলিটা খেয়েই বাঘটা রান্নাঘরের চ্যাঁচার বেড়া ভেঙে এক লাফ দিয়ে পড়ল এসে উঠোনে। সঙ্গে সঙ্গে একেবারে নিঃস্পন্দ।
কী সুন্দর চেহারা সেই বাঘিনিটার, কী অপূর্ব শরীরের গড়ন, যেন কোনও শিল্পীর সৃষ্টি। হাত আর পা দুটো ছড়িয়ে শুয়ে আছে লম্বা হয়ে, মুখে একটা কাতর ভাব।
লোকজন সরে গিয়েছিল অনেক দূরে। মাধবই চেঁচিয়ে উঠল, মার, মার, মার, সুম্বুন্ধির পুতকে মার।
আবার সবাই ছুটে এল সে-দিকে। হাতের কুড়ুলটা দিয়ে সেই সদ্য মৃত বাঘিনির ওপর কোপের পর কোপ মেরে যেতে লাগল মাধব। তারপর অন্যদের ধাক্কাধাক্কিতে এক সময় সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ওই ছিন্নভিন্ন ব্যাঘ্র-শরীরে।
.
ইচ্ছাপূরণ
বছর ঘুরে গেছে। আবার এসেছে ফাল্গুন মাস, এসেছে আকালের দিন। নদীর ধারে বাঁধের ওপর উবু হয়ে বসে থাকতে দেখা যায় জোয়ান-মন্দ মানুষদের। হাতে কোনও কাজ নেই, ঘরে খোরাকির ধান ফুরিয়ে আসছে। আবার জঙ্গলে কাঠ কাটতে যাবার জন্য উসখুস করছে ছোকরাদের মন।
নিশ্চয়ই জঙ্গল থেকে চোরাই কাঠ নিয়ে নিরাপদে ফিরেও আসছে অনেকে। নইলে আর মহাদেব মিস্তিরির ব্যবসা চলছে কী করে? এই সময়টাতেই তার কারবার ফেঁপে ওঠে, তার বাড়ির সামনে জমে ওঠে কাঠের পাহাড়। দিনমজুরি হিসেবে মাধব মাঝিকে কাঠ ওজন করার একটা চাকরি দিয়েছে মহাদেব, মাছ ধরা ছেড়ে সে এখন ওই কাজ করে। প্রায়ই মাধব ভাবে, বউ-বাচ্চাদের নিয়ে এই বাদা অঞ্চল ছেড়ে সে অন্য কোথাও চলে যাবে। কোথায় যে সাবে, সেটাই জানে না।
দু-দশ জন ঘনিষ্ঠ লোক ছাড়া মনোরঞ্জনের কথা আর কেউ মনে রাখেনি। মৃত মানুষকে নিয়ে বেশি দিন হা-হুতাশ করা এ-দিককার নিয়ম নয়। যে গেছে সে তো গেছেই, যারা আছে, তারাই নিজেদের ঠ্যালা সামলাতে অস্থির।
শূন্য হাটখোলায় বসে দুপুরের দিকে তাস পেটায় সাধুচরণ, নিরাপদ, বিদ্যুৎ আর সুভাষরা। আবার কোনও একটা যাত্রাপালার মহড়া শুরু করার কথা মাঝে মাঝে ভাবে। ‘মাটি আমার মা’ নামে একটা আধুনিক পালা ওদের খুব মনে ধরেছে, কিন্তু তার নায়কের মুখে গান আছে। তখন মনে পড়ে মনোরঞ্জনের কথা। বেশ ভাল গানের গলা ছিল মনোরঞ্জনের, ওর জায়গা আর কেউ নিতে পারবে না।
তাস খেলতে খেলতে সাধুচরণ মাঝে মাঝে অন্য রকম কড়া চোখে তাকায় মোটা সুভাষের দিকে। এ দৃষ্টির মানে আছে। সুভাষ চোখ নামিয়ে নেয়।
পরিমল মাস্টার কথা রেখেছিল, সাধুচরণকে তাঁর ইস্কুলে একটা কাজ দিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সাধুচরণ সে-চাকরি রাখতে পারেনি। অতবড় একটা জোয়ান শরীর নিয়ে সে ইস্কুলের দফতরির ভূমিকায় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারল না। মাঠের জল কাদা ভেঙে হাল চষা, চড়চড়ে রোদে নৌকো নিয়ে মাছ ধরা কিংবা আট টাকা রোজে সারা দিন কারুর বাড়িতে মাটি কাটায় সে অভ্যস্ত, দেহের ঘাম না ঝরলে কাজকে সে কাজ বলেই মনে করে না। তাছাড়া, রোজ সাত মাইল ভেঙে সে জয়মণিপুরে চাকরি করতে যাবে, তাহলে তার নিজের চার বিঘে জমি কে চাষ করবে? গোটা সংসার তুলে নিয়ে গিয়ে জয়মণিপুরে থাকাও তার পক্ষে সম্ভব নয়, মাইনের একটা টাকায় সে তাদের কী খাওয়াবে?
মাথা গরম সাধুচরণের, ইস্কুলের এক মাস্টারের ওপর রেগে এক দিন মারতে উঠেছিল। শহর থেকে আসা মাস্টারবাবুটি তুই তুই বলে ডাকতেন। প্রথম দিন থেকেই তাকে অপছন্দ করেছিল সাধুচরণ। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোক বলে, এ-দিককার চাষিরাও মাঠে পরস্পরকে আপনি বলে। মাস্টারবাবুটির ঘাড় চেপে ধরেছিল এক দিন, সেই অপরাধেই সাধুচরণের চাকরি গেল।
চাকরিটি হারিয়ে সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য সাধুচরণের তেমন ক্ষতি হয়নি, বরং লাভই হয়েছিল। তখনই বাগদা-পোনার হুজুক উঠল। বছরের বিশেষ একটা সময়ে এই সব নদীর দু’ধার দিয়ে বাগদা চিংড়ির বাচ্চারা ভেসে যায়। প্রায় স্বচ্ছ, সরু আলপিনের মতো তাদের চেহারা, খালি চোখে প্রায় বোঝাই যায় না। হাজার হাজার বছর ধরেই তারা নিশ্চয়ই ভেসে যাচ্ছে, এত দিন কেউ লক্ষ্য করেনি। এখন বাগদা চিংড়ির দাম প্রায় সোনার মতো, সাহেবরা খায়, তাই ভেড়ির মালিকরা ওই বাগদা-পোনার অস্তিত্ব আবিষ্কার করে লাগিয়ে দিল গ্রামের লোকদের। ছেলে-মেয়ে-বুড়ো-মন্দা কেউ আর বাকি রইল না, সবাই নেমে পড়ল নাইলনের জাল নিয়ে। সেই সময়টায় সাধুচরণ এবং তার বন্ধুরা দিনে প্রায় পঁচিশ তিরিশ টাকা পর্যন্ত রোজগার করেছে। সেই কয়েকটা দিন বড় সুদিন গেছে।
সন্ধেবেলা মাঠে গিয়েছিল বাসনা, তারপর মহাদেব মিস্তিরির পুকুর থেকে গা হাত-পা ধুয়ে ফেরবার সময় হঠাৎ ভয় পেয়ে বলল, কে? কে?
পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। অথচ সে স্পষ্ট পায়ের শব্দ শুনেছিল।
অন্ধকার হয়ে গেছে, এখানে খানিকটা বাগান মতো পেরিয়ে তারপর ওদের বাড়ি। ভয় পায়নি বাসনা। বন-বিড়ালির মতো শরীরে রোঁয়া ফুলিয়ে একটু বেঁকে দাঁড়িয়ে রইল। একটু ক্ষণের মধ্যেও কেউ এল না দেখে সে বলল, মরণ! কোন মুখপোড়া, একবার আয় না দেখি সামনে।
ভিজে কাপড়ে সপসপ করে বাসনা ফিরে এল বাড়িতে। শরীরে গোলগাল ভাবটি খসে গিয়ে এখন তার বেশ ফুরফুরে চেহারা।
শোওয়ার ঘরের দাওয়া থেকে ডলি বলল, ওই এলেন নবাবের বেটি! বলি, ও-বেলা যে ঝিঙেগুলো কুটে রাখা হয়েছিল সেগুলো সাঁতলে না রাখলে পচে যাবেনা? টাকা-পয়সা কি খোলামকুচি, না গাছে ফলে?
শাড়ি নিংড়োতে নিংড়োতে বাসনাও সমান ঝাঁঝের সঙ্গে উত্তর দিল, সেগুলো একটু আগেই বেঁধে রাখা হয়েছে। চোখ থাকলেই কেউ রান্নাঘরে গিয়ে দেখতে পারে।
বুঁচির বাপ কখন থেকে এসে বসে আছে। তাকে দুটো খেতে দেবে কোথায়, না পুকুরে গেছে তো গেছেই।
আর সবাই বুঝি ঠুটো জগন্নাথ? দুটো ভাত বেড়ে দিতেও পারে না?
এ-রকম চলে কথার পিঠে কথা। বাসনা তার শাশুড়ির সঙ্গে সমান তালে টক্কর দিয়ে যায়। আত্মরক্ষার সহজাত নিয়মেই সে বুঝেছে যে মুখ বুজে সইলে আর হবে না, তাকে লড়ে যেতে হবে সর্বক্ষণ।
বাসনার আর কোনও দিনই বাপের বাড়ি ফিরে যাবার আশা নেই। তার সইয়ের দাম কানাকড়ি হয়ে গেছে। পরিমল মাস্টার অনেক চেষ্টা করেও গ্রুপ ইনসিওরেন্স কিংবা সরকারের প্রতিশ্রুত টাকা আদায় করে দিতে পারেনি। সবাই জেনে গেছে যে তিন নম্বর নয়, সাত নম্বর ব্লকেই কাঠ কাটতে গিয়েছিল ওরা। সাধ করে বাঘের খপ্পরে গেছে, একটা বে-আইনি কাজ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে মনোরঞ্জন, সেজন্য কে ক্ষতিপূরণ দেবে?
বাসনার মা সুপ্রভা হঠাৎ মারা গেছে মাত্র দু’দিনের অসুখে। তারপর তিন মাস যেতে না-যেতেই শ্রীনাথ সাধু এক মাঝবয়সি বিধবাকে রক্ষিতা করে এনেছে বাড়িতে। বউ মারা যাবার পর এক জন রক্ষিতা না রাখলে তার মতো মানী লোকের মান থাকে না। কিন্তু তার ছেলে বদ্যিনাথ এটা মোটেই পছন্দ করেনি। সেই জন্য বাপ-ব্যাটাতে এখন লাঠালাঠি চলে। নিতাইচাঁদ বাংলাদেশের চোরাচালানিদের সঙ্গে যোগসাজসে বেশ ভালই রোজগারপাতি করছিল, হঠাৎ এ-দিন বিপক্ষ দলের হাতে বেধড়ক ধোলাই খেয়ে ঠ্যাঙ ভেঙে কাবু হয়ে পড়ে আছে বাড়িতে। ফটিক বাঙালও নদীতে তলিয়ে যায়নি, বরং পদোন্নতি হয়েছে তার। এখন তার দৌড় ক্যানিং পর্যন্ত। সেখানকার এক মাছের আড়তদারের মেয়ের সঙ্গে তার গভীর আশনাই চলছে। বাসনাকে মামুদপুরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আর কার মাথাব্যথা থাকবে?
সময়ের নিয়মে সময় চলে যায়, কেউ কারুর জন্য বসে থাকে না। শুধু বাসনা মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠে গভীর রাত্রে খাটের উপর জেগে বসে থাকে। এখনও তার আশা, বুঝি হঠাৎ ফিরে আসবে মনোরঞ্জন।
বাসনার দিকে প্রথম নজর দিয়েছিল মহাদেবমিস্তিরির ছোট ভাই ভজনলাল। সে থাকে নামখানায়। মাঝেমধ্যে এ-দিকে আসে। দুর্গাপুজোর সময় ডামাডোলের মধ্যে বাসনার হাত ধরে টেনে অন্ধকারের মধ্যে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। চেঁচিয়ে উঠতেই ভোঁ দৌড়। এর দুদিন পরে, দুর্গাপুজোর ভাসানের সময় কে বা কারা যেন একা পেয়ে খুব ঠেঙিয়েছিল ভজনলালকে। আততায়ীদের মুখ সে দেখতে পায়নি। চিনতেও পারেনি। হাটখোলার সবাই বলল, তা হলে নির্ঘাত ভূতে মেরেছে। এই কথা বলে, আর সাধুচরণের দল হেসে গড়াগড়ি যায়।
দ্বিতীয় জন মোটা সুভাষ। ঠুকঠুক করে এ-বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, নানা ছুতোয় বিষ্টুচরণের সঙ্গে দেখা করতে আসে। বাসনা তার সঙ্গে হেসে কথা বলে, মোটা সুভাষের মনে হয়, তাকে বুঝি বাসনার খুব পছন্দ। কিন্তু বেশিদূর সে এগোতে সাহস পায় না, সাধুচরণ প্রায়ই তার দিকে অমন রাগি চোখে তাকায় কেন? সাধুচরণ ঠিক ধরে ফেলেছে তার মতলব। এর মধ্যে এক দিন বাসনা হঠাৎ মোটা সুভাষকে বলল, আপনি কবিতাকে বিয়ে করেন না কেন? আপনার সঙ্গে ভাল মানাবে। তা শুনে একবারে মাটিতে বসে পড়ল মোটা সুভাষ। যাচ্চলে! এই ছিল মেয়েটার মনে?
সাধুচরণ বাসনার পরিত্রাতা, কিন্তু ইদানীং তারও মনটা ইতি-উতি করে। সেই যে নদীতে মামুদপুরের লোকদের নৌকোটা উলটে যাবার সময় সে বাসনার হাত ধরে টেনে এক হ্যাঁচকা টানে নিজের কোলের ওপর ফেলেছিল, সেই থেকে তার বুকটা খালি খালি লাগে। বার বার সে সেই দৃশ্যটা কল্পনায় ফিরিয়ে আনে, একলা থাকলেই সে শূন্যে হাত দিয়ে সেই রকম হ্যাঁচকা টান দেয়।
কোনও না-কোনও পুরুষমানুষ তো বাসনাকে খাবেই, সাধুচরণ ভাবে, সে খেলে দোষ কী? মনোরঞ্জন ছিল তার বড় আপনজন, সেই মনোরঞ্জনের অবর্তমানে তার জিনিস যদি সাধুচরণ ভোগ করে, তাতে কি খুব অন্যায় হয়? কিন্তু বাসনা তাকে সমীহ করে, তার দিকে ভাল করে মুখ তুলে তাকায় না। এটা বাড়াবাড়ি না? সাধুচরণ আবার সুভাষ-টুভাসদের মতো মিঠে-মিঠে কথাও বলতে পারে না।
আরও যে-ক’জন বাসনার শরীরটাকে খাবার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় আছে, তাদের মধ্যে প্রধান হল তার শ্বশুর বিষ্টুচরণ। এটাও এখানকার একটা প্রথা। যে ভাত দেবার মালিক, তার একটা ন্যায্য অধিকার আছে। একটু নিরিবিলিতে পেলেই বিষ্টুচরণ তার পুতের বউয়ের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে। বাঁ-হাতখানা প্রথমে রাখে বাসনার পিঠে। তারপর আঙুলগুলো লকলকিয়ে এগোতে শুরু করলেই বাসনা ছাঁটা মেরে সরে যায়। ষাট বছর বয়েস পেরিয়ে গেছে বিষ্টুচরণের, গত বর্ষায় আছাড় খেয়ে তার একটা পা সেই যে ভাঙল, আর সারেনি। এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে, চোখে ছানি, তবু এখনও তার লালচ মরেনি। ডলি তো ভালভাবে জানে বলেই সর্বক্ষণ বিষ্টুচরণকে চোখে চোখে রাখে।
যে-সময় কাজ থাকে না, ঘরে ধান থাকেনা, পেটে সর্বক্ষণ খিদে খিদে ভাব, সেই সময়টাতেই যে কেন মানুষের যৌন খিদে বাড়ে, তা বলে যাননি ফ্রয়েড সাহেব। নাকি বলে গিয়েছিলেন? সে-সব কিছুনা জেনেও সাধুচরণ ক্ষুধার্ত বাঘের মতো ভেতরে ভেতরে গজরায় বাসনার দিকে চেয়ে।
মোটমাট চার-পাঁচটা বাঘ ওৎ পেতে আছে বাসনার দিকে। যে-কোনও দিন লাফিয়ে পড়বে, খাবে। জঙ্গলঘেঁষা দেশে এটাই নিয়ম।
বাসনা অবশ্য এ পর্যন্ত কারুকে ধরা-ছোঁয়া দেয়নি। একমাত্র সেই প্রত্যেকদিন এখনও মনোরঞ্জনের কথা মনে করে অন্তত একবার। প্রায়ই মুচড়ে মুচড়ে কাঁদে। শুধু স্বার্থও নয়, আরও কিছু একটার সম্পর্ক ছিল মনোরঞ্জনের সঙ্গে। তার মাত্র আট মাসের বন্ধন, তারপর এক বছর কেটে গেছে, তবু সেই বন্ধন আরও তীব্র মনে হয়।
কিন্তু এই অবস্থায় আর কত দিন চলবে তার? মাত্র একুশ বছরের ডবকা চেহারার মেয়ে বিধবা হলে তারপর বাকি জীবনটা সে নিখুঁতি সন্দেশটি হয়ে থাকবে? কেউ তাকে খাবেনা? একথা বললে এই জল-জঙ্গল বাদা এলাকার একটা গোরুও বিশ্বাস করবে না। বাসনা নিজেও এ-কথা জানে, সে-ও তো কম দেখেনি।
এক-এক দিন মাঝ রাতে বাসনা নিদ্রাহীন চোখে আর খাটে শুয়ে থাকতে পারে না, বাইরে এসে দাওয়ায় পা ঝুলিয়ে বসে সামনের অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকে। ওই অন্ধকারের মধ্যে সে তার ভবিষ্যৎটা খোঁজে। মা নেই, তার বাপ আর তাকে কোনও দিন কাছে ডেকে নেবেনা। শ্বশুরের আর অথর্ব হতে বেশি দিন বাকি নেই। ননদের বিয়ে দিতে হবে, তাতে কিছুটা জমি চলে যাবে। আধপেটা খেয়ে, মান খুইয়ে, শাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া করে কাটাতে হবে সারা জীবন। আর নয়তো…।
শুধু এক জন নেই। অথচ দুনিয়াটা যেমন চলছিল, তেমনই চলছে। মনোরঞ্জন থাকলে সে তার শক্ত কাঁধ দিয়ে এই সংসারটাকে তুলে ধরতে পারত। সে নেই, সে আর আসবে না।
হাওয়া নেই, রাতচরা পাখির ডাক নেই, মাঝে মাঝে কিট কিট কিট কিট শব্দকরছে ঘাসফড়িং, টুপ টাপ করে খসে পড়ছে গাছের পাতা, কোঁয়াক কোঁয়াক করে ডাকছে ব্যাঙ, তাদের ধরবার জন্য সরসর শব্দে এগোচ্ছে সাপ, সামনের খালটা থেকে উঠে আসছে পাট-পচানো জলের গন্ধ, চাঁদ ডুবে গেল মেঘের তলায়। চমৎকার, ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার, বলে কোনও এক বুড়ি হুতোম প্যাঁচা গাছের ডাল থেকে উড়াল দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাটিতে, চিক চিক চিক চিক শব্দে পালাতে লাগল ইঁদুর ছুঁচোরা, দূরে একটা কুকুর অকারণে ঘেউ ঘেউ করে উঠল কয়েকবার।
জীবন চলছে নিজের নিয়মে। নদী বয়ে চলেছে এক মনে, আকাশে ঘুরছে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ, দেশ বিদেশ থেকে উড়ে আসছে হাওয়া, একটা জোনাকি উড়ে যায় গোয়ালঘর থেকে রান্নাঘরের দিকে, ঠিক যেমন ভাবে গিয়েছিল গত বছর এই সময়, তার আগের বছর, তার আগের বছর ..।
মাঝ রাতের অন্ধকারে বাসনাকে একলা একা বসিয়ে রেখেই কাহিনিকারকে বিদায় নিতে হবে। এই মেয়েটির জীবনে সুখ-শান্তি ফিরিয়ে দেবার মতো কলমের জোর তার নেই। ইচ্ছে মতো শেষ পরিচ্ছেদে সোনালি সূর্য এঁকে দেবার উপায়ও তার নেই। বাস্তবতার দোহাইতে সে লেখকের হাত বাঁধা।
আগামীকালের কোনও পাঁচালি-লেখক কিংবা পালাকার যদি মনোরঞ্জন খাঁড়ার জীবন উপাখ্যান রচনা করে, তবে সে হয়তো এইভাবে শেষ করবে
বাসনা নামেতে মেয়ে বিধবা অকালে
একা একা কান্দে বসি হাত দিয়া গালে
স্বামী নাই সুখ নাই সম্মুখে আন্ধার
কোন খানে যাবেকন্যা সব ছারখার
জোয়ারের নদী যেন নারীর যৌবন
অসময়ে ভাটি কেবা দেখছ কখন?
মন দিয়া শুন সবে পরে কী ঘটিল
নারিকেল গাছে আসি কে তবে বসিল?
গাছে কেহ বসে নাই, প্যাঁচা দেখি এক
প্যাঁচার উপরে কেবা দেখহ বারেক।
প্যাঁচার উপরে বসি হাসিছেন যিনি
তিনি জগন্মাতা লক্ষ্মী নারায়ণী।
বাসনারে দেখি তাঁর দয়া উপজিল
মানবীর লাগি দেবী অশ্রু নিষ্কাষিল
বাহনেরে কন দেবী চল মোর বাছা
প্যাঁচাও সেই ক্ষণে ছাড়ে নারিকেল গাছা
এ-বন ও-বন ছাড়ি যান অন্য বনে
কাহারে খুঁজেন দেবী ব্যাকুলিত মনে?
এক বন আলো করি আছেন বনদেবী
সিংহ ব্যাঘ্র থাকে তথা তাঁর পদসেবী
সেই বনে আসিলেন লক্ষ্মী নারায়ণী
বনদেবী তাঁকে কন এসো গো ভগিনী
বৈকুণ্ঠ ছাড়িয়া কেন এলে এই বনে
কহ সব ত্বরা করি অতীব যতনে।
জগন্মাতা কন তারে, শুন মন দিয়া
এক গ্রাম আছে হোথা নাজনেখালিয়া
সেথা এক বালা কান্দে আছাড়ি পিছাড়ি
নদী কান্দে বন কান্দে আমি ছার নারী
তার পতি হরি নিলে তুমি কোন দোষে?
সবিস্তারে তাহা তুমি বুঝাও বিশেষে।
হাসি কন বনদেবী, সে মনোরঞ্জন
বাসনার পতি সে যে জীবনের ধন
পরীক্ষার লাগি তারে রেখেছি লুকায়ে
যথাকালে দিব তারে স্বস্থানে ফিরায়ে
বছর পুরালে মেয়ে থাকে যদি সতী
অবশ্যই পাইবে সে গুণবান পতি
খাঁটি সতী হয় যদি তার কোন ভয়
সময়ে জীনে স্বামী আসিবে নিশ্চয়।
এই দ্যাখো হাড় মাস, এই দ্যাখো খুলি
এই দ্যাখো মাখিলাম মন্ত্রমাখা ধুলি..
তারপর কী কহিব আশ্চর্য ব্যাপার
চক্ষের নিমেষে হল জীবন উদ্ধার
মাটি থেকে লাফ দেয় সে মনোরঞ্জন
হাতে ঢাল-তরোয়াল বাজিছে ঝন ঝন
লাফ দিয়ে তিন বন চার নদীতীর
পার হয়ে এল চলি সেই মহাবীর
সর্বঅঙ্গ দিয়ে তার বাহিরার জ্যোতি
বাসনার কাছে আসে তার প্রাণপতি
গলায় হিরার হার সর্ব অঙ্গে সোনা
সতীত্বের গুণে হল এমনই বাসনা
বাতাসে ফুৎকার দিল দুই জন মিলে
নতুন অরূপ রাজ্য ফুটিল নিখিলে
তারপর কী কহিব, জয় জয় জয়।
জয় জয় বলো, জয় জয় বলো…
(এই উপন্যাসের সমস্ত ঘটনা ও চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কোথাও কেউ কোনও মিল দেখতে পেলে তা সম্পূর্ণ আকস্মিক হলে গণ্য করতে হবে। –লেখক)